সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ১৩

পরেরদিন সকালে রোহিত ঘুম থেকে উঠে ছায়া রাণীকে ডেকে বলে -- ছায়া, আজ বিকালে শহর থেকে মণিকারা আসবে, এখানে থেকে শহীদুল ওর বউকে নিয়ে আসবে। সন্ধ্যার পর আমরা সবাই মিলে একটু  আনন্দ করব।  

আর একটি কথা, আমি আগামীকাল সকালেই চলে যাচ্ছি। মন খুব করে চেয়েছিল জন্মভূমি দেখতে, এখানকার মাটির গন্ধ নিতে, শৈশবের ধূলির পথগুলো থেকে ধূলো পায়ে মাখতে। আমার সেই অদম্য তৃষ্ণা কিছুটা হলেও মিটেয়েছি। যদিও এ তৃষ্ণা চিরতরে মিটাবার নয়। আকুতি থেকেই যাবে। যা হোক যতটুকু মিটিয়ে নিলাম, ঐ প্রবাস বিভূঁইয়ে এখন আর মন প্রাণ তেমন উতলা হবে না। 

ছায়া রাণী কাঁদছিল। রোহিত বাহুতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে --  পাগলি !  তুই কাদছিস কেন? যদি বেঁচে থাকি, আবার হয়ত এমনই হুট করে একদিন চলে আসব। 

-- দাদা, তুমি আমাকে হঠাৎ করে বলছ, তুমি চলে যাবে। একটুও সময় দিলে না। তোমাকে ওট পিঠা, দইলা পিঠা,  মালপোয়া, চদ্রপুলি, দুধের পিঠা কিছুই বানিয়ে খাওয়াতে পারিনি। জেঠী মা এগুলো তোমাকে বানিয়ে খাওয়াতো।  তুমি খুব পছন্দ করতে।              

-- মন খারাপ করিস  না। আমি আবার তো আসব, তোকে বললাম। তখন বানিয়ে খাওয়াবি।
 
-- আমার মাথার দিব্বি রইল। তুমি আবার আসবে কিন্তু।   
  
--- আচ্ছা।  জামাই বাবু ও রঞ্জিতকে বলে রাখবি, ওরা যেন কাল সন্ধ্যায় থাকে।  আর, শোন্ -- এই টাকাগুলো রাখ, বাজার করবি। সবাইকে দুমুঠো ডাল ভাত খাওয়াতে হবে তো !    

আমি একটু শহীদুলের ওখানে যাচ্ছি। দুপুরেই চলে আসব। এসে তোর সাথে বসে একসাথে খাব। 

-- নাস্তা করে যাও। 

-- শেফালী ভাবীর কাছে থেকে খেয়ে নেব।     

রোহিত শহীদুলের বাড়িতে পৌঁছেই শহীদুলের স্ত্রীকে বলে -- ভাবী, সেমাই রান্না করো।  মুড়ি দিয়ে সেমাই খাব। সেই কতকাল ধরে মুড়ি দিয়ে সেমাই খাই না।   

--- রোহিত দা, আপনেরা দুই বন্ধু গল্প করতে থাকেন, আমি ঝটপট সেমাই রান্না করে নিয়ে  আসছি।         

শহীদুল রোহিতকে বলছিল, তুই কাল কখন যাবি? 

-- সকাল নয়টার মধ্যে বের হয়ে যাব। 

-- তোকে একটা কথা বলি রোহিত। এখনও তো জীবন অনেকখানি রয়ে গেছে। এই ধর্ -- পাঁচ বছর, দশ বছর, বিশ বছর বাঁচতেে পারিস। এই সময়টুকু সায়াহ্নকাল। অসুখ বিসুখ, শারিরীক কত অক্ষমতা আসে মানুষের । তাছাড়া একাকীত্ব তো আছেই। তুই একটা বিয়ে করে নে।                                 

-- নারে, সংসার আসক্তি আমার একদমই নেই। ভালোবাসা মায়া মমতা সবই মুক্ত বিহঙ্গের মতো ব্যপ্ত হয়ে আছে আকাশে। আমার আছে নীল আকাশ। আমার আছে মেঘ। যদি কখনও নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগে, যদি একা এলা আর না চলতে পারি, তবে মেঘকে বলব, তুমি বৃষ্টি ঝরাও,  বলব -- তুমি কাঁদো। না হয়, ঈশ্বরকে ডাকব, বলব -- তুমি আমাকে নিয়ে যাও।     

-- আমি বুঝিনা তোর এইসব কথা।          

--- সে বহুকাল আগে স্বপ্নে পাওয়ার মতো ডানা মেলে উড়ার আকাশ পেয়েছিলাম। ছোট্ট একটি ঘরে সংসার গড়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেই আকাশটা, সেই ঘরটা আর পাওয়া হয়নি। সবই স্বপ্নেে থেকে পাওয়া ছিল। স্বপ্ন ভেঙে গেছে। সবকিছু হারিয়ে গেছে।  


--- তুই বিয়ে কর, তুই সবকিছু আবার ফিরে পাবি।                        

-- এই জীবনে আর রাজ্যপাট গড়তে চাই না। কত কিছুই ঘটে পুরো জীবন অব্দি। কতজন কত কিছু পায়, রাজ্য, রাজরাণী, রাজকন্যা -- কতকিছু ! এই সব অনেকেই পায়, যারা সৌভাগ্যবান। অনেকে আবার পেয়ে হারায়। আবার কেউ কেউ পায়ই না। প্রবঞ্চিত যারা।    

জীবনে কত কিছুই ঘটে গেল। কত দেশ দেখলাম , কত নব নব মুখ, কত তুষার পড়া শীতের রাত্রি।পুষ্প কাননে ফুটে থাকা কত  নতুন ফুল, পদ্ম-কুসুম দামের কত হৃদয় কেঁদে কেঁদে দিঘির জলে মিশিয়েছে,  কত সে মায়া বিদুর স্মৃতি!…

--- আমি কিছু অনুমান করতে পারছি। তোর এই অপ্রাপ্তি, তোর এই হাহাকার ও গ্লানি কিসের জন্য, কার জন্য? 

--- অনুমানের কথা তোর ভিতরেই থাক্। যে কথা বলা হয়নি এতকাল তা আর এই সায়াহ্ন কালে নাইবা বলা হলো। তা অপ্রকাশিতই থাক। কোনো কথা না বলা মিথ্যা বলা নয়।                     


শেফালী এসে বলে -- চলুন খাবার টেবিলে। মুড়ি সেমাই খেয়ে নিন।      

      

নাস্তা খাওয়ার পর রোহিত শহীদুলকে বলে -- আলোকদিয়ার পুরানো জমিদার বাড়ির সামনে   একটি দিঘি ছিল না !  ঐ  দিঘিতে নেমে স্নান করতে ইচ্ছা করছে।  ছোট বেলায় ঐ দিঘিতে নেমে আমরা কত জলখেলা করেছি না !  আহা, কী শীতল ছিল জল। গা ঠান্ডায় জুড়ে যেত। আচ্ছা শহীদুল, জমিদার বাড়ির ঐ দিঘির জল এত ঠান্ডা ছিল কেন?   

--  তা জানি না।   চল্ জলকে চল্। তপ্ত দেহখানি শীতল করে নিবি।  '         


দুপুরে রোহিত বাড়িতে এসে ছায়া রাণীকে নিয়ে একসাথে বসে ভাত খেয়ে নেয়। খেতে খেতে রোহিত ছায়া রাণীকে বলছিল -- তুই এই বাড়িটিকে আনন্দে ভরে রেখেছিস।  তুই না থাকলে এই বাড়িতে একটি মূহুর্ত আমি  থাকতে পারতাম না।  আমার মায়ের শূন্যস্থাম তুই পূরণ করেছিস , রোহিনীর ও বৌদিদির অভাবও দূর করে দিয়েছিস। মনেই হয়নি আমি সব হারিয়ে বসে আছি।  

আর, একটা জিনিস আমার খুব ভালো লেগেছে তা হলো -- এই আঁধার হয়ে যাওয়া বাড়িটিতে কেউ না কেউ প্রতি সন্ধ্যায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায়ে রাখে। ধান ধূপ দিয়ে ঠাকুরের ঘরে পূজা দেয়। স্বর্গীয় পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। তুই তাই করছিস।  আমি তোর কাছে ঋণী হয়ে রইলাম ছায়া। 

ছায়া রাণী অঝোর ধারায় কাঁদছিল।  

   -

                                              

বিকালে মতি মিয়া এসে রোহিতকে খবর দিয়ে যায়, শহর থেকে মণিকা'রা চলে এসেছে সন্ধায় এখানে চলে আসবে।    

সন্ধ্যার পর সবাই চলে আসে। মণিকা, জামাইবাবু, ঐশ্বর্শময়ী ও মতি মিয়া । শহীদুলদের বাড়ি থেকে আসে শহীদুল ও তার স্ত্রী শেফালী। আর বাড়ির মানুষের ভিতর ছায়া রাণী,  ছায়া রাণীর স্বামী ও রঞ্জিত।     

উঠোনে লিচু তলায় চেয়ার সাজিয়ে রাখা আছে।  সবাই গোল হয়ে বসে একে অপরের সাথে গাল গল্প, স্মৃতিচারণ, সুখ দুঃখের নানান কথা আদান প্রদান করতে থাকে।     

কাকতালীয় ভাবে সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। সন্ধ্যা রাত থেকেই বাড়ির সারা উঠোন জুড়ে চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে। রোহিত মণিকাকে বলে -- তুমি একটা গান গেয়ে শোনাও।  মণিকা আজ পরেছে সোহাগপুরের নীল রঙের  তাঁতের শাড়ি। গলায় পরেছে শিউলি ফুলের মালা। খোঁপায় এক গুচ্ছ সাদা অতসী ফুল। খুব সুন্দর লাগছিল ওকে।  মণিকা খালি গলায় গাইতে থাকে রবি ঠাকুরের গান --     

'আজ    জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥

যাব না গো যাব না যে,   রইনু পড়ে ঘরের মাঝে--এই নিরালায় রব আপন কোণে।

যাব না এই মাতাল সমীরণে ॥


রোহিত রঞ্জিতকে বলছিল, তুমি একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাও।  রঞ্জিত শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতাটি আবৃত্তি করে --

' স্বাধীনতা তুমি 

রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি 

কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা- 

স্বাধীনতা তুমি 

শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা 

স্বাধীনতা তুমি

পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল...।'


ছায়া রাণী গেয়ে শোনায় রজনীকান্ত সেনের একটি গান ---

' তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, 

মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে.... ।'


এবার রোহিত সবাইকে উদ্দেশ্যেে বলে -- খুব ভালো লাগল এতক্ষণ সবার গান ও কবিতা শুনে। মনে হলো, 'এত সুর আর এত গান ওগো যদি কোনোদিন থেমে যায়।' পরক্ষণেই রোহিত বলে -- না, থামবে না। 

আমি আমার সবচেয়ে  প্রিয় কিছু মানুষকে নিয়ে আজ এখানে এই নির্মল জোছনা রাতে সমবেত হয়েছি। আমি সব হারানো একজন নিঃসঙ্গ মানুষ।  যায়াবরের মতো পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়াই। কতকাল পরে কী এক অসীম মায়ার টানে এখানে এই মাটির ক্রোরে কয়েকদিনের জন্য  ফিরে এসেছিলাম।  এসে দেখি, এখনও কয়েকজন মানুষ আছে, যারা জন্ম জন্মান্তরের আপন। যাদের ভিতর আমার আত্মার স্পন্দন অনুভব  করেছি। যদি ফিরে না আসতাম তাহলে এই প্রিয় মানুষ গুলোকে না দেখেই আমার অতৃপ্ত চোখ  চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত।

কেন যে আমি পৃথিবীর এই ছোট্ট কোণের অপূর্ব সুন্দর এই হরিনা গোপাল গ্রামটি থেকে এক আঁধার রাতে  চলে গিয়েছিলাাাম।  সে কথা চিরদিনের জন্য না বলা হয়েই থাকল।  শুধু এইটকু বলব, সেটি নিতান্তই তারুণ্যের আবেগ ছিল। সেটি ছেলেমানুষী এক ভুল অভিমান ছিল।  আজ এত বছর পর উপলব্ধি করছি, এর জন্য আমাকে কতই না মূল্য দিতে হয়েছে। কত বিনিদ্র রাত কেটেছে নিরব অশ্রুপাতে।                                                                           

এই দীর্ঘকালে কত প্রিয় মানুষকে হারিয়েছি। পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় তারা দেখতে পায়নি আমার মুখ, আমিও দেখতে পাইনি শেষ বিদায়ের ক্ষণের তাদের  অশ্রু সজল মুখখানি। শুনতে পইনি তাদের রক্তাক্ত আর্তনাদ। এদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা চরম মূল্য দিয়ে গেছেন। বাবা মা ভাই ছোট বোনকে হারিয়েছি।  তাদের মতো এই গ্রামের অনেক মানুষ শহীদ হয়েছেন। রোহিনীর মতো অনেক মা বোন তাদের অমূল্য সম্ভ্রমকে এদেশের স্বাধীনতার জন্য বিলিয়ে দিয়ে গেছে।   

আমি আগামীকাল সকালে চলে যাব। আবার কবে আসব, কিংবা আর আসা হবে কী না জানি না।  হয়ত আসব, হয়ত আসব না।  আমার মন এবং আত্মা বারবার আমাকে বলছিল -- 'তোমার কিছু দায় আছে, তোমার কিছু ঋণ আছে, তা তুমি শোধ করে যাও।'    

এই যে আজ এখানে উপস্থিত আছে আমার পরম বাল্যবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম, এখানে উপস্থিত আছে তরুণ দুটি প্রাণ মণিকা ও রঞ্জিত। ওদের দুজনের ভিতর আমি প্রত্যয় দেখেছি। ওদের দুজনকে আমি কিছু দায়িত্ব দিয়ে যাব। ওদেরকে উপদেষ্টা হিসাবে সহায়তা করবে আমার  বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম। ওদের দুজনের পাশে আরও থাকবে, ছায়া রাণী, নাসির উদ্দীন ও ছায়া রাণীর স্বামী সুবোধ দত্ত। 

যে কাজটি করতে হবে তাহলো -- মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত সকল বীরাঙ্গনাদের নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে । যে সমস্ত ধর্ষিতারা শহীদ হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন এবং যারা বেঁচে আছেন তাদের নাম । বাংলাদেশের প্রতি গামে গঞ্জে, শহরে, বিভিন্ন জনপদে হেঁটে হেঁটে, ঘুরে ঘুরে, খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে তাদেরকে।  অনেক বীরাঙ্গনা আছে যারা লজ্জায় তাদের আত্মত্যাগ ও পরিচয় গোপন করে রেখেছে। তাদেরও খুঁজে বের করেতে হবে এবং বলতে হবে তাদের -- দেশের জন্য  তোমরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছ এজন্য মোটেই তোমরা অসম্মানিত নও। ঘৃণিত নও।  তোমরা মহান, এবং মহিয়সী।  তোমাদের ত্যাগ আমরা কোনদিন ভুলব না।                           

কাজটি অনেক কঠিন এবং বিশাল। তোমরা একা এই কাজ শেষ করতে পারবে না। কিন্তু তোমরা শুরু করবে। এর আগে কিছু কাজ ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম, মালেকা বেগম, বেগম মুশতারী শফি, বাসন্তীগুহ ঠাকুরতা ও ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী'রা করে গেছেন।  তারা যেখানে শেষ করেছেন, তোমরা সেখান থেকে শুরু করবে। তোমরা শুরু করবে এই হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে। তারপর  ইউনিয়ন, থানা ও নিজ জেলায় প্রতিটি গ্রামে এবং লোকালয়ে যাবে । তোমাদের এই কর্মযজ্ঞ ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে।  


তোমাদের  না  বলেই আমি একটি ট্রাস্ট করে ফেলেছি। যার নাম দিয়েছি 'রোহিনী স্মৃতি কল্যাণ ট্রাস্ট'। তোমরা সবাই জানো, আমার এই আদরিনী ছোট বোনটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক আর্মির দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল এবং তাকে পরে গুলি করে নৃশংস ভাবে  হত্যা করেছিল।                   

রোহিত তার ব্যাগ থেকে  একটি ছোট্ট কাঁচের বক্স বের করে। বক্সের ভিতর রয়েছে  পুরানো জীর্ণ একটি বকুল ফুলের মালা । রোহিত বলে -- এটি একটি রাখী। এই রাখিটি আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে এক রাখীবন্ধনের দিনে রোহিনী আমার হাতে পরিয়ে দিয়েছিল। 

রোহিত কিছুক্ষণ নিরব থাকে। চশমার ফ্রেমের নীচে আঙুল ঢুকিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে উপস্থিত সবাইকে বিশেষ করে মণিকা, রঞ্জিত ও শহীদুলকে বলে -- 'আমি যে কাজের কথা বললাম, তা তোমরা করতে পারবে না? '    

সবাই আস্থার সাথে সমস্বরে বলে -- পারব।                                                                

তারপর রোহিত ব্যাগ থেকে একটি দলিল বের করে। দলিলটি সবাই কে দেখিয়ে বলে -- আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি 'রোহিনী স্মৃতি কল্যাণ ট্রাস্টে'র নামে দান করে দিয়েছি। যার তত্বাবধায়ক হচ্ছে দুজন -- মণিকা ও রঞ্জিত। এদের দুজনকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।' 

দলিলটি ছায়া রাণীর হাতে দিয়ে রোহিত বলে, এটি তোর কাছে পবিত্র আমানত হিসাবে জমা থাকল। তুই এই বাড়ি,  জায়গা জমিন সব দেখেশুনে রাখবি। তুই মণিকা ও রঞ্জিতকে মায়ের স্নেহ দিয়ে  আগলে রাখবি সারা জীবন।                               

রোহিত মণিকাকে বলে -- মা একটু কাছে আয়। রঞ্জিতকেও কাছে ডাকে। দুজনকে দুই বাহুতে জড়িয়ে নিয়ে বলে -- ' কী !  তোমরা আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না?' ওরা দুজনেই বলে --  জ্বী, পারব।              

মণিকা উপস্থিত সবাইকে আবার একটি গান গেয়ে শোনায় --                  

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।

আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই     দেবালয়ের প্রদীপ করো--

নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে। 

আঁধারের  গায়ে গায়ে পরশ তব,  সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।

নয়নের  দৃষ্টি হতে  ঘুচবে কালো, যেখানে           পড়বে সেথায়  দেখবে আলো--

ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে  ঊর্ধ্ব পানে।

  

গান শেষ হয়ে গেলে রোহিত সবাইকে বলে -- ছায়া রাণী চমৎকার সব রান্না করে রেখেছে। তোমরা সবাই খেয়ে যাবে।    



আজই রোহিতের এ বাড়িতে শেষ রাত্রি। সে তার বাবা মার খাটের উপর শুয়ে আছে।  ঘুম আসছে না চোখে। সে উঠে খাটের উপর কিছুক্ষণ বসে থাকে। ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। আনমনা হয়ে ঘরের ভিতর পায়চারী করতে থাকে। মায়ের কথা খুব  মনে পড়ছিল তার । 


রোহিত ভাবছিল -- মার কোনো অভিজ্ঞান বা কোনো স্মৃতি চিহ্ন কী এই ঘরে নেই? সে ঘরের এক কোণে বহু পুরানো একটি কাঠের তোরঙ্গ দেখতে পায়। তোরঙ্গটি অব্যাবহৃত ও অযত্নে পড়ে আছে। কাঠের ঢাকনার উপর ধূলো জমে গেছে। তালা লাগানো নেই। রোহিত বাক্সটা খুলে ফেলে। ভেতর থেকে উৎকট ভ্যাপসা গন্ধ বের হয়। তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে। বাক্সের ভিতর  দুটো লেপ, একটি কাঁথা, একটি লোহার সুপারির যাতি ও একটি পিতলের পানের ডাবর দেখতে পায়। লেপের কাপড় ছিঁড়ে ছিটে তুলা সব বের হয়ে গেছে। তেলাপোকা সেখানে বাসা বেঁধেছে। কাঁথাটা পুরনো হয়ে গেলেও মোটামুটি ঠিক আছে। রোহিতের মনে পড়ে -- মা কাঁথাটি তার পরনের কাপড় দিয়ে রাঙা সুঁতোর কাজ করে তাকে সেলাই করে  দিয়েছিল। রোহিত এই কাথাটি গায়ে দিত। কাঁথাটি তোরঙ্গ থেকে বের করে ঝেরে ভাজ করে তার ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে নেয়।  সে ভাবছিল -- মায়ের পরনের কাপড় দিয়ে তৈরি এই কাঁথাটি সে বাকী জীবন গায়ে দিয়ে ঘুমাবে।  মনে হবে তার -- মা তাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে রেখেছে। 

রোহিত দরজা খুলে বাইরে আসে। সে দেখতে পায়, সন্ধ্যা রাত্রির সেই অপূর্ব চাঁদটি একাকী মধ্য গগনে টুপটুপ করে জ্যোৎস্না ঝরিয়ে দিচ্ছে। ওর কান্না পায়। তার মায়ের কথা মনে পড়ে। অপূর্ব সুন্দর ঐ চাঁদটি যেন মায়ের প্রীতি আনন্দের বারতা দিচ্ছে। আশাময়ী, হাস্যময়ী মা যেন আশীর্ববাদ করছে --- "কাঁদে নাা বাপ,  তোমার জীবন সুন্দর হোক,  তোমার পথচলার পথের ধূলি মধুময় হোক। জগৎ সংসারে তুমি ভালো থেক বাপ।''  আকাশটা  যেন তার স্নেহে মমতায় জ্যোৎস্না হয়ে ঝরে পড়ছে  বিন্দুতে বিন্দুতে।  নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে…ঝিরি ঝিরি.. টুপ…টাপ।

                                                                           

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন