সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

টিনটিন ন্যু

অনেক দিন আগের কথা। তখন বিয়ে করিনি। রাজধানীর পাশে অজো এক পাড়া গাঁও, নাম গাওয়াইর। এই গ্রামে ছিমছাম নিরিবিলি এক বাড়িতে আমি একা থাকি। সেদিন ছিলো হিমেল শীতের রাত্রি। শৈত্য প্রবাহও ছিলো। ইউনিভার্সিটির হলে বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়ে রাত নয়টার দিকে বাসায় চলে আসি। আমি যখন আসি, দেখি আশেপাশের দুই একটি বাড়িতে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে। দূরে বড়ো রাস্তায় গাড়ি হর্ণ বাজিয়ে চলে যাচ্ছে টংগীর দিকে। পুরো জনপদ নিরব তখন। আমি ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকি। সারা রুমময় অন্ধকার। বালিশের নীচে দিয়াশিলাই খুঁজতে থাকি। হঠাৎ রুমের ভিতরে আলো জ্বলে ওঠে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি একটি তিব্বতি ঘরানার মেয়ে। হাতে তার মাটির প্রদীপ। সলতেতে আলো জ্বলছে। ও বলে - 'তুমি ভয় পেওনা। আমার নাম টিনটিন ন্যু। আমি দূর পাহাড়ের একটি মেয়ে। আমি এ্যাঞ্জেল হয়ে রাতবিরাতে এমনিতেই ঘুরে বেড়াই। তুমি একা থাকো। আমি দূর হতে তা দেখতাম। তোমার জন্য আমার মায়া হয়। এই নাও, এই প্রদীপ খানি হাতে ধরো।'  আমি টিনটিন ন্যুর হাত থেকে প্রদীপটি হাতে নেই। এবার সে বলে, 'তুমি চোখ বন্ধ করো। ' আমি দুই চোখ বন্ধ করি। তারপর আর কোনো কথা নেই। নিঝুম নিরবতা। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে দেখি - টিনটিন ন্যু নেই। হাতে আমার প্রদীপ জ্বলছে।

আর একদিন এইরকমই রাত নয়টার দিকে বাড়ীতে ফিরি। ফেরার পথে আজিজের হোটেলে খেতে যাই । ইতালিয়ান টাইপের হোটেল। ভাত শেষ হয়ে গেছে। আজিজ মিয়া বলে - ' শীতের রাইত। কাস্টমার আইসেনা স্যার। তাই অল্প স্বল্প রানদি। সব শ্যাষ অইয়া গ্যাছে।' আমি অভূক্ত থেকেই ঘরে এসে লেপ মুড়ে দিয়ে সেদিনের মতো শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাই। কার যেনো হাতের ছোঁয়ায় আমার তন্দ্রা ভেঙ্গে যায়। পাশ ফিরে দেখি, টিনটিন ন্যু আমার শিয়রে বসে আছে। পাখির পালকের মতো নরম আঙ্গুলের ছোঁয়ায় আমার মাথার চুল বিলিয়ে দিচ্ছে। কাঠের টেবিলে ল্যাম্প জ্বলছে। এই বাতিটি আমি নিভে দিয়েছিলাম শোবার সময়ে। টিনটিন ন্যু বলছিলো - আমি দেখেছি তুমি না খেয়ে শুয়ে পড়েছো। আমি জানি, কিছু না খেলে তোমার ঘুম আসেনা।  তোমার জন্য তাই আমি হাজীর বিরিয়ানি কিনে নিয়ে এসেছি। ওঠো তুমি। খেয়ে নাও। ' আমি ওকেও খেতে বললাম কিন্তু খেলোনা সে। আমাকে যত্ন করে খাওয়ায়ে দিয়ে বললো -- 'এবার তুমি শুয়ে পড়ো। আমি মাথার চুল বুলিয়ে দেই। ' সকালে ষখন ঘুম ভাঙ্গে, দেখি, টিনটিন ন্যু নেই।

তখন কলাবাগানে আমার অফিস। একদিন ছুটির পরে অফিস থেকে হেটে হেটে গ্রীনরোড আসতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আমি ভিজে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে একটি মেয়ে এসে আমার মাথায় তার ছাতাটি মেলে ধরে। মেয়েটিকে আমি চিনতে পারছিলাম না। একই ছাতার নিচে হাটতে হাটতে আমরা ফার্মগেট পর্যন্ত চলে আসি। ততোক্ষণে বৃষ্টি ছেড়ে যায়। এবং মেয়েটি অন্য দিকে চলে যায়। বাসায় আসতে আসতে সেদিনও নয়টা বেজে গিয়েছিল। বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখি, আমার ঘরে বাতি জ্বলছে। রুমে ঢুকেই দেখি টিনটিন ন্যু আমার বিছানায় বসে আছে। পরনে তার পরীর মতো সাদা কারুকাজময় ঘাঘরা। চুল সাদা ফিতা দিয়ে বাঁধা। খোঁপায় আর গলায় বেলী ফুলের মালা। ও খুব অভিমান করে বলছিলো -- ' তোমাকে ছাতা মাথায় ধরে নিয়ে এলাম, আর তুমি কিনা আমাকে চিনতে পারলেনা।'

টিনটিন ন্যু বলছিলো - 'তুমি আমার হাত ধরো। চোখ বন্ধ করো।' আমি তাই করলাম। তারপর ও বললো -- এবার চোখ খোলো।  আমি  চোখ খুলে দেখি, সে এক শুভ্র আকাশ বাড়ি। ধবল মেঘরাশি তুলোর মতো চতুর্দিকে উড়ছে। পরম আবেশে দু'হাত দিয়ে টিনটিন ন্যু আমাকে জড়িয়ে ধরে। ও বলছিলো তখন - 'গানের মতো এ রাত, প্রাণের মতো এ ক্ষণ।'  এক অদ্ভূত মেঘে মেঘে আমরা ঢেকে যাচ্ছিলাম দু 'জন। আমার দুই চোখ মুদে ঘুম পাচ্ছিলো খুব এবং মেঘের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাই। যখন ঘুম ভাঙ্গে, দেখি টিনটিন ন্যু নেই।

কখনো সন্ধ্যারাতে, কখনো মাঝরাতে, কখনো বৃষ্টিমূখর বর্ষার রাতে টিনটিন ন্যু আমার ঘরে চলে আসতো। কি এক মোহ আমাকে পেয়ে বসলো আমি নিজেই স্বপ্নাবিষ্ঠ হয়ে অপেক্ষা করতাম ওর জন্য। আমি কোনো দিন কোথাও আর রাত কাটাতাম না। সন্ধ্যার মধ্যেই ঘরে ফিরে আসতাম, অপেক্ষা করতাম টিনটিন ন্যু 'র জন্য। যেদিন ও আসতোনা, সেদিন সারারাত আমার চোখে ঘুম আসতোনা। এক জাদুর মায়ায় টিনটিন ন্যু 'র সাথে আমি আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে যাই।

বাড়ি থেকে খবর আসতো বাড়ি যাবার জন্য। কিন্তু আমি যেতাম না। যেতে মন চাইতো না। জীবনের প্রতি, জগৎ সংসারের প্রতি কেমন উদাসীনতা চলে আসে। কাছের মানুষগুলোর সাথেও ভালোমতো কথা বলতে ইচ্ছা করতো না। সব সময় একটি ঘোরের মাঝে থাকতাম। কিন্তু বাড়ি থেকে আমার এই উদাসীনতা বুঝতে পেরে আমাকে বিবাহ করানোর জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠে এবং বিয়ে ঠিক করে ফেলে।

যেদিন আমার গায়ে হলুদ হবে তার আগের রাতের কথা। সম্ভবত পঞ্চমীর চাঁদের রাত হবে সেদিন। সন্ধ্যার চাঁদ সন্ধ্যা রাতেই ডুবে গেছে। ঘরের চারদিকে আঁধার। আজ আমি নিজেই সন্ধ্যা প্রদীপখানি ঘরে জ্বালালাম। অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে পথের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হলো আজকের আকাশে কোনো তারা নেই। উত্তরের বাতাস থেকে কোনো সুর আসছেনা। মৃদুমন্দ বাতাসেই বাঁশ ঝাঁড় থেকে মর্মর ধ্বনীতে মরা পাতাগুলি ঘরের চালের উপর ঝরে পড়ছিলো।

রাত তখন অনেক হয়েছে । আধো ঘুম চোখে দেখতে পাই টিনটিন ন্যু চলে এসেছে। ওর পরনে পাহাড়ি পিরান। গালে তার চন্দন মাখা। গলায় বৈচী ফুলের মালা। এই মেয়েটিকে দেখেছিলাম কবে বান্দরবনের পাহাড়ি পথে পথে। উপত্যকার ঢালে অচ্ছূত ফুল হয়ে ফুটে আছে। সেকি কোনো স্বপ্ন দেখার কেউ ছিলো?  টিনটিন ন্যু আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ফুপরে ফুপরে কাঁদতে থাকে । কোনো কথাই আর সে রাতে বললোনা। নিরবে ঘর হতে সে বেরিয়ে যায়। অন্ধকারে হেটে হেটে পথের মাঝেই সে মিলিয়ে গেলো।

তারপর টিনটিন ন্যু কোনো রাতেই আর আমার কাছে আসে নাই। আমি আমার মায়াবতী বউটিকে নিয়ে বেশ সুখেই আছি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন