বুধবার, ২০ মে, ২০২০

ছোট্ট মায়া

ছোট্ট মায়া  

তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। কার্তিক মাসের এক 
ছুটির দিনে একাকী  মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার বাড়ি হচ্ছে গোপীনাথপুরে। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে। যমুনা নদীর তীর ঘেসে মামার বাড়ি । পায়ে হেঁটে যেতে হয়। মাঝখানে একটা ছোট নদীও পড়ে। খেয়া নৌকায় পার হতে হয।     

রবিনহুডের মতো একদিন হেঁটে হেঁটে মাঠ ঘাট প্রান্তর পার হয়ে পৌঁছে যাই গোপীনাথপুর আমার  মামার বাড়ি । 

সারা বিকাল পর্যন্ত মামাতো ভাই ছাইদুলের সাথে পুরো গ্রাম চষে বেড়াই। যমুনার কূলে যাই বেড়াতে। দেখি, সেখানে  মাটির পাড় ভেঙে পড়ছে নদীতে। বয়রা ঘাট থেকে ছেড়ে আসা বড়ো স্টীমারটি ভেঁপু বাজিয়ে চলে যাচ্ছে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের দিকে। চলছে লঞ্চ ও পাল তোলা সারি সারি নৌকা। জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরছে । দূরে মাঝ নদীতে জেগে ওঠা চর জুড়ে দেখতে পাচ্ছিলাম সাদাকেশি কাশবন।   
  
মাঠে কার্তিকের রোদ্রতাপে কিষাণীরা কাজ করছিল। কেউ কেউ জারীগান গাইছিল আপন মনে, কেউ হুকোয় তামাক তুলে মনের সুখে গরগর শব্দ তুলে টান দিচ্ছিল। নদীর কূলে উপরে ছেয়ে আছে  নীল আকাশ, সেই আকাশে বিভিন্ন পাখি উড়ছে। উড়ছিল চিলও। নদী থেকে বাতাস বয়ে আসছিল শন শন করে। কী যে ভালো লাগছিল -- কূলে দাঁড়িয়ে জল দেখতে!  
                       
কিন্তু যমুনার  একটি জিনিস দেখে আমার খুব 
মনখারাপ হয়েছিল । দেখলাম,  আধা পাকা ধানক্ষেত, সরিষা ক্ষেত, আখ ক্ষেত ভেঙে ভেঙে পড়ছে উত্তাল নদীতে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল --  চোখের সামনে দেখলাম,  একটি বহু প্রাচীন জীর্ণ মঠ  মাটি উপড়ে নদীর জলে তলিয়ে  যেতে ।       

যমুনার পাড় থেকে  ফেরার পথে ছাইদুল আমাকে বলছিল -- 'তুই তো খুব মন খারাপ করেছিস দেখছি। চল্ তোর মন ভালো করে দেই।' 
আমি বললাম, কী সে ! 
ছাইদুল বলল - ' আলেয়া আপুর নাম শুনিস নাই? আমার চাচাতো ফুপুর মেয়ে। পূর্ব পাড়ায় ওদের বাড়ি।  তোকে ওখানে ঐ বাড়িটায় নিয়ে যাব।'
আমি বললাম, 'আলেয়া আপুর নাম শুনেছি মার কাছে থেকে। কিন্তু কোনো দিন দেখি নাই তাকে ।'      
আম, জাম, কাঁঠাল, শুপারি ও নারিকেল গাছ বেষ্টিত ছিমছাম পরিবেশে আলেয়া আপুদের বাড়ি। আমরা বাড়িতে ঢুকতেই দেখতে পেলাম  -- আলেয়া আপুকে। এমন পল্লীর নিবিড় কোণে, এমন প্রতিমার মতো মেয়ে থাকে ! বিস্ময়ে চেয়ে দেখছিলাম। চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ,... চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি করে না। আমি তখন নিতান্তই  কিশোর--উত্তর এক তরুণ। মেয়েদের রূপ লাবণ্য ঐ ভাবে তখন বুঝতাম না।  আমি যখন অনেক বড়ো হয়ে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হলাম -- চন্দ্রাবতী, পদ্মাবতী, পার্বতী, লাবণ্যদের রূপ বর্ণনা যখন পড়েছি,  তখন অনেক আগের -- সবুজ পত্রপল্লব ঘেরা পল্লী গৃহকোণে একজন আলেয়া আপুকে দেখা তার অপূর্ব শ্রীময়ী মুখখানি মনে মনে মিলাতাম।  
                     
কী সুন্দর করে কত কথাই না বলেছিল আলেয়া আপু -- ' তুমি কী পড়ো, কী হতে চাও জীবনে, কী ভালো লাগে তোমার, আমার কথা তোমার মনে থাকবে,  তুমি অনেক ভালো ছেলে !'  এমন অনেক ভাঙা ভাঙা কম্পিত কথা।   
          
আলেয়া আপুদের বাড়ি থেকে যখন চলে আসি -- তখন আপু বলেছিল -- 'ফাল্গুনের চার তারিখে আমার বিয়ে হবে।  তুমি এসো বিয়েতে।  কী আসবে না তুমি? '

আমি মাথা নেরে বলেছিলাম -- ' আসবো আপু। আমি এসে সারা বাড়ির উঠোনে আলপনা আঁকবো আর নেচে নেচে হারমণিকা বাজাবো।'      

পথে আসতে আসতে সাইদুল আমাকে বলছিল -- কী আলেয়া আপুকে দেখে তোর মন ভালো হয়েছে তো ?'  আমি বলেছিলাম -- 'হয়েছে।'

কিন্তু,  ছাইদুল জানতে পারেনি,  সেদিন আমার কোমল কিশার তরুণ মন অনেক খারাপও হয়েছিল। সেই মনখারাপের বিষণ্ণতা আজও মনের উপর ছায়া ফেলে।        

বিকালে যখন বাড়ি ফিরে আসছিলাম, তখন আমার সাথে খেয়া পার হচ্ছিল একজন বোষ্টুম ও বোষ্টুমি। ওদের পরনে ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়। দুজনের হাতে দোতারা!  আমি বললাম -- তোমরা একটা গান গেয়ে শোনাবে আমাকে!  টাকা চাইলে টাকা নিবা। আমার কাছে দশ টাকা আছে। তাই দেব তোমাদের।                                    

বোষ্টুমি বলছিল -- 'আমরা কত ঘাটে কত বাটে কত গান গেয়ে শোনাই মানুষকে। কেউ পয়সা দেয়, কেউ দেয় না। আজ আমরা তোমাকে এমনি একটা গান শোনাব, কোনো পয়সা লাগবে না।'        

বোষ্টুমি দোতারায় তান তুলল। বোষ্টুম বাজাচ্ছিল খুঞ্জরি টুংটাং করে --
দুজনেই একসাথে গেয়ে শোনাল গান।

'...ছেড়ে দিয়া মায়াপুরী
দিতে হবে ভব পাড়ি
চেয়ে দেখো মন-ব্যাপারী
দিন গেলে হয় সন্ধ্যা ..
আপনি যদি ভালো বুঝ
সুসময়ে মুর্শিদ ভজ
জ্ঞান থাকিতে পাগল সাজো
চোখ থাকতে হও আন্ধা ..
এই দুনিয়া মায়া জালে বান্ধা ..'
                      
                                       
মানুষের জীবনে শুরু থেকে কত কিছুই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি থাকে !  কত সুখ অনুরণরিত হয় বোষ্টুমীর ঐ দোতারার তানের মতো চিরকাল।  আবার কত মায়া--বেদনা আটকে থাকে বুকের গভীরে অনন্ত জীবন ধরে, কান্না হয়ে তা ঝরে পড়েনা। 

কী এক অদ্ভুত সন্ধ্যা ছিল সেদিন।  ছোট্ট সেই নদীর জলের ক্ষীণ ধারা ছলাৎছল করছিল। সন্ধ্যা আকাশের সব সোনালি আভা যেন মেখে দিচ্ছিল অন্তরের মাঝে!  

কিছু রঙ তার এখনও মনকে রঙিন করে।                                  
                         
কোয়েল তালুকদার  
২১ মে, ২০২০ ইং,  ঢাকা।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন