শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৮

চম্পা বকুল চলে

১.  চম্পা বকুল তলে

আমার স্কুল সহপাঠী নারায়ণ পূজা পার্বনে প্রায়ই ওদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যেত। নারায়ণের মা নারিকেলের নারু আর গুরের বাতাসা খেতে দিত। সেবার ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর লক্ষীপূজায় গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। নারু আর বাতাসার সাথে মাসীমা ক্ষীরও খেতে দিয়েছিল। ক্ষীর খেয়ে বলেছিলাম, ' দারুণ  মজা হইয়াছে।' মাসীমা এই কথা শুনে বলেছিল, 'তুমি আবার আসিও। তোমাকে আরও ভাল করে ক্ষীর রান্না করে খাওয়াব। ' কিন্তু  আমার আর যাওয়া হয় নাই। সেইটাই ছিল শেষ যাওয়া। পরে শুনেছি, সেই মাসীমা ইহলোক ত্যাগ করেছেন।

এই নারায়ণের সাথে আমার দেখা হয় তিরিশ বছর পরে কূড়াগাছা মেলায়। ও আমাকে জোর জবরদস্তি করে নিয়ে যায় ওদের বাড়ি। স্কুল থেকে আগে যে পথ দিয়ে ওদের বাড়ি যেতাম, সে পথ ছিল ধূলির। সেই পথই দেখলাম ইট সুরকি বিছানো। একটি রিক্সায় করে চলে যাই ওদের ব্রহ্মগাছা গ্রামে। পথে দিয়ে চলছিলাম, আর দেখছিলাম পথের দুইপাশের চিত্রগুলি। সবকিছুই কেমন যেন অচেনা লাগছিল। সেইসময়ে পথের ধারে পাকুড় গাছতলায় দেখেছিলাম, খালি মাঠের উপরে একটি নাট্যশালা। আজ দেখলাম --- সেই নাট্যশালাটি সেখানে নেই।  ভেঙে সেখানে স্কুল করা হয়েছে।

নারায়ণদের বাড়িতে পৌঁছে মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে নতুন কোনো ঘর দুয়ার ওঠে নাই। যা দেখেছিলাম তাই আছে। সবকিছুই কেমন জীর্ণ পুরাতন হয়ে গেছে। মুখর করা বাড়িটি কোলাহলহীন মনে হচ্ছে। সাদা ধূতি শাড়ি পড়ে কোনো পৌঢ়া মহিলা আজ আর বের হলনা। কাছে এসে মায়ের মতো আদর করে বললোনা --- ' বাবা, তুমি কেমন আছ?'

একটু পরে নারায়ণ ওর স্ত্রীকে আমার সামনে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেয়। সাথে ওর দুটো বাচ্চাকেও। আমি ওর স্ত্রীর মুখের দিকে ভাল করে একবার দৃষ্টি মেলে তাকালাম, যাকে ভেবে এই চেয়ে থাকা, সেই মেয়ে এই মেয়ে নয়। তারপরেও তাকেই দেখলাম, বললাম, বৌদি, 'আমি নারায়ণের স্কুল সহপাঠী বন্ধু। তিরিশ বছর পর আমাদের দেখা। '

বাড়িতে তেমন কাউকে না দেখতে পেয়ে নারায়নকে বলি, অপর্ণা দিদির কোথায় বিয়ে হয়েছে? নারায়ণ বলে, দিদি এখন জলপাইগুড়িতে থাকে। ওখানেই তাঁর ঘর সংসার। '
----  সুধীন দাদা কোথায়?
----   সেও ওপারে চলে গেছে। শিলিগুড়িতেই বিয়ে করেছে।
---- তোর ছোট ভাই নৃপেন কোথায় থাকে?
---- ও কোলকাতায় চিৎপুরে থাকে। আমি এই পুরো বাড়িতে এখন একাই থাকি।

নারায়ণ আরও বলছিল, জানিস, কেমন যেন শ্মশানের মতো শূন্যতার মনে হয় -- এই বাড়ি। এই লোকালয়। কত আপন মানুষ যে স্বর্গীয় হয়ে গেল। কত আত্মজন যে চলে গেল এই দেশ পারাপার ছাড়িয়ে ওপারে, অন্য পরভূমে। অন্তর হাহাকার করে ওঠে। তোকে যখন মেলায় দেখলাম, মনটা কি যে আনন্দে ভরে উঠল। কত কথা মনে হচ্ছে তোকে দেখে। কত স্মৃতি। '

আমি নারায়ণের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, কেমন যেন বিষাদে ছেয়ে উঠেছে ওর মুখখানি। আমি ওকে বলি --- তোদের বাড়ির পিছনে তো ইছামতী নদী আছে, চল্, একটু বেড়িয়ে আসি তীর থেকে। তখন সন্ধ্যা নেমে আসছিল। আমি আর নারায়ণ হাটতে হাটতে চলে যাই ইছামতীর তীরে । হায়!  নদী আর নেই। হয়ে গেছে মরা খাল। সামান্য কিছু জল স্থির হয়ে আছে তলাতে। সেই কাজল জল, সেই স্রোতধারা, সেই উথাল ঢেউ কিছুই আজ আর নেই।

ভেবেছিলাম মনটা আমাদের ভাল হবে নদী দেখে। তা আর হলনা। চৈত্রের এই সন্ধ্যা রাতে আকাশে উঠেছিল একাদশীর চাঁদ। বুঁনো জোনাকিরা জ্বলে উঠেছিল নদীর কাশবনে। ঝিঁঝির ডাক শুনতে শুনতে আকুল হয়ে নারায়ণকে বলছিলাম --- 'তোর সেই দীপা বর্মণের খবর কী, যাকে তুই ভালবেসেছিলি।  বৌঠানের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম -- এই তো দীপা নয়।'

আমরা নদীর কূল থেকে সন্ধ্যার আঁধারে হেটে হেটে ফিরে আসছিলাম। যে পথ দিয়ে গিয়েছিলাম নদীর কূলে, সেই পথ দিয়ে নারায়ণ আমাকে আনলো না। অন্য একটি পথ দিয়ে সে আমাকে নিয়ে আসছিল। পথের দুপাশটা খুব পরিচিত মনে হ্চ্ছিল। জ্যোৎস্নার আলো আঁধারিতে চিনতে পারছিলাম পরিচিত গাছগুলো। আজ থেকে তিরিশ বছর আগের সেই বকুলের গন্ধ, পথের পাশের ঝাড় থেকে আসছিল চম্পা ফুলের সেই  সুবাস। আমার মনে পড়ছিল এই রকম সুবাস পেয়েছিলাম তিরিশ বছর আগে দীপা বর্মণদের বাড়ি যেতে।

নারায়ণ যে বাড়িটির সামনে আমাকে নিয়ে আসে, সে বাড়িও আমার চেনা। ইটের এই বাড়িটি তখনও পুরানো ছিল।  আজ দেখলাম, এর পলেস্তারা সব খসে গেছে। ভাঙ্গা ইটের ফাঁকে পরগাছা জন্মে গেছে। নারায়ণ আমাকে বলে ----' চিনতে পারছিস বাড়িটি?'  আমি বললাম, চিনতে পারছি । এই বাড়ি দীপাদের। সেইবার লক্ষীপূজায় এখানে কীর্তন গানের আসর বসেছিল। সেদিন আকাশে ছিল কোজাগরী চাঁদ। সারা পৃথিবী খাখা জ্যোৎস্নায় ভরে উঠেছিল। পূজার প্রসাদ সেদিন দীপা তোকে না দিয়ে আমাকে দিয়েছিল। আজ তোকে বলছি --- সেদিন সেই অসম্ভব সুন্দর জ্যোৎস্নায় দীপা গোপনে ধরেছিল আমার  একটি হাত। দীপা বলেছিল -- ' দাদা, তুমি আমাকে একটু চম্পা বকুলের ছায়াতলে  নিয়ে যাবে? এই কোজাগরী চাঁদ, এই রাত তোমার জন্য মায়াময় মনে হচ্ছে।'  আমি জানি, দীপা ছিল তোর। তাই দীপার সেই হাত আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম সেদিন।'

নারায়ণ আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়। দেখি, চল্লিশোর্ধ্ব একজন রমণী বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে বসে আছে। তার পাশে  লন্ঠন জ্বলছে। নারায়ণ লন্ঠনটি তুলে ধরে সেই রমণীর মুখের দিকে। এবং বলে, দেখত চিনতে পারিস কিনা এই মুখ। ' আমি চিনেছিলাম, সেই মুখ। এ যে দীপা। সে কোনো কথা বললনা, নির্বাক তাকিয়ে থাকল আমার মুখের দিকে। '

গন্ধে আকুল করা চম্পা বকুল তলা দিয়ে হাটতে হাটতে সেই রাতে বাড়ি ফেরার সময় নারায়ণ বলেছিল --- ' তিরিশ বছর ধরে জানতে পারিনি, দীপা কেন এমন বদ্ধ পাগল হয়েছে। আজ তোর কাছ থেকে জানতে পারলাম, দীপা কেন এমন পাগল হয়ে গেছে।'



২.       নূরী

শেষ পর্যন্ত একজন বালিকাকে আমার বিবাহ করতে হলো।  কোনো এক শীতের সন্ধ্যায় তাকে লাল বেনারশী শাড়ি পড়ানো হলো। মুখে আলপনা আঁকা হলো। হাতে চুড়ি পড়ানো হলো। মেহেদী লাগিয়ে দেয়া হলো দুই হাতে। খুব একটা উৎসব হলোনা। সানাইও বাজেনি। ইচ্ছা ছিলো দুই ঘোড়ার গাড়িতে করে বউ তুলে আনবো, তাও হলোনা। ফুলহীন, সাজসজ্জাহীন একটি সাদা গাড়ীতে করে সেদিন নববধূকে ঘরে তুলে এনেছিলাম।

এ যেনো পুতুলখেলার সংসার শুরু হলো। বাজারে যেয়ে হাঁড়ি পাতিল কিনলাম। বালতি কিনলাম। শীল পাটা কিনলাম। মাদুর,ফুলদানী সব কিনতে হলো। এ এক অত্যশ্চর্য জীবনের শুরু। যা জীবনে কোনোদিন চোখে দেখি নাই। শুনি নাই। বুঝি নাই। এখন আর সকাল বেলা পাখীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করতে হয়না। এলার্ম দিয়ে রাখতে হয়না ঘড়িতে।এতো সুুন্দর জীবন আছে জীবনে, আগে বুঝি নাই।

ওর নাম আয়শা নূর। বলেছিলাম তুমি এষা না নুরী। ও বলেছিলো আমি নুরী।
নূরী চঞ্চল হয় সকাল বেলা। রোদ্রের উত্তাপে হয় দহন।
সাওয়ারের নীচে জল ঢালে সারা দুপুর,
সন্ধ্যায় আকুল হয় রবি ঠাকুরের গানে,
মনে পড়ে তার দূর গায়ের কথা
স্টেশনে রেল গাড়ির সেই হুইসেলের শব্দ, মনে পড়ে সেই ঝিকঝিক আওয়াজ।

নুরী ওর বাবার সাথে একদিন বাড়ী চলে যায়। সেখানে ওর ছোটো বোনকে পায় খেলার সাথী করে। দু'জন হেটে হেটে চলে যায় রেল লাইনের ধারে। দূর থেকে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন এসে থামে প্লাটফরমে। হৈ হুল্লর করে যাত্রিরা নেমে আসে কামড়া থেকে।

আমি বুঝতে পারি আমার প্রথম শূণ্যতা।  আলনায় কাপড় হয়ে থাকে এলোমেলো। আবার পাখীর ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ঘুম ভাঙ্গার। জীবনের এতোটা বছর একা লাগেনি। কবিতা লেখার ভাবনা চলে যায় সমান্তরাল রেল লাইনের সেই দূরের প্রান্তে। নিঃসীম শূণ্যতা পড়ে থাকে সেখানে। একদিন ঘুম আসে সন্ধ্যাবেলা, আরেকদিন সারা রাতেও না।

আর একদিন রাতের বেলা ল্যাম্পের আলো জ্বেলে চিঠি লিখতে বসি ---
'নূরী, তুমি চলিয়া যাইবার পর হইতে আমার খাওয়ার অরুচি হইয়াছে। প্রত্যহ অফিসে যাইতে লেট হইতেছে। ঘুমও ঠিকমতো হইতেছেনা। অনেক চেষ্টা করিয়াছি,স্বপ্নে তোমাকে কাছে পাইতে। কিন্তু একদিনও তোমাকে পাই নাই। যাহা হোক,পত্র পাঠ তুমি চলিয়া আসিও। ইতি---

উত্তরে নুরী লিখলো ---
'প্রিয়তম, তোমার চিঠি পেলাম। আমি এখানে খুব ভালো আছি। আমরা প্রতিদিন রেল লাইনের ধারে বেড়াতে যাই। কাল কাজিপুরা নানী বাড়ী বেডাতে যাবো। উল্লাপাড়া ছোটো ফুপুর বাড়ীতেও যাবো। বেশী খিদা লাগলে তুমি আজিজের হোটেলে খেয়ে নিও। রবীন্দ্রনাথের গান শুনিও। তবেই ঘুম আসবে। ইতি- নুরী।

নুরীতে থাকে মুক্তা, পাথরে ভারী হয়ে থাকে বুক
যমুনার জলে রুপালী মাছের ঝাঁক ঘুরে বেড়ায়
হেমন্তের রাত্রিতে চাঁদ নেমে আসে দুই পাড়ে-
তার চোখ আমাকে বিষন্ন করে, কোথায় পড়ে আছে
বকুল ফুলের মালা খানি। আমি প্রতিদিন চেয়ে থাকি
অন্ধকারে- বালিকা চলে আসছে
রেল লাইনের স্লিপারে হেটে হেটে।.

আমি নিজেই ওকে দেখতে চলে যাই একদিন। রাজশাহী এক্সপ্রেস ট্রেনটি থামলো জামতৈল স্টেশনে। তখন সন্ধ্যা হয়েছে। মুগ্ধতার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম বুকের তল থেকে। রক্তের স্পন্দন বাড়ছিলো তাকে দেখবার আনন্দে। বাড়ী পৌঁছে শুনি- ছোটো ফুফুর বাড়ীতে নুরী বেড়াতে গেছে। আজকেই ওর ফেরার কথা ছিলো। কিন্তু আসেনি।

দূর ভ্রমনে শরীরে ক্লান্তি ছিল। মন খারাপের চোখে নাকি ঘুম বেশি আসে।  অবসাদ আর মনবেদনা নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে যাই। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে --- তখন চোখ মেলে দেখি পাশে নুরী শুয়ে আছে। ঘুমের ঘোরে ওর একটি হাত আমার বাহুতে জড়িয়ে ধরে আছে।

তারপর পাখী সব কলরব করে ডেকে উঠলো
ভোরের আলো জ্ব্বলে ওঠে হুরাসাগরের জলে.
স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় রাতের ক্লান্ত ট্রেন খানি
তখন গান কবিতা হয়,কবিতা হয়ে যায় গান।


৩.    মেহেরজান

অপ্রেমে দূরে রেখেছিলাম তাকে। প্রেমেই তাকে কাছে নিয়ে আসে। এত কাছে যে --- ওর চোখের মায়া একদিন আমার চাহনীতে না পেলে আমার মন খারাপ হয়ে যেত। আমার সমস্ত চৈতন্যে, সমস্ত অবচৈতন্যে তার ভালবাসায় জড়িয়ে যাই।

মেহেরজানকে প্রথম দেখে বিমুুগ্ধ হয়েছিলাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে। তখন সেখানে এতো অট্রালিকা ছিলো না। ওয়াইজ ঘাট থেকে হেটে হেটে আরো একটু পশ্চিমে, নদীর তীরে একটা ভাঙ্গা ইটের ঢিপির উপর দু'জন বসেছিলাম। সূর্য তখন অস্তমিত। নদীতে ভেসে থাকা লাল আভার ঝিলিক মেহেরজানের মুখে এসে পড়েছিল। আর প্রথম বিমুগ্ধ হওয়া সেখানেই।

সেদিন ঝুনু আপা ক্লাশে আসেনি। তাই ক্লাশ আর হলোনা। তবলচি কিছুক্ষণ একাকী তবলায় তাল দিল।কিন্তু সে নাচ আর কারও করা হলো না। তারপর মর্নিং শো'তে স্টার সিনেমা হলে আমি আর মেহেরজান যেয়ে ঢুকে পড়ি। সুভাষ দত্তের 'বসুন্ধরা'। সিনেমা কি দেখবো ? আমরা যেখানে বসেছিলাম,তার আশে পাশে ওয়াইজ ঘাটের এক গাদা Out of Bond এর মেয়েরা বসেছিল। উদ্ভট সাঁজ, আর পোষাক পরিহিত ঐ সব বনিতারা অকারণে হাসি আর শিষ দিচ্ছিল। বিরতির সময় আমরা বের হয়ে চলে আসি।

আর একদিন আহসান মঞ্জিলে গিয়েছিলাম। প্রকোষ্ঠের পর প্রকোষ্ঠ ঘুরছিলাম। একটি রুম আছে নবাবদের পানশালা হবে হয়ত। দেয়ালে টানানো একজন নর্তকীর তৈলচিত্র দেখতে পাই। আমি মেহেরজানকে বলি --- তুমিও তো নাচ শিখছ। নবাবরা থাকলে এই রকমই নর্তকী হতে পারতে।
মেহেরজান:   তুমি কি ঐ মেয়ের চোখ দেখে কিছু বুঝতে পারছো ?
আমি:    যে মাদকতা আমি দেখছি ওর চোখে মুখে, সেখানে কেবল আনন্দই দেখতে পাচ্ছি।
মেহেরজান:   তুমি দেখেছ কেবল ওর আনন্দময়ী দুটি চোখ। আমি দেখেছি ওর চোখের পিছনে --- যেখানে অনেক বেদনার অশ্রু জমে আছে। যা দেখাও যায়না, ঝরেও পড়েনা।

আমি দেখলাম, মেহেরজানের চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছে। হঠাৎ মনে হলো ঐ রুমের মধ্যে ঘুঙ্গুরের শব্দ হচ্ছে। তবলচি বাজাচ্ছে তবলা। শরাব খা্চ্ছি আমি।মেহেরজান নাচছে নুপুর পায়ে। আমি তো মেহেরজানের চোখে কোনো দুঃখ দেখছিনা, দেখছি আনন্দ। শরাব পান করছি। প্রিয়া আজ মেহেরজান। হঠাৎ মনে হলো, পাশের প্রকোষ্ঠ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। মনে হলো কোনো একজন নর্তকী আথবা যৌনদাসী কাঁদছে। যখন ঘোর কাটে তখন দেখতে পেলাম --- আমি মেহেরজানের চুলে মুখ লাগিয়ে চুলের সুবাস নিচ্ছি।মেহেরজান আমার বুকে জড়িয়ে আছে।

তারপর অনেক কথা। কতো ভালবাসা হলো দুজনের।কিন্তু ঈশ্বর আমাদের সেই প্রেম কালস্রোতের উল্টো দিকে ভাসিয়ে দিলো। প্রেমেই একদিন মেহেরজানকে কাছে টেনে এনেছিলো, আবার প্রেমেই তাকে দূরে রেখে দিলাম। যার চোখের মায়া দিয়ে আমাকে একদিন না দেখলে সারাদিন  মন খারাপ লাগত, তাকেই নয়নের আড়াল করে রাখলাম। মেহেরজানকে আমার সমস্ত চৈতন্যে, সমস্ত অবচৈতন্যে ভুলে যেতে থাকি, কেন ভুলে যেতে থাকি --- সে দীর্ঘশ্বাশের কথা আরেকদিন বলবো।


৪.       কুসুম

একটি রিসার্স প্রজেক্টে কাজ করতে কুসুম ঢাকা এসেছিল । সাময়িক চাকুরী। ও আমার সহকর্মী ছিল।গত সপ্তাহে কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে গেছে। তাই চাকুরী আর নেই। আজ সে বাড়ী ফিরে যাচ্ছে। কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। জানালার পাশে বসে থাকা কুসুমের বিষন্ন চোখ আমার দিকে চেয়ে আছে । ট্রেনের চাকার খট্ খট্ কর্কশ আওয়াজ দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে সামনের সমান্তরাল পথের দিকে। কুসুমের চোখ আর দেখা গেলনা। এই শহর ছেড়ে কুসুম চলে গেলো।

কতক্ষণ প্লাটফরমে একাকী হাটছিলাম। কেমন যেন উদাস লাগছিল। পাশে অদূরে একটি চা'র দোকানে গিয়ে বসি। এক কাপ লাল চা খাই। তারপর সিগারেট ধরাই। পাশে কেউ ছিলনা। ধূয়াগুলো মিলিয়ে দিচ্ছিলাম শুন্য প্লাটফরমের দিকে।

স্টেশন থেকে পথে নেমে পড়ি। প্রখর রোদ্রে হেটে হেটেই মুগদাপাড়ায় মেসে চলে আসি। মনটা ভাল লাগছিলনা। বিছানায় সোজা শুয়ে পড়ি। টেবিলের উপর রাখা ডাইরীটার উপর চোখ যায়। একবার প্রজেক্টের কাজে নেত্রকোনা'র বারোহাট্রা গিয়েছিলাম। কংস নদীর পাড়ে এক নিরিবিলিতে আমার ডায়েরীটা নিয়ে কুসুম লিখেছিল ----
'তুমি আমাকে পূর্ণ করো। আমাকে পূর্ণ করবেনা অন্য কেউ। আমাকে তুমি স্বপ্ন দেখাও। যে স্বপ্ন ভাঙ্গতে পারবেনা কেউ। আমি বসে থাকি তোমার পথের দিকে।তোমার সাথে পথ চলবো।, সে পথ চলা বন্ধ করতে পারবেনা কেউ। আজকের এই কংস নদীর জলকে সামনে রেখে বলছি ---- 'আমি তোমাকে ভালবাসি।'এই ভালোবাসাও কেড়ে নিতে পারবেনা কেউ।'

একদিন দুইদিন যায়। সময় কাটতে চায়না। সব চেনা পথগুলো ফাঁকা ফাঁকা লাগে। দুটো টিউশনী করি।বিকেল হলে একাকী স্টেশনের প্লাটফরমে ঘুরে বেড়াই।কখনও অসময়ে ঘুমিয়ে থাকি। কখনও সারারাত জেগে থাকি। মাঝে মাঝে ভাবি, কুসুম আমার কি না হতে পারত। ওকে কেন যেতে দিলাম। রেখে দিতাম আমার উদ্বাস্ত জীবনের কাছে।
                                                                                                                                                       একটি কোম্পানীতে পণ্য মার্কেটিংএর চাকুরী পাই। প্রথম দিনেই সহকর্মী মালতী নামে একটি মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। যেন কুসুম। সেই চোখ, সেই চুল, সেই স্মিত হাসি। সেই ঘনিষ্ঠতা হয়ে ওঠা। সেই পুরানো প্রেম ফিরে পাওয়া। কুসুমকে নিয়ে যে পথগুলো দিয়ে হেটেছিলাম, সে পথ দিয়েই মালতীকে নিয়ে হাটি। পার্কে যে বেঞ্চে কুসুমকে নিয়ে বসে থেকেছি সেই বেঞ্চেই মালতীকে নিয়ে বসে থাকি। মালতীর ভালবাসাগুলোও কুসুমের মতোই। সেই একই শরীরের গন্ধ, আলিঙ্গনের উষ্ণতা একই, চুম্বনের মাধূর্যও একই।'

এক অগ্রহায়নে মালতী আর আমার বিয়ের সানাই বেজে ওঠে। আমার পরনে শেরওয়ানী, মাথায় কারুকার্য খচিত টুপি, ওদিকে মালতীর পরনে লাল বেনারশী শাড়ি। সিঁথিতে টিকলী বাঁধা। গালে কপালে আবির মাখা সাঁজ। যখন আমার পাশে মালতীকে বসানো হলো, তথন একবার তাকালাম মালতীর দিকে। দেখি এ যেন সেই কুসুম। সেই মায়াবী চোখ, সেই আনত ললাট। চারদিকে কত আনন্দ, কত হৈহুল্লুর, কত গান বাজছিল । সব গান ছাপিয়ে এই গানটি  বিষন্ন সুরে ভেসে এল ---
 ''প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে।
 চারি দিকে হাসিরাশি, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে।''


৫.        শেষ বিকেলের কথা

রাতে খাবারের পর কেমন যেন আলস্য লাগছিল। শুয়ে ছিলাম বালিশে মুখ গুজে। ভালো লাগছিলনা। উঠে তাই ছাদে চলে আসি। ছাদের এককোনে আমি দাড়িয়ে আছি। আজ আকাশে চাঁদ নেই। ছড়ানো ছিটানো আছে কয়েকটি তারা। আমার পরনে টি-সার্ট এবং ট্রাউজার্স।একটা সিগারেট ধরাই। সিগারেট টানছিলাম আর ভাবছিলাম আজকের শেষ বিকেলের কথ। সিগারেটের ধূয়ার টানে মনটা চলে গেল --- বিকালে পার্কের সেই বিবর্ণ সময়ের কাছে ।

দু'টো প্রজাপতি একটাই গোলাপের উপর বসে আছে।পাশে আরও গোলাপ আছে, আরো অনেক ফুল আছে।সেখানে কোনো প্রজাপতি নেই। একটি ফুল থেকেই দু্'টো প্রজাপতি সুবাস নিচ্ছে। ওরা মধুরাক্ষী কিনা জানিনা। এই অপূর্ব মোহনীয় দৃশ্যটি দেখছিলাম আমি আর পাঁপড়ি।

পাঁপড়ি আমার সহপাঠী। আমাদের ক্লাশ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আজকে পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল।ক্যাম্পাসকে বিদায় জানিয়ে এসেছি। কাল থেকে কেউই আমরা ক্যাম্পাসে থাকবনা। সেমিনার কক্ষে কত ছাত্র বসে থাকবে, আমরা সেখানে থাকবনা। ক্যান্টিনে আর চা'র কাপে ঝর উঠবেনা। লাইব্রেরী বারান্দায় বসে আর কোনো আড্ডাও হবেনা।

আমার আর পাঁপড়ির এইসব নিয়ে এমনিতেই মন খারাপ ছিলো। তারপরেও আজকের এই শেষ বিকালটা কাটানোর জন্য পার্কে চলে আসি। এসেই প্রজাপতিদের ঐ মোহনীয় দৃশ্যটি দেখতে পাই। এলোমেলো ভাবে হাটছিলাম দু'জন। এক সময় লেকের পারে ঘাসের উপর যেয়ে বসি। পাঁপড়ি কালকেই চলে যাবে দেশের বাড়ী। ওর বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হয়ে আছে। অপেক্ষা ছিল শুধু পরীক্ষা শেষ হবার। পাঁপড়ি বলছিল --- তুমি যাবেনা আমার বিয়েতে ?
আমি :  তুমি বললে অবশ্যই যাব।
পাঁপড়ি মায়াবী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল -- তুমি অবশ্যই যাবে।
আমি:  যাবো। কিন্তু কোনো কারণে যদি না যেতে পারি ---

আমি আমার ঝুলানো কাপড়ের ব্যাগ থেকে রবীন্দ্রনাথের 'গীতবিতান' বইটি বের করি। পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে এই গানটি চোখে পড়ে-

'অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে কানে
কত নিশীথ-অন্ধকারে, কত গোপন গানে গানে
সে কি তোমার মনে আছে তাই শুধাতে এলেম কাছে–
রাতের বুকের মাঝে মাঝে তারা মিলিয়ে আছে সকল খানে।'

গীতবিতানের প্রথম পাতায় লিখি --- ' তোমার শুভ দিনে আমার এই শুভাশীষ '। নীচে আমার নাম ও তারিখ লিখি। তারপর বইটি পাঁপড়ির হাতে দিয়ে বলি --- সেদিন যদি কোনো কারণে তোমার বিয়েতে না যেতে পারি, তোমার জন্য আমার এই গীতবিতান।'

বইটি আমার হাত থেকে নিতেই দেখি পাঁপড়ির মুখ।মহুয়া গাছের ফাঁক দিয়ে বিকেলের রোদ এসে মুখে পড়েছে। লেকের নিস্তব্ধ জলের মতো চোখ বিনম্র হয়ে আছে। উদ্ভান্ত বাতাসে কড়ই গাছ থেকে তখন মরা পাতা ঝরঝর করে ঝরে পডছে। কি কথা যেন বলতে চেয়েছিল পাঁপড়ি কিন্তু আর বলতে পারেনি। দেখলাম ---পাঁপড়ি কাঁদছে।



৬.         পৃথিবীর পথে পথে

সিরাজগঞ্জে শহীদ মনসুর আলী স্টেশন থেকে সিল্কসিটি ট্রেনে ঢাকা আসছিলাম। আমার পাশের সিটে মধ্য বয়সী এক বিদেশী বসা ছিল। প্রাথমিক পরিচয়ে যতটুকু জানতে পারি --- ওর নাম পল এ্যান্ডারসন। সে একজন ধর্ম যাজক এবং পরিব্রাজক। অনেকটা ক্যারাভান লাইফ তার, যাযাবরীয় জীবন যাপন করে। গিয়েছিল দিনাজপুরে কান্তজীর মন্দির দেখতে। সেখান থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাট। সোনা মসজিদ দেখে এখন ঢাকার পথে। তারপরে যাবে রেঙ্গুন।

সিল্কসিটি ধীরে ধীরে যমুনা অতিক্রম করছিল। তখন বর্ষার সময়। জেগে থাকা চরগুলো জলে ডুবে গেছে।সারা যমুনার বুক জুুড়ে জল থৈথৈ করছে। সাগরের মতো লাগছিল যমুনাকে। ওপারের কোনো কূল কিনারা দেখা যায়না। ট্রেনের জানালা দিয়ে পল বিস্ময়ে দেখছিল যমুনা নদী !
পল :   তোমাদের এই নদীটির নামই তো যমুনা ?
আমি:  হ্যাঁ, এইটিই যমুনা নদী।
পল:  খুবই সুন্দর একটি নদী। ঐ যে দূরে পানি আর পানি দেখছি। তারপরে কোন শহর বা গ্রাম আছে ?
আমি:  ঐ জলের ওপারে কোনো শহর নেই, নদীর কূল ঘেসে আছে শুধূ গ্রাম আর ফসলের ক্ষেত।

পলের সাথে এইভাবেই কথা বলতে থাকি। ট্রেনটি ইতোমধ্যে যমুনা পার হয়ে ঢাকার দিকে চলতে থাকে।মির্জাপুর পর্য্ন্ত যেতে যেতে পল সম্বন্ধে যতটুকু জানতে পারি --- পলের জন্ম আমেরিকার টেক্সাসের হার্স্ট শহরে। ওর মা ছিলো বার্মিজ। পলের বাবা চাকুরী সূত্রে রেঙ্গুনে থাকাকালীন সময়ে পলের মা'র সাথে প্রণয় হয় ও পরবর্তীতে বিয়ে হয়। পলের বাবা'র পরবর্তী পোস্টিং হয়েছিলো বোম্বে। আর পলের কৈশরকাল কাটে এই ভারতবর্ষের বোম্বে নগরীতেই। এই নগরীতেই পলের মায়ের অকাল মৃত্যুও হয়।

ট্রেনটি মির্জাপুর স্টেশনে থেমে আছে। অন্য আর একটি ট্রেন এখানে ক্রসিং হবে। ট্রেনটি ছাড়তে দেরী হবে দেখে আমি আর পল স্টেশনে নেমে প্লাটফর্মের উপর দিয়ে হাটতে থাকি।
আমি :  পল, তারপরের কথা বলো।
পল:  আমার য়য়স যখন নয় বছর তখন বাবা হার্স্টে চলে আসে। এমনই দূর্ভাগ্য যে, বাবা একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান সে বছরেই।

আমরা যেয়ে একটি চা'র দোকানে বসি। এবং চা খেয়ে নেই । পলই আমাকে সিগারেট অফার করে। সিগারেট খেতে খেতে বলছিলাম --- পল এবার তোমার ঘর সংসারের কথা কিছু বলো।

পল:  আমার স্ত্রী একজন আইরিশ মেয়ে। সে এখন ডাবলিনে থাকে। বিচ্ছিন্ন জীবন। ওর কাছে আমার একটি সাত বছরের মেয়ে রয়েছে। নাম মিলিশা।

পল মানি ব্যাগ থেকে ওর মেয়ের একটি ছবি বের করে আমাকে দেখায়। ফুটফুটে পরীর মতো দেখতে ওর মেয়ে।
পল আরও একটি সিগারেট ধরিয়ে টানছে। ঢাকার দিক থেকে আসা ট্রেনটি স্টেশনে এসে দাড়ায়। আমরা আবার ট্রেনে যেগে উঠে পড়ি।

ট্রেনটি যখন মৌচাক বনাঞ্চল অতিক্রম করছিল --- দেখি বনারণ্যের গভীরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে পল। আমি পলকে ডাকি --- 'পল ?'
পল:   জ্বী, কোয়েল।
আমি: তুমি তো এখন অনেক নিঃসঙ্গ ! তোমার সময়গুলো কি ভাবে কাটাও ?
পল:  এই তো ধর্ম কর্ম করছি। দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পৃথিবীর পথে পথে একাকী হাটছি। বিভিন্ন উপাসানালয়ে ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ মানুষের সাথে কথা বলি। আমার ধর্মের বাণী অন্য মানুষদের শোনাই। কাল চলে যাবো রেঙ্গুনে। মাতামহ ও মাতামহীর গ্রেবইয়ার্ডে যাব। তাদের জন্য প্রার্থনা করব। ওখানকার বৌদ্ধ উপাসানালয়গুলো ঘুরব। এইত এইভাবেই জীবন চলছে। এই ভাবেই সময় কাটাই।

আামাদের ট্রেনটি দ্রুত গতিতে ঢাকার দিকে ছুটে চলেছে। কখন টঙ্গী চলে এসেছে বুঝতেই পারি নাই। আমি পলকে বললাম--- 'সামনে বিমান বন্দর স্টেশনে আমি নেমে যাব।' আমি পলকে শেষ যে প্রশ্নটা করেছিলাম, তাহলো- ''পল, তুমিত পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছ, কোন দেশে বা কোথায় তোমার মরতে ইচ্ছা করে ? '' আমার এ প্রশ্ন শুনে, পলের মুখটা বিষন্ন হয়ে গেল। চোখ দুটো কেমন যেনো ভারী হয়ে উঠলো।

পল :   তোমাদের ভারতবর্ষের বোম্বে নগরীতে আমি মরতে চাই। ওখানে আমার শৈশব ও ছেলেবেলা কেটেছে। ওখানকার আকাশ বাতাস এখনও আমাকে টানে। আরব সাগরের তীরে ছোট বেলায় আমার হাতধরে বাবা মা কত ঘুরে বেড়াত। আমার মায়ের সমাধিস্থল ঐ শহরেই। ঐ শহর আমাকে ডাকে। মেরিন ড্রাইভ রোডের আমাদের ছোট্ট বাড়ীটার কথাও মনে পড়ে।

ট্রেনটি হুইসেল বাজিয়ে বিমান বন্দর স্টেশনে এসে থেমে যায়। আমি পলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়ি।
বিদায় মুহূর্তে পলকে বলেছিলাম --- তোমার সাথে আমার আর কি কখনও দেখা হবে ? পল বলেছিল--- হয়ত হবে, এই পৃথিবীর কোনো এক পথে। এই রকমই কোনো এক ট্রেনে।


বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৮

হিমালয় কুইন এক্সপ্রেস

৪৩. হিমালয় কুইন এক্সপ্রেস

নব্বই দশকের মাঝামাঝির কথা। হরিয়ানার কালকা শহরেই আমার কাজটা ছিলো।  এল/সি'র শর্ত অনুযায়ী আমদানীকারকের পক্ষে কালকা স্টেশনের কাছেই মালবাহি ট্রেনে গমের শিপমেন্ট পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলাম। স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী গম শিপমেন্ট করছে কিনা এইটাই দেখা ছিলো আমার কাজ।  কলিকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে ক্যামাক স্ট্রীটে রপ্তানীকারকের অফিসে মিঃ পি.কে আগোরওয়ালের চেম্বারে বসে কফি খাচ্ছিলাম। উনি আমাকে বলেছিলেন-' দাদা, কালকাতে যেহেতু যাচ্ছেনই, পারলে ট্রেনে সিমলা থেকে ঘুরে আসবেন। খুব ভালো লাগবে।'
চমৎকার
কালকাতে পাঁচ দিন ছিলাম,ভালোই লেগেছিলো হরিয়ানার এই ছোট শহরটির। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিলো স্বপ্নপুরীর মতো। আমি প্রায় সন্ধ্যায় শিখ উপসানালয় গুলোতে ঘুরতে যেতাম। দেখতাম আর মনে হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অবস্থিত গুরুদ্বুয়ারা নানক সাইয়ের উপসানালয়টির কথা। কালকা স্টেশনের কাছেই হোটেল উইন্ডক্রসে আমি থাকতাম। হাতে দুইদিন সময় ছিলো, ভাবলাম- সিমলাটা না হয় দেখেই আসা যাক। আমি সন্ধ্যায় হোটেল থেকে চেক আউট হই। টিকিট আগেই কাটা ছিলো। রাত দশটা দশ মিনিটে হিমালয়া কুইন এক্সপ্রেস ট্রেনটি কালকা স্টেশন থেকে ছাড়ে। গন্তব্য সাদা তুষারের শহর সিমলা।

সিমলাগামী রাতের ট্রেনে যাত্রী একটু কমই থাকে । আট সিটের একটি কেবিন কম্পার্টমেনট রুমে আমরা যাত্রী মাত্র ছিলাম তিনজন। আমার ঠিক অপোজিট রো'তে একজোড়া শ্বেত চামড়ার দম্পত্তি বসে আছে। কিন্তু তাদের সাথে ঐভাবে কথা বলার সুযোগ নেই।কালকা-সিমলা রেলওয়ে একটি ন্যারোগ্যাজ রেলওয়ে। এটি উত্তর পশ্চিম ভারতের কলকা থেকে সিমলা ভ্রমনের সবচেয়ে পর্বতময় একটি রেলওয়ে। উত্তেজনাপূর্ণ পাহাড়-পর্বত এবং ছবির মতন আশেপাশের গ্রামের জন্য এই রেলওয়ে বিখ্যাত। কিন্তু রাতের জার্নিতে সেই সৌন্দর্য , সেই উত্তেজনাটা পাওয়া যায়না। আর যার কারণেই রাতের এই হিমালয়া কুইনে আজ যাত্রী কম।

ব্রিটিশ ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী সিমলার সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য কলকা-সিমলা রেলওয়ে স্থাপিত হয়। সিমলা হিমাচল প্রদেশের রাজধানী এবং কলকা হরিয়ানা প্রদেশের পাঞ্চকুলা’র একটি শহর। পুরো ট্রেন রাস্তায় দুইধারে দর্শনীয় প্রকৃতি এর চোখ ধাধানো প্রকৃতির মাঝে এই রেললাইন, ভ্রমন পিপাসুদের আকর্ষন করে। ট্রেন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫৬ মিঃ উচুতে অবস্থিত শহর কলকা অতিক্রম করার পরপর ট্রেন পাহাড়ে পাদদেশের প্রবেশ করে এবং এর পরপরই ট্রেনটি পাহাড়ে চড়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।আমি একাকী একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম। কারণ একটু পরপর ট্রেনটি পাহাড়ের সুরঙ্গে প্রবেশ করতে থাকে। বাইরে তখন নিকষ কালো অন্ধকার । মনে হয় যেনো কোনো হরোর পাতালপুরী পাড়ি দিচ্ছি।

এই রুটটি কলকার সিভালিক মালভূমির বিভিন্ন স্থান যেমনঃ ধরমপুর, সোলান, কান্দাঘাট, তারাদেবী, সালগোরা, টটু, সামারহিল এবং সিমলা থেকে হিমালয়ের প্যানোরমিক ভিউ দেখা যায়, যা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন । কিন্তু রাতের আঁধারে আমি কোনো সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছিলামনা। ওপাশে শ্বেত কপোত কপোতীদের বেশ অন্তরঙ্গ অবস্হায় দেখা যাচ্ছিলো। ওদের কোনো হুস নেই যে, আমি একজন এ পাশে বসে আছি। নাইট জার্নির সাথে নাইট রাইডিং ভালোই করছিলো ওরা।

ট্রেনটা একসময় সোলান স্টেশনে এসে থামে। তখন রাত্রি সাড়ে বারোটা হবে। সোলান শহরটি ছোট সিমলা নামে পরিচিত। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি জুন মাসে সোলান শহরে শুলিনি দেবী’র পূজা হয় যার নাম অনুসারে শহরের নাম সোলান হয়েছে । রাতের সোলান স্টেশনটি খুব ভালো লাগছিলো। বোঝাই যাচ্ছিলো দিনের বেলা এই শহরটিকে ছবির মতো লাগতো। আমি স্টেশনের আলো ঝলমল প্লাটফরমের দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখলাম একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা আমার কেবিন কম্পার্টমেন্টে উঠলেন।এবং টিকিটের আসন মিলিয়ে ঠিক আমার সামনের সিটে মুখোমুখি বসে পড়লেন।

ট্রেন সোলান ছেঁড়ে আসে। কিছু দূর যাওয়ার পর ট্রেনটি আর একটি পার্বত্য সুরঙ্গে প্রবেশ করে। চারদিকে মনে হচ্ছে ভূত পেত্নীরা কাউমাউ করছে। এবার আর বেশী ভয় পাচ্ছিলামনা। কারণ আমার সামনে একজন বিগ বিউটিফুল ওমান বসে আছে। ট্রেনের লুকোচুরির আলো আঁধারিতে আমি ঐ মহিলাকে ফাঁকে ফাঁকে দেখছিলাম। ঠিক খারাপ কোনো দৃষ্টিতে নয়, শুধু কৌতূহল- মহিলা দেখতে কেমন ?

মহিলা ডীপ মেকআপ করেছে। মনে হলো মুখের দাগগুলো ঢেকে ফেলেছে ফাউন্ডেশন বেজ মেক আপে। চোখ অনেকটা স্মোকি স্টাইল করা। চোখে আর্টিফিসিয়াল ভ্রু এবং মাসকারা লাগানো। চোখের পাতায় বাদামি কালার হাইলাইট করা। ট্রেনের রাতের আলো আধারীতে ঠোঁটে গাঢ় ভাবে লাগানো পার্পেল কালারের লিপস্টিক চিকচিক করছিলো। মহিলার পরনে ছিলো ঘিয়ে রঙ্গের জর্জেট শাড়ি। স্লিভলেস ব্লাউজ, শাড়ি নাভীর অনেক নীচ পর্যন্ত নামানো। গলায় গোলাপী স্টোনের লকেটের নেকলেস। হাতে তার মুক্তাখচিত ব্রেসলেট। চুল পিছনে ব্যান্ড দিয়ে হালকা করে খোপা বাঁধা ছিলো। শাড়ি ব্লাউজে তাকে দারুণ আবেদনময়ী লাগছিলো। তার শরীরের খোলা অংশগুলোতেও বেজ মেকআপ করে লাবন্যময় করে রেখেছিলো। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো কোথাও কোনো পার্টিতে সে এ্যাটেন করতে গিয়েছিলো ।

উপত্যাকা আর পাহাড়ের পথে পথে ট্রেন চলছে। রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলছে হিমালয়া কুইন এক্সপ্রেস। ওপাশে শ্বেত মেয়েটা লোকটার ঘারের উপড় মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। লোকটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে পাহাড়ের ফাঁকে দিয়ে রাতের আকাশ। আমার চোখে ঘুম নেই। মহিলাও জেগে আছে। আমি ওনার সাথে প্রথম কথা বলতে দ্বিধা করছিলাম, কিন্তু ইচ্ছা করছিলো কথা বলতে। একটু সৌভাগ্যই বলতে হবে, উনিই প্রথম কথা বললো আমার সাথে। (ওনার সাথে কথা হয়েছিলো ইংরেজী আর হিন্দীতে। আমি এখানে বাংলা করে লিখলাম।)

মহিলা :  আপনি কোথা থেকে এসেছেন ?

আমি :  ঢাকা, বাংলাদেশ থেকে।
মহিলা:  কোথায় যাচ্ছেন ?
আমি : এসেছিলাম কালকায় ব্যবসায়িক কাজে, যাচ্ছি সিমলায় ঘুরতে।
মহিলা : ও তাই।
আমি :   এক্সকিউজ মী, আপনার নামটি একটু বলবেন ?
মহিলা :  সায়নী সিং
আমি:    আপনি কোথা থেকে এসেছেন ?
সায়নী :  অমৃতসর, পাঞ্জাব। এখানে এসেছিলাম সোলান, যাচ্ছি সিমলা।

সায়নীর সাথে কথা বলে যেটা জানলাম, সে একজন শিখ ধর্মালম্বী। স্বামীর সাথে আন অফিসিয়ালী সেপারেশন চলছে। সে একটি বহুজাতিক কোম্পানীর আঞ্চলিক বিপনন ব্যবস্থাপক। সে অফিসিয়াল কাজেই সোলান এসেছিলো, এবং যাচ্ছে সিমলায়। ট্রেন চলছে, কখনো আঁকাবাঁকা পাহাড়ের গা ঘেসে, কখনো বিভিন্ন সেতু অতিক্রম করছে, কখনো বিভিন্ন সুরঙ্গ পাড়ি দিচ্ছে। ট্রেনটি তারাদেবী স্টেশনে চলে আসে। তখন সম্ভবতঃ রাত্রি তিনটা বাজে। দশ মিনিট দাড়িয়েছিলো ট্রেনটি। তারপর ট্রেন আবার চলতেে থাকে। কথা বলতে বলতে আমি সায়নীর বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। মনে হলো উনি খুব মিশুক। কথা আর গল্পে গল্পে সময়টা ভালোই কাটছিলো। সায়নী আমাকে বলেছিলো - 'তুমি কি সিঙ্গেল ?' আমি বলেছিলাম- 'না। আমি নতুন বিবাহিত।'

সায়নীর চোখে ঘুম নেই। দেখলাম সে একটি হার্ড ড্রীংসের বোতল বের করেছে। গ্লাসে ঢেলে তা সে পান করতে থাকে। ড্রীংস সে আমাকেও ওফার করে। আমি খেতে চাইনা, আমি বলি- আই এ্যাম নট হ্যাবিচুয়েটেড ইট।' কিন্তু সায়নী অনেকটা সম্মোহনের জাল তৈরী করে ফেলে। আমি ঠিক পুরোপুরী সজ্ঞানে নয়, সম্মোহিত হয়েই সুরা পান করি, সায়নী একটু  বেশীই খাওয়াছিলো মনে হয় আমাকে। কখন সালগোরা আর টুটু স্টেশন দুটি পার হয়ে গিয়েছিলো আমি জানি নাই।

ট্রেনটি যখন সিমলা পৌঁছে, তখন সায়নী আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। ঘড়িতে চেয়ে দেখি সকাল সাতটা বাজে। আমি দিনের আলোয় চোখ মেলে দেখি সায়নীকে। আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম সায়নীকে দেখে। এই সেই রাতের আবেদনময়ী সায়নী ? যে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো, যে আমার স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিলো। এই তার চেহেরা ! মুখের এবং শরীরের বলিরেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখের নীচে কালচে দাগ। এক বিধ্ধস্ত বিগত যৌবনা বয়স্কা রমণী সে। ফল্স ব্রান্ড অন্তর্বাস পড়া। বয়স তার ষাট বাষট্রি হবে।

সায়নী, তার ব্যাগ ব্যাগেজ গুছিয়ে নেমে গেলো। যাবার বেলায় হ্যান্ডশেক করে বলে গেলো- 'তুমি সত্যিই  খুব ভালো ছেলে। তোমাকে আমার মনে থাকবে। আবার দেখা হবে কোনোদিন।'


৪৪.    কে সেই জন

আমরা তিনজনই সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। তিনজনই খুব ভালো বন্ধূ ছিলাম, আমি,গিয়াস এবং রিমি। কলাবাগানে একটি টিনসেড বাড়ীর একটি রুম ভাড়া নিয়ে আমি আর গিয়াস থাকতাম। রিমি থাকতো জিগাতলা মোড়ে ওর খালার বাসায়। ক্লাসে আরো ছেলেমেয়ে ছিলো, তাদের সাথে বন্ধুত্ব হলোনা, বন্ধু হলাম আমরা তিনজন, রিমি, গিয়াস আর আমি।

রিমি যেদিন ক্লাশে আসতোনা সেদিন খুব মন খারাপ লাগতো। ক্লাশ করতেও মন চাইতো না। এক দুই ক্লাশ করে চলে যেতাম বাসায়। শুয়ে থাকতাম বিছানায়। তারপর চোখে ঘুম আসতো এবং ঘুমিয়ে যেতাম। যখন ঘূম ভাঙ্গতো তখন দেখতাম সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গিয়াস ততোক্ষণে চলে আসতো এবং বলতো - 'তুই কি রিমির জন্য মন খারাপ করে থাকিস ?'
আমি :  হে।
গিয়াস :  তুই কি রিমিকে ভালোবাসিস ?
আমি :  না।
গিয়াস : দুপুরে কিছু খেয়েছিলি ?
আমি : না ।
গিয়াস :  চল কালা চাঁদের হোটেলে যেয়ে কিছু খেয়ে আসি।
আমি :  চল্।

সেদিন একাউন্টিং ক্লাশের স্যার আসেন নাই। আমরা তিনজনেই মিরপুর রোডের 'চিরোকী'তে বসে আ্ড্ডা দেই। আমাদের তিনজনের মধ্যে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিলো। অনেক গল্প করেছিলাম তিনজনে। না বলা অনেক কথাও হয়েছিলো আমাদের মধ্যে। বলেছিলাম- কলেজ পড়া শেষ হলে কে কোথায় চলে যাবো,  কে কোথায় পড়বো ?  কে কখন বিয়ে করবো, আরো অনেক কথা।  তিনজনে কথা বলতে বলতে কখন ক্লাশ আওয়ার ওভার হয়ে গিয়ছিলো আমরা জানি নাই।

বিকালে পড়ার টেবিলে বসে মার্কেটিংএর  নোট খাতার ভিতর কি সব হিবিজিবি লিখছিলাম-

তুমি কি শুধুই বন্ধু হওয়ার জন্য এসেছিলে ! তুমি শুধু সহপাঠি নও আমার,
তুমি কাকে ভালোবাসো আমি জানিনা,
আমি পূর্ব মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে কেবল কালো মেঘ
আমি উত্তরের মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে,
আমি তোমাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতে চাইনা,
তবুও আমার দু'চোখ মুদে ঘুম আসে-
ঘুমেও নয়, স্বপ্নেও নয় হঠাৎই মনে হয় আমি তোমাকে
কাছে টেনে বলছি- ভালোবাসি।

ওপাশে তাকিয়ে দেখি গিয়াস ওর পড়ার টেবিলে  বসে কি যেনো লিখছে। আমি ওকে বলি-  'কি লিখছিস ?' গিয়াস বলে- 'কবিতা লিখছি।' আমি বলি- 'তুই আবার কবি হলি কবে ?' গিয়াস উত্তর দেয় - 'এমনি হিবিজিবি কিছু লিখছিলাম।' আমি বলি- 'পড়ে শোনা।' ও তখন আমাকে পড়ে শোনায়-

আমার থেকে হাজার ক্রোশ দূরে তুমি বসে আছো
শুনতে কি পাও ভালোবাসার মর্মরধ্বনি ?
লক্ষ যোজন দূরে থেকে বুঝতে কি পারো
আমার হৃৎ কম্পনের কথা ?
নির্জন নিরালায় তুমি আমার গান হয়ে ওঠো
শ্বেতকমলে তোমার পরশখানি জেগে ওঠে-
এখনো দূর হতে কোনো কোমল সিম্ফনি ভেসে আসে
এখনো তোমার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে।

আরেকদিন কলেজে যেয়ে হঠাৎ শুনতে পাই আজ কোনো ক্লাশ হবেনা।  কি যেনো এক দাবীতে শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। মন খুব একটা খারাপ হলোনা। বলাকা সিনেমা হলে চলছিলো 'সূর্যকন্যা'।  আমরা তিনজন টিকিট কেটে সাড়ে বারোটার শো'তে হলে ঢুকে পড়ি। সারা সিনেমা চলাকালীন সময়ে রিমি আমার এক হাত ধরে থেকেছিলো। ওর আরেক হাত ধরেছিলো গিয়াসের হাত।  সিনেমা শেষে আমরা তিনজন নিউ মার্কেটের ভিতরে লিবার্টি খাবার হোটেলে যেয়ে ভাত খেতে বসি। রিমি গুনগুন করে আস্তে আস্তে আমাদের কানের কাছে সুর্যকন্যার এই গানটি গাচ্ছিলো-

আমি যে আধারে বন্দিনী আমারে আলোতে ডেকে নাও
স্বপন ছায়াতে চঞ্চলা আমারে পৃথিবীর কাছে নাও.
শ্রাবণ ঘন এই আকাশ কালো তৃষিত হৃদয় মোর জ্বেলেছে আলো
এবার আমায় বাসিবে ভাল প্রিয় তুমি কথা দাও কথা দাও।

মাঝে মাঝে নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করি, রিমি কাকে ভালোবাসে ? আমাকে না গিয়াসকে ? না অন্য কাউকে ? তার কোনো হিসাব মিলাতে পারিনা।শুধু এইটুকুই জানি, আমি রিমিকে ভালোবাসি, তা কেউ জানেনা।

দেখতে দেখতে কখন আমাদের সব সিলেবাস শেষ হয়ে গেলো, দেখতে দেখতে আমাদের শেষ ক্লাশটিও হয়ে গেলো। এবং একসময় ফাইনাল পরীক্ষাও হয়ে যায়। এই ভাবেই আমাদের কলেজ পাঠ পর্ব শেষ হয়ে যায়। সেদিন চলছিলো আমাদের কলেজে একে অপরের বিদায় পর্বের দিন। দেখলাম রিমি একটা নীল রঙ্গের শাড়ি পড়ে কলেজে এসেছে। এর আগে ও কখনো শাড়ি পড়ে কলেজে আসে নাই। আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ শাড়ি পড়া। খুব ভালো লাগছিলো ওকে নীল শাড়ীতে। সহপাঠীদদের সাথে অনেক সুখের কথা হলো, অনেক প্রাণের কথা হলো। অনেক স্মৃতিচারণ হলো। তারপর আমরা তিনজন হাটতে হাটতে চলে যাই ধানমন্ডি লেকের ধারে।

লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর তিনজন বসে আছি। লেকের জল তখন নিরব স্থির হয়ে আছে। ঝিরিঝিরি কোনো বাতাস নেই। জলের উপর ছোটো ছোটো কোনো ঢেউ নেই। কড়ই,জারুল, কৃষ্ণচূড়া গাছে দু'একটি পাখী করুণ সুরে ডাকছিলো। বিকেলের সূর্য গাছের আড়ালে চলে গেছে। আলোছায়ায় অনেকটা মন খারাপ করেই আমরা বসে আছি। কে কি বলবো যেনো আমাদের কোনো ভাষা নেই। তারপরেও বললাম রিমিকে-  কবে বাড়ী যাচ্ছো ?

রিমি :  কালকেই। তোমরা কবে যাচ্ছো ?
আমি :  আগামী মাসের এক তারিখে। রুম ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ করেছি।
গিয়াস : একই তারিখে আমিও যাচ্ছি।
রিমি :  তোমরা ভুলে যেওনা আমাকে।
আমি:  তুমিও ভুলে যেওনা। চিঠি লিখবে।
গিয়াস: আমিও ভুলবো না। চিঠি লিখো।

রিমি চলে গেছে ওর দেশের বাড়ী বাগেরহাট। আমি আর গিয়াস এক তারিখেই রুম ছেড়ে দিয়ে যার যার মতো দেশের বাড়ী চলে যাই। গিয়াস চলে যায় পটুয়াখালীতে, আর আমি চলে আসি সিরাজগঞ্জে।

বাড়ীতে যেয়ে মনটা উড়ো উড়ো লাগছিলো। কারো সাথে ঠিক মতো মন খুলে কথা বলতে পারছিলাম না। এমনিতেই একাকী যেয়ে নদীর কূলে বসে থাকতাম। নয়তো মাঠের আলপথ দিয়ে ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে হাটতাম। মনের মধ্যে কি এক ভ্রান্তি ঢুকেছিলো যে, তা কাউকে প্রকাশ করতে পারছিলাম না। নির্জন প্রান্তরের অশ্বথ গাছের তলে বসে ভাবতাম আর অনুশোচনা করতাম, আমিতো রিমিকে ভালোবেসেছিলাম। এই কথা কেনোদিন তাকে আমি বলি নাই।  যে কথা বলি নাই তা নিয়ে এখন কেনো অনুশোচনা করছি ?

সেদিন ছিলো হাটবার।আমাদের ছোনগাছা হাটে সেদিন মেলাও ছিলো। মেলায় উৎসবের আমেজ। বাঁশের বাঁশি বাজছে। চারদিকে ঢাকের শব্দ, কাঁসার শব্দ। নাগরদোলার চড়কি ঘুরছে। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে কালি সন্ধ্যা হয়েছে। আমি একপাশে দাড়িয়ে নাগরদোলার ঘূর্ণি দেখছিলাম।  পোস্ট অফিসের পিয়ন আমাকে দেখে একটি চিঠি দেয়। প্রেরকের জায়গায় লেখা- রিমি, বাগেরহাট। আমি মেলার মধ্যে অন্ধকারে চিঠিটি আর খুললাম না।

রাতে বাড়ীতে এসে হেরিকেনের আলোয় চিঠিটি খুলে পড়তে থাকি-

'প্রিয় বন্ধু আমার, তোমরা দু'জনই আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলে। তোমাদের দু'জনকেই আমি খুব ভালোবাসতাম।বাড়ীতে এসে তোমাদের জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে ? কই, কখনো বলোনিতো - 'তোমাকে ভালোবাসি।' আমাকে যে বলেছে -'ভালোবাসি', তার সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের তারিখ : ১৪ ই ফাল্গুন, ১৩৯০ বাং । তোমাকে নিমন্ত্রণ দিলাম। চলে এসো। ইতি- রিমি।'

রিমি আর গিয়াসের বিয়েতে আমি আর যাই নাই। তারপর আর কোনো যোগাযোগ করিনি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেই। সরকারী চাকুরীও পেয়ে যাই। ইতোমধ্যে দশ বছর চলে গেছে। একবার একটি সরকারী কাজে গিয়েছিলাম- পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। কাজের ফাঁকে একদিন কুয়াকাটা বিচে বেড়াতে যাই। সাগরপাড় এতো জমজমাট তখন ছিলোনা । একদম বিরাণ বালুকাবেলা ছিলো। তখন সূর্যাস্তের সময়। সাগর তীরে একাকী হাটছিলাম, আর সূর্যাস্ত অবলোকন করছিলাম- হঠাৎ ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ির এক লোক আমার কাছে এগিয়ে আসে। চিনতে অসুবিধা হলোনা। এ যে সেই গিয়াস !

কাছেই লতাচাপালী গ্রামে গিয়াস থাকে। ও এখানকার এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আমাকে জোর করে ওর বাড়ীতে নিয়ে যায়। বাড়ীতে আমি তখন খুঁজতে থাকি রিমিকে। কিন্তু কোথাও রিমিকে দেখতে পেলাম না। তখন গিয়াসকে জিজ্ঞাসা করি- 'রিমি কোথায় ?'  গিয়াস আমার কথা শুনে বিস্মিত হয়। এবং বলে - 'তুই রিমিকে বিয়ে করিস নাই ? ' আমি বলি - 'না।'
গিয়াস তখন ওর স্টীলের ট্রাংক খুলে রিমির একটা চিঠি বের করে আমাকে দেখায়-  সেই একই চিঠি, একই ভাষা, এবং একই তারিখ, যা রিমি আমাকেও লিখেছিলো ।



৪৫.          কে সেই জন

আমরা তিনজনই সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। তিনজনই খুব ভালো বন্ধূ ছিলাম, আমি,গিয়াস এবং রিমি। কলাবাগানে একটি টিনসেড বাড়ীর একটি রুম ভাড়া নিয়ে আমি আর গিয়াস থাকতাম। রিমি থাকতো জিগাতলা মোড়ে ওর খালার বাসায়। ক্লাসে আরো ছেলেমেয়ে ছিলো, তাদের সাথে বন্ধুত্ব হলোনা, বন্ধু হলাম আমরা তিনজন, রিমি, গিয়াস আর আমি।

রিমি যেদিন ক্লাশে আসতোনা সেদিন খুব মন খারাপ লাগতো। ক্লাশ করতেও মন চাইতো না। এক দুই ক্লাশ করে চলে যেতাম বাসায়। শুয়ে থাকতাম বিছানায়। তারপর চোখে ঘুম আসতো এবং ঘুমিয়ে যেতাম। যখন ঘূম ভাঙ্গতো তখন দেখতাম সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গিয়াস ততোক্ষণে চলে আসতো এবং বলতো - 'তুই কি রিমির জন্য মন খারাপ করে থাকিস ?'
আমি :  হে।
গিয়াস :  তুই কি রিমিকে ভালোবাসিস ?
আমি :  না।
গিয়াস : দুপুরে কিছু খেয়েছিলি ?
আমি : না ।
গিয়াস :  চল কালা চাঁদের হোটেলে যেয়ে কিছু খেয়ে আসি।
আমি :  চল্।

সেদিন একাউন্টিং ক্লাশের স্যার আসেন নাই। আমরা তিনজনেই মিরপুর রোডের 'চিরোকী'তে বসে আ্ড্ডা দেই। আমাদের তিনজনের মধ্যে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিলো। অনেক গল্প করেছিলাম তিনজনে। না বলা অনেক কথাও হয়েছিলো আমাদের মধ্যে। বলেছিলাম- কলেজ পড়া শেষ হলে কে কোথায় চলে যাবো,  কে কোথায় পড়বো ?  কে কখন বিয়ে করবো, আরো অনেক কথা।  তিনজনে কথা বলতে বলতে কখন ক্লাশ আওয়ার ওভার হয়ে গিয়ছিলো আমরা জানি নাই।

বিকালে পড়ার টেবিলে বসে মার্কেটিংএর  নোট খাতার ভিতর কি সব হিবিজিবি লিখছিলাম-

তুমি কি শুধুই বন্ধু হওয়ার জন্য এসেছিলে ! তুমি শুধু সহপাঠি নও আমার,
তুমি কাকে ভালোবাসো আমি জানিনা,
আমি পূর্ব মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে কেবল কালো মেঘ
আমি উত্তরের মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে,
আমি তোমাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতে চাইনা,
তবুও আমার দু'চোখ মুদে ঘুম আসে-
ঘুমেও নয়, স্বপ্নেও নয় হঠাৎই মনে হয় আমি তোমাকে
কাছে টেনে বলছি- ভালোবাসি।

ওপাশে তাকিয়ে দেখি গিয়াস ওর পড়ার টেবিলে  বসে কি যেনো লিখছে। আমি ওকে বলি-  'কি লিখছিস ?' গিয়াস বলে- 'কবিতা লিখছি।' আমি বলি- 'তুই আবার কবি হলি কবে ?' গিয়াস উত্তর দেয় - 'এমনি হিবিজিবি কিছু লিখছিলাম।' আমি বলি- 'পড়ে শোনা।' ও তখন আমাকে পড়ে শোনায়-

আমার থেকে হাজার ক্রোশ দূরে তুমি বসে আছো
শুনতে কি পাও ভালোবাসার মর্মরধ্বনি ?
লক্ষ যোজন দূরে থেকে বুঝতে কি পারো
আমার হৃৎ কম্পনের কথা ?
নির্জন নিরালায় তুমি আমার গান হয়ে ওঠো
শ্বেতকমলে তোমার পরশখানি জেগে ওঠে-
এখনো দূর হতে কোনো কোমল সিম্ফনি ভেসে আসে
এখনো তোমার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে।

আরেকদিন কলেজে যেয়ে হঠাৎ শুনতে পাই আজ কোনো ক্লাশ হবেনা।  কি যেনো এক দাবীতে শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। মন খুব একটা খারাপ হলোনা। বলাকা সিনেমা হলে চলছিলো 'সূর্যকন্যা'।  আমরা তিনজন টিকিট কেটে সাড়ে বারোটার শো'তে হলে ঢুকে পড়ি। সারা সিনেমা চলাকালীন সময়ে রিমি আমার এক হাত ধরে থেকেছিলো। ওর আরেক হাত ধরেছিলো গিয়াসের হাত।  সিনেমা শেষে আমরা তিনজন নিউ মার্কেটের ভিতরে লিবার্টি খাবার হোটেলে যেয়ে ভাত খেতে বসি। রিমি গুনগুন করে আস্তে আস্তে আমাদের কানের কাছে সুর্যকন্যার এই গানটি গাচ্ছিলো-

আমি যে আধারে বন্দিনী আমারে আলোতে ডেকে নাও
স্বপন ছায়াতে চঞ্চলা আমারে পৃথিবীর কাছে নাও.
শ্রাবণ ঘন এই আকাশ কালো তৃষিত হৃদয় মোর জ্বেলেছে আলো
এবার আমায় বাসিবে ভাল প্রিয় তুমি কথা দাও কথা দাও।

মাঝে মাঝে নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করি, রিমি কাকে ভালোবাসে ? আমাকে না গিয়াসকে ? না অন্য কাউকে ? তার কোনো হিসাব মিলাতে পারিনা।শুধু এইটুকুই জানি, আমি রিমিকে ভালোবাসি, তা কেউ জানেনা।

দেখতে দেখতে কখন আমাদের সব সিলেবাস শেষ হয়ে গেলো, দেখতে দেখতে আমাদের শেষ ক্লাশটিও হয়ে গেলো। এবং একসময় ফাইনাল পরীক্ষাও হয়ে যায়। এই ভাবেই আমাদের কলেজ পাঠ পর্ব শেষ হয়ে যায়। সেদিন চলছিলো আমাদের কলেজে একে অপরের বিদায় পর্বের দিন। দেখলাম রিমি একটা নীল রঙ্গের শাড়ি পড়ে কলেজে এসেছে। এর আগে ও কখনো শাড়ি পড়ে কলেজে আসে নাই। আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ শাড়ি পড়া। খুব ভালো লাগছিলো ওকে নীল শাড়ীতে। সহপাঠীদদের সাথে অনেক সুখের কথা হলো, অনেক প্রাণের কথা হলো। অনেক স্মৃতিচারণ হলো। তারপর আমরা তিনজন হাটতে হাটতে চলে যাই ধানমন্ডি লেকের ধারে।

লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর তিনজন বসে আছি। লেকের জল তখন নিরব স্থির হয়ে আছে। ঝিরিঝিরি কোনো বাতাস নেই। জলের উপর ছোটো ছোটো কোনো ঢেউ নেই। কড়ই,জারুল, কৃষ্ণচূড়া গাছে দু'একটি পাখী করুণ সুরে ডাকছিলো। বিকেলের সূর্য গাছের আড়ালে চলে গেছে। আলোছায়ায় অনেকটা মন খারাপ করেই আমরা বসে আছি। কে কি বলবো যেনো আমাদের কোনো ভাষা নেই। তারপরেও বললাম রিমিকে-  কবে বাড়ী যাচ্ছো ?

রিমি :  কালকেই। তোমরা কবে যাচ্ছো ?
আমি :  আগামী মাসের এক তারিখে। রুম ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ করেছি।
গিয়াস : একই তারিখে আমিও যাচ্ছি।
রিমি :  তোমরা ভুলে যেওনা আমাকে।
আমি:  তুমিও ভুলে যেওনা। চিঠি লিখবে।
গিয়াস: আমিও ভুলবো না। চিঠি লিখো।

রিমি চলে গেছে ওর দেশের বাড়ী বাগেরহাট। আমি আর গিয়াস এক তারিখেই রুম ছেড়ে দিয়ে যার যার মতো দেশের বাড়ী চলে যাই। গিয়াস চলে যায় পটুয়াখালীতে, আর আমি চলে আসি সিরাজগঞ্জে।

বাড়ীতে যেয়ে মনটা উড়ো উড়ো লাগছিলো। কারো সাথে ঠিক মতো মন খুলে কথা বলতে পারছিলাম না। এমনিতেই একাকী যেয়ে নদীর কূলে বসে থাকতাম। নয়তো মাঠের আলপথ দিয়ে ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে হাটতাম। মনের মধ্যে কি এক ভ্রান্তি ঢুকেছিলো যে, তা কাউকে প্রকাশ করতে পারছিলাম না। নির্জন প্রান্তরের অশ্বথ গাছের তলে বসে ভাবতাম আর অনুশোচনা করতাম, আমিতো রিমিকে ভালোবেসেছিলাম। এই কথা কেনোদিন তাকে আমি বলি নাই।  যে কথা বলি নাই তা নিয়ে এখন কেনো অনুশোচনা করছি ?

সেদিন ছিলো হাটবার।আমাদের ছোনগাছা হাটে সেদিন মেলাও ছিলো। মেলায় উৎসবের আমেজ। বাঁশের বাঁশি বাজছে। চারদিকে ঢাকের শব্দ, কাঁসার শব্দ। নাগরদোলার চড়কি ঘুরছে। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে কালি সন্ধ্যা হয়েছে। আমি একপাশে দাড়িয়ে নাগরদোলার ঘূর্ণি দেখছিলাম।  পোস্ট অফিসের পিয়ন আমাকে দেখে একটি চিঠি দেয়। প্রেরকের জায়গায় লেখা- রিমি, বাগেরহাট। আমি মেলার মধ্যে অন্ধকারে চিঠিটি আর খুললাম না।

রাতে বাড়ীতে এসে হেরিকেনের আলোয় চিঠিটি খুলে পড়তে থাকি-

'প্রিয় বন্ধু আমার, তোমরা দু'জনই আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলে। তোমাদের দু'জনকেই আমি খুব ভালোবাসতাম।বাড়ীতে এসে তোমাদের জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে ? কই, কখনো বলোনিতো - 'তোমাকে ভালোবাসি।' আমাকে যে বলেছে -'ভালোবাসি', তার সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের তারিখ : ১৪ ই ফাল্গুন, ১৩৯০ বাং । তোমাকে নিমন্ত্রণ দিলাম। চলে এসো। ইতি- রিমি।'

রিমি আর গিয়াসের বিয়েতে আমি আর যাই নাই। তারপর আর কোনো যোগাযোগ করিনি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেই। সরকারী চাকুরীও পেয়ে যাই। ইতোমধ্যে দশ বছর চলে গেছে। একবার একটি সরকারী কাজে গিয়েছিলাম- পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। কাজের ফাঁকে একদিন কুয়াকাটা বিচে বেড়াতে যাই। সাগরপাড় এতো জমজমাট তখন ছিলোনা । একদম বিরাণ বালুকাবেলা ছিলো। তখন সূর্যাস্তের সময়। সাগর তীরে একাকী হাটছিলাম, আর সূর্যাস্ত অবলোকন করছিলাম- হঠাৎ ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ির এক লোক আমার কাছে এগিয়ে আসে। চিনতে অসুবিধা হলোনা। এ যে সেই গিয়াস !

কাছেই লতাচাপালী গ্রামে গিয়াস থাকে। ও এখানকার এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আমাকে জোর করে ওর বাড়ীতে নিয়ে যায়। বাড়ীতে আমি তখন খুঁজতে থাকি রিমিকে। কিন্তু কোথাও রিমিকে দেখতে পেলাম না। তখন গিয়াসকে জিজ্ঞাসা করি- 'রিমি কোথায় ?'  গিয়াস আমার কথা শুনে বিস্মিত হয়। এবং বলে - 'তুই রিমিকে বিয়ে করিস নাই ? ' আমি বলি - 'না।'
গিয়াস তখন ওর স্টীলের ট্রাংক খুলে রিমির একটা চিঠি বের করে আমাকে দেখায়-  সেই একই চিঠি, একই ভাষা, এবং একই তারিখ, যা রিমি আমাকেও লিখেছিলো ।

৪৬.     বৃষ্টিমঙ্গল

আমি তখন বাগবাটী স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র। আষাঢ় মাস শুরু হয়েছে। কিন্তু নদী নালায় তখনো বন্যার পানি ঢোকে নাই। সেদিন স্কুলে ক্লাস শেষে বাড়ী ফিরবো কিন্তু হঠাৎ আকাশ জুড়ে মেঘ দেখা দেয় এবং বৃষ্টি নামা শুরু হয়। সবাই বৃষ্টি থেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমি আর তা করলাম না। বইগুলো প্লাস্টিকের কাগজে পেঁচিয়ে নেই। ধূলির রাস্তা একটু বৃষ্টি হলেই কাঁদা হয়ে যেতো। কাঁদায় স্যান্ডেল পড়ে হাটা যেতো না। আমি একহাতে বই আরেক হাতে স্যান্ডেল নিয়ে আড়াই মাইল পথ কাঁদায় হেটে এবং বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ী ফিরি। মা প্রথমেই তার শাড়ীর আঁচল দিয়ে আমার মাথা মুছে দেয়। কিন্তু মাথা মুছে্ দিলে কি হবে, রাতে ঠিকই ভীষণ জ্বর এসে গিয়েছিলো।

একবার বাবার সাথে শহর থেকে হেটে বাড়ী ফিরছিলাম। শৈলাভিটা খেয়াঘাট পার হওয়ার পর থেকেই মুশলধারে বৃষ্টি শরু হয়ে যায়। পথ চলতে যেয়ে বাবা তার হাতের ছাতা আমার দিকে ঝুঁকে রাখে। আমি যেনো ভিজে না যাই। কিন্তু আমি বার বার ছাতার বাইরে এসে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকি। সেদিন সারা রাস্তা বাবার ছাতার নীচে এমনি লুকোচুরি খেলে ভিজতে ভিজতে বাড়ী ফিরে এসেছিলাম।

তখখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। কবি জসিম উদ্দীন হলে থাকি। সেদিন সারাদিন বৈশাখের তপ্ত গরম ছিলো। রাতে সামান্য গুরি গুরি বৃষ্টি হচ্ছিলো। ঠিক ঐ রকম নয়, দু'এক ফোঁটা ফোঁটা। একটু শীতল হওয়ার জন্য সে রাতে সারারাত আমি আর আমার এক বন্ধু হলের ছাদে শুয়ে থেকেছিলাম।

ঢাকার দক্ষিণখানের বাড়ীতে তখন আমি একা থাকি। বর্ষার দিনে সন্ধ্যার পর অফিস থেকে যখন বাড়ী ফিরতাম, তখন প্রায়ই বৃষ্টির জন্য প্রা্র্থনা করতাম। এয়ারপোর্ট বাস স্ট্যান্ডে নামার পর যেদিন বৃষ্টি পেতাম, সেদিন আমার মনের স্ফূর্তি বেড়ে যেতো। আমি সারা পথ একাকী ভিজতে ভিজতে ঘরে চলে যেতাম।একা থাকার কারনে কেউ দেখতে পেতোনা আমার শরীরের ভেজা কাপড়।

সবে মাত্র বিয়ে করেছি তখন। একদিন সন্ধ্যার পর আমরা দুজন শেরেবাংলা নগর মামার বাসা থেকে রিক্সায় করে মিরপুরে আমার বোনের বাসায় যাচ্ছিলাম। আবহাওয়া অফিসের কাছে যেতে না যেতেই মেঘ শুরু গম্ভীর করে বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। আকাশ ভেঙ্গে বূষ্টি শুরু হয়ে যায়। বউ রিক্সার হুট উঠিয়ে দিতে চায়। আমি বাঁধা দেই। আমরা দুইজন কাক ভেজার মতো ভিজে চুপসেে যাই। সেদিন মিরপুর পর্যন্ত সারা রাস্তা ভিজে ভিজে চলে গিয়েছিলাম। আমার বালিকা বধূ প্রথম সেদিন বুঝতে পেরেছিলো- একটা পাগল তার কপালে জুটেছে।

ফুয়েন্টসোলিং ভূটানের একটি ছোট্ট শহর। একে একটি বাজারও বলা যেতে পারে। ভারতের জলপাইগুরির জয়গাঁও সীমা্ন্ত লাগোয়া এই শহরটি অবস্থিত। ভারত থেকে সড়কপথে ভূটানে যাবার অন্যতম এটি একটি প্রবেশ দূয়ার । এই ফুয়েন্টসোলিং এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে শিলিগুরি থেকে আমি আর আমার স্ত্রী ট্যাক্সিতে জয়গাঁঁও যাচ্ছিলাম। আমরা যখন ডুয়ার্স অতিক্রম করি তখন থেকেই মুশুলধারে বূষ্টি শুরূ হয়ে যায়। জলপাইগুরির চা বাগানের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা টিলা পথে আমাদের ট্যাক্সি জয়গাঁওয়ের দিকে চলতে থাকে। গাড়ীর উইন্ড গ্লাস বৃষ্টির জলে ঘোলা হয়ে আসছিলো। চা বাগাানের ভিতর দিয়ে বৃষ্টিমুখর সেই দিনের পথচলা স্বর্গীয় মনে হয়েছিলো । কি যে ভালো লেগেছিলো সেই ক্ষণ। মনে হয়েছিলো এই পথ যেন কোনোদিন শেষ না হয়। কিন্তু-

'গীতিময় সেইদিন চিরদিন বুঝি আর হলো না
মরমে রাঙ্গা পাখি উড়ে সে গেলো নাকি
সে কথা জানা হলো না.....
চোখের ভাষাতে আজকে না হয়
মনের কথা বলো না।'


৪৭.          পদ্মাবতী

আমি আর আমার স্ত্রী  ২০০৯ সালে ডুয়ার্সের অরণ্য দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের শিলিগুরির বন্ধু শিশির রায় বলেছিল, এসেছই যখন, এক ফাঁকে তোমরা কোচবিহারের রাজবাড়ীটাও দেখে নিও, ভালো লাগবে। শিলিগুরির এনজে জংশন থেকে একদিন আমরা কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেসে কোচবিহার চলে যাই। ছিমছাম সুন্দর শহরটির ইলোরা হোটেলে আমরা উঠি। ভখন বিকাল হয়ে গিয়েছে। সেদিন আর রাজবাড়ী দেখতে যাইনা। সন্ধ্যায় রি্ক্সায় শহরটিতে একটু ঘরিয়ে। তারপর মদনমোহন মন্দির দেখতে যাই। সেখানে কৃষ্ণ মূর্তির পাশে বসে অনেকক্ষণ আমরা কীর্তন শুনেছিলাম।

রাতে ক্যাফেতেই খেয়ে নেই। খেয়ে হোটেল রুমে বসে আমরা গল্প করছিলাম।সে সময়ে হোটেল এ্যাটেন্ডেন্ট  রুমে প্রবেশ করে। ও বলছিলো আমাদের সুবিধা অসুবিধার কথা। ওর নাম কৃষ্ণ কুমার। মধ্য বয়সী অসমীয়া লোক।শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে। বাড়ী আসামের ডিব্রুগড়ে। কথায় বুঝতে পারলাম.লোকটা খুবই পরোপকারী এবং ভদ্র। আমরা ওর কাছ থেকেই জানার চেষ্টা করি রাজবাড়ীর কথা। এই রাজবাড়ী সম্পর্কে বলতে গিয়েই কৃষ্ণ কুমার আমাদের একটি কাহিনী শোনায়েছিলো। ও শুনেছিলো নাকি ওর পিতামহের কাছ থেকে, আর পিতামহ শুনেছিলো তারও পিতামহের কাছে। অনেকটা কিংবদন্তীই বলা যায়। শুনুন এবার সেই কাহিনী।

১৬২১ সালে রাজা দীননারায়ণ কোচবিহারের সিংহাসনে বসেন। রাজা ছিলেন প্রবৃত্তির বশবর্তী। তাঁর চরিত্রে ছিল লাম্পট্যের আধিপত্য। যদিও তিনি সংগীতপ্রেমিক  ও সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন, কিন্তু নিজের রাজত্বের বহু উচ্চবংশীয় নারীকে তিনি হরণ করে নিয়ে যেতেন, এবং তাঁদের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হতেন।

চিকনা পাহাড়ের পাদদেশের নিরিবিলি টিলা বেষ্টিত একটি লোকালয়। পাশেই খরস্রোতা কালজানি নদী। এই নৈসর্গিক উপত্যাকার একটি গ্রামে থাকতেন এক পন্ডিত মশায়। আশে পাশের ছেলেরা এসে এই পন্ডিতের কাছে লেখাপড়া করত। পন্ডিত মশাইয়ের একটি ষোড়সী মেয়ে ছিল নাম পদ্মাবতী। উদ্ভাসিত নব যৌবনা, টানা টানা পিঙ্গল চোখ, মাথা ভর্তি কালো চুল, মৃগনাভি,চিকন কোমড়, প্রসারিত বক্ষরাজি, তোর্সা নদীর বাঁকের মতো তার উরু। একদিন রাজা দীন নারায়ন তার সঙ্গী নিয়ে ঘোড়ায় চরে উপত্যাকার ঐ পথে যাচ্ছিলো।পদ্মাবতী তখন কালজানি নদীতে স্নানরত। রাজা দীন নারায়ন সেই দৃশ্য দেখে ফেলে। সে তখন সঙ্গীদের প্রাসাদে পাঠিয়ে দেয়। লম্পট দীন নারায়ন পদ্মাবতীর সাথে প্রথম তার পৈশাচিক নিবৃত্তি চরিতার্থ করে এই কালজানি নদীর উপকূলে।

এরপর কালজানির নদীর কালো জল অনেক গড়িয়েছে। রাজা দীন নারায়ন এই উপত্যাকায় এসেছে বার বার। একসময় পদ্মাবতী গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এ কথা লোক সমাজের কেঊ জানতোনা। সন্তান জন্ম দেয়ার দুইতিন মাস আগে পদ্মাবতী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পাশের পরগনা দেওহাটায় ওর এক মাসি থাকতো। সেখানেই পদ্মাবতী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। নাম রাখে ইলা। এই ইলাকে নিঃসন্তান মাসীর কাছে রেখে তার গ্রামে আবার ফিরে আসে। ইলা থেকে যায় মানুষের লোক চক্ষুর আড়ালে।

 কিছু দিন পর রাজা দীন নারায়ন পদ্মাবতীকে বিয়ে করে। তাকে রানীর মর্যাদা দিলেও রাজার লাম্পট্য থেমে থাকেনি। এভাবেই কেটে যায় পদ্মাবতীর ষোলোটি বছর। এদিকে ইলা পদ্মাবতীর মাসীর ঘরেই বড়ো হতে থাকে। ইতোমধ্যে সেই মাসীর মৃত্যু হয়। পদ্মাবতী ইলার পরিচয় গোপন রেখে রাজাকে বলে ইলাকে রাজ প্রাসাদে নিয়ে আসে।কিন্তু রাজা জানেনা ইলা তারই ঔরসজাত কন্যা।

ইলা অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে ছিলো। রাজকুমারী হয়েও সে রাজকুমারী নয়। প্রাসাদে তার মর্যাদা অনেকটা বাঈজীদের মতো। ইলা সুন্দর গান গাইতে পারতো, সুন্দর নাচতে পারতো। ওর রূপ পদ্মাবতীর রূপকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। রাজা দীন নারায়নের কুনজরে পড়ে ইলা। রানী পদ্মাবতী এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে আশংকা বোধ করতে থাকে।

শরতের এক বিকেলে রাজা দীন নারায়ন কালজানি নদীতে অনেকটা জোড় করেই ইলাকে নিয়ে বজরায় নৌ বিহারে যায়।পদ্মাবতী রাজার কুউদ্দেশ্য বুঝতে পারে। বজরাটি অপরূপ সাজে সাজানো হয়েছিলো। গানের বাদ্যয্ন্ত্র ও নাচের নুপুর, ঘুঙ্গুরও নেয়া হয়েছিলো। ইলার পরনে ছিলো মুক্তাখচিত জয়পুরী চোলী। ইলা সেদিনের সেই বিকেলে রাজা দীন নারায়নকে সব দুঃখের গানগুলি শোনায়েছিলো। নেচেছেও রাজার সামনে একাকী। তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বজরার অন্দরমহলে একসময় ইলার সব গান থেমে যায়। নুপুরের শব্দ আর শোনা যায়না। তখন সূর্য অস্তমিত হয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বক আর গাংচিলরা পাখা ঝাপটে দুর অরণ্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে। জলের উপরে ছোটো ছোট পাখীদের কিচির মিচির গানগুলো কান্নার শব্দের মতো মনে হচ্ছেছিলো। খরস্রোতা কালজানির জল যেনো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।

তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে। বজরা এসে ঘাটে ভেড়ে। মাঝি মাল্লারা পাটাতন ফেলে দেয় কূলে। রাজা দীন নারায়ন নেমে আসে। ইচ্ছাকৃতই হবে হয়তো, নামতে যেয়ে ইলা পা ফসকে অন্ধকারে নদীর গভীরে পড়ে যায়। শুধু টুপ করে একটা শব্দই শোনা গেলো। মুহূর্তেই ইলা জলের তলে হারিয়ে গেলো।

পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার নীচ দিয়ে হেটে হেটে রাজা দীন নারায়ন একাকী প্রাসাদে ফিরে আসে। মুখে তার মগ্ন বিষাদ। নিঃশব্দে শোবার ঘরে ঢুকতেই সে দেখতে পায় রানী পদ্মাবতী ফাঁসিতে আত্মহত্যা করেছে।

__________________________________________________

ডিসক্লেমেয়ার:   এই কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা যাছাই করা হয় নাই। এটি কৃষ্ণ কুমারের বলা একটি কল্প কাহিনীও হতে পারে।


৪৮.          তারে খুঁজে বেড়াই

এই গোলকে ঘুরতে ঘুরতে কতোজনের সাথেই তো দেখা হয়ে যায়। পথ চলতে চলতে পথের উপরে কিংবা কফি হাউসে গরম চা চুমক দিতে দিতে। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় কবি জসিম উদদীন হলে। আমার রুমমেটের কাছে তিন দিনের অতিথী হয়ে সে এসেছিলো। চিত্রালীতে প্রকাশিত 'সেই চোখ' কবিতাটি পড়ে সে আমার ভক্ত হয়ে যায়। অদ্ভূূত এক বন্ধু বৎসল চুম্বক শক্তি ছিলো তার। তাইতো তিনদিনেই সে আমার প্রাণের কাছে ঠাঁই করে নিয়েছিলো।

তারপর অনেক বছর দেখা নেই। ভুলেই গিয়েছিলাম সেই স্বল্প সময়ের বন্ধুটিকে। এক সন্ধ্যায় ফার্মগেট বাস স্ট্যান্ডে আমি দাড়িয়ে আছি। পাবলিক বাসে আসবো এয়ারপোর্টে। হঠাৎ আলো আধারীতে  সেই বন্ধুটি  আমার কাছে এগিয়ে আসে। যার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো জসিম উদ্দীন হলে। সেও যাবে এয়ারপোর্ট বাস স্ট্যান্ডে। পরে জানলাম আমার এলাকা দক্ষিনখানে একটি মেসে সে ভাড়া থাকে।

সে সময় আমার কর্মহীন জীবন চলছিলো। নতূন বিয়ে করেছি। হঠাৎ সেই বেকারত্ব জীবনে এই বন্ধুটি আমার সকাল বিকালের সাথী হয়ে যায়। প্রায় তিন মাস ঢাকা শহরের কতো পথে পথে একসাথে ঘুরেছি তার কোনো শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর,  লাইব্রেরী চত্বর, পাবলিক লাইব্রেরী, যাদুঘর প্রাঙ্গন, ধানমন্ডি লেকের পার, পুরানো ঢাকায়,পথের উপর টং চা'র দোকান, কতো জায়গায় যে দু'জন ঘুরে বেড়িয়েছি, আর সময় কাটিয়েছি।

একবার সদরঘাটের প্লাটফরমের রেলিং এ দাড়িয়ে দু'জন বুড়িগঙ্গার জল দেখছিলাম, কতো লঞ্চ এসে ভিড়ছে প্লাটফরমে। কতো মানুষ জীবিকার জন্য আসছে ঢাকা শহরে। মনটা কেমন উদাস লাগছিলো। জীবনের প্রতি হতাশার কথা বলছিলাম ওকে। সে তখন আমার ঘাারের উপর হাত রেখে বলেছিলো- Never give up easily in life, success is right around the corner.

ওর এক কাজিন ছিলো একটি বেসরকারী ব্যাংকের পরিচালক। নিজে ভালো কিছু করতোনা। তরপরেও তার কাজিনকে বলে ব্যাংকে ভালো একটি চাকুরী আমাকে পাইয়ে দেয়। এরপর থেকে আমি চাকুরীতে ব্যস্ত হয়ে যাই। আগের মতো তার সাথে আড্ডা বা ঘোরাঘুরি করা সম্ভব হতোনা। এর কিছুদিন পর দক্ষিনখানের মেস ছেড়ে  কলাবাগানের একটি মেসে সে চলে আসে।

এরপর মাঝে মাঝেই সুযোগ সময় পেলে কলাবাগানের  মেসে যেয়ে ওর সাথে আমি দেখা করতাম। একবার প্রায় ছয় মাস, ওর সাথে আমার দেখা করা হয়নাই। পরে যখন যাই, যেয়ে দেখি কলাবাগানের ঐ মেস ছেড়ে সে অন্যত্র চলে গেছে। মেসমেটরাও বলতে পারেনি সে কোথায় গিয়েছে।

এই পৃথিবীর পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে কতোজনের সাথেইতো মানুষের দেখা হয়। যে পথগুলো দিয়ে আমি ঘুরেছি, সে পথের উপর দিয়ে আকাশ ছিলো, কিন্ত সে পথে তার দেখা পাই নাই। কতো শূণ্য প্রান্তরের মধ্য দিয়ে একাকী দৌড়ে দৌড়ে হেটেছি কিন্তু কোথাও আমার সে বন্ধুটি ছিলোনা। এখন ফেসবুক,গুগল, টুয়েটারেও  সার্চ দিয়ে দেখেছি, সেখানেও তার খোঁজ পাওয়া যায় নাই।

মানুষ ঘুরতে ঘুরতে নাকি চাঁদ হয়ে যায়, যেখানেই থাক, পৃথিবীর যে কোনো কোণকে নাকি সে আলোকিত করে রাখে। আমিও আমার সেই বন্ধুটির আলোর দ্যূতি গায়ে মাখি। আমার জীবনের এক ক্রান্তিকালে যে উপকার সে করেছিলো, তার ঋণ আমি শোধ করতে পারি নাই। সেই ঋণ শোধ করার জন্য আমি এখনো এই ঢাকা শহরের পথে পথে তাকে খুঁজে বেড়াই।

ওর ঠিকানা আমার পুরোপুরি জানা নেই। গ্রামের নামও মনে নেই। শুধু পোস্ট অফিস ও থানার নামটি মনে আছে। মোঃ শফিকুল ইসলাম, পোঃ ভিটঘর, থানা- নবীনগর, জেলা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কেউ একটু খুঁজে দেখবেন কি ?


৪৯.    অঝোর ধারায় বৃষ্টি

আলেয়া নামের সেই মেয়েটি এই ঢাকা শহরেই থাকে জানা ছিলোনা । আর জানার জন্য ঐরকম আগ্রহ কখনো হয়নি ।তবে ওকে যে মনে পড়তোনা,তা নয়। কখনো যদি অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে, আর সে সময়টা যদি দুপুরের হয়, তখন আলেয়ার কথা মনে পড়ে।

আলেয়ার সাথে সম্পর্ক কিংবা জানাশোনা ছিলো মাত্র পঁচিশ ত্রিশ দিনের। আমরা তখন ভাড়া থাকতাম পুরানো ঢাকায় দীননাথ সেন লেনের একটি বাসায়।ঠিক পাশের বাসাটা ছিলো আলেয়ার বড়ো বোনের ।তারাও ভাড়া থাকতো। আর এখানেই বেড়াতে এসেছিলো আলেয়া। ঠিক বেড়াতেও নয়,ছেলে দেখাতে নিয়ে এসেছিলো ওকে। আর এখান থেকেই ওর বিয়ে হয়ে যায়।

তখন ঢাকাতে 'আলো তুমি আলেয়া' সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে। মরহুম ফতেহ লোহানী একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে এই ছবিতে অভিনয় করেছিলো। সেদিন রূপমহল সিনেমা হলে ম্যাটিনী শো 'আলো তুমি আলেয়া' ছবিটি দেখে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছিলাম।দেখি দুই বাসার গলিমুখে আলেয়া দাড়িয়ে। এর আগেই ওর সাথে পরিচয় ও কথা হয়েছে। ও আমাকে দেখে একটু হাসি মুখ করে । বাসায় ঢোকার সময় আমি ওকে বলি- 'আলো তুমি আলেয়া'।

এর পরেও ওর সাথে আমার দেখা হয়, কথা হয়।মেয়েটি দেখতে ভালোই। মফস্বলের সরলতা ছিলো ওর চোখে মুখে।  কিন্তু ওর সাথে  প্রেম করবো,এই ভাবনা কখনো ভাবিনি। আমি তখন কেবল ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।বিয়ে সাদির কথা মুখে আনলে সোজা বাড়ী থেকে আমাকে পিটাতো।

আলেয়ার সাথে আরো কয়েকবার কথা হয়েছে।আমার কাছে মনে হয়েছে, সে আমাকে ভালোবাসতে চায়। ওকেও যে ভালোবাসা যায়, সেই রকমই একটি মেয়ে আলেয়াও । সুচন্দার মতো টানাটানা চোখ, স্লিম বডি,লম্বা কালো চুল, শ্যামবর্ণ গায়ের রং। আমারও মনে হতো, ওর সাথে একটু প্রেম করি। দূরে কোথাও পালিয়ে নিয়ে যেয়ে ওকে বিয়ে করি। কিন্তু তা আমি নিজেকে করতে দিলামনা।

ইতোমধ্যে আলেয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। যেদিন বিয়ে  হবে তার তিনদিন আগের ঘটনা। সেদিন ছিলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সময়টা ছিলো দুপুর। রুমের মধ্যে একাকী ছোট জানালার পাশে দাড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিলাম। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। বাড়ীর সামনে গলিটি জলে ভেসে গেছে। বৃষ্টির সাথে শীলাও পড়ছিলো। এবং সাথে মেঘ গুরু গম্ভীর বজ্রপাত।আমার রুমটা ছিলো পুরানো জীর্ণ। দেয়ালে পলেস্তারা খসে গেছে। মেঘ বৃষ্টির কারণে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। রুমটা অন্ধকারোচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বাইরে তখনো মুষুলধারে বৃষ্টি। হঠাৎ রুমের মধ্যে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আলো আঁধারিতে দেখতে পাই,আলেয়া।

আলেয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা লুকিয়ে কাঁদতে থাকে, এবং বলতে থাকে- তুমি এই বিয়ে ভেঙ্গে দাও। আমাকে তুমি এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও।' আমি কোনো কথা বলিনি।এটা আমার কাপুরুষতাও নয়। আমিতো আলেয়াকে কখনোই ভালোবাসিনি। ওকে আমি কখনোই বলিনি ভালাবাসি।

তখনো আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছে। আলেয়া আমার বুকে জড়িয়ে। মানুষ মাঝে মাঝে প্রকৃতির অংশ হয়ে যায়। মানুষ একাকার হয়ে যায় বৃষ্টি,নদী,সাগর, জ্যোৎস্নার রাত কিংবা পাহাড়ী নির্জন অরণ্যের মতো প্রকৃতিগুলোর মাঝে। প্রকৃতি তার অসীম শক্তি দিয়ে মানুযকে কাছে টেনে নেয়, আর মানুষও তখন প্রকৃতির মাঝে একাকার হয়ে যায়। ধারণ করে স্বর্গীয় রূপের যা মর্তলোকের জীবন আচরণের সাথে কোনো মিল নেই। আলেয়ার চোখের জল ততোক্ষণে শুকিয়ে গেছে।বৃষ্টিও থেমে গেছে।

আলেয়ার ঐ ছেলের সাথেই বিয়ে হয়ে যায় এবং স্বামীর ঘরে চলে যায়। দু'তিন মাস পরে দীননাথ সেন লেনের বাসা ছেড়ে আমরা আজিমপুর কোয়ার্টারে চলে আসি। এরপর আলেয়ার সাথে কিংবা ওদের পরিবারের কারো সাথে আমাদের দেখা নেই।

 ঠিক নয় বছর পর,একদিন নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানের সামনে আলেয়ার দেখা পাই। একটি আট বছরের ছেলের হাত ধরে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই একে অপরকে চিনে ফেলি। দু'জনের চোখে মুখে বিস্ময় এবং বিষন্নতা মুহূর্তেই ফুটে উঠে। সবচেয়ে বেশী বিস্মীত হই ওর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে। আমার চাহনী থেমে যায় ছেলেটার মুখের উপর। আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। শরীরের সমস্ত রক্ত হঠাৎ তরঙ্গায়িত হয়ে হিম শীতল হয়ে গেলো।ঐ রকম বয়সে আমাকে দেখতে ওর মতোই লাগতো। আলেয়া বেশী ক্ষণ দেরী করেনি। ছেলের হাত ধরে চলে যেতে উদ্যত হয়। ছেলেটিকে খুব আদর করতে ইচ্ছা হলো। ওর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করি- বাবু তোমার নাম কি ? ছেলেটি ওর যে নামটি বলেছিলো- সেটি আমারই নাম।


৫০.       মাধবী এসেই বলে যাই

রফিক আজাদের কবিতার পংতির মতো --- 'মাধবী এসেই বলে যাই'। আমি বলি কোথায় যাবে ? সে বলে, 'কোথায় নিয়ে যাবে ?' আজ আমরা বংশী নদীর পারে যাবো। ওখানে নদীর জল দেখব, নৌকা দেখব।গাছের ছায়ায় বসে থাকব। মাধবী বলে --- 'এই কাঠপোড়া রোদ্রের দুপুরে যাবে বংশী নদীর পারে ! আমার খিদে লেগেছে। আগে খাওয়াও, তারপর যাব।' আমরা নীলক্ষেতের ভাই ভাই হোটেলে কাচকি মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে নেই। তারপর চাঁন খাঁর পুল থেকে লোকাল বাসে উঠে সোজা চলে আসি সাভার বাজারে ।

বাস স্টান্ডের অদূরে দেখি গাঁধা টানা একটি ছোট টমটম দাড়িয়ে আছে। কোচোয়ানকে বলি, তোমার টমটম কি যাবে ?
কোচোয়ান:  কোথায় যাবেন স্যার ?
আমি:  রাজা হরিশচন্দ্রের বাড়ী।
কোচোয়ান:  আমি চিনিনা।
আমি:  ( মাধবীকে দেখিয়ে ) ওকে চেনো ?
কোচোয়ান:  না
আমি:  উনি হচ্ছে রাজা হরিশচন্দ্রের বড়ো মেয়ে। নাম: রাজকুমারী অনুদা ।
মাধবী:  তুুমি আমাদের বংশী নদীর তীরে নিয়ে চলো।
কোচোয়ান:  চলেন।

টমটম চলছে। মনে হচ্ছে এ যেন সাম্ভার নগরী। বারশত বছর আগে লাল পোড়ামাটির পথ ধরে আমরা চলছি বংশী নদীর তীরে। টমটমের মুখোমুখি আমি আর মাধবী বসে আছি। মাধবীকে রাজকুমারী অনুদার মতোই লাগছিল। চুল হাওয়ায় উড়ছে। রোদ্র এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে। ওড়না গলা থেকে দুই দিক থেকে বুুকের উপর দিয়ে সাপের মতো নীচে নেমে পড়েছে। ওকে খুব রোমান্টিক লাগছিল।

আমাদের টমটম এসে থামে বংশী নদীর তীরে।কোচোয়ানকে বললাম ---- তুমি ঐ বটবৃক্ষ তলায় যেয়ে অপেক্ষা কর। আমরা ফিরব দুই ঘন্টা পর।
কোচোয়ান:  স্যার, হরিশচন্দ্রের বাড়ী যাইবেন না।
আমি:  যাবো। বংশী নদীর হাওয়া খেয়ে আসি, তারপর যাবো।
কোচোয়ান:  হুজুর আপনার পরিচয়টা একটু দিবেন।
আমি : আমার নাম গোপীনাথ। আমি ময়নামতির মহারানীর পুত্র। রাজা হরিশচন্দ্রের হবু জামাতা।
কোচোয়ান:  জ্বী,আচ্ছা।

তখন বিকেলের রোদ। বংশী নদীর কূল ধরে আমরা হেটে হেটে চলে যাই আরো সামনের দিকে। নদীর তীরে একটি জারুল গাছের নীচে দুজন ঘাসের উপর বসে পড়ি। হেমন্তের বংশী নদী। নদীর জল অর্ধেক হয়ে আছে। দু'একটা নৌকা এলোমলো ভাবে চলছে। একটু পর পর বংশী নদীর শীতল হাওয়া আমাদের শরীরে এসে লাগছিল। চারদিকে জন মানবহীন। কেমন সুনসান নিরবতা ।
মাধবী:  আমার ভয় লাগছে।
আমি:  তাহলে চলে যাবে ?
মাধবী:  না। যাবো না।
আমি:  কেন যাবে না ?
মাধবী:  ভালো লাগছে।

নদীর কূল থেকে একটু দূরে একটি পরিত্যক্ত নাট মন্দির দেখতে পাই। আমরা আস্তে আস্তে ঐ নাট মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাই। দু'জন সন্তর্পণে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে পড়ি। ভিতরে ঢুকে মন্দির দেখে বিস্মিত হই। কি অদ্ভূত কারুকার্যখচিত মন্দির। দেখি ভিতরে রাজা হরিশচন্দ্র ও রানী কর্ণবতী প্রার্থনায় রত। পাশে একজন পুরোহিত জপমালা জপছে। একটু পর রাজা রানীর প্রার্থনা শেষ হয়। পিছনে মুখ ফিরিয়েই তারা আমাদের দেখতেে পায়।
রানী:  মা অনুদা তুমি এসেছো।
রাজা:  বাবা গোপীনাথ তুমি এসেছো।
রাজা হরিশচন্দ্র পুরোহিতকে কহিলেন --- এদের ধর্ম ও ভগবান মতে বিবাহের ব্যবস্থা করো। পুরোহিত তাই করিলেন।

মন্দিরের সাথেই স্বর্ণকূটিেরের মতো একটি ছোট কক্ষে আমাদের প্রবেশ করানো হলো। রানী মা কহিলেন --- তোমরা এখানে বিশ্রাম নাও। এই বলে রানী মা কক্ষের দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে চলে গেলেন। আমরা দুজন পালঙ্কের উপর যেয়ে বসলাম।
আমি :   অনুদা, প্রিয়সী আমার --- এই ক্ষণ কেমন লাগছে ?
অনুদা:  জ্বী জাহাপনা, এই ক্ষণটির জন্য এতকাল অপেক্ষায় ছিলাম।
আমি:  এসো আরো কাছে এসো।
অনুদা:  জ্বী, আসছি।
আমি:  এই ক্ষণ শুধু তোমার আমার !

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারদিকে কেমন যেন অন্ধকার। সবকিছুই অপরিচীত লাগছে। চেয়ে দেখি --- আমি আর মাধবী জীর্ণ এই নাট মন্দিরের মেঝেতে পাশাপাশি শুয়ে আছি। বাইরে থেকে কোচোয়ান ব্যাটা ডাকছে ---- 'হুজুর ! হূজুর ! গোপীনাথ স্যার ! আর কতক্ষণ দেরী হইবে ? যাইবেন না !'


৫১.    কাজল রেখা

আজ আমার এই চিলকোঠার ছোট্ট ঘরে কাজলের বউ হয়ে আসার কথা ছিলো। সজ্জায় বিছিয়ে রাখার কথা ছিলো ফুলের পাঁপড়ি। জ্বালাতে চেয়েছিলো ঘরে আলো। এসব আজ কোনো কিছুই হলোনা। আমি ঘরকে আঁধার করে একাকী বসে আছি। কোনো আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করছেনা। সিগারেটের ধূয়ায় রুমটা অন্ধকারে ভরে গেছে।

 কাজল রেখা। আমি ডাকতাম ওকে কাজল বলে। ওর বাবা মা ডাকতো রেখা। ঢাকা শহরের এই জনারণ্যে পথ চলতে চলতেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। পথের মানুষ পথেই যেন প্রিয় মানুষের দেখা পেয়ে গেলাম। এক বৃষ্টি  ঝুমঝুম সন্ধ্যায় দাড়িয়েছিলাম গুলিস্তান বাস স্টান্ডে রাস্তার উপরে। বৃষ্টিতে ভিজতেছিলো আমার মাথার চুল। পাশে দাড়ানো মেয়েটা ওর ছাতাটা এগিয়ে দিয়েছিলো আমার মাথায় উপর। রাস্তার উপরে এই প্রথম কোনো মেয়ের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়া, প্রথম কোনো মায়া দিয়েছিলো একজন অপরিচীতা। সে এই কাজল।

মতিঝিল এরিয়ায় কাজল একটি চাকুরী করতো। আমারও চাকুরীস্হল ছিলো মতিঝিলেই।আমি অস্থায়ী ছোটো একটি চাকুরী করি,বেতন ভাতা নগন্য। কাজলের সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো। কোনো কোনো দিন রাস্তার উপর হোটেলে বসে আমরা লাঞ্চ করতাম। কোনো কোনো দিন পাউরুটী কলা, কোনো কোনো দিন নোনতা বিস্কুট আর চা খেতাম।

এই ভাবেই চলতে চলতে দু'জন দু'জনার প্রতি মায়ায় বেঁধে যাই। দু'জন দু'জনকে ভালোবেসে যাই। জগৎ সংসারে কোনো পাওয়াই মনে হয় মসৃন হয়না। কাজল যখন আমার কথা বলেছিলো ওর মা বাবার কাছে, তখন তারা বলেছিলো 'না'। এ ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হবেনা। আমার মতো চালচুলোহীন ছেলের কাছে কোনো বাবা মা তার আদরের মেয়েকে তুলে দিতে চায় ?  কেমন যেনো মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো এ জীবনে কাজলকে আমি আর পাবোনা। যাকে এতো আপন করে কাছে টানতে চাইলাম ,সে তাহলে দূরেই থাকবে।

গতকাল আমরা দুজনই লাঞ্চের পর আর অফিসে যাইনা। একটি রিক্সা নিয়ে বলদা গার্ডেনে চলে যাই। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল হয়েছে। আমরা দু'জন ঝাউবনের পাশে সবুজ ঘাসের উপর যেয়ে বসি। জারুল আর মহুয়াবনে পাখীরা তখন কিচির মিচির করছিলো। কথা বলছি দু'জনে, ভালোবাসছি দু'জনে। যেনো ' বাতাসের কথা সে তো কথা নয় রূপ কথা ঝরে তার বাঁশিতে আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই যেন দুটি আঁখি ভরে রাখে হাসিতে।'  কেনো জানি ভানু চক্রবর্তীর কবিতার এই চরণটি আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো- 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি।' গার্ডেনের সবুজ ঘাসে বসেই দু'জন সিদ্ধান্ত নেই. আগামীকালই আমরা কোর্ট ম্যারেজ করবো।

সন্ধ্যার পাখীরা সব কলোরব করে উঠলো। বাগানের সব ফুল যেনো ফুটে উঠতে লাগলো। সুবাস ছড়িয়ে পড়তে থাকলো চারদিকে। মৃদুমন্দ বাতাস বইতে লাগলো। কাজল কখন আমার হাত ধরেছিলো,খেয়াল নেই। সন্ধ্যার আলো আধারীতে ওর আনত মুখখানি একবার দেখলাম। জগতের সমস্ত সুখের আভা যেনো ছড়িয়ে আছে ওর চোখে মুখে। 'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হারিয়ে. মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। তব ভুবনে তব ভবনে. মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।' গার্ডেন থেকে আমরা বেরিয়ে আসি । কাজল রিক্সায় উঠে বক্সীবাজারে ওদের বাসার দিকে চলে যায়। যাবার বেলায় বলে যায়- কাল তোমার চিলেকোঠায় বউ হয়ে আসছি।
 
চিলেকোঠায় ফিরে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে ভাবছিলাম- এই ছোট্র ঘরে কাল কাজল আসবে। আমার চুলো জ্বালাবে। সন্ধ্যাবাতি জ্বালাবে ঘরে। ছোট সংসার হবে। ঘরবাড়ী গোছাবে লক্ষ্মী ঐ মেয়ে। যে স্বপ্ন দেখেছিলাম,তারুণ্যের প্রথম প্রহরে, তা যেনো কালকেই পূরণ হতে যাচ্ছে। আমার মন প্রাণ উল্লসিত হয়ে উঠলো।

হঠাৎ দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ শুনতে পাই। দরজা খুলে দেখি- একটি অপরিচিত লোক দাড়িয়ে। উনি বলছিলো- আমি হাসপাতাল থেকে এসেছি।কাজল নামে একটি মেয়ে আমাকে পাঠিয়েছে। উনি রোড এক্সিডেন্টে আহত হয়ে জরুরী বিভাগে আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রক্ত দরকার।'

আমি ্দ্রুত হাসপাতালে চলে যাই। হাসপাতালের জরুরী বিভাগের কোরিডোরের সামনে আমি দাড়ানো। ডাক্তারকে বলি- কাজল এখন কেমন আছে ? 
ডাক্তার : আপনি ওনার কি হন ?
আমি :   আমি ওর কিছু হইনা।
ডাক্তার :  ও আচ্ছা।
আমি:  ওর সাথে আমি কি একটু কথা বলতে পারবো ?
ডাক্তার :  উনি এখন জীবনেও নেই, মরনেও নেই। আপনি ভিতরে যান। দেখেন আপনার সাথে উনি কথা বলে কি না ?

কাজল আমার সাথে কথা বলেনি। রুম হতে বের হতেই দেখি- এক পৌঢ় ও একজন বয়স্কা মহিলা বাইরে দাড়ানো। কাজলের বাবা মা হবে হয়তো। তারা কাঁদছে। হাসপাতালের কোরিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে আমি রাস্তায় চলে আসি। যে জনারণ্যে একদিন কাজলকে খুঁজে পেয়েছিলাম, সেই জনারণ্যেই আমি হারিয়ে গেলাম।

মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৮

সে আসেনি

 ২৯.  সে  আসেনি

মেয়েটি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল বাংলা একাডেমির গোল পুকুরপাড়ে। ফাল্গুনের সেই বিকেলে বইমেলায় আগত দর্শনার্থীদের কোলাহলে মুখর ছিল প্রাঙ্গণ। কেউ একজন মেয়েটিকে বলেছিল -- 'এসো তুমি আজ,আমিও আসব। দেখা হবে এই পুকুর পাড়ে।' মেয়েটি ভেবেছিল ফাগুন সন্ধ্যা নামবে তাদের চোখের দিকে চেয়ে থেকে। ফুসকাওয়ালার দোকান থেকে পানি ফুসকা খাবে। তারপর দুজনে মিলে খুঁজতে বের হবে শামসুর রাহমানের 'প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' কবিতার বইটি কিনতে। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল ছেলেটি আর এলনা।

মেয়েটি ভাবছিল মানুষ এমন হয় কেন? কথা দিয়ে কথা রাখেনা। তার সাথে এই ছলটুকু না করলে কী হতনা তার? সত্যিকারের ভালবাসা কখনও এমন মিথ্যা করে কথা বলেনা। চারপাশে কত ছেলেমেয়ে এখানে ঘুরছে। আমতলায় বসেছে যেন গল্প আর আড্ডার আসর। কেউ কেউ খাবার দোকানে বসে খাবার খাচ্ছে। গরম কফি কাপে দিচ্ছে চুমুুক।

মেয়েটি পড়ে এসেছিল আজ নীল রঙের শাড়ি। কানে পড়েছিল জয়পুরী ইমিটেশনের দুল। হাতের নোখে মেখেছিল শাড়ির রঙে মিলিয়ে নেইল পালিশ। হাতের কাঁচের চুড়িগুলো তখনও রিনঝিন করছিল। সন্ধ্যার ফাগুন বাতাসে উড়ছিল মাথার চুল। মেয়েটি ভাবছিল, চোখের সুরমা তার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। খোঁপায় বাঁধা বেলীফুলগুলো কখন একটি একটি করে ঝরে পড়েছে। তার এই সাজগোজ নিরর্থক হয়ে গেল। শরীরের ভিতরে বয়ে যাওয়া ঘ্রাণগুলো প্রাঙ্গণের ধূলি বাতাসে মিলিয়ে গেল।

মেয়েটি বাড়িতে ফিরে যায়। রাতে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়তে বসে। অনাহুতভাবে বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকে। মা এসে একবার জিজ্ঞেসা করে --
'  তোমার কী আজ মন খারাপ?' মেয়েটি মাথা নেড়ে বলে --- 'না।' রাতে সে আর কিছু খেলনা। শুয়ে পড়ে বিছানায়। ওর চোখে ঘুম আসেনা। অন্ধকারে চেয়ে দেখে একটি আবছা মুখকে। যে বলেছিল আজ আসবে, কিন্তু সে আসেনি।



৩০.    লিলিয়ান অর্কিড

শিলিগুড়ি থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের উপত্যকার খাঁজে এক রমণীয় শৈল শহর হচ্ছে মংপু। এইখানেই মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ‘জন্মদিন’ কবিতাটি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মংপুতে কাটানোর দিনগুলি নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবী রচনা করেছিলেন ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’।

মৈত্রেয়ী দেবীর এই বইটি পড়েই আমার মংপু দেখবার সাধ হয়েছিল। আমার ভিতরে লক্ষ্যহীন একটি বাউন্ডুলে স্বভাব ছিল। ঘুড়ে বেড়াতে ইচ্ছা করত দেশ থেকে দেশান্তরে। এমনি এক উদাসীন মনের টানে অনেক বছর আগে এক সেপ্টেম্বরে আমি মংপুতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। শিলিগুড়ি থেকে জীপে করে পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে মংপুতে যেয়ে পৌঁছেছিলাম দুপুরের পরেই ।

মংপুতে উঠেছিলাম শহর  থেকে দূরে কালিঝোরা নদীর পাশে তিনচুলেতে নিরিবিলি এক ছোট্ট প্রাইভেট বাংলোতে। এখানে সূর্যালোকে ক্ষণে ক্ষণে সাজবদল করে। খুব কাছেই মহানন্দা অভয়ারণ্য। সনসেরিদাঁড়া ভিউপয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অন্যান্য নয়নাভিরাম তুষারশৃঙ্গ দেখা যায়। আমি বাংলাতে একটু রেস্ট নিয়ে প্রথমেই রবীন্দ্র স্মারক ভবন দেখতে চলে যাই। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সদনটি। এখানে কবিগুরুর অনেক স্মৃতি চিহ্ন দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।

শাল, সেগুন, অর্জুনে ছাওয়া পাহাড় থেকে নেমেছে কালিঝোরা। সেই ঝোরার নামেই জায়গার নাম। পাশে বয়ে চলেছে তিস্তা। এই রকমই এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশে আকন্ঠ বুঁদ হয়ে ছিলাম সেদিনের সেই পাহাড়ি অরণ্য সন্ধ্যায়। মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম এই লাইনগুলো- ‘‘পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে,
শূন্যে আর ধরাতলে,
মন বাঁধে ছন্দে আর মিলে।
বনেরে করায় স্নান শরতের সোনালী।
মাঝখানে আমি আছি, চৌদিকে আকাশ তাই নিঃশব্দে দিতেছে করতালিতে।
আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ।'এই অনিন্দ্য সুন্দর মংপু।

আমি যে বাংলোতে ছিলাম সেটি ছিল সিঙ্গেল কটেজের মত একটি বাড়ি। কালিঝরার পাহাড়ি ঢালে অবস্থিত হওয়ায়, এখান থেকে নদী, পাহাড়, উপত্যকা আর নীল আকাশ একসাথে দেখা যেত। কটেজের কেয়ারটেকার ছিল মধ্যবয়সী এক নেপালি, নাম ছিল অমল থাপা। ওর একটি গুণ ছিল, সে পুরোদস্তুর বাংলা ও হিন্দি বলতে পারত। প্রয়োজনীয় ইংরেজিও বলত সুন্দর করে। সে বাংলো থেকে সামান্য দূরে পাহাড়ের ঢালে  স্ত্রী সন্তান নিয়ে আলাদা একটি বাড়িতে থাকত।

আমি এখানে দুইরাত থাকার জন্য বুকিং দেই। যে দুইদিন থাকব, আমার খাবারের ব্যবস্থা অমলই করে দেবে। দেখলাম, অমল ওর বাসা থেকে খাবার রেঁধে টিফিন বাটিতে করে তা এনে রেখেছে। আমি সন্ধ্যা রাতেই খেয়ে নেই। অমল আমাকে খাওয়ায়ে রেখে চলে যেতে চায়।
আমি ওকে বলি --- 'আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।'  সে তখন একটি রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল --- 'ভয় নেই বাবু এখানে। জ্বীন,পরী, ভূত আসবেনা।' এই কথা বলে অমল চলে গেল।

সন্ধ্যায় কুন্ডলী পাকিয়ে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকতে দেখেছিলাম মেঘ। তারপর দেখেছিলাম এই অরণ্যে রাত নামতে। আমি বারান্দায় বসে একাকী রাতের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি।  অদ্ভুত এক অনুভূতি জেগেছিল তখন। এইরকম কাঠের বাড়ী, এই রকম পরিবেশ, এইরকম সৌন্দর্য শুধু সিনেমাতেই দেখেছিলাম। বাস্তবে তা অনুভব করতে পেরে অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম। বাইরে তাপমাত্রা তখন পাঁচ। কেমন যেন জমাট ঠাণ্ডা লাগছিল। হঠাৎ ঘরের বাইরে কিসের যেন খচ খচ শব্দ শুনতে পাই। ভয় হল খুব। এই জনবসতি বিরল আদিম সৌন্দর্যের রাতে, এখানে আবার কে এলো? আমি দ্রুত ঘরের মধ্যে চলে যাই। ভিতরে যেয়ে কান পেতে থাকি, কিন্তু সেই শব্দটি আর শুনতে পেলাম না।

ঘরের মধ্যে অসীম নিস্তব্ধতা। বাইরে নিঝুম রাত্রির পাহাড়। বনারণ্যে বুঁনো পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। কেমন যেন গা ছমছম করছিল। বুক হিম হয়ে আসছিল প্রচন্ডভাবে । এমন জনমানবহীন জনারণ্যে একাকী কোনো মনুষ্য বসবাস করে? একবার মনে হল কেন মরতে এলাম এখানে। আবার পরক্ষনেই মনে হল, ঘরহীন ৰোহেমিয়ানদের জীবনের জন্য এত মায়া করা ঠিক নয়।

রাত দ্রুত বেড়েই চলছে। রুমের ভিতরে বাতি নিভাতে ভয় পাচ্ছিলাম।  একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে কাঁচের জানালা দিয়ে দেখ্ছিলাম, বাইরের মংপু। এমন অদ্ভুত আঁধার নামে আকাশের গায়ে! পাহাড়ের ফাঁকে যে আকাশটুকু দেখা যায়, তা ধূসর মেঘে ঢাকা। সেখানে চাঁদও নেই, তারাও নেই।

আমি জানালার কাছ থেকে সরে বিছানার উপর এসে বসি। দূরে বনে বাঁদারে পাখিদের কোনো ডাক নেই। ঝিঁঝিঁ পোকাদের গুঞ্জন নেই। ধবল তুষারপাতের শব্দ নেই। চারদিকে পাহাড় স্তব্ধ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ বাইরে বারান্দায় কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাও আবার আস্তে আস্তে নুপুর পড়ে হাটবার শব্দ। আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। এত রাতে কার এই নুপুরের নিক্কণ!

আমি অনেকটা ঠাঁয় বসে থাকি। চুপচাপ কেটে যায় আরও কিছটাু সময়। মনে হলো, নুপুরের নিক্কণ থেমে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। এবং রমণী কণ্ঠে বলছিল --- 'তুমি দরজা খুলে দাও। '
আমি :  তুমি কে?
রমণী :  আমি জেসমিন রিনচেন। তুমি আমাকে চিনবেনা। দরজা খোল। তারপর বলছি।

আমি সন্তর্পনে দরজার কাছে যেয়ে দরজা খুলে দেই। দেখি, ঝলমলে নাচের পোশাকে তিব্বতি ঘরানার একটি মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে। এমন নির্জন আঁধারে, এমন নিস্তব্ধ রাত্রি প্রহরে, এমন বনান্তরে, এমন একটি লাস্যময়ী মেয়ে আমার দরজার সামনে একাকী দাঁড়িয়ে। আমি পরম বিস্ময়ে এই রাত্রি সহচরীকে দেখছিলাম।
জেসমিন :  আমাকে ঘরে বসতে দেবেনা?
আমি  :   আসো, বসো।
জেসমিন রিনচেন এসে আমার বিছানায় বসে। আমি ওকে বলি, তুমি এতরাতে এখানে কী জন্য এসেছ? জেসমিন বলছিল ---- 'তুমি এই নির্জনে একাকী রয়েছ। আমি জানি, তুমি খুব ভয় পাচ্ছিলে। তাই তোমার কাছে চলে এলাম।'
আমি : তুমি কোথায় থাক, কী করো?
জেসমিন : আমার জন্ম এই মংপুতেই। বাবা নেপালি। আর আমার মা তিব্বতি। মা ছিল সিছুয়ানের খাংদিং এর একজন ক্যাবার ড্যানসার । সে আর এখন নৃত্য করেনা। আমি করি।'
আমি : এত রাতে তুমি একাকী এখানে। আমি পরদেশী। দেখো, আমার বদনামি হবে। তুমি চলে যাও।
জেসমিন : কী বলো তুমি? তুমি আমার গান শুনবেনা, নাচ দেখবেনা, তাই কী হয়? আমার কাছে, তাওয়াংএর ভেষজ সুরা আছে। যেটি দালাইলামাও খুব পছন্দ করে। তুমি এটা পান করো। ভাল লাগবে তোমার। মনে হবে তুমি স্বর্গে আছো। '
আমি :  আমার খুব ভয় লাগছে তুমি চলে যাও।
জেসমিন :  কী বলো তুমি? এমন মধুময় যামিনীতে তুমি আমাকে এত কাছে পেয়েও দূরে সরিয়ে দিতে চাও? আমি যদি তোমাকে অনেক ভালবাসতে চাই, তুমি আমাকে ভালবাসবে না?
আমি :  না। আমার দেশের একজন মায়াবতীকে আমি  খুব ভালবাসি। তার সাথে আমার বিবাহ ঠিক হয়ে আছে। আমি তাকেই বিবাহ করব।

জেসমিন ওর ব্যাগ থেকে সোনালি মোড়কে মোড়ানো একটি প্যাকেট বের করে ছোট্ট একটি রূপালি গ্লাসে করে ঐ সুরা পান করতে দেয় আমাকে । আমি অনেকটা সম্মোহিত হয়েই তা পান করি। প্রথমে জেসমিন গেয়েছিল একটি তিব্বতি গান। অনেকটা মেলোডী সুরে গেয়েছিল গানটি। সেদিনের সেই পার্বত্য নির্জন রাত্রিতে সেই মায়াবী সুর মংপু র আাকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল। আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম সেই গান। তিব্বতি সেই গানটির অর্থ ছিল এইরকম -----

'যদি পথ আরো দীর্ঘ হয়, তাহলে তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে? যদি তুমি আমার মন দেখতে পারো, তাহলে নিজেকেও খুঁজে পাবে। আমি তোমার সঙ্গে ঘুমন্ত স্মৃতি নিয়ে জেগে উঠতে চাই। আমার ভালোবাসা এখন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার ভালবাসা তোমার সঙ্গে আজীবন থাকবে।'

সকাল গড়িয়ে তখন বেলা হয়ে গেছে। অমল থাপা এসে বাইরে দরজায় নক করছিল । ডাকছিল আমাকে -- 'বাবুজি ওঠেন। ' আমি ধূরমুর করে জেগে উঠি এবং দরজা খুলে দেই। রুমের ভিতরে কোথাও রাতের সেই জেসমিন রিনচেনকে দেখতে পেলাম না। ঘরের দরজা যেমন করে বন্ধ করে শুয়েছিলাম তেমনি আছে। কিন্তু কী আশচর্য! বিছানার উপরে জেসমিনের পায়ের নুপুর, বুকের উপরে বাঁধা তার লাল দোপাট্টা, কয়েকটি চুলের কাঁটা, খোঁপায় লাগানো লিলিয়ান অর্কিড ফুল বিছানায় পড়ে আছে।

-------------------------------------------------------------------------
ডিসক্লেইমার :  জেসমিন রিনচেনের সাথে আমার কথা হয়েছিল হিন্দি আর ইংরেজিতে। আমি ইচ্ছে করে এখানে বাংলা সংলাপ ব্যবহার করেছি।



৩২.        ম্যাপল পাতা ঝরে পড়ে

আমার বয়স তখন ছয় কী সাত হবে । আমার বড় বোনের সবে মাত্র বিবাহ হয়েছে। এক বর্ষার দিনে বুবু প্রথম তার শ্বশুরবাড়িতে যায়। যাওয়ার সময় আমাকেও সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল তার শ্বশুরবাড়িতে। বাড়ির ঘাট থেকে নৌকায় করে প্রথমে আমরা সিরাজগঞ্জের বয়রা ঘাটে যাই। সেখান থেকে স্টীমারে করে যমুনা পার হয়ে জগন্নাথগজ্ঞ ঘাটে যেয়ে নামি। তারপর আবার নৌকা করে পিংনার চিতলিয়া নামে একটি গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। ঐখানেই ছিল বুবুর শ্বশুরবাড়ি।

এত বছর আগের কথা যে, আমি এখন সব বিস্মৃত প্রায়। আমার বয়স কতই ছিল? অনেক কিছুই পুরো মনে নেই। আমার মনে আছে বুবু তখন নিতান্তই চৌদ্দ পনের বছরের একজন বালিকা ছিল। আমাদের বোনদের মধ্যে সেই সবচেয়ে সুন্দরী ছিল। বুবু পড়েছিল টিয়া রঙের একটি জর্জেট শাড়ি। শ্বশুরবাড়িতে বুবু বাড়ির উঠোনে ছোট ছোট পা ফেলে হেটে এ ঘর থেকে ওঘরে যেত। ইন্দারা পারে যেয়ে বালতি দিয়ে জল তুলত। সকাল বেলা কবুতরদের ধান গম ছিটিয়ে খাবার খেতে দিত। বুবুকে নিয়ে আমার এই টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলি এখনও মনে আছে।

এর আট দশ দিন পরে বাবা আমাদের আনতে যায়। ফেরার পথে আবার নৌকা করে প্রথম জগন্নাথগজ্ঞ ঘাট আসি।  সেখান থেকে আমরা স্টীমারে করে প্রমত্তা যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে সিরাজগঞ্জে বয়রা ঘাটে চলে আসি । বয়রা ঘাটে ছোট একটি পানসী নৌকা ভাড়া করেন বাবা।  আমরা সেই পানসী নৌকা করে বাড়ির দিকে রওনা হই।

তখন শ্রাবণ মাসে বর্ষার পানিতে মাঠ ঘাট বিল নদী টইটুম্বর থাকত। আমার মনে আছে, সেদিন দক্ষিণা প্রবল বাতাস ছিল। মাঝি টানিয়েছিল নৌকায় বাদাম। শো শো করে আমাদের নৌকাটি কখনও আমন ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে, কখনও বিলে ভেসে ওঠা শাপলার ফুলের মধ্যে দিয়ে, কখনও ইছামতী নদী দিয়ে বাড়ির দিকে চলে আসতে থাকে। নৌকা যখন বাড়ির ঘাটের কাছাকাছি চলে আসে, তখন আমাদের গ্রামেরই কেউ একজন হাসিমুখে বাবাকে বলেছিল --- '' তালুকদারের ব্যাটা, গজ্ঞে থেকে মিষ্টি এনেছেন নাকি? বাড়িতে যান, আমাদেরকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে।'' আমি নৌকায় বসে, তখন ঐ লোকের এই কথার অর্থ বুঝি নাই। বাড়িতে এসে দেখি, মা'র কোলের কাছে বিছানায় ছোট্ট একটি শিশু শুয়ে আছে। যে আমাদের পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ।

কয়দিন আমাদের বাড়িতে উৎসবের আনন্দ হলো। বুবু এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। তার উপরে নতুন এক অতিথি। সবার এত আনন্দ যে! কে কার আনন্দ দেখে! আশেপাশে দূর গায়ে থেকে আত্মীয় স্বজনেরা নৌকায় করে বুবু ও নতুন বাবুকে দেখতে আসতে থাকে। যেন 'আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকে বিরাজ।' যেন চারিদিকে হাসি রাশি প্রাণ।

ঠিক আটদিনের দিন একদিন সন্ধ্যা থেকে আমাদের সেই ফুটফুটে বাবুটি চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। অন্য কোনো অসুখ নয়, শুধুই চিৎকার করে কান্না তার। এ কান্না কিছুতেই থামানো যাচ্ছিলনা। মা তার বুকের দুধ খাওয়াবার চেষ্টা করে, দুধও মুখে নেয়না। শুধুই চিৎকার করে কাঁদতে থাকে । আমার চাচাতো ভাই একজন এল.এম.এফ ডাক্তার ছিলেন, তিনি তার সমস্ত প্রচেষ্টা চালালেন কান্না থামাবার। আমরা ভাইবোনেরা অসহায়ের মতো সেই রাতে ওর কাছেই বসে ছিলাম।

বাবুকে বুবু তার কোলের ভিতরে জড়িয়ে ধরে  রেখেছিল। ঠিক প্রত্যুষে তার কোলের ভিতরেই বাবুর কান্না চিরতরে থেমে যায়। কাছ থেকে কোনো মৃত্যু দেখা আমার সেই প্রথম ছিল। আমার কিছুতেই মনে হলনা শিশুটি মরে গেল। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলাম তার বন্ধ চোখের দিকে। কী সুন্দর! চিৎকারহীন। পৃথিবীর সব রূপ আর সৌন্দর্য নিয়ে সে ঘুমিয়ে আছে। কিন্ত এই বিশ্বজগতেরে কোনো কিছুই শিশুটি দেখে যেতে পারলনা। সবাই কাঁদছিল তখন। বুবুও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ওকে বুকে চেপে ধরে ।

আজ ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখ। ২০১৫ সালে এইদিনে কানাডার মন্ট্রিলের একটি হাসপাতালে আমার সেই বুবু ইন্তেকাল করেন। সে এখন ঘুমিয়ে আছেন মন্ট্রিলের নিঝুম একটি কবরস্থানের মাটির নীচে। প্রতি বসন্ত দিনে হয়ত তার কবরের উপর শুকনো ম্যাপল পাতা ঝরে পড়ে। শীতে সাদা বরফে ঢেকে থাকে হয়ত কবরের মাটি। আপনজনদের এই রকম ঘুমুতে থাকতে দেখলে আমার দুই চোখে কেমন যেন  ঘুম নেমে আসে। কিছুই ভাল লাগেনা।

নিজেকে খুব দুঃখী মনে হলে ছুটে যাই কবিগুরুর কাছে।
লিখেছিলেন তিনি  ----

'অনন্ত জনম মাঝে গেছে সে অনন্ত কাজে ,
সে আর সে নাই ।
আর পরিচিত মুখে তোমাদের দুখে সুখে
আসিবে না ফিরে ।
তবে তার কথা থাক্‌ ,যে গেছে সে চলে যাক
বিস্মৃতির তীরে । '



৩২.       গঙ্গোত্রী গোমুখ

দুই হাজার এগারো সালে একবার ভারতের উত্তরাখন্ডে গঙ্গোত্রীতে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি ওখানে একটা গুহায় থাকতেন।  মা গঙ্গা মন্দিরে তিনি পূজা দিতেন। আমার সঙ্গে তার কথা হয় প্রথমে গঙ্গা ভাগিরথীর উৎপত্তি স্থলের এক পার্বত্য রাস্তার উগরে।  তারপর তার গুহায় বসে । শুনেছিলাম তার কাছ থেকে অনেক কথা। সেও এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। মাথার চুলে তার জট ছিল, সারা মুখ মন্ডল মোছ আর দাঁড়িতে ঢাকা ছিল। পরনে ছিল তেল চিটচিটে পুরানো ছেঁড়া পোশাক।

এই সন্ন্যাসীর সাথে কথা বলতে যেয়ে আমি অবাক হই তার কন্ঠ শুনে, তার চোখের চাহনি দেখে। আমার কাছে মনে হয়েছিল, এই সন্ন্যাসীকে আমি কোথায় যেন দেখেছিলাম। এই কণ্ঠ আমার চেনা। এই চোখ আমার দেখা। তবে সন্ন্যাসী রূপে নয়, অন্য কোনো রূপে।

ফ্ল্যাস ব্যাক : ১৯৭১ সাল।

তখন মার্চের উত্তাল সময়।  সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দলোন চলছে। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা শুরু করেছে। মানুষ উৎকন্ঠায় আছে, কী হবে, কী হবেনা। এই রকমই এক অস্থির সময়ে নিখিলেশ ঘোষ  নামে একজন লোক আমাদের গ্রামে ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। তার আত্মীয়টি ছিল আমার একজন সিনিয়র বন্ধু।  আমার সাথে ছিল তার হৃদিক সম্পর্ক। আমাদের গ্রামে উনি কয়েকদিন ছিলেন। আমি তাকে দাদা ডাকতাম। বাড়ি বগুড়ার মহাস্থান গড় এলাকায়। তিনি খুব বিনয়ী ও ভদ্র ছিলেন। খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। বয়সে দশ বারো বৎসরের বড়ো হলেও বন্ধুর মত হয়ে গিয়েছিলাম মাত্র কয়েকদিনেই। অল্প কদিনেই ওনার অনেক কাছাকাছি আমি যেতে পেরেছিলাম।

ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।  নিখিলেশ'দাও চলে যায় তাদের গ্রামে । উনি চলে যাবার পর ওনার  সাথে আর কোনসময় দেখা হয়নাই। কিন্তু তার সাথে আমার ক্ষণসময়ের সম্পর্কটি আমার কিশোর মনে ভীষণরকম দাগ কেটে গিয়েছিল। জীবনে কখনই ভুলতে পারিনি তার সাথে আমার খন্ড খন্ড স্মৃতিগুলো।

শুনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিখিলেশ দা'দের পুরো পরিবার স্মরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। নিখিলেশ দা তখন তেইশ চব্বিশ বৎসরের একজন টগবগে তরুণ। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর পড়াশুনা করে নাই। নিজেদের পারিবারিক মিষ্টি দধির ব্যবসায় দেখভাল করত । নিখিলেশ দা ভাল গান গাইতে পারত। স্থানীয় ভাবে তার একটি সুনাম ছিল।

বগুড়া শহর পাক সেনারা দখল করলে সেখানে তারা জ্বালাও পোড়াও শুরু করতে থাকে। স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকসেনারা বেছে বেছে হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালাতে পোড়াতে থাকলে একাত্তরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝির দিকে নিখিলেশ'দা দের পুরো পরিবার ভারতের পশ্চিম বঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুরের বালুর ঘাট এরিয়াতে চলে যায়। ওখানে পতিরাম নামক এক গ্রামের স্কুল মাঠে অবস্থিত স্মরণার্থী শিবিরে তারা  আশ্রয় নেয়।

আজ প্রায় চল্লিশ বছর পর সেই নিখিলেশ দাকে আমি দেখলাম সন্ন্যাসী রূপে এই গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখে ভাগিরথী ও গঙ্গার উৎপত্তি স্থলের প্রায় ১৩২০০ ফুট উচুতে তীর্থস্থানে এক পর্বত গুহার পাশে। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম তাকে। তাকে বলি : 'দাদা, আপনি কী নিখিলেশ ঘোষ? ' সন্ন্যাসী আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। মনে হল সে আমাকে চিনতে পারে নাই। বললাম --- ' আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ, ছোনগাছা হাটে। সত্যেন দা আমার সিনিয়র বন্ধু। ' আমার পরিচয় শুনে সন্ন্যাসীর দুচোখ ক্ষণিকের জন্য কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সেও হয়তো তাকিয়ে দেখছিল আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের এক কিশোর মুখকে। সন্ন্যাসী আমাকে চিনতে পারে। বলে --- তুমি এত বড় হয়ে গেছ? চেনাই যায়না। সত্যেন কেমন আছে?
আমি :  জ্বী বড়ই হয়ে গেছি। সত্যেন দা ভাল আছে। আপনার এ অবস্থা কেন? এমন সন্ন্যাস রূপ?
নিখিলেশ দা :   সে অনেক কথা । তা তুমি এই গোমুখে কয়দিন আছ? কোথায় উঠেছ?
আমি :  ভাগিরথী তীরে 'সাগর গঙ্গা ' হোটেলে। আমি এখানে দুই দিন থাকব।
নিখিলেশ দা : তুমি আমার ডেরায় যাবে ?
আমি  :  চলেন, যাব।

উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীতে অবস্থিত শহর গঙ্গোত্রী। সেখানে রয়েছে মা গঙ্গার মন্দির। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত সেই মন্দির হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে অন্যতম তীর্থস্থান। হিমালয় পর্বতশ্রেণির ৩,১০০ মিটার উচ্চতায় রয়েছে গঙ্গা মাতার মন্দির। প্রত্যেক বছর অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য তিথিতে শুরু হয় চারধাম যাত্রা - গঙ্গোত্রী, যমুনেত্রী, বদ্রীনাথ ও কেদারনাথ। খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের দ্বার।

যাহোক, আমি নিখিলেশ দার গুহায় চলে যাই। সে এক বিস্ময়কর দৃশ্য ! কেমন যেন ভূতরে পরিবেশ। কেমন যেন মাটির গন্ধ পাচ্ছিলাম। দেখছিলাম  সংসার বৈরাগ্য এক নিঃসঙ্গ মানুষকে। চাল নেই। চুলা নেই। আমার এসব দেখে ভালও লাগছিল খুব। এ এক দুঃশ্চিন্তাহীন সুখের  জীবন। একসময় কত ইচ্ছা হত সন্ন্যাস জীবন যাপনে। আজ নিজ চোখে দেখছি, এই সন্ন্যাসব্রত জীবন।

আমি যে দুইদিন এখানে ছিলাম, সে দুইদিন নিখিলেশ দার গুহায় বসে সময় কাটিয়েছি। কখনো পার্বত্য রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি। কখনও ভাগিরথীর তীরে বসে নিখিলেশ দার জীবনের কথা শুনেছি। আমার জানার খুব ইচ্ছা ছিল, কেনই তিনি বেছে নিলেন তার এই সন্ন্যাস জীবন?

আমার কৌতুহলী মন উদ্গ্রীব ছিল নিখিলেশ'দার কাছ থেকে তার সন্ত্রাস জীবন ধারণের কথা জানবার। তাকে  বলেছিলাম, আপনারা যখন স্মরনার্থী হয়ে এসেছিলেন, সেই সময়ে আপনার তো বয়স ছিল মুক্তিযুদ্ধে যাবার। তা আপনি কেন যাননি মুক্তিযুদ্ধে? আমার এই কথা শুনে তিনি খুব বিমর্ষ হলেন। একটি বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিখিলেশ দা একটি গাঁজার চুরুট  ধরালেন। জানালা দিয়ে দেখছিলেন দূরের পাহাড় । কী যেন ভাবছিলেন তিনি। তারপরের কথাগুলো নিখিলেশ দা 'র মুখ থেকেই শোনা যাক :

বালুরঘাটের অন্তর্গত গঙ্গারাম বাজারে একটি মিষ্টির দোকানে আমি কাজ নেই। আমার কাজ ছিল আশেপাশের গ্রাম থেকে যারা দুধ বিক্রয় করতে আসত,  তাদের কাছ থেকে সে দুধগুলো সংগ্রহ করে রাখা এবং কারখানায় কারিগরের সহকারী হিসাবে কাজ করা। এই মিষ্টি দোকানটির মালিক ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ একজন বিধবা মহিলা। নাম ছিল বেনুকা দেবী। আমি ওনাকে মাসী ডাকতাম। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। অল্প কদিনেই আমি এই কারখানায় বেশ সুনাম করে ফেলি।

একদিন কারখানায় যেয়ে শুনলাম আজ বালুরঘাটে কলিকাতা থেকে স্বাধীন বাংলা শিল্পী সমিতি আসবে গান গাইতে। আমি মালিকানের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বালুরঘাটে চলে যাই । তখন বিকেল হয়েছে।  বালুরঘাট স্টেশনের কাছে রাস্তায় খোলা ট্রাকের উপরে দশ বারো জনের একদল ছেলেমেয়ে উদ্দীপনামূলক মুক্তির গান গাইছে। আমি খুব উচ্ছসিত হই গান শুনে। গান শেষ হলে আমি এগিয়ে যাই খোলা ট্রাকটির দিকে। যিনি ঐ দলের নেতা ছিলেন, তাকে বলি :  আমি গান গাইতে পারি। আমি আপনাদের গানের দলে যোগ দিব। উনি বলেছিলেন 'তুমি কলিকাতায় এসো। অবশ্যই তোমাকে আমরা গানের দলে নিয়ে নিব। ' শুনেছিলাম ঐ দলের নেতা ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেণু।  অন্য সদস্যরা ছিলেন, শাহিন মাহমুদ, শারমিন মুরশিদ, নায়লা জামান, বিপুল ভট্টাচার্য, তারিক আলী, লুবনা মরিয়ম, স্বপন চৌধুরী সহ অনেকে।

কিন্তু আমার আর গানের দলে যোগ দেওয়া হয়নি। আমার মালিকান বলেছিল : তুমি চলে গেলে আমি উপোস নিব। আর একটিও অন্ন গ্রহণ করবনা। তুমি আর কোনদিন তোমার এই মাসী মাকে দেখতে পাবেনা।আরও একজন সেদিন খুব  মন খারাপ করেছিল --- সে হচ্ছে ফুলমনি সরেন। একজন সাঁওতাল রমণী। বয়স মধ্য তিরিশ। বিবাহিতা, কোনো সন্তান নেই । এই মেয়েটি এখানে মাঝে মাঝে দুধ বিক্রি করার জন্য আসত। খুব বেশি কথা হতনা ওর সাথে। ফুলমনির স্বামী রাঁচিতে থাকত। ওখানে রেলওয়ে স্টেশনের একজন কুলি। এক দুই মাস পর বাড়ি আসত। এসে যে কদিন থাকত সে নাকি রীতিমতো ফুলমনিকে ধর্ষণ করতো। আর মারধর করত।

এই ফুলমনিকে বলেছিলাম ---- 'আমি কলিকাতা চলে যাব।  গানের দলে যোগ দিব। মুক্তির গান গাইব। অথবা  যুদ্ধে যাব। '
ফুলমনি :   আপনি যাবেন না। আপনি চলে গেলে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাব।
আমি :  কোথায় নিরুদ্দেশ হবে তুমি?
ফুলমনি :  কত জায়গা আছে। কাশি, গয়া, বৃন্দাবন, না হলে গঙ্গোত্রী গোমুখ। সন্ন্যাসিনী হয়ে ঘুরব মঠে মঠে, মন্দিরে মন্দিরে।
আমি :  আমাকে কী তুমি ভালবাসো?
ফুলমনি : জ্বী।

আমি থাকতাম বেনুকা মাসীর কারখানার পিছনে একটি ঘরে। এই ঘরের পিছনে অদূরেই ছিল পুনর্ভবা নদী। যেদিন কোনো কাজ থাকতনা, যেদিন কোনো কারণে আমার মন খারাপ লাগত, সেদিন একাকী চলে যেতাম পুনর্ভবা নদীর তীরে। এই নদীর জল বয়ে গেছে আমাদের দেশেও। এপারে পুনর্ভবা, ওপারেও পুনর্ভবা। আজ ফুলমনির কথাগুলো শুনে চিত্ত আমার কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছিল। চলে যাই পুনর্ভবা নদীর তীরে। নির্জন ছাতিম গাছের তলে বসে দেখছিলাম নদীর জলের কুলকুল ধ্বনি। ভাবছিলাম --- ফুলমনিকে কখনও ভালবাসলাম না। প্রাণ খুলে কথা বলিনি কোনদিন। তারপরেও এই সাঁওতাল রমণীটি আমার জন্য কেন নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে? কেন সে আমাকে ভালবাসলো?

মনটা আরও ভাল করার জন্য সন্ধ্যার পরে আমার ছোট্ট রেডিওটি কানের কাছে নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র শুনি।  উনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। চরমপত্রে তাঁর দৃপ্ত উচ্চারণ ----- ‘ঘেটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট। কি হইলো? কি হইলো? অংপুরের ভুরুঙ্গামারীতে ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়ারা হালাক হইলো। কেইসটা কি?....."

আমারও যে কী হয়েছিল একদিন কিংবা দুই তিন দিন ফুলমনি না এলে ভাল লাগতনা। আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড় এই কালো সাঁওতাল মেয়েটির জন্য এমন লাগে কেন? আমি জানি আমার এই ভাললাগা আমার অন্তরের মধ্যেই ঢেকে থাকবে । প্রকাশিত হবেনা কোনোদিন। পুনর্ভবা নদীতে সাঁওতাল পুরুষদের দেখেছি পানকৌড়ি শিকার করতে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হতনা ধনুকের তীর। আমি জানি, যদি বলি --- 'ফুলমনি, আমি তোমাকে ভালবাসি। ' শত শত তীর এসে বিদ্ধ হবে  আমার শরীরে। রক্তাক্ত হবে পুনর্ভবার জল।'

আমার প্রায়দিনই খুব মন খারাপ লাগত। বেনুকা মাসী বলত 'তোমার কী হয়েছে নিখিল? ' আমি মিথ্যা করে  বলতাম, 'কিছু হয়নি। ভাল আছি।'  আমার অনেক গ্লানি আছে, আমি যুদ্ধে যাইনি। আমার অনেক কষ্ট হয়, আমি গাইনি দেশের জন্য মুক্তির গান। ' আমিও গোপনে গোপনে ফুলমনিকে অনেক ভালবাসি। কিন্তু, কখনও ওকে বলিনি ----- ভালবাসি।

সেদিন ছিল কার্তিকের অমাবশ্যার রাত। একটু আগে আগেই আটটার মধ্যেই দোকান বন্ধ করে খেয়ে শুয়ে পড়ি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিল। কেমন যেন গা ছমছম করছিল। ঘুম আসছিলনা চোখে। রাত বেড়েই চলছিল। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাই। সারা ঘরময় অন্ধকার। শিখা ধরাব কিন্তু দিয়াশলাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আস্তে আস্তে দরজার কাছে যেয়ে বলি ---- কে?  ওপাশ থেকে উত্তর আসে ---   আমি ফুলমনি।

তারপরের কিছু কথা নিখিলেশ দা ব্লাকআউট করলেন।
আমাকে বললেননা। আমি বুঝতে পারলাম কেন তিনি বললেন না সেইরাতের অনেক কথা। হয়ত অন্ধকার ছিল। হয়তো শিখা জ্বলে উঠেছিল। হয়তো কার্তিকের অমানিশার সমস্ত আঁধার ঢেকে দিয়েছিল নিখিলেশ'দাকে আর ফুলমনিকে। দূরে পুনর্ভবা নদীর জল নিস্তব্ধ ভাবে বয়ে যাচ্ছিলো হয়ত গঙ্গা পদ্মা অববাহিকার দিকে।

সেদিন রাতে যে ফুলমনি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল, এটি জেনে গিয়েছিল ফুলমনির পরিবার। সে যখন ঘরে ফিরে গিয়েছিল তা দেখে ফেলেছিল ওর নন্দিনী। আর ওর নন্দিনী বলে দিয়েছিল, ফুলমনির স্বামীকে। ফুলমনির গোয়ার স্বামী এই ব্যাপারটির জন্য তাকে অনেক মারপিট করেছিল। কিন্তু ফুলমনি স্বীকার করেনি , সে রাতে সে কোথায় গিয়েছিল। এরপর ফুলমনি আর ঘরের বাহির হয়নাই।

এরপর একবারই ফুলমনি আমার ঘরে এসেছিল। সেও একদিন সন্ধ্যা রাতে। খুব হন্যে হয়ে এসে বলেছিল --- তোমাকে খুন করে ফেলার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তুমি এই এলাকা ছেড়ে  চলে যাও। আমি ফুলমনিকে বলি  ---  তুমি আমার সাথে চলো, বল্লা মা কালী মন্দিরে। মা দেবীকে স্বাক্ষী রেখে তোমাকে বিয়ে করব। আমরা মন্দিরে চলে যাই।  ফুলমনি ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে। এবং ওকে বিয়ে করি। ফুলমনি  বলেছিল --- আমি এখন ধর্মত তোমার বউ। আমি তোমার কাছেই থাকিব। আমি আর ফিরিয়া যাইবোনা।
আমি :  তা কি করে সম্ভব?  তুমি আজ চলে যাও। পরে কোনো একদিন চলে আসিও। '
ফুলমনি আর কোনো কথা বললো না। সোজা মন্দির থেকে বের হয়ে চলে গেল।

আমি প্রত্যুষেই পতিরাম স্মরণার্থী শিবিরে চলে যাই। কাকতালীয় কিনা জানিনা, সেদিন ছিল ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে খবর পাই, আমাদের বিজয় হয়েছে। গান বাজছে বেতারে ----
'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল
জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।।
বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল,
হয়েছে কাল, হয়েছে কাল, হয়েছে কাল।'

আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। আতিশয্যে ভুলে যাই ফুলমনিকে। স্বাধীন দেশ, বিজয়ের দেশ দেখার জন্য মন প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। শিবিরে শিবিরে সেকি আনন্দ উৎসব সেদিন। সারি সারি নৌকায় পাল তুলে পুনর্ভবা নদী দিয়ে  আমরা পরের দিনই হলুদ মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে  বাংলাদেশে চলে আসি।

আমি নিখিলেশ'দাকে বলি --- ফুলমনি র কী হল? আর আপনি কেন এখানে, এই গঙ্গোত্রী গোমুখে? কেনই এই সন্ন্যাস রূপ? নিখিলেশ দা ৰলেছিল ---' আমি পতিরামে যেয়ে একবার ফুলমনির খোঁজ নিয়েছিলাম। শুনেছি সে নিরুদ্দেশ হয়ে কোথায় চলে গেছে।  'ফুলমনি একদিন বলেছিল ----  'কত জায়গা আছে। কাশী, গয়া, বৃন্দাবন, না হলে গঙ্গোত্রী গোমুখ। সন্ন্যাসিনী হয়ে ঘুরব মঠে মঠে, মন্দিরে মন্দিরে। '
সেই কতকাল ধরে আমিও কাশী, গয়া, বৃন্দাবন, এই গঙ্গোত্রী গোমুখে সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরছি। খুঁজছি হতভাগী ফুলমনি'কে। এখনও কোথাও ওর দেখা পাইনি।'


৩৩.       দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা

আজকের এই শীত আর কুয়াশা দেখে মনে পড়ল অনেক দিন আগের এক শীতের কথা।  এমনই সেদিন শীত ছিল। এমনই শৈত্য প্রবাহ বয়ে এসেছিল হিমালয় পর্বতের গিরি শৃঙ্গ থেকে। উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়ের আকাশে সেদিন ধবল মেঘ উড়ছিল তুলোর মত। শরীর মন হিম শীতল হয়ে গিয়েছিল রাতের ট্রেন জার্নিতে। শীতে কাঁপতে কাঁপতেই আমি ও আমার এক সহকর্মী সেদিন সকালে ট্রেন থেকে নেমেছিলাম স্টেশনে। একটি রিক্সা নিয়ে শীতে জড়োসড়ো হয়ে যেয়ে উঠেছিলাম ডাকবাংলোতে। সরকারি একটি প্রকল্প কাজের মূল্যায়নের জন্য ওখানে আমাদের যেতে হয়েছিল। আমরা সেখানে  তিনদিন ছিলাম।

আমার সেই সহকর্মীটির নাম ছিল রুহুল আমিন। আমরা দুজন আবার বন্ধুও ছিলাম। একই সাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম । আমি পড়তাম বাংলাতে। আমার বন্ধুটি পড়ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে।  আমি রুশপন্থী সমাজতন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলাম। ও ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিশ্বাসী রাজনীতিতে। আমাদের দুজনের রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই থাক, সরকারি চাকুরিতে যোগদানের পর আমরা আর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম না। আর আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব ছিল অমলিন। রাজনৈতিক বিশ্বাস কখনও বন্ধুত্বের  সম্পর্ককে নস্ট করতে পারেনি।

একই সময়ে আমাদের সাথে দর্শন বিভাগের একটি মেয়ে চাকুরীতে যোগদান করেছিল। ওর সাথে আমাদের দুজনের আগে থেকে কোনো পরিচয় ছিলনা। মেয়েটির ডাক নাম ছিল তিথি। এই তিথির সাথে আমাদের দুই বন্ধুরই সখ্যতা গড়ে ওঠে। তবে কোনো প্রেমের সম্পর্ক কারও সাথে নয়। না আমার সাথে, না রুহুল আমিনের সাথে। তবে মেয়েটাকে আমার যে ভাল লাগত না,তা নয়। মনে হত এই মেয়ের সাথে প্রেম করলে ভালই হবে। কেমন যেন শেষের কবিতার লাবন্যর মত চেহারা ছিল ওর। ঐরকমই মায়াভরে কথা বলত আমাদের সাথে। ওর টানা টানা চোখ আমার চোখকে টানত। আর একটি গুণ ছিল তিথির, তাহল খালি গলায় সে ভাল রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারত।

একদিন বিকালে ছুটির পরে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত আমাদের অফিস থেকে বের হয়ে হাটতে হাটতে আমরা তিনজন চলে এসেছিলাম  সংসদ ভবন চত্বরে। ওখানে সবুজ ঘাসের উপর বসে আমরা  সন্ধ্যা অবধি অনেক কথাই বলেছিলাম। সেদিন আমাদের একটি গান শুনিয়েছিল তিথি। অসাধারণ দরদ দিয়ে গেয়েছিল গানটি  -----

'শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো।
সারা পথের ক্লান্তি আমার সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাব যে খুঁজে না পাই দিশা—
এ আঁধার যে পূর্ণ তোমায় সেই কথা বলিয়ো।'

মাঝে মাঝেই কেমন যেন উদাস হত মন। কেমন যেন স্বপ্নের ঘোরের মত লাগত নিজেকে।  একাকী পথ চলতে পা অবশ হয়ে আসত।  রাতে শুয়ে থেকে অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে ভাবতাম, তিথি যদি আমাকে ভালবাসতো, যদি কোনো ক্লান্ত দুপুরে উদাস দুটি চোখ মেলে তাকিয়ে আমাকে বলত ----- 'তোমাকে আমি ভালবাসি। ' এসব ভাবতে ভাবতে ঘুম চলে আসত দুচোখে। স্বপ্নের ভিতরে চলে আসত তিথি আমার কাছে। কখনও সে প্রেমিকা হয়ে, কখনও বউ হয়ে। স্বপ্নের এই পাওয়ার আবেশ নিয়ে আমি প্রতিদিন অফিসে যেতাম। দেখতাম পরম বিস্ময় চোখে তিথিকে। দেখে আমার মন খারাপ হয়ে যেত --- মনে হত তিথি তো আমার বউ নয়। প্রেমিকাও নয়।

শীতের হিম শীতল আমেজ নিয়েই আমাদের পঞ্চগড়ের কাজগুলো শেষ করে ফেলি।  আমাদের দুজনেরই খুব সাধ হল, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার। তাই তেঁতুলিয়া চলে যাই। তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে একটি ঐতিহাসিক ডাক বাংলো আছে। মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষা ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন সুউচ্চ গড়ের উপর সাধারণ ভূমি হতে প্রায় ১৫ হতে ২০ মিটার উচুতে বাংলোটি অবস্থিত। উক্ত স্থান হতে হেমন্ত ও শীতকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আমরা এই ডাকবাংলোতেই সেই রাতে অবস্থান করেছিলাম।

আমরা যখন তেঁতুলিয়া পৌঁছি তখন বিকাল হয়েছিল। বিকেলেই আমরা ভজন পুর ও তেতুলিয়া মধ্যবর্তী বুড়াবুড়ি নামক স্থানে একটি দূর্গের ভগ্নাংশ, ভদ্রেশ্বর মন্দির, শিবমন্দির ও গ্রিক ভাস্কর্ষ রীতিতে নির্মিত দুটি সমাধি স্তম্ভ দেখতে যাই।  থানার সীমানা ঘেসে চলে যাওয়া মহানন্দা নদীর তীরে দাড়িয়ে খুব ভোরবেলা  কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত নাকি খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়।

রাতে ডাকবাংলোতে একই খাটে  দুই বন্ধু পাশাপাশি শুয়ে আছি। শুয়ে শুয়েই বলছিলাম দুজন দুজনের কথা। দুজনের জীবনের অনেক সুখ দুঃখ প্রেম বিরহের কথা। অনেক কথাই বলতে বলতে রুহুল আমিন বলছিল ---- 'তোকে একটা কথা বলব। '
আমি :  বল্, কী কথা?
রুহুল :  আমরা যেদিন পঞ্চগড় আসি, তার আগের দিন তিথি আমাকে ডেকে নিয়ে নিবেদন করে বলেছে --- 'আমি তোমাকে ভালবাসি। '

রুমের ভিতরে তখন অন্ধকার বিরাজ করছিল। একে অপরের মুখ চোখ কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ আমার মুখটি বিষাদে ছেয়ে গেল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। কন্ঠ কেমন যেন রোধ হয়ে আসছিল। এসবের কিছুই রুহুলকে বুঝতে দিলামনা। আধারে লুকিয়েই রুহুলকে বললাম ---- 'ভাল তো! তুই খুব ভাগ্যবান। তিথির মত একটি সুন্দরী মেয়ে তোকে ভালবাসে। '
রুহুল :  আমার ধারণা ছিল তিথি তোকে ভালবাসবে। তুইতো অনেক সুন্দর করে কথা বলিস। তুই অনেক ভাল ছেলে।
আমি :  আরে, না। আমাকে ভালবাসবে কেন? আমার কী তোর মত এত ঐশ্বর্য আছে?

তারপর সেই রাতে ডাকবাংলোতে আমাদের মাঝে আর বেশি কথা হয় নাই। বেশি কথা বলতেও পারছিলাম না। একটু পর দেখি, রুহুল ঘুমিয়ে গেছে। আমার চোখে আর ঘুম আসছিল না। রাতের আঁধার ভেদ করে দৃষ্টি আর বেশি দূরে কোথাও যেতে চায়নি। মনে হচ্ছিল কেবল সেই চিরন্তন সত্য কথাটাই ---  'কেউ চেয়ে পায়না, কেউ না চেয়েই পায়। '

সব আঁধার সরে যেয়ে একসময় ভোর হয়।  আমরা দুজন হেটে হেটে চলে যাই মহানন্দা নদীর তীরে। নদীর ওপারে ভারত। দূরে তাকিয়ে দেখি --- হিমালয়ের সুদৃশ্য  কাঞ্চনজঙ্ঘা। শৃঙ্গে তার ধবল মেঘ তুলোর মত উড়ছে। এত সুন্দর মোহনীয় দৃশ্য দেখে মনটি ভাল হওয়ার কথা, কিন্তু ভাল হলনা। কেমন যেন ঝিরিঝিরি শৈত্য প্রবাহের জল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল আমার চোখ মুখ। ভেজা চোখের দৃষ্টিতেই দেখছিলাম অনেক দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা। ঘন কুয়াশায় সেদিন কেউ দেখতে পায়নি আমার ভেজা চোখ। রুহুল আমিনও না।


৩৪.          পদচিহ্ন পড়ে আছে

মেয়েটি প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে জিমনেসিয়াম মাঠে চলে আসতো। মাঠে এসে  পুরো মাঠটি দৌড়ে চার পাঁচবার প্রদক্ষিণ করতো। তারপর মাঠের সবুজ ঘাসের উপর বসে যোগ ব্যায়ামের মতো করে রিলাক্স নিয়ে আবার হেটে হেটে সে বাড়ি চলে যেতো।

আর একটি ছেলে। সেও প্রতিদিন আসতো মাঠে। গাঢ় নীল রঙের জীন্স প্যান্ট পড়তো আর গায়ে থাকতো টি সার্ট। একেক দিন একেক রঙের টি সার্ট পড়ে সে আসতো। কিন্তু সে কখনো ব্যায়াম কিংবা দৌড়াদৌড়ি করতোনা। সে স্বাভাবিক হাটাহাটি করতো।

দুইজনই স্লার্ট তরুণ তরুণী। প্রথম প্রথম দুজন দুজনকে ফলো করতো, কথা হতোনা কারোর সাথে। কিন্ত কথা বলতে মন চাইতো দুুজনেরই। ছেলেটির ভাবনা ছিলো  এই রকম :

তুমি বেনী বেঁধে আসোনা কখনো। আবার মাথার চুল ছেড়েও রাখোনা। কাঁটা দিয়ে খোপা বেঁধে রাখো প্রতিদিন। কখনো তুমি চোখ মেলে দেখো ভোরের আকাশ। আবার আলো ঝরানো সূর্যও দেখো তুমি। তুমি কেন একবারও নয়ন ভরে আমার দিকে তাকাওনা। একবার যদি দেখো বুঝতে পারতে, এই চোখে তোমার জন্য কতো ভালো লাগা লেগে আছে।

মেয়েটিও ভাবতো ছেলেটির কথা। নিজের কাছেই নিজেকে বলতো : তুমিতো ছেলে মানুষ। হাটছো সবুজ ঘাসের উপরে। মনে হয় যেনো কোনো স্বপ্ন নেই। তুমি রাজপুত্তুরের মতো অহংকার করো কেন? আমি যে স্বপ্ন মেলাতে চাই তোমার চোখে। হেটে হেটে যখন বাসায় চলে যাই। তখন পিছনে তোমাকে রেখে আসতে মন চায়না। তুমি একটিবার কাছে এসে তো বলতে পারো --  'তোমার নাম কি? ' কিছুই বলোনা তুমি। তোমার সাথে কথা বলার দায় কি শুধু আমার?

কতো সকাল চলে গেছে চুপিসারে অপলক দৃষ্টিতে। কতো সকালের এলোমেলো হাওয়া দুজনের মনকে উতলা করেছে। আকুল হয়ে কাছে চলে এসেছে কথা বলবে বলে দুজন। কিন্তু কোনো কথাই বলা হয়নি।

ঠিক একদিন কাকতালীয় ভাবে ঘটলো ঘটনাটি । মেয়েটি মাঠে দৌড়ানোর সময়ে হোচট খেয়ে পড়ে যায় ছেলেটির সামনে। জুতোর ভিতরে মোচড় লাগে পায়ে। মেয়েটি ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলো। ছেলেটি কাছে এগিয়ে যায়। মেয়েটির জুতার ফিতেগুলি খুলে দেয়। এবং পা তার হাঁটুর উপর রেখে ম্যাসেজ করে দেয়।
কিছু সময় পরে ছেলেটি মেয়েটিকে বলে -- কেমন লাগছে এখন?
মেয়েটি :  বেশ ভালো লাগছে! অনেক ধন্যবাদ।
ছেলেটি : ওয়েলকাম। কি নাম তোমার?
মেয়েটি  :  নাওমি।  তোমার?
ছেলেটি :  রাহুল।

বাসায় আসার পর নাওমির পা বেশ ফুলে যায়। এতো যে ব্যথা পেয়েছিল মাঠে তা বুঝতে পারেনি। ডাক্তারের পরামর্শে এক মাসের জন্য পা প্লাস্টার ব্যান্ডজ করে রাখতে হয়। বাড়ির বারান্দায় বেশির ভাগ সময় ইজি চেয়ারে বসে থাকতে হয় তাকে। মন তার উদাস হয়ে চলে যায় জিমনেসিয়াম খেলার মাঠে।
ভাবে সে :
তুমি তো প্রতিদিন আসো ঐ মাঠে। সবুজ ঘাসের উপর হাঁটো যখন, তখন কি তুমি আমাকে খুঁজো সেই আগের মতোই। আমি উন্মেলিত চোখে চেয়ে থাকি এখনও তোমার দিকে। হলুদ রঙের টি সার্ট তোমাকে কিযে মানায়! আমার নরম হাতের পাঁচ আঙুলের স্পর্শ দিতে চায় তোমার বুকের পাঁজরে। আমার ভালো লাগেনা কোনো কিছুই। মনে হয় সব ব্যান্ডেজ টেনে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেই।

ছেলেটি এরপর প্রায় প্রতিদিনই মাঠে আসতো। ছোট ছোট পা তুলে সবুজ ঘাসের উপর সে হাটতো। হাটতে হাঁটতেই খুঁজতো নাওমিকে। কিন্তু নাওমি আর অাসেনা। হঠাৎ ভ্রান্তি তারও হয় :

ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে তোমার মাথার চুল। তুমি দৌড়ে দৌড়ে চলে আসছো, রাজপথ থেকে মাঠে। তুমি দৌড়ে যেন আসছো আমার দিকেই। বুকে জড়িয়ে নাও আমাকে। পাঁজরের নীচে তোমার ঘামের গন্ধ পাই।  আবেশে আমি দুইচোখ বন্ধ করি। আবার যখন চোখ মেলে ধরি, দেখি কোথাও তুমি নেই। সারা মাঠ খুঁজে ফিরি। শুধু শূণ্য মাঠ পড়ে থাকে ঘাসের উপরে।

পরপর দশ পনেরো দিন ছেলেটি মাঠে এসেছিল। কোনো দিনই সে নাওমির দেখা পায় নাই। তারপর সপ্তাহ খানেক সে আর আসে নাই। তারপর সে আর একদিনই এসেছিল মাঠে। সেদিনও একাকী হাঁটছিলো সবুজ ঘাসের উপর। পরনে ছিল হলুদ রঙের টি সার্ট। একটু হাটার পরই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। বসে পড়ে  ঘাসের উপরে। রোদ্রকরোজ্জ্বল সকাল ছিল সেদিন । সেদিনও সেই ভোরের আলোয় ছেলেটির বিষন্ন চোখ খুঁজছিল নাওমিকে।

যে ছোট্ট মেয়েটি প্রতিদিন বকুল ফুলের মালা বিক্রি করতো, সেই মেয়েটি আজো এসেছে মাঠে। রাহুল মেয়েটিকে ডেকে কাছে আনে। ওর কাছ থেকে একটি মালা নেয়। মালাটি নিয়ে ওর হাতে পাঁশশত টাকা দেয়। মেয়েটি বলে :  আমার মালার দাম দশ টাকা। আপনি এতো টাকা দিলেন কেন?
রাহুল :  আমি তোমাকে মালার দাম দেই নাই। তুমি আমার ছোট বোনের মতো, তোমাকে এমনি এই টাকা দিলাম। তুমি একটি জামা বানিয়ে নিও।

নতুন জামা হবে এ কথা মনে করে মেয়েটি খুশিই হয়। রাহুল তারপর বলে --
' একটি মেয়ে যে প্রতিদিন এখানে দৌড়াতে আসে ওকে তুমি চিনো ?'
মেয়েটি :  নাওমি আপুর কথা বলছেন? চিনি তো।
রাহুল পকেট থেকে খামের ভিতরে রাখা একটি চিঠি আর বকুল ফুলের মালাটি মেয়েটির হাতে দিয়ে বলে --
' দেখা হলে এগুলো তুমি তোমার নাওমি আপুকে দিয়ে দেবে। '

তারও একমাস পরে নাওমি একদিন আস্তে আস্তে হেটে মাঠে চলে আসে। সেদিন আর সে দৌড়াচ্ছিলনা। হাটছিল সে ঘাসের উপর। খুঁজছিল এদিক ওদিক তাকিয়ে রাহুলকে। হেমন্তের সকালে কতো শিশির পড়ে আছে এই ঘাসের উপরে । কিন্তু কোথাও রাহুলের পায়ের চিহ্ন নেই। মালা বিক্রি করা সেই মেয়েটি নাওমির কাছে এগিয়ে আসে। ওর জীর্ণ ব্যাগের ভিতর থেকে একটি শুকনো বকুল ফুলের মালা আর চিঠিটি নাওমির হাতে দিয়ে বলে -- 'এগুলো রাহুল ভাইয়া দিয়েছে আপনাকে দেবার জন্য। '

বাসায় এসে খামের ভিতরে থেকে চিঠিটি বের করে পড়তে থাকে নাওমি  --

'এই চিঠি তুমি পাবে কিনা জানিনা। যদি পাও তখন আমি সুদূর ভিয়েনায় থাকবো। বাবার সাথে কিছু দিনের জন্য ঢাকা এসেছিলাম। আমার ফুপিকে দেখতে। আমি নাকি মায়ের মুখ দিখি নাই। এই ফুপিই আমাকে লালন করেছে।  কাল চলে যাচ্ছি ভিয়েনায়। ওখানে আমি  বাবার সাথেই থাকি। বাবা একা মানুষ। মা মরে যাবার পরে বাবা আর বিয়ে করেনি
তোমার কথা আমার খুব মনে পড়বে। জানো, তোমার  পায়ে নুপুর পড়াতে খুব ইচ্ছা করেছিল। যে পায়ে তুমি ব্যথা পেয়েছিলে। আর কন্ঠে পড়াতে ইচ্ছা করে আমার মায়ের রেখে যাওয়া মনিহার। এই ইচ্ছা গুলো স্বপ্ন হয়েই রইল।
কোনো বিষন্ন বিকেলে দানিয়ুব নদীর তীরে আমি হাঁটবো একাকী। ওখানে আছে এমনি সবুজ ঘাস। তোমার কথা মনে পড়বে। ওখানেও সন্ধ্যা নামে। ওখানেও চাঁদ ওঠে। ওখানেও তারা জ্বলে আকাশে। তোমাকে হয়তো খূঁজবো সেই সব তারায়।

যদি পারো একবার ফোন করো এই নাম্বারে।
+431972389.
------- রাহুল। '

নাওমির চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে। ডায়াল করে এই নাম্বারে +431972389. ওপাশ থেকে ধরে রাহুলের বাবা। বলে -- কাকে চাচ্ছেন? '
নাওমি :  রাহুলকে। আমি ওর বন্ধু।
রাহুলের বাবা :  তুমি হয়তো এখনো জানো নাই, বাংলাদেশ থেকে আসার দুই দিন পরেই ওকে হাসপাতালে ভর্তি করি। ওর হার্টের দুটো বাল্বই অকেজো ছিল। পেসমেকার পড়ানো ছিলো। হঠাৎ সেখানে অধিক রক্ত ক্ষরণ হতে থাকে। আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে ছিলো সাত দিন। তারপরেও ওকে আর বাঁচানো যায়নি। চলে গেছে আমাকে ছেড়ে।

রাহুলের বাবা বলছিল -- 'তোমার নাম কি মা?'
নাওমি :  নাওমি।
রাহুলের বাবা : ওহ! তুমি তাহলে নাওমি!  ডাক্তার বলেছিল, আইসিইউ তে অজ্ঞান অবস্থায় তিনজনকে নাকি রাহুল ডেকেছিল। এক. ওর ফুপিকে, দুই. আমাকে আর তিন, নাওমিকে।

রাহুলের বাবা ওপাশ থেকে নাওমির কান্নার শব্দ ছাড়া অন্য কোনো কথা আর শুনতে পারে নাই।


৩৫.        কে এই অভাগী?

অনেক দিন আগের কথা। এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা রাতে  জয়দেবপুরের রাজেন্দ্রপুর রেল স্টেশনে অপেক্ষা  করছিলাম একটি লোকাল ট্রেনের জন্য। তখন বাসের যোগাযোগ এত ভাল ছিলনা। ঢাকা আসার জন্য ট্রেনই ছিল একমাত্র ভরসা। চারদিকে শালবন বেষ্টিত এই স্টেশনটি সেই বৃষ্টির সন্ধ্যা রাতে ছিল প্রায় জনমানবহীন। ডাউন ট্রেন তাই লোকজনের অতো সমাগম ছিলনা। অল্প কজন যাত্রী এলোমেলো ভাবে ঘোরাফেরা করছিল।

স্টেশন মাস্টারের কাছে খবর নিলাম। ট্রেন আসতে অনেক দেরি হবে। ট্রেন নাকি তখনও গফরগাঁও অতিক্রম করেনি। স্টেশনটিতে আলোর তেমন ঔজ্জ্বলতা ছিলনা। সব মিলে তিন চারটি বাল্ব টিমটিম করে জ্বলছিল। গুরিগুরি বৃষ্টি ঝরছিল। রাত আটটা  বেজে যায়, সাতটার ট্রেনের তখনও খবর নেই।

প্লাটফর্মের পূর্ব পাশে ছোট্ট চার দোকানের বেঞ্চে বসে চা আর সিগারেট খেয়ে সময় পার করছিলাম। হঠাৎ দেখি,  পশ্চিম পার্শ্বে বিশ্রামাগারের ভিতর থেকে একটি বিশ একুশ বছরের মেয়ে বের হয়ে রেল লাইন ক্রস করে চায়ের দোকানের কাছে চলে আসছে। সে কখন বিশ্রামাগারে এসে বসেছিল খেয়াল করিনি। তার পরনে ছিল সালোয়ার কামিজ। মেয়েটিকে দেখে মনে হলো সে নিম্ন বিত্ত ঘরের মেয়ে হবে । তার চোখ মুখ খুবই বিমর্ষ লাগছিল।

আমার একটি লাজুক স্বভাব,  কোন মেয়ের দিকে  সরাসরি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনা। আরও একটি অভ্যাস কোন অপরিচিত মেয়ের সাথে আগ বাড়িয়ে কোন কথাও বলিনা। দেখলাম -- মেয়েটি চায়ের অর্ডার দিল। এবং চা খেতে খেতে মেয়েটি আমাকে বলছিল --- কোথায় যাবেন আপনি?
আমি :   তেজগাঁও, ঢাকা। বললাম, আপনি কোথায়. 
              যাবেন?
মেয়েটি :  পিয়ারপুর। ময়মনসিংহ। অথবা অন্য
               কোন স্টেশনে।
আমি   :  কখন আসবে আপনার ট্রেন?
মেয়েটি :  এখন কোন ট্রেন নেই। ভোর চারটায় ট্রেন ।
আমি   : এতক্ষণ কী করবেন?
মেয়েটি :  জানিনা, কি করবো।
আমি :   বাড়িতে ফিরে যান।
মেয়েটি :  এখানে আমার বাড়ি নেই। এখানে কেউ নেই।

মেয়েটির অসহায়ত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে একটু চিন্তাই করছিলাম। ভাবছিলাম, এই বৃষ্টি ঝঞ্ঝা রাতে মেয়েটি একাকী এই স্টেশনে বসে থাকবে? একটু পর এই স্টেশন আরও জনশূন্য হয়ে যাবে। চায়ের দোকানটাও বন্ধ হয়ে যাবে। একটু চিন্তাই লাগছিল। মেঘাচ্ছন্ন আলো আঁধারে স্টেশনের পূর্ব পার্শ্ব ধরে আমি ও মেয়েটি হাঁটছিলাম। বলছিলাম --- এখানে কোথায় এসেছিলেন?

মেয়েটি : আজই এখানে এসেছিলাম। যার কাছে এসেছিলাম সে এখানে নেই। এখানে সে থাকেনা। সে কোনদিন এখানে ছিলও না। আমি  ঘর ত্যাগ করে তার কাছে সারা জীবনের জন্য চলে এসেছিলাম। এসে বুঝতে পারলাম, আমি প্রতারিত হয়েছি।

আমি :  যার কাছে এসেছিলেন উনি আপনার কী হয়?
মেয়েটি : কিছু হয়না। উনি আমার কেউ না।
আমি :  এই যে বললেন, ওনার কাছে সারা জীবনের জন্য ঘর ছেড়ে চলে এসেছিলেন।
মেয়েটি : সে অনেক দুঃখের কথা।

স্টেশনের অদূরে দেখি, সবুজ সিগন্যাল বাতিটি জ্বলে উঠেছে। আমি মেয়েটিকে বললাম --- ঢাকা যাবার ট্রেনটি বোধহয় চলে আসছে। আপনি এখানে খুব একা হয়ে যাবেন। ভোর চারটে হতে এখনও অনেক দেরি । একাকী এই স্টেশনে অপেক্ষা করতে ভয় পাবেননা তো?
মেয়েটি :  আমাকে সাথে করে এক রাতের জন্য আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবেন? কাল সকালেই চলে আসবো।

আমি ভিতরে ভিতরে একটু বিব্রত হলাম। নতুন বিবাহ করেছি। এই রাত দুপুরে একটি অপরিচিত যৌবনবতী মেয়েকে নিয়ে বাসায় হাজির হবো, আমার নব পরিনীতা স্ত্রী কী ভাববে? এই কথা ভেবে মেয়েটিকে বললাম -- তা সম্ভব হবেনা। আপনাকে সাথে নিয়ে গেলে আমার নতুন সংসারে অমঙ্গল হবে।

মেয়েটি বললো, ও আচ্ছা। ঠিক আছে। আমি একাই এখানে এই স্টেশনে থাকতে পারবো। আপনি কোন চিন্তা করবেননা।

আমি মেয়েটিকে স্টেশনের এই পাশে রেখে ওপাশে টিকিট ঘরের দিকে এগিয়ে যাই। টিকিট কেটে এসে স্টেশনের এই পাশেই দাড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তখনও ট্রেনটি আসেনি।

তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছিল। আলো আঁধারে মনে হচ্ছিল রেল লাইনের ও পাশ থেকে মেয়েটি আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। কেন জানি  মেয়েটির জন্য খুব মায়া হলো। মনে হলো এই মেয়ে যদি আমার প্রেয়সী হতো তাহলে ঠিকই তো আজ আমি ওকে আমার ঘরে নিয়ে যেতাম। ও আমার প্রেমিকা না হোক, পথের একটি অসহায় মেয়েকে আমার ঘরে এক রাতের জন্য স্থান দিলে কী এমন ক্ষতি হবে? আমার নব বধূকে না হয় ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলবো।

দেখি ট্রেনটি স্টেশনের দিকে চলে আসছে। ওপাশে মেয়েটি তখনো আমার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে।  আমি এ পাশ থেকে মেয়েটিকে ইশারায় বললাম --- 'তুমি এই ট্রেনেই উঠবে। আমার সাথে ঢাকা যাবে।'

ট্রেনটি স্টেশনে এসে থামে। ট্রেনের আড়াল হয়ে যায় মেয়েটি। আমি ট্রেনে উঠে পড়ি। ওপাশে তাকিয়ে দেখি, মেয়েটি দাড়ানো নেই। ভাবলাম, ট্রেনের কোন কামড়ায় হয়ত সে উঠে পড়েছে। স্টেশনের বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একটু পরে ট্রেনটি বৃষ্টি আর রাতের  অন্ধকার ভেধ করে ঢাকার দিকে চলে আসতে থাকে।

তেজগাঁও স্টেশনে নেমে আবারও খুঁজলাম মেয়েটিকে। কোন কামড়া থেকেই সে আর নামলোনা। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। ঢাকার রাতের আকাশে কোন মেঘ নেই। নিয়ন আলোয় আলোকিত হয়ে আছে রাজপথ। স্টেশন থেকে একটি রিক্সা নিয়ে নাখাল পাড়ায় আমার বাসায় চলে আসি।

তারও একদিন পরে ইত্তেফাকের তৃতীয় পাতায় একটি নিউজ হেডিং দেখতে পাই -- " কে এই অভাগী? " ভিতরে ছোট করে খবরে লেখা ছিল --- ' গত পরশু রাত সাড়ে নয়টার দিকে রাজেন্দ্রপুর স্টেশনের কাছে ঢাকাগামী একটি লোকাল ট্রেনের নীচে কাটা পড়ে বিশ একুশ বছরের  অজ্ঞাতনামা একটি মেয়ে মারা গিয়েছে। জিআরপি পুলিশ লাশটির ময়না তদন্তের জন্য জয়দেবপুর সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। ময়না তদন্তে জানা যায় মেয়েটি দুই মাসের অন্তসত্তা ছিল। এ ব্যাপারে জয়দেবপুর সদর থানায় একটি মামলা রজ্জু  করা হয়েছে। '

তারপর কত বছর চলে গেছে। ঐ মেয়ের কথা কখনও মনে পড়ে, কখনও পড়েনা। কিন্তু এখনও কোন ট্রেনের চাকার ঘস্ ঘস্ শব্দ শুনলে ঐ অভাগী মেয়েটির আর্তনাদ আমি শুনতে পাই। কানে বাজে একটি মিনতি --- 'আমাকে একটি রাতের জন্য সাথে করে নিয়ে যাবেন আপনার বাড়িতে? '



৩৬.        মহুয়া বনে

যার ঘটনা নিয়ে এই লেখা তিনি হচ্ছেন অনিমেষ রায়। অনিমেষ আমার বন্ধু। আমেরিকায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখেই বসবাস করছিল সে। কিন্তু নয় এগারোর পর অবৈধভাবে বসবাসের কারণে হঠাৎ ঐদেশ থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। কিন্তু স্ত্রী সন্তান রয়ে যায় সে দেশেই।

বাংলাদেশে আসার পরে সে একাকী হয়ে যায়। সে তার নিঃসঙ্গ সময়গুলোতে প্রায়ই আমার অফিসে এসে কাটাতো। ওর সব কথা আমার জানা নেই। সব মানুষেরই হৃদয়ের কিছু গোপণ সুখ দুঃখ থাকে।  তা শুধু জানে সে নিজেই । অনিমেষেরও তেমন সুখ দুঃখ ছিলো। কিছু আমাকে বলতো। আবার কিছু বলতোনা।

তখন ফেসবুক এতো জনপ্রিয় ছিলোনা। ইয়াহু ম্যাসেঞ্জার জনপ্রিয় ছিলো। ও তার স্ত্রীর সাথে প্রায়ই ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং করতো। টেলিফোনেও কথা বলতো। ও তার স্ত্রীকে দেশে চলে আসতে বলতো। কিন্তু ওর স্ত্রী সে কথা শোনে নাই। ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে থেকে যায় ঐদেশেই । এতে করে অনিমেষের ভিতরে হতাশা বিরাজ করতো।

অনিমেষ থাকতো মোহাম্মদপুরে ওর শ্বশুরালয়ে। ওখান থেকেই প্রায়ই উত্তরায় আমার অফিসে চলে আসতো। আমার অফিসে ইন্টারনেট সুবিধা ছিলো, এক্সট্রা একটি  কম্পিউটার ছিলো, এথানে বসে বসে ও তার নিঃসঙ্গ সময়গুলো পার করতো। কখনো আমার সাথে গল্পগুজব করে, কখনো চ্যাটিং করে, কখনো একেরপর এক সিগারেট খেয়ে।

একদিন অনিমেষ এলো দুপুরের পরে। খুব বিধ্বস্ত চোখ মুখ ওর। সম্ভবত রাতে ঘুমায়নি। ওকে বললাম - কি হয়েছে তোমার?
অনিমেষ :  মহুয়া সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে আর এদেশে আসবেনা।
আমি :  আসতে চাচ্ছেনা কেন?
অনিমেষ :  দুইটি মোহ তার।
আমি : কি?
অনিমেষ : এক. স্বপ্নের দেশে থাকবার মোহ। আরেক. ভারতীয় এক রাজস্থানী যুবক।
আমি :  সত্যিই দুঃখের কথা।
অনিমেষ :  কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে ইচ্ছা করে।

অনিমেষের বিষন্ন মুখ দেখে মনে হতো, এই মুখে কতোকালের দুঃখ ছেয়ে আছে। চোখ দেখে মনে হতো, এই চোখ নির্ঘুম হয়ে থাকে সারারাত। ও ওয়াইন খেতে চাইতো। আমি বলতাম -- এইসব না। জীবন তো থেমে থাকবেনা। জীবন চলবে জীবনের মতো করেই। দেখো, কি হয়? কোনো স্বপ্ন সুখ ফিরে আসতেও তো পারে জীবনে।

অনিমেষের মুখেই শোনা যাক, অনিমেষের কথা। ' চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলাম অনেক ক্ষণ। ঘুম আসেনা। ভাবছিলাম মহুয়ার কথা। তখন শম্ভুগঞ্জ যেতে ফেরী পার হতে হতো। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, ব্রহ্মপুত্র তীরে ফেরী পারাপারে। আমি চেয়েছিলাম জলের দিকে। মহুয়া তাকিয়েছিলো আকাশের নীলে। তারপর দুইজনের চোখ দুুজনের দিকে। হঠাৎ ব্রহ্মপুত্রের সব জল যেন রোদ্রের আলোয় ঝিলমিল করে উঠলো।

প্রথম কথা ছিলো মহুয়ারই। বলেছিল -- আপনার জল ভালো লাগে বুঝি?
আমি বলাছিলাম :  জল এবং আকাশের নীল আমি একসাথে দেখি।
তারপর ব্রহ্মপুত্রের জল বেশী দূরে গড়তে দেওয়া হয়নি। ময়মনসিংহ রামকৃষ্ণ মঠের এক ব্রহ্মাচারী আমাদের বিয়ে পড়ান। আমাদের প্রথম বাসর হয়েছিল মঠের এক ভাঙা টিনের চালের ঘরে। জীবন আনন্দের হয়, আত্মাও জেগে ওঠে পরমানন্দে, যদি ভাঙা ঘরের বাইরে থাকে ভরা জ্যোৎস্নার রাত।

আজ কোনো আলোর ধারা বইলোনা কোনো দিগ থেকেই। নুরজাহান রোডের বাড়িটির দোতলায় আমার থাকার রুমটিতে সব আলো নিভে দিয়ে অন্ধকার করে রেখেছিলাম সন্ধ্যা রাতেই। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছিলো। একবার মনে হয়েছিল, জীবনের সমস্ত ভার আজ রাতেই  হালকা করে ফেলবো। আবার ভাবলাম, জীবন তো নদীর বাঁকের মতো। এক বাঁকে পলিমাটি ভাঙ্গে, আরেক বাঁকে বালিয়ারি। এই বাঁকে আছে হয়তো খরস্রোতা জল, আরেক বাঁকে যেয়ে দেখতে পাবো সব স্রোত থেমে গেছে।

প্রথম যেদিন মহুয়াকে নিয়ে নিউইয়র্কে হাডসন নদীর পারে নিয়ে গিয়েছিলাম, হাডসনের জল দেখে মহুয়া সেদিন বলেছিল -- 'তুমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, আমার শহর ময়মনসিংহে। আমার এই শহর ভালো লাগেনা। এই নদী ভালো লাগেনা। এখানকার আকাশে কোনো নীল নেই। বিদ্যাময়ী স্কুলের সহপাঠীদের কথা আমার মনে হয়। স্টেশনে যেয়ে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে গরম চা খেতে ইচ্ছা করে। ঘুরতে ইচ্ছা করে তোমাকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে।'

অনিমেষ রায়ের জীবন স্রোত থেমে গিয়েছিল জীবনের আরেক বাঁকে। একটানা একবছর অনিমেষ আমার কাছে আসে নাই। আমি ওর শ্বশুরবাড়িতে খোঁজ নিয়েছিলাম, তারা বলেছিলো-- অনিমেষ একদিন সন্ধ্যায় ওর ব্যাগটি নিয়ে যে বেড়িয়ে গেলো। তারপর ও আর ফিরে আসে নাই । তারও এক বছর পর অনিমেষ আমার কাছে ফিরে এসেছিল। প্রথম দেখে আমি ওকে চিনতেই পারিনি। মুখে বড়ো বড়ো দাঁড়ি। সব সুদর্শন হারিয়ে গেছে ধূসর মেঘের আড়ালে। আমি ওকে বলি : এতোদিন কোথায় ছিলে?
অনিমেষ :  ময়মনসিংহে।
আমি :  ওখানে কোথায়, কার কাছে ছিলে?
অনিমেষ :  রামকৃষ্ণ মঠে।
আমি :  ওখানে কেন?
অনিমেষ :  আমি ঐ মঠের একজন ব্রহ্মাচারী।
আমি :  তোমার এই দশা কেন? কেন তোমার এই সন্নাস জীবন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে জগতের যতো দুঃখ তোমার চোখে মুখে লেগে আছে।
অনিমেষ :  না আমি ভালোই আছি। আমার আছে আশ্রম। আমার আছে  আনন্দলোক। যেখানে কোনো মহুয়া বনের সুঘ্রাণ নেই। '

অনিমেষ আমার সাথেই দেখা করার জন্য ঢাকা এসেছিল সেইবার। আমি ওকে সেধেছিলাম একটি দিন আমার এখানে থেকে যেতে। কিন্তু ও থাকেনি। ঐদিনই সে ফিরে চলে যায় রামকৃষ্ণ মঠের আশ্রমে। ও চলে যাবার পর মনে হয়েছিল, যে প্রেম আর যে স্বপ্ন দিয়ে অনিমেষের জীবন শুরু হয়েছিল, সে স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে হঠাৎ ঈষাণ কোণ্ থেকে আসা এক ঝড়ে।

কি এক অবহেলায় কয়েক বছর আমি আর কোনো খবর রাখিনি অনিমেষের। একবার খুব মন চাইলো, ওকে একটু  দেখতে। চলে যাই তাই ময়মনসিংহে রামকৃষ্ণ মঠের আশ্রমে । ওখানে যেয়ে জিজ্ঞাসা করি অনিমেষ রায়ের কথা। তারা আমাকে প্রাঙ্গনের একটি ভাঙ্গা টিনের ঘর দেখিয়ে বললো -- ঐ যে ঘরটি দেখছেন, ওটাতেই অনিমেষের বাসর ঘর হয়েছিলো। এক হেমন্তের পূর্ণিমা রাতে ঐ ঘরের ধর্নাতে ফাঁসি দিয়ে সে আত্মহত্যা করে।' মৃত্যুর তারিখ মিলিয়ে দেখলাম আমার সাথে অনিমেষ দেখা করতে গিয়েছিল যেদিন, সেই দিনই ছিলো সেই রাত। আর এই রাতই ছিলো ওর বিয়ের রাত।

হাডসন নদীর তীরে কোনো এক রাজস্থানী যুবকের হাত ধরে ঘুরছে হয়তো মহুয়া। দেখছে সেখানে নিস্তব্ধ নদীর জল, দেখছে সেখানকার নীল আকাশ। শুনছে ডানা মেলা গাংচিলদের গান। কিন্তু কার জন্য উড়েছিলো সেদিন অনিমেষ রায়ের দেহের ছাই ভস্ম ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে। সে খবর কেউ জানেনা। মহুয়াও না।



৩৭.         আকাশ প্রদীপ জ্বলছে

তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবেমাত্র স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পূর্ণ করেছি। কোথাও কোনো চাকুরী হয় নাই। হলেই থাকি। আমার এক পরিচিত বন্ধুর রেফারেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের গবেষণা কাজে সহায়তা করার জন্য সাময়িক ভাবে তাঁর ওখানে যোগ দেই। বান্দরবানের শঙ্খ নদীর তীরে বসবাসরত মানুষদের আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক জীবন ধারার উপর উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। আমাকে এ কাজের জন্য ওখানে এক মাসের মতো থাকতে হবে।

আমি চলে যাই বান্দরবানে। ছিমছাম ছোট এই পাহাড়ি শহরের একটি পুঞ্জিতে এক বৃদ্ধার বাড়িতে এক মাসের জন্য একটি রুম ভাড়া নেই। বৃদ্ধার দশ বারো বছরের একটি  নাতি ছাড়া আর কেউ ছিলোনা। স্বামী আগেই গত হয়েছিল। ছেলে, ছেলে বউ দুজনেরই অকাল মৃত্যু হয়েছে। একমাত্র নাতিকে নিয়েই সে এই বাড়িতে থাকে। আমি এখানে নিজেই টুকটাক রান্না করে খেতাম। আবার মাঝে মাঝে রাস্তার উপরে  কুসুমেন্দু মং এর পাতার ছাউনির হোটেলেও খেতাম।

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা উচ্ছল ছলছল এক তরুণ। হঠাৎ এমন নৈসর্গিক জায়গা পেয়ে উচ্ছসিত হয়ে যাই। পাহাড়, বনরাজি, মানুষ আর নদীর কাছে আমার সকল বিমুগ্ধতা বিলিয়ে দেই। প্রথম দিনই আমি হাটতে হাটতে চলে যাই শঙ্খ নদীর তীর ধরে পাইনছড়াতে। আঁকাবাঁকা সর্পিল বনপথ ধরে যখন একাকী চলছিলাম, দেখি লালচে একটি ভালুক হাটছে শঙ্খ নদীর তীর ধরে। আবার দেখি একটি গয়াল বন থেকে বের হয়ে নদীতে জল খেতে যাচ্ছে। পথের পাশে নাগলিঙ্গম গাছে কতোগুলো হনুমান এ ভাল ও ডালে লাফালাফি করছে। এসবই দেখে আমি মুগ্ধ হই। চলতে চলতে পথে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি আকাশের নীল।  অরণ্য, পাহাড়,পাখপাখালি, নদী, জীবজন্তু -- এসব দেখার মুগ্ধতা নিয়েই আমি এই বনভূমিতে কাজ করতে থাকি।

আমার উদ্দেশ্যই ছিলো এখানকার মানুষদের জীবন যাত্রাকে দেখা, তাদের জীবন আচার, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় উৎসব পর্যবেক্ষণ করা। এই এলাকা বা পুঞ্জীটি ছিলো মারমা উপজাতীয় প্রধান। আমি দেখছিলাম এইসব মানুষদেরই জীবন। তাদের প্রতিদিনের হাসি কান্না সুখ দুঃখ।  এদের সাথে কথা বলে আমার প্রশ্ন সম্পর্কিত উত্তরগুলো টুকে নিতাম নির্দিষ্ট প্রশ্নমালায়।

একদিন পানছড়াতে যাবো বলে শঙ্খ নদীর পারের পথ ধরে হেটে যাচ্ছিলাম।  হাটতে হাটতে পথে পা আমার থেমে যায়। হঠাৎ কেন এই পথের মাঝে থেমে যাওয়া? জলের দিকে তাকিয়ে দেখি তীব্র স্রোত বয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। সেই নিঝুম নিরালায় মন আমার উদাস হয়ে উঠলো। বাসা থেকে চলে এসেছি তখন অনেকটা দূর। ভাবনায় কিছু স্বপ্নের মৃত্যু হতে দেখলাম। মন খারাপ হয়ে গেল। পথ চলতে আর মন চাইলো না। মনে হচ্ছিল, যে মায়াবি চোখ আমি দেখে এসেছিলাম ঘর থেকে বের হওয়ার সময়। সেই মলিন চোখ কি কাঁদছে কারোর জন্য? মন চাইলো, ফিরে যাই ঘরের দিকেই। দেখি যেয়ে ঐ মেয়েটিকে আবার।

সত্যি সত্যি ফিরে এলাম বাড়ির দিকে। কাঠের দোতলার বারান্দায় দাড়ানো যে মেয়েটিকে দেখে গিয়েছিলাম, সে তখন আর সেখানে দাড়ানো নেই। আমি চলে আসি আমার রুমে। ঢাকা থেকে আসার সময় কিছু বই নিয়ে এসেছিলাম। সেই বইগুলো থেকে পড়ছিলাম যাযাবরের দৃষ্টিপাত। পড়তে পড়তে যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকে পড়া শুরু করি -- 'পরিহাসকে মনে করেছি প্রেম; খেলাকে ভেবেছি সত্য। কিন্তু আমি তো একা নই। জগতে আমার মতো মুর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত। তাদের , ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গান, শিল্পী অঙ্কন করেছেন চিত্র, ভাস্কর পাষাণখণ্ডে উত্কীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা ।'

পড়তে পড়তে বুকের উপর বই রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সারা দিনের কোনো ক্লান্তি ছিলনা আজ। তবুও ঘুমালাম। জীবনের শুরুতে নাকি মানুষ বেশি করে স্বপ্ন দেখে। ঘুম ভাঙ্গার পর আজ কোনোই আফসোস নেই আমার। কোনো স্বপ্ন আসেনি আজ। আমিতো দেখতে পারতাম, পাশের বাসার ঐ মারমা মেয়েটিকে। ঐ যে তার দুঃখি দুঃখি চোখ, পরনে ছিলো সাদা কালো চেকের থামি। বুকে বাঁধা ছিলো রাংপাই। বয়স তার মধ্য তিরিশ। সে চেয়ে দেখে নিরব নির্ঝরে দুরের পাহাড়ের ঝর্ণাধারা। কখনো দেখে কি সে ধূসর মেঘ পাহাড়ের গায়ে। আমি প্রথম দেখায় বুঝতে পেরেছিলাম এই মেয়ের চোখের ভিতর শঙ্খ নদীর নিস্তব্ধ জল ভরে আছে।

বাইরে বের হবো বলে আজ বিকেলে পরিপাটি কাপড় চোপড় পড়ি। রুম থেকে বেরুনোর সময় বৃদ্ধা আমাকে বলছিল -- তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা তো?
আমি :  না মাসি।
মাসি :  কোনো কিছু অসুবিধা হলে বলবে আমাকে।
আমি :  আচ্ছা। বলবো।
এই বৃদ্ধাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, তার মুখে দেখেছিলাম আমার মায়ের প্রতিরূপ। যে কয়টি দিন ছিলাম এখানে সে জানতে পারেনি , তাকে দেখতে লাগে আমার মায়ের মতোন।

ঘর থেকে যখন বের হচ্ছিলাম, তখন এই শৈল শহরে সন্ধ্যা নামছিল। বনে বনে পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। অস্তমিত সূর্যের বিচ্ছুরিত লাল আভা পাহাড়ের উপর দিয়ে, বৃক্ষ রাজির ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম। স্বর্গীয় এই সন্ধ্যা আলোয় খুব ইচ্ছা হলো ঐ মেয়ের মুখখানি দেখবার। আস্তে আস্তে হেটে আসছিলাম তাই ঐ বাড়ির সামনে দিয়ে। পৃথিবীর সমস্ত সৌভাগ্য যেন ঈশ্বর আমাকেই দিল। সে দাড়িয়ে আছে আমারই পথের দিকে। কেন যেন কষ্ট পেলাম তাকে দেখে । আজকের এই সন্ধ্যার মেঘমালা তার মুখের গভীর দুঃখ ছায়াকে একটুও সরাতে পারেনি।

শহরের উঁচুনিচু পথ ধরে একাকী হাটছিলাম। মনটি কেমন যেন উড়ো উড়ো লাগছিল। দেখি এক জায়গায় একটি ইস্কন মন্দিরে কীর্তন হচ্ছে । অনেকগুলো নারী পুরুষ বসে শুনছে সে গান। আমি ওদের মাঝে যেয়ে বসে পড়ি। সন্নাসী জাতীয় কয়েক লোক গাইছিল তখন--
'অঙ্গ পুলকিত, মরম সহিত, অঝরে নয়ন ঝরে।
বুঝি অনুমানি, কালা রূপ খানি,
তোমারে করিয়া ভোরে।।
দেখি নানা দশা, অঙ্গ যে বিবশা,
নাহত এত বড় ভারে।।

কিছুক্ষণ কীর্তন শুনে  চলে যাই কুসুমেন্দুর হোটেলে। কুসুমেন্দুকে বলি :  আজ তোমার মেনু কি?
কুসুমেন্দু বলে, লইটকা শুটকি মাছ, আর বন মোড়গের তরকারি। আমি দুটোরই অর্ডার দেই।

একদিন মাসির নাতি বিজুকে ডেকে বলি --  বিজু, পাশের বাড়ির ঐ যে মেয়েটা প্রতিদিন একাকী বারান্দায় দাড়িয়ে থাকে, ওর নাম কি?
বিজু   :  আনা ফুফুর কথা বলছো? উনি আমার
             সম্পর্কিত ফুপু হয়।
আমি  :  জ্বী বিজু। পুরো নাম বলো।
বিজু   :  আনাচিং মারমা।
আমি  :  কি করে সে?
বিজু  :   কিছু করেনা।
আমি  :  তোমার ফুপির বিয়ে হয়নি?
বিজু  :   হয়েছিল। ফুপা মারা গেছে অনেক আগে।

পরে মাসির কাছে থেকে জেনেছিলাম, আনাচিং এর বিয়ের কয়েকদিনের মাথায় মাত্র তিন দিনের জ্বর ভোগের পর তার স্বামী মারা যায়। কোনো বাচ্চা নেই। সেও নাকি দশ বারো বছর হয়ে গেছে। তারপর তার আর বিয়েও হয়নি। মারমাদের গোত্রীয় নিয়ম অনুযায়ী বিধবাদের বিয়ে করার আর অনুমতি নাকি দেওয়া হয়না।

আনাচিং সম্পর্কে আরো কিছু জেনে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি যে, সে তার বৈধব্য জীবনে বাড়ি থেকে কোথাও বের হয়না। কারো সাথে কোনো কথা বলেনা। বিশেষ করে পুরষদের সাথে। সে দেখতে ঐ পুঞ্জীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিলো। কোনো প্রকার সাজহীন মুখ তার বনভূমির নব কিরণের আলোর দ্যূতি ছড়ায় শঙ্খ নদীর পাড়ের আকাশে বাতাসে। সপ্তাহে প্রতি রবিবারে সে একবারই বের হয়, যায় তাজিংডং পাহাড়ের স্বর্ণ মন্দিরে। মহামতি বুদ্ধের স্বর্ণ মূর্তির পাশে বসে থাকে সে এবং ধ্যান করে।

সেদিনের বিকেল ছিল শান্ত ও সৌম্যের। সকাল থেকেই সোনালি রোদ্দুর ঝিলমিল করছিল বনভূমির বৃক্ষ রাজির পাতায় পাতায়। আমার মন বড়ই চঞ্চল হয়ে উঠলো। আমি চলে যাই তাজিংডং পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত স্বর্ণ মন্দিরে। মন্দিরের বাইরে নিজ পাদুকা জোড়া রেখে মন্দিরে প্রবেশ করি। দেখি আনাচিং বুদ্ধ মূর্তির পাশে বসে একাগ্রচিত্তে ধ্যান করছে। আমি যেয়ে ওর পাশে বসি এবং ধ্যানে মগ্ন হই। আনা'র ধ্যান করা শেষ হলে তাকায় আমার দিকে। আমিও তাকাই আনাচিং এর দিকে। হঠাৎ মন্দিরের ভিতরে সমস্ত জপমালা যেন থেমে গেল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কোনো হাসি নেই। বুদ্ধের চোখও যেন বিষন্ন হয়ে দেখছে আমাদেরকে। আনাচিং এর চোখ দেখে মনে হলো হাজার বছর আগে কপিলাবস্তুুতে কোনো এক আম্রপালি গুমরে গুমরে কেঁদে স্থির করে রেখেছে এই চোখ। মন্দিরে মহামতি বুদ্ধের মূর্তির সামনে ওকে বলতে ইচ্ছা করলো, এই চোখে তুমি এতো জল ভরে রেখেছো কেন? কিছু জল রেখে দিতে পারো শঙ্খ নদীতে। আর কিছু দিতে পারো আমাকে।

আজ রাতে আর কুসুমেন্দু হোটেলে খেলামনা। অন্ধকারে হেটে হেটে ঘরে এসে আলো জ্বালাই। মাসি এসে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি কি খেয়েছো?
আমি :  না।
মাসি :  খাবেনা?
আমি :  না।
একটু পর দেখি, মাসি জুম ফসলের কিছু খাবার থালিতে করে এনে রেখে দিল। বললো -- খেয়ে নিও।

মাসির দেওয়া কিছু খাবার খেয়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুমাবার চেষ্টা করলাম, ঘুম আসেনা চোখে। পথে যেতে যেতে দেখেছিলাম আজ কতো বৃক্ষের ছায়া এসে পড়েছিল পথে। আনাচিং এর জীবনের এই পথে কোনো বৃক্ষের ছায়া কি আর পড়েনি? আমিতো হতে পারি তার শীতল বৃক্ষের ছায়া! আবার আলো জ্বালিয়ে দেই। আবার বসে থাকি। জানালা খুলে দেখি, দূরের পাহাড়ের গায়ে আঁধার। জীবন এত শূণ্য মনে হয় কেন?
মনে পড়ছিলো সেই শিলংয়ে লাবন্য অমিতের কথা --
আকাশে সোনার রঙের উপরে চুনি গলানো, পান্না গলানো আলোর আভাসগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাতলা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সুগভীর নির্মল নীল, মনে হয় তার ভিতর দিয়ে যেখানে দেহ নেই শুধু আনন্দ আছে সেই অমর্ত্য জগতের অব্যক্তধ্বনি আসছে। '

আস্তে আস্তে বান্দরবানের দিনগুলি আমার শেষ হয়ে আসে। এরপর একটি রবিবার পেয়েছিলাম স্বর্ণ মন্দিরে যাওয়ার। গিয়েছিলামও কিন্ত দেখা মেলেনি আনাচিং এর। সন্ধ্যার মেঘমালায় কখনো কখনো তার দেখা পেতাম ঐ বাড়ির কাঠের দোতলায়। মাঝে মাঝেই এলোচুলে ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকতো সে। পরনে থাকতো সাদা থামি আর রাংপাই। কেন জানি মনে হতো, ঐ চোখ খুঁজতো ঝাঁকড়া চুলের কোনো এক তরুণকে। যে তরুণ কখনো বলেনি তাকে 'আমি তোমাকে ভালবাসি।' কিন্তু তার জন্য কেন অন্তর দাহ হয়।  আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যায় কাঁচা সোনা। যে সোনা পোড়ানোর দাহে তপ্ত হয়েছিল এক বিধবা আনাচিং এর বৈধব্য মন।

সেদিন ছিলো প্রবারণা পূর্ণিমা। আমারও শেষ দিন ছিলো বান্দরবানে। প্রবারণা পূর্ণিমায়  বৌদ্ধ নরনারীরা শুচি শুভ্র হয়। সুন্দর পোশাকে বৌদ্ধ বিহার সমবেত হয়।  বুদ্ধকে পূজা দেয়। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এদিন ঘরে ঘরে ভাল রান্না হয়। সন্ধ্যায় হয় ফানুস উড়ানো উৎসব। ফানুস উড়ানোর উদ্দেশ্য হলো আকাশে ভাসমান গৌতমের পবিত্র কেশধাতুকে প্রদীপ দিয়ে বন্দনা করা হয়। আশ্বিনের সেই পূর্ণিমার আকাশে মোহনীয় আকাশ প্রদীপ জ্বলে ওঠে।

মাসি অথবা বিজুর মাধ্যমে আমার চলে যাবার কথা শুনেছিল হয়তো আনাচিং। আজকের এই প্রদীপ জ্বালানো রাতে আনাচিং চেয়েছিল আমাকে। আলো আঁধারের সন্ধ্যায় যখন হাঁটছিলাম ঐ বাড়ির পাশ দিয়ে, হঠাৎ উপর থেকে উড়ে এলো একটি ছিন্ন কাগজ। তাতে লেখা ছিল --' তুমি তাজিংডং পাহাড়ে দেবতা পুকুর পারে চলে যেও। '

আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার সন্ধ্যা রাত। ফানুস উড়ানোর উৎসব হচ্ছে। আকাশে আকাশে আকাশ প্রদীপ জ্বলছে। উৎসবের এমন রাতে আমি দুরুদুরু পায়ে হাটতে থাকি জ্যোৎস্না তলার নীচ দিয়ে উপত্যকার পথ ধরে তাজিংডং পাহাড়ের দিকে। চারদিকে বুঁনো ফুলের গন্ধে উতলা হয়ে আছে বাতাস। জ্যোৎস্নার আলোর ছটা ঝরে পড়ছে পথে পথে। এই স্বর্গীয় মায়াময় পথে হেটে হেটে পৌঁছে যাই দেবতা পুকুর পারে।

চারদিকে নিরব নির্জন। কোনো মনুষ্য নেই। মনুষ্য কর্তৃক কোনো  আলো জ্বালানো নেই। আছে পূর্ণিমার চাঁদ। আর দূরে আকাশ প্রদীপ জ্বলছে। ঠিক পুকুর পারের ওপাশে একটি নারী মূর্তি দেখা গেল। কাছে এগিয়ে যেয়ে দেখি, আনাচিং। আজো পরনে সেই সাদা থামি। আর বুকে বাঁধা রাংপাই। আমি ওর মুখখানির দিকে একবার তাকাই। এই মুখ কতো সন্ধ্যার মেঘমালায় দেখেছি দূর থেকে। আজ এই পূর্ণিমার আলোয় দেখছি কাছে থেকে। কিযে ভালো লাগছিল আমার! আনাচিং খুব কাছে এসে আমার বুকে ওর কপাল ঠেকিয়ে বলছিল -- তুমি কেন আমাকে ভালোবাসলে? এই জীবনে তুমি আমাকে তো পাবেনা। '

আমার বুক থেকে আনাচিং ওর কপাল উঠিয়ে নেয়।  দেবতা পুকুর পার ধরে সে হেটে হেটে চলে যায় পাহাড়ের ঢালের দিকে। আমাকে বলে, ' তুমি একটু এখানে দাড়াও।' আমি ওর কথায় দাড়িয়ে থাকি। বুঁনো ফুলের গন্ধ আর বাতাসে ভেসে আসছিলনা। হঠাৎ পূর্ণিমার চাঁদ মেঘে ঢেকে গেল। কেমন যেন আঁধার নেমে এলো চারদিক থেকে। তারপর অন্ধকারে আনাচিংকে আর দেখতে পাচ্ছিলামনা। কাছে যেয়ে দেখি আনাচিং কোথাও নেই। নীচে তাকিয়ে দেখি, গিরি খাদ। খাদের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা শঙ্খ নদী। দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, আকাশ প্রদীপ জ্বলছে।



৩৮.       পিঞ্জিরা

হুইল চেয়ারের হাতল ঘুরিয়ে বৃদ্ধ নাজির আলি নিজেই আস্তে করে এগিয়ে যায় ঘরের এককোণে রাখা পুরনো লোহার পিঞ্জিরাটির কাছে। প্রায় ষাট বছরের পুরনো এই পিঞ্জিরাটি এতবছরে জং ধরে ক্ষয়ে গেছে।  নাজির আলি তার অশিত হাত দিয়ে পিঞ্জিরাটি ধরে । যেন পরম মমতায় বার বার স্পর্শ করে দেখছিল পিঞ্জিরাটির দরজা, শিকল এবং শিকগুলি।

তখন সে একুশ বাইশ বছরের টগবগে যুবক। ঘরে নববিবাহিতা পরমাসুন্দরী বালিকা বধূ। একদিন রাতে গল্পের ছলে তার স্ত্রী আবদার করল --- তাকে একটি ময়না পাখি কিনে এনে দিতে হবে। নাজির আলি পরেরদিনই বাজার থেকে একটি ময়না পাখি কিনে এনে দেয়। তার স্ত্রী পাখিটিকে পেয়ে যারপরনাই আদর যত্ন করতে থাকে। তিনদিন পর তার স্ত্রী এসে বললো, পিঞ্জিরা থেকে কখন পাখিটি উড়ে চলে গেছে, জানিনা। '
তার বালিকা বধূ আবারও বায়না ধরল, ময়না পাখি কিনে দিতে হবে। নাজির আলি আবারও তার স্ত্রীর জন্য ময়না পাখি কিনে এনে দেয়। এবারও তিন দিন পর তার স্ত্রী এসে বললো, কালরাতে কখন পিঞ্জিরা থেকে পাখিটি উড়ে চলে গেছে, জানিনা। এই বলে সে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।

স্ত্রীর এইরকম কান্না দেখে নাজির আলি আবারও বাজার থেকে একটি ময়না পাখি কিনে এনে দেয়। এবার তার স্ত্রী ময়না পাখিটিকে সারাক্ষন কাছে কাছে রাখল। রাতে ঘুমাবার সময়ও সে পাখিটিকে খাটের পাশে এক কোণে রেখে দেয়। যেন উড়ে চলে না যায়।

একদিন গভীর রাতে তার স্ত্রী দেখতে পায়, তার স্বামী চুপি চুপি পিঞ্জিরাটির দরজা খুলে ময়না পাখিটিকে ছেড়ে দিচ্ছে। ইহা দেখে সে তার স্বামীকে বলে -- ' তুমিই তাহলে পাখিগুলোকে ছেড়ে দিতে? ' নাজির আলি তার অবুঝ বালিকা বধূকে বুকে টেনে নিয়ে পরম আদর করে বলতে থাকে --- ' পাখিকে খাঁচায় আটকে রাখতে নেই। ওরা খোলা আকাশে উড়তে চায়। এই যে ঘর!  এই ঘরে তোমাকে যদি সারাক্ষণ আটকে রাখি, তোমাকে যদি বাইরে বের হতে না দেই, তোমার কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই তোমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। '

ঈশ্বর তখন কী ভেবে রেখেছিল নাজির আলি তা জানতে পারেনি। সে বেশি দিন তার স্ত্রীকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখতে পারে নাই। অকালেই এই ঘর ছেড়ে, এই সংসার ছেড়ে সে না ফেরার দেশে উড়ে চলে যায়।

এরপর ষাট বছর চলে গেছে। এই ঘরের ভিতরেই জীবনের বেশির ভাগ বছর নাজির আলি একাকী কাটিয়েছে।  বিছানায় শুয়ে থেকে আর হুইল চেয়ারে বসে দিনগুলি যেন তার শেষ হয়না। হতভাগা নাজির আলি তাই মুক্তি খূঁজে এই ঘর থেকে বের হবার। ইচ্ছা হয় তাঁর এই পিঞ্জিরা থেকে বের হয়ে দূরে কোথাও উড়ে চলে যাবার।



৩৯.            নিউ স্টার অপেরা

মনটা কখনো কখনো ভবঘুরে মন হয়ে ওঠে। কোনো কিছু ভালো লাগেনা। কারোর মায়াও কাছে টানেনা। কিন্ত পথ আমাকে টেনে নিয়ে যায়। উদাস হয়ে ঘুরতে মন চায় পথে পথে, খেয়া ঘাটে। নদীতে নদীতে, নৌকায় নৌকায় । মন চায় কোনো সার্কাস দলের কিংবা কোনো যাত্রা দলের গায়েন হতে। যদি রাত্রি নিশীথে মঞ্চের পালায় গান গাইতে পারতাম!

অনেক বছর আগে এক শ্রাবণ বর্ষা মৌসুমে আমাদের গ্রামের হাটের পাশে সার্কাস পার্টি এসেছিলো। নাম ' নিউ স্টার সার্কাস অপেরা '। প্রায় একমাস ছিলো তারা আমাদের গ্রামে। তখন ছিলো আমার তারুণ্যের প্রথম প্রহরের সময়। প্রায় প্রতিদিন যেতাম, ঐ সার্কাস দেখতে। কি প্রবল আকর্ষণে টেনে নিয়ে যেতো আমাকে। সার্কাস দেখানোর পাশাপাশি গান হতো, নাচ হতো, কৌতুক হতো, হাতির খেলা হতো সেখানে।

ঐ সার্কাস দলে তেরো চৌদ্দ বছরের একটি বালিকা এসেছিলো। সে ঘাগরা পড়ে নাচতো। গানও গাইতো আবার সার্কাসের বিভিন্ন শারীরিক কৌশল ও খেলা দেখাতো সে। ওর এই চৌকস পারফরমেন্স আমাকে ভীষণরকম মুগ্ধ করেছিল। ঐ মেয়ের অদ্ভুত সব গুণ দেখে সেদিনের এক গ্রাম্য সরল বালক সার্কাসের ঐ বালিকার ভক্ত হয়ে উঠেছিল।

তখন সেই বর্ষার দিনে নৌকায় করে স্কুলে যেতাম। ছলাৎছলাৎ বৈঠার শব্দ হতো জলে। কাঠের পাটাতনের উপর চুপচাপ বসে থাকতাম। জলের নুপুরে ঐ সার্কাস বালিকার ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পেতাম। মরা গাঙে তখন বানের জলে ভরে যেতো। পামোসা মাঝি জাল পেতে রাখতো মাছ ধরার জন্য। পাটের জাঁকের উপর বসে থাকতো ধবল বক। মাথার উপরে উড়তো গাংচিল। ওদের চ্রিহি চ্রিহি ডাকের মধ্যে অামি শুনতে পেতাম সার্কাসের ঐ বালিকার গান আর যন্ত্রী দলের খুঞ্জরীর শব্দ।

মন প্রফুল্ল হতো কিনা বুঝতে পারতাম না। পুকুর পারের কদম গাছ থেকে কদম ফুল ছিঁড়ে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিতাম। উজান থেকে নৌকাগুলো বাদাম তুলে চলে যেতো দক্ষিণের গঞ্জে। মাঝি মল্লারও গান গাইতো ভাটিয়ালী সুরে সুরে। কিন্তু সব গান আর সব সুর থেমে যেতো সার্কাস দলের ঐ বালিকার গানে। জলে কদম ভাসানোর সময় মনে হতো, এর একটি ফুলতো নিতে পারতো ঐ দিগবালিকা।

কাউকে কিছুই বলা হয়নি আর। ভাবতাম, লেখাপড়া করে কি লাভ হবে? তারচেয়ে আমি যদি গায়েন হতে পারতাম। যদি যোগ দিতে পারতাম ঐ সার্কাস দলে। জীবনটা কতো সুন্দরই না হতো। বালিকাও তো শুনতো আমার গান! দ্বৈত সঙ্গীত গাইতাম যাত্রার পালায়। জীবনের স্বপ্নগুলো পূর্ণতা পেতো সার্কাসের আনন্দময় সঙ্গীত নিশীথে।

সেইদিন শ্রাবণ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল। আমাদের বাড়ির রাখাল সমির আলি ছোট নৌকায় করে আমাকে নিয়ে যায় সার্কাস প্যান্ডেলে। হেজাক বাতির আলো জ্বলছিলো ভিতরে চারিধার। যন্ত্রী দলের কেউ একজন ৰাঁশিতে সুর তুললো, তবলায় তাল দিচ্ছিল তবলচি। হারমোনিয়াম বেজে উঠলো। সেদিনও বালিকা গান গাইলো প্রাণ ভরে। নাচলো নুপুরের ঝুমঝুম শব্দ তুলে। প্যান্ডেলের বাইরে ছিলো পূর্ণিমার চাঁদ। নৌকায় আসার সময় বাইরে দেখে এসেছিলাম জ্যোৎস্নায় ভাসছে আকাশ। আমি জানতাম না, সেই রাত ছিলো বালিকার শেষ রাত। জানতাম না সেইটি হবে আমার বালিকার কাছ থেকে শেষ গান শোনার।

পরের দিন দুপুরের পর সার্কাস দলটি বড়ো পানসী নৌকা করে চলে যায় অন্য আরেক ঘাটে। বিকেলে যখন মাঠের ঐ সার্কাস প্যান্ডেলটি দেখতে যাই, দেখি -- সেখানে কোনো সামিয়ানা টানানো নেই। দুই একটি বাঁশের খুঁটি এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। আমার উন্মেলিত চোখ খুঁজেছিল বালিকাকে। দেখতে পেলামনা আজ আর কাউকেই। নিঝুম বাতাসে কান পেতে থেকেছিলাম অনেকক্ষণ, সেদিন আর বালিকার কোনো ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পেলামনা।



৪০.          আমার বসন্ত দিনে

পৃথিবীতে সেই সৌভাগ্যবান যিনি কোনো বালিকার প্রথম ভালোবাসা পেয়েছে কিংবা তার প্রথম ভালোলাগার মানুষ।

গল্পটা এমন।
এক আলস্য ফাগুন দুপুরে একটি চিঠি এলো। বিকেলের রোদ্র ছায়া  তখনো চোখে মুখে লেগে আছে। তরুণ মন তখনো তৈরী হয়নি কোনো স্বপ্নের ঘোরে। পাখি সব করে রব করে রাত্রি পোহায়। প্রতি দিনের জীবন ধারা স্বপ্নেও নেই, যাযাবরেও নেই। জীবনের কোন্ গোপন অলিন্দে কখন কাকে দেখেছিলাম, কখন কাকে ভালোলেগেছিলো তা সবই মনে নেই।

অনেক সময়ই তো ভালো লাগে শ্রাবনের বৃষ্টিধারা। নদীর কূল ধরে হাটতে হাটতে মাঝি মল্লারদের গান শুনতে ভালো লাগে। ভালো লাগে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির। এই সুন্দর পৃথিবীতে এতো সব চমৎকার জিনিস রয়েছে যে, সেসব ভালোলাগার জিনিসকে দেখে শেষ করা যায়না। মনেও রাখা যায়না অনেক কিছু।

কি লেখা ছিলো সে চিঠিতে :

'প্রিয় সুহৃদতম,
আমি যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তোমাকে সদরঘাটের প্লাটফর্মে, রেলিং ধরে দাড়িয়েছিলে তুমি। দেখছিলে বুড়িগঙ্গার জল। হাতে তোমার সিগারেট জ্বলছিলো। সেদিন সন্ধ্যায় ছিলো নদীতে ঝিরিঝিরি হাওয়া। বাতাসে উড়ছিলো তোমার মাথার চুল। আমি তোমাকে অনেক কাছ থেকে দেখেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার দিকে একবারও ফিরে তাকালেনা। এই যে তুমি আমায় একটিবার দেখলেনা। এই অহংকারটি ভালো লাগলো আমার। এর আগে ভালো লেগেছিলো তোমার কবিতা  এবং তোমার আবৃত্তি। এসব তুমি কিছুই জানতেনা। আম্মু আর ভাইয়া ছিলো আমার সাথে। আমি ভাইয়াকে বলে তোমার একটা অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম সেদিন । মনে আছে তোমার? অটোগ্রাফ নেওয়ার ছলে তোমার ঠিকানাও চেয়ে নিয়েছিলাম। বলেছিলাম -- অকেশনে গ্রিটিং পাঠাবো।

তুমি চলে গেলে চাঁদপুরে। আমরা চলে এসেছিলাম বরগুনায়। তারপর মাঝে চলে গেলো একটি বছর। তোমাকে আর কোনো গ্রিটিংস পাঠানো হয়নি। কিন্তু তুমি যে আমার প্রথম ভালোলাগা ছিলে সেটি তুমি জানলেনা। জানলেনা তাই ভালোও বাসলেনা। গত এক বছরে তোমাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখলাম। নিভৃতে বসে বসে তোমাকে ভেবেছি কতো প্রহর। এক অজানা আলোয় তুমি আমার জীবনকে আলোকিত করলে। এই  চিঠিখানা পড়ে তুমি নির্বাক হয়ে বসে থাকবে হয়তো কিছুক্ষণ। একমাত্র আমিই জানি, তোমাকে আমার কতটা ভালোলাগে। আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তার সবটাই তো তোমারই দান। কতোজন ভালোবাসতে চাইলো, কতো বসন্ত পাখি এসে গান শোনাতে চাইলো। কিন্তু তুমিই আমার বসন্ত দিনের গান হয়ে রইলে। বৈশাখী ঝড়ের রাতেও রত্ন কুঁড়ায়েছি আমি । সব ঝড়ের রাতে কুড়ানো রত্ন জমিয়ে রেখেছি তোমায় দেবো বলে। কবে আবার দেখা হবে আমাদের? প্লাটফর্মে দাড়ানো বুড়ি গঙ্গার তীরে দেখা তোমার মুখখানি আজো আমার বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস হয়ে ঝরে পড়ে। ইতি --  সাহানা।'

চিঠিখানি পড়ে সেদিনের সেই বিকেলে দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়েছিল আমারও। চিঠির এ পাতায় ও পাতায় এবং খামের উপর কোথাও সাহানার ঠিকানা খুঁজে পেলামনা। ভেবেছিলাম, পরে হয়তো আবার চিঠি লিখবে, কিন্তু লেখেনি আর।

তারপর আমার জীবন থেকে কতো বসন্ত চলে গিয়েছে।  কতোজনই তো আমার বসন্ত দিনে বসন্তের গান শোনাতে চেয়েছিল। কিন্তু সাহানা নামের সেই মেয়েটি আমার কোনো বসন্ত দিনেই তার কোনো বসন্ত গান শোনাতে আর আসেনি।


৪১.         শুক্লা দ্বাদশীর দিনে

অনেক দিন আগের ফাগুনের এক শুক্লা দ্বাদশী রাতের কথা। তখন আমি পরিকল্পনা কমিশননের একজন তরুণ কর্মকতা। কমিশনের একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন জনাব এম,এ আজিজ। ওনার বাড়ী ছিলো ময়মনসিংহের গফরগাঁও এর নয়াবাড়ী গ্রামে। ব্যক্তিগত জীবনে উনি ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব গিয়াস উদ্দীন খান পাঠানের জামাতা। ওনার বাড়ীটি ছিলো আধুনিক জমিদার বাড়ীর মতো। অনেক কক্ষ বিশিষ্ট্ বড়ো দোতালা বাড়ী। বাড়ীর সামনে ছিলো শান বাঁধানো পুকুর। পুকুরের পাড় আর বাড়ীর সামনে জুড়ে ছিলো ফুলের বাগান। বিভিন্ন রকমের ফুলের সমারোহে পুরো বাড়ীটাই একটা গার্ডেন বলে মনে হতো। তাছাড়া বাড়ীর চারপাশে ফলের গাছও ছিলো।

জনাব এম,এ আজিজ সাহিত্য অনুরাগী, সাংস্কৃতিকমনা, ক্রীড়া অনুরাগী ও ভীষণ রকম আমুদে মানুষ ছিলেন। উনি ছিলেন স্নেহ বৎসল একজন পিতার মতো। অনেক বড়ো কর্মকতা হয়েও আমাদের মতো জুনিয়র কর্মকর্তাদের উনি আপন করে নিতেন। অফিসিয়াল প্রটোকল অতো মানতেননা।  প্রতি ফালগুনের শুক্লা দ্বাদশীর দিনে ওনার বিভাগের একদল ছেলে মেয়ে কর্মকর্তাকে দাওয়াত করে বাড়ীতে নিয়ে যেতেন। দিনব্যাপী গান বাজনা ও আনন্দ হতো। পুকুরে মাছ ধরা আর খানাপিনা তো থাকতোই।

এমনি এক ফাল্গনের শুক্লা দ্বাদসীর দিনে আমরা ঢাকা থেকে দশ বারো জন ছেলেমেয়ে গিয়েছিলাম ওনার বাগান বাড়ীতে।  আমাদের অফিসে একজন মেয়ে কর্মকর্তা ছিলো, ওর ডাক নাম ছিলো জয়িতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বৎসরের জুনিয়র ছিলো। পড়তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেই। মাঝে মাঝেই এই মেয়েটিকে কলাভবনের কোরিডরে কিংবা সেমিনার কক্ষে দেখতাম। কিন্তু কোনো দিন ওর সাথে কথা হয় নাই। অনেক মেয়েদের ভীড়ে এই মেয়েটিকে ভালোই লাগতো। কিন্তু ঐ ভালোলাগা পর্যন্তই। কাকতালীয় ভাবে এই মেয়ে আমার সহকর্মী হয়ে এলো।

অফিসে জয়িতার সাথে প্রতিদিনই দেখা হয়। এখানেও জয়িতা আমার জুনিয়র। পূর্বের বিশ্ববি্দ্যালয়ের রেশ ধরে সে আমাকে ভাই ডাকতো। এবং আপনি সম্বোধন করতো। জয়িতাকে আমি অফিসে প্রতিদিন দেখি । দেখি ওর টানা টানা চোখ, বাঁকানো ভ্রু। লম্বা স্ট্রেইট চুল, মাঝখানে সিঁথি করে পিছনে খোপা বাঁধতো। সুন্দর বাচনভঙ্গীতে কথা বলতো। হালকা পাতলা স্লীম বডি। ভালোই লাগতো জয়িতাকে।

বাড়ীতে এসে শুয়ে শুয়ে এমনি আলসে করে ভাবতাম। মনে হতো এই মেয়েটি যদি আমাকে প্রেম নিবেদন করতো ! কিংবা যদি ওকে ডেকে  বলতে পারতাম- 'জয়িতা, তোমাকে আমার ভালো লাগে, তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে ?' কিন্তু দ্বিধা করতাম। ভাবতাম যদি জয়িতা প্রত্যাখান করে ? যদি মুখের উপর বলে দেয় - 'না'। তাহলে তো আমাকে লজ্জা পেতে হবে। কিন্তু এইটাই মনে হতো আমার, জয়িতাই একদিন আমাকে বলবে- 'আপনাকে আমার ভালোলাগে, আপনাকে আমি ভালোবাসি।'

আজিজ সাহেবের বাগানবাড়ীতে আজ কেবলই আনন্দ। সবাই যে যার মতো আনন্দস্ফূর্তি করছে। কেনো জানি আমার মনটা অতো ভালো লাগছিলো না। পুকুরপাড়ে শান বাঁধানো ঘাটে খুঁজছিলাম জয়িতাকে। একবার মনে হলো জয়িতা গাঁদা ফুলের ঝাঁরে কেচি দিয়ে মালিনীর মতো পাতাগুলো ড্রেসিং করছে। পিছন থেকে আমি ওর সাথে কথা বলি, ওকে বলি- 'ফুল বাগানে তোমাকে মানিয়েছে ভালো।' আজ জয়িতারও কি মন খারাপ ? আমার  সাথে ঠিকমতো কথা বলছেনা যে।

বিকালে আমরা বাড়ীর বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কাজের মানুষেরা নাস্তা আর চা দিয়ে যাচ্ছিলো। এখানেও দেখি জয়িতা নেই। মনে হলো জয়িতা একাকী মন খারাপ করে শুয়ে আছে। একবার মনে হলো ওর রুমে যেয়ে ওকে ডেকে নিয়ে আসি। কিন্তু সবাই আমাকে কি মনে করবে ? এই ভেবে জয়িতাকে আর ডাকা হলোনা।

সন্ধ্যার পর আমাদের সেই কাঙ্খিত সময়টি এলো। আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ উঠলো। পুকুর পারে শান বাঁধানো ঘাটের কাছে বকুলতলায় বেঁতের চেয়ারে আমরা বসে আছি। বাঁশ ঝাঁরের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলো এসে ঝলমলিয়ে পুকুরের জলে পড়ছে। জোনাকীদের আলো ম্লান লাগলেও ভালো লাগছিলো ঝিঁঝিঁ পোকাদের গান।  আমাদের অফিসের শর্মিলী দিদি গান গাইলেন-

'আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ।
যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায় রব আপন কোণে। যাব না এই মাতাল সমীরণে।'

আমাকে সবাই বললো কবিতা আবৃতি করতে। আমি আবৃতি করলাম-

'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে. কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
 আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,. আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,.
এই সংগীত-মুখরিত গগনে. তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে. দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।'

গানে আর কবিতায় খুঁজছিলাম জয়িতাকে। আজ এই জ্যোৎস্না রাতে এতো সুর এখানে, এতো গান এখানে। এতো আলো ঝরছে ঐ চাঁদ থেকে। এতো তারা জ্বলছে দূরের ঐ আকাশে।  আমার মন আকুল হলো জয়িতার কন্ঠে একটি গান শোনার জন্য।  আজ এই রাতে, এই বকুলতলায় জয়িতা কোনো গান গাইলোনা। একাকী এক কোনে কোথায় পড়ে রয়েছ সে।

রাতে খেয়ে আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি, বারোটার দিকে আমরা শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম জয়িতার কথা। চোখে ঘুম আসছিলোনা । বাইরে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছিলো। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজও কানে আসছে। রাত ক্রমেই নিরব নিঃশব্দ হয়ে উঠছিলো। রুমের ভিতর দেয়াল ঘড়িতে রাত দুটো বাজার ঘন্টা বেজে ওঠে।  তারও কিছুক্ষণ পরে বাইরে কার যেনো পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।  কিন্তু দরজায় কোনো কড়া নারার শব্দ হলোনা।  আমি ভয় পেলামনা, উঠে দরজা খুলে দেই। দেখি বাইরে বারান্দায় জয়িতা দাড়িয়ে আছে । ওর পরনে সিল্কের সাদা সালোয়ার কামিজ।  আমি এগিয়ে যেয়ে বলি- 'এতো রাতে তুমি একা, আমার রুমের সামনে।  কেউ দেখলে কি মনে করবে ?'

জয়িতা : দেখলে দেখুক,মনে করলে করুক।
আমি :   তুমি তোমার রুমে যাও। কাল ভোরে না হয় আমরা কথা বলবো।
জয়িতা :  না আমি যাবোনা। আমার ঘুম আসছেনা। চলো আমরা ঘাটপাড়ে বকুল গাছের তলায় গিয়ে বসি।
আমি :  চলো।

জয়িতা আমার হাত ধরলো।  আমরা দু'জন হাতধরেই বকুল তলায় যেয়ে বসি। শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ অনেকটাই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। গফরগাঁও এর এই নয়াবাড়ী গ্রামের সারা প্রান্তর জুড়ে কেবলই জ্যোৎস্নার রোসনাই।  জয়িতা আমার পাশে বসে আছে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে। ওকে দেখতে কিযে ভালো লাগছিলো।  জয়িতা আমার কাধে মাথা রেখে বলছিলো- ' জানো আমি এমনি একটি চাঁদের রাতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই রকম শুক্লা দ্বাদশী চাঁদের রাতে তোমার বুকে মাথা রেখে বলতে চেয়েছিলাম- ভালোবাসি।  ওগো, আজ তোমায় সেই কথাটিই বলছি- 'তোমাকে ভালোবাসি।'

পুকুরপাড়ে গাঁদা ফুলের গন্ধে ভরে উঠেছিলো। রাতের বসন্ত বাতাস বয়ে চলছে। সাথে হাস্নাহেনার সুবাসে আকুল হয়ে উঠেছে পুকুরপারের বকুলতলা। আমি জয়িতাকে বুকে টেনে বলি -- 'আমিও তোমাকে ভালাবাসি।' তারপর আরো কিছু সময় বিমুগ্ধ হয়ে শুয়ে থেকেছিলাম বকুল গাছের নীচে। দখিনা মৃদুমন্দ বাতাসে ঝির ঝির করে বৃষ্টির মত বকুল ফুল ঝরে পড়েছিল আমাদের শরীরের উপর।

ঘাট থেকে ঘরে ফেরার সময় কয়েকটি গাঁদা ফুল ছিঁড়ে তোড়া করে জয়িতা আমাকে দেয়।  জয়িতা চলে যায় ওর রুমে। আমি চলে আসি আমার রুমে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরী হয়ে যায়। ঘুম ভেঙ্গে দেখি বিছানার এক পাশে জয়িতার দেয়া রাতের সেই ফুলের তোড়াটি পড়ে আছে।  দেখে মনটা বেশ খুশী হলো। ফুলগুলো হাতে নিয়ে সুবাসও নেই। চিত্তটা আনন্দে ভরে উঠলো।

বিছানা থেকে উঠে বাইরে আসি।  মনে মনে খুঁজতে থাকি জয়িতাকে।  সবাই ঘুম থেকে উঠেছে। ওঠেনি কেবল জয়িতা।  আরো কিছুক্ষণ পরে জয়িতাকে না দেখে শর্মিলী দিদিকে বলি-  'জয়িতা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি ?'
শর্মিলী দিদি বিস্ময়ে বলে-  ' তুমি এসব কি বলছো ? জয়িতা তো আমাদের সাথে এখানে আসেই নাই।'



৪২.            অচিন পাখি

আমি তখন আমাদের বাগবাটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন স্কুলে তিন পিরিয়ড করার পর বাকি ক্লাসগুলো করতে আর ইচ্ছা করছিলনা। আমার খিদেও লেগেছিল খুব। ভাবলাম বাড়ি চলে যাই। তাই ক্লাসের পিছন দরজা দিয়ে বইগুলো অনেকটা লুকিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিলাম।

আমাদের স্কুল ছিল বাড়ি থেকে আড়াই মাইল দূরে। কাঁচা রাস্তা আর মেঠো পথে হেঁটে স্কুলে যেতে হত। সেদিন ছিল চৈত্রের দুপুর। আমি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঁচা রাস্তা দিয়ে না এসে মাঠ আর ক্ষেতের পাশ দিয়ে মেঠো পথে বাড়ি ফিরছিলাম।

পথে নেমে দেখি, চৌচির করছে মাঠ। কোথাও সবুজ নেই। কোনও ক্ষেতে ফসল নেই। শুধু চাষের মাঠ। ক্ষেত্তগুলোতে পড়ে আছে মাটির শুখনো ছোট বড় ঢিল। রোদ্রে তপ্ত হয়ে যেন আগুন ছড়াচ্ছে। চারপাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই। বিরান এই প্রান্তর পাড়ি দিতে হবে আমাকে একা। সাথে কোনও সাথী নেই। দূরে তাকিয়ে দেখি মিছে পানির ঢেউ বইছে। আসলে সবই ছিল দুপুরের করুণধারা। সবই ছিল মরিচীকা।

হাঁটতে হাঁটতে ঘামতে ঘামতে ক্লান্তি নেমে এসেছিল শরীরে। ধূলির পথে পায়ে পায়ে উড়ছিল ধূলো। পথের শেষ যেন শেষ হতে চাইছিলনা। পা দুটোও কেমন থেমে আসছিল। কোথাও কোনও ছায়াতলে একটু জিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছিল। নির্জন সেই চরাচরে পথের ধারে একটি উন্মুক্ত ঈদগাহ দেখতে পাই। সেখানে একটি আমগাছ আছে। আমি সেই আম গাছের ছায়াতলে যেয়ে দাঁড়াই। দেখি, সেখানে আমাদের গ্রামের 'অন্ধ' হাফেজ মিয়া বৃক্ষমূলে একাকী বসে আছে।

হাফেজ ভাল মতো চোখে দেখতে পেত না। আবছা আবছা দেখতে পেত। মাটির দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে একাই লাঠি হাতরিয়ে পথ চলত।  সে ছিল কোরআনে হাফেজ। সেই জন্য  সবাই তাকে হাফেজ নামে ডাকত। সে ভালো গানও গাইতে পারত। হাফেজ ছিল অত্যন্ত গরীব ও দীনহীন। পথে ঘাটে, স্টেশনে, লঞ্চ স্টীমারে, ক্বেরাত ও গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে দান ও সাহায্য গ্রহণ করে জীবন নির্বাহ করত।

আমি হাফেজের সাথে গল্প করি। কথা বলতে বলতে আমি তাকে বলি --- ' হাফেজ ভাই, তুমি আমাকে একটা গান শোনাও না।' হাফেজ ভাই বললো, 'এখানে আর কেউ তো নেই। তুমি একাই শুনবে গান?' বললাম, 'আমি একাই শুনব। তুমি বিকেলে আমাদের বাড়ি এসে মার কাছ থেকে চাল নিয়ে যেও।'

সেদিন সেই খাঁখাঁ ক্লান্ত দুপুরে হাফেজ আমাকে এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল ---

'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি
দিতাম পাখির পায়।....'

আমি হাফেজের সাথে মাথা দোলায়ে আর দুহাত নেড়ে গানটি মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। এই গানটি প্রথম তারই কাছ থেকে শোনা ছিল। এটি যে একটি লালন গীতি তাও তখন জানতাম না। গান শেষে হাফেজ ভাইকে আমি বলেছিলাম---
'এই গানটির অর্থ বলে দাও না।' হাফেজ ভাই বলেছিল, তুমি এই গানের অর্থ এখন বুঝবেনা। বড়ো হও, তখন বুঝতে পারবে।'

তারপর অনেক বছর চলে গেছে। ততদিনে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। স্কুল শেষ করে কলেজে পড়েছি। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছি। এখানে আমাদের লালন সাহিত্য পাঠ‍্য ছিল। ক্লাসে স‍্যার লালনের 'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি' গীতি
টি পড়িয়েছে। বুঝেয়েছেও আমাদের। কিন্তু খাঁচার ভিতরে সেই অচিন পাখিকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারিনি। চিনতেও পারিনি। আর কেমনই বা ছিল সেই পাখি দেখতে?

তারও অনেক পরে একবার বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, হাফেজ ভাইয়ের কাছ থেকে সেই অচিন পাখির গান আর একবার শুনে বুঝিয়ে নিব। কিন্তু জানতে পারলাম হাফেজ ভাই মারা গেছে। মনের ভিতরে কী এক আকুতি হলো। সেই অচিন পাখিকে আর বোঝা হলোনা। পাখি অচিনই রয়ে গেল।

আমি এখনো তন্ময় হয়ে ভাবি --- সেই কত বছর আগে এক অন্ধ গায়েন ধূ ধূ খোলা প্রান্তরে বৃক্ষ তলে বসে গেয়েছিল গান। এক অর্বাচীন বালক সেই গান শুনে বিমুগ্ধ হয়েছিল। তার সেই গানের অপার্থিব সুর এখনও যে সেই বালকের অন্তরে বাজে।

'মন তুই রইলি খাঁচার আসে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশের
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।'