রবিবার, ৩০ মে, ২০২১

এক রাজকন্যার গল্প

এক রাজকন্যার গল্প /

আমার মেয়ে আমার হাত পায়ের নোখগুলো নেইল কাটার দিয়ে কেটে দিতে দিতে বলেছিল-

'কাল আমার বিয়ে। কাল আমাকে শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হবে। আমার যাবার সময় তুমি একটুও কাঁদবে না। তুমি কাঁদলে আমি কিন্তু হাউমাউ করে কেঁদে ফেলব। আমি তখন আর শ্বশুর বাড়িতেই যাব না।'

আমি মাথা নেড়ে বলছিলাম -- না মা, আমি কাঁদব না একটুও। তুমি দেখে নিও।

বিয়ের দিন সানাই বাজল। বর আসল। বর যাত্রীরা এল। কত হৈহুল্লর হলো। কত আনন্দ, কত রকম খাওয়া দাওয়া হলো। কোথাও কোনো দুঃখের লেশ নেই। চারিদিকে কেবল হাসি রাশি। কোথাও কোনো ক্রন্দন ধ্বনি নেই।

যথারীতি মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় হলো। বিদায়কালীন আমার মুখে কোনো বেদনার ছায়াপাত পড়ল না। চোখে মুখে আনন্দময় হাসি। আমার হাসি মুখ দেখে মেয়েও তার মুখখানিতে হাসি মেখে রেখেছে। কোনো কান্না নেই। চোখ থেকে একবিন্দু অশ্রুও ঝরে পড়ল না। আগত অতিথিদের কেউ কেউ সমালোচনা করে বলল - কেমন বাবা মেয়ে! কারোর চোখে জল নেই।

মেয়েকে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে ঘরে চলে আসি। আর মেয়েও হাসি মুখে ওর শ্বশুর বাড়ি চলে গেল।

বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছি। কেমন নিঝুম সারা ঘরময়। মুহূর্ত পরেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে মেয়ের কিছু কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। যে কথাগুলো গত চার পাঁচ দিন ধরে আমাকে বলে এসেছে। আমি খুব কানের কাছে থেকে ওর এই কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম --

' বাবা, তুমি ঔষধগুলো সময়মতো খাবে। ভুলে যাবে না। কখন কোন্ ঔষধ খাবে আমি কাগজে সব লিখে রেখেছি। সাজিয়ে রেখেছিও ঐ ভাবেই৷'

' মশারী টানাতে ভুলবে না। আমি সুন্দর করে মশারী টানানোর ব্যবস্থা করে রেখেছি। '

' সুমীর মাকে বলে গেছি, উনি তোমাকে গোসলের পানি গরম করে দেবে। কখনও ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করবে না।'

' তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল ভালো করে মুছবে। ভেজা চুল আঁচড়িবে না।'

' বেশি রাত জাগবে না কখনও, সময় মতো ঘুমিয়ে পড়বে।'

' ট্রাঙ্ক খুলে পুরনো এ্যালবাম বের করে মা'র ছবি একাকী বসে দেখে দেখে কাঁদবে না।'

' ময়লা কাপড়গুলো বালতিতে রেখে দিও। সুমীর মাকে বলে গেছি -- দুতিন দিন পর পর সে পরিষ্কার করে রেখে যাবে। '

' খাওয়া নিয়ে অনিহা করবে না। সময়মতো খেয়ে নেবে।'

' এক দুটো সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দিলাম। এর বেশি একটিও খাবে না। '

'আমি মাঝে মাঝে এসে তোমাকে দেখে যাব। তুমি কোনো অনিয়ম করেছ কী না, অনিয়ম করলে আমি কিন্তু তোমাকে দেখলেই ধরতে পারব।'

' হাত পায়ের নখ বড়ো হয়ে গেলে আমিই এসে কেটে দিয়ে যাব। তুমি কাটতে যেও না।'

' আর... পানি খেতে ভুলো না। শিয়রে জগের ভিতর পানি ভরে রাখবে সবসময়। '

' আমি যা বলে যাচ্ছি, সেই সব কথা মনে রাখবে এবং পালন করবে। আমার মাথা ছুঁয়ে তুমি দিব্বি দাও, বলো -- শুনবে সব কথা।'

এই রকম ওর আরও অনেক কথা শূন্য এই কক্ষের ভিতর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। দেখলাম -- আমার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বালিশ ভিজে যাচ্ছে।

মেয়েটা আমার হারানো মা এবং স্ত্রীর শূন্যতা কখনো বুঝতে দেয়নি একটুও। আজ যেন মনে হচ্ছে -- ঐ দুজনসহ তিনজনকে আমি হারিয়ে ফেললাম।

এই পৃথিবীতে মেয়েরা বাবার কাছে রাজকন্যার মতো, আর বাবাও যেন মেয়ের কাছে রাজার মতো বেশ থাকে। পৃথিবীর কোনো রাজাই রাজ্য হারিয়ে মনে হয় কাঁদে না, কিন্তু রাজকন্যা হারিয়ে কাঁদে।

এই যেমন আমি কাঁদছি।

~  কোয়েল তালুকদার