শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২০

হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো



হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো

একদিন কর্মহীন এক অলস অপরাহ্নে আত্ম পরিজনহীন আমার গৃহকোণে শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম শামসুর রাহমানের 'হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো' থেকে এই পংক্তিগুলো --

'... তোমার মদির চোখ, গোধূলি-রঙিন গ্রীবা,/জীবন স্পন্দিত টসটসে ঠোঁট/ অর্থাৎ তোমার সৌন্দর্যে সচকিত হয়েও/ শুধু সেজন্যেই আমার অনুরাগের আংটি/ পরিয়ে দিই নি তোমার আঙুলে।

তোমার হাসি, যা হতাশাকে করে তোলে দীপান্বিতা,
আমাকে নিয়ে গ্যাছে সেই ঘাটে, / যেখানে ফোটে মনোজ কহলার। / না, কেবলমাত্র সেজন্যেও
ভালোবাসি না তোমাকে।'

ঘরের পশ্চিম পাশে জানালাটা খোলা। বাঁশঝাড় থেকে দু'একটা করে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। এত নির্জন যে, আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। ঘুম আসতে চায় চোখে, মুদে আসছিল দুচোখ। তন্দ্রা, ঘুম ও স্বপ্ন নাকি পরপর আসে -- তন্দ্রায় বোঝা যায় আমি কী করছি, কী ভাবছি। কিন্তু ঘুম ও স্বপ্নে কিছুই বোঝা যায় না। 

মনে হলো কার যেন পদধ্বনি বাজছে বাইরে। শুধুই পায়ের শব্দ। নুপুর কিংবা চুড়ির শব্দ নয়। পদ শব্দ আস্তে আস্তে নিস্তব্ধ হলো। কে যেন দরজায় কড়া নারল একবার। আমি যেয়ে দরজা খুলে দেই। দেখি --সম্মুখে দাঁড়িয়ে জেবা সাহানি। পরনে তার টাংগাইলের হালকা নীল রঙের তাঁতের শাড়ি। ম্যাচিং করে ব্লাউজ, টিপ, কানে ইমিটেশনের দুল ও গলায় নীল পাথর বসানো লকেটের সোনার চেন পরেছে। মুখে স্মিত হাসি। হাসিটা শুধু মুখে নয়, হাসিটা চোখে এবং চোখের তারায়। মেয়েদের এমন হাসি দেখতে খুবই ভালো লাগে। জেবা সাহানিকেও খুব ভালো লাগছিল। 

জেবা আমার পড়ার টেবিলটার সামনে চেয়ারটাতে এসে বসে। জেবা বলছিল -- আমি হঠাৎ করে আপনার এখানে চলে এলাম আপনাকে কিছু না জানিয়ে। খুব অবাক হচ্ছেন বুঝি? 

-- জ্বী, একটু চমকিয়ে উঠেছি। তুমি আসবে জানলে ঘরটা ভালো করে গুছিয়ে রাখতাম। আলনার কাপড়গুলো ভাজ করে সাজিয়ে রাখতাম। পড়ার টেবিলের বইখাতাগুলো এত এলমেল থাকত না। ফুলদানিতে কোনো ফুল নেই। অন্তত কয়েকটি গাঁদাফুল এনে ফুলদানিটা সাজিয়ে রাখতে পারতাম। 

-- এই যে এলমেল সবকিছু এইটাই ভালো লাগছে। ছেলেদের ঘর সাজানো গোছানো মানায় না। সবকিছু পরিপাটি করে রাখে মেয়েরা।  ছেলেরা নয়। খুব বেশি মনে হয় সিগারেট খান। এ্যাসট্রেটা একদম ভরে ফেলেছেন। 

-- নাহ্ খুব বেশি খাই না। বেশ কয়েকদিনের এই ছাইগুলো। ফেলে দেয়া হয়নি।

-- বিছানার উপরে 'হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো'। তা কোন্ কবিতাটা পড়ছিলেন? 

-- ' কেন তোমাকে ভালোবাসি? ' কবিতাটি পড়ছিলাম --
".... দৈবাৎ এক রাতে ভুলক্রমে তোমার সঙ্গে আমার/ অদৃশ্য যোগাযোগ। এমনই আকস্মিক
সেই ঘটনা, আজো কেমন ধন্দ লাগে। / বস্তুত

মধুর এক ধাক্কা খেয়ে পথচলা
মেঘের আলপথে। / একটি ভুলের কুঁড়ি বিকাশের বাঁশির তানে/ চমৎকার এক ফুল হয়ে
দুলে উঠবে সত্যের মুখোমুখি, কে জানতো?...''

*****  *****  *****

( এখানে একটু বলি -- জেবার সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। আমার এক বন্ধুর কাজিন সে। আমি বিয়ে করব, মেয়ে খুঁজছি। এই কথা জেনে আমার সেই বন্ধু বলেছিল-- আমার একটি কাজিন আছে, ইডেনে পড়ে। ট্রেডিশনাল সিস্টেমে বাংলা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেবে।  তুমি ওকে দেখতে পারো। ' 

বললাম, ঠিক আছে দেখব। 

ধানমন্ডির একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে আমরা তিনজন একদিন লাঞ্চ করি।  ঐদিনই জেবাকে আমি প্রথম দেখি। দেখে ওকে ভালো লাগল। 

আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  বাংলায় অনার্স এবং মাস্টার্স করেছি। জেবা তাই আমাকে অনুরোধ করে বলেছিল -- 'আমি মাঝে মাঝে  আপনার কাছে থেকে একটু হেল্প নেব।' আমি বলেছিলাম, অবশ্যই তোমাকে প্রয়োজনীয় হেল্প করব।'

শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি বারান্দায়, ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের লনে বসে আমি এবং জেবা সাহানি  একাডেমিক বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছি, এবং জেবাকে যতটুকু পারি, টিপস্ দিয়েছি। ব্যাস, এই পর্যন্তই। কিন্তু কোনো ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে পড়িনি কেউই।

একদিন আমার সেই  বন্ধুটির সাথে আমার দেখা হয়। এবং সে বলে -- 'জেবাকে কি তোমার পছন্দ হয় ?' আমি ওকে বলি -- 'জেবা খুব ভালো মেয়ে। ওকে নিয়ে ঘর করা যায়।'

আমার সেই বন্ধুটি বলে -- 'তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি।' আমি বললাম -- কী কথা? 

-- জেবার একটি বিয়ে হয়েছিল। ওদের বাসর রাতও হয়েছিল।  কিন্তু সেই একটি রাতই কেবল, কিংবা একটি দিনই বিয়ে টিকেছিল। তারপরের দিনই সে বিয়ে ভেঙে যায়। দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কী জন্য বিয়েটা ভেঙে যায়, তা জানি না। জেবা সে কথা  কাউকে বলেনি কখনও। 

আমি শুধু কথাগুলো শুনলাম। এবং বললাম -- আমি আমার বাড়িতে আলাপ আলোচনা করে, তোমাকে মতামত জানাব। 

আমি বাড়িতে আলাপ আলোচনা করে -- আমার সেই বন্ধুকে নেগেটিভ মতামত জানিয়ে দিলাম। বললাম -- আমাদের বাড়িতে কেউই এই বিয়েতে রাজি নয়। ) 

*****  *****  *****

জেবা বলছিল -- আপনার কবিতার খাতাটি কই?  একটু দেখব। দেখি -- সর্বশেষ কোন্ কবিতাটি আপনি লিখেছেন, একটু পড়ব। 

টেবিলের উপরেই আমার কবিতার খাতাটি ছিল।  আমি খাতাটি জেবার হাতে দিলাম।  জেবা খাতাটি হাতে নিয়ে আমার লেখা শেষ কবিতাটা পড়তে লাগল --

" আমি একটি ছেলেকে চিনি
সেই ছেলে 

সন্ধ্যা আকাশের তারার আলো হতে চেয়েছিল
কিন্তু মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেছে সেই তারা 
নিভে গেছে সেই আলো।

ছেলেটি একটি অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন ছুঁতে চেয়েছিল
কিন্তু অলৌকিক ঝরনাধারায় ভেসে গেছে সেই স্বপ্ন, জীবনের ক্যানভাসে সেই স্বপ্ন সে আঁকতে পারেনি। 

ছেলেটি চেয়েছিল একটি ঘর 
আনন্দলোক থেকে সুখ কুড়িয়ে আনতে চেয়েছিল
ফুলের রেণু থেকে অমৃত
মাধুকর হতে চেয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার মাধবীকে।

সে চেয়েছিল কেউ একজন চিরকালের হোক,
নিপবনের পাখির বাসার মতো ঘর হবে তার
পূর্ণিমা রাতের উদ্দাম জোছনার প্লাবন বইবে ভাঙা অলিন্দ দিয়ে।

ছেলেটি একটা অমল সুন্দর প্রিয়তমা চেয়েছিল
যার কাছে  মন খুলে বলা যায় সব কথা
ইচ্ছে করলেই যাকে বুকে জড়িয়ে 
চুমু খেয়ে নেওয়া যায় একটার পর একটা
চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখা যায়
হাতে হাত রেখে সব ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়া যায়
কিন্তু সে পারেনি।

হাতের মুঠোয় সে ভরতে পারেনি প্রেম
চিরকাল যৌবনের মোহ ভেঙে খুঁজেছে তার শৈশব 
ময়ুরাক্ষী দিনগুলো কখন যে চলে গেছে সে বুঝতেই পারেনি।

এক একজন এভাবেই ভাবে
আর এভাবেই ভুল অঙ্কের খাতায় হারাতে থাকে
একের পর এক তার প্রিয়মুখ
দিনশেষে পড়ে থাকে শুধু অতৃপ্ত কিছু অভিমান।"


কবিতাটা পড়া শেষ হলে জেবা অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকে। কোনো কথা বলছিল না সে। মনে হলো ওর বুকের গভীর থেকে একটি লুপ্ত হয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল। 

জেবা বলছিল -- 'আমার কাজিন, অর্থাৎ আপনার বন্ধু আমাকে সব কথা বলে দিয়েছে।  তবুও আজ আসলাম আপনার এখানে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল আপনার ঘর, আপনার ঘরের এলমেল সব জিনিসপত্র। আপনার লেখার টেবিল যেখানে বসে আপনি কবিতা লেখেন। 

আজ এই বিষণ্ণ বিকালে খুব ইচ্ছে করছিল -- আপনাকে নিয়ে দূরে কোথাও নদীর কূলে একটু বেড়াতে যেতে। নদীর জলের ধ্বনি শুনতে আপনাকে নিয়ে। একটি সূর্যাস্ত দেখতাম হৃদয়ে পৃথিবীর সব আলো নিভিয়ে দিয়ে।' 

নাহ্ , সেইদিন সেই বিষণ্ণ বিকালে আমাদের নদীর তীরে যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি তীরে দাঁড়িয়ে শেষ সূর্যাস্ত। মনের ভিতর জীবনানন্দ দুঃখ তখন -- '
সব পাখি ঘরে আসে -- সব নদী ফুরায় জীবনের সব লেনদেন, থাকে শুধু অন্ধকার।'

জেবা সাহানি সন্ধ্যার আগেই ফিরে চলে যায়। যাবার সময় একটুও সে পিছনে ফিরে তাকাল না। জানিনা,  ওর চোখে হয়ত জল ছিল, তাই  ফিরে তাকায় নি। 

জেবা আমার কেউ নয়, সামান্য  কিছুদিনের  পরিচয় ছিল মাত্র। তবুও সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যায় খুব  শূন্যতা বোধ করেছিলাম।

~ কোয়েল তালুকদার 

শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২০

রুপালী আলো

রুপালী আলো

লোকটা একটা খচ্চর। বয়স পয়ত্রিশ হবে।  এই পর্যন্ত বিয়ে করেছে পাঁচটা। প্রথম চার বউ ছেড়ে চলে গেছে।  বর্তমানে যে বউ আছে -- ওর নাম রুপালী। বছর খানেক আগে রুপালীর বিয়ে হয়েছে এই খচ্চর রফিকের সাথে।  এখনও এই বিয়েটা  টিকে আছে। 

খচ্চর রফিক অটো চালাত রাজেন্দ্রপুর মাস্টার বাড়ি এলাকায়। রুপালীর সাথে ওর প্রথম দেখা এই অটো চালাতে গিয়ে। রুপালী কাজ করত চৌরাস্তায় একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে। মাস্টার বাড়ি এক বাড়িতে ওরা কয়েকজন মেয়ে মিলে ভাড়া থাকত ।  রফিক প্রতিদিন ফ্রী তে আনা নেওয়া করত রুপালীকে।  আর এই ভাবেই রফিকের সাথে ওর প্রণয় হয়। এবং পরবর্তীতে বিয়ে হয়।

খচ্চর রফিক ছিল সুঠাম দেহের অধিকারী। সুদর্শনও বলা যায়। ওর এই সৌন্দর্যের কারণে মেয়েদেরকে সে প্রলুব্ধ করতে পারত।  ওর প্রধান অভ্যাস ছিল তারি খাওয়া। তারি খেয়ে মাতাল হয়ে ওর বউদের সাথে সে মাতলামি করত। অকারণে তাদের মারপিট করত।  ওর এই আচরণের কারণে ওর আগের বউরা ওকে ছেড়ে চলে যায়। 

রুপালীকে বিয়ে করার দুইদিনের মাথায় একদিন সন্ধ্যায় তারি খেয়ে মাতলামি করতে করতে রুপালীকে বলে -- 'তুই কাল থাইকা আর গারমেনে যাইতে পারবি না।'
রুপালী বলে -- ' ক্যান যাইতে পারুম না? '

-- আমি তরে কইলাম, যাবি না।  ব্যাস,  আর যাবি না। '

-- কারনডা আমারে কও। 

-- তুই তো রূপের ছেরি, তোর ডবকা যৌবন, আরেক ব্যাডার লগে তুই  পিরিত করবি। এবং আমারে ছাইড়া চলে যাবি। এই জন্য। 

-- আমি গারমেন্টে কামে যামুই। 

খচ্চর রফিক রুপালীর এই কথা  শোনা মাত্র ওকে ধরে পেটাতে থাকে। সেকি তুমুল মাইর। চুল ধরে কিলাইতে কিলাইতে রুপালীকে বলে -- কী যাবি মাগী? ক। 

রুপালী ভয়ে  কাঁদতে কাঁদতে কাতর হয়ে বলে -- 'না, যাব না।'

শালবনের পাশে নান্দুয়াইন গ্রামে একটি ছোট্ট মাটির বাড়িতে রফিক ওর বউ রুপালীকে নিয়ে থাকে।  বনপাশে এমন নিরিবিলি বাড়িতে একা একা থাকতে রুপালীর ভালো লাগে না। রুপালীর মনে পড়ে ওর সহকর্মীদের কথা।  মনে পড়ে ফিরোজা, রুবী, খাদিজাদের কথা। মনে পড়ে আরও একজনের কথা, নাম -- শাহীন।  শাহীনও ওর সহকর্মী ছিল। শাহীন  একদিন ওকে বলেছিল, ' তোমাকে আমার ভালো লাগে রুপালী।' 
ঐ পর্যন্তই। শাহীনকে আর কিছু বলা  হয়নি রুপালীর। এর মধ্যেই ওর বিয়ে হয়ে যায় -- খচ্চর রফিকের সাথে। 

রফিক একটা গোয়ার। তরকারিতে লবন কম হলে রুপালীকে ধরে পিটায়। ঘরের বাইরে  কোনো লোকের সাথে রুপালী একটু কথা বললেই -- ওকে ধরে পিটায়। রফিক  রুপালীকে বাপের বাড়ি মির্জাপুর যেতে দিত না। যেতে চাইলে ধরে পিটাত।  রফিক ভাবত -- রুপালী বাপের বাড়ি চলে গেলে আর ফিরে  আসবে না। রফিক অনেক সময় রুপালীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনও করত। বাধা দিলে মারপিট করত। 

রুপালী হাঁপিয়ে ওঠে রফিকের সাথে ঘর করতে।  এক একসময় রুপালীর মনে হতো -- এই ঘর, এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে সে। মনে হতো -- শাহীন যদি আবার এসে বলত,  'তোমাকে আমি ভালেবাসি রুপালী,  তুমি আমার ঘরে চলো।'  রুপালী ঠিকই শাহীনের হাত ধরে পালিয়ে যেত। এই পাষাণ স্বামীর ঘর করতে তার কিছুতেই আর ভালো লাগছে না। 

একদিন সন্ধ্যা রাত্রিতে রুপালী ঘরে বাতি জ্বালিয়ে বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়াতেই ছায়ার মতো কাকে যেন দেখতে পায়। কে যেন বরোই গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা এগিয়ে আসে রুপালীর কাছে।  এসে বলে -- আমি শাহীন রুপালী।  তুমি আমাকে চিনতে পারছ না ?'  তোমার খোঁজ জেনে তোমাকে দেখতে আসলাম। তুমি কেমন আছো ? '

-- 'আমি ভালো নেই।  কিন্তু তুমি এ কী করলে !  প্রতিবেশী কেউ দেখে ফেললে তারা আমার স্বামীকে বলে দেবে।  ঐ গোয়ার লোকটা আমাকে মেরেই ফেলবে।  তুমি এক্ষুনি চলে যাও।'

সেদিনের মতো শাহীন চলে আসলেও এর পরে প্রায়ই গোপনে রুপালীর সাথে সে দেখা করত।  দেখা করে কথা বলত। ওদের এই দেখা  করাটা খুব সাবধানে হতো। অল্প সময় নিয়ে দেখা করে কথা বলে চলে আসত শাহীন। ঘরে বসত না। দেরিও করত না।  

এরই মধ্যে ওদের সাথে প্রণয় গড়ে ওঠে। একদিন রুপালীর সাথে শাহীনের শলাপরামর্শ হয় -- ওরা দুজন রাতে দেখা করবে শালবনের ভিতর। ঘন বনের ভেতর চলে আসবে রুপালী একটি নির্দিষ্ট জায়গায়। শাহীন অপেক্ষা করবে ওর জন্য  সেখানে। যেখানে ওরা মিলিত হবে। 

কথামতো সেই রাতে শাহীন চলে যায় শালবনে। রাত ক্রমে গভীর হতে থাকে। শাহীন অপেক্ষা করতে থাকে রুপালীর জন্য।  বনের ভিতর ঝিঁঝি পোকারা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে থেমে যেতে থাকে। জোনাকিদের আলো জ্বলা নিভে যেতে থাকে।  পঞ্চমীর চাঁদও ডুবে গেছে সেই  সন্ধ্যা রাতেই।  তারারা জ্বলছে, নিভছে। কেমন নীরব হয়ে আছে  বন নিভৃতে। বন জুড়ে তখনও স্তব্ধ অন্ধকার ।

হঠাৎ শুকনো পাতার মর্মর ধ্বণি শোনা গেল। পথের উপর পড়ে থাকা বনের  শুকনো পাতা  মাড়িয়ে নগ্ন পায়ে চলে আসে রুপালী।  রুপালী শাহীনকে দেখে বলে -- আমি দেরি করতে পারব না, এখনই যেতে হবে।  গোয়ার কসাইটা জেগে উঠতে পারে । '

সেই  স্বল্প সময়ের ভিতরই সেই বন নিবিড়ে দুটি মানব মানবী এক আশ্চর্য রাতের গভীরে মিলে গেল। বনতলে সেই আঁধারে দুজন হারিয়ে যেতে লাগল, হারিয়ে দিতে লাগল, ধরা দিল নিজেদেরকে, খুঁজে পেল একে অপরকে। মনে হয়েছিল ওদের -- রাতকে কখনও ভোর হতে দেবে না। শালবনের সব পাখি তখন ঘুমে বেঘোর। সব বৃক্ষ অন্ধকারের সাক্ষী হয়ে রইল অনেক কিছুর। সাক্ষী হলো আকাশ, আকাশের তারা, ঘুমন্ত জোনাকি আর বনশয্যার বিছানো শুকনো মর্মর পাতা। 

তারপর রুপালী  উঠে দাঁড়িয়ে শাহীন কে জড়িয়ে ধরে বলে -- তুমি আমাকে কবে নিয়া যাইবা। 

-- খুব শীঘ্রই। তুমি যখন যাবে, তখনই। 
 

রুপালী বাড়ির দিকে আসার জন্য তখন পা বাড়ায়।  পা ফেলতেই তার খালি পায়ে কাঁটার মতো  কী যেন বিঁধে যায়। অন্ধকারে দেখতে পায় একটি মরা গাছের শুকনো চোখা গুরি বিঁধেছে। বেশ রক্ত ঝরছে।  রুপালী খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসে। বাড়িতে এসে দেখে ওর স্বামী তখনও  ঘুমিয়ে আছে। 

খুব ভোরে  রফিকের ঘুম ভাঙে।  সে বিছানা থেকে উঠে বাইরে আসে।  তখনও সূর্য দেখা যাচ্ছিল না বন প্রান্তরে।  কিন্তু ভোরের আলোয় সে দেখতে পেল উঠানে পায়ের ছাপের রক্তের দাগ। সেই  ছাপ ঘরের মেঝে পর্যন্ত চলে গেছে। সে ঘরের ভিতর যেয়ে রুপালীকে ডেকে তোলে। সে দেখতে পায় -- রুপালীর পায়ে থেকে তখনও  একটু  একটু করে  রক্ত ঝরছে। 

রফিক রুপালীকে বলে -- 'ওঠ্।  আমার সাথে বাইরে আয়।' রুপালী উঠে রফিকের সাথে উঠানে আসে।  রফিক পায়ের রক্তের ছাপ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রুপালীকে নিয়ে  পিছনে শালবনে চলে যায়।  য়েখানে রুপালী শাহীনের সাথে দেখা করেছিল সেখান পর্যন্ত।  রফিক রুপালীকে বলে -' 'ক মাগী,  রাইতে তুই কার সাথে দেখা করেছিলি এইখানে ?  কী করেছিলি, ক।'

রুপালী কোনো কথা বলে না।  চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।  রফিক ওর গলা চেপে  ধরে বলে -- 'ক মাগী,  তুই  কার সাথে দেখা করেছিলি?' রুপালী নিশ্চুপ।  রফিক শক্ত করে আরও হজোরে গলা চেপে ধরে বলে -- 'ক মাগী।'  রুপালী ততক্ষণে নির্জীব হয়ে গেছে। 

একসময় ভোরের আলো শালবৃক্ষের পাতার ফাঁক দিয়ে নীচে  মরে পড়ে থাকা রুপালীর মুখের উপর এসে পড়ছিল। কী সুন্দর রুপালী আলো, কী শুচি শুভ্র দেখতে লাগছিল রুপালীর মুখখানি। 

~  কোয়েল তালুকদার 
 

সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০২০

কংসাবতীর তীরে

কংসাবতীর তীরে 

তেমন কোনো বিত্ত ছিল না আমাদের। ছিল না দৌলতও। টিউশনি করে লেখাপড়া করেছি। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর লেখাপড়া চালিয়ে  যাওয়া আর সম্ভব হয় নাই। পরিবারের প্রয়োজনে  একটি এনজিও তে চাকুরি নেই। আমার পোস্টিং হয় শেরপুরের নালিতাবাড়ীর মেঘালয় সীমান্তবর্তী এক অজো পাড়া গাঁয়ে।  আমার পদবী ছিল মাঠকর্মী। যারা এনজিও থেকে ঋণ নেয়, তাদের কাছ থেকে ঋণের কিস্তির টাকা আদায় করাই আমার কাজ ছিল।  

আমি এর আগে কখনও এই নালিতাবাড়ী আসিনি। বাড়ি থেকে আসার পথে খুব দুর্ভাবনা করেছি, ঐ অপরিচিত জায়গায় যেয়ে কোথায় উঠব, কোথায় থাকব। কিন্তু এখানে আসার পর সেই ভাবনা অনেকটা দূর হয়েছে। আমাদের কেন্দ্রের ম্যানেজার সাহেব অফিস সংলগ্ন একটি ছোট্ট রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। 

এখানে নিজেই রান্না করে খাই। বেশিরভাগ সময়  সকালবেলা রান্না করে তিন বেলা খেয়ে খেতাম। ভাত রান্না করার সময় ভাতের মধ্যে ডিম সিদ্ধ দিতাম। সেই ডিম কাঁচা মরিচ ও পিয়াজ দিয়ে ভর্তা করতাম। আবার ডিম মামলেটও করতাম মাঝে মাঝে।  কোনো কোনো সময় মসুর ডাল ভর্তাও করতাম। মাছ মাংস তেমন কেনা হতো না। ওগুলো কাটাকুটি করে রান্না করে খাওয়া আমার পক্ষে  সম্ভব ছিল না।
  
এলাকাটি দারুণ প্রকৃতি শোভাময়। অদুরেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সীমান্ত শুরু হয়েছে সুউচ্চ গারো পাহাড় দিয়ে। সেই পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে  এসেছে কংসা নদী। জেনেছি  ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগে তুরার কাছে এ নদীর উৎপত্তি। কী অদ্ভুত ! যে নদীর জন্ম দিল শৃঙ্গে জমে থাকা মেঘ আর চেরাপুঞ্জির অজস্র বৃষ্টির জলধারা। আর সেই ধারা কী-না বয়ে এল আমাদের দেশে নদী হয়ে। কী স্বচ্ছ এর জল।  পাথর, পাথরকুচি আর সিলিকন বালু এই নদীর অতল দিয়ে ভেসে আসে এ দেশে । 

এই নদীর এখানে অন্য নাম -- ভোগাই। নাহ্ আমি  তাকে সে নামে ডাকতাম না। ভালো লাগত না এই নামটি। আমি ওকে কংসাবতী বলে ডাকতাম। আমিই  ডাকি, আমি তা শুনি। আমিই তার অরূপ রূপ দেখি । 

আমার তেমন কোনো বন্ধু ছিল না এখানে। তাই এই নদীটাকে আমি আমার বন্ধু করে নিয়েছিলাম। এর কূল ধরে হাঁটতাম, কত সন্ধ্যা নেমেছে কংসাবতীর তীরে, কত সূর্য ডুবে গেছে গারো পাহাড়ের শৃঙ্গের আড়ালে। অস্তাচলের কত সোনালি আভার দিগন্ত আঁধারে কালো  হয়ে গেছে।  মনে হতো জীবনের সব গান  হারিয়ে ফেলেছি ঐ দূর আকাশে,  ঐ পাহাড় শৃঙ্গের ঘন লতাগুল্মের নিভৃতে । 

এই কংসাবতীর তীরের একটি গ্রাম নয়াগাঁও।  আমাদের এনজিওর একটি কেন্দ্র ছিল এখানে। কেন্দ্রটির অফিসিয়াল নাম দেওয়া হয়েছিল 'সন্ধ্যাতারা'।  এই কেন্দ্র থেকে গরীব, দুস্থ ভূমিহীন মেয়েরা ঋণ গ্রহণ করত।  আছিয়া, নুরজাহান, নুরী, বুলবুলি, নসিরণ, জরিনা সহ আরও এমন অনেক মেয়ে এই সন্ধ্যাতারা কেন্দ্র থেকে ঋণ নিয়ে  তারা নিজেদের স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে । শাখার ম্যানেজার সাহেব প্রথম দিনই ঋণ গ্রহিতাদের তালিকা আমাকে দিয়ে বললেন -- এই সন্ধাতারা কেন্দ্রে আপনাকে কাজ করতে হবে। তিনি এই ব্যাপারে আমাকে আরও কিছু প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দিলেন। 

পথম দিনের কথা। 

শাখা অফিস থেকে কংসাবতীর তীর  ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম নয়াগাঁও সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে। তখন ছিল আশ্বিন মাস। কংসাবতীর বুক ভরা অথৈই জল। কংসার স্বচ্ছ পানির উপরে পড়েছে শরতের সাদা মেঘের ছায়া। জলের উপর রোদ্দুর ঝিলমিল করছে। নদীর কূল ধরে যখন হাঁটছিলাম তখন দেখছিলাম জল আর মেঘ-রোদ্দুরের খেলা।  আরেক দিকে  দেখছিলাম হলুদ ফুলের সরিষার ক্ষেত। ফড়িং আর প্রজাপতি এসে পড়ছিল গাদা গাদা ফুলের উপর। অদূরে দেখতে পাই একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ। কোথাও একটি মানুষও নাই। একদম  বিজন। বটবৃক্ষটি পার হয়ে সামনের দিকে হাটঁতে থাকি। 

তখন বেলা বারোটা হবে। নয়াগাঁও গ্রামের নিকটবর্তী হতেই দেখতে পাই -- একটি স্ত্রীলোক নির্জন কংসাবতীর জলে নেমে সে স্নান করছে। বক্ষের বসন ঈষৎ উন্মোচন করা,  সাদা ঝকঝকে গায়ের রং, হাতে বালা , পরনে লালপাড় শাড়ি, বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে। স্ত্রীলোকটি প্রথমে আমাকে দেখতে পায় নাই, যখন আমাকে দেখতে পায়, সে লজ্জাশীলা হয়ে উঠে। বুকের বসন ঠিক করে  নদীর কূলে অবস্থিত  তার বাড়ির দিকে হেঁটে চলে যায় । 

তখন আমার বয়সই কত !  বিশ হবে। একজন উচ্ছল তরুণ,  বিয়ে করি নাই। আমি  অত বড়ো বিদ্বান ব্যক্তিও ছিলাম না। তেমন কিছু পড়া হয় নাই উপন্যাস, গল্প, নাটিকা। পড়লে বুঝতে পারতাম -- মঞ্জুলিকা, বাসন্তী, শকুন্তলা, বিনোদিনী, অভিসারিকা এইসব  কী !  কিন্তু সেদিন সেই আশ্বিনের মিষ্টি রোদের নীচে কংসাবতীর জলে যে রমণীকে স্নানরত দেখলাম -- তা আমার তরুণ হৃদয় মনে একধরনের মদিরার মতো চির আসক্তির অনুভব হয়ে থাকল। 

নয়াগাঁও গ্রামে ঢুকে কেন্দ্র প্রধান নুরজাহান খাতুনের বাড়িটি খুঁজে বের করি। আমি নুরজাহানের বাড়িতে ঢুকে  আমার পরিচয় দেই। নুরজাহান আমাকে ছালাম দিয়ে বলে -- 
'স্যার আপনি বসেন। আমি সব সদস্যদের ডেকে নিয়ে আসি।'  

আমি উঠোনে একটি কাঠের চেয়ারে বসে থাকি। আমার ভালোই লাগছিল এই জন্য যে, সামান্য একটা চাকুরী করি। আর এই মেয়েটি কিনা আমাকে স্যার ডাকল। আমাকে তাহলে এখানকার সবাই স্যার ডাকবে। 

ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্রায় বিশ বাইশ জনের মতো মেয়ে জড়ো হলো। তাদের সবার বয়স কুড়ি থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। আমি ওদের নিকট আমার পরিচয় দিলাম -- বললাম, 'আমার নাম আনিসুর রহমান। এই কেন্দ্রে নতুন জয়েন করেছি। আমার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি থানায়। শাখা অফিসেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আমি নবীন, অল্প বয়স।  আপনেরা আমাকে স্যারও ডাকতে পারেন, আবার আনিস ভাইও ডাকতে পারেন।' নুরজাহান বলে উঠল -- স্যার, আমরা সবাই আপনাকে স্যারই ডাকব। '

সবাই তাদের ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তিগুলোা আমাকে প্রদান করে তাদের জমা বইয়ে এন্ট্রি করে নিচ্ছিল।  একটি মেয়ে ঘোমটা টেনে একটু  দূরে দাঁড়িয়েছিল। সে আসছিল না আমার কাছে।  নুরজাহান ঐ মেয়েটিকে ডেকে বলে -- ও জরী, তুই দাঁড়িয়ে রইছোস ক্যান, কিস্তি জমা দে। '

মেয়েটি ঘোমটা টেনে মৃদু পায়ে আমার কাছে এসে টাকা ও জমা বইটি  আমার হাতে দেয়।  আমি ঘোমটাটার ফাঁক দিয়ে দেখলাম তার মুখ। এ যে সেই  মেয়ে যাকে আমি কংসাবতীর জলে স্নানরত দেখেছিলাম। জমা বইতে নাম দেখলাম -- মোছাঃ জরিনা খাতুন, স্বামী  -- সোলাইমান মিয়া, সাকিন -- নয়াগাঁও। মেয়েটি আমার দিকে একবারও তাকাল না। খুব সলজ্জ ভঙ্গিতে টাকা জমা দিয়ে সে চলে গেল। 

সেদিনের মতো কাজ শেষ করে  চলে আসি। ফিরে আসছিলাম কংসাবতীর তীর ধরে। নদীর জলগুলো কেমন স্থির হয়ে আছে।  বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতের প্রান্তরের দিকে তাকালাম -- ফুলগুলো দুপুরের  রোদে ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। বটবৃক্ষের তলে যেয়ে দেখি -- একটি মধ্যবয়সী গারো গায়েন বসে গান গাইছে বাঁশের দোতারা বাজিয়ে। আমি তার গান শুনি। কী অপূর্ব গাইছিল।  ওর গানের ভাষা আমি  বুঝিনি। কিন্তু গানের সুরটি ছিল দুঃখের। 

রুমে এসে খেয়ে একটু বিশ্রাম নেই। বিকালবেলা কংসাবতীর তীরে  গিয়ে চুপ করে বসে থাকি। নদীর নীরব তরঙ্গধ্বনি শুনি।  গারো পাহাড়ের  মাথার ওপর দিয়ে  সূর্য অস্তমিত হতে থাকে। সোনালী আভা সরিয়ে ক্রমে আকাশ ধূসর হয়ে উঠে। তারপর অন্ধকার নামে আদিম গুহার আঁধারের মতো। সেই আঁধার জগতে একটি সিক্ত বসনার রমণী মূর্তি ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল। যাকে আমি দেখে এসেছিলাম আজ কংসাবতীর 
তীরে। 

রাতে বিছানায় শুয়ে  ভাবছিলাম অনেক কথা। ঘুম আসছিল না চোখে। মধ্য প্রহরে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াই।  দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়কে দৈত্যের মতো লাগছিল। একবার মনে হলো -- কংসাবতীর তীরে যেয়ে ঘুরি। কিন্তু এত অন্ধকার যে,  ঐ জনমানবহীন নদীর তীরে যেতে শঙ্কা লাগছিল। বারান্দা থেকে রুমে এসে আবার শুয়ে পড়ি। তারপর কখন ঘুমিয়ে যাই জানতে পারি নাই। 

সপ্তাহে একদিন আমাকে নয়াগাঁও এ সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে যেতে হতো। বাকী কর্ম দিনগুলোতে অফিসে কাজ করতাম। নয়াগাঁও কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সারা সপ্তাহ উন্মুখ হয়ে থাকতাম। 

একদিন নয়াগাঁও যাওয়ার জন্য বের হয়েছি। যখন বের হয়েছি তখন ঝকঝকে রোদ ছিল।  সেই একই রাস্তা, একই নদীর কূল ধরে চলেছি সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রের দিকে।  অর্ধ রাস্তা যাওয়ার পর হঠাৎ আকাশে মেঘ হয়। প্রাচীন বটবৃক্ষের নিকট যাওয়া মাত্র ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতে থাকে। আমি বটগাছের নীচে দাঁড়াই। কিছুটা বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেলেও ভিজে যায় জামা ও মাথার চুল । বৃষ্টি ছাড়লে আমি আবার রওনা হই। ভেজা শরীর নিয়েই নয়াগাঁও পৌঁছি। 

জরিনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে আমি যাচ্ছিলাম। বাড়ির আঙিনা থেকে জরিনা আমাকে ভেজা অবস্থায় দেখে ফেলে।  একটি ছয় সাত বছরের বালক কাছে  এসে বলে -- 'আপনাকে মায়ে ডাকছে।' আমি দেখলাম -- জরিনা ঘোমটা মাথায়  দিয়ে বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে যেতেই সে মুখ আড়াল করে বলে -- 'আপনি ভিজে গেছেন। বারান্দায় টুলের উপর বসেন।' 

আমি টুলের উপর বসি। জরিনা একটি গামছা এনে দিয়ে সেই একই রকম মাথায় ঘোমটা টেনে বলে -- 'এইটা দিয়ে মাথা মুছে নিন। আপনার  ঠান্ডা লেগে যাবে।'

মাথা মুছে এবং জামা একটু শুকিয়ে নিয়ে নুরজাহানের বাড়ি যাই। সেদিনও জরিনা মাথায় ঘোমটা দিয়ে কিস্তির টাকা আমার কাছে এসে জমা দিয়ে যায়। জরিনার এমন ঘোমটা দেওয়া দেখে নুরজাহান ওকে বলে -- 'কী লো জরী, তুই মাথায় এমন ঘোমটা দ্যাস ক্যান?  স্যারেরে দেইখা তুই কি লজ্জা পাস? '

কাজ শেষে কাঠের চেয়ারের উপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। দেখলাম, জরী মুখ ঘুরিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর  সলজ্জিত মুখখানি দেখতে বড়ই সাধ হয়। জরী মনে হয় -- ওর সেদিনের সেই নির্জন নদীর কূলে ঈষৎ উদোম হওয়া দেহখানি দেখেছি যে, সেই লজ্জা ঘোমটা দিয়ে আড়াল করে  ফেলতে চাইছে। কিন্তু জরী জানে না -- তার সেই অপরূপ রূপ আমার অন্তরের কোণে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে রেখেছে। 

সেদিনও পথে আসতে আসতে চেয়ে দেখছিলাম কংসাবতীর জল। কেমন অতৃপ্ত বিষাদ বাতাস ঝাপটার বেগে আমার দেহ মনে এসে লাগল। কেমন শীতল অনুভব হলো -- জরি আমার সব না। কেউ না। কিন্তু আমি এই কদিনে অনেক কিছু ভেবে বসলাম। জরির মতো এমন একটি মেয়েকে নিয়ে এমন ভাবনা করা ঠিক নয়। জীবনের মধুকাল তো ধরতে গেলে শুরুই হয়নি। সামনে আরও কত সময় আসবে। দেখা পাব কত কুমারী মেয়ের।  কত উদ্যোত প্রস্ফুটিত সন্ধ্যামালতী ফুল  ফুটে থাকবে পুষ্প কাননে। যা কিছু পাব তার গন্ধ বিলাস উপভোগ করব।  তখন মনে হবে আমিই জগতের সুখী মানুষ। 


বিকাল বেলা রুম থেকে  বাইরে আর বের হলাম না। শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। ঘরে আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করল না।  অন্ধকারেই শুয়ে  থাকলাম আরও কিছু সময়।  তারপর উঠে আলো জ্বালাই। সকালের রান্না করা ভাত খেয়ে নেই।  খেয়ে বিছানায় এসে আবার শুয়ে পড়ি। আজও চোখে কোনো ঘুম নেই।  আজও দরজা খুলে বাইরে আসি। 

নিস্তব্ধ তারাভরা রাত্রি। কংসাবতীর পাড় থেকে হু-হু হাওয়া বইয়ে আসছিল। এই রকম তারাভরা অন্ধকার আকাশের তলে দাঁড়ালে কত কথা মনে আসে। জীবনের গ্লানিগুলো মনে জাগে। আবার কত পাওয়া আঁধারে হারিয়ে যেতে থাকে। আসলে জীবন বড়োই পলাতকা। পাওয়া হয় না কোনো  কিছু, যা আমি চাই। 

আর একদিন যখন নয়াগাঁও যাই, পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, আহা! আজ যদি জরী ওর ঘোমটাখানি সরিয়ে ফেলত।  তাহলে প্রাণ ভরে  দেখে নিতাম ওর মুখ , স্থির শান্তদৃষ্টিতে আমার দিকে যদি একবার চাইত। ঐ সুশ্রী মুখ যে আমি এখনো মন ভরে  দেখিনি। ঐ চোখ নিশ্চয়ই ডাগর কালো হবে। ঠোঁটের নীচে আলগা ভাঁজ আছে, হাসলে নিশ্চয়ই গালে টোল পড়ে। এর আগে ওকে যতটুকু দেখেছিলাম তা দূর থেকে। দেখতে না দেখতে সেই শুভ দৃষ্টি মিলিয়ে গিয়েছিল বিন্দুর মতো। জরীর বাড়ির কাছে যেয়ে  ওকে খুজলাম, কিন্তু আজ সে বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে নেই। 

সন্ধ্যাতারায় যেয়ে দেখলাম -- জরী দূরে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। কারোর সাথে কথা বলছে  না।  আজও নীরবে এসে সবার আগে কিস্তির টাকা দিয়ে চলে গেল।  জরীর সাথে কথা বলার তেমন সুযোগ নেই।  আর বললেও মাথা থেকে ঘোমটা তো সে সরাবে না।  

জরী তাড়াতাড়ি করে চলে যাওয়াতে মন ভালো লাগছিল না।  সকালে আমি কোনো রান্না করে খেয়ে আসিনি। অভুক্ত ছিলাম। পেটে খুব খিদা ছিল। দ্রুত কাজ সেরে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে পড়ি। জরীর বাড়ির পাশ  দিয়ে যখন আসছিলাম, তখন দেখি -- জরী পথের উপরে একটি ছোট্ট টোপলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  টোপলাটি আমার হাতে দিয়ে বলে -- আপনার মুখটি খুব শুকনো দেখেছিলাম। এর ভিতর কিছু খাবার আছে।  ঘরে গিয়ে খেয়ে নেবেন।'

আমি বললাম -- তুমি একটু ঘোমটা সরাও না জরী। তোমাকে একটু দেখি। 

-- না। 

-- কেন না। 

-- এই মুখ আপনাকে দেখাতে লজ্জা করে। 

জরি আরও বলছিল -- আমি যাই। আপনার সাথে একাকী দাঁড়িয়ে কথা বলছি, কেউ দেখে ফেললে আমার বদনামি হবে।  আমার স্বামী আমাকে মারধর করবে। আপনি জানেন না, সে একটা কসাই। 


ঘরে এসে টোপলাটা খুললাম। টোপলার ভিতর তেলের পিঠা, নারিকেলের কুশলি পিঠা, আর মুড়ির কয়েকটি মোয়া দেখলাম।  আমার পেটে প্রচণ্ড খিদা ছিল। আমি বেশ পরিমাণ খেয়ে নিলাম। 


এরই মধ্যে সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে আমার কাজ করা দুই মাস পূর্ণ হয়।  প্রতি সপ্তাহেই জরীর সাথে কেন্দ্রে আমার দেখা হতো।  ঘোমটা টেনে কোনো কথা না বলে কিস্তি দিয়ে  নিঃশব্দে সে চলে যেত। আমার দিকে একটুও তাকাত না। ওর বাড়ির কাছে দিয়ে আসা যাওয়ার পথে ওকে খুঁজতাম ওর আঙিনায়। ঘোমটা টেনে মাঝে মাঝে চুপচাপ  দাঁড়িয়ে থাকত অদূরে। দেখতাম ওকে দূর থেকেই।   

দুই মাস পূর্ণ হওয়ার প্রেক্ষিতে আমাকে অন্য একটি কেন্দ্রে বদলি করে। এরপর থেকে নয়াগাঁও সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে আমার আর যাওয়া হতো না। মনটা প্রায়ই বিষণ্ণ হয়ে থাকত।  যেখানেই যাই, কেমন যেন অবসন্ন লাগত। সন্ধ্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম কংসাবতীর তীরে। নদীর জলের দিকে তাকিয়ে বলতাম -- 'আমার সাথে তুমি একটু কথা বলো। তোমার জলে আমাকে টেনে নাও।' সেই ধূসর সন্ধ্যায় বক ও বালিহাঁসগুলো নদীর চরাচর ছেড়ে উড়ে  চলে যেত গারো পাহাড়ের দিকে। হয়ত ওখানেই ওদের বাসা।ওখানেই ওদের কুলো। 

কূলেই রাত্রি নেমে আসত।  নদীর কোনো কথাই শোনা হতো না।  আকাশ ভরা নক্ষত্রবীথি তখন জ্বলে উঠত। ফিরে আসি ঘরে। আমি কী বুঝি অত কোনো গান, কোনো সুর। জীবন মর্মরে তখন অন্য কথা বাজে -- 

'যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার। জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পারো তুমি...'।


আরও চার মাস পর ---

আমার বদলি অর্ডার আসে জেলা সদর অফিস থেকে। ইতোমধ্যে বাড়িতে আমার দাদাজানের পীড়াপীড়ি তে আমার বিবাহ ঠিক হয়ে যায়। আমার দাদা খুব অসুস্থ। মৃত্যুর আগে সে তার নাত্ বউকে দেখে যেতে চায়। 

আমি শাখা অফিসে সমস্ত খাতাপত্র ও হিসাব নিকাশ বুঝিয়ে দেই।  ব্যাবস্থাপক সাহেবকে বলি, আমার চাকুরি জীবনে প্রথম যাদেরকে নিয়ে কাজ করেছিলাম, নয়াগাঁও এর সন্ধ্যাতারার সেই  মেয়েগুলোর কাছ থেকে একটু বিদায় নিয়ে আসতে চাই। উনি আমাকে অনুমতি দিলেন এবং বললেন -- 'যান, দেখা করে আসেন নুরজাহান, নুরী, নসিরন ও জরিনাদের সাথে।'

আমি আজও গেলাম নয়াগাঁও-এ সেই প্রথম দিনের মতো কংসাবতীর তীর ধরে একাকী হেঁটে হেঁটে। যেদিন প্রথম যাই --  সেদিন ছিল হেমন্তের রোদ্দুর।  আজ চৈত্রের দুপুর। সেদিন মাঠ ভরা ছিল সরিষা ফুলের হলুুদ প্রান্তর। আজ ধুঁ-ধূঁ  বিস্তীর্ণ খালি মাঠ। সেদিন ছিল কংসাবতীতে ভরা জল, আজ সেখানে স্বল্প পাথুরে পানি , বালি আর নুড়ি । 

পথের পাশে বৃক্ষগুলির পাতা চৌচির হয়ে ঝরে পড়ছে। ধুলো উড়ছে। পাখিদের সুমধুর গান নেই। কংসাবতীর জলে ঠোঁট চুবিয়ে জল খাচ্ছে তৃষিত কয়েকটি বক ও পানকৌড়ি। রুক্ষ বাতাস এসে লাগছিল আমার গায়ে। একসময় প্রাচীন সেই বটবৃক্ষ তলে এসে দাঁড়াই। আজ আর কোনো গায়েন নেই এখানে। একটু জিরিয়ে আবার নয়াগাঁও এর দিকে হাঁটতে থাকি। 

একসময় নয়াগাঁও-এ জরীদের বাড়ির কাছে চলে আসি। কংসাবতীর তীরে যে ঘাটে জরী সেদিন স্নান করেছিল, সেখানে এসে দাঁড়াই। আজ আর  সেখানে জরী স্নানরত নেই। কিন্তু আমার মানসপটে দেখতে পাচ্ছিলাম, সেদিনকার সেই স্বর্গীয় দৃশ্য ! একটি পল্লীবালা, যার দেহবল্লরী ছিল  এই কংসাবতী নদীর মতো উচ্ছলা, স্বচ্ছ জলের ঢেউ আছরে পড়ছিল যেন শরীরের বাঁকে।  আজও কম্পিত হলাম কিছু মুহূর্তের জন্য । চোখ ফিরিয়ে আনলাম কংসাবতীর জল থেকে। 

আমি জরীর বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি।  ওর বাড়ির আঙিনায় যেয়ে দেখতে পাই ওর ছেলেটাকে। ওকে বলি -- 'তোমার মাকে একটু ডেকে নিয়ে আসো। যেয়ে বলো -- তোমার স্যার এসেছে।'

জরী ঘর থেকে বের হয়ে আসে। আজকেও সে ঘোমটা টেনে আমার কাছে এসে দাঁড়ায়।  আমি জরীকে ডাকি -- জরী। 

-- জ্বী। 

-- কেমন আছো তুমি? 

-- ভালো। 

-- জরী...

-- বলেন। 

-- আমার বদলি হয়েছে,  আগামীকালই চলে যাচ্ছি এখান থেকে। 

-- আর আসবেন না? 

-- না। 

জরী কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।  কেমন যেন স্থির, এবং নির্বাক। কথা বের হচ্ছিল না মুখ থেকে। আমি আবার ওকে ডাকি -- জরী... 

জরী কথা বলছে না। 

আমি জরীকে বললাম -- 'আমার  বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তোমাদের সবাইকে আমি  নিমন্ত্রণ করব।  তুমি যাবে না আমার বিয়েতে? '

জরী এবার মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি খুব কাছে থেকে  দেখলাম তার বিষাদস্নাত ম্লান মুখ ও চোখ। দেখলাম, ওর চোখ দুটো জলে ভরে আছে !  কংসাবতীর জলের মতো সেই জল স্বচ্ছ ও নির্মল।


পরিশিষ্ট --

আমার সেই অল্প বয়সের জীবনঅধ্যায় শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সেই জীবনের  প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির কথা ভেবে  এখনকার জীবনেও অবসাদ নামে। হঠাৎই মন কেমন করে ওঠে। হারানো মধুময় কোনো দৃশ্য কখনোই আর দেখতে পাব না। সেই সবের জন্যে আক্ষেপও নেই।  মহাকালের বীথিপথের দিকে চোখ মেলে দেখব -- কংসাবতীর তীরে এক পল্লী রমণী  হাঁটছে ফিরছে, জলের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছে। দক্ষিণা শীতল হাওয়া এসে তার শরীরে লাগছে, তার মাথার চুল উড়ছে।

আমি যা পেয়েছিলাম, তা সত্য। আবার হয়ত কখনও পাব তা, এটি আশা। পেলেও তা আবার ফুরিয়ে যাবে, এটা অমোঘ । 


~ কোয়েল তালুকদার