বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৮

হিমালয় কুইন এক্সপ্রেস

৪৩. হিমালয় কুইন এক্সপ্রেস

নব্বই দশকের মাঝামাঝির কথা। হরিয়ানার কালকা শহরেই আমার কাজটা ছিলো।  এল/সি'র শর্ত অনুযায়ী আমদানীকারকের পক্ষে কালকা স্টেশনের কাছেই মালবাহি ট্রেনে গমের শিপমেন্ট পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলাম। স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী গম শিপমেন্ট করছে কিনা এইটাই দেখা ছিলো আমার কাজ।  কলিকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে ক্যামাক স্ট্রীটে রপ্তানীকারকের অফিসে মিঃ পি.কে আগোরওয়ালের চেম্বারে বসে কফি খাচ্ছিলাম। উনি আমাকে বলেছিলেন-' দাদা, কালকাতে যেহেতু যাচ্ছেনই, পারলে ট্রেনে সিমলা থেকে ঘুরে আসবেন। খুব ভালো লাগবে।'
চমৎকার
কালকাতে পাঁচ দিন ছিলাম,ভালোই লেগেছিলো হরিয়ানার এই ছোট শহরটির। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিলো স্বপ্নপুরীর মতো। আমি প্রায় সন্ধ্যায় শিখ উপসানালয় গুলোতে ঘুরতে যেতাম। দেখতাম আর মনে হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অবস্থিত গুরুদ্বুয়ারা নানক সাইয়ের উপসানালয়টির কথা। কালকা স্টেশনের কাছেই হোটেল উইন্ডক্রসে আমি থাকতাম। হাতে দুইদিন সময় ছিলো, ভাবলাম- সিমলাটা না হয় দেখেই আসা যাক। আমি সন্ধ্যায় হোটেল থেকে চেক আউট হই। টিকিট আগেই কাটা ছিলো। রাত দশটা দশ মিনিটে হিমালয়া কুইন এক্সপ্রেস ট্রেনটি কালকা স্টেশন থেকে ছাড়ে। গন্তব্য সাদা তুষারের শহর সিমলা।

সিমলাগামী রাতের ট্রেনে যাত্রী একটু কমই থাকে । আট সিটের একটি কেবিন কম্পার্টমেনট রুমে আমরা যাত্রী মাত্র ছিলাম তিনজন। আমার ঠিক অপোজিট রো'তে একজোড়া শ্বেত চামড়ার দম্পত্তি বসে আছে। কিন্তু তাদের সাথে ঐভাবে কথা বলার সুযোগ নেই।কালকা-সিমলা রেলওয়ে একটি ন্যারোগ্যাজ রেলওয়ে। এটি উত্তর পশ্চিম ভারতের কলকা থেকে সিমলা ভ্রমনের সবচেয়ে পর্বতময় একটি রেলওয়ে। উত্তেজনাপূর্ণ পাহাড়-পর্বত এবং ছবির মতন আশেপাশের গ্রামের জন্য এই রেলওয়ে বিখ্যাত। কিন্তু রাতের জার্নিতে সেই সৌন্দর্য , সেই উত্তেজনাটা পাওয়া যায়না। আর যার কারণেই রাতের এই হিমালয়া কুইনে আজ যাত্রী কম।

ব্রিটিশ ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী সিমলার সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য কলকা-সিমলা রেলওয়ে স্থাপিত হয়। সিমলা হিমাচল প্রদেশের রাজধানী এবং কলকা হরিয়ানা প্রদেশের পাঞ্চকুলা’র একটি শহর। পুরো ট্রেন রাস্তায় দুইধারে দর্শনীয় প্রকৃতি এর চোখ ধাধানো প্রকৃতির মাঝে এই রেললাইন, ভ্রমন পিপাসুদের আকর্ষন করে। ট্রেন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫৬ মিঃ উচুতে অবস্থিত শহর কলকা অতিক্রম করার পরপর ট্রেন পাহাড়ে পাদদেশের প্রবেশ করে এবং এর পরপরই ট্রেনটি পাহাড়ে চড়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।আমি একাকী একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম। কারণ একটু পরপর ট্রেনটি পাহাড়ের সুরঙ্গে প্রবেশ করতে থাকে। বাইরে তখন নিকষ কালো অন্ধকার । মনে হয় যেনো কোনো হরোর পাতালপুরী পাড়ি দিচ্ছি।

এই রুটটি কলকার সিভালিক মালভূমির বিভিন্ন স্থান যেমনঃ ধরমপুর, সোলান, কান্দাঘাট, তারাদেবী, সালগোরা, টটু, সামারহিল এবং সিমলা থেকে হিমালয়ের প্যানোরমিক ভিউ দেখা যায়, যা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন । কিন্তু রাতের আঁধারে আমি কোনো সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছিলামনা। ওপাশে শ্বেত কপোত কপোতীদের বেশ অন্তরঙ্গ অবস্হায় দেখা যাচ্ছিলো। ওদের কোনো হুস নেই যে, আমি একজন এ পাশে বসে আছি। নাইট জার্নির সাথে নাইট রাইডিং ভালোই করছিলো ওরা।

ট্রেনটা একসময় সোলান স্টেশনে এসে থামে। তখন রাত্রি সাড়ে বারোটা হবে। সোলান শহরটি ছোট সিমলা নামে পরিচিত। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি জুন মাসে সোলান শহরে শুলিনি দেবী’র পূজা হয় যার নাম অনুসারে শহরের নাম সোলান হয়েছে । রাতের সোলান স্টেশনটি খুব ভালো লাগছিলো। বোঝাই যাচ্ছিলো দিনের বেলা এই শহরটিকে ছবির মতো লাগতো। আমি স্টেশনের আলো ঝলমল প্লাটফরমের দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখলাম একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা আমার কেবিন কম্পার্টমেন্টে উঠলেন।এবং টিকিটের আসন মিলিয়ে ঠিক আমার সামনের সিটে মুখোমুখি বসে পড়লেন।

ট্রেন সোলান ছেঁড়ে আসে। কিছু দূর যাওয়ার পর ট্রেনটি আর একটি পার্বত্য সুরঙ্গে প্রবেশ করে। চারদিকে মনে হচ্ছে ভূত পেত্নীরা কাউমাউ করছে। এবার আর বেশী ভয় পাচ্ছিলামনা। কারণ আমার সামনে একজন বিগ বিউটিফুল ওমান বসে আছে। ট্রেনের লুকোচুরির আলো আঁধারিতে আমি ঐ মহিলাকে ফাঁকে ফাঁকে দেখছিলাম। ঠিক খারাপ কোনো দৃষ্টিতে নয়, শুধু কৌতূহল- মহিলা দেখতে কেমন ?

মহিলা ডীপ মেকআপ করেছে। মনে হলো মুখের দাগগুলো ঢেকে ফেলেছে ফাউন্ডেশন বেজ মেক আপে। চোখ অনেকটা স্মোকি স্টাইল করা। চোখে আর্টিফিসিয়াল ভ্রু এবং মাসকারা লাগানো। চোখের পাতায় বাদামি কালার হাইলাইট করা। ট্রেনের রাতের আলো আধারীতে ঠোঁটে গাঢ় ভাবে লাগানো পার্পেল কালারের লিপস্টিক চিকচিক করছিলো। মহিলার পরনে ছিলো ঘিয়ে রঙ্গের জর্জেট শাড়ি। স্লিভলেস ব্লাউজ, শাড়ি নাভীর অনেক নীচ পর্যন্ত নামানো। গলায় গোলাপী স্টোনের লকেটের নেকলেস। হাতে তার মুক্তাখচিত ব্রেসলেট। চুল পিছনে ব্যান্ড দিয়ে হালকা করে খোপা বাঁধা ছিলো। শাড়ি ব্লাউজে তাকে দারুণ আবেদনময়ী লাগছিলো। তার শরীরের খোলা অংশগুলোতেও বেজ মেকআপ করে লাবন্যময় করে রেখেছিলো। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো কোথাও কোনো পার্টিতে সে এ্যাটেন করতে গিয়েছিলো ।

উপত্যাকা আর পাহাড়ের পথে পথে ট্রেন চলছে। রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলছে হিমালয়া কুইন এক্সপ্রেস। ওপাশে শ্বেত মেয়েটা লোকটার ঘারের উপড় মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। লোকটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে পাহাড়ের ফাঁকে দিয়ে রাতের আকাশ। আমার চোখে ঘুম নেই। মহিলাও জেগে আছে। আমি ওনার সাথে প্রথম কথা বলতে দ্বিধা করছিলাম, কিন্তু ইচ্ছা করছিলো কথা বলতে। একটু সৌভাগ্যই বলতে হবে, উনিই প্রথম কথা বললো আমার সাথে। (ওনার সাথে কথা হয়েছিলো ইংরেজী আর হিন্দীতে। আমি এখানে বাংলা করে লিখলাম।)

মহিলা :  আপনি কোথা থেকে এসেছেন ?

আমি :  ঢাকা, বাংলাদেশ থেকে।
মহিলা:  কোথায় যাচ্ছেন ?
আমি : এসেছিলাম কালকায় ব্যবসায়িক কাজে, যাচ্ছি সিমলায় ঘুরতে।
মহিলা : ও তাই।
আমি :   এক্সকিউজ মী, আপনার নামটি একটু বলবেন ?
মহিলা :  সায়নী সিং
আমি:    আপনি কোথা থেকে এসেছেন ?
সায়নী :  অমৃতসর, পাঞ্জাব। এখানে এসেছিলাম সোলান, যাচ্ছি সিমলা।

সায়নীর সাথে কথা বলে যেটা জানলাম, সে একজন শিখ ধর্মালম্বী। স্বামীর সাথে আন অফিসিয়ালী সেপারেশন চলছে। সে একটি বহুজাতিক কোম্পানীর আঞ্চলিক বিপনন ব্যবস্থাপক। সে অফিসিয়াল কাজেই সোলান এসেছিলো, এবং যাচ্ছে সিমলায়। ট্রেন চলছে, কখনো আঁকাবাঁকা পাহাড়ের গা ঘেসে, কখনো বিভিন্ন সেতু অতিক্রম করছে, কখনো বিভিন্ন সুরঙ্গ পাড়ি দিচ্ছে। ট্রেনটি তারাদেবী স্টেশনে চলে আসে। তখন সম্ভবতঃ রাত্রি তিনটা বাজে। দশ মিনিট দাড়িয়েছিলো ট্রেনটি। তারপর ট্রেন আবার চলতেে থাকে। কথা বলতে বলতে আমি সায়নীর বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। মনে হলো উনি খুব মিশুক। কথা আর গল্পে গল্পে সময়টা ভালোই কাটছিলো। সায়নী আমাকে বলেছিলো - 'তুমি কি সিঙ্গেল ?' আমি বলেছিলাম- 'না। আমি নতুন বিবাহিত।'

সায়নীর চোখে ঘুম নেই। দেখলাম সে একটি হার্ড ড্রীংসের বোতল বের করেছে। গ্লাসে ঢেলে তা সে পান করতে থাকে। ড্রীংস সে আমাকেও ওফার করে। আমি খেতে চাইনা, আমি বলি- আই এ্যাম নট হ্যাবিচুয়েটেড ইট।' কিন্তু সায়নী অনেকটা সম্মোহনের জাল তৈরী করে ফেলে। আমি ঠিক পুরোপুরী সজ্ঞানে নয়, সম্মোহিত হয়েই সুরা পান করি, সায়নী একটু  বেশীই খাওয়াছিলো মনে হয় আমাকে। কখন সালগোরা আর টুটু স্টেশন দুটি পার হয়ে গিয়েছিলো আমি জানি নাই।

ট্রেনটি যখন সিমলা পৌঁছে, তখন সায়নী আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। ঘড়িতে চেয়ে দেখি সকাল সাতটা বাজে। আমি দিনের আলোয় চোখ মেলে দেখি সায়নীকে। আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম সায়নীকে দেখে। এই সেই রাতের আবেদনময়ী সায়নী ? যে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো, যে আমার স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিলো। এই তার চেহেরা ! মুখের এবং শরীরের বলিরেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখের নীচে কালচে দাগ। এক বিধ্ধস্ত বিগত যৌবনা বয়স্কা রমণী সে। ফল্স ব্রান্ড অন্তর্বাস পড়া। বয়স তার ষাট বাষট্রি হবে।

সায়নী, তার ব্যাগ ব্যাগেজ গুছিয়ে নেমে গেলো। যাবার বেলায় হ্যান্ডশেক করে বলে গেলো- 'তুমি সত্যিই  খুব ভালো ছেলে। তোমাকে আমার মনে থাকবে। আবার দেখা হবে কোনোদিন।'


৪৪.    কে সেই জন

আমরা তিনজনই সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। তিনজনই খুব ভালো বন্ধূ ছিলাম, আমি,গিয়াস এবং রিমি। কলাবাগানে একটি টিনসেড বাড়ীর একটি রুম ভাড়া নিয়ে আমি আর গিয়াস থাকতাম। রিমি থাকতো জিগাতলা মোড়ে ওর খালার বাসায়। ক্লাসে আরো ছেলেমেয়ে ছিলো, তাদের সাথে বন্ধুত্ব হলোনা, বন্ধু হলাম আমরা তিনজন, রিমি, গিয়াস আর আমি।

রিমি যেদিন ক্লাশে আসতোনা সেদিন খুব মন খারাপ লাগতো। ক্লাশ করতেও মন চাইতো না। এক দুই ক্লাশ করে চলে যেতাম বাসায়। শুয়ে থাকতাম বিছানায়। তারপর চোখে ঘুম আসতো এবং ঘুমিয়ে যেতাম। যখন ঘূম ভাঙ্গতো তখন দেখতাম সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গিয়াস ততোক্ষণে চলে আসতো এবং বলতো - 'তুই কি রিমির জন্য মন খারাপ করে থাকিস ?'
আমি :  হে।
গিয়াস :  তুই কি রিমিকে ভালোবাসিস ?
আমি :  না।
গিয়াস : দুপুরে কিছু খেয়েছিলি ?
আমি : না ।
গিয়াস :  চল কালা চাঁদের হোটেলে যেয়ে কিছু খেয়ে আসি।
আমি :  চল্।

সেদিন একাউন্টিং ক্লাশের স্যার আসেন নাই। আমরা তিনজনেই মিরপুর রোডের 'চিরোকী'তে বসে আ্ড্ডা দেই। আমাদের তিনজনের মধ্যে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিলো। অনেক গল্প করেছিলাম তিনজনে। না বলা অনেক কথাও হয়েছিলো আমাদের মধ্যে। বলেছিলাম- কলেজ পড়া শেষ হলে কে কোথায় চলে যাবো,  কে কোথায় পড়বো ?  কে কখন বিয়ে করবো, আরো অনেক কথা।  তিনজনে কথা বলতে বলতে কখন ক্লাশ আওয়ার ওভার হয়ে গিয়ছিলো আমরা জানি নাই।

বিকালে পড়ার টেবিলে বসে মার্কেটিংএর  নোট খাতার ভিতর কি সব হিবিজিবি লিখছিলাম-

তুমি কি শুধুই বন্ধু হওয়ার জন্য এসেছিলে ! তুমি শুধু সহপাঠি নও আমার,
তুমি কাকে ভালোবাসো আমি জানিনা,
আমি পূর্ব মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে কেবল কালো মেঘ
আমি উত্তরের মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে,
আমি তোমাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতে চাইনা,
তবুও আমার দু'চোখ মুদে ঘুম আসে-
ঘুমেও নয়, স্বপ্নেও নয় হঠাৎই মনে হয় আমি তোমাকে
কাছে টেনে বলছি- ভালোবাসি।

ওপাশে তাকিয়ে দেখি গিয়াস ওর পড়ার টেবিলে  বসে কি যেনো লিখছে। আমি ওকে বলি-  'কি লিখছিস ?' গিয়াস বলে- 'কবিতা লিখছি।' আমি বলি- 'তুই আবার কবি হলি কবে ?' গিয়াস উত্তর দেয় - 'এমনি হিবিজিবি কিছু লিখছিলাম।' আমি বলি- 'পড়ে শোনা।' ও তখন আমাকে পড়ে শোনায়-

আমার থেকে হাজার ক্রোশ দূরে তুমি বসে আছো
শুনতে কি পাও ভালোবাসার মর্মরধ্বনি ?
লক্ষ যোজন দূরে থেকে বুঝতে কি পারো
আমার হৃৎ কম্পনের কথা ?
নির্জন নিরালায় তুমি আমার গান হয়ে ওঠো
শ্বেতকমলে তোমার পরশখানি জেগে ওঠে-
এখনো দূর হতে কোনো কোমল সিম্ফনি ভেসে আসে
এখনো তোমার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে।

আরেকদিন কলেজে যেয়ে হঠাৎ শুনতে পাই আজ কোনো ক্লাশ হবেনা।  কি যেনো এক দাবীতে শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। মন খুব একটা খারাপ হলোনা। বলাকা সিনেমা হলে চলছিলো 'সূর্যকন্যা'।  আমরা তিনজন টিকিট কেটে সাড়ে বারোটার শো'তে হলে ঢুকে পড়ি। সারা সিনেমা চলাকালীন সময়ে রিমি আমার এক হাত ধরে থেকেছিলো। ওর আরেক হাত ধরেছিলো গিয়াসের হাত।  সিনেমা শেষে আমরা তিনজন নিউ মার্কেটের ভিতরে লিবার্টি খাবার হোটেলে যেয়ে ভাত খেতে বসি। রিমি গুনগুন করে আস্তে আস্তে আমাদের কানের কাছে সুর্যকন্যার এই গানটি গাচ্ছিলো-

আমি যে আধারে বন্দিনী আমারে আলোতে ডেকে নাও
স্বপন ছায়াতে চঞ্চলা আমারে পৃথিবীর কাছে নাও.
শ্রাবণ ঘন এই আকাশ কালো তৃষিত হৃদয় মোর জ্বেলেছে আলো
এবার আমায় বাসিবে ভাল প্রিয় তুমি কথা দাও কথা দাও।

মাঝে মাঝে নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করি, রিমি কাকে ভালোবাসে ? আমাকে না গিয়াসকে ? না অন্য কাউকে ? তার কোনো হিসাব মিলাতে পারিনা।শুধু এইটুকুই জানি, আমি রিমিকে ভালোবাসি, তা কেউ জানেনা।

দেখতে দেখতে কখন আমাদের সব সিলেবাস শেষ হয়ে গেলো, দেখতে দেখতে আমাদের শেষ ক্লাশটিও হয়ে গেলো। এবং একসময় ফাইনাল পরীক্ষাও হয়ে যায়। এই ভাবেই আমাদের কলেজ পাঠ পর্ব শেষ হয়ে যায়। সেদিন চলছিলো আমাদের কলেজে একে অপরের বিদায় পর্বের দিন। দেখলাম রিমি একটা নীল রঙ্গের শাড়ি পড়ে কলেজে এসেছে। এর আগে ও কখনো শাড়ি পড়ে কলেজে আসে নাই। আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ শাড়ি পড়া। খুব ভালো লাগছিলো ওকে নীল শাড়ীতে। সহপাঠীদদের সাথে অনেক সুখের কথা হলো, অনেক প্রাণের কথা হলো। অনেক স্মৃতিচারণ হলো। তারপর আমরা তিনজন হাটতে হাটতে চলে যাই ধানমন্ডি লেকের ধারে।

লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর তিনজন বসে আছি। লেকের জল তখন নিরব স্থির হয়ে আছে। ঝিরিঝিরি কোনো বাতাস নেই। জলের উপর ছোটো ছোটো কোনো ঢেউ নেই। কড়ই,জারুল, কৃষ্ণচূড়া গাছে দু'একটি পাখী করুণ সুরে ডাকছিলো। বিকেলের সূর্য গাছের আড়ালে চলে গেছে। আলোছায়ায় অনেকটা মন খারাপ করেই আমরা বসে আছি। কে কি বলবো যেনো আমাদের কোনো ভাষা নেই। তারপরেও বললাম রিমিকে-  কবে বাড়ী যাচ্ছো ?

রিমি :  কালকেই। তোমরা কবে যাচ্ছো ?
আমি :  আগামী মাসের এক তারিখে। রুম ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ করেছি।
গিয়াস : একই তারিখে আমিও যাচ্ছি।
রিমি :  তোমরা ভুলে যেওনা আমাকে।
আমি:  তুমিও ভুলে যেওনা। চিঠি লিখবে।
গিয়াস: আমিও ভুলবো না। চিঠি লিখো।

রিমি চলে গেছে ওর দেশের বাড়ী বাগেরহাট। আমি আর গিয়াস এক তারিখেই রুম ছেড়ে দিয়ে যার যার মতো দেশের বাড়ী চলে যাই। গিয়াস চলে যায় পটুয়াখালীতে, আর আমি চলে আসি সিরাজগঞ্জে।

বাড়ীতে যেয়ে মনটা উড়ো উড়ো লাগছিলো। কারো সাথে ঠিক মতো মন খুলে কথা বলতে পারছিলাম না। এমনিতেই একাকী যেয়ে নদীর কূলে বসে থাকতাম। নয়তো মাঠের আলপথ দিয়ে ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে হাটতাম। মনের মধ্যে কি এক ভ্রান্তি ঢুকেছিলো যে, তা কাউকে প্রকাশ করতে পারছিলাম না। নির্জন প্রান্তরের অশ্বথ গাছের তলে বসে ভাবতাম আর অনুশোচনা করতাম, আমিতো রিমিকে ভালোবেসেছিলাম। এই কথা কেনোদিন তাকে আমি বলি নাই।  যে কথা বলি নাই তা নিয়ে এখন কেনো অনুশোচনা করছি ?

সেদিন ছিলো হাটবার।আমাদের ছোনগাছা হাটে সেদিন মেলাও ছিলো। মেলায় উৎসবের আমেজ। বাঁশের বাঁশি বাজছে। চারদিকে ঢাকের শব্দ, কাঁসার শব্দ। নাগরদোলার চড়কি ঘুরছে। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে কালি সন্ধ্যা হয়েছে। আমি একপাশে দাড়িয়ে নাগরদোলার ঘূর্ণি দেখছিলাম।  পোস্ট অফিসের পিয়ন আমাকে দেখে একটি চিঠি দেয়। প্রেরকের জায়গায় লেখা- রিমি, বাগেরহাট। আমি মেলার মধ্যে অন্ধকারে চিঠিটি আর খুললাম না।

রাতে বাড়ীতে এসে হেরিকেনের আলোয় চিঠিটি খুলে পড়তে থাকি-

'প্রিয় বন্ধু আমার, তোমরা দু'জনই আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলে। তোমাদের দু'জনকেই আমি খুব ভালোবাসতাম।বাড়ীতে এসে তোমাদের জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে ? কই, কখনো বলোনিতো - 'তোমাকে ভালোবাসি।' আমাকে যে বলেছে -'ভালোবাসি', তার সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের তারিখ : ১৪ ই ফাল্গুন, ১৩৯০ বাং । তোমাকে নিমন্ত্রণ দিলাম। চলে এসো। ইতি- রিমি।'

রিমি আর গিয়াসের বিয়েতে আমি আর যাই নাই। তারপর আর কোনো যোগাযোগ করিনি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেই। সরকারী চাকুরীও পেয়ে যাই। ইতোমধ্যে দশ বছর চলে গেছে। একবার একটি সরকারী কাজে গিয়েছিলাম- পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। কাজের ফাঁকে একদিন কুয়াকাটা বিচে বেড়াতে যাই। সাগরপাড় এতো জমজমাট তখন ছিলোনা । একদম বিরাণ বালুকাবেলা ছিলো। তখন সূর্যাস্তের সময়। সাগর তীরে একাকী হাটছিলাম, আর সূর্যাস্ত অবলোকন করছিলাম- হঠাৎ ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ির এক লোক আমার কাছে এগিয়ে আসে। চিনতে অসুবিধা হলোনা। এ যে সেই গিয়াস !

কাছেই লতাচাপালী গ্রামে গিয়াস থাকে। ও এখানকার এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আমাকে জোর করে ওর বাড়ীতে নিয়ে যায়। বাড়ীতে আমি তখন খুঁজতে থাকি রিমিকে। কিন্তু কোথাও রিমিকে দেখতে পেলাম না। তখন গিয়াসকে জিজ্ঞাসা করি- 'রিমি কোথায় ?'  গিয়াস আমার কথা শুনে বিস্মিত হয়। এবং বলে - 'তুই রিমিকে বিয়ে করিস নাই ? ' আমি বলি - 'না।'
গিয়াস তখন ওর স্টীলের ট্রাংক খুলে রিমির একটা চিঠি বের করে আমাকে দেখায়-  সেই একই চিঠি, একই ভাষা, এবং একই তারিখ, যা রিমি আমাকেও লিখেছিলো ।



৪৫.          কে সেই জন

আমরা তিনজনই সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। তিনজনই খুব ভালো বন্ধূ ছিলাম, আমি,গিয়াস এবং রিমি। কলাবাগানে একটি টিনসেড বাড়ীর একটি রুম ভাড়া নিয়ে আমি আর গিয়াস থাকতাম। রিমি থাকতো জিগাতলা মোড়ে ওর খালার বাসায়। ক্লাসে আরো ছেলেমেয়ে ছিলো, তাদের সাথে বন্ধুত্ব হলোনা, বন্ধু হলাম আমরা তিনজন, রিমি, গিয়াস আর আমি।

রিমি যেদিন ক্লাশে আসতোনা সেদিন খুব মন খারাপ লাগতো। ক্লাশ করতেও মন চাইতো না। এক দুই ক্লাশ করে চলে যেতাম বাসায়। শুয়ে থাকতাম বিছানায়। তারপর চোখে ঘুম আসতো এবং ঘুমিয়ে যেতাম। যখন ঘূম ভাঙ্গতো তখন দেখতাম সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গিয়াস ততোক্ষণে চলে আসতো এবং বলতো - 'তুই কি রিমির জন্য মন খারাপ করে থাকিস ?'
আমি :  হে।
গিয়াস :  তুই কি রিমিকে ভালোবাসিস ?
আমি :  না।
গিয়াস : দুপুরে কিছু খেয়েছিলি ?
আমি : না ।
গিয়াস :  চল কালা চাঁদের হোটেলে যেয়ে কিছু খেয়ে আসি।
আমি :  চল্।

সেদিন একাউন্টিং ক্লাশের স্যার আসেন নাই। আমরা তিনজনেই মিরপুর রোডের 'চিরোকী'তে বসে আ্ড্ডা দেই। আমাদের তিনজনের মধ্যে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিলো। অনেক গল্প করেছিলাম তিনজনে। না বলা অনেক কথাও হয়েছিলো আমাদের মধ্যে। বলেছিলাম- কলেজ পড়া শেষ হলে কে কোথায় চলে যাবো,  কে কোথায় পড়বো ?  কে কখন বিয়ে করবো, আরো অনেক কথা।  তিনজনে কথা বলতে বলতে কখন ক্লাশ আওয়ার ওভার হয়ে গিয়ছিলো আমরা জানি নাই।

বিকালে পড়ার টেবিলে বসে মার্কেটিংএর  নোট খাতার ভিতর কি সব হিবিজিবি লিখছিলাম-

তুমি কি শুধুই বন্ধু হওয়ার জন্য এসেছিলে ! তুমি শুধু সহপাঠি নও আমার,
তুমি কাকে ভালোবাসো আমি জানিনা,
আমি পূর্ব মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে কেবল কালো মেঘ
আমি উত্তরের মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে,
আমি তোমাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতে চাইনা,
তবুও আমার দু'চোখ মুদে ঘুম আসে-
ঘুমেও নয়, স্বপ্নেও নয় হঠাৎই মনে হয় আমি তোমাকে
কাছে টেনে বলছি- ভালোবাসি।

ওপাশে তাকিয়ে দেখি গিয়াস ওর পড়ার টেবিলে  বসে কি যেনো লিখছে। আমি ওকে বলি-  'কি লিখছিস ?' গিয়াস বলে- 'কবিতা লিখছি।' আমি বলি- 'তুই আবার কবি হলি কবে ?' গিয়াস উত্তর দেয় - 'এমনি হিবিজিবি কিছু লিখছিলাম।' আমি বলি- 'পড়ে শোনা।' ও তখন আমাকে পড়ে শোনায়-

আমার থেকে হাজার ক্রোশ দূরে তুমি বসে আছো
শুনতে কি পাও ভালোবাসার মর্মরধ্বনি ?
লক্ষ যোজন দূরে থেকে বুঝতে কি পারো
আমার হৃৎ কম্পনের কথা ?
নির্জন নিরালায় তুমি আমার গান হয়ে ওঠো
শ্বেতকমলে তোমার পরশখানি জেগে ওঠে-
এখনো দূর হতে কোনো কোমল সিম্ফনি ভেসে আসে
এখনো তোমার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে।

আরেকদিন কলেজে যেয়ে হঠাৎ শুনতে পাই আজ কোনো ক্লাশ হবেনা।  কি যেনো এক দাবীতে শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। মন খুব একটা খারাপ হলোনা। বলাকা সিনেমা হলে চলছিলো 'সূর্যকন্যা'।  আমরা তিনজন টিকিট কেটে সাড়ে বারোটার শো'তে হলে ঢুকে পড়ি। সারা সিনেমা চলাকালীন সময়ে রিমি আমার এক হাত ধরে থেকেছিলো। ওর আরেক হাত ধরেছিলো গিয়াসের হাত।  সিনেমা শেষে আমরা তিনজন নিউ মার্কেটের ভিতরে লিবার্টি খাবার হোটেলে যেয়ে ভাত খেতে বসি। রিমি গুনগুন করে আস্তে আস্তে আমাদের কানের কাছে সুর্যকন্যার এই গানটি গাচ্ছিলো-

আমি যে আধারে বন্দিনী আমারে আলোতে ডেকে নাও
স্বপন ছায়াতে চঞ্চলা আমারে পৃথিবীর কাছে নাও.
শ্রাবণ ঘন এই আকাশ কালো তৃষিত হৃদয় মোর জ্বেলেছে আলো
এবার আমায় বাসিবে ভাল প্রিয় তুমি কথা দাও কথা দাও।

মাঝে মাঝে নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করি, রিমি কাকে ভালোবাসে ? আমাকে না গিয়াসকে ? না অন্য কাউকে ? তার কোনো হিসাব মিলাতে পারিনা।শুধু এইটুকুই জানি, আমি রিমিকে ভালোবাসি, তা কেউ জানেনা।

দেখতে দেখতে কখন আমাদের সব সিলেবাস শেষ হয়ে গেলো, দেখতে দেখতে আমাদের শেষ ক্লাশটিও হয়ে গেলো। এবং একসময় ফাইনাল পরীক্ষাও হয়ে যায়। এই ভাবেই আমাদের কলেজ পাঠ পর্ব শেষ হয়ে যায়। সেদিন চলছিলো আমাদের কলেজে একে অপরের বিদায় পর্বের দিন। দেখলাম রিমি একটা নীল রঙ্গের শাড়ি পড়ে কলেজে এসেছে। এর আগে ও কখনো শাড়ি পড়ে কলেজে আসে নাই। আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ শাড়ি পড়া। খুব ভালো লাগছিলো ওকে নীল শাড়ীতে। সহপাঠীদদের সাথে অনেক সুখের কথা হলো, অনেক প্রাণের কথা হলো। অনেক স্মৃতিচারণ হলো। তারপর আমরা তিনজন হাটতে হাটতে চলে যাই ধানমন্ডি লেকের ধারে।

লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর তিনজন বসে আছি। লেকের জল তখন নিরব স্থির হয়ে আছে। ঝিরিঝিরি কোনো বাতাস নেই। জলের উপর ছোটো ছোটো কোনো ঢেউ নেই। কড়ই,জারুল, কৃষ্ণচূড়া গাছে দু'একটি পাখী করুণ সুরে ডাকছিলো। বিকেলের সূর্য গাছের আড়ালে চলে গেছে। আলোছায়ায় অনেকটা মন খারাপ করেই আমরা বসে আছি। কে কি বলবো যেনো আমাদের কোনো ভাষা নেই। তারপরেও বললাম রিমিকে-  কবে বাড়ী যাচ্ছো ?

রিমি :  কালকেই। তোমরা কবে যাচ্ছো ?
আমি :  আগামী মাসের এক তারিখে। রুম ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ করেছি।
গিয়াস : একই তারিখে আমিও যাচ্ছি।
রিমি :  তোমরা ভুলে যেওনা আমাকে।
আমি:  তুমিও ভুলে যেওনা। চিঠি লিখবে।
গিয়াস: আমিও ভুলবো না। চিঠি লিখো।

রিমি চলে গেছে ওর দেশের বাড়ী বাগেরহাট। আমি আর গিয়াস এক তারিখেই রুম ছেড়ে দিয়ে যার যার মতো দেশের বাড়ী চলে যাই। গিয়াস চলে যায় পটুয়াখালীতে, আর আমি চলে আসি সিরাজগঞ্জে।

বাড়ীতে যেয়ে মনটা উড়ো উড়ো লাগছিলো। কারো সাথে ঠিক মতো মন খুলে কথা বলতে পারছিলাম না। এমনিতেই একাকী যেয়ে নদীর কূলে বসে থাকতাম। নয়তো মাঠের আলপথ দিয়ে ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে হাটতাম। মনের মধ্যে কি এক ভ্রান্তি ঢুকেছিলো যে, তা কাউকে প্রকাশ করতে পারছিলাম না। নির্জন প্রান্তরের অশ্বথ গাছের তলে বসে ভাবতাম আর অনুশোচনা করতাম, আমিতো রিমিকে ভালোবেসেছিলাম। এই কথা কেনোদিন তাকে আমি বলি নাই।  যে কথা বলি নাই তা নিয়ে এখন কেনো অনুশোচনা করছি ?

সেদিন ছিলো হাটবার।আমাদের ছোনগাছা হাটে সেদিন মেলাও ছিলো। মেলায় উৎসবের আমেজ। বাঁশের বাঁশি বাজছে। চারদিকে ঢাকের শব্দ, কাঁসার শব্দ। নাগরদোলার চড়কি ঘুরছে। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে কালি সন্ধ্যা হয়েছে। আমি একপাশে দাড়িয়ে নাগরদোলার ঘূর্ণি দেখছিলাম।  পোস্ট অফিসের পিয়ন আমাকে দেখে একটি চিঠি দেয়। প্রেরকের জায়গায় লেখা- রিমি, বাগেরহাট। আমি মেলার মধ্যে অন্ধকারে চিঠিটি আর খুললাম না।

রাতে বাড়ীতে এসে হেরিকেনের আলোয় চিঠিটি খুলে পড়তে থাকি-

'প্রিয় বন্ধু আমার, তোমরা দু'জনই আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলে। তোমাদের দু'জনকেই আমি খুব ভালোবাসতাম।বাড়ীতে এসে তোমাদের জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে ? কই, কখনো বলোনিতো - 'তোমাকে ভালোবাসি।' আমাকে যে বলেছে -'ভালোবাসি', তার সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের তারিখ : ১৪ ই ফাল্গুন, ১৩৯০ বাং । তোমাকে নিমন্ত্রণ দিলাম। চলে এসো। ইতি- রিমি।'

রিমি আর গিয়াসের বিয়েতে আমি আর যাই নাই। তারপর আর কোনো যোগাযোগ করিনি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেই। সরকারী চাকুরীও পেয়ে যাই। ইতোমধ্যে দশ বছর চলে গেছে। একবার একটি সরকারী কাজে গিয়েছিলাম- পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। কাজের ফাঁকে একদিন কুয়াকাটা বিচে বেড়াতে যাই। সাগরপাড় এতো জমজমাট তখন ছিলোনা । একদম বিরাণ বালুকাবেলা ছিলো। তখন সূর্যাস্তের সময়। সাগর তীরে একাকী হাটছিলাম, আর সূর্যাস্ত অবলোকন করছিলাম- হঠাৎ ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ির এক লোক আমার কাছে এগিয়ে আসে। চিনতে অসুবিধা হলোনা। এ যে সেই গিয়াস !

কাছেই লতাচাপালী গ্রামে গিয়াস থাকে। ও এখানকার এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আমাকে জোর করে ওর বাড়ীতে নিয়ে যায়। বাড়ীতে আমি তখন খুঁজতে থাকি রিমিকে। কিন্তু কোথাও রিমিকে দেখতে পেলাম না। তখন গিয়াসকে জিজ্ঞাসা করি- 'রিমি কোথায় ?'  গিয়াস আমার কথা শুনে বিস্মিত হয়। এবং বলে - 'তুই রিমিকে বিয়ে করিস নাই ? ' আমি বলি - 'না।'
গিয়াস তখন ওর স্টীলের ট্রাংক খুলে রিমির একটা চিঠি বের করে আমাকে দেখায়-  সেই একই চিঠি, একই ভাষা, এবং একই তারিখ, যা রিমি আমাকেও লিখেছিলো ।

৪৬.     বৃষ্টিমঙ্গল

আমি তখন বাগবাটী স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র। আষাঢ় মাস শুরু হয়েছে। কিন্তু নদী নালায় তখনো বন্যার পানি ঢোকে নাই। সেদিন স্কুলে ক্লাস শেষে বাড়ী ফিরবো কিন্তু হঠাৎ আকাশ জুড়ে মেঘ দেখা দেয় এবং বৃষ্টি নামা শুরু হয়। সবাই বৃষ্টি থেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমি আর তা করলাম না। বইগুলো প্লাস্টিকের কাগজে পেঁচিয়ে নেই। ধূলির রাস্তা একটু বৃষ্টি হলেই কাঁদা হয়ে যেতো। কাঁদায় স্যান্ডেল পড়ে হাটা যেতো না। আমি একহাতে বই আরেক হাতে স্যান্ডেল নিয়ে আড়াই মাইল পথ কাঁদায় হেটে এবং বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ী ফিরি। মা প্রথমেই তার শাড়ীর আঁচল দিয়ে আমার মাথা মুছে দেয়। কিন্তু মাথা মুছে্ দিলে কি হবে, রাতে ঠিকই ভীষণ জ্বর এসে গিয়েছিলো।

একবার বাবার সাথে শহর থেকে হেটে বাড়ী ফিরছিলাম। শৈলাভিটা খেয়াঘাট পার হওয়ার পর থেকেই মুশলধারে বৃষ্টি শরু হয়ে যায়। পথ চলতে যেয়ে বাবা তার হাতের ছাতা আমার দিকে ঝুঁকে রাখে। আমি যেনো ভিজে না যাই। কিন্তু আমি বার বার ছাতার বাইরে এসে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকি। সেদিন সারা রাস্তা বাবার ছাতার নীচে এমনি লুকোচুরি খেলে ভিজতে ভিজতে বাড়ী ফিরে এসেছিলাম।

তখখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। কবি জসিম উদ্দীন হলে থাকি। সেদিন সারাদিন বৈশাখের তপ্ত গরম ছিলো। রাতে সামান্য গুরি গুরি বৃষ্টি হচ্ছিলো। ঠিক ঐ রকম নয়, দু'এক ফোঁটা ফোঁটা। একটু শীতল হওয়ার জন্য সে রাতে সারারাত আমি আর আমার এক বন্ধু হলের ছাদে শুয়ে থেকেছিলাম।

ঢাকার দক্ষিণখানের বাড়ীতে তখন আমি একা থাকি। বর্ষার দিনে সন্ধ্যার পর অফিস থেকে যখন বাড়ী ফিরতাম, তখন প্রায়ই বৃষ্টির জন্য প্রা্র্থনা করতাম। এয়ারপোর্ট বাস স্ট্যান্ডে নামার পর যেদিন বৃষ্টি পেতাম, সেদিন আমার মনের স্ফূর্তি বেড়ে যেতো। আমি সারা পথ একাকী ভিজতে ভিজতে ঘরে চলে যেতাম।একা থাকার কারনে কেউ দেখতে পেতোনা আমার শরীরের ভেজা কাপড়।

সবে মাত্র বিয়ে করেছি তখন। একদিন সন্ধ্যার পর আমরা দুজন শেরেবাংলা নগর মামার বাসা থেকে রিক্সায় করে মিরপুরে আমার বোনের বাসায় যাচ্ছিলাম। আবহাওয়া অফিসের কাছে যেতে না যেতেই মেঘ শুরু গম্ভীর করে বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। আকাশ ভেঙ্গে বূষ্টি শুরু হয়ে যায়। বউ রিক্সার হুট উঠিয়ে দিতে চায়। আমি বাঁধা দেই। আমরা দুইজন কাক ভেজার মতো ভিজে চুপসেে যাই। সেদিন মিরপুর পর্যন্ত সারা রাস্তা ভিজে ভিজে চলে গিয়েছিলাম। আমার বালিকা বধূ প্রথম সেদিন বুঝতে পেরেছিলো- একটা পাগল তার কপালে জুটেছে।

ফুয়েন্টসোলিং ভূটানের একটি ছোট্ট শহর। একে একটি বাজারও বলা যেতে পারে। ভারতের জলপাইগুরির জয়গাঁও সীমা্ন্ত লাগোয়া এই শহরটি অবস্থিত। ভারত থেকে সড়কপথে ভূটানে যাবার অন্যতম এটি একটি প্রবেশ দূয়ার । এই ফুয়েন্টসোলিং এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে শিলিগুরি থেকে আমি আর আমার স্ত্রী ট্যাক্সিতে জয়গাঁঁও যাচ্ছিলাম। আমরা যখন ডুয়ার্স অতিক্রম করি তখন থেকেই মুশুলধারে বূষ্টি শুরূ হয়ে যায়। জলপাইগুরির চা বাগানের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা টিলা পথে আমাদের ট্যাক্সি জয়গাঁওয়ের দিকে চলতে থাকে। গাড়ীর উইন্ড গ্লাস বৃষ্টির জলে ঘোলা হয়ে আসছিলো। চা বাগাানের ভিতর দিয়ে বৃষ্টিমুখর সেই দিনের পথচলা স্বর্গীয় মনে হয়েছিলো । কি যে ভালো লেগেছিলো সেই ক্ষণ। মনে হয়েছিলো এই পথ যেন কোনোদিন শেষ না হয়। কিন্তু-

'গীতিময় সেইদিন চিরদিন বুঝি আর হলো না
মরমে রাঙ্গা পাখি উড়ে সে গেলো নাকি
সে কথা জানা হলো না.....
চোখের ভাষাতে আজকে না হয়
মনের কথা বলো না।'


৪৭.          পদ্মাবতী

আমি আর আমার স্ত্রী  ২০০৯ সালে ডুয়ার্সের অরণ্য দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের শিলিগুরির বন্ধু শিশির রায় বলেছিল, এসেছই যখন, এক ফাঁকে তোমরা কোচবিহারের রাজবাড়ীটাও দেখে নিও, ভালো লাগবে। শিলিগুরির এনজে জংশন থেকে একদিন আমরা কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেসে কোচবিহার চলে যাই। ছিমছাম সুন্দর শহরটির ইলোরা হোটেলে আমরা উঠি। ভখন বিকাল হয়ে গিয়েছে। সেদিন আর রাজবাড়ী দেখতে যাইনা। সন্ধ্যায় রি্ক্সায় শহরটিতে একটু ঘরিয়ে। তারপর মদনমোহন মন্দির দেখতে যাই। সেখানে কৃষ্ণ মূর্তির পাশে বসে অনেকক্ষণ আমরা কীর্তন শুনেছিলাম।

রাতে ক্যাফেতেই খেয়ে নেই। খেয়ে হোটেল রুমে বসে আমরা গল্প করছিলাম।সে সময়ে হোটেল এ্যাটেন্ডেন্ট  রুমে প্রবেশ করে। ও বলছিলো আমাদের সুবিধা অসুবিধার কথা। ওর নাম কৃষ্ণ কুমার। মধ্য বয়সী অসমীয়া লোক।শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে। বাড়ী আসামের ডিব্রুগড়ে। কথায় বুঝতে পারলাম.লোকটা খুবই পরোপকারী এবং ভদ্র। আমরা ওর কাছ থেকেই জানার চেষ্টা করি রাজবাড়ীর কথা। এই রাজবাড়ী সম্পর্কে বলতে গিয়েই কৃষ্ণ কুমার আমাদের একটি কাহিনী শোনায়েছিলো। ও শুনেছিলো নাকি ওর পিতামহের কাছ থেকে, আর পিতামহ শুনেছিলো তারও পিতামহের কাছে। অনেকটা কিংবদন্তীই বলা যায়। শুনুন এবার সেই কাহিনী।

১৬২১ সালে রাজা দীননারায়ণ কোচবিহারের সিংহাসনে বসেন। রাজা ছিলেন প্রবৃত্তির বশবর্তী। তাঁর চরিত্রে ছিল লাম্পট্যের আধিপত্য। যদিও তিনি সংগীতপ্রেমিক  ও সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন, কিন্তু নিজের রাজত্বের বহু উচ্চবংশীয় নারীকে তিনি হরণ করে নিয়ে যেতেন, এবং তাঁদের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হতেন।

চিকনা পাহাড়ের পাদদেশের নিরিবিলি টিলা বেষ্টিত একটি লোকালয়। পাশেই খরস্রোতা কালজানি নদী। এই নৈসর্গিক উপত্যাকার একটি গ্রামে থাকতেন এক পন্ডিত মশায়। আশে পাশের ছেলেরা এসে এই পন্ডিতের কাছে লেখাপড়া করত। পন্ডিত মশাইয়ের একটি ষোড়সী মেয়ে ছিল নাম পদ্মাবতী। উদ্ভাসিত নব যৌবনা, টানা টানা পিঙ্গল চোখ, মাথা ভর্তি কালো চুল, মৃগনাভি,চিকন কোমড়, প্রসারিত বক্ষরাজি, তোর্সা নদীর বাঁকের মতো তার উরু। একদিন রাজা দীন নারায়ন তার সঙ্গী নিয়ে ঘোড়ায় চরে উপত্যাকার ঐ পথে যাচ্ছিলো।পদ্মাবতী তখন কালজানি নদীতে স্নানরত। রাজা দীন নারায়ন সেই দৃশ্য দেখে ফেলে। সে তখন সঙ্গীদের প্রাসাদে পাঠিয়ে দেয়। লম্পট দীন নারায়ন পদ্মাবতীর সাথে প্রথম তার পৈশাচিক নিবৃত্তি চরিতার্থ করে এই কালজানি নদীর উপকূলে।

এরপর কালজানির নদীর কালো জল অনেক গড়িয়েছে। রাজা দীন নারায়ন এই উপত্যাকায় এসেছে বার বার। একসময় পদ্মাবতী গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এ কথা লোক সমাজের কেঊ জানতোনা। সন্তান জন্ম দেয়ার দুইতিন মাস আগে পদ্মাবতী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পাশের পরগনা দেওহাটায় ওর এক মাসি থাকতো। সেখানেই পদ্মাবতী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। নাম রাখে ইলা। এই ইলাকে নিঃসন্তান মাসীর কাছে রেখে তার গ্রামে আবার ফিরে আসে। ইলা থেকে যায় মানুষের লোক চক্ষুর আড়ালে।

 কিছু দিন পর রাজা দীন নারায়ন পদ্মাবতীকে বিয়ে করে। তাকে রানীর মর্যাদা দিলেও রাজার লাম্পট্য থেমে থাকেনি। এভাবেই কেটে যায় পদ্মাবতীর ষোলোটি বছর। এদিকে ইলা পদ্মাবতীর মাসীর ঘরেই বড়ো হতে থাকে। ইতোমধ্যে সেই মাসীর মৃত্যু হয়। পদ্মাবতী ইলার পরিচয় গোপন রেখে রাজাকে বলে ইলাকে রাজ প্রাসাদে নিয়ে আসে।কিন্তু রাজা জানেনা ইলা তারই ঔরসজাত কন্যা।

ইলা অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে ছিলো। রাজকুমারী হয়েও সে রাজকুমারী নয়। প্রাসাদে তার মর্যাদা অনেকটা বাঈজীদের মতো। ইলা সুন্দর গান গাইতে পারতো, সুন্দর নাচতে পারতো। ওর রূপ পদ্মাবতীর রূপকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। রাজা দীন নারায়নের কুনজরে পড়ে ইলা। রানী পদ্মাবতী এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে আশংকা বোধ করতে থাকে।

শরতের এক বিকেলে রাজা দীন নারায়ন কালজানি নদীতে অনেকটা জোড় করেই ইলাকে নিয়ে বজরায় নৌ বিহারে যায়।পদ্মাবতী রাজার কুউদ্দেশ্য বুঝতে পারে। বজরাটি অপরূপ সাজে সাজানো হয়েছিলো। গানের বাদ্যয্ন্ত্র ও নাচের নুপুর, ঘুঙ্গুরও নেয়া হয়েছিলো। ইলার পরনে ছিলো মুক্তাখচিত জয়পুরী চোলী। ইলা সেদিনের সেই বিকেলে রাজা দীন নারায়নকে সব দুঃখের গানগুলি শোনায়েছিলো। নেচেছেও রাজার সামনে একাকী। তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বজরার অন্দরমহলে একসময় ইলার সব গান থেমে যায়। নুপুরের শব্দ আর শোনা যায়না। তখন সূর্য অস্তমিত হয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বক আর গাংচিলরা পাখা ঝাপটে দুর অরণ্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে। জলের উপরে ছোটো ছোট পাখীদের কিচির মিচির গানগুলো কান্নার শব্দের মতো মনে হচ্ছেছিলো। খরস্রোতা কালজানির জল যেনো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।

তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে। বজরা এসে ঘাটে ভেড়ে। মাঝি মাল্লারা পাটাতন ফেলে দেয় কূলে। রাজা দীন নারায়ন নেমে আসে। ইচ্ছাকৃতই হবে হয়তো, নামতে যেয়ে ইলা পা ফসকে অন্ধকারে নদীর গভীরে পড়ে যায়। শুধু টুপ করে একটা শব্দই শোনা গেলো। মুহূর্তেই ইলা জলের তলে হারিয়ে গেলো।

পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার নীচ দিয়ে হেটে হেটে রাজা দীন নারায়ন একাকী প্রাসাদে ফিরে আসে। মুখে তার মগ্ন বিষাদ। নিঃশব্দে শোবার ঘরে ঢুকতেই সে দেখতে পায় রানী পদ্মাবতী ফাঁসিতে আত্মহত্যা করেছে।

__________________________________________________

ডিসক্লেমেয়ার:   এই কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা যাছাই করা হয় নাই। এটি কৃষ্ণ কুমারের বলা একটি কল্প কাহিনীও হতে পারে।


৪৮.          তারে খুঁজে বেড়াই

এই গোলকে ঘুরতে ঘুরতে কতোজনের সাথেই তো দেখা হয়ে যায়। পথ চলতে চলতে পথের উপরে কিংবা কফি হাউসে গরম চা চুমক দিতে দিতে। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় কবি জসিম উদদীন হলে। আমার রুমমেটের কাছে তিন দিনের অতিথী হয়ে সে এসেছিলো। চিত্রালীতে প্রকাশিত 'সেই চোখ' কবিতাটি পড়ে সে আমার ভক্ত হয়ে যায়। অদ্ভূূত এক বন্ধু বৎসল চুম্বক শক্তি ছিলো তার। তাইতো তিনদিনেই সে আমার প্রাণের কাছে ঠাঁই করে নিয়েছিলো।

তারপর অনেক বছর দেখা নেই। ভুলেই গিয়েছিলাম সেই স্বল্প সময়ের বন্ধুটিকে। এক সন্ধ্যায় ফার্মগেট বাস স্ট্যান্ডে আমি দাড়িয়ে আছি। পাবলিক বাসে আসবো এয়ারপোর্টে। হঠাৎ আলো আধারীতে  সেই বন্ধুটি  আমার কাছে এগিয়ে আসে। যার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো জসিম উদ্দীন হলে। সেও যাবে এয়ারপোর্ট বাস স্ট্যান্ডে। পরে জানলাম আমার এলাকা দক্ষিনখানে একটি মেসে সে ভাড়া থাকে।

সে সময় আমার কর্মহীন জীবন চলছিলো। নতূন বিয়ে করেছি। হঠাৎ সেই বেকারত্ব জীবনে এই বন্ধুটি আমার সকাল বিকালের সাথী হয়ে যায়। প্রায় তিন মাস ঢাকা শহরের কতো পথে পথে একসাথে ঘুরেছি তার কোনো শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর,  লাইব্রেরী চত্বর, পাবলিক লাইব্রেরী, যাদুঘর প্রাঙ্গন, ধানমন্ডি লেকের পার, পুরানো ঢাকায়,পথের উপর টং চা'র দোকান, কতো জায়গায় যে দু'জন ঘুরে বেড়িয়েছি, আর সময় কাটিয়েছি।

একবার সদরঘাটের প্লাটফরমের রেলিং এ দাড়িয়ে দু'জন বুড়িগঙ্গার জল দেখছিলাম, কতো লঞ্চ এসে ভিড়ছে প্লাটফরমে। কতো মানুষ জীবিকার জন্য আসছে ঢাকা শহরে। মনটা কেমন উদাস লাগছিলো। জীবনের প্রতি হতাশার কথা বলছিলাম ওকে। সে তখন আমার ঘাারের উপর হাত রেখে বলেছিলো- Never give up easily in life, success is right around the corner.

ওর এক কাজিন ছিলো একটি বেসরকারী ব্যাংকের পরিচালক। নিজে ভালো কিছু করতোনা। তরপরেও তার কাজিনকে বলে ব্যাংকে ভালো একটি চাকুরী আমাকে পাইয়ে দেয়। এরপর থেকে আমি চাকুরীতে ব্যস্ত হয়ে যাই। আগের মতো তার সাথে আড্ডা বা ঘোরাঘুরি করা সম্ভব হতোনা। এর কিছুদিন পর দক্ষিনখানের মেস ছেড়ে  কলাবাগানের একটি মেসে সে চলে আসে।

এরপর মাঝে মাঝেই সুযোগ সময় পেলে কলাবাগানের  মেসে যেয়ে ওর সাথে আমি দেখা করতাম। একবার প্রায় ছয় মাস, ওর সাথে আমার দেখা করা হয়নাই। পরে যখন যাই, যেয়ে দেখি কলাবাগানের ঐ মেস ছেড়ে সে অন্যত্র চলে গেছে। মেসমেটরাও বলতে পারেনি সে কোথায় গিয়েছে।

এই পৃথিবীর পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে কতোজনের সাথেইতো মানুষের দেখা হয়। যে পথগুলো দিয়ে আমি ঘুরেছি, সে পথের উপর দিয়ে আকাশ ছিলো, কিন্ত সে পথে তার দেখা পাই নাই। কতো শূণ্য প্রান্তরের মধ্য দিয়ে একাকী দৌড়ে দৌড়ে হেটেছি কিন্তু কোথাও আমার সে বন্ধুটি ছিলোনা। এখন ফেসবুক,গুগল, টুয়েটারেও  সার্চ দিয়ে দেখেছি, সেখানেও তার খোঁজ পাওয়া যায় নাই।

মানুষ ঘুরতে ঘুরতে নাকি চাঁদ হয়ে যায়, যেখানেই থাক, পৃথিবীর যে কোনো কোণকে নাকি সে আলোকিত করে রাখে। আমিও আমার সেই বন্ধুটির আলোর দ্যূতি গায়ে মাখি। আমার জীবনের এক ক্রান্তিকালে যে উপকার সে করেছিলো, তার ঋণ আমি শোধ করতে পারি নাই। সেই ঋণ শোধ করার জন্য আমি এখনো এই ঢাকা শহরের পথে পথে তাকে খুঁজে বেড়াই।

ওর ঠিকানা আমার পুরোপুরি জানা নেই। গ্রামের নামও মনে নেই। শুধু পোস্ট অফিস ও থানার নামটি মনে আছে। মোঃ শফিকুল ইসলাম, পোঃ ভিটঘর, থানা- নবীনগর, জেলা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কেউ একটু খুঁজে দেখবেন কি ?


৪৯.    অঝোর ধারায় বৃষ্টি

আলেয়া নামের সেই মেয়েটি এই ঢাকা শহরেই থাকে জানা ছিলোনা । আর জানার জন্য ঐরকম আগ্রহ কখনো হয়নি ।তবে ওকে যে মনে পড়তোনা,তা নয়। কখনো যদি অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে, আর সে সময়টা যদি দুপুরের হয়, তখন আলেয়ার কথা মনে পড়ে।

আলেয়ার সাথে সম্পর্ক কিংবা জানাশোনা ছিলো মাত্র পঁচিশ ত্রিশ দিনের। আমরা তখন ভাড়া থাকতাম পুরানো ঢাকায় দীননাথ সেন লেনের একটি বাসায়।ঠিক পাশের বাসাটা ছিলো আলেয়ার বড়ো বোনের ।তারাও ভাড়া থাকতো। আর এখানেই বেড়াতে এসেছিলো আলেয়া। ঠিক বেড়াতেও নয়,ছেলে দেখাতে নিয়ে এসেছিলো ওকে। আর এখান থেকেই ওর বিয়ে হয়ে যায়।

তখন ঢাকাতে 'আলো তুমি আলেয়া' সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে। মরহুম ফতেহ লোহানী একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে এই ছবিতে অভিনয় করেছিলো। সেদিন রূপমহল সিনেমা হলে ম্যাটিনী শো 'আলো তুমি আলেয়া' ছবিটি দেখে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছিলাম।দেখি দুই বাসার গলিমুখে আলেয়া দাড়িয়ে। এর আগেই ওর সাথে পরিচয় ও কথা হয়েছে। ও আমাকে দেখে একটু হাসি মুখ করে । বাসায় ঢোকার সময় আমি ওকে বলি- 'আলো তুমি আলেয়া'।

এর পরেও ওর সাথে আমার দেখা হয়, কথা হয়।মেয়েটি দেখতে ভালোই। মফস্বলের সরলতা ছিলো ওর চোখে মুখে।  কিন্তু ওর সাথে  প্রেম করবো,এই ভাবনা কখনো ভাবিনি। আমি তখন কেবল ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।বিয়ে সাদির কথা মুখে আনলে সোজা বাড়ী থেকে আমাকে পিটাতো।

আলেয়ার সাথে আরো কয়েকবার কথা হয়েছে।আমার কাছে মনে হয়েছে, সে আমাকে ভালোবাসতে চায়। ওকেও যে ভালোবাসা যায়, সেই রকমই একটি মেয়ে আলেয়াও । সুচন্দার মতো টানাটানা চোখ, স্লিম বডি,লম্বা কালো চুল, শ্যামবর্ণ গায়ের রং। আমারও মনে হতো, ওর সাথে একটু প্রেম করি। দূরে কোথাও পালিয়ে নিয়ে যেয়ে ওকে বিয়ে করি। কিন্তু তা আমি নিজেকে করতে দিলামনা।

ইতোমধ্যে আলেয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। যেদিন বিয়ে  হবে তার তিনদিন আগের ঘটনা। সেদিন ছিলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সময়টা ছিলো দুপুর। রুমের মধ্যে একাকী ছোট জানালার পাশে দাড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিলাম। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। বাড়ীর সামনে গলিটি জলে ভেসে গেছে। বৃষ্টির সাথে শীলাও পড়ছিলো। এবং সাথে মেঘ গুরু গম্ভীর বজ্রপাত।আমার রুমটা ছিলো পুরানো জীর্ণ। দেয়ালে পলেস্তারা খসে গেছে। মেঘ বৃষ্টির কারণে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। রুমটা অন্ধকারোচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বাইরে তখনো মুষুলধারে বৃষ্টি। হঠাৎ রুমের মধ্যে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আলো আঁধারিতে দেখতে পাই,আলেয়া।

আলেয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা লুকিয়ে কাঁদতে থাকে, এবং বলতে থাকে- তুমি এই বিয়ে ভেঙ্গে দাও। আমাকে তুমি এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও।' আমি কোনো কথা বলিনি।এটা আমার কাপুরুষতাও নয়। আমিতো আলেয়াকে কখনোই ভালোবাসিনি। ওকে আমি কখনোই বলিনি ভালাবাসি।

তখনো আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছে। আলেয়া আমার বুকে জড়িয়ে। মানুষ মাঝে মাঝে প্রকৃতির অংশ হয়ে যায়। মানুষ একাকার হয়ে যায় বৃষ্টি,নদী,সাগর, জ্যোৎস্নার রাত কিংবা পাহাড়ী নির্জন অরণ্যের মতো প্রকৃতিগুলোর মাঝে। প্রকৃতি তার অসীম শক্তি দিয়ে মানুযকে কাছে টেনে নেয়, আর মানুষও তখন প্রকৃতির মাঝে একাকার হয়ে যায়। ধারণ করে স্বর্গীয় রূপের যা মর্তলোকের জীবন আচরণের সাথে কোনো মিল নেই। আলেয়ার চোখের জল ততোক্ষণে শুকিয়ে গেছে।বৃষ্টিও থেমে গেছে।

আলেয়ার ঐ ছেলের সাথেই বিয়ে হয়ে যায় এবং স্বামীর ঘরে চলে যায়। দু'তিন মাস পরে দীননাথ সেন লেনের বাসা ছেড়ে আমরা আজিমপুর কোয়ার্টারে চলে আসি। এরপর আলেয়ার সাথে কিংবা ওদের পরিবারের কারো সাথে আমাদের দেখা নেই।

 ঠিক নয় বছর পর,একদিন নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানের সামনে আলেয়ার দেখা পাই। একটি আট বছরের ছেলের হাত ধরে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই একে অপরকে চিনে ফেলি। দু'জনের চোখে মুখে বিস্ময় এবং বিষন্নতা মুহূর্তেই ফুটে উঠে। সবচেয়ে বেশী বিস্মীত হই ওর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে। আমার চাহনী থেমে যায় ছেলেটার মুখের উপর। আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। শরীরের সমস্ত রক্ত হঠাৎ তরঙ্গায়িত হয়ে হিম শীতল হয়ে গেলো।ঐ রকম বয়সে আমাকে দেখতে ওর মতোই লাগতো। আলেয়া বেশী ক্ষণ দেরী করেনি। ছেলের হাত ধরে চলে যেতে উদ্যত হয়। ছেলেটিকে খুব আদর করতে ইচ্ছা হলো। ওর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করি- বাবু তোমার নাম কি ? ছেলেটি ওর যে নামটি বলেছিলো- সেটি আমারই নাম।


৫০.       মাধবী এসেই বলে যাই

রফিক আজাদের কবিতার পংতির মতো --- 'মাধবী এসেই বলে যাই'। আমি বলি কোথায় যাবে ? সে বলে, 'কোথায় নিয়ে যাবে ?' আজ আমরা বংশী নদীর পারে যাবো। ওখানে নদীর জল দেখব, নৌকা দেখব।গাছের ছায়ায় বসে থাকব। মাধবী বলে --- 'এই কাঠপোড়া রোদ্রের দুপুরে যাবে বংশী নদীর পারে ! আমার খিদে লেগেছে। আগে খাওয়াও, তারপর যাব।' আমরা নীলক্ষেতের ভাই ভাই হোটেলে কাচকি মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে নেই। তারপর চাঁন খাঁর পুল থেকে লোকাল বাসে উঠে সোজা চলে আসি সাভার বাজারে ।

বাস স্টান্ডের অদূরে দেখি গাঁধা টানা একটি ছোট টমটম দাড়িয়ে আছে। কোচোয়ানকে বলি, তোমার টমটম কি যাবে ?
কোচোয়ান:  কোথায় যাবেন স্যার ?
আমি:  রাজা হরিশচন্দ্রের বাড়ী।
কোচোয়ান:  আমি চিনিনা।
আমি:  ( মাধবীকে দেখিয়ে ) ওকে চেনো ?
কোচোয়ান:  না
আমি:  উনি হচ্ছে রাজা হরিশচন্দ্রের বড়ো মেয়ে। নাম: রাজকুমারী অনুদা ।
মাধবী:  তুুমি আমাদের বংশী নদীর তীরে নিয়ে চলো।
কোচোয়ান:  চলেন।

টমটম চলছে। মনে হচ্ছে এ যেন সাম্ভার নগরী। বারশত বছর আগে লাল পোড়ামাটির পথ ধরে আমরা চলছি বংশী নদীর তীরে। টমটমের মুখোমুখি আমি আর মাধবী বসে আছি। মাধবীকে রাজকুমারী অনুদার মতোই লাগছিল। চুল হাওয়ায় উড়ছে। রোদ্র এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে। ওড়না গলা থেকে দুই দিক থেকে বুুকের উপর দিয়ে সাপের মতো নীচে নেমে পড়েছে। ওকে খুব রোমান্টিক লাগছিল।

আমাদের টমটম এসে থামে বংশী নদীর তীরে।কোচোয়ানকে বললাম ---- তুমি ঐ বটবৃক্ষ তলায় যেয়ে অপেক্ষা কর। আমরা ফিরব দুই ঘন্টা পর।
কোচোয়ান:  স্যার, হরিশচন্দ্রের বাড়ী যাইবেন না।
আমি:  যাবো। বংশী নদীর হাওয়া খেয়ে আসি, তারপর যাবো।
কোচোয়ান:  হুজুর আপনার পরিচয়টা একটু দিবেন।
আমি : আমার নাম গোপীনাথ। আমি ময়নামতির মহারানীর পুত্র। রাজা হরিশচন্দ্রের হবু জামাতা।
কোচোয়ান:  জ্বী,আচ্ছা।

তখন বিকেলের রোদ। বংশী নদীর কূল ধরে আমরা হেটে হেটে চলে যাই আরো সামনের দিকে। নদীর তীরে একটি জারুল গাছের নীচে দুজন ঘাসের উপর বসে পড়ি। হেমন্তের বংশী নদী। নদীর জল অর্ধেক হয়ে আছে। দু'একটা নৌকা এলোমলো ভাবে চলছে। একটু পর পর বংশী নদীর শীতল হাওয়া আমাদের শরীরে এসে লাগছিল। চারদিকে জন মানবহীন। কেমন সুনসান নিরবতা ।
মাধবী:  আমার ভয় লাগছে।
আমি:  তাহলে চলে যাবে ?
মাধবী:  না। যাবো না।
আমি:  কেন যাবে না ?
মাধবী:  ভালো লাগছে।

নদীর কূল থেকে একটু দূরে একটি পরিত্যক্ত নাট মন্দির দেখতে পাই। আমরা আস্তে আস্তে ঐ নাট মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাই। দু'জন সন্তর্পণে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে পড়ি। ভিতরে ঢুকে মন্দির দেখে বিস্মিত হই। কি অদ্ভূত কারুকার্যখচিত মন্দির। দেখি ভিতরে রাজা হরিশচন্দ্র ও রানী কর্ণবতী প্রার্থনায় রত। পাশে একজন পুরোহিত জপমালা জপছে। একটু পর রাজা রানীর প্রার্থনা শেষ হয়। পিছনে মুখ ফিরিয়েই তারা আমাদের দেখতেে পায়।
রানী:  মা অনুদা তুমি এসেছো।
রাজা:  বাবা গোপীনাথ তুমি এসেছো।
রাজা হরিশচন্দ্র পুরোহিতকে কহিলেন --- এদের ধর্ম ও ভগবান মতে বিবাহের ব্যবস্থা করো। পুরোহিত তাই করিলেন।

মন্দিরের সাথেই স্বর্ণকূটিেরের মতো একটি ছোট কক্ষে আমাদের প্রবেশ করানো হলো। রানী মা কহিলেন --- তোমরা এখানে বিশ্রাম নাও। এই বলে রানী মা কক্ষের দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে চলে গেলেন। আমরা দুজন পালঙ্কের উপর যেয়ে বসলাম।
আমি :   অনুদা, প্রিয়সী আমার --- এই ক্ষণ কেমন লাগছে ?
অনুদা:  জ্বী জাহাপনা, এই ক্ষণটির জন্য এতকাল অপেক্ষায় ছিলাম।
আমি:  এসো আরো কাছে এসো।
অনুদা:  জ্বী, আসছি।
আমি:  এই ক্ষণ শুধু তোমার আমার !

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারদিকে কেমন যেন অন্ধকার। সবকিছুই অপরিচীত লাগছে। চেয়ে দেখি --- আমি আর মাধবী জীর্ণ এই নাট মন্দিরের মেঝেতে পাশাপাশি শুয়ে আছি। বাইরে থেকে কোচোয়ান ব্যাটা ডাকছে ---- 'হুজুর ! হূজুর ! গোপীনাথ স্যার ! আর কতক্ষণ দেরী হইবে ? যাইবেন না !'


৫১.    কাজল রেখা

আজ আমার এই চিলকোঠার ছোট্ট ঘরে কাজলের বউ হয়ে আসার কথা ছিলো। সজ্জায় বিছিয়ে রাখার কথা ছিলো ফুলের পাঁপড়ি। জ্বালাতে চেয়েছিলো ঘরে আলো। এসব আজ কোনো কিছুই হলোনা। আমি ঘরকে আঁধার করে একাকী বসে আছি। কোনো আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করছেনা। সিগারেটের ধূয়ায় রুমটা অন্ধকারে ভরে গেছে।

 কাজল রেখা। আমি ডাকতাম ওকে কাজল বলে। ওর বাবা মা ডাকতো রেখা। ঢাকা শহরের এই জনারণ্যে পথ চলতে চলতেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। পথের মানুষ পথেই যেন প্রিয় মানুষের দেখা পেয়ে গেলাম। এক বৃষ্টি  ঝুমঝুম সন্ধ্যায় দাড়িয়েছিলাম গুলিস্তান বাস স্টান্ডে রাস্তার উপরে। বৃষ্টিতে ভিজতেছিলো আমার মাথার চুল। পাশে দাড়ানো মেয়েটা ওর ছাতাটা এগিয়ে দিয়েছিলো আমার মাথায় উপর। রাস্তার উপরে এই প্রথম কোনো মেয়ের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়া, প্রথম কোনো মায়া দিয়েছিলো একজন অপরিচীতা। সে এই কাজল।

মতিঝিল এরিয়ায় কাজল একটি চাকুরী করতো। আমারও চাকুরীস্হল ছিলো মতিঝিলেই।আমি অস্থায়ী ছোটো একটি চাকুরী করি,বেতন ভাতা নগন্য। কাজলের সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো। কোনো কোনো দিন রাস্তার উপর হোটেলে বসে আমরা লাঞ্চ করতাম। কোনো কোনো দিন পাউরুটী কলা, কোনো কোনো দিন নোনতা বিস্কুট আর চা খেতাম।

এই ভাবেই চলতে চলতে দু'জন দু'জনার প্রতি মায়ায় বেঁধে যাই। দু'জন দু'জনকে ভালোবেসে যাই। জগৎ সংসারে কোনো পাওয়াই মনে হয় মসৃন হয়না। কাজল যখন আমার কথা বলেছিলো ওর মা বাবার কাছে, তখন তারা বলেছিলো 'না'। এ ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হবেনা। আমার মতো চালচুলোহীন ছেলের কাছে কোনো বাবা মা তার আদরের মেয়েকে তুলে দিতে চায় ?  কেমন যেনো মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো এ জীবনে কাজলকে আমি আর পাবোনা। যাকে এতো আপন করে কাছে টানতে চাইলাম ,সে তাহলে দূরেই থাকবে।

গতকাল আমরা দুজনই লাঞ্চের পর আর অফিসে যাইনা। একটি রিক্সা নিয়ে বলদা গার্ডেনে চলে যাই। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল হয়েছে। আমরা দু'জন ঝাউবনের পাশে সবুজ ঘাসের উপর যেয়ে বসি। জারুল আর মহুয়াবনে পাখীরা তখন কিচির মিচির করছিলো। কথা বলছি দু'জনে, ভালোবাসছি দু'জনে। যেনো ' বাতাসের কথা সে তো কথা নয় রূপ কথা ঝরে তার বাঁশিতে আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই যেন দুটি আঁখি ভরে রাখে হাসিতে।'  কেনো জানি ভানু চক্রবর্তীর কবিতার এই চরণটি আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো- 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি।' গার্ডেনের সবুজ ঘাসে বসেই দু'জন সিদ্ধান্ত নেই. আগামীকালই আমরা কোর্ট ম্যারেজ করবো।

সন্ধ্যার পাখীরা সব কলোরব করে উঠলো। বাগানের সব ফুল যেনো ফুটে উঠতে লাগলো। সুবাস ছড়িয়ে পড়তে থাকলো চারদিকে। মৃদুমন্দ বাতাস বইতে লাগলো। কাজল কখন আমার হাত ধরেছিলো,খেয়াল নেই। সন্ধ্যার আলো আধারীতে ওর আনত মুখখানি একবার দেখলাম। জগতের সমস্ত সুখের আভা যেনো ছড়িয়ে আছে ওর চোখে মুখে। 'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হারিয়ে. মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। তব ভুবনে তব ভবনে. মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।' গার্ডেন থেকে আমরা বেরিয়ে আসি । কাজল রিক্সায় উঠে বক্সীবাজারে ওদের বাসার দিকে চলে যায়। যাবার বেলায় বলে যায়- কাল তোমার চিলেকোঠায় বউ হয়ে আসছি।
 
চিলেকোঠায় ফিরে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে ভাবছিলাম- এই ছোট্র ঘরে কাল কাজল আসবে। আমার চুলো জ্বালাবে। সন্ধ্যাবাতি জ্বালাবে ঘরে। ছোট সংসার হবে। ঘরবাড়ী গোছাবে লক্ষ্মী ঐ মেয়ে। যে স্বপ্ন দেখেছিলাম,তারুণ্যের প্রথম প্রহরে, তা যেনো কালকেই পূরণ হতে যাচ্ছে। আমার মন প্রাণ উল্লসিত হয়ে উঠলো।

হঠাৎ দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ শুনতে পাই। দরজা খুলে দেখি- একটি অপরিচিত লোক দাড়িয়ে। উনি বলছিলো- আমি হাসপাতাল থেকে এসেছি।কাজল নামে একটি মেয়ে আমাকে পাঠিয়েছে। উনি রোড এক্সিডেন্টে আহত হয়ে জরুরী বিভাগে আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রক্ত দরকার।'

আমি ্দ্রুত হাসপাতালে চলে যাই। হাসপাতালের জরুরী বিভাগের কোরিডোরের সামনে আমি দাড়ানো। ডাক্তারকে বলি- কাজল এখন কেমন আছে ? 
ডাক্তার : আপনি ওনার কি হন ?
আমি :   আমি ওর কিছু হইনা।
ডাক্তার :  ও আচ্ছা।
আমি:  ওর সাথে আমি কি একটু কথা বলতে পারবো ?
ডাক্তার :  উনি এখন জীবনেও নেই, মরনেও নেই। আপনি ভিতরে যান। দেখেন আপনার সাথে উনি কথা বলে কি না ?

কাজল আমার সাথে কথা বলেনি। রুম হতে বের হতেই দেখি- এক পৌঢ় ও একজন বয়স্কা মহিলা বাইরে দাড়ানো। কাজলের বাবা মা হবে হয়তো। তারা কাঁদছে। হাসপাতালের কোরিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে আমি রাস্তায় চলে আসি। যে জনারণ্যে একদিন কাজলকে খুঁজে পেয়েছিলাম, সেই জনারণ্যেই আমি হারিয়ে গেলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন