মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩

কবিতার পাণ্ডুলিপি - ৮

১.      বিদায়ী পংক্তিমালা

যে ছেলেটি একদিন ট্রেনে করে এসেছিল এই ঢাকা শহরে
সে আজ শববাহী যাত্রী হয়ে চলে যাচ্ছে তারই শহরে,
তার জ্বলজ্বলে চোখ ভালোবেসেছিল বাংলাদেশের মানচিত্র।

উদ্দাম তারুণ্যে বার বার হেঁটে গেছে সে রবীন্দ্র সরোবরের কাছে
যেখানে নিহত হয়েছিলেন স্থপতি, জাতির পিতা ইতিহাসের সেই আদর্শিক পিতার ছবিকে করেছে কুর্নিশ।

বহিমিয়ান ছিল না সে, সে  লিখত কবিতা
জীবন থেকে শব্দ তুলে এনে লিখত গল্প 
কোনোই অভিমান ছিল না তার ! ধূসর এই হেমন্ত সন্ধ্যায়
চলে গেল সে শীর্ণ এক নদীর  তীরে, শেষ খেয়াটির জন্য অপেক্ষা না করে।


২.          আকাশের সব নীল


আমি প্রতিদিন বিস্ময়ে দেখি-তুরাগ পাড়ের কাশবন
বালি মাটিতে ফুটে থাকা তুচ্ছ ঘাস ফুল
দেখি দিয়াবাড়ির আকাশ,শুনি কানপেতে সন্ধ্যার শব্দ,
কপালের উপর তোমার উড়ে পড়া চুল
দেখি স্বপ্নের মধ্যে ভালোবাসার কাতরতা ।

ঘর থেকে বের হওয়ার বাঁশি শুনি
ধূসর বসন্ত সন্ধ্যায় যদি তুমি ডাক দাও
উড়ন্ত শশারের মতো স্বপ্ন নিয়ে উড়ে যাই
আকাশের সব নীল তখন লালচে হতে থাকে।

তোমাকে সাথে নিয়ে যে সন্ধ্যা আমি দেখি
যে রাত দেখি- বিমুগ্ধ প্রণয়ের যে কাতরতা 
চোখের উপর চোখ রেখে বুঝতে পারি-
এই ক্লান্তির শহরে আমাদের সব প্রেমই অম্লান।


৩.


৪.        সংসারভূক


একটি কোমল হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙ্গে যায়। 
সে কি ছু্ঁয়েছিল আমার কপাল ? 
ঘুম ভাঙ্গবার আগে হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বেজেছিল কি ? 

চোখ মেলে রাতের স্বপ্নগুলি মনে করতে পারিনি কিছুতেই। চুম্বনগুলো কি স্বপ্নের মধ্যে ছিল ? তার দিকে অপলক চেয়ে থেকেই সকাল শুরু হয়ে যায। 

কোর্টের বোতাম লাগিয়ে শেষে  কপাল রেখেছিলো বুকের উপর, অফিসের চাবীটা  তুলে দিয়ে দিয়েছিল হাতে। এত যে ভালোবাসা, এতো যে টান, তারপরও নিজকে আজও  সংসারভূক করতে পারিনি।


৫.       রোদ্রক্লান্ত দুপুর 


একি কোনো মায়াজাল তবে? 
আমার সকল ভাবনায়
সকল পাওয়ার আকুলতায়
এই রোদ্র ক্লান্ত দুপুরে তোমাকে কাছে টানতে 
মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে 
আমার অন্তর্মহলের সমস্ত দুয়ার খুলে যায় 
আমি নির্মোহে শূন্য করে দিতে চাই সব।    

তখন তুমি ছিলে রবীন্দ্র সঙ্গীতে 
থামিয়ে দিয়ে সব গান দিলে বাহু পেতে 
বললে, 'এসো এসো আমার ঘরে এসো।'



৬.        ভালোবাসি 


যদি কখনও নাম ধরে তোমাকে ডেকে বলি -- ভালোবাসি। 
আর ঠিক  তখনই যদি কল্লোলিত হয়ে ওঠে  সমুদ্র,  
যদি প্রচণ্ড ঢেউ  ব্যেপে এসে বলে --  আমার জলে তোমাদের স্থান নেই। 
আর ঠিক তখনই আকাশ তার ছায়া ফেলে বলে -- স্হান দিতে না পারি, ছায়ামাখা রোদ্রের দিন তোমাদের দেবো।
তবুও তুমি বলে দাও -- ভালোবাসি।


৭.        সুচরিতাসু, 

তুমি নিজেকে লুকাতে পারবে না কোথাও ,
না যমুনার জলে, না ধুরবাহাটির অরণ্যে -
তোমাকে ছুঁইতে গিয়ে ছুঁয়েছি আগুন 
তবুও তুমি আগুন হতে চাওনি কখনও। 

তুমি  নিজেকে যেমন লুকাতে পারবে না 
তেমনি আমিও যেতে পারব না দূরে - 
অথচ কতকাল ধরে আমরা হয়ে আছি ছাড়াছাড়ি... 
তোমাকে পেতে অরণ্য গহীনে গিয়েছি বারবার, জলে ভেসে গিয়েছি জলধির অতলান্তে।

তুমি নিমগ্ন আমার চেতনা জুড়ে, 
দ্বিধার দুয়ার খুলে বেরিয়ে আসো পথে , যে পথের উপর নির্বাসিত  বহিমিয়ান জীবন আমার... 

কোনও বিষাদ অপরাহ্ণে দুরবাহাটির অরণ্যে 
কিংবা নির্জন যমুনা কূলে আর কী কখনও হবে না আমাদের দেখা। 


৮.        শিকারী


মনে করো প্রশান্ত সাগর থেকে উঠে আসা 
তীব্র ঢেউ তোমার শরীর ফেনায়িত করল
তুমি ক্রমশঃ দুই চোখ মেলে বললে -- জড়িয়ে ধরো।
কিন্তু তার আগেই আসন্ন সেই শীতের রাতে তুষারপাত শুরু হলো।
সাদা বরফের কুচি তোমার সর্বাঙ্গে লেপ্টে আছে
তুমি তখন অভিমানহীন উদাসীন এক নির্জন হরিণী। 

যে প্রেম পালঙ্ক আসনে, যে আসন চিত্রিত মেঘে ঢাকা 
যে মেঘের নীচে গুচ্ছ গুচ্ছ তারা 
যেথায় ত্রস্ত হয়ে ওঠো তুমি, আমি সেথারই এক নিষ্ঠুর হরিণ শিকারী।


৯.        কত রূপে তুমি 


মাধবকুণ্ডের জলপ্রপাতের মতো মাধুর্যমণ্ডিত
তোমার রূপ লাবণ্য, তোমার কটিদেশ মাইনী নদীর বাঁকের মতো আঁকাবাকা , 
সুন্দরবনের সুন্দরী পাতার গন্ধের মতো সৌরভ  আসে তোমার শরীর থেকে। 

তোমাকে অপ্সরী মনে হয় -
পৃথিবীর মতো রূপবতী তুমি, রামসাগরের জলের মতো রুপোলী তোমার গায়ের রং, 
হেমন্তের সরিষা ফুলের সুবাস ঝরে, যেখানে কেবলই মৌমাছি গুনগুন করে, 
ময়ূরাক্ষী তোমার চোখ বুক চিবুক ওষ্ঠ
বর্ষার জলের মতো  মাদল বাজে বক্ষে তোমার, 
অনাবৃত জঙ্ঘাস্থিতে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভোরের আলোর দ্যূতি ছড়ায়...

মহাস্থান গড়ের লালমাটির রং তোমার মুখশ্রীতে 
খোঁপায় গুঁজে রাখো ভাঁটফুল -
মেঘের আয়নায় দেখো মুখ , 
পরনে ঝলকিত হয় রাজশাহীর লাল রেশমি শাড়ি, যেন মধুপুরের শিমুল ফুল ফুটে দাউ দাউ 
জ্বলছে।

দূর মহেশখালীর মৈনাক পাহাড়ের ছাদ থেকে দেখব তোমাকে, যে রূপেই দেখি- সাগর কন্যা কিংবা মেঘদূহিতা... 
অপরাহ্নের আবছা আলোয় দেখে চিনে নেব ঠিকই তোমার কাজল আঁকা চোখ, ঠোঁট,  আঙুল, চুল, কপোল। 


১০.        স্বপ্নের কথা বলি


যদি আমি স্বপ্নের কথা বলি
গল্প বলার মতো করে রূপকথা
চন্দ্র রাত্রির কথা
স্বপ্নবাজ এক রাজপুত্তুরের কথা
এক মিথের রাজকুমারীর কথা, 
শুনবে তুমি? 

মধ্যরাত্রিতে ঘোড়ার পায়ের খট খট শব্দ
রিনিকঝিনি নুপুরের শব্দ
তারা ঝরে পড়ার শব্দ, আমাদের পায়ের শব্দ 
হাওয়ায় মিলে যায় নিঝুম প্রান্তরে দিগ্বিদিকহীন। 

যাই কংসাবতীর তীরে, 
এক পাটনী নৌকায় তুলে নেয় আমাদের, 
দেখি নদীর বাঁক, শুনি জলের শব্দ, চুড়ির শব্দ। 

স্বপ্নযাত্রায় যখন ঘোর কাটে, 
তখন তুমি আর রাজকুমারী নও
কোনো পাটনীও নওত
দেখি তুমি সে এক কৈবর্ত  বউ নিশি রাই

তারপরে আর কোন স্বপ্নের কথা বলি না  
রাতভর রাত্রিচরা পাখিদের মতো 
উড়তে থাকি, উড়তে থাকি, উড়তে থাকি --
রাতের গহীনে, তোমার হৃদয়ের গহীনে।


১১.        চাই অমৃত শিউলি চন্দনে 

রাতের নির্জনতায় অন্তরমহলের দরজাটা 
খুলে দাও,
এই তো তুমি আছ তোমার মতো করে --
হৃদয় ভরে নিয়ে শিউলি আর চন্দনের গন্ধে ! 

সব দুঃখকে ভুলে দিতে পারো তুমি। 

আমি চাই বাগদাদের একটি রাত আর রাজস্থানের একটি সকাল,
যেখানে রাতের ভালবাসা শরাব আর 
সাকীতে বিভোর থাকে।

সকালবেলা ধ্বনিত হয় মীরা বাঈয়ের কণ্ঠে 
প্রভুর জন্যে গাওয়া গীত ও সংগীত ।


১২.     আমাদের ভালোবাসা 


নয়নে নয়ন রেখে দেখলাম তোমাকে, তুমি বললে অন্তরে দেখো।
অন্তরে অন্তর ছু্ঁয়ে ভালোবাসতে চাইলাম,
তুমি বললে বুকে তলে নাও।
বুকে বুক রাখতেই শীতের সকাল আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের লেলিহান ছড়িয়ে গেল দেহ থেকে দেহান্তরে। তুমি জ্বললে, আমাকেও জ্বালালে।  ছাই ভস্ম হয়ে দেহ দুটি এখন ছিন্ন তুলোর মতো আকাশে উড়ছে।

১৩.       পৃথিবীর ধূলির পথে


কোনো একদিন সব কোলাহল থেমে যাবে 
স্তব্ধ হয়ে যাবে বাতাসের বেগ দিগন্তে
মুখর পাখিরা এসে গাইবে না গান অলিন্দে বসে 
মৃতেরা যেয়ে  ঠাঁই নেবে মাটির গহ্বরে
সেদিন পাশে থাকবে না কেউ আর। 

আমার সমস্ত জীবন ভার
বেদনার সব ভার 
পৃথিবীর ধুলোর পথে বয়ে বেড়াবে না আর
হারাবে সমস্ত পথ তার অন্ধকারে
আমার প্রাণের প্রান্তে নৈঃশব্দরা উন্মাতাল হবে। 

কার হাতে দেবো তখন জীবনের ক্লান্তির ভার
সাদা কফিনের পাশে তোমরা কেউ উৎসব করো না
লোবানের গন্ধ উড়িও না বাতাসে
পৃথিবীর সমস্ত রোদ্র যখন ছায়ায় ভাসতে থাকবে 
প্রিয়জনেরাও শান্ত হবে তখন। 

সব পাপ প্রায়শ্চিত্ত হবে একদিন 
স্তব্ধ  হয়ে যাবে সব জনকলরোল
আত্মারা তখন উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকবে পুনর্জন্মের জন্য পৃথিবীর ধূলির পথে পথে 
আমারই আজন্ম ক্রন্দনধবনির মতো।


১৪.       আজন্ম প্রেমিক


আজন্ম প্রেমিক আমি, বুদ হয়ে থাকি আনন্দে,
আনন্দ আমার পূর্বপুরু্ষ থেকে পাওয়া অধিকার।

তুমি কি আনন্দ করতে পারবে ?
পারলে পারবে, না পারলে চলে যাবে
যেমন চলে গেছে পূর্বের অক্ষম সব প্রেমিকারা।

আমি তো ভিখারী রাঘব নই,
আমৃত্যু আনন্দ করা আমার অধিকার।


১৫.        ও ক্যাকটাস ও কুসুম


কুসুমের ক্ষুদে বার্তা 'ও' নেই, ( 'ও' মানে স্বামী,)
যদি আসো সাকীতে দেখতাম ক্যাকটাস,
বললাম-- ক্যাকটাসে তো কাঁটা আছে।

'ও' বলল -- ('ও' মানে কুসুম) তবুও আসো।

শীতের হাওয়ায় কুসুমের ওড়না উড়ছে,
ওড়নায় ঢেকে নেই বুক, ক্যাকটাসের কাঁটায় বিদ্ধ
ওখানে কেউ নেই, 'ও'- খানে আমার হাত
তারপর চুমো (চুমো'র শেষে 'ও' )।

বলদায় বইছে তখন নির্মল বাতাস, 
আনন্দ সাকীতে ক্যাকটাসের পাপড়ি আহত ও ছিন্নভিন্ন।

বিষণ্নতার ওড়না নেড়ে 'ও' (কুসুম) চলে গেল।


১৬.       গীতিময়


এমনই কনকনে শীতের দিনে এক কলেজ ফেরা বিকেলে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল  
পরনে ছিল তার লাল রঙের কামিজ, 
চুল ছিল বেণীখোঁপা বাঁধা, 
চোখে ছিল বিকেলের ছায়ার মতো নিঝুম মায়া , দেখেছিলাম তার রূপসজ্জাহীন নিরাভরণ মুখ,  ঐ মুখখানির মধ্যে ভুবনজয়ী ভালোবাসা  ছড়িয়েছিল...

জামতৈল স্টেশনে গরম চায়ের চুমুক দিয়ে আমরা রেললাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর., 
তারপর কুয়াশা নামলো, কুয়াশা ভেঙে 
আকাশে  চাঁদ উঠলো...পথের দু'ধারে বুনো গাছগাছালির পাতার গন্ধ! 

কত কথা হলো দুজনের
কত গান ভেসে গেল সন্ধ্যার বাতাসে, 
কত ছন্দ বাজল পায়ে পায়ে
আমরা সেদিন মিশতে পারতাম অনন্ত জোৎস্নায় ভিজে পূর্ণিমা প্রহরে
আমরা উড়তে পারতাম মুক্ত ডানার চিলের মতো  আকাশের নীলে
আমরা ভাসতে পারতাম রাজহংসের মতো উত্তাল ঢেউয়ের উপরে...

কিন্তু --
আমরা মিশিনি উন্মত্ত হয়ে অথৈ জোৎস্নায় 
আমরা উড়িনি মুক্ত ডানায় লক্ষ তারার নীড়ে
আমরা ভাসিনি বুঁদ হয়ে স্বেদ জলে...
আমাদের ক্ষণগুলো ছিল 
রবি ঠাকুরের ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থের কবিতার মতো গীতিময়। 


১৭.        তুমি স্বৈরিণী নও


পুরুষকে তুমি কি মনে করো ? পুরুষ মানেই মধুকর ?
তুমি স্বৈরিণী নও, ময়ুরাক্ষীও নও, তুমি প্রেমিকা
আমি চাইলেই স্ত্রৈণ হতে পারি না, তুমি পারো না স্বৈরিণী হতে,
আমরা যাই হই, স্ত্রৈণ কিংবা স্বৈরিণী
আমরা আসলে প্রেম বুভূক্ষু এক যুগল, ভালোবাসি প্রেম
যে প্রেম উৎসব করে দেহে, স্বর্গে কিংবা নরকে।


১৮.       তুমি এসো 


ঝুমঝুম পায়েলের শব্দ তুলে তুমি এসো। চুড়ির রিনঝিন শব্দ তুলে তুমি এসো। নিশীথ রাত্রির দ্বিপ্রহরে তুমি এসো। আমার ঘুমিয়ে পড়া দুচোখের স্বপ্নে তুমি এসো। 

আমার ঘুম ভাঙিয়ে তুমি দিও।
যদি চোখ ছোঁয়াতে চাও চোখে, তবে ছুঁয়ে দিও। 
যদি  চুমু দিতে চাও ঠোঁটে, চুম্বন দিও।
যদি আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরতে চাও, জড়িও।

যদি আরও কিছু চাও, তাও নিও
যদি ভাসতে চাও সমুদ্রে, ভাসিও। যদি চাও অমরত্ব, অমরত্বই তুমি নিও।

ভালো থেকো। ভালোবাসা নিও।


১৯.           স্বর্গের পথে আছি


দীর্ঘ পথ পায়ে মারিয়ে  পৌঁছতে পারিনি গন্তব্যে,
জীবনভর হাঁটলাম মাইল মাইল পথ । 
কিন্তু কোনও স্বর্গের পথ খুঁজে পাইনি আজও,
এখন কোথায় যাবো লুকিয়ে কোন্ নরকে?

আমার জন্য ঈশ্বর  তৈরি করেছিলেন একজন ধ্রুপদী রমণী --
যার চোখ মুখ আমার চোখে রং মাখে উজ্জ্বল তুলিতে,
কিছু সৌন্দর্যের ছ্বটা রয়ে যায় ভাবনায়, 
কিছু থাকে স্বর্গের পথে হারিয়ে যাবার জন্য--
আমি এখন সেই স্বর্গের পথে আছি। 


২০.       নিভে গেল আলো


আমাদের সম্পর্ক যখন ছিন্ন হলো, সব লেনদেন শুন্য করে যখন পথে নামলাম -- দেখি, পথ শুয়ে আছে মনখারাপ করে সমান্তরাল,
তাকে আমি ফেলে রেখে আসলাম স্তব্ধ অন্ধকারে 
কিংবা সেই নীভে দিল সব আলো। 

দুপাশের বৃক্ষরাজি শেষ শীতের রোদ্রে চৌচির করছে 
পাতা ঝরছে একটি দুটি করে টুপটাপ 
সব ছেড়েছুরে পথে নেমে আসলে পথও কী পর হয়?
কেমন নির্জনতা চষে বেড়াচ্ছে চারদিক 
পৃথিবীর বুক থেকে অজস্র রক্তক্ষরণ হচ্ছে অনবরত।

কোথাও পাখি ডাকে না, কোথাও মেঘের ছায়া নেই 
লতাচাপালি শুকিয়ে জড়িয়ে আছে ঝোপে ঝাড়ে
কৃষক ঋজু পায়ে গরু নিয়ে যাচ্ছে মাঠে 
কোথাও কোনো ঘাসফুল আজ ফুটে নেই পথের ধারে।

এর আগে এমন শুন্যতা দেখিনি কখনো 
এমন করে খেয়াল করিনি একাকীত্ব নিজের অস্তিত্বের ভিতর, এমন কান্নার ধ্বনি শুনিনি বাতাসে। 

আমি হেঁটে নদীর কাছে যাই, কেমন শীর্ণা শুষ্কতোয়া নদী , জলের শব্দ শোনার জন্য কূলে বসে থাকি, 
যদি ভরে ওঠে অথৈ হয়ে, যদি কুলকুল ধ্বনি বাজে ---
নিজের গোপন ক্রন্দনধ্বনি মিলিয়ে দেওয়ার জন্য 
কান পেতে থাকি নদীর দিকে...।


২১.       যদি বলো চলে যাও 


যদি বলো চলে যাও -
আমি চলে যাব ভোরের কমলা রোদ্দুর 
তপ্ত কাঠপোড়া হয়ে ওঠার আগেই। 

যদি বলো চলে যাও -
আমি চলে আসব নৈঋতে জমে থাকা মেঘের জলস্রোতে, ঈষাণের বায়ুর মতো দ্রুত বেগে, 
ঘাসের উপর ভোরের শিশির শুকিয়ে যাবার 
আগে। 

যখন চলে আসব -
কোথাও আমার শরীরের ঘ্রাণ রাখব না
ধুয়ে রেখে যাবো বিছানাপত্তর, আমার গায়ের ছোঁয়া  লাগা তোমার কাপড়ও। 

মুছে দিয়ে যাব সারা বাড়িতে আমার ফেলে রাখা পায়ের চিহ্ন, নামিয়ে ফেলব দেয়াল থেকে যুগল প্রতিকৃতি।

যদি বলো চলে যাও --
ব্যবহৃত তোয়ালে, টুথব্রাশ, পারফিউমের শিশি, তোমার দেওয়া অঙ্গুরীয়, হাতঘড়ি, ব্রেসলেট  সব ছুড়ে ফেলে দেবো, সরিয়ে ফেলব এ্যালবাম থেকে সমস্ত প্রণয় ছবি,
কোথাও কোনও অভিজ্ঞান রাখব না। 

তুমি চলে যাও বললেই -
ল্যাপটপে ডাউনলোড করা আমাদের প্রিয় গানগুলি ডিলিট করে দিয়ে যাব, যে গানগুলো শুনতাম মৌনতার কোনও বিকেলে ও সান্ধ্য অন্ধকারে।
পুরনো একটি চিঠিও তোরঙ্গে রাখব না, সব ছিঁড়ে ফেলে রেখে যাব।

আমাদের খুনসুটি, বিরাগ, অভিমান, আমাদের অপেক্ষা, প্রণয় উম্মাদনা, মধুময় আলিঙ্গন, কোনও কিছুই মনে গেঁথে নিয়ে যাব না, 
সব এই ঘরে তোমার কাছে  দগ্ধ ক্ষত করে রেখে যাব।

এই ঘরে রেখে যাব খা-খা শূন্যতা, উঠোনে পড়ে থাকবে ঝরা পাতা, 
তুমি জীর্ণ পাতা মাড়িয়ে হেঁটে হেঁটে খুঁজবে আমাকে, 
কোথাও পাবে না আামার অস্তিত্ব, আমার ঘ্রাণ, আমার উপস্থিতির ছায়া। 

যদি কখনও ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামে, থইথই জলের উঠোনে দাঁড়িয়ে তুমি একাকী ভিজবে, স্মৃতিরা ফিরে আসবে তোমার কাছে, কিন্তু আমি আসব না। মানুষ চলে গেলে মানুষ আর ফিরে আসে না। 


২২.        একটি এলিজি


মৌনতা দিয়েই ঢেকে থাক
তোমার মুখখানি 
বিস্মৃতির মেঘে ঢেকে যাক আকাশটিও।

প্রতিরাত বেঘোর ঘুমের মাঝে কোনো 
স্বপ্ন দেখা হয় না
শোনা হয় না আর কারোর গল্প কথাও।


২৩.        একাকী


একাকী ছিলাম, ভালো লাগত নদীর কূলের নির্জনতা
কৃষ্ণ যেমন বাঁশী বাজাত একাকী,
তেমনি আমার একাকীত্বের সুর ভাসত নির্মল বাতাসে।

একাকী ছিলাম,ভালো ছিলাম-
মায়া চোখে তাকিয়ে দেখতাম দূরের আকাশ
দেখতাম পঞ্চমীর চা্ঁদ, সেও একা
আলোয় ভিজতাম একাকী নদীর নির্জনতায়,
সেই একাকীত্বের ভালোবাসায় দুঃখ ছিল না
স্বপ্ন দেখতাম না কোনো আশা জাগানিয়ার।

এই শহর, এই কোলাহল, এই রাজপথ, এই অট্টালিকা
ল্যাম্প পোস্টের নীচে ধূসর এই অন্ধকার- ভালো লাগে না
ইচ্ছে হয়-দূরে কোথাও একাকী গিয়ে বসে থাকি-
বসে থাকি নির্জনতার সেই যমুনা নদীর তীরে।


২৪.        যে চলে যায় 


যে চলে যায় সে কোনো কারণ ছাড়াই চলে যায়
সন্ধ্যার দোলনচাঁপার রূপ সে দেখে না, রাতের অপরূপ তারামণ্ডল দেখে না, নিঝুম রাত্রির স্বপ্নগুলো দেখে না।

যে চলে যায় সে আরক্ত সুন্দর ঠোঁট দেখে না, চোখের নীচে আদ্রতা দেখে না, হৃদয়ের ভিতর কোমলগান্ধার দেখে না, বুকের মর্মরিত আলিঙ্গনের টান বোঝে না।

যে যায় সে অকারণে মাদল বেজে হাওয়ায় ভেসে যায়, অচিন পাখির মতো নীলিমায় উড়ে যায়, ক্ষমা করার অসীম মন বোঝে না, অনিঃশেষ ভালোবাসা বেঝে না।

যে চলে যায় সে কোনো গুমরি গুমরি ক্রন্দনধ্বনি শোনে না, দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনে না, ভোরের প্রার্থনা শোনে না, পিছুপিছু হেঁটে যাওয়ার পথচলার শব্দ  শোনে না।

যে চলে যায় সে ফতুর করে দিয়ে যায়, পথে পথে অনাদরের পদরেখা রেখে যায়, শরীর সুধাগুলো কেড়ে নিয়ে যায়, ভালোবাসার অভিজ্ঞান দলিত করে  যায়।

যে চলে যায় সে স্বপ্নের ঘরটি ভেঙে দিয়ে চলে যায়, স্বার্থপরের মতো নিজের পাওনা বুঝে নিয়ে যায়, তঞ্চকের ন্যায় পিছনের দিকে সে ফিরেও তাকায় না।


২৫.        স্টপ ইট


রূপবতী রমণীর কাছে যাসনে যুবক
ঐটি আত্মহণনের পথ, যাসনে ,স্টপ ইট!
রাতের নীলে নীলকণ্ঠ পাখি হোস নে
পাগলা মেহের আলী হয়ে বলিস না -
'তফাৎ যাও, দুনিয়া সব জুট হ্যায়।'
যুবক, তুই হেমন্তের সুর ছবি আর গান
বসন্তের ঐ ঘূর্ণী হাওয়ার ধুলি লাগাস নে 
ওখানে বিষের সাপ, ছোবল তুলে আছে
যাস নে ঐ রমণীর কাছে - স্টপ, স্টপ ইট।


২৬.    এখানেই নোঙ্গর 


বন্দরে জাহাজ দাড়িয়ে আছে ভেঁপু বাজিয়ে আমায় ডাকছে
তুমি এসে ধর আমর হাত তোমার হাতে। 
তারপর ...
জাহাজ সাগরের স্রোত ছুঁতে ছুঁতে চলে যাবে
অচেনা বন্দরে
অকূলে ভাসতে ভাসতে মনে হবে
দূরের ঐ বন্দর আমাদের নয়
তুমি তখনও ধরে আছ আমার হাত, মনে হবে এই জলধি আমাদের
এই জল আমাদের, এখানেই আমাদের নোঙর।


২৭.         সুপ্রভাত
                                                                          
কোনো একদিন ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে যাবে
মেলতে পারব না আর সে চোখ
শরীরের সব চেনা গন্ধ ঢেকে যাবে আতরে-
কর্পূরের সুবাস ছড়িয়ে দেয়া হবে কফিনে,
কবরে মাটি ঢাকা পড়তেই দেখতে পাবো না সূর্যাস্ত, দেখতে পাবো না মৌনতার আকাশ,
দেখতে পাবো না চাঁদ নক্ষত্র জোনাকীদের আলো।

উঠবে আবার সূর্য, শুরু হবে নতুন অন্যরকম আরেক জীবনের--
তখনও কী এমনই মায়া ছড়ানো কোনও ভোরে কেউ এসে বলবে না আর 'সুপ্রভাত'।


২৮.        শুভাশিস 

তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাও না, আকুলও হও না,   ভালবাসো না, অন্তর গৃহ তখন তোমার মৌনব্রত থাকে। 

তুমি আমাকে মনে রাখতে পারো আবার সহজে ভুলে যেতে পারো যেভাবে সন্ধ্যার তারা মেঘে ঢেকে রাখে। 

এত নিবিড় করে কেন এত প্রেম দাও, আবার কেন
তুমি দিতে  চাও জীবনের যত অজস্র  ঘৃণার লেশ?

অহং উল্লাসে কি এত সুখ পাও? হৃদয় দিয়ে হৃদয় পোড়াও, আমাকেও শেষ করো, নিজেও হও শেষ। 

কে আর আমায় দেবে অমৃত সুধা, কে আর আমায় বলবে ভালো থেকো, কে আর আমায় দেবে অভিশাপ। 

কে আর আমায় নেবে স্বর্গবাসে, কে আর আমায় দেবে শান্তি, কে আর আমায় দেবে মুক্তি নরকের যত পাপ।