রুক্সীনী
নাইনে পড়ি তখন। কার্তিক মাসের এক ছুটির দিনে একাকী মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার বাড়ি ছিল গোপীনাথপুরে। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে। যমুনা নদীর তীর ঘেসে বাড়ি। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। মাঝখানে একটা ছোট নদীও পড়ে। খেয়া নৌকায় পার হতে হয়।
রবিনহুডের মতো একদিন হেঁটে হেঁটে মাঠ ঘাট প্রান্তর পার হয়ে পৌঁছে যাই গোপীনাথপুর আমার মামার বাড়ি।
মামাতো ভাই ছাইদুলের সাথে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বিকালে যখন বাড়ি ফিরব, তখন ছাইদুল বলছিল, তুই কোন্ পথ দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবি?
আমি বললাম, আমি এসেছি নদীর কূলের পথ ধরে। ফিরে যাবও ঐ পথ দিয়েই।
ছাইদুল আমাকে বুদ্ধি দিল -- তুই যে পথ দিয়ে এসেছিস, ঐ পথ দিয়ে যাবি না। আরও একটা সুন্দর পথ আছে, তুই ঐ পথ দিয়ে যাবি। খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারবি।
আমি বললাম -- কোন্ পথ দিয়ে যাব ? বলে দে।
ছাইদুল পথ বলে দিল -- প্রথমে খেয়া নৌকায় ছোট নদীটা পার হবি। নদী পার হয়ে বামদিকে পথ দিয়ে না যেয়ে সোজা পাঁচঠাকুরী গ্রামের পথ ধরে পশ্চিম দিকে চলে যাবি। তবে পাঁচঠাকুরী গ্রাম পর্যন্ত যাবি না। আধা মাইল যাওয়ার পর দেখবি, হাতের বাম দিকে একটা মেঠো পথ নেমে গেছে। ঐ মেঠো পথ ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর তিন রাস্তার মোড় দেখতে পাবি।
ঐ তিন রাস্তার মোড়ে তুই বামদিকের রাস্তায় যাবি না, ডানদিকেও যাবি না। সোজা চলে যাবি। কিছু দূর যাওয়ার পর একটি বড়ো আমগাছ দেখতে পাবি। ঐ আমগাছের তলা দিয়ে হেঁটে চলে যাবি সামনের গ্রামের দিকে। ঐ গ্রামের পরই তোদের কুসুমপুর গ্রাম।
বিকালে যখন বাড়ি ফিরে আসছিলাম, তখন ছাইদুলের বলে দেওয়া পথ ধরেই আসতে থাকি। প্রথমেই খেয়া পার হচ্ছিলাম। আমার সাথে খেয়া পার হচ্ছিল একজন বোষ্টুম ও একজন বোষ্টুমি। ওদের পরনে ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়। দুজনের হাতে দোতারা! আমি বললাম -- তোমরা একটা গান গেয়ে শোনাবে আমাকে! টাকা চাইলে টাকা নিবা। আমার কাছে দশ টাকা আছে। তাই দেব তোমাদের।
বোষ্টুমি বলছিল -- 'আমরা কত ঘাটে কত বাটে, কত চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে -- কত গান গেয়ে শোনাই মানুষকে। কেউ পয়সা দেয়, কেউ দেয় না। আজ আমরা তোমাকে এমনি একটা গান শোনাব, কোনো পয়সা লাগবে না।'
বোষ্টুমি দোতারায় তান তুলল। বোষ্টুম বাজাচ্ছিল খুঞ্জরি টুংটাং করে --
দুজনেই একসাথে গেয়ে শোনাল গান।
'ছেড়ে দিয়া মায়াপুরী
দিতে হবে ভব পাড়ি
চেয়ে দেখো মন-ব্যাপারী
দিন গেলে হয় সন্ধ্যা ..
চোখ থাকতে হও আন্ধা ..
এই দুনিয়া মায়া জালে বান্ধা ..'
কী ভালো লাগছিল গানটা! এক অদ্ভুত বিকাল ছিল তখন। ছোট্ট সেই নদীর জলের ক্ষীণ ধারা ছলাৎছল করে উঠছিল। বিকালের আকাশের সব সোনালি আভা যেন মেখে দিচ্ছিল আমার অন্তরের মাঝে!
খেয়া নৌকায় পার হয়ে যখন এ পাড়ে আসি তখন আমি বৌষ্টুমীকে বলি -- তোমরা কোথায় যাচ্ছো?
--- আমরা ধলডোব গ্রামে যাব। ওখানে রায় বাড়িতে গানের আসর আছে। ওখানে আমরা গান শোনাব।
--- আমারে সাথে নিবা?
--- তুমি যাইবা?
--- হু, যাব।
--- তোমার বাবা মা তোমাকে বকবে না?
--- তারা জানবে না।
--- তাই? চলো তবে ।
নদী পার হয়ে পশ্চিম দিকে রাস্তা ধরে বৌষ্টুমীদের সাথে হাঁটতে থাকি। সূর্যের কড়া রোদ মুখে এসে পড়ছিল। খুব ভালোও লাগছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি -- এক বাড়ির গাছ তলায় অনেক মানুষের জটলা। লাঠির বারির আওয়াজ আর শোরগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এক লোককে জিজ্ঞাসা করি , ওখানে কী হচ্ছে? লোকটি বলল -- লাঠিখেলা হচ্ছে। '
আমি বোষ্টুমী দিদিকে ডাকলাম -- ও দিদি!
-- কী!
-- লাঠিখেলা দেখবা?
-- না, আমাদের সময় নেই।
-- আমি দেখব।
-- তুমি দেখ গে।
-- তোমাদের সাথে আমার আর যাওয়া হলো না।
-- আচ্ছা।
-- তোমাদের আবার কোথায় দেখা পাব?
--- আমরা পথের মানুষ। পথে পথে ঘুরি। এই পথেই দেখা পাবে কোনো একদিন ।
আমি চলে যাই লাঠি খেলা দেখতে। কী যে চমৎকার লাঠি খেলা হচ্ছিল। পালোয়ানের
মতো দুজন সুঠাম লোক লাঠি খেলছে । উঁচা লম্বা। পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। লুঙ্গি মালকোচা করে বান্দা। পোক্ত বাঁশের লাঠি। পোড়ানো এবং কালচে রঙ করা। সে কি তুমুল বাইরাবেরি। খটখট আওয়াজ হচ্ছে। লোকজন হুল্লোড় কড়ছে। কেউ শীষ দিচ্ছে। আমি বিস্ময় ভরে ওদের লাঠি খেলা দেখতে থাকি!
মাগরিবের আযানের আগ দিয়ে লাঠি খেলা শেষ হয়ে যায়। খেলা দেখা শেষ করে আমি পুণরায় আবার বাড়ির পথে চলতে থাকি।
ছাইদুল বলেছিল -- পাঁচঠাকুরী গ্রামের আগেই বামদিকের একটি মেঠো পথ দিয়ে যেতে হবে। পাঁচঠাকুরী গ্রামের ঐ পর্যম্ত যেতেই কালী সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমার সাথে কোনো সঙ্গী সাথী নাই। খুব ভয় ভয় লাগছিল আমার ।
আমি রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, ঠিক এই মেঠো পথ দিয়ে যেতে হবে কী না? পথটির দুধারে বিস্তৃর্ণ আখের ক্ষেত। কিছু দেখা যায় না। তার উপর সন্ধ্যা রাত্রির অন্ধকার! ঠিক তখনই আখের ক্ষেতের ভিতর থেকে মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে আসে একজন যুবতী নারী।
রমণীটিকে আমি চিনি। এ যে আমাদের গাঁয়ের ভোলা মন্ডলের সুন্দরী বউ। আমি একটু সাহস পেলাম -- বললাম -- তুমি কই যাও?
-- 'নরপাড়া বাপের বাড়ি যাইতাছি। তোমার ভোলা ভাই আমারে মাইরা খেদাইয়া দিছে!'
এই রাতে আমাকে একা দেখে ভোলা মন্ডলের বউ বলছিল -- 'তা তুমি একা যাইতে পারবা? সামনে একটা জায়গা আছে, খুব একটা ভালো না। তুমি তিন রাস্তার মোড়ে যেয়ে সোজা যাইও। ভুলেও ডান দিকে যাবা না।'
আমি বললাম -- আচ্ছা।
ভোলা মন্ডলের বউ বলছিল, 'আমি কী তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসব?'
এই নিশি রাতে এক পর সুন্দরী রমণী আখ ক্ষেতের ভিতর দিয়ে আমার সাথে গমন করবে, কেউ দেখলে আমার বদনাম হবে। এই ভেবে আমি ভোলা মন্ডলের বউকে বললাম -- আমি একাই যেতে পারব।
ভোলা মন্ডলের বউ পাশের নরপাড়া গাঁয়ের দিকে চলে গেল। আমি আখ ক্ষেতের ভিতর দিয়ে মেঠো পথ ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। কিছুদূর আসার পর দেখি -- আখ ক্ষেতের পাতাগুলো বাতাসে নড়ছে। একটু ভয় পেলাম। যত হাঁটছি, ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝি পোকার ডাক বাড়ছে। আকাশে চাঁদ নেই। আখ পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশে চেয়ে যা দেখছি তা কয়েকটি অনুজ্জ্বল তারা।
হঠাৎ দেখি -- কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মুনিয়া পাখি উড়ে আসছে। ওরা আমার মাথার উপর দিয়ে শন শন করে চলে যাচ্ছে। অদূরে শিয়ালও ডাকছে হুক্কাহুয়া করে। শিয়ালের ডাক শুনে আমি ভয় পেলাম না। আমি হাঁটতে থাকি সাহস করে সামনের দিকে।
কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি -- সেই তিন রাস্তার মোড়। আমাকে মাঝের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু দেখি, মাঝের রাস্তার উপর অনেকগুলো কাক মরে পড়ে আছে। মরা কাকের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাকে যেতে হবে। খুব ভয় লাগছিল আমার।
আমি মাঝের রাস্তা দিয়ে না যেয়ে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে য়েতে থাকি। কী সুন্দর খোলা পথ! খুব ভালো লাগছিল হাঁটতে। কোথাও কোনো আখ ক্ষেত নেই। চারিদিকে সব সরিষার ক্ষেত। রাতের বেলায় হলুূদ ফুলের প্রান্তর দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কেমন এক মোহন আবেশে মন ভরে উঠছিল। গন্ধে আকুল করে রেখেছিল রাতের মিহি বাতাস। আমি সে গন্ধ মেখে হাঁটতে থাকি।
সামনের দিকে এগুতেই দেখতে পাই -- একটি পরিত্যক্ত নীলকুঠি। নীলকুঠি তো নয়, পোড়ামাটির ধ্বংসস্তূপ। শুনেছি এই কুঠি এলাকায় কেউ ভয়ে দিনের বেলায় আসে না। এখানে নাকি ভূতের আড্ডা বসে দিনে ও রাত্রিতে।
হায় আল্লাহ! আমাকে কে যে এখানে টেনে নিয়ে এলো ! কোন্ জ্বীন পরী? পিছনে তাকিয়ে দেখি -- কোথাও কোনো হলুদ সরিষার ক্ষেত নেই। সব মিছে ছিল। সব আখ ক্ষেত!
নীলকুঠির সামনে বাবলা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি এক দাড়িওয়ালা বুড়াকে। আমি বুড়াকে বলি -- দাদু, আমি পথ ভুল করে এখানে এসেছি। আমাকে তুমি পথ দেখিয়ে দাও।
--- তুই আর এখান থেকে যেতে পারবি না!
--- কেন পারব না?
--- তোকে বলি দিব।
বুড়ার পিছনে দেখি -- পনের ষোল বছরের একটি রূপবতী মেয়ে। পরীর মতো চেহারা। অসম্ভব সুন্দরী। মাথার চুল দুই বেনী করা। বেনীতে বাবলা ফুল গাঁথা , আর গলায় কাঁঠালীচাঁপা ফুলের মালা। আমি বললাম -- মেয়েটি কে?
বুড়া বলল -- ওকে আমি যমুনার নদীর এক গহীন চর থেকে নিয়ে এসেছি। ওর নাম রুক্সীণী । ও আমার নাতীকে ভালো বাসত। কিন্তু আমার নাতী সাপে কেটে মারা গেছে।
তারপর থেকে রুক্সীণী পাগল হয়ে কাশবনে পড়ে থাকত। কিছু খেত না। কী করব? ওর জন্য আমার খুব মায়া হয়। পরে ওকে আমি এখানে এই নীলকুঠিতে নিয়ে আসি বিবাহ করব বলে । কিন্তু আমার তান্ত্রিক গুরু শর্ত দিয়েছে আমাকে আগে নরবলি দিতে হবে। তারপর আমি বিবাহ করতে পারব।
মেয়েটি আমার দিকে সেই অন্ধকার রাত্রিতে খুব মায়া করে তাকিয়ে দেখছিল। যেন কতকাল ধরে সে আমাকে চেনে। আমিও তাকে চিনি। আমি ইঙ্গিৎ করে -- মেয়েটিকে বললাম -- তুমি আমাকে বাঁচাও! আমিও তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব।
বুড়া আমাদের শলাপরামর্শ বুঝতে পারছিল। বুড়া বলে -- 'এখানে দাঁড়া তুই , আমি ভিতর থেকে রামদা নিয়ে আসি। এখনই তোর গর্দান মাটিতে ফেলে দিব।' এই কথা বলে বুড়া নীলকুঠির ভিতরে চলে যায়।
আমি এই সুযোগে খপ করে রুক্সীণীর একটি হাত ধরি। এবং দুজন হাত ধরে ক্ষেত পাতাইলা ঝাইরা আমাদের গ্রামের দিকে দৌড় দেই।
এর পরের ঘটনা আমার আর মনে নেই।
তখন বেলা দশ ঘটিকা হবে । আমি আমাদের বাড়ির ঘরে পালঙ্কের উপর শুয়ে আছি। চারপাশে অনেক মানুষ! সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ভীড়ের মধ্যে একটি মেয়েকে দেখতে পেলাম -- ঠিক রাতে দেখা নীলকুঠির ঐ পরী মেয়েটির মতো। চুল দুই বেনী গাঁথা, বেনীতে বাবলা ফুল, গলায় কাঁঠালিচাঁপার মালা। এই মেয়েটিকে এর আগে কখনও আমাদের বাড়িতে দেখি নাই।
কোয়েল তালুকদার
২৫ মে, ২০২০ ইং, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন