শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২৩

প্রসন্নবিমলকান্তি মুখশ্রী ( কবিতা পাণ্ডুলিপি)

প্রসন্নবিমলকান্তি মুখশ্রী ( কাব্যগ্রন্থ)

উৎসর্গ -

মায়াবতীকে।
যে আমার আছে জীবনে,
পূর্ণচন্দ্রকিরণে। 


 ১.  প্রস্থানের দিনে


মনে করো, এই যে আমি কবিতা লিখছি, গল্প লিখছি-
আমি যদি আর না লিখতে পারি !
একদিন আকাশ দেখব বলে বেরিয়ে গেলাম।
যদি আর ফিরে না আসি।
যদি আকাশের তারাদের কাছে যেয়ে বসে থাকি।
এই যে দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি টানানো আছে,
ওটা নামিয়ে দিয়ে নজরুলের মতো ঝাঁকড়া চুলের
আমার ছবিটি কি তুমি ওখানে লাগাবে?
সন্ধ্যার বুকে নিভে যাওয়া আলোয় দেখবে ছবির প্রসন্ন বিমলকান্তি মুখশ্রী?
তুমি কি সেই ছবিতে ফুল দেবে ?

টেবিলের উপর কবিতার খাতাটি পড়ে থাকবে,
হিবিজিবি কাটাকাটি করা অনেক কিছুই লেখা,
পাতা উল্টালেই দেখতে পাবে-
রাত জেগে কত প্রহরে
তোমাকে নিয়ে কত কথা লিখে রেখেছি-
কত ভালোলাগা, কত গ্লানি, কত অভিমান আর দীর্ঘশ্বাসের কথা,
তুমি কি পড়বে সেই সব কথা ?

বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলমেল হয়ে থাকবে তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের বই,
পুরনো হয়ে যাওয়া 'খোয়াবনামা' ও 'ক্রীতদাসের হাসি'। হুমায়ুন আহমেদের 'মাতাল হাওয়া' পৃষ্ঠা খোলা অবস্থায় পড়ে রবে এক কোণে,
এ্যাসট্রের ছাই উড়বে ফ্যানের বাতাসে.. লগআউট করা থাকবে না ল্যাপটপ, মুঠোফোনও ডিফল্ট হয়ে থাকবে... লাস্ট ডায়াল কলটাও হয়ত তোমাকেই করা থাকবে ...
খুব কী মনখারাপ হবে তোমার?
তুমি সেদিনও আমাকে ভালোবাসবে কি ?
নাকি মোমবাতি জ্বেলে আধো অন্ধকারে পড়বে তোমাকে নিয়ে লেখা 'আরক্ত সুন্দর মুখে'র এই কয়েকটি চরণ --

' একদিন মনখারাপ হবে খুব,
অথচ কান্না নেই
সে মুখোমুখি এসে দাঁড়ানোর পর হয়ত কান্না এসে যাবে
বড্ড অচেনা লাগবে তখন পৃথিবী,
একদিন সবকিছু ফুরোবার আগেই আমিও হারিয়ে যাবো..
তখন কারও চোখে আমার কান্না
রয়ে যাবে।

কোন্ আলোয় দেখেছিলাম তার মুখখানি!
ক্ষণকালের দেখায় চিরকালের ভালোবাসা হলো
তার সেই আরক্ত সুন্দর মুখ।

কেন যে কিছু মুখে পৃথিবীর মায়া লেগে থাকে
কেন যে কিছু মুখে পাই শুকপাখির পালকের ঘ্রাণ
কেনই আবার দুঃখ কাতরতা দেখি সেই মুখখানিতে।

সেই মুখেই --
জীবন থেকে মৃত্যুর খেয়া পারাপার দেখি।'



৩. মায়া চিহ্ন


আমার দুই চোখ রাতের গভীরে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়
আমার দৃষ্টি চলে যায় বহুদূর, সেই প্রথম কলাবৃত যৌবনে--

তারুণ্যের অসংযত সময়ে আমার হাতের করতলে
চুম্বন দিয়ে কেউ একজন বলেছিল--
এ আমার স্মৃতিময় অভিজ্ঞান তোমার জন্য-- 'মনে রেখো'। সেই ধূসর মায়া চিহ্ন আমি আর মনে রাখতে চাই না।

আমার পাশে সারারাত্রি নিষ্কলুষ কেউ একজন ঘুমিয়ে থাকে --
আমি কোনও কালিমা লাগাতে চাই না তার দেহরূপে,
তার মাঝেই আমি দেখতে পাই -- জীবনের সকল আনন্দ বেদনার রূপ।


৪.   মধ্যরাতে রচিত কবিতা


তুমি দড়জায় কড়া নাড়ো রাতের মধ্যপ্রহরে
আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় অকস্মাৎ।

দেখি --
প্রগাঢ় চুম্বন নেবার জন্য তুমি অপেক্ষা করছ।

অলৌকিক কোনো পুরকৌশল আমার জানা নেই
কিভাবে তৈরি করব দেহজ সুরম্য বাঁধ--

আমি মধ্যপ্রহরের ভ্রমণবিলাসী অভিযাত্রি এক...
অরণ্যের দিকে ধেয়ে চলেছে তাম্র রঙ্গের অশ্ব।

চলতে চলতে
লতা গুল্ম আচ্ছাদিত এক গুহা দেখতে পাই--

পথ ছেড়ে দাও, সোয়ার ধরেছি আমার হাতে
তুমি আমার সকল পথের, আমার সকল গন্তব্যের সহযাত্রি হতে পারো।



৫.  তুমি এমনই নদী


মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে অনেক দূরে চলে যাই একলা কোনো জীবনে। যেখানে সব বাঁধনহারা। যেখানে জীবন  উদ্দাম নদীর মতো স্রোতে ভাসা। কিন্তু একলা হয়ে যেতে আর পারি কই? কোথায় থেকে তুমি আরেক নদীর মতো বেগে ধেয়ে ছুটে আসো। এসে মিশে যাও আমার নদীতে।
তখন একই স্রোত হয়, একই জল হয় । দুজনেই তখন জলে ভাসি, ভাসতে ভাসতে একূল ওকূল দুকূল হারিয়ে ফেলি। কোথায় যে মোহনা! খুঁজে পাই না।

হঠাৎ বর্ষার বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে পড়তে থাকে,
উপর থেকে জল, নীচে থেকেও জল। তখন কূলও পাই না, কিনারাও পাই না।

তুমি এমনই নদী, এমনই শীতল তুমি। 
না পারি দূরে যেতে। না পারি জলে ডুবে মরে যেতে‌।


৬.  পদধ্বনি শুনি


তোমাকে যে চোখে দেখি সে চোখে ছানি
পড়ে গেছে, বহু বর্ণখচিত মণিতে এখন কেবলই
আঁধার দেখি --
সকল মাধুরী লোনা জলে নষ্ট হয়ে গেছে
চেয়ে দেখবার সকল চেষ্টা বৃথা মনে হয়।

এখনও বিকেল বেলার সোনালি অস্তরাগে
তোমার পায়ের শব্দ কানে বাজে
এখনও পুতুল খেলার পুতুলের চোখে দৃষ্টি দান হয়
চিঠির জন্য ডাক পিয়নের পথের দিকে
চেয়ে থাকি আজও।

দূরের কোনও ট্রেনের হুইসেল শুনলে মনে হয়,
হয়ত তুমি আসছ ঐ ট্রেনেই।



৭.  অপেক্ষা

প্রথমে পরিচিত সেই পায়ের শব্দ, তারপর কড়া নাড়লো কেউ এসে দরজায় --
বিভ্রম নয়, পুরনো ভালোবাসারা এইভাবেই কড়া নাড়ে এসে দরজায়।

ওপাশে যে আছে তাকে আমি চিনি, এইভাবেই সে এসে মাঝে মধ্যে কড়া নাড়ে ঝুমবর্ষা দুপুরে !
বাতাসের বেগ থেমে যায়, বাঁশতলায় শুকনো পাতা ঝরঝর করে ঝরে পড়ে-

বহুবছর আগে একদিন এমনি করে এসে দরজায়
কড়া নেড়েছিল গুলনাজ মহল -
স্বপ্ন দেখিয়েছিল সে আমাকে, শুনিয়েছিল মৃত্যু ভয়, একা হয়ে গেলে কীভাবে নিঃসঙ্গতা
কাটাতে হয় সেই কথাও বলেছিল , শোকের ভিতর সুখ খুঁজে নিতে হয় কীভাবে তাও জেনেছিলাম তার কাছে থেকেই।

পদশব্দ মিলিয়ে যায়, কড়া নাড়ার শব্দ থেমে যায় তারপরও দূর হতে ছায়ার মতো মায়ার মতো হেঁটে হেঁটে যে আসে তাকে আমি চিনি --
সে যে কোনও বিভ্রম নয়, তাকে আমি আলোতেও দেখতে পাই, অন্ধকারেও দেখতে পাই।

এমনই করে প্রায়শঃই পুরনো ভালোবাসারা এসে দরজায় কড়া নাড়ে, আনমনে সেইসব শব্দ শোনার জন্য
কান পেতে থাকি, দরজা খুলে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করি....।


৮.  আমার মৌনতাগুলি


প্রতিদিন তোমাকে হন্ন হয়ে খুঁজি ---
এক দিশাহীন নিশাচর পাখির মতো ।
আমার সৌভাগ্য এই , তোমাকে আমি পেয়েছি
কখনও স্বপ্নে , কখনও কবিতায়।
আমার চোখ তোমাকে প্রথম দেখেছে সবুজ ঘাসে
তোমার চুলের বেণী বেয়ে আমার মৌনতাগুলি
ভেসে যায় আকাশের দিকে।
আর খুব নিঃশব্দে মুছে যায় তোমাকে লেখা আমার অলিখিত প্রেমপত্রগুলি ।

আমার চোখে জল আসে অসতর্ক সময়ে
আমি দেখি তোমার চোখের পাতা ,
যা শ্রাবণ বৃষ্টির মতো ধ্বনিত এবং স্তব্ধবাক।
মেঘ চুয়ে তখনও জল এসে ঠোঁটে পড়েনি।
তখনও গন্ধ নেই তোমার ভেজা কাপড়ের ঘ্রাণ --
এক উন্মুল উড়নচন্ডী তোমাকে যে ভালবেসেছিল।



৯.  ভুলে যাও লীলাবতী


তুমি আমাকে ভুলে যাও লীলাবতী
তোমার এখন বসন্ত সময়,
তোমার মন শিমুল পলাশে রাঙানো
তুমি রোমাঞ্চিত হও কামিণী সৌরভে
আমাকে তুমি ভুলে যাও লীলাবতী।

তোমার এখন আর বিষণ্ণতা নেই
তুমি নও ক্লেদজ কুসুম
ঠোঁটে তোমার রক্তকমলের দাগ, চেতনায় মিশেছে ভাঁটফুলের গন্ধ, চিবুকে ছুঁয়েছে নিশী মল্লিকার রেণু
প্রতিদিন তুমি স্নাত হও শান্ত দীঘির জলে
আমাকে ভুলে যাও লীলাবতী।

কত ভালোবাসা ছুঁয়ে আছে তোমার শরীর জুড়ে
কত প্রেম পেয়ে তুমি হয়েছ কলাবতী রমণী
তোমার আর কোনও দুঃখ নেই
তুমি আমাকে ভুলে যাও লীলাবতী।


১০.      অলকানন্দায়

আমাদেরর ভালোবাসার প্রথম লগ্ন লেগেছিল অলকানন্দায়
তারপর হলুদের রঙ্-এ রঙ্গিন হয়েছিল তার সাদা শাড়ি
তারপর অরণ্যের দুয়ার খুলে যায়,
তারপর বন উপবন নমিত হয় সাগরের দিকে।
ঝিরঝির ধারায় ভিজে অসভ্য হয়ে যায় তার সকল 'বাস
চন্দনের গন্ধে কামাতুর হয়ে ওঠে যত বন হরিণী,
পাখি, সর্প, সরিসৃপ,পশু, পঙ্গপাল
শৃঙ্গারে জন্য তারাও আকুল হয়
বৃক্ষ, লতাগূল্ম, বনরাজিতে লাগে হাওয়া,
মেঘ গুরুগম্ভিরে শীৎকার ধ্বনি বাজতে থাকে                                 আকাশ ভেঙ্গে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে 
তার নির্বাস সফেদ শরীর স্নাত হতৃে থাকে
তখন শত শত অলকানন্দা ঝরে পড়ে ঢেকে দেয় সকল নগ্নতা।


১১.         আগুন পাখি


আমাকে বুঝতে পারবে না তুমি কোনদিন 
এখন সুন্দর করে লিখতেও ভয় হয়
মিথ্যে কথা লিখে অভিশাপও নিতে চাই না,
গুহামানবও পারেনি অন্ধকারে কোনও শিল্প আঁকতে
যদি না কেউ প্রদীপ জ্বালিয়ে ধরে।

আমি সেই আগুন পাখি
যার কাছে আসলে শুধু দহনই হবে, আমার উড়ে চলা যে আগুনের দিকে,
বিমুগ্ধ চুম্বনগুলো শুধু শুকোতেই থাকবে মহাকালের দেয়ালে, এই অনিত্য ভুবনের  চৈত্র বৈশাখের রৌদ্রতাপে।

তুমি ধরো না তাই কোনো আগুন পাখি।


১২.         প্রবঞ্চিতের কবিতা


রমণী এসে দাঁড়িয়েছিল,
এনেছিল পুরনো খাতা, কাঠ পেন্সিল, কোনও অর্থ না থাক, সে লিখে রেখে গেছে -- অনেক নামে ডাকা নামগুলো, যা বহু কাল আগে কেউ একজন ভুলে গেছে।

এসেছ যখন রেখে যাও, 
পাহাড়ের পথে পথের ধূলি, লতা গুল্ম, যার নীচেই রঙিন পানির হ্রদ, উপরে ঘোলাটে আকাশ, একসময়ের হেঁটে যাওয়া পদচিহ্ন, এই অভিজ্ঞান গুলো। যে পথে কেউ একজন যাত্রী ছিল।

রমণী আবার ভুল করেছিল,
কোচে ঢেকে রাখা ফুলের কাছে, জলহীন নদীর কাছে, সাত রঙের পালকের প্রজাপতিরা এখন আর আসেনা, তারা উড়ে গেছে দূরে বহুদূরে -- আকাশনীলে।

রমণী,
তোমার সবকিছু এখন শুকনো ফুল, গন্ধহীন, স্বাদহীন। যাকে তুমি দান করেছিলে তোমার হিল্লোলিত যৌবন-- সে এখন অন্য কারোর, পরিযায়ী পাখি হয়ে উড়ে 
চলে গেছে অন্য আকাশে।


১৩.       বিস্মৃতির অতল তলে


বিস্মৃতির মতো আমিও একদিন হারিয়ে যাব তোমার  অন্তর্লোক থেকে,
কেউ মনে রাখুক না রাখুক আমাকে মনে রাখবে আমার কুসুমপুরের মাটি।

হাজার বছর পরে যদি কোনও প্রভাতে তুমি হাঁটতে যাও সেখানকার মেঠো পথ ধরে, যদি তখন কোনও পলাশের গন্ধ পাও সেখানে,
মনে করিও -- সেই পলাশ তলের মাটিতেই আমার দেহ মিশে আছে।


১৪.      করোনাকালীন কবিতা 



তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে? 
অনেক বছর আগে এক পৌষের দ্বিতীয় প্রহরের রাত ছিল সেদিন।
সেই রাতে কোন্ চাঁদটি উঠেছিল, তা আজ পুরনো পঞ্জিকা ঘেঁটে ঘেঁটে বের করে দেখতে হবে-- হয়ত দ্বিতীয়া, তৃতীয়া কিংবা পঞ্চমীর ছিল, 
হয়ত সেই রাতে একে একে জ্বলে উঠেছিল সব তারা আকাশে,
হয়ত সেই রাতে আশাবরী রাগে রবীন্দ্র সঙ্গীত বেজে বেজে থেমে গিয়েছিল,
হয়ত কোথাও কোনো নিশিগন্ধা আকুল করে সুবাস ঝরিয়েছিল
কোনো এক উপশহরে সেদিন ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ রাত্রি নেমে এসেছিল।

কাগজে কিছু লেখে হয়নি সেই রাতে।
তোমার চোখের তারায় চেয়ে চেয়ে বলেছিলাম সেদিন -- 
'তুমি কাছে থেকো, পাশে থেকো, চির জীবন ছুঁয়ে ছুঁয়ে থেকো।'
তুমি ছোট্ট করে বলেছিলে -- হ্যাঁ। 

কিন্তু সেই কথা, সেই  প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে তুমি! 
ভঙ্গ করল করোনা।


১৫.        এত দূরে 


তোমার আর আমার মাঝখানে এখন অনেক দূরত্ব। 
এত দূরত্ব যে --
দৈহিক দুরত্ব বেড়ে গেছে অন্ধকার রাত্রির মতোন হুহু করে।

তুমি চলে গেছ বহু দূরে --- বহু পথের ওপারে,
সেখানে নদী নেই
ঋতুবতী রমণীর মতো মোহনা নেই, অরণ্য নেই। 

দুজনের মাঝখানে এখন রাত্রিবেলার আকাশ
সেই আকাশে অনেক কালো মেঘ ---
সেই মেঘ থেকে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে।


১৬.         মেনোপেজ


নেতাজী সুভাষ বসু বলেছিল,'তুমি আমাকে রক্ত দাও,
আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেবো।'
না, আমি এই স্বাধীনতার কথা বলছি না
আমি এই রক্ত ঝরানোর কথা বলছি না।

আমি বলছি একটি বালিকার কথা--
যে আমার বোন হতে পারে, আমার কন্যা হতে পারে,
আমার ভাগিনী হতে পারে, আমার ভাতিজী হতে পারে।

বালিকা একদিন সকালবেলা দেখতে পায়
শুভ্র বিছানায় রক্তের দাগ লেগে আছে;
দেখতে পায় তার ট্রাউজার্স রক্তে ভিজে গেছে
বালিকা কেঁদে ওঠে, দৌড়ে চলে যায় মায়ের কাছে,
মা আদর করে বলে-- কাঁদেনা মা-
এই বয়সে মেয়েদের এ রক্ত ঝরা শুরু হয়।'

বালিকা একদিন তরুণী হয়ে ওঠে
চন্দ্রমাসের হিসাব কি তখন সে জেনে যায়
বন্ধুুরা কেউ বলে এটি একটি অচ্যূত 
কেউ বলে তুমি অপবিত্র, কেউ বলে এ রক্ত নোংরা
তুমি কিছু ধরতে পারবে না, কিছু ছুঁইতে পারবে না
এসবই ভুল কথা, এটি একটি পবিত্র কাল।

এই যে আমি পৃথিবীতে এসেছি
এই আসা আমার মায়ের পবিত্র কাল চক্র থেকে
এর নামই মাতৃত্বের কাল
আমরা পৃথিবীতে আসতে পেরেছি এই সুবর্ণ কালেই,
কী ভাবে আমি বলি এটি অচ্যূত সময় !

জীবনের এক অস্তমিত সময়ে,ঋতুচক্র থেমে যায়
যে বালিকাটি একদিন মা হয়ে উঠেছিলো সে বিষণ্ণ হয়
চন্দ্রমাসের দিন গোনা কি ভুল হচ্ছে তার?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে একাকী কাঁদে
খোঁজে বলিরেখা, রক্তের এ ধারা কেন থেমে যায় !


১৭.         কবে কখন 


বলতে পারো --- 
ঠিক কবে থেকে তোমাকে ভালো লেগেছিল
ঠিক কবে থেকে তুমি আমার হয়েছিলে                                                                ঠিক কখন থেকে তোমাকে পাওয়া হয়েছিল শুরু
স্বপ্নটা তৈরী হয়েছিল ঠিক কখন থেকে। 

বলতে পারো ---     
কখন শ্রাবন বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল তোমার চোখে
কখন বাতাস বেগ পেয়েছিল তোমার জানালায়
কখন সন্ধ্যা তারা ঝরে পড়েছিল উঠোনে 
কখন চম্পা বকুলের গন্ধে আকুল হয়েছিল তোমার মন।

বলতে পারো ---
ভালোবাসার উৎসব শুরু হয়েছিল কখন কোন্ জ্যোৎস্নাভূক রাত্রির অন্ধকারে 
কখন আমরা মিলিত হয়েছিলাম রক্তে আর শোণিতে 
কখন থেকে দুই আত্মা একাত্মা হয়ে গিয়েছিল?
বলতে পারো?


১৮.         কবরদের বাড়ি 


এই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেলেই সামনে আমাদের বাড়ি। বাড়ি গেলেই দেখা যেত মা বসে আছে জানালার পাশে।
এই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেলেই দেখা যায়, উদাসী এক প্রান্তর। মাঠের মাঝখানে কবরদের বাড়ি। সেখানে খেঁজুর গাছের ছায়ায় মা'কে বসে থাকতে দেখি না।

ঘরের এক কোনে দেখতে পাই ছোট কাঠের নামাজের চোকি
যার উপরে একপুরু ধুলো জমে আছে ,
পানের বাটাখানি পড়ে আছে কাঁচের আলমিরায়,
আলনায় ভাজ করে রাখা আছে জায়নামাজ
চশমার ফ্রেমটা জীর্ণ হয়ে পড়ে আছে তাকের উপরে,
চারিদিকে কেবলি অসীম শূন্যতা দেখি,  
আমি কেঁদে কেঁদে হেঁটে হেঁটে এই পথ দিয়ে ফিরে  চলে আসি।


১৯.       কবিতাবাস


কবিতার মধ্যেই একদিন সুখ খুঁজেছিলাম। 
সুখ পেতে যেয়ে কবিতা দিয়েছে বিষাদ ও
জীবনের পতন। 
ভেবেছিলাম কবিতায়ই আছে দীর্ঘ যৌবন 
অনন্ত শান্তিময়তা। 
কিন্তু সেই শান্তি কী কবিতার কাছে আমি  পেয়েছি?

এখন আবার চাচ্ছি সেই বাল্য সময় --- 
যেন কবিতাতেই সাজাতে পারি জীবনের সৌন্দর্য। 
কিন্তু সে সময় কী আমি আর পাবো ?

আজ এই ক্রাম্তি সময়ে লিখলাম কিছু পংক্তিমালা :

একদিন চন্দ্রালোকিত রাত্রির আকাশ
আর দিগন্তজোড়া জ্যোৎস্না দেখে সাধ হয়েছিল --
তোমার হাত ধ’রে সারা জীবনের জন্য হেঁটে চলে যাব নিরুদ্দেশের পথে ---
সেথায় যেতে যেতে মাথার উপরে ঝুলে পড়া আকাশ স্পর্শ করব মেঘের হাতছানি উপেক্ষা করে। 

প্রগল্ভতায় চলে যাব অনেকদূর। কখনও প্রেত অন্ধকার পার হয়ে
রাত্রির ভিতরে পরস্পরের হাত ছুঁব। 
তারপর হাজার বছর একসাথে বসবাস করে
সিদ্ধান্ত নেব -- আমরা একে অপরের হতে পারব 
কী না?


২০.        আমাকে দেখতে পাবে 


যখন ঝমঝম করিয়া বৃষ্টিতে ভিজিয়া সমুষ্ণ হইবে  ধরিত্রীর মৃত্তিকা, 
ভূবন জুড়িয়া বহিবে শীতল বাতাস, 
নদীর উপরে ছায়া ফেলিবে সন্ধ্যাকালীন মেঘ, বৃক্ষরাজির ভিতরে নামিয়া আসিবে অন্ধকার , 
তখনই আমি আসিব তোমার কাছে।

তুমি দেখিতে পাইবে -- দক্ষিণা বাতাসে রুক্ষ চরাচর
হইয়াছে মোলায়েম । 
মেঘ ভাঙ্গিয়া নামিয়াছে বৃষ্টি, জলে ভরিয়া উঠিয়াছে নদী। বৃক্ষপল্লব হইয়া উঠিয়াছে সবুজ । 
তখনই তুমি দেখিতে পাইবে আমাকে এইসব বহমানতায় --- বৃষ্টি, মেঘ, আকাশ, বাতাস, নদী আর বৃক্ষরাজিতে।


২১.         তখন অন্ধকার সময়


কাঠের স্লীপারে উপর বসে আছি, দূরে ট্রেন আসছে,
ঝিকঝিক.
লাইটপোস্ট নেই, আলো নেই,তারা ঢেকে আছে মেঘে
রেল পুলিশের সতর্ক বাঁশি বাজছে
পথ বেশ্যারাও ঘুরছে এদিক সেদিক-
সিগারেট হয় চুরুট, জীবনের অর্থ খোঁজে টানে টানে,
কুকুরেরও ঘর আছে শুয়ে থাকে আপন ঘরে শূন্য ইস্টিশানে,
মনে পড়ে দীঘির জলের কথা, জলের উপর খেলতো প্রজাপতি
মাছরাঙ্গা রাঙ্গিয়ে দিতো প্রাণ।

মা'র চোখে ঘুম নেই
তার খোকা পড়ে থাকে রেল লাইনের ধারে,
পাশেই মহুয়ার জঙ্গলে
জোনাকিরা আলো জ্বেলে খেলা করে-
আমার খুব ঘুম পায়
ঝিঁঝিঁর আলোর বিন্দুু এসে মুখে পড়ে
আমি তখন আকাশের তারা গুনি এক দুই তিন চার.....।

( রেল লাইনের পাশে এক নেশাখোর তরুণকে দেখে।)


২২.         পুষ্পস্নান


চপল ঢেউয়ের মতো এঁকেবেঁকে
পুষ্প কানন থেকে মাধবীলতা আসলেন 
হঠাৎ সজল বাতাসে উন্মুখ হয়ে উঠল এক ভ্রমর।

মাধবী তার পদ্মযৌবন পাপড়ি মেলে ধরলেন
কোনও বিষাদ নেই, সে যেন উতলা হয়ে আছে
বিস্মরণের এক রমণীর মতো।

বহুকাল পরে ভ্রমর যেন প্রাণ পেলেন মাধবীর পুষ্পিত দেহ বল্লরীর সৌরভে, এবং স্নাত হলেন
তার অন্তঃপুরের সকল ধারায়।


২৩.   ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু


এখন আর ভোরগুলোতে ধ্বনিত হয় না কোনও 
রবীন্দ্র সঙ্গীত। অলিন্দে বসে ডাকে না আর কোনও রঙ্গিন কাকাতুয়া। পৃথিবীর সব রোদ্রে ছায়া পড়ে আছে ধূসরতম সব মেঘরাশিতে।

তারপরেও জানালা খুলে খুঁজি জ্যোতির্ময় আলোর রশ্মি। যদি এসে তা চোখে লাগে, সেই আলোর ছ্বটা ভেদ করে আমার চোখ চেয়ে থাকে সুদূরের দিকে। আমি দেখি --সমান্তরাল পথ অনেক দূরে চলে গেছে বিন্দুর মতো।

পথ চলতে চলতে পথিক তুমি কী ক্লান্ত?
'পথে যদি পিছিয়ে পড়ি।' ----
'ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু।'


২৪.        কত যে মাধুরী


একদিন শুক্লপক্ষে নবমীর চাঁদ উঠেছিল আকাশে। সন্ধ্যা থেকেই উদ্বেলিত হয়েছিল মন। তোমাকে নিয়ে যমুনা তীরে যাব, না কবিতায় বেঁধে রাখব, সে কথা ভাবতে ভাবতেই চাঁদ ডুবে গেল। মাঝ রাতে হঠাৎ এমন আঁধার নেমে এলো যে,  এক উতরোল উৎসব সহসা কোথাও  থেমে গেল।

সেই আঁধারে তোমাকেই চেয়ে দেখেছি, তোমাকেই কাছে টেনেছি। তুমি আমারই হয়েছিলে -- কত যে মাধুরী দিয়েছিলে।


২৫.        হলো না 


তোমাকে নিয়ে গীতি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম হলো না
তোমাকে নিয়ে গানে সুর সাজাতে চেয়েছিলাম তা হলো না

কবিতার কোনো ছন্দে তুমি নেই
গানের  কোনো কথায় তুমি নেই

তোমাকে নিয়ে বাঁধতে চেয়েছিলাম ঘর তা  হলো না
তোমাকে নিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম স্বপ্ন তা হলো না

যদি মনে পড়ে আমায় কবিতায় এসো
যদি সুরে ভাসে প্রাণ তবে গানে এসো

তোমাকে নিয়ে তাজমহল গড়তে চেয়েছিলাম তা হলো না
তোমাকে নিয়ে গীতি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম হলো না।


২৬.        অথৈ 


বাড়িয়েছি হাত তোমাকে ধরব বলে 
বেদনা এসে ছেয়ে গেল আকাশ 
হাতটি আর ধরা হলো না যে ----
আমাকে তুমি দূরে ঠেলে দিলে।

দাওনি তুলে  হাত আমার হাতে
ডুবেছি যে অনন্ত অথৈ জলে 
জলের অতলে তুমি গেলে ডুবে
আমাকে তুমি একা করে দিলে।

এখন দুচোখে কেবলই ঘুম নেমে আসে
আকাশ যেন কাঁদে বৃষ্টির জল ঢেলে 
চাওয়াগুলো শূন্য হয়ে যায় হৃদঅন্তরে  
আমাকে তুমি অশেষ করে দিলে।


২৭.         অরুন্ধতি,অমরাবতি


অরুন্ধতি,অমরাবতি-  সবাই নিন্দা করে করুক
আমি তোকেই ভালোবেসে যাব
ঐ যে উজ্জ্বয়নীর পর্বতশৃঙ্গে শ্বেত-শুভ্র বরফরাশি
আমি ঐ বরফ জলে বার্তা পাঠিয়েছি তোর কাছে
তুই কি ভেজাতে পেরেছিস তোর উন্মাতাল ঠোঁট
নীল পাথরের বুক? নাকি পাষাণি তুই।

যন্ত্রণা যদি হয় হোক
ক্ষরণ যদি হয় হোক
অরুন্ধতি, অমরাবতি-  প্রাচীন সভ্যতার মৃত্তিকাতলে
সেখানে কেবলই পোড়ামাটির গন্ধ ভাসে
বনমল্লিকায় ভাসে শুক্লা একাদশীর চাঁদ
শরীর পোড়ে তার শুকনো ঘাসের উপর,
প্রাসাদের সমান দুঃখ সেখানে
উজ্জ্বল প্রখর দৃষ্টি টানে তোরই দিকে
নিন্দুকেরা যতো নিন্দাই করুক, আমি তো তোকেই
ভালোবাসি।

বেত্রবতীতে এখন আর সেই জল নেই
চোখের জলেও ঢেউ উঠে না ঈশাণের বাতাসে
কোশাম্বীর উপত্যাকায় নেই কোনো স্রোতধারা
ত্রস্ত জল পিপাসু হরিণের মতো তোকেই ডাকি
উন্মূখ দৃষ্টি মেলে দেখি তোরই আনত গ্রীবা
এখনো ঘুঙ্গুরের শব্দে মূর্ছণা হয় তোর পদধ্বনিতে।

অরুন্ধতি, অমরাবতি- নিন্দুকেরা যাই বলুক,
আমি তোকেই ভালোবাসি।


২৮.           একাকীত্ব ভঙ্গ 


সেই কবে একদিন প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়েছিল পৃথিবীর মৃত্তিকার উপর
সেই কবে প্রথম চাঁদ উঠেছিল --
সেই কবে প্রথম জ্যোৎস্নার কণা এসে লেগেছিল সমুদ্র শৈবালে,

সেই কবে প্রথম আগুনে পুড়েছিল সভ্যতা
সেই কবে প্রথম একাকীত্বের ঘুম ভেঙে 
কে আমার কাছে এসেছিল...


২৯.      চাই ভার্জিন


বন্ধুর জন্মদিনে ভার্জিন মেয়ে উপহার খুঁজিস !
ঘরে তোর বোন আছে দিতে পারবি তাকে ?
না,পারবি না,আমিও তোকে দিতে বলবো না
কারণ, আমি তোর বোনকে শ্রদ্ধা করি-

তোর ঐশ্বর্য আছে তুই নষ্ট করতে পারিস ভার্জিন
তোরও তো মা আছে, 
তুই একটা শুয়োর, একটা হারামজাদা
তোকে এসবের বাচ্চাও বলতে পারতাম, 
তা বলবো না
কারণ, আমি যে তোর মাকেও শ্রদ্ধা করি-

কার্তিকের কুত্তার মতো ভূগভূগ করিস লোকালয়ে
কিনতে চাস ভার্জিন ? স্পর্ধা তোর বাপেরও,
তোর সমস্যাটা কোথায় ? ঐ উত্থিত শিশ্নে ?
আয় তোকে বৃহন্নলা করে দেই, তোর বাপকেও-

সোনা আছে, ক্ষমতা আছে, বিচার কিনবি ?
ধর্মগ্রন্থ খতমও পড়াস, আবার মোনাজাতও হয়
কি বিচিত্র দেশ আমাদর ! মসজিদেও প্রার্থনা হয় !
শুয়োর, এসব করে পার পাবিনা, 
এ আমার বিশ্বাস।

( ফ্যাক্ট -- একটি স্বনামধন্য জুয়েলারি ব্যবসায়ীর গুণধর পুত্রের কাহিনি অবলম্বনে।) 


৩০.        রাত্রির বিভাস


যখন চলে যাব, তখন সবকিছু নিঃশেষ করেই চলে যাব 
আমার কোনও স্মৃতি কারোর যেন বেদনার কারণ না হয়, 
আমার অস্তিত্বের সুক্ষ্ম কুটোটিও যেন কোথাও কারও কাছে পড়ে না থাকে।
এই পৃথিবীতে আমার কিঞ্চিৎকর কিছুই নেই
যা ছিল তা শুধু সুন্দরতম কিছু মুহূর্ত।

সায়াহ্ন সময়ে পরিস্বচ্ছ কিছু আশাবোধ থাকে 
আবারও যদি আমার কুসুমপুরের মাটিতে জন্ম হতো সেই একই মায়ের কোলে, 
আমার পার্থিব দেহ জুড়ে পড়বে শুধু প্লাবিত জ্যোৎস্না রাত্রির বিভাস।


৩১.        প্রণয় কথা


নির্বোধ অনুভূতির ভিতর তুমি এখনও দীপ্ত
এখনও সিক্ত হয় চোখ অশ্রু বিন্দুতে
সব প্রেম ছিল অনর্থক, হে অবুঝ বালক!

সাঁঝের তারার মণিকিরণের মতো এখনও উজ্জ্বল তোমার মুখ
এখনও আকাশমণি গাছ থেকে বিষণ্ন পাতা ঝরে পড়ে,
অপরাহ্ণের অস্তমিত সূর্যের নীচে এখনও ঝলমলিত কতো প্রণয় মুহূর্ত।

আবার তুমি দাঁড়াও এসে কোনও পথের বাঁকে ক্লান্ত চরণে, 
আবার যদি তুমি এসে সাজাও এলমেল অশ্রুত এই সংসারে।

নিরর্থক আশা এখনও এই নির্বোধ বালকের।


৩২.     ঋদ্ধতা


আমার হৃৎস্পন্দন প্রথম কেঁপে উঠেছিল
তোমার প্রাণ স্পর্শে, সে কী প্রাণোচ্ছ্বাস! 
তুমি প্রথম আগুন জ্বালালে এক  হেমন্ত রাতের 
মধ্য প্রহরে, সেই আগুনে পুড়েছিল 
সবুজ শ্যামল শস্যের মাঠ,
তারপর একদিন- শ্রাবণের মেঘে বৃষ্টি ঝরল
মুঠো মুঠো প্রেম ছড়িয়ে গেল দিক দিগন্তে, সেকি হৃদয় আকুল করা প্রেমোচ্ছাস! 

আমরা ঋদ্ধ হতে পেরেছিলাম দীর্ঘ সহযাপনের পর
পোড়া মাটির শুদ্ধতার মতো আর মেঘ ও জলের স্বচ্ছ স্রোতধারায়।


৩৩.       মেঘ বৃষ্টির গল্প 


আমার আকাশে এখন মেঘ। এই মেঘকে তোমার
আকাশে পাঠিয়ে দিতে চাই 
সব মেঘ জল হয়ে আমার এখানেই ঝরে পড়বে
ঘর অন্ধকার হয়ে আসবে, সেই অন্ধকারে আমাকেই একাকী বসে থাকতে হবে-- এ আমি চাই না।

তুমি জানালে, তোমার আকাশেও নাকি মেঘ !
তুমিও নাকি বসে আছ অন্ধকারে একাকী--
তুমিও তোমার মেঘকে আমার আকাশের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছ।

তোমার মেঘ আমার মেঘে এসে মিশে গেল
মেঘে মেঘে ঘর্ষণ হলো, বজ্রপাত হলো--
তারপর বৃষ্টি নামতে লাগল।

এ দিক থেকে আমি ঘর হতে বেরিয়ে পড়ি, ও দিক থেকে তুমি
পথের মাঝখানে আমাদের দেখা হয়
আমাদের শরীরের উপর ঝরতে থাকে অনবরত জল
সে জলে ভিজে দু'জন চুপসে একাকার হয়ে যাই।


৩৪.        এ গান নহে


যদি  দখিনা বাতাস  আসে ঘরে
আনমনে বসে থেক  দুয়ার খুলে
সন্ধ্যায়  হাস্নাহেনা পড়বে ঝরে।

হয়ে যেওনা তুমি  একলা পাখি
শিশির ফোটায় ভিজিয়ে আঁখি
রেখ আমায় বুকের মায়াডোরে।

মাধবীরাতে  সুর উঠুক গানে
প্রেমদোলায় দুলুক দুটো প্রাণে
ফুরিয়ে যাবে রাত  সুরে সুরে। 

তোমার অফুরন্ত  কর্ম অবসরে
ভালোবাসা ভরিও উজার করে
বাঁধিও আমায় চিরকালের তরে।


৩৫.        ভোরের বৃষ্টি 


সকালে বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এমন বৃষ্টিতে জেঁকে ঘুম আসার কথা। কিন্তু ঘুম আর এল না। ঘুম এলে হয়ত সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখতে পারতাম।

জানালা দিয়ে দূরের ভেসে যাওয়া মেঘ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, জীবনে কতোকিছুই হতে চেয়েছিলাম। কী ই-বা হতে পারলাম। কোনও কিছুই তো হতে পারিনি।

কোনও কিছু হতে না চেয়ে যদি নিঃসঙ্গ জীবন চাইতাম।  সংসারহীন, বন্ধুহীন, উন্মুল উদ্বাস্তু জীবন। যে জীবনে কোনও মর্মবেদনা নেই। 

যৌবনের একটা সময়ে বাংলাদেশের কতো পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়েয়েছি। কত শহর কত জনপদ। কত বিচিত্র জীবনের সান্নিধ্য পেয়েছি। কত সব অদ্ভুত মানুষ।

কতসব ভাবতেই ভাবতেই বৃষ্টি থেমে গেল। এমনভাবে  বৃষ্টি থেমে গেলে মন খারাপ হয়ে যায়। আজও হলো।


৩৬.        প্রজাপতির গান  


তোমাকে বুকে জড়ালেই মেঘ গুরুগম্ভীর হয়ে 
ওঠে আমার আকাশ, ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে
যমুনার জলে ঢেউ বেগ পায়
কাশফুল চন্দনের মতো লাল হয়ে যায়।

তোমার বুকের তিলকেও লাগে শিহরণ
মেঘে মেঘে উড়তে থাকে খয়েরি ডানার চিল
ঝাউ পাতার মতো এলোমলো হাওয়া এসে
তোমার শরীরকে মুগ্ধ করে।

বৃষ্টিতে লতা গুল্ম বৃক্ষ ফুল তখন প্রস্ফুটিত হয়
বাগানের ফুল ছিঁড়বার সময়ে আমি
প্রজাপতি হয়ে উঠি-
তুমি তখন সেই প্রজাপতির গান শুনতে থাকো ।


৩৭.       মায়ার টান


এই পৃথিবীতে এসে দেখলাম নদী, সাগর, চন্দ্র সূর্য, গ্রহ,তারা-
দেখা হলো তোমার সাথেও -
সে এক অদ্ভুত মায়াময়ী তুমি। 

জীবনকাল জড়িয়ে থাকলে তুমি প্রগাঢ় ভালোবাসায়,
ছাড়তে ইচ্ছা করে না, এই পৃথিবীর মায়ার মতো
সে এক অপার্থিব টান।

কিন্তু ভালোবাসারও মৃত্যু হয়,
যেমন করে চলে যেতে হয় এই পৃথিবী থেকে
সেই প্রথম ক্রন্দন ধ্বনির মতো
অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে।


৩৮.    নদীর সাথে অভিমান 


শ্রাবণ জ্যোৎস্নারাতে
বহুদিন এই গ্রাম থেকে ঐ গ্রামে
গোপনে নৌকা নিয়ে ঘাটে ঘাটে ঘুরেছি
দেখেছি কত উপচে পড়া জল ---
আর নদীর  স্রোতবক্ষে ভেসেছি সারারাত।

সব ঘাটই জলকে কাছে টেনেছিল, 
আমাকে নয় --
নদী আর আমাতে ছিল যত অভিমান।


৩৯.       অমরতা 


আজ যদি আমি চলে যাই
কাল কী কেউ রাখবে মনে,
কাল থেকে কেবল স্মৃতি আমি 
কেউ কী রাখবে স্মরণে।

এই  পার্থিবে জড়িয়ে রবো না
কারোর জীবনে
ফিরে আসব না আর কখনও 
নিঃশব্দ চরণে।

আমি থাকব না, থাকবে না
আমার দেহ ও করোটি -
স্বপ্নগুলো থাকবে কেবল
গল্প ও কবিতার ভিতর।


৪০.        প্রিয় বাংলাদেশ   

                                                            কেমন যেনো গুমোট বদ্ধ লাগে। 
কেমন যেনো দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অস্থির লু হাওয়া
যা লিখতে চাই তা লিখতে পারিনা, ভয় পাই-
একটি চাপাতি ধেয়ে আসে আমার দিকে, কিংবা ৫৭ ধারা
মেয়ের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতেও ভয় পাই
মনে হয়, বোমার আগুনে দগ্ধ হয়ে যাবো !

এ রকম মন খারাপ হলে আগে বাড়ীতে চলে যেতাম
মা'র কাছে গেলেই মন ভালো হয়ে যেতো
এখন মা'ও নেই
স্নিগ্ধ সুবাতাস নিতে পারিনা ধানক্ষেতের আলে দাড়িয়ে।

এই শহরেই আছি,
যাবো কোথায় ? কোন ভিন্ দেশে ? এই শহরেই তুমি থাকো
ঠিকানা একটাই, ঐ লাল সুবুজের ছায়ার নিচে ঘুমিয়ে থাকি-
প্রিয় বাংলাদেশ।


৪১.       স্বপ্নচরাচর


---- 'কাল রাতে রাতের রঙে ফুল হয়ে ফুটেছিলাম তোমার কাননে, তুমি তার সৌরভ নিলে রাতভর।
তুমি বিমুগ্ধচরের মতো বিবস হলে তখন ---
আমি কী মক্ষিকা হতে পেরেছিলাম?
নাহ, এসব কোনোভাবেই কোনো স্বপ্নচরাচরের কথা নয়। '

---- আমিও বলিনা, এটা কোনো স্বপচরাচরের ঘটনা ছিল।


৪২.        গান শোনাও


চারদিক থেকে শূন্যতার ধবনি ভেসে আসে
কেমন হাহাকার আর কান্নার শব্দ
একটা গান শোনাও-
যেন মৃতেও শোণে সে গান
যেন কবরেও পৌঁছে সে গান
যেন থেমে যায় দূরাগত ঐ কান্নার ধ্বনি।

যে চুম্বন তোমাকে আমি দিয়েছিলাম
তা তূমি ফিরিয়ে দাও আমার ঠোঁটে
যে জল ফেলেছিল আমার চোখ
তা তুমি তুলে নাও তোমার চোখের বৃন্তে।

একটা গান শোনাও-
যে গান শুনে ভালোবাসা এসে থামবে
আমার মনের কোণে।


৪৩.        নিদ্রাবতী 


আজ কোনো কথা নয়
যদি ওঠে নবমীর চাঁদ, মায়াবতী তোর ভ্রুকুটী প্রেমময়
ঘুম এনে দেবে এই স্বপ্নময়ী রাত।

সেই কবে থেকে ঘুম নেই,
দূর প্রান্তরে মরিচীকার ছায়া, স্বপ্নের কথা বলি যেই
ছড়িয়ে দিস তুই ভালোবাসার ঘাত।

তারপরও তোকে ভালোবাসি
বিনিদ্র রাতের দুপুরে করি শোক, দুঃখ দিস তবুও
তোর কাছে আসি
তোর দিকেই বাড়িয়ে দেই দুই হাত।

আর কোনো কথা নয় মায়াবতী,
আসবেই নিদ্রাবতী রাত , তুই হবি তখন অমরাবতী
সেদিনও উঠবে এমনি নবমীর চাঁদ।


৪৪.          জ্যোতির্ময় করো


আমাদের পদচারণায় চঞ্চল হয়ে উঠিছিল
অরণ্যের বৃক্ষাদি
পল্লবিত হয়ছিল সবুজে শ্যামলে
মধ্যহ্নের সূর্য রশ্মিতে তপ্ত হয়েছিল পর্বতমালা
জলপ্রপাত বেগ পেয়েছিল পাথরে পাথরে
ঝর্নায় স্নাত হয়ে শীতল হয়েছিল দেহখানি।

এখনও সবুজে মাতাল হয় অরণ্য, এখনো উষ্ণ হয়
সেখানকার পাহাড়
এখনও বহে নির্মল বাতাস
এখনও জলপ্রপাতের জলে স্নান করে অনাগত মানুষ
এখনও ঝর্নাধারায় জল ঝরে অবিরত।

এসো আমাকে আলিঙ্গন করো ঐ নদীর মতো
জড়িয়ে ধরো ঐ সাগরের মতো
মিশে যাও ঐ মোহনার মতো
চুম্বন দাও মাতৃক্রোড়ে ঐ দেবশিশুর মতো।

এসো বাহু বন্ধনে-
এসো জ্যোতির্ময় করো ঐ সূর্যের মতো।


৪৫.      তার কানে কানে


যে কথাটি বলা হয়নি মাধবীর কানে
সেই কথাটি বলব
তোমার কানে কানে
যে সুর তুলতে পারিনি আমার এ গানে
সেই গান গাইব তোমার প্রাণে প্রাণে।

মাধবী চলে গেছে এক মাধুরী রাতে
হৃদয়টা নিয়ে গেছে
শূন্য করি আমাতে
যে নদী বেঁকে গেছে দূরের মোহনায়
সেই সুর থেমে গেছে অ্সীম মায়ায়।

যে পাখি উড়ে গেছে নীলিমার পানে
সে পাখি আসেনি
আর বসন্তে গানে
বেহালায় সুর বাজে আজও প্রাণে প্রাণে
সেই কথাটি বলিনি তারই কানে কানে।


৪৬.     প্রথম দেখা 


আমাদের প্রথম দেখার দিনে যে বাঁশি শুনেছিলাম, 
সে বাঁশিতে আনন্দধ্বনি বেজেছিল,
আমাদের প্রণয়ে যে জ্যোতির্ময় আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল তা ছড়িয়ে গিয়েছিল বিশ্বলোকে,
কেতকী বনের শালমঞ্জরীর উতল হাওয়ায় ময়ুুরীরা সেদিন নৃত্য করে উঠেছিল,
আমরা মিশে গিয়েছিলাম নির্জন বনতলে মর্মরমুখরিত জোছনা রাত্রির বিহবলতায়।

তারপর আমরা পৃথিবীর শঙ্কুল পথ ধরে হেঁটে হেঁটে চলে এসেছিলাম আমাদের এই মায়ার সংসারে।


৪৭.       নির্জন পরশমণি


ধূসর মেঘের সাথে হাওয়ার রাত
অলৌকিক জলে ভিজে মেদুর হয়েছ
আজ তোমার অগণন চুম্বন গুলো দাও।

এই রাতে কোনো বিষাদ রেখ না
রেখ না খেদ
আজ শ্রাবণ মেঘের অফুরান নেশা
রাত্রি কখনোই ভোর হবে না।

প্রস্ফুটিত শরীর খুলে খুলে দাও
একান্ত ঐশ্বর্যগুলি উৎসর্গ করো
নির্জন পরশমণি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দাও
আমাদের কোনো অপূর্ণকাল নেই।

৪৮.    গোপন তুমি 

তোমাকে রেখে দেই আমার কবিতায় 
কেউ তা জানে না 
তোমার কথা বলে যাই আমার গল্পে
কেউ তা বোঝে না 
তোমাকে দেখি চোখের কোঠরে রেখে  
কেউ তা দেখে না
তোমাকে সযতনে লুকিয়ে রাখি হৃদয়ে 
স্পন্দন কেউ শোনে না
তোমার মুখের  ছবি আঁকি বিমূর্ত করে 
কেউ  তা চেনে না

একটা ম্যাগপাই এসে বসে অলিন্দে 
শীশ কেউ শোনে না 
কত কবিতা কত গান কাটাকুটি করি
ছন্দ কখনও মেলে না
তোমার অস্তিত্ব সর্বত্র তরঙ্গায়িত হয়
কেউ উপলব্ধি করে না 

তোমার ঘুম নির্ঘুম আশা নিরাশা বেদনা,
তোমার মৃত্যু - আমিই শুধু বুঝতে পারি-
আর কেউ না।


৪৯.        হিবিজিবি স্বপ্নের কথা


পৃথিবীতে এমন কেউ একজন থাকে
যে জীবনেও থাকে মরণেও থাকে। যাকে দেখতে পাই বহু যুগের ওপারে ---
কত স্বপ্ন নিয়ে সে পড়ে থাকে, কতো জীবনের স্মৃতির জীর্ণ স্তুপে।    

বহু কালের একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনার জন্য কান পেতে থাকি। ফিরে যেতে থাকি সেই অতীত বিন্দুতে, যেথায় অসংখ্য স্বপ্ন নিয়ে কেউ একজন বসে থাকে দু’হাত বাড়িয়ে।

সব হিবিজিবি লেখার পাতাগুলো সরিয়ে বিনম্র চোখ সেই একটি পাতা খুঁজতে থাকে
যেখানে তার অনেক স্বপ্নের কথা লেখা থাকে ---
আমি নির্লিপ্ত দু'চোখ মেলে দেখি তা।


৫০.       ভালো আছি, ভালো নেই 


সবকিছুই কেমন যেন ভুলো ভুলো 
সব রং কখন আবির হলো
কবে কখন কাকে বুকে জড়িয়েছিলাম
কার বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলাম
পাঁজরেই কি ঠাঁই ছিল!
চুম্বনেই কি বাঁধা ছিল? 
সব নিয়ম যে ভুল হলো 
রাতটাও দেখি শেষ হয়ে গেল।

সকালে তোমার চুলের গন্ধ ভাসে
ভালোবাসার সেই আবেশ আসে 
কখন যে সবকিছু নিয়ে গেল সেই 
ভালো আছি,আবার ভালো নেই।


৫১.       অবগাহনের সময়


আমরা হাত ধরে চলে যাই ধূঁ-ধূ মাঠের প্রান্তরে
সেখানে মধ্যরাতে আদিগন্ত শূন্যতার বুকে
জ্যোৎস্নার প্লাবন নামে।
অসংলগ্ন শরীরময় লতগুল্ম ঝিঁঝি পোকারা জড়িয়ে ধরে 
ঘর হয়ে যায় নির্ঘর, তখন নদীও যেন কাছে টানে,
নেমে পড়ি জলে,
অবগাহনের সময় ঘরে ফেরার কথা আমরা বেমালুম  ভুলে যাই।


৫২.        রক্তাক্ত দোলনচাঁপা 


সেই সব কুমারী মেয়েরা করে যায় ভুল,
তারা জানেনা তাদের বিষয় সম্পদ কতো দামি 
কেউই জানেনা হীরক খন্ড কি 
তারা জানে কেবল সমুদ্র বেসাতি, 
তারা জানে ঝিনুক থেকে কিভাবে মুক্তা হয়
তারা সমুদ্র কন্যাও।

দু’চোখ নাশপাতি তার, ঠোট-দু’টিতে কমলার রং মাখা
বুকে তাদের মহূয়ার গন্ধ 
পাশ ফিরে শুয়ে থাকে তপ্ত আগুন হয়ে বালুর উপরে 
দারুচিনিও ভস্ম হয়, দেহটি কোথায় পড়ে থাকে
কোনও ভাবে জানল না তো কেউ
খুঁজেছিল তারা সমুদ্রপাড়ে কুমারীদের আত্মার ভিতরে,
শুক্তির ভিতরকার শুভ্র মুক্তার জন্য গাইত যারা গান।

দোলনচাঁপার মাঠে তাকে তারা খুঁজেছে অনেক
যেখানে আগের রাত থেকে পড়েছিল অন্তর্বাসের ছেঁড়া ফিতা, একখানি চপ্পল আর চাপচাপ কিছু  রক্ত!


৫৩.      প্রতিক্ষা


কত দূরের পথ যেতে চাইলে বলে যেতে হয়
কত দূরে চলে গেলে কারোর প্রতিক্ষা করতে হবে না,
সোনাজঙ্গ পাখিরা উড়ে চলে যায় বহু দূর --
তারা কী কাউকে বলে যায়? বরফ দেশে যেয়ে
তারা হিম হয়ে থাকে।

নদী বেগে ধেয়ে যায়, তার আঁকেবাঁকে স্রোতের 
ধারা থেমে থাকে না --
কত দূর দেশ, কত মৃত্তিকা ভেঙ্গে, অথৈ সাগরে মিলে যায়, সে নদী কী কাউকে কিছু বলেছিল?

বর্ষার সুগন্ধি ফুল ফোঁটে, সে ফুল ঝরে যায় 
রোদ্রের উত্তাপ মেখে, সেও বলে না তার ঝরে 
যাবার মর্মবেদনার কথা।

কোথাও কোনো পথে ধূলোটি নেই, সব পরিপাটি, সব মসৃণ মখমলে,
সেই পরিচ্ছন্ন পথ ধরে সে যে কবে চলে গেছে 
অনন্ত পথে -- বলে যায়নি তা কাউকে,
তার জন্যেই যে আমি আজও চিরপ্রতিক্ষায় আছি।


৫৪.        আমার সর্বত্রে তুমি


কতকাল ধরে তোমাকে দেখতে পাই না
কত ঘুমহীন রাত্রি নিশীথে
কত অনন্ত নক্ষত্রবীথির ভিতর চেয়ে থাকি
সেথায় কালকূটের পাশে অরুন্ধতি সর্বগ্রাসী একা।

কত চেয়ে থাকায় আকাশ বিদীর্ণ হলো না 
কত অন্ধকার এসে দুচোখ ঢেকে দিল।

যেথায় তুমি চলে যাও নাকো
আমার সকল আলোয় তুমি ঢেকে থাকো
কত অসীম বেদনায় তোমাকে খুঁজে ফিরি
উটের চাহনির মত সর্বত্র দিগ দিগন্তে।

কত হাসনাহেনা ফুটল হেমন্ত রাত্রি প্রহরে
কত মঞ্জুরিকা ঝরে গেল শান্ত ভোরে
আমার সকল নিঃসঙ্গে তুমি যাপিত থাকো।

যেথায় যত দূরেই যাও যত আঁধার সীমান্তে
তুমি রয়ে যাবে সর্বত্রে আমার অন্তর প্রান্তে।

-----------------------------------

( এই কবিতাটি বন্ধু নেয়ামুল বারীকে 
উৎসর্গ করলাম।)

১৩/৮/ ২০১৯ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা


৫৫.        কেমনে প্রকাশি...


হৃদয়ের রক্ত দিয়ে রক্তজবা ফুল ফুটিয়ে রেখেছি, 
ওগো তুমি এস তোমার সকল মায়ায়,
এক'পা দু'পা চরণে এস-- উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি মেলে দেখ গো আমায়... 
নাও তোমার ফুল, দাও তোমার কনকচাঁপার বুক, ডোরাকাটা ঠোঁটের  চুম্বন রাশি রাশি...
অবগুণ্ঠন খুলে দ্বিধাহীন  তুমি বলো -- ভালোবাসি ভালোবাসি।


৫৬.         আমার স্বপ্নেরা


একসময় তুমি মেঘনাপাড়ের মেয়ে আমি মেঘনাপাড়ের নেয়ে পড়তে যেয়ে মন চঞ্চল হতো , রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা পড়তে পড়তে চেঙ্গী ভ্যালীর পথে পথে খুঁজে মরতাম এক লাবণ্যকে, কিন্তু অমিত আধারকার হয়েই রয়ে গেছে।  

আমি এখনো রয়ে গেছি জীবনানন্দের একাকী এক শঙ্খচিল, ভোরের শিশিরে ভেজা ঘাস, ধূসর পান্ডুলিপির অস্পষ্ট অক্ষর হয়ে , নির্ঘুম চোখে এখন আর কোনো স্বপ্ন নেই , বুদ্ধদেব-বিষ্ণু-সমর সেনদের মতো কবিতা লিখতে যেয়ে হারিয়েছি অনেককেই।

সেদিন সবই ছিল, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ছিল, ভালোলাগার ঘোর ছিল, ভালোবাসার আকুলতা ছিল, মৌনতার দুঃখ ছিল, এখন আর কোনো কিছুই নেই। আমার স্বপ্নেরা মৃত হয়ে গেছে অনেক আগেই।


৫৭.     একাত্মা 


তুমিও জানো আমিও জানি-- নদী কীভাবে আকুল হয়ে  সাগরে মেশে
সাগরও জানে নদীও জানে-- কীভাবে কাছে টানতে হয় ভালোবেসে।
তারাও জানে চাঁদও জানে -- কীভাবে আলো ঢালতে হয় পৃথিবীর উপরে
রাত্রিও জানে ভোরও জানে -- কীভাবে শিশির ঝরাতে হয় ঘাসের 'পরে।
আকাশ জানে মেঘও জানে -- কীভাবে  বৃষ্টি নামাতে হয় শীতল জলধারায়
মুক্তাও জানে শুক্তিও জানে -- কীভাবে ঝিনুকের বুকে জড়িয়ে থাকতে হয়
রূপকথা জানে গল্পও জানে -- কীভাবে লেখা হয়ে যায় অমর প্রেম কাহিনি 
হৃদয়ও জানে শরীরও জানে --  কীভাবে একাত্মা হতে হয় মদিরায় মোহিনী।

কেউ না জানুক আমরা জানি -- কে কাকে কতটুকু চির মমতায় ভালোবাসি 
তুমিও জানো আমিও জানি  -- একজন ছাড়া আরেক জন অকূলে ভাসি।


৫৭.       রূপকথার রাজপুত্র


সোনা মেয়ে, কেন তুমি রাগ করো অসময়ে
কেন তুমি সঁপে দিতে চাও পাংশু দেহ।
চোখে কাজল নেই, 
মুছে ফেলেছ তা বহু রাত জেগে। 

কোন্ দুঃখে তুমি বিপথে যেতে চাও? 
এক রাজকন্যার রূপের হাসি
কবে ডুবে গেছে মেঘলোকের অন্ধকারে
এখন আলোহীন নিভু নিভু নক্ষত্র তুমি।

তোমার চোখ তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণ গহবরে
খোঁজো সেখানে জ্যোতির্ময় কাউকে 
আমি নেই সেখানে।
আমি কারোরই নই , নই তোমারও --
রূপকথার রাজপুত্র দূরের কোনও ভুবনের।


৫৮.       আনন্দ কাব্য


এই বিশাল মহাজগতে ছোট্ট এ পৃথিবী, তার মাঝে ক্ষণিকের এই জীবন--
সেই ক্ষণকালের জীবনটিকে আমি আনন্দে ভরে রাখি।
আমি জানি, জগতের বুকে দুঃখই বেশি।
এই ঝলমলে রোদ, 
এই পাখির কলকাকলি, 
গাছের পাতায় হাওয়ার দোলায় এই ঝিরঝির শব্দ, রিমঝিম বৃষ্টির গান
নদীর পাড়ের শীতল বাতাস
ভোরের খোলা হাওয়ায় বুকভরে শ্বাস নেওয়া --- 
এসবই আমি উপভোগ করি। এর মাঝেই জীবনের আনন্দ।


৫৯.      ভালোবাসা কারে কয়


তুমি বঙ্গোপসাগরের লোনাজল, 
নাকি পলিমাটি মিশানো যমুনার স্রোতধারা? 
তোমার প্রেম শীত না বসন্ত, নাকি নাতিশীতোষ্ণ!
সবকিছুই দ্বিধায় ঢেকে রেখেছ। 

নাকি ভালোবাসা এই রকমই --
যেমন তুমি আবক্ষ জলে নামলে শীৎকার করো
আবার ডাঙ্গায় তপ্ত রোদ্রে ছটফট করো 
তোমাকে কাছে টানলেই সমস্ত মেঘ
জল হয়ে ভূবন ভাসে।

আবার তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখলে 
সমস্ত দীর্ঘশ্বাস ঝড় হয়ে যায় ঈ্ষাণ কোণে
তুমি আগুন হয়ে জ্বলে পোড়া মাটি করো 
আবার জল হয়ে নদীও হয়ে যেতে পারো।

তোমাকে ভালোবাসতে কোনো দ্বিধা নেই
তুমিই শিখিয়েছ কিভাবে ভালোবাসতে হয়
তুমি শিখিয়েছ, ভালোবাসা কারে কয়!


৬০.         বাসনা কুসুম 


আমার এই জীবনে তুমি একমাত্র রমণী
তুমিই একমাত্র সহচরী কিংবা রাজ রাজেশ্বরী
যে তুমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছ আমার পাশে,  
ময়ুরের পেখম মেলে কথা বলি তোমার সাথে প্রাগৈতিহাসিক ভাষায় --
যেন রাত্রিও সচকিত হয়ে ওঠে।  

তুমি কখনো হতে পারোনি সম্পূর্ণ রমণী
কোনো বসন্ত শেষ করতে পারোনি
হয়ে থাকলে বাসনা কুসুম --
কত রাত শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে রুমাল বানিয়েছি
কত রাত দাবা খেলায় রাণীর  হেরে গেছে 
ধাবমান অশ্ব ক্ষুরে, সৈনিকের তলোয়ারের খোঁচায়। 

জীবন ফতুর হয়ে গেল
সব আয়ুস্কাল ভাঙ্গা প্রদীপের নীচে নিভে গেল
এ এক দুঃসহ ক্লেদ আমার --
একটি রাজ্যও এখনো জয় করতে পারিনি।






বুধবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০২৩

লোহিতকিরণচ্ছটা (অণুকবিতা গ্রন্থ)

লোহিতকিরণচ্ছটা

(অণুকবিতা গ্রন্থ)

উৎসর্গ -
সহপাঠী বন্ধু রবীন্দ্রনাথ অধিকারী, 
তুমি কবি হতে পেরেছ, আমি পারিনি। 

১.

ঝড় আসে, ঝড়ে উড়ে যায় পথের ধুলো
নির্ঝরে পাতা ঝরে, চৌচির হয়ে যায় সবুজ বৃক্ষ।
এই চরাচরে ধুলো উড়ে, পাতা ঝরে
রৌদ্র ক্লান্ত দুপুর শেষে বড়ই ম্রিয়মাণ আমি।

যদি কোনও রক্তিম আভার সিক্ত সন্ধ্যায়
তুমি আসতে আরক্ত দেহ সাজে, মোহনীয় করে দিতে পারতে উদ্বেলিত সকল মুহূর্ত!


২.


আমার যে প্রেম তুমি চেনো, আমার যে দেহ তুমি ভালবাসো, শরীরের যে পথঘাট অলিগলি তোমার মুখস্থ -- সেখানে যদি বিদায়ের মূর্ছণা বেজে ওঠে, যদি আর না থাকি।

দিগন্ত জোড়া হলুদ মাঠে কোনও বটবৃক্ষ তলে নিঝুম দুপুরে কোনও রাখাল বালক বাজায় বাঁশি, যদি গায় লালনের গান, মনে করো -- তার সেই গানে আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।

৩.

স্বর্গের লোভ দেখিও না, পৃথিবীর কথা বলো,
হুর অপ্সরাদের শরীরী মদিরার কথা বলো না,
লোভ দেখিও না তাদের উত্তপ্ত স্পর্শের।
মায়া দাও, মমতা দাও,
ঘৃণা যন্ত্রণাও দিতে পারো। আমি দুটি প্রাণের সৃষ্টি উল্লাসের কাঙ্গাল।

৪.

কাল রাতে তোমার পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়,
তুমি থাকলে শব্দ হয়, না থাকলে নৈঃশব্দ।
কাল রাতে দেখি রাত-ঝুম-ঝুম বৃষ্টি, তুমি থাকলেই বৃষ্টি হয়,
না থাকলে মেঘ।
রাতের শেফালীকে ঘুমিয়ে যেতে দেখেছি-
তুমি ঘুমিয়ে থাকলেই আমাকে জেগে থাকতে হয়
সে এক ঘুমহীন,স্বপ্নহীন, দুঃসহবাস।

৫.

ভালোবাসা হোক পুণ্যে স্নাত।
তুমি আমাকে দগ্ধ করো।
মেঘমল্লার আকাশকে বলি, তুমি বৃষ্টি ঢেলে দাও --- নিভিয়ে দাও দহন।
নদীকে বলি, তুমি ভাসিয়ে নিয়ে যাও
শঙ্খনীল সাগরে।

৬.


অস্তরাগের সন্ধ্যায় তুমি এসো-
ধান ধুপে জ্বলবে প্রদীপ, জ্বলবে তারার বাতি
তারপর দোঁহা জ্বলব রাত ভর
কেউ নেভাতে আসবে না, ছাই ভস্ম হবো বর্বর আদি অনলে।

৭.

বলো, আর কত আঁধার হওয়া আছে বাকি?
আর কত আঁধার হলে জ্বলে উঠবে জোনাকি
আলো হবে, আলো আসবেই তোমরা শোনো
মানুষ আঁধারে থাকবে তাই কী হয় কখনো?

৮.


সারারাত টুপটাপ ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল ঝরেছে, নাকি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কোথাও কেউ কেঁদেছে।
কে জানে?

কে কোথায় কাঁদে, কে কোথায় চোখের জল মুছে
তার খবর নেওয়ার কে আছে।

তোমাকে ছেড়ে সেই কবে চলে এসেছি
বিচ্ছেদকালীন সে কান্নার জল এখনও চোখে লেগে আছে।


৯.


করোনাকালীন কবিতা-

তুমি নও
তোমার ছায়া পড়ুক আমার প্রাণে
স্পর্শ নয়
তোমার চেয়ে থাকা তান তুলুক আমার গানে।

এখন একটু দূরেই থাকো--

আবার একদিন
বকুলঢাকা বনে হাঁটব দুজনে
আবার একদিন
শ্রাবণআকাশ নীলাদ্রি হবে হৃদ স্পন্দনে।


১০.


কত পথ কত প্রান্তর, কত বন্দর কত লোকালয় ঘুরেছি,
কত অন্ধকারে চোখ রেখে এতকাল যাকে খু্ঁজতেছিলাম --
আর তারই কী-না দেখা পেয়ে গেলাম সিরাজগঞ্জের জামতৈল স্টেশনের কাছে এক নির্জন শ্রান্ত শান্ত কুটীরে।


১১.


কত অন্তহীন পথ হেঁটে এসে শেষে দাঁড়ালাম তোমার দ্বারে। আমি পানি চাইলাম।
তুমি দেখালে নদী। এত জল কার?
এত ঝিনুক সেখানে। জলে নামতেই দেখি, শ্যাওলাদামের ভিতরে অসংখ্য মুক্তা।

স্রোতে ভেসে যাই। ডুবে যাই।
আমার কোথাও কূলও নাই, কিনারা নাই।


১২.


গল্পে কেউ থাকে কেউ থাকে কবিতায়
কেউ থাকে জনম জনম
কেউ হয় ক্ষণিকা
কেউ থাকে মেঘে ঢেকে
কেউ আবার নদী হয়ে অকূলে যায় ভেসে ।


১৩.


যত দূরেই যাই, থাকি তোমার কাছেই
চোখে চোখ পড়ে না, তোমাকে ছুঁয়েও নেই,
কিন্তু তোমাকে ছুঁয়ে আসা মেঘেরা বৃষ্টি
ঝরায় আমার উপরেই।


১৪.


কোথায় চলে যাবে? কোন্ পথ দিয়ে।
সব পথে পথে কবিতা লিখে এসেছি।
আমার কবিতাই তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে আমার ঘরে।


১৫.


পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে থাকা বিষাদগুলি
আনন্দে রূপান্তরিত হয়ে চলে গেল
ঐ শেষ অস্তরাগে।
দূরে ছড়িয়ে থাকা মেঘকণাগুলি অশ্রু হয়ে উড়ে এল আমার চোখের 'পরে।


১৬.


চিরদিনের আকাশ চিরদিনের জোৎস্না
কুসুমপুর থেকেই দেখা যায়। গীতিগন্ধ ভরা দখিনা বাতাস,
ঝরে পড়া শিমুলের মাতাল সুবাস, কুসুমপুর গেলেই পাওয়া যায়।

সেখানে হিজলের বন আছে, ঝুমঝুম নদী আছে
সেখানে সমির আলী আজো গান গায়
ভাটিয়ালি মনহরা,
আমার কুসুমপুর গাঁও, সবসময় চির বসুন্ধরা।


১৭.


বহু বছর আগে এই বঙ্গেতে এক কবি জন্মেছিল। যমুনা কূলে ছিল তাঁর নিবাস। মৃৎপাত্রে লাল মাটি গুলিয়ে বাঁশের শলা দিয়ে তালপাতার উপর সে কয়েকটি চরণ লিখেছিল।

আমার আঙিনাতে আন্ধার কেনে
তোমার হেথায় যে চান্দের আলো ।।
আমার কাননে ফুল ফোটে নাই
তোমার বাগানে কে ফুল ফুটালো।।

কবি ছিল যশহীন, খ‍্যাতিহীন। তার নাম কেউ মনে রাখেনি।


১৮.


'আকাশ হারিয়ে যায় দূরের আকাশে
তুমি হারিয়ে থাকো তার নীলে।
আমি ভ্রমে খুঁজি তখন অপরাজিতার নীলে।
ঝিনুক লুকিয়ে থাকে সাগর বালুকাবেলায়,
তুমি থাকো অতলান্তে,
আমি ভ্রমে খুঁজি তখন সুপ্ত কোনও
দীঘির কালো জলে।

এই দুইয়ের কোথাও তুমি নেই।'


১৯.


সব প্রেমের মধ্যেই প্রেম থাকে না
সব আনন্দই আনন্দ নয়
সব ঘুমেই স্বপ্ন আসে না।
সব তারা ডুবে গেছে আকাশ নিশীথে।

আমার দেহখানি নির্ভার করে দাও
মলিন দুঃখগুলোকে মুছিয়ে দাও
প্রদীপখানি জ্বালিয়ে দু'হাতে ধরো।

২০.


হঠাৎ হঠাৎই অনেকের কথা মনে পড়ে। অনেক প্রিয় মানুষের মুখ। যারা চলে গেছে অনন্তের পথ
ধরে বহু দূরে। প্রায় সময়ই চোখ বন্ধ করে সেই সব মুখগুলো দেখি।

কেন যে জন্ম হয় মানুষের।
কেনই যে মৃত্যু আসে সে জীবনের ।


২১.


প্রায়শই এই কোলাহল থেকে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছা করে। নিবিড় কোনও বন জঙ্গলে কিংবা কোনও মাজারে। সামিয়ানার নীচে বসে সারারাত কাওয়ালি শুনি। অথবা নির্জন সাগরকূলে বসে সমুদ্রের গর্জন। সারারাত বৃষ্টি নামুক। বৃষ্টির সাথে সাগরের সঙ্গম। বৃষ্টি ও জলের প্রজনন।

আমি রহিনু পড়ে এই কোলাহলে,
একা। প্রেম ও বিরহ এখানে এক বিন্দুতে আহত হয়।


২২.


মধ্যরাতে কিছু অবাধ্য বাতাস জানালার কাছে
এসে শব্দ করে বলে -- খুলে দাও।
জ্যোতির্ময় এক আলোর বিভায় ঝলমলিয়ে উঠি --
কানের কাছে গুণগুণ করে জোনাকি।

তখনও নিশ্চুপ এক তরুণী ---
তখনও রাজকন্যা সিন্ড্রেলার ঘুম কিছুতেই ভাঙানো গেল না।

২৩.


এই জ্যোৎস্না মাধবী রাতে, ঐ নীল জলধি আমাদের ডাকে
ঐ অতল তলে কিসের গান বাজে-
কি সুর ধ্বনিত হয় দীর্ঘশ্বাসে, বিসর্জন দিতে মন চায় যে !
' অতুল মাধুরী ফুটেছে আমাদের মাঝে,.
চরণে চরণে সুধাসঙ্গীত বাজে- এ কি সত্য।'


২৪.


তোমার অকম্পিত হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলে --
পরম নির্ভর বাহুডোর। আলিঙ্গণে জড়িয়ে নাও, উষ্ণতা পাবে।
ছায়াবীথির মতো বুক দেখিয়ে বলেছিলে --
এখানে হৃদয়। জমাট বেঁধে আছে লাল রক্তের ছোপ !
যত্ন করো, পরিচর্যা করো, নিজের স্থানকে নিরাপদ করে রাখো.....

২৫.


শ্রাবণ জ্যোৎস্নারাতে
বহুদিন এই গ্রাম থেকে ঐ গ্রামে
গোপনে নৌকা নিয়ে ঘাটে ঘাটে ঘুরেছি
দেখেছি কত উপচে পড়া জল ---
আর নদীর স্রোতবক্ষে ভেসেছি সারারাত।

সব ঘাটই জলকে কাছে টেনেছিল,
আমাকে নয় --
নদী আর আমাতে ছিল যত অভিমান।


২৬.


যতোদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায় তাকিয়ে দেখলাম
কোথাও তোমার ছায়া নেই,
শুধু আকাশের ছায়াটি পড়ে আছে।


২৭.


ঘরের ভিতরে কেউ নেই। তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ গুমরে গুমরে করে কান্নার শব্দ শুনতে পাই। মনে হলো পায়ের উপর টপ টপ করে শীতল জল ঝরে পড়ছে।

আলো জ্বালাই। ঘরের ভিতরে কেউ নেই। ভাবলাম -- বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিনা? জানালা খুলে দেখি, চরাচর জুড়ে পাগল করা জ্যোৎস্নার রাত।


২৮.


হাত ছুঁয়ে দেখলাম। রেখাগুলো আছে আগের মতোই। চোখের তারা তেমনি ঝলমলে। ঠোঁটের পৃষ্ঠে কাঁপন। বুকের নীচে উতল ভালোবাসা। ইচ্ছাগুলোও মায়াবদ্ধ।
চলো আমরা অনাগতের পথে হাঁটতে থাকি। সেই প্রথম অনুভবের মতো।


২৯.

তুমি যেন নদী। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আছো। এই নদীর ভাঙ্গন চূর্ণ করে দুপারের মৃত্তিকা, এর জলতরঙ্গ আমাকে ভেসে নিয়ে যায়।

আমার শূন্যতার ভেতর তুমি পূর্ণতায় ভরিয়েছ।
তুমি দিয়েছ আর আমি পূর্ণ হয়েছি।

কী ভাবে আমি তোমাকে প্রবঞ্চিত করে রাখি?
আমি ভিখারি হলেও না।


৩০.


তুমি যেন নদী। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আছো। এই নদীর ভাঙ্গন চূর্ণ করে দুপারের মৃত্তিকা, এর জলতরঙ্গ আমাকে ভেসে নিয়ে যায়।

আমার শূন্যতার ভেতর তুমি পূর্ণতায় ভরিয়েছ।
তুমি দিয়েছ আর আমি পূর্ণ হয়েছি।

কী ভাবে আমি তোমাকে প্রবঞ্চিত করে রাখি?
আমি ভিখারি হলেও না।

৩১.


সকালও এমন ঘন ঘোর আঁধারের হয়!
মেঘ ভেঙে বৃষ্টি হবে তাই হয়ত এমন আয়োজন তার।
"আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ অন্ধ করা,
তোমার পরশ থাকুক আমার হৃদয়ভরা৷"

সব কেমন আনন্দে ভরে গেল যে !
'দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ,
আমার চিত্তে মিলি একত্রে তোমার মন্দিরে উছাসে।'


৩২.

যদি আর বৃষ্টি না ঝরায় মেঘে ঢাকা আকাশ,
যদি আর কোনো ফুল না ফোটে।

যদি মরে যাই একদিন, যেন মরি ফুলের বনে।


৩৩.


কতো রাত পোহালো তবু তার সঙ্গে দেখা হলো না।

তুমি কি ছিলে এই রাত্রিতে , এই চন্দ্রপক্ষে নিজেকে বিসর্জনরত?
যেখানে মাটির সঙ্গে প্রেম,
যেখানে দেহের বিষে প্রেম আলিঙ্গনবদ্ধ হয়।

ভালোবাসার ফুলে ভরে ওঠে জল, তবুও জল স্পন্দন শুনলো না কেউ ।


৩৪.


একটাই জীবন জেনেও জড়াইনি অন্য আর কারোর জীবনে --
যতটুকু সময় আছে, আছি তোমার সাথে সুখ দুঃখের এই ভূবনে,
জীবনে যা পেয়েছি অমৃত সুধায় ভরে থাক আর কিছু চাহিনে।


৩৫.


পুড়ে যতই হয়ে যাই ছাই.....
তোমার ছোঁয়া পেলে প্রাণ ফিরে পাই।

৩৬.


এখনও ভালোবাসি
এখনও কাছে আসি নিঃশব্দ চরণে,
এখনও স্মরি তোমায় অনিঃশেষ
অশ্রু ক্ষরণে।

৩৭.

কথা ছিল মেঘ গুুরুগম্ভীর বর্ষারাতে আমরা নদীতে ভাসব। রাতের মধ্য্ প্রহরে তুমি এমন হলে তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত আমি। তুমি পাশ ফিরে মুখ ঘুরিয়ে মেঘ হয়ে গেলে। তোমার এমন মেঘ হওয়া দেখে বিষাদগ্রস্থ হই। দেখি -- সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরছে।

তুমি এসো, আষাঢ়ের মেঘের মতো
এসো, আমার বর্ষালিপি।
টুপটাপ ঝরতে ঝরতে
একটি আনন্দ নদী পার হই, এসো সাঁতার দেই।

৩৮.


বৃষ্টি ঝরঝর এক বর্ষা রাতে
এসেছিল সে বাতাসের মর্মর ধ্বনিতে
আকাশ দীর্ণ করা আলোর ঝলকানিতে
জড়িয়েছিল বুকে রিমঝিম সঙ্গীতে।


৩৯.


ক্রমশঃ গহীনতম পথে চলতে থাকে আমাদের লীলাপর্ব
জলের ঢেউ ভেঙে নাবিক নোঙ্গর ফেলে আরো অতলে
আমরা বুঁদ হয়ে থাকি জলের নির্মাণে --
নিঃসঙ্গ বালিয়ারীতে তখন মুক্তা ফলায় ঝিনুক
জলধির গভীরে যে কথা হয় তার সাথে
তার বুকে কান রেখে সে কথা শুনি আমারই প্রাণে।


৪০.


অভিমান তুমি আমাদের মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াও
কেউ থেকো না আজ
থাকবে না কোনো বৃক্ষের ছায়া, থাকবে না উপত্যকার কোনো ঘাসও।

লক্ষিনদারের বাসর ঘরের মতো সবকিছু নিশ্ছিদ্র।
আমরা দুজন আজ একজন হবো।


৪১.


কেন যে গানের কথা লিখি,
কেন যে সুরে সুরে ভরে যায় সন্ধ্যার আঁধারে এই মন, কেন যে দুচোখ জলে ভরে ওঠে, কেন যে বুকের গহীনে মর্মরিত বেদনা বাজে, জানিনে জানিনে...।


৪২.


যদি প্রেমহীন হয়ে থাকো, মেঘদূতের সম্ভোগের শ্লোক পড়েও যদি নির্বিকার থেকে যাও
যদি না থাকে তোমার রাগ-অনুরাগ-
যদি বিহ্বল না হয় কস্তরীনাভি, যদি রাগ না ওঠে কোমলগান্ধার,
যদি কেঁপে না ওঠে তোমার শরীর,
রক্তে শোণিতে যদি না ভেজে তোমার পরনবাস, তাহলে তুমি আমার কবিতা পড়ো না।

৪৩.


যত ঘৃণাই কর, যত দূরেই ঠেলে দাও। আমি জানি, অনেক দূরের স্বপ্ন হয়ে গেলে, তুমিই সবার আগে ক্লান্তিহীন দৌড়ে দৌড়ে ছুটে চলে যাইতে চাইবে জীবন সীমানার ওপারে।


৪৪.


যখন আমি গল্প লিখি, শেষ লাইনে এসে থেমে যাই। তখনও কাহিনিতে জীবনের রেশ থাকে। তখনও জীবন্ত তুমি। সেই তুমি আরেক রূপে এসে ধরা দাও। তখন শুরু হয় অন্য আর একটি গল্প।


৪৫.


কিছুটা সম্পূর্ণ কিছুটা অসম্পূর্ণ একটি আকাশ
কয়েক'শ কোটি তারার আয়োজনে
আসে একটি মাত্র রাত।

তোমাকে ভালোবাসি এই আকাশ তলে
আমরা মেঘ হবো, নীল মেঘ, খয়েরী মেঘ, রঙবেরঙের মেঘ।


৪৬.

তোমার চুল আমাকে টানে
তোমার কন্ঠস্বর রাগ ভৈরবী হয়
মুখের মাদকতা আমাকে টানে --
নির্বাক, বুভুক্ষু আমি পায়চারি করি
চন্দ্রালোকের খাঁ-খাঁ রাস্তায়।


৪৭.

একদিন মনখারাপ হবে খুব, অথচ কান্না নেই।

সে মুখোমুখি এসে দাঁড়ানোর পর হয়ত কান্না এসে যাবে
বড্ড অচেনা লাগবে তখন সারা পৃথিবী,
একদিন সবকিছু ফুরাবার আগেই আমিও হারিয়ে যাবো..
তখন কারও চোখে আমার কান্না রয়ে যাবে।


৪৮.


প্রায়ই মনে পড়ে...আজ তো আরো বেশি করে।
মহুয়া বনের মাতাল আমি...

৪৯.


বিশ্বাস রেখো বুকে, কোথাও কোনো নদীর ঘাটে একটি কালো নৌকা আমাকে তুলে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।


৪৯.


তোমাকে ফেলে দিয়ে
পথে নেমে একা একা পথে পথে ঘুরি। যাযাবর সন্ধ্যা বেলায় পথ ভুল করে আবার তোমার কাছেই ফিরে আসি।
কবে একদিন আমার জন্য তোমার দুই ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়েছিল, তারই ঋণ শোধ করার জন্য এমন করে বারে বারে ফিরে আসা।


৫০.


আসব তোমার কাছেই যদি মেলে দাও
তোমার আকাশ,
যদি ভিজাও বহতা নদীর কূলকূল জল ধারায়।
যদি দেখাও উপত্যকা, হামাগুড়ি দেব তার ঢালে,
পুকুর নালায় উপচে পড়বে ঝর্ণার জল।
যদি নিয়ে যাও পূর্ণিমার আলোয় পথ ধরে
নিরুদ্দেশ কোথাও।
যেখানে সন্ধ্যা রাত্রিতে থেকে থেকে জোনাকি জ্বলে। যেখানে রাতভোর স্নাত হওয়া যায় শিশিরে।

৫১.


জীবনের মধুরতম সময়গুলোর আয়ু ক্ষণকালের, উপভোগ করতে না করতেই শেষ হয়ে যায়। আমাদের বসন্তদিনও শেষ হয়ে গেল। এত ভালবাসলাম তারে, তবুও ধরে রাখা গেল না।

৫২.

এই পথ দিয়ে তুমি এসেছিলে
তখন আলো জ্বলে উঠেছিল,
এই পথ দিয়েই তুমি চলে যাবে
সব আলো নিভে দিয়ে।

বিধাতার কী নিয়ম।


৫৩.


পথে যেতে যেতে সন্ধ্যা হলো,
চারদিকে এতো নীলাভ ছায়া কেন?
তুমি তো আলোই ছিলে --
তবে কেন এই অন্ধকার হয়ে আসা!


৫৪.


বিচ্ছেদ চাইনি কখনো --
আঙ্গুলগুলো জড়িয়ে রয়েছে তার হাতেই
আকাশে চেয়ে দেখি নক্ষত্রও নিঃস্ব,
বাতাসেও কোনো সিম্ফণী নেই।


৫৫.


তোমাকে ছো্ঁয়ার আগেই চাঁদ পশ্চিম আকাশে ডুবে গেছে,
সব আলো নীভে গেছে তোমার বন্ধ চোখের নীচে। সেই উষ্ণতার আনন্দ আর পাওয়া হলো না।
সব জ্যোৎস্না তোমাকে পাওয়ার আগেই আকাশলীনে হারিয়ে গেলো।

জোৎস্না বিধোত হয়ে তুমি কি আবার চাঁদ হয়ে ফিরে আসবে ?


৫৬.


তুমি চলে যাও, যাবার বেলায় বলে যাও--
'এবার চললাম চিরদিনের জন্যে।'

তারপর কী হয়! হয়ত তুমি দূর থেকে আমাকে দেখো
দূর থেকে কাছের করে দেখো -
চোখ বন্ধ করে দেখো, চোখ মেলে দেখো।

তারপর আবার মায়া ভরে ফিরে আসো
আমার কাছেই।


৫৭.


আমার প্রাণ ছুঁয়ে গেল কে, শারদীয় রোদ্রের মতো, আমি আবেশে অবশ হয়ে যাই,
তুমি আজ যেই গানই গাও , তোমার সেতার জানে আমি কী গান শুনিতে চাই।


৫৮.


জীবন যদি থেমে যায় ধূলি পথের দীপ্ত প্রান্তরে।
জারুল তমাল নিম নাগেশ্বরের মাঝে ব্যপ্ত যে মুখখানি দেখতে পাবো নক্ষত্র আলোকে, তাকে ঠিকই চিনে নিতে পারব।

আমার জীবনের সকল দায়ভার তোমাতেই গচ্ছিত। আমি যাকে পেয়েছিলাম, শেষপর্যন্ত শেষ মুহূর্তেও তাকেই কাছে পাইলাম। আমার আর খেদ রইল না...।


৫৯.


তুমি ভোরের চাঁপা ফুল আর জুঁই,
এত সুবাস আমি কোথায় থুই। তুমি দিতে চাও না কিছুই্,
তবুও তোমাকে আমি ছুঁই।
নির্বিকার থাক সে আমি বুঝি, তবুও তোমার মাঝেই নিমগ্নতা খুঁজি।


৬০.


তোমার পুজোর থালায় ফুল দিয়ে রেখো ঢেকে যখন সন্ধ্যা নামে,
কোনো অনুযোগ নেই, তোমার থেকে যা আমি পেয়েছি তা রেখেছি অনেক অশ্রু দামে... ...।


৬১.


মনটা হয়ে আছে মেঘের মতো ধূসর
সামনের পথ আর রয়েছে কত বাকি?
যেতে যেতে পথে যদি আঁধার নামে
পথ দেখাবে না হয় কোনো জোনাকি।


৬২.


চন্দনের গন্ধ নিতে গিয়ে বুকের গন্ধ পেয়েছি
এইরকম আরো কত কিছু ভুল করে নিয়েছি
চন্দন নেব না তোর থেকে আবীর দে
ভালোবাসা জমেছে যত সবই লুটিয়ে নে।

৬৩.


উপেক্ষা করে দূরে দূরে সরিয়ে রেখেছি যাকে
দিনশেষে সেই আমার জন্য অপেক্ষায় থাকে
আদর তো দূরের কথা হাতখানি ধরিনি যার
সেই আমায় ভালোবাসা করে দিয়েছে উজার।


৬৪.


ফিরে যেতে বলেছিলে তাই মুখ ফিরিয়ে চলে গেছি। পৃথিবীর সমস্ত কক্ষপথ ঘুরে এসে দেখি, তুমি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছ দুহাত পেতে।
ঐ হাত আমি ফিরিয়ে দেই কী করে ?


৬৫.


ধরতে চেয়েছি আঙ্গুল তুমি এগিয়ে দিলে হাত,
ধরতে গিয়েছি হাত, তুমি এগিয়ে দিলে বক্ষ,
বলেছিলে -- বুভুক্ষু আমি, এই বুক চৌচির প্রান্তর।
শীতল করো, অমৃত সুধা করো পান।


৬৬.


উঠেছে কোজাগরী,
ভূবন জুড়ে আলোয় আজ ভরেছে ,
আমি দেখিনি সেই চাঁদ, যারা দেখবার তারা দেখেছে।
আমার ঘরেই ছিল চাঁদ মেখেছি তার আলো
গৃহ ত্যাগ তাই হলোনা আমার
জেগেছি রাত, বেসেছি তারে ভালো, এই রাত ছিল যে শুধু পূর্ণিমার।


৬৭.


কখনও যদি নিজেকে খুব একা লাগে, যদি তোমার কাছে কেউ না থাকে, যদি নিঃসঙ্গতার ধূপ আগুনে পুড়তে থাকো সারাক্ষণ । তবে তুমি লেখার কাছে চলে যেও। তখন তুমি কবিতার সাথে কথা বলো , গল্পের সাথে গল্প করো।



৬৮.


ঘোর লাগা নির্জন পাতার গায়ে
লিখে রাখি তোমার নাম,
উদ্বেলিত রাত্রির আকাশে জ্বলে ওঠে বিগলিত চাঁদ।

তারা'রা যে যার মতো ভেসে যায় ,
রাতখোর যুগলেরা মিটায় তখন তাদের আরাধ্য সর্গীয় স্বাদ।


৬৯.


কোনো একদিন বসন্তবায় উড়ে চলে যাব। দূরে বহুদূরে, শূন্যে চিল হয়ে, মেঘের আড়ালে। ঠিক হারিয়ে যাব একদিন। কেউ আমায় ছুঁতে পাবে না। কেউ খুঁজেও পাবে না।


৭০.


যার ভিতরে মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। তার সাথে জড়িয়ে পড়তে বা সম্পর্ক করতে ইচ্ছা করে না। আর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেও তাকে ছেড়ে আসতে অসুবিধা হয় না।

৭১.


কাউকে ভালোই যখন বাসলাম, তার শরীরটাকে ভালো বাসতাম। মনটাকে কেন ভালোবাসতে গেলাম। শরীরটা ত্যাগ করে রেখে আসা যায়, মনটাকে আসা যায়না। মনটা পড়ে থাকে মনের কাছে।


৭২.


যে আমাকে ছাড়া এক মূহূর্তকাল থাকতে পারেনা। বলে- তুুমি ছাড়া এই পৃথিবী মিথ্যা।
সেই একদিন শিখে নেবে --- আমাকে ছাড়া কিভাবে তার মৃত্যু মুহূর্তকাল পর্যন্ত থাকতে হবে।


৭৩.


যখন কাছে থাকো তখন তোমাকে দেখি -
যখন দূরে চলে যাও, উৎকণ্ঠিত আঁখি মেলে
তখন আরও বেশি করে তোমাকে দেখি।


৭৪.


তুমি যদি তার শরীর চাও, খুলে বলো তাকে। ভালোবাসার অভিনয় করে তার শরীর নিও না। নিজেকে সৎ রাখো।
.

৭৫.


কাল রাতে হেঁটেছিলাম চন্দ্র তারার
নীচ দিয়ে একা।
পথ আর কতটুকু বাকি।
পথ চলার সেই সময়টুকুতে আমার সাথেই না হয় পথ চললে।
থেকেও গেলে আমার অন্তরতম অন্তরস্থলে।

তুমি তোমার ভালোবাসার ঝর্নাধারা 
বইয়ে দাও।


৭৬.


আমিতো সমর্পণ করতে চাই,  তুমি থাকো সহস্র আলোকবর্ষ দূরে ...!

এ শহর ফাঁকা হয়ে গেছে। রাস্তায় বের হয়ে ভালো লাগেনি এমন শূন্যতা।  জনারণ্যময় রাজপথই আমার বেশী প্রিয়। কোলাহলে অনেক দুঃখই ভুলে থাকা যায়।

হে প্রভু, এমন শূন্যতা নয়
আমাকে মুখর মুহূর্ত সমর্পণ করো।


৭৭.


বৃষ্টির শব্দ আঁখি পল্লবে 
জলের ধ্বনি তোমার আরক্ত ঠোঁটে, 
এই রাত্রিতে শব্দগুলো আজ কবিতা হয়ে ওঠে।


৭৮.

রাতের দিকে ঘন মেঘ এলে, 
বুকের ভিতর সকরুণ বাঁশি বাজতে থাকে, আবছা আঁধারের মধ্যে তখন ভেসে ওঠে তার মুখ ...


৭৯.


ভালোবাসার কাছেই আমি নমিত হই। সে যদি বলে, 'চলো নরকে যাব'। তাহলে নরকেই যাব। আর যদি বলে, 'স্বর্গে যাব'। তবে স্বর্গেই।
যেখানেই যেতে বলে, সেখানেই যাব --- দ্বিধাহীন নিঃশঙ্ক চিত্তে।


৮০.


এই পৃথিবীতে কত শত মুখ দেখেছি আমি। দেখেছি অনেক জনের চোখও। সব ছাড়িয়ে একটি মাত্র মুখই সবসময চোখে ভেসে থাকে। সেই একজনেরই চোখ এখনও তীব্র ভাবে আলো ছড়ায়। তার সেই বিচ্ছুরিত আলোয় আমি আমার জীবন চলার পথ খুঁজে নেই।