শুক্রবার, ৮ অক্টোবর, ২০২১

বুকের ভিতর দুঃখের মর্মর ( অনুকবিতা গুচ্ছ )

১.

দূরে চলে গিয়ে হয়েছ সুদূরিকা
দুরেও থাকে নীহারিকা।
যত দুরেই থাকো-
দু'হাতের বন্ধনে বুকের গভীরে রেখো
চিরজনমের সখা হয়ে ভালোবেসো।

২.

ফিরে যেতে বলেছিলে --
তাই মুখ ফিরিয়ে চলে গেছি। পৃথিবীর সমস্ত কক্ষপথ ঘুরে এসে দেখি, তুমি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছ দুহাত পেতে।
ঐ হাত আমি ফিরিয়ে দেই কী করে ?

৩.

উপেক্ষা করে দূরে দূরে সরিয়ে রেখেছি যাকে
দিনশেষে সেই আমার জন্য অপেক্ষায় থাকে
আদর তো দূরের কথা হাতখানিও ধরিনি যার
সেই আমায় ভালোবাসা করে দিয়েছে উজাড়।

৪.

পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরি
কত কাঁটা পড়ে থাকতে দেখি পথের উপর
কত বুনোফুল ফুটে থাকে ঝোপেঝাড়ে
কত ঘাসফড়িং উড়ে ঝিলিমিলি
কত আনন্দময় আমন্ত্রণ করে প্রজাপতি
তারপরও জোনাকজ্বলা মৌন সন্ধ্যার আগেই
সব ফেলে ফিরে আসি তোমার কাছেই...

৫.

বুকের ভিতর অসুখ রেখে প্রেমটুকু
দিও
এই পার্থিবেই তুমি আমার শুভাশিস
নিও
যেথায় তুমি যাও - সাঁজ আকাশেই
থেকো
অপার্থিবের তারা হয়ে আমায় মনে
রেখো।

৬.

জীবন ফুরালো ভালোবাসা করে দিয়ে উজাড়
ফতুর আমি কোনো কিছু নেই যে আর দেবার

কত চেয়েছিলাম তোমাকে চিরদিনের করে
চলে গেলে তুমি একলা ফেলে একলা ঘরে।

৭.

তুমি দাঁড়িয়ে আছো আমার চোখের পাতার কাছে
চেয়ে দেখি তোমার চুলে আমার চোখ ঢেকে আছে

চোখের উপর রেখেছ তোমার চোখ
জল ঝরে নাই ছিলনা কোনো শোক ,

তোমার চোখেই আমার ভালোবাসা জেগে আছে।

৮.

চিরকালের তরে ধরে রাখতে চাই
নিজের করে তারে
আহম্মক য়ে সে জন মরে সে যায়
নিজের দুঃখ ভারে।

তার জন্যই যত করি আমি আঁখি ছলোছল
সকল কর্ম ফেলে দূরে রাখি যত কোলাহল

করব অশ্রুপাত নির্জনে সেথায় জীবন
নদীর ওপারে।

৯.
আমার জন্যই আজ তোমার যত অসুখ বিসুখ
বিসর্জন দিয়েছ তুমি অপাত্রে তোমার যত সুখ

দায়ও নিয়েছ যত গ্লানি আর ব্যর্থতা আমার
তারপরও ভালোবাসো তুমি অজস্র অপার

আমার ছায়ার সাথে তোমার ছায়া রেখেছ মিশে
শিকড়ে তোমার অস্তিত্ব মন বোঝে তা অহর্নিশে।


১০.

তুমি কাছে থাকলেও তোমাকে মনে রাখব, দূরে চলে গেলেও তোমাকে মনে রাখব। এমনকি জীবন নদীর ওপারে চলে গেলেও মনে রাখব।
তাই বলো না -- আমাকে তুমি মনে রেখ না। কাউকে মনে রাখার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমার মনের। এখানে তোমার খবরদারি চলে না।

১১.


কাল সারারাত ছিল তারা ভরা রাত,
কিন্তু হায়! নির্জন নির্ঘুম ঘুমের মধ্যে কেউ স্বপ্ন দেখাতে আসেনি!

১২.


তুমি চলে গেছ, বিচ্ছিরি সময়গুলো পার করছি,
খারাপ লাগে না তবুও তেমন --
খারাপ লাগে তখন, যখন সন্ধ্যা বেলায় হাঁটতে যাই, পথের পাশে অলকানন্দা ফুল, কূলায় ফিরে যাওয়া উদ্যত শালিক, আর আকাশে সদ্য জ্বলে ওঠা তারাগুলো তিরস্কার করে হেসে বলে -- তুমি এখন একা, ভীষণ একা।

১৩.


কড়মচা গাছের ডালে সবুজ পাতার উপর বৃষ্টির ফোঁটা কান্নার মতো ঝরে পড়ে বলছে যেন --
এত সুখ ছিল যার জীবনে, সেই জীবনই যে শেষ হয়ে গেল।


১৪.


তুমি থাকলে কোলাহল, না থাকলে নির্জনতা।
তুমি থাকলে মুখর সব , না থাকলে মন খারাপ লাগে।
তোমার পায়ের শব্দে আনন্দ ভৈরবী বেজে ওঠে
পথে পথে।
তুমি আর কখনও আসবে না জেনেও,
দৌড়ে চলে যাই পথের দিকে। যেয়ে দেখি-- পথের উপর নির্জনতা'রা ক্রন্দন করছে।


১৫.


শত বছর পরে এমন বৃষ্টি বৃষ্টি সন্ধ্যা রাত্রিতে মাটির ফোড়া কাটা ঝোপে ঝাড়ে লুকিয়ে ঝিঁঝি পোকা ডাকবে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে আঁধার করা বনমৌরির গন্ধে যখন রাতের জোনাকিরা আকুল হবে -- সেই রাতের গোপনে আমি ফিরে আসব ওদের মতো করে।
চেনার মতো আজিকার কোনো মানুষ হয়ত তখন থাকবে না।

এই পৃথিবী নামে গ্রহে আবার যে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে, তা যে রূপেই হোক, যত তুচ্ছ কিছু হয়ে হলেও --- ঝিঁঝি পোকা কিংবা জোনাকি।


১৬.

ভীষণ ক্লান্তি হৃদয়ে আমার, আত্মাও ক্ষীণ স্পন্দনহীন,
শুক্লা যামিনীতে যদি তুমি আসো -- দেখতে পাবে না ঠিক আগের মতো
দূরে কোথাও হাস্নাহেনা'রা ফুটে আছে।


১৭..

তোমার অকম্পিত হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলে -- ধরো। পরম নির্ভর বাহু, ছায়াবীথির মতো বুক দেখিয়ে বলেছিলে -- এখানে হৃদয়। জমাট বেঁধে আছে লাল রক্তের ছোপ !
যত্ন করো, পরিচর্যা করো, নিজের স্থানকে পবিত্র করে রাখো.....

১৮.

ঘর থেকে বের হলে উঠোন। উঠোন পেরোলেই পুকুর। পুকুর পাড়ে কলাগাছের সারি। সারা বাড়ির আঙিনায় গাছগাছালি। তারপর ধানক্ষেত।
এইটুকুর ভিতরে সব আছে। নির্মল বাতাস আছে । নীল আকাশ দেখা যায়। পাখির কলকাকলি শোনা যায়। রোদ্দুর পাওয়া যায় । ছায়া পাওয়া যায় ।

১৯.


মুছে যাওয়া চাঁদ, ঐ ছায়াপথ, নিভে যাওয়া নীল আলো।
সব মিথ্যুক, অমর তারাই যারা বেসেছিল
ভালো।

২০.


আমার একটা স্বপ্ন আছে। আমার দেশের প্রতিটি নদীর কাছে আমি যেতে চাই। স্পর্শ নিতে চাই সব নদীর জলের।
সেরে ওঠো প্রিয় দেশ।
আমাকে যে যেতে হবে সবগুলো নদীর কাছে।

২১.


এই কী নিয়তি তবে, চলে গেলে  অন্ধকারে
ওপারে, সেই অসীম যাত্রা তোমার কতদূর....? 
কান্নাটুকু রেখে গেলে, থামিয়ে দিয়ে তোমার 
জীবন বীণার সুর।


২২..


বলো, আর কত আঁধার হওয়া 
আছে বাকি?
আর কত আঁধার হলে জ্বলে 
উঠবে জোনাকি
আলো হবে, আলো আসবেই 
তোমরা শোনো
মানুষ আঁধারে থাকবে তাই কী 
হয় কখনো?


২৩.


একদিন গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি পরে হিজল বনের পাশে এসে তুমি দাঁড়িও। লুকিয়ে থাকবে সেখানে  পাতার রঙে। সবাই দেখবে সবুজ পাতা, আমি জানব সেখানে তুমি দাঁড়িয়ে।

ঠিক তখনই সবুজ প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাব। ঢুকে পড়ব তোমার আঁচলের নীচে। ঘুরব, দেখব চির হরিৎময় আর এক স্বপ্নের জগৎ। 
'নয়ন আমার রূপের পুরে
সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে, শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন।'
'জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।'


২৪.


তুমি নও 
তোমার ছায়া পড়ুক আমার প্রাণে
স্পর্শ নয় 
তোমার চেয়ে থাকা তান তুলুক আমার গানে।

এখন একটু দূরেই থাকো--

আবার একদিন 
বকুল ঢাকা বনে হাঁটব দুজনে
আবার একদিন  
শ্রাবণ আকাশ নীলাদ্রি হবে হৃদ স্পন্দনে।

২৫.


কোথায় সেই রহস্যময় রাত
কোথায় সেই হৃদয় দুয়ার খুলে দেওয়া আশ্চর্য সন্ধ্যা... 
কোথায় সেই অনাস্বাদিত মখমলের সমুদ্র জল!
কোথায় সে দাঁড়িয়ে অমৃত সুধা পাত্র হাতে 
'দাও ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে....'


২৬.


তোমার জন্য চোখ টলোমলো, 
কবিতার অক্ষর এলোমেলো, কলম জুড়ে প্রকাশ 
পেল কেবলই শোক।

আত্মার আলো নিভে গেল, 
প্রদীপখানি জ্বেলে ধরো, স্মৃতির সাথে কথা বলো
মৃত্যু কেবল আমারই হোক।


২৭.


আমার ছিল বৃষ্টি নামানোর দায়, 
তুমি মেঘ করেছ যত
এই শ্রাবণে তোমার আকাশ ভার,  
বৃষ্টি কী হবে অবিরত?

এই শহর থেকে তুমি আজ
থাকো অনেক দূরে 
বদ্ধ ঘরে বন্দী আমি মন যে  
কেমন কেমন করে।

পায়ের পাতায় লেগে আছে 
যাযাবরের বালি 
উদাস চোখে মেঘরাগে তোমায়
মনে পড়ে খালি।

২৮.


জানালা খুলে রেখেছি, পুকরপাড় থেকে ছাতিমগন্ধের
সন্ধ্যা আসুক কবরচাপা নিঃশব্দের মতো,
কত গল্প কবিতাই তো লিখেছি, এই দমবন্ধ দিনে কবিতা তোমাকে ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দিলাম। আর কোনো গল্প লিখতে চাই না কোনো বঞ্চিতের,, সব কোলাহল থেমে যাও, কীবোর্ড তুমিও।

চন্দ্রমাস গুনতে ভুলে গেছি, আজ রাতে কী ধরনের চাঁদ উঠবে তাও জানি না, যেই চাঁদই উঠুক, বন্ধ জানালা খুলে দেখব তোমাকে। 

কেউ কী বাজাবে কোনো সরোদ, কিংবা গীটার দূরে কোথাও বেবাগী সুরে....


২৯.


আজিকার সূর্যের এমনই আলো সে শুধু মনখারাপের রোদ ছড়ায়
কুসুমপুরের পাতার বাঁশিওয়ালা সেই বালককে ডেকে আনো, ও আজ গান শোনাক......

মানুষই যদি না থাকে কে শুনবে তার গান আকুল করা 
কে গায়ে মাখবে অমিত সূর্য কিরণ,
কে দেখবে রাতের গগন জুড়ে লক্ষ লক্ষ তারা..


৩০.


ক্লান্তির শেষে, এই অন্ধকারের পর, সমস্ত ধূসর গোধূলির পরেও অকৃপণ আলো সব… আমাদের  হোক। আমাদের  হোক।


৩১..

দুজনেরই জেগে থাকার কথা ছিল --
কথা ছিল দুজনেই একসাথে ঘুমিয়ে পড়ব,
একসাথে স্বপ্ন দেখব বলে প্রতিশ্রুতি ছিল।

আর তুমি কী-না আগেই ঘুমিয়ে গেলে!
কত স্বপ্ন দেখার ছিল --

আমি নাকি বিশাল আকাশ হবো, সেই আকাশ জুড়ে তুমি পাখি হয়ে উড়বে। উদ্দাম নদীর মতো জল হবো আমি। সেই জলস্রোতে তুমি ভেসে যাবে।


৩২.

তার প্রাণের কথা, মায়াবী কাজল চোখ , বহুদিনের চেনা গন্ধ, বালিশে লেগে থাকা সুগন্ধি, গল্প বলা অজস্র রাত্রি, অস্পষ্ট করে  মনে পড়া কত ডাক নাম -- আরও কত কিছু আষ্টেপৃষ্টে করে মনে জাগে কত ভাবে যে প্রাণে জড়াতে চায় সারাক্ষণ -- 
'দেহমনের সুদূর পারে  হারিয়ে ফেলি আপনারে,
গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে। ' 

সবই তোমার মায়ার টানে ......


৩৩.

কখনো আর হবে না দেখা কখনো আর মিলব না দুজন দুজনে,
আমাদের ভালোবাসা ছিল ভুল অঙ্কে ভরা ভুল বিয়োগ  বিভাজনে
তাইতো আজ দুজন দুদিকে কখনো আর হবে না মিল
কোনো যোগ পূরণে।

৩৪.

চলে যাব সব ফেলে, এই অবগুণ্ঠিত নীলাকাশ, 
জলে ভরা টইটম্বুর এই নদী, স্মৃতির বসতবাড়ি, শ্রাবন কদম্ব ফুল।
রেখে যাব লুকিয়ে রাখা জীর্ণ প্রেমপত্র আর তোমাকে দেওয়া নাকফুল।

৩৫.

তোমার মনে বসন্তের আগুন লেগেছে। এই আগুন আমিই নিভে দিতে পারি। যদি চাও আমার জল বৃষ্টি মেঘ।


৩৬ 


তোমাকে ভালোবাসি।
এই কথাটি আর কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না।

তোমাকে ভালোবাসি। 
এই কথা আর কারোর কাছ থেকে শুনতেও ইচ্ছে করে না।

তোমাকে ভালোবাসি। 
এই কথা বলার পর কথা না রেখে চলে যায় শেষমেশ।

যারা কথা রাখবে বলে মনে করি তারা বলেও না --
তোমাকে ভালোবাসি।


৩৭.


আজ প্রথম কোকিল ডাকল। তাও আমার বাড়ির কাঁঠাল গাছের ডালে। এসো উদযাপন করি আসন্ন বসন্তদিন।

'আজ চাঁদ খাবলে জ্যোৎস্না রাখব তোমার বুকে। ফিনফিনে জ্যোৎস্না। তার পর নক্ষত্রেরা বসবে উবু হয়ে। আমি কাকে দেখব? তোমাকে না নক্ষত্রকে? আজ কোকিল ডেকেছে।

আজ ভালোবাসার উন্মোচন। ফুলের কুঁড়ি চেয়ে আছে। কোকিলের ঠোঁটে দিগন্তের ঘুঙুর। সব নদী একসঙ্গে ছুটছে। তুমিও কি ছুটে আসছ আমার দিকে? যেমন করে নক্ষত্র ছিটকে আসে বকুলের ডালে!

এসো কিন্তু। আজ কোকিল ডেকেছে।'


৩৮. 

নদীর মতো
সন্ধ্যার মতো
নির্জনতার মতো 
অন্ধকার হয়ে তুমি কোথায় চলে যাও
আমি দেখতে পাই না...

৩৯.


জানি না। কী বলেছিলে। 'জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে...।' কেমন সেই ভালোবাসার অরূপ রূপ । কী আশ্চর্য লাবণ্যে ভরা তোমার মুখ! 'দিয়ো গো আমারে নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে, তুমি।'

আমার এপিটাফ  লিখে রেখে যেও তুমি 
শিমুলতলার টিলায়। ঐ মাটির বাড়িটার শ্বেতপাথরের ফলকে।
ফেলো না আমারে ছড়ায়ে।


৪০.      


যত দূরে যাও, তত তুমি দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে যাও, 
নদী যেমন করে দূরে চলে যায়,
অথৈ সাগর হয়ে যায়।


৪১.


যখন খুব একা লাগে, যখন মনে হয় এ জীবন আর চলছে না, তখন কারো কাঁধে একটু মাথা রাখতে ইচ্ছা করে, মনে হয় কেউ এসে একটু জড়িয়ে ধরুক। কিন্তু কেউ আসে না কাছে। কেউ নেয় না জড়িয়ে। 

তখন নিজের কাঁধে নিজেই মাথা রাখি, নিজেকে নিজেই জড়িয়ে ধরি।


৪২.

তোমাকে ভালোবাসি এই কথাটি তোমাকে আমি  বোঝাতে পারিনি। 
যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানবিলাস ফুল ছুঁয়ে বলেছিলাম, ভালোবাসি। সেই  কথাটি বিশ্বাস করলে না তুমি। 
ভালোবাসি এই কথাটি বিশ্বাস করেছিল সেদিনের  ঝাউবনের হরিৎ পাতা, গাঁদা ফুল, শিশির ভেজা ভোরের হাওয়া আর হলুদ প্রজাপতি। 

যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোমাকে বলেছিলাম ভালোবাসি, সেই বারান্দায় এখন দেখি-- সেখানে অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

সেই বারান্দাটি এখন আর আমাদের নেই।


৪৩.


'ভালোবাসি। কোনো দিন ভুলব না। ছেড়ে যাব না।'
কত প্রতিশ্রুতি!

সেই তুমি কিসের টানে চলে গেলে, ফেলে রেখে গেলে তোমার স্মৃতি। 

কথা রাখলে না, ফিরে আর আসলে না, ভেঙে ফেললে সকল প্রতিশ্রুতি।


৪৪. 

ভালোবেসে কাছে আসতে পারোনি যখন
তখন বিচ্ছেদই অনন্ত হয়ে থাক,
তোমার জন্য রোগে শোকে জ্বলবে শরীর
স্মৃতিগুলো পুড়ে খাক হয়ে যাক।


৪৫.


স্বপ্নে স্বপ্নে চলি। স্বপ্ন দেখে চলি। মনখারাপ থাকলে এর ওর সাথে কথা বলি। এ বাড়ি ও বাড়ি যাই। কখনো কখনো কারোর কাছ থেকে জীবনের গল্প শুনি। নিজের কথা বলি। মেঘে ঢাকা সূর্য ছায়ার নীচে একা একা পায়ে পায়ে হাঁটি। 

চলতে চলতে আবারও মনখারাপ হয়ে যায়। ভাবি, সবই মিথ্যা হাসি হাসা। সবই মিথ্যা ভালো থাকা। 

হায়! এই আমার প্রতিদিনের ভালোথাকা।


৪৬.          

মৌনতা দিয়েই ঢেকে থাক
তোমার মুখখানি 
বিস্মৃতির মেঘে ঢেকে যাক আকাশটিও।

প্রতিরাত বেঘোর ঘুমের মাঝে কোনো 
স্বপ্ন দেখা হয় না
শোনা হয় না আর কারোর গল্প কথাও।


৪৭.


কাল আমার পুরোনো এই বাড়িটায় একটি দোয়েল নেমে এসেছিল ঝাঁঝা দুপুরে,
সে  ডানা ঝাপটালো, পালক ফেলল, ঘুরে ঘুরে দেখল আঙ্গিনাটা।
ভালো লেগেছিল তার নরম পালক, পিপাসিত চঞ্চু, ভৈরবী রাগের মতো শিস।

কে    রজনীগন্ধার লজ্জাহীন গোপন সুবাস ছড়িয়েছিল ! ভালো লেগেছিল তার রাতের বেলার  বুভুক্ষু গন্ধ নিতে, 
ভালো লেগেছিল তাকে পুণ্য জল ধারায় ভিজিয়ে দিতে, পৃথিবীর নির্জনে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলতে পাপড়ি। 

কে   অমৃত জলের প্রস্রবণে ভেসেছিল , কে দিয়েছিল প্রথম প্রস্তাব দ্বিধা উপেক্ষা করে, তা জানবে কী করে মূর্খ দোয়েল, আর অপ্রেয়সী এক রজনীগন্ধা!


৫০.   


যদি প্রেমহীন হয়ে থাকো, মেঘদূতের সম্ভোগের শ্লোক পড়েও যদি নির্বিকার থেকে যাও           
যদি না থাকে তোমার রাগ-অনুরাগ-
যদি বিহ্বল না হয় কস্তরী নাভি, যদি সুর  না ওঠে কোমলগান্ধার,                                           
যদি কেঁপে না ওঠে তোমার শরীর, 
রক্তে শোনিতে যদি না ভেজে তোমার পরনবাস,    তাহলে তুমি আমার কবিতা পড়ো না।


৫১.


অন্ধকার পছন্দ করো, বুকের খাঁজে তাই তোমাকে রেখেছি
তা দেখে রাত্রিও হিংসা করে-
শরীরের ঘ্রাণ পেয়ে আহলাদী হয়ে ওঠো
আমিও তখন স্বপ্ন  বীজ বুনি তোমার উর্বর 
মৃত্তিকায়।


৫২.  


আমার ঠিকানায় এসে আমাকে পাবে নাকো আর
শুধু নামটি লেখা আছে, 
যেথায় গিয়েছি চলে    সেথায় কেউ পারেনা যেতে
পারেনা  থাকতে  কাছে,
যে জীবন ছিল ভাঁটফুল মহুয়ার কাছে, চলে গেছে 
সে নক্ষত্র-বীথির দেশে।


৫৩.  



বহু সহস্র কাল ধরে কত জনপদ কত জনপথ পেড়িয়ে 
সেই তুমি আসলে যখন, 
যে পার্থিবে যে পর্ণকুটিরে তুমি এসে দাঁড়ালে 
তখন আর আমি সেখানে নেই.... 

সেই শান্ত তুমি অপলক চেয়ে রইলে উদাস
এবং ক্লান্তিহীন,  চুপচাপ খুঁজতে থাকলে আমাকে অপার্থিবের অন্ধকারে।


৫৪.          


গতরাতে রাতের মাঝখানে ঘুম ভেঙ্গে যায়
আজও দেখলাম তোমার একটি নিষ্কলুষ হাত আমার বুক ছুঁয়ে আছে
এটাই তোমার বার্তা, এইটাই তোমার অস্তিত্বের জানান-- তোমার থেকে যেন দূরে চলে না যাই।

কোনোদিন কোনো বিদায়ের ক্ষণে 
ক্ষণ তরে যদি তোমার ও দুটি হাত, না ছুঁইতে পারে আর,

তখন তুমি  দারজা লাগিয়ে দিয়ে চলে যেও, 
আমার অশ্রুবিন্দুর মাঝে তোমার মুখচ্ছবির কোনো ছায়া যেন ফেলে না যাও।


৫৫.      


আমি কীভাবে পেতে পারি তোমার
নির্জন মুগ্ধতা, 
তুমি যে এখনও অলৌকিক আলোর বিচ্ছুরণে ঢেকে আছ।
আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে 
কী ভাবে চেয়ে দেখব মনিরত্নম? 
কী ভাবে কেড়ে নেব তোমার 
নির্জন মুগ্ধতা।


৫৬.     
 

বলো, আর কত আঁধার হওয়া 
আছে বাকি?
আর কত আঁধার হলে জ্বলে 
উঠবে জোনাকি
আলো হবে, আলো আসবেই 
তোমরা শোনো
মানুষ আঁধারে থাকবে তাই কী 
হয় কখনো?


৫৭.     


যে পথ দিয়ে চলে এসেছিলাম সেই পথ দিয়েই চলে যাব একা 
তোমার ভুবনে তুমি পড়ে রবে কোথাও পাবে না আমার দেখা 
যদি আমাকে খুঁজে পেতে চাও আঁধারে জ্বালিও আলোক রেখা 
চিনিয়ে দেবে তোমাকে পথের উপর ফেলে রাখা আমার পদরেখা।


৫৮.     
  

যদি কোনো রাত্রির মধ্যাহ্নে
চন্দ্রকিরণতলে দাঁড়িয়ে কেউ ললাটে চুম্বন দিত!
জোছনাধারা বইত ধীরে --
কুয়াশা-নিবিড় নির্জনতায় চলে যেতাম
বাঁশ ঝাড়ের ছায়া মর্মর পথের উপর... 

বলতাম,
নাও তুমি আমার অনন্ত ভালোবাসা।


৫৯.     
     

তোমাকে ফেলে দিয়ে
পথে নেমে একা একা পথে পথে ঘুরি। যাযাবর সন্ধ্যা বেলায় পথ ভুল করে আবার তোমার কাছেই ফিরে আসি।
কবে একদিন আমার জন্য তোমার দুই ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়েছিল, তারই ঋণ শোধ করার জন্য এমন করে বারে বারে ফিরে আসা।


৬০.    

শ্রাবণ জ্যোৎস্নারাতে
বহুদিন এই গ্রাম থেকে ঐ গ্রামে
গোপনে নৌকা নিয়ে ঘাটে ঘাটে ঘুরেছি
দেখেছি কত উপচে পড়া জল ---
আর নদীর  স্রোতবক্ষে ভেসেছি সারারাত।

সব ঘাটই জলকে কাছে টেনেছিল, 
আমাকে নয় --
নদী আর আমাতে ছিল যত অভিমান।


৬১.     


আমার সমস্ত ভালোবাসা বুঁনো আবেগে তাড়িত
আমি বিশ্বাস করি- তোমাকেই আমি ভালোবাসি,
কিন্তু তোমার হৃদয়ের মধ্যে এক অসম্ভব নীরবতা
যা আমাকে ধুঁকে ধুঁকে আহত করে।

প্রাপ্তি এইটুকুই --
যদি কখনও দূর থেকে বাতাস এসে গায়ে লাগে, প্রশান্তিই বলে দেয়
এই বাতাস তোমার শরীর ছুঁয়ে এসেছে।


৬২.       


সেই কবে তার অটোগ্রাফ খাতায় লিখে দিয়েছিলাম,
'ভালোবাসার জন্য চোখের জল ফেলতে হয়,
তবেই সে জলে ভালোবাসা জ্বলে।'
আজ এত বছর পর এসে বুঝতে পেলাম-
'তার নয়ন জল কখন নয়ন থেকে  ঝরে গিয়েছে দেখতে পারি নাই।'

৬৩.     

ঝড় আসে, ঝড়ে উড়ে যায় পথের ধূলো
নির্ঝরে পাতা ঝরে, চৌচির হয়ে যায় সবুজ বৃক্ষ।
এই চরাচরে ধূলো উড়ে, পাতা ঝরে
রৌদ্র ক্লান্ত দুপুর শেষে বড়ই ম্রিয়মাণ আমি।

যদি কোনও রক্তিম আভার সিক্ত সন্ধ্যায়
তুমি আসতে আরক্ত দেহ সাজে, মোহনীয় করে দিতে পারতে উদ্বেলিত সকল মুহূর্ত!


৬৪.     


একটাই জীবন জেনেও জড়াইনি অন্য আর কারোর জীবনে -- 
যতটুকু সময় আছে, আছি তোমার সাথে সুখ দুঃখের এই ভূবনে,
জীবনে যা পেয়েছি অমৃত সুধায়  ভরে থাক আর কিছু চাহিনে।


৬৫.     


কতো রাত পোহালো তবু তার সঙ্গে দেখা হলো না।

তুমি কি ছিলে এই রাত্রিতে , এই চন্দ্রপক্ষে
নিজেকে বিসর্জনরত? 
যেখানে মাটির সঙ্গে প্রেম, যেখানে দেহের বিষে প্রেম আলিঙ্গনবদ্ধ হয়।

ভালোবাসার ফুলে ভরে ওঠে জল, তবুও জল স্পন্দন শুনলো না কেউ ।


৬৬.     

কালো মেঘের মতো চুল ঢেকে দিয়েছিল তোমার গোল্লাছুট খেলার পিঠ, 
অর্ধেক এসে ঢেকেছিল উপত্যকার টিলা লতাগুল্মে, 
ঈশাণে জমে থাকা মেঘ জল হয়ে গিরিপথ বেয়ে অতল খাদে পড়তে থাকে। 
আর সেই খাদে ফুটে থাকে লক্ষ লক্ষ বুঁনো জলপদ্ম।


৬৭.      বর্ষা মঙ্গল


কথা ছিল মেঘ গুুরুগম্ভীর বর্ষারাতে আমরা নদীতে ভাসব। রাতের মধ্য্ প্রহরে তুমি এমন হলে তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত আমি। তুমি পাশ ফিরে মুখ ঘুরিয়ে মেঘ হয়ে গেলে। তোমার এমন মেঘ হওয়া দেখে বিষাদগ্রস্থ হই। দেখি -- সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরছে।

তুমি এসো, আষাঢ়ের মেঘের মতো
এসো, আমার বর্ষালিপি।
টুপটাপ ঝরতে ঝরতে
একটি আনন্দ নদী পার হই, এসো সাঁতার দেই।



৬৮.       ভীষণ একা


তুমি চলে গেছ, বিচ্ছিরি সময়গুলো পার করছি, 
খারাপ লাগে না তবুও তেমন --
খারাপ  লাগে তখন, যখন সন্ধ্যা বেলায় হাঁটতে যাই,  পথের পাশে অলকানন্দা ফুল, কূলায় ফিরে যাওয়া উদ্যত শালিক, আর আকাশে সদ্য জ্বলে ওঠা তারাগুলো তিরস্কার করে হেসে বলে -- তুমি এখন একা, ভীষণ একা।

৬৯.      এই মুখের উপরে কোন্ আলো এসে পড়ল। কার মতো দেখতে তুমি!
হাজার অন্ধকার রাতে দুই একটি তারা তীর্যক আলো ছড়ায় এসে আমার ঘরে।

তুমি যে হাজার রাতের আলোকবর্তিকা।


৭০.    

 আমাদের প্রথম দেখার দিনে যে বাঁশি শুনেছিলাম, 
সে বাঁশিতে আনন্দধ্বনি বেজেছিল,
আমাদের প্রণয়ে যে জ্যোতির্ময় আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল 
তা ছড়িয়ে গিয়েছিল বিশ্বলোকে,
কেতকী বনের শালমঞ্জরীর উতল হাওয়ায় ময়ুুরীরা সেদিন নৃত্য করে উঠেছিল,
আমরা মিশে গিয়েছিলাম নির্জন বনতলে মর্মরমুখরিত জোছনা রাত্রির বিহবলতায়।

তারপর আমরা পৃথিবীর শঙ্কুল পথ ধরে 
হেঁটে হেঁটে চলে এসেছিলাম আমাদের এই মায়ার সংসারে।