শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

দুয়ারে তুমি দাঁড়িয়ে ( গদ্যকবিতা গ্রন্থ )

দুয়ারে তুমি দাঁড়িয়ে ( গদ্যকবিতা গ্রন্থ ) 

উৎসর্গ -
আমার স্ত্রীকে। 
দুয়ারে দাঁড়িয়ে নয়, সে আমার ঘরেই বসবাস করছে শুরু থেকে, এবং  জীবনমৃত্যু পর্যন্ত। 



১.    রাত্রিভূক অনাহারী

রাত গভীর হলেই দরজা খুলে বনের নিবিড়ে যেতে মন চায় । যেখানে বন পাশেই স্বচ্ছতোয়া নদী বয়ে চলেছে । নদী থেকে শীতল বাতাস বয়ে আসে। অন্ধকারে চোখ মেলে খুঁজব কাউকে। মন বলবে - কোথাও আমার কেউ নেই, কেউ নেই। 
তারপরও ডাকব কাউকে- ' এসো, এসো তুমি রাতের নিভৃতে তারার আলোয় ছায়াপথ ধরে এই বনকুঞ্জে, এই নদীর কূলে।'

আমার আর্ত ডাক কী শুনতে পাবে না কেউ ! এসো গো তুমি। এসো। বড়ই রাত্রিভূক অনাহারী আমি এই রাতে । বড়ই কাঙাল আমি ভালোবাসা পেতে।


২.   নীল নীল- নীল আকাশ


দিনের বেলায় অনেকটা অসময়ে ঘুমিয়ে যাই। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি ছেলেবেলার। সাবানের ফেনায় ফু্ঁ দিয়ে শতশত বেলুন উড়িয়ে দিচ্ছি আকাশের দিকে। উড়ে যাওয়া বেলুন দেখতে দেখতে --- ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে শুনতে পাই ঘরের কার্নিশে বসে একটি কাক কা-কা করে ডাকছে। ডাকটা কর্কশ মনে হলো না। ও তো পাখি। এটি ওর কথা। কান্নাও হতে পারে।

খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাই। নীল মেঘে ঢাকা নীল আকাশ দেখতে পাই। আহা ! পাখি কিংবা মেঘ হয়ে যদি উড়ে যেতে পারতাম। মনে মনে ভাবি --- আকাশের ঐ নীল মেঘ হয়ে থাকা অনেক ভালো ! নীল মেঘেই যেন জীবনের সৌন্দর্যগুলি লুকিয়ে আছে !


৩.   দুই বিন্দু নয়নের জল


এক. 
সারাটা জীবন একটা ঘোরের মধ্যেই কাটিয়ে দিলাম। জীবন যেন একদিন আর এক রাত্রির সমান। দিন শেষে ঘুমালাম, ঘুম ভেঙ্গে দেখি-- জীবনই শেষ। কত স্বপ্ন ছিল, সে সব আর দেখা হলো না। সব স্বপ্নই কি এক রাত্রিতে দেখে শেষ করা যায় ? সব চাওয়া পাওয়া অপূর্ণই রয়ে গেল।

দুই. 
প্রতিক্ষায় থাকি তুমি আসবে, তাই ঘরের দরজা খুলে রাখি। উঠানের কাছে এসে থেমে গেলে তুমি। মনে হলো পথ ভুল করেছ। না চিনেই চলে গেলে। তুমি না আসো। আমার দেহ এক সময় নীল হবে। নীল পাথরের দ্যূতি ছড়াবে তোমার ঘরের পথ পর্যন্ত। সে আলোয় তুমি পথ খু্ঁজে পাবে আমাকে খু্ঁজে পাবার। তখন এসে পাথরে লিখ তোমার নাম।


৪.        সন্ধ্যার অভিবাদন


মন ভালো লাগছিল না। বাসা থেকে তাই একাকী হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই দিয়াবাড়ী। সাদা কাঁশফুলের পাশের পথ দিয়ে হাঁটছিলাম। পড়ন্ত বিকালের নির্মল বাতাসে ফুলগুলি দুলছিল। ফড়িং প্রজাপতিরা তখনও উড়ছিল ফুলে ফুলে। লেকের পাড়ে যেয়ে বসে থাকি কতোক্ষণ। দেখলাম, দূর দিগন্তে বৃক্ষরাজির আড়ালে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। সন্ধ্যার কি এক আশ্চর্য মায়াবী আলোয় ছেয়ে গেল দিয়াবাড়ীর আকাশ। মনটা আমার ভালো হয়ে গেল। আজকের এই হেমন্ত সন্ধ্যার এই ভালোলাগা পাঠিয়ে দিচ্ছি তাই সবার করে, যে যেখানে আছে পৃথিবীর যে প্রান্তে !


৫.  অপার আনন্দধারায়


তুমি আমার কাছে এসেই ত্রস্ত হরিণীর মতো ছটফট করো, তাড়া করো চলে যাবার। দ্রৌপদীও এমন করে না দেবতার সাথে মিলন পর্বে। তোমার অম্লান দেহখানিি ধূসর ধূলায় মিশিয়ে দাও। আমি পেতে চাই সৃষ্টির সুখের উল্লাস। ভালোবাসার আকুলতায় কোনও কান্না রাখতে নেই। তুমি থেকে যাও এখানেই, আমার বাহু লগ্নে, এই অপার আনন্দধারায়।


৬.  জলস্রোতের কান্না


কেমন করে তোমাকে এত ভালবাসি। কেমন করে তোমাকে বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখি। তুমি তো ভেসে যাবে কোনও নদীর মতো জলস্রোতে একদিন। কত কথা হয়েছিল, কত স্বপ্ন দেখা হয়েছিল আমাদের চার চোখ মিলে। সব কথা, সব স্বপ্ন দেখা কী শেষ হয়ে যাবে? তুমি চলে গেলেই কী ভালোবাসার মৃত্যু হবে? জানিনা মৃত্যু কী, জানিনা বিচ্ছেদ কী?
আমি কী তোমাকে আমার দুঃখ বেদনাকে কুড়িয়ে এনেছিলাম কোনও মর্মরিত জীবনের উঠান থেকে বস্তুবৃক্ষের ঝরা ফুলের মতো।


৭.  দাঁড়িয়ে আছ


কাল থেকে শরীরটা একটু খারাপ ছিল। এখন এমন হয়েছে যে, শরীর সামান্য খারাপ হলেই মন বিষাদ হয়ে যায়। এই যে মন খারাপ হয়ে যাওয়া, তা কিসের জন্য হয়? তা কি পৃথিবীর জন্য হয়? নাকি স্ত্রী সন্তানদের জন্য। কেন যে এই মায়াগুলো নিজের জীবনের উপর এসে পড়ে।

এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আজ দুপুরে অসময়েই ঘুমিয়ে যাই। যখন ঘুম ভাঙ্গে, দেখি -- একটি কোমল হাত আমার কপালে ছুঁয়ে আছে। যেন দাঁড়িয়ে আছে কেউ আমার জীবনের পাড়ে। বুঝতে পারি, পৃথিবীর মায়াগুলো এমনি করেই জীবনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে।


৮.  রুপালি জলে স্নান 


তারা ভরা ঐ আকাশটার আজ অনেক নেশা ধরেছে। যে-নেশায় এক অখ্যাত প্রেমিক রাত্রির আকাশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চাইছে। যে আকাশের টানে ঘর ফেলে সে বাইরে চলে যেতে চাইছে। জ‍্যোৎস্নার ঢেউয়ের দোলায় ভাসতে যেতে চাইছে তার প্রেয়সীকে নিয়ে। রুপালি জলের ধারায় আজ স্নাত হবে তারা।


৯.  বসন্তের পদধ্বনি 


ঘরের দুয়ারে বসন্তের পদধ্বনি শুনতে পাই। যে বাতাস বইবে আসন্ন বসন্ত দিনে, তা কি আমার জীবনের পূর্ণতাকে ধুলো বালিতে ঢেকে দিবে ? আমার জীবন পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে। তোমার কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তার শক্তি দিয়ে জীবনের বাকী পথ চলে যেতে পারব। আর যদি না পারি তুমি তো আছোই আমার পাশে।


১০.  আমাদের অসম্পূর্ণ প্রেম


আমাদের ভালোবাসা কেমন? সম্পূর্ণ না অসম্পূর্ণ? সম্পূর্ণ প্রেম শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অসম্পূর্ণ প্রেম নিঃশেষ হয় না। সেই প্রেম পূর্ণিমা নিশীথের মতো কাছে টানে। বহু যুগ আগে কোথায় কখন একটি গল্প লেখা শুরু হয়েছিল, কে ছিল সেই গল্পের দুই মানব মানবী? সেই গল্পের কাহিনী এখনও যে শেষ হয়নি। তারা দুজনই পাশাপাশি হাঁটছে পৃথিবীর পথে। এখনও দুজন দুজনের হাত ধরে আছে।

কত পায়ের ছাপ পড়ে আছে কত পথে। কত পথের ধুলো উড়েছে তাদের পায়ে পায়ে। কত কৃষ্ণচূড়া, কত বাবলা বৃক্ষ, কত অশত্থের ছায়া পড়েছে তাদের উপর। কেউ তা দেখতে পায়নি কখনও।

কত যুগের কত ভালোবাসার মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল। কত ভালোবেসে যৌবন শেষ করেছি আমরা। এমন কোন রাস্তা নেই যেখানে দিয়ে আমরা হাঁটিনি। পথের ধারে কত রেস্টুরেন্টে বসে খেয়েছি। কত নদী মরুপথ, ট্রেনে বাসে, রিক্সায়, নৌকা লঞ্চে চলেছি। কত ভালোবাসার মুহূর্তগুলোতে ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিলাম। আলিঙ্গনে বিমুগ্ধ হয়ে কত সময় পার করেছি। কোনও প্রেমই সম্পূর্ণ করতে পারেনি এই অতৃপ্ত যুগল।

কোনো এক সময় আমরা কেউ কোথাও থাকব না।
বুড়ো হাবরা হয়ে মরে মিশে যাব একদিন এই মৃত্তিকা তলে। আমাদের ভালোবাসার সৌরভ অনাদিকাল সেই সব রাস্তার অলিতে গলিতে আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াবে।

বহু যুগ পরে হয়ত আমাদের হেঁটে যাওয়া রাস্তাগুলো দিয়ে অনাগত কোনও যুগল বর্ষার সন্ধ‍্যাতে হেঁটে যাবে। আর হঠাৎ করে সেই কবেকার আমাদের অসম্পূর্ণ প্রেমের শিরশিরে বাতাস তাদের গায়ে লাগবে। তখনকার তাদের সেই অনুভব অচিন কোনও প্রান্ত থেকে আমরা কী তা বুঝতে পারব?

এই গানটা যতবার শুনি ----
'অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে কানে
কত নিশীথ-অন্ধকারে, কত গোপন গানে গানে।
সে কি তোমার মনে আছে তাই শুধাতে এলেম কাছে–
রাতের বুকের মাঝে মাঝে তারা মিলিয়ে আছে সকল খানে।'

আজ এত বছর পরে অনেক ভাবনাই বেশি বেশি করে মাথায় জেঁকে বসে। ঠিক যেন মনে হয় দুটো মানুষ তাদের জীবনে উপান্তে এসে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাচ্ছে ফেলে আসা অসম্পূর্ণ প্রেম গুলোর দিকে। যেখান থেকে তারা পার্থিব কিছু পায় নি। কিন্তু শিখেছে অনেক, ঋদ্ধ হয়েছে অনেক।


১১.  বসন্ত দুুপুরের পংক্তিমালা


এখনও রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে 
হঠাৎ মনে পড়ে যায়, কেউ একজন আসবে বলে আর আসেনি। কেউ একজন আসবে বলে আয়োজন করেছিলাম অনেক কিছুই। তার পুরোনো চিঠিগুলোতে আছে অনেক কবিতা, সুন্দরতম শব্দমালা। আছে মুগ্ধ করা অনেকগুলো মূহুর্ত। অনেক হৃৎস্পন্দনের অনুরণন…

কেমন যেন হাহাকার বুকের মাঝে। ঠিক কষ্টেরও না, কেমন যেন। সবাইকে লুকিয়ে একলা রাতে বালিশে মুখ গুঁজে রাখতে মন চায়। হাতের সব কাজ ফেলে দিয়ে মনে হয় স্টেশনের সেই কাঠের বেঞ্চিটাতে গিয়ে বসে থাকি। মনে হয় বসন্তের ঝরে যাওয়া পাতাগুলোর উপর মর্মর আওয়াজ তুলে হাঁটতে হাঁটতে দূরে কোথাও চলে যাই।


১২.  পরজনম


যেদিন আকুল হয়ে বইবে বসন্ত বাতাস, যেদিন সবুজ বৃক্ষরাজির পল্লব ঝিরি ঝিরি করে দুলে উঠবে, যেদিন পূর্ণিমা রাতের ধূসর ছায়া পড়বে পদ্মপুকুর জলে ---
সেদিন সেই দিনে, সেই রাত্রিতে আমি আসব তোমার কাছে, হাজার বছরের অন্ধকার রাত্রির পর হলেও আমি আসব।


১৩.  প্রেম


প্রেমে পড়া কাকে বলে? এই যে আৃমি --
এই শহরটাকে ভালোবেসে পৃথিবীর অন্য কোনো ঝলমলে শহরে থিতু হইনি,
সন্ধ্যাবেলা বের হলে কোনো না কোনো বাড়ি হতে ধুপের গন্ধ পাই,
কবরস্থানে দাঁড়িয়ে নীল আকাশ যেমন দেখি
আবার বুড়িগঙ্গার পারে দাঁড়িয়ে দেখি বিকালের বিষণ্ণ সূর্যাস্ত,
রেল স্টেশনে থেমে থাকা ট্রেনের জানালা দিয়ে কেউ না কেউ অপলক চেয়ে থাকে,
সকাল বেলা হাঁটতে যেয়ে সিভিল অ্যাভিয়েশনের বড়ো পুকুরটাতে কস্তরি ফুল ফুটে থাকতে দেখি -
বাঁশঝাড়ের তলায় যত নিঃশব্দেই হাঁটি না কেন, শুকনো পাতার মরমর ধ্বনি শুনতে পাই,
বাড়ির সম্নূখে পিচঢালা রাস্তাটাতে হাঁটার সময় মনে পড়ে এখানে আগে মেঠোপথ ছিল,
প্রাইমারি স্কুলে নতুন কুঁড়িরা যখন হেঁটে যায়, তখন মনে পড়ে আমার কৈশোর কথা!

আমি এইসবের প্রেমে পড়ি, এইসব কী প্রেম নয়?


১৪.   এসো


এসো আমার হাত ধরো, অচেনা পথ ধরে চলে যাই কোথাও। যেখানে কোনো সভ্যতা নেই। আছে চাঁদের পাহাড়, আছে নদী। বনারণ্য আড়াল করে রাখবে আমাদের। আকাশও ঢেকে রাখবে। এমন মনুষ্যহীন লোকালয় কোথায় আছে ? যেখানে প্রথম কথা হবে আমাদের। প্রথম কোলাহল, প্রথম পায়ের চিহ্ন আমরাই এঁকে আসব।

মেঘ থম্ থম্ করছে। বৃষ্টিও ঝরছে। হোক বাদল দিন। তারপরেও বেরিয়ে পড়ব ঐ অচেনা পথেই। আনন্দময় হোক পথ চলা।


১৫. কোনো বসন্ত দিনে


এইসব অন্ধকার দিন, এইসব নিবিড় তিমির রাত্রি পেরিয়ে একদিন ঠিক দেখা হবে চাঁপাগন্ধ কোনো বসন্ত দিনে। তখনই খোঁপায় বেঁধে দেবো নিশি চন্দন। সেই অপার্থিব সাক্ষাৎ মূহুর্তে আমি স্থানু হয়ে গ্রহণ করব পার্থিব যত সুখ.....


১৬. আত্মার অনুভব


আচ্ছা, মরে গেলে তো মাটিতে চিহ্নহীন হয়ে যাবে এই দেহ। আর সেই মাটির উপর যদি মাধবীলতার ঝাড় হয়। যদি তার গন্ধে আকুল হয়ে ওঠে কোনো সন্ধ্যা।
কিংবা রাত্রি জোনাকীরা গুণগুন করে গান গায় সেই মাধবীলতার ঝাড়ে।
যদি কোনো কিশোরী ঐ মাটি ছেনে পুতুল বানিয়ে খেলা করে কোনো নিঝুম দুপুরে!

আমার আত্মা কী এইসবের কোনো অনুভবই পাবে না তখন?


১৭.      আঁধারে আলো


এই পৃথিবীতে পথ চলতে চলতে হঠাৎ কেমন যেন আঁধার নেমে আসে। চারদিক থেকে সব আলোগুলো নিভে যেতে থাকে। তখন আর পথ চলতে পারি না। লিখতে পারি না কোনো কবিতা। অনিঃশেষ আঁধারে কেমন যেন পথ হারিয়ে ফেলি। 

আঁধার সরাতে তখন তোমার প্রদীপখানিতে একটু  আলো জ্বালিয়ে  তুলে ধোরো।


১৮.        শেষ দৃষ্টি 


তোমার কোমলময়ী করপুট থেকে সব ঝরে যায় - প্রেম, মায়া মমতা, স্পর্শ সব। 
তোমাকে না দেখে আমি চলে যাব না কোথাও, স্থবির ও অবশ হয়ে যায়নি এখনও অনুভবের স্পন্দন।
চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে অন্তত আর একবার দেখে নেব তোমার চোখ, দেখব সেখানে কোনও অশ্রুবিন্দু লেগে আছে কী না। 


১৯.    সেই চোখ 


সেই চোখ যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, দীঘির স্বচ্ছ জলে তা  ছিল প্রতিবিম্বিত,  জলোচ্ছ্বাসের মতো সিক্ত, বিস্মিত মিলন অভিলাষী ও অশ্রুপাতক্ষম। কোনও কথাই বলিতে চাহিল না। শুধু মায়াটুকু রাখিয়া সে ঘুমাইয়া পড়িল।


২০.     অপ্রস্ফুটিত ফুল গলি


সেই কবে অপ্রস্ফূটিত ফুলগুলি বিকশিত না হয়েই 
ঝরে গেছে, যারা কলি মেলেছিল আমার প্রথম যৌবনের মৌবনে।
দখিনা বাতাসের কানে কানে তারা বলে গিয়েছিল চির বিরহিনীর নিশ্বাস ফেলে-
'তোমার আছে বিশ্ব, আছে অনন্ত আকাশ। তুমি সেথায় নক্ষত্র হয়ে বিচরিত। তুমি সেথায় মুখরিত।'

কিন্তু, তারা দেখতে পায়নি, 
মুখরিত নক্ষত্রেরও চোখে জল আছে । 


২১.     আমার স্বপ্ন 


একদিন আমার স্বপ্ন চোখে যখন তুমি এসে ধরা দিলে, মনের মধ্যে তখন যেন অদ্ভুত এক মুক্তির আনন্দ বয়ে গেল। এ মুক্তি অব্যবহিত অন্তর্জালকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে জানান দিল জগতে প্রেম আছে। শরীর নয়, আত্মার কাছকাছি স্বর্গীয় সুধা আছে। তোমার প্রেরণায় জীবন আমার এগিয়ে গেল। যুগ বয়ে যাচ্ছে তোমাকে নিয়ে। তোমাকে কতটা যে ভালোবাসি, এতটা যে কোন পাহাড়ের ক্ষমতা নেই পরিমাপের, এতটা যে কোন আকাশে না এ বিস্তৃত হবে, এতটা যে না কারো চিন্তায় এর জায়গা হবে।


২২.  অস্তকাল


মানুষ একটা সময়ে স্নিগ্ধ কোমল স্বভাবের হয়ে যায়। সেকি তখন দূরাগত পরপারে্র ডাক শুনতে পায়। এই কারণে ? নাকি কিছু সময় আসে শুধু ভালোবাসবার। পৃথিবীর ধূলো বালি মাটি খড়কুটোও তখন প্রিয় হয়ে ওঠে।

কোনো মৃত্যু চেতনা থেকে নয়, মৃত্যু ভয় থেকেও নয়, একটা সময় মানুষ ভালোবাসে চিরদিনের নীল আকাশকে, স্ব্প্ন দেখানো মানুষকে, নদী সাগর জনারণ্যকে।

আমি কি সেই রকম কোনো সময়কাল অতিক্রম করছি ? নিজকে কেমন যেন কাঙ্গাল লাগে। সবাইকে ভালোবাসতে ই্চ্ছা করে। সবার কাছ থেকে ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করে। আর, পৃথিবীটাকেও স্বর্গীয় মনে হয় !


২৩.   দূরের তুমি 


দুরে চলে গেছ। তবু তোমার ছায়া পড়ে থাকে। বর্ণিল ছবি আঁঁকা থাকে মেঘে। দুরে চলে গেছ। তবু বাতাসে গন্ধ ভাসে তোমার চুলের।
উড়ে গন্ধ যেন অমরাবতীর। বাতাসও মাতাল হয় সে রঙে বহু বর্ণময় হয়ে। যেন গান শেষ তবুও তার সিম্ফনী মিশে যায় দশ দিকে।

আজ তোমাকে অন্য নামে ডাকতে ইচছা করছে। নাম কী দেবো তার?
যদি ডাকি অমরাবতী ।


২৪.        পথের যত ভাবনা


পথকে নিয়েই পথিকের যত ভাবনা। পথের উপর যাদের চরণপাত পুষ্পবৃষ্টির মতো পড়েছিল আজ তারা কি কোথাও নেই?' পথ কি নিজের শেষকে জানে? যেখানে লুপ্ত ফুল আর স্তব্ধ গান বেদনাহত হয়। যেখানে পথিকরা পথ হারায়।


২৫.        আমাদের মংপু নেই 


একঘেয়ে লাগছে। আমাদের তো মংপু নেই। মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িও নেই।  যেখানে গিয়ে  মন পরিবর্তন করে আসব।  সেই গলিমুখের বাড়ি। একই ঘরের ছাদ। জানালা খুললে একই আকাশ। এমন করে থাকলে অনেক কথাই মনে পড়ে। ভুলে যাওয়া কথাও। ভুলে থাকা মুখ। ধুলোয় জমে থাকা প্রিয় পোট্রেট। কাল রাতে খুব খারাপ লাগছিল,  রক্ত প্রবাহে কেমন ভাটার টান। সেই পুরনো বেদন নতুন করে।

খুব মনে পড়ে। মাঝে মাঝে অনেক বেশি। এক নিঝুম একাকী বিকেলে ইন্দিরা রোডের একটি বাড়িতে শেষ পড়েছিলাম, সেও বত্রিশ বছর আগে। মন খারাপের উপর মন খারাপ এসে তাড়া করে।  আজ আবার মনে পড়ছে নিজের মতো করে -- 'আমার এই পুরুষের বাহু নিশ্চেষ্ট থাকতে চায় না। ইচ্ছা করে, স্বর্গমর্তের সমস্ত শাসন বিদীর্ণ করে তোমাকে তোমার জীবনের ব্যর্থতা থেকে উদ্ধার করে আনি। তার পরে এও মনে হয়, তোমার দুঃখই তোমার অন্তর্যামীর আসন। সেটি হরণ করবার অধিকার আমার নেই।'

সবই এলমেল কথা এই যাপিত জীবনের। কদিন অন্য কিছু নিয়ে থাকব। অন্য ভাবনা। অন্য কর্ম। পাণ্ডুলিপি পাণ্ডুর হয়ে পড়ে আছে। ঐদিকেই ধাবিত হোক এই প্রাণ। ওখানেই প্রাণ খুঁজে পাব। ফিরে যাব দেবযানীর কাছে।


২৬.        এই গৃহ এই সন্নাস


আমি সংসারেই খু্ঁজেছি সুখ, সংসারেই পেয়েছি শান্তি, স্ত্রী সন্তানদেরই করেছি মায়া। এখন এই মায়া ছিন্ন করে চলে যেতে হবে পরপারে। এই যে চলে যাবার ভাবনা, এই যে কষ্ট পাওয়া-  তারচেয়ে যদি সিদ্ধর্থের মতো  প্রথম জীবনেই গৃহ ছেড়ে চলে যেতাম কোনো আশ্রমে, কিংবা ফকির দরবেশদের মতো পড়ে থাকতাম কোনো মাজারে, সেই মনে হয় ভালো হতো। এতো মায়াও করতে হতো না, চলে যাবার এই যে বেদনা তাও পেতে হতো না। ঐখানেই জীবন নিঃশেষিত হতো। ঐখানেই মরে পড়ে থাকতাম । কেউ জানতোও না, কেউ কাঁদতোও না।


২৭.       তোমার সত্ত্বা 


তোমার সত্ত্বা আমার ভালোবাসার সুবাস নিক। তোমার পায়ের পাতা স্পর্শ করুক যেখানে আমরা হেঁটেছি এক সাথে। আমি চাই আমার মমতার ছোঁয়া লাগুক তোমার দ্রোহে আর ঘৃণায়। আমার সমস্ত গীতিকবিতা যাকে নিয়ে, সেই তুমি, আমার গভীরতম ভালোবাসায় নিয়ত পুষ্পিত, পল্লবিত হও। এভাবেই আমার প্রেমের নির্দেশে তুমি স্পর্শ করো আমার সত্তা। আমরা একদিন থাকব না, আামাদের পদচিহ্নগলো থাকুক এই পার্থিবে অনন্তকাল।


২৮.       সীমান্ত


বয়স হয়ে গেল এখনও স্বপ্ন দেখা শেষ হলো না। শুক্লপক্ষের রাতেও স্বপ্ন দেখি, কৃষ্ণপক্ষের রাতেও দেখি। কিন্তু সেই সবই দুঃস্বপ্ন ও ক্লান্ত নিশিচারণের। আর কয়েকবছর পর মাথার চুলগুলো গুণে বলে দিতে পারব। কপালের ভাজগুলোও আঙুলে ধরা পড়বে। আগে দৌড়ে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলতাম। এখন হেঁটে হেঁটে চলে যাই পার্কে ও লেকের ধারে। চাইলেই আর হাত পা ঝাপিয়ে পুকুরে সাঁতরাতে পারব না।

ছায়া পড়ে উঠোনে। রোদ্দুরে ঢেকে যায় দুপুর। একটি একাকী শালিক চুপচাপ বসে থাকে কার্নিশে। উড়ে গেলে পড়ে থাকে দুই একটি পালক। চাইলেই আগের মতো শিস মেলাতে পারব না কোনও সাদাকালো দোয়েলের সাথে।

পিয়ানোর রিডের উপর আর আঙুল চলবে না আগের মতো। চাইলেই গানও গাইতে পারব না। ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজ হবে কণ্ঠে। পারব না একটি গীতিকবিতা লিখতেও। কলম যে চলতে চাইবে না। 


২৯.      দিবারাত্রির কাব্য


কেমন যেন বিষণ্ণের দিন। কেমন যেন বিষণ্ণের রাত্রি। একাকীত্বের অস্থিরতা। নৈঃশব্দ্য চারদিক। কিছুই হলো না। এখন শুধুই ক্লান্তি। 
তোমার কী হয়েছে? কেউ জানে না। অন্ধকার জানে। বিষাদ রাত্রি জানে। 

এলমেল ভাবনা যত। তোমাকে অনেক নামে ডাকতে ইচ্ছে করছে। ডাকব? আজকে তুমি প্রথম শ্রাবণ। সঙ্গে চাঁপার গন্ধ মাখব।

কত কথা মনে পড়ে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজের পশ্চিম পাড়। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখেছি কত পদ্মার ঢেউ। ব্রিজের লাল পাতে লিখে রেখেছিলাম সাহানা জোয়ার্দারের নাম।

সে নাম মুছে গেছে। এখন সবই চাঁদের রাতের আবছায়া অন্ধকার। তারপর এল তোমার নাম। সে নাম নিয়ে কবিতা লেখা হয়। সে তুমি আমার সকল দিবারাত্রির কাব্য।


৩০.   স্বপ্নের কথা


আজ এই হেমন্তের সকালে প্রথম মনে পড়ল - রাতের ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নের কথা। জ্যোৎস্নার আকাশ ভেসে গেছে অন্ধকারে। আমার গল্পের কথা বলা ছিল সেখানে। সেখানেই ছিলে তুমি বিরাজমান। খুঁজতে হয়নি দূরে কোথাও গিয়ে। যখন স্বপ্ন ভাঙ্গল- দেখি, তুমি দূরে চলে গেছ। কাছ থেকে তোমাকে খুঁজলাম, পেলাম না। দূরে তাকিয়ে দেখি - তুমি কাছেই আছ।



৩১.   এই পথ যেন শেষ না হয়


আমি নিরন্তর পথ চলছি। এ চলার যেন শেষ নেই। কাশবনের ছায়া দিয়ে,পলাশ ডাঙ্গার মাঠ মাড়িয়ে,পদ্মফুলের গাঙ পেরিয়ে যে পথ  চলে গেছে সামনে, সেই পথ দিয়ে আমি দেশ গা্ঁ ছাড়িয়ে চলে গেছি বহূদর ! 
আমি একাই পথ চলেছি। পথ চলবে বলে যারা আমার সাথি হয়েছিল, তারা মাঝ পথ থেকেই আমাকে ফেলে চলে যায়।
তারপর কখন কোন্ স্বর্নালী প্রভাত বেলায় তুমি আমার পথের প্রান্তে এসে সাথি হলে।
তারপর থেকে তোমাকেই নিয়েই পথ চলছি, আর এই পথ চলা যেন কোনও দিন শেষ না হয়।


৩২.    আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবী 


আশ্চর্য রকমের সুন্দর আমাদের এই পৃথিবী। কত রহস্য ধারণ করে আছে এই পৃথিবীতে। কত সৌন্দর্যই না আছে এখানে। সেই সৌন্দর্যের শুধুমাত্র সূচীপত্রে চোখ বুলাতে গেলেও মানুষের একজীবন শেষ হয়ে যাবে । পৃথিবীর সব  সৌন্দর্য দেখবে সে কখন ! ঈশ্বর  যদি আমাকে সহস্র বছরের  জীবন দিয়ে বলত-- কোন্ গ্রহে আবার ফিরে যেতে চাও তুমি ? আমি বলতাম--- আমি আমার অসম্ভব সু্ন্দর  পৃথিবীতেই আবার ফিরে যেতে চাই । সহস্র বছর ধরে বে্ঁচে থেকে দেখতে চাই, পৃথিবীর সব রূপ রস সৌন্দর্যগুলি।


৩৩.          কমলদীঘি


একদিন এক অস্তগামী সূর্যের বিকালে স্নান সারিয়া রমণী বসিয়াছিল কমলদীঘির শান বাঁধানো ঘাটের সোপানে। বিনম্র কুচভারে সে জলের দিকে তাকিয়া ভাবিতেছিল,  'তোমাকে আমি প্রাণ দেবো তবুও আমার প্রেম থাকিবে আমার অন্তরে।' 

দক্ষিণের দিকে হইতে ঝিরিঝিরি বাতাস বহিতেছিল। মাথার কালো কেশ এলমেল উড়িতেছিল। কী কথা ভাবিয়া সে আবার সোপানে পা রাখিল। জলে নামিয়া কমল ছিড়িল। সে নিজেই মৃণাল পরিধান করিল খোঁপায়। বিমুগ্ধ ছিল রমণী। জলের পরিধি কত, সে বুঝিতে পারিল না।
 
সে ছিল কমলিনী। রাজ্যের সব মানুষ তাহাকে কমল বলিয়া ডাকিত। তাহাকে কেউ খুঁজিয়া পায় নাই। কিন্তু সে যে অজস্র কমলের মাঝে কালকালান্তর ধরিয়া ফুটিয়া আছে। সে যে ভাসিয়া বেড়ায় দীঘিতে। তাহার ভেজা পাপড়িতে অশ্রু-সম-জল লাগিয়া থাকে। রোদ্রে তাহা শুকিয়া যায়। সবাই ঐ দীঘিকে কমলদীঘি বলিয়া ডাকে।

আজও কোনো উন্মূল প্রেমিক ঐ দীঘির পাড়ে বসিয়া ভাবে -- 'তার রূপ-রত্নাকরে ;
মগ্ন হয়ে, তারে আমি সঁপিলাম মন!'


৩৪.         গতস্য শোচনা নাস্তি


যারা একদিন ভালবেসে ভালবাসা পায়নি, তারা অনেকেই নক্ষত্র হয়ে  চলে গেছে। কত অসমাপ্ত চুমুর দাগ পড়ে আছে নির্গন্ধহীন। রাতে সারা ঘর অন্ধকার হলে পাশে ঝোপের ভিতর জ্বলে ওঠে দু-একটি জোনাকি। কবেকার নির্মাল্য ভালবাসার কথা মনে পড়ে যেয়ে মনখারাপ হয়।

স্টেশনের হুইসেল বাজে দূর থেকে। শুনি বাঁশি। এমন গভীর রাতে, অনেক দূরের সুর ভেঙে হঠাৎ গান ভেসে  আসে। 

কে যে বাঁশি বাজায়? যেই বাজাক বাঁশি। 
মনে পড়ে প্রেমিকার ঠোঁট। ঠোঁট কাঁপছে তার। চোখ বন্ধ করি। এই আঁধারেও  অজস্র ঘাসফড়িং উড়ে চরাচরে। 'সুরে সুরে বাঁশি পুরে তুমি আরও আরও আরও দাও তান...।' কথা বলে কে যেন। বলে, ঘুমালে নাকি?

শিউলিবনে ভালবাসার মানুষ কোমল গান্ধারে কাকে যেন কী বলে। বলে -- তোমার ঠোঁটে ধানের ছায়া। কুসুমপুরের আমছায়ার মতো সুনিবিড়। সেই নিবিড় গহীন ছায়ায় হারিয়ে যায় এই শহরের এক রাখাল বালক।

জীবনের কত হাস্নাহেনা সুরভিত দিন গ্লানিতে ভেসে গেছে। এইসব নিয়ে ভাবিনা তা।  ভেবে কী লাভ?  গতস্য শোচনা নাস্তি।


৩৫.        গোলাপ বউ


নিঝুম ছিমছাম বাড়িতে সেই প্রথম একবার পরী তার  পালক খুলেছিল। আবার কি তবে মনে মনে চাইব তোমাকে? পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছ সুখের সেই তুমি। বাতাসের গান জলে ডুবছে ভাসছে। আবার তুমি যদি রাতে নেমে আসো এই বাড়িতে? প্রদীপের পাশে এসে ফিসফিস করে বলো, 'জানিনা আমি জানিনা। তুমি জানো?'
ছাতিম ফুল নাকি মনের কথা শোনে। নীলকণ্ঠ পাখির দেশে কানে কানে বলবে,  চলো ওই একলা যুবকের বুকে। যে একা একা এই শহরে ঘোরে, তার হাত ধরে একবার হেসে ওঠো। শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ছাতিম ফুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা সুখের শিশিরে তুমি ঠোঁটের দাগ রেখে চলে যাও। যে যায় সে আর আসে না। যে আসে সে এখন যুবকের সন্ধ্যার বুকে একাকী টবে রাখা গোলাপ বউ।


৩৬.      আকাশ ও নদী 


আকাশ আর নদীর দূরত্ব যোজন যোজন দূরে। তবুও নদী ভালোবাসলো আকাশকে। আকাশ তার দূরের নীলিমার নীলের মেঘ থেকে ঝিরিঝিরি জল ঝরে দিত নদীতে। আবার কখনও অজস্র নক্ষত্র বীথির ছায়া ফেলত আবক্ষ নদীর জলে। আবার কখনও প্রচণ্ড রবি কিরণের আলোকসম্পাত এসে পড়ত উচ্ছল বাঁকে। উত্তপ্ত হয়ে উঠত পাড়ের লতা গুল্মও।

প্রেমিকার কিছু করার নেই। সে শুধু তার উদাসি প্রেমিক আকাশের কাছে থেকে জল আর রবি কিরণই গ্রহণ করতে পারত। প্রাণের কোনো সারাৎসার জলবিন্দুর সাথে মিশিয়ে দিয়ে কখনই সে তা আকাশের কাছে পৌঁছাতে পারত না।


৩৭.          হেমন্তের ভোর 


হেমন্তের ভোর সবসময় বিন্দু বিন্দু শিশির বিন্দুর মতো শুচি শুভ্র মনে হয়। আজ প্রভাতে হাঁটতে যেয়ে তা মনে হলো না। কেমন যেন আজ আকাশ। সারা আকাশে বিবর্ণ মেঘরাশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হাঁটতে পারছিলাম না। ব্যথা লাগছিল পায়ে! পথের উপরে পা থেমে আসছিল।

আকাশ ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্য কখনও দেখিনি। আজ মনে হলো যেন সব খণ্ড খণ্ড হচ্ছে। মনে হলো এই বিশ্ব চরাচর বিমুখ। নীরব নিথরে কী গান বাজছিল দূরে, অনেক দূর থেকে সেই সুর আসছিল ভেসে ---
'হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে   যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে--
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।
অন্তরগ্লানি সংসারভার   পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই।'


৩৮.   বাউল দুপুর 


ইচ্ছা করে কোনও বাউল দুপুরে একটি ছন্দহীন কবিতা লিখি। একাকী কোনো পাখি ক্লান্ত চোখে যেমন চেয়ে থাকে, 
তেমন করে পৃথিবীর দিকে চেয়ে থেকে ভালোবাসার কোনও গান শুনি।
কেউ কী নেই? নিস্তব্ধ দুপুরের এই নিস্তরঙ্গ শব্দগুলোকে
বিসমিল্লা খাঁর সানাইয়ের সুরের মতো মায়াবী করে কন্ঠে তুলে নিতে?


৩৯.        এসো ছুঁয়ে থাকি


কত কালচে রাত্রির অন্ধকার। কত পথ ঘুরে তবুও যেতে ইচ্ছা করে তোমার কাছে কুসুমপুর তুমি কতদূর!এই প্রবাস বিভূঁইয়ে মরতেও ইচ্ছা করে না।

কার্তিকের পাঁকা ধানের মতো তুমি নুয়ে আছ, তোমার শরীর জুড়ে শস্যের অপার গন্ধ। হাত ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে, নরম ঠোঁটের স্পর্শ নিতে ইচ্ছা করে। যেতে ইচ্ছা করে তোমার কাছে, খুব তাড়া করে এই হেমন্তেই।

অমাবস্যার রাত্রিতে নক্ষত্রেরা  ছুটে আসে এই পৃথিবীতে। সেই সব নক্ষত্ররাজীর আলোয় গোপন পথগুলো আমাকে ঠিকই চিনে নিয়ে যাবে একজন অন্তরাক্ষীর কাছে। 

হেমন্তের চিবুক ছোঁয়া আলোয় থিতু হবো সেখানে। এসো তোমাকে ছুঁয়ে থাকি।


৪০.        দুঃস্বপ্নবাস


যখন অবসাদ নেমে এল শরীরে  তখনই দুচোখের ঘুম এল। জীবন এত ক্লান্ত হলো কেন? একদুপুর  ঘুমিয়ে কাটল প্রহর। তারপরই সেই দুঃস্বপ্নটি দেখা। কেন আর্তনাদ করে উঠলাম। সৃষ্টিকর্তার নাম মুখে আনলাম। নাকি অসহায় সমর্পণ তারই কাছে। সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম তখন, আর তখনই এই দুঃস্বপ্নে জেগে ওঠা।

'কোন্‌ দূরের মানুষ যেন এল আজ কাছে, তিমির-আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে।
বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা , গোপন-মিলন-অমৃতগন্ধ-ঢালা।  
মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি-- হার মানি তার অজানা জনের সাজে।'

বিছানায় বসে নিঃশব্দে রোদন করলাম। যেখানেই চোখ মেলি, দেখি চারদিকে কংক্রিটের দেয়াল। কোনো অলিন্দ্য নেই। কাঁচের দরজার ওপাশে পুরু কাপড়ের পর্দা ছিল। একবিন্দু শীতল হাওয়ার জন্য বিফল চাওয়া। এক ঝিলিক আলোর জন্যেও। কি দুঃসহনীয় অতিক্রান্ত  সময়কাল ! কেউই দেখতে পেল না আমাকে। আমার চোখও না, এবং লুকায়িত অশ্রু...।


৪১.       নির্জন নীরবতা


হেমন্তের শীত এখনও জেঁকে আসেনি পৌষের শীতের মতো। সন্ধ্যা রাতের আঁধারও তেমন প্রগাঢ় হয়নি। বিকাল থেকে পাঁজরের নীচে তীব্র ব্যথাটি ওর ছিল না। তবুও হাত ধরে উঠোনে নিয়ে যেয়ে নারিকেল গাছ তলায় কাঠের চেয়ারে যেয়ে দুজন বসি। আঙ্গিনায় নিয়ন বাতি জ্বালানো ছিল না। নির্লিপ্ত চোখে আকাশ দেখছিলাম। দেখি, কোথাও চাঁদ নেই। 
রাত্রির নিভৃত আকাশও চেয়ে দেখছিল যেন আমাদের। কোনও কথা নেই। কেমন নির্জন নীরবতা। খুব বলতে ইচ্ছা করেছিল ওকে। কোনও মিনতি করেও নয়। এমনি কপালে কপাল রেখে ---

'আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমনি করে গাও গো। আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনি করে চাও গো।'

৪২.        একি তৃষ্ণা 


জীবন কাটে না এ জীবনে আর, জীবন ভরেও না এক জীবনে। একি তৃষ্ণা আমার। একি ক্লান্তি নিয়ে বসে থাকি। অনেক কাছে থেকে দেখি অনেক দূরের আশার বিন্দু! আজ দক্ষিণের দুয়ার খোলা আছে। আসুক বাতাস আজ দক্ষিণ থেকেই।


৪৩.       আত্ম প্রকৃতি


আমি সবসময় উদাসীন প্রকৃতির একজন মানুষ। নিজেকে কখনো যাযাবর, কখনো স্বার্থপর, কখনো ক্রুর, কখনো পলাতক মনে হয়। আমি চিনতে পারি না নিজেকে। কে ভালবাসে, কে বাসে না। তাও জানিনা । জীবন কোথা থেকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। কেমন তার পথচলা, কেমন তার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, সে হিসাবও কখনো করি নাই । 

যমুনার চরে উথাল পাথাল ঢেউ খায় কাঁশবনের ঝাড়ে।  কেমন তার জীবনকথা, কেমন তার দিন লিপি। কেউ প্রাণ খুলে কখনো তা জানতে চায়নি।


৪৪.      প্রিয়ন্তী


তোমার নীল নয়নে শ্রাবণ মেঘের বিদ্যুৎ ঝলক। কন্ঠে মধুমঞ্জরির মালা। দেহলতায় পদ্মদামের লাবণ্য। তোমার শরীর অমল ধবল জ‍্যোৎস্নায় স্নাত। চোখের পাতায় নাগকেশরের স্পর্শ। হে আমার প্রিয়ন্তী, তোমার কেশ কুন্তলের গন্ধে মদির এই ঘর। আমাকে তুমি দীপ্ত করো।


৪৫.         আমার আনন্দ 


চলে যাব বলে যে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে আর ফিরে আসে না। কারণ, সে তার গন্তব্য জানে। ফিরে তারাই আসে, যারা পথে নেমে পথ হারিয়ে ফেলে। চারিধারে যারা আঁধার দেখে। 

এই সব পথহারা, ঘরহারা মানুষদের পথ চিনে দেওয়াই আমার আনন্দ।


৪৬.     অস্তিত্ব 


তুমি প্রতিক্ষণ আমাকে অসীম এক শূন্যতার দিকে ঠেলে দিয়েছ। মুক্ত করে নিতে চেয়েছ নিজেকে। আমার জীবনের সকল অস্তিত্ব থেকে, সকল বাঁধন থেকে, সকল টান থেকে তোমাকে মুক্তি দিলাম। তুমি সুবিমল আকাশে মুক্ত হয়ে বিচরণ করো। এখন থেকে তুমি চিরকালের জন্য  আকাশের। আমার অস্তিত্ব, আমার প্রেম  তোমার কোনো কিছুতে রেখ না। না শরীরে, না মনে।


৪৭.      কেউ আসেনি


আমার  চোখ সেই পথের দিকে চেয়ে থাকে, যে পথের সকল লতা গুল্ম ঘাস পায়ে মাড়িয়ে তুমি চলে গেছ। তারপর আকাশে জমেছে মেঘ, ঝরেছে জল, সব পথ কা্দাজলে ভেসে গেছে কিন্তু মেঘের নীচে সেই কাদা পথে হেঁটে কেউ আর ফিরে আসেনি । এই যে এত জল, এত মেঘ --- যে জলে ভিজে ভিজে আমি একাই হাঁটছি, আমার এই বৃষ্টি ভেজা একাকী ভালোবাসা উপভোগ করল না কেউ।


৪৮.        অশেষ করেছ 


দিনের বেলায় ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকার বানিয়ে একাকী শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।  কোনও আলো যেন চোখে না লাগে। কোনও কোলাহল যেন শুনতে না পাই।  নৈঃশব্দের মধ্যে কাটুক আমার সময়। জীবন যখন শুকায়ে যায় তখন কি এই ইচ্ছাগুলো হয় ! 

কেন যে সংসারে থাকি ! জগতের সব আনন্দ করুণ ধারায় কা্ঁদে। তারপরেও স্তব্ধ এই অন্ধকার থেকে বা্ঁধ ভাঙ্গা আলোয় বেরিয়ে যেতে মন চায়। কেউ একজন আমার জন্য আজও সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়ে রাখে। তার জন্যেই আমার এই পৃথিবী, আমার সন্তানেরা। সেই আমার জীবনকে মহিমান্বিত করেছে।

'আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।'  


৪৯.      দাঁড়াও সময়


পৃথিবীর বয়স কতো কিংবা মহাকালের? পৃথিবী এবং মহাকাল আরো কতো শ' কোটি বছর ধরে চলবে? ধর্মে যাই থাক, মানুষের আয়ু এত ক্ষুদ্র কেন? একটি ঢিল জলে ফেলতে যতটুকু সময় লাগে, মহাকালের তুলনায় তা একটি অণুমুহূর্ত মাত্র। মানুষ এইটুকু অণুমহুর্তের আয়ু নিয়েই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। অথচ এই পৃথিবীতে মানুষই সবচেয়ে বেশি আবেগ দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টিকে ভালবাসে।
আর সেই কী না এই মায়াময় পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সময়ের জন্য বেঁচে থাকে।


৫০.     অনীহা 


তুমি উঠতে বসতে শুইতে আমার খুঁত ধর। নানান খুঁত ধরে তুমি চলে যেতে চাও। কিন্তু একসময় কী নিখুঁত ভাবে তুমি আমার হাতটি ধরেছিলে। 
তখন বলতে কী সুন্দর সন্ধ্যা তারা! কী ঝলমল ময়ুরাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটা, কী অপূর্ব দেখতে ঘাসফড়িং, কী মায়াবী এই হেমন্ত রাত।

এখন স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নের মনে কর। তারার আকাশে তারা খুঁজে পাও না। হাওয়ার রাতে শব্দ শুনতে পাও না। সোনালি রোদ্দুরে পথে বের হও না। গান গাও না। গল্প শোনাও না।

যে চোখ দেখত পরম বিস্ময়ে! সে চোখে আর কোনো মায়া নেই, জল নেই, ঘুম নেই। যে বুক টেনে নিত স্মিত আলিঙ্গনে, সে বুকে এখন ক্লান্তি। শান্তি নেই। আদর নেই। কাছে টানতে অনিহা। কেমন অবহেলা। কেমন অনাদর ছুঁয়ে আছে..........


৫১.      ধূসর অন্ধকার


আমি প্রেম চাই না। ঘৃণাও না। এখানে আমার ভালো লাগেনা। এই ভূবনে যত কোলাহলে । নির্জনতা আমার ভালো লাগে। তোমরা আমার মৌনতাকে ভেঙ্গে দিও না। আমি চলে যেতে চাই। যে পথ দিয়ে আমি হেঁটে যেতে চাই, সে পথ তোমরা কেউ অনুসরণ করো না। জীবন এখানে ভঙ্গুর। কোনও স্বপ্ন নেই। তোমরা কেউ স্বপ্ন দেখাতেও পার না। তারচেয়ে চলে যাই। যেখানে যাব, সেখানে শান্তি হয়তে নেই । আছে ধূসর নির্জন কোনও অন্ধকার! সেখানে যেয়ে শুনব বিবর্ণ জীবনের সঙ্গীত।

 একাকী দেখব সেখানে প্রভাতী সূর্যের লাল আভা। আমি আমার আত্মার মাঝে অনুভব করতে পেরেছি, সেখানেও আছে, পাখির কলতান। আছে ইছামতি নদী। ছোট ছোট ঢেউয়ের দোলা দোল দেবে সেখানেও। সেই নির্জন তীরে আর কেউ থাকবে না। একাকী দেখতে পাব সূর্যাস্ত। সন্ধ্যার মেঘমালায় ভাসাতে পারব আমার ভেঙে যাওয়া সকল দুঃস্বপ্নের বেদনার ছায়া।
সেখানেও রাত নামে স্তব্ধতায়। আমার ঘূম পায়। ঐ ধূসর আঁধারেই তোমরা আমাকে ঘুমাতে দাও।


৫২.    দুটি প্রাণ 



পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন। কোনও মানুষ রবে না আর সেখানে। যদি সেই বিরাণ পৃথিবীর মাটিতে বুঁদবুঁদ করে কোথাও কোনো প্রাণ জেগে ওঠে। তবে সেই প্রাণ বা প্রাণ দুটো কার হবে? সে কী মানুষের প্রাণ হবে? নাকি পাখি, জীবজন্তু, কিংবা কোনও সরীসৃপের? যদি মানুষের প্রাণ হয়, তবে কোন্  দুইজনের প্রাণ জেগে উঠবে মাটি থেকে?

যদি তুমি আর আমি হই সেই দুইটি প্রাণ। যদি মানুষ হয়ে আবার ফিরে আসি এই পৃথিবীতে? যদি গড়ি আবার আবাস ! কেমন হবে? 

সেদিন প্রাণের সাথে প্রাণের মিলন হবে।


৫৩.         গন্তব্য 


এই ভূলোকের কোথায় হবে আমার গন্তব্য। কোন অরণ্য বনছায়ায় চলতে হবে পথ। কোথায় আছে পাহাড়,নদী, উপত্যকা। কোথায় সেই সিংহ দুয়ার, জীবনের অনন্ত ঝর্ণাধারা। একাকী নদী তীরে অনাহুতের মতো রয়েছি দাঁড়িয়ে। বেলা পড়ে যাচ্ছে । বালুচরে কোনও বক, ডাহুক, পানকৌড়ি নেই। শিকারীরা ধনুক হাতে ফিরে গেছে লোকালয়ে। জল জেলেরাও চলে গেছে সন্ধ্যা কুটিরে। মেঘগুলো ভেসে বেড়ায় দূর নদীর প্রান্তর জুড়ে। সন্ধ্যা-আকাশ বয়ে আনছে কি অনাস্বাদিত কোনও বার্তা ? কি ঘটতে চলেছে, এই বালুচরবর্তী জনহীন জনপদে। এমন ধূসর সময় তো কখনো আসেনি। নিস্প্রভ রৌদ্রগুলি চরাচরে মিলে যাচ্ছে। আঁধার ধেয়ে আসছে। কেমন নৈঃশব্দ চারদিক। কৃষ্ণ গহবরে কি গন্তব্য আমার ? যেখানে নিঃশেষিত হবে প্রাণ।


৫৪.      গল্পগুলো ভালোবাসার  


আচ্ছা ভালোবাসা গুলো কেমন হয়? ধরুন, একটি ব্যস্ত রাস্তা পার হবো। সেই ক্ষণে সে যদি এসে আমার হাত ধরে বলে -- দুদিকে দেখে সাবধানে রাস্তা পার হবে।

আমার হাতে বেশ ওজনের বাজারের ব্যাগ। সে হতদ্যোম হয়ে কাছে এসে যদি বলে --- তুমি নেবে না। আমাকে দাও। তোমার বুকে ব্যথা হবে।

মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে অসহ্য ব্যথায় কাতরাচ্ছিল সে। মুখে তুলে ঔষধ খাওয়ার সামর্থ্যটুকু তার ছিল না। কেন ডাকা হলো না আমাকে? এই কথা বলতেই সে যদি বলে -- তোমার ঘুম আমি ভাঙ্গাতে চাইনি।

আবার এমনও আছে --- সেই কবে তার ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে আইলাইনার বের করে চোখের কাজলরেখা ঠিক করে দিয়েছিলাম। সেই কথাটি সে মনে রেখেছে এখনও যত্ন করে।

এলমেল হয়ে যাওয়া তার শাড়ির কুচিগুলো রাস্তার উপর পায়ের কাছে বসে সেই কবে ঠিক করে দিয়েছিলাম, এই কথাটিও সে মনে রেখে আজ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে।

আমি টিপ পরা খুব পছন্দ করি -- তাই সাজতে গিয়ে এই কথাটি নাকি তার আগে মনে থাকে -- টিপ পরতে হবে।

এমন আরও কত কিছু আছে। ধরুন, হাঁটতে গেছি --- উদোম আকাশের নিচে পথের ধারে এক লোক চা বিক্রি করছে। কেটলি থেকে ঢেলে দিল কাগজের কাপে গরম দুকাপ চা দুজনকে। এখানেও নাকি সুন্দর ক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়।

গুগল ঘাটছিলাম । হঠাৎ চোখে পড়ল এই নিউজটি। বিষয় বার্ষিকীতে স্বামীকে কিডনি দিয়ে প্রাণ বাঁচালেন স্ত্রী। ভালোবাসার জন্য এমন ত্যাগ স্বীকার করে ! এ কী মানুষ? নাকি ঈশ্বরী। এইভাবে বেঁচে থাকুক ভালোবাসা।

         
৫৫.     তুমি 


তুমি যখন ছিলে না:

কোনোদিন ঘরে সন্ধ্যা বাতি জ্বালানো হয়নি
ঘরের দেয়ালে আর ছাদে ঝুল জমে থাকতো
টেলিফোনের রিসিভারের নীচে জমে থাকতো ধূলো
বাড়ির আঙ্গিনা আগাছায় ভরে যেতো
সকালের ঘুম ভাঙ্গতো দুপুরে, সন্ধ্যাকে মনে হতো সকাল
দুপুরের ভাত খেতাম রাতে-
রাতের ঘুমগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে যেতো নির্ঘুমে।

তুমি যখন আসলে:

ট্রাউজার্স পরিপাটি, হ্যাঙ্গারে ইস্ত্রি করা সার্ট ঝুলে থাকে
জুতার সক্ গুলোতে সুগন্ধি দেওয়া থাকে, ফুলদানিতে ফুল
মেঘের আকাশ হয় তারাভরা রাত, আলোয় ভরে ওঠে ভূবন
মেঝেতে বে্ঁজে উঠলো তোমার পায়ের শব্দ
আমার একাকীত্বগুলো পেলো প্রাণ, প্রেম হলো গান
সন্ধ্যার কলিরা ফুল হয়ে ফোটে রাতের পূণ্যতায়।

তুমি যখন থাকবে না:

সাদা চুলগুলোতে আর কলপ মাখা হবে না
গো্ঁফ হয়ে যাবে ঋষিদের মতো শুভ্র সমুজ্জল
পার্কের বেঞ্চে শুয়ে থাকবো রৌদ্রছায়ায়
ঘরে ফেরা হবে না অস্ত সন্ধ্যাবেলায়
রেল লাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে বিপন্ন পথিকের মতো
হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব দূরের কোনও স্টেশনে
হূইসেল বাজিয়ে ট্রেন আসবে, ট্রেন চলে যাবে
 উদাসীন পথে হেঁটে হেঁটে আর ফেরা হবে না ঘরে।


৫৬.   ক্যামেলিয়ার সুবাস 


বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে যে আকাশ আজ দেখলাম, সে আকাশ যেন মৌনতায় কাঁদছে। বাগানে যে ক্যামেলিয়া ফুলগুলো হেমন্তের গোলাপ হয়ে ফোটার কথা ছিল, ওরা আজ তা ফোটে নাই। গোবিন্দগঞ্জের ঐ কালো সাঁওতাল মেয়েটার কানে আজ আর ক্যামেলিয়া ফুল নেই। এই সুন্দর শ্যামল মাটিতে নেই আর সেই সোঁদা গন্ধ। ভেবেছিলাম ক্যামেলিয়ার সুবাস মেখে আজকের দিনটা শুরু করব, তা আর হলো না।


৫৭.       যদি থাকি কাছাকাছি


সংসারের জন্যে, উত্তর পুরুষের জন্যে, সভ‍্যতা তৈরির জন্য মানুষ যুথবদ্ধ হয়। নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য মানুষ তার সঙ্গী বেছে নেয়। যুগলবন্দী সেই সংসারে মানুষ কত যে সংগ্রাম করে। কত যে ভালোবাসা হয় লেনদেন। 

অনেক দুঃখ জড়াও আছে, আছে ভাঙ্গা গড়াও। তারপরও মানুষ একা হয়। হৃদয়ের গভীরে একাকীত্ব অন্তঃশীল হলে বুঝতে পারে, সে আসলেই নিঃসঙ্গ এবং সঙ্গীহীন।

এই বেদনাক্লীষ্ঠ পৃথিবী থেকে একদিন চলে যেতে হবে। হয় তোমাকে আগে, না হয় আমাকে। তখন কী কেউ একজন সত্যি একা হয়ে যাবে? এর কী কিছু ব‍্যতিক্রম হতে পারে না? ধরো, আমি আগে চলে গেলাম। তুমি কী তখন একা হয়ে যাবে? মনে করবে -- তুমি একা হও নাই। আমি শুধু এই ঘর থেকে অন‍্য ঘরে চলে গেছি। কাছাকাছিই আছি ঠিক পাশের ঘরেই।



৫৮.   আমাদের ভালোবাসা 


হেমন্তের বিকেলের শেষ রোদ তার মুখের উপর এসে উপচে পড়েছিল। নোলক পরা মুখখানি সোনালি আলোয় ঝলমল করে উঠেছিল। ধূপছায়া রঙের শাড়িটি তার হয়নি বিবর্ণ । বিকাল আর সন্ধ্যার এমনই মায়াবি সন্ধিক্ষণে বুকের উপরে কপাল রেখে সে বলেছিল --- ওগো, আমার খুব ভয় হয়। আমাদের ভালোবাসা কখনই যেন ঘৃণায় শেষ না হয়।


৫৯.  ধূসর সন্ধ্যা 


আজ এই ধূসর সন্ধ্যায় মন কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কি ভেবে এই মন খারাপ হওয়া বুঝতে পারছি না। জীবন তো ভালোই চলছে, তবে কেন এই বিষাদ, এই বিষণ্ণতা ! অতীতের কোনও গ্লানি কিংবা কোনও কিছু না পাওয়ার আর্তি নয় তো? যা গোপনে এই সন্ধ্যায় দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঝরে পড়ছে।


৬০.       দুয়ারে তুমি দাঁড়িয়ে 


দুয়ারে তুমি দাঁড়িয়ে , কেমনে বলি তুমি ফিরে যাও, কেমনে বন্ধ করে দিই মুখের উপর দুয়ার? 
আবার কেমনেই ঘরে তুলে নিই তোমাকে, এই ঘরে যে আর একজনের বসবাস - বহুদিন ধরে পরম বিশ্বাসে সেই আমার  জীবনব্যাপি জড়িয়ে আছে।

                                                                                          '




রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২২

তুমি সেই মায়াজম ( অনুকবিতা গ্রন্থ )



তুমি সেই মায়াজম ( অনুকবিতা গ্রন্থ )

উৎসর্গ -

বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী
তৌফিকুর রহমান রাঙা - কে

এই ছেলেটা আমাকে দিয়ে জোর করে কবিতা লেখায়,
এবং সেই কবিতা আবৃত্তি করে
মানুষকে শোনায়।


১.

ধরতে চেয়েছি আঙ্গুল তুমি এগিয়ে
দিলে হাত,
ধরতে গিয়েছি হাত, তুমি এগিয়ে
দিলে বক্ষ,
বলেছিলে -- বুভুক্ষু আমি, এই বুক চৌচির প্রান্তর।
শীতল করো, অমৃত সুধা করো পান।

২.

ছায়া রোদ্দুর বিকালে কোথায় যেন গান বাজে
কে যে গায় গান, তাকে আমি চিনিনা
আমার কেবলই ঘুম পায়,
মনে হয় রাত্রি নেমে এল তারই করুণ সঙ্গীতের সুরে সুরে।

মাঝে মাঝে তার ছায়াখানি দেখি ---
রোদ্দুরের উত্তাপ হিমেল বাতাসে হিম হয়ে ভাসে
তখন সত‍্যি যে রাত হয়,
আমার ঘুম পায়, তবু জেগে থাকি যদি সে আসে।


৩.


যে পথে আমার যাওয়া হয়নি
আমি চলে যাচ্ছি সেই পথ ধরে অনেক দূর
কেমন যেন অবশ লাগছে আমার পা
কেমন যেন দুঃখ ছেয়ে আছে
পথের ধুলোর উপর।

যেথায় যাচ্ছি সেখানে তুমি নেই
সেথায় তাই দুঃখও নেই --
ক্লান্তির ছায়া পড়ে আছে পথে পথে
পায়ে পায়ে আমার কোনো ক্লান্তি নেই।

৪.

কঠিন প্রস্তরের উপর খোদাই করে লিখে রেখে যাব আমাদের নাম ও কিছু নির্মল শব্দাবলি। প্রাণহীন এবং অনুজ্জ্বল সেই শব্দগুলি চেয়ে থাকবে জ্বলজ্বল করে পৃথিবীর স্বরূপের দিকে। দূর্বা ঘাস আর শিলালিপির উপর হেমন্তের শিশির ঝরে পড়বে নির্জন রাত্রি প্রহরে।

খোদাই করা এই অভিজ্ঞান চিহ্ন থাকবে অনন্তকাল,
এখানেই পড়ে রইবে আমাদের স্বপ্নের কথা, আমাদের আরক্ত মুখচ্ছবি।

৫.

আদিমতা তুমি ফিরে এসো না, আমরা সভ্যতায় থাকতে চাই
বর্বরতা তুমি ফিরে এসো না, আমরা সম্প্রীতিতে থাকতে চাই
ধংস তুমি উন্মত্ত হইও না, আমরা শান্তির জনপদ এখানে নির্মাণ করেছি
আগুন তুমি জ্বলে উঠো না, আমরা শীতল আবাস এখানে গড়েছি।

৬.

তোমাকে ভালোবাসতে কখনও ক্লান্ত হই না। তোমার 'না' শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত।

৭.


অভিমান করলে আমিই তা ভাঙিয়ে দেই। না ভাঙলে ভালোবাসা হেরে যায়। আর, অভিমান আছে দেখেই ভালোবাসা জিতে যায়।

৮.

কতটুকু তোমাকে ভালোবাসলে আকাশে মেঘ হবে,
মেঘগুলো জল হবে, পূর্ণতা পাবে নদী --
কতটুকু ভালোবাসলে বসন্তে ফুটবে ফুল
মৌবন হবে শোভিত, মৌমাছিরা গুনগুন করবে চারদিক ,
কতটুকু ভালোবাসলে তোমার কস্তরী ঠোঁট সপ্রতিভ হবে, কাজল চোখে তারা জ্বলবে,
কুচবরণ কেশে গন্ধ ছুটবে !
কতটুকু ভালোবাসলে তুমি হবে নির্জনে
নগ্নিকা একজন।


৯.


যদি কখনও নাম ধরে তোমাকে ডেকে বলি -- ভালোবাসি।
আর ঠিক তখনই যদি কল্লোলিত হয়ে ওঠে সমুদ্র,
যদি প্রচণ্ড ঢেউ ব্যেপে এসে বলে -- আমার জলে তোমাদের স্থান নেই।
আর ঠিক তখনই আকাশ তার ছায়া ফেলে বলে -- স্হান দিতে না পারি, ছায়ামাখা রোদ্রের দিন তোমাদের দেব।
তবুও তুমি বলে দাও -- ভালোবাসি।


১০.

যার ভিতরে মায়া নেই, তার সাথে জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছা করে না। আর জড়িয়ে পড়লেও তাকে ছেড়ে আসতে অসুবিধা হয় না।


১১.


যতই কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দাও
বংশী নদীর জলে,
ততই দূর থেকে কাছাকাছি চলে আসি।
যতই বুকের পাজরে বেঁধে রাখো তুমি
সুনিপুণ শৃঙ্খলে --
ততই তোমাকে আমি বেশি ভালোবাসি।

১২.


কী বেদনা লুকিয়ে রাখি অন্তরে
কী যাতনা পুষে রাখি গোপনে।
দিবা নিশিতে ভরে থাকে বিষণ্নতা, অবসাদ নিয়ে করি জীবন যাপন।
ইচ্ছা হলে ছড়িয়ে দিও মাধুরীমাখা ভালোবাসা,
বড়ই কাঙ্গাল হয়ে উঠি সময়ে অসময়ে।


১৩.


পরমেশ্বরী, তুমি আছ আমার ভূবনে
আঁধারের উপর আলো ফেলে,
কত রাত্রিতে কত নক্ষত্র আভায়
করেছ তুমি দান তোমার সকল কুসুমসুধা
পরশ-কম্পিত প্রাণে।

আমি ক্ষণিক নহি, তুমি নহ ক্ষণিকা ---
তোমার মাধুরী ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বাতাসে
তুমি রবে জনমে জনমে পরজনমে,
সে কথা আমার মন জানে।

১৪.


তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
কথা আছে তোমার চোখের সঙ্গে আমার
চোখের পাতার।
তোমার ঠোঁটের সঙ্গে আমার ঠোটের
আশ্লেষের।
তোমার হৃদয়ের সঙ্গে আমার রক্তকণিকার
তোমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমার প্রশ্বাসের...


১৫.

তোমার সকল অস্তিত্ব আমার মাঝে উঞ্চতায় ধরা দেয় বারবার
তোমার উষ্ণতার উত্তাপে জ্বলে পুড়ে হৃদয় হয় সব ছারখার
তুমি ভস্ম হও, আমাকেও ভস্ম করো , হয়ে যাই রক্তিম অঙ্গার
তুমি শুচি হও, শূচি হয় আমার দেহ, সুরে ভরে ওঠে কোমলগান্ধার।

১৬.

রাতের মায়াকে অন্ধকারে বিলীন করে দিতে নেই। কোনো বিনিদ্র চোখ যদি আঁধারে কাঁদে তা দেখা যায় না। তাই তাকে খেয়াল করে রাখতে হয় ভোরের আলো পর্যন্ত।

১৭


দিঘি থেকে প্রতিদিন জল তুলি । দিঘির জল আমার হয়। কিন্তু দীঘি জানে আমি কখনোই দিঘির নই।

১৮.


তুমি ভালোবাসা দাও বুকের গভীর থেকে। আমি গ্রহণ করার জন্য করতল পেতে রাখি,
তোমার বুকের বাহিরে।

১৯.


আমি নিঃশ্বাস নেই তোমার শরীর থেকে ছুঁয়ে আসা বাতাস থেকে। আমি প্রশ্বাস রেখে যাব তোমার নিঃশ্বাসের বাতাসে।

২০.

আমি যা রেখে যাব, খুঁজলে দেখতে পাবে অসীম শূন্যতা সেখানে। একসময়ে যেখানে ভালোবাসা পরিপূর্ণ ছিল। তখন তুমি তা দেখতে পেতে না।

২১.

তুমি নেই, তৃষ্ণা যত ক্রন্দনের। মর্মরধ্বনি তাই বাতাসে।

২২.


নির্জন পথবেশ্যা ভোর থেকে শিশিরে ভিজে, রোদ্দুরে শুকিয়ে যায় তার হেমন্ত গন্ধ শাড়ি
তারও প্রতিক্ষা আছে, পাশে দিয়ে হেঁটে যায় নির্মাণ শ্রমিক, যদি বলে সে --- চলো ঐ ঝোপের আড়ালে
শয্যা পাতো শিশির ভেজা ঘাসের উপর।

কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর।


২৩.

আঁধার নেমে এসেছে পৃথিবীতে, জোনাকীরা জ্বালিয়েছে সব আলো
একে একে জ্বলে উঠেছে সব তারা--
অরূন্ধতী,স্বাতি, ধ্রবতারা।
নয়ন মেলে দেখ আর একবার
ঘুমিয়ে পড়ার আগে সব চুম্বনগুলো দিয়ে দাও
যত পারো যেখানে,
যদি আর ঘুম না ভাঙে কাল সকাল বেলায়।

২৪.

চন্দ্রিমা উদ্যানে আজ মেঘের ছায়া পড়বে না
সপ্তপদি পাতার ফাঁক দিয়ে দুপুরের রোদ্দুর পড়বে তোমার মুখে,
এলমেল হাওয়ায় উড়বে চুল,
অসতর্কে খসে পড়বে বুক থেকে মখমলের ওড়না।
একটি দুরন্ত গিরগিটি লুকাবে চকিতে লতা গুল্মে।
ঘাসফুলের গন্ধে উন্মূখ হব দুজন,
কত মাধুরীময় প্রেম সেখানে ... আঙুলের স্পর্শে দেহ পটে কত ছবি আঁকা...।


২৫.

তোমাকে ঢেকে রাখি গোপন আলোয় আঁধার গুহায়।
তারপরও সেখানে তুমি জ্বলতে থাকো।

আমি চাই -
সেথায় তুমি অপ্রকাশিত থাকো।

২৬.

মনে হয়,
জগতের সকল অন্ধকার দিয়ে তোমাকে রাখি ঢেকে। রাখিও তাই।
আর তখন তুমি শত সহস্র আলোকবর্তিকা হয়ে অন্ধকার ভেদ করে জ্বলে ওঠো। আর মুহূর্তেই যেন আমার অন্ধকার ঘরটি আলোকিত হয়ে যায়।

২৭.

তোমার কাছে প্রেম চাই তোমার কাছে সুখ
মুছে দাও যাতনা যত মুছে দাও মলিন মুখ
নয়ন খুলে দেখতে চাই দেখতে চাই আলো
তোমাকেই সারা জনম বাসিতে চাই ভালো।

২৮.


মালকোষ রাগে ‘গোধূলি লগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’
আর ভূপালিতে ‘একি এ সুন্দর শোভা’।

যারা গান করেন তারা জানেন, মালকোষ ও ভূপালি রাগ দুটো খুব কাছাকাছি, এবং নিবিড় একে অপরে। কিন্তু আবার ভিন্ন অনেক কিছুতে এর তাল এবং লয়ে।

আর রাগ দুটো যদি হয়, সে এবং আমি।


২৯.


হিম আঙুলের স্পর্শে শিলীভূত করতে চাই তোমার হৃদয়।
প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, মৃত্তিকার অতল থেকে উত্থিত সকল অগ্নুৎপাত ধপ করে নিভে যাবে।


৩০.


তখন পড়ে রইবে আমার ছায়া, তখন বাজবে না বাঁশি,
গাইবে না আর কেউ কোনো গান !
তখন সব স্বপ্ন মিশে থাকবে পৃথিবীর স্বপ্নের ভিতর।


৩১.


ভালবাসা জৈব, ভালবাসা যৌন, শরীর না থাকলে কিছু্ই থাকে না ভালবাসায়। প্রেম কখনই এই দেহকে অতিক্রম করতে পারে নাই।

আবার উল্টোও আছে ---
ভালোবাসা কামগন্ধহীন, কেবলই নিজেকে বিলিয়ে দেয় পরিবর্তে নেয় না কিছুই। দুষ্প্রাপ্য আমাজান লিলির মতো মনোলোভা। এমন নিষ্কাম প্রেম, শুধু দু’হাত ভরে দিয়ে যায়।

একটি বেগ, আরেকটি আবেগ।


৩২.


ভৈরবী রাগের যে গানটি আমি লিখলাম, সেই গানে তোমার কথা লেখা আছে।
তোমার প্রাণে যে অনুরাগ
আমার গানে যে সুর,
তা আজ তোমার চরণধ্বনি হয়ে বাজছে।
এখন শুধু গানের মুহূর্ত। এখন শুধু গান শোনাবার কাল। এসো, শিশির তলে। এসো, মহুয়া বনে। গান শোনাব আজ।

৩৩.


যে প্রেম কথা বলে না, চিৎকার করে না,
আশা করে না। অপ্রকাশিত থাকে।
অপেক্ষা করতে করতে জীবন ফুরিয়ে যায় , তবু বলে না -- ভালোবাসি।

এমন প্রেম আহম্মকেরা কেন যে করে, কেন যে তারা দুঃখ দূর্দশায় জড়ায়।

৩৪.


আজ রুপালি সমুূ্দ্রে সাঁতার কাটলাম। ঝলাৎ ঝলাৎ ঢেউয়ের শব্দ। ভেঙ্গে পড়ছিল দুপাড়। এত ভাঙ্গন আর এত উথাল পাথাল ! সে এক অবিস্মরণীয় জলপতনের খেলা।

৩৫.


দুহাতে খু্ঁজেছিলাম পাহাড়ের চূড়া। ঠিক উঠতে উঠতে। আবার নামতে নামতে। দেখি মণিমুক্তা খচিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। একবার চূড়োয়। একবার তার পাদদেশে। একবার হিমাদ্রিতে। কী যে আনন্দময় পরিভ্রমণ ছিল !


৩৬.


যে ছেড়ে চলে যায়, সে জানে সে চলে যাবে। তাই সে প্রস্তুতি নেয় আগে থেকেই। তার ভিতর কোনো আক্ষেপ থাকে না। বিদায়কালীন সময়ে চোখ থেকে একবিন্দু জলও ঝরে না।

কিন্তু যাকে ছেড়ে গেল সেই জানে হঠাৎ এই শূন্যতার হাহাকার কী? সেই প্রাণপাত করে। সেই জলশূন্য নদীর মাছের মতো ছটফট করে....


৩৭.


এই রাত্রিতে শিশির ঝরছে অন্তহীন
আজ ভাসিয়ে দাও
তোমার হৃদয়ের আমন্ত্রণে আমাকে নাও
হে নিশীথিনী‌।

এই জল, এই অন্ধকার, এই নক্ষত্র বীথিকে --
আকুল করে তোলো,
দেহকে স্নাত করো ক্ষণকাল।

৩৮.


ভালোবাসার প্রথম পা‌ঠ নিয়েছিলাম কোনও নদীর কাছে, খোলা আকাশের নীচে,
মূর্তে-বিমূর্তে, গ্রীষ্মের প্রখর দীপ্তিতে, বর্ষার ধারায়, শীতের উষ্ণতায়, প্রাণখোলা বসন্তবাতাসে, শরতের ঔদার্যে, হেমন্তের পেলবতায়,
সৌন্দর্যে আর বীভৎসতায়, উৎস আর মোহনায়, নগ্নতায় এবং আড়ালে, ধূসর সাম্রাজ্যে নিষিদ্ধ সেই সব শব্দগুলির সাথে তোমার নামটিই জড়িয়ে আছে।


৩৯.


মাধবী নামটির সাথে মাধুরী জড়ানো আছে। একদিন মাধবী বলেছিল, পৃথিবীতে দুটো জিনিসেই মাধুরী আছে -
এক. বাগদাদের ফুল, আর দ্বিতীয়. রাজস্থানের মীরা বাঈ এর গান। আমি এর কোনোটাই নই। তাই আমার ভিতরে কোনো মাধুরী খুঁজো না।


৪০.

কখন অস্তমিত হয়ে গেল বেলা
কখন ফুরিয়ে গেল ক্ষণ,
শূন্য করে ভরে দেওয়া যার খেলা,
তার জন্য রয়েছিনু বসে
সারা জীবন।

৪১.

চলতে চলতে পথে ক্লান্তিতে যখন আর
চলতে পারি না,
তখন কোথা থেকে তুমি এসে হাতটি ধরো ---
বলো, থেমে যেও না।
ক্ষুদ্র প্রাণের ঘাসফড়িং প্রজাপতি উড়ে
ফুলে ও পত্রপল্লবে --
ধরে আছি হাত আমরাও চলি ওদের মতো আনন্দে প্রফুল্লে।


৪২. 


যদি কোনো রাত্রির মধ্যাহ্নে
চন্দ্রকিরণতলে দাঁড়িয়ে কেউ ললাটে চুম্বন দিত!
জোছনাধারা বইত ধীরে --
কুয়াশা-নিবিড় নির্জনতায় চলে যেতাম
বাঁশ ঝাড়ের ছায়া মর্মর পথের উপর... 

বলতাম,
নাও তুমি আমার অনন্ত ভালোবাসা।


৪৩.


নয়নে নয়ন রেখে দেখলাম তোমাকে, তুমি বললে অন্তরে দেখো।
অন্তরে অন্তর ছু্ঁয়ে ভালোবাসতে চাইলাম,
তুমি বললে বুকে তুলে নাও।
বুকে বুক রাখতেই শীতের সকাল আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের লেলিহান ছড়িয়ে গেল দেহ থেকে দেহান্তরে। তুমি জ্বললে, আমাকেও জ্বালালে।  ছাই ভস্ম হয়ে দেহ দুটি এখন আকাশে উড়ছে।


৪৪.       


প্রিয় মানুষকে ভালোবাসি গোপনে। 
তার প্রতি মায়া করি লুকিয়ে। বুঝতে দিই না তাকে ভালোবাসার অসীমতা। 
কারণ, আমি যখন থাকব না, সে তখন সইতে পারবে না আমার দেওয়া  মায়াময় অভিজ্ঞান
ও আমার শূন্যতা।

৪৫.      


আজন্ম প্রেমিক আমি, বুদ হয়ে থাকি আনন্দে
আনন্দ আমার পূর্বপুরু্ষ থেকে পাওয়া অধিকার।

তুমি কি আনন্দ করতে পারবে ?
পারলে পারবে, না পারলে চলে যাবে
যেমন চলে গেছে পূর্বের অক্ষম প্রেমিকারা।

আমি তো ভিখারী রাঘব নই
আমৃত্যু আনন্দ করা আমার অধিকার।


৪৬.


তুমি রবে না 
আমি রবো না 
রবে না এই সময়।

শুধু রবে আমাদের পায়ের চিহ্ন 
যেখান দিয়ে আমরা হেঁটে চলে গেছি।

কোনও কথা থাকবে না
শুধু গল্প থাকবে -
পূর্ণিমানিশীথের কোনও এক দেবযানীর 
স্বপ্নের ভিতর।

৪৭.


এই দুঃখময় জগতে যা কিছু সুন্দর সে তুমি,
সে তোমার প্রেম। জন্ম মৃত‍্যুর কালচক্রে সেই প্রাপ্তিকেও একদিন হারাতে হবে।


৪৮.


তুমি তুলে দিয়েছিলে হাতে ভালোবাসবার ভার
তোমাকে ভালোবেসে আজ আমি নির্ভার,
অপার ভালোবাসা বুকে যার 
কেমনে ফিরাই তারে সেই দুঃসাধ্য আছে কী আমার?

৪৯.       


আমরা ভেসে যাই উদ্দাম সমুদ্রের নীরে
বাধা উপেক্ষা করে ভীতিহীন , 
জীবনের পথে পথে আমরা হাঁটি  ধীরে 
থাকি পাশাপাশি চিত্ত অমলিন।


৫০.

তুমি আসতে যদি -
কপাল জুড়ে চন্দনের টিপ দিতাম
গাল ভর্তি আবীর মেখে দিতাম 
গোলাপ ঠোঁটে কনকচাঁপার রঙ ভরাতাম, বুক থেকে লোধ্ররেণুর সুবাস নিতাম।  

৫১.

আমি যাব
তুমি না বললেও যাব
মহাসমুদ্র পাড়ে নৌকা নিয়ে মাঝি একজন অপেক্ষা করছে।

ঐ নৌকায় উঠে আমি একদিন চলে যাব
ঐ মহাসমুদ্রের ওপাড়ে।

৫২.


মৌনতা দিয়েই ঢেকে থাক
তোমার মুখখানি 
বিস্মৃতির মেঘে ঢেকে যাক আকাশটিও।

প্রতিরাতে বেঘোর ঘুমের মাঝে কোনো 
স্বপ্ন দেখা হয় না
শোনা হয় না আর কারোর গল্প কথাও।

৫৩.

একটুখানি চেয়ে দেখাতে সমগ্র পৃথিবীর মানচিত্রকে দেখে নেয়া যায়। 
একটুখানি ছুঁয়ে দেখাতে কারোর সারা জীবনের প্রাণ স্পন্দন অনুভব করা যায়। 

কিছু প্রাপ্তি আসে, 
জীবনের পরম পাওয়া হয়ে থাকে। কোনো আফসোস ব্যাতিত এই জগৎ জীবন 
থেকে চলে যাওয়া যায়।

৫৪.      

কখনই দেখিনি তোমাকে কোনও নিশীথ অন্ধকারে,
এই মহাবিশ্বজীবনে।
কে তুমি ৷ জানিও নাই তুমি কে৷ চিনিও নাই।
শুধু এইটুকু জানি --- সেই তোমারই জন্য
এই রাত্রির অন্ধকারে 
জ্বালায়ে ধরেছি আমার অন্তর প্রদীপ-খানি৷

আজ তোমার জন্মদিন,
অঞ্জলী লহো ভালোবাসা মোর।

৫৫.


কেন যে জীবন এলো 
কেন যে সে জীবনে তুমি এলে
কেন যে মায়ায় বাঁধলে 
কেন যে কাছে আসলে নিভৃত চরণে।

কখন যে কে একা হবে
কখন যে কে  চলে যাবে
কোথায় যে কে পড়ে রবে
পৃথিবী কী রাখবে আমাদের স্মরণে।




শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০২২

তুমি মাধুকরী ( কাব্যগ্রন্থ )


উৎসর্গ -
লেখক, সাহিত্যিক, সম্পাদক
ফেরদৌস জেসমীন -কে।

এই মেয়েটিকে আমি চোখে দেখিনি
কিন্তু সে আমার কল্যাণকামী।


১.   তুমি এসো


এত কাছে আসতে নেই অগ্নিমুখ প্রজ্জ্বলিত করে
দীর্ঘ চুম্বনের পথ পাড়ি দিয়ে
হঠাৎ জ্বলে ওঠা প্রথম আলোর মূর্ছণার মতো।

এত ভালো বাসতে নেই
সব প্রেমচিহ্নর পথ মাড়িয়ে আবাস গড়ো এসে
যেখানে নদী আছে
জ্যোতির্ময় অরন্যানী আছে
বসন্তদীঘি আছে
যেখানে হাত ডোবালেই পেয়ে যাও অমৃতের শুদ্ধতা।

তুমি আলো হয়ে আলো ছড়াও নির্জনতার ভিতর
মহাকাশ ছুঁয়ে থাকে যেমন পৃথিবীর বুকে --
তোমার দীপ্তিময় মুখে বিষণ্নতার বিলাপ নেই
তুমি ঘুমঘোরে জড়িয়ে ধরো
অঙ্গার করো
ছাই করো
ভস্মীভূত করো
আপন কক্ষপথে জ্বলে ওঠে যত নক্ষত্র-বীথি।

এত কাছে জড়াতে নেই
যেখানে নক্ষত্রে নক্ষত্রে সংঘর্ষ হয়
আলিঙ্গন তৈরি হয়
নৈঋত থেকে ঝড় ধেয়ে আসে, হৃদয় তোলপাড় হয়
রক্তক্ষরণ হয়,
বসতি ধ্বংস হয় --
আমি এই প্রেম চাইনা।

এসো প্রিয়তমা
অন্ধকারের নৈঃশব্দ ভেঙ্গে সকল শূন্যতা পূর্ণ করো
পূর্ণিমার চাঁদের মতো আলো ঝলমলিয়ে এসে আলোকবর্তিকা হও।


২.       হাওয়ার মতো জোছনার মতো
 

তোমাকে নিয়ে একদিন এমন কোথাও চলে যাব যেখানে নির্জনতা ছাড়া আর কেউ থাকবে না 
আমাদের দেখবে ফুল পাখি আর বন্য হরিণেরা
প্রাণে প্রাণ ছুঁয়ে বলব কথা।

আমাদের কথা ওরা কেউ বুঝবে না, 
আমরা গাইব গান, সে গানে পিয়ানোর মতো সুর তুলবে সেখানকার স্বচ্ছতোয়া নদীর জলকলরল, 
নিসর্গের মর্মরে আমরা নিশ্চুপও থাকব
ঘাসের উপর শুয়ে দেখব রাতের তারার আকাশ, 
তুমি বলবে -- চলো, আমরাও তারা হয়ে যাই ঐ দূর আকাশে...

আঁধারে তখন বিপুল নৈঃশব্দ্যের স্তব্ধতা  
কোনও কথা নেই আর কারোর -
প্রেম তখন ছুঁয়ে থাকবে শরীরে শরীরে! 

মহাকালের বুকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার জন্য 
উন্মত্ত উদ্দীপনায় আমরা উন্মুখ হবো তখন! 
আমরা ভেসে যাব রাতের গাঢ় অম্বরে হাওয়ার মতো, জোছনার মতো...


৩.    এলমেল ভাবনা


কবিতা নয়,‌ গল্প নয়, একটি ব্যঞ্জনাময় বাক‍্যও নয়। সেই কতকাল থেকে একটি মাত্র শব্দকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু তার দেখা আমি আজও পাইনি।

আগে ঘরের চালে এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে ঘুম ভেঙ্গে যেত। এখন অঝোর ধারায় ঝুমঝূমিয়ে বৃষ্টি হলেও ঘুম ভাঙ্গে না।

ছোটবেলায় সূর্য নিঃশেষিত সন্ধ্যায় ধনিদহ বিলে পাখিদের পালক খুঁজতে যেতাম। এখন সন্ধ্যার বুকে নিজেই ছটফটে পাখি হয়ে থাকি।

এখানে জানালার পাশে বড় বড় অট্টালিকা উঠছে। নীল আকাশ দেখা যায়না। দক্ষিণের বাতাস নেই। ক্লান্ত দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনতে পাইনা।

একটি সুন্দর ঝলমলে রোদ্দুরের দিন খুঁজছি। নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে, হাওয়াই চপ্পল পায়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে যাব।

আমার খুব ঘুম পায়। ঘুমিয়ে থাকার এক অনন্ত খিদে। কোথায় সেই সবুজ ঘাসের বিছানা? যেথায় রাতভর জ‍্যোৎস্না ঝরবে আর ভোরের শিশির বিন্দু।


৪.   পাখি উড়ে গেছে


যে পাখি উড়ে গেছে, তার পিছু আর যেওনা। নতুন আকাশে মেঘের আড়ালে সে বাসা বেঁধেছে। স্মৃতি ও বিস্মৃতির মধ্যবর্তী ধূসরে এখন তুমি একা।

যে পাখি উড়ে গেছে, তাকে আর পিছু ডাক দিওনা। এখন সে উৎসবে ব্যস্ত । আলো ঝলমলে স্বপজাল তার চোখে মুখে। তাকে অনুসরণ কোরো না।

যে পাখি উড়ে গেছে, যতটা সম্ভব ছিন্ন পর্ব থেকে ভুলে যাও তাকে। বারবার তাকে ডেকো না। পুরাতন ডাক শুনলে সে চমকে উঠবে। বিরক্ত হবে।



৫.    আসব তোমার কাছেই


আসব তোমার কাছেই যদি মেলে দাও
তোমার আকাশ,
যদি ভিজাও বহতা নদীর কুলকুল জল ধারায়।
যদি দেখাও উপত্যকা, হামাগুড়ি দেব তার ঢালে,
পুকুর নালায় উপচে পড়বে ঝর্ণার জল।
যদি নিয়ে যাও পূর্ণিমার আলোয় পথ ধরে নিরুদ্দেশ কোথাও।
যেখানে সন্ধ্যা রাত্রিতে থেকে থেকে জোনাকি জ্বলে। যেখানে রাতভোর স্নাত হওয়া যায় শিশিরে।


৬.    ভালো আছি, ভালো নেই


সবকিছুই কেমন যেন ভুলো ভুলো
সব রং কখন আবির হলো
কবে কখন কাকে বুকে জড়িয়েছিলাম
কার বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলাম।

পাঁজরেই কি ঠাঁই ছিল!
চুম্বনেই কি বাঁধা ছিল?
সব নিয়ম যে ভুল হলো
রাতটাও দেখি শেষ হয়ে গেল।

সকালে তোমার চুলের গন্ধ ভাসে
ভালোবাসার সেই আবেশ আসে
কখন যে সবকিছু নিয়ে গেল সেই
ভালো আছি, আবার ভালো নেই।


৭.    অবগাহনের সময়


আমরা হাত ধরে চলে যাই ধূঁ-ধূ মাঠের প্রান্তরে
সেখানে মধ্যরাতে আদিগন্ত শূন্যতার বুকে জ্যোৎস্নার প্লাবন নামে।
অসংলগ্ন শরীরময় লতগুল্ম ঝিঁঝি পোকারা জড়িয়ে ধরে
ঘর হয়ে যায় নির্ঘর, তখন নদীও যেন কাছে টানে,
তখন নেমে পড়ি জলে,
অবগাহনের সময় ঘরে ফেরার কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই।


৮.    প্রতিক্ষা


কত দূরের পথ যেতে চাইলে বলে যেতে হয়
কত দূরে চলে গেলে কারোর প্রতিক্ষা করতে হবেনা,
সোনাজঙ্গ পাখিরা উড়ে চলে যায় বহু দূর --
তারা কী কাউকে বলে যায়? 
বরফ দেশে যেয়ে তারা হিম হয়ে থাকে।

নদী বেগে ধেয়ে যায়, তার বাঁকে বাঁকে স্রোতের ধারা থেমে থাকে না --
কত দূরদেশ, কত মৃত্তিকা ভেঙ্গে, অথৈ সাগরে মিলে যায়, সে নদী কী কাউকে কিছু বলেছিল?

বর্ষার সুগন্ধি ফুল ফোঁটে, 
সে ফুল ঝরে যায়
রোদ্রের উত্তাপ মেখে, সেও বলে না তার ঝরে যাবার মর্মবেদনার কথা।

কোথাও কোনো পথে ধুলোটি নেই,
সব পরিপাটি, সব মসৃণ মখমলে,
সেই পরিচ্ছন্ন পথ ধরে সে যে কবে চলে গেছে অনন্ত পথে -- বলে যায়নি তা কাউকে,
তার জন্যেই যে আমি আজও চির প্রতিক্ষায় আছি।


৯.    যদি নাও প্রেম


চারপাশের শুন্যতারা মিথ্যে হোক, ভালোবাসার
সুগভীর ছায়া পড়ুক এই জীবনে
তোমার ভিতরে ছড়িয়ে দেব আমার প্রাণ, আমার প্রেম
ঈশ্বরের নির্মিত এই বুকে যতোই বাজুক
গভীর যত ক্রন্দনের আওয়াজ।

আত্মার মধুর আলোকে দ্যুতি ছড়িয়ে দেব তোমার অন্তরাত্মায়
প্রিয় তুমি, সবই হতে পারে তোমাকে নিয়ে
এই পৃথিবীর ধুলোয়
আমার রক্ত কণিকায় জাগাও তোমার সকল প্রবাহমান প্রেম, সকল মায়া -
তুমি এসে চূর্ণ করো আমার অন্তর্গত সকল গ্লানি।

তোমাকেই ভালবাসা অর্পণ করি
তর্পন করি মায়া মমতা
আমার দু'হাতের আজলায় উপচিয়ে পড়ে প্রেম
যদি ভরে নাও সেই প্রেম, যদি থাকো কাছাকাছি
তুমি কখনোই পরাজিত হবেনা।


১০.    রক্তাক্ত দোলনচাঁপা


সেই সব কুমারী মেয়েরা করে যায় ভুল,
তারা জানেনা তাদের বিষয় সম্পদ কতো দামি
কেউই জানেনা হীরক খণ্ড কি
তারা জানে কেবল সমুদ্র বেসাতি,
তারা জানে ঝিনুক থেকে কিভাবে মুক্তা হয়
তারা সমুদ্র কন্যাও।

দু’চোখ নাশপাতি তার, ঠোঁট-দু’টিতে কমলার রং মাখা
বুকে তাদের মহুয়ার গন্ধ
পাশ ফিরে শুয়ে থাকে তপ্ত আগুন হয়ে বালুর উপরে
দারুচিনিও ভস্ম হয়, দেহটি কোথায় পড়ে থাকে
কোনও ভাবে জানল না তো কেউ
খুঁজেছিল তারা সমুদ্রপাড়ে কুমারীদের আত্মার ভিতরে,
শুক্তির ভিতরকার শুভ্র মুক্তার জন্য গাইত যারা গান।

দোলনচাঁপার মাঠে তাকে তারা খুঁজেছে অনেক
যেখানে আগের রাত থেকে পড়েছিল অন্তর্বাসের ছেঁড়া ফিতা, একখানি চপ্পল আর চাপচাপ কিছু রক্ত!


১১.    এই শহর আমার জন্য নয়

পার্কের পাশে লাইটপোস্টের নীচে স্ট্রীট বেশ্যারা উন্মাতাল -
চারপাশে দেখে তারা চর্বিওয়ালা লোকের চাহুনি
আর অসংখ্য মদ পিপাসু মানুষ - আমি তখনো সঙ্গীবিহীন
প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হেঁটে যাই
উদ্বাস্তু উদাসীনতার রাজপথে ধরে।

এই শহর আমার জন্য নয়
লাল আলোর জানালার ধারে মায়াবী চোখ দেখি, সিগারেট হাতে
মৃদু সঙ্গীত আর চোলীর মাঝখানে লুকানো ক্লান্তি
সেইসব রমণীর দিকে আমি ফিরে তাকাতে চাইনা
সেখানে রাত গভীর হতে থাকে পাপের গভীরে।

এই শহর আমার জন্য নয়
এখানে সেই ইছামতির সচ্ছ জল নেই
প্রথম স্বাদ প্রাপ্তির  জলপথ দিয়ে ঘুরতে থাকি অবিরাম বৃত্তাকারে
সিগারেটের ধুঁয়ায় সেই মায়াবী চোখ খু্ঁজি
যার আঁচল তলে মুখ ঢাকতে চাই পুণ্যতার জন্য।


১২.      আলোক ধারা


নির্জন রাত্রি দুপুরে তোমাকে নিয়েই রচিত হয়
আমার কবিতার চরণগুলো 
আমি চোখে চোখ রাখি অন্তরে খুঁজি উচ্ছাস যত।

তুমি আমাকে যেন ভুলে না যাও
আমার গান আমার রাত জাগার বাঁশির সুর, আমার ভালোবাসা এবং আমার যত অনুভাবনা। 

তুমি অমৃতসুধা ঢেলে দাও
শরীর থেকে শরীরে জ্বালাও আলোর শিখা, আমি জেগে জেগে প্রসারিত করি দীর্ঘ এক স্বপ্ন।

আমি হাঁটি মাইল মাইল পথ
আমার চরণে বাঁজে তোমার চরণধ্বনি
তুমি থেকে যাও আমার কর্মে, 
আমার সৃষ্টিতে, আমার সকল আলোক 
ধারায়।


১৩.     সুগন্ধি লোবান


ক্রমেই দিনগুলি বিষণ্ন হয়ে আসছে
যেমন বিষণ্ন হলো আজকের বিকেলও
একগুচ্ছ রক্তিম ক্যামেলিয়াও 
বিষণ্ন হয়ে রইল হাতের করতলে, 
স্বপ্নগুলো তোমাকে খুঁজতে খুঁজতেই ভেঙ্গে গেল
কষ্টগুলো তোমার বুকেই ঘুমিয়ে গেল 
নিভৃত ক্রন্দনধ্বনিতে।

এ কোন্ মায়া পুড়ে ছারখার হয় নিষ্ঠুর ছায়াধূপে
সকল কর্মের পরিসমাপ্তি কি আসন্ন তবে --
যেথায় যে বাগান আছে তা আর থাকবে কি? 
যেথায় যে ফুল ফুটবার কথা তা আর ফুটবে কি?

সাদা পাঞ্জাবী টুপি পরে মৌলানা সাহেব আসবেন
আসবেন তার নবাগত শিষ্যরাও
সুর করে সুরা ফাতিহা পাঠ করবেন
কফিনের পাশে সুগন্ধি লোবান জ্বলবে, 
তোমাকে দেখতে পারবে কি আর আমার চোখ? 
শেষবারের মতো আর একবার।


১৪.     একটি অপ্রেমের কবিতা


বসন্ত আসার আগেই ঝরা পাতা উড়িয়ে দিলাম --
মল্লিকার বনও পুড়ে বিরাণ হলো
এ কোন্ আগুনে?
এই শ্রাবণে বৃষ্টির জন্য তাই এত হাহুতাস।

তোমাকে ভালোবাসি অসম্ভবের মতো অসংলগ্ন
ঈশ্বরের নাম আসেনা মুখে জপি তোমার নাম
সারারাত ধরে কবিতার শিরোনাম হও তুমিই --
এইসবই কি ভ্রান্ত তবে?

মৃত্তিকায় মিশিয়ে দিতে চাই এ প্রেম, 
এ মাধুরী--
বুভুক্ষ পিঁপড়ার দল এসে পুরোয় 
তার উদোর,
সব প্রেম অপ্রেম হয়ে জড়ো হয় তোমারই কাছে। 

বাগানের ফুল তুলতে গিয়ে খুলে ফেলি তোমার খোঁপার ফুল, সময়ে অসময়ে কিংবা মধ্যরাতে।


১৫.     নিবেদন


তোমাকে দিলাম আমার সন্ন্যাস
আমার ছিন্ন পাতা, অনাস্বাদিত অপূর্ণ প্রেম, আমার দীনতা, ও আমার সকল গ্লানি।

তুমি দাও আমাকে সপ্তপর্ণী সবুজ পাতা,
নীলকন্ঠ পাখির পালক, শূভ্র মেঘের জল কণা
তোমার সৌধ, ঐশ্বর্য, তোমার সৌন্দর্য সুধা।

দাও নিস্তব্ধতা, অমরত্ব, মর্মরিত বেদনা
এবং ঘন আকুল নিঃশ্বাস।


১৬.     হেঁটে গেছি সন্ধ্যাতারার দিকে


এখনও স্বপ্নে দেখি আমার নদীটাকে।
হেঁটে গেছি কত প্রান্তরের পর প্রান্তর মেঠো পথ ধরে                                      পথই টেনে নিয়ে গেছে যেদিকে নদী আছে । 
তারপর হাঁটতে হাঁটতে পাড়ে চলে যাওয়া।            
তারপর শুনেছি এর জলতরঙ্গের গান, 
কতো সন্ধ্যা মগ্ন হয়েছে রাতের আঁধারে। সব তারা ডুবে যেত যমুনার জলে।
নদীর পাড় ধরে আমি হেঁটে গেছি কত সন্ধ্যাতারার দিকে, নদীর ঝুমঝুম শব্দগুলো চোখের জলপতনের শব্দ হয়ে ফিরে অসতো ।

আমি আজও অলস পায়ে হাঁটি ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে। হাঁটি আর হাঁটি। কোনও ক্লান্তি নেই।
মাটির সোদা গন্ধ চিনিয়ে নিয়ে যায় নদীর টানে।
তখন দখিনের  হাওয়া উতাল হয় , বেগ পায় নিঃশ্বাসের বাতাস
তখন আমার সারা অন্তর্ময়  করুণ এক গানের সুরে কা্ঁদতে থাকে-
'যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে.                                        সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে'।


১৭.       রূপকথার রাজপুত্র


সোনা মেয়ে, কেন তুমি রাগ করো অসময়ে
কেন তুমি সঁপে দিতে চাও পাংশু দেহ।
চোখে কাজল নেই, 
মুছে ফেলেছ তা বহু রাত জেগে। 

কোন্ দুঃখে তুমি বিপথে যেতে চাও? 
এক রাজকন্যার রূপের হাসি
কবে ডুবে গেছে মেঘলোকের অন্ধকারে
এখন আলোহীন নিভু নিভু নক্ষত্র তুমি।

তোমার চোখ তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণ গহবরে
খোঁজো সেখানে জ্যোতির্ময় কাউকে 
আমি নেই সেখানে।
আমি কারোরই নই , নই তোমারও --
রূপকথার রাজপুত্র দূরের কোনও ভুবনের।


১৮.      আনন্দ কাব্য


এই বিশাল মহাজগতে ছোট্ট এ পৃথিবী, তার মাঝে ক্ষণিকের এই জীবন--
সেই ক্ষণকালের জীবনটিকে আমি আনন্দে ভরে রাখি।
আমি জানি, জগতের বুকে দুঃখই বেশি।
এই ঝলমলে রোদ, 
এই পাখির কলকাকলি, 
গাছের পাতায় হাওয়ার দোলায় এই ঝিরঝির শব্দ, ভোরের খোলা হাওয়ায় বুকভরে শ্বাস নেওয়া --- 
এসবই আমি উপভোগ করি। এর মাঝেই জীবনের আনন্দ।


১৯.       ভালোবাসা কারে কয়


তুমি বঙ্গোপসাগরের লোনাজল, 
নাকি পলিমাটি মিশানো যমুনার স্রোতধারা? 
তোমার প্রেম শীত না বসন্ত, নাকি নাতিশীতোষ্ণ!
সবকিছুই দ্বিধায় ঢেকে রেখেছ। 

নাকি ভালোবাসা এই রকমই --
যেমন তুমি আবক্ষ জলে নামলে শীৎকার করো
আবার ডাঙ্গায় তপ্ত রোদ্রে ছটফট করো 
তোমাকে কাছে টানলেই সমস্ত মেঘ
জল হয়ে ভুবন ভাসে।

আবার তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখলে 
সমস্ত দীর্ঘশ্বাস ঝড় হয়ে যায় ঈ্ষাণ কোণে
তুমি আগুন হয়ে জ্বলে পোড়া মাটি করো 
আবার জল হয়ে নদীও হয়ে যেতে পারো।

তোমাকে ভালোবাসতে কোনো দ্বিধা নেই
তুমিই শিখিয়েছ কিভাবে ভালোবাসতে হয়
তুমি শিখিয়েছ, ভালোবাসা কারে কয়!


২০.     বাসনা কুসুম 


আমার এই জীবনে তুমি একমাত্র রমণী
তুমিই একমাত্র সহচরী কিংবা রাজ রাজেশ্বরী
যে তুমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছ আমার পাশে,  
ময়ুরের পেখম মেলে কথা বলি তোমার সাথে প্রাগৈতিহাসিক ভাষায় --
যেন রাত্রিও সচকিত হয়ে ওঠে।  

তুমি কখনো হতে পারোনি সম্পূর্ণ রমণী
কোনো বসন্ত শেষ করতে পারোনি
হয়ে থাকলে বাসনা কুসুম --
কত রাত শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে রুমাল বানিয়েছি
কত রাত দাবা খেলায় রাণীর  হেরে গেছে 
ধাবমান অশ্ব ক্ষুরে, সৈনিকের তলোয়ারের খোঁচায়। 

জীবন ফতুর হয়ে গেল
সব আয়ুষ্কাল ভাঙ্গা প্রদীপের নীচে নিভে গেল
এ এক দুঃসহ ক্লেদ আমার --
একটি রাজ্যও এখনো জয় করতে পারিনি।


২১.     ভালোবাসা জেগে আছে 


সেই কবে রক্ত কণিকায় লুপ্ত হয়েছিল ভালোবাসা
সেই কবে এক্কা দোক্কা খেলতে যেয়ে  পায়ে বেজে উঠেছিল ঝুমুর সুরে তোমার ঘুঙুর --
আমার প্রথম গান ধ্বনিত হয়েছিল সেইদিন থেকে।

কেমন যেন মেঘ মেঘ ছিল কাল রাত 
কেমন যেন বৃষ্টি বৃষ্টি ছিল সময় --
কেমন যেন কম্পিত হচ্ছিল শিরা উপশিরা 
যেন বিদ্যাপতির রাধিকা নেমে এসেছিল পথে
নিবিড় করে ভিজছিল তোমারও আঁচলখানি। 

কয়দিন আগে দীপাবলীর সব দীপ নিভে গেছে
দীপ নেই আলো নেই এই রাতে 
বৃষ্টি তো আছে, দেখ তুমি -- অন্তরে তোমার ভালোবাসা জেগে আছে।


২২.      সুস্মেলী


সুস্মেলী, সেই যে তুই চলে গেলি
তারপর একবারও ফিরে না এলি

তুই কি আমার মতো একলা থাকিস
নাকি কাউকে আবার ভালোবাসিস

নাকি চেয়ে দেখিস নিঃসঙ্গ সন্ধ্যাতারা
নীল জোনাকি খোঁজে তোকে ছন্নছাড়া

নির্জনতায় কি ঘুরে বেড়াস চিত্রাপারে
ইচ্ছে হলেই আমায় ডাকিস চুপিসারে 

সুস্মেলী, আমি যে তোকে ভালোবাসি
রাত গভীর হলে তোর জন্য জলে ভাসি।


২৩.    প্রথম জল, প্রথম অগ্নিমালা

 
কথা ছিল মেঘ বৃষ্টির নীচে শুয়ে রবো এই ভরা শ্রাবণ নদী সন্ধ্যায়।
                                                          কতোটা আঁধার পেলে এ রাত একা 
হয়ে যায়। 
                                                          নিজস্ব শাড়ির আড়ালে বিপন্ন বেহাগ, কেঁপে ওঠে চাঁদের শরীর।
                                                          দূর কোন অতীতের পাখি  উষ্ণতা নিয়ে উড়ে যাবে আরো দূর ইপ্সিত অন্ধকারে।
                                                          নরম নৈঃশব্দের মতো আমিও হেঁটে যাবো প্রগাঢ় তৃষ্ণার দিকে।
কে আমার প্রথম জল, প্রথম অগ্নিমালা।    
কার কাছে হারাবো, 
ভেসে যাবো জলের তরলে অমৃতের জোৎস্নায়। 


২৪.       রাতের পদাবলী


কবিতা লিখব বলে রাত জেগে আছি
নিশাচর পাখিরা এলো
তারারা ছুটে এলো
বাতাস এলো
নৈঃশব্দ্যের গান শোনা গেল
জ্যোৎস্নায় আকাশ ভাসল
তোমার পদধ্বনি বাজল
সকাল বেলা খাতা খুলে দেখি --

সেখানে কোনো পদ নেই
কোনো পদাবলী নেই
কোনো কবিতা নেই 
সারা পাতা জুড়ে তোমারই নাম লেখা।


২৫.      ফিরে যেতে চাই


আমি চলে যেতে চাই সেই বেলায়
যে বেলায় ঘুরে বেড়েয়েছি ইছামতীর তীরে 
যে বেলায় শ্রাবণের মেঘের বৃষ্টিতে ভিজেছি
যে বেলায় গোল্লাছুট খেলতাম স্কুল মাঠে
যে বেলায় বিকালের হাওয়া লাগাতাম গায়ে 
যে বেলায় কোনো শ্যামল কালো বালিকা 
হাত ধরে নিয়ে যেত সোনাল বনে 
যে মেয়ের মুখ দেখতান খাঁ খাঁ রোদ্দুরে 
যে বেলায় আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতাম
যে বেলায় কবিতা লিখতাম ছন্দ খুঁজে খুঁজে। 

আমি ফিরে যেতে চাই সেইসবের কাছে। 


২৬.     মনে কি পড়ে


মনে কি পড়ে কোভা? ব্যস্ত শহরে সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল
তুমি ভেজা হাইওয়ে ধরে 
চলে গিয়েছিলে লং ড্রাইভে অনেক দূরে 
কি নিঝুম বৃষ্টি ছিল ! রিমঝিম উড়ছিল পথের ক্লান্তি
মনে কি পড়ে কোভা? আমি ছিলাম তোমার পাশে।

চোখ মেলেছিল ডানা উড়ন্ত গাংচিলে
দূরে ঝাঁও বনে ঝরছিল বৃষ্টি অনবরত
আরও বেশি স্তব্ধতার ভিতর তুমি ছিলে ভাবলেশহীন,

মনে কি পড়ে কোভা?
কি মোহময় সেই বৃষ্টিপাত! কি অবিরাম 
জলের ধারা
বাহুর আশ্রয়ে জানিয়েছিলে প্রথম ভালোবাসার নিমন্ত্রণ
বলেছিলে --' তোমাকে ভালোবাসি। '

তুমি বিস্মৃত হয়োনা কোভা --
সেই বিনম্র মুখের হাসি সেই মায়াবী দৃষ্টিপাত
নগরীর সমস্ত সভ্যতা ভেঙে চুরমার হয়েছিল 
বৃষ্টির শব্দে পথ চলতে চলতে সেই বিকেল! 

বিস্মৃত হয়োনা কোভা 
শান্তা মনিকার তীরে আমাদের সেই শেষ আলিঙ্গন! 
প্যাসিফিকের জল স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল 
তারও আগে 
যা আজ আর মনে পড়েনা।


২৭.     ভালো থেকো পৃথিবী 


তোমার দেখা পেলাম না এজন্য মনখারাপ নেই 
আমি চলে যাচ্ছি একাকী পাখির মতো
শূন্যে ডানা মেলে,
আমার স্বপ্নগুলোও নিয়ে যাচ্ছি 
ওরাও অসীমে উড়ে চলে যাচ্ছে আমার সাথে, 
তোমার চারপাশে একটিও স্বপ্ন রেখে 
গেলাম না... 

আমার কী যে ঘুম পাচ্ছে এখন, 
কোনও ভার নেই আর, 
কেমন নির্ভার অবসাদে জড়িয়ে আসছে শরীর, 
এমন অনন্ত ভালো লাগা এই পৃথিবীতে নেই.. 
যেখানে যাচ্ছি সেখানেই আমার স্বপ্ন ও শান্তিরা অপেক্ষায় আছে..  
ভালো থেকো পৃথিবী, বিদায়!


২৮.      এই প্রেম সেই প্রেম ছিলনা 


আজ এই সন্ধ্যার বাতাস থেকে জেনে নিয়েছি
যে হাওয়া বইছে আজ এখানে
যে গানের সুর ভেসে আসছে পূরবী ঝংকারে 
সেই সুর ঝংকার আমার জন্য বাজেনি -
তোমার ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত কাপড় বলে দিচ্ছে 
গর্ভধারণের আড়ালে যে তুমি
সে তুমি কখনোই আমার ছিলে না।

এই প্রেম, সেই প্রেম ছিলনা কস্মিনকালেও
এ ছিল প্রেমহীনতার উৎসব উৎসব খেলা
প্রেমের আড়ালে ছিল শুন্য করে দেবার দহন
জ্যোৎস্নার আড়ালে যে উদ্বাস্তু প্রান্তর ছিল 
সেখানে হতো কেবল বেদনাহতদের কান্নার উৎসব।

এই রকম শোকাচ্ছন্ন উৎসবের রাতে --
এই রকম অন্ধকার পথের প্রান্তের উপর
অনিশ্চিত গোপণ রক্ত ক্ষরণের ভিতর
পূর্ব পুরুষদের বিদ্ধ করতে চাইনা কোনো পাপ স্খলণে।

আজ এই সন্ধ্যার বাতাস সেই বার্তাই দিয়ে গেল।


২৯.     দূরের সুবর্ণরেখা


কপালে পরেছিলে টিপ যেন লেগে রয়েছিল চাঁদ
পুর্ণিমার আকাশ থেকে 
মুখ তোমার আলোয় হেসেছিল
মায়াবী ছোঁয়ায় চুল ছড়িয়ে পড়েছিল পিঠের উপরে
যেন আদিগন্ত ছায়া পড়েছিল সেখানে
স্থির হয়েছিল তোমার গ্রীবার ভঙ্গি
ভ্রূ বেঁকেছিল তৃতীয়া চাঁদের মতো ধনুকের।

চোখ ছিল চোরাবালির বালি, পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার
এসে ডুব দিয়েছিল সেখানে --
তারপরও ভালোবাসার চিহ্নগুলি খুঁজেছিলাম দূরের সুবর্ণরেখায়।


৩০.     আমার রোদ্রের দিন


এত ভালোবাসা এত ভালোলাগা এত মায়া
ভেবেছিলাম তুমিই আমার সম্পূর্ণ কবিতা হবে, 
না হলে না, তুমি অসম্পূর্ণ হয়েই থাকলে। 

এত পরিচর্যা এত যত্ন এত জল ঢালা
তবুও একটি সম্পূর্ণ ফুল হয়ে ফুটতে পারোনি
তুমি অপ্রস্ফূটিত করে রাখলে তোমার পাঁপড়ি।

শ্রাবণের মেঘ সব সরিয়ে দিলাম
শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘ উড়ছে, 
মেঘে মেঘে ভেসে এসে না হতে পারলে জল
না হতে পারলে আমার রোদ্রের দিন।


৩১.       যখন তুমি থাকবে না


এই প্রেম তোমার, এই নির্জনতাও তোমার
সমস্ত স্মৃতিতে বিস্মৃতির ধুলো জমবে একদিন
যখন তুমি থাকবে না।

শোক বিহবল শয়ন কক্ষের অসীম নীরবতায়
মন ছুটে চলবে দিগন্তে, যেখানে ওড়ে একাকী চিল
তার ডানা মেলার কোনো শব্দ নেই
মেঘ আকাশ জলরাশি নক্ষত্রমণ্ডলী
প্রত্যেকেই আর্তনাদ করবে তোমার অনুপস্থিতিতে।

পার্কের পাশে পাইন গাছ ছিল
ছাতিম গাছের তলায় নির্জনতাও ছিল
লেকের জল স্থির হয়ে ছিল
দুইজনের নিঃশ্বাস মাতাল করতে পারতো হাওয়া।

অবসর আর কর্মহীন প্রহরে তোমার ছায়া পড়বে না
পাখি কলরব করবে মোয়াজ্জিনের আযান হবে
মন্দিরে শঙ্খধবনি বাজবে, গীর্জায় নিনাদ হবে
এই আকাশ এই নক্ষত্র সবই থাকবে যেখানে আছে
শুধু তুমি থাকবে না।

তখন মাতাল হবেনা কোনো বাতাস 
তখন মেঘে মেঘে ছেয়ে থাকবে না কোনো আকাশ।


৩২.       নিষিদ্ধ পদাবলী


যাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। যারা সবচাইতে প্রিয়জন। যাদের জন্য বহুকাল বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে। তারাই যদি ঘৃণা করে,
তারাই যদি আর ভালো না বাসে
তারাই যদি মৃত্যু কামনা করে ----

তখনই খুব সুবিধা হয়, এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবার। এই সংসার থেকে অনেক দূরে চলে যাবার। সেই সুদূরের পথ কী খুব বেশি দূর?
কেমন হবে সেই প্রস্থানের ক্ষণ?

কোনো অন্ধকার রাত্রি ?
কোজাগরি চাঁদনি রাত ?
ঝুমঝুম শ্রাবণ বৃষ্টির দিন?
প্রভাত কিরণের উজ্জ্বল সময়?
মর্মর পাতা ঝরার কোনো স্তব্ধ দুপুর?
নাকি সন্ধ্যার অস্তরাগের মুহূর্ত !

জীবন বড়ই নির্ভার মনে হইতেছে। বাতাসে কোথাও মায়ার শব্দ শুনিতে পাইতেছি না। নেই কোনো ক্রন্দন ধ্বনিও।


৩৩.       জানি নাই

কখন কে এসে আমার পথে এঁকেছিল 
তার প্রথম পদচিহ্ন? 
কখন আমাকে বলেছিল প্রথম সম্ভাষণ প্রেমের! 
তখন প্রণয় বুঝিনি
তখন কুঞ্জবনে পাখিদের গানের অর্থ বুঝিনি
তখন ঝলমল করে উচ্ছসিত হয়নি কাঁচা প্রাণ।

তখন শুনতে পাইনি কোনো জাতিস্মরের বাঁশি
তখন বিন্দু বিন্দু করে ঝরে পড়েনি
কোনো অশ্রু জলের মায়া --

তারপর কখন সেই পায়ের চিহ্ন ধরে তুমি এলে
তারপর বিস্মরণের খেয়ায় পার হবার জন্য
বসেছিলাম দু 'জন জীবন নদীর তীরে --
এসব তখন কিছুই জানি নাই।


৩৪.      সেই বারান্দাটি


তোমাকে ভালোবাসি 
এই কথাটি তোমাকে আমি বোঝাতে পারিনি। 

যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানবিলাস ফুল ছুঁয়ে বলেছিলাম, ভালোবাসি। সেই  কথাটি বিশ্বাস করলে না তুমি। 

ভালোবাসি এই কথাটি বিশ্বাস করেছিল সেদিনের ঝাউবনের হরিৎ পাতা, 
গাঁদা ফুল, শিশির ভেজা ভোরের হাওয়া আর হলুদ প্রজাপতি। 

যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোমাকে বলেছিলাম ভালোবাসি, সেই বারান্দায় এখন অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

সেই বারান্দাটি এখন আর আমাদের নেই।


৩৫.      চাই অমৃতভোগ


শরৎ সন্ধ্যায় আজ রং ছিল
তোমার মনে আজ ঢং ছিল
পরনে লাল শাড়ি ছিল
তোমার সাথে আড়ি ছিল
শরীরটাতে নদীর বাঁক ছিল
পরান তোমাকে ডাকছিল।

রাতের মধ্যে স্বপ্ন আছে
বুকের তলায় রত্ন আছে
রূপবতীর রূপ আছে
স্বপ্নলোকে আলো আছে।

শরৎ রাতে বাজছে গান 
লীলাবতীর হাসছে প্রাণ
রাতের রংএ রাঙ্গিল এক রাধা
কৃষ্ণের প্রেমে থাকল না বাধা।

স্পর্শে কা্ঁপল তার দেহলোক
চাই অসীমে যত অমৃতভোগ
এসো তবে তব তাই হোক।


৩৬.       উড়নচণ্ডী 


ভালোবেসেছিলি ঠিক ছিল
ভালোবাসা দিয়েছি।
কেন আবার বিয়ে করতে চাস?
অভাব সন্তাপ সইতে পারবি তো?

অবহেলা করবি না জানি
অযত্নও করবি না তুই
চোখের জল রাখার মতো আছে তো যমুনা চোখ?
নিতে পারবি শোক?

হাওয়ায় আঁচল উড়ে তোর
প্রজাপতি উড়ে এসে বসে তোর চুলে
তুই আকাশের নীল দেখিস
স্বপ্ন দেখে তোর চোখ
তুই কি ঘর করতে পারবি এই উড়নচণ্ডীর?

আচ্ছা, আসবি যখন আয়
আগুন যখন লাগিয়েছিস লাগুক
তুই যদি জ্বলতে পারিস আমিও জ্বলব
তুই যদি ছাই হতে পারিস আমিও হব
ভালোবাসা পুড়ুক।

ঘর নেই, দোর নেই!
দুজনেই খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকব। 
রৌদ্র ঝড়ুক। বৃষ্টি পড়ুক। 
পাখি হয়ে উড়ে যাব শূন্য দিগন্তে। ফুল হয়ে ফুটে থাকব পুষ্প কাননে।

( এই কবিতাটি যখন আমি লিখেছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল একুশ। পুরোনো জীর্ণ খাতা থেকে উদ্ধার করা। 
লেখার তারিখ ছিন্ন।)



৩৭.      বদলে গেছো


তুমি উঠতে বসতে শুইতে আমার খুঁত ধরো। নানান খুঁত ধরে তুমি চলে যেতে চাও। কিন্তু একসময় কী নিখুঁত ভাবে তুমি আমার হাতটি ধরেছিলে। 
তখন বলতে কী সুন্দর সন্ধ্যা তারা! কী ঝলমল ময়ুরাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটা, কী অপূর্ব দেখতে ঘাসফড়িং, কী মায়াবী এই হেমন্ত রাত।

এখন স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নের মনে করো। তারার আকাশে তারা খুঁজে পাওনা হাওয়ার রাতে শব্দ শুনতে পাওনা সোনালি রোদ্দুরে পথে বের হওনা
গান গাওনা
গল্প শোনাও না।

যে চোখ দেখত পরম বিস্ময়ে! 
সে চোখে আর কোনও মায়া নেই, 
জল নেই, ঘুম নেই। 
যে বুক টেনে নিত স্মিত আলিঙ্গনে, 
সে বুকে এখন ক্লান্তি। 
শান্তি নেই। 
আদর নেই। 
কাছে টানতে অনিহা। 
কেমন অবহেলা। কেমন অনাদর ছুঁয়ে আছে...।


৩৮.        মহুয়া বনে


চলতে চলতে পথে অচেনা কোনও স্টেশনে
হঠাৎ ট্রেন থেকে নেমে পড়ব
সেখানে দেখব মহুয়া আর আমলকীর বন
কী দারুণ ধূপছায়া গন্ধ ভাসে
চন্দ্রকান্তমণির মতো জ্যোৎস্না-গলা সে গন্ধ।

সময় হয়েছে জেনে  চলে যাব প্রস্তুতিহীন
অজানা কোনও পথ ধরে বহুদূর ....
মনে পড়বে অতীত কোনো মধুময় চুম্বনের কথা
প্রতিধ্বনিত হবে বনের গভীরে প্রিয়ের শ্বাস
যে ছিল যে আজ নেই কোথাও।

ঝুমঝুম বৃষ্টির মতো অতৃপ্ত ভালোবাসারা ঝরে যাবে
দীর্ঘশ্বাস বেগ পাবে ধূপছায়ার সেই মহুয়া বনে।



৩৯.        অমিমাংসিত ভালোবাসা


আমরা দুজন দুজনের হাত ধরেছিলাম 
ভালোবাসার টানে 
কেউ না জানুক সে কথা আমাদের মন জানে
কেউ না বুঝুক এর মানে মিথ্যা ছিল না। 

কোনও এক হেমন্ত দিনে
এই শহরের ডাক বাক্সে প্রথম চিঠি এসেছিল 
বাতাস এসে কথা বলেছিল কানে কানে-
বলেছিল ভালোবাসার কথা,
আজ কেমন আঁধার নেমেছে চারদিকে
নিজেকে দেখাচ্ছে হাভাতে কাঙালের মতো। 

কত কথা মনে হয় কত বেহিসেবি চুম্বনের কথা
কত সঙ্গম সম্পূর্ণ হয়েছিল অনাচ্ছাদিত ঘাসের উপর,
শরীর মনের কত ঋণ শোধ হয়েছে
কত অমিমাংসিত ভালোবাসার গল্প করেছি, 
দুজন কত যে নয়ন জলে ভেসেছি।


৪০.       মধ্যরাতের পংক্তিমালা


মধ্যরাতে দুঃস্বপ্নের ভিতর কবিতার শব্দেরা কেঁদে ওঠে কবিতার চোখেও ঝরে বিন্দু বিন্দু জল।

পাথর আর ফুল এক নয়। যে কথা আমি কবিতায় লিখি, তা প্রেম নয়, প্রেম আর পরকীয়া এক নয়।

ভালোবাসতে হলে বুকের ভিতরে অজস্র আবেগ থাকতে হয়। আবেগ তাড়িত হয়ে ভুলও হয়ে যায়।

ভালোবাসার মানুষটির ভিতরটাকে ছুঁতে হয়। যেখানে শ্বাসপ্রশ্বাস তৈরি হয় সেখানে।

হৃদয় ভাঙে, একবার নয়, দুই বার, তিনবারে আর ভালোবাসা হয়না। তখন সে মরে যায়।

তুমি দিয়ে গেছ অনেক কিছু। কান্নার বদলে মেঘলা আকাশ। এখন রাতভর বৃষ্টি হয়।

দিয়েছ পাখিদের ঝরা পালক। কবরের মাটি শ্মশানের দাহ। ধুপের ধোঁয়া আর কর্পুরের গন্ধ।


৪১.      স্বপ্নপ্রহরে দেখা মেয়েটি


আমি যখন দূর অরণ্যে উদাস চোখে খু্ঁজছিলাম কোনো এক মানসীকে,
তখন তুমি  অপেক্ষায় ছিলে তোমারই বাড়ির আঙ্গিনায়।
তখনও তুমি আমাকে দেখনি, 
দেখনি এক স্বপ্নবাজ তরুণের ঝাঁকড়া চুল,
যে কবিতা লিখে নিশীথের চন্দ্রপ্রহরে। যে কবিতায় তুমি কখনই ছিলেনা।

কোনো এক স্বপ্নপহরে তাকে আমি প্রথম দেখলাম,
দেখলাম বাড়ির অলিন্দে বসে থাকা সেই মেয়েটির কাজল কালো চুল
দেখলাম তার আনত চোখ, 
দেবী প্রতিমার মতো আ্ঁকা তার দেহখানি
যেখানে শরতের কা্ঁচা রোদ্রের মতো শুভ্র রং ছু্ঁয়ে আছে
দেখলাম সেই স্বপ্ন দেখা মেয়েকে যাকে আমি খু্ঁঁজেছিলাম স্বপ্নপ্রহরে, 
আমার সকল দিনরাত্রিতে, আমার সকল কবিতায়।


৪২.      হাজার তারার ভিতর 


অনেক আগে অরুন্ধতি হয়ে সে এসেছিল একবার 
এখন ছায়ার মতো অন্ধকার!
অনেক আগে যে নদীর ঘাটে ভিড়াতাম নৌকা
এখন সেখানে কেবল ধূঁ-ধূ বালুচর --
অনেক আগে কাঁঠালি চাঁপা ফুটে থাকতো যেখানে 
এখন সেখানে বুনো নাগকেশরের গন্ধ। 

এখন হেমন্ত এসেছে -
এখন চলে যাবার সময় সেখানে 
এখন সেখানে আছে পাকা ধানের মাঠ, 
বিস্তৃত সরিষার ক্ষেত - 
হলুদ গালিচার উপরে শুয়ে থাকবো 
রাতভর চেয়ে থাকবো নক্ষত্রের দিকে, 
আর খুঁজবো তোমাকে  হাজার 
তারার ভিতর।


৪৩.        জ্যোতির্ময় করো


আমাদের পদচারণায় চঞ্চল হয়ে উঠিছিল
অরণ্যের বৃক্ষাদি
পল্লবিত হয়ছিল সবুজে শ্যামলে
মধ্যহ্নের সূর্য রশ্মিতে তপ্ত হয়েছিল পর্বতমালা
জলপ্রপাত বেগ পেয়েছিল পাথরে পাথরে
ঝর্নায় স্নাত হয়ে শীতল হয়েছিল দেহখানি।

এখনও সবুজে মাতাল হয় অরণ্য, এখনো উষ্ণ হয়
সেখানকার পাহাড়
এখনও বহে নির্মল বাতাস
এখনও জলপ্রপাতের জলে স্নান করে অনাগত মানুষ
এখনও ঝর্নাধারায় জল ঝরে অবিরত।

এসো আমাকে আলিঙ্গন করো ঐ নদীর মতো
জড়িয়ে ধরো ঐ সাগরের মতো
মিশে যাও ঐ মোহনার মতো
চুম্বন দাও মাতৃক্রোড়ে ঐ দেবশিশুর মতো।

এসো বাহু বন্ধনে-
এসো জ্যোতির্ময় করো ঐ সূর্যের মতো।


৪৪.      ভালোবাসা জেগে আছে 


সেই কবে রক্ত কণিকায় লুপ্ত হয়েছিল ভালোবাসা
সেই কবে এক্কা দোক্কা খেলতে যেয়ে  পায়ে বেজে উঠেছিল ঝুমুর সুরে তোমার ঘুঙুর --
আমার প্রথম গান ধ্বনিত হয়েছিল সেইদিন থেকে।

কেমন যেন মেঘমেঘ ছিল কালরাত 
কেমন যেন বৃষ্টিবৃষ্টি ছিল সময় --
কেমন যেন কম্পিত হচ্ছিল শিরা উপশিরা 
যেন বিদ্যাপতির রাধিকা নেমে এসেছিল পথে
নিবিড় করে ভিজছিল তোমার আঁচলখানি। 

কয়দিন আগে দীপাবলীর সব দীপ নিভে গেছে
দীপ নেই আলো নেই এই রাতে 
বৃষ্টি তো আছে, দেখ তুমি -- 
অন্তরে তোমার ভালোবাসা জেগে আছে।


৪৫.       কেউ অপেক্ষায় নেই


কবি হতে চেয়েছি রাত্রিদিন। 
দুহাতে পায়রা উড়ায়েছি। 
অকাতরে প্রেম নিয়েছি । 
বড়ো করে চুল রেখেছি। 
আঁতেল মনে করেছি নিজকে। 
লেখার টেবিলে কেটেছে সারাবেলা, চেতনায় দিয়েছি শান। 
রাজকুমারের মতো হেঁটে গেছি সহস্র দৃষ্টির সামনে দিয়ে। 
পাপবদ্ধতা নয়, একধরণের ভান ছিল, কারোর দিকে ফিরে না তাকানো। 

আজ দূর, বহুদূর হেঁটে এসে দেখি কেউ আমাকে অনুসরণ করেনি। দেখি শূন্যতা চারদিক, দেখি কেউ আমার জন্য অপেক্ষায় নেই ।



৪৬.        হঠাৎ তুমি ছাড়া


আমি জানি তুমি ছাড়া পুড়ে খাক হয়ে যায়
সবুজের প্রান্তর, ফসলের মাঠ
চৌচির হয়ে যায় উর্বর মাটি
বিরাণ হয়ে যায় লতা গুল্ম বৃক্ষ, সারি সারি তরু।

তুমি না থাকলে গান নেই
গৌরীপ্রসন্নের কলম থেমে যায়
বেটোফোনের ভায়োলিন করুণ সুরে ভেসে যায়
কানে বাজে রাতভর বিসমিল্লা খাঁর সানাই
তুমি না থাকলে দূরাগত কোনো নিক্কণ বাজেনা।

সুখ নেই, প্রশান্তির বুক নেই, ভালোবাসা নেই
তুমি না থাকলে শুকিয়ে যায়
দীঘির শান্ত জল,
সব কিছুই বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, মেঘে মেঘে ভেসে যায়।

আমার সকল মায়া সুধা, হৃদয় গহীনের সকল আকুলতা, সকল ভাবনা,
তিস্তা পারের দু 'কূলের সকল দীর্ঘশ্বাস-
হঠাৎ তুমি ছাড়া সব কিছুতেই হাহাকার করে ওঠে।


৪৭.      আমিই ওর নিঃসঙ্গতা


আমিই ওর নিঃসঙ্গতা। আমিই ওর একাকীত্ব                                            এই অনুভব অনুপ্রবেশ করেছে  নিঃশব্দ পদসঞ্চারে।                                                                                                    অথবা আমি সেই গন্ধবিধুর বাতাস ভেজা অস্তিত্ব, যা ভেসে বেড়ায় ওর যাপিতদুঃখে।          
সোনালি হলুদ চন্দ্রমল্লিকাদের সূর্যের দিকে চোখ, 
শরীর জুড়ে হাসির হিল্লোল।                  কিন্তু আমি জানতেই পারি না। এই অনন্ত অন্ধকারের কথা।

আর ওর দিকে তাকিয়ে যেন শুনতে পাই রাতচরা পাখির কান্না।                    মুহূর্ত বিলীন হয় অনুকম্পার দিগন্তরেখায়।                                      আমি অনুভব করি মন্দলয়ে... কামনার সুর, আবেগমদির....

আমি ওকে দখল করি চাঁদের আলোয় ভেসে। 
বাঁধা দেয়না।                                        আমি দেখি.. ওই হাসিটি এখন ওর ঠোঁটে ...                                              কিন্তু যে কান্না আমি কোনওদিন স্পর্শ করতে পারব না ...
কেমন অক্লেশে গড়িয়ে যায় ওর জ্বরতপ্ত গাল দু'টি বেয়ে ...                    চাঁদের আলো মেখে ... স্বর্নীল মুক্তা বিন্দু যত...।


৪৮.      মায়াবী ছায়া 


কেমন যেন চৌচির হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষ, 
পত্র পল্লব।
বৃষ্টির মেঘ কোথাও নেই। বাতাসে জ্বলে উঠছে আগুন। তপ্ত রোদ্রে শুকিয়ে যাচ্ছে জল।

এই উতল রুক্ষ পৃথিবীতে কেমনে তোমাকে ভালবাসা অর্পণ করব? 
তর্পণ করব কিভাবে অন্তরের মায়া? 
এই নাও আঁজলা ভরা জল।

আমার জীবন একদিন যখন নিঃশেষিত হয়ে যাবে। তখন তুমি মায়াবী ছায়া হয়ে এসো। আসবে তো নিশ্চয়?


৪৯.     বিসর্জন দাও


দূর থেকে তাকে আজ দেখলাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে 
হেঁটে হেঁটে সে এসেছিল আরমানীটোলা থেকে।
নবাব বাড়ির গেটে এসে
থমকে দাঁড়িয়েছিল সে একবার। 
আমি তার নাম জানিনা, 
সে কি কৃষ্ণা? নাকি দীপালী? নাকি বিজলী? 
কপালে তার সিঁদুর ছিল না, 
সেকি মীর্জা বাড়ির মেয়ে তবে ? 
নাকি সাঁওতাল, হরিজন দাসী কেউ?
মেয়ে তুমি যেই হও, চিত্ত আজ বিমুগ্ধ তোমাকে দেখে।

পায়ে  ঝুমঝুম মল বেজেছিল 
হাতে ছিল শাঁখারী বাজারের শাঁখা 
কানে ঝুলেছিল ঝুমকা , মাথার চুলে চন্দনের গন্ধ 
লালবাগের কেল্লার লাল রং মেখে বিস্ময়ে দাঁড়িয়েছিল।

তুমি কি বিসর্জন দেবে এই গঙ্গার জলে? 

পার্বতী আজ ফিরে যাবে কৈলাসে মানস সরোবরে
যাবে সে শ্বশুরবাড়ি, শিব সংসারে --

মেয়ে, তোমার তো কোনও শ্বশুরবাড়ি নেই।

যদি সন্ন্যাস হতে হয় হবো , যদি বেদুইন হতে হয় হবো
যদি সাঁওতাল হতে হয় হবো
হরিজন হরিদাশ হতে হলে তাই হবো --
তবুও বিসর্জন দাও এসে তোমাকে আমারই হৃদ যমুনায়।


৫০.      কালের দীর্ঘশ্বাস 


শতবছর পরে এমনই এক স্থবির বিকেলে
কেউ একজন বিষণ্ণ চোখ মেলে বসে থাকবে 
এই বাড়ির বারান্দায়, 
অফিস থেকে ফিরে আসবে আমারই মতো কেউ একজন কর্মক্লান্ত শরীরে...
ঐ দুজন আমাদেরই বংশ পরম্পরার কেউ হবে।

অথচ ওরা জানবে না --
শতবছর আগে এখানে এই বারান্দায় 
ওদের মতো করে কেউ একজন বসে থাকত মায়াচোখে পথের দিকে , 
কারোর ঘরে ফেরার অপেক্ষায়।