মান ভঙ্গ
বেশ কিছুদিন ধরে মেহনাজের সাথে আমার ঘন ঘন ঝগড়াঝাটি ও খুনসুটি হচ্ছে। নানান কারণে নানারূপ ঝগড়া । মাঝে মাঝে ঝগড়া তুমুল আকার ধারণ করে। প্রায়ই মেহনাজ আমাকে বলে -- 'তুমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও। তোমার মতো স্বামীর আমার দরকার নাই।'
একদিন খুব তুমুল ঝগড়া হয় মেহনাজের সাথে আমার। সেদিনও মেহনাজ রাগে গর্জনে আমাকে বাড়ি হতে বের হয়ে যেতে বলে। আরও বলে -- 'তোমার মুখ আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। আই হেট্ ইউ।'
সেদিন সত্যি সত্যি বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। পকেটে তেমন কোনো টাকা ছিল না । বিভিন্ন সোর্স থেকে যে টাকা আয় হয়, তা মেহনাজই খরচ করে। আমার কোনো অধিকার নেই তাতে। আসলে আমার কাছে কোনো অধিকার রাখিনি। আমি চাইতাম -- এই টানাটানির সংসারে মেহনাজই সব সামলাক। এ আমার কান্ডজ্ঞানহীন দায়িত্বহীনতাও বলা যেতে পারে।
বাজার করে এনে দেওয়ার পর কিছু খুচরো টাকা বাচতো, সেগুলো রেখে দিতাম বিছানার নিচে। গুণে দেখি -- সেখানে ৪৫৩ টাকা আছে । তখন সকাল এগারোটা বাজে। এই কটা টাকা নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। মোবাইল ফোনটা সাথে নেই না। রেখে যাই বাড়িতে।
আমার একটি প্রিয় জায়গা বিমানবন্দর রেল স্টেশন। হাঁটতে হাঁটতে সেখানেই চলে যাই। প্লাটফর্মেের উত্তর মাথায় নিরিবিলি একটি পাকা কংক্রিটের বেঞ্চের উপর যেয়ে বসে থাকি।
আমার কাছে পান বিড়িওয়ালা একটা ছেরা আসে। ওকে বললাম, সিগারেট দে।
-- কোন্ সিগারেট দিব স্যার?
আজ থেকে তিন বছর আগে চিরজনমের জন্য সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছাড়ার আগে তখন খেতাম বেনসন। আজ আবার শুরু করছি নতুন করে। বিড়িওয়ালা ছেরাকে বললাম -- বেনসন এ্যান্ড হেজেস দে। ঐ ছেরা আমাকে তাই দিল।
কংক্রিটের বেঞ্চের উপর বসে পরপর দুই শলা সিগারেট মনের সুখে খেলাম।
প্লাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে আরও একটু উত্তর দিকে যাই। ওখানে দেখি -- একলোক পথের উপর কাপড় পেতে অনেকগুলো ইনভিলপ সারি করে বিছিয়ে রেখেছে। তার হাতের উপর একটি পোষা টিয়া পাখি বসে আছে। কাগজের সাইনবোর্ডে লেখা-- "এখানে ভাগ্যলেখা দেখা হয়।" আমি লোকটিকে বললাম -- 'ভাগ্য লেখা দেখতে কত টাকা লাগবে?'
--- দশ টাকা স্যার।
আমি লোকটিকে দশ টাকা দিয়ে বললাম -- ভাগ্য লেখা দেখান।
লোকটি টিয়া পাখিকে বলল -- 'এই সাহেবের ভাগ্যে কী লেখা আছে? উঠাও।'
টিয়া পাখি ঘুরে ঘুরে একটি ইনভিলপ ঠোঁট দিয়ে উঠিয়ে লোকটির হাতে দিল। সে দিল আমার হাতে। আমি ইনভিলপটি হাতে নিয়ে ভিতর থেকে কাগজটি বের করে পড়লাম। কাগজটিতে লেখা আছে -- 'স্বামী--স্ত্রী / প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে আজ মহব্বত বাড়বে।'
হেঁটে হেঁটে আবার কংক্রিটের বেঞ্চের উপর এসে বসি। প্লাটফর্মের ওপাশে ডোবার মতো পুকুর। পুকুর পাড়ে দুটো শালিক আজাইরা ঠোকরাঠুকরি করছে। প্রেমে গদগদ হলে এমন নাকি লাফালাফি করে। খুব বিরক্ত লাগছিল, এর নাম নাকি 'টু ফর জয়।' মনে মনে বললাম -- 'ঘোড়ার ডিম। এই বুঝি আমার আনন্দ !'
কমলাপুরের দিক থেকে একটি লোকাল ট্টেন প্লাটফর্মে এসে থামে। যাবে ময়মনসিংহ। আমি ঐ ট্রেনটিতে উঠে পড়লাম। তৃতীয় ক্লাসে টিকিট বিহীন যাত্রী আমি। ট্রেনটা ষখন জয়দেবপুর ছেড়েছে, তখন এক ছোকরা বয়সের চেকার এসে বলে -- 'টি-কে-ট।'
বললাম -- নেই।
-- কোথায় যাবেন?
-- যেতে চেয়েছিলাম মশাখালি, গফরগাঁও। তা আর যাব না। সামনে রাজেন্দ্রপুর নেমে যাব।
-- জরিমানা সহ একশত টাকা দিন।
আমি ছোকরাকে একশত টাকা গুণে দিয়ে পাকা রশিদ নিয়ে নিলাম।
রাজেন্দ্রপুর স্টেশনে নেমে পড়ি। পেটে তখন সাঙ্গাতিক খিদা। একটা টিনের চালার হোটেলে ঢুকে পড়ি। মালিককে বললাম -- তরকারি কী?
মালিক বলল -- ফার্মের মুরগী, পাকিস্তানি কক, দেশি মোরগ, আর কালিয়াকৈরের বিলের বাইলা মাছ।
আমি বললাম -- দেশী মোরগ আর বাইলা মাছ দিবেন।
মালিক তার মেছিয়ারকে বলল -- ঐ বেটা, প্লেট ভালো করে ধুইয়ে এই স্যারের জন্য বাইলা মাছ আর দেশি মুরগী লাগা।
হোটেলে খেয়ে বাইরে এসে একটি টং দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে আবারও বেনসন সিগারেট খেলাম পরপর দুই শলা। দ্বিতীয় শলা যখন টানছিলাম তখন হঠাৎ মনে পড়ল --
আজ থেকে সাতাশ বছর আগে মেহনাজকে নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে এই শালবনে বেড়াতে এসেছিলাম। তখন সবেমাত্র বিয়ে করেছি। বউকে নিয়ে শালবন দেখার খুব সাধ হয়েছিল। একদিন ছুটির দিনে লোকাল ট্রেনে করে টংগী স্টেশন থেকে এই রাজেন্দ্রপুর চলে আসি। এখানে স্টেশনে নেমে একটি চা'র দোকানে বসে দু'জন চা খাই। সাথে দুটো করে ডালপুরি ও গরম সিঙারাও খেয়েছিলাম।
স্টেশনটা আস্তে আস্তে এক সময় ফাঁকা হয়ে যায়। আমরা বসেই থাকি। দেখি -- একটা লোক একটা বানর নিয়ে এগিয়ে আসছে। সে বানরের নাচের খেলা দেখায়। লোকটাকে দশ টাকা দিয়ে বানরের নাচ দেখি। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা শালবনের দিকে চলে যাই।
মেহনাজের পরনে ছিল হলুদ রঙের জর্জেট শাড়ি। পায়ে ছিল লাল রঙ্গের বাটার জুতা আর চুল ছিল সবুজ ভেলভেটের ফিতা দিয়ে খোপা বা্ঁধা। দেখতে একদম রূপবানের মতো রূপবতি লাগছিল। আমরা শালবনের অনেক ভিতরে চলে যাই। কা্ঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। ভাবছিলাম, ওর একটা হাত ধরি। কিন্তু লজ্জা লাগছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে। আরো কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি, একটি জলার মতো পুকুর। পুকুরের চারপাশে শালবনে ঘেরা। পাড়ে দূর্বা ঘাসের উপর দু'জন বসে পড়ি।
একটু পর দেখি, একটি বালিকা বকুল ফুলের মালা নিয়ে এগিয়ে আসছে। মেহনাজকে বলে -- 'আফা, একটা মালা নিবেন।' আমি বালিকার কাছ থেকে চারটি মালা কিনে ওর খোঁপায় পরিয়ে দিয়েছিলাম।
তারও কিছু সময় পর একটি বৃদ্ধ লোক ময়ুরের পেখম এনে ওকে বলে -- মা, ময়ুরের ফইরা নিবেন।' আমি বৃদ্ধের কাছ থেকে সবগুলো পেখম কিনে নতুন বউকে দিয়ে বলেছিলাম, বাড়িতে যেয়ে আমার জন্য একটা ময়ুরপঙ্খী পাখা বানাইয়া দিও।
বালিকা ও লোকটি চলে যায়। পুকুরের পাড় তখন নির্জন। বক, ডা্হুক, হা্ঁস,পানকৌড়িরা তখন কিচিরমিচির করছিল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, জনমানব শূণ্য। আমি ওর মুখের দিকে একবার তাকাই। নির্জন দুপুরের রোদ্দুর ওর মুখে এসে পড়েছিল। খুব মোহনীয় লাগছিল ওকে। ভাবলাম- একটু কাছে টানি। আদর দেই ঐ মুখে। ওর মুখের দিকে ঝুঁকতেই কোত্থেকে একটি তীর এসে ওর শরীরে বিদ্ধ হয়। রক্তাক্ত হয় ওর শরীর, রক্তে ভিজে যায় ওর শাড়ি।
আর আহত হয় পানকৌড়ি। পানকৌড়ির রক্তাক্ত পালক পড়ে থাকে পুকুরের পাড়ে।
মনটা ভালো লাগছিল না। ভাবছিলাম কী করব, কোথায় যাব? একবার মনে হলো -- হেঁটে হেঁটে পুকুর পাড়ে চলে যাই, যেয়ে বসি পাড়ের ঘাসের উপর। যেখানে আজ থেকে সাতাশ বছর আগে আমরা দুজন বসেছিলাম। সেই ঘাস হয়ত নেই, নেই আমাদের স্পর্শ কোথাও । তবু যেতে ইচ্ছে করছে। কেউ না থাকুক, শালবনের নিবিড় ছায়া তো সেখানে আছে। সেই ছায়ায় মিশে আছে কারোর ছায়াহীন মায়া।
একা একা যেতে আর ইচ্ছা করল না। বসে থাকি বেঞ্চের উপরই। বসে বসে আরও এক কাপ চা ও দুটো সিগারেট খাই। হঠাৎ অদূরে তাকিয়ে দেখি -- স্টেশনের সবুজ সিগনাল বাতিটা জ্বলে উঠেছে। ঢাকামুখি একটি ট্রেন এসে স্টেশনে থামে। আমি টিকেট কেটে ট্রেনটাতে উঠে পড়ি, এবং ঢাকায় চলে আসি।
বিমানবন্দর স্টেশনে যখন আসি তখন বিকাল হয়ে যায়। প্লাটফর্মের উপর নেমে পায়চারি করতে থাকি। ভাবছিলাম এখন কোথায় যাব? আমার তো ঘর নেই। আমার কেউ নেই। যে একজন আছে, সে আমাকে ঘৃণা করে। আমাকে দেখতে পারে না।
স্টেশনের নির্জন পুকুর পাড়ের কাছে যেয়ে একটু দাঁড়াই। ছোট ছোট কচুরীপানার ফাঁকে মৃদুমন্দ ঢেউ ভাঙছিল। বিকালের বিষণ্ণ রোদ জলের উপর পড়ে ঝলমল করছিল।
সামনের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখি, সমান্তরাল রেল পথ। জীবনের অনেক কিছুই জলের ঐ রৌদ্র দীপ্ত ঢেউয়ের মতো ঝিলমিল করে, আবার ঐ পথের মতো সমান্তরাল। একটি অপরিচিত ট্রেনে উঠে দূরে কোনো অচিনপুরে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
স্টেশনের বাইরে এসে একটি অটো রিকশা নিয়ে চলে যাই শিয়ালডাঙ্গা। দুধারে কাশবনের ফাঁকে নির্জন পথের উপর নেমে রিকশা ছেড়ে দেই। জলাশয়ের কাছে বাবলা গাছটার তলে যেয়ে বসি। মন খারাপ হলে কত বিকাল, কত সন্ধ্যায় আমি আর মেহনাজ এসে বসে থাকতাম এই বাবলা গাছের নীচে । পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্তমিত হতে দেখেছি কত দুজন, কত লাল আভার আবেশে ভরে উঠেছে আমাদের মন।
মেহনাজ আমার বুকের ছায়ায় মাথা লুকিয়ে বলত, 'এই জীবনে তোমাকে আমি পেয়েছি, তাই কোনো দৌলত খুঁজি না কোথাও। আমি অন্য কিছু চাই না আর।'
দুই হাঁটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে একটা অনুযোগই শুধু করছিলাম -- ' সেই তুমি কত বদলে গেছ !'
হাঠাৎ পিঠের উপর কার যেন কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করি। মুখ তুলে দেখি -- মেহনাজ। ও বলছিল -- ' আমি জানতাম, তোমার মন খারাপের দিনে তুমি এখানেই থাকবে। তাই এখানেই চলে এলাম তোমাকে খুঁজতে।'
সায়াহ্নের সেই সন্ধ্যায় অস্ত সূর্যের উদ্ভাসিত আলোয় চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম তার আনত মায়াবী মুখখানি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন