শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২০

রুপালী আলো

রুপালী আলো

লোকটা একটা খচ্চর। বয়স পয়ত্রিশ হবে।  এই পর্যন্ত বিয়ে করেছে পাঁচটা। প্রথম চার বউ ছেড়ে চলে গেছে।  বর্তমানে যে বউ আছে -- ওর নাম রুপালী। বছর খানেক আগে রুপালীর বিয়ে হয়েছে এই খচ্চর রফিকের সাথে।  এখনও এই বিয়েটা  টিকে আছে। 

খচ্চর রফিক অটো চালাত রাজেন্দ্রপুর মাস্টার বাড়ি এলাকায়। রুপালীর সাথে ওর প্রথম দেখা এই অটো চালাতে গিয়ে। রুপালী কাজ করত চৌরাস্তায় একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে। মাস্টার বাড়ি এক বাড়িতে ওরা কয়েকজন মেয়ে মিলে ভাড়া থাকত ।  রফিক প্রতিদিন ফ্রী তে আনা নেওয়া করত রুপালীকে।  আর এই ভাবেই রফিকের সাথে ওর প্রণয় হয়। এবং পরবর্তীতে বিয়ে হয়।

খচ্চর রফিক ছিল সুঠাম দেহের অধিকারী। সুদর্শনও বলা যায়। ওর এই সৌন্দর্যের কারণে মেয়েদেরকে সে প্রলুব্ধ করতে পারত।  ওর প্রধান অভ্যাস ছিল তারি খাওয়া। তারি খেয়ে মাতাল হয়ে ওর বউদের সাথে সে মাতলামি করত। অকারণে তাদের মারপিট করত।  ওর এই আচরণের কারণে ওর আগের বউরা ওকে ছেড়ে চলে যায়। 

রুপালীকে বিয়ে করার দুইদিনের মাথায় একদিন সন্ধ্যায় তারি খেয়ে মাতলামি করতে করতে রুপালীকে বলে -- 'তুই কাল থাইকা আর গারমেনে যাইতে পারবি না।'
রুপালী বলে -- ' ক্যান যাইতে পারুম না? '

-- আমি তরে কইলাম, যাবি না।  ব্যাস,  আর যাবি না। '

-- কারনডা আমারে কও। 

-- তুই তো রূপের ছেরি, তোর ডবকা যৌবন, আরেক ব্যাডার লগে তুই  পিরিত করবি। এবং আমারে ছাইড়া চলে যাবি। এই জন্য। 

-- আমি গারমেন্টে কামে যামুই। 

খচ্চর রফিক রুপালীর এই কথা  শোনা মাত্র ওকে ধরে পেটাতে থাকে। সেকি তুমুল মাইর। চুল ধরে কিলাইতে কিলাইতে রুপালীকে বলে -- কী যাবি মাগী? ক। 

রুপালী ভয়ে  কাঁদতে কাঁদতে কাতর হয়ে বলে -- 'না, যাব না।'

শালবনের পাশে নান্দুয়াইন গ্রামে একটি ছোট্ট মাটির বাড়িতে রফিক ওর বউ রুপালীকে নিয়ে থাকে।  বনপাশে এমন নিরিবিলি বাড়িতে একা একা থাকতে রুপালীর ভালো লাগে না। রুপালীর মনে পড়ে ওর সহকর্মীদের কথা।  মনে পড়ে ফিরোজা, রুবী, খাদিজাদের কথা। মনে পড়ে আরও একজনের কথা, নাম -- শাহীন।  শাহীনও ওর সহকর্মী ছিল। শাহীন  একদিন ওকে বলেছিল, ' তোমাকে আমার ভালো লাগে রুপালী।' 
ঐ পর্যন্তই। শাহীনকে আর কিছু বলা  হয়নি রুপালীর। এর মধ্যেই ওর বিয়ে হয়ে যায় -- খচ্চর রফিকের সাথে। 

রফিক একটা গোয়ার। তরকারিতে লবন কম হলে রুপালীকে ধরে পিটায়। ঘরের বাইরে  কোনো লোকের সাথে রুপালী একটু কথা বললেই -- ওকে ধরে পিটায়। রফিক  রুপালীকে বাপের বাড়ি মির্জাপুর যেতে দিত না। যেতে চাইলে ধরে পিটাত।  রফিক ভাবত -- রুপালী বাপের বাড়ি চলে গেলে আর ফিরে  আসবে না। রফিক অনেক সময় রুপালীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনও করত। বাধা দিলে মারপিট করত। 

রুপালী হাঁপিয়ে ওঠে রফিকের সাথে ঘর করতে।  এক একসময় রুপালীর মনে হতো -- এই ঘর, এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে সে। মনে হতো -- শাহীন যদি আবার এসে বলত,  'তোমাকে আমি ভালেবাসি রুপালী,  তুমি আমার ঘরে চলো।'  রুপালী ঠিকই শাহীনের হাত ধরে পালিয়ে যেত। এই পাষাণ স্বামীর ঘর করতে তার কিছুতেই আর ভালো লাগছে না। 

একদিন সন্ধ্যা রাত্রিতে রুপালী ঘরে বাতি জ্বালিয়ে বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়াতেই ছায়ার মতো কাকে যেন দেখতে পায়। কে যেন বরোই গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা এগিয়ে আসে রুপালীর কাছে।  এসে বলে -- আমি শাহীন রুপালী।  তুমি আমাকে চিনতে পারছ না ?'  তোমার খোঁজ জেনে তোমাকে দেখতে আসলাম। তুমি কেমন আছো ? '

-- 'আমি ভালো নেই।  কিন্তু তুমি এ কী করলে !  প্রতিবেশী কেউ দেখে ফেললে তারা আমার স্বামীকে বলে দেবে।  ঐ গোয়ার লোকটা আমাকে মেরেই ফেলবে।  তুমি এক্ষুনি চলে যাও।'

সেদিনের মতো শাহীন চলে আসলেও এর পরে প্রায়ই গোপনে রুপালীর সাথে সে দেখা করত।  দেখা করে কথা বলত। ওদের এই দেখা  করাটা খুব সাবধানে হতো। অল্প সময় নিয়ে দেখা করে কথা বলে চলে আসত শাহীন। ঘরে বসত না। দেরিও করত না।  

এরই মধ্যে ওদের সাথে প্রণয় গড়ে ওঠে। একদিন রুপালীর সাথে শাহীনের শলাপরামর্শ হয় -- ওরা দুজন রাতে দেখা করবে শালবনের ভিতর। ঘন বনের ভেতর চলে আসবে রুপালী একটি নির্দিষ্ট জায়গায়। শাহীন অপেক্ষা করবে ওর জন্য  সেখানে। যেখানে ওরা মিলিত হবে। 

কথামতো সেই রাতে শাহীন চলে যায় শালবনে। রাত ক্রমে গভীর হতে থাকে। শাহীন অপেক্ষা করতে থাকে রুপালীর জন্য।  বনের ভিতর ঝিঁঝি পোকারা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে থেমে যেতে থাকে। জোনাকিদের আলো জ্বলা নিভে যেতে থাকে।  পঞ্চমীর চাঁদও ডুবে গেছে সেই  সন্ধ্যা রাতেই।  তারারা জ্বলছে, নিভছে। কেমন নীরব হয়ে আছে  বন নিভৃতে। বন জুড়ে তখনও স্তব্ধ অন্ধকার ।

হঠাৎ শুকনো পাতার মর্মর ধ্বণি শোনা গেল। পথের উপর পড়ে থাকা বনের  শুকনো পাতা  মাড়িয়ে নগ্ন পায়ে চলে আসে রুপালী।  রুপালী শাহীনকে দেখে বলে -- আমি দেরি করতে পারব না, এখনই যেতে হবে।  গোয়ার কসাইটা জেগে উঠতে পারে । '

সেই  স্বল্প সময়ের ভিতরই সেই বন নিবিড়ে দুটি মানব মানবী এক আশ্চর্য রাতের গভীরে মিলে গেল। বনতলে সেই আঁধারে দুজন হারিয়ে যেতে লাগল, হারিয়ে দিতে লাগল, ধরা দিল নিজেদেরকে, খুঁজে পেল একে অপরকে। মনে হয়েছিল ওদের -- রাতকে কখনও ভোর হতে দেবে না। শালবনের সব পাখি তখন ঘুমে বেঘোর। সব বৃক্ষ অন্ধকারের সাক্ষী হয়ে রইল অনেক কিছুর। সাক্ষী হলো আকাশ, আকাশের তারা, ঘুমন্ত জোনাকি আর বনশয্যার বিছানো শুকনো মর্মর পাতা। 

তারপর রুপালী  উঠে দাঁড়িয়ে শাহীন কে জড়িয়ে ধরে বলে -- তুমি আমাকে কবে নিয়া যাইবা। 

-- খুব শীঘ্রই। তুমি যখন যাবে, তখনই। 
 

রুপালী বাড়ির দিকে আসার জন্য তখন পা বাড়ায়।  পা ফেলতেই তার খালি পায়ে কাঁটার মতো  কী যেন বিঁধে যায়। অন্ধকারে দেখতে পায় একটি মরা গাছের শুকনো চোখা গুরি বিঁধেছে। বেশ রক্ত ঝরছে।  রুপালী খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসে। বাড়িতে এসে দেখে ওর স্বামী তখনও  ঘুমিয়ে আছে। 

খুব ভোরে  রফিকের ঘুম ভাঙে।  সে বিছানা থেকে উঠে বাইরে আসে।  তখনও সূর্য দেখা যাচ্ছিল না বন প্রান্তরে।  কিন্তু ভোরের আলোয় সে দেখতে পেল উঠানে পায়ের ছাপের রক্তের দাগ। সেই  ছাপ ঘরের মেঝে পর্যন্ত চলে গেছে। সে ঘরের ভিতর যেয়ে রুপালীকে ডেকে তোলে। সে দেখতে পায় -- রুপালীর পায়ে থেকে তখনও  একটু  একটু করে  রক্ত ঝরছে। 

রফিক রুপালীকে বলে -- 'ওঠ্।  আমার সাথে বাইরে আয়।' রুপালী উঠে রফিকের সাথে উঠানে আসে।  রফিক পায়ের রক্তের ছাপ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রুপালীকে নিয়ে  পিছনে শালবনে চলে যায়।  য়েখানে রুপালী শাহীনের সাথে দেখা করেছিল সেখান পর্যন্ত।  রফিক রুপালীকে বলে -' 'ক মাগী,  রাইতে তুই কার সাথে দেখা করেছিলি এইখানে ?  কী করেছিলি, ক।'

রুপালী কোনো কথা বলে না।  চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।  রফিক ওর গলা চেপে  ধরে বলে -- 'ক মাগী,  তুই  কার সাথে দেখা করেছিলি?' রুপালী নিশ্চুপ।  রফিক শক্ত করে আরও হজোরে গলা চেপে ধরে বলে -- 'ক মাগী।'  রুপালী ততক্ষণে নির্জীব হয়ে গেছে। 

একসময় ভোরের আলো শালবৃক্ষের পাতার ফাঁক দিয়ে নীচে  মরে পড়ে থাকা রুপালীর মুখের উপর এসে পড়ছিল। কী সুন্দর রুপালী আলো, কী শুচি শুভ্র দেখতে লাগছিল রুপালীর মুখখানি। 

~  কোয়েল তালুকদার 
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন