বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন, ২০২০

পরিচ্ছেদ -- ৬

বহু বছর পর রোহিত যাচ্ছে শহীদুলদের বাড়িতে। কৈশোরে আর তারুণ্যে  কত সময় ওরা দুজন একসাথে কাটিয়েছে।  প্রায়ই শহীদুল চলে যেত রোহিতদের বাড়িতে,  না হয় রোহিত আসত শহীদুলদের বাড়িতে। চিরকালের সেই চেনা পথ দিয়েই রোহিত আজ চলে আসে শহীদুলদের বাড়িতে।  বাড়ির বড়ো উঠোনেই ওর সাথে দেখা হয়ে  যায়। পয়ত্রিশ বছর পর দেখা। কিন্তু চিনতে একটুও অসুবিধা হয়নি।  কোনো দ্বিধা না করেই  শহীদুলকে রোহিত বলে -- 'তুই কেমন আছিস শহীদুল?' শহীদুলও রোহিতকে চিনে ফেলে এবং জড়িয়ে ধরে বলে -- 'রোহিত, তুই? এত বছর পর তোর দেখা পেলাম।'  
দুই বন্ধু আপ্লূত হয়ে কিছু সময়  একে অপরকে  জড়িয়ে ধরে থাকে। খুশির আনন্দ অশ্রুতে ভিজে যায় দুজনেরই নয়ন।
                               
শহীদুল রোহিতকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় বাড়ির ভিতরে। বিছানায় বসিয়ে ওর স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে আসে। রোহিতকে দেখিয়ে পরিচয় করে দিয়ে  বলে, এই হচ্ছে রোহিত।  আমার প্রাণের বন্ধু। যার কথা তোমাকে কত লক্ষ বার যে বলেছি।    

অনেক বছর পর দুই বন্ধু দুজনকে কাছে পেয়ে নানা অতীত স্মৃতিচারণ করতে থাকে।  রোহিত শহীদুলকে বলে -- তোর কথা কিছু বল, কত ঘটনা ঘটে গেছে এই পয়ত্রিশ বছরে ! বল, শুনি।  
  
শহীদুল বলছিল -- 'জীবনে কত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি অপূর্ণতা রয়ে গেল। কতকিছু পেয়েছি যেমন, আবার হারিয়েছিও অনেক।  আল্লাহর কী অসীম মহিমা এখনও বেঁচে আছি।  তার করুণার দানেই  এই জীবন পার করে দিলাম। কত ঘাত, কত আনন্দ বেদনা, কত সুখ, কত অপূর্ব জ্যোৎস্না-রাত্রি এসেছে জীবনে। এই গ্রামে ঝোপে ঝাড়ে কত নতুন নতুন  ফুল ফুটেছে।  কত সন্ধ্যা তারা নিভে গেছে, কত কোমল হৃদয় ভেঙে গেছে। কান্না জড়ান কত মধুর স্মৃতি, কত দিন রাত্রির কাব্য গাঁথা রচিত হয়েছে ।'    

'মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে চুপিচুপি গান শুনি। এরকম করে গান শোনাও খারাপ। তবুও শুনি। কিছু গান থাকে সৃষ্টির অমৃত সুধাকে পান করায় এমনই রাত্রির মধ্য প্রহরে। কিছু সুর থাকে স্নায়ু বিকল হয়ে যায় , হাড় হীম হয়ে আসে। শুনি সেই গান রাতের নিবিড়ে গোপনে। 

শীত চলে গেছে কত বসন্তের হুহু বাতাসকে ডাক দিয়ে। এ হাওয়ায় যখন তখন মন কেমন কেমন করে।  চোখ মেলে থাকি অন্ধকারের দিকে। আঁধার ভালো লাগে। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করে না। ভয়ও লাগে, যদি নিভে যায়।

কত কথা মনে হয় পিছনের জীবনের। কত পদচিহ্ন পড়ে আছে এই পৃথিবীর মাটিতে। গায়ে মাখতে ইচ্ছে করে শৈশবের ধূলো। গান শুনতে শুনতে ঘুম আসে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন আসে।  আবার কখনো আর ঘুম আসে না। ঘুমের মতো ঘোরের মধ্যে থাকি। দিন রাত্রি বুঝি না, সুখ দুঃখ বুঝতে পারি না।

একটি চাওয়া সবসময় চিত্তকে আকুল করে। হাসিমুখ রাখতে চাই। হাসির ওপিঠে দুঃখ কেউ যেন না দেখতে পায়। হাসিটুকু রেখে যেতে চাই। 

তারপর ক্রমশ গানের কথার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। সুরের সঙ্গে ভেসে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না আমার।

"যেটুকু প্রহর বাকী সুপটু হাতের ফাঁকি
কিছুটা সময় আঁকি
জামার গায়।
সে জামা হলুদ ভোরে তোমারি কপোল জুড়ে
ঠোঁটের অনতিদূরে 
রোদ পোহায়।"

-- তোর অনিতা দেব বর্মনের খবর কী? ভাবীকে দেখলাম, সে তো অনিতা নয়।   

-- আমি মুক্তি যুদ্ধে চলে গিয়েছিলাম। ভারতের আসামের ধুবড়িতে ট্রেনিং নিয়ে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের আন্ডারে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেই। খালেদ মোশাররফ, যিনি পরবর্তীকালে কে ফোর্সেরও অধিনায়ক ছিলেন। আমরা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ  জায়গায় ঢুকে পড়ে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলাম। যুদ্ধ শেষে যখন গ্রামে ফিরে আসি,  দেখি -- আমাদের এই জনপদ পাকিস্তানি আর্মিরা এ দেশের বাজাকার আলবদরদের সাথে নিয়ে এখানে হত্যা যজ্ঞ চালিয়েছে।  আমাদের এই হরিনাগোপাল গ্রামেই দুইশত মানুষকে তারা হত্যা করে। আমার বাবাকেও মেরে ফেলে। আমাদের বাড়ি ঘর আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।                          

--- তারপর? 

অনিতাকে পাক সেনারা ধর্ষণ করে  গুলি করে মেরে ফেলে রেখে যায়।  অনিতার দুই ভাই এবং ওর বাবাকেও পাক সেনারা গুলি করে মেরে ফেলে। জানিস রোহিত -- যেদিন যুদ্ধে যাই তার আগের দিন সন্ধ্যা রাতে অনিতা আর আমি মন্দিরে গিয়েছিলাম। ও পূজো দেয়ার জন্য মন্দিরে ঢোকে। আমি বাইরে বেল গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকি।  পুজা শেষে অনিতা মন্দির থেকে বের হয়ে এসে  সন্ধ্যা রাত্রির অন্ধকারে  আমাকে প্রণাম করে বলেছিল -- দেশ যখন স্বাধীন হবে, তুমি তখন লাল সবুজের ঝান্ডা উড়িয়ে গান গাইতে গাইতে চলে আসবে এই গ্রামে । আমিও হারমনিকা বাজাব বাড়ির উঠোনে নেচে নেচে। তারপর একদিন তুমি ----
'স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে 
মুগ্ধ এ চোখে।
ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে   এসে আমার ঘরে।'

-- সরি, শহীদুল,  তোকে আমি অনিতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে দুঃখ  দিলাম।                   

-- অনিতাকে একটুও ভুলতে পারিনা রে!  আমার শত কর্মের মাঝে ও চুপিচুপি চলে আসে।  কানের কাছে ফিসফিস করে বলে -- 'তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি, আসব যাব চিরদিনের সেই আমি, তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।'                    
শত বছর পরে কোনো এক শ্রাবণে বৃষ্টি সন্ধ্যা রাত্রিতে হয়ত মাটির ফোড়া কাটা ঝোপে ঝাড়ে লুকিয়ে ঝিঁঝি পোকা ডাকবে।  বাঁশঝাড়ের আড়ালে আঁধার করা বনমৌরির গন্ধে যখন রাতের জোনাকিরা আকুল হবে -- সেই রাতের  গোপনে হয়ত সে আবার  ফিরে আসবে এই হরিনা গোপাল গ্রামে। আমিও মরে যাব একদিন। আমিও হয়ত ফিরে আসব।  চেনার মতো আজিকার কোনো মানুষ হয়ত তখন থাকবে না।  এই পৃথিবী নামে গ্রহে তখন অন্য রূপে আসব। তুচ্ছ কোনো কিছু হয়ে। হয়ত ঝিঁঝি পোকা কিংবা সন্ধ্যা নিশীথের নীল নীল জোনাকি হয়ে।    

শহীদুলের চোখের কোণ্ জলে ভিজে চিকচিক করছিল। রোহিত ওকে বলে -- তোকে আমি অহেতুক কাঁদালাম।         

-- ধলডোবের দোলা মিত্রের কথা শুনেছিস না ! তুই যখন গ্রাম ছেড়ে চলে গেলি, তখন ও বালিকা ছিল। মুক্তি যুদ্ধের সময় ও ক্লাস নাইনে পড়ত।  আমি তখন স্কুলে নবীন শিক্ষক।  দোলা  আমার সরাসরি ছাত্রী ছিল। মেয়েটি ভালো গান গাইত।  পাক সৈন্যদের কালো হাতের থাবা থেকে সেদিন দোলাও রক্ষা পায়নি। সেও ধর্ষিত হয়েছিল।          লজ্জ্বায় আর গ্লানিতে দোলাদের পরিবার স্মরণার্থী হয়ে সেই যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারপর আর ওরা ফিরে আসে নাই এই দেশে। শুনেছি ওরা নাকি ভারতের শিলিগুড়িতে থাকে।      

শহীদুল রোহিতকে বলে -- মুক্তিযুদ্ধের সময় তুই কোথায় ছিলি?       

--- মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসে থেকেও আমি কিছু ভূমিকা রেখেছিলাম । আমি তখন লন্ডনে পিএইচডি করছিলাম। এপ্রিল মাসের কোনো একসময় ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনেক প্রবাসী বাঙালি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গমহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে        সমাবেশ করেছিল। সমাবেশ শেষে প্রবাসী বাঙালিরা  ডাউনিং স্ট্রীটস্থ প্রধানমন্ত্রীর অফিসের দিকে মিছিল নিয়ে যায়। সেখানে তারা     পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক  বাংলাদেশে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের  বিরুদ্ধে স্মারকলিপি প্রদান করে। সেদিনকার  সেই মিছিলে খন্দকার ফরিদ আহমেদ, লুলু বিলকিস বানু , ফেরদৌস রহমান, সুলতা শরীফ, বদরুল হোসেন তালুকদার  প্রমুখদের সাথে আমিও উপস্থিত  ছিলাম। আমরা সেদিন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি প্রদান ও পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছিলাম।  
তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে লন্ডনে অনুষ্ঠিত  বিভিন্ন সভা, সমিতি ও  সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়েছিলাম।                         

--- আয়, আমরা দুজন এই গানটি কবিতার মতো করে একসাথে আবৃত্তি করি । খুব শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছে করছে শহীদদের প্রতি ও বীরাঙ্গনাদের প্রতি।

'মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে/ কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা, তাঁরা কি ফিরিবে আজ সু-প্রভাতে,
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে।'
     
শহীদুল রোহিতকে বলে,  তুই কি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস? 
--- না।  তবে বেশি খাই না।  মন খারাপ হলে খাই।  মাঝে মাঝে মনে হয়, এই সিগারেটই প্রকৃত বন্ধু। ঐই দুদণ্ড শান্তি দেয় আমাকে। ও কোনো ফাঁকি দেয় না।  এই মনে কর্,  এখন খুব খেতে ইচ্ছে করছে। 

--- তোর কি মন খারাপ লাগছে?  

--- হুম। 

--- চল বাইরে পুকুর পাড়ে ছাতিম তলায় যাই। ওখানে যেয়ে খাই।   

--- চল্।  

রোহিতই  শহীদুলকে সিগারেট ওফার করে।  দুই বন্ধু ছাতিম তলায় চেয়ার পেতে বসে সিগারেট খেতে থাকে।      

শহীদুল রোহিতকে বলে -- তুই একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি আমাকে? 

-- বল।  সম্ভব হলে উত্তর দিব। 

--- তুই গৃহ ত্যাগ করেছিলিি কেন?  কী হয়েছিল তোর? 

--- না, এই প্রশ্নের উত্তর তোকে আমি দিব না। আমার জীবনের এই গোপন কথাটি আজ পয়ত্রিশ বছর ধরে গোপন রেখেছি।  কাউকে বলিনি।  বলবও না কখনও। কারণ, আমি যে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলাম ও আছি। বললে গীতাকে অপবিত্র করা হবে।       

--- তোর এই গোপন কথাটি আর কেউ কি জানে? 

---  যারা জানত তারা কেউ আজ আর বেঁচে নেই। সবাই পরপারে চলে গেছে।       

--- তোর কী মনে হয় না,  তুই ভুল করেছিলি চিরদিনের জন্য গৃহ ত্যাগ করে। 

--- চিরদিনের জন্য আর হলো কই?  এই তো কয়দিনের জন্য এলাম তো ফিরে। তবে হ্যাঁ, আমি ভুল করেছিলাম।      

--- তা, বিয়ে করিস নাই কেন? 

---  পৃথিবীর পথে পথে কত খুঁজেছি একজন মনের মানুষকে, কিন্তু মনের মতো মনের মানুষ কোথাও খুঁজে পাইনি। একবার অস্ট্রিয়ার একটি অজো গ্রামে গিয়েছিলাম। ওখানে ঐ জনপদে  ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন জাতি সত্বার মানুষ বসবাস করে। তাদের নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের  উপর  কিছু উপাত্ত সংগ্রহ করাই আমার কাজ ছিল।    

নদীর নাম মোরাভা।   
ঠিক আমাদের ইছামতী নদীর মতো ছোট্ট একটি নদী বয়ে এসেছে কোথা থেকে, জানতাম না । পরে জেনেছি --  নদীটির উৎপত্তি স্থল ছিল দানিয়ুব নদী। স্লোভাকিয়ার বুক চিরে ভেসে ভেসে এসেছে সে অস্ট্রিয়ার এই নির্জন সমতটে।  স্লোভাক আর রোমার এই দুটি জাতি স্বত্বার সংমিশ্রণে বিবর্তিত নৃগোষ্ঠির মানুষেরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিল।  

একটি গ্রাম্য বধু স্নান করে উঠে আসছিল ঘাট থেকে। দেখতে একদম বাঙালি রমণীর মতো লাগছিল । মেয়েটিকে দেখে মনে হয়েছিল -- তাকে  আমি এর আগে কোথায় যেন অনেক দেখেছি। আমি ওর কাছে যেয়ে কথা বলবার চেষ্টা করি।  বলেছিলামও কথা ওর সাথে  - 'মেয়ে, তোমাকে আমি জন্মজন্মান্তর ধরে চিনি।'  কিন্তু ও আমার কথা কিছুই বোঝেনি। 

ডরমেটরীতে ফিরে আসার পর  মন কিছুতেই ভালো লাগছিল না। বারবার মনে পড়ছিল ঐ মেয়েটির কথা।  পরের দিন আবার গেলাম ওকে খুঁজতে।  কিন্তু ওর কোনো দেখা পেলাম না।  তারপরের দিন আবার যাই।  সেদিনও  দেখা পেলাম না। যেদিন ভিয়েনা ছেড়ে চলে আসব, তার আগের দিন আবার যাই ঐ জনপদে ছোট্ট ঐ স্বচ্ছতোয়া নদীটির তীরে। কত খুঁজেছি তাকে। একে ওকে কতজনকে জিজ্ঞাসা করেছি কেউ ওর খোঁজ দিতে পারেনি।                                 
                                           
প্রায়ই ঐ মেয়েটির কথা মনে পড়ে। ওগো লক্ষ্মী মেয়ে!  তুমি কী এখনও আছ সেখানে ? সুদীর্ঘ কত বছর চলে গেছে। আজও তুমি কি সেই নির্জন নদীর কূলে ভাঙা ঘাটে স্নান করতে আসো? তোমাকে খুব  মনে পড়ে…তোমাকে আবার দেখতে বড়োই ইচ্ছে করে..... অনেক দূরের  কোনো বনপাতার ঘরে তুমি কী প্রদীপ জ্বালাও মৌন সন্ধ্যায়? আবার যদি যাই,  দেখা কী পাব 
তোমার?

-- খুব তো সুন্দর গল্প কথা শোনালি।  তা এটি কী সত্য কথা !  নাকি  আসল কথাটা আড়াল করে গেলি।  

---  সত্যটাও সত্য,  মিথ্যাটাও সত্য।     

--- তোর কী এই দেশের জন্য প্রাণ কাঁদত না?   

--- এই দেশের মাটি, জলবায়ু, আকাশ, বৃক্ষরাজি ও নদীর জন্য প্রায়ই  মন তৃষিত হয়ে ঘাকত। যখনই কোনও অস্তমিত  সন্ধ্যাবেলায় টেমস কিংবা স্যাভরন নদীর পাড়ে গিয়েছি, তখনই মনে হতো ইছামতী ও যমুনা নদীর কথা। বিস্মৃতপ্রায় ঝাপসা ছবির মতো মনে ভেসে উঠত -- নিভৃত পল্লিগ্রামের জীর্ণ শানবাঁধানো পুকুর ঘাটের কথা। পুকুরের জলে ভেজা লক্ষ্মীর চরণচিহ্নের মতো মায়ের  জলসিক্ত পা দু খানির রেখা আঁকা পদচিহ্নর কথা…আঁধার সন্ধ্যায় আম কাঁঠালের বনের  মাথার ওপরের আকাশে দু-একটা নক্ষত্র জ্বলে ওঠার কথা । শান্ত  আঙিনায় তুলসী মঞ্চমূলে মঙ্গল প্রার্থিনী সে কোন্ পূজারত মাতৃমূর্তি, করুণামাখা অশ্রু ছল ছল তার চোখের কথা  ... । 

শহীদুলের স্ত্রী শেফালী দুই বন্ধুর জন্য প্লেটে করে  পিয়ারা কেটে  দিয়ে যায়। এবং রোহিতকে বলে যায় -- দাদা, আজ দুপুরে আমাদের এখানেই ডাল ভাত খাবেন।       
   
শহীদুল বলছিল -- একটা সুখের কোনো ঘটনা বল্,  যা শুনে মনটা যেন একটু ভালো হয়।  আর একটা সিগারেট দে খাই।         

-- লন্ডনে যে ইউনিভার্সিটি থেকে এমফিল করছিলাম -- ওখান থেকেই একবার ব্রাজিল গিয়েছিলাম। রিও ডি জেনেরিওর একটি ইউনিভার্সিটির সাথে আমাদের ইউনিভার্সিটর এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ছিল।  উদ্দেশ্য ছিল আমাজনের আদিবাসীদের জীবন যাত্রার উপর এ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করা ।      

আমার সাথে আরও তিনজন তরুণ গবেষক ছিল। এর ভিতর দুজন ছিল মেয়ে । রিও ডি জেনেরিও থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে  আমাজন অরণ্য অবস্থিত । সেই অরণ্যে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির আদিবাসীদের বাস। তার একটি হলো --    ‘আয়োরো’।  এই আয়ারো আদি গোষ্ঠীকে নিয়েই আমাদের এ্যাসাইমেন্ট ছিল। 

আয়োরো আদিবাসীদের বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী। 
এরা মূলত পশুপালন করে । এক একটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকে কমপক্ষে শতাধিক শূকর। এই গোষ্ঠীর সমাজে যখন কেউ 
প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন তাকে নিজ চেষ্টায় ঘর তৈরি করতে হয়। ঘর তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করলেই বর্ষায় তাকে বিয়ে দেয়া হয়। আর বর্ষার শুরুর আগে প্রথম যেদিন পাখি ডাকে সেদিন শুরু হয় আয়োরো আদিবাসী গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় উৎসব ‘আছোঞ্জা’। পুরো একমাস ব্যাপী এই উৎসব চলে।

রিও থেকে আমরা প্রথম চলে গিয়েছিলাম  আমাজন নিকটবর্তী একটি ছোট্ট শহরে। তারপর  আমাজনের সেফ জোনে যেয়ে আমরা তাবু পেতেছিলাম। একমাস সেই তাবুতে ছিলাম। কী আনন্দময় জীবন ছিল , যাকে বলে 'দ্যাট ওয়াজ রিয়াল ন্যাচারাল লাইফ টুগেদার। যে একমাস ছিলাম জীবনের সব দুঃখ বেদনা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম আমাজনের গভীর জঙ্গলেে। আমাদের মূল শ্লোগান ছিল -- Life is ours, we live it our way.   

আমাদের সাথে যে দুজন মেয়ে ছিল তার একজনের নাম ছিল সান্ডি আরিস্তা। ও এসেছিল স্পেনের  বার্সিলোনা থেকে।  তেইশ চব্বিশ বছরের স্প্যানিশ উচ্ছ্বল তরুণী।  ও আমার রিসার্চ 
মেট ছিল। আমরা দুজন প্রায়ই  হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম গভীর অরণ্যে। ও ছিল সাংঘাতিক  ভিতু প্রকৃতির। এক জায়গায় এক নীল জলের শীর্ণা নদীর কূলে বসে দুজন গল্প করছিলাম।  জলের ছোট ছোট ঢেউ  দেখছিলাম চেয়ে  চেয়ে। কারোরই কোনো চাওয়া নেই। সান্ডি আরিস্তা শুধু আমাকে বাহু বন্ধনে বেঁধে রেখেছিল।  নির্জন সেই বন-ক্রোরে নীল আকাশের নীচে কী আর কথা থাকে? 
অরণ্য ঘেরা নদীর কূলে আরক্ত  চাঁপাফুলের কি যে মৌ মৌ গন্ধ,  সিক্ত হলো ঘাস -- স্বর্গীয় আশীর্বাদে ঋদ্ধ হলো দুজন।  এক গভীর নিবিড় আলিঙ্গনে একাত্ম হয়ে গেলাম।  শুধু  'তোমারি আনন্দ আমার দুঃখে সুখে ভরে / আমার করে নিয়ে তবে নাও যে তোমার করে। / আমার বলে যা পেয়েছি শুভক্ষণে যবে,/ তোমার করে দেব তখন তারা আমার হবে-- সব দিতে হবে।'
                                     
শুনলি তো, আমার আনন্দময় একটি ঘটনার কথা। একটা কথা তোকে বলি -- জীবনের আনন্দময় ক্ষণ খুবই ক্ষণকালের হয়। সান্ডি আরিস্তার চোখের জল মিশেছিল আমাজনের  শীর্ণা নদীটির নীল জলে, আর আমার দীর্ঘশ্বাস মিশেছিল সেখানকার হিমেল বাতাসে।                  




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন