বুধবার, ৩১ মে, ২০১৭

শুক্লা দ্বাদশীর দিনে

অনেক দিন আগের ফাগুনের এক শুক্লা দ্বাদশী রাতের কথা। তখন আমি পরিকল্পনা কমিশননের একজন তরুণ কর্মকতা। কমিশনের একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন জনাব এম,এ আজিজ। ওনার বাড়ী ছিলো ময়মনসিংহের গফরগাঁও এর নয়াবাড়ী গ্রামে। ব্যক্তিগত জীবনে উনি ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব গিয়াস উদ্দীন খান পাঠানের জামাতা। ওনার বাড়ীটি ছিলো আধুনিক জমিদার বাড়ীর মতো। অনেক কক্ষ বিশিষ্ট্ বড়ো দোতালা বাড়ী। বাড়ীর সামনে ছিলো শান বাঁধানো পুকুর। পুকুরের পাড় আর বাড়ীর সামনে জুড়ে ছিলো ফুলের বাগান। বিভিন্ন রকমের ফুলের সমারোহে পুরো বাড়ীটাই একটা গার্ডেন বলে মনে হতো। তাছাড়া বাড়ীর চারপাশে ফলের গাছও ছিলো।


জনাব এম,এ আজিজ সাহিত্য অনুরাগী, সাংস্কৃতিকমনা, ক্রীড়া অনুরাগী ও ভীষণ রকম আমুদে মানুষ ছিলেন। উনি ছিলেন  স্নেহ বৎসল একজন পিতার মতো। অনেক বড়ো কর্মকতা হয়েও আমাদের মতো জুনিয়র কর্মকর্তাদের উনি আপন করে নিতেন। অফিসিয়াল প্রটোকল অতো মানতেননা।  প্রতি ফালগুনের শুক্লা দ্বাদশীর দিনে ওনার বিভাগের একদল ছেলে মেয়ে কর্মকর্তাকে দাওয়াত করে বাড়ীতে নিয়ে যেতেন। দিনব্যাপী গান বাজনা ও আনন্দ হতো। পুকুরে মাছ ধরা আর খানাপিনা তো থাকতোই।

এমনি এক ফাল্গনের শুক্লা দ্বাদসীর দিনে আমরা ঢাকা থেকে দশ বারো জন ছেলেমেয়ে গিয়েছিলাম ওনার বাগান বাড়ীতে। আমাদের অফিসে একজন মেয়ে কর্মকর্তা ছিলো,ওর ডাক নাম ছিলো জয়িতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বৎসরের জুনিয়র ছিলো। পড়তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেই। মাঝে মাঝেই এই মেয়েটিকে কলাভবনের কোরিডরে কিংবা সেমিনার কক্ষে দেখতাম। কিন্তু কোনো দিন ওর সাথে কথা হয় নাই। অনেক মেয়েদের ভীড়ে এই মেয়েটিকে ভালোই লাগতো। কিন্তু ঐ ভালোলাগা পর্যন্তই। কাকতালীয় ভাবে এই মেয়ে আমার সহকর্মী হয়ে এসেছে।

অফিসে জয়িতার সাথে প্রতিদিনই দেখা হয়। এখানেও জয়িতা আমার জুনিয়র। পূর্বের বিশ্ববি্দ্যালয়ের রেশ ধরে সে আমাকে ভাই ডাকতো। এবং আপনি সম্বোধন করতো। জয়িতাকে আমি অফিসে প্রতিদিন দেখি । দেখি ওর টানা টানা চোখ, বাঁকানো ভ্রু। লম্বা স্ট্রেইট চুল, মাঝখানে সিঁথি করে পিছনে খোপা বাঁধতো। সুন্দর বাচনভঙ্গীতে কথা বলতো। হালকা পাতলা স্লীম বডি। ভালোই লাগতো জয়িতাকে।

বাড়ীতে এসে শুয়ে শুয়ে এমনি আলসে করে ভাবতাম। মনে হতো এই মেয়েটি যদি আমাকে প্রেম নিবেদন করতো ! কিংবা যদি ওকে ডেকে  বলতে পারতাম- 'জয়িতা, তোমাকে আমার ভালো লাগে, তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে ?' কিন্তু দ্বিধা করতাম। ভাবতাম যদি জয়িতা প্রত্যাখান করে ? যদি মুখের উপর বলে দেয় - 'না'। তাহলে তো আমাকে লজ্জা পেতে হবে। কিন্তু এইটাই মনে হতো আমার, জয়িতাই একদিন আমাকে বলবে- 'আপনাকে আমার ভালোলাগে, আপনাকে আমি ভালোবাসি।'


আজিজ সাহেবের বাগানবাড়ীতে আজ কেবলই আনন্দ। সবাই যে যার মতো আনন্দস্ফূর্তি করছে। কেনো জানি আমার মনটা অতো ভালো লাগছিলো না। পুকুরপাড়ে শান বাঁধানো ঘাটে খুঁজছিলাম জয়িতাকে। একবার মনে হলো জয়িতা গাঁদা ফুলের ঝাঁরে কেচি দিয়ে মালিনীর মতো পাতাগুলো ড্রেসিং করছে। পিছন থেকে আমি ওর সাথে কথা বলি, ওকে বলি- 'ফুল বাগানে তোমাকে মানিয়েছে ভালো।' আজ জয়িতারও কি মন খারাপ ? আমার  সাথে ঠিকমতো কথা বলছেনা যে।

বিকালে আমরা বাড়ীর বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কাজের মানুষেরা নাস্তা আর চা দিয়ে যাচ্ছিলো। এখানেও দেখি জয়িতা নেই। মনে হলো জয়িতা একাকী মন খারাপ করে শুয়ে আছে। একবার মনে হলো ওর রুমে যেয়ে ওকে ডেকে নিয়ে আসি। কিন্তু সবাই আমাকে কি মনে করবে ? এই ভেবে জয়িতাকে আর ডাকা হলোনা।

সন্ধ্যার পর আমাদের সেই কাঙ্খিত সময়টি এলো। আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ উঠলো। পুকুর পারে শান বাঁধানো ঘাটের কাছে বকুলতলায় বেঁতের চেয়ারে আমরা বসে আছি। বাঁশ ঝাঁরের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলো এসে ঝলমলিয়ে পুকুরের জলে পড়ছে। জোনাকীদের আলো ম্লান লাগলেও ভালো লাগছিলো ঝিঁঝিঁ পোকাদের গান। আমাদের অফিসের শর্মিলী দিদি গান গাইলেন-

'আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে বসন্তের এই মাতাল সমীরণে । 
যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে 
এই নিরালায় রব আপন কোণে। যাব না এই মাতাল সমীরণে।' 

আমাকে সবাই বললো কবিতা আবৃতি করতে। আমি আবৃতি করলাম-

'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে. কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
 আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,. আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,. 
এই সংগীত-মুখরিত গগনে. তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো। 
এই বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে. দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।'


গানে আর কবিতায় খুঁজছিলাম জয়িতাকে। আজ এই জ্যোৎস্না রাতে এতো সুর এখানে, এতো গান এখানে। এতো আলো ঝরছে ঐ চাঁদ থেকে। এতো তারা জ্বলছে দূরের ঐ আকাশে। আমার মন আকুল হলো জয়িতার কন্ঠে একটি গান শোনার জন্য। আজ এই রাতে, এই বকুলতলায় জয়িতা কোনো গান গাইলোনা। একাকী এক কোনে কোথায় পড়ে রয়েছ সে।

রাতে খেয়ে আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি, বারোটার দিকে আমরা শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম জয়িতার কথা। চোখে ঘুম আসছিলোনা । বাইরে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছিলো। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজও কানে আসছে। রাত ক্রমেই নিরব নিঃশব্দ হয়ে উঠছিলো। রুমের ভিতর দেয়াল ঘড়িতে রাত দুটো বাজার ঘন্টা বেজে ওঠে। তারও কিছুক্ষণ পরে বাইরে কার যেনো পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু দরজায় কোনো কড়া নারার শব্দ হলোনা। আমি ভয় পেলামনা, উঠে দরজা খুলে দেই। দেখি বাইরে বারান্দায় জয়িতা দাড়িয়ে আছে । ওর পরনে সিল্কের সাদা সালোয়ার কামিজ। আমি এগিয়ে যেয়ে বলি- 'এতো রাতে তুমি একা, আমার রুমের সামনে। কেউ দেখলে কি মনে করবে ?'

জয়িতা : দেখলে দেখুক,মনে করলে করুক।
আমি :  তুমি তোমার রুমে যাও। কাল ভোরে না হয় আমরা কথা বলবো।
জয়িতা : না আমি যাবোনা। আমার ঘুম আসছেনা। চলো আমরা ঘাটপাড়ে বকুল গাছের তলায় গিয়ে বসি।
আমি : চলো।

জয়িতা আমার হাত ধরলো। আমরা দু'জন হাতধরেই বকুল তলায় যেয়ে বসি। শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ অনেকটাই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। গফরগাঁও এর এই নয়াবাড়ী গ্রামের সারা প্রান্তর জুড়ে কেবলই জ্যোৎস্নার রোসনাই। জয়িতা আমার পাশে বসে আছে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে। ওকে দেখতে কিযে ভালো লাগছিলো। জয়িতা আমার কাধে মাথা রেখে বলছিলো- ' জানো আমি এমনি একটি চাঁদের রাতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই রকম শুক্লা দ্বাদশী চাঁদের রাতে তোমার বুকে মাথা রেখে বলতে চেয়েছিলাম- ভালোবাসি। ওগো, আজ তোমায় সেই কথাটিই বলছি- 'তোমাকে ভালোবাসি।'


পুকুরপাড়ে গাঁদা ফুলের গন্ধে ভরে উঠেছিলো। রাতের বসন্তের  ঝিরিঝিিরি বাতাস বয়ে চলছে, সাথে হাস্নাহেনার সুবাসে আকুল হয়ে উঠেছে পুকুরপারের বকুলতলা। আমি জয়িতাকে বুকে টেনে বলি- 'আমিও তোমাকে ভালাবাসি।'

ঘাট থেকে ঘরে ফেরার সময় কয়েকটি গাঁদা ফুল ছিঁড়ে তোড়া করে জয়িতা আমাকে দেয়। জয়িতা চলে যায় ওর রুমে। আমি চলে আসি আমার রুমে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরী হয়ে যায়। ঘুম ভেঙ্গে দেখি বিছানার এক পাশে জয়িতার দেয়া রাতের সেই ফুলের তোড়াটি পড়ে আছে। দেখে মনটা বেশ খুশী হলো। ফুলগুলো হাতে নিয়ে সুবাসও নেই। চিত্তটা আনন্দে ভরে উঠলো।

বিছানা থেকে উঠে বাইরে আসি। মনে মনে খুঁজতে থাকি জয়িতাকে। সবাই ঘুম থেকে উঠেছে। ওঠেনি কেবল জয়িতা। আরো কিছুক্ষণ পরে জয়িতাকে না দেখে শর্মিলী দিদিকে বলি- 'জয়িতা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি ?'
শর্মিলী দিদি বিস্ময়ে বলে- ' তুমি এসব কি বলছো ? জয়িতা তো আমাদের সাথে এখানে আসেই নাই।'






এ কি সত্য

এই জ্যোৎস্না মাধবী রাতে, ঐ নীল জলধি
আমাদের ডাকে
ঐ অতল তলে কিসের গান বাজে-
কি সুর ধ্বনিত হয় দীর্ঘশ্বাসে, বিসর্জন দিতে
মন চায় যে !
' অতুল মাধুরী ফুটেছে আমাদের মাঝে,. 
চরণে চরণে সুধাসঙ্গীত বাজে- এ কি সত্য।'.

পূর্ণিমা মাধবী রাতে

প্রতি নক্ষত্ররাতে প্রতি পূর্ণিমা রাতে
আমি ঘর হতে বেরিয়ে পড়ি-
চোখ মেলে দেখি বাইরের বিষন্ন জ্যোৎস্নার প্রান্তর
নিঝুম হয়ে ঘুমিয়ে থাকে ধানক্ষেত
স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে রাতের আকাশ
যমুনা নদীর জলে জ্বলে রুপালী ঢেউ
আমি প্রান্তরের পর প্রান্তর হাটতে থাকি
হাটতে হাটতে ক্লান্ত হই
সিদ্ধার্থের মতো মায়াহীন হয়ে পথ্ চলতে থাকি
আমার ক্লান্তির পদধ্বনি শুনতে পারেনা কেউ।

প্রতি নক্ষত্র রাতে নদীর কাছে ছুটে যাই
প্রতি পূর্ণিমা রাতে অরণ্যের কাছে যাই
প্রতি জ্যোৎস্না রাতে আমি পথে পথে হাটি
এমন পাগল করা পূর্ণিমা মাধবী রাতে
তুমি কখনো আমাকে বলবেনা- ভালোবাসি।

মঙ্গলবার, ৩০ মে, ২০১৭

ভিসন

নীচের ছবিটি আজ উত্তরা ৫নং সেক্টরের লেকের কূলে থেকে তোলা। ছবির এই  মেয়েটি স্নানের পর এইভাবেই তার পরনের মূল কাপড়টি রোদ্রে শুকাচ্ছে।

আমাদের সামনে ভিসন ২০২১, ভিসন ২০৩০, ভিসন ২০৪১।
আমাদের এইসব মেয়েরা তখন
'লাল দোপাট্টা মলমল' শাড়ি পড়ে ঘুরে বড়াবে।

তিলকে লাগে শিহরণ

তোমাকে বুকে জড়ালেই আকাশ রোদ্র আগুনে
জ্বলে ওঠে
টানটান হয়ে ওঠে মেঘ
যমুনার জলে আচমকা ঢেউ বেগ পায়
কাশফুল চণ্দনের মতো লাল হয়ে যায়-

তোমার গালের তিলকে লাগে শিহরণ
মেঘে মেঘে উড়তে থাকে খয়েরী ডানার চিল
সবুজ পাতার মতো এলোমলো হাওয়া এসে
তোমার শরীরকে মুগ্ধ করে-

বৃষ্টিতে লতা গুল্ম বৃক্ষ ফুল তখন প্রস্ফুটিত হয়
বাগানের ফুল ছিঁড়বার সময়ে আমি
প্রজাপতি হয়ে উঠি
তুমি তখন মৌমাছিদের গান শুনতে থাকো ।

গীতি কবিতা

তুমি আসলে- এমনই বাদল দিনে
তুমি ভাসলে- এমনই প্রেম কিরণে
এমনই ঝরঝর বর্ষণে
তুমি আমার অন্তর দোলালে।

কদম ফুলের আকুল করা গন্ধে
তুমি আমি বেঁধেছি যুথিবন্ধে
হৃদয়ের গোপন কথা
মাধুরী মিশায়ে তুমি শোনালে।

তুমি রাখলে- এমনই তারার পাশে
তুমি বাঁধলে- এমনই চাঁদের আশে
এমনই প্রাণের মায়াতে
তুমি আমার হৃদয় ভোলালে ।





সোমবার, ২৯ মে, ২০১৭

একটি গান

যদি আর কোনোদিন দখিনা বাতাস না আসে ঘরে
থাকবেনা বসে তুমি আর দুয়ার খুলে
সন্ধ্যাবেলায় কখনো হা্স্নাহেনা আর পড়বেনা ঝরে।

আমি হয়ে যাই রাতের একলা পাখি
তুমি ভুলে যাও ভরা নদীর জলের মতো ভিজিয়ে আঁখি
যদি আর আমায় না বাঁধো তোমার বুকের মায়া ডোরে।

হেমন্ত মাধবী রাতে যদি আর সুর না আসে তোমার গানে
আমার দীর্ঘশ্বাসে যদি ঝড় আনে।

যদি তোমার কর্ম অবসরে
ভালোবাসায় ভরে দাও দখিনা বাতাসের মতো উতলা করে
সে তোমার করুণা সে তোমারই প্রেমে বেঁধে রেখো মোরে।


রাজবাড়ী

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আমার একজন বন্ধু ছিলো। আমরা তখন কবি জসিমউদ্দীন হলে একসাথেই থাকতাম।বর্ষার ছুটিতে ওর সাথে একবার  মুক্তাগাছায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো রাজবাড়ী দেখার। সেদিন সকাল থেকেই কেমন যেনো ঝরোঝরো বৃষ্টি হচ্ছিলো। একটি রিক্সা নিয়ে আমি আর বন্ধু ইকবাল রাজবাড়ি দেখতে যাই।রাজবাড়ীর মূল ফটক বা সিংহ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে  রাজপ্রাসাদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ফটকের দুই করিডরের পাশে তিনটি করে মোট ছয়টি সিংহমূর্তি । সিংহ দরজা পেরিয়ে একটু এগোলেই খানিকটা খোলা জায়গা । আরেকটু এগোলেই চোখে পড়ে একটি মন্দির। মন্দির থেকে হাতের ডান পাশেই ফাঁসির ঘর। এখানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো অপরাধী এবং অবাধ্য প্রজাদের। এই ঘরের সামনে ছিল একটি বড় গর্ত, যা এখন ভরাট অবস্থায় আছে। এই গর্তেই ফেলে দেওয়া হতো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া লাশদের। গর্তের সঙ্গে ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের যোগসূত্র। জোয়ারের পানিতে ভেসে যেত ওই সব মানুষের লাশ। 
                                                                                                                                           

রবিবার, ২৮ মে, ২০১৭

সমর্পণ

আমি করতে চেয়েছিলাম সমর্পণ, তুমি করলে মায়া
আমি সকল মাধুরী দিয়ে করতে চেয়েছিলাম
রূপ সুধা পান
তুমি দূরে বহুদূরে বনছায়ায় চলে গেলে
ওখানে যেয়ে খূঁজলে নদী
'সুদূর কোন্ নদীর পারে, গহন কোন্ বনের ধারে
গভীর কোন্ অন্ধকারে হতেছো তুমি পার'।

পাহাড়ের কাছে নতজানু হয়ে দু'বাহু বাড়ালে তুমি
ধরতে চাইলে আমাকে
ছুঁইতে চাইলে আমার ছায়ামূর্তি, যেখান আমি নেই
মৃত্তিকার কাছে চাইলে আমার শরীরের ঘ্রাণ
তারপর তুমি চকিত আসন পাতলে ভূমিতে
তুমি আজন্ম তপস্যা করেও বুনতে পারোনি বীজ
ফলাতে পারোনি ফসল।

আমি আমার সকল প্রেম সমর্পণ করতে চেয়েছিলাম
যে ভূমিতে,সেখানে উর্বরতা নেই
এক অবিশ্বাস্য ধূলির মায়া নিয়ে পড়ে থাকলে
জলের প্রার্থনায় চিরকাল।



শনিবার, ২৭ মে, ২০১৭

বৃষ্টির গল্প

আমার আকাশে এখন মেঘ। এই মেঘকে তোমার
আকাশে পাঠিয়ে দিতে চাই
সব মেঘ জল হয়ে আমার এখানেই ঝরে পড়বে
ঘর অন্ধকার হয়ে থাকবে, সেই অন্ধকারে
আমাকেই একাকী বসে থাকতে হবে-
এ আমি চাইনা।
তুমি জানালে, তোমার আকাশেও নাকি মেঘ !
তুমিও নাকি বসে আছো,অন্ধকারে একাকী-
তুমিও তোমার মেঘকে আমার আকাশের
দিকে পাঠিয়ে দিয়েছো।
তোমার মেঘ আমার মেঘে এসে মিশে গেলো
মেঘে মেঘে ঘর্ষণ হলো, বজ্রপাত হলো-
তারপর বৃষ্টি নামতে লাগলো।
এ দিক থেকে আমি ঘর হতে বেরিয়ে পড়ি,
ও দিক থেকে তুমি
পথের মাঝখানে আমাদের দেখা হয়
শরীরের উপর ঝরতে থাকে অনবরত জল
সে জলে ভিজে দু'জন একাকার হয়ে যাই।

শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭

কতোদূর !

শাহবাগ থেকে হাইকোর্ট প্রাঙ্গন কতোদূর ?
কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইকোর্ট !
শাহবাগ ঘুমিয়ে গেছে রাতের প্রথম প্রহরেই
বিশ্ববিদ্যালয়ও জেগে নেই-
ছোট্র একটি মিছিল গেলো
তাও লাঞ্চিত হতে হলো পুলিশের হাতে দোয়েল চত্বরে।

যাক, তবুও কলংকমোচন করলো ছাত্র ইউনিয়ন
কেউ বলতে পারবেনা- ' প্রতিবাদ করেনি কেউ,
প্রতিরোধ করেনি কেউ।'
এই গৌরবের সংগঠনটি আমিও একদিন করতাম-
অভিনন্দন তোমাকে ! বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।

প্রাণ স্পন্দন

আমার হৃৎস্পন্দন প্রথম কেঁপে উঠেছিলো
তোমার প্রাণ স্পর্শে
তুমি প্রথম আগুন জ্বাললে কোনো এক
হেমন্ত রাতের মধ্য প্রহরে
প্রথম আগুনে পুড়েছিলো তার শস্য সবুজের মাঠ,
তারপর একদিন- শ্রাবনের মেঘে বৃষ্টি ঝরলো
মুঠো মুঠো প্রেম ছড়িয়ে গেলো দিগ দিগন্তে।
আমরা ঋদ্ধ হতে পেরেছিলাম দীর্ঘ তপস্যার পর
পোড়া মাটির গন্ধে আর মেঘ জলের স্রোত ধারায়।

বুধবার, ২৪ মে, ২০১৭

তারপরেও-

নীচের ছবিটি আজ সকালে উত্তরা ১৩ নং সেক্টরের লেকের ধারে পার্কে থেকে তোলা। কালো পর্দা দিয়ে আড়াল করে ভিতরে কয়েকজন মহিলা স্বাভাবিক কাপড় পরিধান করে অর্থাৎ বোরকা,হিজাব,শাড়ি ও সালোয়ার কামিজ পড়ে হালকা পাতলা জগিং স্টাইলে ব্যয়াম করছে। আমি এই দৃশ্যের কোনো সমালোচনা করছিনা। আমি বলতে চাচ্ছি আমাদের দেশের মেয়েরা এতো রাখ ঢাক করে চলেও ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে পারছেনা।

মন খারাপের ভোর

রাতের বেলা চাঁদ খুঁজেছিলাম। ঘুম ভেঙ্গে দেখি- জ্যোৎস্নার চাদরে শরীর ঢাকা নেই। রাতের সব ফুল নিঃশব্দেই ঝরে গেছে। কখনো কখনো তাই এমনি মন খারাপের ভোর হয়। চোখ মুদে কোথায় খুঁজি তারে ! 

হিমালয় কুইন এক্সপ্রেস

নব্বই দশকের মাঝামাঝির কথা। হরিয়ানার কালকা শহরেই আমার কাজটা ছিলো। এল/সি'র শর্ত অনুযায়ী আমদানীকারকের পক্ষে কালকা স্টেশনের কাছেই মালবাহি ট্রেনে গমের শিপমেন্ট পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলাম। স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী গম শিপমেন্ট করছে কিনা এইটাই দেখা ছিলো আমার কাজ। কলিকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে ক্যামাক স্ট্রীটে রপ্তানীকারকের অফিসে মিঃ পি.কে আগোরওয়ালের চেম্বারে বসে কফি খাচ্ছিলাম। উনি আমাকে বলেছিলেন-' দাদা, কালকাতে যেহেতু যাচ্ছেনই, পারলে ট্রেনে সিমলা থেকে ঘুরে আসবেন। খুব ভালো লাগবে।'

কালকাতে পাঁচ দিন ছিলাম,ভালোই লেগেছিলো হরিয়ানার এই ছোট শহরটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিলো স্বপ্নপুরীর মতো। আমি প্রায় সন্ধ্যায় শিখ উপসানালয় গুলোতে ঘুরতে যেতাম। দেখতাম আর মনে হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অবস্থিত গুরুদ্বুয়ারা নানক সাইয়ের উপসানালয়টির কথা। কালকা স্টেশনের কাছেই হোটেল উইন্ডক্রসে আমি থাকতাম। হাতে দুইদিন সময় ছিলো, ভাবলাম- সিমলাটা না হয় দেখেই আসা যাক। আমি সন্ধ্যায় হোটেল থেকে চেক আউট হই। টিকিট আগেই কাটা ছিলো। রাত দশটা দশ মিনিটে হিমালয়া কুইন এক্সপ্রেস ট্রেনটি কালকা স্টেশন থেকে ছাড়ে। গন্তব্য সাদা তুষারের শহর সিমলা।

সিমলাগামী রাতের ট্রেনে যাত্রী একটু কমই থাকে । আট সিটের একটি কেবিন কম্পার্টমেনট রুমে আমরা যাত্রী মাত্র ছিলাম তিনজন। আমার ঠিক অপোজিট রো'তে একজোড়া শ্বেত চামড়ার দম্পত্তি বসে আছে। কিন্তু তাদের সাথে ঐভাবে কথা বলার সুযোগ নেই।কালকা-সিমলা রেলওয়ে একটি ন্যারোগ্যাজ রেলওয়ে। এটি উত্তর পশ্চিম ভারতের কলকা থেকে সিমলা ভ্রমনের সবচেয়ে পর্বতময় একটি রেলওয়ে। উত্তেজনাপূর্ণ পাহাড়-পর্বত এবং ছবির মতন আশেপাশের গ্রামের জন্য এই রেলওয়ে বিখ্যাত। কিন্তু রাতের জার্নিতে সেই সৌন্দর্য , সেই উত্তেজনাটা পাওয়া যায়না। আর যার কারণেই রাতের এই হিমালয়া কুইনে আজ যাত্রী কম।

ব্রিটিশ ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী সিমলার সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য কলকা-সিমলা রেলওয়ে স্থাপিত হয়। সিমলা হিমাচল প্রদেশের রাজধানী এবং কলকা হরিয়ানা প্রদেশের পাঞ্চকুলা’র একটি শহর। পুরো ট্রেন রাস্তায় দুইধারে দর্শনীয় প্রকৃতি এর চোখ ধাধানো প্রকৃতির মাঝে এই রেললাইন, ভ্রমন পিপাসুদের আকর্ষন করে। ট্রেন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫৬ মিঃ উচুতে অবস্থিত শহর কলকা অতিক্রম করার পরপর ট্রেন পাহাড়ে পাদদেশের প্রবেশ করে এবং এর পরপরই ট্রেনটি পাহাড়ে চড়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।আমি একাকী একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম। কারণ একটু পরপর ট্রেনটি পাহাড়ের সুরঙ্গে প্রবেশ করতে থাকে। বাইরে তখন নিকষ কালো অন্ধকার । মনে হয় যেনো কোনো হরোর পাতালপুরী পাড়ি দিচ্ছি।

এই রুটটি কলকার সিভালিক মালভূমির বিভিন্ন স্থান যেমনঃ ধরমপুর, সোলান, কান্দাঘাট, তারাদেবী, সালগোরা, টটু, সামারহিল এবং সিমলা থেকে হিমালয়ের প্যানোরমিক ভিউ দেখা যায়, যা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন । কিন্তু রাতের আঁধারে আমি কোনো সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছিলামনা। ওপাশে শ্বেত কপোত কপোতীদের বেশ অন্তরঙ্গ অবস্হায় দেখা যাচ্ছিলো। ওদের কোনো হুস নেই যে, আমি একজন এ পাশে বসে আছি। নাইট জার্নির সাথে নাইট রাইডিং ভালোই করছিলো ওরা।

ট্রেনটা একসময় সোলান স্টেশনে এসে থামে। তখন রাত্রি সাড়ে বারোটা হবে। সোলান শহরটি ছোট সিমলা নামে পরিচিত। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি জুন মাসে সোলান শহরে শুলিনি দেবী’র পূজা হয় যার নাম অনুসারে শহরের নাম সোলান হয়েছে । রাতের সোলান স্টেশনটি খুব ভালো লাগছিলো। বোঝাই যাচ্ছিলো দিনের বেলা এই শহরটিকে ছবির মতো লাগতো। আমি স্টেশনের আলো ঝলমল প্লাটফরমের দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখলাম একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা আমার কেবিন কম্পার্টমেন্টে উঠলেন।এবং টিকিটের আসন মিলিয়ে ঠিক আমার সামনের সিটে মুখোমুখি বসে পড়লেন।

ট্রেন সোলান ছেঁড়ে আসে। কিছু দূর যাওয়ার পর ট্রেনটি আর একটি পার্বত্য সুরঙ্গে প্রবেশ করে। চারদিকে মনে হচ্ছে ভূত পেত্নীরা কাউমাউ করছে। এবার আর বেশী ভয় পাচ্ছিলামনা। কারণ আমার সামনে একজন বিগ বিউটিফুল ওমান বসে আছে। ট্রেনের লুকোচুরির আলো আঁধারিতে আমি ঐ মহিলাকে ফাঁকে ফাঁকে দেখছিলাম। ঠিক খারাপ কোনো দৃষ্টিতে নয়, শুধু কৌতূহল- মহিলা দেখতে কেমন ?

মহিলা ডীপ মেকআপ করেছে। মনে হলো মুখের দাগগুলো ঢেকে ফেলেছে ফাউন্ডেশন বেজ মেক আপে। চোখ অনেকটা স্মোকি স্টাইল করা। চোখে আর্টিফিসিয়াল ভ্রু এবং মাসকারা লাগানো। চোখের পাতায় বাদামি কালার হাইলাইট করা। ট্রেনের রাতের আলো আধারীতে ঠোঁটে গাঢ় ভাবে লাগানো পার্পেল কালারের লিপস্টিক চিকচিক করছিলো। মহিলার পরনে ছিলো ঘিয়ে রঙ্গের জর্জেট শাড়ি। স্লিভলেস ব্লাউজ, শাড়ি নাভীর অনেক নীচ পর্যন্ত নামানো। গলায় গোলাপী স্টোনের লকেটের নেকলেস। হাতে তার মুক্তাখচিত ব্রেসলেট। চুল পিছনে ব্যান্ড দিয়ে হালকা করে খোপা বাঁধা ছিলো। শাড়ি ব্লাউজে তাকে দারুণ আবেদনময়ী লাগছিলো। তার শরীরের খোলা অংশগুলোতেও বেজ মেকআপ করে লাবন্যময় করে রেখেছিলো। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো কোথাও কোনো পার্টিতে সে এ্যাটেন করতে গিয়েছিলো ।

উপত্যাকা আর পাহাড়ের পথে পথে ট্রেন চলছে। রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলছে হিমালয়া কুইন এক্সপ্রেস। ওপাশে শ্বেত মেয়েটা লোকটার ঘারের উপড় মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। লোকটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে পাহাড়ের ফাঁকে দিয়ে রাতের আকাশ। আমার চোখে ঘুম নেই। মহিলাও জেগে আছে। আমি ওনার সাথে প্রথম কথা বলতে দ্বিধা করছিলাম, কিন্তু ইচ্ছা করছিলো কথা বলতে। একটু সৌভাগ্যই বলতে হবে, উনিই প্রথম কথা বললো আমার সাথে। (ওনার সাথে কথা হয়েছিলো ইংরেজী আর হিন্দীতে। আমি এখানে বাংলা করে লিখলাম।)
মহিলা : আপনি কোথা থেকে এসেছেন ?
আমি : ঢাকা, বাংলাদেশ থেকে।
মহিলা: কোথায় যাচ্ছেন ?
আমি : এসেছিলাম কালকায় ব্যবসায়িক কাজে, যাচ্ছি সিমলায় ঘুরতে।
মহিলা : ও তাই।
আমি : এক্সকিউজ মী, আপনার নামটি একটু বলবেন ?
মহিলা : সায়নী সিং
আমি: আপনি কোথা থেকে এসেছেন ?
সায়নী : অমৃতসর, পাঞ্জাব। এখানে এসেছিলাম সোলান, যাচ্ছি সিমলা।
সায়নীর সাথে কথা বলে যেটা জানলাম, সে একজন শিখ ধর্মালম্বী। স্বামীর সাথে আন অফিসিয়ালী সেপারেশন চলছে। সে একটি বহুজাতিক কোম্পানীর আঞ্চলিক বিপনন ব্যবস্থাপক। সে অফিসিয়াল কাজেই সোলান এসেছিলো, এবং যাচ্ছে সিমলায়। ট্রেন চলছে, কখনো আঁকাবাঁকা পাহাড়ের গা ঘেসে, কখনো বিভিন্ন সেতু অতিক্রম করছে, কখনো বিভিন্ন সুরঙ্গ পাড়ি দিচ্ছে। ট্রেনটি তারাদেবী স্টেশনে চলে আসে। তখন সম্ভবতঃ রাত্রি তিনটা বাজে। দশ মিনিট দাড়িয়েছিলো ট্রেনটি। তারপর ট্রেন আবার চলতেে থাকে। কথা বলতে বলতে আমি সায়নীর বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। মনে হলো উনি খুব মিশুক। কথা আর গল্পে গল্পে সময়টা ভালোই কাটছিলো। সায়নী আমাকে বলেছিলো - 'তুমি কি সিঙ্গেল ?' আমি বলেছিলাম- 'না। আমি নতুন বিবাহিত।'

সায়নীর চোখে ঘুম নেই। দেখলাম সে একটি হার্ড ড্রীংসের বোতল বের করেছে। গ্লাসে ঢেলে তা সে পান করতে থাকে। ড্রীংস সে আমাকেও ওফার করে। আমি খেতে চাইনা, আমি বলি- আই এ্যাম নট হ্র্যাবিচুয়েটেড ইট।' কিন্তু সায়নী অনেকটা সম্মোহনের জাল তৈরী করে ফেলে। আমি ঠিক পুরোপুরী সজ্ঞানে নয়, সম্মোহিত হয়েই সুরা পান করি, সায়নী একটু বেশীই খাওয়াছিলো মনে হয় আমাকে। কখন সালগোরা আর টুটু স্টেশন দুটি পার হয়ে গিয়েছিলো আমি জানি নাই।

ট্রেনটি যখন সিমলা পৌঁছে, তখন সায়নী আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। ঘড়িতে চেয়ে দেখি সকাল সাতটা বাজে। আমি দিনের আলোয় চোখ মেলে দেখি সায়নীকে। আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম সায়নীকে দেখে। এই সেই রাতের আবেদনময়ী সায়নী ? যে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো, যে আমার স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিলো। এই তার চেহেরা ! মুখের এবং শরীরের বলিরেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখের নীচে কালচে দাগ। এক বিধ্ধস্ত বিগত যৌবনা বয়স্কা রমণী সে। ফল্স ব্রান্ড অন্তর্বাস পড়া। বয়স তার ষাট বাষট্রি হবে।
সায়নী, তার ব্যাগ ব্যাগেজ গুছিয়ে নেমে গেলো। যাবার বেলায় হ্যান্ডশেক করে বলে গেলো- 'তুমি সত্যিই খুব ভালো ছেলে। তোমাকে আমার মনে থাকবে। আবার দেখা হবে কোনোদিন।'



মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭

শূন্যতার গাঁথা

আমি তোমার ভালোবাসা পেয়ে ঐশ্বর্যবান হয়েছি। তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে থাকি। কতো যোজন পথ দূরে থেকে তোমাকে যে কাছে ডাকি । কতো জল চোখে ভরে  তোমাকে যে কাছে পাই। জীবনে জীবনে তোমাকেই যে আমি ভালোবেসে যাই।

আমার জীবনের কিছু পৃষ্ঠা খুলে পড়ে দেখো-
শুনতে পাবে সেখানে কেবল ঝরা পাতার
মর্মর ধ্বনির কথা
দেখতে পাবে সেখানে কেবল শূন্যতার গাঁথা।

সোমবার, ২২ মে, ২০১৭

গরম সমাচার

১. জৈষ্ঠ্য মাসের ভ্যাপসা গরম, চারিদিকে প্রচন্ড তাপ দাহ। শরীর ঘামছে। বিদ্যুৎও নেই, চলছে লোডশেডিং। এরই মধ্যে হোয়াটস্ আপে একজনের একটি ম্যাসেজ এলো- ' এই, কেমন আছো, কি করছো ?' আমি ছোট করে রিপ্লাই দিলাম- 'এই,ভালো আছি।'

২. বউ খাবারের জন্য টেবিলে ডাকছে। যেয়ে দেখি টেবিলে - নাজিরশাল চালের পান্তা ভাত। পাশে যে সব মেনু দেখলাম তাহলো- কয়েকটা গোল কাঁচা মরিচ, তেলে ভাজা কয়েকটা লম্বা শুকনো মরিচ, তিনটে ছিলানো পিয়াজ, পুঁইশাক দিয়ে মশুর ডাল মাখানি, ডিম মামলেট, ভেটকি মাছের ফ্রাই আর টাঁকি মাছ ভর্তা। কি আর করবো ? এই গরমের মধ্যে এইগুলো দিয়েই জম্পেশ করে পান্তা ভাত খেলাম।

৩. এসে দেখি, ম্যাসেঞ্জারে তখনো সবুজ বাতি জ্বলছে। হোয়াটস্ আপে ঐ মেয়েটাকে ম্যাসেস লিখে পাঠালাম- 'এই কেমন আছো, কি করছো ?'


একটি হাস্য রসাত্মক দুঃখ

অভাবের সংসার, নুন আনতে পান্তা ফুরোনের মতো অবস্থা। স্বামী স্ত্রীকে ডেকে বললো- 'আজ রাতে আমার একজন মেহমান আসবে। তাকে খাওয়াতে হবে।'

স্ত্রী :  ঘরে ডাল রান্না করা ছাড়া আর কিছুই নেই। আমার খুব লজ্জা করবে শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাওয়াতে।

স্বামী : চিন্তা কোরোনা, আমি তোমাকে একটা বুদ্ধি দিচ্ছি-  আমি আর আমার মেহমান বন্ধুটি যখন খেতে বসবো, তখন তুমি রান্না ঘরের মধ্যে একটি খালি পাতিল ফেলে দিয়ে শব্দ করবে। মুখ কাচুমাচু করে এসে বলবে - 'রুই মাছের তরকারীর পাতিলটা পড়ে ভেঙ্গে গেছে।' আমি তখন তোমাকে বলবো- ' তাহলে মাংস দিয়েই আমাদের খেতে দাও।' আবারও রান্না ঘরে যেয়ে তুমি আর একটি পাতিল ভাঙ্গার শব্দ করবে এবং কাছে এসে ভয়ে ভয়ে বলবে- 'মাংসের পাতিলটাও পড়ে ভেঙ্গে গেছে।' তখন আমি তোমাকে বলবো- 'তাহলে ডাল দিয়েই আমাদেরকে খেতে দাও।'

যথারীতি রাতে মেহমান আসলো। দুই বন্ধু খেতে বসেছে। রান্না ঘরে একটি পাতিল ভাঙ্গার শব্দ পাওয়া গেলো। স্ত্রী ভয়ে ভয়ে স্বামীর কাছে এসে কাচুমাচু করে বললো- ' ডালের পাতিলটা পড়িয়া ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।'


ডিসক্লেমেইয়ার :  থিম বিদেশী ই-ম্যাগাজিন থেকে পাওয়া। ভাষাটি সম্পূর্ণ আমার।

শনিবার, ২০ মে, ২০১৭

সান্তা মনিকা'র তীরে

মেয়েটির নাম কোভা ভেলহস্ট্রম। মা একজন তাইওয়ানিজ, বাবা সুইডিস। ছেলেবেলা কাটিয়েছে সুইডেনের স্টকহোম শহরে। বাবা স্ক্যান্ডিনেভীয় হওয়াতে ওর চোখ ছিলো নীল রংএর আর চুল ছিলো সম্পূর্ণ সফেদ সোনালী। আর মা তাইওয়ানিজ হওয়াতে ওর চেহারা দেখতে লাগতো মঙ্গোলীয় এশিয়ান। দ্বৈত জাতিসত্তার মিশ্রণ হওয়াতে কোভা একধরণের লাবন্যময়ী মেয়ে হয়ে উঠেছিলো।

হাই স্কুলের পড়া শেষ করে কোভা আমেরিকায় পারি জমায়। ওখানে নভোদা'র লাসভেগাস শহরে সে থাকতো। কোভা তখনো বিয়ে করেনি। তবে ওর একজন মেক্সিক্যান বয় ফ্রেন্ড ছিলো। কোভাও এসেছিলো লস এ্যাঞ্জেলসে হলিউড সিনেমা সিটিতে। ওখানে একটি 'হলিউড সিনে মেকআপ আর্টিস্ট্রী'র উপর এক মাসব্যাপি  প্রশিক্ষণ কর্মশালায় যোগ দিতে। আমিও যোগ দিয়েছিলাম সেই প্রশিক্ষণ কর্মশালায়। আর কোভার সাথে আমার পরিচয় সেখানেই।

ওয়ার্কশপে আমার পাশের আসনটি কোভার। প্রথম কথা বলাও সেখানে কোভার সাথে। ইনাস্ট্রাক্টর ছিলো হলিউডের বিখ্যাত মেকআপ আর্টিস্ট নেলী রেচিয়া। হয়তো সৌভাগ্যই বলতে হবে, ভারতীয় উপমহাদেশের বাদামি রঙ্গের কোনো একটি মুখকে খুঁজছিলো নেলীর চোখ।  ডেকে নেয় আমাকে। ত্রিশ মিনিটের একটি ওরিয়েন্টেশন মডেল হতে হলো আমাকে। চারদিকে অনেক স্লাইড স্ক্রীনে আমার মুখ রঙ্গিন আলোতে ঝলমল করছে। নেলীর অনুপম হাতের তুলি আর ব্রাশের ছোঁয়া তখন আমার চোখে মুখে। প্রথমদিনই এই রকম একটি বর্নীল অভিজ্ঞতা আমাকে ভীষনভাবে আপ্লুত করে।

কফি ব্রেকেও আমি আর কোভা পাশাপাশি থাকি। যদিও আমাদের পাশে দাড়িয়েছিলো কোরিয়ার সিউল থেকে আসা ইয়াংজু কিম আর ওয়াসিংটন ডিসি থেকে আসা মিলিশা উইনটার। সিগারেটের ওফারটা করে কোভাই প্রথম। প্রিয় ব্রান্ড মার্লবোরো লাইট। যদিও আমি খেতাম মার্লবোরো হার্ড। শুধু কোভার কারণে আমি পরে মার্লবোরো লাইট কেনা শুরু করি। বিকালে ওয়ার্কশপ শেষে আমরা দুজন এক সাথে উইলটার্ণ থিয়েটার বিল্ডিং-এর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসি। উইলশেয়ার বেল্যুভার্ডের ওয়াকওয়ে ধরে হাটতে হাটতে দু'জন মেট্রো স্টেশনের দিকে চলে যাই। রিফ্রেশ কর্ণারে দাড়িয়ে দুজন আবার সিগারেট খাই। এবার আমি ওকে সিগারেট ওফার করি। সিগারেট টানতে টানতে বলছিলাম- 'তুমি এখন কোন এরিয়ায় যাবে ?

কোভা :  কালভার্ট সিটি , সান্তা মনিকা।
আমি :  ওখানে কার কাছে থাকো ?
কোভা :  একটি ডরমেটরীতে, জাস্ট লাইক এ্য হোস্টল ।
আমি:   ওহ,তাই।
কোভা : তুমি কোথায় উঠেছো ?
আমি :  গ্রামের্সী প্লেস, ওটাও একটি হোস্টেল।
কোভা : খুব সুন্দর, কাল তোমার সাথে আবার দেখা হবে।
আমি :   ইয়েস,গুড ইভেনিং, বাই।
কোভা চলে যায় কালভার্ট সিটি,সান্তা মনিকার দিকে। আমি চলে আসি গ্রামের্সী প্লেসে।

সন্ধ্যায় গ্রামের্সীর খোলা গার্ডেনে রাখা একটি চেয়ারে বসে আছি। ভাবছিলাম আজকের প্রথম ব্যস্ত দিনটির কথা। ভাবছিলাম কোভার কথাও। কতো বন্ধুবৎসল মেয়েটা। কতো ভদ্র এবং বিনয়ী। এতো সুন্দর মেয়ে হয় ! ভাবছিলাম- আমার যদি সেই প্রথম যৌবনের দিনগুলি থাকতো, যদি আামার থাকতো সেই কুমারত্বের তারুণ্যের সময়, তবে সত্যিই এই মেয়ের প্রেমে পড়তাম। কিন্তু তা আর হলোনা, আমার ঘরে যে একজন মায়াবতী স্ত্রী আছে। যদি এই মায়াবতী না থাকতো তাহলে এই মেয়েকে নিয়ে লেখা যেতো এমনই একটি কবিতা-

তোমার ঐ নীলাভ চোখ ডুবে থাকে স্টকহোমের মায়াবী
সান্ডোম হৃদের নীল জলে
মেলোর্নের ঝিরঝির বাতাসে উড়ে তোমার সোনালী চুল
দেখতে তুমিও যদি তিব্বতী,
তোমার নাক আমাদেরই কূষ্ণের বাঁশির মতো
তুমি কথা বলো ভ্রু তুলে শুভ্র মেঘের মতো বাঁকা ঠোঁটে
ছোটো ছোটো হাসি ঝরে পড়ে মুক্তার ন্যায়
হঠাৎই মনে হয় তুমি আমাদেরই যমুনাপারের মেয়ে একজন,
যাকে আজ দেখে এলাম উইলটার্ন থিয়েটারের
আলো ঝলমল হল রুমে।

আমার সাথে কোভার কথা হয় প্রতিদিনই। প্রতিদিনই আমাদের আসন থাকে পাশাপাশি। আলোচনা,ওরিয়েন্টেশন, প্রজেক্টরে হলিউডের বিখ্যাত ছবিগুলোর বিশেষ অংশগুলো দেখা, বিখ্যাত ফ্যাশান ফটোগ্রাফারদের কাজের অভিজ্ঞতার কথা, মডেলস রাম্প মডেলস,আপকামিং মডেলদের ক্যাটওয়াক প্রদর্শনী দেখার ফাঁকে ফাঁকে আমি আর কোভা ছোটো ছোটো করে অনেক কথাই বলতে থাকি। বলি আমাদের এক অপরের অনেক ব্যক্তিগত কথাও।

একদিন  দুপুরে ম্যাকডোনাল্ডে বসে লাঞ্চ করছিলাম। আগেই শর্ত দিয়ে রেখেছিলো কোভা, পেমেন্ট সে করবে। আমরা বসেছিলাম স্বচ্ছ কাঁচের জানালার পাশে। মুখোমুখি নয় পাশাপাশি দুজন বসে আছি। সুপরিসর রাস্তার পাশে দেখছিলাম রোদ্রকরোজ্জ্বল বাইরের আকাশ। অনেক গাড়ী ছুটে চলছে, কোনো হর্ণ বাজছেনা, সব গাড়ী চলছে নৈঃশব্দে। কোভা বলছিলো- 'তোমার বউয়ের ছবি থাকলে আমাকে একটু দেখাও না ?' আমি আমার স্মার্ট ফোন থেকে আমার স্ত্রীর কয়েকটি ছবি বের করে দেখাই। ও খুব বিস্ময় চোখে দেখছিলো ছবিগুলি-
কোভা :  তোমার বউ তো বেশ সুন্দরী।
আমি :  হু
কোভা :  তোমার বউ কি করে ?
আমি :  সেও একজন বিউটি এক্সপার্ট। শি হ্যাজ বীন রানিং এ বিউটি সেলুন।
কোভা : তোমার দেশে আমাকে নিয়ে যাবে ?
আমি : যাবে তুমি ? তুমি যাবে, আর তোমাকে আমি নিবো না ?
কোভা :  তোমার বউকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
আমি : তোমার বয়ফ্রেন্ডকে দেখাও।
কোভা : দেখবে এই মেক্সিক্যান কাউবয়কে ?
আমি :  দেখাও।

কোভা ওর ফোন মিমোরী থেকে ওর ফ্রেন্ডের কয়েকটি ছবি বের করে দেখায় আমাকে । আমি ওকে বললাম- 'তুমি কি তোমার এই বন্ধুটিকে নিয়ে সুখী ? ' কোভা বিষন্ন মুখোয়বে বলেছিলো- 'না'।

রাতে হোস্টেলের বিছানায় শুয়েছিলাম। ঘুম আসছিলোনা চোখে। এর আগে ঢাকায় কথা বলেছিলাম প্রিয়তমা স্ত্রীর
সাথে। ওর সাথে কথা বললে পরের সময়গুলো ভালোলাগার চেয়ে খারাপই বেশী লাগে। পরের সময়গুলো দারুণভাবে ওকে মিস করতে থাকি। হোস্টেলের পিছনে রিক্রিয়েশন এরিয়াতে যেয়ে সিগারেট খাই। পরপর তিনচারটা স্টীক খেয়ে ফেলি। কোভার জন্য কেন জানি একটু মায়া হচ্ছিলো। মনে পড়ছিলো আজকের পড়ন্ত দুপুরে সেই বিষন্ন মুখখানির কথা-

এতো সুন্দর লাবন্যময় মুখে কোনো বিষন্নতা কি মানায় ?
জীবনতো পলে পলে উপভোগ করার কথা-
সব স্বপ্নের পাখীরা ডানা মেলে তোমার ভূবনে আসবে এইটাই সত্য,
কে সেই কাওবয় ? চিনতে পারেনি এই সারল্যে ঢাকা লাস্যময়ীকে-
লাসভেগাসের রাতের পথে পথে জ্বলে ওঠে নীল নীল আলো
তুমিওতো সে আলোয় নীল হয়ে যেতে পারো নিমিষেই
দুঃখও ভুলে থাকতে পারো সেখানে।


সেদিন ছিলো আমাদের হোস্টেলের থ্যাংস্ গিভিং ডে ডিনারপার্টি। হোস্টেলের মালিকান মিসেস সেলিয়া এই ডিনারপার্টির আয়োজন করেছিলো। কোভাও এসেছিলো সেদিন। ডিনারের মেনু ছিলো, Staffed Turkey, Gravy, Mashed Potatoes Cranberry Sauce, Mince Meat Pie, Soft and Hard drinks. আর ছিলো মিউজিকের সুরের মূর্ছনা। অনেক রাত পর্যন্ত কোভা সেখানে ড্যান্স করেছিলো, ঘুমিয়ে পড়েছিলো গ্রামের্সী হোস্টেলেই। হতাশার ছায়ার নীচে কোভার যে কোনো সুখ নেই, তা বুঝতে পেরেছিলাম আমি সেই রাতে।


একসময় আমাদের ট্রেনিং ওয়ার্কশপ প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যায়। দেশে ফিরবার দিনও কাছে চলে আসে। যেদিন ঢাকায় ফিরবো, তার আগের দিন বিকেল বেলা আমি আর কোভা সান্তা মনিকা বিচে চলে যাই। বিচ টার্মিনালের দোতালায় একটি মেক্সিক্যান রেস্টুরেন্টে বসে কিছু খেয়ে নেই। তারপর দু'জন সিগারেট ধরাই। পেমেন্ট আমিই করি। এরপর আমরা বালুকাবেলায় হাটতে থাকি। কখন কোভা আমার হাত জড়িয়ে হাটছিলো জানি নাই। তখন সুর্যাস্তের সময়। আমরা দাড়িয়ে আছি প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলের পাশে। সূর্য তখন ডুবে যাচ্ছিলো অসীম জলধি তলে।

আমি কোভাকে বলছিলাম- ' তুমি কি আমাকে ভুলে যাবে ?' কোভা আনত মুখ তুলে বললো- না, চির জনম ধরে 'না'। আমি দেখছিলাম ওর স্ক্যান্ডিনেভীয়ান নীল চোখে প্যাসিফিকের লোনা জল। কোভা আমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।

Standing here, Starring at the blue.
Thought and memories surfing one after one like waves,
Deeper than the deepest Pacific Ocean, at Santa Monica
In the calm presence of waves around me,
Finally, my heart is at peace.




                                                                                              

সেদিন নক্ষত্রলোকে

সেদিন রাতে আলো খুঁজছিলে তুমি
ডুবে যাচ্ছিলে অচেনা বৃত্তের অথৈ অন্ধকারে
শ্বাস নিতে পারছিলেনা তুমি
প্রগাঢ় নিঃশ্বাসে
কবরের নিরবতা নেমে এসেছিলো তখন
যেনো শ্মশানের আগুনে জ্বলছিলে একাকী।

তোমার সাথে সকল উষ্ণতা নেমে গিয়েছিলো
হিমাঙ্কের নীচে
সকল সম্পর্কও থেমে গিয়েছিলো নাভীর নীচে
চোরাবালির পথে
সকল প্রেম নির্মাণ করেছিলো তোমার জন্য
লখিনদারের বাসর
আমি একবার চন্দ্রালোকে তোমাকে খুঁজেছি
আরেকবার নক্ষত্রলোকে-

যদি তুমি আসো শীলাদেবীর ঘাটে অনেক বছর
আগের
কোনো এক হেমন্ত পূর্ণিমার মতো-
স্বচ্ছ করোতোয়ার জলে নেমে স্নান করবো
সকল ক্লেদ মুছে ফেলবো মহাস্থান গড়ের লাল
মাটি মেখে,

এসো প্রেমালোক জ্বেলে শুদ্ধ হই
শতো বছরের আলোকবর্তিকা জ্বলুক আমাদের প্রাণে
কখনো চন্দ্রালোকে,কখনো নক্ষত্রলোকে-
কখনো পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ভেসে
কখনো অমাবেশ্যার নিঁশুথি অন্ধকারে।



শুক্রবার, ১৯ মে, ২০১৭

চাই ভার্জিন

বন্ধুর জন্মদিনে উপহার খুঁজিস ভার্জিন মেয়ে !
ঘরে তোর বোন আছে দিতে পারবি তাকে ?
না,পারবিনা,আমিও তোকে দিতে বলবো না
কারণ, আমি তোর বোনকেও শ্রদ্ধা করি-
তোর ঐশ্বর্য আছে তুই নস্ট করতে পারিস ভার্জিন
তোরও তো মা আছে, তুই শুয়োর, একটি হারামজাদা
তোকে এসবের বাচ্চাও বলতে পারতাম, তা বলবোনা
কারণ,আমি যে তোর মাকেও শ্রদ্ধা করি-
কার্তিকের কুত্তার মতো ভূগভূগ করিস লোকালয়ে
কিনতে চাস ভার্জিন ? স্পর্ধা তোর বাপেরও,
তোর সমস্যাটা কোথায় ? ঐ উত্থিত শিশ্নে ?
আয় তোকে বৃহন্নলা করে দেই, তোর বাপকেও-
সোনা আছে, ক্ষমতা আছে, বিচার কিনবি ?
খতমও করাস,আবার মোনাজাতও হয়
কি বিচিত্র দেশ আমার ! মসজিদেও প্রার্থনা হয় !
শুয়োর, এসব করে পার পাবিনা, এ আমার বিশ্বাস।


,

বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০১৭

না থাকলে নৈঃশব্দ।

কাল রাতে তোমার পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়,
তুমি থাকলে শব্দ হয়, না থাকলে নৈঃশব্দ।
কাল রাতে দেখি রাত ঝুম ঝুম বূষ্টি, তুমি থাকলেই বৃষ্টি হয়,
না থাকলে মেঘ।
রাতের শেফালীকে ঘুমিয়ে যেতে দেখেছি- 
তুমি ঘুমিয়ে থাকলেই আমাকে জেগে থাকতে হয়
সে এক ঘুমহীন,স্বপ্নহীন, দুঃসহবাস।

বুধবার, ১৭ মে, ২০১৭

ভালোবাসি

সেই কবে একদিন প্রথম বৃষ্টির ফোটা এসে
পড়েছিলো পৃথিবীর মৃত্তিকার উপর
সেই কবে প্রথম চাঁদ উঠেছিলো-
সেই কবে প্রথম জ্যোৎস্নার কনা এসে লেগেছিলো
পাহাড়ের শৈবালে,
সেই কবে প্রথম আগুনে পুড়েছিলো সভ্যতা
সেই কবে কে প্রথম একাকীত্তের ঘুম
ভাঙ্গালো আমার-
সেই কবে কে প্রথম বলেছিলো- ভালোবাসি।


আজকের সকাল

বাড়ীর বারান্দায় দাড়িয়ে দেখে এলাম সকালের আকাশ। কেমন যেনো মেঘ গুরু গম্ভীর।
তুরাগ নদীতে বইছে শীতল বাতাস। সে বাতাস এসে লাগলো আমার গায়ে।
পাশের দয়িতার এখনো ঘুম ভাঙ্গে নাই,
আঙ্গিনার গন্ধরাজ ফুলটিও ভিজে আছে রাতের বৃষ্টির জলে।

বুঝতে পারছি আজকের সকাল কবিতা লেখার নয়।
আজকের সকাল শুধু ভালোবাসবার।

সবাইকে সুপ্রভাত।

আমার ঘর নেই

সন্ধ্যার এই মেঘ গুরুগম্ভীর বৃষ্টির ধারা আমাকে
কোথায় নিয়ে যায় ?
যেখানে আমাকে নিয়ে যায় সেখানে আমার ঘর নেই
গ্রীস্মের ঘরের এই ছাদ ফুঁড়ে নামে অলৌকিক বূষ্টি
তোমার নাভীতলের নদীতে আমি ডুবে আছি
শৈশবের হারানো কাগজের নৌকাটি এখন দুলছে।

হে জল হে বৃষ্টি তুমি আজ এই মাটির কথা শোনো
এই মাটি এখানে শুষ্ক চৌচির হয়ে আছে
সাঁওতাল মেয়েরা নদী থেকে জল আনতে ফিরে আসে
পোকা মাঁকড় সরীসৃপও উঠে আসে মাটির তল থেকে-
এই মাটি  সুজলা হোক
এই ফসল সুফলা হোক
সাঁওতাল মেয়েরা দল বেঁধে যাক নদীর পারে
রুপালী মাছেরা সাঁতার কাটুক জলের গভীরে।

আমি জানি এ জল কখনো আমার হবেনা
এই নদীতেও হবেনা আমার ঠাই
এই মাটির সোদা গন্ধেও ভরবেনা মন
সাঁওতাল মেয়েরা কেউ প্রেমিকাও হবেনা।

প্রেমিক ঈশ্বরই জানেন কোথায় আমার ঘর
কোথায় আমার জল, কোথায় আমার নদী।

মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০১৭

অরুন্ধতি,অমরাবতি

অরুন্ধতি,অমরাবতি-  সবাই নিন্দা করে করুক
আমি তোকেই ভালোবেসে যাবো
ঐযে উজ্জয়নীর পর্বত শৃঙ্গে শ্বেত শুভ্র বরফরাশি
আমি ঐ বরফ জলে বার্তা পাঠিয়েছি তোর কাছেে
তুই কি ভেজাতে পেরেছিস তোর উন্মাতাল ঠোঁট
নীল পাথরের বুক ? নাকি পাষাণি তুই।

যন্ত্রণা যদি হয় হোক
ক্ষরণ যদি হয় হোক
অরুন্ধতি,অমরাবতি-  প্রাচীন সভ্যতার মৃত্তিকাতলে
সেখানে কেবলই পোড়ামাটির গন্ধ ভাসে
বনমল্লিকায় ওঠে শুক্লা একাদশীর চাঁদ
শরীর পোড়ে তার শুকনো ঘাসের নীচে,
প্রাসাদের সমান দুঃখ সেখানে
উজ্জ্বল প্রখর দৃষ্টি টানে তোরই দিকে
নিন্দুকেরা যতো নিন্দাই করুক, আমিতো তোকেই
ভালোবাসি।

বেত্রবতীতে এখন আর সেই জল নেই
চোখের জলেও ঢেউ উঠেনা ঈশাণের বাতাসে
কোশাম্বীর উপত্যাকায় নেই কোনো স্রোতধারা
ত্রস্ত জল পিপাসু হরিণের মতো তোকেই ডাকি
উন্মূখ দৃষ্টি মেলে দেখি তোরই আনত গ্রীবা
এখনো ঘুঙ্গুরের শব্দে মূর্ছণা হয় তোর পদধ্বনিতে।

অরুন্ধতি,অমরাবতি- নিন্দুকেরা যাই বলুক,
আমি তোকেই ভালোবাসি।

সোমবার, ১৫ মে, ২০১৭

কোন্‌ অচিনপুরে

তিন মাস হাসপাতালে থাকার পর আজই বাসায় ফিরেছে নাজমা। বাসায় এসে দেখে সব এলোমেলো। তার সাজানো সংসার যেভাবে সাজিয়ে রেখে গিয়েছিলো, আজ এসে দেখে তা আগের মতো আর নেই। আলনায়  কোনো কাপড় ভাজ করা নেই। ময়লা করে একটার উপর আরেকটি কাপড় এলোমেলো করে রেখে দিয়েছে । বিছানাটাও পরিপাটি নেই। ঘরের মেঝের কোণে কোণে ময়লা জমে আছে। রান্না ঘরের মেঝেতে মাছি উড়ছে। ময়লার ঝুঁরির ভিতর বাসি খাবার পড়ে আছে। হাঁড়ি পাতিলগুলো ঝকঝকে নেই। এলোমেলো এসব জিনিষ দেখতে দেখতে নাজমা কেমন যেনো হাঁপিয়ে উঠছিলো। শরীরটাতে ক্যামো দেওয়ার কারণে এমনিতেই দূর্বল ছিলো। কোনো কিছুই ভালো লাগছিলোনা। হাত পা কাঁপছিলো। ওর এই অবস্থা দেখে ওর স্বামী ওকে হাত ধরে ভিতরে বিছানায় নিয়ে শোয়ায়ে দেয়।

নাজমা'র চার মাসের বাচ্চাটি পাশের রুমে দোলনায় ঘুমাচ্ছে। নাজমা ওর স্বামীকে বলে- 'মর্জিনাকে বলো, বাবুকে একটু আমার কাছে নিয়ে আসতে।' মর্জিনা যখন বাবুকে নিয়ে আসে তখনো ওর ঘুম ভাঙ্গে নাই। বাবু'র জামাটি ফিডারের দুধে ভিজে আছে। ফিডারের নিপলটা পুরোনো দুধের গন্ধে ভরে গেছে। বাবুর চোখে কোনো কাজল নেই। কপালে কোনো কালো টিপ নেই। নাজমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগুলো দেখছিলো , আর বিষাদে ছলো ছলো হয়ে উঠেছিলো ওর চোখ ।

আজ থেকে দেড় বছর আগে এক বসন্ত দিনে নাজমার বিয়ে হয়। মধুরতম এক ভালোবাসায় সাজিয়ে তোলে নিজের ঘর। আহ্লাদের জীবন ছিলো তার প্রতিদিন। বিয়ের পর প্রিয়তম স্বামীর সাথে কতো জায়গায় সে ঘুরেছে। কতো প্রান্তর ,কতো পথ যে দু'জন হাতে ধরে হেটেছে। কতো বনছায়া তলে তারা একান্তে বসে থেকেছে, কতো নদীর কূলে তারা জলের গান শুনেছে। তারা বেড়িয়েছে পার্বত্য শৈল পাহাডে, আবার গিয়েছে কখনো সাগর বালুকাবেলায়।


তারপর একসময় বাবু পেটে এলো। একদিন সন্ধ্যারাতে সিজারে পেট উন্মোচন করে একটি রাজপুত্র এই পৃথিবীতে নিয়ে আসা হয় । ঠিক তারপরেই জানা গেলো মরণ ব্যাধি ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। তারপরেই তার সাজানো ঘর এলোমেলো হতে থাকে। তিনমাস হাসপাতালে থেকে আজই নাজমা তার ঘরে এলো। এসে দেখতে পাচ্ছে বারান্দায় ঝুল জমে আছে। বাড়ীর উঠোনের ঘাসগুলো বড়ো হয়ে গেছে। ঘরের ভেন্টিলেটরের ফাঁকে চঁড়ুই পাখী এসে বাসা বেঁধেছে।


আসলে ডাক্তার তাকে তিন দিনের জন্য হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়েছে। তিনদিন পর তাকে আবার নিয়মিত ক্যামো দেওয়ার জন্য হাসপাতালে ফিরে যেতে হবে। নাজমা একটা ব্যাপার পুরোপুরি জানেনা, সে বাঁচবে মাত্র আর জোর একমাস। ঠিক তিনদিন পর একদিন বিকালে হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স এসে বাড়ীর গেটে থামে। নাজমাকে যখন এ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হয়, তখন বাবু তার কোলেই ছিলো। সে দেখছিলো বাবুর মুখ আর ফিরে ফিরে দেখছিলো স্মৃতি বিজড়িত বাড়ীর আঙ্গিনাটি।

একদিন হাসপাতালের বেডে নাজমা শুয়ে আছে। তার শিয়রে স্বামী দাড়ানো।নাজমার প্রাণ নিঃশেষিত প্রায়। শরীরের সব মাধূর্য শুকায়ে গেছে। স্বামীর দিকে নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে নাজমা বলছিলো- 'ওগো আমি চলে গেলে তোমাকে দেখবে কে ? বাবুকে দেখে রাখবে কে ?' স্বামী ওর কপালে হাত বুলিয়ে বলেছিলো - 'তুমি ভালো হয়ে যাবে, তুমিই দেখবে।'

কিন্তু নাজমা আর ভালো হয় নাই। ঠিক একমাস পর একটি লাশবাহি গাড়ি বাড়ীর গেটে এসে থামে। এবার আর ওকে ঘরের ভিতর নেওয়া হলোনা। ঘরের বাইরে থেকেই ওকে সৎকার করে কবরস্থানে মাটির ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

তারপর অনেক দিন চলে গেছে। নাজমার সাজানো সেই ঘর এখনো এলোমেলোই থাকে। এখনো বারান্দায় জমে থাকে ঝুল । এখনো ঘরের আসবাব পত্রে ধুলোবালি পড়ে আছে। আলনায় কাপড় চোপর থাকে এলোমেলো। ঘরের চারদিকে চঁড়ুই পাখীরা এসে আরো বেশী করে বাসা বেঁধেছে।

নাজমার আদরের  খোকনসোনা প্রায় সময় অনাদরে দোলনায় শুয়ে থাকে। প্রায়ই ও কান্না করে। ওর কান্নাভেজা চোখ মাকে খুঁজে বেড়ায়। গৃহকর্মী মর্জিনার আদর অনেক সময় নিতে চায়না। নাজমার স্বামী প্রায়ই একাকী, কখনো বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বাড়ীর আঙ্গিনায় পায়চারী করে। অনেক অন্ধকার রাতে বাড়ীর বারান্দায় ইজি চেয়ারে একাকী বসে থাাকে।  নিঃসঙ্গ চিত্তে  কোনো দিন চাঁদের রাতে দূরে তারার মাঝে খুঁজে বেড়ায় তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখখানি। অ্ন্তরের মাঝে তখন বিষাদের সুর বেজে ওঠে । কোথা থেকে এই গানটি যেনো ভেসে আসে -

দূরে কোথায় দূরে দূরে. আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে। 
যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে. 
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্‌ অচিনপুরে।


















রবিবার, ১৪ মে, ২০১৭

শোনাও প্রাণে প্রাণে

সেদিন ছিলো শ্রাবন মাসের এক সকাল। হঠাৎ শোনা গেলো ডিস্ট্র্রিক বোর্ডের রাস্তার পাশে আমাদের বাজারে পাকসেনারা এসে জড়ো হয়েছে। খবর শুনে বেশীর ভাগ তরুণ,তরুণী,যুবক,যুবতী,মধ্যবয়সী মানুষ ও বৌঝিরা নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়। পাকসেনাদের মুল টার্গেট ছিলো হিন্দু পাড়া এবং বেছে বেছে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ী। পাকসেনারা পুরো হিন্দু পাড়া জ্বালিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগ সমর্থক ছিলেন আমার এক চাচাতো ভাই, তার বাড়ীটিও জ্বালিয়ে দেয় পাকসেনারা ।

তান্ডব শেষে পাকসেনারা একসময় ফিরে চলে যায়। আস্তে আস্তে ফিরে আসতে থাকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়া গ্রামের মানুষগুলো। তারা দেখতে পায় অনেক বাড়ীঘর তখনো ধাউ ধাউ করে জ্বলছে। যে যেভাবে পারে আগুন নেভাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ততোক্ষণে জ্বলে পুড়ে সব ছারখার হয়ে গেছে। পুড়ে ভস্মিভূত হয়ে গেছে ঘরের টিন,কাঠ,আসবাবপত্র ও পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে গোলাঘরে রাখা ধান, চাল অন্যান্য ফসল। বাতাসে তখন পোড়া ধান চাউলের গন্ধে ভাসছে। পোড়া বাড়ীর মানুষদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ওরা যাবার সময় হত্যা করে ফেলে রেখে যায় ময়নাল হক ও  জেলে পাড়ার সন্তোষ মাঝিকেও।

এখন যে ঘটনাটি বলবো সে ঘটনাটি অনেকেই জানেনা। দু'একজন জানলেও মানবিক কারণে তা এখনো গোপন করে রেখেছে। আমার চাচাতো ভাই ছিলেন একজন এলএমএফ ডাক্তার। তার বাড়ীটিও পাকসেনারা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আমার তখন কৈশর বয়স। ঘটনাটি সেদিন জানি নাই। পরে শুনেছি। আসুন,ঘটনাটি না হয় ডাক্তার সাহেবের মুখ থেকেই শোনা যাক-:

''বাইরের একটি অতিথী ঘর পাকসেনারা অক্ষত রেখেছিলো। রাতে সেই ঘরেই আমি শুয়ে আছি। চারদিকে পোড়া সব জিনিষের গন্ধ। চোখে ঘুম আসছিলোনা। রাত তখন এগারোটা হবে। দরজায় আস্তে করে কড়া নারার শব্দ শুনতে পাই। আমি উঠে দরজা খুলে দেই। দেখি দড়জার সামনে আমারই গাঁয়ের এক লোক দাড়িয়ে আছে। তার মুখ অত্যন্ত বিমর্ষ। সে বলে- 'আমার মেয়েটার অবস্থা খুব সংকটাপূর্ণ। তোমাকে একটু যেতে হবে।' আমি আমার ডাক্তারী ব্যাগটা হাতে নিয়ে তার বাড়ীতে চলে যাই। দেখি মেয়েটি অর্ধচৈতন্য অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে। কাঁথা রক্তে ভিজে গেছে। আমি বললাম- কখন থেকে এ অবস্থা ? লোকটি বললো- দুপুর থেকেই। পাকসেনারা চলে যাবার পর থেকেই। প্রথমে রক্ত কম ঝরছিলো, ক্রমেই রক্তপাত বাড়ছে। ভেবেছিলাম, ভালো হয়ে যাবে কিন্তু হয়নাই। লজ্জায় এতো সময় তোমাকে ডাকিনি।'

মেয়েটির বয়স কতোই হবে, তেরো চৌদ্দ বছর। আমি ঐ লোকের স্ত্রীকে বললাম- ' লন্ঠনের আলোটি একটু তুলে ধরো।' ওর কাপড়টি সরাতে হবে। আমার কথা শুনে অর্ধচেতন মেয়েটা নিজেই পায়জামার ফিতা খুলে দেয়। মেয়েটি অনেকটা অবচেতন হয়েই আমাকে ওর ক্ষত জায়গাগুলো দেখাতে থাকে। মেয়েটি এতো বেশী ধর্ষিত হয়েছে যে, আমি দেখে নিজেই শিউরে উঠি। আমি সারারাত জেগে থেকে আমার সকল প্রচেষ্টা দিয়ে ওকে অনেকটা ভালো করে তুলি। সকালবেলায় ঘরের জানালাটা খুলে দিতে বলি। সূর্যের আলো মেয়েটির গায়ে এসে লাগে। ততোক্ষণে ওর রক্তক্ষরণও বন্ধ হয়ে গেছে।''


সবার মনটা কেমন যেনো ভারী করে দিলাম মনে হয়। আসুন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা' র কন্ঠে একটি মঙ্গলের গান শুনি-

'সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, 
শোনো শোনো পিতা
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে 
মঙ্গলবারতা
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, 
সদাই ভাবনা
যা-কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা
সুখ-আশে দিশে দিশে বেড়ায় কাতরে–
মরীচিকা ধরিতে চায় এ মরুপ্রান্তরে ।'


_______________________________________________________________________

ডিসক্লেইমার :   অনুগ্রহপূর্বক, কেউ ধর্ষিত সেই মেয়েটির নাম,ধাম,পরিচয় আমার কাছ থেকে জানতে চাইবেন না। এমনকি তার বর্তমানে অবস্থানও। ধন্যবাদ।

শুক্রবার, ১২ মে, ২০১৭

কে সেই জন

আমরা তিনজনই সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। তিনজনই খুব ভালো বন্ধূ ছিলাম, আমি,গিয়াস এবং রিমি। কলাবাগানে একটি টিনসেড বাড়ীর একটি রুম ভাড়া নিয়ে আমি আর গিয়াস থাকতাম। রিমি থাকতো জিগাতলা মোড়ে ওর খালার বাসায়। ক্লাসে আরো ছেলেমেয়ে ছিলো, তাদের সাথে বন্ধুত্ব হলোনা, বন্ধু হলাম আমরা তিনজন, রিমি, গিয়াস আর আমি।

রিমি যেদিন ক্লাশে আসতোনা সেদিন খুব মন খারাপ লাগতো। ক্লাশ করতেও মন চাইতো না। এক দুই ক্লাশ করে চলে যেতাম বাসায়। শুয়ে থাকতাম বিছানায়। তারপর চোখে ঘুম আসতো এবং ঘুমিয়ে যেতাম। যখন ঘূম ভাঙ্গতো তখন দেখতাম সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গিয়াস ততোক্ষণে চলে আসতো এবং বলতো - 'তুই কি রিমির জন্য মন খারাপ করে থাকিস ?'
আমি :  হে।
গিয়াস :  তুই কি রিমিকে ভালোবাসিস ?
আমি :  না।
গিয়াস : দুপুরে কিছু খেয়েছিলি ?
আমি : না ।
গিয়াস :  চল কালা চাঁদের হোটেলে যেয়ে কিছু খেয়ে আসি।
আমি :  চল্।

সেদিন একাউন্টিং ক্লাশের স্যার আসেন নাই। আমরা তিনজনেই মিরপুর রোডের 'চিরোকী'তে বসে আ্ড্ডা দেই। আমাদের তিনজনের মধ্যে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিলো। অনেক গল্প করেছিলাম তিনজনে। না বলা অনেক কথাও হয়েছিলো আমাদের মধ্যে। বলেছিলাম- কলেজ পড়া শেষ হলে কে কোথায় চলে যাবো,  কে কোথায় পড়বো ?  কে কখন বিয়ে করবো, আরো অনেক কথা।  তিনজনে কথা বলতে বলতে কখন ক্লাশ আওয়ার ওভার হয়ে গিয়ছিলো আমরা জানি নাই।

বিকালে পড়ার টেবিলে বসে মার্কেটিংএর  নোট খাতার ভিতর কি সব হিবিজিবি লিখছিলাম-

তুমি কি শুধুই বন্ধু হওয়ার জন্য এসেছিলে ! তুমি শুধু সহপাঠি নও আমার,
তুমি কাকে ভালোবাসো আমি জানিনা,
আমি পূর্ব মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে কেবল কালো মেঘ
আমি উত্তরের মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে,
আমি তোমাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতে চাইনা,
তবুও আমার দু'চোখ মুদে ঘুম আসে-
ঘুমেও নয়, স্বপ্নেও নয় হঠাৎই মনে হয় আমি তোমাকে
কাছে টেনে বলছি- ভালোবাসি।


ওপাশে তাকিয়ে দেখি গিয়াস ওর পড়ার টেবিলে  বসে কি যেনো লিখছে। আমি ওকে বলি-  'কি লিখছিস ?' গিয়াস বলে- 'কবিতা লিখছি।' আমি বলি- 'তুই আবার কবি হলি কবে ?' গিয়াস উত্তর দেয় - 'এমনি হিবিজিবি কিছু লিখছিলাম।' আমি বলি- 'পড়ে শোনা।' ও তখন আমাকে পড়ে শোনায়-

আমার থেকে হাজার ক্রোশ দূরে তুমি বসে আছো
শুনতে কি পাও ভালোবাসার মর্মরধ্বনি ?
লক্ষ যোজন দূরে থেকে বুঝতে কি পারো
আমার হৃৎ কম্পনের কথা ?
নির্জন নিরালায় তুমি আমার গান হয়ে ওঠো
শ্বেতকমলে তোমার পরশখানি জেগে ওঠে-
এখনো দূর হতে কোনো কোমল সিম্ফনি ভেসে আসে
এখনো তোমার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে।


আরেকদিন কলেজে যেয়ে হঠাৎ শুনতে পাই আজ কোনো ক্লাশ হবেনা।  কি যেনো এক দাবীতে শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। মন খুব একটা খারাপ হলোনা। বলাকা সিনেমা হলে চলছিলো 'সূর্যকন্যা'।  আমরা তিনজন টিকিট কেটে সাড়ে বারোটার শো'তে হলে ঢুকে পড়ি। সারা সিনেমা চলাকালীন সময়ে রিমি আমার এক হাত ধরে থেকেছিলো। ওর আরেক হাত ধরেছিলো গিয়াসের হাত।  সিনেমা শেষে আমরা তিনজন নিউ মার্কেটের ভিতরে লিবার্টি খাবার হোটেলে যেয়ে ভাত খেতে বসি। রিমি গুনগুন করে আস্তে আস্তে আমাদের কানের কাছে সুর্যকন্যার এই গানটি গাচ্ছিলো-

আমি যে আধারে বন্দিনী আমারে আলোতে ডেকে নাও 
স্বপন ছায়াতে চঞ্চলা আমারে পৃথিবীর কাছে নাও. 
শ্রাবণ ঘন এই আকাশ কালো তৃষিত হৃদয় মোর জ্বেলেছে আলো 
এবার আমায় বাসিবে ভাল প্রিয় তুমি কথা দাও কথা দাও।

মাঝে মাঝে নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করি, রিমি কাকে ভালোবাসে ? আমাকে না গিয়াসকে ? না অন্য কাউকে ? তার কোনো হিসাব মিলাতে পারিনা।শুধু এইটুকুই জানি, আমি রিমিকে ভালোবাসি, তা কেউ জানেনা।


দেখতে দেখতে কখন আমাদের সব সিলেবাস শেষ হয়ে গেলো, দেখতে দেখতে আমাদের শেষ ক্লাশটিও হয়ে গেলো। এবং একসময় ফাইনাল পরীক্ষাও হয়ে যায়। এই ভাবেই আমাদের কলেজ পাঠ পর্ব শেষ হয়ে যায়। সেদিন চলছিলো আমাদের কলেজে একে অপরের বিদায় পর্বের দিন। দেখলাম রিমি একটা নীল রঙ্গের শাড়ি পড়ে কলেজে এসেছে। এর আগে ও কখনো শাড়ি পড়ে কলেজে আসে নাই। আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ শাড়ি পড়া। খুব ভালো লাগছিলো ওকে নীল শাড়ীতে। সহপাঠীদদের সাথে অনেক সুখের কথা হলো, অনেক প্রাণের কথা হলো। অনেক স্মৃতিচারণ হলো। তারপর আমরা তিনজন হাটতে হাটতে চলে যাই ধানমন্ডি লেকের ধারে।


লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর তিনজন বসে আছি। লেকের জল তখন নিরব স্থির হয়ে আছে। ঝিরিঝিরি কোনো বাতাস নেই। জলের উপর ছোটো ছোটো কোনো ঢেউ নেই। কড়ই,জারুল, কৃষ্ণচূড়া গাছে দু'একটি পাখী করুণ সুরে ডাকছিলো। বিকেলের সূর্য গাছের আড়ালে চলে গেছে। আলোছায়ায় অনেকটা মন খারাপ করেই আমরা বসে আছি। কে কি বলবো যেনো আমাদের কোনো ভাষা নেই। তারপরেও বললাম রিমিকে-  কবে বাড়ী যাচ্ছো ?

রিমি :  কালকেই। তোমরা কবে যাচ্ছো ?
আমি :  আগামী মাসের এক তারিখে। রুম ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ করেছি।
গিয়াস : একই তারিখে আমিও যাচ্ছি।
রিমি :  তোমরা ভুলে যেওনা আমাকে।
আমি:  তুমিও ভুলে যেওনা। চিঠি লিখবে।
গিয়াস: আমিও ভুলবো না। চিঠি লিখো।

রিমি চলে গেছে ওর দেশের বাড়ী বাগেরহাট। আমি আর গিয়াস এক তারিখেই রুম ছেড়ে দিয়ে যার যার মতো দেশের বাড়ী চলে যাই। গিয়াস চলে যায় পটুয়াখালীতে, আর আমি চলে আসি সিরাজগঞ্জে।


বাড়ীতে যেয়ে মনটা উড়ো উড়ো লাগছিলো। কারো সাথে ঠিক মতো মন খুলে কথা বলতে পারছিলাম না। এমনিতেই একাকী যেয়ে নদীর কূলে বসে থাকতাম। নয়তো মাঠের আলপথ দিয়ে ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে হাটতাম। মনের মধ্যে কি এক ভ্রান্তি ঢুকেছিলো যে, তা কাউকে প্রকাশ করতে পারছিলাম না। নির্জন প্রান্তরের অশ্বথ গাছের তলে বসে ভাবতাম আর অনুশোচনা করতাম, আমিতো রিমিকে ভালোবেসেছিলাম। এই কথা কেনোদিন তাকে আমি বলি নাই।  যে কথা বলি নাই তা নিয়ে এখন কেনো অনুশোচনা করছি ?

সেদিন ছিলো হাটবার।আমাদের ছোনগাছা হাটে সেদিন মেলাও ছিলো। মেলায় উৎসবের আমেজ। বাঁশের বাঁশি বাজছে। চারদিকে ঢাকের শব্দ, কাঁসার শব্দ। নাগরদোলার চড়কি ঘুরছে। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে কালি সন্ধ্যা হয়েছে। আমি একপাশে দাড়িয়ে নাগরদোলার ঘূর্ণি দেখছিলাম।  পোস্ট অফিসের পিয়ন আমাকে দেখে একটি চিঠি দেয়। প্রেরকের জায়গায় লেখা- রিমি, বাগেরহাট। আমি মেলার মধ্যে অন্ধকারে চিঠিটি আর খুললাম না।

রাতে বাড়ীতে এসে হেরিকেনের আলোয় চিঠিটি খুলে পড়তে থাকি-

'প্রিয় বন্ধু আমার, তোমরা দু'জনই আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলে। তোমাদের দু'জনকেই আমি খুব ভালোবাসতাম।বাড়ীতে এসে তোমাদের জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে ? কই, কখনো বলোনিতো - 'তোমাকে ভালোবাসি।' আমাকে যে বলেছে -'ভালোবাসি', তার সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের তারিখ : ১৪ ই ফাল্গুন, ১৩৯০ বাং । তোমাকে নিমন্ত্রণ দিলাম। চলে এসো। ইতি- রিমি।'


রিমি আর গিয়াসের বিয়েতে আমি আর যাই নাই। তারপর আর কোনো যোগাযোগ করিনি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেই। সরকারী চাকুরীও পেয়ে যাই। ইতোমধ্যে দশ বছর চলে গেছে। একবার একটি সরকারী কাজে গিয়েছিলাম- পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। কাজের ফাঁকে একদিন কুয়াকাটা বিচে বেড়াতে যাই। সাগরপাড় এতো জমজমাট তখন ছিলোনা । একদম বিরাণ বালুকাবেলা ছিলো। তখন সূর্যাস্তের সময়। সাগর তীরে একাকী হাটছিলাম, আর সূর্যাস্ত অবলোকন করছিলাম- হঠাৎ ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ির এক লোক আমার কাছে এগিয়ে আসে। চিনতে অসুবিধা হলোনা। এ যে সেই গিয়াস !

কাছেই লতাচাপালী গ্রামে গিয়াস থাকে। ও এখানকার এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আমাকে জোর করে ওর বাড়ীতে নিয়ে যায়। বাড়ীতে আমি তখন খুঁজতে থাকি রিমিকে। কিন্তু কোথাও রিমিকে দেখতে পেলাম না। তখন গিয়াসকে জিজ্ঞাসা করি- 'রিমি কোথায় ?'  গিয়াস আমার কথা শুনে বিস্মিত হয়। এবং বলে - 'তুই রিমিকে বিয়ে করিস নাই ? ' আমি বলি - 'না।'
গিয়াস তখন ওর স্টীলের ট্রাংক খুলে রিমির একটা চিঠি বের করে আমাকে দেখায়-  সেই একই চিঠি, একই ভাষা, এবং একই তারিখ, যা রিমি আমাকেও লিখেছিলো ।









নস্টালজিক

আমার দুই চোখের ঘুম রাতের গভীরে থেমে গেছে
নির্ঘুম চোখ তাই বলে দিচ্ছে-,আজ আর ঘুম আসবেনা,
আমার দৃষ্টি ফিরে গেছে অনেক দূর, সেই প্রথম যৌবনে-
আমি শুনতে পাই বিমান বন্দর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের হুইসেল
রানওয়ে থেকে প্রচন্ড বেগে উড়ে যাওয়া প্লেনের শব্দ।

তারুণ্যের সেই অসংযত সময়ে আমার হাতের করতলে চুম্বন দিয়ে
এক মেয়ে বলেছিলো- এ আমার স্মৃতিময় অভিজ্ঞান তোমার জন্য,
সেইসব ধূসর মায়া চিহ্নগুলি আমি আর মনে রাখতে চাইনা।

আমার পাশে এক নিষ্পাপ মুখ ঘুমিয়ে আছে
আমি কোনো কালিমা লাগাতে চাইনা এই রাত্রির চাদরে
প্রিয়তমার এই চোখ আমাকে স্বপ্ন দেখায়
আত্মজার স্নিগ্ধ মুখ আমাকে স্বপ্ন দেখায়
যমুনা পারের সেই ডানপিটে বালক ফিরে যেতে চায় তার পবিত্র কৈশরে
যেখানে কোনো গ্লানি ছিলোনা, কোনো পাপ সমাচার ছিলোনা।

হেমলক

বৈজ্ঞানিক নাম: Conium maculatum.
ক্রম: Apiales
পরিবার: আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
বংশের শাখাApioideae
সদয়Conium
প্রজাতি: C. maculatum
আইরিশরা হেমলক গাছকে ডাকে “Devil's Bread” নামে, মানে শয়তানের পাউরুটি বা "Devil's Porridge" মানেশয়তান এর জাউ
বিষাক্ত হেমলক গাছ মানুষসহ অন্য যে কোনো প্রাণীর জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে তৃণভোজী প্রাণী ও বীজ ভক্ষণকারী পাখিরা হেমলকের বিষে আক্রান্ত হয়ে অনেক সময়ই মারা যায়। হেমলকের ছয় থেকে আটটি পাতায় যে পরিমাণ বিষ আছে তা কোনো মানুষের দেহে প্রবেশ করানো হলে মৃত্যু অনিবার্য!


সক্রেটিসের মৃত্যু:
কমবেশি সবাই জানে হেমলক এর বিষ পান করে মৃত্যু হয় “গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস” এর। পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ সালে। মহান শিক্ষক ও গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে প্রহসনের বিচারে দেয়া হয় মৃত্যুদন্ড! রায়ে বলা হয়, “মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে হেমলক বিষ পান করিয়ে
মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার দিনসক্রেটিসের হাতে তুলে দেয়া হয় এক পেয়ালা হেমলক বিষ। সক্রেটিসকে বলা হয়পেয়ালার বিষ পুরোটুকু পান করতে হবে। এক ফোঁটা বিষও যাতে পেয়ালার বাইরে না পড়ে। 
সক্রেটিসের মৃত্যু
সক্রেটিস ধীরস্থিরভাবে এক চুমুকে সবটুকু বিষ পান করেন। এবার সক্রেটিসকে নির্দেশ দেয়া হলরুমের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করার জন্যযাতে করে বিষ সমস্ত শরীরে ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সক্রেটিস কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। তার পা দুটি অবশ হয়ে আসতে লাগলো। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। সারা দেহ অবশ হয়ে কিছু সময়ের মাঝেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।

ইংরেজ কবি John Keats তার ‘Ode to a Nightingale’ কবিতায় হেমলকের কথা উল্লেখ করেছেন (হয়তো সক্রেটিসের কথা মনে করে)-  

"My heart aches, and a drowsy numbness pains
My sense, as though of hemlock I had drunk"

দূরের সিম্ফনি

আমার থেকে হাজার ক্রোশ দূরে তুমি বসে আছো
শুনতে কি পাও ভালোবাসার মর্মরধ্বনি ?
লক্ষ যোজন দূরে থেকে বুঝতে কি পারো
হৃৎ কম্পনের কথা ?
নির্জন নিরালায় তুমি এখানো গান হয়ে ওঠো
শ্বেতকমলে তোমার পরশখানি জেগে ওঠে-
এখনো দূর হতে কোনো কোমল সিম্ফনি ভেসে আসে
এখনো তোমার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে।

আমি চাইলেই-

আমি ডাক দিলেই তুমি চলে আসো
বাতাসে তখন আম্রমুকুলের গন্ধে ভাসে
গলায় তখন উত্তরীয় অন্তরে মর্মর ধ্বনি
আমি চাইলেই তুমি ভালোবাসা দাও
চাইলেই তুমি জেনে শুনে করো বিষ পান।

আমি হাত বাড়ালেই তুমি আমার হাত ধরো
এই হাতেই তুমি নির্ভরতার শক্তি খুঁজে পাও
তোমাকে কাছে টানতেই ভুমি বুকে জরিয়ে ধরো
এই বুকেই তুমি চন্দনের গন্ধ বিলিয়ে দাও।

আমি বললেই তুমি সাগরে যেতে পারো
ডুবতে পারো অতলে মরতে পারো জলে
আমি বললেই তুমি জ্যোৎস্নালোকে হাটো
চলে যেতে পারো  অরণ্য গহীনে
আমি তোমার হাতে হেমলক তুলে দিলেই
তুমি পান করো,অকাতরে আত্মাহুতি দাও।

বুধবার, ১০ মে, ২০১৭

Bleeding Heart ( রক্তাক্ত হৃদয় )

(ফুলটার নামঃ Bleeding Heart ( রক্তাক্ত হৃদয় ) 
বৈজ্ঞানিক নামঃ Clerodendrum Thomsonae 
এটি Lamiaceae পরিবারের একটি উদ্ভিদ 
অন্যান্য নামের মধ্যে Bleeding Glory Bower, Bag Flower উল্লেখ যোগ্য। 
এর আদি নিবাস ধরা হয় পশ্চিম আফ্রিকাকে।)

দেখলে মনে হয় কোনো এক কোমল হৃদয় 
কিসের আঘাতে যেন রক্তাক্ত-
কিসের আঘাতে হৃদয় রক্তাক্ত হয় ?  
ফুল থেকেও যে রক্ত ঝরে, পাঁপড়িও যে রক্তাক্ত হয়
আমার তা জানা ছিলোনা,
জানতাম মানুষেরই কেবল হৃদয় হয়
সে হৃদয় ভালোবেসে রক্তাক্ত হয়
না ভুল- প্রদীপের নীচেও অন্ধকার হয়,
কার চোখের কোনে এতো জল ?
কার হৃদয়ে এতো রক্তক্ষরণ !

ফুলেরও হৃদয় আছে, সেও রক্তাক্ত হয়
ভালোবাসে সবুজ বৃক্ষ পল্লব-
রক্তাক্ত পাঁপড়ির হাহাকার ছড়িয়ে যায়
লতা পাতায়, সেখানেও আঁধার নামে-
আঁধারও রক্তিম হয় প্রতিদিনের রক্ত ক্ষরণে।
           

মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

রাত নামচা

আজ বিকাল হইতেই চিত্ত আমার অস্থির হইয়া উঠিয়াছে। কোনো কিছুই ভালো লাগিতেছেনা। কোনো কাজেই মন বসাইতে পারিতেছিনা। কোনো কিছু লিখিতেও পারিতেছিনা। বার বার মনে হইতেছে আজকে যদি চাঁদনী রাত হইতো তাহা হইলে ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িতাম। বন জঙ্গলে একাকী ঘুড়িয়া বেড়াইতাম। ওখানে নদীর তীরে কোথাও মগ্ন হইয়া বসিয়া থাকিতাম।

তুমি যাবে আমার সাথে দূর বনে কোথাও ?
বসবে নদীর কূলে, ঘুরবে জঙ্গলে আমার সাথে ?
নিস্তব্ধ জল  দেখবে ?  সেখানে জীবন কেমন চলছে !
এই লোকালয় আর ভালো লাগেনা
তুমি যদি যাও- এই গৃহের দরকার নেই।

বনের পাখীরা দেখুক আমাদের প্রেম
বনছায়ায় বাজুক ঝরা পাতার গান
যদি তুমি সাথী হও চলো আমার সাথে
ঐ দূর বনান্তরে দিকেই আমরা চলে যাই-

অরণ্য আমাকে ডাকে, নদী আমাকে ডাকে
যদি হয় চাঁদনী রাত- আজকেই গৃহ ত্যাগ করবো।



মনের মতো বউ

জীবনে কতো সাধ আহলাদ আর স্বপ্ন ছিলো শহরের মেয়েকে বিবাহ করবো। মেয়ে ফ্যাসান করে চলবে। মাধুরী কাট চুল থাকবে। ডায়নার মতো ভ্রু স্টাইল হবে। পোষাক পড়বে 'ববি' ছবির নায়িকা ডিম্পলের মতো। কথা বলবে ইংরেজী বাংলা মিক্স করে।  কিন্তু তা আর কপালে জুটলো না। মা আমাকে বিবাহ করালেন তারই পছন্দ মতো এক মেয়েকে। তার সখ ছিলো ছেলেকে পাল্কি চড়িয়ে বিয়ে করাবে।আমি তাই করলাম। এক হেমন্তের সন্ধ্যায় বাড়ী থেকে তিন মাইল দূরের এক গ্রাম থেকে অচেনা এক মেয়েকে বিবাহ করে পালকিতে চড়িয়ে বাড়ীতে বউ করে নিয়ে আসলাম।

মা তার রূপবান সুন্দরী পুত্রবধুকে লাল শাড়ী পড়ায়ে রাখলেন। গ্রামের বালক বালিকা, বৌঝিরা সব দল বেঁধে দেখতে আসতে লাগলো। বাড়ী ভর্তি আত্মীয় স্বজন। সবাই উৎসব আর আনন্দ করছে। এরই ফাঁকে বিয়ের তিন চলে গেছে। মাকে বললাম- আমার ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছে। ঢাকা যেতে হবে।' মা বললেন- নতুন বৌমাকে রাখিয়া তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবে ? তাহা কি করিয়া হয় ? তুমি আর কয়েকটা দিন থাকিয়া যাও ''। আমি বললাম- ''তোমরা আমাকে হঠাৎ করে ধরে এনে বিবাহ করিয়েছো। আমি অফিস থেকে ছুটি আনি নাই। আমাকে চলে যেতে হবে।' মা তখন বললেন,- 'তাহলে বৌমাকেও সাথে করে  তুমি ঢাকা নিয়ে যাও।'  যাহোক, বউকে একদিনের জন্য বাপের বাড়ী ঘুরিয়ে এনে পরের দিনই তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি।

ভালোই লাগছে হঠাৎ শুরু হওয়া সংসার জীবন। ভালোই লাগছে নতুন এই জীবনের শুরু। হঠাৎ করেই যেন জীবনের অনেক বড়ো পাওয়া পেলাম। হঠাৎ করেই জীবনের সব নিয়ম কানুন বদলে গেলো। একজনের জীবন থেকে হঠাৎ করেই দু'জনের জীবনের রুপান্তর হলো। রাতে দু'জন একসাথে ঘুমিয়ে থাকি পাশাপাশি। জীবনের স্বপ্নগুলোও দেখি একসাথে। জীবন হঠাৎ করেই সাজানো গোছানো হয়ে উঠলো। এখন আর আধাঁরে একাকী বসে থাকতে হয়না।  এখন ঠিক সময়েই ঘরে সন্ধ্যা বাতি জ্বলে ওঠে।

চারদিক থেকে সকল আলোর বিচ্ছুরণ যেনো ঘরে এসে পড়ছে
ঘরহীন কোনো শুন্যতা কোথাও নেই
জীবনের সকল সুখ ভরে উঠতে থাকে সকল পূর্ণতা দিয়ে
আমি বিস্ময়ে চেয়ে থাকি এই মেয়ের দিকে
সকল ঐশ্বর্য সকল ভালোবাসা নিয়ে তার এই কাছে আসা
এক জীবনেই যে এতো প্রেম কেউ দিতে পারে- জানি নাই।

আমার এই বউয়ের নাম আনারকলি। আমি তাকে 'কলি' বলে ডাকি, আবার কখনো আনারকলিও বলি। মোঘল হেরেমের আনারকলি সে নয়। সে নেহাত একটি সহজ সরল গ্রামের মেয়ে। আজ অফিস থেকে এসে শুনি- পাশের বাসার এক ভাবীর সাথে রাস্তায় বেড়াতে বের হয়েছিলো সে। ভাবী  বেশ সাজগোজ করে বের হয়েছিলো। পাড়ার ছেলেরা নাকি ভাবীর দিকেই তাকিয়ে থেকেছে। তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় নাই। এজন্য তার মন খারাপ। আমার কাছে আবদার করেছে- মেকআপের সামগ্রী কিনে এনে দিতে । পরের দিন আনারকলিকে ফাউন্ডেশন,কনসিলার, ব্লাসন, আই ভ্রু পেন্সিল, আইল্যাস, কাজল,নেইলপালিশ, লিপস্টিক, ফেসপাউডার,আইস্যাডো,ব্রাশ,প্যানকেক, টিপ, চূড়ি এইসব কিনে এনে দেই। পরের দিন অফিস থেকে এসে দেখি- আনারকলি সুন্দর হয়ে সেজে বসে আছে। বললাম বেড়াতে যাওনি ? কলি তখন বলে- তোমার জন্য সেজে বসে আছি।'

আরেকদিন আনারকলিকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাই। আনন্দ সিনেমা হলে তখন চলছে- 'চাঁপাডাঙ্গার বউ'। চাঁপাডাঙ্গা বউয়ের দুঃখ দুর্দশা দেখে- আনারকলি কাঁদছে। আমি বললাম, 'তুমি কাঁদছো কেনো ? আমার কথা শুনে সে আরো জোড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।পাশের মানুষরা উৎসুক হয়ে কলির কান্ড দেখতে থাকে। আমি সিনেমার বাকী অংশ আর না দেখে কলিকে নিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসি।

আরেকদিন নতুন বউকে নিয়ে চায়নিজ খাবার খেতে যাই উত্তরার একটি রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের ভিতরে আলো আঁধার তার পছন্দ হয়না। সে বলছিলো- তার নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে। এক চামচ স্যুপও সে খেলোনা। ভেজিটেবলও মুখে নেয় নাই। ওর জন্য আলাদা করে বীফ নেই। তাই দিয়ে একটু রাইছ খেয়ে নেয়।  আমি আমার নতুন বউকে চায়নিজ খাওয়ায়ে সেবার খুশী করাতে পারি নাই।

আনারকলিকে নিয়ে কেটে যায় প্রতিদিন ভালোলাগার দিন
ভালোলাগে  সারল্য ভরা খুনসুটি, ভালোলাগে যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি
আমি চেয়ে দেখি ওর মায়াময় চোখ, দেখি ওর হেটে চলা মেঝেতে
ভালো লাগে ভেজা চুলে যখন সিঁথি করে আয়নার সামনে দাড়িয়ে
আমি দেখি কেমন করে সাজাচ্ছে ঘর আলনায় সাজাচ্ছে কাপড়
আর ফুলদানীতে সাজাচ্ছে ফুল
দেখতে দেখতে কখন হয়ে উঠলো সে ঘরের লক্ষ্মী
আমি বিস্ময়ে দেখি তার এই ঘরণী হয়ে ওঠা-
আমার প্রতিটি কর্মে সে হয়ে ওঠে প্রেরণাময়ী ,
সে যেনো আমারই- মনের মতো বউ।


এতো প্রেম আর এতো ভালোবাসার জীবন থেকে কলিকে দূরে রাখতে মন চায় না। তাইতো নতুন বউ আনার পর থেকে ওকে আর বাড়ী পাঠানো হয়নাই। আমার এই ভালোলাগা জীবনের সাথে সে রয়ে গেছে। একদিন সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখি কলি শুয়ে আছে। আমি ওকে বলি- এই অসময়ে কেনো শুয়ে আছো ?
কলি বলে- 'মাথা ঘুরছে। বমি করেছি।'  আমি বুঝতে পারলাম- হয়তো এ কোনো নতুন অতিথীর আগমনী বার্তা হবে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তারের রিপোর্টও- পজেটিভ, আমাদের ঘরে একজন নতুন অতিথী আসছে।


কলির কথামতো  সুন্দর একটি বাচ্চার পোস্টার কিনে এনে ঘরে লাগিয়ে দেই। প্রায়ই এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে ও স্বপ্ন দেখে। কল্পনার জাল বুনে, তারও এই রকম একটি ছেলে সন্তান হবে ।সে আদর করবে। বুকের দুধ খাওয়াবে। একদিন বিকেলবেলা খুব মন খারাপ করে কলি বলছিলো- 'আমার যদি মেয়ে হয়, তুমি রাগ করবেনা তো ?' আমি বলেছিলাম - 'না।'

আস্তে আস্তে আনারকলির ডেলিভারীর ডেট চলে আসে। দেশের বাড়ী থেকে শ্বাশুরী মাকে চাকায় আনা হয়। আনারকলি প্রায়ই মন খারাপ করে থাকে। তখন শ্রাবন মাস ।  সেদিন ছিলো আমার ছুটির দিন। সকাল থেকেই আকাশে কালো মেঘ হয়ে আছে, একটু পর মুশুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আনারকলি বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়। আমিও যেয়ে ওর পাশে গিয়ে দাড়াই। বৃষ্টি দেখছিলাম দু'জনই। আনারকলি বলছিলো- শরীরটা ভালো লাগছেনা।
আমি :  বেশী খারাপ লাগছে ?
কলি :   অতো বেশী না।
আমি:   বিছানায় শুয়ে পড়বে।
কলি :  ওগো আমার খুব ভয় হয় !
আমি :  চলো তোমাকে বিছানায় শোয়ায়ে দেই।

আমি আনারকলিকে অনেকটা পাশ জড়িয়ে করে বিছানায় এনে শোয়ায়ে দেই। ভাবছিলাম আর হয়তো দেরী করা ঠিক হবেনা। শ্বাশুরী মার সাথে আলাপ করে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যেই একটি ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসি। ওদিকে ঢাকায় আমার বড়ো বোন ও দুলাভাইকে খবর দেওয়া হয়। তারাও চলে আসে। মুশুলধারে বৃষ্টির মধ্যই আমাদের ট্যাক্সিা হলি ফ্যামেলী হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে গিয়ে পৌঁছে।

অপারেশন রুমের সামনে অপেক্ষা করছিলাম সুসংবাদের জন্য । একটু পর যে সংবাদ আসে- 'অধীক রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। নবজাতক ছেলে শিশুটিও বেঁচে নেই।' আকাশ তখনও মেঘে ঢাকা ছিলো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো কর্কশ শব্দ করে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছিলো অনবরত। জীবনের সব আশা আর স্বপ্নগুলোকে পিছনে ফেলে তখন রাস্তায় নেমে আসি।

তারপর শুধু অসীম শূন্যতার কথা। ঘর আর ভালো লাগে নাই কখনো। ঘর ছেড়ে বেশীর ভাগ সময় মাজার, মসজিদ, পথে, ঘাটে,পার্কে শ্টেশনে পড়ে থাকি। মন চাইলে ঘরে ফিরে যাই। না চাইলে পথে পথেই ঘুরে বেড়াই।

একি শূন্যতা তুমি দিয়ে গেলে আমায়, একি দীর্ঘশ্বাস-
জীবন আর ভরাতে পারিনা কোনো আনন্দে
জীবন আর এগুতে পারেনা সামনে চলতে,
দিনগুলি আর চায়না যে ফুড়োতে...।













সোমবার, ৮ মে, ২০১৭

সুপ্রভাত

সব প্রেমের মধ্যেই প্রেম থাকেনা
সব আনন্দই আনন্দ নয়
সব ঘুমেই স্বপ্ন আসেনা
রাস্তায় ল্যামপোস্টের সব বাতি নিভে গেছে
সব তারা ডুবে গেছে আকাশ নিশীথে
আমার দেহখানি নির্ভার করে দাও
মলিন সকল গ্লানি ঘুচায়ে দাও
যদি প্রদীপখানি জ্বালাতে হয় দু'হাতে ধরো।

ভোর হয়েছে, রাতের শোক গান আর নেই
দেখছি অনুরাগের লাল রোদ্দুর- সুপ্রভাত।

অপেক্ষায় আছি

আবার কি উঠবে চাঁদ বনের আড়ালে
আবার কি নামবে বৃষ্টি বাড়ীর উঠোনে
আবার কি দেখা হবে
আবার কি কথা হবে
আমাদের দু'জনের-
আমি চাঁদ ওঠার অপেক্ষায় আছি
আমি বৃষ্টি নামার অপেক্ষায় আছি।

রবিবার, ৭ মে, ২০১৭

আমার সকল পথের

তুমি দড়জায় এসে কড়া নাড়ো রাতের মধ্যপ্রহরে
তখন আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় অকস্মাৎ
দেখি প্রগাঢ় চুম্বন নেবার জন্য তুমি অপেক্ষা করছো,
অলৌকিক কোনো পুরকৌশল আমার জানা নেই
কিভাবে তৈরী করবো সুরম্য বাঁধ-
আমি মধ্যপ্রহরের ভ্রমনবিলাসী অভিযাত্রি এক
অরণ্যের দিকে ধেয়ে চলেছে তাম্র রঙ্গের অশ্ব এক
লতা গুল্ম তারকাখচিত গুহা দেখতে পাই-
তুমি পথ ছেড়ে দাও, সোয়ার ধরেছি আমার হাতে
তুমি আমার সকল পথের, আমার সকল গন্তব্যের
সহযাত্রি হতে পারো।
( এটি একটি মধ্যরাতে লেখা কবিতা )

শনিবার, ৬ মে, ২০১৭

একজন হেমা মালিনী

হঠাৎ করেই তার প্রেমে পড়ে যাই। হঠাৎ করেই আমার জীবনের রোজকার রোজনামচা পরিবর্তন হয়ে গেলো। এক বিকেলে একে অপরে দেখা না হলে সে বিকেল হয়ে যায় মৌনতার সঙ্গীত। যেনো দুঁহু করে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।'

মেয়েটির নাম- হোমায়রা আকতার। পাবলিক লাইব্রেরীতে ওর সাথে আমার পরিচয় । মাঝে মাঝে নোট করতে আসতো এখানে। পড়তো বদরুন্নেসায়। ও পড়তো ওখানে বাংলায়। আমি পড়তাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায়। তাই মনে হয় একে অপরে স্টাডি সহায়কের কারণে সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরটা আমাদের যেনো প্রেমের বৃন্দাবন হয়ে উঠলো।

এক ফাল্গুনের উদাস দুপুরে লাইব্রেরীর সিঁড়ি সোপানে বসে আছি। এবং ওকে ডাকি :  হোমায়রা ?
হোমায়রা : জ্বী।
আমি :  ভালো লাগেনা।
হোমায়রা:  কি ভালো লাগেনা ?
আমি : তোমার এই নাম !
হোমায়রা: হুম।
আমি : তোমাকে হেমা নামে ডাকবো।
হোমায়রা:   ডাকো ।
আমি : হেমা ?
হেমা :  জ্ব্বী।
আমি:  না এ নামেও ডাকবো না।
হেমা:  পাগল তুমি ! কি নামে ডাকবে ?
আমি:  মালিনী।

আমি মালিনীর কানের কাছে যেয়ে আস্তে আস্তে এই কবিতাটি আবৃতি করতে থাকি-

দেখো তুমি চেয়ে কড়ই গাছের ছায়ায় রোদ্র থেমে গেছে
ঝরা পাতার শব্দে তোমার আগমনের গান শুনি
বেনী খোপায় পড়ো তুমি সাদা সন্ধ্যা মালতী
তোমার বাগানের তুমি যেনো মালিনী একজন
প্রতিদিন জল ঢালো সেখানে, তুমি নিজেই হয়ে যাও সন্ধ্যা মালতী
আজ শাহবাগের মোরে কোনা ফুল নেই, সব ফুল আজ তোমার বাগানে।


একদিন লাইব্রেরীর ভিতরে বসে দু'জন নোট করছিলাম। আমি করছিলাম বৈষ্ণব পদাবলীর জীবাত্মা আর পরমাত্মার প্রেমের উপরে। মালিনী করছিলো রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের প্রকৃতির ভূমিকা। বাইরে তখন মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো।মালিনী বলে- 'ভালো লাগছেনা'। আমি বলি- 'কেনো ?' মালিনী বলে - চলো বৃষ্টি দেখি।'

বাইরে এসে দু'জনেই দেখছিলাম বৃষ্টি। আমগাছের ডালে জুবুথুবু হয়ে দুইটি কাক ভিজছে। আমি মালিনীকে বলি- চলো কাকের মতো করে অমন করে দু'জনে জলে ভিজি। মালিনী বলে- 'চলো, ভিজতে ভিজতে আমরা রিক্সায় গিয়ে উঠি। তুমি নীল ক্ষেতের মোরে নেমে যাবে, আমি একাকী ওখান থেকে হোস্টেলে চলে যাবো।' রিক্সা চলছে আজিমপুরের দিকে, হুট উঠানো নেই। কাকের মতোই ভিজে দু'জন জুবুথুবু হচ্ছি। আমি মালিনীর কানে কানে বলি- 'তোমাকে রাধিকার মতো লাগছে। শুধু যমুনার তীর এখানে নেই। নেই এখানে সেই  শ্রাবন দুপুর।' মনে মনে ভাবি, আজ এই বাদলমূখর দিনে মালিনী আমারই পাশে। ভিসির বাড়ীর সামনে বড়ো বড়ো কড়ই গাছের ছায়াতল দিয়ে রিক্সা চলছে। পাতা ছুঁয়ে বৃষ্টির জল এসে পড়ছিলো আমাদের গায়ে।


আরেকদিন দু'জনের মন উড়ু উড়ু। লাইব্রেরীর টেবিলে মন বসছেনা। পেটে দুপুরবেলার খিদা। মালিনী বলছে খিদে লেগেছে। লাইব্রেরীর ক্যান্টিনে যেয়ে দু'জন খেয়ে নেই। আমি মালিনীকে বলি- সিনেমা দেখবে ? বলাকায় 'দেবদাস '।মালিনী বলে- 'চলো'। হলের রুম অন্ধকার হলো। সামনের কালো পর্দা সরে গেলো। আমার ডান হাত মালিনীর বাম হাত ছুঁয়ে আছে। পারু দেবদাসের কৈশর প্রেম তখন চলছে। আমি মালিনীকে বললাম- একটু ডার্ক ড্রামা করবো ?' মালিনী আস্তে করে বলে- 'মাইর চিনো, মাইর'?। সিনেমার শেষ দৃশ্যে পারু আর্ত চিৎকার করে যখন বাড়ীর বাইরে আসতে চায়,ততোক্ষণে লোহার সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।'  প্রেক্ষাগৃহের বাতিগুলো তখন জ্বলে উঠেছে। দেখলাম আমার মালিনীর মন খারাপ। ডার্ক ড্রামা আর হলোনা।


আমাদের ভালোবাসা চলছে, ভানু চক্রবর্তীর এই কবিতার মতো- ''পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,. আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী। রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল. পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,. ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে. দিগঙ্গনার নৃত্য,. হঠাৎ-আলোর ঝল্‌কানি লেগে. ঝলমল করে চিত্ত।'' একদিন ঘরে বসে আছি। মনে হলো পূর্বের জানালাটা খুলে বাইরের আকাশটা দেখি। জানালা খুলতেই এক ঝলক পূর্ণিমার আলো এসে চোখে মুখে লাগলো।


তুমি এখন হোস্টলে ব্যালকনীতে একাকী আছো কি বসে ?
উদাস ভাবনায় কাটছে কি প্রহর ?
আজিমপুরের আকাশে উঠেছে কি চাঁদ ? তুমি কি দীপ্তিময় হয়ে উঠেছো ?
তুমি কি অনুভব করতে পারো কোনো উচ্ছসিত তরুণের ভালোবাসার প্রাণ স্পর্শ ? 
আজকের এই জ্যোৎস্না রাতে তুমি বের হয়ে আসো রাধার মতো-
চলো দূর প্রান্তরের দিকে হেটে যাই, ভেসে বেড়াই মেঘের নীচে নীচে।


দেখতে দখভে প্রায় তিন মাস চলে যায়। সামনে গ্রীস্মে কলেজ ইউনিভার্সিটি দুটোই বন্ধ হয়ে যাবে। মালিনীও চলে যাবে দেশের বাড়ী। যেদিন যাবে তার আগের দিন পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরে দুজন বসে আছি। কাল মালিনী চলে যাবে।
আজ কেমন যেনো মনমরা হয়ে আছে লাইব্রেরী চত্বরের ঘাস। কোনো পাখী গাইছেনা গান ।  রোগীবাহি এ্যাম্বলেন্সগুলো করুণ হর্ণ বাজিয়ে হাসপাতালে ঢুকছে। মালিনী চুপ হয়ে বসে আছে, কোনো কথা বলছেনা। আমি ওকে ডাকলাম- মালিনী।
মালিনী : জ্বী।
আমি :   ভুমি আসবে ফিরে কবে ?
মালিনী:  এইতো দেড় মাস পর।
আমি : এসে আমার সাথে দেখা করবে না ?
মালিনী:  করবো
আমি:  কেমনে জানতে পারবো তুমি ঢাকা এসেছো ?
মালিনী : তুমি আগামী জুন মাসের ১৭ তারিখে এখানে থাকবে।
আমি :  আচ্ছা।

মালিনী ওর ব্যাগ থেকে একটি ক্যাসেট আমার হাতে দিয়ে বলে- 'এখানে আমার গাওয়া একটি গান আছে। যদি কখনো আমার কথা মনে পড়ে তবে বাজিয়ে শুনো এই গান।' আমি ওকে বললাম- তুমি যে গান জানো এ কথা তো কখনো বলো নাই। মালিনী বললো- তুমিতো জানতে চাও নাই, আর মানুষের কতো কথাইতো অপ্রকাশিত থাকে।' আমি মালিনীকে বলি- 'তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো ?
মালিনী :  না।
আমি :  মালিনী ।
মালিনী : জ্বী।
আমি : তোমার হাতটা একটু ধরি ?
মালিনী : ধরো।
আমি : একটু চুমু দেই হাতে।
মালিনী : দাও।


একদুই করতে করতে দেড়মাস চলে গেলো। আসে ১৭ই জুন। আমি পাবলিক লাইব্রেরীতে চলে যাই। সারাদিন অপেক্ষায় থাকি। মালিনী আর এলোনা। এরপর পরপর আরো দশ দিন যাই। কোনো দিনই মালিনী এলোনা। তারপর প্রতি সপ্তাহেই একদুই দিন করে লাইব্রেরীতে যেয়ে মালিনীকে খুঁজেছি। কিন্তূু মালিনী কে আর পাইনি। মালিনীর দেশের বাড়ী বগুড়ার মহাস্থান গড় এলাকায়। এই টুকু ঠিকানাই জানতাম। এর চেয়ে বেশী ঠিকানা আমার জানা ছিলোনা। ওখানে যেয়ে কোথায় খুঁজবো মালিনীকে ? হোস্টেলেও খোঁজ নিয়েছি,সেখানেও আসেনাই।

আমি মালিনীর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। তারো দুই বৎসর পরে আমি বিয়ে করি। যেদিন আমার গায়ে হলুদ হবে সেদিন কি মনে করে মালিনীর ক্যাসেটটির কথা মনে পড়ে। যা এতোদিন শোনা হয়নাই। তাছাড়া ওর কথা আজকের এই দিনে মনে পড়ছিলো খুব। আমাদের বাড়ীর মধ্যে তখন উৎসব আনন্দ হচ্ছে। চারিদিকে হাসি আর গান। আমি আমার ঘরে মালিনীর নিজের কণ্ঠে গাওয়া সেই গানটি শুনতে থাকি-

তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি--
তবু মনে রেখো।
যদি  জল আসে আঁখিপাতে,
এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু মনে রেখো।
এক দিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে--  মনে রেখো।
যদি পড়িয়া মনে
ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে--
তবু মনে রেখো।