রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

অপরাজিতা

অপরাজিতা 

আমি তখন মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। নিয়মিত ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। পরীক্ষার পরই ইউনিভার্সিটি জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। হল থেকে খুব বেশি বের হতাম না। বোরিং লাগলে মাঝে মাঝে বিকাল বেলা হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম হাকিমের চায়ের দোকানে। ওখানে চা খেয়ে বন্ধু বান্ধবদের সাথে একটু আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার পরপরই হলে চলে আসতাম।                                 
পরীক্ষার পর চাকুরি হোক বা না হোক, মা আমার বিবাহ ঠিক করে রেখেছে। আমিও সেই মেয়েকে দেখেছি, কথা বলেছি। ওর নাম নীলিমা। রূপশ্রী কলাবতী মেয়ে। ওড়না উড়ে তার করতোয়ার বক্ষ ছুঁয়ে আসা উতল বাতাসে। হেমন্ত জোছনায় চোখ আলো করে রাখে।  চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বাজে জল তরঙ্গের মতো । কী এক রহস্যময় জগৎ উন্মোচিত হবে,  সেই ভাবনায় সেই অপেক্ষায় কখনও কখনও পরীক্ষার পড়া ভুল ভাবে মস্তিষ্কে ধরা দিত। মনে রাখতে পারতাম না। 'মোর ভাবনারে একি হাওয়া লাগল দোলে মন দোলে অকারণ হরষে'।                


সেদিন দুপুরে রুমে টেবিলে বসে পড়ছিলাম সোফোক্লিসের ইডিপাস। জটিল কমপ্লেক্সে মনটা যখন উথালপাতাল হচ্ছিল, ঠিক তখন ডাকপিওন একটি পত্র দরজার নীচে দিয়ে ফেলে রেখে যায়। মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। ভেবেছিলাম নীলিমার চিঠি। ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ও তাই  মাঝে মাঝে আমার কুশল জানতে চেয়ে  চিঠি লেখে। ভেবেছিলাম নীলিমার চিঠি হবে।      

কিন্তু না। এটি নীলিমার চিঠি ছিল না। অন্য আর একজনের চিঠি। চিঠির নীচে একটি মেয়ের নাম লেখা আছে  -- অপরাজিতা।                                           

আমি অপরাজিতা নামে কোনো মেয়েকে চিনি না। কে এই অপরাজিতা? চিঠিতে লিখেছে --

প্রিয়জনেষু আনিস, 

একটু অবাকই হচ্ছো অপরাজিতা মেয়েটি আবার কে? আমাকে তুমি দেখেছ অনেক। যদি কখনও  আবার দেখ, ঠিকই  চিনতে পারবে আমাকে। আমি কে, এই কথা বলব না তোমাকে। তুমি আমাকে জানলে আমার প্রতি তোমার আর আগ্রহ থাকবে না। 

তোমাকে আমার কবে ভালো লেগেছিল জানো?                  

একদিন তুমি গাঢ় নীল রঙের  জিন্স প্যান্টের সাথে  হালকা নীল রঙের টি-সার্ট পরেছিলে। পায়ে ছিল সাদা কেডস্। তোমার মোছ সদ্য গজিয়ে ওঠা দূর্বা ঘাসের মতো সতেজ, চুল এলভিস প্রিসলীর মতো পিছনে ব্রাশ করে আঁচড়ান। স্নানের পর ললাটে নেমে আসে কেশদাম ৷ চোখ স্বপ্নচ্ছটা। কখনও মেঘলা আকাশের তারার মতো মণিদীপ। তুমি মাধুকর। ছেলে মানুষও দেখতে এত টান টান হয়। আমি বিস্ময়ে চেয়ে দেখেছিলাম শুধু। তোমাকে ভালো লাগা ওখান থেকেই। হৃদয়ে ভাঙন তখন থেকেই শুরু । কিন্তু প্রপোজ করিনি কখনও। কেন করিনি সে অনেক কারণ, অনেক ভাঙচুরের কথা।                                    

তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি।

তোমার মতো আর কোনও ছেলে আমি দেখিনি।  রূপে গুণে, গানে আর প্রাণের প্লাবনে তুমি যে অনন্য। তুমি স্বপ্নে দেখা রাজকুমার।

তোমার জন্য  আমার মনের  মধ্যে তৈরি হয় এক গভীর মায়াবোধ,  কীসের যেন একটা অভাবও অনুভব করি। তোমাকে আমার করে কী পাওয়া হবে এই জীবনে? সারাক্ষণ মন কেমন করে। এক ধরনের ভারী  বিষণ্ণতা বুক চেপে ধরে আছে ।   

বড়ো অসময়ে আমি তোমাকে এই কথাটি বললাম। যখন তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ফিরে আসার কোনো পথ কি তোমার খোলা আছে? নাকি রুদ্ধ তোমার সকল দুয়ার?         

ভালো থেকো তুমি।

ইতি --- অপরাজিতা।                  


অপরাজিতা নামে কোনো মেয়ের সাথে কোনো দিন আমার পরিচয় ছিল না। তার নামও কোনও দিন শুনিনি। নিশ্চয়ই ছদ্মনাম দিয়ে কেউ এই চিঠিটি লিখেছে। যে আমাকে খুব কাছে থেকে জানে। আমার হলের রুম নং ও তার জানা আছে।  কিন্তু কে এই মেয়ে?  হাতের লেখাটিও চিনতে পারছি না। একটু দুশ্চিন্তাও করতে থাকি। সামনে আমার শুভ বিবাহ। একজন অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে আর কিছুদিন পর হাতে মেহেদি পরবে। কাঁচা হলুদ দেবে তার গায়ে। কপালে টিপ পরবে। খোপায় পরবে শুভ্র সন্ধ্যামালতী ফুল।                                                  
রাতে টেবিলে বসে যখন পড়ছিলাম, তখন শরীর মদির হয়ে চোখে ঘুম নেমে আসে। শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম আসে না। চেয়ে থাকি নিমগ্ন হয়ে। দূরে অনেক দূরে বন ঝাড়ে দেখতে পাই অজস্র অপরাজিতা ফুল ফুটে আছে। ফুলগুলো বেদনায় নীল। আমি জানি, এদের আয়ু খুব ক্ষণকালের। কে-ই বা ছুঁইবে তাদের। অনাদরে ওরা ঝরে 
যায় ।                            

একদিন দুপুরে ডাইনিং রুম থেকে খেয়ে এসে রবি ঠাকুরের কড়ি ও কোমল কবিতার বইটি বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে  পড়ছিলাম। পরের দিন রবীন্দ্র সাহিত্য পরীক্ষা। পাশের জানালাটা খোলা ছিল। চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল আকাশের দিকে। দেখছিলাম দূরে  অনন্ত আকাশের নীল। মনে হচ্ছিল জলেশ্বরী তলার আকাশ দেখছি আমি। যেন ''শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল। / আমার নিখিল /  তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল। নাহি জানি, কেহ নাহি জানে--'' 
আমি জানি -- নীলিমা আমার। নীলিমা আমার হবে।    

রুমের দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। কড়ি ও কোমল বিছানার উপর রেখে দরজাটা যেয়ে খুলে দেই। দেখি -- ডাকপিয়ন চিঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকেও অপরাজিতার চিঠি।      

পরম কল্যাণীয়, 

তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? এই সময়ে তোমাকে বিরক্ত করা আমার  ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ করেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। কত কথা বলতে ইচ্ছে করে তোমার সাথে। অথচ এক সময় কত কথা তোমার সাথে বলতে পারতাম। আজ যখন ক্রমে অনেক দূর চলে যাচ্ছ, তখন মনে হয় -- তোমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করি। তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলি তোমার কঠিন কোমল বুকে।  আমার নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় যে !  কোথাও কোনও নন্দন কানন থেকে যদি তুমি একটি চাঁপা ফুল এনে আমায় দিতে, তবে নিঃশ্বাস নিতাম প্রাণ ভরে। 

আমার পরম সৌভাগ্য যে তোমাকে আমি চেয়েছিলাম,  আর আমার নিয়তি যে তোমাকে আমি কোনও দিন পাব না। তোমার জীবনময় আমি থাকব না, কিন্তু তোমার জীবনভর আমার অদৃশ্য ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকবে। আমার খুব কান্না পায়, কষ্ট হয়, হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে টান লাগে। দুঃখের  মাধুরীতে আমাকে শুধু সিক্তই করলে। আমাকে কাছে নেবার কোনও দায় নিলে না। কাঁদিয়েই রাখবে কেবল জনমভর।                                                    
তোমাকে আমার জীবনের শেষ অব্দি পর্যন্ত মনে থাকবে। শুধু একটু আফসোস রয়ে গেল তোমার সাথে জলেশ্বরী তলায় তোমাদের বাড়ির আম্রকাননে দাঁড়িয়ে একটা সকাল দেখা হলো না, কাটাতে পারলাম না শোয়ার ঘরে একটি নিঝুম দুপুর, দক্ষিণের বারান্দায় একটা কমলা রঙের বিকেল, আর ছাদে পাটিতে বসে উপভোগ করতে পারলাম না  একটি জ্যোৎস্নার রাত।  

ভালো থেকো তুমি। 
ইতি -- অপরাজিতা।                              

              

পরীক্ষার কয়েকটি দিন বাকী ছিল।  অনেকটা মন খারাপের ভিতরেই পরীক্ষা শেষ করি। হঠাৎ আনন্দময় ভাবনার ভিতর অজ্ঞাত কোন্ এক মেয়ে মনের উপর একটু বিষণ্ণতার ছায়া ফেলল। ভুলে যাই। মনের উপর জোর রাখলাম, ভাবলাম,  এইসব কিছু না।  এইসব মিছে মায়া।  অন্তরের ভিতর এইসব  ঠাঁই দিয়ে আসন্ন শুভক্ষণগুলোকে অসুখকর করা ঠিক হবে না। 

যেদিন পরীক্ষা শেষ হয়, সেদিন রুমে এসে দেখি দরজার নিচে দিয়ে পিওন দুটো চিঠি ফেলে রেখে গেছে।  একটি চিঠি নীলিমার।  আর একটি চিঠি অপরাজিতার। আমি নীলিমার চিঠিখানি প্রথম পড়ি। 

প্রিয়তম, 

পরীক্ষার শেষ হওয়ার পর দেরি না করে তাড়াতাড়ি চলে আসিও। বাঁধ ভাঙা আবেগে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। সময়ে অসময়েই  তোমার কথা আমার মনে পড়ে। দিন যত এগিয়ে আসছে, তত আমার শরীর মন কাঁপছে। ভাবি বসে বসে -- কী সুন্দর দিন, কী মধুময় রাত হৃদয় পথগামি। 

সকাল থেকেই এখানে আজ বৃষ্টি হচ্ছে । দমকা হাওয়ায় মাতিয়ে উঠেছে বৃক্ষরাজি। একটি ছাতা মাথায় দিয়ে দুজন করোতায়া নদীর পারে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। আমাকে তুমি বৃষ্টি দাও। ঝুমঝুম করে আমার সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে দাও। 

তুমি এসো। চূর্ণ করে দাও আমার অপেক্ষা।কিছুতেই কাজে মন বসে না। তুমি আমাকে তোমার ঘরে তুলে নিয়ে বাজাও বর্ষার মল্লারের সুর।      

ভালো থেক তুমি প্রতিদিন সারাক্ষণ। 

-- তোমার নীলিমা।   

    

 এরপরে পড়লাম অপরাজিতার চিঠিটি। 

 কল্যাণীয়েষু,  

আমি জানি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিনই তুমি  চলে যাচ্ছ। তোমাদের বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক হয়ে আছে। তোমার এই আসন্ন শুভক্ষণে আজ আর আমি কোনও অমঙ্গলের কথা লিখব না। তোমার এই শুভদিনে আমি শুধু তোমার মঙ্গল প্রার্থনাই করব। 

কটা দিন ধরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কী দরকার ছিল তোমাকে অমন করে  চিঠি লেখার। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে আমন্ত্রণ করব -- বুড়িগঙ্গার পারে যেয়ে দুজন দেখা করব। ওখানে নদীর তীরে কোথাও ঘাসের ওপর বসব—তুমি আর আমি। তখন জলে বিরাজ করবে শুভ্র শান্তি। অন্ধকারে তীরের বৃক্ষ গুল্ম হয়ে উঠবে নিবিড়। অস্তমিত সূর্যের আবছায়ায়  মুখ তুলে তাকিয়ে দেখব তোমাকে। লাল আভায় চিক চিক করবে আমার চোখের জল। যদি তোমারও কান্না পায়, যদি তোমারও চোখের জল ঝরে পড়ে আমার ললাটের উপর। তাহলে মরেও শান্তি পাব। কিন্তু তা হলো না। ভয়ও করল যদি তুমি না আসো। আমি নিজেই নিজেকে বারণ করলাম। 

হয়ত আর চিঠি লিখব না। একা থাকা কী হবে? কেউ না কেউ আসবে জীবনে। তাকে নিয়েই হবে সংসার। সংসার কর্মের ভিতর তোমাকে যেন ভুলে থাকতে পারি। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার শেষ কটি চরণ দিয়ে এই চিঠিখানা শেষ করছি --

তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান, গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়, ওগো বন্ধু বিদায়। 

 -- অপরাজিতা।  

                

মনটা কেমন যেন লাগছিল। বাড়িতে আসার আগের দিন এমনই একদিন বুড়িগঙ্গার পারে একাকী চলে যাই। কোথাও নির্জন কূল নেই। নদীতে কত নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার। ওদের আসা যাওয়ার ভেঁপু'র শব্দ। তীরে জনারণ্য। নেই কোথাও বনঝোপ। কোথাও কোনও বন অন্তরালে অপরাজিতা ফুটে নেই।     


আমি বাড়িতে চলে যাই। এক ফাগুন দিনে আমার বিয়ের তারিখ হলো।    

বিয়ের দুই দিন আগের কথা। সেদিন  ঘরে আমি একাই ছিলাম। অনেক রাত্রি হয়েছে। ঘুম আসছিল না চোখে। অপরাজিতার চিঠি তিনটি ব্যাগে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। চিঠি তিনটির কথা মনে হলো। মনটা কেমন হুহু করে উঠল। একটি সিগারেট ধরাই। দরজার খিরকি খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে অন্ধকার। আকাশে একটি তারাও নেই । কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হাতের সিগারেটের পোড়া অর্ধেকটা উঠোনে ফেলে দিয়ে রুমে চলে আসি। টেবিলের উপর ল্যাম্পটি  মিটমিট করে জ্বলছিল। ব্যাগের  তলা থেকে চিঠি তিনটা বের করে ল্যাম্পের আলোয় আবার পড়তে থাকি। কবে কখন একটি মেয়ে এমন করে আমায় ভালো বেসেছিল, ভেবে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। 

দুইদিন পর বিয়ের সানাই বেজে উঠবে। ভাবলাম-- অমঙ্গলের এই অভিজ্ঞান কেন ঘরে রাখব? চিঠি তিনটি তাই  ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করি। এবং ছে্ঁড়া টুকরাগুলি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেই। অন্ধকারে সে টুকরোগুলো দমকা বাতাসে উড়ে কোথায় ধূলোবালিতে মিশে হারিয়ে গেল।


প্রায় এগারো বছর পরে একদিন অপরাজিতার একটি চিঠি পাই। অপরাজিতা লিখেছে --

বন্ধু আমার, 

এই শহরে তুমি থাকো। আমিও থাকি। তোমার কুশল আমি সব জানি। তোমাকে দেখিও মাঝে মাঝে। কী সুন্দর পরীর মতো বউ তোমার। বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে দূর থেকে তোমার সব সুখ আমি দেখি। 

আমার কথা কী তোমার একবারও মনে পড়ে না? অবশ্য আমাকে তুমি মনে রেখো -- এই দায় তোমাকে আমি কখনও দেইনি।  তোমার উপর থেকে আমার ভালোবাসা একটুও যায়নি। আজও তোমাকে খুব ভালোবাসি।

যে মেয়েটি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল, তাকে একটিবারও দেখবার সাধ হয় না?  আমাকে না দেখেই তুমি মরে যাবে?  এমন অতৃপ্তি তুমি রেখ না। যদি আমাকে দেখবার ইচ্ছে হয় তাহলে  দেখতে এসো। কেবিন নং ৫০৭, পঞ্চম তলা,  পিজি হাসপাতাল, ঢাকা।   

--- অপরাজিতা। 

দুইদিন পরই একদিন সকাল এগারোটার দিকে আমি পিজি হাসপাতালে চলে যাই। ৫০৭ নং কেবিনের দরজায় নক করি। কেউ খুলছে না। একজন নার্স এগিয়ে আসে। উনি বলছিলেন - ওনার তো আজ অপারেশন হচ্ছে । ওটি নং ৩ এর সামনে চলে যান। ওখানে ওনার স্বজনেরা আছেন। আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করি -- কী হয়েছে ওনার?  কিসের অপারেশন হচ্ছে। 

-- যকৃতে ক্যানসার। সম্ভবত শরীরের সারা রক্তে তা ছড়িয়ে গেছে।                                        

      

আমি ৩ নং অপারেশন থিয়েটারের সামনে চলে যাই। ওটির সামনে বেশ কয়েকজন নারী পুরুষকে দেখতে পেলাম। কেউ আমাকে চেনে না। একজন লোককে দেখলাম সে একটি ছয় সাত বছরের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। মেয়েটি কাঁদছেে। বুঝতে পারলাম মেয়েটি অপরাজিতার  মেয়ে। আর লোকটি অপরাজিতার স্বামী। ওনার চোখে মুখে চরম উদ্বিগ্নতার ছাপ। আরও যারা আছে, তারাও সবাই চিন্তাক্লিষ্ট ও বিষণ্ণ। কেউ কেউ অশ্রু সিক্ত।   

আমি অনাহুতের মতো একটু দূরে কোরিডরে দাঁড়িয়ে থাকি। আধা ঘণ্টা পরে অপারেশন থিয়েটার থেকে কেউ একজন এসে জানায় -- রোগিণী মারা গেছে। তারও কিছুক্ষণ পরে ট্রেসারে করে সাদা চাদরে ঢেকে মৃত রোগিণীকে ওটি থেকে বের করে আনে। কোরিডরে আত্মজনরা সবাই ট্টেসারের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সাদা কাপড় সরিয়ে সবাই তার মুখখানি দেখছে। আমিও নিঃশব্দে ট্রেসারের কাছে গিয়ে দাঁড়াই, দেখি অপরাজিতার মুখ।   


আমি কোরিডর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে আসি। পিছনে বাচ্চা মেয়েটির ক্রন্দনধ্বনি হাসপাতালের কংক্রিটের দেয়ালে বিদীর্ণ হচ্ছিল। শব্দহীন আত্মস্বরে বলছিলাম -- অপরাজিতা, এত কাছে ছিলে তুমি। এত তোমায় দেখেছি। এত ভালো বেসেছিলে তুমি। আমি তা বুঝতে পারিনি। তুমি চোখ বন্ধ করে আছ,  দেখলাম তোমার আর্তিময় আঁখিপাতের মায়া।  জীৎ তোমারই হলো। আমিই  হেরে গেলাম। বাকী জীবন আফসোস করে  আমাকে কাটাতে হবে। 

ওপারে তুমি ভালো থেকো অপরাজিতা। রেস্ট ইন পিচ।       

 

২৯ জুলাই, ২০২০ ইং

দক্ষিণখান, ঢাকা ৃ                                                        

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০২০

ইডিয়ট

ইডিয়ট 

একদিন অফিসের ঠিকানায় একটি চিঠি পাই। খামের উপর হাতের লেখা দেখে চিনতে পারিনি -- চিঠিটি কে পাঠিয়েছে। খাম খুলে চিঠিটা পড়তে থাকি ।
 
কল্যানীয়ষু রঞ্জন,
 
জানিনা তুমি কেমন আছো?  অনেক কষ্ট করে তোমার ঠিকানা আমি যোগাড় করে এই পত্রখানা লিখছি।  অনিশ্চিত মনে হচ্ছে, এই ঠিকানায় তুমি চিঠি পাবে কিনা? তবুও লিখলাম।
কতগুলো বছর চলে গেছে। তোমার সাথে আমার দেখা নেই। হিসাব করে দেখলাম পঁয়ত্রিশ বছর। এই পঁয়ত্রিশ  বছর ধরে তোমাকে দেখি না।    

তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ঠিকানা দিলাম। সময় করে যদি একবার আসতে খুব খুশি হতাম।  ভালো থেকো। 
 
ইতি -- নীলোৎসী।                                         
             

নীলোৎসী ছিল আমার সহপাঠী।  ওর  পুরো নাম কাজী নাদিরা বেগম।  ক্লাসের সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে ছিল সে। তুলনামূলক ভাষা সাহিত্যের ছাত্রী ছিল।  ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইত। আবৃত্তি, বিতর্ক, নাচও করত। ক্লাসের এক ডজন ছেলের মতো আমিও তার এক তরফা প্রেমিক ছিলাম। 

আমিও আবৃত্তি করতাম, বিতর্কে অংশ নিতাম , সৌখিনভাবে নাটকেও অভিনয় করতাম। আমাকে তাই নীলোৎসী একটু পাত্তা দিত। অন্য ছেলেদের চেয়ে আমার সাথে সে বেশিই মিশত। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোনো দিন সাহস করে  নীলোৎসীকে বলিনি -- ''তোমাকে আমার ভালো লাগে''।  আর -- ''তোমাকে আমি ভালোবাসি'' এই কথা বলা তো অনেক দূরের আকাশের চাঁদ ছোঁয়ার মতো ছিল । তাই ঐ ছায়াপথে কখনও হাঁটতাম না।    '   
                           
নীলোৎসী ছিল অভিজাত পরিবারের মেয়ে। ঐ সময়ে সে গাড়িতে করে ইউনিভার্সিটিতে আসা যাওয়া করত। প্রতিদিন এক একটা নতুন জামা পরত। বেশির ভাগ সময় ব্যান্ড দিয়ে চুল বেঁধে খোলা চুলগুলো পিছনে ঝুলিয়ে রাখত। কোরিডর দিয়ে যখন হীল জুতা পরে খটখট করে  হাঁটত তখন চুলগুলো হাওয়ায় উড়ত।

সে যাই হোক -- আমিই ওর ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। ক্লাস অবসরে আমার সাথেই ও কথা বলত। ক্যান্টিনে যেয়ে মাঝে মাঝে সিঙারা চা খেতাম। এই পর্যন্তই।             

একদিন সেমিনার রুমের সামনে কোরিডরে দাঁড়িয়ে নীলোৎসীকে বলেছিলাম -- "তুমি নীল শাড়ি, কপালে নীল টিপ, নীলের সাথে মিলিয়ে চুড়ি, মালা,  চুলের ক্লীপ পরে একদিন ক্লাসে    আসবে। তোমাকে আশ্চর্য রকম রূপবতী লাগবে। এই রূপে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।" নীলোৎসী হঠাৎ এই কথা শুনে বিস্ময় চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল। কিছুক্ষণ নিরব থেকে  বলেছিল -- 'আচ্ছা, নীল শাড়ি, নীল টিপ পরে আসব একদিন।'                           

নীলোৎসী নীল শাড়ি পরে আর ক্লাসে আসেনি। কারণ, এর পরপরই বাবা মার পছন্দ মতো একটি অপরিচিত ছেলের সাথে ওর বিয়ে হয়ে যায়। নীলোৎসী ছিল বুদ্ধিমতি মেয়ে।  সে ভুল করে নাই। ওর স্বামী ছিল বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাদের পুরো পরিবার ছিল প্রতিষ্ঠিত ও বিত্তশালী। বিয়ের পর নীলোৎসী আর ইউনিভার্সিটিতে আসেনি। দেখাও হয়নি আর কোনদিন।  ওর সাথে কোনো যোগাযোগও হয়নি আর।  

নীলোৎসীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর খুব  মনমরা হয়ে থাকতাম। কোনো কিছু ভালো লাগত না। ক্লাসে পড়ায় মন বসত না। সহপাঠীদের সাথে ভালোভাবে কথা বলতাম না। নিজের কাছে মনে হতো -- "আমি মনে হয় নীলোৎসীকে ভুল করে  ভালোবেসে ফেলেছিলাম।''  আমার এই মনমরা ও উদাস অবস্থা দেখে সহপাঠীরা পরিহাস করে 
বলত -- "তুই একটা ইডিয়ট। কোনো একটা মেয়ের একটু কথা বলাকে, একটু মেশামেশাকে, একটু বন্ধুত্বকে মনে করেছিস প্রেম। তুই নির্বোধ ছাড়া আর কিছু না ! "     

আমারও তাই মনে হয়েছে -- আমি সত্যি একটা ইডিয়ট। একটা মায়া লাগা ঘোর, একটা মিছে স্বপ্ন দেখা, একটা অবাস্তব চাওয়া -- আর না পাওয়ার বেদনায় নিজেকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছিলাম। ভুলে যেতে চাইলাম সব মিছে মায়া, মিছে স্বপ্ন। ভুলেও গেলাম। আমি যে একটা ইডিয়ট ছিলাম, এই ভেবে নিজেকে মনে মনে তিরস্কারও করলাম। 

তারপর চলে গেছে পঁয়ত্রিশ বছর।  নীলোৎসী কোথায় থাকে, কেমন আছে, কী করে কিছুই খোঁজ খবর জানতাম না। 

আজ এত বছর পর সেই বিস্মৃত হয়ে যাওয়া নিলোৎসীর চিঠি পেলাম। কেমন যেন লাগছে আমার। একবার মনে হলো -- কেন যাব?  যেতে বলল দেখেই যেতে হবে? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, নীলোৎসী আমার কিছু না হোক, সে তো আমার সহপাঠী ছিল। এই একটি দায় তো আমার চিরকালের হয়ে আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম, নীলোৎসীকে দেখতে যাব।  ওকে তাই একটা চিঠি লিখলাম --                                                                                
কল্যাণীয়াসু নীলোৎসী, 

আমি আগামী ২৭ আশ্বিন, বৃহস্পতিবার তোমার ওখানে আসছি। আমি এখান থেকে ভোরে রওনা হবো। রাস্তায় কোনো অসুবিধা না হলে  তোমার ওখানে বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব।  আমাকে আবার ঐদিন বিকালেই চলে আসতে হবে। 

আমি যে তোমার ওখানে যাচ্ছি, এই কথা আমার স্ত্রীকে বলছি না। তুমি আমার কেউ না, তুমি আমার কিছু ছিলে না, তারপরও তোমার কাছে যাচ্ছি একথা শুনলে সে মনে কষ্ট পাবে। একটু মিথ্যা না হয় বললাম ওকে। বলব, একটা অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি, আজই ফিরে আসব। 
ভালো থেকো তুমি।

ইতি --- রঞ্জন।                                                           

মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে একটি পাবলিক বাসে উঠে টাংগাইলের মধুপুর রওনা হই । মধুপুর গড় এলাকাতে একটি বাংলো বাড়িতে  নীলোৎসী থাকে। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম  -- সেই কতকাল পড়ে নীলোৎসীকে দেখতে পাব। নীলোৎসী চিরকাল মানুষের কাছে থেকে ওর রূপের প্রসংশা কুড়িয়েছে। একটু ভয় লাগছিল -- এক সময়ের এই মানস প্রতিমাটি তো বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যায়নি? মুখে কপোলে পড়েনি বলিরেখা? আবার ভাবলাম, দেবীরা কখনও বুড়ী হয় না, ওরা চিরকাল চির যৌবনা থাকে । 
                
একসময় মধুপুর যেয়ে বাসটি পৌঁছে। আমি বাস থেকে নেমে একটি চার দোকানে চা খেতে খেতে নিলোৎসীর বাড়িতে ষাওয়ার পথটি দোকানদারের কাছে থেকে  জেনে নেই। দোকানদার বলছিল, আপনি একটি টমটম নিয়ে যেতে পারেন, কিংবা রিকশায়। আমি একটি টমটম নিয়েই  নিলোৎসীর বাড়ির দিকে যেতে থাকি ।    

এলাকাটি সম্পূর্ণ গড় এলাকা। আমি যে রাস্তা দিয়ে টনটমে করে যাচ্ছিলাম, তার একপাশে বিস্তীর্ণ শাল, গজারি, গামারী, মেহগনি, জারুল গাছের বন। বনের ফাঁকেে ফাঁকে ছোট বড়ো মাটির টিলা আছে,  দেখতে অনেকটা মালভূমির মতো লাগছিল।  রাস্তার আরেক পাশে সমতল ফসলের ক্ষেত। 

কিছুদূর যাওয়ার পরই একটি একতলা বাংলো বাড়ি দেখতে পাই।  বাড়িটার একদম কাছে গেলে গেটে একটি নাম ফলক দেখা গেল। ফলকে  লেখা আছে -- 'নীলোৎসী'। বুঝতে পারলাম এটাই নীলোৎসীর বাড়ি। আমি টমটম থেকে নেমে 
পড়ি।                                     
 
গেটের কাছে একজন দারোয়ানকে দেখতে পাই। এই বাড়ি যে নীলোৎসীর বাড়ি এটা জেনেও দাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করি,  এটা কি মিসেস নাদিরা বেগমের বাড়ি? 

-- জ্বী।  আপনার নাম কী?  কোথা থেকে এসেছেন? 

-- আমার নাম রঞ্জন রহমান। ঢাকা থেকে এসেছি। 

-- ভিতরে আসুন। ম্যাডাম আপনার কথা আমাকে বলে রেখেছেন। বলেছে, ঢাকা থেকে আমার একজন মেহমান আসবে, তার নাম রঞ্জন রহমান।                              
দাড়োয়ান সোজা আমাকে বাংলোর ভিতরে নিয়ে  যায়। ভিতর থেকে একজন পরিচারিকা বের হয়। দারোয়ান পরিচারিকাকে বলে, ইনি ম্যাডামের মেহমান। ড্রইংরুমে ওনাকে বসতে দাও।  এবং  ম্যাতামকে যেয়ে  বলো -- উনি চলে এসেছেন। 
পরিচারিকা আমাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে ভিতরে চলে যায়। একটু পর ফিরে এসে বলে -- ম্যাডাম আপনাকে ভিতরে যেতে বলেছে। উনি ওপাশে বারান্দায় বসে আছেন।  

ভিতরে যেতে একটু দ্বিধাই করছিলাম। একটু শঙ্কাও লাগছিল , কোনো বিপদে পড়ব না তো ! এ কী সত্যি নীলোৎসী? নাকি অন্য কেউ?  তবুও দুরু দুরু পায়ে ভিতরে বারান্দার দিকে চলে যাই। বারান্দাটির চারিদিকে গ্রিল দিয়ে ঘেরা। বাইরে ওপাশে শাল গজারির নিবিড় বন। আসন্ন দুপুরের তপ্ত সূর্যের আলো ঝরে পড়ছে বনের পাতার ফাঁক দিয়ে। কিচিরমিচির করছে বনের পাখিরা। দেখি, একটি হুইল চেয়ারে একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা আমার আসার পথপানে করে বসে আছে। মুখখানি শুকনো এবং বিষণ্ণ সুন্দর। আমি চিনতে পারলাম, এই নীলোৎসী।  আমাকে দেখে সে স্মিত হেসে বলে -- 'তুমি এসেছ রঞ্জন!' পাশে একটা চেয়ার আগে থেকেই রাখা ছিল। আমাকে সেই চেয়ারটা দেখিয়ে বলল -- তুমি এখানেই বসো রঞ্জন।  

নীলোৎসীর চেহারা আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমার চোখে আঁটকে ছিল। একটি প্রস্ফুটিত ফুলের মতো চেহারা ছিল ওর।        আজ ওকে দেখে আমার মনটা হুহু করে উঠল। এই সেই নীলোৎসী যে কী না একসময় শত তরুনের হৃদয় কাঁপাত ! সেই নীলোৎসী এত রোগক্লিষ্ট, এত মলিন হয়ে গেছে।

এত ভগ্ন শরীর নিয়েও সে আজ হালকা নীল রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি পরে আছে। মুখে কোনো প্রসাধন করেনি। হাতে নীল পাথর বসানো চুড়ি পরেছে কেবল। আমার মনে পড়ে গেল-- সেই কবে একদিন ইউনিভার্সিটির কোরিডরে দাঁড়িয়ে ওকে বলেছিলাম ---- তুমি একদিন নীল শাড়ি পরে ক্লাসে আসবে। নীলোৎসী বলেছিল -- "আসব পরে একদিন।" কিন্তু নীলোৎসী আর পরে আসতে পারেনি। আজ কী আমাকে দেওয়া  ওর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল?                       
            
খুব বেদনা ভরে নীলোৎসী আমাকে বলছিল -- তুমি কেমন আছো রঞ্জন?  বললাম -- আমি ভালো আছি। 

-- মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? 

-- তোমাকে দেখার পরই হয়ত এমনটা হয়েছে আমার। তোমাকে দেখেই  কেমন যেন হয়ে গেছি আমি। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। তোমার কী হয়েছে নীলোৎসী? 

-- লিভার সিরোসিস। লিভার গলে পঁচে গেছে। দুইবার স্ট্রোকও করেছে। তারপর থেকে প্যারালাইজডৃ হয়ে গেছি। হাসপাতালে ছিলাম অনেক দিন। ডাক্তার ঔষধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে -- বাড়িতেই বিশ্রামে থাকেন। মাঝে মাঝে টাংগাইল থেকে ডাক্তার ডেকে এনে ফলোআপ করিয়ে নেই।                                                        
   
-- তোমার স্বামী ও ছেলেমেয়ে কোথায়?  কাইকে যে দেখছি না। 

--- স্বামী গত বছর মারা গেছেন।  এক ছেলে এক মেয়ে দুজনেই বিদেশে থাকে। মেয়ে কানাডাতে আর ছেলে আমেরিকায়। দেশে ওরা কেউই আসে না। মেয়েটা একটু খোঁজ খবর রাখে।  ছেলেটি একদম না। মনে হয় ওরা ওদের মন থেকে  শিকড় উপড়ে ফেলেছে। 
              
নীলোৎসী বলছিল -- থাক ঐসব কথা।  তোমার বউ কেমন আছে? 

-- ভালো আছে। 

-- খুব সুন্দরীী মেয়ে বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই। 

-- হুম।  তোমার মতোই দেখতে। 

-- কী নাম ওর? 

-- মায়া। 

-- মায়াবতী নিশ্চয়ই? 

-- হুম। 

-- ছেলেমেয়ে কজন? 

-- এক ছেলে দুই মেয়ে। 

-- ছেলেটা দেখতে নিশ্চয়ই তোমার মতো হয়েছে? 

-- হুম।

-- মেয়ে দুটো কার মতো? 

-- মায়ের মতো।                             

আমি নীলোৎসীকে বললাম,  তা এই বন নির্জনে কেন আছ?  শহর ছেড়ে এত দূরে?  

-- আমার স্বামী বন বিভাগেই চাকুরি করত। দেশের কত বনারণ্যে ঘুরেছি,  থেকেছি। এখানে এই মধুপুর রেঞ্জেও ওর পোস্টিং ছিল। ও এই জায়গাটা খুব পছন্দ করেছিল। পেনশনের টাকা থেকে এই জায়গাটা কিনে এই কাঠের বাংলাটা তৈরি করেছিল।  বলেছিল -- আমাদের শেষ জীবনটা এই বনকুঞ্জেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু তা আর কাটাতে পারল কই?  আমাকে একা করে ফেলে রেখে বিধাতা ওকে  আমার কাছে থেকে নিয়ে গেল। এখন তো আমি নিজেই মৃত্যুর প্রহর গুনছি।                                                                                 
আমি বললাম -- জায়গাটা খুবই সুন্দর। একপাশে ঘন অরণ্য, আরেকপাশে ফসলের মাঠ।  ছোট্ট সুন্দর একটি পুকুরও দেখলাম । পুকুর ভর্তি নীলপদ্ম ভরে আছে । সম্মুখে বাগান দেখলাম, রঙ্গন,জবা, চেরী , গোলাপ, বেলী ফুল সব  ফুটে আছে।      
                                                         
নীলোৎসী বলছিল -- পত্রে তুমি  লিখেছ, আজই বিকেলে তুমি চলে যাবে। যদি তুমি থাকতে তাহলে বুঝতে পারতে এখানে কী সুন্দর রাত্রি নামে। সন্ধ্যার পরপরই আস্তে আস্তে পাখিদের কলকাকলি থেমে যায়। তারপর রাত নামতে থাকে। শাল গজারি মেহগনি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যায়। দূরে অজস্র নক্ষত্রবীথি। 
ঝোপে ঝাড়ে জোনাক জ্বলে। জ্যোৎসায় ভাসে বন প্রান্তর। ফুলের সুবাসে ভরে থাকে এই বারান্দা, চাঁদের আলোর রশনি এসে আমার চোখে মুখে লাগে। আমার কী যে ভালো লাগে তখন। আমি কান পেতে থাকি। কার যেন দূরাগত পদধ্বনি শুনতে পাই। মনে হয় কেউ যেন হেঁটে হেঁটে আমার দিকে  আসছে।  আসলে কেউ আসে না। সবই ভ্রম!                                    
    
নীলোৎসী বলছিল -- কথায় কথায় দুপুর গড়িয়ে গেল।  চলো-- চারটা ডাল ভাত খেয়ে নেবে। 

ও ওর পরিচারিকাকে ডাকতে যাচ্ছিল।  আমি বললাম, কী জন্য ডাকছ?  নীলোৎসী বলছিল, মেয়েটা এসে আমাাকে একটু ডাইনিং পর্যন্ত নিয়ে যাক।                      

আমি মেয়েটিকে ডাকতে দিলাম না। আমি নিজেই হুইল চেয়ারের পিছনে যেয়ে দাঁড়াই। এবং চেয়ারটা ধরে ঠেলে নীলোৎসীকে ডাইনিং রুমে  নিয়ে  আসি। নীলোৎসী হুইল চেয়ারে বসেই আমার সাথে খেতে বসে। কোনো রিচ খাবার নেই।  সাদা ভাত, ডাল, ডাটা দিয়ে টেংরা মাছের তরকারি, উস্তা ভাজা, টাকি মাছ ভর্তা আর কচুর লতি ও কাঁঠালের বিঁচি দিয়ে পুঁটি মাছের তরকারি। আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, ও যখন আমার বন্ধু ছিল,  তখন আলাপ প্রসঙ্গে নীলোৎসীকে আমার এই পছন্দের খাবারগুলোর কথা প্রায়ই বলতাম। ও কী সেই কথা আজ পর্যন্ত মনে রেখেছে তাহলে?    

বিকাল হয়ে যায়। আমি নীলোৎসীকে বলি -- আমার চলে যাবার সময় হয়ে গেছে।  ও বলছিল -- হ্যাঁ,  তোমাকে থাকতে বলব না।  তোমার মায়াবতীকে আমি কষ্ট দিতে চাই না।  তোমার প্রতি আমার অধিকার সেই কবেই হারিয়েছি।  এখন শুধু মিছে মায়াটুুকু ছাড়া কিছু নেই। কয়দিন ধরে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল।  সেই কত বছর চলে গেছে। কত হাহাকার করেছি তোমাকে একটু দেখবার  জন্য। এখন মনে হচ্ছে-- মরেও শান্তি পাব। পরপারে তুমিও যখন যাবে তখন তোমাকে ঠিকই চিনে নিতে পারব। 

আমি নীলোৎসীর অলক্ষ্যে  আমার চশমার ফ্রেমের নীচে আঙুল দিয়ে চোখের কোণটা মুছে নেই। ওকে বললাম -- আসি এখন। 

নীলোৎসী বলছিল-- আমার হুইল চেয়ারটা একটু দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাবে?  আমি চেয়ারটি ঠেলে ওকে দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাই।  নীলোৎসী বলছিল -''আমার হাতটি একটু  ধরে দাঁড় করাবে?  আমি দরজাটা ধরে  দাঁড়াব। দরজায় দাড়িঁয়ে তোমার চলে যাওয়া দেখব।''  আমি ওর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দেই।  ও কষ্ট করে দরজাটা ধরে দাঁড়ায়। দেখলাম,  ওর হাত পা কাঁপছে ।     
  
নীলোৎসীর  হাতটা ভীষণ গরম লাগল, কপাল ছুঁয়ে দেখি -- সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।  আমি ওকে বললাম -- তোমার তো অনেক জ্বর। এতক্ষণ তুমি কোন্ শক্তিতে বসে আমার সাথে কথা বললে? 

নীলোৎসী বলছিল -- ও কিছু না।  এই রকম জ্বর প্রায়ই হয়। ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যায়। আর,  তোমার হাতটা খুব শীতল ছিল -- তপ্ত জ্বর তাতেই  চলে যাবে।       

আমি নীলোৎসীর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। আসতে আসতে মনে হলো, পিছনে তাকিয়ে ওকে আর একবার দেখে নেই । বিদায় নিয়ে কারোর কাছে থেকে চলে  আসার সময় নাকি পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। কিন্তু মন মানল না।  আমি পিছনে মুখ  ঘুরিয়ে নীলোৎসীকে আবার  দেখলাম। ও দরজা ধরে আমার দিকে মায়া ভরে তাকিয়ে আছে। 

ওর চোখে তখন কী জল ছিল?  দূর হতে বোঝা গেল না।  


২৪ জুলাই, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।                                                                                                                                           

 

সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ১৩

পরেরদিন সকালে রোহিত ঘুম থেকে উঠে ছায়া রাণীকে ডেকে বলে -- ছায়া, আজ বিকালে শহর থেকে মণিকারা আসবে, এখানে থেকে শহীদুল ওর বউকে নিয়ে আসবে। সন্ধ্যার পর আমরা সবাই মিলে একটু  আনন্দ করব।  

আর একটি কথা, আমি আগামীকাল সকালেই চলে যাচ্ছি। মন খুব করে চেয়েছিল জন্মভূমি দেখতে, এখানকার মাটির গন্ধ নিতে, শৈশবের ধূলির পথগুলো থেকে ধূলো পায়ে মাখতে। আমার সেই অদম্য তৃষ্ণা কিছুটা হলেও মিটেয়েছি। যদিও এ তৃষ্ণা চিরতরে মিটাবার নয়। আকুতি থেকেই যাবে। যা হোক যতটুকু মিটিয়ে নিলাম, ঐ প্রবাস বিভূঁইয়ে এখন আর মন প্রাণ তেমন উতলা হবে না। 

ছায়া রাণী কাঁদছিল। রোহিত বাহুতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে --  পাগলি !  তুই কাদছিস কেন? যদি বেঁচে থাকি, আবার হয়ত এমনই হুট করে একদিন চলে আসব। 

-- দাদা, তুমি আমাকে হঠাৎ করে বলছ, তুমি চলে যাবে। একটুও সময় দিলে না। তোমাকে ওট পিঠা, দইলা পিঠা,  মালপোয়া, চদ্রপুলি, দুধের পিঠা কিছুই বানিয়ে খাওয়াতে পারিনি। জেঠী মা এগুলো তোমাকে বানিয়ে খাওয়াতো।  তুমি খুব পছন্দ করতে।              

-- মন খারাপ করিস  না। আমি আবার তো আসব, তোকে বললাম। তখন বানিয়ে খাওয়াবি।
 
-- আমার মাথার দিব্বি রইল। তুমি আবার আসবে কিন্তু।   
  
--- আচ্ছা।  জামাই বাবু ও রঞ্জিতকে বলে রাখবি, ওরা যেন কাল সন্ধ্যায় থাকে।  আর, শোন্ -- এই টাকাগুলো রাখ, বাজার করবি। সবাইকে দুমুঠো ডাল ভাত খাওয়াতে হবে তো !    

আমি একটু শহীদুলের ওখানে যাচ্ছি। দুপুরেই চলে আসব। এসে তোর সাথে বসে একসাথে খাব। 

-- নাস্তা করে যাও। 

-- শেফালী ভাবীর কাছে থেকে খেয়ে নেব।     

রোহিত শহীদুলের বাড়িতে পৌঁছেই শহীদুলের স্ত্রীকে বলে -- ভাবী, সেমাই রান্না করো।  মুড়ি দিয়ে সেমাই খাব। সেই কতকাল ধরে মুড়ি দিয়ে সেমাই খাই না।   

--- রোহিত দা, আপনেরা দুই বন্ধু গল্প করতে থাকেন, আমি ঝটপট সেমাই রান্না করে নিয়ে  আসছি।         

শহীদুল রোহিতকে বলছিল, তুই কাল কখন যাবি? 

-- সকাল নয়টার মধ্যে বের হয়ে যাব। 

-- তোকে একটা কথা বলি রোহিত। এখনও তো জীবন অনেকখানি রয়ে গেছে। এই ধর্ -- পাঁচ বছর, দশ বছর, বিশ বছর বাঁচতেে পারিস। এই সময়টুকু সায়াহ্নকাল। অসুখ বিসুখ, শারিরীক কত অক্ষমতা আসে মানুষের । তাছাড়া একাকীত্ব তো আছেই। তুই একটা বিয়ে করে নে।                                 

-- নারে, সংসার আসক্তি আমার একদমই নেই। ভালোবাসা মায়া মমতা সবই মুক্ত বিহঙ্গের মতো ব্যপ্ত হয়ে আছে আকাশে। আমার আছে নীল আকাশ। আমার আছে মেঘ। যদি কখনও নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগে, যদি একা এলা আর না চলতে পারি, তবে মেঘকে বলব, তুমি বৃষ্টি ঝরাও,  বলব -- তুমি কাঁদো। না হয়, ঈশ্বরকে ডাকব, বলব -- তুমি আমাকে নিয়ে যাও।     

-- আমি বুঝিনা তোর এইসব কথা।          

--- সে বহুকাল আগে স্বপ্নে পাওয়ার মতো ডানা মেলে উড়ার আকাশ পেয়েছিলাম। ছোট্ট একটি ঘরে সংসার গড়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেই আকাশটা, সেই ঘরটা আর পাওয়া হয়নি। সবই স্বপ্নেে থেকে পাওয়া ছিল। স্বপ্ন ভেঙে গেছে। সবকিছু হারিয়ে গেছে।  


--- তুই বিয়ে কর, তুই সবকিছু আবার ফিরে পাবি।                        

-- এই জীবনে আর রাজ্যপাট গড়তে চাই না। কত কিছুই ঘটে পুরো জীবন অব্দি। কতজন কত কিছু পায়, রাজ্য, রাজরাণী, রাজকন্যা -- কতকিছু ! এই সব অনেকেই পায়, যারা সৌভাগ্যবান। অনেকে আবার পেয়ে হারায়। আবার কেউ কেউ পায়ই না। প্রবঞ্চিত যারা।    

জীবনে কত কিছুই ঘটে গেল। কত দেশ দেখলাম , কত নব নব মুখ, কত তুষার পড়া শীতের রাত্রি।পুষ্প কাননে ফুটে থাকা কত  নতুন ফুল, পদ্ম-কুসুম দামের কত হৃদয় কেঁদে কেঁদে দিঘির জলে মিশিয়েছে,  কত সে মায়া বিদুর স্মৃতি!…

--- আমি কিছু অনুমান করতে পারছি। তোর এই অপ্রাপ্তি, তোর এই হাহাকার ও গ্লানি কিসের জন্য, কার জন্য? 

--- অনুমানের কথা তোর ভিতরেই থাক্। যে কথা বলা হয়নি এতকাল তা আর এই সায়াহ্ন কালে নাইবা বলা হলো। তা অপ্রকাশিতই থাক। কোনো কথা না বলা মিথ্যা বলা নয়।                     


শেফালী এসে বলে -- চলুন খাবার টেবিলে। মুড়ি সেমাই খেয়ে নিন।      

      

নাস্তা খাওয়ার পর রোহিত শহীদুলকে বলে -- আলোকদিয়ার পুরানো জমিদার বাড়ির সামনে   একটি দিঘি ছিল না !  ঐ  দিঘিতে নেমে স্নান করতে ইচ্ছা করছে।  ছোট বেলায় ঐ দিঘিতে নেমে আমরা কত জলখেলা করেছি না !  আহা, কী শীতল ছিল জল। গা ঠান্ডায় জুড়ে যেত। আচ্ছা শহীদুল, জমিদার বাড়ির ঐ দিঘির জল এত ঠান্ডা ছিল কেন?   

--  তা জানি না।   চল্ জলকে চল্। তপ্ত দেহখানি শীতল করে নিবি।  '         


দুপুরে রোহিত বাড়িতে এসে ছায়া রাণীকে নিয়ে একসাথে বসে ভাত খেয়ে নেয়। খেতে খেতে রোহিত ছায়া রাণীকে বলছিল -- তুই এই বাড়িটিকে আনন্দে ভরে রেখেছিস।  তুই না থাকলে এই বাড়িতে একটি মূহুর্ত আমি  থাকতে পারতাম না।  আমার মায়ের শূন্যস্থাম তুই পূরণ করেছিস , রোহিনীর ও বৌদিদির অভাবও দূর করে দিয়েছিস। মনেই হয়নি আমি সব হারিয়ে বসে আছি।  

আর, একটা জিনিস আমার খুব ভালো লেগেছে তা হলো -- এই আঁধার হয়ে যাওয়া বাড়িটিতে কেউ না কেউ প্রতি সন্ধ্যায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায়ে রাখে। ধান ধূপ দিয়ে ঠাকুরের ঘরে পূজা দেয়। স্বর্গীয় পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। তুই তাই করছিস।  আমি তোর কাছে ঋণী হয়ে রইলাম ছায়া। 

ছায়া রাণী অঝোর ধারায় কাঁদছিল।  

   -

                                              

বিকালে মতি মিয়া এসে রোহিতকে খবর দিয়ে যায়, শহর থেকে মণিকা'রা চলে এসেছে সন্ধায় এখানে চলে আসবে।    

সন্ধ্যার পর সবাই চলে আসে। মণিকা, জামাইবাবু, ঐশ্বর্শময়ী ও মতি মিয়া । শহীদুলদের বাড়ি থেকে আসে শহীদুল ও তার স্ত্রী শেফালী। আর বাড়ির মানুষের ভিতর ছায়া রাণী,  ছায়া রাণীর স্বামী ও রঞ্জিত।     

উঠোনে লিচু তলায় চেয়ার সাজিয়ে রাখা আছে।  সবাই গোল হয়ে বসে একে অপরের সাথে গাল গল্প, স্মৃতিচারণ, সুখ দুঃখের নানান কথা আদান প্রদান করতে থাকে।     

কাকতালীয় ভাবে সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। সন্ধ্যা রাত থেকেই বাড়ির সারা উঠোন জুড়ে চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে। রোহিত মণিকাকে বলে -- তুমি একটা গান গেয়ে শোনাও।  মণিকা আজ পরেছে সোহাগপুরের নীল রঙের  তাঁতের শাড়ি। গলায় পরেছে শিউলি ফুলের মালা। খোঁপায় এক গুচ্ছ সাদা অতসী ফুল। খুব সুন্দর লাগছিল ওকে।  মণিকা খালি গলায় গাইতে থাকে রবি ঠাকুরের গান --     

'আজ    জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥

যাব না গো যাব না যে,   রইনু পড়ে ঘরের মাঝে--এই নিরালায় রব আপন কোণে।

যাব না এই মাতাল সমীরণে ॥


রোহিত রঞ্জিতকে বলছিল, তুমি একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাও।  রঞ্জিত শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতাটি আবৃত্তি করে --

' স্বাধীনতা তুমি 

রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি 

কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা- 

স্বাধীনতা তুমি 

শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা 

স্বাধীনতা তুমি

পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল...।'


ছায়া রাণী গেয়ে শোনায় রজনীকান্ত সেনের একটি গান ---

' তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, 

মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে.... ।'


এবার রোহিত সবাইকে উদ্দেশ্যেে বলে -- খুব ভালো লাগল এতক্ষণ সবার গান ও কবিতা শুনে। মনে হলো, 'এত সুর আর এত গান ওগো যদি কোনোদিন থেমে যায়।' পরক্ষণেই রোহিত বলে -- না, থামবে না। 

আমি আমার সবচেয়ে  প্রিয় কিছু মানুষকে নিয়ে আজ এখানে এই নির্মল জোছনা রাতে সমবেত হয়েছি। আমি সব হারানো একজন নিঃসঙ্গ মানুষ।  যায়াবরের মতো পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়াই। কতকাল পরে কী এক অসীম মায়ার টানে এখানে এই মাটির ক্রোরে কয়েকদিনের জন্য  ফিরে এসেছিলাম।  এসে দেখি, এখনও কয়েকজন মানুষ আছে, যারা জন্ম জন্মান্তরের আপন। যাদের ভিতর আমার আত্মার স্পন্দন অনুভব  করেছি। যদি ফিরে না আসতাম তাহলে এই প্রিয় মানুষ গুলোকে না দেখেই আমার অতৃপ্ত চোখ  চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত।

কেন যে আমি পৃথিবীর এই ছোট্ট কোণের অপূর্ব সুন্দর এই হরিনা গোপাল গ্রামটি থেকে এক আঁধার রাতে  চলে গিয়েছিলাাাম।  সে কথা চিরদিনের জন্য না বলা হয়েই থাকল।  শুধু এইটকু বলব, সেটি নিতান্তই তারুণ্যের আবেগ ছিল। সেটি ছেলেমানুষী এক ভুল অভিমান ছিল।  আজ এত বছর পর উপলব্ধি করছি, এর জন্য আমাকে কতই না মূল্য দিতে হয়েছে। কত বিনিদ্র রাত কেটেছে নিরব অশ্রুপাতে।                                                                           

এই দীর্ঘকালে কত প্রিয় মানুষকে হারিয়েছি। পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় তারা দেখতে পায়নি আমার মুখ, আমিও দেখতে পাইনি শেষ বিদায়ের ক্ষণের তাদের  অশ্রু সজল মুখখানি। শুনতে পইনি তাদের রক্তাক্ত আর্তনাদ। এদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা চরম মূল্য দিয়ে গেছেন। বাবা মা ভাই ছোট বোনকে হারিয়েছি।  তাদের মতো এই গ্রামের অনেক মানুষ শহীদ হয়েছেন। রোহিনীর মতো অনেক মা বোন তাদের অমূল্য সম্ভ্রমকে এদেশের স্বাধীনতার জন্য বিলিয়ে দিয়ে গেছে।   

আমি আগামীকাল সকালে চলে যাব। আবার কবে আসব, কিংবা আর আসা হবে কী না জানি না।  হয়ত আসব, হয়ত আসব না।  আমার মন এবং আত্মা বারবার আমাকে বলছিল -- 'তোমার কিছু দায় আছে, তোমার কিছু ঋণ আছে, তা তুমি শোধ করে যাও।'    

এই যে আজ এখানে উপস্থিত আছে আমার পরম বাল্যবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম, এখানে উপস্থিত আছে তরুণ দুটি প্রাণ মণিকা ও রঞ্জিত। ওদের দুজনের ভিতর আমি প্রত্যয় দেখেছি। ওদের দুজনকে আমি কিছু দায়িত্ব দিয়ে যাব। ওদেরকে উপদেষ্টা হিসাবে সহায়তা করবে আমার  বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম। ওদের দুজনের পাশে আরও থাকবে, ছায়া রাণী, নাসির উদ্দীন ও ছায়া রাণীর স্বামী সুবোধ দত্ত। 

যে কাজটি করতে হবে তাহলো -- মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত সকল বীরাঙ্গনাদের নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে । যে সমস্ত ধর্ষিতারা শহীদ হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন এবং যারা বেঁচে আছেন তাদের নাম । বাংলাদেশের প্রতি গামে গঞ্জে, শহরে, বিভিন্ন জনপদে হেঁটে হেঁটে, ঘুরে ঘুরে, খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে তাদেরকে।  অনেক বীরাঙ্গনা আছে যারা লজ্জায় তাদের আত্মত্যাগ ও পরিচয় গোপন করে রেখেছে। তাদেরও খুঁজে বের করেতে হবে এবং বলতে হবে তাদের -- দেশের জন্য  তোমরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছ এজন্য মোটেই তোমরা অসম্মানিত নও। ঘৃণিত নও।  তোমরা মহান, এবং মহিয়সী।  তোমাদের ত্যাগ আমরা কোনদিন ভুলব না।                           

কাজটি অনেক কঠিন এবং বিশাল। তোমরা একা এই কাজ শেষ করতে পারবে না। কিন্তু তোমরা শুরু করবে। এর আগে কিছু কাজ ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম, মালেকা বেগম, বেগম মুশতারী শফি, বাসন্তীগুহ ঠাকুরতা ও ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী'রা করে গেছেন।  তারা যেখানে শেষ করেছেন, তোমরা সেখান থেকে শুরু করবে। তোমরা শুরু করবে এই হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে। তারপর  ইউনিয়ন, থানা ও নিজ জেলায় প্রতিটি গ্রামে এবং লোকালয়ে যাবে । তোমাদের এই কর্মযজ্ঞ ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে।  


তোমাদের  না  বলেই আমি একটি ট্রাস্ট করে ফেলেছি। যার নাম দিয়েছি 'রোহিনী স্মৃতি কল্যাণ ট্রাস্ট'। তোমরা সবাই জানো, আমার এই আদরিনী ছোট বোনটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক আর্মির দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল এবং তাকে পরে গুলি করে নৃশংস ভাবে  হত্যা করেছিল।                   

রোহিত তার ব্যাগ থেকে  একটি ছোট্ট কাঁচের বক্স বের করে। বক্সের ভিতর রয়েছে  পুরানো জীর্ণ একটি বকুল ফুলের মালা । রোহিত বলে -- এটি একটি রাখী। এই রাখিটি আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে এক রাখীবন্ধনের দিনে রোহিনী আমার হাতে পরিয়ে দিয়েছিল। 

রোহিত কিছুক্ষণ নিরব থাকে। চশমার ফ্রেমের নীচে আঙুল ঢুকিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে উপস্থিত সবাইকে বিশেষ করে মণিকা, রঞ্জিত ও শহীদুলকে বলে -- 'আমি যে কাজের কথা বললাম, তা তোমরা করতে পারবে না? '    

সবাই আস্থার সাথে সমস্বরে বলে -- পারব।                                                                

তারপর রোহিত ব্যাগ থেকে একটি দলিল বের করে। দলিলটি সবাই কে দেখিয়ে বলে -- আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি 'রোহিনী স্মৃতি কল্যাণ ট্রাস্টে'র নামে দান করে দিয়েছি। যার তত্বাবধায়ক হচ্ছে দুজন -- মণিকা ও রঞ্জিত। এদের দুজনকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।' 

দলিলটি ছায়া রাণীর হাতে দিয়ে রোহিত বলে, এটি তোর কাছে পবিত্র আমানত হিসাবে জমা থাকল। তুই এই বাড়ি,  জায়গা জমিন সব দেখেশুনে রাখবি। তুই মণিকা ও রঞ্জিতকে মায়ের স্নেহ দিয়ে  আগলে রাখবি সারা জীবন।                               

রোহিত মণিকাকে বলে -- মা একটু কাছে আয়। রঞ্জিতকেও কাছে ডাকে। দুজনকে দুই বাহুতে জড়িয়ে নিয়ে বলে -- ' কী !  তোমরা আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না?' ওরা দুজনেই বলে --  জ্বী, পারব।              

মণিকা উপস্থিত সবাইকে আবার একটি গান গেয়ে শোনায় --                  

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।

আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই     দেবালয়ের প্রদীপ করো--

নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে। 

আঁধারের  গায়ে গায়ে পরশ তব,  সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।

নয়নের  দৃষ্টি হতে  ঘুচবে কালো, যেখানে           পড়বে সেথায়  দেখবে আলো--

ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে  ঊর্ধ্ব পানে।

  

গান শেষ হয়ে গেলে রোহিত সবাইকে বলে -- ছায়া রাণী চমৎকার সব রান্না করে রেখেছে। তোমরা সবাই খেয়ে যাবে।    



আজই রোহিতের এ বাড়িতে শেষ রাত্রি। সে তার বাবা মার খাটের উপর শুয়ে আছে।  ঘুম আসছে না চোখে। সে উঠে খাটের উপর কিছুক্ষণ বসে থাকে। ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। আনমনা হয়ে ঘরের ভিতর পায়চারী করতে থাকে। মায়ের কথা খুব  মনে পড়ছিল তার । 


রোহিত ভাবছিল -- মার কোনো অভিজ্ঞান বা কোনো স্মৃতি চিহ্ন কী এই ঘরে নেই? সে ঘরের এক কোণে বহু পুরানো একটি কাঠের তোরঙ্গ দেখতে পায়। তোরঙ্গটি অব্যাবহৃত ও অযত্নে পড়ে আছে। কাঠের ঢাকনার উপর ধূলো জমে গেছে। তালা লাগানো নেই। রোহিত বাক্সটা খুলে ফেলে। ভেতর থেকে উৎকট ভ্যাপসা গন্ধ বের হয়। তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে। বাক্সের ভিতর  দুটো লেপ, একটি কাঁথা, একটি লোহার সুপারির যাতি ও একটি পিতলের পানের ডাবর দেখতে পায়। লেপের কাপড় ছিঁড়ে ছিটে তুলা সব বের হয়ে গেছে। তেলাপোকা সেখানে বাসা বেঁধেছে। কাঁথাটা পুরনো হয়ে গেলেও মোটামুটি ঠিক আছে। রোহিতের মনে পড়ে -- মা কাঁথাটি তার পরনের কাপড় দিয়ে রাঙা সুঁতোর কাজ করে তাকে সেলাই করে  দিয়েছিল। রোহিত এই কাথাটি গায়ে দিত। কাঁথাটি তোরঙ্গ থেকে বের করে ঝেরে ভাজ করে তার ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে নেয়।  সে ভাবছিল -- মায়ের পরনের কাপড় দিয়ে তৈরি এই কাঁথাটি সে বাকী জীবন গায়ে দিয়ে ঘুমাবে।  মনে হবে তার -- মা তাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে রেখেছে। 

রোহিত দরজা খুলে বাইরে আসে। সে দেখতে পায়, সন্ধ্যা রাত্রির সেই অপূর্ব চাঁদটি একাকী মধ্য গগনে টুপটুপ করে জ্যোৎস্না ঝরিয়ে দিচ্ছে। ওর কান্না পায়। তার মায়ের কথা মনে পড়ে। অপূর্ব সুন্দর ঐ চাঁদটি যেন মায়ের প্রীতি আনন্দের বারতা দিচ্ছে। আশাময়ী, হাস্যময়ী মা যেন আশীর্ববাদ করছে --- "কাঁদে নাা বাপ,  তোমার জীবন সুন্দর হোক,  তোমার পথচলার পথের ধূলি মধুময় হোক। জগৎ সংসারে তুমি ভালো থেক বাপ।''  আকাশটা  যেন তার স্নেহে মমতায় জ্যোৎস্না হয়ে ঝরে পড়ছে  বিন্দুতে বিন্দুতে।  নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে…ঝিরি ঝিরি.. টুপ…টাপ।

                                                                           

রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ১৪

রোদ্রকরোজ্জ্বল সুন্দর সকাল আজ। রহিত আজ চলে যাচ্ছে।  মণিকা, ছায়া রাণী, শহীদুল, শেফালী, নাসির, রঞ্জিত, ঐশ্বর্যময়ী সহ সবাই উপস্থিত আছে। রাস্তায় উপর একটি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। সবাই রোহিতকে বিদায় জানানোর জন্য পাকা রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে। 

শহীদুল রোহিতকে বলে -- 'আমরা তোকে শহর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি না হয়।'  
 
 -- 'না। আমি একাই চলে যাব।  চারদিকে অপূর্ব  রুপোলী রোদ, মাথার উপর নীল আকাশ, রাস্তার দুপাশে বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠ। বনকূচের লাল ফুল, অনন্ত লতা, সোনালের হলদে ফুলের শোভা, বৈচীর ঝোপ, বাঁশঝাড়, গাঙশালিখদের গর্তে লুকিয়ে যাবার  দৃশ্য  দেখতে দেখতে চলে যাব।  ভালোই লাগবে আমার। পথে চলব আর-- বনে, বাগানে, পাখিদের এলমেল কলকাকলি শুনব। দক্ষিণ হাওয়ায় ভেসে আসবে বুঁনো ভাট ফুলের রোদ্র-স্নিগ্ধ গন্ধ। উদ্দাম আনন্দ উচ্ছাসে ভরে উঠবে 
মন। 

একটু উদাস উদাস লাগছিল রোহিতকে।  রোহিত শহীদুলকে বলে -- চল একটু ওধারে যাই। পুকুর পাড়ে বেলীফুলের ঝাড়ের আড়ালে । 

ওরা দুজন চলে যায় পুকুর পাড়ে।  
  
রোহিত শহীদুলকে বলে -- একটা সিগারেট দে। খাই। 

শহীদুল নিজেই রোহিতের ঠোঁটে  সিগারেট ধরিয়ে দেয়। 
    
রোহিত সিগারেট টানতে থাকে।  কিছুক্ষণ মুখে কোনো কথা নেই।  চোখ ছলছল করছে। রোহিত করুণ চোখে শহীদুলের মুখের দিকে চেয়ে বলে -- এই কাগজটি নে। এখানে আমার কিছু কথা লেখা আছে।  আমি চলে যাবার দু' তিনদিন পরে এই চিঠিটি পড়বি। আমি যখন পৌঁছব তখন। তার আগে নয়। '

শহীদুল বলে -- 'আচ্ছা।'  
 
সিগারেট খেয়ে শেষ করে দুজনেই পুণরায় চলে আসে রাস্তার উপর । 

মণিকা বিষণ্ণ মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। ভিতরে ভিতরে বইছিল কান্নার ধারা। সে রোহিতের কাছে চলে আসে। রোহিতের পাঁজরেে কপাল ঠেকিয়ে অঝোর ধারায় ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। কান্নার ভিতর  কিছু  কথা অস্পস্ট ভাবে  শোনা গেল কেবল -- 'আপনাকে আমার এত আপন লাগছে কেন? কী মায়া রেখে গেলেন ! অন্তর বীণার তার ছিঁড়ে যাচ্ছে যে ! '   

'পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা--

দুখের মাধুরীতে করিল দিশাহারা

সকলই নিবে-কেড়ে,    দিবে না তবু ছেড়ে--

মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে।'

                                          
সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে রোহিত রিকশার দিকে এগুতে থাকে। ঠিক তখনই পিছন থেকে ঐশ্বর্যময়ী বলে ওঠে --  দাদু, তোমার গল্পটা শেষ করে গেলে না। '

রোহিত ফিরে এসে ঐশ্বর্যকে জড়িয়ে ধরে গল্পের শেষ টুকু শোনায়-- ' 'তারপর কী হলো শোনো -- সেই মেঘের দেশে হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতে শুরু করল । বৃষ্টিতে ভিজে আমি  শীতে কাঁপতে থাকি। আমার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখি -- পরীটা নেই। ও চলে গেছে। পড়ে বুঝতে পারলাম, পরীটাকে আমার স্বপ্নের ভিতর পাওয়া ছিল। স্বপ্ন ভেঙে গেছে,  পরীও চলে গেছে।       
                                
রোহিত যেয়ে রিকশায় উঠে।  পিচঢালা পথ ধরে রিকশাটি চলতে থাকে সম্মূখপানে।  পিছনে পড়ে থাকে -- তার দূরন্ত শৈশব, মাটির সোঁদা গন্ধ, মৃত্তিকার নীচে আপন মৃত মানুষের করোটি, বাতাসে রোহিনীর কান্নার ধবনি, চরাচরে দীপ্যমান  দুঃখিনী মায়ের মুখচ্ছবি। আর যে থাকল সে দুজন হতভাগ্য মানুষের  অবিচ্ছেদ্য রক্ত মাংসের তৈরি পিতৃ মাতৃহীন মণিকা। 

উপেক্ষিতা হয়ে আরও একজন থেকে গেল। সে অপার্থিব। দূরালোকে সে চলে গেছে। কেউ জানে না, রোহিত কুমার সেনের সে কী ছিল ? যাকে পায়নি সে এই জীবন কালে। সে যে জনম জনম প্রবঞ্চিতা,  সে যে অপ্রাপণীয়া।  

রোহিতের সামনে কিছুই নেই। সংসার নেই। ঘর নেই। কেউ নেই। সেও অপ্রাপণীয়। দূর প্রবাসে কোনো নিঃসঙ্গ শয্যায়  প্রিয়  মানুষের কোমল হাতের পরশহীন অজ্ঞাত মৃত্যুর জন্য সে অপেক্ষা করবে।  

'আমি তো থাকবই শুধু মাঝে মাঝে পাতা থাকবে সাদা,
এই ইচ্ছামৃত্যু আমি জেনেছি তিথির মতো…
আমি তো থাকবই তোমাদের দুঃখের অতিথি, আমি ছাড়া
দেবতার হাত থেকে কে খুলে পড়বে চিঠি,
কার রক্তের আদেশে মালা হয়ে উঠবে ফুল?
আমি দিয়ে যাব তোমাদের সঙ্গোপন গন্ধর্ব... 
এই স্বেচ্ছামৃত্যু আমি নিজেই চেয়েছি।”

সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর কবিতা।

----- ----- ----- ----- -----

কয়েকদিন পরের কথা। বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে শহীদুল রোহিতের চিঠির কথা ভুলেই গিয়েছিল। আজ হঠাৎ চিঠিটির কথা তার মনে পড়ে। সে প্যান্টের পকেটের  ভিতর চিঠিটি রেখেছিল। প্যান্টটি  খুঁজতে থাকে। আলনায় প্যান্ট নেই। সে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে। তার স্ত্রী বলে, 'আমি প্যান্টটি ধুয়ে ভাজ করে ওয়ারড্রবের ভিতর রেখে দিয়েছি।' 

শহীদুল প্যান্টের পকেট থেকে চিঠিটি বের করে। পানিতে ভিজে চিঠটি এবড়ো খেবড়ো হয়ে গেছে। কাগজ গলে নরম হয়ে জায়গায় জায়গায় উঠে  গেছে। ছিঁড়েও গেছে খানিক। পানিতে ধুয়ে লেখা গুলো মুছে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।        

শহীদুল অনেক কষ্ট করে জোড়াতালি দিয়ে চিঠিটি পড়বার চেষ্টা করে। রোহিত লিখেছে -- 

সুপ্রিয়য়েষু শহীদুল, 

এই পত্রখানি তুই যখন পড়বি তখন আমি তোর থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকব। জীবনের বাঁকে বাঁকে কত বন্ধু আমি পেয়েছি, কিন্তু তোর মতো অকৃত্রিম বন্ধু  আর কাউকে পাইনি। সব মানুষের জীবনে এমন কিছু গোপন কথা থাকে ... 
( অস্পষ্ট ও লেখা পড়া যায় না ).দুই একটি কথা কাউকে না কাউকে বলতে হয়   .. আমার কেউ নেই। কাকে বলব?  ( অস্পষ্ট.,পড়া যায় না....)     
কিছু  কথা তেকে বলছি। আল্লাহর দোহাই লাগে, কাউকে বলবি না। 
মণিকা আমারই মেয়ে...  ( অস্পষ্ট এবং, পড়া যায় না).... 
আমি ধর্মান্তরিত ( অস্পষ্ট)... 
ঘটনাটি বলছি,  সেদিন ছিল কার্তিকের অমাবস্যার পূর্ব রাত্রি। রেবেকা এসেছিল.( অস্পষ্ট)..... অন্ধকারে চোখের জলে .. রুধিরের দাগ.. (অস্পষ্ট, এবং চিঠি ছিন্ন )....... 
    

রোহিতের জীবন ধারা  থেমে থাকবে না ।  তার প্রতিদিনের কর্ম অবসরে, বিনিদ্র রাত্রির অন্ধকারে, রোগ শয্যায়,  কিংবা অপার্থিব কোনো জ্যোতির্ময়  ছায়াপথ থেকে দূর দৃষ্টি মেলে দেখবে -- হরিনা গোপাল গ্রামে তাদের বাড়িটাতে সাঁজ অন্ধকার নামছে। ধীর স্নিগ্ধ হাতে ঘরে সন্ধ্যা বাতি জ্বালাচ্ছে ছায়া রাণী। হয়ত সেই আঁধার রাত্রিতে বাড়ির পিছনে ঝিমঝিম করে ঝিঁ-ঝি পোকা গুঞ্জন করে ডাকবে, ডুমুর গাছে কেঁদে উঠবে লক্ষী পেঁচা। নামহীন অনেক পাখিই হয়ত ডেকে ডেকে ফিরে যাবে অন্যত্র, অন্য কোনও বন নিভৃতে ।        

সে আরও দেখবে -- স্বচ্ছতোয়া পদ্মদিঘি, অরণ্য নিবিড় বাঁশ ঝাড়, ধনিদহ বিলে যেতে বিস্তৃর্ণ মাঠ, দেবী বিশালাক্ষীর পোড়ো মন্দির। এই সবই জলছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠবে। পোড়ো ঐ মন্দির ঘরের পিছনের বাতাবি লেবুর বন থেকে পাখিদের কলকাকলিও শুনতে পাবে। প্রতি বর্ষায় ইছামতী নদী কানায় কানায় বানের জলে ভরে উঠবে । কস্তুরি ফুলগুলি স্রোতে ভেসে চলে যাবে দূর মোহনায় । 

এক হারানো রাত্রির কথা মনে করে আক্ষেপও করবে। পুকুরপাড়ের কাঞ্চন-ফুল তলায় ঘাসের উপরে স্বর্গ পাওয়ার কথা মনে পড়বে। মহাকালের বীথিপথে অনাগত দিনের শত হেমন্ত পাখিরা এসে মুখর করে রাখবে  হরিনা গোপাল গ্রামের বৃক্ষ বৃন্তে।  

রেবেকা চলে গিয়েছে পৃথিবী ছেড়ে কোনও নক্ষত্রের দেশে, সে হয়ে গিয়েছে আর এক নক্ষত্র। দূর্ভাগা  শ্রী রোহিত কুমার সেন মৃত্যুর পর কোনও স্বীকৃত উত্তরসুরী রেখে যেতে পারবে না, যে  তাকে স্মরণ করে তার আত্মার শান্তি চেয়ে ঠাকুর ঘরে প্রদীপ জ্বেলে প্রার্থনা করবে।  দিন চলে যাবে, ফুরাবে আয়ুষ্কাল, মহাকালে নিবর্তিত হবে দিন মাস বর্ষ। জীবনের সব মর্মর স্বপ্ন, বিষাদ বেদনা, মধু কথা, মাধবী রাত্রিও ফুরাবে একদিন। তবুও চলবে জীবন ধারা, আপন উত্তরসুরী থাক বা না থাক, অন্য কেউ তো থাকবে....।                           

আখ্যান শেষ হয় নাই।
          


শনিবার, ১১ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ১২

ঘরে বসেই রোহিত ও শহীদুল গল্প গুজব করছিল। রোহিত শহীদুলকে বলে -- আমি আগামী পরশু দিনই চলে যাচ্ছি। তুই এই একদেড়দিন আমার সাথে সাথেই থাকবি। কাল মণিকাদের আসতে বলেছি। ওরাও চলে আসবে। কাল সন্ধ্যায়  তুইও চলে আসবি শেফালী ভাবীকে সাথে করে। রাতে তোদের  আমার  নিমন্ত্রণ। আমরা সবাই মিলে খাব, গান গাইব, আনন্দ করব।    

-- এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি? খুব মন খারাপ লাগছে। এত বছর  হারিয়ে থেকেছিলি সেও একরূপ ছিল। তোকে ভুলেই গিয়েছিলাম।  কেনই এলি। এসে হৃদয়টাকে উসকে দিলি। তোকে কত বছর পর পেলাম। পেয়েও আবার হারাব। কেন জানি মনে হচ্ছে , বাকি যে স্বল্প জীবনটুকু আছে সেই জীবনে তোর আর দেখা পাব না। 
'একটা সিগারেট দে, খাই।' 

সিগারেট ধরিয়ে খেতে খেতে শহীদুল  বলতে থাকে, তোকে দেখার পর থেকে তোর উপর আমার কী যে  মায়া পড়ে গেছে। এত একাকী তুই ! মন বলছে,  তুই অনেক বড়ো কোনো বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছিস। 

আচ্ছা রোহিত, তুই বলত -- এই যে তুই ঢাকায় ছিলি দুই আড়াই বছর, তারপর বিদেশে কত দেশে দেশে গেলি, এবং থাকলি । তোকে পাবার জন্য কোনো মেয়েই কি ব্যাকুল হয়নি? দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে কেউ কি বলেনি --  'এস আলিঙ্গণে জড়িয়ে ধরো, সারা জীবন কালের জন্য তুমি  আমাকে চিরসঙ্গী করে নাও।'   

রোহিত শহীদুলের মুখপানে চেয়ে মনে মনে বলছিল -- ' কেউ তো একজন এসেছিল, কেউ তো একজন এক নিশীথে পরম ভালোবাসায় বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ---  'আমাকে তুমি এখান থেকে লইয়া যাও। আমি তোমার ঘরে যাইব। জনম জনম ধরিয়া তোমার কাছে থাকিব।'

তাকে আর ঘরে আনা হয়নি । আর আমি হয়ে  গেলাম চিরকালের জন্য ঘরহীন। শুধুই আক্ষেপ, কেবলই দীর্ঘশ্বাস এখন। অন্তর কেঁদে কেদে বলি -  
'দুঃখসুখের দোলে এসো,  প্রাণের হিল্লোলে এসো।ছিলে আশার অরূপ বাণী ফাগুনবাতাসে বনের  আকুল নিশ্বাসে-- এবার ফুলের প্রফুল্ল রূপ এসো বুকের 'পরে।' 
কিন্তু সে আর ঘরে এল না। বেদনায় শোকে দুঃখে এবং অভিমানে সে এখন দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে।       

রোহিত বলছিল -- শহীদুল চল, আমরা দুজন একটি রিক্সা নিয়ে  ইছামতী নদীর তীরে যাই। পুরো সন্ধ্যা ওখানে নদীর কূলে সবুজ ঘাসের উপর বসে কাটিয়ে দেই। হেমন্তের ঝিরিঝিরি বাতাসে দোল খেয়ে রাত্রি নামবে। রাত্রির নিরবতায় তোকে আমি একটি ছোট্ট গল্প শোনাব।  

দুই বন্ধু নদীর কূলে একটি পাকুড় গাছের তলে  যেয়ে বসে । অদূরে ইছামতী বয়ে চলেছে। যদিও এই হেমন্তে নদীর জলের ধারা তীব্র নয়। অনেকটাই শান্ত, এবং শীর্ণ এই নদী।

জীবনে  কিছু কঠিন গোপন কথা থাকে, তা কাউকে না কাউকে স্বাক্ষী করে বলে যেতে হয়। কারোর কাছে প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকলেও ভঙ্গ করে হলেও তা বলতে হয়। রোহিত শহীদুলকে এখানে এই নদীর কূলে এনে রেবেকার সাথে তার সম্পর্কের কিছু  কথা বলতে চেয়েছিল। কতটুকু সম্পর্ক ছিল তার সাথে । কী ঘটেছিল তাদের জীবনে, সব কথা। কিন্তু কী এক দ্বিধায় তা বলতে পারল না। একজন মৃত মানুষের সব কথা বলা কী ঠিক?   

আর এইভাবে মুখোমুখি অনেক সত্য কথা তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল -- রেবেকা আর তার ভিতরকার না বলা কিছু কথা শহীদুলকে কাগজে লিখে যাবার বেলায়  বলে দিয়ে  যাবে। 

রোহিত সত্যি সত্যি তার মত পরিবর্তন করে ফেলল।  সে শহীদুলকে নদীর কূলে  সেই সন্ধ্যা রাতে  শোনাল অন্য গল্প কথা ---    

'তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। আমার সহপাঠিনী ছিল দীপান্বিতা। ও প্রেম করে বিয়ে করেছিল তাদেরই পাড়ার নীলেশকে। নীলেশদের সোয়ারি ঘাটে পাইকারি মাছের আড়ত ছিল। পড়াশোনা করেছিল সে অস্টম ক্লাস পর্যন্ত। কাড়ি কাড়ি টাকা ছিল নীলেশদের।  কিন্তু  টাকা থাকলে কি হবে, নীলেশরা ছিল একটু গোয়ার গোবিন্দ ও গারোল টাইপের।

একদিন দেখি, দীপান্বিতা ক্লাশে আসেনি। পরের দিনও সে এল না। তারপরের দিনও না। এবং তারপরে কোনদিন আর দীপান্বিতা ক্লাসে আসেনি।

নীলেশ শরীর চিনত দীপান্বিতার। এক রাত্রে দীপান্বিতার ভিতর জৈবিক ভালোবাসার চাহিদা নাকি আদৌ  ছিল না। কিন্তু নীলেশের ছিল গোয়ার্তুমি। নীলেশ তাকে বলাৎকার করেছিল।
ফলে দীপান্বিতার পেটে  সন্তান আসে নেহাতই জৈবিক নিয়মে।  কি নিষ্করুণ সৃষ্টির এই রুঢ় নিয়ম। যা আসতে দিতে চায়নি তাই আসে জীবনে। 

দীপান্বিতার জন্য  মন খারাপ লাগত। ক্লাসে এত গুলো মুখের মাঝে দীপান্বিতার মুখটি আর দেখতে পেতাম না। কিছু ভালোলাগা,  কিছু অন্তর নিসৃত টান আমাকে বিষণ্ণ করে রাখত। দীপান্বিতা আমার কেউ ছিল না। কিন্ত ওর জন্য আমার প্রাণ 
কাঁদত। 

আমি পুরানো ঢাকার বাকরখানি খেতে খুব পছন্দ করতাম। দীপান্বিতা প্রতিদিন আমার জন্য বাকরখানি নিয়ে আসত ওর ব্যাগে করে । এইগুলি খেয়েই প্রায়ই কাটিয়ে দিতাম বিকাল পর্যন্ত। যদি কোনো দিন বেশি খিদে লাগত, তাহলে শহীদুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেয়ে , চাঁনখারপুল পার হয়ে হাজির দোকান থেকে পাতায় মোড়ান বিরিয়ানি কিনে এনে দুজন খেতাম। 

যেদিন আমার পকেটে টাকা থাকত না সেদিন আগেই আমার মুখ দেখে বুঝতে পারত দীপান্বিতা। ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় ও যখন বাড়ি চলে যেত, তখন ভ্যানেইটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে আমার বুক পকেটে দিয়ে বলত, চাকুরি পেলে -- পরে এ টাকা আমায় শোধ করে দেবে। এখন শুধু হিসাবটা ডাইরিতে লিখে রাখবে। 

প্রায়ই দীপান্বিতা মন খারাপ করে ক্লাসে আসত। সবাইকে হাসি খুশি মুখ দেখাবার চেষ্টা করত। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম, ওর অন্তরের গভীর বেদনার কথা। আমি জানতে চাইতাম, কিন্তু কোনো কথা বলত না দীপান্বিতা। কান্না এবং দীর্ঘশ্বাস দুটোই বুকের গভীরে আড়াল করে রাখত সে। মাঝে মাঝে উদাস কোনো রাত্রি বেলা একাকী শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, জগতে এত মেয়ে থাকতে কেন এই অন্তর দুঃখী মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় হলো। 

একদিন এক মেঘলা দিনের অসতর্ক মুহূর্তের কথা। কার্জন হলের সামনে সবুজ ঘাসের উপর দুজন বসেছিলাম। চুপচাপ আছি দুইজনই, কারও মুখে কোনো কথা নেই।  হঠাৎ দীপান্বিতা আমার হাত টেনে নিয়ে আঙুল ছুঁয়ে বলেছিল -- 'তুমি তোমার এই অঙুলি দিয়ে আমার সিঁথির সিঁদুর সব মুছিয়ে দাও।' সেদিন কোনো সিঁদুর মোছা হয়নি। ঝমঝম করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল।  

যেদিন ওর সাথে আমার শেষ দেখা হলো, সেদিন বুঝতে পারিনি এইটি হবে ওর সাথে আমার শেষ দেখা। আমরা বসেছিলাম, লাইব্রেরী বারান্দায়। আমাকে দীপান্বিতা বলেছিল -- 'কে যেন আমার চলাফেরা গতিবিধি অনুসরণ করে। এক অজানা আশংকা আমার মধ্যে। যদি আর তোমার সাথে আর কোনো দিন দেখা না হয়। '

আমার শিক্ষা বর্ষের বাকি সময়গুলোতে আর কোনো বন্ধু করিনি কাউকে। প্রতিদিন ক্লাশে আসতাম। পিছনের ব্রেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকতাম। দুপুরে প্রায় দিনই খাওয়া হতো না আমার । খেতে ইচ্ছাও করত না। ক্লাস শেষে একাকী শহীদ মিনারের সোপানের উপরে বসে থাকতাম। বসন্তদিনে ইউক্যালিপটাসের পাতা ঝরে পড়ত। পথের ধূলো উড়ত বসন্ত বাতাসে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের চেনা পথ দিয়ে তারপরেও প্রায় দুই বছর চলেছি। কোথাও কোনো দিন আর দীপান্বিতার দেখা পাইনি। কার্জন হলের সামনে সবুজ লনের ঘাস, বাংলা একাডেমির বৃক্ষছায়া তল, কিংবা খাজা নাজিমউদ্দিনের মাজার প্রাঙ্গণের সোপান, সেখানকার বৃক্ষরাজি কেউই বলতে পারেনি, দীপান্বিতা এখানে আর এসেছিল কি না?  

প্রার্থনার দিনগুলোতে প্রায় সন্ধ্যায় চলে যেতাম ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। শঙ্খ ধ্বনি বাজত সেখানে । আরতি হতো পূজার। কোনো দিন কোনো পূজার স্থলে দীপান্বিতার দেখা পাইনি।  ধূপের গন্ধ বিষাদের ধূয়া হয়ে মন্দিরে মিলিয়ে গেছে। সকল পূজা শেষ হয়ে গেছে। আরতি থেমে গেছে। কিন্তু দেবীর দেখা আর মেলেনি। 

শিক্ষা জীবন শেষ হয় একসময়। বৃটিশ সরকারের স্কলার্শিপের চিঠি আমার হাতে আসে । হঠাৎই      বঙ্কিমের 'আনন্দ মঠ' বইটি নতুন করে আবার পড়বার ইচ্ছা হয় । কিন্তু  'আনন্দ মঠ ' কোথাও খুঁজে না পেয়ে নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানে বইটি খুঁজতে যাই । বইটি  পেলামও সেখানে। 

বইটি কার ছিল জানি না। বইটি কিনে বাসায় এসে আনন্দ মঠের পাতা উল্টায়ে দেখছিলাম। প্রথম সাদা পাতাটি ছিল আংশিক ছেঁড়া। কোনো কিছু লেখা ছিল না তাতে। বইয়ের শেষ সাদা পাতার প্রথম পৃষ্ঠায় আবছা নীল কালিতে লেখা ছিল -- 

' বুড়িগঙ্গার ধারে নির্জন শ্মশান ঘাট থেকে
লাশ পোড়ানোর গন্ধ আসছে, 
কার হৃদয় পুড়ছে ওখানে দাউ দাউ করে
বাতাস ভারী হয় কার ক্রন্দনে --
কে চলে গেল কাকে শূন্ঢ় করে দূরের পরপারে। '

আনন্দ মঠের শেষ সাদা পাতার অপর পৃষ্ঠায় লেখা ছিল --

'সময়ের ব্যবধানে হার মেনেছি সময়ের সাথে
আজো বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে নিঝুম রাতে
মন খারাপের তো কয়েক হাজার কারণ থাকে
সত্যিই কেন যে দেখা হয়েছিল তোমার সাথে। '
                           ----------  দীপান্বিতা সেন।

প্রথম চরণগুলো উৎসর্গ করা ছিল স্বর্গীয় শ্রী নীলেশ সেনকে, আর দ্বিতীয় চরণগুলো উৎসর্গ করা ছিলো আমাকে।'

------  -------  ------   -------
     
শহীদুল বলছিল -- নদীর কূলে এই সন্ধ্যায় তুই একটি আনন্দময় স্মৃতির কথা শোনা আমাকে। এত দুঃখের কথা আর সইতে পারি না। 
                                                                          রোহিত বলছিল -- তবে শোন্ আনন্দময় এক সন্ধ্যারাত্রির কথা ---
আরিজোনা ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার

একবার দক্ষিণ আরিজোনার টুসন শহরে যাত্রা বিরতি করেছিলাম। হোটেল থেকেই জানতে পারি সোনারন নামে একটি  মরুভুমিতে নাকি  থোকা থোকা কমলা রঙের ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফুটে থাকে। আরও আছে  বালিয়াড়িতে প্রান্তরের পর প্রান্তরে  ক্যাকটাসের ঝাড়। হাতে সময় নেই। পরের দিনই চলে যাব লাসভেগাস। আমার খুব দেখতে সাধ হলো মরুভুমিতে ফুটে থাকা ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার আর ক্যাকটাসের ঝাড় । হোটেলের ইনফরমেশন সেন্টার থেকে সোনারন যাওয়ার সব তথ্য জেনে নিলাম। ওরা আমার সাথে  একজন গাইড নিয়ে যাবার  পরামর্শ দিল এবং একজন গাইডের ব্যবস্থা করেও দেয় আমাকে।

গাইড মেয়েটির নাম -- নিকিতা জুলি। আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রী। জুয়োলজীতে পড়াশোনা করে।  মেয়েটি ল্যাটিনা। ভেনেজুয়েলা থেকে এসেছে। ভারতীয় মেয়েদের মতো কালোকেশী।  অসম্ভব সুন্দরী, নদীর মতো দেহবল্লরী তার। চমৎকার ইংরেজিতে কথা বলে। ইউনিভার্সিটি ভ্যাকেশন সময়ে সে পার্টটাইম জব হিসেবে টুসন শহরে আগত পর্যটকদের গাইড হিসাবে কাজ করে।  

সকাল দশটার দিকে একটি পর্যটন মাইক্রোবাসে করে সোনারন মরুভূমির উদ্দেশ্য রওনা হই। আমাদের সাথে ছিল আরও ছয়জন নারী পুরুষ। তারাও যাবে সোনারন দেখতে।   

আমি আর নিকিতা সামনের সিটে বসে আছি। চলতে চলতে মাইক্রোবাসটি শহর ছেড়ে একসময় মরুভূমিতে যেয়ে পড়ে। চারিদিকে  ধু-ধু বালুকাময় প্রান্তর। কিন্তু এখানকার বালি অনেকটা ঊষর। জায়গায় জায়গায় পাথুরে মাটিও দেখতে পাই। নিকিতা আমাকে বলছিল, এই একমাত্র মরুভূমি তুমি একটু পর দেখতে পাবে ছোট্ট ছোট্ট টিলা। এবং পাহাড়। 

মাইক্রোবাসের অন্য সঙ্গীরা যে যার মতো আনন্দ করছে, স্ফূর্তি করছে, হুল্লোড় করছে, বিয়ার খাচ্ছে, গান গাইছে। নিকিতা আমাকে বলছিল --' তুমি কী কিছু খাবে?'  বললাম 'দাও।' 
'কী দিব?' 
'আনারসের জুস'। 
নিকিতা একটু বিস্মিত হলো! 

কী অপূর্ব দৃশ্য অপেক্ষা করছিল!  মরুভূমির বালি ফুঁড়ে সবুজ ঘাস !  অপেক্ষা করছিল আরও বিস্ময় !  রাস্তার দুপাশে ক্যাকটাসের জঙ্গল।  জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে কমলা রঙের অজস্র ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফুটে আছে। সুন্দর আবহাওয়া, বেশ মোলায়েম । না শীত, না গরম।  নিকিতার দিকে চেয়ে দেখি-- এখন যে তার গানের সময়। স্প্যানিস ভাষায় সে গুণ গুণ করে গান গাইছে।  আমি ওকে বলেছিলাম, তুমি যে গানটি গাইলে তা ইংরেজিতে একটু ট্রানস্লেট করে কথাগুলো বলো না ! ও বলছিল ---
'How it is to be with you
From the first day I saw your face
I knew this love was true…'

প্রান্তরের পর প্রান্তর মাইলের পর মাইল পথ  ছাড়িয়ে যাওয়ার পর একটা বাড়ি চোখে পড়ে।  আসলে এটি একটি গেস্ট হাউজ। পরে দেখলাম,  এই রকম গেস্ট হাউজ একটি নয়, বেশ কয়েকটি আছে। নিকিতা বলছিল -- 'এইটিই সোনারন ডেজার্ট।' যে সমস্ত পর্যটকরা এখানে এসে রাত্রিযাপন করতে চায়, তারা এই গেস্ট হাউজ গুলোতে ওঠে।  এখানে রেস্টুরেন্ট ও বার আছে। আছে মিউজিক ক্যাফে ও স্পোর্টস কাফেও।' একটি মিউজিয়ামও দেখলাম। আমি আর নিকিতা একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে নেই। তখন বিকেল হয়ে যায় ।   

এখান থেকে অদূরে ছোট বড়ো পাহাড় দেখতে পেলাম।  তারও আরো দূরে সানফ্রান্সিসকো পর্বতমালা। এখানে আগত নারী পুরুষ ও ছেলেমেয়েদের প্রধান আনন্দময় জায়গা হচ্ছে এই পাহাড়ের পাদদেশ।   

নিকিতা আমাকে বলছিল -- ' তুমি কী ঐ পাহাড়ের পাদদেশে যাবে?'  আমি বললাম,  যাব।  হেঁটে হেঁটে দুজন  যাচ্ছিলাম পাহাড়ের দিকে ক্যাকটাস আর ওয়াইল্ডফ্লাওয়ারের ঝাড়ের ভিতর দিয়ে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছিল।  ছায়া ছায়া ময় মনোরম পরিবেশ। সবুজ গালিচার মতন ঘাসে পাথর ঢাকা। কত নারী পুরুষ আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে  নিজেকে সপে দিচ্ছে পাহাড়কে সাক্ষী রেখে। অনেক ছেলেমেয়ে এখানে এসে প্রপোজ করে ভালোবাসার। ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার হাতে দিয়ে বলে -  I love you, I marry to you.  
          
কয়েকজোড়া ছেলেমেয়েকে দেখলাম --  প্রপোজ শেষে হাত ধরে জড়িয়ে হেঁটে হেঁটে আরও দূর পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি নিকিতাকে বলি -- ওরা কোথায় যাচ্ছে?  
নিকিতা বলছিল --  'ওরা মরুভুমি ভালোবাসে, ওরা পাহাড় ভালোবাসে।  আজ রাতটা এখানেই কাটাবে ওরা। খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকবে। পৃথিবীটাই ওদের বিছানা।'

তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছিল। দেখলাম প্রচন্ড একটি চাঁদ উঠেছে আকাশে। জ্যেৎস্নায় ভাসছে প্রান্তর। ভাবছিলাম, কী নির্জনে মধুযামিনী না হবে ওদের ! চাঁদের নিচে  ঘাসের শয্যা। 

নিকিতা বলছিল -- 'যাবে না তুমি?' বলেছিলাম -- যেতে ইচ্ছে করছে না যে ! 


                        
                             

বুধবার, ৮ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ১১

বাড়িতে ফিরে আসতে আসতে রিকশায় বসে রোহিত ভাবছিল --  যতক্ষণ মণিকার ওখানে ছিলাম, আর যতবার আমি ওকে তাকিয়ে দেখেছি, ততবার মনে হয়েছে, ও আমারই চির জনমের আপন কোনো জন। কোথায় থেকে একটি স্বর্গীয় আলো ওর মুুখের উপর এসে পড়েছিল। দৈব কণ্ঠে কে যেন বলছিল --- 'তুই ভালো করে চেয়ে দেখ এই মেয়েটিকে। ওর মুখের উপর যে অপার্থিব আলো আমি ফেলেছি, তা শুুুধু ওকে ভালো করে  চিনে নেবার জন্য ফেলেছি। ' 

''নদীর জলে থাকি রে কান পেতে, কাঁপে যে প্রাণ পাতার মর্মরেতে।
মনে হয় যে পাব খুঁজি,  ফুলের ভাষা যদি বুঝি,
যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে......''

-- রবীন্দ্রনাথের গানের কথা।    

আসতে আসতে পথে ইছামতী নদীর তীরে সন্ধ্যা নেমে আসে। রোহিত দূরে নদীর কূলে দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকে  কাশবনের দিকে। বালির উপরে ঘন কাশবন। থরে থরে সাদা ফুল ফুটে আছে। ধবল শুভ্র  সেই  কাশফুল দুহাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে একটি কিশোরী বালিকা দৌড়ে দৌড়ে তার দিকে ছুটে আসছে । রোহিত চিনতে পারে এই কিশোরীকে। সে যে অনেক আগের কিশোরী মণিকা। ওকে দেখতে দেখতে চোখে ঘোর লেগে আসে। ঘোর ছাড়ার জন্য সে চোখ বন্ধ করে। আবার যখন চোখ খুলে তাকায় দূরে কাশবনের দিকে। তখন কাশবন সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। সেখানে কোনো কিশোরীকে সে আর দেখতে পায় না ।         

রোহিতের বাড়িতে পৌঁছতে পৌছতে রাত্রি হয়ে যায়। ছায়া রাণী অপেক্ষা করছিল তার জন্য। কখন তার দাদা চলে আসবে।       

রোহিত সকালে ঘুম থেকে জেগেই  দেখতে পায় শহীদুল বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে। রোহিত ওকে দেখেই বলে -- সুপ্রভাত।    শহীদুলও  বলে -- সুপ্রভাত।  

--- কখন এসেছিস? 

--- একটু আগে।  তা কাল তুই কোথায় গিয়েছিলি? 

-- মণিকাকে দেখতে গিয়েছিলাম। খুব দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল মেয়েটাকে।

-- তা দেখেছিস? 

-- দেখেছি 'প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে'। কী যে ভালো লেগেছে মেয়েটিকে দেখে । আমার অন্তর গহীনে ওর মায়াময় মুখ, চোখ, চাহনি, হাসি-- সব ছুঁয়ে আছে। যা আমি বয়ে নিয়ে যাব অনেক দূরে। এই মুখ আমার মনে গেঁথে থাকবে।     
        
আর মাত্র দুই একদিন আছি। তারপর চলে যাব।  এবার যেয়ে কোথাও গিয়ে নিরিবিলি  কিছুদিন কাটাব। আমি জানি মনটা খুব ভঙ্গুর ও বিধ্বস্ত থাকবে। ফিনল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। ওখানে নরওয়ের সীমান্তের কাছাকাছি রয়েছে হাল্টি পর্বত মালা। নির্জন অনেক গুহা আছে সেখানে। সারাদিনে একটুও  সূর্যের আলো পড়ে না। আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয় দিনের বেলায়। তা না হলে অন্ধকার!  কোনো একটি গুহায় ডেরা পাতব।  মাসখানেক থাকব। ওখানে যারা যায় তারা বেশির ভাগই পর্বত প্রস্তুরে কিংবা গুহা গাত্রে বিভিন্ন চিত্র এঁকে রেখে আসে। আমি চিত্রকর নই। তবুও ছবি আঁকব। রং তুলি নিয়ে যাব। আমি  আঁকব একটি মেয়ের মুখের ছবি। একটিই মুখ থাকবে , কিন্তু সেই মুখে দুজন প্রকাশিত হবে। মা ও মেয়ে । ছবিটির নাম দেব -- বিশ্ব ভরা প্রাণ।     
  
হয়ত উৎফুল্লতেই কাটবে গুহাবাসের দিনগুলো । দূরে বাল্টিক সাগরের তীর থেকে ভেসে আসবে হিম মাখা শীতল বাতাস। চোখ ও দৃষ্টি  ওখান থেকে অনেক দূরের বাংলাদেশের উপর এসে পড়বে। গুহা প্রান্তে দাঁড়িয়ে মন কী উদাস হবে কারোর জন্য? পর্বতেও অস্তমিত হয় সূর্য, ওখানেও চাঁদ ওঠে, জ্যোৎস্নার প্লাবন বয়, তারা জ্বলে। আমি জেগে থাকব, চোখ মেলে কান পেতে শুনব --

'যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে।যে পথ সকল দেশ পারায়ে  উদাস হয়ে যায় হারায়ে। সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্‌ অচিনপুরে।'

-- রবি ঠাকুরের গান।   

ছায়া রাণী এসে ওদের দুজনকেই বলে -- দাদা ভাইরা আসুন, নাস্তা করে নিন। নাস্তা খেতে খেতে রোহিত ওদের দুজনকেই বলে -- আমি আজও  একটু শহরে যাব।  কিছু কাজ বাকী আছে।  ওগুলো সেরে বিকালের মধ্যেই চলে আসব। শহীদুলকে বলে -- তুই  বাড়িতেই থাকিস। সন্ধ্যায় তোকে নিয়ে একটু  ঘুরতে বের হবো।  

রোহিত শহরে চলে যায়।  এবং সমস্ত কাজ সম্পাদন করে ফেলে। সে কাজ সেরে  মণিকার সাথে দেখা করে। আজকে জামাইবাবু নাসির উদ্দীনের সাথেও  দেখা হয়। নাসির খুব অমায়িক ছেলে।  রোহিত ছেলেটির সাথে কথা বলে খুব ভরসা পেল। ওদের দুজনকেই রোহিত বলে দেয়, 'তোমরা কাল বিকালেই চলে যেও। একটা ছোট্ট পারিবারিক মিলনীর ব্যবস্থা করেছি।  সবাই একত্রিত হয়ে  আনন্দ করব। গান করব। তাছাড়া আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে,  যা তোমাদের সবাইকে আমি  বলব।            

আজও ঐশ্বর্যময়ী রোহিতকে দেখে দৌড়ে কোলের উপর বসে পড়ে। এবং বলে -- 'দাদু,, তুমি আমাকে একটা গল্প শোনাও।'     

আচ্ছা শোনাই -- তখন আমি তোমার মতো ছোট। মা আমাকে একদিন পরীর গল্প শোনায়ে ঘুম পারিয়ে দিল।  তো আমি ঘুমিয়ে গেছি।  দেখি -- একটা সুন্দর রঙবেরঙের পাখাওয়ালা পরী আমার পাশে এসে  দাঁড়িয়ে আছে । পাখা দেখতে একদম  ময়ুরের মতো।  আমাকে সে বলছে -- এই ছেলে তুমি ওঠো। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।  আমি বললাম -- তোমার নাম কী?  পরী বলল -- আমার মাম মেঘবতী। 

--- তুমি কোথায় থাকো?  

-- আমি মেঘের দেশে থাকি। তুমি আমার একটি ডানা ধরো। আমরা দুজন উড়ে উড়ে চলে যাব মেঘ রাজ্যে।' আমি পরীর একটি ডানা ধরলাম। পরী উড়তে লাগল।  দুজনই উড়ে উড়ে যেয়ে দেখি,  সত্যিই সে এক অপূর্ব মেঘের দেশ।' 

এই টুকু বলে রোহিত একটু থামল। 

--- তারপর, থামলে কেন?  বলো। 

--- বাকিটুকু কাল বলব।  তুমি তোমার বাবা মার সাথে কাল দাদু বাড়িতে চলে এস। ওখানে  তোমাকে বাকীটুকু শোনাব।       

 -- আচ্ছা।                                                                        

রোহিত বিকালেই চলে আসে হরিনা গোপাল গ্রামে। বাড়িতে এসে দেখে -- শহীদুল ওর জন্য অপেক্ষা করছে।                         


                                      

                                                   

                                                         

সোমবার, ৬ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ১০

রোহিত খেতে বসে ছায়া রাণীকে বলে, 'তোর ছেলেকে ডাক্।  ওকে নিয়ে বসে আজ একসাথে ভাত খাব।  আসার পর ওর সাথে তেমন কোনো কথাই হলো না।'

রঞ্জিত খেতে চলে আসে।  খাবার টেবিলে রঞ্জিতকে রোহিত বলে -- তুমি কী নিয়ে পড়াশোনা করছ? 

--- মানবিক নিয়ে পড়ছি। 

--- আচ্ছা, খুব ভালো।  

--- তা উচ্চতরে যেয়ে কোন্ বিষয় নিয়ে পড়তে চাও? 

-- জানি না।  ভাবিনি এখনও। আপনি বলেন, কী নিয়ে আমি পড়ব। 
                                         
-- তুমি সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারো। ভালো রেজাল্ট করতে পারলে বাইরে স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সুযোগ বেশি পাবে।   

-- আচ্ছা মামা। দোয়া করবেন আপনি।    

-- আর একটি কাজ করবে। যদি পারো,  নিজের প্রতি যদি দায় হয় --  তুমি মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিতা মেয়েদের নিয়ে গবেষণামূলক কিছু কাজ করবে।  কাজটি অনেক বড়ো ও কঠিন ।  তবুও করবে।  তুমি শুরু করবে আমাদের এই হরিনা গোপাল  গ্রাম থেকে।  এই ধরো, তোমার রোহিনী মাসির কথা। তার নাম কিন্তু কোথাও লেখা নেই।  এই রকম অনেক ধর্ষিতা মেয়ে আছে, গ্রামে গঞ্জে ও বিভিন্ন জনপদে। জীবিত ও মৃত কিংবা শহীদ হয়েছেন। তাদেরকে তুমি খুঁজে খুঁজে বের করবে।  তুমি তরুণ প্রাণ। হাতে অনেক সময়। তুমিই পারবে এই বিশাল কাজটি করতে। আমি এই ব্যাপারে একটি দিকনির্দেশনা দেব পরে একদিন।      

খাওয়া শেষ হলে  রোহিত ছায়া রাণীকে বলে -- তুই রাতেই আমার সব জমি জমার কাগজগুলো বের করে রাখবি। আমি ওগুলো দেখব,  এবং একজন উকিলকে দেখাব।  কোনো ভুল ভ্রান্তি থাকলে তা ঠিক করে নেব। তারপর রোহিত বিছানায় চলে যায় ঘুমুতে।

রোহিত চলে যাবার পর জামাই বাবু ছায়া রাণীকে বলছিল, শুনলে তো তোমার দাদার কথাবার্তা। তুমি শুধু শুধু পর মানুষের সম্পত্তি কষ্ট করে দেখে শুনে রাখলে। কী লাভ হলো তোমার?  শুধু পাহারাদারনী হয়েই থাকলে।  অপেক্ষা করো ক'টা দিন। দেখো কী করে তোমার দাদা?  সব বেচে থুইয়ে টাকা নিয়ে পারি জমাবে দূরদেশে ।  আর আসবে না।    
                                  
ছায়া রাণী বলে -- 'দাদা যা করার করবে।  তোমাকে এই নিয়ে ভাবতে হবে না।  ওনার সম্পত্তি উনি যা করার করবে। এ নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যথা কেন?   

রোহিত সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে নেয়। সে আজ শহরে যাবে। একবার ভেবেছিল -- শহীদুলকে সাথে করে নেবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, সে একাই যাবে। 

রোহিত জমিজমার কাগজগুলো বের করে দেখল।সে একটি হিসাব করে, কতটুকু জায়গাজমি তার আছে।  সে দেখতে পায় -- বাড়ি এবং পুকুরসহ  চার বিঘা, আমবাগান কাঁঠালবাগান, সুপারিবাগান ও অন্যান্য  ভিটা  মিলে ৫ বিঘা, ফসলি জমি ১৫ বিঘা,  আর বাজারে দোকানের জায়গা ১ বিঘা।  আর অস্থাবর সম্পদ হচ্ছে -- পাকা দালান একটি,  ছোট বড়ো টিনের ঘর তিনটি, বাজারে আধা পাকা দোকান চারটি। সব মিলে যার বর্তমান মূল্য দেড় কোটি টাকার উপর হবে।                                                
রোহিত ছায়া রাণীকে বলে -- আমি আজ একটু শহরে যাচ্ছি। আজ যদি না আসতে পারি, কাল চলে আসব।      

রোহিত শহরে এসেই প্রথম ভালো একজন উকিলোর সাথে  দেখা করে। তাকে তার সমস্ত সম্পত্তির কাগজপত্র দেখায়। এবং তার সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইনগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে।  এবং বলে আপনি একটি খসড়া দলিল তৈরি করেন।  আগামীকাল এটি সম্পাদন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমি কাল আবার আসব।   

রোহিত উকিলের চেম্বার থেকে বের হয়ে  রাস্তায় নেমে হাঁটতে থাকে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। একটি রিকশা ডাকে, এবং রিকশাওয়ালাকে বলে - 'তুমি আমলা পাড়া যাবে?' '

-- যাব, ওঠেন আপনি।'      

রিকশা একসময় আমলা পাড়ার গলিতে ঢোকে।  রিকশাওয়ালা বলে -- এটাই আমলা পাড়া। তা, কোন্ বাড়িতে যাবেন? '
--- যে বাড়িতে যাব, সে বাড়ি আমি চিনিনা। 

--- বাড়ির মালিকের নাম কী?  

---নাসির উদ্দীন উকিল। 

রিকশাওয়ালা দুই একজনকে  জিজ্ঞাসা করে বাড়িটি চিনে নেয়। তারপর রোহিতকে সেই বাড়িটির সামনে নামিয়ে দেয়। রিকশাওয়ালা  রোহিতকে বাড়িটি দেখিয়ে দিয়ে বলে -- 'এইটি নাসির উকিলের বাড়ি।'  রিকশাওলাকে ভাড়া পরিশোধ করে রোহিত বাসার গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। এবং  গেট নক করে। ভিতর থেকে একজন তিরিশোর্ধ্ব মেয়ে এসে গেট খুলে দেয়।   

মেয়েটিকে দেখে তার শরীরের সমস্ত  রক্ত মুহূর্তে হিম শীতল হয়ে ওঠে । আত্মার স্পন্দন ধ্বনি  থেমে  যায়। কী আশ্চর্য !  সেই আনত মুখ, সেই মায়াভরা চোখ, সেই গ্রীবা, সেই নাক,  সেই শরীর গড়ন, মুখ জুড়ে সেই লুকানো হাসি। একদম রেবেকার মতো।  আরও আশ্চর্য হয় -- সে এমন কিছু মিল খুঁজে পায় মেয়েটির ভিতর, তা আরও  বিস্ময়ের।  

মেয়েটি বলে -- আপনি কে?  কাকে চান? আপনাকে তো চিনতে পারছি না।   

--- আমি রোহিত সেন। এখানে মণিকার সাথে দেখা করতে এসেছি।  তুমি কী মণিকা ? 

-- জ্বী, আমি মণিকা।  কিন্তু রোহিত সেন নামে কাউকে আমি চিনিনা।  তা, আপনি কোথায় থেকে এসেছেন? 

--- আমি আপাতত হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে এসেছি।  কিছু মনে করোনা।  তুমি কী আমাকে একটু বসতে দেবে?        

--- ও দুঃখিত। আপনাকে বসতেই বলিনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।  আসুন, ভিতরে চলুন।                                                                                                        
মণিকা রোহিতকে ভিতরে নিয়ে বসতে দেয়। একটি পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে  ছুটে কাছে চলে আসে। এবং রোহিতের কোলের উপর এসে  বসে পড়ে।  বাচ্চাটি রোহিতকে বলে -- 'তুমি আমার কী হও?' রোহিত বলে -- 'আমি তোমার দাদু হই।'

--- এতদিন কোথায় ছিলেন? 

-- চাঁদের দেশে। 

-- তুমি  আমাকে একটা গল্প শোনাও। 
-- চাঁদের দেশে এক চাঁদের বুড়ীর সাথে আমার খুব ভাব ছিল।  সে আমাকে একদিন  একটা সাদা বিড়ালছানা উপহার দেয়।  সেই বিড়াল ছানাটির নাক, মুখ, চোখ, গাল একদম তোমার মতো দেখতে খুব সুন্দর।  আর শরীরটা ছিল তুলতুলে। আমি সেই নরম বিড়াল ছানাটির গাল আমার গালে লাগিয়ে আদর করতে থাকি। দেখি -- কী সুন্দর শান্ত হয়ে আছে। 

--- তারপর?     

--- তারপর আর কী?  দেখি সে ঘুমিয়ে গেছে।         
-- তুমি আমাকে ঐরকম একটা বিড়াল ছানা এনে দিবে? 

-- অবশ্যই দেব। আমি আবার যখন চাঁদের দেশে যাব,  তখন চাঁদবুড়ীকে বলে তোমার জন্য একটি সুন্দর  তুলতুলে বিড়াল ছানা নিয়ে আসব।  আচ্ছা, তোমার নাম কী? 

--- ঐশ্বর্যময়ী। 
                              
মণিকা ওর ঐশ্বর্যময়ীকে বলে -- 'তুমি তোমার দাদুর সাথে পরে কথা বলবে। এখন চলো।' 

মণিকা মেয়েকে অন্য রুমের  ভিতর রেখে আসে। এবং অনেকটা বিস্মিত হয়ে রোহিতকে বলে --'আজ প্রথম দেখলাম, আমার মেয়েটি কোনো একজন অপরিচিত মানুষের কোলে গিয়ে বসেছে। এবং তাকে আপন করে নিয়েছে।'     

রোহিত মনে মনে বলছিল -- 'আমি অপরিচিত মানুষ?' পরক্ষণেই বলে --  ও আমাকে খুব আপন মনে করেছে। তাই এসে কোলে উঠেছে। আচ্ছা,  তুমি আমার নাম আগে কারোর কাছে থেকে কখনো শোনোনি? 

-- জ্বী ,  এখন মনে পড়ছে। মতি চাচাসহ গ্রামের অনেকের কাছে থেকে আপনার কথা আমি শুনেছি। আপনি তো নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন সেই কবে।  তা এতবছর কোথায় ছিলেন? 

-- সে অনেক কথা। এত কথা শোনার তোমার সময় হবে না। বিরক্ত হবে তুমি। আমার জীবন হচ্ছে যাযাবরীয়। একটা গান শুনেছ নিশ্চয়ই -- '' আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর। আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভলগার রূপ দেখেছি, অটোয়ার থেকে অস্ট্রিয়া হয়ে প‌্যারিসের ধূলো মেখেছি... ''  পৃথিবীর দেশে দেশেই আমার ঘর। গানের ঐ কথার মতোই আমার জীবন।

কত দেশ ঘুরেছি, কত বিচিত্র মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি, কত সরোবরে পদ্মফুল জলে ভাসতে দেখেছ।  কত নদীর কূলে একাকী বসে থেকেছি, কত সাগরবেলায় হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে জলের সাথে অন্তরের বেদনার কথা প্রকাশ করতে চেয়েছি।     

পরিব্রাজকের মতো  ঘুরতে ঘুরতে জীবনের এই প্রান্ত বেলায় এসে মনে হলো -- আর কত অভিমান প্রলম্বিত করব?  কার সাথেই অভিমান আমার !  নিজের কাছে থেকে নিজে কখনও জানতে 
চাইনি -- 'কোথায় আমার কে আছে?' কখনও খুঁজতেও চাইনি -- 'আপন কেউ কী আছে , যে আমার জন্য সান্ধ্য ধূপগন্ধ প্রদীপ জ্বেলে অপেক্ষা করবে।  

মাঝে মাঝে খুব করে মনে হতো -- আমার অমঙ্গলে, আমার অসুখ বিসুখে, আমার রোগ মুক্তির জন্য  কোনো আপন মানুষ কী প্রার্থনা করে?  কত সময়ে তপ্ত জ্বরে শরীর পুড়ে যেত, প্রবাসে সেই অজ্ঞাতে কেউ কাপড়ে  জল ভিজে জলপট্টি দেয়নি কপালে।   

মানুষের  যখন বয়স বাড়ে, তখন তার বোধের অনেক কিছু দূর্বল হয়ে যায়, এই ধরো -- আমার তারুণ্যে যে অভিমান ছিল, সে অভিমান এখন আর নেই, তা অবদমিত। সবাই আহাম্মক হয় না, কেউ কেউ হয়। আমি ছিলাম সেই আহম্মকের দলে।  কত কুসুমাস্তীর্ণ জীবনই না হতে পারত এই জীবন। তার কোনো সুবাসিত ফুলই ফোটাতে পারিনি। তবু জীবন আছে। কেন যে এখনও  এই পৃথিবীর মধ্যখানে প্রবল ভাবে বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে।  বিধাতা একমাত্র এই পৃথিবীকেই  বহু অমূল্য রূপ সৌন্দর্য দিয়ে তৈরি করেছেন। 

একটা জিনিস জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে এসে উপলব্ধি করছি -- কারোর প্রতি চির অভিমান করতে নেই। কাপুরুষের মতো সবাইকে ছেড়েছুঁড়ে  জনমের তরে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে নেই। তুমি হয়ত বলতে পারো -- 'জীবনটা আবাার সংশোধন করে নিন।'  কিন্তু কী লাভ আর সংশোধন করে ? জীবনই তো শেষ ! ভাঙা এই প্রবঞ্চিত জীবনে কেউই তো আর নেই।                 

--  আপনি বিয়ে করেন নি। 

-- না।                                                                    
রোহিত মণিকাকে বলছিল -- মা,  একটা কথা বলব?

-- বলেন। 

-- আমার খুব খিদে লেগেছে।  একটু খেতে দেবে?  আমি দুপুরে এখনও খাইনি। 

মণিকা একটু অবাক হয়!  স্বগোতক্তি করে বলছিল, লোকটিকে ভালো করে চেনাই হলো না। সে কি না, খেতে চাচ্ছে। আবার ভাবছিল,  উনি আমাকে আপন মনে করেই হয়ত খাবার চাইছে। যেমন করে সন্তান খেতে চায় মায়ের কাছে, যেমন করে বাবা খেতে চায় কন্যার কাছে। উনি হয়ত আমার ভিতর একজন কন্যার ছায়া দেখতে পেয়েছে । 
              
খাবার টেবিলে খেতে বসে রোহিত মণিকাকে বলছিল -- জামাই বাবু কখন আসবে?  

-- ও চলে আসবে। ওর চলে আসার সময় হয়েছে। 

--- আমি জামাইবাবুকে রেখেই খেতে বসলাম। 

-- কোনো অসুবিধা নেই।  আপনি বিব্রত হবেন না। 


রোহিত খেতে খেতে মণিকাকে বলছিল -- তোমার মা আমার ছাত্রী ছিল।  তাকে আমি খুব স্নেহ করতাম। সে আমার মঙ্গল কামনা করত সবসময়। একবার রেবেকা আমার জীবনও বাঁচায়েছিল। কেউ যদি কারোর জীবন বাঁচায়,  তখন সে তার কাছে একজন দ্বিতীয় ঈশ্বর বা দেবী হয়ে থাকে চিরকাল।  আমি তোমার মায়ের কাছে চিরঋণী হয়ে আছি।      

রোহিত আরও বলছিল -- আমি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে তোমার কাছে এসেছি মা। তুমি তিনদিন পর জামাইবাবুকে নিয়ে হরিনা গোপাল গ্রামে চলে আসো,  তোমাদের কিছু কাজ দিয়ে যাব। কিছু দায়িত্ব।  তুমি আসো, তখন তোমাকে বিস্তারিত সব বলব।                                                                                    
রোহিতের খাওয়া শেষ হয়ে যায়। তখন পর্যন্ত জামাইবাবু আসে নাই।  রোহিত বলছিল -- আমি আজ চলে যাই। যদিও কাল আরও একবার আসব শহরে। একটা জরুরি কাজ করা বাকি আছে। কাল এসে সেটা সম্পাদন করব। 

--- তাহলে কাল আবার আসবেন। 

--- দেখি, যদি সময় পাই আসব। আর না আসতে পারলে তোমরা কিন্তু অবশ্য অবশ্যই গ্রামে যাবে।  কোনো কিছুতেই যেন  মিস না হয়। জামাইবাবুকে আমার হয়ে সব বলবে।   

--- যাব আঙ্কেল। 

-- তোমার মেয়ে কই? ডাকো। 

মণিকা মেয়েকে নিয়ে আসে।  এবারও সে কোলে এসে বসে বলে -- তুমি চলে যেওনা।  তুমি চলে গেলে আমাকে গল্প শোনাবে কে? 

--- আমি আবার আসব।  এসে মেঘের দেশের এক অপূর্ব সুন্দর পরীর গল্প শোনায়ে যাব।         

রোহিত ঐশ্বর্যময়ীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলে -- তুমি তোমার আব্বু আম্মুকে সাথে করে নিয়ে এই শহর থেকে সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর কটি জামা ও খেলনা কিনবে। 

ঐশ্বর্যময়ী রোহিতের পাজরের কাছে  মাথা রেখে  বলে, আচ্ছা।      
                        

    
                      


  



                                                                                                             

রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ৯

বাড়িতে আসার পর শহীদুল রোহিতকে বলছিল -- আমি কী এখন চলে যাব?  
--- না যাসনে, চল পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর কিছুক্ষণ বসে থাকি। বিশ্বাস কর শহীদুল, তোকে না পেলে আমি মনে হয় একদিনও এখানে থাকতে পারতাম না। কেমন দম বন্ধ হয়ে যাবার মতো শূন্যতা চারদিকে। সেই শূন্যতার মাঝে তুই আমার ছায়াসঙ্গী।  

ওরা দুজন পুকুর পাড়ে খালি জায়গায় ঘাসের উপর যেয়ে  বসে। রোহিত শহীদুলকে বলছিল -- একটা সিগারেট দে। ধরাই।

রোহিত আনমনা দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে স্বগোতক্তির মতো বিড়বিড় করে বলছিল -- একটি গ্রাম‍্য অর্বাচীন ছেলে। যে তার বুকের ভিতর  রিমঝিম বৃষ্টি লুকিয়ে রাখত। প্রদীপের আলোর বাইরে যে অনির্বচনীয় জোৎস্না থাকে, তাও সে মুঠোর ভিতর পরম যত্নে ভরে রাখতে চেয়েছিল। সে বুঝতে পারত এ আলোর নীচে কোনও আঁধার নেই। খুব কাছে তারায় তারায় ভরা আকাশ। কত অফুরন্ত আলোর রোসনাই ঐ আকাশের গায় । ঐ আকাশ, ঐ আলো, এই পার্থিব  জগত কেবলই মায়ার। এই মায়া থেকে কেউ নিজেকে আলাদা করতে  পারে না। কেউ ছাড়তেও পারে না। এই মায়াগুলোই হচ্ছে ভালোবাসা । 


শহীদুল রোহিতের ঘারের উপর একটি হাত রেখে বলে--' তুই কী যেন আমার কাছে লুকাচ্ছিস, কী এক গোপন দুঃখ ব্যথা।   আমি একসময় তোর জীবন জুড়ে ছিলাম। আজ মনে হচ্ছে - সেই থাকার মধ্যে অনেক ফাঁক ছিল। কোথায় কোন্ গোপন অন্তর কুঠিরে  তোর সুখ দুঃখ বেদনার কথা লুকিয়ে রেখেছিলি।  না হলে, কাউকে কিছু না বলে এইভাবে এই শিকড় ছেড়ে চলে যাস্?  আজ এই সন্ধ্যার বিষণ্নতা বলে দিচ্ছে -- কী এক অমূল্য জিনিস হারিয়ে ফেলে , চির অভিমান করে তুই সব মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলি।     

শহীদুল আরও বলছিল --   
আমার কথা বাদ দে। তুই জানিস, মাসি মা তোর জন্য কত কেঁদেছে। সন্ধ্যায় পূজার ঘরে আলো জ্বালাতে গিয়ে আলো জ্বালাননি তিনি । ঠাকুরের পায়ে কপাল ঠেকিয়ে অন্ধকারে  অশ্রুপাত করেছে। রোহিনী সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকত। পরিপাটি করে মাথার বেনী বাঁধতে না। ও ভুলে গিয়েছিল পায়ে নুপুর পরে উঠোনে হাঁটতে । স্কুলেও যেতে চাইত না ঠিকমতো। 

--- কী বলব তোকে। শূন্য এই ভরা বুকের মাঝে কেউ আর নেই।  তুইও তো আমার অন্তরতলা থেকে বেদনা জাগিয়ে  দিয়ে  কাঁদাচ্ছিস --   
       
'আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে
আমার দিন ফুরালো
গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে
আমার দিন ফুরালো…'

চোখের ভিতর অনেক জল ছপ ছৃপ করছে। কিন্তু সব জল স্থির করে রেখেছি। ঝরতে দেই না।  কারোর জীবন দীপ নিভে গেছে, এমন কোনো আঁধার হওয়ার করুণ-সুধা রসের কথা তোকে আজ বলতে চাই না। 

রাতভোর যদি বৃষ্টি হতো।  দরজা জানালা খুলে বৃষ্টির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বৃষ্টির ছাটে ভিজে শীতল করতাম দেহখানি। কী  যে ইচ্ছে করে বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ নিতে।  যদি তুমুল ঝড় উঠত।  

জানিস শহীদুল,  কতকাল সাদা টগর ফুল স্পর্শ করিনি। উন্মুখ হয়ে থাকি রাধাচূড়ার তলে যেয়ে একটু হাঁটতে। মৌ মৌ গন্ধ ভাসত বাতাসে। কতদিন চলে গেছে -- ঐ হলুদ ফুলটার পাপড়ি ছুঁয়ে দেখিনি আমি।  কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে মন।
 
'...কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।'

--- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। 


--- দোহাই লাগে,  তুই তোর এইসব কথা বন্ধ কর! 

রোহিত শহীদুলকে বলে -- আরও একটা সিগারেট দে। এমন  চুপ হয়ে আছিস কেন?

-- একটু মন ভালো করে দে। তোর নির্বাসিত প্রবাস  জীবনের কোনো সুখ স্মৃতি যদি থাকে, সেই স্মৃতির কথা শোনা আমাকে।      

-- ১৯৭০ সালে স্কলারশিপ নিয়ে প্রথম আমি বিলাতে যাই।  থাকতাম উইনিভার্সিটির একটি হোস্টেলে। ওখানে যাওয়ার পরপরই শীতকাল শুরু হয়।  জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি কোনো এক সময় হবে। প্রচুর শীত পড়েছে। আমি তো শীতের তেমন কোনো কাপড় নিয়ে যাইনি। কাছে বাড়তি কোনো টাকাও ছিল না যে, তাই দিয়ে ভারী শীতের কাপড় কিনব। 

একদিন সকাল বেলা জানালা খুলে দেখি -- বাইরে প্রচুর সাদা সাদা বরফ পড়ছে। আমি এতদিন শুধু তুষারপাতের কথা শুনেছি। কিন্তু তা স্বচক্ষে  কোনোদিন দেখিনি । ঐ দিনই প্রথম তুষারপাত  দেখি। মনটা ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। কয়দিন ধরে মনটা এমনই  খারাপ লাগছিল। হোম কান্ট্রি সিক যাকে বলে। কিন্তু তুষারপাত দেখে  মনটা ভালো হয়ে গেল।  মন খুব টানছিল সারা শরীরে তুষার মাখাতে। আমি বোকার মতো একটা হালকা 
টি-সার্ট ও প্যান্ট পরে তুষারে ভিজতে বাইরে বের হয়ে পড়ি। 

পথে নেমে পা পা করে হাঁটতে থাকি। শিমুল তুলার মতো বরফ উড়ে উড়ে  এসে আমার টি-সার্টের উপর পড়ছিল।  প্রথম প্রথম নিজেকে  খুব দুঃসাহসিক অভিযাত্রী  মনে হলো । যেন -- 'আহা!  কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।' কিন্তু পরক্ষণেই দেখি, হাত পা শরীর বরফে জমেি আসছে। কিন্তু  দমে গেলাম না। আমি থাকতাম পশ্চিম লন্ডনের একটি এরিয়ায়। ওখান থেকে ক্যাস্টল বার পার্ক রেল স্টেশন বেশি দূরে নয়। আমি প্রায়ই ঐ রেলস্টেশনে যেয়ে বসে থাকতাম। খুব চমৎকার নিরিবিলি একটা স্টেশন।  তুষারে ভিজতে ভিজতে আমি  ঐ স্টেশনে চলে যাই। ততক্ষণে সারা শরীর হিম শীতল হয়ে গেছে । আমার মাথার চুল, ভ্রু, কান, কাপড়চোপড় বরফে ঢেকে যায়।  

স্টেশনটা তখন ফাঁকা ছিল।  মনুষ্য সমাগম তেমন ছিল না। একটা বেঞ্চে জড়োসড়ো হয়ে বসে কাঁপছিলাম খুব । পাশে দিয়ে যাচ্ছিল মধ্য বয়সী একজন আইরিশ মহিলা। সে মনে করেছিল আমি একটা আধা পাগল ছেলে। নইলে এমন করে তুষারে ভিজে কেউ?  দয়াপরবশ হয়ে সেই মহিলা  তার সুটকেস থেকে একটি বিগ সাইজের লেডিস কোট আমাকে বের করে দেয়, এবং  বলে -- 'তুমি এটা পরো।' আমি কোটটি পরে নেই।   
সে আরও বলে -- তোমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই?' 

আমি বললাম -- না। 

সে আমাকে কুড়ি পাউন্ড দিয়ে বলে -- তুমি ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি চলে যাও।' সে বিড়বিড় করে এও বলছিল, -- এমনও পাগল ছেলে হয় ? '  
                                                                          

স্মৃতিকথা থামিয়ে দিয়ে রোহিত শহীদুলকে বলছিল -- কী মন ভালো করতে পেরেছি তোকে? 

--- তুই তোর আসল কথা বলছিস না। এ সমস্ত গল্পকথা আমাকে বলে তোর জনম জনমের আসল দুঃখকে ঢেকে রাখতে পারবি না। 

-- যে মানুষের জীবনে দুঃখ নেই, সে তো জীবনের স্বাদই পায় নাই। জীবনকে চিনতে হলে দুঃখের নদী সাঁতরাতে হয়। তবেই বোঝা যায়,  জীবন কী? ব্যর্থতা, গ্লানি, খেদ, অপূর্ণতা, আফসোস, অশ্রুত কান্না, দীর্ঘশ্বাস, বিরহ, বিষাদ,  উপেক্ষা, অবহেলা -- এই সবই জীবনের বোধ। আর এই বোধগুলোকে যে না চিনেছে, সে তো আর একজন ব্যর্থ মানুষ। সত্যি অর্থে সে জীবনই দেখেনি।                                                                                       
কথায় কথায় সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে যায় অনেক।বেলীফুলের ঝাড় থেকে গন্ধে ভরে ওঠে সারা পুকুর পার। ঝিঁঝি ডাকছে। জোনাকিরা মিটি মিটি করে  সবুজ আলো জ্বালিয়েছে ছিটকির বনে। রোহিত শহীদুলকে বলে -- 'আর একটা সিগারেট দে। খেয়ে ঘরে চলে যাই।'                    
                                      
যেদিন শেষ বারের মতো চলে যাব, সেদিন পথ 
ডেকে বলবে , দাঁড়াও তুমি-- ধূলি মেখে যাও পায়ে।
শূন্য নীল আকাশ বলবে, এস তোমাকে নীলাদ্রি করে দেই। রাতের তারা মন্ডল বলবে --- কোথায় আর যাবে? তারা হয়ে জ্বলে থাকো আমাদের পাশে।
দখিনা সজল বাতাস দোলা দিয়ে বলবে -- তোমার আতর মাখা শরীরের গন্ধ ছুঁয়ে দাও।
ফুল বলবে, আজ তোমার জন্য ফুঁটেছিলাম, সুবাস নিয়ে যাও। পাখি বলবে -- যাবেই যখন আমার একটি পালক পরে নাও।
নদী বলবে, এস আর একবার, অবগাহন করো, পুণ্য হয়ে যাও।
নারী বলবে, প্রেম দিব তবু তুমি যেওনা।

খরতাপে চোখ পুড়ে তপ্ত মাঠ পেরিয়ে চলে যাব।
ধুনো ধূপের গন্ধ পাব আকুল করা আশ্বিন সন্ধ্যায়। হাঁটব যতক্ষণ না তারা ফুটে উঠবে আকাশে। চলব যতক্ষণ না আলো নিভে মেঠো পথে। অন্ধকারে যতক্ষণ না দেখতে পাব জোনাকিরা উঠছে, পড়ছে, জ্বলছে, নিভছে।
                           

শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০

অতিপ্রাকৃত

একটা ভয়ংকর ঘটনার কথা লিখছি।  ১৯৮৫ সালের কথা। তখন বিয়ে সাদি কিছু করিনি।  এক বাড়িতে একা থাকি। আশেপাশে তেমন বাড়ি ঘর নেই। বাড়ির পাশেই জঙ্গল। বাঁশ ঝাড়ও আছে ঘরের চাল ঘেষে।     

সে বছর একুশের বইমেলা থেকে কোন্ কুক্ষণে কিছু অতিপ্রাকৃত ভূত পেত্নীর বই কিনেছিলাম। তার মধ্যে ছিল বিভূতিভূষণের তারানাথ তান্ত্রিক।  তো কয়দিন সেই বইগুলো পড়লাম। পড়ার সময়ই আমার ভিতর কেমন যেন একটি পরিবর্তন অনুভব করলাম। কেমন অস্বাভাবিক সন্ন্যাস সন্ন্যাস ফকির ফকরান্তি ও পাগল পাগল ভাব। ভাবছিলাম এর কারণ কী?  আমার কাছে মনে হলো যত গন্ডগোলের মূল -- বিভূতিভূষণের এই তারানাথ তান্ত্রিক।  ওকে যে করে হোক ঘর থেকে সরাতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম -- ওকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে একদিন তুরাগ নদীতে ফেলে দিয়ে আসব।          
 
কিন্তু তারানাথ তান্ত্রিককে বিসর্জনে পাঠানোর
আগেই ঘটে গেল এক ভয়ংকর ঘটনা।   

সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মেঘ গুরুগম্ভীর বৃষ্টি হচ্ছিল । ঘরে আমার চাল চুলো জ্বলে না।  আজিজ মিয়ার হোটেল থেকে বাজিতপুরের বিলের  ঠ্যাংওয়ালা চিংড়ি মাছের ভুনা তরকারি  দিয়ে ভাত খেয়ে আসি। সাথে আষাঢ়ের ডিমওয়ালা টেংরা মাছের তরকারিও ছিল।       
  
কী করব?  কোনো কাজ কাম নাই। টেবিল থেকে  তারানাথ বের করে  পড়তে থাকি। উইলিয়াম ওয়ার্ডওয়ার্থের লেখা  দুষ্ট কবিতার মতো  বৃষ্টির রাত ছিল। কী চমৎকার ঝরো হাওয়ার সাথে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে । শীতল হতে লাগল শরীর মন।       

তারানাথ তান্ত্রিক পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই। হঠাৎ একটি শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। শব্দটা বারান্দার দিক থেকে আসছিল। ঘড়িতে চেয়ে দেখি রাত পৌণে তিনটা। তারানাথে পড়েছিলাম -- ভুত পেত্নী দেখে ভয় পেতে নেই। ভয় করলে ওরা নাকি মাথায় ওঠে এবং ঘার মটকিয়ে চিবিয়ে খায়।      

শব্দটা আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছিল।  আমি মনে সাহস আনলাম।  দরজার কাছে এগিয়ে যাই। আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে বুকে ফু দিয়ে বিসমিল্লাহ বলে দরজাটা খুলি। দরজা খুলে আমি তো বিস্ময়েে হতবাক! বাইরে মধ্য আকাশে পূর্ণিমাভূক বিশাল চাঁদ। চন্দ্রদাসী হয়ে  সে আলো ছড়াচ্ছে আঙিনায়। যে মেঘ আর বৃষ্টি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সে মেঘও নেই,  সে বৃষ্টিও নেই। তার পরিবর্তে এই অবিস্মরণীয় চাঁদের আলোয় ভাসছে  ভূবনলোক । সেই চন্দ্রালোকে একটি উপজাতীয় মেয়েকে দেখতে পাই। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটি বলছিল -- আমি টিনটিন।  বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় থেকে এসেছি । 

ও আরও বলছিল -- আমাকে তোমার মনে আছে? আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতাম।  এবং তুমিও।  তোমার কারণে আমি খুন হয়েছিলাম গাঙুর হাতে। এই দেখো আমার শরীর জুড়ে খুনের রক্ত।       

-- না, আমি তোমাকে চিনিনা। তুমি কে? চলে যাও তুমি ।  

অনেকটা অবজ্ঞা ও ধমক দিয়ে আমি এক নিমিষে ঘরের ভিতর চলে এসে দরজা বন্ধ করে দেই। ভিতর থেকে আবারও শব্দ শুনতে পাই।  আবারও দেখি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। গুরুগম্ভীর করে মেঘ ডাকছে। কোথাও কোনো চাঁদের আলো নেই। একটু পর শুনতে গাই --  টিনটিন গুমরে গুমরে কাঁদছে। 

তখনও ঘরের চালে এক কোণে বাঁশের  ঘষঘষ শব্দ হচ্ছিল। ভাবলাম, 'টিনটিন কাঁদলে কাঁদুক। আমার কী?  ও আমার কে?' আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি এবং ঘুমিয়ে যাই। 

সকালে ঘুম ভেঙে দরজা খুলে দেখি -- উঠোনে বৃষ্টির জলের সাথে ছোপ ছোপ রক্ত ভাসছে। এবং  বারান্দায় দেখি -- টিনটিনের ফেলে যাওয়া ওর  রক্তমাখা ওড়না পড়ে আছে । 

আমি ঐদিনই দেরি না করে  তারানাথ তান্ত্রিক বইটি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে  তুরাগ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আসি।                           

      

   

                                                                           

             
                                

বুধবার, ১ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ৮

পিপুলবাড়িয়া বাজারে চা খেয়ে  দুপুরের মধ্যেই রোহিত ও শহীদুল বাড়ি  চলে আসে। শহীদুল  চলে যায় ওর বাড়িতে।  রোহিত শহীদুলকে বলে দেয়  -- তুই বিকালে একটু চলে আসিস।  তোকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। 

--- কোথায় যাবি?

--- তুই বিকালে আয়।, তোকে  কোথায় নিয়ে যাই।  তখনই জানতে পারবি।     

বাড়ির ভিতর রোহিত যখন ঢুকে তখন ঘরের ভিতর ছায়া রাণী ও জামাই বাবু কী নিয়ে যেন কথা-কাটাকাটি করছিল। রোহিত শুধু জামাই বাবুর এই কথাটি শুনতে পেল -- 'বেচে টেচে যখন সব টাকা পয়সা নিয়ে চলে যাবে, তখন তুমি বুঝতে পারবে।'                 

রোহিত ছায়া রাণীকে ডাকে -- ছায়া...। 

ছায়া রোহিতের কাছে এসে বলে --  জ্বী দাদা। 

--- নে, বাজারের ব্যাগটা ধর্।  পিপুলবাড়িয়া বাজারে যমুনার আইর মাছ পেলাম তাই কিনে নিয়ে এলাম। কতকাল ধরে যমুনার মাছ খাইনা। তুই ঠিক আমার মায়ের মতো করে রান্না করবি।  আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে,  আজ আমার মায়ের হাতের রান্না খাব।       

 বিকালে যথাসময়ে শহীদুল চলে আসে। শহীদুল রোহিতকে বলে এখনই বের হবি? 
-- হুম।  এখনই বের হবো,  চল। 

দুই বন্ধু বের হয়ে পড়ে।     

রোহিত শহীদুলকে সাথে নিয়ে  যে বাড়িটাতে যাচ্ছে, সে বাড়ির পথ তার চির চেনা। কিছু পথ আছে, হাজার বছর পরেও  চলতে যেয়ে  অচেনা মনে হয় না। কিছু নদী আছে যে নদীর আঁখি কোণের জল ফুড়ায় না,  কিছু আকাশ আছে, যে চির নীলাম্বরী শাড়ি পড়ে থাকে চিরকাল। যেন 'বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল—
সকলই আমার মতো।'

অপরাহ্ণের  পাখিগুলো সুপারি বাগানের ঝাড়ে বসে ডাকছিল। পাখিদের ভিতরও সব পাখির ডাক একই রকম হয় না। কারোর ডাকের ভিতর আনন্দ উৎসব করার নিমন্ত্রণ থাকে,  কারোর ডাকে  শোনা যায় বেদনা নিঃসৃত কান্নার ধ্বনি। ওদের ভিতরও আছে  সুখ দুঃখের অনুভূতি। কারোর ভিতর যদি মন খারাপ থাকে, সেদিন তার সুরের  মাধুর্য প্রাণের মধ্যে কোনো সাড়া দেয় না। সুরের স্তরে স্তরে মন কেমন উদাস হয়ে ওঠে। মনে হয় জীবনটা কেবল কতকগুলো বিষাদের গানের সুরের সমষ্টি। 

পরন্ত বিকালে মানুষ তার জীবনের  ক্লান্তির ছায়া নামতে দেখে। আত্মার স্পন্দন ক্ষীণ ভাবে অনুভব করে।  যা কিছু ভালোলাগা তা ঐ পশ্চিম আকাশের লাল আভাটুকু।  রোহিত হাঁটছিল আর ভাবছিল -- 'কী এক অসীম ক্ষরণ হৃদয়ে,  রক্তান্ত  আত্মার সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রাপ্তির এই চাওয়াটুকু চাইতে ইচ্ছে করে, 'পর জনমে শুক্লা যামিনীতে যদি তুমি আস, দেখতে পাই যেন  তোমাকে  ঠিক চির কল্যাণময়ী রূপে।'

দূরে কোথায় যেন হাস্নাহেনা ফুটে আছে। অনাঘ্রাত সুবাস মিশে আছে আজকের এই অপরাহ্ণের ঝলমলে রোদ্র  ছায়ায়। পথ আর চলতে পারিনা যে! 'ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো।'


রোহিত ও শহীদুল একসময় চলে আসে সেই বাড়িটিতে।  সুন্দর ছোট্ট একটি পুকুর। পিছনে পশ্চিম পাশে বাঁশবন, আমগাছ গুলো বহু আগের। ফলের গাছগুলো যেন প্রাচীন অরণ্যে পরিণত হয়েছে। খুব নির্জন বাড়ি। এই বাড়িতে এখন কে থাকে? 

শহীদুল বিস্ময়ে রোহিতকে জিজ্ঞাসা করে। -তুই এই বাড়িতে আমাকে নিয়ে আসলি? এটা তো হাসান মাস্টারের বাড়ি। এই বাড়িতে ওনার কেউ থাকে না।  একজন পুরানো ভৃত্য বাড়িটি দেখাশোনা  করে।'

রোহিত শহীদুলকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। বাড়ির আগের ঘরগুলো এখনো রয়ে গেছে। সেই বারান্দার কোণ্ এখনো আছে। শুধু চেয়ার টেবিলগুলো ওখানে নেই, যে কোণে বসে রোহিত রেবেকাকে পড়াত। স্মৃতির অমল কাঁটায় ক্ষরণ হচ্ছিল তার হৃদয়ে --    

তেতত্রিশ বছর আগের! কী আশ্চর্য মধুময় স্মৃতি চোখে দেখতে পাচ্ছিল রোহিত। টেবিলে বসে আছে সে। বিস্ময়ে দেখছিল রেবেকাকে। একটি ডোরাকাটা কামিজ পরে আছে। ওড়না পিছনের ঘার থেকে দুই দিক দিয়ে ঘুরিয়ে সামনে এনে রেখেছে। ওর একটি হাত খাতার উপর, আর একটি হাত রোহিতের হাত ধরে রেখেছে। রোহিত দ্বিধা করছিল ছাড়িয়ে দেবার। কিন্তু পারছিল না, বারবার চেষ্টা করেছে, তাও পারে নাই।  রেবেকার অতি প্রত্যয়ের মুখ দেখে মনে হয়েছিল -- 'ন্যায় অন্যায় জানিনে শুধু তোমাকে জানি।'  শুধু তোমাকে চাই প্রথমত। তোমাকে চাই জীবনের শেষ পর্যন্ত।         

ভৃত্য মতি কাছে এগিয়ে আসে। রোহিত মতিকে চিনতে পারে।  মতি তখন ছোট ছিল।  একদম বালক।  এই বাড়ির ফয়ফরমাস করত।  রোহিত মতিকে বলে -- 'তুমি কেমন আছো মতি?' মতি রোহিতের  মুখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। চিনতে পারেনা।   

-- আমাকে চিনতে পারছো না মতি?  আমি তোমার রোহিত দা। 

মতি রোহিতের হাত চেপে ধরে বলে -- ' এত বছর পর আপনি এলেন রোহিত দা? মনে করেছিলাম -- আপনি আর কোনোদিন ফির আসবেন না।' চলেন ঘরের  ভিতর যেয়ে বসেন।' 

-- না, আমরা বসব না।  চলে যাব এখনই।  আচ্ছা মতি, তোমার রেবেকা বুবুকে কোথায় কবর দিয়েছে, জানো?'

-- আপনি আসেন আমার সাথে।  দেখাচ্ছি। 

বাড়ির পূর্বপার্শ্বে একটি পারিবারিক কবরস্থান। ওখানে বেশ কয়টি কবর আছে। তাদের ভিতরই রেবেকার কবর।  কবরটি বাঁধানো।  শ্বেত পাথরের একটি প্লেটে লেখা আছে  --
মোছাঃ রেবেকা বেগম। 
মৃত্যু -- ২৭ আষাঢ়, ১৩৭৪ বাংলা।  

সৌম্য নিস্তব্ধ সমাধি স্থল। প্রত্যহ রাত্রির  আকাশ থেকে চন্দ্র কিরণ ঝরে পড়ে দূর্বা ঘাসের উপর। অজস্র তারার আলোর নীচে দূর্বাদলের উপর সুঘ্রাণ ছড়ায় বন্যমালতী।  শ্রাবণ মেঘ থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে  ভিজে থাকে মাটি। সন্ধ্যায় সোনালি আভায় হাস্নাহেনার গন্ধে আকুল হয়ে ওঠে প্রাঙ্গন। রোহিত মৃত্তিকার নীচ থেকে রেবেকার হৃদয়ের স্পন্দন ধ্বনি শুনতে পায় । ক্ষণতরে ক্ষরিত হয় বহু আগের প্রণয়সুধাসার।          
                         
রোহিত শহীদুলকে বলে -- 'তুই রেবেকার কবরটা জিয়ারত করে ওর আত্মার শান্তি কামনা করে   একটু মোনাজাত কর্।'

শহীদুল কবরটি জিয়ারত শেষে মোনাজাত করে। সেই মোনাজাতে রোহিতও হাত উঠায়ে প্রার্থনায় রত ছিল।           
      
বাড়ির ভিতর এসে মতি রোহিতকে বলে -- এই বংশে রেবেকা বুবুর একটি মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। ওনার মেয়েটি স্বামীর সাথে শহরে থাকে। নাম মণিকা।  শহরের আমলা পাড়াতে থাকে।  ওর স্বামীর নাম -- নাসির উদ্দীন উকিল।                 
           
মতি আরো বলছিল -- জানেন রোহিত দা, আমার মনে আছে, যেদিন রেবেকা বুবুর বিয়ে হয়, সেদিন সে খুব কেঁদেছিল। বিয়ের পর থেকেই রেবেকা বুবু কেমন অসুখে পড়ে যায়। খেতে পারত না কোনো কিছু।  দিনে দিনে একদম রোগা হয়ে যায়।  এর মাঝেই তার গর্ভে সন্তান আসে।  প্রসবের সময় সে মারা যায়। সন্তানটি বেঁচে থাকে।  আর সেই সন্তানই হচ্ছে  মণিকা।   

রোহিত মতিকে বলে -- ঠিক আছে মতি।  তুমি থাকো। আমরা যাই।  পারলে একবার আমাদের বাড়িতে  এস। আমি দুই তিনদিন আছি। 

মতি বলে -- একটা জিনিস আছে।  আপনি একটু দাঁড়ান, আমি ভিতর থেকে নিয়ে আসছি। 

মতি ঘরের ভিতর চলে যায়। একটু পর পুরনো খবরের কাগজে মোড়ানো একটি বই এনে রোহিতের হাতে দিয়ে বলে -- রেবেকা বুবু মৃত্যুর কয়দিন আগে এই বইটি আমাকে দিয়ে বলেছিল -- 'যদি কোনোদিন তোর রোহিত দাদা ফিরে আসে তখন এই বইটি তাকে দিয়ে দিবি। অন্য কাউকে বলবি না এই বইটির কথা। '   

রোহিত মোড়ানো কাগজ খুলে দেখে, এটি নবম শ্রেণির একটি অংকের বই। বইটি সে সিরাজগঞ্জ থেকে কিনে এনে রেবেকাকে দিয়েছিল। রেবেকা বইটির দাম দিতে চেয়েছিল কিন্তু রোহিত তার কাছ থেকে মুলা গ্রহণ করেনি। 

বইটি জীর্ণ পুরনো হয়ে হলুদ রঙ হয়ে গেছে। সে বইটির পাতা উল্টায়ে দেখতে পায় , প্রথম সাদা পাতায় রেবেকার নিজ হাতে এই চরণগুলি লেখা --

জীবন যখন শুকায়ে যায় 

করুণাধারায় এসো।

সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, 

গীতসুধারসে এসো।

কর্ম যখন প্রবল-আকার

গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার,

হৃদয়প্রান্তে হে জীবননাথ, 

শান্তচরণে এসো।

আর কিছু লেখা নেই। নাম তারিখ বা অন্য কোনো কথা।                                                                    

এক মনখারাপের অসীম  বেদনা নিয়ে রোহিত বাড়ি চলে আসে।  আসতে আসতে পথে যেন এক বিরহিণীর অযত্ন বিন্যস্ত মেঘবরণ চুল এলিয়ে দেওয়ার মতো সন্ধ্যা নামতে থাকে। প্রিয়াহীন প্রাণের নিবিড়  দূর বনে ডাকছিল কাকাতুয়া। চোখ  অশ্রু সজল হয়ে উঠে। তার নিসৃত অশ্রুধারা পথসঙ্গী শহীদুল দেখতে পেল না।   

'দীর্ঘদিন আমি এমন প্রবাসী হয়ে আছি।
বড়ো দীর্ঘদিন, দীর্ঘবেলা।
জলের ভিতরে ক্রমে জমে-ওঠা শ্যাওলার সবুজ,
হাওয়া ভারী হয়ে আসে, স্রোত
থেমে যায়, ক্রমে
কুসুমের বুক থেকে ঝরে পড়ে নিহিত কুসুম।
দীর্ঘদিন বিজনে একেলা।'

কবিতা -- প্রণব মুখোপাধ্যায়।

রোহিত যখন ফিরে আসছিল -- তখন কার্তিক হাওয়ায় রাস্তার দুপাশের বৃক্ষরাজী থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছিল। বট, অশোক, কৃষ্ণচূড়া,র পাতা বাতাসে ঝিলমিল করে উড়ছে। একজন পাগলিনী এলমেল ভূষণে ছুটে চলে যাচ্ছিল কোথাও । সেই পাগলিনী একবারও কারোর দিকে  না তাকিয়ে বলে যাছিল -- 
'সুখ নেইকো মনে, সুখ নেই। নাকফুলটি হারিয়ে গেছে বেতসীর বনে।'