সিল্কসিটি এক্সপ্রেস
বৃদ্ধাা মহিলাটির ঠোঁট মুখ বাঁকা হয়ে গেছে। কথা বলতে পারে না। শরীরের বাঁ পাশটা পুরো অবশ। তার যে দুতিন বার স্ট্রোক করেছিল, তাকে দেখলে তা বোঝা যায়।
কোনো শক্ত খাবার সে খেতে পারে না। নিজে হাত দিয়ে তুলে কোনো কিছু খেতে পারে না। তাকে তুলে খাওয়াতে হয়। তার আরও অসুবিধা আছে, তাহলো সে নিজে বাথরুমে যেতেও পারে না। অন্য কারোর সাহায্য নিতে হয়।
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে দেখে মনে হলো ওনারা নিম্নবিত্তের গ্রামের মানুষ। ওনারা যেহেতু সদানন্দপুর থেকে উঠেছে এদের বাড়ি কামারখন্দ-ভদ্রঘাট- কোনাবাড়ি- সিরাজগঞ্জ সদরের কোনো এলাকায় হয়ত হবে। আবার নাও হতে পারে। অন্য কোথাও থেকে এসে এই সদানন্দপুর স্টেশন থেকে তারা উঠতে পারে।
ট্রেনটি চলছে। ওনারা সাধারণ শোভন সিটে বসে আছে। লোকটা খুব সেবা সুশ্রুষা করছে ওনার স্ত্রীকে। তার সেবা সুশ্রুষা দেখে মনে হলো -- তাদের ভিতর একসময় খুব প্রেন মহব্বত ছিল। একটা শিশুকে যে ভাবে মা যত্ন করে খাওয়ায়, ঠিক সেইভাবে যত্ন করে স্ত্রীলোকটিকে সে খাওয়াচ্ছিল। কখনও তাকে দুহাত দিয়ে বুকের পাশে জড়িয়ে রাখছিল, কখনও তার কোলের উপর মাথা রেখে চুল বিলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিচ্ছিল লোকটি।
কামড়ার অন্যান্য যাত্রীরা সবাই মুগ্ধ হয় স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এমন ভালোবাসা দেখে। বৃদ্ধা মহিলাটি একসময় তার প্রিয়তম স্বামীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। মনে হলো, এমন কেউ একজন গান গেয়ে গেয়ে তাকে ঘুম পারালো --
'তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার
কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার,
জীনন মরণ মাঝে.... '
লোকটির সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হলো আমার। বললাম -- আপনারা কোথায় যাবেন? লোকটি বলল -- পাকসীর কাছেই, পদ্মার পাড়ে একটি গ্রামে।
--- ওনাকে আপনি খুব ভালোবাসেন বুঝি?
--- জ্বী, আমার পরানের চেয়ে বেশি।
--- তাই? শুনে অনেক খুশি হলাম।
--- জানেন, আমার সংসারে কিছু ছিলনা। সেই বাবার বাড়ির যা কিছু পেয়েছিল, সবই আমাকে এবং আমার সংসারের জন্য দিয়ে দিয়েছে। নিজের জন্য কিছু রাখেনি।'
-- যাক, আপনিও অকৃতজ্ঞ হননি। স্ত্রীর এই অসুস্থতার সময় তার পাশে রয়েছেন।
লোকটি স্মিত হাসলো।
ট্রেনটি ইতোমধ্যে ঈশ্বরদী জংশনে এসে থামে। লোকটি -- তার কোলের উপরে ঘুমিয়ে থাকা তার স্ত্রীকে ডাকে -- 'এই, ওঠো, এসে গেছি।'
বৃদ্ধা মায়া করে তার স্বামীর চোখের দিকে চোখ মেলে তাকায়।
লোকটি আবারও বৃদ্ধাকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে নামে। এবং তার স্ত্রীকে বামপাশ করে আস্তে আস্তে করে হেঁটে বিশ্রামাগারের দিকে নিয়ে যায়।
লোকটি তার অসুস্থ স্ত্রীকে বিশ্রামাগারের বেঞ্চের উপর শোয়ায়ে দেয়। তার মাথায় ও কপালে হাত বুলায়ে বলে -- 'খুব খারাপ লাগছে তোমার?'
বৃদ্ধা কথা বলতে পারছিল না। মাথা নেড়ে বলছিল শুধু , হে।
--- 'তুমি একটু শুয়ে থাকো। ভালো লাগবে।
আমি তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।' এই কথা বলে সে বিশ্রামাগারের বাইরে চলে আসে।
প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা সিল্কসিটি ট্রেনটি তখন হুইসেল বাজিয়ে পুনরায় চলতে থাকে। লোকটি একবার এদিক সেদিক তাকায়। তারপর দৌড়ে গিয়ে পিছনের কামড়ার একটি দরজা দিয়ে ত্বরিৎ ট্টেনটিতে উঠে পড়ে।
সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঝিকঝিক করে দ্রুত বেগে ছুটে চলতে থাকে রাজশাহীর দিকে।
কোয়েল তালুকদার
৩০ মে, ২০২০ ইং, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন