শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২০

হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো



হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো

একদিন কর্মহীন এক অলস অপরাহ্নে আত্ম পরিজনহীন আমার গৃহকোণে শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম শামসুর রাহমানের 'হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো' থেকে এই পংক্তিগুলো --

'... তোমার মদির চোখ, গোধূলি-রঙিন গ্রীবা,/জীবন স্পন্দিত টসটসে ঠোঁট/ অর্থাৎ তোমার সৌন্দর্যে সচকিত হয়েও/ শুধু সেজন্যেই আমার অনুরাগের আংটি/ পরিয়ে দিই নি তোমার আঙুলে।

তোমার হাসি, যা হতাশাকে করে তোলে দীপান্বিতা,
আমাকে নিয়ে গ্যাছে সেই ঘাটে, / যেখানে ফোটে মনোজ কহলার। / না, কেবলমাত্র সেজন্যেও
ভালোবাসি না তোমাকে।'

ঘরের পশ্চিম পাশে জানালাটা খোলা। বাঁশঝাড় থেকে দু'একটা করে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। এত নির্জন যে, আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। ঘুম আসতে চায় চোখে, মুদে আসছিল দুচোখ। তন্দ্রা, ঘুম ও স্বপ্ন নাকি পরপর আসে -- তন্দ্রায় বোঝা যায় আমি কী করছি, কী ভাবছি। কিন্তু ঘুম ও স্বপ্নে কিছুই বোঝা যায় না। 

মনে হলো কার যেন পদধ্বনি বাজছে বাইরে। শুধুই পায়ের শব্দ। নুপুর কিংবা চুড়ির শব্দ নয়। পদ শব্দ আস্তে আস্তে নিস্তব্ধ হলো। কে যেন দরজায় কড়া নারল একবার। আমি যেয়ে দরজা খুলে দেই। দেখি --সম্মুখে দাঁড়িয়ে জেবা সাহানি। পরনে তার টাংগাইলের হালকা নীল রঙের তাঁতের শাড়ি। ম্যাচিং করে ব্লাউজ, টিপ, কানে ইমিটেশনের দুল ও গলায় নীল পাথর বসানো লকেটের সোনার চেন পরেছে। মুখে স্মিত হাসি। হাসিটা শুধু মুখে নয়, হাসিটা চোখে এবং চোখের তারায়। মেয়েদের এমন হাসি দেখতে খুবই ভালো লাগে। জেবা সাহানিকেও খুব ভালো লাগছিল। 

জেবা আমার পড়ার টেবিলটার সামনে চেয়ারটাতে এসে বসে। জেবা বলছিল -- আমি হঠাৎ করে আপনার এখানে চলে এলাম আপনাকে কিছু না জানিয়ে। খুব অবাক হচ্ছেন বুঝি? 

-- জ্বী, একটু চমকিয়ে উঠেছি। তুমি আসবে জানলে ঘরটা ভালো করে গুছিয়ে রাখতাম। আলনার কাপড়গুলো ভাজ করে সাজিয়ে রাখতাম। পড়ার টেবিলের বইখাতাগুলো এত এলমেল থাকত না। ফুলদানিতে কোনো ফুল নেই। অন্তত কয়েকটি গাঁদাফুল এনে ফুলদানিটা সাজিয়ে রাখতে পারতাম। 

-- এই যে এলমেল সবকিছু এইটাই ভালো লাগছে। ছেলেদের ঘর সাজানো গোছানো মানায় না। সবকিছু পরিপাটি করে রাখে মেয়েরা।  ছেলেরা নয়। খুব বেশি মনে হয় সিগারেট খান। এ্যাসট্রেটা একদম ভরে ফেলেছেন। 

-- নাহ্ খুব বেশি খাই না। বেশ কয়েকদিনের এই ছাইগুলো। ফেলে দেয়া হয়নি।

-- বিছানার উপরে 'হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো'। তা কোন্ কবিতাটা পড়ছিলেন? 

-- ' কেন তোমাকে ভালোবাসি? ' কবিতাটি পড়ছিলাম --
".... দৈবাৎ এক রাতে ভুলক্রমে তোমার সঙ্গে আমার/ অদৃশ্য যোগাযোগ। এমনই আকস্মিক
সেই ঘটনা, আজো কেমন ধন্দ লাগে। / বস্তুত

মধুর এক ধাক্কা খেয়ে পথচলা
মেঘের আলপথে। / একটি ভুলের কুঁড়ি বিকাশের বাঁশির তানে/ চমৎকার এক ফুল হয়ে
দুলে উঠবে সত্যের মুখোমুখি, কে জানতো?...''

*****  *****  *****

( এখানে একটু বলি -- জেবার সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। আমার এক বন্ধুর কাজিন সে। আমি বিয়ে করব, মেয়ে খুঁজছি। এই কথা জেনে আমার সেই বন্ধু বলেছিল-- আমার একটি কাজিন আছে, ইডেনে পড়ে। ট্রেডিশনাল সিস্টেমে বাংলা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেবে।  তুমি ওকে দেখতে পারো। ' 

বললাম, ঠিক আছে দেখব। 

ধানমন্ডির একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে আমরা তিনজন একদিন লাঞ্চ করি।  ঐদিনই জেবাকে আমি প্রথম দেখি। দেখে ওকে ভালো লাগল। 

আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  বাংলায় অনার্স এবং মাস্টার্স করেছি। জেবা তাই আমাকে অনুরোধ করে বলেছিল -- 'আমি মাঝে মাঝে  আপনার কাছে থেকে একটু হেল্প নেব।' আমি বলেছিলাম, অবশ্যই তোমাকে প্রয়োজনীয় হেল্প করব।'

শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি বারান্দায়, ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের লনে বসে আমি এবং জেবা সাহানি  একাডেমিক বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছি, এবং জেবাকে যতটুকু পারি, টিপস্ দিয়েছি। ব্যাস, এই পর্যন্তই। কিন্তু কোনো ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে পড়িনি কেউই।

একদিন আমার সেই  বন্ধুটির সাথে আমার দেখা হয়। এবং সে বলে -- 'জেবাকে কি তোমার পছন্দ হয় ?' আমি ওকে বলি -- 'জেবা খুব ভালো মেয়ে। ওকে নিয়ে ঘর করা যায়।'

আমার সেই বন্ধুটি বলে -- 'তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি।' আমি বললাম -- কী কথা? 

-- জেবার একটি বিয়ে হয়েছিল। ওদের বাসর রাতও হয়েছিল।  কিন্তু সেই একটি রাতই কেবল, কিংবা একটি দিনই বিয়ে টিকেছিল। তারপরের দিনই সে বিয়ে ভেঙে যায়। দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কী জন্য বিয়েটা ভেঙে যায়, তা জানি না। জেবা সে কথা  কাউকে বলেনি কখনও। 

আমি শুধু কথাগুলো শুনলাম। এবং বললাম -- আমি আমার বাড়িতে আলাপ আলোচনা করে, তোমাকে মতামত জানাব। 

আমি বাড়িতে আলাপ আলোচনা করে -- আমার সেই বন্ধুকে নেগেটিভ মতামত জানিয়ে দিলাম। বললাম -- আমাদের বাড়িতে কেউই এই বিয়েতে রাজি নয়। ) 

*****  *****  *****

জেবা বলছিল -- আপনার কবিতার খাতাটি কই?  একটু দেখব। দেখি -- সর্বশেষ কোন্ কবিতাটি আপনি লিখেছেন, একটু পড়ব। 

টেবিলের উপরেই আমার কবিতার খাতাটি ছিল।  আমি খাতাটি জেবার হাতে দিলাম।  জেবা খাতাটি হাতে নিয়ে আমার লেখা শেষ কবিতাটা পড়তে লাগল --

" আমি একটি ছেলেকে চিনি
সেই ছেলে 

সন্ধ্যা আকাশের তারার আলো হতে চেয়েছিল
কিন্তু মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেছে সেই তারা 
নিভে গেছে সেই আলো।

ছেলেটি একটি অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন ছুঁতে চেয়েছিল
কিন্তু অলৌকিক ঝরনাধারায় ভেসে গেছে সেই স্বপ্ন, জীবনের ক্যানভাসে সেই স্বপ্ন সে আঁকতে পারেনি। 

ছেলেটি চেয়েছিল একটি ঘর 
আনন্দলোক থেকে সুখ কুড়িয়ে আনতে চেয়েছিল
ফুলের রেণু থেকে অমৃত
মাধুকর হতে চেয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার মাধবীকে।

সে চেয়েছিল কেউ একজন চিরকালের হোক,
নিপবনের পাখির বাসার মতো ঘর হবে তার
পূর্ণিমা রাতের উদ্দাম জোছনার প্লাবন বইবে ভাঙা অলিন্দ দিয়ে।

ছেলেটি একটা অমল সুন্দর প্রিয়তমা চেয়েছিল
যার কাছে  মন খুলে বলা যায় সব কথা
ইচ্ছে করলেই যাকে বুকে জড়িয়ে 
চুমু খেয়ে নেওয়া যায় একটার পর একটা
চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখা যায়
হাতে হাত রেখে সব ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়া যায়
কিন্তু সে পারেনি।

হাতের মুঠোয় সে ভরতে পারেনি প্রেম
চিরকাল যৌবনের মোহ ভেঙে খুঁজেছে তার শৈশব 
ময়ুরাক্ষী দিনগুলো কখন যে চলে গেছে সে বুঝতেই পারেনি।

এক একজন এভাবেই ভাবে
আর এভাবেই ভুল অঙ্কের খাতায় হারাতে থাকে
একের পর এক তার প্রিয়মুখ
দিনশেষে পড়ে থাকে শুধু অতৃপ্ত কিছু অভিমান।"


কবিতাটা পড়া শেষ হলে জেবা অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকে। কোনো কথা বলছিল না সে। মনে হলো ওর বুকের গভীর থেকে একটি লুপ্ত হয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল। 

জেবা বলছিল -- 'আমার কাজিন, অর্থাৎ আপনার বন্ধু আমাকে সব কথা বলে দিয়েছে।  তবুও আজ আসলাম আপনার এখানে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল আপনার ঘর, আপনার ঘরের এলমেল সব জিনিসপত্র। আপনার লেখার টেবিল যেখানে বসে আপনি কবিতা লেখেন। 

আজ এই বিষণ্ণ বিকালে খুব ইচ্ছে করছিল -- আপনাকে নিয়ে দূরে কোথাও নদীর কূলে একটু বেড়াতে যেতে। নদীর জলের ধ্বনি শুনতে আপনাকে নিয়ে। একটি সূর্যাস্ত দেখতাম হৃদয়ে পৃথিবীর সব আলো নিভিয়ে দিয়ে।' 

নাহ্ , সেইদিন সেই বিষণ্ণ বিকালে আমাদের নদীর তীরে যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি তীরে দাঁড়িয়ে শেষ সূর্যাস্ত। মনের ভিতর জীবনানন্দ দুঃখ তখন -- '
সব পাখি ঘরে আসে -- সব নদী ফুরায় জীবনের সব লেনদেন, থাকে শুধু অন্ধকার।'

জেবা সাহানি সন্ধ্যার আগেই ফিরে চলে যায়। যাবার সময় একটুও সে পিছনে ফিরে তাকাল না। জানিনা,  ওর চোখে হয়ত জল ছিল, তাই  ফিরে তাকায় নি। 

জেবা আমার কেউ নয়, সামান্য  কিছুদিনের  পরিচয় ছিল মাত্র। তবুও সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যায় খুব  শূন্যতা বোধ করেছিলাম।

~ কোয়েল তালুকদার 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন