রোহিত তার জীবনের এতগুলো বছর পৃথিবীর পথে পথে ঘুরেছে। একদেশ থেকে অন্য আর এক দেশে গিয়েছে। কোথাও সে স্থায়ী ভাবে থিতু হতে পারেনি। তার জীবন ছিল যাযাবরের মতো। ভলগা থেকে দানিয়ুব, আটলান্টিকের বালুকাবেলা থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের নির্জন পাড়ে, মস্কো থেকে মাদ্রিদ, সান্টিয়াগো থেকে টরেন্টো, আল্পস পর্বতমালা থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাত -- কত শহর, কত বন্দর সে গিয়েছ। কখনও মেট্রোতে, কখনও ট্রেনে, জাহাজের ডেকে, স্টেশনে স্টেশনে, মসজিদ-মন্দির- গীর্জায় ও বিভিন্ন ধর্মশালায় সে রাত কাটিয়েছে। কত যে স্থানে সে ঘুরেছে ফিরেছে থেকেছে। তার ইয়াত্তা নেই। সারা পৃথিবীই যেন ছিল তার নিজের ঘর। যেন 'মোরা একই যাত্রী এক তরণীর'।
আজ এত বছর পর এদেশের মাটিতে পা দিয়ে মনে হলো রোহিতের -- এই দেশ এই মাটি যে তারই। কত যে আপন লাগছে। এই যে মাথার উপর নীল আকাশ, এই রোদ্দুর, মেঘের শীতল ছায়া, বাতাসের গন্ধ, সবই আগের মতোই তার চিত্তকে দোলা দিচ্ছে। রোহিত প্রাণ ভরে উপভোগ করছে -- 'আমারও দেশেরও মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন।'
এয়ারপোর্টের কনকোর্স হল দিয়ে হেঁটে রাজপথের উপর এসে দাঁড়ায় সে। হঠাৎ ধূসর লাগছিল এই শহর। তার মনে পড়ছিল -- আজ থেকে তেতত্রিশ বছর আগের তেজগাঁও বিমানবন্দরের কথা। সেদিন একটি পিআইএর বিমানে করে লন্ডন যাত্রা করেছিল সে। কেউ আসেনি সেদিন এয়ারপোর্টে। কোনো আপন মানুষ বিমান বন্দরে তাকে বিদায়ী অভিবাদন জানায়নি। কাঁদতে কাঁদতে সেদিন এই দেশ ছেড়ে সে চলে গিয়েছিল।
কোথায় যাবে সে প্রথম? কোথাও কেউ তো তার জন্য অপেক্ষায় নেই। আবার ভাবছিল -- হয়ত কেউ তার জন্য অপেক্ষায় থাকতে পারে। জীবনের পয়ত্রিশটা বছর খুব কী বেশি সময়? যাদের জীবন আনন্দের, তাদের জন্য এটি খুব বেশি সময় নয়। আবার নিঃসঙ্গ একাকী মানুষের জন্য এটি দীর্ঘ সময়।
রোহিত একটি রেন্ট- এ ট্যাক্সি ডাকে। ট্যাক্সির চালককে বলে -- ভাই, সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে আমাকে নিয়ে চলো। চালক বলে -- ওঠেন।
ট্যাক্সি আশুলিয়ার পথ ধরে চলতে থাকে। সে ভাবছিল -- আমি অধম। আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি। একাত্তরে আমি টগবগে যুবক ছিলাম। ইচ্ছা করলেই এই মাটিতে ফিরে আসতে পারতাম। কিন্তু আসিনি। কী এক অভিমান ছিল অন্তর জুড়ে। কারোর টানেই এ দেশে ফিরে আসা হয়নি। না মা, না দেশ, না আদরের ছোট বোন , না অন্য কারোর টানে।
মানুষের হৃদয় পাথরের মতো এত কঠিন হয় ! কী যে অনাহুতের মতো সজ্জনহীন ভাবে পরবাসে পড়ে রইলাম এতকাল? কত পথ চলেছি, কত রমণীর সাথে দেখা হয়েছে, কত রূপময়ী মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে। কত বর্ণের, কত ধর্মের -- কিন্তু কাউকেই ভালো লাগল না। কাউকেই পথে থেকে তুলে নিয়ে পথের সাথী করা হয়নি। সারাটা জীবন ঘরহীন ঘরে পড়ে রইলাম। এই সবই এক অন্তহীন গ্লানি।
একবার লাসভেগাসে ভ্রমণ করতে যেয়ে পকেটে কোনো ডলার ছিল না। কপর্দকহীন যাকে বলে। কী করব? একটি মেট্রোরেল স্টেশনের প্লাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে আমার প্রকাশিত নৃবিজ্ঞানের উপর সারা জাগানো বই 'পিউরিটি এ্যান্ড ড্যান্জার' কয়েকটি কপি বিক্রি করছিলাম। এক পঞ্চাশোর্ধ্ব মার্কিন মহিলা আমার ব্যাগে থাকা বইটির সবগুলো কপি সে কিনে নেয়। মহিলা তার বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ করেছিল। আমি গিয়েছিলাম তার বাসায়। বাসায় ঢুকে আমি অবাক হয়েছিলাম। দেখি -- তার ড্রয়িং রুমের দেয়াল জুড়ে জয়নুল আবেদীনের বিখ্যাত দূর্ভিক্ষের ছবিটির কপিফটো টানানো। মহিলার নাম ছিল -- ডোর্বা আলিসন। সে ভালো পিয়ানো বাজাতে পারত। আপ্যায়নের পর সেই রাতে ডোর্বা আমাকে পিয়ানো বাজিয়ে শোনায়েছিল। আমি শুধু তার বাজানো মেলোডি সুরটিই শুনেছিলাম। গানের কথা কী ছিল তা বুঝতে পারিনি। তবে এটা যে একটা দুঃখের গানের সুর ছিল, তা বুঝতে পেরেছিলাম। আরও সিয়র হয়েছিলাম, - যখন দেখি পিয়ানো বাজানো শেষে ডোর্বার চোখে জল।
এই ধনাঢ্য বিনয়ী মহিলাটিও আমার জীবনের অনেক কিছুই হতে পারত।
ট্যাক্সিটি একসময় নবীনগর স্মৃতিসৌধের সামনে গিয়ে থামে। রোহিত গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে সৌধের কাছে চলে যায়। এতদিন ধরে এই সৌধটি ছবিতে আর ভিডিওতে দেখেছে সে। আজ চাক্ষুষ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষ শহীদের রক্তে গড়া এই সৌধ। রোহিত তার নিজের গ্লানি যেন মোচন করছিল বিনম্র ভঙ্গিতে মাথা নত করে। দূরে প্রবাসে বসে কত শুনেছে সে এই গানটি -- ' সব কটা জানালা খুলে দাওনা, ওরা আসবে চুপিচুপি / যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ...। '
রোহিত ট্যাক্সীর কাছে চলে আসে। চালক ছেলেটি বলছিল -- স্যার এখন কোথায় যাবেন?
-- হোটেল অবকাশ, মহাখালী।
হোটেলে চেক ইন করে নেয় রোহিত। তারপর রুমে যেয়ে গোসল করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
কখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি।
রোহিত উঠে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকে। এই শহরে কেউ নেই তার। সেই কবে প্রথম এসেছিল সে এই শহরে । সব মনে পড়ছে তার। মনে পড়ছে শরীফুল ইসলামের কথা। শরীফ নামের সেই ছেলেটা তাকে এই ঢাকা শহর চিনিয়েছিল, আশ্রয় দিয়েছিল তাকে এই আত্মজনহীন শহরে ।
শরীফের সাথে রোহিতের পরিচয় হয়েছিল ট্রেনে। সে যেদিন গ্রাম থেকে চলে আসছিল সেদিন। স্টিমার থেকে নেমে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে সে ঢাকাগামী একটি ট্রেনে উঠে। তৃতীয় শ্রেণির কামড়ায় সে বসেছিল । তার পাশেই বসেছিল ওর সমবয়সী একটি ছেলে। চলতে চলতে ট্রেনে ছেলেটির সাথে কথা হয় ও পরিচয় হয়। প্রথম কথা বলেছিল শরীফ আগে। বলেছিল -- কোথায় যাবে তুমি ? রোহিত বলেছিল -- উদ্দেশ্যহীন গন্তব্য। তবে ঢাকা পর্যন্ত আপাতত যাব।
--- ঢাকায় কোথায় যাবে?
--- জানি না।
--- এর আগে কখনও ঢাকা যাওনি?
--- না।
এরপর সারা রাস্তা দুজনের সাথে আরও অনেক কথা হয়। এবং ট্রেনের ভিতর ক্ষণকালের ভ্রমণের সময়টুকুতে একে অপরের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কমলাপুর স্টেশনে যখন দুজন নামে তখন শরীফ বলছিল -- বন্ধু, তুমি আমার মেসে কিছুদিনের জন্য উঠতে পারো। আমি যেমন থাকি তুমিও তেমন থাকবে, আমি যা খাই, তুমিও তাই খাবে। একই চোকিতে দুজন একসাথে না হয় কিছুদিন কষ্ট করে ঘুমাব।
আর শোনো, আমি কিন্তু তোমাকে কোনো করুণা বা দানের কথা বলছি না। ঢাকা শহরে এসেছ যখন, তখন কিছু একটা করে তো খাবেই। এই যেমন আমি একটি এ্যালুমিনিয়াম কারখানায় কাজ করে খাই। তুমিও এমন কিছু করে খেতে পারবে। তখন না হয় শোধ করে দিও।
রোহিত শরীফের দুহাত চেপে ধরে বলে -- তুমি সত্যি মহৎ ওগো বন্ধু আমার। চলো, তোমার কাছেই আমি থাকব।
বকশি বাজারে একটি সরু গলির ভিতর একটি মেসে শরীফ থাকে। ঐ মেসেই রোহিত বর্ডার হয়ে যায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সে দু-তিনটে টিউশনি পেয়ে যায়। মেসের জীবন ভালোই চলতে থাকে তার ।
জীবনের সুখ দুঃখের ক্রান্তিকালের দুই আড়াই বছর এই শরীফ রোহিতের জীবনে জড়িয়ে ছিল। খুব হাসি খুশিপূর্ণ ছেলে ছিল। হাজারও দুঃখের মাঝে নিজেকে হাসি খুশি রাখত। একদিন ওর কারখানা বন্ধ ছিল। বিকালে সে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে ছিল । রোহিত জিজ্ঞাসা করে -- 'বন্ধু, তোমার কী হয়েছে? কোনো অতীত সুখ স্মৃতি মনে পড়ছে তোমার? কিংবা কোনো দুঃখের কথা?'
শরীফ বলে, না আমার তেমন কিছু নেই। আমি কী অতই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছি যে -- একটি গোলাপ ফুল হাতে দিয়ে কোনো মায়াময়ী মেয়ে এসে বলবে ---আমি তোমাকে ভালোবাসি। তবে আমার কৈশোরের বেদনা জাগানিয়া একটি স্মৃতি আছে, যা এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
--- ঐটিই শোনাও, বলো শুনি।
--- ' মনটা কখনো কখনো ভবঘুরে মন হয়ে ওঠে। কোনো কিছু ভালো লাগে না। কারোর মায়াও কাছে টানে না। কিন্ত পথ আমাকে টেনে নিয়ে যায়। উদাস হয়ে ঘুরতে মন চায় পথে পথে, খেয়া ঘাটে। নদীতে নদীতে, নৌকায় নৌকায় । মন চায় কোনো সার্কাস দলের কিংবা কোনো যাত্রা দলের গায়েন হই। বর্ষার রাত্রি নিশীথে মঞ্চের পালায় গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেড়াই !
অনেক বছর আগে এক শ্রাবণ বর্ষা মৌসুমে আমাদের গ্রামে হাটের পাশে সার্কাস পার্টি এসেছিল। নাম ' নিউ স্টার সার্কাস অপেরা '। প্রায় একমাস ছিল তারা আমাদের গ্রামে। তখন ছিল আমার তারুণ্যের প্রথম প্রহরের সময়। প্রায় প্রতিদিন যেতাম, ঐ সার্কাস দেখতে। কি প্রবল আকর্ষণে টেনে নিয়ে যেত আমাকে। সার্কাস দেখানোর পাশাপাশি সেখানে গান হতো, নাচ হতো, কৌতুক হতো, হাতির খেলা হতো ।
ঐ সার্কাস দলে তেরো চৌদ্দ বছরের একটি বালিকা এসেছিল। নাম স্বপ্না। পিঙ্গল মণিকান্ত চোখ। শরীর নদীর বাঁকে বাঁকে তখনও ঢেই তরঙ্গায়িত হয়নি । সে ঘাগরা পড়ে নাচত। গানও গাইত। আবার সার্কাসের বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ দেখাত সে। ওর এই চৌকস ব্যাপারগুলো আমাকে ভীষণরকম মুগ্ধ করেছিল। ঐ মেয়ের অদ্ভুত সব গুণ দেখে সেদিনের এক গ্রাম্য সরল বালক ঐ বালিকার ভক্ত হয়ে উঠেছিল।
তখন বর্ষার দিনে নৌকায় করে স্কুলে যেতাম। ছলাৎছলাৎ বৈঠার শব্দ হতো জলে। কাঠের পাটাতনের উপর চুপচাপ বসে থাকতাম। জলের নুপুরে ঐ সার্কাস বালিকার ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পেতাম। মরা গাঙে তখন বর্ষার জলে ভরে যেত। সন্তোষ মাঝি জাল পেতে রাখত মাছ ধরার জন্য। পাটের জাঁকের উপর বসে থাকত ধবল বক। মাথার উপরে উড়ত গাংচিল। ওদের চ্রিহি চ্রিহি ডাকের মধ্যে আমি শুনতে পেতাম সার্কাসের ঐ বালিকার গানের সুর আর যন্ত্রী দলের খুঞ্জরীর শব্দ।
মন প্রফুল্ল হতো কিনা বুঝতে পারতাম না। পুকুর পাড়ের কদম গাছ থেকে কদম ফুল ছিঁড়ে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিতাম। উজান থেকে আসা নৌকাগুলো বাদাম তুলে চলে যেত দক্ষিণের গঞ্জে। মাঝি মল্লারও গান গাইত ভাটিয়ালি সুরে । কিন্তু সব গান আর সব সুর থেমে যেত সার্কাস দলের ঐ বালিকার ঘুঙুরের তালে। জলে কদম ফুল ভাসানোর সময় মনে হতো, এর একটি ফুল যদি আমার থেকে নিত ঐ দিগবালিকা।
কাউকে কিছুই বলা হয়নি আর। ভাবতাম, লেখাপড়া করে কি লাভ হবে? তারচেয়ে আমি যদি গায়েন হতে পারতাম। যদি যোগ দিতে পারতাম ঐ সার্কাস দলে। জীবনটা কত সুন্দরই না হতো। বালিকা শুনত আমার গান ! দ্বৈত কণ্ঠে গাইতাম যাত্রার পালায়। জীবনের স্বপ্নগুলো পূর্ণ হতো আনন্দময় সঙ্গীতে।
সেইদিন শ্রাবণ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল। আমাদের বাড়ির রাখাল সমির আলি ছোট নৌকায় করে আমাকে নিয়ে যায় সার্কাস প্যান্ডেলে। হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে প্যান্ডেলের ভিতরে । যন্ত্রী দলের কেউ একজন ৰাঁশিতে সুর তুলে, তবলায় তাল দিচ্ছিল তবলচি। হারমোনিয়াম বেজে উঠে। সেদিনও বালিকা গান গেয়েছিল। নুপুরের ঝুমঝুম শব্দ তুলে নেচেছিল । আমার প্রাণের তন্ত্রী কেঁপে উঠেছিল।
প্যান্ডেলের বাইরে ছিল পূর্ণিমার চাঁদ। নৌকায় আসার সময় বাইরে দেখে এসেছিলাম জ্যোৎস্নায় ভাসছে জলে ভাসা মাঠ ঘাট। আমি জানতাম না, সেই রাত ছিল বালিকার শেষ গানের রাত। জানতাম না সেইটি হবে আমার বালিকার কাছ থেকে শেষ গান শোনা।
পরের দিন দুপুরের পর সার্কাস দলটি বড়ো একটি পানসি নৌকা করে চলে যায় দূরে অন্য আরেক ঘাটে। বিকেলে যখন প্যান্ডেলটি দেখতে যাই,
দেখি -- সেখানে কোনো সামিয়ানা টানানো নেই। দুই একটি বাঁশের খুঁটি এলমেল পড়ে আছে। স্তব্ধ বাতাসে কান পেতে থেকেছিলাম অনেকক্ষণ।সেদিন আর বালিকার কোনো ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পেলাম না।
টিউশনী করার পাশাপাশি রোহিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে মাস্টার্স প্রিলিমিনারীতে ভর্তি হয়। ক্লাসে পড়া শোনায় সে খুব ভালো করে এবং শিক্ষকদের নজরে আসে। দুবছর পর সে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়। রেজাল্টের পরপর বৃটিশ সরকারের স্কলার্শিপ নিয়ে নৃবিজ্ঞানের উপর উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য সে লন্ডনেে চলে যায়।
সেদিন সেই ট্টেনে যদি শরীফের সাথে রোহিতের পরিচয় না হতো, যদি ঢাকা শহরে তাকে আশ্রয় না দিত, তাহলে সে আজকের এই রোহিত সেন হতে পারত না।
এত বছর পর ঢাকায় এসে তার সেই অকৃত্রিম নিঃস্বার্থ বন্ধুটির কথা খুব মনে পড়ছে । পুরোনো ঢাকার একটি এ্যালুমিয়াম ফ্যাক্টরীর শরীফ একজন কেরানী ছিল।
রোহিত সন্ধ্যায় একটি বেবীট্যাক্সি নিয়ে জেলখানার নিকট বেগম বাজার মোড়ে চলে যায়। ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে বেচারাম দেউরীর একটি গলির মধ্যে ঢোকে। রোহিতের এ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরীটি খুঁজতে থাকে। সে দেখতে পায় -- যে বাড়িতে ফ্যাক্টরিটি ছিল সেখানে সেটি নেই। লোকজনদের জিজ্ঞাসা করে শরীফুল ইসলামের কথা। কিন্তু তারা কেউই তাকে চিনতে পারে না। সে কোথায় চলে গেছে তাও জানে না।
রোহিত একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেগম বাজারের জনারণ্যময় গলির উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। বিমর্ষ হয়ে ভাবছিল -- যাকে একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম একটি যাত্রী ট্রেনে, সে আজ হারিয়ে গেল কোন্ অজ্ঞাতে, কোন্ জনারণ্যে। এ জীবনে তাকে কী আর খুঁজে পাব? যেখানেই থাকো শরীফ, তুমি ভালো থেক বন্ধু।
সে ভগ্ন মন নিয়ে ফিরে আসে হোটেলে। ট্যাক্সিতে আসতে আসতে মনে পড়ছিল শরীফের সাথে মেস জীবনের সুখ দুঃখের স্মৃতির কথা।
একদিনের কথা। ক্লাস শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেসে ফিরছিলাম। পথে জয়কালী মন্দিরের কাছে আমাদের গাঁয়ের মজিদ মন্ডলের সাথে দেখা হয়। ও এসেছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওর এক আত্মীয়ের চিকিৎসা করাতে। রাস্তার পাশে ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে মজিদের সাথে কথা বলছিলাম । কথায় কথায় জানতে পারলাম রেবেকার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। মনটা মুহূর্তে বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মজিদের সাথে কথা বলতে পারছিলাম না। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। নিশ্চুপ হয়ে ভাবছিলাম -- যাও-বা গ্রামে ফিরে যাওয়ার ক্ষীণ ইচ্ছা ছিল, তাও রুদ্ধ হয়ে গেল।
মজিদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর মেসে গেলাম না। কোথায় গেলে মন ভালো লাগবে সেই পথ খুঁজছিলাম। ভাবলাম, বুড়িগঙ্গার তীরে যেয়ে বসে থাকি গিয়ে। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চানখার পুল পার হয়ে জেলখামার পাশে দিয়ে ইসলামপুর রোডের উপর যেয়ে উঠি।
আমি যখন নবাব বাড়ির গেটের পাশে দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হলো -- নবাববাড়ির ভিতরে অন্দরমহল থেকে ঘুঙুরের আওয়াজ কানে আসছে। কে যেন পায়েল পরে নাচছে। উঁকি দিয়ে একবার দেখতে মন চাইল -- কোন্ সে নর্তকী?
পিয়ারি বেগম।
জিন্দাবাহার লেনের একটি বাড়িতে হরিমতি বাঈজীর কাছে রক্ষিতা হয়ে থাকত পিয়ারি। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সকালে ভৈরবি রাগে গান গাইত ‘রসিয়া তোরি আখিয়ারে, জিয়া লাল চায়’ ঠুংরী ঠাটের গানের এ কলিতে জিন্দা বাহার গলি কানায় কানায় ভরে উঠত। আরও একটি গান পায়েলের ঝুমুর শব্দের সাথে শোনা যেত --
'প্রভু মোর অবগুন চিতনা ধর
সমদরশি হ্যায় নাম তোমার
এক লহো পুজামে রহত হ্যায়
এক রহো ঘর ব্যাধক পরো
পরলোক মন দ্বিধা নাহি হ্যায়
দুই কাঞ্চন করো।'
খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, যদি কোনো অস্তরাগের বিকালে কাউকে নিয়ে বসতে পারতাম ওয়াইজঘাটের অদুরে সেই শান বাঁধানো ঘাটে। যে ঘাটে অনেক বছর আগে কত হেমন্ত বিকালে কমলা রঙের রোদ মেখে নবাব বাড়ি থেকে এসে বসত পিয়ারি বেগম। পিয়ারির মুখটি ছিল অবিকল ছবির মতো, থুতুনিটি ঈষৎ তীক্ষ, ঠোঁট দুটি যেন কোয়ারিতে রাখা করবী। তার নাকের প্রতিটি নিঃশ্বাস বুড়িগঙ্গার মলয় বাতাসে মিলিয়ে যেত। ওর শরীরটি যেন মুর্শিদাবাদী রেশম দিয়ে মোড়ান। এমনই মসৃন তার ত্বক। পাকা পাতি লেবুর গায়ে হাল্কা গোলাপী রঙের পোচে যে রঙের মিশ্রন হয় ঠিক তেমনই ছিল তার গায়ের রঙ। তার নীল কালো চোখ দুটি যেন স্তম্ভিত মেঘ মুখের অর্ধেকটাই জুড়ে থাকত।
তুমি কী আমার সেই রূপ ঝলসিত একজন পিয়ারি বেগম?
না, তুমি পিয়ারি বেগম নও। তুমি রেবেকা বেগম।
যাকে আমি পেয়েছিলাম পূর্ব জীবন থেকে এই পর জীবনে। স্বপ্নের কোন্ ইন্দ্রলোক থেকে তুমি এসেছিলে। তোমার চোখের আলোয় যে দ্যুতি ছড়িয়েছিল, তা আমাকে পথ দেখিয়েছিল নতুন জীবনের।
এই সবই আমার পরাবাস্তব ভাবনা ছিল, যা একেবারেই মূল্যহীন।
বুড়িগঙ্গার ঘাট থেকে ফেরার সময় ইসলামপুরের মোড়ে গঙ্গাজলির মক্ষিকালয়ের প্রবেশ মুখে দেখতে পাই -- রঙবেরঙের চোলি পরিহিতা রূপবাহারি অনেকগুলো মেয়ে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে, গান গাইছে, বিচিত্র অঙ্গ ভঙ্গি করছে। ইশারায় শীশ দিচ্ছে ভিতরে যাওয়ার জন্য।
ওখানে কী আনন্দ হয় অনেক? ওটা নাকি বিরহীদের আনন্দলোক। ওখানে রূপের হাটে শরীরের ভালোবাসা বেচাকেনা হয়।
"অ্যায় হুসন, জী খোলকর আজ সাতাঁলে মুঝকো। কাল, মেরা ইস্ককা আন্দাজ বদল যায়ে গা। ”
মানে, “ওহে সুন্দরী! আজ প্রাণ খুলে আমাকে দুঃখ দিয়ে নাও, আমায় নিয়ে খেলা করো, আমার সঙ্গে আজ তোমার প্রাণের খেলার সময়। আহা! তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা। কারণ কাল, আগামিকাল, আমার প্রেমের পাত্রী অন্য কেউও হয়ে যেতে পারে।”
সেদিন রাতে পথে ঘুরে ঘুরে মেসে ফিরে এসে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শরীফ কতবার বলেছিল, কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু ওর সকল অনুরোধ উপেক্ষা করেছিলাম। ও বলেছিল, কেন তোমার মন খারাপ? আমাকে বলো না !' কী বলব ওকে? মনে রয়ে গেল মনেরই কথা, শুধু চোখে জল।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন