টেন্ডু পাতার বিড়ি
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। কালের বিবর্তনে ধূমপানের ব্রান্ডটিও আমার পরিবর্তন হয়েছে। তিস্তা, মিতালি, কিং স্ট্রং থেকে স্টার, ক্যাপস্টেন। গোল্ডলিফও খেতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ষেদিন বাবার পাঠানো মানি অর্ডার পেতাম, সেদিন মনের আনন্দে লন্ডন ব্রান্ড 555 কিনে খেতাম দুই এক শলা।
সহপাঠি বন্ধু ইকবাল হোসেন বাদল মাঝে মাঝে যখন হলে আমার রুমে এসে থাকত, তখন ঐ কদিন রেগুলার লন্ডন 555 খেতাম। বাদল ছিল ঢাকার স্থানীয় বড়োলোকের পোলা। গোড়ানের চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে। ও খেত 555, বাদল যে কয়দিন থাকত, সে কয়দিন আমার আর সিগারেট কিনতে হতো না। ঐ-ই কিনত। আমি খেতাম মাংনা।
আমেরিকাতে ছিলাম মাস তিনেক। ওখানে খেতাম মার্লবরো হার্ড। লাসভেগাস থেকে এসেছিল কোভা নামে একটি মেয়ে। কোভা আমার খুব ভালো বন্ধু হয়েছিল, ও খেত মার্লবরো লাইট। ওর কারণে ব্রান্ড বদল করে মার্লবরো লাইট ধরেছিলাম। হলিউডে সিনে মেকআপ আর্টিস্ট্রির উপর একটি ওয়ার্কশোপে আমরা যোগ দিয়েছিলাম। ওয়ার্কশপ শেষে উইলটার্ন বিল্ডিংয়ের সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসে স্মোকিং জোনে আমি আর কোভা সিগারেট ধরিয়ে টানতাম।
একদিন বিকালে কোভা বলছিল -- হাবিব, চলো সান্তা মনিকা বীচে যাই। বললাম -- কেন?
আজ আমার মন ভালো লাগছেনা।
আচ্ছা, চলো যাই।
বীচে দুজন বালু আর ছোটো ছোটো ঝিনুকের উপর পা মাড়িয়ে হাঁটছিলাম। কোভা খুব বেশি কথা বলছিল না। প্যাসিফিকের জল ছিল সেদিন শান্ত। ওর চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, চোখ দুটো সমুদ্রের নীল জলের মতো স্থির ও শান্ত হয়ে আছে। আমি ওকে বলি -- 'কী হয়েছে তোমার? মন খারাপ করে আছ কেন?'
ও ওর ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করে একটি সিগারেট ধরায়। আমাকেও বলে -- 'খাবে নাকি একটা?' দেখলাম -- আজকের সিগারেট মার্লবরো লাইট নয়। অন্য আর একটি ব্রান্ডের সিগারেট। আমি একটি স্টিক নিয়ে ধরালাম এবং টানতে থাকি। সিগারেটটি টান দেওয়ার পর আমার শরীর আস্তে আস্তে কেমন যেন হিম শীতল হয়ে আসছিল। আমার ইন্দ্রিয়ে অদ্ভুত এক সুখানুভূতি অনুভূত হচ্ছিল।
মানুষ কত ভাবে দুঃখ সরিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সুখ খোঁজে কত কিছুর ভিতর। সেদিন সেই অস্ত-সন্ধ্যা বেলায় কোভা কী ওর দুঃখ সরিয়ে দিতে পেরেছিল সিগারেটে ! সে কথা আর ওর কাছে থেকে জানা হয়নি। শুধু মনে হয়েছিল -- ' আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন-- আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন।'
তো, যে কথা বলছিলাম -- বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার প্রায় পনেরো বছর পরের কথা। কয়দিন ধরেই সেই স্কুলবেলার টেন্ডু পাতার বিড়ি খাওয়ার কথা খুব মনে পড়ছিল। খেতেও ইচ্ছে করছিল ভীষণ। ঢাকায় এই বিড়িটি কোথাও পাওয়া যায় না। কী করা যায় ! একদিন আমার সেই বাল্য সহপাঠি বন্ধু সাইফুলকে পত্র লিখলাম--'সাইফুল, আমার খুব টেন্ডু পাতার বিড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। এখানে পাচ্ছি না। তুই টেন্ডু পাতার বিড়ি যোগার করে রাখবি। আমি খুব শীঘ্রই আসছি। একসাথে দুজনে বিড়ি টানব। '
কয়েক দিন পর আমি বাড়িতে যাই। সাইফুলের সাথে আমার দেখা হয় না সে অনেক বছর। আমি একদিন দ্বিপ্রহরেের আগেই দুই মাইল দূরে আমিনপুর গ্রামে সাইফুলদের বাড়িতে সাইকেল চালিয়ে চলে যাই। সাইফুল আমাকে দেখে তো বেজায় খুশি। সেই কত বছর পরে দেখা। ও ম্যাট্রিক পাস করার পর অভাব অনটনের কারণে আর পড়ে নাই। জমি জমা যা আছে, তাই দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে।
ওর থাকার ঘরে বিছানার উপর আমাকে বসতে দেয়। একটু পর ওর স্ত্রীকে অনেকটা জোর করে টেনে আমার সামনে নিয়ে আসে। ওর স্ত্রীকে বলে-- 'এতদিন তো হাজারো বার আমার এই বন্ধুটির কথা তোমাকে বলেছি । আজ ওকে দেখো চক্ষু মেলিয়া।'
একটুপর সাইফুল এগারো বারো বছরের একটি বালিকাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। বলে -- 'এই হচ্ছে আমার মেয়ে মরিয়ম। ক্লাস সিক্সে পড়ে। খুব ভালো ছাত্রী। রোল নং ২, সাইফুল ওর মেয়েকে বলে -- ইনি আমার বাল্য বন্ধু। তোমার চাচা হয়। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করো।'
মরিয়ম আদুরী আদুরী খুব লক্ষ্মী মেয়ে। দেখতেও খুব মায়াবী এবং রূপন্বিতা। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি-- তুমি বেঁচে থাকো মা, ভালো ভাবে লেখা পড়া করবে। ' সাইফুলের স্ত্রী ও মেয়ে অন্য ঘরে চলে গেলে আমি সাইফুলকে বললাম -- 'বিড়ি কই, বিড়ি দে।' সাইফুল এক বান্ডিল টেন্ডু পাতার বিড়ি কই থেকে যেন যোগার করে এনেছে। আমাকে বিড়ির বান্ডিল দিয়ে বলে -- 'নে, বসে বসে খা।' এখানে এই বিড়ি পাওয়া যায় না। হিলি বর্ডার থেকে আনিয়েছি। যে কয়টা পারিস খা। বাকীগুলো নিয়ে যাবি।'
সেই কতকাল পরে দুই বন্ধু বসে বসে মনের সুখে বিড়ি টানলাম। কী যে ভালো লাগছিল, কী যে ঘ্রাণ ছিল বিড়ির। সেই কত বছর আগের রথ ঘরে বসে বিড়ি খাওয়ার কথা মনে পড়ছিল। সেই অনাবিল ঘ্রাণ, সেই স্বর্গীয় আনন্দ।
দুপুরে সাইফুল না খেয়ে আসতে দেয়নি। ওর বউ ধনিদহ বিলের বোয়াল মাছ, আর ওদের নিজেদের পালন করা হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ায়ে দিয়েছিল। দারুণ সুস্বাদু ছিল ওর বউয়ের রান্না।
ভাত খেয়ে বিছানার উপর বসে আবারও দুজন বিড়ি ধরাই। দুইজনই বিড়ি টানতে থাকি। সাইফুল বিষাদ জড়িত কণ্ঠে বলছিল -- 'তোকে একটা কথা বলা হয় নাই। '
আমি বললাম -- কী কথা, বল্ ?
-- মরিয়মের খুব অসুখ।
--- কী অসুখ!
--- আজ দশ পনেরো দিন ধরে ভিতরে ভিতরে খুব জ্বর। ভালো হচ্ছে না।
--- শহরে নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবি।
--- আচ্ছা।
আমি ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, কোনো করুণা কিংবা দয়া না। তোর মেয়ে আমারও মেয়ে। টাকাগুলো রাখ্। মরিয়মের চিকিৎসা করাবি। ' আমি ওকে আরও বললাম -- আল্লাহ খারাপ কিছু না করুক --যদি মনে করিস ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। তাহলে চলে আসিস আমার বাসায়।
আমি যখন চলে আসি, মরিয়ম কাছে এসে বলেছিল --
চাচু, তুমি আবার এস।
আমি ঢাকায় চলে আসি। এরপর আরও কয়েকমাস চলে যায়। বিভিন্ন কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে যাই। সাইফুলের মেয়েটার আর খোঁজ নেওয়া হয় নাই। অনেকটা 'পৃথিবীতে কে কাহার?' এর মতো উপেক্ষা , এবং ভুলে থাকা ।
তারও অনেক পরে -- একদিন জানতে পারি যে, সাইফুলের মেয়েটার নাকি লিউকেমিয়া হয়েছিল এবং সে মারা গেছে।
২৯ জুন, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন