সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৩

আলোগুলো জ্বালিয়ে দাও ( মুক্তগদ্য কবিতাগ্রন্থ )

আলোগুলো জ্বালিয়ে দাও ( মুক্তগদ্য কবিতাগ্রন্থ )

প্রকাশকাল - ফেব্রুয়ারি' ২০২৪ ইং

উৎসর্গ -
আমার দাদাজান ও দাদীমা কে।
যাদের আমি চোখে দেখিনি কিন্তু তাদের আশীর্বাদ আমার উপর আছে।

১. মাধুরী

মাধবী নামটির সাথে মাধুরী জড়ানো আছে। একদিন মাধবী বলেছিল, পৃথিবীতে দুটো জিনিসেই মাধুরী আছে-

এক. বাগদাদের ফুল, আর দ্বিতীয়- রাজস্থানের মীরা বাঈ-এর গান। আমি এর কোনোটাই নই। তাই আমার ভিতরে কোনো মাধুরী খুঁজো না।



২. অনুজ্জ্বল তারা


তোমার কখনও মনখারাপ হয় ? মনখারাপ খুব ভালো। কান্নাও ভালো। চোখের জল চোখ পরিস্কার করে। অশ্রু শুকিয়ে ফেলো না যেন।

আমাকে যেতে হবে এবার, একটি নির্জন বাবলাফুলতলা দিয়ে, ধনিদহ বিল পার হয়ে ফাঁকা মাঠের উপর বটতলা ছাড়িয়ে অনেক দূর...ওই যে নদীর ঘাট দেখছ, ওইখানে আমার জন্য ছোট একটি খেয়ানৌকা বাঁধা আছে।

তোমার মাথার উপর পড়বে অনন্ত আকাশের ছায়া।
আমি সেই আকাশেই থাকব একটি অনুজ্জ্বল তারা হয়ে। আর তুমি থাকবে জগতের যত আনন্দের ভিতর।


৩. একবার সাধ হয়


আর একবার জন্ম নিতে সাধ হয়।
স্কুল ফেরা পথে ধুধু প্রান্তরে সেই আমগাছটির জন্য । তার শীতল ছায়ার জন্য। গাব ফুল কুড়ানো আকুল করা ভোরের জন্য। বর্ষার পাট শুকানো গন্ধের দুপুরের জন্য।

জন্ম কী হবে আবার!
শুধু আর একবার...


৪. একা


আমি সবার হতে পারি, পূর্ণ সূর্যকিরণের মতো আলো ছড়িয়ে দিতে পারি । কিন্তু কেউ-ই আমার হতে পারে না। দিনশেষে এই আমি মৌন সন্ধ্যার মতো একা।


৫. শূন্যতা


কেউ কাছে চলে আসে কেউ দূরে চলে যায়। যে চলে যায় তার পায়ের চিহ্ন পড়ে থাকে। পাখি উড়ে চলে গেলে যেমন পড়ে থাকে দু'একটা পালক। আলনায় এলমেল হয়ে থাকে কিছু পরিধেয় কাপড় । রান্না ঘরে চুলার ধূয়া উড়তে থাকে কিছুক্ষণ, কথার প্রতিধ্বনিও মিলিয়ে যায়।

আর শূন্যতা? যে নতুন করে এলো -- সেই ভরিয়ে দেয়।


৬. চেনা অচেনা


জীবনের দৃষ্টিপাত একজায়গায় কেন? কত গান আছে জীবনের। আরো কত স্পন্দন আছে হৃদয়ে এবং আত্মায়। সেসবও কিছু শুনতে হয়।

খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। মনে হয় সারাজীবন ছুঁয়ে থাকি। জীবনের পরেও।

এই পৃথিবীতে অনেক ভালো মানুষ আছে। তাদের চিনে নিতে হয়। তাদের ধরে রাখতে জানতে হয় যত্ন করে।

এই হাওয়ার রাতে কত হাসনাহেনার গন্ধ ভাসে। কত মনখারাপের কথা লুকিয়ে থাকে অন্ধকারে! কেউ কেউ গল্পের বই নিয়ে বিছানায় শোয়, আর কেউ কেউ জীবনের শেষ পাতা লিখতে বসে যত্ন করে....


৭. নিঃসঙ্গ আকাশ


কবিতার মধ্যে তুমি লুকিয়ে থাকো, সামনে আসতে পারো না দুরন্ত সাহস নিয়ে। ভাঙ্গতে পারো না, অচলায়তন, অবাধ্য হতে পারো না নিষিদ্ধ নিষেধাজ্ঞার। তোমার এলমেল চুল বাতাসে উড়ে, চোখ দুটো মেলে থাকে, তপ্ত দুপুরে পথিকহীন উড়োখুরো পথের ধুলোয়। যেখানে কোনও বসন্ত সন্ধ্যা বেলায় ভুল করে আমি কখনই হাঁটিনি।

আমাকে টানে মধ‍্যরাত্রির উতলা হাওয়া, নক্ষত্রহীন নিঃসঙ্গ আকাশ। আমি গাঢ় অন্ধকারের ভিতর তোমাকে খুঁজি। স্বপ্নহীন ঘুমে তখন তুমি ঘুমিয়ে থাকো। আমার কবিতার শব্দে তোমার ঘুম ভাঙ্গে না। কী উষ্ণতা চাও, আমার কবিতার কাছে। আমি সমর্পণের জন্য সারারত্রি জেগে থাকি।

শুধু তোমার জন্য আমি কবিতার কাছে দেউলিয়া হয়েছি। ভুল করে কবিতা নির্মাণ করেছি এক রাখাল বাঁশির উদাসীন দুপুরে। কবিতার সারা অঙ্গে পরিয়েছি অর্থহীন উপমা উৎপ্রেক্ষা। ক্ষরণ করেছি রক্ত কবিতার দেহে, তোমার আত্মায়। আমি যশ চাইনি। আমি কবি হতে চাইনি। আমি কবিতায় তোমাকে চেয়েছি।

এই গাঙে, এই জল ভূমিতে কত বান এল, বিবর্ণ এই গিরি উদ‍্যানে কত অগ্নুৎপাত হলো। শুধু তোমার জন্য আমি অথৈ জলে ভাসতে চেয়েছি, দহন দাহে আমাকে পুড়ে ছারখার করতে চেয়েছি। তবুও কিছু পাওয়া হলো না, না কবিতাকে, না তোমাকে।


৮. আমার মৃত্যু দ্রষ্টব্য


আমার দায়ভার যখন শেষ হবে, তখন অপেক্ষাই বা কেন করব? সেই উদ্দাম, আনন্দময় জীবন যদি আর নাই থাকে, অক্ষম আর বোঝা হয়ে থাকা এই সুন্দর পৃথিবীর কাছে গ্লানিকর। সব সু্ন্দর শেষ হবার সন্ধিক্ষণেই ঘরের জানালা দরজা সব খুলে রাখতে চাই। আত্মার প্রস্থানের সাথে মানুষের সকল দুঃখের নাকি পরিসমাপ্তি ঘটে। পৃথিবী থেকে চলে যাবার আনন্দটাই তখন অন্যরকম হয় ।


৯. পরিপাটি


তুমি সুন্দর করে ঘর দুয়ার গোছাও, ঝকঝকে রাখো ঘরের মেঝে। পরিপাটি রাখো আলনা। বারান্দায় ঝুল পড়েনা। আসবাবপত্রে জমে না ধূলো। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি না থাকলে তুমি এমনি করেই কি ঘরদুয়ার গোছাবে ? ফুলদানিতে সাজাবে ফুল ? কিংবা জ্বালাবে সন্ধ্যা বাতি ঠিক আগের মতো করেই ?

আঙ্গিনার ধূলোবালি মুছতে যেয়ে আমার পায়ের চিহ্নগুলিও একদিন মুছে ফেলবে। আমার জন্যে কে্ঁদে থাকা তোমার চোখের অশ্রুবি্ন্দুগুলিও একদিন শুকিয়ে যাবে, মুখে ভাসবে হয়তো তখন তোমার করুণ কোনো হাসি।


১০. এই জীবন


ঘর হতে বেরিয়ে আলোতে এসে দাঁড়াই। বাইরে এত আলোর ছ্বটা। ঝলমল করছে বৃক্ষরাজি, অ্ট্টালিকা, পশু, পাখী, পাহাড়, নদী, সাগর। মনে হচ্ছে এই আলো মেখে পরিপূর্ণ করি জীবন। আমাদের স্বপ্ন দেখা শেষ হয় নাই, জীবন পরিপূর্ণ হয় নাই। আমার সাথে তো একজন সাথী আছে, সে এখনও আমার হাত ধরে আছে। যে আলো আজ দেখছি সে আলোয় দু'জনে মিলে পথ চলে যেতে পারব অনেক দূর। জীবন কোথাও শেষ করতে চাই না। পথ চলাও না। এই জীবন, 'এই পথ চলা যেন কোনো দিন শেষ না হয়।'


১১. নিকষিত হেম


সৃষ্টিকর্তা পরম যত্ন সহকারে আমাকে অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য একটি জীবন দিয়েছে। সেই জীবনে তুমিই আমার একমাত্র সহচরী হলে। যার এলমেল চুলে মুখ লুকিয়ে নিঃশ্বাস নেই প্রাণ ভরে। যার বুকের পাঁজরে লেগে থাকে মহাকালের যত সুখ দুঃখ। আমি তার কাছ থেকেই চলে যেতে চাই জীবন নদীর ওপারে -- তাকেই ভালো বাসতে বাসতে।


১২. কবিতার সাথে কথা


কখনও যদি নিজেকে খুব একা লাগে, যদি তোমার কাছে কেউ না থাকে, যদি নিঃসঙ্গতার ধূপ আগুনে পুড়তে থাকো সারাক্ষণ । তবে তুমি লেখার কাছে চলে যেও। তখন তুমি কবিতার সাথে কথা বলো , গল্পের সাথে গল্প করো।


১৩. খোঁজ


খুব ইচ্ছা করে আবার একদিন কুসুমপুরে যেতে। যেখানে সন্ধ্যা রাত্রিতে অলকানন্দার ঝোপে জ্বলে জোনাকির নীল আলো। আম্র মুকুলের গন্ধে আকুল হয়ে ওঠে প্রাঙ্গণ।

তারা ভরা আকাশের নীচে লুকাবে তুমি।
চোখ থেকে চোখে, বুক থেকে বুকে ভালোবাসায় খুঁজে নিব তোমাকে।


১৪. ঝিনুকে মুক্তা খুঁজি


আজ বিকালে সান্তা মনিকা সাগর বেলায় গিয়েছিলাম। একাকীই গিয়েছিলাম। সাথে আর কেউ না। হুমায়ূন আহমেদ কোথায় যেন বলেছিল, সাগরে একা যেতে হয় না। দুজন যেতে হয়। আমি তো এখানে একা। আর কেউ নেই। যে আছে, সে তো প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারে। সেখানে তার কাছে বঙ্গোপসাগরও নেই। কাছেই বয়ে গেছে শীর্ণ তুরাগ নদী। সেখানেই হয়ত হাঁটছে সে এলমেল পা ফেলে বিষণ্নতায়।

প্রিয় তুমি, যেখান থেকে লিখছি, সেখান থেকে সমুদ্রকে খুব সুন্দর, খুব মিষ্টি ও আপন মনে হয়। কাছে গেলে অনুভব হয়, কত যে ভালোলাগা অতলান্ত জল জুড়ে। কাছাকাছি থাকলে উন্মোচিত হয় এর আসল সৌন্দর্য। দূর থেকে 'নোনতা'ভাব বোঝা যায় না। জীবনের স্বাদও খানিকটা এমনই।

তোমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য কত ঝিনুকে মুক্তা খুঁজেছি। তোমাকে দেখবার জন‍্য চেয়ে থেকেছি দূরের রূপালি ঢেউয়ের নীচে। লিখেছি নাম বালুকাবেলায়। স্বপ্ন বুঁনতে থাকা মন হয়ে উঠেছে দিশেহারা। কিন্তু তোমার দেখা মেলেনি কোথাও। অথচ তুমিই হৃদয়ে বাসা বেঁধে রেখেছ চিরকালের। অন‍্য আর চাওয়া-পাওয়া নেই। অন‍্য আর কেউ নেই। যেখানে আর কোনো কাঁটালতার ঝাড় বাসা বাঁধতে পারেনি


১৫. দেখা হয় নাই


জীবনের কত অফুরন্ত ভালোবাসা এখনও পাওয়া হয়নি, এখনও হাঁটা হয়নি হেমন্তের শিশির ভেজা দূর্বাঘাসের পথে, এখনও শোনা হয়নি কোজাগরী পূর্ণিমা রাতের গান, বোষ্টুমিদের কীর্তন। এখনও দেখা হয়নি চন্দ্রাহত কোনও প্রেয়সীর জীবনের সুখ দুঃখের আলেখ্য চিত্র ।
এই সব আকুলতাগুলো আছে দেখেই এখনও পৃথিবীর পথে পথে ঘুড়ে বেড়াই।


১৬. নীল নীল- নীল আকাশ


দিনের বেলায় অনেকটা অসময়ে ঘুমিয়ে যাই। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি ছেলেবেলার। সাবানের ফেনায় ফু্ঁ দিয়ে শত শত বেলুন উড়িয়ে দিচ্ছি আকাশের দিকে। উড়ে যাওয়া বেলুন দেখতে দেখতে --- ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে শুনতে পাই ঘরের কার্নিশে বসে একটি কাক কা-কা করে ডাকছে। ডাকটা কর্কশ মনে হলো না। ও তো পাখি। এটি ওর কথা। কান্নাও হতে পারে।

খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাই। নীল মেঘে ঢাকা নীল আকাশ দেখতে পাই। আহা ! পাখি কিংবা মেঘ হয়ে যদি উড়ে যেতে পারতাম। মনে মনে ভাবি --- আকাশের ঐ নীল মেঘ হয়ে থাকা অনেক ভালো ! নীল মেঘেই যেন জীবনের সৌন্দর্যগুলি লুকিয়ে আছে !


১৭. একটি অসম্পূর্ণ কবিতা


যখন এই পৃথিবীকে ভালো লাগছিল না আর, যখন চলে যেতে ইচ্ছা করছিল পৃথিবী ছেড়ে। ঠিক তখনই তোমার দেখা পেলাম। আর তখনই কী না আমার চলে যাবার সময় হলো।

আমি চলে গেলে পড়ে রইবে আমার ছায়া। তখন বাজাবে না বাঁশি,
গাইবে না কেউ কোনও গান নাগিনী সুরে ! তখন আমার স্বপ্নগুলো তুমি দেখে নিও তোমার স্বপ্নের ভিতর।


১৮. সুবাস ছড়িয়ে দাও


হিমালয় থেকে শৈত্য প্রবাহ আসছে। শীতের রৌদ্রে যতটুকু উত্তাপ পাও, তাই দিয়ে উষ্ণতা দাও। যদি কোথাও চন্দ্রমল্লিকা ফুটে থাকে, যদি কোনও চম্পাবকুল গন্ধ বিলিয়ে যায় --- তাই দিয়ে দয়িতের দেহ মনে সুবাস ছড়িয়ে দাও।

দেখতে পাবে কেমন করে মাতাল হয় হিম বাতাস। কেমন করে উতলা হয় প্রাণসখার দেহ মন।


১৯. আলোর অপেক্ষায়


রাতের নির্জনতার মধ্যেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। এখনও সকাল হওয়ার বাকি। চোখ বন্ধ করে রাতের শব্দ শুনছি। চারিদিকের অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছে, যেন গ্রাস করছে আমার সমস্ত সত্ত্বাকে। বুকের ওপর দুটো হাত রেখে চেষ্টা করি চোখ খুলতে, তখনই চোখ চলে যায় জানালার ওপারে আকাশের দিকে। একঝাঁক তারা সেখানে মিটমিট করে জ্বলছে। তারাদের আলোতে অন্ধকার কিছুটা কেটে আসে। এখন শুধু অপেক্ষা, এই রাত শেষ হওয়ার, অপেক্ষা করছি ভোরের আলোর জন্য!


২০. সাঁতার


আজ রুপালি সমুূ্দ্রে সাঁতার কাটলাম। ঝলাৎ ঝলাৎ ঢেউয়ের শব্দ। ভেঙ্গে পড়ছিল দুপাড়। এত ভাঙ্গন আর এত উথাল পাথাল ! সে এক অবিস্মরণীয় জলপতনের খেলা।


২১. পরিভ্রমণ


দুহাতে খু্ঁজেছিলাম পাহাড়ের চূড়া। ঠিক উঠতে উঠতে। আবার নামতে নামতে। দেখি মনিমুক্তা খচিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। একবার চূড়োয়। একবার তার পাদদেশে। একবার হিমাদ্রিতে। কী যে আনন্দময় পরিভ্রমণ ছিল !


২২. একাকীত্ব


যে ছেড়ে চলে যায়, সে জানে সে চলে যাবে। তাই সে প্রস্তুতি নেয় আগে থেকেই। তার ভিতর কোনও আক্ষেপ থাকে না। বিদায়কালীন সময়ে চোখ থেকে একবিন্দু জলও ঝরে না।

কিন্তু যাকে ছেড়ে গেল সেই জানে হঠাৎ এই শূন্যতার হাহাকার কী? সেই প্রাণপাত করে। সেই জলশূন্য নদীর মাছের মতো ছটফট করে....


২২. এসো মহুয়া বনে


ভৈরবী রাগের যে গানটি আমি লিখলাম, সেই গানে তোমার কথা লেখা আছে। 
তোমার প্রাণে যে অনুরাগ 
আমার গানে যে সুর,
তা আজ তোমার চরণধ্বনি হয়ে বাজছে। 
এখন শুধু গানের মুহূর্ত। এখন শুধু গান শোনাবার কাল। এসো, শিশির তলে। এসো, মহুয়া বনে। গান শোনাব আজ।


২৩.       ভালোবাসা


ভালোবাসার প্রথম পা‌ঠ নিয়েছিলাম কোনও নদীর কাছে, খোলা আকাশের নীচে, মূর্তে-বিমূর্তে, গ্রীষ্মের প্রখর দীপ্তিতে, বর্ষার ধারায়, শীতের উষ্ণতায়, প্রাণখোলা বসন্তবাতাসে, শরতের ঔদার্যে, হেমন্তের পেলবতায়, সৌন্দর্যে আর বীভৎসতায়, উৎস আর মোহনায়, নগ্নতায় এবং আড়ালে, ধূসর সাম্রাজ্যে নিষিদ্ধ সেই সব শব্দগুলির সাথে তোমার নামটিই জড়িয়ে আছে।


২৪.        বেলা শেষের কথা 


জীবনের অনেক আশা মেটে নাই। অনেক চাওয়া পাওয়া মিটবেও না আর এ জীবনে। কত অতৃপ্তি রয়ে গেল। তারপরও ভালো লাগে জীবনকে। মায়া করি এই পৃথিবীকে। আক্ষেপ করি না তাই কোনো অপ্রাপ্তির। অনুশোচনাও নেই কোনো গ্লানির । 

কাল তুমি বললে --- 'কোনো ঐশ্বর্য নাই পেলাম। তোমার কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, সেইটিকে যদি ঐশ্বর্য বা দৌলত মনে করি, তার পরিমান ও মূল্যও অনেক।'

আমাকে তুমি এই ভাবেই কৃতজ্ঞতায় বাঁধো ----
'আমারে তুমি অশেষ করেছ, 
এমনি লীলা তব–. 
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ 
জীবন নব নব।।'


২৫.        আমারই আনন্দ যত


বছরের শেষ কয়েকটি দিন খুব মন খারাপ করে কাটে। বেদনাহত হই এই ভেবে যে, একটি গাছ থেকে সবগুলো সবুজ পাতা ঝরে চৌচির হয়ে গেল। পিছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, একটা বছর নিতান্তই ক্ষণকাল ছিল। একটা একটা করে পাতা ঝরল, একটা একটা করে দিন চলে গেল। একটু একটু করে আয়ু ফুরিয়ে গেল। আহারে জীবন, কেমন ক্ষয়িষ্ণু তুমি!

দিন ফুরিয়ে যাওয়ার এই অবসাদ বেলায় কত কথা মনে জাগে, কত জোছনা বেলায় কত গানের কথা মনে পড়ে। কত বাউল, ভাটিয়ালি, টপ্পা, কীর্তনিয়া... এই জীবনে কোনো আশই মিটিল না। 

জীবনতৃষ্ণা বড় বেশি করে তেষ্টা পায়। কত নদীর ঘাটে কত জল তুলতে ইচ্ছা করে!

সেই কবে মেঠো পথ দিয়ে স্কুল ফেরার পথে এক পাতার বাঁশিওয়ালার বাঁশি বাজানোর সুর আজও শুনতে পাই। কত গান ছিল আকাশে ---
কত কথা ভেসে গেছে বাতাসে, কত অস্তবেলার সূর্য  ডুবে গেছে অস্তাচলে। 


২৬.     অসমাপ্ত কথোপকথন 


তখন ছিল শিশির ঝরার ক্ষণ। আযানের সুর ভেসে আসছিল। পাখিরা কলরোল তোলেনি তখনও। 
শরীরের এক মায়াবী গন্ধ পাচ্ছিলাম তার। পাশ ফিরে পাঁজরে হাত রেখে বলেছিল--
' কোথাও নিয়ে যাবে আমাকে? সন্ধ্যায় তুরাগ নদীর  তীরে ! লাল আভা ছড়ানো সূর্যাস্ত দেখতে ইচ্ছে করছে।
যদি কোথাও থেকে শীতল বাতাস আসে। যদি নিঃশেষিত অস্ত দিনের মর্মর ধ্বনি শুনতে পাই!'

বলেছিল --
'ফেরার পথে রেলপুকুর পাড়ে গফুর মামার দোকান থেকে  ফুসকা খাওয়ায়ে নিয়ে আসবে।'

সত্যি তো রাত নামবে সেখানে। নিশীথের আকাশ থেকে যদি দু-একটি তারা খসে পড়ে! যদি গল্পের তরে হয় জোনাকির আয়োজন!


২৭.      অপূর্ণতা


সারাটা জীবন একটা ঘোরের মধ্যেই কাটিয়ে দিলাম। জীবন যেন একদিন আর এক রাত্রির সমান। দিন শেষে ঘুমালাম, ঘুম ভেঙ্গে দেখি-- জীবনই শেষ। কতো স্বপ্ন ছিল, সে সব আর দেখা হলো না। সব স্বপ্নই কি এক রাত্রিতে দেখে শেষ করা যায় ? সব চাওয়া পাওয়া অপূর্ণই রয়ে গেল।


২৮.      প্রতিক্ষা 


প্রতিক্ষায় থাকি তুমি আসবে, তাই ঘরের দরজা খুলে রাখি। উঠানের কাছে এসে থেমে গেলে তুমি। মনে হলো পথ ভুল করেছ। না চিনেই চলে গেলে। তুমি না আসো।আমার দেহ এক সময় নীল হবে। নীল পাথরের দ্যূতি ছড়াবে তোমার ঘরের পথ পর্যন্ত । সে আলোয় তুমি পথ খু্ঁজে পাবে আমাকে খু্ঁজে পাবার। তখন এসে পাথরে লিখ তোমার নাম।


২৯.       অপরাজিত 


রোদ্রে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটেছি  দুজন পথে পথে। চলতে চলতে পথে ক্লান্তি আসেনি কখনও। 
এই জীবনে ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য যেমন পেয়েছি, আবার দুঃখ ও বঞ্চনাকেও ফিরিয়ে দেইনি। আমরা ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়ে জিতেছি যেমন, 
আবার হেরেছিও মানুষের ভালোবাসার কাছে।


৩০.       আমাকে ফিরিয়ে নাও


ভালোবাসাহীন পৃথিবী দেখলেই মন অস্থির হয়ে ওঠে। কেমন যেন একাকী লাগে। মনে হয় দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে কেউ নেই। সামনে সুউচ্চ পাহাড়, না হয় কোনো উদ্দাম জলরাশি। সেখানেই নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করতে চাই, তাকে বলতে চাই - তুমি আমাকে ফিরিয়ে নাও। আমার আত্মাকে তুমি গ্রহণ করো।


৩১.     ভাবনা 


যে আমাকে সারাক্ষণ ভাবে তাকে আমি একটুও ভাববো না, তাই  কি হয়? 
যে আমাকে এতখানি ভালোবাসে তাকে আমি একটুও ভালোবাসবো না, তাই  কি হয়? 
যে আমাকে এত করে মনে রাখে, তাকে আমি একটুও মনে রাখবো না, তাই কি হয়?

কেউ ভালোবাসা দিলে তার প্রতি এমনিতেই  একধরনের মায়া এসে যায়। তুমি আমাকে ভালোবাসো-- তাই তোমাকে আমি মায়া করি। 
তাই তোমাকে আমি ভালোবাসি।


৩২.      স্পন্দন যেন থেমে না যায়

চলে যেতে হবে এ কথা মনে হলেই কলম থেমে যায়, হাত পা অবশ হয়ে আসে। মন খারাপ শুরু হয়। মনে হয় তুমি থাকো পাশে। আমাকে শক্তি দাও, চেতনা দাও, প্রেরণা দাও। আমি লিখতে চাই। কবিতায় বলতে চাই- তোমাদের কথা। আমি বেঁচে থাকতে চাই, চলতে চাই পথ আরো অনেক দূর। জীবনের স্পন্দন এখনই যেন থেমে না যায়। 


৩৩.    জ্যোৎস্নার সুখদুঃখ 


যেদিন জ্যোৎস্নার রাত থাকে সেদিন কোনো দুঃখ থাকে না আমার। তুমি জ্যোৎস্না থেকে আমার দুঃখগুলো তোমার দু'হাতের আজলায় ভরে তোমারই চোখে মুখে মেখে ফেলো কিন্তু আরেক অন্ধকার রাতে সব দুঃখগুলো এসে আমার হৃদয় বেদনায় পূর্ণ করে তোলে।


 ৩৪.       পার্শ্ববর্তিনী 



যখনই নিজেকে খুব একাকী মনে হয়েছে, তখনই প্রসন্নময়ী কেউ না কেউ নীরব পদধ্বনিতে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। সে  আর কেউ নয়, সে তুমি।


৩৫.      পথের প্রান্তে


পলাতকেরা পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে এক পথিকের জন্য। চোখ আমার চেয়েই ছিল সারা বিকেল সুদূরের প্রান্তে। একদল বালক বাঁশি বাজিয়ে চলে গেল পাশ দিয়ে। সন্ধ্যা হলে পৃথিবী অন্ধকার হবে, না শিখা জ্বলে উঠবে?  বুঝতে পারছিনা কিছুই। কাল ঘরে ফেরার পথে রেল লাইনের ধারে এক পাগলির অট্টহাসি শুনে এসেছিলাম। সেই থেকে মনটা কেমন যেন থেমে থেমে যাচ্ছিল বেহালার ছেঁড়া তারের মতো। জীবনের সবকিছুই এলমেল। সবকিছুই ছন্নছাড়া।
এত বোহেমিয়ান হলে চলবে কী করে  এই বয়সে। যতই পথের উপর দাঁড়িয়ে কেউ অপেক্ষা করুক। আমার যখন সময় হবে চলে যাব, অন্ধকার থাক্ অথবা শিখা প্রজ্জ্বলিত থাকলেও।


৩৬.         পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ


ঈশ্বরকে বলব -- অনন্ত মহাকালের দু'একটি মুহূর্তের জন্য কেন আমাকে এখানে পাঠিয়েছে ? আমি মানুষের প্রেম ভালোবাসাকে ছাড়তে পারছি না। পারছি না আত্মজার মুখ মলিন করে দিয়ে কোথাও চলে যেতে। এখানে নদী আছে, নীল আকাশ আছে, পাখি আছে, দোলনচাঁপা আর চামেলী ফুলের সুবাস আছে। স্বর্গের প্রতি কোনো আসক্তি নেই। পৃথিবীর রূপ রস গন্ধের কাছেই আমি থেকে যেতে চাই।


৩৭.


এত নিঃশব্দ চরণে হেঁটে তোমার কাছে চলে আসি যে, তুমি মুখ না ফিরিয়েই বুঝতে পারো, আমি এসেছি। এত সন্তর্পণে তোমার পাশে থেকে উঠে চলে যাই যে, তুমি বুঝতে পারো, আমি চলে যাচ্ছি।

আমার শরীরের গন্ধ নাকি তোমাকে বলে দেয়, আমি আছি কী নেই।


৩৮.


বেশি করে ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে অনেক সময় অভিমান করি। অভিনয় করি। অনুযোগ করি। মুখ ঘুরিয়ে রাখি। আর তুমিও বুঝতে পারো আকাশে মেঘ হচ্ছে। বৃষ্টি নামবে। ছাতা খুঁজো তখন। ছাতাটি মাথার উপরে মেলে ধরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠো‌।

হোক না হয় বৃষ্টি। ছাতা ধরো না। রাশি রাশি জল ঝরুক। এসো ভিজে নিই। ছুঁয়ে নিই। জড়িয়ে নিই। কাছে না এলে অভিমান আরো প্রগাঢ় হবে যে। আর তোমাকে হারিয়ে ফেললে নিজের উপর অনেক অভিমান হবে যে......


৩৯.           অপার আনন্দধারায়


তুমি আমার কাছে এসেই ত্রস্ত হরিণীর মতো ছটফট করো, তাড়া করো চলে যাবার। দ্রৌপদীও এমন করে না দেবতার সাথে মিলন পর্বে। তোমার অম্লান দেহখানিি ধূসর ধূলায় মিশিয়ে দাও। আমি পেতে চাই সৃষ্টির সুখের উল্লাস। ভালোবাসার আকুলতায় কোনো কান্না রাখতে নেই। তুমি থেকে যাও এখানেই, আমার বাহু লগ্নে, এই অপার আনন্দধারায়।


৪০.      প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি 


একটুখানি চেয়ে দেখাতে সমগ্র পৃথিবীর মানচিত্রকে দেখে নেয়া যায়। 
একটুখানি ছুঁয়ে দেখাতে কারোর সারা জীবনের প্রাণ স্পন্দন অনুভব করা যায়। 

কিছু প্রাপ্তি আসে, জীবনের পরম পাওয়া হয়ে থাকে। কোনো আফসোস ব্যাতিত এই জগৎ জীবন থেকে চলে যাওয়া যায়।


৪১.       জলস্রোতের কান্না


কেমন করে তোমাকে এত ভালোবাসি। কেমন করে তোমাকে বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখি। তুমি তো ভেসে যাবে কোনো নদীর মতো জলস্রোতে একদিন। কত কথা হয়েছিল, কত স্বপ্ন দেখা হয়েছিল আমাদের চার চোখ মিলে। সব কথা, সব স্বপ্ন দেখা কী শেষ হয়ে যাবে? তুমি চলে গেলেই কী ভালোবাসার মৃত্যু হবে? জানিনা মৃত্যু কী, জানিনা বিচ্ছেদ কী? 
আমি কী তোমাকে, আমার দুঃখ বেদনাকে কুড়িয়ে এনেছিলাম কোনো মর্মরিত জীবনের উঠান থেকে বস্তুবৃক্ষের ঝরা ফুলের মতো।


৪২.       আবার যদি... 


যে জীবন চলে গেছে -- সে জীবনে হারিয়েছি অনেককে। আহা!  আবার যদি দেখা পেতাম তাদের কোনো শীষ ডাকা দোয়েল ভোরে, আমলকী ঝাড়ের পাশে কিংবা বসে আছে কেউ ছলাৎ ছলাৎ কোনো জলছবির  নদীর কূলে....


৪৩.       রহস্যময়তা


সবার জীবনেরই কিছু রহস্যময়তা আছে। আছে গোপন অলিন্দ। নিঝুম রাত্রি দুপুরে জোৎস্না এসে গায়ে লাগে সেই অলিন্দ দিয়ে। ঘুম ভেঙে গেলে বসে চেয়ে দেখে সে, বহু বছর আগের কোনো দীপ জ্বলা আলো। আবার অন্ধকারও কখনও তাকে গ্রাস করে।

না, এসব কোনো ভ্রান্তি নয়। এই সবই রহস্য। এই সবই দূর অতীতের কোনো মায়া।


৪৪.       পথসঙ্গী



ঘরের দুয়ারে বসন্তের পদধ্বনি শুনতে পাই। যে বাতাস বইবে আসন্ন বসন্ত দিনে, তা কি আমার জীবনের পূর্ণতাকে ধুলো বালিতে ঢেকে দিবে ? আমার জীবন পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে। তোমার কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তার শক্তি দিয়ে জীবনের বাকী পথ চলে যেতে পারব। আর যদি না পারি তুমি তো আছোই আমার পাশে।


৪৫.       নতুন পৃথিবী 


তুমি আমার জীবনকে জ্যোতির্ময় করেছো। সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারা আলোকিত হয়েছে। এই ব্রহ্মাণ্ডের সব পাহাড় নদী সাগর, বন্দর লোকালয়- মহাপ্রলয়ে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের দেহ আত্মা অবিনশ্বর থাকবে। আমাদের প্রেম ধ্বংসস্তুপের উপর জন্ম দেবে আর একটা গোলাপের। যে গোলাপ সৌরভ ছড়াবে নতুন আরেক পৃথিবীতে।


৪৬.        সুপ্রভাত 



জীবন কাটে না এ জীবনে আর, জীবন ভরেও না এক জীবনে। একি তৃষ্ণা আমার । একি ক্লান্তি নিয়ে বসে থাকি। অনেক কাছে থেকে দেখি অনেক দূরের আশার বিন্দু! আজ দক্ষিণের দুয়ার খোলা আছে। আসুক বাতাস আজ দক্ষিণ থেকেই।

সবাইকে সুপ্রভাত।


৪৭.       ফিরে যেতে চাই 


আমি শৈশবের কাছে  চলে যেতে চাই। যেখানে কাশবনে হাসে শরতের রোদ্র। যমুনার পাড় ধরে হাঁটব, আর হাঁটতে থাকব যতক্ষণ না রমণীর এলো চুলের মতো সন্ধ্যা নেমে না আসে। চরে ফুটে থাকা কাশফুলের ঝাড়ে শুনব ঝিঁঝি পোকাদের গান। রাতের মধ্য প্রহরে খু্ঁজব দূর আকাশে লুব্ধক, স্বাতি, অরুন্ধতী, কালপুরুষ। বালিকার বেণী বাঁধা চুলের সুবাস নেব। আর দাদীমা'র আচঁলতলায় বসে শুনব পিতামহের পু্ঁথি পাঠ ।


৪৮.         ক্ষণিকের অতিথি


চলার পথে মানুষের জীবনে কখনো কখনো হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এমন কেউ এসে পড়ে— যা মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। কেউ কেউ সেই মানুষটিকে মনে রাখে আজীবন, যা হয়তো ওই মানুষটিও কোনোদিন জানতে পারে না। এ ধরনের অনুভূতি বা সম্পর্কের নাম কী? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় হয়তোবা এরা ‘ক্ষণিকের অতিথি’। কিন্তু ক্ষণিকের অতিথি হয়েও কেউ কেউ সারাজীবন জুড়ে থাকে। যেমন  ‘বনলতা সেন’ সেই রকমই একজন অসাধারণ নারী। 

কবি তাই লিখেছিলেন :
'আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, 
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।'

সবার জীবনেই এরকম কেউ না কেউ ক্ষণিকের অতিথি আছে। বুকে হাত দিয়ে বলুন, অস্বীকার করতে পারবেন কি? বুকের তলায় খুঁজে দেখুন, এরকম অতিথি আপনার জীবনেও এসেছিল।


৪৯.       বিদর্ভ নগরীর রাজপুত্র



একদিন সন্ধ্যা রাতে রুমের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি। ভাবলাম অসময়ই একটা ঘুম দেব। কিন্তু ঘুম আর এল না। মনে হলো রুমটা যেন একটা বিদর্ভ নগরী। আমি যেন এর রাজপুত্র। বনলতা সেনের কথা খুব মনে হচ্ছিল। যদি সে আসতো রাজকুমারী হয়ে এই রাতে, যদি পাখির বাসার মতো চোখ তুলে দু'দণ্ড কথা বলতো ! সেই কবে ক্লাসে ডঃ মনিরুজ্জামান স্যার পড়িয়েছিলেন বনলতা সেন। স্যার হাসির স্থলে কৌতুক করে বলেছিল, এ এক রহস্যময়ী নারী। একে বুঝতে হলে এক জীবন লাগবে। স্যার তার এক জীবন শেষ করে পরপারে চলে গেছেন। আমারও এক জীবন শেষের দিকে। কিন্তু এই বনলতা সেনকে আজও বোঝা হলো না। যাকে বুঝতেই পারলাম না, তাকে পাব কি ভাবে !


৫০.         নিরুদ্দেশ 


আমি অনেক ঘুরেছি এই বাংলার পথে ঘাটে প্রান্তরে। কত বনবাদর, কত উপকূল, কত বালিয়ারির পথ হেঁটেছি। কত নদী, কত দীঘি, কত ঘাট দেখেছি, কিন্তু একটি ঘাটই আমাকে টানে -- সে আমাদের যমুনার ঘাট। কোনো একদিন সন্ধ্যাবেলায় এই ঘাটে দাঁড়িয়েই দূরের সোনালি মেঘের আকাশে নিরুদ্দেশ হয়ে যাব। আর কখনই ফিরে আসব না এই পৃথিবীতে।

আমার ছেলেবেলায় ধানক্ষেতের আলপথ দিয়ে, ইছামতী নদী পেরিয়ে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, কত দুপুর সন্ধ্যায় এই নদীর কূলে কাটিয়েছি। তখন ভেঁপু বাজিয়ে স্টিমার চলত। গয়না নৌকাগুলো সারি করে চলে যেত, দূরের কোনও বন্দরে। 

মনে হয় যেন, আমি আজও দূরাগত স্টিমারের ভেঁপুর শব্দ শুনতে পাই। আরো শুনতে পাই, যমুনার জলের ছলাৎ ছল শব্দ। বালুরচরে কাশবনের কাশফুল গুলো হেমন্ত হাওয়া লেগে দুলে উঠতে দেখি। আর দেখি --- সন্ধ‍্যার সোনালি মেঘের আকাশ। আর ঐ মেঘের আকাশেই যে অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছা করে।


৫১.         হেমন্ত 


হেমন্তের শীত এখনও জেঁকে আসেনি পৌষের শীতের মতো। সন্ধ্যা রাতের আঁধারও তেমন প্রগাঢ় হয়নি। বিকাল থেকে পাঁজরের নীচে তীব্র ব্যথাটি ওর ছিলনা। তবুও হাত ধরে উঠোনে নিয়ে যেয়ে নারিকেল গাছ তলায় কাঠের চেয়ারে যেয়ে দুজন বসি। আঙ্গিনায় নিয়ন বাতি জ্বালানো ছিলনা। নির্লিপ্ত চোখে আকাশ দেখছিলাম। দেখি, কোথাও চাঁদ নেই। 
রাত্রির নিভৃত আকাশও চেয়ে দেখছিল যেন আমাদের। কোনও কথা নেই। কেমন নির্জন নিরবতা। খুব বলতে ইচ্ছা করেছিল ওকে। কোনও মিনতি করেও নয়। এমনি কপালে কপাল রেখে ---

'আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমনি করে গাও গো। আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনি করে চাও গো।'


৫২.        আত্ম প্রকৃতি


আমি সবসময় উদাসীন প্রকৃতির একজন মানুষ। নিজেকে কখনো যাযাবর, কখনো স্বার্থপর, কখনো ক্রুর, কখনো পলাতক মনে হয়। আমি চিনতে পারিনা নিজেকে। কে ভালবাসে,কে বাসেনা। তাও জানিনা । জীবন কোথা থেকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। কেমন তার পথচলা, কেমন তার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, সে হিসাবও কখনো করি নাই । 

যমুনার চরে উথাল পাথাল ঢেউ খায় কাশবনের ঝাড়ে।  কেমন তার জীবনকথা, কেমন তার দিন লিপি। কেউ প্রাণ খুলে কখনো তা জানতে চায়নি।


৫৩.        ক্লান্তি 


তুমি উঠতে বসতে শুইতে আমার খুঁত ধর। নানান খুঁত ধরে তুমি চলে যেতে চাও। কিন্তু একসময় কী নিখুঁত ভাবে তুমি আমার হাতটি ধরেছিলে। 
তখন বলতে কী সুন্দর সন্ধ্যা তারা! কী ঝলমল ময়ুরাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটা, কী অপূর্ব দেখতে ঘাসফড়িং, কী মায়াবী এই হেমন্ত রাত।

এখন স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নের মনে কর। তারার আকাশে তারা খুঁজে পাও না। হাওয়ার রাতে শব্দ শুনতে পাও না। সোনালি রোদ্দুরে পথে বের হও না। গান গাও না। গল্প শোনাও না।

যে চোখ দেখত পরম বিস্ময়ে! সে চোখে আর কোনো মায়া নেই, জল নেই, ঘুম নেই। যে বুক টেনে নিত স্মিত আলিঙ্গনে, সে বুকে এখন ক্লান্তি। শান্তি নেই। আদর নেই। কাছে টানতে অনিহা। কেমন অবহেলা। অনাদর ছুঁয়ে আছে..........


৫৪.        চাওয়া পাওয়া


কখন যে চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। বুঝতে পারি না। কেউ না চেয়ে পায়। কেউ চেয়েও পায় না। আবার কেউ আছে কোনো দিন কিছু চায় না।

যারা জীবনে কারো কাছে কিছু চায় না, তাদের জন্যই মমত্ববোধটা বেশি হয়। তাদেরকে নিজে থেকে কিছু দেওয়ারও দায় হয়ে যায়। আর এই কিছু দেওয়াটা যদি কোনো অবহেলায় না দেওয়া হয়, তখনই নিজের প্রতি অপরাধবোধটি চলে আসে।

আমি কোনো অলক্ষ্যে এমনই কোনো অপরাধ করছি না তো? বুঝতে পারছি না। কিংবা আমি জ্ঞাত হয়ে কাউকে এমন বঞ্চনা কি করতে পারি? 
'আকাশের তারায় তারায় বিধাতার যে হাসিটি জ্বলে
ক্ষণজীবী জোনাকি এনেছে সেই হাসি এ ধরণীতলে। '
নজরুলের সেই গানের কথা ---

'পথে পথে ঝুরিতে
নগ্ন দিনের আলোকেতে
চাহি না তোমায় ব’ক্ষে পেতে
তুমি ঘুমের মাঝে স্বপনেতে
হৃদয়-দুয়ার খুলিও।'


৫৫.       প্রাপ্তি 



প্রত্যন্ত ভোরবেলা আদর শেষে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আর জেগে উঠে দেখবে আমার নিশ্চিন্ত মুখ। দূর থেকে ভেসে আসবে রাগ-ভৈরবীর সুর, শিউলির গন্ধ। 

এই মূহুর্তটাই তার পরম পাওয়া। এমন নিশ্চিন্ত মুখ দেখা জীবনের সেরা প্রাপ্তি। তাই তার আর কোনো গ্লানি নেই। কোনো আক্ষেপ নেই। আর কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। 

কেউ কেউ সুখ মূল্যবান ধনদৌলত প্রাপ্তির মধ্যে অনুভব করে। কেউ কেউ জীবনের সাধারণ কোনো অনুভবের মাঝেও খুঁজে পায় ।


৫৬.        আক্ষেপ 


অনেক আগে একটি ছোট্ট নীল প্রজাপতিকে ধরতে যেয়ে সে উড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর কত মহুয়া বনে তাকে খুঁজেছি। কিন্তু দেখা পাইনি। এই সামান্য বিষাদটুকু নিয়ে কোনও কবিতার চরণ হয় না। তারপরও কয়েকটি শব্দে লিখে রাখলাম, ছোট্ট সেই আক্ষেপের কথা।


৫৭.        উথলে নয়ন বারি


_ আমি নিরুদ্দেশ হয়ে চলে গেলে কী হবে?
_  দূর থেকেও তো ভালবাসা যায়।
_ অন্ধকার রাতে যাব না। চাঁদের রাতে যাব।
_ ট্রেনে উঠে বসব। ট্রেন চলতে থাকবে।
_  চলতে চলতে কোনো সন্ন্যাসীর আখরা পড়বে।
_  গেরুয়া পোশাক সব।
_ জায়গাটা অমরাবতী হতে পারে।
_  মানস সরোবরের নাম শুনেছ?
_  পাহাড় না। পর্বতমালা।
_ পর্বতগুহায় রাত কাটাব।
_ মাথার উপরে মাটি। নাকি পাথর।
_ সন্ন্যাসীদের কীর্তন শুনব।
_  মাজার কিংবা ফকিরের আখরায়ও যেতে পারি।
_  কাওয়ালি শুনব। তালে তালে মাথা নাড়ব।
_ তোমার কথা মনে পড়বে। 
_  কী বিশ্বাস হয়না?
_ আচ্ছা, মরে পড়ে থাকলে কেউ বুঝবে কেমনে। আমি কোন্ ধর্মের?
_ কী আমি যে বলছি বিশ্বাস হয়না?
_ যখন ঘুমে থাকবে, তখন যাব।
_  একটা অভিজ্ঞান ফেলে রেখে চলে যাব।
_ তখন বিশ্বাস হবে।
_  তুমি বুঝতেও পারবে না শেষ চুম্বনটি কখন, কোনটি হবে।

উপরের এই একক কথাগুলো সে শুধু শুনছিল। দেখলাম -- তার হৃদয়ের এ কুল ও কুল দু কুল ভেসে গিয়েছে। উথলে উঠেছে নয়ন বারি।


৫৮.       অশেষ করেছ


হঠাৎ করেই শরীর কেঁপে জ্বর আসে। দুই দিন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। কী বোর্ডে আঙ্গুল চালানও সম্ভব হয়নি। কাউকে কিছুু বলিনি। কেমন যেন লাগত। মনে হতো, সৃষ্টিকর্তা বুঝি আমাকে নিয়ে যাবে। 

নাহ্ নিয়ে যায়নি। 
তার সুশ্রষাগুলো নব প্রাণ দিল। 'আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব–. ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।'


৫৯.       প্রেমময়ী তুমি 


হঠাৎই খুব মন খারাপ লাগলে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। এমনি মনখারাপ নিয়ে  শুয়ে থেকেছিলাম আজকেও। কত হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখচ্ছবি চোখের সামনে এসে ভাসতে থাকে। কেমন যেন বিপন্ন লাগছিল নিজেকে। পাশে টেবিলের উপরে রাখা ধর্মগ্রন্থটি এনে পড়তে থাকি। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই।

কার যেন পায়ের মৃদু শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। চেয়ে দেখি -- চিরদিনের প্রসন্ন মুখের সেই তুমি। বুকের উপর রাখা ধর্মগ্রন্থটি সযত্নে টেবিলের উপর রেখে তোমাকে বুকে টেনে নেই।  কী শান্তি! কী অনন্ত প্রেমময়ী তুমি!  আমার সকল মন খারাপ দূর হয়ে গেল। 


৬০.       আলোগুলো জ্বালিয়ে দাও


ধরুন আপনি মৃত্যু শয্যায় শুয়ে আছেন। আপনার শেষ বাক্যটি কি হতে পারে? কিংবা আপনি কি বলতে চান? আমি যে কথাটি বলব বা ঐসময় উচ্চারিত হবে আমি কি তখন তা বুঝতে পারব- সেইটি আমার শেষ বাক্য?   আমি যতোটুকু জানি , মানুষ সেই সময়ে জীবনেও থাকে না, মরণেও থাকে না। সে এক বিষাদময় সন্ধিক্ষণ! আসলে কিছু কি বলতে পারব তখন? কিংবা তারও কিছু আগে? হয়ত শেষ কথাটি হবে -- 'আলোগুলো এক এক করে নিভে যাচ্ছে কেন? সব আলো জ্বালিয়ে দাও। '

হয়ত কোনো কথাই বলা হবেনা। তার চেয়ে বরং সেই সময়ে কেউ যেন আমার চোখের সামনে আমার মায়ের একখানা ছবি মেলে ধরে। সেই ছবিটি দেখতে দেখতেই আমার দুই চোখ যেন বন্ধ হয়ে যায়।


সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৩

হাত ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দিয়েছি সব (অণুকবিতা গ্রন্থ)


হাত ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দিয়েছি সব (অণুকবিতা গ্রন্থ ) 

প্রকাশকাল - এপ্রিল -২০২৪

উৎসর্গ -

আমার বহু স্মৃতি বিজড়িত কবি জসীমউদ্দিন হলের ৪২৬ নং কক্ষের উত্তরাধিকার হয়েছিল এক তরুণ। একই খাটে ঘুমিয়েছিও দুজন বছর অধীক সময়। 
সেই তরুণ এখন মস্তবড়ো সরকারি আমলা।

শাহ মোহাম্মদ নাসিম - কে।


১.

যে পথ দিয়ে সে চলে গেল, সেই পথ দিয়েই আর একজন চলে এল।
পথ একই। সম্পর্ক একই।
শুধু মানুষ ভিন্ন।


২.

কুসুমপুরের সোঁদা মাটিতেই অস্তিত্বহীন হবে দেহের।
চেয়ে দেখার মতো চোখ থাকবে না তখন --
দেখা হবে না নীল আকাশ আর অজস্র নক্ষত্র,
মাটির মাধুরিতে মিশে যাব, বুঝব না কোনও আলো অন্ধকার।


৩.


আমারও একটি নদী আছে, নাম যমুনা। কাশবনের ঝাড়ে ছেয়ে গেছে হয়ত বালুচর।
তোমার সাথে দেখা করব অপূর্ব কোনো এক বিকেলে। যদিও তুমি এখন শীর্ণতোয়া।

জল রেখো বুকে, স্নান করতে আসব।


৪.

অনেক দুঃখ নিয়ে থাকি। কতো বিষাদ আর বিষণ্ণতায় মন ঢেকে থাকে। তবুও ভালো আছি -- তুমি কাছে আছো।

৫.

কী বেদনা লুকিয়ে রাখি অন্তরে
কী যাতনা পুষে রাখি গোপনে।
দিবা নিশিতে ভরে থাকে বিষণ্নতা, অবসাদ নিয়ে করি জীবন যাপন।
ইচ্ছা হলে ছড়িয়ে দিও মাধুরীমাখা ভালোবাসা,
বড়ই কাঙ্গাল হয়ে উঠি সময়ে অসময়ে।


৬.


পরমেশ্বরী, তুমি আছ আমার ভূবনে
আঁধারের উপর আলো জ্বেলে।
কত রাত্রিতে কত নক্ষত্র আভায়
করেছ তুমি দান তোমার সকল কুসুমসুধা
পরশ-কম্পিত প্রাণে।

আমি ক্ষণিক নহি, তুমি নহ ক্ষণিকা ---
তোমার মাধুরী ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বাতাসে
তুমি রবে জনমে জনমে পরজনমে,
সে কথা আমার মন জানে।


৭.


তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে,
কথা আছে তোমার চোখের সঙ্গে আমার চোখের পাতার,
তোমার ঠোঁটের সঙ্গে আমার ঠোটের
আশ্লেষের,
তোমার হৃদয়ের সঙ্গে আমার হৃৎরক্তকণিকার
তোমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমার দীর্ঘশ্বাসের...

৮.

তোমার সকল অস্তিত্ব আমার মাঝে উঞ্চতায় ধরা দেয় বারবার
তোমার উষ্ণতার উত্তাপে দেহমন জ্বলে পুড়ে হয় সব ছারখার
তুমি ভস্ম হও, আমাকেও ভস্ম করো , হয়ে যাই প্রজ্জ্বলিত অঙ্গার
তুমি শুচি হও, শুচি হয় আমার দেহ, সুরে ভরে ওঠে যেন কোমলগান্ধার।


৯.


ঘরের চালে ঝরছে হেমন্তের শীত।
নারকেলের গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় চাঁদ।
তুমি হেনা পুষ্পিত হাত বাড়ালে, আর --
জ্যোৎস্না ধরতে চায় আরেক দিগবালিকা।

এ রাতে আকাশেরও
প্রেমিক হতে ইচছা পোষণ করে।


১০.


জীবন অনিত্য, পদ্মপাতায় জল।

আমাকে বৃথা রাঙিও না, সব রং ধুয়ে যাবে। বরং রাখো আমায় তোমার রঙের পাত্রে। দেখো সেখানে আমি কেমন সবুজে সবুজ, নীলিমায় নীল।


১১.


শারীরিক সম্পর্কের ভিতর শরীরের আনন্দ এবং মনের আনন্দ, এই দুটোই থাকতে হয়। এর একটি না থাকলে মনে হয় দুটোই নেই।


১২.

এত নির্জনতা ভালো লাগে না
এত নৈঃশব্দ্য হাতড়িয়ে দূরের আকাশে চেয়ে দেখতেও ভালো লাগে না।

এত ভালোবাসে তবু প্রাণ চায় -
সে যেন আমাকে আরো বেশি ভালোবাসে।


১৩.


যদি কখনও ফিরে না আসি। সন্ধ্যার আকাশে যদি একটি তারা না জ্বলে, যদি আর গন্ধ না বিলায় সন্ধ্যামালতীর ঝাড়।
তখনও কি তুমি নির্ঘুমে প্রদীপ জ্বেলে অপেক্ষা করবে আমারই জন্যে ? হয়ত করবে, হয়ত করবে না।


১৪.


আমি তোমাকে ভালোবাসি কি-না, এর প্রমাণ তোমাকে আমি কীভাবে দেবো? আমি তোমাকে ভালবাসি কি-না, সে কথার প্রমাণ তুমিই ভালো দিতে পারবে।


১৫.


রাতের মায়াকে অন্ধকারে বিলীন করে দিতে নেই। কোনও বিনিদ্র চোখ যদি আঁধারে কাঁদে তা দেখা যায় না। তাই তাকে খেয়াল করে রাখতে হয় ভোরের আলো পর্যন্ত।

১৬.


দীঘি থেকে প্রতিদিন জল তুলি । দীঘির জল আমার হয়। কিন্তু দীঘি জানে আমি কখনোই দীঘির নই।

১৭


তুমি ভালোবাসা দাও বুকের গভীর থেকে। আমি গ্রহণ করার জন্য করতল পেতে রাখি,
তোমার বুকের বাহিরে।

১৮.


আমি নিঃশ্বাস নেই তোমার শরীর থেকে ছুঁয়ে আসা বাতাস থেকে। আমি প্রশ্বাস রেখে যাই তোমার নিঃশ্বাসের বাতাসে।

১৯.


আমি যা রেখে যাব, খুঁজলে দেখতে পাবে অসীম শূন্যতা সেখানে। একসময়ে যেখানে ভালোবাসা পরিপূর্ণ ছিল। তখন তুমি তা দেখতে পেতে না।

২০.


তুমি নেই, তৃষ্ণা যত ক্রন্দনের,
তুমি নেই, অনন্ত মায়ামর্মরধ্বনি বাজে বাতাসে।


২১.


আঁধার নেমে এসেছে পৃথিবীতে, জোনাকীরা জ্বালিয়েছে সব আলো
একে একে জ্বলে উঠেছে সব তারা--
অরূন্ধতী,স্বাতি, ধ্রবতারা।
নয়ন মেলে দেখ আমাকে আর একবার
ঘুমিয়ে পড়ার আগে সব চুম্বনগুলো দিয়ে দাও যত পারো যেখানে,
যদি আর ঘুম না ভাঙ্গে কাল সকাল বেলায়।


২২.


নির্জন পথবেশ্যা ভোর থেকে শিশিরে ভিজে, রোদ্দুরে শুকিয়ে যায় তার হেমন্ত গন্ধ শাড়ি
তারও প্রতিক্ষা আছে, পাশে দিয়ে হেঁটে যায় নির্মাণ শ্রমিক, যদি বলে সে --- চলো ঐ ঝোপের আড়ালে
শয্যা পাতো শিশির ভেজা ঘাসের উপর।


২৩.


চন্দ্রিমা উদ্যানে আজ চাঁদ ওঠেনি,
সপ্তপদি পাতার ফাঁক দিয়ে দুপুরের রোদ্দুর পড়বে তোমার মুখে,
এলমেল হাওয়ায় উড়বে চুল,
অসতর্কে খসে পড়বে বুক থেকে মখমলের ওড়না। একটি দুরন্ত গিরগিটি লুকাবে চকিতে লতা গুল্মে।
ঘাসফুলের গন্ধে উন্মূখ হব দুজন, কত মধুরিমা প্রেম সেখানে ...'


২৪.


যার অভিমান করবার কেউ নাই। রাগ দেখাবার কেউ নাই। আবদার চাওয়ার কেউ নাই। সেই হলো সবচেয়ে নিঃসঙ্গতম একজন মানুষ। ধরে নিতে হবে, সে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বসে আছে।


২৫.


তোমার কাছে প্রেম চাই তোমার কাছে সুখ
মুছে দাও যাতনা যত মুছে দাও মলিন মুখ
নয়ন খুলে দেখতে চাই দেখতে চাই আলো
তোমাকেই সারা জনম বাসিতে চাই ভালো।


২৬.


নক্ষত্রের দিকে উড়তে থাকি আলবাট্রস পাখির মতো ,
ডানার পালকগুলো ছিঁড়ে পড়ে যায়, কী যে ক্লান্তি !
তখন আর পৌঁছতে পারি না গন্তব্যে.... কিন্তু আমাদের দেখা হবে ঠিকই, জ্যোতির্ময় অন্য আরেক ভুবনে,
অন্য কোনও গ্রহের ছায়া পথে।


২৭.


যেখানেই যাই যত দূরেই যাই
যাই না কোনও অন্তরীক্ষে --
কিংবা পড়ে থাকি পৃথিবীর 'পরে।

একটি মুখের দিকেই চেয়ে থাকি
তার মুখের নিঝুম ছায়াপাত এসে পড়ে
আমারই মুখের উপরে।


২৮.


সে : মনটা ভালো লাগছে না, কেমন যেন হাহাকার লাগছে।

আমি: চলো, বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়াই। রাতের তারাময় আকাশ দেখি। ঐখানে সুন্দর একটা জগৎ আছে! যাবে ওখানে?

সে : নিয়ে চলো আমাকে। কোনো দিন আর ওখান থেকে ফিরে আসব না।


২৯.


পথে প্রান্তরে দিগন্তে কোথাও ভালোবাসা নেই। এই শহরও আজ বেদনার ভারে ভারাক্রান্ত।
তুমি চোখ মেলে দেখো প্রিয়অপ্রিয় ঢাকা শহর। কোথায় কার চোখে আছে জল!


৩০.


কেউ বলেনি আমাদের কথা
কোনও উপাখ্যানেও নেই আমাদের কাহিনি
আমরা হতে পারিনি কোনও কিংবদন্তী-

এই শহরও জানে না কোনও কথা
শুধু জীবনের পাতাগুলো ছিঁড়ে গেছে ।

হেমন্ত ভোরে শিউলি ঝরে যায়
চুমোগুলো উড়ে যায়
বসন্তে বাতাসে শুনব গান পথে পথে।


৩১.


হঠাৎই কখনও আমার মুখের উপর ছায়া ফেলে প্রতিবিম্বতে দেখো তোমার মুখ।
আর আমি দেখি, শত ঝরনার জল --
যা করুণাধারায় তোমার চোখ থেকে ঝরে পড়ে।


৩২.


কিছু সময় আসে ভালোবাসা উন্মাতাল হয়
নম্র বুকের উপত্যাকায় মেলে রাখি চোখ
মদিরার মতো তার শরীর থেকে অচেনা গন্ধ ভেসে আসে
স্বপ্ন ভেঙ্গে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়
শরীর থেকে শরীরে হয় লেনদেন
বেহিসাবি চাওয়া পাওয়া পূর্ণতা পায়
দেহ নিবিড়ে তৈরি হয় এক প্রগাঢ় আলোড়ন....


৩৩.


নিভিয়ে দিওনা দীপ
আঁধার করো না এই মণিময় পৃথিবী!

তুমি চলে গেলে কোথায় পাব মণিরত্নম!
কেমনে আঁকব তোমার মুখের জলছবি,
সেই আবির কোথায়?
আমাকে স্বপ্ন দেখাতে পারে, সেই ঘুমও আসবে না আর।


৩৪.

রাজপথের জনারণ্য থেকে যাকে পেয়ে রেখে দিয়েছিলাম বুকের ভিতরে
সেই একদিন হারিয়ে গেল রাত্রির আকাশে অনেক তারার অন্তঃপুরে।


৩৫.


যখন এই পৃথিবীকে ভালো লাগছিল না আর, যখন চলে যেতে ইচ্ছা করছিল পৃথিবী ছেড়ে। ঠিক তখনই তোমার ভালোবাসা পেলাম।
আর তখনই কী না আমার চলে যাবার সময় হলো।


৩৬.


কবিতা নদীর মতো, নদী নারীর মতো, নারী কবিতার মতো।
কবিতা, নদী ও নারী - তিনজনই এক ও সমার্থক।


৩৭.


হিম আঙুলের স্পর্শে শিলীভূত করতে চাই তোমার হৃদয়।
প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, মৃত্তিকার অতল থেকে উত্থিত সকল অগ্নুৎপাত ধপ করে নিভে যাবে।


৩৮.


ভালোবাসা জৈব, ভালোবাসা যৌন, শরীর না থাকলে কিছু্ই থাকে না ভালোবাসায়। প্রেম কখনই এই দেহকে অতিক্রম করতে পারে নাই।

আবার উল্টোও আছে ---
ভালোবাসা কামগন্ধহীন, কেবলই নিজেকে বিলিয়ে দেয় পরিবর্তে নেয় না কিছুই। দুষ্প্রাপ্য আমাজান লিলির মতো মনোলোভা। এমন নিষ্কাম প্রেম, শুধু দু’হাত ভরে দিয়ে যায়।

একটি বেগ, আরেকটি আবেগ।


৩৯.


যে প্রেম কথা বলে না, চিৎকার করে না,
আশা করে না। অপ্রকাশিত থাকে।
অপেক্ষা করতে করতে জীবন ফুরিয়ে যায় , তবু বলে না -- ভালোবাসি।

এমন প্রেম আহম্মকেরা কেন যে করে, কেন যে তারা দুঃখ দূর্দশায় জড়ায়।


৪০.


জীবনের অনেক পৃষ্ঠাই জীর্ণ পুরাতন হয়ে গেছে।
আমি ছিঁড়ে ফেলি সেইসব পাতা। ছেঁড়া পাতাগুলো তার হাতে দিয়ে বলি -- নিয়ে নাও। প্রদীপ জ্বালিয়ে ধরো। পুড়ে ফেলো।
কী হবে এইসব রেখে। এই সব পাতায় যে জীবনের গ্লানি আর ব‍্যর্থতার কথা লেখা আছে।


৪১.


যেখানে ভালোবাসা নেই, টান নেই, উদ্বেগ নেই। যখন কেউ আর অপেক্ষা করে না। তখন তার কাছে আর ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না।


৪২.


এই রাত্রিতে শিশির ঝরছে অন্তহীন
আজ ভাসিয়ে দাও
তোমার হৃদয়ের আমন্ত্রণে আমাকে নাও হে নিশীথিনী‌।

এই জল, এই অন্ধকার, এই নক্ষত্র বীথিকে --
আকুল করে তোলো,
দেহকে স্নাত করো ক্ষণকাল।


৪৩.


চলতে চলতে পথে ক্লান্তিতে যখন আর
চলতে পারি না,
তখন কোথা থেকে তুমি এসে হাতটি ধরো --
বলো, থেমে যেও না।
ক্ষুদ্র প্রাণের ঘাসফড়িং, প্রজাপতি উড়ে
ফুলে ফুলে পত্রপল্লবে --
ধরে আছি আমাদের হাত, আমরাও চলি ওদের মতো আনন্দে প্রফুল্লে।


৪৪.


যদি কোনো রাত্রির মধ্যাহ্নে
চন্দ্রকিরণতলে দাঁড়িয়ে কেউ ললাটে চুম্বন দিত!
জোছনাধারা বইত ধীরে --
কুয়াশা-নিবিড় নির্জনতায় চলে যেতাম
বাঁশ ঝাড়ের ছায়া মর্মর পথের উপর...

বলতাম,
নাও তুমি আমার অনন্ত ভালোবাসা।


৪৫.


প্রিয় মানুষকে ভালোবাসি গোপনে। তার প্রতি মায়া করি লুকিয়ে। বুঝতে দিই না তাকে ভালোবাসার অসীমতা।
কারণ, আমি যখন থাকব না, সে তখন সইতে পারবে না আমার  দেওয়া  মায়াময় অভিজ্ঞান ও আমার শূন্যতা।


৪৬.


কেউ কেউ কোনও কারণ ছাড়া ভালোবাসে
আবার, কোনও কারণ ছাড়া ঘৃণাও করে।
যখন ভালোবাসা থাকে না
তখনই হৃদয় শূন্য করে ----
তখনই সে শূন্যস্থানে ঘৃণা এসে পূর্ণ করে।

আমাদের বেলায় ব্যাপারটি ভিন্ন -----
আমরা একে অপরে এত ভালোবাসি যে,
কোনও ঘৃণা আসার সুযোগই পায় না।


৪৭.


জীবন পেয়েছিলাম ক্রন্দন ধ্বনিতে, 
জীবন চলে যাবে আঁখি কোণে অশ্রু কণা ফেলে রেখে,  
মাঝখানের সময়টুকু দুঃখের এবং আনন্দের।

আসুন আমরা ঐ আনন্দটুকুই উপভোগ করি। দুঃখেরটুকু নয়।
সবাইকে নতুন বছরের অভিবাদন।


৪৮.


তুমি নেই জীবনে,
অথচ তুমি আছ ছায়ার মতোন মায়ার মতোন আমারই জীবনে জীবনে।


৪৯.


যাকে আমি খুঁজে মরি আলোতে, 
তাকে আমি দেখতে পাই -
লোহিত রক্তের আবরণে ঢাকা হৃদপিণ্ডের অন্ধকারে।


৫০.
 

রাত নামে শহরে
আঁধার নামে তার সঙ্গে আজও
পূর্ণ চন্দ্ররাতে
তুমি কি এখনও সজো ? 

রাতের এই নিরালে
কত ভালবাসাই যে বাসতে ইচ্ছা হয়
চাঁদের ঐ আড়ালে। 


৫১.


যখন তোমার মন খারাপ থাকবে, যখন বিষাদ ছুঁয়ে থাকবে তোমার চোখ মুখ।
কেউ পাশে না থাকুক, তোমার আঁধার রাতে স্বপ্নগুলো দূর আকাশে তারা হয়ে জ্বলুক।


৫২.


এই দুঃখময় জগতে যা কিছু সুন্দর সে তুমি,
সে তোমার প্রেম। জন্ম মৃত‍্যুর কালচক্রে সেই প্রাপ্তিকেও একদিন হারাতে হবে।


৫৩.


তুমি রবে না 
আমি রবো না 
রবে না এই সময়।

শুধু রবে আমাদের পায়ের চিহ্ন 
যেখান দিয়ে হেঁটে চলে গেছি।

কোনও কথা থাকবে না
শুধু গল্প থাকবে -
পূর্ণিমানিশীথের কোনও এক দেবযানীর স্বপ্নের ভিতর।


৫৪.


তুমি তুলে দিয়েছিলে হাতে ভালোবাসবার ভার
তোমাকে ভালোবেসে আজ আমি নির্ভার,
অপার ভালোবাসা বুকে যার 
কেমনে ফিরাই তারে সেই দুঃসাধ্য আছে কী আমার?


৫৫.


কেউ একজন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলছে - তুমি ঘুমাও। যে রাতটি তুমি এখন পার করছ, এটি একটি অনন্ত রাত। তুমি কেবল স্বপ্নই দেখতে পাবে। যে স্বপ্ন দেখা কোনও দিন শেষ হবে না।


৫৬.


তোমার চোখে স্বপ্ন ছিল। পূর্ণিমা রাতের ছায়া ছিল। সন্ধ্যা মালতীর শুভ্রতা ছিল। সারারাত শিশির ঝরে এখানে। এখানেই যত ক্ষেদ। জীবনের যত গল্প বলাও এইখানেই।  মৃত্যুর ছায়াও এই চোখে দেখতে পাই।


৫৭.


নদীও কখনো সাপের মতো শুয়ে থাকে, 
সেও যৌবনবতী হয়, কাঁপে তার দুকূল থিরথির,
দূর থেকে গর্জন শুনি,
মনে হয় সে প্রহরিণী প্রেমিকা
কতদিন ধরে বেপথু হয়ে চলছে,
তার স্তন যুগলে রুপালি বালির দাগ
জঙ্ঘায় অনিঃসৃত জলধারা ---

চলতে চলতে 
ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে
সে কোনো অচিন পুরুষের দয়িতা হয়ে যায়। 


৫৮.


তোমাদের জন্য লিখেছি অনেক গল্প কবিতা।
এখন বেলা শেষ হয়ে এসেছে।
ওগো বন্ধু ---
আর চেওনা, আর যদি কিছু দিতে না পারি।

বীণায় অস্তমিত সন্ধ্যার সুর বাজছে
আমাকে সেই সুর শুনতে দাও।


৫৯.


শরীর মন যেমনই থাক, দূরন্ত চাঁদের রাত্রিতে আমাদের অন্তরে আনন্দের হিল্লোল বহিয়া যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। জ‍্যোৎস্নায় ভিজতে ভিজতে আমরা চলে যাই মহুয়া বনে।


৬০.


কপাটের ওপাশে কেউ একজন তার নাম লিখে গেছে ভেজা শিশিরের অক্ষরে। হয়ত সে বলতে চেয়েছিল --  'খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর, বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে। '


৬১.


কাল আমার পুরোনো এই বাড়িটায় একটি দোয়েল নেমে এসেছিল ঝাঁঝা দুপুরে,
সে ডানা ঝাপটালো, পালক ফেলল, ঘুরে ঘুরে দেখল আঙ্গিনাটা।
ভালো লেগেছিল তার নরম পালক, পিপাসিত চঞ্চু, ভৈরবী রাগের মতো শিস।

কে  রজনীগন্ধার লজ্জাহীন গোপন সুবাস ছড়িয়েছিল ! ভালো লেগেছিল তার রাতের বেলার  বুভুক্ষু গন্ধ নিতে, 
ভালো লেগেছিল তাকে পুণ্য জল ধারায় ভিজিয়ে দিতে, পৃথিবীর নির্জনে কুঁচি কুঁচি করে ছিঁড়ে ফেলতে পাপড়ি। 

কে   অমৃত জলের প্রস্রবণে ভেসেছিল , কে দিয়েছিল প্রথম প্রস্তাব দ্বিধা উপেক্ষা করে, তা জানবে কী করে মূর্খ দোয়েল, আর অপ্রেয়সী এক রজনীগন্ধা!


৬২.


দূরে বহুদূরে চঞ্চল মেঘের মাঝে আকাশ ছাড়িয়ে 
ভেসে যাও। ব্যাপ্তিও ছড়াও ঐ দূরালোকে। 
আমি গভীর গহনে আবর্তিত হই একাকী ভূবন মাঝে। তুমি যতদূরেই যাও, আমার ভূবনেই তুমি ব্যাপ্ত হয়ে আছ।


৬৩.


মেয়ে তুমি ভুল প্রেমিকের প্রেমে পড়েছ। 
পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আকাশ ছুঁতে গিয়ে 
এখন তুমি গিরিখাদে। 
মেয়ে তুমি মৃত্তিকার উপর দাঁড়াও, প্রেমিকা হও ঘাসের, আর বুনোফুলের।


৬৪.


তোমাকে সাথে নিয়ে 
যে সন্ধ্যা দেখি
যে রাত দেখি 
বিমুগ্ধ প্রণয়ের যে কাতরতা দেখি
চোখের উপর চোখ রেখে বুঝতে পারি--
এই ক্লান্তির শহরে আমাদের সব প্রেমই অম্লান।

৬৫.


যে চলে যেতে চায় সে চলে যাক, দেখতেও চাই না তার ছায়া
যে চলে যায় সে সব নিয়ে যায়, নিয়ে যেতে পারে না শুধু  মায়া।


৬৬.


কাউকে ছেড়ে চলে আসার সময়  পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না, এতে করে মায়ায় থমকে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন।


৬৭.


'প্রেমের মরা জলে ডোবে না।' জানিনা সে কেমন জল, কেমন প্রেম!
তবে 'যোগাযোগ কমলে প্রেম মরে যায়'।

আমার দেবযানীকে দেখ---
'যত বেশি করে অভিমান, তত বাড়ে তাঁর প্রেম।'
মরে তো না-ই প্রেমের আগুন লকলকিয়ে ওঠে। 

'প্রেম কভু নাহি কমে, বাড়ে বারেবারে, টানেটানে একাকার-- মিলে যায় দুটি প্রাণ।'


৬৮.


আমার কাজতো শেষ। থাকার কি দরকার।
আর অপেক্ষাই করব কার জন্যে ?
এখানে হৃদয় ভাঙ্গে
এখানে হৃদয় বদলায়-
তার চেয়ে চলে যাই। বিদায় !


৬৯.


তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করলেই চোখ বন্ধ করে রাখি। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, তুমি আমার কথা মতো নীল শাড়ি পরে হাঁটছো বারান্দায়। চোখ রেখেছ নীলে। যেন তুমি খুঁজছ আমাকেই।

যখন চোখ খুলি, তখন দেখি অন‍্য কিছু। অন‍্য মানুষ, অন‍্য আকাশ, জনারণ্য, দূরের ধূঁ-ধূ প্রান্তর।


৭০.


এই হাত ধরেছিল তার হাত কোমল কঠিনে
এই বুক জড়িয়ে নিয়েছিল গভীর আলিঙ্গনে।
তারপরও তাকে ধরে রাখা গেল না।

এই হাত এই বুক মিথ্যা ছিল তাহলে?


৭১.


মনখারাপ করব না আর 
তারপরও মনখারাপ হয়
যে চলে গেছে তার জন্য মনখারাপ হয়।

মনখারাপ হওয়ার আর কোনো কারণ নয়
যে চলে গেছে তাকে নেই হারানোর ভয়।

তবুও মন খারাপ হয়
য়ে চলে গেছে তাকে চিরকালের জন্য  মন থেকে হারানোর ভয়!


৭২.


দেখো তুমি চেয়ে কড়ই গাছের ছায়ায় 
রোদ্র থেমে গেছে
ঝরা পাতার শব্দে তোমার আগমনের গান শুনি
বেণী খোঁপায় পরো তুমি সাদা সন্ধ্যা মালতী
তোমার বাগানের তুমি যেন মালিনী একজন
প্রতিদিন জল ঢালো সেখানে। 
তুমি নিজেই হয়ে যাও কখনও সন্ধ্যা মালতী
আজ শাহবাগের মোড়ে কোনো ফুল নেই, 
সব ফুল আজ তোমার বাগানে।


৭৩.


জানি না। কী বলেছিলে। 'জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে...।' কেমন সেই ভালোবাসার অরূপ রূপ । কী আশ্চর্য লাবণ্যে ভরা তোমার মুখ! 'দিয়ো গো আমারে নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে, তুমি।'

আমার এপিটাফ  লিখে রেখে যাব
হাস্নাহেনার ঝাড় তলায়, ঐ মাটির বাড়িটার শ্বেত পাথরের ফলকে। তুমি এসে পড়ে যেও।


৭৪.


পথ কখনই সমান্তরাল নয়,পথের বাঁক আছে। নদীও সমান্তরাল নয়,নদীরও বাঁক আছে। জীবনটা এমনই পথ ও নদীর বাঁকের মতো। 
আমার পথ চলায় এমনি এক পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে আছি। যেন মিশে যাচ্ছি নদীর মতোই অন‍্য বাঁকে, 
অন‍্য  মোহনায়।


৭৫.


মানুষ প্রেমে পড়লে মন উদার হয়। সবকিছুতে নিবিড় সমর্পণ করে। সে কখনই রুঢ় হয় না। আর, খুনও করতে পারে না কাউকে।


৭৬.


বৃষ্টি নামলে ছাতা নিয়ে বের হবেনা। মন ভরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে। যদি পিছলে পড়ে যাও, ভয় নেই। আমি ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছি।


৭৭.


আজই দেখলাম-- গন্ধরাজ ফুলের উপর সন্ধ্যা পূর্ব বিকালের সূর্যের আলো এসে পড়েছে। কী বিষণ্ন ভাবে চেয়েছিল দুজন দুজনের দিকে। দুজনেরই তখন বিদায় কালীন সময়। একজন অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। আর একজন ঝরে পড়বে।


৭৮.


কেউ যদি বুকের ভিতর মুখ গুজে গুমরে গুমরে কাঁদে এবং তা যদি বুকেরই মর্মতলে গড়াতে থাকে, এবং তা যদি ইছামতির কালো জলের মতো সুপ্ত আকার ধারণ করে, স্বভাবতই তখন মন খারাপ হয়ে যায়।

ঘরের দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। চোখ মেলে দেখতে পাই শুধুই অন্ধকার। মন ভালো হলো না। পরক্ষনেই একবার আকাশের দিকে তাকাই। দেখলাম, আকাশ ভর্তি তারা। সত্যিই, মনটা ভালো হয়ে গেল।


৭৯.


আবির দিচ্ছিলাম তার তুলতুলে গালে
সে তখন বলে ওঠে --- এ তুমি কি করছো !
কী করছো! 
আমি বলি, আজ বসন্ত দিন। শহর জুড়ে চলছে
লাল হলুদের উৎসব,
যেতে হবে -- বকুল শিমুল কৃষ্ণচূড়া আর মহুয়া বনে।


৮০.

প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভেঙে যায় 
দেহ জুড়ে ক্লান্তির অবসাদ, 
তখনও ফুরায়নি রাত -
পাজরে ধরে আছে তার কোমল হাত
হৃদপিণ্ডের গভীরে 
অনুভবে বুঝতে পারি আমার অস্তিত্ব 
জুড়ে সে-ই আছে।


৮১.

যে সব ভালোবাসা আমি পেয়েছি,
তা আজ যমুনার জলে ভাসিয়ে দিয়ে এলাম । ঘৃণাগুলোও রেখে এলাম গহীন বালুচরে। 

জল বলেছিল বারবার ---
তুমি স্নান করো, পবিত্র করো দেহ, 
অসুন্দরগুলো নাও মুছিয়ে।


৮২.


'তোমাকে ভালোবাসি। কোনো দিন ভুলব না। ছেড়ে যাব না।'
কত প্রতিশ্রুতি!

সেই তুমি কিসের টানে চলে গেলে, ফেলে রেখে গেলে
তোমার স্মৃতি। 

কথা রাখলে না, ফিরে আর আসলে না, ভেঙে ফেললে সকল প্রতিশ্রুতি।


৮৩.


পোড়ামাটির প্রতিমার গন্ধ ছিল তোমার শরীরে
কাঁচা মাটি ছানতে গিয়ে পেয়েছিলাম তার স্বাদ
পুড়েছ আর জ্বলেছ ভালোবাসায় হয়েছ নিখাদ।


৮৪.


অন্ধকার পছন্দ করো, বুকের খাঁজে তাই তোমাকে রেখেছি
তা দেখে রাত্রিও হিংসা করে-
শরীরের ঘ্রাণ পেয়ে আহলাদী হয়ে ওঠো -
আমিও তখন স্বপ্ন বীজ বুনি তোমার উর্বর মৃত্তিকায়।


৮৫.


দুপুরের রোদ্দুর নিভে গেল, অলৌকিক এক আঁধার হলো।
এই বসন্তে বৃষ্টি এলো।
এক অপ্রেমিকের আবদারে, বিবাগী গান বেজে উঠল তার বীণা তারে।


৮৬.

চলে যাব সব ফেলে, এই অবগুণ্ঠিত নীলাকাশ, 
জলে ভরা টইটম্বুর এই নদী, স্মৃতির বসতবাড়ি, শ্রাবণ কদম্ব ফুল।
রেখে যাব লুকিয়ে রাখা জীর্ণ প্রেমপত্র আর তোমাকে দেওয়া নাকফুল।

৮৭.


তোমার মনে বসন্তের আগুন লেগেছে। এই আগুন আমিই নিভে দিতে পারি। যদি চাও আমার জল বৃষ্টি মেঘ।


৮৮.


ভরা নিশীথ দেখলে ভয় লাগে। যদি কাছে টানতে যেয়ে আড়াল হয়ে যাও? যদি অন্ধকার ঘিরে ধরে? তারচেয়ে পূর্ণিমায় এসো, ওগো পূর্ণিমা নিশীথিনী। ধবল আলোর পশর নামবে ধরণীতে। সে আলোয় পথ চিনে নেব এবং চিনেও নেব তোমার সাদা শাড়ি।


৮৯.

সেই শূন্য জায়গাতেই তোমাকে বারবার খুঁজতে যাই
যেখানে তুমি নেই,
নিঃশ্বাসের বাতাস ভারি হয়ে আসে --
সেই শুন্য জায়গাতেই যেয়ে নিঃশ্বাস ফেলি অসীম শূন্যতায়।


৯০.


আবার কে যেন মায়া দিতে চায়। আলো জ্বালাতে চায়। দরকার নেই ---
আমার আঙ্গিনায় এখন থৈথৈ করছে মায়াবী পূর্ণিমা রাত্রি। এই রাত্রির মধুরিমায় ভালোই আছি।

 
৯১.


কেউ জেগে আছে কেউ ঘুমিয়ে আছে কেউ আছে রোগে শোকে,
এই আঁধার রাত ঠিক শেষ হয়ে যাবে ভোরের উজ্জ্বল আলোকে।


৯২.


এই সমুদ্র দেখে মনে হয় এখানেই জলবাস আমার
এর উচ্ছাস, এর অতল গহবর, এর গর্জন, এর ভৈরবী নিনাদ
আমাকে কাছে ডাকে,
কতকাল অপেক্ষায় ছিলাম নদী হয়ে মোহনায় মিশব
কিন্তু পারিনি নদী হতে।
আজ এখানে এসে তোমার কূলে বসে আছি
তোমার উদাত্ত আহবান আমার প্রাণে জাগে
তুমি টেনে নাও, হে জলধি ! তোমার জলের বুকে।


৯৩.


কখনও আর হবে না দেখা মিলব না আর দুজন দুজনে,
আমাদের ভালোবাসা ছিল ভুল অঙ্কে ভরা  ভুল বিয়োগ বিভাজণে,
তাই আজ দুজন দুদিকে - ভুল অঙ্ক মেলাবার অন্বেষণে।


৯৪.


বিষাদ ভারাক্রান্ত কোনো জানালায়
যদি কখনো তুমি মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকো
যদি অনুভব করো আমার প্রেম 
যদি ভ্রু বাঁকিয়ে ডাক দাও আমাকে
যদি তুমি দানশীল হও ভোগের ,
বিস্মরণের সময় যদি বিমূর্ত থাকো পিকাসোর ছবির মতো ভাবলেশহীন ---
তখনই সময় হয় আমার ভালোবাসবার।


৯৫.


            
শিমুল দেখলেই রক্তভূক হয়ে উঠি
এই শহরে কোথায় পাবো শিমুল ?
তোমার সাদা জবায় এখন বসন্তকাল
তুমি হয়ে উঠেছ তাই রক্তকরবী ।

বসন্ত চলে যাক ---
আসছে গ্রীস্মে তুমি রাধাচূড়ার আবির মেখে থেকো
আমি আসব কাছে --- আমার শরীরে থাকবে তখন
বঙ্কিম রূপের নাগকেশরের গন্ধ। 


৯৬.


একদিন আমিও হারিয়ে যাব
যেমন করে হারিয়ে যায় চাঁদ কৃষ্ণ গহ্বরে। 
একদিন আমিও ঝরে যাব
যেমন করে শিউলি ঝরে যায় 
দিনের রোদ্রকরোজ্জ্বলে। 
চাঁদের অলক্ষ্যেই তারা হারিয়ে যায়
আবার তারার অলক্ষ্যে চাঁদ, 
একদিন ওদের মতো আমিও হারিয়ে যাব অন্ধকার মৃত্তিকা তলে।


৯৭.


যে পথ দিয়ে চলে এসেছিলাম সেই পথ দিয়েই চলে যাব একা 
তোমার ভুবনে তুমি পড়ে রবে কোথাও পাবে না আমার দেখা 
যদি আমাকে খুঁজে পেতে চাও আঁধারে জ্বালিও প্রদীপ শিখা 
চিনিয়ে দেবে তোমাকে পথের উপর ফেলে আসা আমার পদরেখা।


৯৮.


পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে থাকা বিষাদগুলি
আনন্দে রূপান্তরিত হয়ে চলে গেল
ঐ শেষ অস্তরাগে। 
দূরে ছড়িয়ে থাকা মেঘকণাগুলি উড়ে এল আমার চোখের 'পরে অশ্রুত আবেগে। 


৯৯.


যমুনাপুলিনে দাঁড়িয়ে অপূর্ব সন্ধ্যায়
শুধিয়েছিলাম তারে - 
'চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই
চোখ খুললে সে নাই।'
বলত কে সে?
সে বলেছিল - 'রোশনাই'।

(তার নাম রোশনি বাঈ।)


১০০.


হাত ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দিয়েছি সব
তবু্ও অমৃত সুধা পাত্র ভরল না -
হৃদয় ভেঙে দূরে চলে গিয়েছ 
তবুও হৃদয় তোমাকে ভুলল না।