বুধবার, ১ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ৮

পিপুলবাড়িয়া বাজারে চা খেয়ে  দুপুরের মধ্যেই রোহিত ও শহীদুল বাড়ি  চলে আসে। শহীদুল  চলে যায় ওর বাড়িতে।  রোহিত শহীদুলকে বলে দেয়  -- তুই বিকালে একটু চলে আসিস।  তোকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। 

--- কোথায় যাবি?

--- তুই বিকালে আয়।, তোকে  কোথায় নিয়ে যাই।  তখনই জানতে পারবি।     

বাড়ির ভিতর রোহিত যখন ঢুকে তখন ঘরের ভিতর ছায়া রাণী ও জামাই বাবু কী নিয়ে যেন কথা-কাটাকাটি করছিল। রোহিত শুধু জামাই বাবুর এই কথাটি শুনতে পেল -- 'বেচে টেচে যখন সব টাকা পয়সা নিয়ে চলে যাবে, তখন তুমি বুঝতে পারবে।'                 

রোহিত ছায়া রাণীকে ডাকে -- ছায়া...। 

ছায়া রোহিতের কাছে এসে বলে --  জ্বী দাদা। 

--- নে, বাজারের ব্যাগটা ধর্।  পিপুলবাড়িয়া বাজারে যমুনার আইর মাছ পেলাম তাই কিনে নিয়ে এলাম। কতকাল ধরে যমুনার মাছ খাইনা। তুই ঠিক আমার মায়ের মতো করে রান্না করবি।  আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে,  আজ আমার মায়ের হাতের রান্না খাব।       

 বিকালে যথাসময়ে শহীদুল চলে আসে। শহীদুল রোহিতকে বলে এখনই বের হবি? 
-- হুম।  এখনই বের হবো,  চল। 

দুই বন্ধু বের হয়ে পড়ে।     

রোহিত শহীদুলকে সাথে নিয়ে  যে বাড়িটাতে যাচ্ছে, সে বাড়ির পথ তার চির চেনা। কিছু পথ আছে, হাজার বছর পরেও  চলতে যেয়ে  অচেনা মনে হয় না। কিছু নদী আছে যে নদীর আঁখি কোণের জল ফুড়ায় না,  কিছু আকাশ আছে, যে চির নীলাম্বরী শাড়ি পড়ে থাকে চিরকাল। যেন 'বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল—
সকলই আমার মতো।'

অপরাহ্ণের  পাখিগুলো সুপারি বাগানের ঝাড়ে বসে ডাকছিল। পাখিদের ভিতরও সব পাখির ডাক একই রকম হয় না। কারোর ডাকের ভিতর আনন্দ উৎসব করার নিমন্ত্রণ থাকে,  কারোর ডাকে  শোনা যায় বেদনা নিঃসৃত কান্নার ধ্বনি। ওদের ভিতরও আছে  সুখ দুঃখের অনুভূতি। কারোর ভিতর যদি মন খারাপ থাকে, সেদিন তার সুরের  মাধুর্য প্রাণের মধ্যে কোনো সাড়া দেয় না। সুরের স্তরে স্তরে মন কেমন উদাস হয়ে ওঠে। মনে হয় জীবনটা কেবল কতকগুলো বিষাদের গানের সুরের সমষ্টি। 

পরন্ত বিকালে মানুষ তার জীবনের  ক্লান্তির ছায়া নামতে দেখে। আত্মার স্পন্দন ক্ষীণ ভাবে অনুভব করে।  যা কিছু ভালোলাগা তা ঐ পশ্চিম আকাশের লাল আভাটুকু।  রোহিত হাঁটছিল আর ভাবছিল -- 'কী এক অসীম ক্ষরণ হৃদয়ে,  রক্তান্ত  আত্মার সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রাপ্তির এই চাওয়াটুকু চাইতে ইচ্ছে করে, 'পর জনমে শুক্লা যামিনীতে যদি তুমি আস, দেখতে পাই যেন  তোমাকে  ঠিক চির কল্যাণময়ী রূপে।'

দূরে কোথায় যেন হাস্নাহেনা ফুটে আছে। অনাঘ্রাত সুবাস মিশে আছে আজকের এই অপরাহ্ণের ঝলমলে রোদ্র  ছায়ায়। পথ আর চলতে পারিনা যে! 'ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো।'


রোহিত ও শহীদুল একসময় চলে আসে সেই বাড়িটিতে।  সুন্দর ছোট্ট একটি পুকুর। পিছনে পশ্চিম পাশে বাঁশবন, আমগাছ গুলো বহু আগের। ফলের গাছগুলো যেন প্রাচীন অরণ্যে পরিণত হয়েছে। খুব নির্জন বাড়ি। এই বাড়িতে এখন কে থাকে? 

শহীদুল বিস্ময়ে রোহিতকে জিজ্ঞাসা করে। -তুই এই বাড়িতে আমাকে নিয়ে আসলি? এটা তো হাসান মাস্টারের বাড়ি। এই বাড়িতে ওনার কেউ থাকে না।  একজন পুরানো ভৃত্য বাড়িটি দেখাশোনা  করে।'

রোহিত শহীদুলকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। বাড়ির আগের ঘরগুলো এখনো রয়ে গেছে। সেই বারান্দার কোণ্ এখনো আছে। শুধু চেয়ার টেবিলগুলো ওখানে নেই, যে কোণে বসে রোহিত রেবেকাকে পড়াত। স্মৃতির অমল কাঁটায় ক্ষরণ হচ্ছিল তার হৃদয়ে --    

তেতত্রিশ বছর আগের! কী আশ্চর্য মধুময় স্মৃতি চোখে দেখতে পাচ্ছিল রোহিত। টেবিলে বসে আছে সে। বিস্ময়ে দেখছিল রেবেকাকে। একটি ডোরাকাটা কামিজ পরে আছে। ওড়না পিছনের ঘার থেকে দুই দিক দিয়ে ঘুরিয়ে সামনে এনে রেখেছে। ওর একটি হাত খাতার উপর, আর একটি হাত রোহিতের হাত ধরে রেখেছে। রোহিত দ্বিধা করছিল ছাড়িয়ে দেবার। কিন্তু পারছিল না, বারবার চেষ্টা করেছে, তাও পারে নাই।  রেবেকার অতি প্রত্যয়ের মুখ দেখে মনে হয়েছিল -- 'ন্যায় অন্যায় জানিনে শুধু তোমাকে জানি।'  শুধু তোমাকে চাই প্রথমত। তোমাকে চাই জীবনের শেষ পর্যন্ত।         

ভৃত্য মতি কাছে এগিয়ে আসে। রোহিত মতিকে চিনতে পারে।  মতি তখন ছোট ছিল।  একদম বালক।  এই বাড়ির ফয়ফরমাস করত।  রোহিত মতিকে বলে -- 'তুমি কেমন আছো মতি?' মতি রোহিতের  মুখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। চিনতে পারেনা।   

-- আমাকে চিনতে পারছো না মতি?  আমি তোমার রোহিত দা। 

মতি রোহিতের হাত চেপে ধরে বলে -- ' এত বছর পর আপনি এলেন রোহিত দা? মনে করেছিলাম -- আপনি আর কোনোদিন ফির আসবেন না।' চলেন ঘরের  ভিতর যেয়ে বসেন।' 

-- না, আমরা বসব না।  চলে যাব এখনই।  আচ্ছা মতি, তোমার রেবেকা বুবুকে কোথায় কবর দিয়েছে, জানো?'

-- আপনি আসেন আমার সাথে।  দেখাচ্ছি। 

বাড়ির পূর্বপার্শ্বে একটি পারিবারিক কবরস্থান। ওখানে বেশ কয়টি কবর আছে। তাদের ভিতরই রেবেকার কবর।  কবরটি বাঁধানো।  শ্বেত পাথরের একটি প্লেটে লেখা আছে  --
মোছাঃ রেবেকা বেগম। 
মৃত্যু -- ২৭ আষাঢ়, ১৩৭৪ বাংলা।  

সৌম্য নিস্তব্ধ সমাধি স্থল। প্রত্যহ রাত্রির  আকাশ থেকে চন্দ্র কিরণ ঝরে পড়ে দূর্বা ঘাসের উপর। অজস্র তারার আলোর নীচে দূর্বাদলের উপর সুঘ্রাণ ছড়ায় বন্যমালতী।  শ্রাবণ মেঘ থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে  ভিজে থাকে মাটি। সন্ধ্যায় সোনালি আভায় হাস্নাহেনার গন্ধে আকুল হয়ে ওঠে প্রাঙ্গন। রোহিত মৃত্তিকার নীচ থেকে রেবেকার হৃদয়ের স্পন্দন ধ্বনি শুনতে পায় । ক্ষণতরে ক্ষরিত হয় বহু আগের প্রণয়সুধাসার।          
                         
রোহিত শহীদুলকে বলে -- 'তুই রেবেকার কবরটা জিয়ারত করে ওর আত্মার শান্তি কামনা করে   একটু মোনাজাত কর্।'

শহীদুল কবরটি জিয়ারত শেষে মোনাজাত করে। সেই মোনাজাতে রোহিতও হাত উঠায়ে প্রার্থনায় রত ছিল।           
      
বাড়ির ভিতর এসে মতি রোহিতকে বলে -- এই বংশে রেবেকা বুবুর একটি মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। ওনার মেয়েটি স্বামীর সাথে শহরে থাকে। নাম মণিকা।  শহরের আমলা পাড়াতে থাকে।  ওর স্বামীর নাম -- নাসির উদ্দীন উকিল।                 
           
মতি আরো বলছিল -- জানেন রোহিত দা, আমার মনে আছে, যেদিন রেবেকা বুবুর বিয়ে হয়, সেদিন সে খুব কেঁদেছিল। বিয়ের পর থেকেই রেবেকা বুবু কেমন অসুখে পড়ে যায়। খেতে পারত না কোনো কিছু।  দিনে দিনে একদম রোগা হয়ে যায়।  এর মাঝেই তার গর্ভে সন্তান আসে।  প্রসবের সময় সে মারা যায়। সন্তানটি বেঁচে থাকে।  আর সেই সন্তানই হচ্ছে  মণিকা।   

রোহিত মতিকে বলে -- ঠিক আছে মতি।  তুমি থাকো। আমরা যাই।  পারলে একবার আমাদের বাড়িতে  এস। আমি দুই তিনদিন আছি। 

মতি বলে -- একটা জিনিস আছে।  আপনি একটু দাঁড়ান, আমি ভিতর থেকে নিয়ে আসছি। 

মতি ঘরের ভিতর চলে যায়। একটু পর পুরনো খবরের কাগজে মোড়ানো একটি বই এনে রোহিতের হাতে দিয়ে বলে -- রেবেকা বুবু মৃত্যুর কয়দিন আগে এই বইটি আমাকে দিয়ে বলেছিল -- 'যদি কোনোদিন তোর রোহিত দাদা ফিরে আসে তখন এই বইটি তাকে দিয়ে দিবি। অন্য কাউকে বলবি না এই বইটির কথা। '   

রোহিত মোড়ানো কাগজ খুলে দেখে, এটি নবম শ্রেণির একটি অংকের বই। বইটি সে সিরাজগঞ্জ থেকে কিনে এনে রেবেকাকে দিয়েছিল। রেবেকা বইটির দাম দিতে চেয়েছিল কিন্তু রোহিত তার কাছ থেকে মুলা গ্রহণ করেনি। 

বইটি জীর্ণ পুরনো হয়ে হলুদ রঙ হয়ে গেছে। সে বইটির পাতা উল্টায়ে দেখতে পায় , প্রথম সাদা পাতায় রেবেকার নিজ হাতে এই চরণগুলি লেখা --

জীবন যখন শুকায়ে যায় 

করুণাধারায় এসো।

সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, 

গীতসুধারসে এসো।

কর্ম যখন প্রবল-আকার

গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার,

হৃদয়প্রান্তে হে জীবননাথ, 

শান্তচরণে এসো।

আর কিছু লেখা নেই। নাম তারিখ বা অন্য কোনো কথা।                                                                    

এক মনখারাপের অসীম  বেদনা নিয়ে রোহিত বাড়ি চলে আসে।  আসতে আসতে পথে যেন এক বিরহিণীর অযত্ন বিন্যস্ত মেঘবরণ চুল এলিয়ে দেওয়ার মতো সন্ধ্যা নামতে থাকে। প্রিয়াহীন প্রাণের নিবিড়  দূর বনে ডাকছিল কাকাতুয়া। চোখ  অশ্রু সজল হয়ে উঠে। তার নিসৃত অশ্রুধারা পথসঙ্গী শহীদুল দেখতে পেল না।   

'দীর্ঘদিন আমি এমন প্রবাসী হয়ে আছি।
বড়ো দীর্ঘদিন, দীর্ঘবেলা।
জলের ভিতরে ক্রমে জমে-ওঠা শ্যাওলার সবুজ,
হাওয়া ভারী হয়ে আসে, স্রোত
থেমে যায়, ক্রমে
কুসুমের বুক থেকে ঝরে পড়ে নিহিত কুসুম।
দীর্ঘদিন বিজনে একেলা।'

কবিতা -- প্রণব মুখোপাধ্যায়।

রোহিত যখন ফিরে আসছিল -- তখন কার্তিক হাওয়ায় রাস্তার দুপাশের বৃক্ষরাজী থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছিল। বট, অশোক, কৃষ্ণচূড়া,র পাতা বাতাসে ঝিলমিল করে উড়ছে। একজন পাগলিনী এলমেল ভূষণে ছুটে চলে যাচ্ছিল কোথাও । সেই পাগলিনী একবারও কারোর দিকে  না তাকিয়ে বলে যাছিল -- 
'সুখ নেইকো মনে, সুখ নেই। নাকফুলটি হারিয়ে গেছে বেতসীর বনে।'                                     

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন