শহীদুলের ওখান থেকে বাড়িতে এসে রোহিত বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ভেবেছিল একটু ঘুমাবে। কিন্তু ঘুৃম আসে নাই চোখে। ছায়া রাণী চা বানিয়ে এনে বলে -- 'দাদা, ওঠো খেয়ে নাও।' রোহিত চা খেতে খেতে ছায়াকে বলে -- 'পুরনো জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত কূপ দেখতে যাব, যেখানে মা, বাবা, বড়ো দা, বৌদিদি ও রোহিনীর লাশ ফেলে দিয়েছিল। তুইও চল্ আমার সাথে।'
--- আচ্ছা, যাব তোমার সাথে।
তারপর দুজন হেঁটে যেয়ে কূপের পাশে দাঁড়ায়। মাথা নত করে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে কূপের নীচ তলায়। কেমন আঁধার সেখানে। কবরের মতো অনন্ত অম্বর যেন। কূপের ভিতর থেকে রোহিত শুনতে পাচ্ছিল মায়ের কান্নার শব্দ আর রোহিনীর করুণ আর্তনাদ। রোহিত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করতে থাকে। কূপের তলা থেকে সে শুনতে পাচ্ছিল, কে যেন ওকে বলছে, অনেকটা ওর বাবার কণ্ঠস্বরের মতো করে -- ' ওরে ভয় নাই, নাই স্নেহমোহবন্ধন, ওরে আশা নাই, আশা শুধু মিছে ছলনা। ওরে ভাষা নাই, নাই বৃথা বসে ক্রন্দন, ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজরচনা।'
রোহিত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু চোখে ছিল তার জলের ধারা।
ছায়া ওর দাদাকে বলছিল -- চলো দাদা, ঘরে ফিরে যাই ।
সন্ধ্যা পূর্বেই রোহিত ও ছায়া বাড়ি চল আসে। রোহিত ঘরের ভিতর না ঢুকে ছায়াকে বলে -- আমকে উঠোনে জাম্বুরা গাছ তলায় একটি চেয়ার বের করে দে। ওখানেই কতক্ষণ একা একা বসে থাকব।
ছায়া ঘর থেকে পুরানো হাতলওয়ালা একটি চেয়ার বের করে দেয়। রোহিত চেয়ারটা দেখে চিনতে পারে। এ রকম চেয়ার আরও একটি ছিল। প্রায়ই চাঁদনী রাতে ওর বাবা মা উঠোনে চেয়ারে বসে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করত । কত কথা বলত ফিসফিস করে। চাঁদ ডুবে গেলে তারপর ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়ত।' আজ মনে হচ্ছে -- সবই ছিল তাদের মহব্বত, সবই ছিল প্রেম।
রোহিত অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে উঠানে। আজ আকাশে কোনো চাঁদ উঠল না। তারা' রা বিচ্ছিন্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে জ্বলে আছে আকাশে। আজ --- যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে, / সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া, / যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে, / যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া, / মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে।'
পরের দিন সকালে রোহিত নাস্তা করতে বসে ছায়াকে বলে -- আমাদের জমিজমা, বাড়ি, পুকুর, বাজারের দোকান, দুটো আমবাগান এগুলো কী ভাবে রেকর্ড হয়েছে? তুই জানিস?
--- পিপুল বাড়িয়ার ইয়াকুব চেয়ারম্যান নিজে তদারকি করে তোমাদের সব জায়গা জমি তোমার নামে রেকর্ড করে দিয়েছেন। জমির সব পর্চা ও কাগজপত্র আমার কাছে আছে। তুমি সেগুলো দেখতে পারো। জানো দাদা, ইয়াকুব চেয়ারম্যান মুক্তি যোদ্ধা ছিলেন। উনি খুব ভালো মানুষ ছিল। এই ভালো মানুষটিকে সর্বহারা পার্টির লোকেরা দিনের বেলায় ইউনিয়ন বোর্ডের অফিসের ভিতর কুপিয়ে হত্যা করে।
-- কাগজপত্র যা আছে তোর কাছে আপাতত থাক। আমি পরে দেখব সব। আমার কিছু কাজ আছে। পরে তোর কাছ থেকে নিয়ে নেব। আর মরহুম ইয়াকুব আলী চেয়ারম্যানের আত্মার শান্তি কামনা করছি। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ওপারে যেন ভালো থাকেন।
নাস্তা খাওয়া যখন শেষের দিকে তখনই শহীদুল চলে আসে। ছায়া শহীদুলকে বলছিল -- দাদা আপনাকেও নাস্তা দেই।
-- আমি নাস্তা করে এসেছি।
-- তাহলে আপনাদের চা করে দেই।
-- না। চা দিতে হবে না। আমি আর রোহিত পিপুল বাড়িয়া বাজারে যেয়ে চা খেয়ে নেব।
যেতে যেতে পথে শহীদুল রোহিতকে বলছিল -- 'আবার কোন্ জনমে তুই আসবি, চল্ -- আমাদের স্কুলটা একটু দেখে যা।'
ওরা দুজন হেঁটে হেঁটে স্কুল আঙিনায় চলে আসে। রোহিত স্কুল আঙিনা দেখে হতবাক! কোথাও নেই আগের সেই শান্ত সৌম্য নিরিবিলি পরিবেশ। কোথায় হারিয়ে গেছে আঙিনা বেষ্টিত সবুজ বৃক্ষরাজি। তখনকার সেই আমগাছ, ঝাউ গাছ, দেবদারুর ঝাড়, সুপারি গাছের সারি, ছাতিম গাছ, এসবের চিহ্ন কোথাও নেই। আগে স্কুল ঘরটা ছিল বিশাল লম্বালম্বি, এবং সামান্য এল্ প্যাটার্নের। এখন তার পাশে অপরিকল্পিত ভাবে বিল্ডিং উঠানো হয়েছে। স্কুল আঙিনার অন্য এক পাশে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। উঠানো হয়েছে এলমেল ভাবে স্টাফ কোয়ার্টার আর হোস্টেল। এই গিঞ্জি পরিবেশ দেখে রোহিতের মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়।
ছুটির দিন ছিল ঐদিন। ছাত্র ছাত্রীদের মুখর করা কোলাহল ছিল না। রোহিত শহীদুলকে বলছিল -- দেখ্ -- মাঠের ঐ কোণে একটি আম গাছ দেখতে পাচ্ছি। ওখানে আগেও একটি এমন আম গাছ ছিল। কিন্তু এই গাছটি দেখে নতুন মনে হচ্ছে।
-- আগের সেই গাছটি মরে গেছে। এই গাছটি নতুন করে ঠিক একই জায়গায় পরে লাগানো হয়েছে।
--- চল্, ঐ গাছটার নীচে ঘাসের উপর দুজন কিছুক্ষণ বসে থাকি।
--- আচ্ছা, চল।
ওরা দুজন আমগাছের নীচে যেয়ে বসে। রোহিত বলছিল -- ' তেমন কাউকে তো কোথাও দেখছি না। একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। খাওয়া যাবে?
শহীদুল এদিক ওদিক তাকিয়ে বলছিল -- কেউ তো নেই। কেই দেখতে পাবে না। সিগারেট ধরাতে পারিস।
সিগারেট টানতে টানতে রোহিত শহীদুলকে বলছিল -- তোর মনে আছে? টিফিনের সময় স্কুল ঘরের পিছনে লুকিয়ে লুকিয়ে আমি তুই ও দত্তবাড়ি গ্রামের রতন -- আমরা তিনজন টেন্ডু পাতার বিড়ি খেতাম। রতন হরিপুর গ্রাম থেকে আসা সেতারা নামে একটি মেয়েকে খুব পছন্দ করত, ভালোও বাসত একতরফা। ও শুধু দূর থেকেই মেয়েটিকে ভালো বেসে গিয়েছিল। কোনো দিন তা মেয়েটিকে বলে নাই। যেন শুধুই --
'মনে রয়ে গেল মনের কথা-- শুধু চোখের জল, প্রাণের ব্যথা। মনে করি দুটি কথা বলে যাই, কেন মুখের পানে চেয়ে চলে যাই।'
সেই রতন এখন কোথায় আছে, কেমন আছে? দূর দেশে কত মনখারাপিয়া মুহূর্তে ওর কথা খুব মনে পড়ত। ওর সেই সারল্য মুখ, নিষ্কলুষ চাহনি, সব সময় চোখের সামনে দেখতে পেতাম। কী ভালো ছেলে ছিল। খেপালে একটুও রাগ হতো না কখনও। মুখে একটি স্মিত হাসি লেগেই থাকত সবসময় ।
-- রতন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য ভারতের বালুঘাট গিয়েছিল। আরও কয়েকজন যুবকের সাথে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ও সেখানে যায় । তখন ছিল শ্রাবণ মাস। ওরা প্রথম উঠেছিল পুণর্ভবা নদীর তীরে স্থাপিত একটি স্মরণার্থী শিবিরে। ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ওর ডায়রিয়া হয়েছিল। অনেকটা বিনা চিকিৎসায় রতন সেখানে মৃত্যু বরণ করে।
-- এই দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হওয়া হতভাগ্য রতনের নাম নিশ্চয়ই তালিকায় নেই। এই রকম কত শহীদের নাম অলিখিত রয়ে গেছে। কত তরুণ অকাতরে বিলিয়ে গিয়েছে তাদের প্রাণ! তারা বাংলাদেশের আকাশে তারা হয়ে মিটিমিটি করে জ্বলে থাকবে।
কেউ চলে গেছে, কেউ ফিরে এসেছে, কেউ হয়ে গেছে নিখোঁজ, কেউ আছে মিনারে অভিজ্ঞান হয়ে চিরন্তন, তারা রবে --
'অনন্ত আকাশে অনন্তকাল,
কখনো নদীর স্রোতে মৃত গাধা
ভেসে যেতে দেখেছি সন্ধ্যায়,
দেখেছি একদা যারা হৈচৈ করে যুদ্ধে
গেছে তাদের ক’জন
মহৎ স্বপ্নের শব কাঁধে নিয়ে হেঁটে-হেঁটে
ক্লান্ত হয়ে ফের
স্বগৃহে এসেছে ফিরে।'
ভেসে যেতে দেখেছি সন্ধ্যায়,
দেখেছি একদা যারা হৈচৈ করে যুদ্ধে
গেছে তাদের ক’জন
মহৎ স্বপ্নের শব কাঁধে নিয়ে হেঁটে-হেঁটে
ক্লান্ত হয়ে ফের
স্বগৃহে এসেছে ফিরে।'
শামসুর রাহমানের কবিতা।
--- চল্, পিপুলবাড়িয়া বাজারে যাই। ওখানে চা'র দোকানে বসে বসে চা আর সিগারেট খাই গে। তোর মন ভালো লাগবে।
--- সিগারেট একটু বেশি খাওয়া হচ্ছে না?
--- এই তো এই কটা দিনই একটু বেশি খাব। যে কয়দিন তোর সাথে আছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন