রাতে খাটের উপর রোহিত শুয়ে আছে। ঘুম আসছিল না চোখে। মনে পড়ছিল তার পূর্ব পুরুষদের কথা। ঘুমহীন চোখের সামনে তারা বিচরণ করছিল। পিতামহীর মুখে সে শুনেছিল -- 'নববধূরূপে প্রথম যেদিন সে এই বাড়িতে এসেছিল-- দুধে-আলতায় পা রেখে দাঁড়িয়েছিল এ বাড়ির প্রাঙ্গণে।' 'আজ এই প্রাঙ্গনে তারা কেউ নেই। স্বর্গের বাড়িতে তারা চলে গেছে। হয়ত সেখানে তারা এখন ভালো আছে।
ঠিক পিতামহীর মতো মাও একদিন এই বাড়িতে এসে প্রাঙ্গনে দূধে আলতায় পা রেখে দাঁড়িয়েছিল। মা আজ নেই। সেও বাবাকে সাথে করে স্বর্গলোকে চলে গেছে। আমার জন্য কেউ আজ এই বাড়ির প্রাঙ্গনে এসে দাঁড়াল না। কেউ বলল না, খোকা তুই ফিরে এসেছিস! তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে আমার দুই চোখে ঘা হয়ে গেছে।'
গভীর রাত্রে স্বপ্নের ঘোরে পূর্বপুরুষদের অনুযোগ করে রোহিত বলছিল — ' কেন তোমরা আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? কী করেছিলাম আমি? আমিও ঠিক একদিন চলে আসব তোমাদের কাছে।'
পাশের ঘরে জামাইবাবু ছায়াকে বলছিল -- দাদা এতদিন পর কী উদ্দেশ্যে যে বাড়িতে আসল? নিশ্চয়ই কোনো মতলব নিয়ে এসেছে। বাড়ি ঘর, জমি জিরাত, বাজারের দোকানপাট সব মনে হয় বিক্রি করে দিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে একেবারে পাততারি গুটিয়ে চলে যাবে। '
ছায়া রাণী বলছিল -- তুমি এইসব আজেবাজে কথা বলো না। দাদা কত বছর পরে এল। নিশ্চয়ই তিনি মাটির টানে, পূর্ব পুরুষদের পুন্য আত্মার আহবানে নিজের জন্মস্থান দেখার জন্য এসেছে। দাদাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। আর তিনি যদি সব বিক্রি করে দিয়ে চলেও যায়, যাবে। তার জিনিস তিনি যা করবেন, করবে। তুমি এসবের উপর দৃষ্টি দিও না।
ভোরবেলা রোহিতের আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। তার কাছে মনে হয়েছিল -- ঠিক যেন মায়ের মতো বিছানার পাশে এসে কেউ একজন বলছে --
' বাবা, তুমি ওঠো। তুমি সেই এলে ! তোমার জন্য আমি কত অপেক্ষা করেছি পথের দিকে চেয়ে। মনে হতো -- এই বুঝি তুমি চলে এলে। কিন্তু আসোনি। আমি তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে চোখ অন্ধ করে ফেলেছি। সেই তুমি এলে বাবা। আমি জীবন নদীর এপারে যখন চলে এলাম তখন।'
শুয়ে থেকেই বালিশে মুখ গুজে রোহিত বিড়বিড় করে বলছিল -- 'মা, তুমি যখন ছিলে এই বাড়ি মুখর হয়ে থাকত , তুমি আজ নেই। কেমন নিরব চারদিকে। তুমি থাকলে মুখর সব , না থাকলে মন খারাপ লাগে। তুমি আসবে না মা? তোমার পায়ের শব্দে আনন্দ ভৈরবী বেজে ওঠে পথে পথে। মনে হয় তুমি আসছ।
'মা, তুমি আর কখনোই আসবে না জেনেও, দৌড়ে চলে যাব ঘরের বাইরে । যেয়ে দেখব -- পথের উপর নির্জনতা'রা ক্রন্দন করছে।'
রোহিত বিছানা হতে উঠে মেঝেতে পা রেখে খাটের উপর বসে। কোথা থেকে আসা বেলী ফুলের গন্ধ পাচ্ছিল সে। হঠাৎ তার মনে হলো -- বহু বছর আগে পুকুরের চালায় মা বেলী ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন। যে বছর সে বাড়ি ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল সেই বছর।
রোহিত দরজা খুলে বাহির আঙিনা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের পাড়ে চলে যায়। এক জায়গায় দেখতে পায়, অনেকগুলো বেলী ফুলের গাছে জঙ্গল হয়ে আছে। মা ঠিক এই জায়গাতেই কয়েকটি বেলীফুলের চারা লাগিয়েছিল। সেই চারা কটি-ই জঙ্গল হয়ে গেছে অনাদরে আর অপরিচর্যায়। আর এই জঙ্গল থেকেই বেলী ফুলের বুঁনো গন্ধ ভেসে গিয়েছিল ঘরে। এই বন বেলী ফুল সেই কতকাল পূর্বের কোনো এক বিস্মৃত অতীতের কথা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। মায়ের শরীরের গন্ধের ন্যায় আজিকার এই ফুলের গন্ধ সৌরভ ছড়াচ্ছে এই বাড়ির সারা আঙিনাতে।
কেমন যেন উদাস উদাস লাগছিল তার। সে পুকুরের ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। ঘাটের পাকা সোপানগুলো জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে। আগাছা উঠেছে ফাঁক গুলো থেকে। পুকুর শ্যাওলা আর কচুরিপানায় ভরে গেছে। বহুবছর ধরে কচুরিপানা যে পরিস্কার করা হয় না। এটা বোঝা গেল।
পুকুরের একপাশে ছিল একটি বকুল গাছ। হঠাৎ মনে পড়ল তার সেই বকুল ফুলের গাছটির কথা। একবার রোহিনী বকুল ফুলের মালা গেথে এক রাখী বন্ধনের দিনে তার হাতে পরিয়ে দিয়ে বলেছিল -- দাদা, তোমার জন্য এটা আমার রাখী। তুমি এরকম করে আমায় বেঁধে রেখ তোমার স্নেহে আর মায়ায় ।' রোহিত সেই গাছটি খুঁজে পেল না। শুধু মরা শুকনো গুড়িটি মাটির উপর এখনো লেগে আছে।
রোহিত মন খারাপ করে বসেছিল ঘাটের ভাঙা সোপানের উপর। দুঃংখ জাগানিয়া কত স্মৃতিকথা মনে হচ্ছিল তার। যখন সে ভাবছিল সেইসব স্মৃতি কথা, তখনই ছায়া রাণী এসে তাকে ডাক দেয়-- 'দাদা, বাড়ির ভিতর চলো। নাস্তা খাবে। তোমার জামাই বাবু অপেক্ষা করছে।'
নাস্তা খেতে বসে রোহিত ছায়া রাণীকে বলছিল -- আমি কয়েকদিনের জন্য এখানে এসেছি। তারপর, চলে যাব।
--- দাদা, রাতে তোমাকে বলা হয়নি। আমাদের বৌদিদিকে তুমি যে আনলে না। এবং ভাইজি ভাইপুতদেরও।
--- হা হা হা, আমি তো এখনও বিয়েই করিনি রে! আনব আর কাকে?
--- কেন তুমি এখনও বিয়ে থা করোনি?
--- ' সে অনেক আফসোসের কথা। পৃথিবীর কত দেশ ঘুরলাম, কতজন কে দেখলাম -- কাউকেই মনের মত করে পছন্দ করতে পারলাম না। একটা না একটা খুত থেকেই যায়। এইভাবে খুঁজতে খুঁড়তে কখন যে এতগুলো বছর চলে গেছে, বুঝতেই পারিনি। আর এখন তো বুড়োই হয়ে গেছি। এখন বিয়ে করলে মানুষ হাসবে। তাই বাদ দিয়েছি এই সাবজেক্ট। পরজনম বিশ্বাস করি না। তারপরও যদি থাকে -- সেই জনমে না হয় কাউকে খুঁজে নিব।'
রোহিত জামাই বাবুকে বলছিল -- তুমি কেমন আছো? তোমার ব্যাবসা কেমন চলছে?
-- ঠাকুরের দোয়ায় ভালোই আছি। পুঁজিপাটা তেমন নেই। আপনার দোকান ঘরটাতেই কোনোভাবে দোকানদারী করে যাচ্ছি।
-- ওহ! আচ্ছা।
রোহিত ছায়াকে বলছিল-- আমাদের গ্রামে যে হাসান আলী মাস্টার ছিলেন, ওনার খবর কী? উনি কী বেচে আছেন?
-- না দাদা উনি মারা গেছেন অনেক আগেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর। ওনার স্ত্রী তারও আগে মারা যান। ওনাদের যে মেয়েটা ছিল নাম রেবেকা। সেও মারা গেছে তুমি চলে যাওয়ার বছর খানেকের মধ্যে ।
তুমি চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরই ওর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরপরই অন্তঃসত্ত্বা হয়। দূর্ভাগ্য, প্রসবকালীন সময় সে মারা যায়। বাচ্চাটা এখনও আছে। মেয়ে হয়েছিল । নাম -- মণিকা। অনেক বড়ো হয়ে গেছে। বিয়েও হয়েছে। ওর ঘরে একটা মেয়েও হয়েছে। বয়স পাঁচ ছয় বছর হবে । স্বামী একজন উকিল। নাম নাসির উদ্দীন। সিরাজগঞ্জ শহরে আমলা পাড়াতে থাকে।
রোহিত ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত বাতাস কারোরই গায়ে লাগল না। তার অন্তরমহল কেঁপে উঠল, সে কাঁপনও কেউ অনুভব করতে পারল না । চোখের ভিতর জল ছপছপ করছিল, সে জলও গড়িয়ে পড়েনি ললাটে বেয়ে।
রোহিত ছায়াকে বলে -- হাসান মাস্টারের যে একটি ছেলে ছিল নাম রাসেল, ওর খবর কী?
---ওতো বেঁচে নেই। মুক্তিযুূদ্ধের সময় ওর টায়ৈয়েড হয়েছিল। বিনা চিকিৎসায় সে মারা গেছে। পাক সেনাদের ভয়ে ওকে শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করতে পারে নাই।
--- আর রেবেকার স্বামী? সে কোথায়?
--- সেও নেই। পাঁচ বছর আগে সে পরপারে চলে গেছে। উনি আর বিয়ে করে নাই। মেয়েকে উনিই লালন পালন করেছে। বড়ো করেছে। লেখাপড়া করিয়েছে। এবং বিয়েও দিয়ে গেছে। মনে হয়েছে মেয়ের জন্যই সে বেঁচে থেকেছিল।
রোহিত ছায়াকে বলে -- আমার বাল্যবন্ধু শহীদুল এখন কোথায় আছে? জানিস? বাগবাটী স্কুলে আমরা দুজন একই সাথে পড়েছি।
-- শহীদুল ভাই গ্রামের বাড়িতেই থাকে দাদা। সে বাগবাটী স্কুলেই শিক্ষকতা করে।
--- আচ্ছা।
সবার নাস্তা খাওয়া শেষ হয়। রোহিত উঠে দাঁড়ায়। এবং ছায়াকে বলে -- 'আমি একটু ঘুরে আসি।
-- কোথায় যাবে দাদা?
-- শহীদুলদের বাড়ি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন