বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯

আরো কয়েকটি গল্প

৩২.    ২৪ নং দক্ষিণ গাঁও

আশির দশক। বর্ষার সন্ধ্যা রাত্রি। একটি মেয়ে বাস থেকে স্ট্যান্ডে নামে। স্ট্যান্ডে কোথাও একটি  রিক্সা নেই। মূসুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাগ থেকে  সে ছাতা বের করে। এত বৃষ্টি যে ছাতা মানছিল না। পরনের শাড়ি ভিজে একসারা হয়ে যাচ্ছিল। পথে পথচারী তেমন কেউ নেই। একটি কাভার্ড ভ্যান গায়ে পানি ছিটিয়ে দ্রুত চলে যায়। সে হেঁটে হেঁটে সামনের মহল্লায় গলি মুখে প্রবেশ করে। এই গলিতে এর আগে কখনো সে আসেনি। লাইটপোস্ট গুলোতে কোনো বাতি নেই। একটি নেরি কুকুর ভুগভুগ করে পাশে দিয়ে চলে যায়।

মেয়েটি খুঁজছে চব্বিশ নং বাড়ি। ২৪ নং দক্ষিণ গাঁও।  অদূরে একটি বাড়ির সামনে চালার নীচে একজন ঠেলা গাড়িওয়ালা জরোসরো হয়ে বসে আছে। এগিয়ে গিয়ে তার কাছে থেকে সে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয় কোনটি চব্বিশ নং বাড়ি।

মেয়েটি একটি টিনশেড পুরোনো শ্যাওলা পড়া বাড়ির সামন চলে আসে। বাড়িটির বাহিরের দিকে দরজা। আলাদা কোনো গেট নেই। তখনও বৃষ্টি হচ্ছিল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল ঘন ঘন। সে বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘরের ভিতরে তখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে কেউ একজন এই গানটি গাইছিল ---

'এসো এসো আমার ঘরে।
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে।
স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে
মুগ্ধ এ চোখে।
ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে   
এসে আমার ঘরে।'

মেয়েটি দরজায় কড়া নাড়ে কয়েকবার। ভিতরে থেকে বিষাদের সুরে ভেসে আসা গানটি হঠাৎ থেমে যায়। একজন উম্মূল উদ্বাস্তু  যুবক দরজা খুলে দেয়। বাইরে চমকিত বিদ্যুতের আলোয় যুবকটি দেখতে পায় মেয়েটির মুখ। সে বিস্ময়ে বলে ওঠে -- 'নেলী, এত রাতে তুমি? এই দূর্যোগের রাতে তুমি একা আমার ঘরে?'

নেলী বৃষ্টি ভেজা শিতল কপাল যুবকটির বুকে ঠেকিয়ে বলে --- 'ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে আমি তোমার ঘরে চলে এলাম।'

যুবকটি যক্ষা রোগে আক্রান্ত। ওর নাম মোহাম্মদ আনিস। ভালো গান গাইত তারুণ্যের সময়। গান গাইতে গাইতে গানের শিক্ষক হয়ে যায় সে। আনিস নেলীকে গান শেখাত। 

হারমোনিয়ামের রিডে ছুঁয়ে থাকা জীবনে কখন যে এই চালচুলোহীন সঙ্গীত শিক্ষককে নেলী ভালোবেসে ফেলেছিল বুঝতে পারেনি। তারপর কত রোদেলা পাখি উড়ে আসল, কত সমুষ্ণু বাতাস বয়ে গেল! সন্ধ্যার মেঘের ছায়াও পড়ল বুড়িগঙ্গার জলে। কিন্তু দুইজন আর দুজনের কাছাকাছি থাকতে পারেনি। আনিসকে অবাঞ্চিত করে দেয় নেলীর পরিবার।

এক হেমন্তের শেষ বিকেলে আনিস তার শেষ সুরটি তুলে দিয়েছিল নেলীর কণ্ঠে এই গানটি দিয়ে ---
'এসো এসো আমার ঘরে এসো 
আমার ঘরে
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে
স্বপন দুয়ার খুলে এসো.....'
আর সেই দিনের সেই নিস্তব্ধ বিকালের নিরবতাকে স্বাক্ষী রেখে নেলী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল -- 'আমি একদিন তোমার ঘরে চলে আসব।'

তারপর চলে গেছে আরও কয়েক বছর। মরণ ব্যাধি যক্ষা এসে বাসা বাঁধে আনিসের শরীরে। এর জন্য দায়ী সে নিজেই। অনিয়ম আর অত্যাচার করেছে নিজের শরীরের প্রতি। আনিস নেলীকে বলছিল --- ' তুমি এই অনিষ্ট জীবনের ভার নিতে পারবে না। আমার এখন সায়াহ্ন কাল। তুমি ফিরে যাও।'

আনিস কাশছিল  বেশি করে। কাশতে কাশতে হাঁপিয়ে উঠছিল বারবার। এত ক্লান্তি এত দুর্দশা জীবনে। নেলী এবারও তার বুকে মাথা রেখে বলছিল -- 'না, যাব না। ছিন্ন করে সব চলে এসেছি। আমি তোমার ঘরেই থাকব। আমি আমার সকল যত্ন দিয়ে তোমাকে ভাল করব।'

নেলী আরও বলছিল, ভোর হওয়ার আগেই আমাদের এখান থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে হবে। বাড়ি থেকে লোক অথবা পুলিশ চলে আসতে পারে। রাত পোহালেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে।

মহল্লার লোকজন ভোরবেলা দেখতে পায়, ২৪ নং দক্ষিণ গাঁও এর পুরোনো টিনসেড বাড়িটির দরজা খোলা। রুগ্ন যুবকটি ঘরে নেই। কোথাও চলে গেছে।  তার এলমেল বিছানার পাশে মৃত সঞ্জিবনীর একটি খালি বতল, সিগারেটের খালি প্যাকেট, স্লীপিং পিলের ছেঁড়া খোসা ও একটি পুরনো হারমোনিয়াম পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

ওরা চলে গেছে দূরে কোথাও। যেখানেই গেছে চরম অনিশ্চয়তায় ভরা। হোক না! প্রিয় মানুষ সাথে থাকলে এই পথ চলাতেই জন্মান্তরের সুখ আছে যে!

৩৩.   পৃথক পালঙ্ক

দ্রোণী নামটি কেমন বিদঘুটে। এমন বিদঘুটে নামের একটি মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল চট্টগ্রাম টু রাঙামাটির একটি লোকাল বাসে। দুইজনেই উঠেছিলাম লাভ লেইন থেকে। সময়টা ছিল আশির দশকের প্রথম।

দূর্ভাগ্যক্রমে পাশাপাশি সিটে বসতে হল। আমি জানালার সাইডে। সে অফ সাইডে। বাসটি যখন শহর ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে পাহাড় ছেড়ে এঁকেবেঁকে চলছে, আমি তখন মুগ্ধ চোখে কেবল পাহাড় দেখছিলাম। জীবনের প্রথম পাহাড় দর্শন। আমি কখনো তাকিয়ে থাকি পাহাড়ের গায়ে, কখনো উঁকি দিয়ে দেখি পাহাড়ের চূড়া। কখনো দেখি গিরি খাদ। দেখি পাহাড়ের পাশে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। ছোট ছোট ছড়া। দেখি বৃক্ষরাজি, বন, পাখি, হাতি, পাহাড়ি মানুষ, বেজি ও গিরিগিটি।

পাশে যে একজন সুশ্রী তরুণী বসে আছে, তা আমি বেমালুম ভুলে যাই। আমার মুগ্ধ চোখ দেখছিল পাহাড় ছবির মতন। আঁকাবাঁকা পথ চলতে চলতে পাহাড়ের বাঁকগুলো দেখছিলাম রমণীর মতন। নদী, ছড়া আর ঝরনা গুলো দেখছিলাম তন্বী তরুণীর মতন। তাই পাশে বসে থাকা মেয়েটিকে লাগছিল অনাহুতের মতো। সে ছিল একা। কারো সাথে কথা নেই।

সারা রাস্তা হা করে শুধু পাহাড়ই দেখলাম। পাশে বসে থাকা মেয়েটিকে একটুও ভালো করে দেখলাম না। কথাও বললাম না। আমি একটু অন্য ধরনের ছেলে। কেউ আগে কথা না বললে কথা বলি না। 

পথ ফুড়িয়ে এল। মেয়েটিকে একটু তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা হলো। দেখলামও। মুখে মুলতানি মাটির রং লাগানো যেন লোধ্ররেণু। কালো কেশ। বেনী করা চুলে ঝিনুকের মালা পেঁচিয়ে রেখেছে। চোখ দুটো তিব্বতি। সে একটি বই পড়ছে -- আবুল হাসানের 'পৃথক পালঙ্ক'। একটু বিস্মিতই হলাম। একটি উপজাতীয় মেয়ের হাতে কবিতার বই! মেয়েটির প্রতি ক্ষণিকের জন্য দূর্বল হয়ে গেলাম।

বাসটি রাঙামাটির কাছাকাছি চলে আসে। খুব ইচ্ছা হলো মেয়েটির সাথে একটু কথা বলবার। ওকে বললাম, আপনি বুঝি কবিতা পছন্দ করেন?
---   করি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরীর কবিতা আমার খুব পছন্দ।
----  আপনার নাম কী? 
----  দ্রোণী চাকমা। 

বাসটি রাঙামাটি বাসস্ট্যান্ডে এসে থামে। স্টপেজে বাবার মতো কেউ একজন অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। লোকটি চলে আসে দ্রোণীর কাছে। এবং ত্বড়িৎ ওকে নিয়ে চলে যায়। যাবার সময় মেয়েটি কয়েকবার ফিরে ফিরে তাকিয়েও ছিল আমার দিকে।

মনে মনে একটু আফসোসই করলাম। কতখানি পথ মেয়েটি আমার পাশে ছিল। ওর সাথে কত কথাই না বলতে পারতাম। কত কিছুই জানা হত। যে মেয়ে 'পৃথক পালঙ্ক' পড়ে সে হয়ত শেষের কবিতা, আরণ্যক, জীবন ঘষে আগুনও পড়ে। হয়ত সে আমার ভালো একজন বন্ধুও হতে পারত। আরও অনেক কিছু।

জীবনে এমন কত আক্ষেপ আছে। কিছু মনে থাকে। কিছু মনে থাকে না।

৩৪.   গুড ইভিনিং আঙ্কেল

আমার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাই একদিন আমাকে অনুরোধ করে বলেছিল -- তোমার যদি কোনো অসুবিধা না থাকে, বিকাল এবং সন্ধ্যা রাত্রিতে তুমি তো ফ্রী-ই থাকো, তা হাতিরপুলে আমার এক আত্মীয়ের একটি বাচ্চা মেয়েকে বাসায় যেয়ে তুমি কী একটু পড়াতে পারবে? মেয়েটি ক্লাস ওয়ানে পড়ে। এ জন্য তুমি ভালো সম্মানীও পাবে।

একটি বাচ্চা মেয়েকে পড়াতে হবে। শুনে খুব ভালো লাগল.......  আমারও তো একলা সময় গুলো ভালো কাটতে পারে। আমি তার প্রস্তাবে বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে যাই।

একদিন সন্ধ্যাবেলা আমার সেই সিনিয়র ভাইটির সাথে হল থেকে হেঁটে হেঁটে চলে যাই হাতিরপুলের সেই বাড়িতে। মেয়েটির বাবা মা বললেন কিছু অদ্ভুত কথা -- তাদের মেয়েটির সাথে রোজ সন্ধ্যাবেলা অন্ততঃ এক দেড়ঘন্টা এসে গল্প করতে হবে । গল্পের ছলে একটু পড়িয়ে দিলে হবে। মেয়েটির নাম সঞ্চিতা।

সঞ্চিতা খুব একলা মেয়ে। বাবা মা দুজনে চাকরি করেন। অফিস থেকে ফিরে সঞ্চিতার অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না দুজনেই। ক্লান্ত লাগে। যেমন, হাতি কালো কেন ? আল্লাহকে দেখতে পাই না কেন ? সুমীর মা অত খেতে পারে কি করে? আমার একটি ছোট্ট ভাই নেই কেন? এ একেবারেই যেন রবি ঠাকুরের কাবুলিওয়ালার মিনির ডুপ্লিকেট ।

সঞ্চিতা বলছিল, তুমি কাল থেকে আসবে তো আঙ্কেল?

--- তুমি নয় সঞ্চিতা, আপনি বলো ওনাকে। সম্মান করে কথা বলতে হয়।

সঞ্চিতা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে........

আমি সঞ্চিতাকে একটু কাছে ডেকে পাশে বসাই। ওকে বলি -- ঠিক আছে,  তুমি যা কিছু আমাকে ডেকো এবং বোলো।

এরপর প্রায়ই সন্ধ্যাবেলায় আমি সঞ্চিতাকে পড়াতে যাই, কিংবা ওর সাথে গল্প করতে যাই। সঞ্চিতা রূপকথা শুনতে খুব পছন্দ করত। রোজই কিছু না কিছু আবদার থাকে সঞ্চিতার। 'আঙ্কেল তুমি সেই মুনিয়া  পাখির গল্পটা আরেকবার বলো।'

আমি সঞ্চিতাকে মুনিয়া পাখির গল্প শোনাই ---

'একবার সৃষ্টিকর্তা ঠিক করলেন , সব পাখিদের মনের মত রং করে দেবেন গায়ে। যে যেমন চাইবে সেরকম রং করা হবে। আবদার মতন, কাককে কালো, বককে সাদা, টিয়াকে সবুজ, ময়ূরকে নীল .... এরকম করে দিচ্ছিলেন। মুনিয়া বারবার ওড়াউড়ি করে দেখছিল আর কত বাকি ? তার লাইন শেষের দিকে। মুনিয়া পাখি ছিল সঞ্চিতার মতো চঞ্চল । ছটফট করতে করতে আবার উড়ে গেল আকাশে । ভাবল একটু ঘুরে আবার আসবে। তারপর ..... তারপর যখন এল তখন দেখল আর কোনই রং নেই। সব পাখিরাই রং পেয়ে গেছে। অল্প একটু রংয়ের ছিটে চারিদিকে পড়ে ছিল। সৃষ্টিকর্তা তাই পাখির পেটের দিকে আর পালকের দিকে একটু একটু দিয়ে দিলেন। তাতেও মুনিয়া খুশি। দেখে সে বেশ সুন্দর লাগছে।'

আমি যেন ওকে বেশি করে সুন্দর সুন্দর রূপকথার গল্প শোনাই এ জন্য সে আমাকে প্রায়ই খুশি করত। ক্যাডবেরী চকলেট আমি যে খুব পছন্দ করতাম। এই কথাও জেনে গিয়েছিল সঞ্চিতা। সঞ্চিতা ওর নিজের চকলেট গুলো আমাকে চুপিচুপি খেতে দিত। তাছাড়া, বাগান থেকে ফুল,ঝাউপাতা ছিঁড়ে রাখত আমার জন্য। আমার হাতের মুঠোর ভিতরে ফুল গুঁজে দিয়ে বলত -- 'গুড ইভিনিং আঙ্কেল।'

দিনে দিনে আমি আর সঞ্চিতা কেমন যেন সন্ধ্যাবেলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যাই। কী এক অদ্ভূত টানে হেঁটে হেঁটে প্রতি সন্ধ্যায় চলে যেতাম। ছোট ভাই-বোন হীন এই শহরে সঞ্চিতাকে খুব আপন করে নেই। আমি সঞ্চিতার ভিতরেও আমার প্রতি একটি নিগুঢ় টান দেখতে পাই। এমন করেই চলে গেল দুই বছর। সঞ্চিতা এখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী।

গরমের ছুটিতে সেইবার বাড়িতে চলে আসি। দুই মাস ক্লাস হবে না।  বাড়িতে এসে কেমন খালি খালি লাগছিল। মনে হচ্ছিল কী যেন একটি রূপার ছোট্ট পুতুল ঢাকায় রেখে এসেছি। সেই পুতুলটি মুনিয়া পাখির মতো। ফুল বাগানের ডালে বিষণ্ন হয়ে হয়ত সে বসে আছে।

ইতোমধ্যে আমার গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হয়ে যায়। আমি ঢাকা চলে আসি। এসেই সন্ধ্যাবেলায় হল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সঞ্চিতাদের বাসায় চলে যাই। বাসায় ঢুকতেই দাড়োয়ান বলে ওঠে --- 'সঞ্চিতা'রা আর এখানে থাকে না। ওর বাবা মা দু'জনেরই বদলি হয়ে গেছে। ওরা এখন চট্টগ্রামে থাকে।'

মনটা খুবই বিষণ্ন হলো। হাত পা চলছিল না। তবুও আলোছায়ার পথ ধরে হলে চলে আসি।

কয়েকদিন ঠিকমতো ক্লাশে যেতে পারিনি। বালিশে মুখ গুঁজে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম। একটা বাৎসল্য প্রেম এত কষ্ট দেয়, এ বেদনা জীবনে প্রথম বুঝতে পারলাম। মানুষকে ভুলে থাকা যায়, মানুষের মায়া মমতাকে ভুলে থাকা যায় না।

তারপর চলে গেছে তেত্রিশ বছর। 

জীবনের মোড়ে মোড়ে কতো কিছু হল। কতো মানুষ এল। বিয়ে করলাম। আমাদের ঘরেও সঞ্চিতার মতো মেয়ে এল। কিন্তু কবেকার সেই ছোট্ট একটি বালিকা অন্তরের এক কোণে ঠাঁই করে নিয়েছিল। তাকে ভুলতে পারলাম না। ওকে প্রায়শ মনে পড়ত। যে নিতান্তই ক্ষণকালের জন্য ছিল। সেই বহু বিস্মৃত নিষ্পাপ মুখখানি মনে পড়ে বিচলিত হয়ে উঠতাম। না জানি কোথায় সে এখন কতো বড়ো হয়ে আছে! অতটুকুন মেয়ে কী আমাকে মনে রেখেছে?

অনেকটা আলস্যে শুয়ে শুয়ে ফেসবুকে নিউজফিড স্ক্রল করে করে দেখছিলাম। হঠাৎ কোনো এক সঞ্চিতার একটি স্টাটাস চোখে পড়ল ---
' আমি তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের বাসা ছিল ঢাকার হাতিরপুলে। কবি জসীম উদ্দিন হল থেকে একটি ছেলে এসে আমাকে পড়াত। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। তাকে আমি আঙ্কেল ডাকতাম। নাম রঞ্জন রহমান। কেউ কী তাঁর কোনো খবর দিতে পারেন?'

কবেকার সেই স্নেহের ফল্গুধারা আজও দুচোখ বেয়ে ঝর ঝর করে ঝরে পড়তে লাগল।

৩৫.   চিরদিনের কিছু নেই

এ জগতে চিরদিনের বলে কিছু নেই। সবই ক্ষণকালের।
সবই মায়া। সবই মরীচিকা।

জীবনের এক একাকীত্বের সময়ে মিলা'র সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। কথা বলতে বলতে জেনে গিয়েছিলাম সেও প্রবঞ্চিতদের একজন। পৃথিবী তাকেও গ্রহণ করতে চায়নি। আমি দেখেছি, এই জীবন পারাপারের খেয়ায় একই নৌকার যাত্রী হতে হয়েছে আমাকে বারেবারে। এমনি প্রবঞ্চিত মানুষদের সাথে আমাকেও খেয়ায় পাড়ি দিতে হয়েছে।

প্রায়ই মনে হতো, কোনো একটি লোকাল ট্রেনে উঠে চলছি অজানায়। কতো স্টেশনে কতো মানুষ উঠল আর  নামল। কোথাও নামা হলো না আমার। শেষ স্টেশনে যেয়ে ট্রেনটি একসময় থেমে যায়। সব মানুষ নেমে গেল। কেউ আর উঠল না। একাকী বসে আছি কামড়ায়। কেউ বলল না, তুমি নামো। পথ শেষ। সামনে আর পথ নেই।

মিলা আমার পথের সাথী হয়েছিল। সে আমার হাত ধরেছিল পরম বিশ্বাসে। আমারও মনে হয়েছিল, এই হাত ধরেনি জীবনে অন্য কোনো পুরুষের হাত? এই চোখ চেয়ে থাকেনি অন্য কারোর মায়াময় চোখের দিকে অপলক, এই মঞ্জলী ঠোঁট চুম্বন করেনি কোনো অবিশ্বাসী ঠোঁটে। বুকে আঁচর নেই অসভ্য নখের। কোনো বসন্ত বাতাসে এলোমেলো হয়ে থাকা চুল কেউ যেন পরিপাটি করে দেয়নি কোনো দিন!

বনে বনে কতো পাখি ডাকতে লাগল। নীল আকাশ ক্ষণে ক্ষণে বদলিয়ে কতো রঙের হলো। বাগানে বাগানে ফুল ফুটে উঠল। যেন মরা গাঙে জোয়ার এলো।

মিলার সাথে ছোট ছোট অভিমান হত, ঝগড়া হত, খুনসুটি হত। কতো প্রতিশ্রুতি হত দুজনের মধ্যে। বলতাম, আমার ভূবন থেকে তুমি কখনও চলে যাবে না। মিলা বলত -- 'ঐ যে তুমি বালু নদীর জল দেখছো, ঐ জলের মতো তুমি স্বচ্ছ আমার জীবনে।' হারানো সুর সিনেমার মতো গীতা দত্ত হয়ে গান গাইত --' তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার।'

কোথা থেকে শীতল হাওয়া আসত। মিলার চুল এসে কপালে পড়ত, ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতাম, 'ওগো তুমি যে আমার। চিরকালের তুমি আমার। চিরদিনের তুমি আমার।'

এই পৃথিবীতে সব কিছু ক্ষণকালের। এই যে বহমান শীতল হাওয়া, এমন করে বইবে না আর কখনও। এই যে সৌর মন্ডলে এত তারা জ্বলছে, সব তারাই একসাথে কী আর জ্বলে উঠবে কখনও? সব মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে না। তুলো হয়ে উড়ে চলে যায়।

পৃথিবীর রূপ রস গন্ধের মতো মানুষের মনও বড়ই বিচিত্র। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের মাঝেই কখন আকাশ জুড়ে কালো মেঘ হয়। ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামে। চরাচর ভেসে যায় জলে। যে মিলা শক্ত করে আমার হাত ধরে থাকত, সেই হাত কেমন যেন শিথিল হতে থাকে। দিন দিন সে দূরে সরতে থাকে। আমি এসবের কোনো মানেই বুঝতাম না। বুঝতাম না তার দ্বিধা কী ? বুঝতাম না তার প্রেম কী রূপ। 

মিলা একদিন বলেছিল, আমাকে তুমি মুক্তি দাও। আমাকে তুমি আর ধরে রেখো না। মায়া কোরো না। আমাকে ঘৃণা দাও। 

আমি মানুষের মুক্তির গল্প লিখি। কতো রাত্রি জেগে কতো অসীমে খুঁজি জীবনের জয়গান। কখন যে কোন্ কাহিনী নিজের জীবনের হয়ে যায়। বুঝতে পারিনা। আমি মিলাকে মুক্তি দিয়েছিলাম আমার জীবন থেকে। যখন সে এসেছিল জীবনে, তখন তার অতীত নিয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি, আজ যখন চলে যেতে চাইছে, তখনও বলিনি --- 'কোথায় তুমি যাবে? কে তোমার ভালোবাসা।'

মনের ভিতর একটাই প্রতিতী, চিরদিনের বলতে এই জগতে কিছু নেই। হাসি, কান্না, দুঃখ, বেদনা, ঘৃণা ও ভালোবাসা কোনোটাই না।

একদিন সব আলো নিভে দিয়ে শুয়ে আছি। হোয়াটস এ্যাপে সংকেত এলো -- দেখি একটি টেক্সট -- ' কী! খুব নিঃসঙ্গ লাগছে মনে হয়! আমি জয়িতা, তোমার একাকীত্বে আমাকে সাথী করে নেবে কী?'

রিপ্লাই দিলাম--
' না। এই পৃথিবীতে চিরদিনের কিছু নেই। তাই -- না।'

৩৬.  হারমনিকা

পাশের বাড়ির জানালা থেকে রোজ সকালে ভেসে আসে হারমনিকার সুর। কে বাজায় তা জানি না। যে বাজায় খুব সুন্দর বাজায়। ঘর থেকে বের হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। ভোরে কয়েকটি দোয়েল শীষ দিয়ে যায়। সারারাতের কল্লোলিনী ঢাকা শীতল শান্ত হয়। শান্তি নামে আমার ছোট ঘরেও। 

যিনি  হারমনিকা বাজায়, যিনি সুর তুলেন, পরে জেনেছি, সে একটি মেয়ে। ওর নাম উর্মিলা। বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী।

উর্মিলা একদিন জানালা খুলে শিক ধরে দাঁড়িয়েছিল। আমি দেখতে পেলাম একটি সুন্দর মুখশ্রী। একটি নির্মল স্নিগ্ধ মুখ। ভোরের বাতাস ওর গা ছুঁয়ে লাগল এসে আমার গায়ে। কেমন যেন মাধুকরী গন্ধ পেলাম। কেমন যেন পরশমণির ছোঁয়া দিল প্রাণের মাঝে। আমি মুগ্ধ হলাম। গন্ধের শরীরটা খুঁজতে থাকি।

তার সাথে দেখা হয় একদিন ঝমঝম বৃষ্টির দিনে। ছাতা না নিয়ে বেরনোয় আমি ভিজতে ভিজতে কাক হয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। আর উল্টোদিক থেকে সেও বিনা ছাতায় ভিজে ঝুপসি হয়ে ফিরছিল। ঝোড়ো হাওয়ায় মাথার চুল হয়ে গেছে  তার এলমেল। চুল বেয়ে জল ঝরে পড়ছিল পিঠের উপরে।

আর একদিন বাসস্টপে ধুলো-ধুসরিত, বিধ্বস্ত, ঘর্মাক্ত শরীরে দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম উর্মিলাও দাঁড়িয়ে। সে কোথায় যাবে জানিনা। ওকে দেখলাম সদ্য স্নাত। মাথার চুল শুকায়নি তখনও। চুল সুন্দর পরিপাটি করে আঁচড়িয়ে পিছনে খোঁপা করে বেঁধে রেখেছে। ভোরের সূর্যালোক এসে পড়েছিল ওর মুখে। যেন জগতের সকল আলো পরিস্ফুটিত হয়েছে এ মুখ মন্ডলে। কী যে ভালো লাগছিল ওকে।

আমি ওর পাশের বাসার এক নতুন অতিথি। চেনেও না আমাকে। ও থাকে ঠিক পাশের রুমটায় ও পাশে। দুই রুমের দুটি জানালা। মাঝখানে প্রাচীর নেই। আবার কেউ যাওয়া আসাও করতে পারব না। মাঝে  ফাঁকা, শূণ্যতা। আমাকে টেনে যা নেয় ঐ মাউথ অর্গানটা। ঐ হারমনিকা। ওর সুর।

৩৭.       সবুজ বাতি

তার সাথে আমার ব্রেক আপ হয়ে গেছে অনেক আগেই। কত অনন্ত মধ্য রাতে কত উতল হাওয়া বইত দুজনের পৃথিবীতে।  তা এখন স্তব্ধ গুমোট দম বন্ধ হয়ে আসার মতো।

যখন কোথাও কাউকে দেখছিলাম না। দেখছি তখন টিমটিম করে সবুজ বাতি জ্বলছে তারই ঘরে।

--- 'কেমন আছো?' ছোট্ট এই বার্তাটি চলে আসে মধ্যরাতের প্রহর ভেঙ্গে। যখন বলে -- ' তোমার যখন জ্বর আসে, কে তোমাকে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেয়?'

---- আমি জানি, তুমি কখনই মিথ্যা কথা বলো না। বুকে হাত রাখ। এবার বলো, কেমন আছ?

--- মাথার চুল কী আগের মতোই এলমেল রাখ? পরিপাটি করে আমিই তো তোমাকে রাখতে বলতাম। এখন কে বলে? খেতে না বললে, খাওয়ার অরুচি হত তোমার। খেতে না কিছুই। খেতে বললে, খেতে। এখন কী তুমি না খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে গেছ?

---- এখন আর খিদে লাগেনা। অসুখ বিসুখও হয় না। রোগ ব্যাধি ভয়ে পালিয়ে গেছে। ওরা সব জেনে গেছে মুখে তুলে খেয়ে দেওয়ার মানুষটি আর নেই। 

--- তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, তা আর পারছি কই। সন্ধ্যা বেলায় বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

---- রমনা সবুজের সেই ছাতিম গাছটি এখনও আছে সেখানে। ঠিক লেকের পূর্ব কোণে। সেদিন সাদা ফুলের গন্ধে ভেসেছিল, আজও কী ভাসে?  খুব যেতে ইচ্ছা করে যেয়ে দেখতে!

---- ভালোবাসা কী অযত্নে আগাছা হয়ে যায়? না মনে হয়। অনাদরে ঝোপে ঝাড়ে ঘাসফুল হয়ে ফুটে থাকে। আকাশ দেখে, বৃষ্টি ঝরে। রাত নামে। তারা দেখে। কত নিঃশব্দ নিঃশ্বাস বেগ পায়।

----- যাই । কে যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। সেই হবে হয়ত। যে থাকে এখন আমার ঘরে।

সবুজ বাতি তখন নিভে গেছে।