রবিবার, ৩১ মে, ২০২০

রোল নং ১৭, দোলা মিত্র

রোল নং ১৭, দোলা মিত্র
   
১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের কোনো একটি দিন। আজ এতদিন পর সঠিক দিন তারিখ মনে নেই।  দেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। 'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল।' 

মুক্তিযুদ্ধের পরে আমাদের স্কুল প্রথম খোলার দিন ছিল সেদিন।  দীর্ঘ দশমাস পর স্কুল খুলবে।  দীর্ঘ দশ মাস পর সবার সাথে দেখা হবে। কেমন একটি উৎসব উৎসব মুহূর্ত ছিল সেদিন , কেমন একটি উত্তেজনা উত্তেজনা ভাব ছিল।     

ক্লাস নাইনে পড়ি।  প্রথম ক্লাসটি ছিল ওয়াহিদ স্যারের অংকের ক্লাস।  আমাদের ক্লাসে প্রায় পঞ্চাশ জনের মতো ছাত্র ছাত্রী ছিল। এর মধ্যে ছাত্রী ছিল মাত্র সাতজন। তখন মেয়েরা স্যারদের পিছে পিছে ক্লাসে আসত।  এবং ক্লাস শেষ হলে স্যারদের পিছেপিছে বেরিয়ে যেত।     

দীর্ঘ দশ মাস পর স্যার প্রথম রোল কল করছে। ক্লাসে সেদিন অনেকেই আসেনি,  ষারা আসেনি তারা কেন আসেনি, সহপাঠীরা যারা জানত তারা কেউ কেউ বলে দিচ্ছিল। 

স্যার একসময় কল করে -- 'রোল নং ১৭, দোলা মিত্র।' কোনো রেসপন্স নেই। কেউ বলছে না -- 'ইয়েস স্যার'। মেয়েদের বেঞ্চে ছয়জন ছাত্রী বসা ছিল। তাদের ভিতর দোলা মিত্র নেই।   

ক্লাস কক্ষ নিরব নিস্তব্ধ। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। দোলাদের বাড়ি ছিল ধলডোব গ্রামে। ঐ গ্রামেরই একটি ছেলে ছিল, নাম বিমল। বিমল আমাদের সাথে পড়ত।  স্যার ওকে জিজ্ঞাসা করে-- 'তুমি কী দোলার কোনো খবর বলতে পারো?' বিমল বলছিল --  ' স্যার, দোলা' রা ভারতে চলে গিয়েছে। এখনও ফিরে আসেনি।'        

দোলা' রা ভারত থেকে আর কোনো দিন ফিরে আসেনি।  কেন আসেনি।  সে অনেক দুঃখের কথা। অনেক দাম দেওয়া কাহিনি।  

কেমন ছিল দোলা নামের মেয়েটা?  ক্লাসে চুপিচুপি ছেলেরা ওকে  ডাকত কাননবালা বলে।  উজ্জ্বল গৌরবর্ণের এই মেয়েটির চোখ দুটো ছিল বিনোদিনীর মতো টানাটানা, কেশবতী ছিল সে। হাতে কঙ্কণ পরত। কিন্তু কিনিকিনি শব্দ হতো না হাতে। স্কুলের বারান্দা দিয়ে স্যারদের পিছনে পিছনে হেঁটে যখন সে ক্লাসে যেত, তখন সিনিয়র ছেলেরা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত ওকে। 'বধূ তুমি চলে যাও গো বকুল বিছানো পথে পথে।'    

দোলা ভালো গান গাইতে পারত।  স্কুলে বার্ষিক  সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ও গানে প্রথম হত।  সেই বার আমাদের ক্লাসে দুজন ছাত্র ছাত্রী পুরস্কার পেয়েছিল। একটি পেয়েছিল গানে দোলা মিত্র।  আর একটি পেয়েছিলাম আমি -- স্বরচিত কবিতা পাঠে। শহর থেকে ক্যামেরাম্যান এনে বিজয়ীদের স্টীল ছবিও তুলেছিল।                                                                                    
দোলা আমার সহপাঠী হলেও ওর সাথে আমার কিংবা অন্য ছেলেদের সাথে ওর  তেমন কোনো  কথা হত না।  কারণ কথা বলার সুযোগ ছিল না তখন।  ছুটির পরে একদিন বাড়ি যেতে যেতে দোলা আমাকে বলেছিল -- 'তুমি তোমার কবিতাটি কপি করে  আমাকে দিও। খুব ভালো লিখেছ, একেবারে গানের মতো।'  

আমি লাইনটানা একটি সাদা কাগজে আমার সেই কবিতাটি লিখে দোলাকে দিয়েছিলাম। তাও গোপনে, কেউ দেখতে পায়নি। সেদিনও ছুটির পর বাড়ি যেতে যেতে কথা হয়েছিল দোলার সাথে।      কবিতাটি দেওয়ার সময় আমি ওকে বলেছিলাম -- 'তুমি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যে গানটি অনুষ্ঠানে গেয়েছিলে, ঐ গানটি আবার একদিন আমায় গেয়ে শোনাবে?' 

দোলা বলেছিল --  'গেয়ে শোনাব তোমাকে '। 

তারপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।  একদিন ভোরবেলা শহর থেকে ধলডোব গ্রামে মিলিটারি গেল।  ম্যাসাখার করল বাগবাটি, হরিনাগোপাল ও ধলডোবসহ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো। জ্বালিয়ে দেওয়া হলো তাদের ঘরবাড়ি ও মন্দির। ঘর থেকে মানুষ ধরে নিয়ে পাখির মতো গুলি করে  হত্যা করে। ধর্ষণ করে মেয়েদের। পাক সৈন্যদের কালো হাতের থাবা থেকে সেদিন দোলাও রক্ষা পায়নি। সেও ধর্ষিত হয়েছিল।                                                                                                         
লজ্জ্বায় আর গ্লানিতে দোলাদের পরিবার স্মরণার্থী হয়ে সেই যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারপর আর তারা ফিরে আসে নাই এই দেশে।      

তারপর জীবন থেকে কত পৃষ্ঠা উল্টে গেছে। কতদিন কত বছর চলে গেছে কালের অতল তলে। আমিও চলে এসেছি গ্রাম থেকে শহরে। সেই কবে অজ পাড়াগাঁয়ের এক স্কুলের, ক্ষণকালের এক  সহপাঠিনী ছিল দোলা মিত্র!  তাকে জীবন ভর মনে রাখার দায় কী ছিল আমার?  যে আবার  চলে গেছে অন্য দেশে।  

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কত গান শুনেছি কত জনের কাছ থেকে। কত সুরে সুরে ভেসে গেছে কত আনন্দের ক্ষণ !  সেই কবে পল্লীর এক স্কুলের অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে দোলা মিত্র নামে অখ্যাত  কেউ একজন -- কী এমন গান গেয়েছিল যে, তার সেই কণ্ঠ, তার সেই সুর এত দিন ধরে মনে রাখতে হবে !  কিংবা তা কী এখনও  হৃদয় বীণায় অনুরণিত হবে চিরকাল !     
    
অনেক বছর পর  পিপুলবাড়িয়া বাজারে সহপাঠী   বিমলের সাথে আমার একবার দেখা হয়।  ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দোলা এখন কোথায় থাকে?  বিমল বলেছিল -- 'শুনেছি, দোলা শিলিগুড়িতে থাকে।  ইসকন মন্দির রোডে ওদের বাসা।  দোলা ওখানকার একটি স্কুলের গানের মাস্টার। ওর স্বামীর নাম -- সুনীল চক্রবর্তী।      

২০০৪ সালে আমি ও আমার স্ত্রী দার্জিলিং গিয়েছিলাম বেড়াতে। ফেরার পথে শিলিগুড়িতে দুইদিন ছিলাম। খুব ইচ্ছা হলো, দোলার সাথে দেখা করার। একদিন বিকালে আমার স্তীকে নিয়ে ইসকন মন্দির রোডে দোলাদের বাড়ি খুঁজতে বের হই।  পেয়েও যাই ওর বাড়ি। 

আধাপাকা টিনসেড ছোট্ট ছিমছাম একটি  বাড়ি। বাড়ির গেটে নক করতেই গেটটি খুলে দেয় মধ্যবয়সী একটি লোক। বুঝতে পারছিলাম,  ইনি দোলার স্বামী হবে।  উনি বলছিলেন -- কোথা থেকে আপনেরা এসেছেন?  
-- আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। 
-- কার কাছে এসেছেন? 
-- এখানে দোলা মিত্র নামে কেউ থাকে?
-- থাকে।  তবে দোলা মিত্র নয়, সে এখন দোলা চক্রবর্তী। উনি আমার স্ত্রী।   
-- ওহ!  আচ্ছা! আমরা দোলার সাথে একটু দেখা করব।    
-- আসুন, ভিতরে বসুন।                         
                                                               
ছোট্ট সাজানো গোছানো একটি ড্রয়িং রুমে আমাদের বসতে দেয়।  একটু পর একজন মহিলা প্রবেশ করে। দেখলাম তাকে! এ যে দোলা মিত্র !  
সেই অপূর্ব সুন্দর মুখচ্ছবি! আজও তেমনই আছে  লাবণ্যময় রূপ মাধুর্য!  মার্জিত বাচনভঙ্গী, আনত নয়ন! কী যে দেবী দেবী লাগছিল ওকে! 

আমি ওকে বললাম -- চিনতে পারছ আমাকে?  
-- পারছি!  তুমি রঞ্জন! 
-- হ্যাঁ,  আমি রঞ্জন।  তেত্রিশ বছর পর আমাদের  দেখা হলো। 

আমার স্ত্রীকে দেখিয়ে দোলা বলছিল,  তোমার বউ নিশ্চয়ই! 
--- হুম! ওর নাম -- মায়াবতী!    
দোলা ওর স্বামীর সাথেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।

দোলাকে দেখছিলাম আর বিষাদে মনটা ভারী হয়ে উঠছিল। ওর মায়াময় মুখখানি দেখে কান্না পাচ্ছিল খুব। বলতে ইচ্ছে করছিল, দোলা -- 'তুমিও তো আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য অনেক  ত্যাগ স্বীকার  করেছ।  তোমার এই আত্মত্যাগ আমরা ভুলি কী করে?'                
        

সেদিন রাত অবধি দোলার বাসায় ছিলাম।  অনেক কথা হয়েছিল দোলা ও দোলার স্বামীর  সাথে। দোলা না খেয়ে  আসতে দেয়নি।

দোলার ড্রইংরুমে  একটি জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম -- ওয়ালে কাঁচের ফ্রেমে একটি ছবি যত্ন সহকারে সে টানিয়ে রেখেছে।  ছবিটি আমাদের স্কুলের একটি পুরস্কার বিতরণীর।  ছবিতে আমি ও দোলা পুরস্কার গ্রহণ করছি হেড স্যারের কাছে থেকে। সবুজ ছায়া সুনিবিড় স্কুল আঙিনা। আম সুপারির ঝাড়,  খোলা মাঠ, খোলা আকাশ সবই ছবিতে দেখা যাচ্ছে। এ যেন বাংলাদেশের একটি চিরায়ত রূপ !     

ওর বাড়ি থেকে  যখন চলে আসব,  তখন দোলা বলছিল -- রঞ্জন, তুমি আমার গান শুনবে না? 

--- শুনব, গাও। 

দোলা হারমোনিয়াম বাজিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই গানটি গেয়ে শোনায়।  যে গানটি স্কুলের অনুষ্ঠানে সে গেয়েছিল,  যে গানটি আমাকে গেয়ে শোনাবে বলে একদিন কথা দিয়েছিল ---
       
'তুমি না হয় রহিতে কাছে-
কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে,
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে। 
এই মধুক্ষণ মধুময় হয়ে নাহয় উঠিত ভরে-
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে,
কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে......। '

তারপর আরও কত বছর চলে গেছে। 
"রোল নং ১৭, দোলা মিত্র।" ক্লাস কক্ষের ভিতর  রোল কলের সেই আওয়াজটি দিনে দিনে আরও অস্পষ্ট ও ক্ষীণ হয়ে আসছে !     


কোয়েল তালুকদার
৩১ মে, ২০২০ ইং,  ঢাকা।              
-------------------------------------------------------
ডিস্ক্লেইমারঃ  লেখককে গল্পের নায়ক ভাবা ঠিক হবে না।                                                                       

শনিবার, ৩০ মে, ২০২০

সিল্কসিটি এক্সপ্রেস

সিল্কসিটি এক্সপ্রেস 

সদানন্দপুর স্টেশন থেকে ষাটোর্ধ একটি লোক ও  এক বৃদ্ধা রাজশাহীগামী সিল্কসিটি ট্রেনটিতে উঠে। তারা কোথায় যাবে, বা নামবে কেউ জানে না। লোকটার বয়স ষাটের উপর হলেও এখনও সে অনেক শক্ত সামর্থ্য। কিন্তু স্ত্রীলোকটি খুব অসুস্থ।  পুরুষ লোকটা অনেকটা বোগল কোল করেই তাকে ট্রেনের কামড়াতে  উঠিয়ে বসায়। কথায় বোঝা গেল বৃদ্ধা তার স্ত্রী হয়। 

বৃদ্ধাা মহিলাটির ঠোঁট মুখ বাঁকা হয়ে গেছে। কথা বলতে পারে না। শরীরের  বাঁ পাশটা পুরো অবশ।  তার যে দুতিন বার স্ট্রোক করেছিল, তাকে দেখলে তা বোঝা যায়।  

কোনো শক্ত খাবার সে খেতে পারে না। নিজে হাত দিয়ে তুলে কোনো কিছু খেতে পারে না।  তাকে তুলে খাওয়াতে হয়।  তার আরও অসুবিধা আছে, তাহলো সে নিজে বাথরুমে যেতেও পারে না।  অন্য কারোর সাহায্য নিতে হয়।    

বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে দেখে মনে হলো ওনারা নিম্নবিত্তের গ্রামের মানুষ। ওনারা যেহেতু সদানন্দপুর থেকে উঠেছে এদের বাড়ি কামারখন্দ-ভদ্রঘাট- কোনাবাড়ি- সিরাজগঞ্জ সদরের কোনো এলাকায় হয়ত হবে। আবার নাও হতে পারে। অন্য কোথাও থেকে এসে এই সদানন্দপুর স্টেশন থেকে তারা উঠতে পারে।       

ট্রেনটি চলছে।  ওনারা সাধারণ শোভন সিটে বসে আছে।  লোকটা খুব সেবা সুশ্রুষা করছে ওনার স্ত্রীকে।  তার সেবা সুশ্রুষা দেখে মনে হলো -- তাদের ভিতর একসময় খুব প্রেন মহব্বত ছিল।  একটা শিশুকে যে ভাবে মা যত্ন করে খাওয়ায়,  ঠিক সেইভাবে যত্ন করে স্ত্রীলোকটিকে সে খাওয়াচ্ছিল।  কখনও তাকে দুহাত দিয়ে বুকের পাশে জড়িয়ে রাখছিল,  কখনও তার কোলের উপর মাথা রেখে  চুল বিলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিচ্ছিল লোকটি।          

কামড়ার অন্যান্য যাত্রীরা সবাই মুগ্ধ হয় স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এমন ভালোবাসা দেখে। বৃদ্ধা মহিলাটি  একসময় তার প্রিয়তম স্বামীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। মনে হলো, এমন কেউ একজন গান গেয়ে গেয়ে তাকে ঘুম পারালো --  
'তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার
কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার,
জীনন মরণ মাঝে....  '    
    
লোকটির সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হলো আমার।  বললাম -- আপনারা কোথায় যাবেন? লোকটি বলল -- পাকসীর কাছেই, পদ্মার পাড়ে একটি গ্রামে। 
--- ওনাকে আপনি খুব ভালোবাসেন বুঝি? 
--- জ্বী, আমার পরানের চেয়ে বেশি। 
--- তাই?  শুনে অনেক খুশি হলাম।     
--- জানেন,  আমার সংসারে কিছু ছিলনা। সেই বাবার বাড়ির যা কিছু পেয়েছিল,  সবই আমাকে এবং আমার সংসারের জন্য  দিয়ে দিয়েছে।  নিজের জন্য কিছু রাখেনি।'
-- যাক,  আপনিও অকৃতজ্ঞ হননি।  স্ত্রীর এই অসুস্থতার সময় তার পাশে রয়েছেন। 

লোকটি স্মিত হাসলো। 

ট্রেনটি ইতোমধ্যে ঈশ্বরদী জংশনে এসে থামে।  লোকটি -- তার কোলের উপরে ঘুমিয়ে থাকা তার স্ত্রীকে ডাকে -- 'এই, ওঠো, এসে গেছি।'

বৃদ্ধা মায়া করে তার স্বামীর চোখের দিকে চোখ মেলে তাকায়। 
                
লোকটি আবারও বৃদ্ধাকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে নামে। এবং তার স্ত্রীকে বামপাশ করে আস্তে আস্তে করে হেঁটে বিশ্রামাগারের দিকে নিয়ে যায়।                     

লোকটি তার অসুস্থ স্ত্রীকে বিশ্রামাগারের বেঞ্চের উপর শোয়ায়ে দেয়।  তার মাথায় ও কপালে হাত বুলায়ে বলে -- 'খুব খারাপ লাগছে তোমার?'
বৃদ্ধা কথা বলতে পারছিল না।  মাথা নেড়ে বলছিল শুধু ,  হে। 
           
--- 'তুমি একটু শুয়ে থাকো।  ভালো লাগবে। 
আমি  তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।'  এই কথা বলে সে বিশ্রামাগারের বাইরে চলে আসে।    
              
প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা সিল্কসিটি ট্রেনটি তখন  হুইসেল বাজিয়ে পুনরায় চলতে থাকে। লোকটি একবার এদিক সেদিক তাকায়। তারপর  দৌড়ে গিয়ে  পিছনের কামড়ার একটি  দরজা দিয়ে ত্বরিৎ ট্টেনটিতে উঠে পড়ে। 

সিল্কসিটি এক্সপ্রেস  ট্রেনটি  ঝিকঝিক করে দ্রুত বেগে  ছুটে চলতে থাকে  রাজশাহীর দিকে।     


কোয়েল তালুকদার
৩০ মে, ২০২০ ইং,  ঢাকা।      

           
                               
                                                     

                                                   

বৃহস্পতিবার, ২৮ মে, ২০২০

দ্বিধা

দ্বিধা
 
লায়লা আমার সহপাঠী ছিল। ইউনিভার্সিটিতে  তিন বছর একসাথে অনার্স পড়েছি।  আমরা দুজন একে অপরের ভালো বন্ধুও ছিলাম। 

লায়লা আমাকে একটি চিঠি লিখেছিল। আমাদের অনার্স পরীক্ষা যেদিন শেখ হয়ে যায় সেদিন।  তিন বছরে কত ক্ষণ ছিল, কত মুহূর্ত ছিল, কত আনন্দময় সময় ছিল,  কত আকাঙ্খা করতাম কোনো নিবেদন পাওয়ার -- তখন সে লেখেনি। ইউনিভার্সিটি  যেদিন বন্ধ হয়ে গেল, যেদিন থেকে আর কোনো দিন ক্লাস হবে না, সেদিন সে আমাকে চিঠি লিখেছে। তাও বিদায় বেলায় যাবার সময়।    
    
চিঠিটি দেওয়ার সময় লায়লা শর্তও দিয়েছিল একটা -- 'আমি যখন চলে যাব। স্টেশন থেকে ট্রেনখানি যখন ছেড়ে চলে যাবে অনেক দূর, তখন  প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তুমি পড়বে আমার চিঠিখানা, এর আগে নয়। '
আমি লায়লাকে বলেছিলাম, 'ঠিক আছে, তাই পড়ব।'     

রাজশাহী এক্সপ্রেস ট্রেনটি হুইসেল বাজিয়ে ঝিকঝিক করে প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যায়। এই ট্রেনেই চলে যায় লায়লা । কী সুন্দর হাসিখুশি ভাবে চলে গেল সে।  মুখে কোনো মন খারাপ নেই।  চোখে কোনো বিষণ্ণতাও নেই । জানালার কাছে বসে ছিল সে। তাই দেখতেও পেলাম ওর যাবার বেলাকার দু চোখ। ট্রেন আড়াল হয়ে  যতদূর পর্যন্ত  মিলিয়ে গেল, ততদূর পর্যন্ত ওর চোখের দিকে চেয়ে রইলাম ।      

পথে যেতে যেতে ওর চোখ থেকে একটুও কী কান্না ঝরে পড়েনি আমার জন্য?  ও কী পাষাণী?  নাকি আমি পাষাণ?  কারোর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও ঝরে পড়ল না!  তবে কী মিছে ছিল সব তিন বছরের মায়া মমতা ! 
                      
লায়লা চলে যাবার পর প্লাটফর্মেের কোলাহল মুহূর্তেই যেন মুখরহীন হয়ে গেল। কতক্ষণ এমনি দাঁড়িয়ে থাকলাম একাকী ।  তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে একটি খালি কংক্রিটের বেঞ্চের উপর যেয়ে  বসি।  ফ্লাস্কে করে এক চা বিক্রেতা ছেরা বলছিল -- স্যার চা খাইবেন? 
বললাম -- দে। 
--- লাল চা কিন্তু! 
--- তাই দে।
--- সিগারেট দিব?
--- দে। 
--- কোনটা খান?
--- ছাত্তার।
--- ছাত্তার কী স্যার! 
--- স্টার দে। স্টারকে ছাত্তার কই।          

চা খেয়ে স্টার টানতে থাকি। একটু জোরে জোরেই টানলাম।  মাথা ধরে গেল বেশ !  মাথা ধরা নিয়েই  লায়লার চিঠিখানি বের করে পড়তে থাকি ---

রঞ্জন, 

আমি চলে যাচ্ছি। আবার কবে আসব জানি না।  মাস্টার্স করা হয়ত আর হবে না।  আবার হতেও পারে। যদি তুমি চাও। 
আমার বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে আছে।  আমি গেলেই আমার মতামত নিয়ে হয়ত কথা পাকাপাকি করে ফেলবে।  
                      
তুমি এমন কেন বলো তো?  ছেলে মানুষের এত দ্বিধা থাকে?  তিন বছরে কতগুলো দিন ছিল, সে কী তুমি গুণেছিলে কখনও?  কত কথা বলেছি তোমার সাথে, কত ক্ষণ তোমার পাশে বসেছি, কত কিছু দিতে নিতে কত যে আঙুলের ছোঁয়া লেগেছে দুজনের ! কার শরীরের কেমন গন্ধ,  তাও জানা হয়ে গেছে।  চেহারার রূপ, অপরূপ, অরূপ -- সবই দেখা হয়ে গেছে ! 

আমাকে কী তোমার ভালো লাগেনি? দ্বিধাটা  ছিল তোমার কোথায়? কেন তুমি গত তিন বছরেও বলতে পারোনি -- ' লায়লা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমি চাই।  তোমাকে ছাড়া বাকী জীবন আমার  চলতে চাইবে না। '            
  
না কী,  তুমি চেয়েছিলে আমি তোমাকে আগে বলি!  তাই না?  

কী আশ্চর্য!  আমারও বলতে বলতে তিনবছর লেগে গেল।  যখন এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি ঠিক তখন। হঠাৎ করেই কেমন জানি লাগছে!  মনে হচ্ছে -- তুমি ছাড়া আমি খুব একা!  তোমাকে ছাড়া আমার বাকী জীবন অর্থহীন।               

এই শহরে কোথায় আমরা যাইনি বলো?  পথে 
পথে কত হেঁটেছি , কত বৃক্ষের সবুজে, ইউক্যালিপটাসের কত ছায়াতলে!  কত সময় পার করেছি অহেতুক কোনো কথা না বলে। শুধু আসল কথাটাই তোমাকে বলা হয়নি -- 'আমি তোমাকে ভালোবাসি রঞ্জন।'       

হ্যাঁ -- রঞ্জন, আমি তোমাকে ভালোবাসি।  এই চিঠির অপর পৃষ্ঠায় আমার ঠিকানা লেখা আছে।  তুমি আমাকে দ্রুত পত্র লিখে তোমার মতামত জানাবে।  আমি তোমার পত্রের জন্য অপেক্ষা করব।  ভালো থেকো। 

-----  লায়লা।                

আমি চিঠিখানা পড়ে কংক্রিটের বেঞ্চের উপর রাখি।  ঐ চা-ওয়ালা ছেরাকে আবার ডাকি।  ওকে বলি -- চা দে এক কাপ!  
ছেরা চা দেয়। এবং বলে -- ছাত্তার দিব?
-- না,  আবদুল লতিফ দে। 
-- স্যার আবদুল লতিফ কী? 
-- চিনোস না!  গোল্ড লীফ!  গোল্ড লীফ দে।                    
চা ওয়ালা ছেরাকে বলি -- তোর নাম কী?  ও বলে, এমডি আবুল কাসেম। 
আমি এমডি আবুল কাসেমকে বলি -- তুই আমাকে আরও দুই রাউন্ড চা সিগারেট খাওয়াবি।  তারপর,  বিল নিয়ে চলে যাবি।  কাসেম মাথা নেড়ে বলে -- আচ্ছা।                    
                                 

প্লাটফর্ম থেকে যখন চলে আসব তখন কংক্রিটের বেঞ্চের উপর রাখা চিঠিখানি খুঁজি।  দেখি চিঠিটি নেই। ফাল্গুণের দমকা বাতাসে কখন চিঠিটি উড়ে যেয়ে প্লাটফর্মের নীচে রেললাইনের উপর পড়ে গেছে দেখতে পাইনি।  ট্রেনের ঘূর্ণোন চাকায় সে চিঠি ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ছিন্ন চিঠি কুড়িয়ে চিঠির পিছনে লেখা লায়লার ঠিকানাটা যে উদ্ধার করব,  তা আর ইচ্ছে হলো না !         

প্লাটফরমের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছিলাম আর ভাবছিলাম, কী করব এই জীবনে?  বিয়ে করে খাওয়াব কী?  সেই একই দ্বিধা! একই অনীহা!  চাল চুলোহীনদের বিয়ে করার সাধ হওয়া ঠিক না।  ওর বিয়ে হয়ে যাক।  ভালো থাক্ আমার আজীবন চির- সখা লায়লা। এর বেশি কিছু চাওয়া ঠিক না !         

পাঁচ বছর পর...... 

একটা সরকারি কাজে চাঁপাই নবাবগঞ্জ  গিয়েছিলাম।  ওখানে কাজ সেরে একটি লোকাল বাসে করে  ফিরছিলাম রাজশাহীতে। পথিমধ্যে গোদাগাড়ী থেকে একটি মেয়ে ওঠে।  আমি দেখে তাকে চিনতে পাই,  এ যে লায়লা।  

সিট ছিল না!  ওকে  বসতে দেই।  আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বলে --  তুমি, এখানে! 

টুকটাক অনেক কথাই হল ওর সাথে।  রাজশাহীতে এসে দুজনই নামি।  লায়লা বলছিল -- চলো আমার স্বামীর বাসায়।  
--- আমি বললাম, না -- আজ না। আজই আমাকে ঢাকা চলে যেতে হবে।  
---   আচ্ছা।  
--- চলো তোমাকে এমনি একটু এগিয়ে দিয়ে আসি! 
--- এসো।  

হাঁটতে হাঁটতে লায়লা আমাকে বলছিল -- বিয়ে করেছ? 
-- না। 
-- কেন করো নাই? 

হঠাৎ ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।  লায়লা বলছিল --  তুমি একটা রিকশা নিয়ে বাস স্টান্ডে চলে যাও। ঠান্ডা লাগবে।  তোমার তো একটুতেই ঠান্ডা লাগে।        
আমি বললাম -- আচ্ছা। 
লায়লা হেঁটে হেঁটে  চলে গেল।  

অনেক দূর পর্যন্ত যেয়ে লায়লা একবার পিছনে ফিরে তাকায়।  ও দেখতে পায় -- তখনও রাস্তার উপর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে আমি ওর চলে যাবার পথের  দিকে তাকিয়ে আছি, তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি বৃষ্টিতে ভিজছি।   
                  
 
কোয়েল তালুকদার
২৮ মে, ২০২০ ইং, ঢাকা।                                        

                            
                           
                    

রবিবার, ২৪ মে, ২০২০

রুক্সীণী

রুক্সীনী

নাইনে পড়ি তখন।  কার্তিক মাসের এক  ছুটির দিনে একাকী  মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার বাড়ি ছিল  গোপীনাথপুরে। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে। যমুনা নদীর তীর ঘেসে বাড়ি। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। মাঝখানে একটা ছোট নদীও পড়ে। খেয়া নৌকায় পার হতে হয়।     

রবিনহুডের মতো একদিন হেঁটে হেঁটে মাঠ ঘাট প্রান্তর পার হয়ে পৌঁছে যাই গোপীনাথপুর আমার  মামার বাড়ি। 

মামাতো ভাই ছাইদুলের সাথে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বিকালে যখন বাড়ি ফিরব, তখন ছাইদুল বলছিল, তুই কোন্ পথ দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবি?
আমি বললাম, আমি এসেছি নদীর কূলের পথ ধরে। ফিরে যাবও ঐ পথ দিয়েই। 

ছাইদুল আমাকে বুদ্ধি দিল --  তুই যে পথ দিয়ে এসেছিস, ঐ পথ দিয়ে যাবি না। আরও একটা সুন্দর পথ আছে, তুই ঐ পথ দিয়ে যাবি। খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারবি।     

আমি বললাম -- কোন্ পথ দিয়ে যাব ? বলে দে।

ছাইদুল পথ বলে দিল -- প্রথমে খেয়া নৌকায় ছোট নদীটা পার হবি। নদী পার হয়ে বামদিকে পথ দিয়ে না যেয়ে সোজা পাঁচঠাকুরী গ্রামের পথ ধরে পশ্চিম দিকে চলে যাবি।  তবে পাঁচঠাকুরী গ্রাম পর্যন্ত যাবি না। আধা মাইল যাওয়ার পর দেখবি,  হাতের বাম দিকে একটা মেঠো পথ নেমে গেছে।  ঐ মেঠো পথ ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর  তিন রাস্তার মোড় দেখতে পাবি। 

ঐ তিন রাস্তার মোড়ে  তুই বামদিকের রাস্তায় যাবি না, ডানদিকেও যাবি না। সোজা চলে যাবি। কিছু দূর যাওয়ার পর একটি বড়ো আমগাছ দেখতে পাবি। ঐ আমগাছের তলা দিয়ে হেঁটে চলে যাবি সামনের গ্রামের দিকে।  ঐ গ্রামের পরই তোদের কুসুমপুর গ্রাম। 
                                                           
বিকালে যখন বাড়ি ফিরে আসছিলাম, তখন ছাইদুলের বলে দেওয়া পথ ধরেই আসতে থাকি। প্রথমেই খেয়া পার হচ্ছিলাম। আমার সাথে খেয়া পার হচ্ছিল একজন বোষ্টুম ও একজন বোষ্টুমি। ওদের পরনে ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়। দুজনের হাতে দোতারা!  আমি বললাম -- তোমরা একটা গান গেয়ে শোনাবে আমাকে!  টাকা চাইলে টাকা নিবা। আমার কাছে দশ টাকা আছে। তাই দেব তোমাদের।                                    

বোষ্টুমি বলছিল -- 'আমরা কত ঘাটে কত বাটে, কত চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে -- কত গান গেয়ে শোনাই মানুষকে। কেউ পয়সা দেয়, কেউ দেয় না। আজ আমরা তোমাকে এমনি একটা গান শোনাব, কোনো পয়সা লাগবে না।'        

বোষ্টুমি দোতারায় তান তুলল। বোষ্টুম বাজাচ্ছিল খুঞ্জরি টুংটাং করে --
দুজনেই একসাথে গেয়ে শোনাল গান।

'ছেড়ে দিয়া মায়াপুরী
দিতে হবে ভব পাড়ি
চেয়ে দেখো মন-ব্যাপারী
দিন গেলে হয় সন্ধ্যা ..
চোখ থাকতে হও আন্ধা ..
এই দুনিয়া মায়া জালে বান্ধা ..'
                      
কী ভালো লাগছিল গানটা!   এক অদ্ভুত বিকাল ছিল তখন।  ছোট্ট সেই নদীর জলের ক্ষীণ ধারা ছলাৎছল করে উঠছিল। বিকালের  আকাশের সব সোনালি আভা যেন মেখে দিচ্ছিল আমার  অন্তরের মাঝে!  

খেয়া নৌকায় পার হয়ে যখন এ পাড়ে আসি তখন আমি বৌষ্টুমীকে বলি -- তোমরা কোথায় যাচ্ছো? 
--- আমরা ধলডোব গ্রামে যাব। ওখানে রায় বাড়িতে গানের আসর আছে। ওখানে আমরা গান শোনাব।
--- আমারে সাথে নিবা?
--- তুমি যাইবা?
--- হু,  যাব।
--- তোমার বাবা মা তোমাকে বকবে না?
--- তারা জানবে না।    
---  তাই?  চলো তবে ।          

নদী পার হয়ে পশ্চিম দিকে রাস্তা ধরে বৌষ্টুমীদের সাথে হাঁটতে থাকি। সূর্যের কড়া রোদ  মুখে  এসে পড়ছিল। খুব ভালোও লাগছিল।  কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি -- এক বাড়ির গাছ তলায় অনেক মানুষের জটলা।  লাঠির বারির আওয়াজ আর শোরগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এক লোককে জিজ্ঞাসা করি ,  ওখানে কী হচ্ছে? লোকটি বলল -- লাঠিখেলা হচ্ছে। '   

আমি বোষ্টুমী দিদিকে ডাকলাম -- ও দিদি! 
-- কী!
-- লাঠিখেলা দেখবা?
-- না, আমাদের সময় নেই।
-- আমি দেখব। 
-- তুমি দেখ গে।
-- তোমাদের সাথে আমার আর যাওয়া হলো না।
-- আচ্ছা।    
-- তোমাদের আবার কোথায় দেখা পাব?
--- আমরা পথের মানুষ। পথে পথে ঘুরি। এই পথেই দেখা পাবে কোনো একদিন । 
 
আমি চলে যাই লাঠি খেলা দেখতে। কী যে চমৎকার লাঠি খেলা হচ্ছিল।  পালোয়ানের 
মতো দুজন সুঠাম লোক লাঠি খেলছে । উঁচা লম্বা। পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি।  লুঙ্গি মালকোচা করে বান্দা। পোক্ত বাঁশের লাঠি।  পোড়ানো এবং কালচে রঙ করা।  সে কি তুমুল বাইরাবেরি। খটখট আওয়াজ হচ্ছে। লোকজন হুল্লোড় কড়ছে। কেউ শীষ দিচ্ছে। আমি বিস্ময় ভরে ওদের লাঠি খেলা দেখতে থাকি!       

মাগরিবের আযানের আগ দিয়ে লাঠি খেলা শেষ হয়ে যায়। খেলা দেখা শেষ করে আমি পুণরায় আবার বাড়ির পথে চলতে থাকি।       

ছাইদুল বলেছিল -- পাঁচঠাকুরী গ্রামের আগেই বামদিকের একটি মেঠো পথ দিয়ে যেতে হবে। পাঁচঠাকুরী গ্রামের ঐ পর্যম্ত যেতেই কালী সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমার সাথে কোনো সঙ্গী সাথী নাই। খুব ভয় ভয় লাগছিল আমার ।                                         
আমি রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম,  ঠিক এই মেঠো পথ দিয়ে যেতে হবে কী না? পথটির দুধারে বিস্তৃর্ণ আখের ক্ষেত।  কিছু দেখা যায় না।  তার উপর সন্ধ্যা রাত্রির অন্ধকার!  ঠিক তখনই আখের ক্ষেতের ভিতর থেকে মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে আসে একজন যুবতী নারী।       

রমণীটিকে আমি চিনি। এ যে আমাদের গাঁয়ের  ভোলা মন্ডলের সুন্দরী বউ। আমি একটু সাহস পেলাম -- বললাম -- তুমি কই যাও?
-- 'নরপাড়া বাপের বাড়ি যাইতাছি।  তোমার ভোলা ভাই আমারে মাইরা খেদাইয়া দিছে!'   

এই রাতে আমাকে একা দেখে ভোলা মন্ডলের বউ  বলছিল --  'তা তুমি একা যাইতে পারবা?  সামনে একটা জায়গা আছে, খুব একটা ভালো না।  তুমি তিন রাস্তার মোড়ে যেয়ে সোজা যাইও। ভুলেও ডান দিকে যাবা না।'    

আমি বললাম -- আচ্ছা। 
ভোলা মন্ডলের বউ বলছিল, 'আমি কী তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসব?'

এই নিশি রাতে এক পর সুন্দরী রমণী আখ ক্ষেতের ভিতর দিয়ে আমার সাথে গমন করবে,  কেউ দেখলে আমার বদনাম হবে।  এই ভেবে আমি ভোলা মন্ডলের বউকে বললাম -- আমি একাই যেতে পারব।           

ভোলা মন্ডলের বউ পাশের নরপাড়া গাঁয়ের দিকে চলে গেল। আমি আখ ক্ষেতের ভিতর  দিয়ে মেঠো পথ ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি।  কিছুদূর আসার পর দেখি -- আখ ক্ষেতের পাতাগুলো বাতাসে নড়ছে। একটু ভয় পেলাম। যত হাঁটছি, ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝি পোকার ডাক বাড়ছে।  আকাশে চাঁদ নেই।  আখ পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশে চেয়ে যা দেখছি তা কয়েকটি অনুজ্জ্বল তারা।                                                                   
হঠাৎ দেখি -- কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মুনিয়া পাখি উড়ে আসছে। ওরা আমার মাথার উপর দিয়ে শন শন করে চলে যাচ্ছে।  অদূরে শিয়ালও ডাকছে হুক্কাহুয়া করে। শিয়ালের ডাক শুনে আমি ভয় পেলাম না।  আমি হাঁটতে থাকি সাহস করে সামনের দিকে।       

কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি -- সেই তিন রাস্তার  মোড়। আমাকে মাঝের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু দেখি, মাঝের  রাস্তার উপর অনেকগুলো কাক মরে পড়ে আছে।  মরা কাকের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাকে যেতে হবে।  খুব ভয় লাগছিল আমার।   

আমি মাঝের রাস্তা দিয়ে না যেয়ে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে য়েতে থাকি। কী সুন্দর খোলা পথ!  খুব ভালো লাগছিল হাঁটতে। কোথাও কোনো আখ ক্ষেত নেই। চারিদিকে সব সরিষার ক্ষেত।  রাতের বেলায় হলুূদ ফুলের প্রান্তর দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম।  কেমন এক মোহন আবেশে মন ভরে উঠছিল। গন্ধে আকুল করে রেখেছিল রাতের মিহি বাতাস।  আমি সে গন্ধ মেখে হাঁটতে থাকি।  
                          
সামনের দিকে এগুতেই দেখতে পাই  -- একটি পরিত্যক্ত নীলকুঠি। নীলকুঠি তো নয়, পোড়ামাটির ধ্বংসস্তূপ।  শুনেছি এই কুঠি এলাকায় কেউ ভয়ে দিনের বেলায় আসে না। এখানে নাকি ভূতের আড্ডা বসে দিনে ও রাত্রিতে। 
        
হায় আল্লাহ!  আমাকে কে যে এখানে টেনে নিয়ে এলো ! কোন্ জ্বীন পরী?  পিছনে তাকিয়ে দেখি -- কোথাও কোনো হলুদ সরিষার ক্ষেত নেই। সব মিছে ছিল।  সব আখ ক্ষেত!          

নীলকুঠির সামনে বাবলা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি এক দাড়িওয়ালা বুড়াকে। আমি বুড়াকে বলি -- দাদু, আমি পথ ভুল করে এখানে এসেছি।  আমাকে তুমি  পথ দেখিয়ে দাও। 
--- তুই আর এখান থেকে যেতে পারবি না!
--- কেন পারব না? 
--- তোকে বলি দিব। 

বুড়ার পিছনে দেখি -- পনের ষোল বছরের একটি রূপবতী মেয়ে।  পরীর মতো চেহারা। অসম্ভব সুন্দরী।  মাথার চুল দুই বেনী করা। বেনীতে বাবলা ফুল গাঁথা , আর গলায় কাঁঠালীচাঁপা ফুলের মালা। আমি বললাম -- মেয়েটি কে? 
বুড়া বলল -- ওকে আমি যমুনার নদীর এক গহীন চর থেকে নিয়ে এসেছি। ওর নাম রুক্সীণী । ও  আমার নাতীকে ভালো বাসত। কিন্তু আমার নাতী সাপে কেটে মারা গেছে। 

তারপর থেকে রুক্সীণী পাগল হয়ে কাশবনে পড়ে থাকত। কিছু খেত না।  কী করব? ওর জন্য আমার খুব মায়া হয়।  পরে ওকে আমি এখানে এই নীলকুঠিতে নিয়ে আসি বিবাহ করব বলে । কিন্তু আমার তান্ত্রিক  গুরু শর্ত দিয়েছে আমাকে আগে  নরবলি দিতে হবে। তারপর আমি  বিবাহ করতে পারব।       

মেয়েটি আমার দিকে সেই অন্ধকার রাত্রিতে খুব মায়া করে তাকিয়ে দেখছিল।  যেন কতকাল ধরে সে আমাকে চেনে। আমিও তাকে  চিনি। আমি ইঙ্গিৎ করে -- মেয়েটিকে বললাম -- তুমি আমাকে বাঁচাও! আমিও তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব। 

বুড়া আমাদের শলাপরামর্শ বুঝতে পারছিল। বুড়া বলে -- 'এখানে দাঁড়া তুই ,  আমি ভিতর থেকে রামদা নিয়ে আসি। এখনই তোর গর্দান মাটিতে  ফেলে দিব।'  এই কথা বলে বুড়া নীলকুঠির  ভিতরে চলে যায়। 

আমি এই সুযোগে খপ করে রুক্সীণীর একটি হাত ধরি। এবং দুজন হাত ধরে ক্ষেত পাতাইলা ঝাইরা আমাদের গ্রামের  দিকে দৌড় দেই।                 

এর পরের ঘটনা আমার আর মনে নেই।

তখন বেলা দশ ঘটিকা হবে ।  আমি আমাদের বাড়ির ঘরে পালঙ্কের উপর শুয়ে আছি। চারপাশে অনেক মানুষ!  সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ভীড়ের মধ্যে একটি মেয়েকে দেখতে পেলাম -- ঠিক রাতে দেখা নীলকুঠির ঐ পরী মেয়েটির মতো। চুল দুই বেনী গাঁথা, বেনীতে বাবলা ফুল, গলায় কাঁঠালিচাঁপার মালা। এই মেয়েটিকে এর আগে কখনও আমাদের বাড়িতে   দেখি নাই।                                                                                                               
                          
কোয়েল তালুকদার
২৫ মে, ২০২০ ইং,  ঢাকা।              

                                

বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০

বাঁধন কেটে যায়

বাঁধন কেটে যায়  

বিয়ের আগের কথা। আমি আমার বাংলো বাড়িতে তখন একা থাকি। একদিন দেখি বারান্দায় টিনের টুইয়ের ফাঁকে দুটো চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছে। কখন ওরা খড়কুটো এনে বাসা তৈরি করেছে, আমি বুঝতেই পারিনি। 

আমার ভালোই লাগত ওদের উড়াউড়ি ছোটাছুটি কিচিরমিচির।  সকালবেলা ওদের কিচিরমিচির যেন বেড়ে যায়।  মনে হতো, ওরা যেন বলছে --- 'ঘুমিয়ে থেকো না, ওঠো, তোমার অফিসে যাবার সময় হয়েছে।'       

একদিন দেখলাম,  মেয়ে চড়ুইটি বাসার ভিতর চুপটি করে বসে আছে। বুঝতে পারলাম,  ডিম পেরেছে। সেই ডিমে তা দিচ্ছে।  আমার খুব ভালো লাগল -- ওরা বাসা বাঁধল।  এখন ওদের ছেলেমেয়েও হবে।া

আমি জেনেছিলাম, মেয়েরা যখন পোয়াতি হয়, তখন নাকি তাদের ভালো মন্দ খাবার খেতে হয়। এই ভেবে আমি একদিন অফিস থেকে আসার সময় দোকান থেকে চালের খুঁদ ও বিস্কুট কিনে নিয়ে আসি। আমি প্রতিদিন উঠোনে চালের খুঁদ ও বিস্কুট গুঁরো করে ছিটিয়ে দিতাম,  চড়ুই দুটো খুব মহানন্দে তা খেত।                             

তারও কিছুদিন পর দেখলাম, চড়ুয়ের ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফুটেছে।  ছেলে চড়ুই ও মেয়ে চড়ুই দুজনের চোখে মুখে সে কি হাসি!  ওদের নতুন ধরনের  কিচিরমিচির শব্দ শুনেই আমি তা বুঝতে পারতাম।  ওদের পরিবারের সংখ্যা যেহেতু বেড়ে গেছে,  তাই আমি খুঁদ ও বিস্কুটের গুঁরো বেশি করে উঠোনে ছিটিয়ে দিতাম।                             

বাচ্চা চড়ুইগুলো দিনে দিনে বড়ো হয়ে উঠল। আর একদিন দেখলাম, সেই বাচ্চা চড়ুইগুলো আর নেই।ওরা উড়ে চলে গেছে।         

কয়দিন চড়ুই দুটোকে খুব মন খারাপ দেখলাম।  ওরা আমার ছিটানো খাবারগুলো তেমন খাচ্ছে না।কিচিরমিচিরও তেমন করে না।

তারও কয়েকদিন পরে দেখি, ওরা আগের মতোই উড়াউড়ি ছুটাছুটি করছে। যেন সব দুঃখ বেদনা ভুলে গেছে।  সকালবেলায় কিচিরমিচির করে আগের মতই  বলত --  'তুমি ওঠো, তোমার অফিসে যাবার সময় হয়ে গেছে।'                                 

কতোদিন ধরে চড়ুই দুটো আমার ঘরের বারান্দায় বাসা বেঁধে আছে,  আমার ভালই লাগত ওদের সাথে এই একাকী জীবন যাপন।  মনে হতো,  এই একাকী বাড়িতে  কেউ না থাকলেও ওরা তো আমার সাথে আছে।
           
তার আরো পরে যেদিন আনন্দ উৎসব করে আমি  বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসলাম। সেদিন  চড়ুই দুটোও আমার সব আনন্দ উৎসব দেখল। ওদেরকেও খুব হাসি খুশি মনে হল। ওদের কিচিরমিচির আমার কাছে আনন্দ সঙ্গীতের মতো মনে হয়েছে।

পরের দিন সকালবেলা  নতুন বউয়ের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলাম, নতুন বউকে  বললাম -- এই পাখি দুটো ছিল আমার একাকীত্বের সঙ্গী। ওরা আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিত।    

কিচিরমিচির করে পাখি দুটো  কী যেন বলছিল তখন,  বুঝতে পারিনি।

ঐদিন সারাদিন পাখি দুটোকে আর দেখতে পেলাম না।  সন্ধ্যায়ও ফিরে এল না। পরের দিন    সকালেও না। আসলে ওরা বাঁধন কেটে উড়ে চলে গেছে। পরে মনে হয়েছিল -- ওরা যে কাল যাবার বেলায়  কিচিরমিচির করে যে কথা বলেছিল,  তখন তা বুঝতে পারিনি । 

ওরা হয়ত বলেছিল -- 'তোমার ঘরে এখন নতুন মানুষ এসেছে। এখন থেকে সেই তোমায় সকালবেলা ঘুম ভাঙাবে। তোমাকে গান গেয়ে শোনাবে। তুমি তার সাথে গল্প করবে। আমাদের দায় শেষ।  আমরা তাই উড়ে চলে গেলাম।'                           

কোয়েল তালুকদার
২২ মে, ২০২০ ইং,  ঢাকা।    
                      
                                     

         
       

                         

        

বুধবার, ২০ মে, ২০২০

ছোট্ট মায়া

ছোট্ট মায়া  

তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। কার্তিক মাসের এক 
ছুটির দিনে একাকী  মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার বাড়ি হচ্ছে গোপীনাথপুরে। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে। যমুনা নদীর তীর ঘেসে মামার বাড়ি । পায়ে হেঁটে যেতে হয়। মাঝখানে একটা ছোট নদীও পড়ে। খেয়া নৌকায় পার হতে হয।     

রবিনহুডের মতো একদিন হেঁটে হেঁটে মাঠ ঘাট প্রান্তর পার হয়ে পৌঁছে যাই গোপীনাথপুর আমার  মামার বাড়ি । 

সারা বিকাল পর্যন্ত মামাতো ভাই ছাইদুলের সাথে পুরো গ্রাম চষে বেড়াই। যমুনার কূলে যাই বেড়াতে। দেখি, সেখানে  মাটির পাড় ভেঙে পড়ছে নদীতে। বয়রা ঘাট থেকে ছেড়ে আসা বড়ো স্টীমারটি ভেঁপু বাজিয়ে চলে যাচ্ছে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের দিকে। চলছে লঞ্চ ও পাল তোলা সারি সারি নৌকা। জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরছে । দূরে মাঝ নদীতে জেগে ওঠা চর জুড়ে দেখতে পাচ্ছিলাম সাদাকেশি কাশবন।   
  
মাঠে কার্তিকের রোদ্রতাপে কিষাণীরা কাজ করছিল। কেউ কেউ জারীগান গাইছিল আপন মনে, কেউ হুকোয় তামাক তুলে মনের সুখে গরগর শব্দ তুলে টান দিচ্ছিল। নদীর কূলে উপরে ছেয়ে আছে  নীল আকাশ, সেই আকাশে বিভিন্ন পাখি উড়ছে। উড়ছিল চিলও। নদী থেকে বাতাস বয়ে আসছিল শন শন করে। কী যে ভালো লাগছিল -- কূলে দাঁড়িয়ে জল দেখতে!  
                       
কিন্তু যমুনার  একটি জিনিস দেখে আমার খুব 
মনখারাপ হয়েছিল । দেখলাম,  আধা পাকা ধানক্ষেত, সরিষা ক্ষেত, আখ ক্ষেত ভেঙে ভেঙে পড়ছে উত্তাল নদীতে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল --  চোখের সামনে দেখলাম,  একটি বহু প্রাচীন জীর্ণ মঠ  মাটি উপড়ে নদীর জলে তলিয়ে  যেতে ।       

যমুনার পাড় থেকে  ফেরার পথে ছাইদুল আমাকে বলছিল -- 'তুই তো খুব মন খারাপ করেছিস দেখছি। চল্ তোর মন ভালো করে দেই।' 
আমি বললাম, কী সে ! 
ছাইদুল বলল - ' আলেয়া আপুর নাম শুনিস নাই? আমার চাচাতো ফুপুর মেয়ে। পূর্ব পাড়ায় ওদের বাড়ি।  তোকে ওখানে ঐ বাড়িটায় নিয়ে যাব।'
আমি বললাম, 'আলেয়া আপুর নাম শুনেছি মার কাছে থেকে। কিন্তু কোনো দিন দেখি নাই তাকে ।'      
আম, জাম, কাঁঠাল, শুপারি ও নারিকেল গাছ বেষ্টিত ছিমছাম পরিবেশে আলেয়া আপুদের বাড়ি। আমরা বাড়িতে ঢুকতেই দেখতে পেলাম  -- আলেয়া আপুকে। এমন পল্লীর নিবিড় কোণে, এমন প্রতিমার মতো মেয়ে থাকে ! বিস্ময়ে চেয়ে দেখছিলাম। চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ,... চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি করে না। আমি তখন নিতান্তই  কিশোর--উত্তর এক তরুণ। মেয়েদের রূপ লাবণ্য ঐ ভাবে তখন বুঝতাম না।  আমি যখন অনেক বড়ো হয়ে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হলাম -- চন্দ্রাবতী, পদ্মাবতী, পার্বতী, লাবণ্যদের রূপ বর্ণনা যখন পড়েছি,  তখন অনেক আগের -- সবুজ পত্রপল্লব ঘেরা পল্লী গৃহকোণে একজন আলেয়া আপুকে দেখা তার অপূর্ব শ্রীময়ী মুখখানি মনে মনে মিলাতাম।  
                     
কী সুন্দর করে কত কথাই না বলেছিল আলেয়া আপু -- ' তুমি কী পড়ো, কী হতে চাও জীবনে, কী ভালো লাগে তোমার, আমার কথা তোমার মনে থাকবে,  তুমি অনেক ভালো ছেলে !'  এমন অনেক ভাঙা ভাঙা কম্পিত কথা।   
          
আলেয়া আপুদের বাড়ি থেকে যখন চলে আসি -- তখন আপু বলেছিল -- 'ফাল্গুনের চার তারিখে আমার বিয়ে হবে।  তুমি এসো বিয়েতে।  কী আসবে না তুমি? '

আমি মাথা নেরে বলেছিলাম -- ' আসবো আপু। আমি এসে সারা বাড়ির উঠোনে আলপনা আঁকবো আর নেচে নেচে হারমণিকা বাজাবো।'      

পথে আসতে আসতে সাইদুল আমাকে বলছিল -- কী আলেয়া আপুকে দেখে তোর মন ভালো হয়েছে তো ?'  আমি বলেছিলাম -- 'হয়েছে।'

কিন্তু,  ছাইদুল জানতে পারেনি,  সেদিন আমার কোমল কিশার তরুণ মন অনেক খারাপও হয়েছিল। সেই মনখারাপের বিষণ্ণতা আজও মনের উপর ছায়া ফেলে।        

বিকালে যখন বাড়ি ফিরে আসছিলাম, তখন আমার সাথে খেয়া পার হচ্ছিল একজন বোষ্টুম ও বোষ্টুমি। ওদের পরনে ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়। দুজনের হাতে দোতারা!  আমি বললাম -- তোমরা একটা গান গেয়ে শোনাবে আমাকে!  টাকা চাইলে টাকা নিবা। আমার কাছে দশ টাকা আছে। তাই দেব তোমাদের।                                    

বোষ্টুমি বলছিল -- 'আমরা কত ঘাটে কত বাটে কত গান গেয়ে শোনাই মানুষকে। কেউ পয়সা দেয়, কেউ দেয় না। আজ আমরা তোমাকে এমনি একটা গান শোনাব, কোনো পয়সা লাগবে না।'        

বোষ্টুমি দোতারায় তান তুলল। বোষ্টুম বাজাচ্ছিল খুঞ্জরি টুংটাং করে --
দুজনেই একসাথে গেয়ে শোনাল গান।

'...ছেড়ে দিয়া মায়াপুরী
দিতে হবে ভব পাড়ি
চেয়ে দেখো মন-ব্যাপারী
দিন গেলে হয় সন্ধ্যা ..
আপনি যদি ভালো বুঝ
সুসময়ে মুর্শিদ ভজ
জ্ঞান থাকিতে পাগল সাজো
চোখ থাকতে হও আন্ধা ..
এই দুনিয়া মায়া জালে বান্ধা ..'
                      
                                       
মানুষের জীবনে শুরু থেকে কত কিছুই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি থাকে !  কত সুখ অনুরণরিত হয় বোষ্টুমীর ঐ দোতারার তানের মতো চিরকাল।  আবার কত মায়া--বেদনা আটকে থাকে বুকের গভীরে অনন্ত জীবন ধরে, কান্না হয়ে তা ঝরে পড়েনা। 

কী এক অদ্ভুত সন্ধ্যা ছিল সেদিন।  ছোট্ট সেই নদীর জলের ক্ষীণ ধারা ছলাৎছল করছিল। সন্ধ্যা আকাশের সব সোনালি আভা যেন মেখে দিচ্ছিল অন্তরের মাঝে!  

কিছু রঙ তার এখনও মনকে রঙিন করে।                                  
                         
কোয়েল তালুকদার  
২১ মে, ২০২০ ইং,  ঢাকা।  

শনিবার, ১৬ মে, ২০২০

নদীর কূলে করি বাস

নদীর কূলে করি বাস    

অভয় দাশ লেনের একটি গলিতে আলী হোসেন দুই রুম নিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে ভাড়া থাকেন। বিল্ডিংটি প্রায় শত বছরের পুরোনো। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। ফাটলও ধরেছে। পরগাছাও জন্মেছে। প্রতি রুমে একটি করে  জানালা থাকলেও দিনের বেলায় সারা ঘর অন্ধকার থাকে। আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। কেমন গুমোট পরিবেশ।          

আজ পনেরো বছর ধরে আলী হোসেন এই বাড়িতেই ভাড়া থাকে। বাংলাবাজারে একটি প্রেসে সে চাকুরি করে। চাকুরিও করছে সে একই জায়গায় পনরো বছর ধরে। এক বাড়িতে বছরের পর বছর বসবাস করা এবং একই চাকুরি বছরের পর বছর করে যাওয়া -- দুটোর ভিতরই তার একঘেয়েমি এসে গেছে।         

একঘেয়েমি এসে গেছে তার স্ত্রীরও। সে প্রায়ই তার স্বামীর সাথে ঝগড়া করে, বলে -- জীবনে ভালো আর কোনো চাকুরি পেলে না। বাসাও পরিবর্তন করলে না, ড্রেনের দূর্গন্ধের মাঝে মশা-মাছি পোকামাকড়ের ভিতর সারাজীবন বসবাস করালে।একটু মুক্ত হাওয়া নেই। জানালা খুললে দখিনা বাতাস আসে না। নীল আকাশ দেখতে পাই না। দূরে কোথাও খোলা মাঠ নেই। কোথাও কোনো নদী নেই। গাছ নেই। পাখি নেই।                                     
আলী হোসেনের বাড়ি সাতক্ষীরার দেবহাটা।পড়াশোনা করেছিল কালীগঞ্জের নালতায় এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে লজিং থেকে। আর এই লজিং বাড়িরই রূপবতী মেয়ে রুমার সাথে তার প্রেম হয়। কিন্তু  রুমার বাবা মা এই প্রণয় মেনে নেয়নি।

আলী হোসেন আইএ পাশ করে ঢাকায় চলে আসে। এবং বাংলাবাজারের একটি প্রেসে চাকুরি নেয়। একবার বাড়িতে যেয়ে রুমাকে পালিয়ে ঢাকায় নিয়ে এসে বিয়ে করে এবং অভয়দাশ লেনের এই বাড়িতে তোলে। আর সেই থেকেই এখানে তারা বসবাস করে আসছে।         

তার জীবনে অনেক অপ্রাপ্তি ও অতৃপ্তি আছে। সে স্কুল কলেজ থেকেই ভালো কবিতা লিখত। তার স্ত্রী রুমা যখন প্রেমিকা ছিল, তখন তাকে নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখেছে। আর এইসব কবিতা চিঠির মতো করে  রুমাকে দিত। রুমার মন ভুলে যেত সেইসব কবিতা পড়ে। একটা কবিতার কিছু কথা এখনও মনে আছে --            
'দূরে বহুদূরে চঞ্চল মেঘের মাঝে আকাশ ছাড়িয়ে যদি তুমি ভেসে যাও, ব্যাপ্তিও ছড়াও ঐ দূরালোকে। আমি গভীর গহনে আবর্তিত হই একাকী আমার ভূবন মাঝে। তুমি যতদূরেই যাও, আমার ভূবনেই তুমি ব্যাপ্ত হয়ে থাকো।'

আলী হোসেন এই মেয়েটিকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কখনও কবিতার শব্দের মায়াবুননে তাকে গেঁথেছে, কখনও রূপকথার গল্প কথা বলে তার মন ভুলিয়েছে, কিন্তু কোনো রূপকথা কখনোই আর নিজের গল্পকথা হয়ে ওঠেনি। 

এই জীবনে সে কবি হতে পারেনি যেমন, তেমনি তার স্ত্রীকে সুন্দর পরিবশে একটি বাড়ি করে দিতে পারেনি এখনও। কিন্তু এই স্বপ্ন দুটো অনেক দিন ধরে এখনও সে দেখে আসছে।                          

অভাব অনটনের এই সংসারে অনেক গঞ্জনা সইতে হয় আলী হোসেনের। অবিশ্বাসী, চরিত্রহীন,  লম্পট হওয়ার কথাও শুনতে হয় তার স্ত্রীর কাছে থেকে। অনেক বছর ধরে আলী হোসেন তার মাহিনার পুরো হিসাব তার স্ত্রীকে দিতে পারে না। প্রতি মাসেই কিছু না কিছু টাকা হিসাবে গরমিল থাকে।  এই নিয়ে স্ত্রীর সাথে অনেক বছর ধরে ঝগড়া হয়ে আসছে।

স্ত্রী রুমার ধারণা আলী হোসেন অন্য কোনো মেয়ের পিছনে টাকা খরচ করে। সে খারাপ মেয়েদের কাছে যায়। স্ফূর্তি ও বিলাসিতা করে টাকা অপচয় করে।       

একদিন স্ত্রীর সাথে তার এই ব্যাপারটি নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়।  আলী হোসেন অফিসে চলে যায়। অফিসে যেয়ে তিন মাসের অবৈতনিক ছুটি নেয়। এবং ওখানেই বসে বসে রুমার কাছে একটি পত্র লেখে। বিকালে বাসায় চলে আসে।  চুপিচুপি সেই পত্রখানি রুমার বালিশের নীচে রেখে দেয়। এবং একটি কাগজের ইনভিলপে কিছু টাকা রেখে দিয়ে পূণরায় ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায।      

সন্ধ্যা হয়ে রাত্রি হয়ে যায়। আলী হোসেন আর ঘরে ফিরে আসে না। রুমা কী করবে কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারে না। সে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। তার কান্না দেখে নাবালক সন্তান দুটোও কান্না করতে থাকে।  অনেক রাত পর্যন্ত সে না খেয়ে বিছানায় বসে বসে অশ্রুপাত করে। হঠাৎ বালিশটা সরাতেই সে একটি চিঠি দেখতে পায়। চিঠিখানি খুলে সে পড়তে থাকে ---           

কল্যাণীয়াসু রুমা

এই জীবনে তোমাকে যে আমি কত ভালোবাসিয়াছি, তা তুমি বুঝিতে পারো নাই। তোমার অনেক স্বপ্ন আমি পূরণ করিতে পারি নাই। এই জন্য আমারও গ্লানি কম হয় নাই। তুমি অনেক কষ্ট করিয়া আমার অভাব অনটনের সংসারে থাকিয়া গিয়াছ। তুমি আমাকে ফেলিয়া রাখিয়া বিত্তবান পিতার গৃহে ফিরিয়া যাও নাই।  আমি জানি, তুমি আমাকে এখনও অনেক ভালোবাসো, এই সংসারকে ভালোবাসো, তোমার সন্তানদের ভালোবাসো। 

আমি কিছুদিনের জন্য  তোমাদের মায়া ত্যাগ করিয়া নিরুদ্দেশ হইয়া চলিয়া গেলাম। বেঁচে থাকিলে আমি আবার তোমাদের কাছে ফিরিয়া আসিব। ইনভিলপের ভিতর কিছু টাকা রাখিয়া গেলাম। আমার ধারণা, কষ্ট করে তুমি মাস তিনেক  চলিতে পারিবে।

আমি এখনও স্বপ্ন দেখি -- তোমার সুন্দর একটি বাড়ি হইবে। কবিতা লেখার জন্য আমার একটি আলাদা কক্ষ থাকিবে। দক্ষিণের জানালা খুলিলেই দখিণা হাওয়া আসিয়া তোমার গায়ে লাগিবে। অদূরে নদী থাকিবে। নীল আকাশের ছায়াতল দিয়া হাঁটিয়া হাঁটিয়া আমরা দুজন নদীর কূলে বেড়াইতে যাইব। ওখানেই সন্ধ্যা নামিবে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠিবে। তারায় তারায় আকাশ ভরিয়া উঠিবে।  আমরা জোছনা মাখিয়া মাখিয়া তারপর ঘরে ফিরিয়া আসিব।           

জানিনা এই স্বপ্ন পূর্ণ হইবে কী না, তবু আমি সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে অভিযাত্রা করিলাম।
ইতি -- তোমার আলী।         

ঠিক দুই মাস পঁচিশ দিন পর.... 

একদিন সন্ধ্যারাতে আলী হোসেন গৃহে ফিরে আসে। মুখ ভর্তি তার দাড়ি। এই কয়দিনে সে দাড়ি কাটে নাই। চোখে, মুখে, শরীরে ক্লান্তির ছাপ। অনেক ধকল ও পরিশ্রমের ছাপ সুস্পষ্ট। রুমা তার স্বামীকে পেয়ে খুব খুশি হয়। আনন্দে উৎফুল্ল হয়  তার ছেলেমেয়ে দুটোও। সে রাতে রুমা আলী হোসেনের বুকে মাথা রেখে আনন্দ অশ্রু জলে ভাসিয়ে দিয়ছিল।                                                                                    
পরের দিন আলী হোসেন চাকুরি থেকে ইস্তফা দিলেন। বাড়িওয়ালাকে নোটিশ করলেন বাড়ি ছেড়ে দেবার। আসবাব পত্র যাকিছু ছিল সব বিক্রি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। রুমা, তার স্বামীকে বলে -- তুমি এসব কী করছো? 
-- এখানে আর থাকব না। আমরা আবার দেবহাটা আমাদের গ্রামের বাড়ি ফিরে যাব।

অভয়দাশ লেনের এই ঘিঞ্জি গলির বাড়িতে সেদিন ছিল শেষ রাত। আলী হোসেন ও রুমা বিছানায় শুয়ে আছে। কারোর চোখেই ঘুম আসছে না। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে। কত হাসি কান্না, কত দুঃখ-সুখ, কত ঝগড়া বিসম্বাদ, কত ভালোবাসার ক্ষণ কেটেছে এই বাড়িতে। কত মধুময় স্পর্শ ছিল দুজনের মধ্যে।  কত প্রেম এসেছিল দুজনের জীবনের প্রান্তে। 

মনে পড়ে,  রুমা সবকিছু ছিন্ন করে তার হাত ধরে উঠেছিল এসে এই বাড়িতেই। বিষণ্ণ দুটো তরুণ তরুণী সেদিন স্বজনহীন একাকী বাসর রাত কাটিয়েছিল । রুমার পরনে কোনো লাল বেনারসি শাড়ি ছিলনা, হাতে ছিলনা মেহেদি। মুখে ছিলনা চন্দন চিহ্ন। গায়ে মাখেনি কোনো আতরের গন্ধ। একটি ফুলও কেউ ছিটিয়ে দেয়নি তাদের বাসর শয্যায় । আয়নাতে দেখেনি দুজন দুজনের মুখ। কেউ মুখে তুলে খাওয়ানি একটুখানি মিষ্টি। কেউ কোনো প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে রাখেনি এই বন্ধ ঘরে।   

এই বাড়ি এই ঘর, পনেরোো বছরের গড়া সুখ দুঃখের এই খেলাঘর ভেঙে দিয়ে তারা পরেরদিন সকালবেলা দেবহাটার উদ্দেশ্যে স্বপরিবারে রওনা হলেন।      

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসটি যখন দেবহাটা এসে থামে তখন বিকাল হয়ে গেছে। রুমা এর আগে আসেনি কখনও এই উপজেলা শহরে। ওরা সবাই নেমে একটি টমটমে ওঠে।  গাড়োয়ান আলী হোসেনকে জিজ্ঞাসা করে,  'ভাই কোথায় যাব?'
আলী হোসেন বলে --- হিজল ডাঙা। 

টমটম চলছে আধা পাকা রাস্তার উপর দিয়ে ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ করে। একসময় টমটমটি কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলতে থাকে। কী অপূর্ব দৃশ্য চারিদিকে। দূরে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ  সবুজ বেষ্টনী। আরেক পাশে ইছামতী নদী বয়ে চলেছে। কী দারুণ শীতল হাওয়া বইছে ! 

রুমারও কী যে ভালো লাগছিল এই প্রকৃতি দর্শনে। পনেরোটা বছর সে বন্দী ছিল ঘিঞ্জি দুর্গন্ধময় গলির ভিতর এক জীর্ণ বাড়িতে। আজ যেন সে প্রাণ থেকে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।  চারিদিকে ঘন সবুজ ফসলের মাঠ, অনিঃশেষ দিগন্ত, ঝাউ বন, শুপারি বাগান, গাছগাছালি, পশু পাখি, খোলা নীল আকাশ, মানুষ, নারী ও নদী।                                                                     

টমটমটি  ইছামতী নদীর তীরে একটি কাঠের দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামে। তখন সন্ধ্যাপূর্ব বিকাল। কী সুন্দর এই কাঠের বাড়িটি। যেন রবি ঠাকুরের কুঠি বাড়ি। একদম ইছামতী নদীর তীর ঘেসে তৈরি এই বাড়িটি। সেই বিনম্র সন্ধ্যাবেলায় নদীর জল কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছিল সাগরের দিকে।

আলী হোসেন সবাইকে নিয়ে  টমটম থেকে নামে।  তারা হেঁটে চলে আসে -- বাড়িটার কাছে। বাড়ির  গেটে ছোট্ট একটি নেম প্লেটে লেখা, 'রুমা ভিলা।' আলী হোসেন পকেট থেকে  চাবি বের করে রুমার হাতে দিয়ে বলে -- এটি তোমার বাড়ি।                          
      
কাকতালীয়ভাবে সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমা রাত্রি। আলী হোসেন আর রুমা বসে আছে দোতালায় বারান্দায়। আকাশে কমলা সুন্দরীর মতো রূপময়ী চাঁদ। পাশে নদীর জল মৃদঙ্গ সুরে  বয়ে চলেছে ঝিরিঝিরি দ্যোতনায়। রুমা, তার স্বামীর বুকে মাথা ঠেকিয়ে পরম আনন্দ চিত্তে 
বলে -- 'ওগো, তুমি এত টাকা কোথায় পেলে?'
আলী হোসেন রুমার গ্রীবা ছুঁয়ে  মুখখানি উপরের দিকে উঠিয়ে বলে -- আমি প্রতি মাসে কিছুকিছু করে টাকা ব্যাংকে জমিয়ে রাখতাম। তুমি তা জানতে না। জানলে আমাদের অভাবের সংসারে খরচ করে ফেলতে। আমাকে কতই না সন্দেহ করতে তুমি। জানো, বারো বছর ধরে আমি এই টাকা জমিয়েছিলাম!

রুমা সলজ্জিত হয়ে আলী হোসেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে --  
আমাকে তুমি ক্ষমা করো, আমাকে তুমি অশেষ করো, আমার দেহখানি প্রদীপ করো ঐ চাঁদের মতোন জোছনায়, আমার ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো আমার যত গ্লানি  ... 

 
সেদিন হেমন্তের চাঁদ ডুবতে চায়নি হিজল ডাঙার অন্ধকার বন-প্রান্তরে। নদীর কূল আকুল হয়ে ভেসেছিল জোছনার বন্যায়। এমন আরও কত অপরূপ প্রহর কেটেছে তাদের। এই নদীর কূলে কত দিবস রাত্রি করেছে বাস ।        

                                                                          
কোয়েল তালুকদার
১৮ মে, ২০২০ ইং, ঢাকা।   
                              

                             
                                                     

শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

কেবা আপন কেবা পর

কেবা আপন কেবা পর 

অনেক আগের এক জৈষ্ঠ্য  দিনের কথা। আমি তখন বাগবাটী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। গরমের কারণে তখন মর্নিং শিফট স্কুল ছিল। 

এগারোটায় স্কুল ছুটি হয়েছে। বাড়িতে চলে আসব। বই হাতে স্কুলের মাঠের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছিলাম। পা ফেলতে ফেলতে   হঠাৎ করে জেবুন্নেসা বুবুর কথা মনে হল। একবার আমাদের বাড়ি থেকে আসার সময় আমাকে কাছে টেনে আদর করে জড়িয়ে ধরে বুবু বলেছিল -- তোমার স্কুল থেকে আমার বাড়ি মাইলখানেক দূরে, যদিও বামদিকে উল্টো যেতে হয়, তবুও তুমি একদিন যেও। দেখে এসো আমাকে। আমি বুবুকে মাথা নেড়ে বলেছিলাম -- আচ্ছা, যাব একদিন।     
        
সেই প্রতিশ্রুতির কথা হঠাৎ মনে হল।    

পিছনে তাকিয়ে দেখি -- আমাদের ক্লাসের সাইফুল ও আমিনুল হেঁটে হেঁটে  আসছে।  আমি থেমে যাই।ওদের বাড়ি দত্তবাড়ি গ্রামে। ঐ গ্রামই হচ্ছে বুবুদের গ্রাম। আমি ওদেরকে বলি -- 'আমি তোদের সাথে আজ তোদের গ্রামে যাব।'  
ওরা তো বেজায় খুশি। ওরা বলে -- 'তা কার বাড়িতে যাবি তুই?' আমি বললাম, মোঃ আব্দুস সোবহান শেখের বাড়িতে যাব। উনি আমার দুলামিঞাভাই হন।'     

আমি এর আগে কখনও এই পথ দিয়ে বুবুদের বাড়িতে যাই নাই। আজই প্রথম যাচ্ছি। কী সুন্দর এই পথ। ইউনিয়ন বোর্ডের তৈরি কাঁচা রাস্তা। দু'ধারে বাড়ি। গাছ আর গাছ। হেঁটে যেতে জৈষ্ঠ্যের রোদ একটুও গায়ে লাগে না। রাস্তাটি সরু হলেও টমটম চলে। কিন্তু গরুর গাড়ি চলে না। সেই জন্য ধুলো কম। দুপাশে ঘাসও আছে।        

যেতে যেতে পথে কত বাড়িতে কত রকম গাছ যে দেখছিলাম!  আম, কাঁঠাল, জাম, জারুল, সোনাল, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, খেজুর, ডুমুর, নিম, সাজনা, আকন্দ, জাম্বুরা, পিয়ারা, কলা গাছ, তেঁতুল, ছিটকি, বাবলা সহ আরও কত রকমের গাছ। পাখিও দেখছিলাম কত রকমের!  ঘুঘু, ওরোল, ঘরবাদুনী, চড়ুই, শালিক, টুনটুনি, হলুদ ফিঙে, বুলবুলি, কাক, দোয়েল সহ আরও অনেক রকম পাখি।

এক জায়গায় দেখি -- একটি বড়ো জামগাছ। সারা গাছ ভর্তি পাকা জামে নীল হয়ে আছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গাছ তলায় জটলা করে দাঁড়িয়ে  আছে। পাখিরা ঠুকরে জাম খাওয়ার সময় অনেক সময় পাকা জাম নীচে পড়ে। কখনও আবার বাতাসেও টুপটুপ করে ঝরে পড়ে। সেইসব পাকা জামগুলো ওরা কুড়িয়ে খাচ্ছিল। আমরাও কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়ালাম। এবং কুড়িয়ে পাকা জাম খাই।     

বেলা বারোটার মধ্যেই আমি দত্তবাড়ি গ্রামে জেবুন্নেসা বুবুদের বাড়িতে পৌঁছে যাই। বুবু তো আমাকে দেখে যারপরনাই খুশি হন। আমাকে কাছে টেনে তাঁর আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে দিলেন ।  তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকেন। আমি বুবুকে বললাম - তোমার এইসব করতে হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা !  

বুবু বাড়ির কামলা দিয়ে পুকুরপাড়ে ডাব গাছ থেকে ডাব পেড়ে ডাবের পানি খাওয়ালেন। মুড়ি খেতে  দেন ঝুনা নারিকেল আর কুশালের গুর দিয়ে। কয়েকটি পাকা আম ছিলে আমাকে দিয়ে বলল -- 'গেদা, এই আমগুলো আমাদের গাছের। খুব মিষ্টি। খাও এগুলো।'        

আমি এই বাড়িটিতে এর আগে আরও দুই একবার এসেছিলাম বাবার সাথে। তখন আরও ছোট ছিলাম। পাঁচ ছয় বছর বয়সের সময়। তেমন কিছু মনে নেই।  আজ বাড়িটি দেখে খুব ভালো লাগছে। 
বাড়ির তিন পাশে শস্যের ক্ষেত। পিছনে বড়ো বড়ো আম কাঁঠালের গাছ। অনেকটা জঙ্গলের মতো। পূর্ব পাশে ছোট্ট একটি পুকুরও আছে। 

সবচেয়ে ভালো লেগেছে গ্রামটি। পুরো গ্রামটি একটি বাঁশ ঝাড়ের বাগান যেন। একে বাঁশ ঝাড়ের বনও বলা যেতে পারে। বুবুদের বাড়িটিও বাঁশ ঝাড়ে বেষ্টিত। বাড়ির সামনে এক দুটো ফসলের ক্ষেতের পরই এই বাঁশবন।    

দুপুরে লিচুতলায় কাঠের হেলাঞ্চির উপর বসে ছিলাম। দেখি, দুটো বেজী বের হয়ে আসছে বাঁশ ঝাড়ের ভিতর থেকে। বেজী দুটো পিটপিট করে কতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি 
ওদের 'হো' বলতেই দৌড়ে জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে যায়।     

বুবুদের একটি পাখির ঘরও আছে । সেখানে কয়েকটি খরগোশ, দুটো টিয়াপাখি, অনেকগুলো মুনিয়া পাখি দেখলাম। পুকুর পাড়ে চারটি রাজহাঁস প্যাক প্যাক করে ঘাস খাচ্ছিল। পুকুরের জলে অনেকগুলো দেশি হাঁসও জলকেলি করছিল।         

আর, সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছিল বাঁশ ঝাড়ের দিক থেকে আসা বিভিন্ন পাখপাখালিদের কিচিরমিচির শব্দ। বুবু এসে বলছিল -- কুয়া থেকে ঠান্ডা পানি তুলে রেখেছি। চলো, গোসল করে নাও। আমি গোসল করবই না, বুবু আমাকে জোর করে গোসল করে দেয়। মাথায়, গায়ে, হাতে,পায়ে সাবান মেখে গোসল করে দিল। সে নিজেই আমার মাথা গা মুছে দিল। যেমন করে আমার মা আমাকে ছোট বেলায় গোসল করিয়ে দিত।       

বুবু আমাকে শীতল পাটিতে বসিয়ে খেতে দেয়। আমার সাথে দুলামিঞাভাইও বসে। বুবু এরই ফাঁকে কখন মোড়গ জবাই করে ও পুকুর থেকে মাছ ধরে রান্না করেছে। জানতাম না। কাতল মাছ ভেজেছে, আবার রান্নাও করেছে। চাল কুমড়া ভাজি, কাতল মাছের মাথা দিয়ে মুগডালের ঘন্টো, ডিমের তরকারি, ডাল, কলার ক্যান দিয়ে নাবড়া, মিষ্টি কুমড়া ভর্তা, এইসব  দিয়ে আমাকে খেতে দিল। আমি ছোট মানুষ! এত কিছু কী খেতে পারি?  খাওয়া শেষে আবার আম দিয়ে দুধ ভাতও খেতে দেয়।     

বিকালে বুবুকে বলি -- আমি এখন বাড়ি চলে যাব।
বুবু বলছিল -- আজ থাকো, কাল যেও।
আমি বললাম -- না। আজই চলে যাব। মা বকবে। চিন্তা করবে।        
                          
আমি আমার বইখাতা হাতে নেই। বুবু বললো -- আমি তোমাকে বাঁশ ঝাড়টা পার করে দিয়ে আসি। তারপর সোজা পথ,  তুমি তখন একা চলে যেতে পাররে।          

বুবু আমার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। বাঁশ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে পায়ে হাঁটার পথ।  কি যে ভালো লাগছিল!  আলোছায়ার সে এক মায়াবী পাতা ঝরার শব্দ । পাখিরা কিচিরমিচির করছিল।  বাঁশ ঝাড়ের পথ পেড়িয়ে আমি ও বুবু খোলা জায়গায় এসে পড়ি।

আমি তো খোলা প্রান্তর দেখে বিস্ময়ে চেয়ে থাকি।  অনেক দূর পর্যন্ত খালি মাঠ। মাঠের পর মাঠ। ক্ষেতের পর ক্ষেত। সবুজ আউশ ধানক্ষেত! সবুজ পাতার গালিচা যেন মেলে রেখেছে। এই খোলা প্রান্তরটি প্রায় এক মাইলের মতো হবে। যাকে নির্জন পাথার বলে।           

বুবু আমাকে বলছিল -- একা এই পাথার পারি দিতে পারবে?
--- পারব।
--- ভয় পাবে না তো!
--- না।
--- তুমি যতক্ষণ এই পাথার পার হবে, ততক্ষণ আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব।
--- আচ্ছা। আমি পিছনে ফিরে ফিরে তোমাকে দেখব।
-- ওহ! আমার সোনার ভাইরে! 

বুবু আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে --
তুমি আবার এসো।
-- না, আমি আর আসব না।
-- কেন, ভাই!
-- তুমি আমাকে বেশি করে খাওয়াও কেন? আমি কী অত খেতে পারি নাকি?
-- আচ্ছা, লক্ষী ভাইটা আমার! তুমি আবার যখন আসবে তখন একদম কম খাওয়াব।
--- আচ্ছা।                                                                      
                          
আমি সেই পাথার একাকী হেঁটে পার হতে থাকি। হাঁটছি যত পিছনে তাকিয়ে বুবুকে দেখছিলাম তত। যত দূরে চলে আসি তত বুবুকে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম। আরও দূরে যখন চলে আসি তখন বুবুকে একটু বিন্দুর মতো দেখতে পাচ্ছিলাম।  পাথার পার হয়ে যখন এপারে চলে আসি, দেখি -- বুবু কোথায় যেন হারিয়ে গেল! আর দেখতে পাচ্ছিলাম না।                                      

হ্যাঁ,  আমার সেই বুবুটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। সেও আরও অনেক বছর পর।  

আমি কী কখনও তার মতো করে তাকে মায়া করেছি?  মায়া করলেও কেউ কী তা বিশ্বাস করবে? সে যে আমার সৎ বোন ছিল।     

আজও যখন কোনো স্তব্ধ মুহূর্তে  সুখ দুঃখের কোনো স্মৃতি বিস্মৃতি হাতড়াই, তখন মনে পড়ে -- সেই কৈশোরে  স্কুল থেকে ফেরা একটি বালককে আপন করে  হাত ধরে বাঁশঝাড়ের পথ ধরে কেউ  নিয়ে আসল। সবুজ ধানক্ষেতের পাশে জড়িয়ে ধরে আদর করল, চেয়ে চেয়ে দেখল সেই বালকের ফিরে আসা। 

তখন তার চোখ কী একটুও বিষাদে ভরে ওঠেনি ! সে কী কেবলই মরীচিকার মতো কোনে ঢেউ ছিল? অন্তরে বাজেনি কী তখন কোনো আপন রক্তের স্পন্দন !                              


কোয়েল তালুকদার
১৫ মে, ২০২০ ইং, ঢাকা।   


মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০২০

নয়নে বহে ধারা

নয়নে বহে ধারা  

আজই দীপ্তর এমবিবিএস পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। সে পাশ করেছে। কলেজে যেয়ে দীপ্ত এই সুখবরটা প্রথম জানতে পারে।  

আর দীপ্ত এই সুখবরটি প্রথম জানায় তার মণিকে ফোনে --
মণি, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো আগে। আমার কপালে চুমু দাও। আমি পাশ করেছি মণি। আজ থেকে আমি ডাক্তার। তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পেরেছি মণি।                 

মণি দীপ্তর মা। দীপ্ত ওর মাকে একএকসময় এক একটা সম্বোধন করে ডাকে। কখনও মা, কখনও মামণি, কখনও মণিমা, কখনও শুধু  মণি বলে ডাকে। তবে বেশি আনন্দে থাকলে, দীপ্ত ওর মাকে মণি বলে ডাকে।             

দীপ্তর মা বিয়ের দুই বছরের মাথায় স্বামীকে হারায়। তখন দীপ্তর বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস। দীপ্তর বাবাও ছিল একজন ডাক্তার। হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।

দীপ্তর মা আর বিয়ে করেন নাই। দীপ্তর বাবার রেখে যাওয়া সীমিত সম্পদ থেকে তিনি সংসার আর দীপ্তর লেখাপড়ার খরচ চালাতেন।      

দীপ্ত বাসায় এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে -- মণি তুমি খুশি হয়েছ? বাবা, মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা যেখানে রেখে গেছেন, আমি সেখানে থেকে আবার শুরু করব মা। তুমি আমাকে দোয়া করবে, আমি যেন তোমার স্বপ্ন ও বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।                                                     
দীপ্তর মা শাহনাজ বেগম তার ছেলেকে একটি আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে তুলবার জন্য জীবনভর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সে আজ খুব খুশি।  দীপ্তর অলক্ষ্যে ওয়ালে টানানো  তার স্বামীর পোট্রের্ট এর সামনে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। 
বলে -- ওগো, তুমি আমাকে দোয়া করো ওপারে থেকে। আমি যেন দীপ্তকে তোমার আদর্শে গড়ে তুলতে কখনোই যেন ক্লান্ত না হই। 

দীপ্ত পিছনে থেকে চুপিচুপি এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় কপাল রেখে বলে -- মণি, তুমি না আমাকে প্রমিজ করেছিলে, আর কখনও কাঁদবে না। তুমি তোমার কথা রাখছ না। তুমি বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রায়ই কাঁদো। শাহনাজ বেগম চোখের জল মুছে বলে, 'আবার প্রমিজ করছি, আর কাঁদব না। চলো, খেয়ে নাও। আমি এখনও খাইনি।'        

দীপ্ত কিছুদিনের মধ্যেই শহরের একটি নামকরা ক্লিনিকে জুনিয়র ডাক্তার হিসাবে যোগদান করে। পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে।                                                   
একদিন খেতে বসে শাহনাজ বেগম দীপ্তকে বলে -
দীপ, তোমাকে একটা কথা বলব?
-- বলো, মণি।
-- তোমার কী কোনো মেয়ের সাথে জানাশোনা আছে? মানে, তোমার কী ভালোলাগার কেউ আছে? 
-- মণি, আমার কেউ থাকলে সে তো তুমিই আগে জানতে। কারণ, এই পৃথিবীতে তুমি আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু।  আর... 
--- আর কী?
--- আর, আমার বউকে পছন্দ করে তুমিই ঘরে  আনবে। তুমি যাকে এনে দিবে, আমি তাকে নিয়েই  সারা জীবন ঘর করব। এও আমার আর একটি স্বপ্ন।       

আর একদিন এমনই খাওয়ার টেবিলে শাহনাজ বেগম তার ছেলেকে বলছিল -- দীপ।
--- বলো মা।
--- আমার এক দূর সম্পর্কের বোনের একটা মেয়ে আছে। ও এবার গার্হস্থ অর্থনীতিতে গ্রাজুয়েট ফাইনাল সেমিস্টার শেষ করবে। শুনেছি মেয়েটি বেশ সুন্দরী। ভালো গানও গাইতে পারে। আমার সেই বোনটির সাথে ফোনে প্রাথমিক কথা হয়েছে। আমি তোমাকে নিয়ে ওখানে বেড়াতে যাব। তুমি মেয়েকে দেখবে। মেয়ে তোমাকে দেখবে। মেয়ের বাবা মা থাকবে। আর কেউ না।
-- মণি, আমি তোমার উপর দিয়ে কোনো কথা কোনো দিন বলেছি? তুমি যা করবে, তুমি যা করতে বলবে, আমি তাই করব।     
-- আমি জানি। তুমি আমার অবাধ্য কোনো দিন হবে না।
-- মণি।
-- বলো বাপ।
-- তুমি বললে, মেয়েটি গান গায়। এই জন্য আমার খুব ভালো লাগছে। তুমি হয়ত জানো না মণি। আমি তোমাকে আজ একটা কথা বলি। 
-- কী, বলো।
-- তুমি প্রায়ই মাঝরাতে ওঠো। হয়ত হঠাৎ করেই  তোমার ঘুম ভেঙে যায়। তুমি উঠে তখন ঘরের লাইট জ্বালাও। বাবার পোট্রের্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখ অনেকক্ষণ । চশমা খুলে চোখ মোছো। তারপর ব্যালকনিতে যেয়ে ইজি চেয়ারে বসে থাকো। ওখানে বসে দূর আকাশে তারার দিকে তাকিয়ে থাকো, হয়ত মেঘের ভিতর লুকিয়ে থাকা  তারাদের মাঝে বাবার মুখ খোঁজো। কোথাও থেকে আসে তখন শীতল ঝিরিঝিরি হাওয়া। বেলী ফুলের ঝাড় থেকে আসে আকুলকরা গন্ধ! তুমি তখন গুনগুন করে সেই একলা রাত্রিতে একটি গান গাও --

'একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
ওগো বন্ধু কাছে থেকো, কাছে থেকো।'    
     
জানো মণি, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপিচুপি তোমার সেই গান শুনতাম। তোমার গান গাওয়া শেষ হলে আমি যেয়ে শুয়ে পড়তাম। তুমি এইসব কিছুই জানতে না।                                                                                                                        
                
একদিন বিকালে শাহনাজ বেগম দীপ্তকে নিয়ে তার সেই বোনের বাসায় বেড়াতে যায়। সুন্দর পরিপাটি একটি ফ্ল্যাট বাড়ি।  বাসায় তার বোন মমতাজ বেগম, তার স্বামী শওকত আলী আর তাদের মেয়ে মালবী ছাড়া আর কেউ নেই। মালবী দেখতে সুন্দরী, লম্বা ছিপছিপে গড়ন, যেন রজনীগন্ধা ফুল, চোখ দুটো টানাটানা, চুল নিবিড় কালো, তার নাকটি কাঁঠালিচাঁপার রেণুর মতো  প্রস্ফুটিত। গায়ের রঙ উজ্জ্বল গৌরীয়, কপোতীর ডানার মতো মসৃণ দু'খানি হাত। পুরো মুখমন্ডল অদ্ভুত সৌন্দর্যময়,  যেন একটি উপমায় ভরা গীতি কবিতার রূপ সারা অবয়বে।

সেদিন উভয় পরিবার একে অপরের মাঝে নানা কথা বললেন। নানা ভাব বিনিময় করলেন। মেয়ে দেখল ছেলেকে, ছেলে দেখল মেয়েকে। তারা দুজন টুকটাক কথাও বলল। মালবী হয়ত ভাবছিল মনে মনে, যে রাজপুত্রকে সে এতদিন চেয়েছিল, সেই এসে আজ এখানে হাজির। অপরদিকে দীপ্তও মনে মনে ভাবছিল, 'এমনই একজন রাজকন্যাকে আমি এতদিন খুঁজেছিলাম।'              

দীপ্তর  মাও মালবীকে দেখে খুব খুশি। পারলে এখনই মালবীকে তার পুত্রবধূ করে ঘরে তুলে নিয়ে যাবে। অপরদিকে মালবীর বাবা মাও অনেক খুশি। তারাও পারলে এখনই তাদের মেয়েকে দীপ্তর সাথে বিয়ে দিয়ে ওর মায়ের হাতে তুলে দিবে।                     
দুই পরিবারের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে যায়। দীপ্ত ও মালবীর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। বিয়েটি হবে মালবীর ফাইনাল পরীক্ষার পর। সেও মাস দেড়েক দেরি আছে এখনও । এর মধ্যে একদিন পানচিনি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওদের  একে অপরের হাতে আংটি পরানো হয়ে যায়।     

দীপ্ত আর মালবী একদিন দেখা করে উত্তরার একটি আকাশ ছোঁয়া রেস্টুরেন্টে। কাঁচের জানালার পাশে বসে দেখছিল -- নীল আকাশ। নীলের মাঝে থোকা থোকা শরতের সাদা মেঘ রাশি। দেখছিল এয়ারপোর্টের রানওয়ে। আর দূরের দিয়াবাড়ির শুভ্র কাশবন।
 
কথা বলছিল-- দুজন দুজনের মুখের দিকে চেয়ে। দীপ্ত বলছিল, আমার ভুবনে এতদিন ছিলাম আমি আর আমার মণি। সেই ভুবনে তুমিও আসছ। জানো, কী যে আলোয় আলোয় ভরে উঠবে আমাদের সেই ভুবন। মালবী দীপ্তর হাতের উপর হাত রেখে বলেছিল -- তোমাদের ভুবনে আমাকে স্থান দিও। কী দেবে তো আমাকে একটু স্থান?
দীপ্ত বলেছিল -- অবশ্যই। 
'এসো এসো আমার ঘরে এসো, বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে। স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে   মুগ্ধ এ চোখে।'

কত দুঃখ বেদনা মানুষের জীবনে । কত ভাঙাগড়াও আবার এই জীবনে! এই পৃথিবী কত স্বপ্ন দেখায়। কত স্বপ্নকে আবার নিষ্ঠুর ভাবে ভেঙে দেয়। এমনই এক স্বপ্ন ভাঙার দিনে মালবী সেদিন আসছিল কলেজ থেকে। বাস স্টান্ডে নেমে বাসায় আসার জন্য রিকশায় উঠবে, ঠিক তখনই দুজন যুবক মোটরসাইকেল করে এসে মালবীর মুখে এসিড মেরে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।                            

আর্ত চিৎকার করে মুখে দুহাত চেপে মালবী রাস্তার উপর বসে পড়ে।  তারপর দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।          

দীপ্ত খবর পায় মালবীর মুখে দুষ্কৃতকারীরা এসিড নিক্ষেপ করেছে। সে এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছে। 

দীপ্ত ছুটে চলে যায় হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে একটি বেডে মালবী শুয়ে আছে। মালবীর মুখ মণ্ডল পাতলা ব্যান্ডেজ কাপড় দিয়ে ঢাকা। অসহ্য যন্ত্রণায় সে কাৎরাচ্ছে। দীপ্ত ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। খুব আস্তে করে মালবীর একটি হাত ধরে। এবং বলে --
' তুমি ভালো হয়ে যাবে, সত্যি তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমি আছি তোমার সকল অসুখে, তোমার সকল বেদনায়। এই দেখ -- আমি তোমার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছি।'                                                
দুই মাস পর মালবীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে বাসায় নিয়ে আসে। মালবীর পুরো মুখ পোড়া দাগে বিকৃত, কুৎসিত ও ভয়ার্ত রূপ হয়ে গেছে। চোখে দেখতে পায়। কিন্তু চোখের পাতা ও ভ্রূ সব ঝলসে গেছে।                        
                 
দীপ্ত ও দীপ্তর মাকে অনেকে এসে বলে এবং বোঝায়-- দীপ্তর মতো এত সুন্দর একটি ছেলের সাথে মালবীকে যেন বিয়ে না করানো হয়। দীপ্ত ও দীপ্তর মা শোনেনি কারোর কথা। মালবীর সাথে আবারও বিয়ের তারিখ ধার্য করা হয়।       

শাহনাজ বেগম খুব অল্প কজন মানুষ নিয়ে মালবীকে দীপ্তর বউ করে ঘরে নিয়ে আসে। বিয়েতে কোনো আড়ম্বর হল না, সানাই বাজল না, আলোকসজ্জা করা হল না। চারিদিকে কোনো হাসিরাশি নেই। কোনো উৎসব নেই।  কোনো সঙ্গীত নেই। কেমন যেন এক বেদনার সুর কোথাও থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল।                                 
       
জীবন থেমে থাকে না। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ জীবন গায় তার জয়গান। পৃথিবীতে আনন্দ এতই ভঙ্গুর যে, তা কাঁচের মতো কখন ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। আবার বেদনাও ঢেকে পড়ে যায় জীবন থেকে পাওয়া নির্মল কোনো আনন্দে।    

একদিন মাঝরাতে শাহনাজ বেগমের ঘুম ভেঙে যায়। আস্তে আস্তে উঠে সে বারান্দায় যেয়ে পায়চারি করতে থাকে। ছেলে দীপ্তর ঘর থেকে তখন ক্ষীণ সুরে একটি গান ভেসে আসছিল, গানটি গাইছিল মালবী। 
'একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
ওগো বন্ধু কাছে থেকো, কাছে থেকো।'  
রিক্ত আমার ক্ষুদ্র প্রাণে তোমার আঁখিটি রেখো।'


এমনই এক নিঝুম শারদ রাতে আজ থেকে  ছাব্বিশ বছর আগে শাহনাজ বেগম এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল তার স্বামীকে। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে মালবীর গাওয়া গানটি শুনতে থাকে। নয়নে বয়েছিল তখন অশ্রু ধারা।         
      
                
কোয়েল তালুকদার
১২ মে, ২০২০ ইং, ঢাক।                 

শনিবার, ৯ মে, ২০২০

প্রাণ ভরিয়ে

প্রাণ ভরিয়ে

নতুন বিয়ে করেছি। মেস ছেড়ে দিয়ে কলাবাগানে বাসা ভাড়া নিয়েছি। বউকে নিয়ে উঠি সেই বাসায়। দুই রুমের ছোট্ট টিনসেডের একটি বাড়ি।   
ছোট বাসা হলেও আঙিনা অনেক বড়ো। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা। ঘরটা পিছনের দিকে। সামনে ডানে বামে খালি জায়গা। গলির দিকে বাসায় ঢোকার গেট।

ঘরের সামনের কোণে একটি ঝাঁকড়া আমগাছ থাকলেও বাকী খালি জায়গায় ঘাস ও বিভিন্ন লতা গুল্মে জঙ্গল হয়ে আছে। একদিন বাড়ির মালিককে আমি বললাম -- 'আমি কী জঙ্গল পরিস্কার করে খালি জায়গায় কয়েকটি ফুল গাছ লাগাতে পারি?'  মালিক বললেন, 'অবশ্যই লাগাতে পারেন। এত ভালো কথা। আমার কোনো আপত্তি নেই।'       

আমার স্ত্রী থানা শহরের মেয়ে। স্থানীয় কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। বাবা স্কুল মাস্টার। মা গৃহিণী। দুই ভাই বোন। ছোট সুখী পরিবার। হারমনিয়াম বাজিয়ে সে ভালো রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারে। স্কুল কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে গান গাইত। 
                                   
তাকে এখানে পড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে অভিমানহীন ভাবে বলেছিল -- আমি শুধু তোমার ঘর সংসার করব। আমাকে পারলে একটি হারমনিয়াম কিনে দিও। যখন মন খারাপ লাগবে তখন ঘরে বসে গান গাইব।'
                
বিয়ের প্রথম মাসে বেতন পেয়ে তাকে একটি হারমনিয়াম কিনে দেই। প্রথম দিনে প্রথম যে গানটি সে গেয়ে শোনায়েছিল --
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার  হৃদয়-পানে চাই নি। 

একদিন অফিস থেকে এসে তাকে বলি, কী ফুল তুমি পছন্দ করো, সেই ফুল গাছ আঙিনায় লাগাব। --- আমার প্রিয় ফুল গন্ধরাজ। তোমার কী ফুল পছন্দ?'  আমি বললাম, আমার পছন্দ জবা। উল্লেখ্য আমার স্ত্রীর নাম জবা।    

এক শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর দিনে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে আমরা দুজন বেশ কয়েকটি জবা আর গন্ধরাজের চারা রিক্সার হুডি ফেলে ভিজতে ভিজতে কিনে এনে আঙিনায় লাগিয়ে দেই।                            
খুব অল্প সময়েই ফুলগাছ গুলো বড়ো হতে থাকে। এনং একসময় গাছগুলোতে ফুুল ফুটতে থাকে। যেদিন প্রথম জবা ফুল ফোটে, সেদিন কাকতালীয় ভাবে জবার জন্মদিন ছিল। 

অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বাসায় আসি।ফেরার পথে জবার জন্য গাওসিয়া মার্কেট থেকে একটি সবুজ রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি কিনে নিয়ে আসি।      

বিকালে ওকে বললাম -- শাড়িটি পরো। জবা শাড়িটি পরে। আমি দুটো জবা ফুল ছিঁড়ে এনে ওর খোঁপায় পরিয়ে দেই। সে হাতে কাঁচের চুড়ি পরে। কপালে লাল টিপ ও ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়। খুব ভালো লাগছিল ওকে। যেন কুমুদিনী।                                            
আমরা একটা খোলা রিকশা করে শেরেবাংলা নগর চন্দ্রিমা উদ্যানে চলে যাই। পরন্ত বিকালের নীল আকাশ দেখতে দেখতে আর নাগরিক কোলাহল পেরিয়ে আমরা উদ্যানে চলে যাই। পথে যেতে যেতে জবা গুনগুন করে গেয়েছিল --   

তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে   টুকরো করে কাছি

আমি ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি।

       
উদ্যানের সবুজ ঘাসে বসে সেদিন দুজন কত কথাই বললাম। কত স্বপ্নের কথা। জীবনের কথা।  ঘর সংসারের কথা। সন্তান নেবার পরিকল্পনার কথা। আরো কত কথা। কথা বলতে বলতে একসময় সব কথা ফুঁড়িয়ে যায়। পাশে হাস্নাহেনার ঝাড় থেকে সুবাস ভেসে আসছিল। উদ্যানের সন্ধ্যার পাখিদের কলরব থেমে গেল। 
নিরবতা ভেঙে আমি জবাকে বললাম -- 'এখানে আজ কোনো গান হল না যে!'
জবা আমার বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলেছিল --  
'এখন গান নয় গো, আজ আমরা দুজন শুধু দুটো প্রাণের হব। চলো, ঘরে ফিরে যাই।'
   
আলো আঁধারে দুজন হাত ধরে হাঁটতে হাটঁতে উদ্যানের বাইরে চলে আসি। আবারও একটি খোলা রিকশা করে আকাশ ভরা তারা দেখতে বাসায় চলে আসি।                
         
রাতটি ছিল স্বপ্ন আর ঘুম জড়ানো। জানালা খোলা ছিল। জবাফুল গন্ধ বিলিয়েছিল গন্ধরাজের গায়ে। কী এক আশ্চর্য দ্যোতনা। বাতাস এসে কথা বলেছিল আমাদের কানে কানে। যেন --  

দিকে দিগন্তে যত আনন্দ  লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ,

আমার চিত্তে মিলি একত্রে   তোমার মন্দিরে উছাসে।


সকালে আমার আগে ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে এমনিতেই বারান্দায় গিয়ে একটু  দাঁড়াই৷ আঙিনায় চেয়ে দেখি-- ঘাসের উপরে  একগুচ্ছ গোলাপ ফুল পড়ে আছে। 
আমি জবাকে ডেকে বলি-- 'দেখ, কে যেন রেখে গেছে এই ফুল!'
জবাও বিস্মিত হয়! তবে ফুলগুলো দেখে তার  মনে পড়ল -- এক জন্মদিনে এমনই এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল তাকে দিয়েছিল তাদেরই ছোট্ট থানা শহরের এক উন্মূল তরুণ। ছেলেটি ওর সহপাঠী ছিল। সে ভালো গানও গাইত।       

       
একদিন অফিস থেকে এসে দেখি, জবার খুব মন খারাপ।  কথা বলছে ভারী কণ্ঠে। চোখ দেখে বোঝা গেল, এই চোখ একটু আগে অঝোর ধারায় কেঁদেছে। এখনও সিক্ত। এখনও চোখের দুই কোণ্ চিকচিক করছে।
        
জবার মনখারাপ থাকলে আমারও মনখারাপ লাগে। ও কাঁদলে আমারও চোখ ছলছল করে ওঠে।  আমি ওকে বললাম, চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। জবা বলছিল-- 'কোথায় নিয়ে যাবে'। বললাম, 'শিশু পার্কে। ওখানে শিশুদের দোলনায় দোল খাওয়া দেখবে। ঘোড়ায় চড়ে ওরা হাট্টিমাটিম গান গায়। সেই গান তুমি শুনবে। ওদের সাথে আমরাও রেলগাড়িতে উঠব।'
জবা বলল -- আচ্ছা, নিয়ে চলো।

আমাদের প্রিয় যান খোলা রিকশায় করে সেদিন গিয়েছিলাম শিশু পার্কে। পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে দুজন ফুসকা খাই। একটি বালিকা এসে ওকে বলে, 'আপা বকুল ফুলের মালা নিবেন?' আমি জবাকে বললাম, নাও দুটো মালা। খোপায় পরিয়ে নাও। খুব ভালো লাগবে।                                        
আমরা দুজন নাগরদোলায় উঠেছিলাম। নাগরদোলাটি যখন সুউচ্চ চূড়ায় পৌঁছে, তখন জবা আমার দুহাত চেপে ধরেছিল। আমি ওর দিকে চেয়ে মনে মনে বলেছিলাম --  ভয় পেওনা তুমি। আমি তোমার জীবনেও আছি। আমি তোমার মরণেও পাশে আছি।                     

 
সেদিন ছিল ছুটির দিন। দুপুরে খেয়ে বিছানায় দুজনই শুয়ে আছি। কোনো কথা নেই কারোরই। আম গাছটায় বসে দোয়েল শিস দিচ্ছিল খুব মায়া করে। জবা আমার হাত ধরে। ঠিক মনে হলো বাইরে ডাকা ঐ দোয়েলটির মতো মায়া করে আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল-- তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো, না!
-- জ্বী বাসি।
-- যদি দূরে চলে যাই, তোমার খুব মন খারাপ লাগবে?
-- হে..
-- জানো, আমি যে কলেজে পড়তাম, সে কলেজে স্কুলের মতো ঘন্টাধ্বনি বাজত। কলেজ ছুটি হলে আমরা রেললাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে জোরে জোরে হেঁটে বাড়ি চলে আসতাম।
--- তাই! 
--- আমাদের বাড়ি থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যেত। বাড়ি থেকে একটু দূরে ছোট্ট একটি রেল ব্রিজ আছে খালের উপরে।
-- আচ্ছা।
--  ঐ ব্রিজটা আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি নিয়ে যাবে আমাকে ঐ ব্রিজ দেখাতে?           
-- নিয়ে যাব।  একটা গান গেয়ে শোনাওনা শুয়ে শুয়ে খালি গলায়। জবা গাইছিল --

দূরে কোথায় দূরে দূরে
আমার  মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে।যে পথ সকল দেশ পারায়ে  উদাস হয়ে যায় হারায়ে
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্‌ অচিনপুরে।

                                        
সুখে দুঃখে আনন্দ বেদনায় দিনগুলো আমাদের ভালোই কাটছিল। কিন্তু জবার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না খুব একটা। দিনে দিনে সে খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলে। রাতে রাতে তার জ্বরও আসে। ডাক্তার দেখাই। চিকিৎসা চলতে থাকে।    

আঙিনায় জবা ও গন্ধরাজ ফুলগাছ গুলো পরিচর্যার অভাবে দিনে দিনে শ্রীহীন হয়ে মরে যেতে থাকে। জবা ফুল গাছে আর ফুল আসে না। গন্ধরাজ আর কোনো গন্ধ বিলায় না সন্ধ্যারাতে। আঙিনায় লতাপাতা গুলো বেড়ে আগাছায় ভরে ওঠে।

সেদিন ছিল আমাদের বিয়ে বার্ষিকী। অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা রাত হয়ে যায়। জরুরি কাজে আটকে পড়েছিলাম। ফেরার পথে গাওছিয়া মার্কেট থেকে জবার জন্য একটি লাল বেনারসি শাড়ি কিনি। আর কিনে নিয়ে আসি একগুচ্ছ লাল গোলাপ।       
              
গেট দিয়ে ঢুকতে আলোছায়ায় আঙিনার ঘাসের উপর একটি ভাজ করা কাগজ দেখতে পাই। হাতে উঠিয়ে গলি থেকে আসা ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় কাগজটি খুলে পড়ি। দেখি, রবি ঠাকুরের একটি গান লেখা আছে। কাগজটি পড়ে আমার কাছেই রেখে দেই।   
                 
ঘরের ভিতর বিছানায় জবা শুয়ে আছে। খুব মায়া করে সে আমাকে তাকিয়ে দেখছিল। চোখের পাতা কেমন কালো হয়ে গেছে। যেন কত অশ্রুর দাগ লেগে আছে। যেন বলতে চাচ্ছে -- 'জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।' 

আমি ওকে বলি-- একটু উঠে বসো, দেখো -- তোমার জন্য আজ একটি বেনারসি শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছি। একটু পরে নাও।'

জবা পরম আনন্দে শাড়িটির দিকে চেয়ে বলে -- 'আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে আজ পরব না লক্ষীটি। আমি ভালো হয়ে উঠি, তখন পরব।'                                
-- আচ্ছা, তাই পোরো।

আমি ঘরের জানালাটা খুলে দেই। আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে অপূর্ব সুন্দর চাঁদের আলো এসে পড়ে জবার মুখের উপর! আমি ওকে বলি -- একটা গান গেয়ে শোনাও না! জবা আমাকে বলে কোন্ গানটি শুনবে তুমি?  
আমি ওকে বলি -- 'প্রাণ ভরিয়ে'।
জবা গেয়ে শোনালো --  
       
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে  মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে     মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান। 

গানটি গাইতে গাইতে জবার চোখের কোণ ভিজে উঠছিল। হয়ত তার মনে পড়ছিল -- কবে এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় ছোট্ট থানা শহরের এক উন্মূল তরুণ এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল তাকে, বাড়ি থেকে দূরে একটি রেল ব্রিজের কাছে ঘাসের উপর বসে থেকে।         

কোয়েল তালুকদার       
১০ এপ্রিল, ২০২০ ইং, ঢাকা।      

                                

বৃহস্পতিবার, ৭ মে, ২০২০

অণুগল্প/ সতর্ক

মেয়েটিি লোকাল ট্রেনে করে আজই শহরে এসেছে। কমলাপুর স্টেশনে নেমে প্লাটফর্মের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্টেশনের সদর গেটের কাছে এসে  দাঁড়ায়। হাতে একটি কাপড়ের ব্যাগ। তার ভিতর থেকে একটি চিরকুট কাগজ বের করে।সেখানে একটি ঠিকানা লেখা আছে। ঠিকানাটি সে আবার পড়ছিল।

একজন পথবেশ্যা তখন পাশে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে তাকে বলে যায় , 'শহরে এসেছ যখন, সাবধানে পথ চলবে।'