রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৭

জিপসি ছেলে

তখন ইউনিভার্টিতে পড়ি। থাকতাম কবি জসিম উদ্দীন হলে। আমার বড়ো বোনের চিকিৎসা চলছিলো পিজি হাসপাতালে।  যে কয়দিন আপা হাসপাতালে ছিলো প্রতিদিন সন্ধ্যায়  চলে যেতাম তাকে দেখতে। আমার মাথায় নজরুলের ইসলামের মতো ঝাঁকরা চুল। হাতে পড়তাম পিতলের ব্রেসলেট। গায়ে থাকতো বুক খোলা টি-সার্ট, আর পরনে থাকতো কাউবয় মার্কা জিন্স প্যান্ট। আপার পাশের কেবিনে এক ভদ্রমহিলার চিকিৎসা চলছিলো। ওনার একটি টিনেজ মেয়ে ছিলো  ,সে  প্রায়ই আসতো হাসপাতালে। ঐ মেয়েকে আমি চেয়ে দেখতাম, কিন্তু কথা বলতাম না। আবার ওর সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা করতো। একদিন হাসপাতালের কোরিডরে একাকী দাড়িয়ে আছি। মেয়েটি হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করে- আপনারা কি খ্রীষ্টান ?
আমি :  না
মেয়ে :  তাহলে কি ?
আমি:  সুন্নী মুসলমান। আমার বাবার নাম মৌলভী..............।
মেয়ে:   আপনাকে দেখে খ্রীষ্টান মনে হয়।
আমি:   তাই নাকি ?
মেয়ে :  হু।

সন্ধ্যার পর হলে চলে আসি। সখ করে তখন একটু আধটু কবিতা লিখতাম। আর আমার যে বয়স সে বয়সে মানুষ প্রেমের কবিতা লিখে থাকে। সে প্রেমে পড়লেও লেখে, প্রেমে না পড়লেও লেখে। জুনিয়র রুমমেট সাহিদ বলছিলো- আপনাকে আজ বেশ খুশী খুশী লাগছে ।কবিতার খাতায় লিখলাম-

আমিতো তোমাকে আজ দেখলাম মেয়ে,
পরীবাগের খোলা আকাশের দিক থেকে এসেছিলো বাতাস,
হাওয়ায় দুলছিলো তোমার চুল,
কাজল ছিলোনা চোখে, বাঁকা হয়ে যাওয়া ভ্রু ছিলো তোমার সুচিত্রা সেনের মতো,
ইশারা কি ছিলো সেই ভ্রুতে- আমি বুঝি নাই তা-
কামিজের ভাজে ঢাকা ছিলো সব নদীর বাঁক
মেয়ে তোমার চোখে মুগ্ধতা ছিলো, পরানের নীচে ছিলো কেবলই ঘাস ।


পরের দিনও দেখা হয় ঐ মেয়ের সাথে। পাখীর পাখার মতো উড়ছে তার ওড়না। মাথার চুল পিছনে ব্যানড দিয়ে বাঁধা। পায়ে সেমি হিল জুতো। খট্ খট্ করে হাটছে হাসপাতালের করিডোরে।  আমি তার চরণ ধ্বনি শুনি।  সে শোনে এলিফ্যান্ট রোডের গাড়ীর হর্ণ। আমি অপেক্ষা করছি তার জন্য, দাড়িয়ে আছি কোরিডোরে একাকী।  চোখ একবার তাকালো দূরে বেতার ভবনের দিকে। তরঙ্গে ভেসে এলো রুনা লায়লার সেই গান- 'অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে,যেনো এক মুঠো রোদ্দুর,আমার দু'চোখ ভরে তুমি এলে।' হঠাৎ পাশে থেকে সে মেয়ের কন্ঠস্বর শোনা গেলো-

মেয়ে :  কেমন আছেন ?
আমি : ভালো আছি। 
মেয়ে:  আপনি কোথায় পড়েন ? কি পড়েন ?
আমি:  ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, বাংলা সাহিত্যে।
মেয়ে:  আপনাকে দেখে মনে হয় ইংরেজীতে পড়েন।
আমি:  কেনো মনে হলো ?
মেয়ে:  হিপ্পি হিপ্পি চুল, ছেঁড়া জিন্স, ম্যাগি হাতা গেঞ্জি পড়েন, তাই মনে হলো।
আমি:  আপনি কোথায় পড়েন ,কি পড়েন ?
মেয়ে: ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার, ইডেন কলেজে।
আমি: নাম কি আপনার ?
মেয়ে:  জিনিয়া
জিনিয়া আমার নামটিও জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়।


রূমে এসে রাত জেগে খাতার পাতায় লিখলাম হিবিজিবি কথা-

তোমার চোখে দেখলাম অসীম দৃস্টি এক, চেয়ে দেখো অন্তর গভীরে
উড়ে চিল ডানা মেলে, নিঃসীম নীল মেঘের উপর দিয়ে
তোমার চঞ্চল ডানা মেলতে চায় তারও উপর দিয়ে
আফ্রোদিতির মতো প্রেম বুকে নিয়ে ডাক দাও আমাকে-
আমি সানাইওয়ালাদের খবর দিবো,
পাল্কি নিয়ে চলে যাবো তোমার রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাড়ী।

আজ আগে ভাগেই দেখা পাই জিনিয়ার। একাকী দাড়িয়ে আছে কোরিডোরে, মনে হলো আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। দু'জন দাড়িয়ে কথা বলছিলাম। আমি যখন কথা বলি,তখন দেখি- আমাকে দেখতে দেখতে জিনিয়ার চোখ উদাসীন হয়।  ও কি ভাবছিলো আমি তা জানিনা।  আবার জিনিয়া যখন কথা বলে আমি তখন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি,  দেখতে পাই- নীল সমুদ্রপাড়ে, সাগরের ঢেউ আছড়িয়ে পড়ছে বালুকাবেলায়।  সাদা শাড়ী পড়ে ধবল আঁচল উড়িয়ে জিনিয়া আসছে আমারই দিকে।  দূর থেকে আস্তে আস্তে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরছে বুকে।

আমরা দু'জন 'মৌলি'র দোতালায় গিয়ে বসি। ওখানে কিছু স্নাকস্ জাতীয় খাবার খাই। কথা বলতে বলতে ভালোবাসার কোনো কথাই বলা হলোনা। বলা হলোনা- 'তোমাকে আমার ভালোলাগে', বলতে পারলামনা- 'জিনিয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি।'  জিনিয়াও কিছু বললোনা।  মৌলি থেকে যখন উঠবো- তখন ও বলছিলো-  'তুমি কবি জসীম উদ্দীন হলের কতো নাম্বার রুমে থাকো ?'  আমি বললাম- '৪২৬ নং রুমে।'  জিনিয়া যেনো ভুলে না যায়- ,তাই ওর হাতের তালুতে নম্বরটি লিখে দেই।

রাতে বিছানায় শুয়ে আছি।  কেমন যেনো এক মুগ্ধতায় দু'চোখে ঘূম আসছিলোনা।  মানুষের যেমন দুঃখের কারনে চোখে ঘুম আসেনা। আবার অনেক সময় অনাবিল সুখের ভাবনাতেও ঘুম আসেনা।  মনে হচ্ছিলো অচেনা অজানা এক মেয়ের দেখা পেলাম,  তাকে ভালোও লাগলো,  হয়তো এই মেয়ে আমার বউ হয়ে ঘরে আসবে একদিন।  বিছানা থেকে উঠে কবিতার খাতায় লিখছিলাম-

তোমার ঐ মায়াবী চোখ আমাকে টানে
তোমার লাবন্যের মুখ আমাকে বের করে নিয়ে যায়
মখমলের চাদর বিছানো মসৃন পথে-
তুমি কোনো স্বপ্ন নও, আমি জানালা খুলে দেখি শাহবাগের আকাশ,
এতো তারা কখনো এক সাথে দেখিনি
এতো গানের সুর কখনো একসাথে বাতাসে ভাসেনি।

পরের দিন হলুদ রঙ্গের একটি টি-সার্ট গায়ো দিলাম। গাঢ় নীল রঙ্গের একটি জিন্স প্যান্ট পড়লাম। খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো রয়েই গেলো। আয়নায় ঘুরে ফিরে দেখলাম নিজের মুখ খানি। আজ জিনিয়াকে মৌলিতে ডেকে নিয়ে যে করেই বলবো- 'তোমাকে ভালোবাসি।'

সন্ধ্যায় হাসপাতালে যাই। আজ কোরিডোরে কাউকে দাড়ানো দেখলাম না। আপার কেবিনে যেয়ে শুনি- পাশের কেবিনের ঐ মহিলা রোগীটি আজ সকালে রিলিজ নিয়ে চলে গেছে। বুকের ভিতর কেমন যেনো হাহাকার করে উঠলো।  আমি আজ আর বেশীক্ষণ দেরী করলামনা।  হাসপাতালের শূন্য কোরিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে হলে ফিরে চলে আসি।

তারপর কতো দুপুর কতো বিকেল অপেক্ষা করেছি জিনিয়ার একটি চিঠির জন্য।  তারো অনেক পরে একটি বিদেশী নীল খামের চিঠি পাই।  প্রেরক- জিনিয়া নাওসীন, নিউ ইয়র্ক, ইউ এস এ ।  চিঠিটির কিছু অংশ এই রকম ছিলো- ''তোমাকে অনেক দিন ধরে লিখবো লিখবো করে লেখা হয়না।  তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছিলো,  কিন্তু আমি একজনের বাগদত্তা ছিলাম।  তাই তোমাকে বলতে পারিনি- 'ভালোবাসি'।....এখানে প্রায়ই আমার স্বামীর হাত ধরে হাডসন নদীর তীরে বেড়াতে যাই,  সেখানে দেখতে পাই বড়ো বড়ো চুলের জিপসি ছেলে হলুদ রঙ্গের টি-সার্ট গায়ে দিয়ে,  ছেঁড়া জীন্স পড়ে হাডসন নদীর তীরে ঘুরে বেড়াতে।  তখনই মনে হয় এমনই একজন জিপসি ছেলেকে আমি দেখে এসেছিলাম পিজি হাসপাতালের বারান্দায়।''

শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৭

একাকী সব সমর্পণ

একা নয়,আমরা দু'জনেই চলে যেতে চাই নক্ষত্রলোকে
আমাদের চন্দ্রালোকিত বসন্ত রাত এখানে থাকবেনা
আমি একা বিজন অরণ্য পথের যাত্রি হতে চাইনা,
পথে পথে লোনা জলের ধারা বহে-
দুজনের পথ চলায় একাকী সব সমর্পণ মিথ্যা হোক।

বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭

শিউলী কথা

বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পরীক্ষার পরপরেই তূলানামুলক ভাষাতত্বের উপর উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য ক্যালেফোর্নিয়ার লস এ্যাঞ্জেলেসের একটি ইউনিভার্সিটি থেকে দুই বৎসরের স্কলারশীপ পাই । সব ফর্মালিটিস্ কমপ্লিট করতে সপ্তাহ খানেক সময় লেগে যায়। হাতে বেশী সময় ছিলোনা। তিন দিন পরেই ফ্লাইট। আমার এই সুখবরটি শুনে যিনি সবচেয়ে বেশী খুশী হবেন তিনি আমার এক স্কুলের শিক্ষক জনাব মোঃ ইদ্রিস আলী। যার বাড়ীতে নন্ পেয়িং হিসাবে আমি  পাঁচ বছর ছিলাম।

আমার এই শিক্ষক মহোদয়কে এই সুসংবাদ ও তার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য সকালের ট্রেনেই চলে আসি জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে। সেখান থেকে যমুনার কূল ধরে হেটে হেটে আড়াই মাইল দূরে উল্লা নামে একটি গ্রামে চলে যাই। নদীর পাড় ঘেসেই মাস্টার মশাইয়ের বাড়ী। পথে আসছিলাম আর ভাবছিলাম, এই মাষ্টার মশাই ছাড়া এ জগতে আমার আর কেউ নেই। আমি যখন এখানে পৌঁছি, তখন বিকাল হয়ে যায়। বাড়ী পৌঁছে মাষ্টার মশাইকে সব কথা বললাম। এও বললাম কাল প্রত্যুষেই আমি চলে যাবো।

এখানে নদী কূলে একাকী কতো মময় কাটিয়েছি। ভাটির স্রোতের টানে মাঝি মাল্লারদের কতো গান শুনেছি। যমুনার জলে কতো যে গা ভিজিয়েছি। এই বাড়ীর পূর্ব পাশে দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে যমুনা নদী। খুব ইচ্ছা হলো, আরেকবার সব ঘুরে ঘুরে  দেখতে। সারা বিকেল একাকী নদীর কুল ধরে হাটলাম। নির্জন নদীর পাড়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম অনেক কথা, মাস্টার মশাইয়ের কথা, ওনার স্ত্রীর কথা, তাদের কিশোরী মেয়ে শিউলীর কথা। আমি যখন প্রথম এই বাড়ীতে আসি। তখন শিউলীর বয়স ছিলো নয় দশ বছর। এখন চৌদ্দ পনরো হবে। অস্টম ক্লাশ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। আমাকে এই বালিকা আনেক সেবা করেছে। অনেক যত্ন সহকারে খাবার খেতে দিয়েছে। আমার কাপড়চোপড় পরিস্কার করে দিয়েছে। অসুখের সময়ও সেবা করেছে। জ্বর আসলে মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছে।

নদীর কূল থেকে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে মাস্টার মশাইয়ের কাছে বসে কথা বলছিলাম- উনি বলছিলো-  ''আমার শরীরটা ভালো যাইতেছেনা। কোনো ঔষুধ পত্র কাজে আসিতেছেনা। যে কোনো সময় ইহলোক ত্যাগ করিতে পারি। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো শিউলীর সহিত তোমাকে বিবাহ দিতে। তুমি কাল প্রত্যুষে চলিয়া যাইবে। তুমি যদি রাজি হও, তাহা হইলে আজ রাতেই তোমাদের বিবাহের ব্যবস্থা করিতাম।'

এই পরিবারের কাছে,এই মাস্টার মশাইয়ের কাছে আমার অনেক ঋন আছে। এরা আমার মতো একজন অনাথকে অনেক স্নেহ করেছে। আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। নিজেরা কষ্ট করে আমার লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছে। আমি বেশী কিছু ভাবলাম না। বললাম- বিবাহের ব্যবস্থা করেন।


মেয়েটির গায়ে কোনো হলুদ দেওয়া হলোনা। দূর্বা চন্দন ভিজিয়ে গোসল করানো হলোনা। নতুন কোনো শাড়ি পরানো হলোনা। হাতে মেহেদী দিলোনা। মুখে কেউ আলপনা আঁকলোনা, পায়ে আলতা মেখে দিলোনা। বুকে লাগানো হলোনা কোনো সুগন্ধী। আমারও তাই। কোনো শেরোয়ানী পড়লামনা। পাঞ্জাবীও পড়লামনা। সানাই বাজলোনা। মসজিদের মৌলভী সাহেবকে ডেকে এনে ইসলামী নিয়মে আমাদের বিবাহ পড়ানো হলো।

সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিলোনা। তারাগুলি জ্বলছিলো নিষ্প্রভ হয়ে। রাতের যমুনায় কুলুকুলু শব্দ হচ্ছিলো।  বাইরে ছিলো ঝিঁঝিঁ পোকাদের গান। নিরব নিস্তব্ধ রাত্রি যেনো চাপা কান্নায় গুমরিয়ে কাঁদছিলো। দেখলাম শিউলী ওর মায়ের পুরানো একটি শাড়ী পড়ে চৌকির এক কোনে ঘোমটা টেনে বসে আছে। ভাবলাম, কাল প্রত্যুষেই চলে যাবো। এই সরলা বালিকাকে আজ রাতের বঞ্চনায় রেখে লাভ কি ? কাছে যেয়ে বললাম-

আমি:  তুমি কি খুশী ?
শিউলী:  হে।
আমি : কাল সকালে চলে যাবো।কষ্ট পাবেনা ?
শিউলী : হে।
আমি:  আমাকে মনে রাখবে না ?

দেখি শিউলী অঝোর ধারায় কাঁদছে। ঘোমটা খুলে ওর মুখখানি দেখলাম। কেরোসিনের শিখার আলো এসে পড়েছে। এর আগেও এই বালিকাকে অনেক দেখেছি। আজ মনে হচ্ছে চন্দ্রালোকের যতো মোহনীয় মাধূর্য এই মেয়ের মুখে লেগে আছে। ওর চোখে জল, তারপরেও আলপনাহীন মুখখানি হিরন্ময় লাগছিলো। ওকে বুকে টেনে নেই। সকালবেলা যখন বিদায় নিচ্ছিলাম তখন শিউলী বলেছিলো - 'আপনি আমাকে ভুলে যাবেন না।'



থাই এয়ারওয়েজের বিমানটি লস এ্যাঞ্জেলেসের লাক্স এয়ারপোর্টে অবতরণ করে। আমার থাকার ব্যবস্থা ছিলো গ্রামের্সি প্লেসের একটি হোস্টেলে।এয়ারপোর্ট থেকে একটি ট্যাক্সী নিয়ে চলে যাই সেখানে। অচেনা শহর,কোনো সজ্জন নেই। পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে রিপোর্ট করি। ঠিক তৃতীয় দিনে ওয়েস্টার্ন বেলভিউতে রোড ক্রসিংএর সময় একটি লরি আমাকে প্রচন্ডভাবে  ধাক্কা দেয়। যখন আমার  জ্ঞান ফেরে দেখি একটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। শুনেছি আমি নাকি একমাস অজ্ঞান ছিলাম। বেশ স্মৃতিভ্রম হয়ে গিয়েছিলো। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়। বাম পায়ের হাড় ভেঙ্গে যায়।

হাসপাতালে আমাকে একটানা এক বৎসর  চিকিৎসা নিতে হয়েছে। আমার স্কলারশীপ প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে যায়। হাসপাতালে মেক্সিক্যান বংশোদ্ভূত এক নার্স আমাকে নিবিড়ভাবে সেবা করে। সে ছিলো পঞ্চাশোর্ধ এক বিধবা মহিলা, নাম রেবেকা উইন্টার। যেদিন আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়, এই রেবেকা উইন্টারই তার বাসায় নিয়ে যায়। সে আমাকে তার বাসায় রেখে সেবা করে। আমাকে ক্রাচে ভর করে হাটতে হতো। রেবেকা তার সারা জীবনের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ আমার চিকিৎসার পিছনে খরচ করে।


আমার পুরোপুরি স্মূতি ফিরে পেতে তিন বছর লেগে যায়। আসার পর থেকে বাংলাদেশের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারি নাই। আমি ভুলেই গেছি মাস্টারমশাইয়ের কথা, শিউলীর কথা। এরই মধ্য একদিন গীর্জায় গিয়ে খ্রীষ্ট ধর্ম মোতাবেক রেবেকাকে বিয়ে করি। এই ভাবেই পনেরো বছর চলে যায়। রেবেকা একসময় ইহলোক ত্যাগ করেন। নিজেকে নিঃস্ব ও একাকী লাগছিলো। ভাবলাম, আর কার জন্য  এদেশে থাকবো ?  আমি দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই।

ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমে কেমন যেনো উদাস লাগছিলো। এই শহরে একজন আপন মানুষ নেই যে সেখানে গিয়ে উঠবো। পল্টনে একটি  হোটেলে যেয়ে উঠি। ভাবলাম কাল সকালবেলাতেই মাস্টার মশাইয়ের ওখানে চলে যাবো। ট্রেন চলছে জগন্নাথগঞ্জের ঘাটের দিকে। কামড়ার মধ্যে বসে ভাবছিলাম- শিউলী কি আমার কথা মনে রেখেছে ? শিউলী কি আমার জন্য অপেক্ষা করছে ? শিউলী কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে ?'  ট্রেন  জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যেয়ে থামে। যমুনার কূল ধরে হাটতে হাটতে উল্লা গ্রামের দিকে চলতে থাকি। তখন বিকাল হয়ে গিয়েছে। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ীর আঙ্গিনায় পৌছতেই দেখি কাঁঠাল গাছের তলায় একটি বালিকা দু'টি ছাগল ছানাকে কাঠালপাতা খাওয়াচ্ছে। পরনে তার সালোয়ার কামিজ। দেখতে একদম শিউলীর মতো। আমাকে দেখে বালিকা থমকে দাড়িয়ে যায়। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম- সেই শিউলীর চোখ, শিউলীর চুল, শিউলীর নাক, সেই চাহুনী, সেই রকমই মুখের মায়া ! ভাবছিলাম, শিউলীকে যে রুপ রেখে গিয়েছিলাম,সেই রুপেই আছে।


তারপরেও মনে হলো- এ মেয়ে শিউলী নয়। আমি কাছে যেয়ে বলি-' তোমার নাম কি ? মেয়েটি বলে- 'রূপালী'। বলি -'তোমার মায়ের নাম কি ?' ও বলে- 'শিউলী বেগম।' আমার চোখ ছলো ছলো হয়ে ওঠে। ওকে বলি- 'তোমার বাবার নাম কি ?' রূপালী তখন আমার নাম বলে। রূপালীকে বলি-'তোমার মা কোথায় ?' বাড়ীর ভিটার পিয়ারা গাছের তলা দেখিয়ে বলে- 'ঐখানে মাটির নীচে শুয়ে আছে।'

আমাদের কথাগুলো শুনছিলো বারান্দায় বসে থাকা এক অন্ধ বৃদ্ধা। উনি মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী। সে আমার কন্ঠ শুনে চিনতে পারে। রূপালীকে ডেকে বলে - 'রূপা, তুই চিনতে পারছিস না ? উনি তোর বাবা।'

আমি রূপালীকে বলি- 'মামনি আমার হাত ধরো, চলো ঐ পিয়ারা গাছের তলায়। আমরা তোমার মায়ের জন্য প্রার্থনা করি।'

মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৭

কবরদের বাড়ী

এই পথ দিয়ে হেটে হেটে গেলেই সামনে আমাদের বাড়ী । বাড়ী গেলেই দেখা যেতো মা বসে আছে জানালার পাশে।
এই পথ দিয়ে হেটে হেটে গেলেই দেখা যায়,উদাসী এক প্রান্তর। মাঠের মাঝখানে কবরদের বাড়ী। সেখানে খেঁজুর গাছের ছায়ায় মা'কে বসে থাকতে দেখিনা।

ঘরের এক কোনে দেখতে পাই ছোট কাঠের নামাজের চোকি
যার উপরে একপুরু ধুলো জমে আছে ,
পানের বাটাখানি পড়ে আছে কাঁচের আলমিরায়,
আলনায় ভাজ করে রাখা আছে জায়নামাজ
চশমার ফ্রেমটা জীর্ণ হয়ে পড়ে আছে তাকের উপরে-
চারিদিকে কেবলি অসীম শূণ্যতা দেখি, আমি কেঁদে কেঁদে
হেটে হেটে এই পথ দিয়ে ফিরে ফিরে চলে আসি।

নূরী

শেষ পর্যন্ত একজন বালিকাকে আমার বিবাহ করতে হলো।  কোনো এক শীতের সন্ধ্যায় তাকে লাল বেনারশী শাড়ি পড়ানো হলো। মুখে আলপনা আঁকা হলো। হাতে চুড়ি পড়ানো হলো। মেহেদী লাগিয়ে দেয়া হলো দুই হাতে। খুব একটা উৎসব হলোনা। সানাইও বাজেনি। ইচ্ছা ছিলো দুই ঘোড়ার গাড়িতে করে বউ তুলে আনবো, তাও হলোনা। ফুলহীন, সাজসজ্জাহীন একটি সাদা গাড়ীতে করে সেদিন নববধূকে ঘরে তুলে এনেছিলাম।

এ যেনো পুতুলখেলার সংসার শুরু হলো। বাজারে যেয়ে হাঁড়ি পাতিল কিনলাম। বালতি কিনলাম। শীল পাটা কিনলাম। মাদুর,ফুলদানী সব কিনতে হলো। এ এক অত্যশ্চর্য জীবনের শুরু। যা জীবনে কোনোদিন চোখে দেখি নাই। শুনি নাই। বুঝি নাই। এখন আর সকাল বেলা পাখীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করতে হয়না। এলার্ম দিয়ে রাখতে হয়না ঘড়িতে।এতো সুুন্দর জীবন আছে জীবনে, আগে বুঝি নাই।

ওর নাম আয়শা নূর। বলেছিলাম তুমি এষা না নুরী। ও বলেছিলো আমি নুরী।
নূরী চঞ্চল হয় সকাল বেলা। রোদ্রের উত্তাপে হয় দহন।
সাওয়ারের নীচে জল ঢালে সারা দুপুর,
সন্ধ্যায় আকুল হয় রবি ঠাকুরের গানে,
মনে পড়ে তার দূর গায়ের কথা
স্টেশনে রেল গাড়ির সেই হুইসেলের শব্দ, মনে পড়ে সেই ঝিকঝিক আওয়াজ।

নুরী ওর বাবার সাথে একদিন বাড়ী চলে যায়। সেখানে ওর ছোটো বোনকে পায় খেলার সাথী করে। দু'জন হেটে হেটে চলে যায় রেল লাইনের ধারে। দূর থেকে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন এসে থামে প্লাটফরমে। হৈ হুল্লর করে যাত্রিরা নেমে আসে কামড়া থেকে।

আমি বুঝতে পারি আমার প্রথম শূণ্যতা।  আলনায় কাপড় হয়ে থাকে এলোমেলো। আবার পাখীর ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ঘুম ভাঙ্গার। জীবনের এতোটা বছর একা লাগেনি। কবিতা লেখার ভাবনা চলে যায় সমান্তরাল রেল লাইনের সেই দূরের প্রান্তে। নিঃসীম শূণ্যতা পড়ে থাকে সেখানে। একদিন ঘুম আসে সন্ধ্যাবেলা, আরেকদিন সারা রাতেও না।

আর একদিন রাতের বেলা ল্যাম্পের আলো জ্বেলে চিঠি লিখতে বসি-
'নূরী, তুমি চলিয়া যাইবার পর হইতে আমার খাওয়ার অরুচি হইয়াছে। প্রত্যহ অফিসে যাইতে লেট হইতেছে। ঘুমও ঠিকমতো হইতেছেনা। অনেক চেষ্টা করিয়াছি,স্বপ্নে তোমাকে কাছে পাইতে। কিন্তু একদিনও তোমাকে পাই নাই। যাহা হোক,পত্র পাঠ তুমি চলিয়া আসিও। ইতি-

উত্তরে নুরী লিখলো-
'প্রিয়তম, তোমার চিঠি পেলাম। আমি এখানে খুব ভালো আছি। আমরা প্রতিদিন রেল লাইনের ধারে বেড়াতে যাই। কাল কাজিপুরা নানী বাড়ী বেডাতে যাবো। উল্লাপাড়া ছোটো ফুপুর বাড়ীতেও যাবো। বেশী খিদা লাগলে তুমি আজিজের হোটেলে খেয়ে নিও। রবীন্দ্রনাথের গান শুনিও। তবেই ঘুম আসবে। ইতি- নুরী।


নুরীতে থাকে মুক্তা, পাথরে ভারী হয়ে থাকে বুক
যমুনার জলে রুপালী মাছের ঝাঁক ঘুরে বেড়ায়
হেমন্তের রাত্রিতে চাঁদ নেমে আসে দুই পাড়ে-
তার চোখ আমাকে বিষন্ন করে, কোথায় পড়ে আছে
বকুল ফুলের মালা খানি। আমি প্রতিদিন চেয়ে থাকি
অন্ধকারে- বালিকা চলে আসছে
রেল লাইনের স্লিপারে হেটে হেটে।.

আমি নিজেই ওকে দেখতে চলে যাই একদিন। রাজশাহী এক্সপ্রেস ট্রেনটি থামলো জামতৈল স্টেশনে। তখন সন্ধ্যা হয়েছে। মুগ্ধতার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম বুকের তল থেকে। রক্তের স্পন্দন বাড়ছিলো তাকে দেখবার আনন্দে। বাড়ী পৌঁছে শুনি- ছোটো ফুফুর বাড়ীতে নুরী বেড়াতে গেছে। আজকেই ওর ফেরার কথা ছিলো।

দূর ভ্রমনে শরীরে ক্লান্তি এসেছিলো। মন খারাপের চোখে খুব ঘুম পায় । শুয়ে পড়ি তাই তাড়াতাড়ি। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে- তখন চোখ মেলে দেখি পাশে নুরী শুয়ে আছে। ওর একটি হাত আমার বাহুতে জড়ানো। তখনো তার ঘুম ভাঙ্গেনি।

তারপর পাখী সব কলরব করে ডেকে উঠলো
ভোরের আলো জ্ব্বলে  ওঠে হুরাসাগর নদীর জলে.
দখিনা বাতাস বেগ পায় ধানক্ষেতের পাতায়
স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় রাতের ক্লান্ত ট্রেন খানি
নিঃসঙ্গ পাখিরা উডে উড়ে চলে যায় মেঘে
তখন গান কবিতা হয়,কবিতা হয়ে যায় গান।

লিমেরিক

লিমেরিক

ফেসবুকে সুরত এক সেলফি দেখে চিনে ফেললাম তাহারে
মাধুরীর মতো চেহারা তার কিযে দারুণ লাগছে আহারে
নাম ছিলো তার মোছাঃ জরিনা
এখন দেখছি সে মিস্ ক্যাটরিনা
প্রেম করতে সাধ হলো তাই ম্যাসেজ পাঠালাম ভাইবারে

সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৭

আমিতো আবার

আমিতো আবার প্রেমে পডতে রাজি
এই তোমার কাছে যাওয়া
অনুভবে তেমাকে পাওয়া
আমিতো আবার ভালোবাসতে রাজি।

আমিতো আবার রাতজাগতে রাজি
এই অপেক্ষায় থাকা
এই চোখে জল ফেলা
আমিতো আবার মন দিতে রাজি।

আমিতো আবার অশ্রু ঝরাতে রাজি
বসে এই গান শোনা
জেগে এই চিঠি লেখা
আমিতো আবার হৃদয় ভাঙ্গতে রাজি।

আমিতো আবার স্বপ্ন দেখতে রাজি
তোমাকে কাছে দেখা
জীবনে সব সুবর্ণরেখা
আমিতো আবার সর্গ সাজাতে রাজি।


তখন অন্ধকার সময়

কাঠের স্লীপারে উপর বসে আছি, দূরে ট্রেন আসছে,
ঝিকঝিক.
লাইটপোস্ট নেই, আলো নেই,তারা ঢেকে আছে মেঘে
রেল পুলিশের সতর্ক বাঁশি বাজছে
পথ বেশ্যারাও ঘুরছে এদিক সেদিক-
সিগারেট হয় চুরুট, জীবনের অর্থ খোঁজে
টানে টানে,
কুকুরেরও ঘর আছে শুয়ে থাকে আপন ঘরে
শূন্য ইস্টিশানে,
মনে পড়ে দীঘির জলের কথা, জলের উপর খেলতো প্রজাপতি
মাছরাঙ্গা রাঙ্গিয়ে দিতো প্রাণ।

মা'র চোখে ঘুম নেই
তার খোকা পড়ে থাকে রেল লাইনের ধারে,
পাশেই মহুয়ার জঙ্গলে
জোনাকিরা আলো জ্বেলে খেলা করে-
আমার খুব ঘুম পায়
ঝিঁঝিঁর আলোর বিন্দুু এসে মুখে পড়ে
আমি তখন আকাশের তারা গুনি এক দুই তিন চার.....।

( রেল লাইনের পাশে এক নেশাখোর তরুণকে দেখে।)

এই শহর

এই শহর ঘুমায়না,ল্যাম্পপোস্টের নীচে ভিখারীরা ঘুমিয়ে আছে
ঘুমিয়ে আছে সদরঘাটের প্লাটফরমে গ্রাম থেকে আসা মানুষেরা
ঘুমিয়ে আছে কমলাপুর স্টেশনে শতো শতো ঘরহীন উদ্বাস্তু
পার্কে মহুয়াতলে দেহের পশরা বিক্রি করছে রাতের বেশ্যারা।

ঘুমায়না এই শহর
ঘুমায়না হাসপাতালে বেদনা কাতর রোগী
ঘুমায়না নগর পুলিশ
ঘুমায়না কুকুরের দল
 ঘুমায়না ছিচকে চোর
ঘুমায়না পানশালার নর্তকী
ঘুমায়না পরীক্ষার পরীক্ষার্থীরা
এই শহর জেগে আছে, জেগে আছি আমিও.আমার চোখে ঘুম নেই।








রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৭

মেনোপেজ

নেতাজী সুভাষ বসু বলেছিলো,'তুমি আমাকে রক্ত দাও,
আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেবো।'
না,আমি এই স্বাধীনতার কথা বলছিনা
আমি এই রক্ত ঝরানোর কথা বলছিনা।

আমি বলছি একটি বালিকার কথা-
যে আমার বোন হতে পারে,আমার কন্যা হতে পারে,
আমার ভাগিনী হতে পারে,আমার ভাতিজী হতে পারে।

বালিকা একদিন সকালবেলা দেখতে পায়
শুভ্র বিছানায় রক্তের দাগ লেগে আছে;
দেখতে পায় তার ট্রাউজার্স রক্তে ভিজে গেছে
বালিকা কেঁদে ওঠে,দৌড়ে চলে যায় মায়ের কাছে,
মা আদর করে বলে- কাঁদেনা মা-
এই বয়সে মেয়েদের এ রক্ত ঝরা শুরু হয়।'

বালিকা একদিন তরুণী হয়ে ওঠে
চন্দ্রমাসের হিসাব কি তখন সে জেনে যায়
বন্ধুুরা কেউ বলে এটি একটি অচ্যূত সময়
কেউ বলে তুমি অপবিত্র,কেউ বলে এ রক্ত নোংরা
তুমি কিছু ধরতে পারবেনা,কিছু ছুঁইতে পারবেনা
এসবই ভুল কথা,এটি একটি পবিত্র কাল।

এই যে আমি পৃথিবীতে এসেছি
এই আসা আমার মায়ের পবিত্র কাল চক্র থেকে
এর নামই মাতৃত্বের কাল
আমরা পৃথিবীতে আসতে পেরেছি এই সুবর্ণ কালেই,
কি ভাবে আমি বলি এটি অচ্যূত সময় !

জীবনের এক অস্তমিত সময়ে,ঋতুচক্র থেমে যায়
যে বালিকাটি একদিন মা হয়ে উঠেছিলো সে বিষন্ন হয়
চন্দ্রমাসের দিন গোনা কি ভুল হচ্ছে তার ?
আয়নার সামনে দাড়িয়ে সে একাকী কাঁদে
খোঁজে বলিরেখা, রক্তের এ ধারা কেনো থেমে যায় !




শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭

নদীর কূলে খুঁজি তারে

অনেক বছর আগের এই কাহিনী । ইছামতি নদীতে তখন হেমন্তেও জল থাকতো। শান্ত সৌম্য স্রোত কার্তিক মাসেও প্রবাহমান থাকতো। এই নদীর তীরেই গারোদহ গ্রাম। গ্রামের উত্তর প্রান্তে খোলা মাঠে ছিলো অনেক জীর্ণ পুরানো একটি মঠ। এর পলেস্তারার ফাঁকে অনেক লতা গুল্ম জন্মেছে। মঠের বয়স কতো শতো বৎসর হবে তা কেউ বলতে পারেনা। এই মঠে কার দেহ ভস্ম রাখা হয়েছিলো, তার কোনো কিংবদন্তীও নেই।

মঠের অদূরে একটি পাকুর গাছতলায় প্রতিবছর ছোট্র আকারে কার্তিক মাসের কৃষ্ণতিথির শেষ তিন দিনে মেলা বসতো। দূর দুরান্ত থেকে কিছু সাধু সন্নাসী আসতো এখানে। সারারাত গান হতো। কীর্তন,ভজন সহ নানান গান গাওয়া হতো। এখানে বিভিন্ন রোগীরাও আসতো। ধর্মীয় অর্চণার মাঝে তারা রোগ মুক্তির প্রার্থনা করতো। দূরের মানুষদের জন্য অস্হায়ী ধর্মশালারও ব্যবস্হা করা থাকতো ।

মঠের পাশে সেবার মেলা শুরু হয়েছে। এই গারোদহ গ্রামেই কানাই দেব বর্মনের বাড়ী। বর্মনরা ছিলো খুব রক্ষণশীল। পরিবারের মেয়েরা খুব বেশী বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পেতোনা। এই বর্মণবাড়ির কিশোরী মেয়ে পিয়ালী। বয়স কতোই হবে, এগারো বারো । পিয়ালী মেলা দেখবার অনুমতি পায় বাবার কাছ থেকে। কিন্তু সাথে যাবে ওর দিদিমা।

মেলার শেষ দিনে পিয়ালী ওর দিদিমার সাথে মেলায় যায়। তখন পরন্ত বিকেল। ধানক্ষেতের আলপথ দিয়ে, নদীর তীর ধরে হেটে হেটে মেলার দিকে যাচ্ছিলো। মঠের কাছাকাছি নদীর কুলে বকুলতলায় একাকী এক বালক করুণ সুরে বাঁশি বাজাচ্ছিলো। সুরটি ছিলো রজনীকান্তের একটি গানের। দিদিমা আগে, পিছে পিছে পিয়ালী। ওরা ঐ বালকটির কাছাকাছি যেতেই বালক তার বাঁশি বাজানো বন্ধ করে দেয় এবং মুখ ফিরিয়ে পিয়ালীকে পলকহীন ভাবে দেখতে থাকে। পিয়ালীও বালককে অতিক্রম করার পরও পিছেনে ফিরে বার বার দেখছিলো।

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পিয়লী আর ওর দিদিমা মেলা থেকে ফিরছিলো ঐ পথ দিয়েই । ছেলেটি তখনো বসেছিলো বকুলতলায়। তখনো সে বাঁশি বাজাচ্ছিলো। পিয়ালীকে দেখে বালক বাঁশি বাজানো বন্ধ করে। এবারো বালক নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে পিয়ালীর দিকে। এবার পিয়ালী ওর হাটা ধীর করে ফেলে। দিদিমা পিছনে না খেয়াল করেই সামনে অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায়। তখন সন্ধ্যার আধার বেশ কালো হয়ে উঠেছে। পিয়ালী এগিয়ে বালকটির কাছে যায়। পিয়ালী বলে: 'তুমি কই থেকে এসেছো ?' বালক যে গ্রামের নাম বলে, পিয়ালী তা চিনতে পারেনা।
পিয়ালী:  তুমি অনেক সুন্দর বাঁশি বাজাও।
বালক:   হু।
পিয়ালী:  তুমি আমাকে অমন করে তাকিয়ে দেখছিলে কেন ?
বালক:  আমার চোখে খুব অসুখ। বাবা আমাকে এখানে আজ সকালেই নিয়ে এসেছে। কাল সূর্য ওঠার আগেই আমরা চলে যাবো। আমি যদি অন্ধ হয়ে যাই, তাই তোমাকে দেখছিলাম বেশী করে। অন্ধ হয়ে গেলেও তোমাকে যেনো মনে রাখতে পারি। কিন্তু এই সন্ধ্যা রাতের অন্ধকারে তোমাকে যতোটুকু দেখলাম তা আমার মনে থাকবেনা।

ওর কথা শুনে পিয়ালীর মনটা একটু খারাপ হলো। মেলা থেকে কেনা বাঁশিটি ছেলেটিকে দিয়ে দেয়।আর ছেলের হাতের বাঁশিটি কেড়ে নিয়ে দ্রুত হেটে দিদিমার কাছে চলে যায়।

তারপর সাত বছর চলে গেছে।:পিয়ালী এখন তন্বী তরুণী। বাবা কানাইদেব বর্মন অনেক দেখে শুনে পিয়ালীর বিবাহ ঠিক করলেন। ছেলে এগারো মাইল দূরে কালোকুশি গ্রামের। ছেলে রায় পরিবারের। খুবই ভালো,অমায়িক,ভদ্র,রুচিবান, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সে।

এক শ্রাবণ বর্ষার দিনে ইছামতি নদী দিয়ে পানসি নৌকায় করে বরযাত্রিরা চলে আসে। চারিদিকে রাশি রাশি আনন্দ বইছে। রাত তখন গভীর, সবাই বলছে- এখন লগ্ন হয়েছে। ব্রাহ্মণ বিবাহের মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। সানাই বেজে উঠলো। পিয়ালী শ্যামল কৃষ্ণ রায়ের সাথে সাত পাকে বাঁধা পড়লো।

স্বামীর ঘরে যেয়ে পিয়ালী সংসারের প্রতি অমনোযোগী ছিলো। স্বামী শ্যামল কৃষ্ণ রায়কে খুব একটা দেখ্ ভাল্ করতোনা। কালোকুশী গ্রামের পাশ দিয়েও ইছামতি নদী বহমান। ঘরের জানালা খুললেই ইছামতি নদী দেখা যায়। পিয়ালী প্রায়ই জানালার কাছে দাড়িয়ে থাকতো। নদীর দিকে উদাস দূষ্টিতে তাকিয়ে জল দেখতো। কেমন যেনো উদাস সে। কেমন যেনো পাগলিনী সে। পিয়ালী কারো সাথে ভালোভাবে কথা বলতো না। ঠিকমতো নাওয়া খাওয়া করতোনা। স্বামী শ্যামল কৃষ্ণ উজার করে তাকে ভালোবাসা দিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো প্রেম,কোনো মায়া মমতা পিয়ালীকে আচ্ছন্ন করতে পারে নাই।

এমনিভাবেই দশ বছর কেটে গেছে। পিয়ালী একসময় কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। শরীর শুকিয়ে আসে। প্রাণ শক্তি ফুরাতে থাকে। চোখের পাতা কালো হয়ে যায়।  পিয়ালী শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। ঘরের মধ্য তখন কেউ ছিলোনা। পিয়ালী স্বামীকে কাছে ডাকে। বলে- 'আমার হাতটি একটু ধরো,আমাকে বুকে জড়িয়ে ঐ জানালার কাছে নিয়ে যাও।' শ্যামল পিয়ালীকে জানালার কাছে নিয়ে যায়। পিয়ালী মায়াময় চোখের দৃষ্টি মেলে দেখে ইছামতি নদীর শান্ত সৌম্য জল। পিয়ালী শ্যামলকে বলে- 'তুমি কি আমাকে একটু ধরে সিন্ধুকের কাছে নিয়ে যাবে ?'  শ্যামল পিয়ালীকে সিন্ধুকের কাছে নিয়ে যায়। শ্যামলই সিন্ধুকটা খুলে দেয়। পিয়ালী সিন্ধুকের ভিতর থেকে কাপড়ে মোড়ানো কি যেনো একটি জিনিস বের করে।

পিয়ালী খুব হাপাচ্ছিলো। শ্যামলকে বলে 'আমাকে বিছানায় শোয়ায়ে দাও'। পিয়ালীকে শোয়ায়ে দেয়। আবারো শ্যামলের হাত ধরে পিয়ালী বলে- 'আমি তোমাকে কোনোদিন ভালোবাসিতে পারি নাই। তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি আর একটি বিয়ে করবে। সংসার করবে। আমি তোমাকে সন্তান সংসার দিতে পারি নাই।' কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটা দেখিয়ে বলে- ' এর মধ্যে অমঙ্গলের অভিজ্ঞান আছে। তুমি ইছামতি নদীতে এটি ফেলে দেবে। ঘরে রাখলে,তোমার সংসারে অমঙ্গল হবে।'

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শ্যামল নিজেই কেরোসিনের বাতি জালিয়ে আনে। পিয়ালী বলছিলো- 'আমার খুব ঘুম পা্চ্ছে, একটা গান গেয়ে শোনাও না লক্ষ্মীটি !' শ্যামল তখন গায়ছিলো-  'তুমি, নির্মল করমঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে। তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে' । পিয়ালী গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায়। ওর আত্মা বুঝতে পারছিলো, আজ থেকে সতেরো বছর আগে এই গানের সুর তুলেছিলো বাঁশিতে এক বালক, ইছামতির তীরে বকুলতলায়।

শ্যামল কৃষ্ণ রায় পরেরদিন শ্মশাণে স্ত্রীর সৎকার করে বাড়ী ফিরলেন। ইছামতি নদীতে স্নান করবার যাবার সময়,কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটা নিয়ে ঘাটে যায়। মোড়ানো কাপড় খুলে সে দেখতে পায়, একটি পুরানো বাঁশি। যে বাঁশিটি এক কিশোরী বালিকা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলো সতেরো বছর আগে এক সন্ধ্যায়,ইছামতির নদীর তীরে।



   

শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

এতো গান এতো সুর

আজ এমনি মেঘলা রাতে জেগে আছি। আজ পাহাড়ী সেই মেয়ের বনফুলের মালা এনে দেবে কি কেউ ! বুঁনো বাশরীর গান শুনতে ইচ্ছা করছে।

আজ এতো গান আকাশে, এতো সুর বাতাসে -

ফুল ফুটে আছে

আজ সারাদিন দেখলাম, তোমার ঠোঁটে ফুল ফুটে আছে। ঝরে পড়তে চায় স্পর্শে।
দখিনা বাতাসের দোলা লাগুক। শুভ রাত্রি।

বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭

আমরা একদিন

আমাদের প্রেম পূর্ণতা পাবে একদিন,সকল অন্ধকার ঘোর কাটিয়ে
তোমার হাত ধরতে পারবো একদিন।
পূর্ণিমা চাঁদ উঠবে,হাসবে ভূবন জোড়া মাঠ,ভালোবাসা ফেরবেনা কেউ কোনোদিন
আশায় আছি আমরা মিলতে পারবো একদিন।

হয়তো একদিন আবার উঠবে চাঁদ,হাসবে আকাশ,এই শস্যভরা প্রান্তরে
মর্তলোকেই আমাদর সে প্রেম পুর্ণ হবে একদিন।

বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৭

ধূসর চিতোরের পদ্মিনী

( ঘটনাকাল ১৩০৩ সাল। দিল্লীর মসনদে আসীন তূর্কি বংশোদ্ভূত খিলজী বংশের দ্বিতীয় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী। এই কাহিনীর কতোটা মিথ এবং কতোটা সত্য তা আজ আর নির্নয় করা সম্ভব নয়। ইতিহাস বলে আলাউদ্দিনের চিতোরগড় দূর্গ দখলকালীন সময়ে ঘটনাটি ঘটেছিল, তা তাঁর দরবারের ইতিহাসবিদ এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমির খসরুর লেখনিতে আছে।এই কাহিনী যারা কল্প কাব্যের চেয়ে বেশী কিছু বলে মনে করেন না, তারা দাবী করেন যে রানী পদ্মিনীর অস্তিত্বের কথা ইতিহাস স্বীকৃত নয়। আবার এই তত্ত্বও পুরো তথ্যভিত্তিক নয়।রাজপূত ইতিহাসে পদ্মিনীর নাম  আছে এটাই ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। )

”হিন্দুস্তানে এক ফুল ফুটেছিল- তার দোসর নেই, জুড়ি নেই!”
কী কুক্ষণে পিয়ারী বেগমের বাঁদীর এই গান কানে গিয়েছিলো বাদশা আলাউদ্দিন খিলজির, কে জানে! গানটা তাঁর ভাল লেগে গিয়েছিলো। সঙ্গে গেঁথে গিয়েছিলো মাথায় গানের কথাগুলো- ”কার সাধ্য সে রাজার বাগিচায় সে ফুল তোলে!”
না কি কথাগুলো ঘা দিয়েছিল তাঁর অহং-এ?
বোধ হয় দ্বিতীয়টাই হবে! শুধুমাত্র রূপে পাগল হয়ে পদ্মিনীকে পেতে চাওয়া এবং ব্যর্থ হলে চিতোরগড় ছারখার করে দেওয়া- প্রেম এতটাও বিধ্বংসী হতে পারে না। বিধ্বংসী হয় কেবল মোহ, অচরিতার্থ কামনা।
আলাউদ্দিন খিলজির সেই অচরিতার্থ কামনার আগুনে যেমন পুড়েছিলো চিতোরগড়, তেমনই গড়ের নারীরাও! কাহিনী বলে, রানী পদ্মিনীর সঙ্গে বারো হাজার নারী বরণ করে নিয়েছিলেন আগুনের দুঃসহ তাপ। জহরব্রত করে আত্মসম্মান রক্ষা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু, তাঁদের আত্মা গড় ছেড়ে কোথাও যায়নি! কোথাও যাননি রানী পদ্মিনীও!

শুনতে অবাক লাগলেও চিতোরগড় বরাবরই রহস্যে মোড়া! মানুষে যেখানে যেতে পারে না, সেখান থেকে বার বার অনেকেই ঘোরাফেরা করেছেন চিতোরগড়ে। তাঁদের কেউ বা দেবী, কেউ বা অভিশপ্ত প্রেতিনী!
সেই আবির্ভাব প্রথম ঘটেছিল যুদ্ধের সময়ে। আলাউদ্দিন খিলজি পণ করেই এসেছেন, চিতোরকে জনশূন্য করে পদ্মিনীকে তিনি বন্দিনী করে রাখবেন হারেমে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তখন বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে গড়। এমন সময়েই ঘটে সেই অলৌকিক কাণ্ড!
'হঠাৎ পায়ের তলায় মেঝের পাথরগুলো যেন কেঁপে উঠলো; তারপর মহারানী অনেকখানি ফুলের গন্ধ আর অনেক নূপূরের ঝিন-ঝিন শব্দ পেলেন। কারা যেন অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে! মহারানী বলে উঠলেন, কে তোমরা? কি চাও? চারিদিকে-দেওয়ালের ভিতর থেকে ছাদের উপর থেকে, পায়ের নিচে থেকে শব্দ উঠল- ম্যায় ভুখা হুঁ!'


রাণা লক্ষ্মণসিংহকে যিনি দেখা দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন চিতোরের কুলদেবী উবরদেবী! তবে, পদ্মিনীর স্বামী খোদ রাণা ভীমসিংহর মন থেকে সন্দেহ যায়নি। রাজপুত বীরেরা যখন যুদ্ধে যাচ্ছেন, তখন আবার দেখা দিয়েছিল সেই মূর্তি। ভীমসিংহের মনে হয়েছিল, তিনি দেবী না পদ্মিনী?
রাণার যা-ই মনে হোক, যুদ্ধের খবর কিন্তু খারাপই আসতে থাকে গড়ে। নিজের জলমহলে বসে শোনেন পদ্মিনী কেবল তাঁকে রক্ষার জন্য হাসিমুখে প্রাণ দিচ্ছে রাজপুতানা! অবশেষে যখন তিনি বুঝতে পারেন, আর আশা নেই, তখন তৈরি হন।
”চিতোরের মহাশ্মশানের মধ্যস্থলে চিতোরেশ্বরীর মন্দিরে বারো-হাজার রাজপুত সুন্দরীর জহর-ব্রত আরম্ভ হলো। বারো হাজার রাজপুতের মেয়ে সেই অগ্নিকুণ্ডের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগলো- লাজ হরণ! তাপবারণ! হঠাৎ একসময় মহা কল্লোলে চারিদিকে পরিপূর্ণ করে হাজার-হাজার আগুনের শিখা মহা আনন্দে সেই সুড়ঙ্গের মুখে ছুটে এলো। প্রচণ্ড আলোয় রাত্রির অন্ধকার টলমল করে উঠলো। বারো হাজার রাজপুতানীর সঙ্গে রানী পদ্মিনী অগ্নি-কুণ্ডে ঝাঁপ দিলেন- চিতোরের সমস্ত ঘরের সোনামুখ, মিষ্টি কথা আর মধুর হাসি নিয়ে এক-নিমেষে চিতার আগুনে ছাই হয়ে গেলো।”


কিন্তু, কোথাও গেলো না! তারা অশরীরে, সবার অলক্ষ্যে থেকে গেলো চিতোরেই!
আজও রাত নামলে চিতোরগড়ে সেই বারো হাজার রমণীর বিলাপের শব্দ শোনা যায়। তাঁরা কেঁদে কেঁদে অপমানের প্রতিকার চান !


বিশ্বাস না হলেও অনেকে চিতোরগড়ে দেখা পেয়েছেন রানী পদ্মিনীরও! রাজকীয় পোশাকে, অপূর্ব অলঙ্কারে শোভিতা এক নারী মাঝে মাঝেই দেখা দেন। ঠিক যেমনটা দেখেছিলেন রাণা ভীমসিংহ আর লক্ষ্মণসিংহ।কিন্তু,বর্তমান সময়ে যাঁরা দেখেছেন,চোখে পড়েছে সেই রমণীর মুখ আগুনে ঝলসানো! সেই রূপ সহ্য করা যায় না! পদ্মিনীর এই মর্মান্তিক দগ্ধ রূপ দেখেই অনেকে ভয়ে প্রাণত্যাগ করেছেন।
তাই রাত নামলে কেউ চিতোরগড়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখান না। যে রূপ একসময়ে বিনাশ ডেকে এনেছিল চিতোরের, সেই রূপের দগ্ধাবশেষেই চিতোরকে রক্ষা করতে চান পদ্মিনী! কাহিনী এমনটাই বলে! তাই তাঁর প্রতি সম্মান করেই  রাত নামলে এখনো কেউ ঐ চিতোর গড়ের দিকে যায় না।

তথ্যসূত্রঃ
২। Legend-Of-Alauddin-Khilji-And-Rani-Padmavati
৩। ancientales.wordpress.com
৪। chittorgarh.com/rani-padmini.
৫। Songbadprotidin
উদ্ধৃতি : অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রাজকাহিনী' থেকে।


                                                                                                                 



                                                                                                                                         

মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭

পত্র পল্লবে

বাঁচতে ইচ্ছা করে এই বৃক্ষের মতো, সবুজ ছড়িয়ে যায় চারদিকে। নিঃশ্বাস ফেলতে ইচ্ছা করে মুক্তির স্বাদে। মৃত্তিকার গহীনে থাকে শিকড়। প্রাণ সতেজ করতে মন চায় এর সৌরভে,এর পত্র পল্লবে। 

অমৃতা

কোনো এক বসন্ত বিকেলে চন্দ্রিমা উদ্যানের সবুজ ঘাসে বসে আমি আর অমৃতা দু'জন হাতে হাত রেখে প্রতিশ্রুতি করেছিলাম, আমরা এ জীবনে অন্য কাউকে বিয়ে করবোনা। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে অমৃতা মৃত্যুর ওপারে চলে যেয়ে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। সে আর বিয়ে করেনি। অমৃতার মৃত্যুর পর তার কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে মায়ের অনেক পিড়াপিড়ীতে শেষ পর্যন্ত আমি বিয়ে করলাম।

আমি তখন বনবিভাগে চাকুরী করি। পোস্টিং ছিলো গাজীপুর রেঞ্জে।শ্রীপুর থানা সদরের অদূরে বাংলো টাইপের এক বাড়ীতে আমি থাকি এবং সেখানেই নতুন বউ জেসমিনকে নিয়ে ঘরে তুলি। জেসমিন জানতোনা অমৃতা নামে কাউকে আমি ভালোবাসতাম। বিয়ের আগে একটা জেদ করেছিলাম,বউকে বেশী ভালোবাসবোনা; তাকে খেয়াল করবোনা ,তাকে সময় দিবোনা কিন্তু সে জেদ আর করতে পারিনি। আস্তে আস্তে আমি জেসমিনকে ভালোবাসতে থাকি।

জেসমিন যখন স্নান সেরে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে থাকে , তখন আমি ওকে দেখি। ও যখন কালো এলো চুল সামনে এনে আছড়াতে থাকে, তখন ওকে আমি দেখি। রান্না করতে যেয়ে টুকটুকে গালে কালি লাগিয়ে যখন আমার সামনে এসে দাড়ায়, তখন আমি ওকে দেখি। ও যখন ঘুমিয়ে থাকে আমার পাশে, ওর স্বপ্ন মুখ আমি তখন দেখি।জেসমিনকে দেখতে দেখতে ওর প্রতি আমার অূসম্ভব মায়া জন্মাতে থাকে।

একদিন ছুটির দিনে জেসমিনকে নিয়ে পাশেই বালু নদীর তীরে বেড়াতে যাই। একটি রিক্সা নিয়ে আধা পাকা পথ পেড়িয়ে, কিছু মেঠো পথ পায়ে হেটে আমরা নদীর কূলে চলে যাই। ওখানে তীরে বসে দেখি বালুর নদীর শান্ত জল। দেখি পানকৌঁড়ি আর বকদের জলের উপর ঘোরাঘুরি। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পশ্চিম আকাশের লাল আভা জেসমিনের মুখের উপর এসে পড়ে। ঠিক এমনি এক মোহনীয় ক্ষণে অমৃতাকে একবার দেখেছিলাম বুড়িগঙ্গার পারে। সেই রক্তিম মুখ ,সেই স্বর্ণাভ ললাট, সেই সৌম্য মুখখানি দেখতে পেলাম আজ জেসমিনের মুখোয়বে।

সেদিন ছিলো বৃষ্টির দিন। বাংলোর বারান্দায় দুজন বসে আছি। শালবনের ঝোপে ঝারে অনবরত বৃষ্টি ঝরছে। টিনের চালে ঝুমঝুম করে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। বারান্দার চাল থেকে গড়িয়ে পড়া জল ধরছিলো জেসমিন। এ যেনো শ্রাবণ মেঘ মল্লার দিন। মন আঁধার করে নামছে সন্ধ্যা। নির্জন সেই মায়াবী ক্ষণে আমাদের ছিলো অনেক চাওয়ার আকুলতা। গুনগুন করে জেসমিন গাচ্ছিলো- আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে, জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগেনা।' এমনি এক বৃষ্টিমুখর দিনে অমৃতার কন্ঠে শুুনেছিলাম এই গান।

রাতে বিছানায় শুয়ে আছি। আমার দুহাত জেসমিনের বাহুতে বাঁধা। দেখলাম ওর খুব মন খাারাপ। কথা বলতে চাইছেনা। ডাকি আদর করে, চুপ হয়ে থাকে সে। টানতে চাই বুকের খাঁজে,আসতে চায়না। কানের কাছে যেয়ে কানে কানে ওকে বলি-' কি হয়েছে তোমার ?' অভিমান ভেঙ্গে জেসমিন বলে- সন্ধ্যায় বারান্দায় বৃষ্টির সময়ে তুমি আমাকে 'মিত্রা' বলে ডেকেছিলে কেন ?' আমি বললাম- 'তুমি একটা পাগলি মেয়ে। আমিতো আদর করে তোমাকে 'মিত্রা' ডেকেছিলাম।' অবাক হই, আমি যে কখন জেসমিনকে 'মিত্রা' বলে ডেকেছিলাম,এ কথা আমার মনেই পড়ছেনা।

দিনগুলি চলছে ভালো করেই,সময়গুলি কাটছে ভালোবেসে। সেদিন ছিলো হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। বাংলোর সামনে পুকুরপাড়ে ঘাসে দু'জন বসে আছি। জেসমিন পড়েছিলো সাদা শাড়ি। শুভ্র জ্যোৎস্নার বিমুগ্ধ স্রোতে জেসমিন মিশে গিয়েছিলো। ওর গোলাপি গাল হয়ে উঠেছিলো সাদা,খয়েরী ঠোঁট হয়ে উঠেছিলো নীল, কালো চুল হয়ে গেলো সোনালী। পুকুরপাড়ের হাস্নাহেনার সুবাস এসে ভরে উঠছিলো জেসমিনের বুকে। আমি তখন কাছে টানি অমৃতাকে। ওকে বলি- চলো মিত্রা, কেউ যাক বা না যাক, আজ এই জ্যোৎস্না রাতে তুমি আর আমি যাবো শালবনে।' এতো ভালোবাসা ওকে ঢেলে দিলাম সেইখানে, তারপরেও জেসমিন সে রাতে ঘরে এসে বিছানায় মুখ গুজে কেঁদেছিলো।

আমি জেসমিনের কাছে ক্রমেই আমার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলাম। ওকে যতো বেশী ভালোবেসে কাছে টানছিলাম, ঠিক ততো বেশী ওর ভিতর অমৃতা সিনড্রোমে আমাকে পেয়ে বসতে থাকে। যা কিছু পুরোনো প্রেম তা প্রকাশিত হচ্ছে অজ্ঞাতসারে,কখনো ঘুমের ঘোরে, কখনো স্বপ্নে,কখনো জাগরণে,কখনো বিহব্বলতায় জেসমিনকে 'অমৃতা' 'মিত্রা' বলতে থাকি। এতে করে জেসমিন কতো যে কষ্ট পেয়েছে, কতো যে গোপনে গোপনে কেঁদেছে.এ খবর আমি কখনো রাখি নাই।

অফিসে সেদিন ঢাকা থেকে অডিট টীম এসেছিলো। তাই বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। জেসমিনকে দেখলাম,তাঁতের সবুজ রঙ্গের শাড়ি পড়ে আছে। এই শাড়িটি পড়েছিলো বিয়ের দ্বিতীয় দিনের সকালবেলায়। মুখে ওর বিষাদের হাসি। শরীরটা খুব ক্লান্ত ছিলো আমার। আমি দু'মূঠো খেয়ে শুয়ে পড়ি। চোখে দুনিয়ার ঘুম জড়িয়ে আসছে।

মিত্রা বলছিলো- আমি তোমাকে মনে হয় ভালোবাসা দিতে পারি নাই।'
আমি বলি-  কি যে বলো তুমি মিত্রা ! সেই কতোকাল ধরে তুমি আমাকে ভালোবাসিতেছো ! বুড়িগঙ্গার পাড়ে কতো  সন্ধ্যা কেটেছে,কতো বিমুগ্ধ তারার রাত কেটেছে আমাদের মিত্রা, তুমি কি ভুলে গেছো সেই সব গভীর চুম্বনের কথা ? ভুলে কি গেছো সেই সব প্রগাঢ় আলিঙ্গনের কথা ? '  
          
তারপর ঘুমের ঘোরে বলেছিলাম হয়তো আরো অনেক কথা। কোনো কথা মনে করতে পারছিনা।জেসমিন বলেছিলো- 'তোমার পুরানো ট্রাংক খুলে অমৃতার লেখা সব চিঠি আমি আজ পড়েছি।' তারপর আরো কি বলেছিলো অমৃতা মনে নেই। আমি গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে যাই।

সকালবেলা বাইরে অনেক মানুষের কথার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায়। জেগে দেখি পাশে জেসমিন নেই। পুকুরপাড়ে অনেক মানুষের ভীড়। সবাই দেখছে- একটি মেয়ে উবু হয়ে পুকুরের জলে ভাসছে।

তারপর ঐ বাংলোতে একাকী বেশী দিন আমি থাকতে পারিনি। হেড অফিসে অনুরোধ করে বদলীর আদেশ নেই। যেদিন চলে আসবো, সেদিন সকালবেলা পুকুরপাড়ে জলের কাছে গিয়ে দাড়াই। জলে দেখতে পাই জেসমিনের মুখ। ওকে বলি- অমৃতা মৃত ছিলো,সে তুমি জানতেনা।তার জন্য এতো বড়ো অভিমান ! তোমরা দু'জনেই একই রকম।আমাকে একা করে রেখে দু'জনেই চলে গেলে।'

                  


সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৭

দেবী

দেবী নামটির প্রতি আমার এক ধরণের দূর্বলতা আছে। সে যে দেবীই হোক। ভারতীয় পুরাণের দেবী, গ্রীক মিথের দেবী অথবা মনুষ্য দেবী। 'দেবী' মানেই মনে হয় সে সুন্দর, সে সুন্দরী, কিংবা সে হুর বা পরী। মনে হয় সে একজন প্রেমিকা রূপ।

একটা নিষ্প্রাণ পাথরের রূপ,থেমিস তার নাম। এতো আন্দোলন, এতো টানাটানি তাকে নিয়ে ? সে শাড়ি পড়ে দাড়িয়ে আছে পাল্লা হাতে। আরেক হাতে তরবারি। অনেকেই  তাকে বলে গ্রীসের দেবী। আমি বলি - সে বাংলার,সে বাঙ্গালী। সে যেই হোক, তাকে ওখান থেকে সরাবেন কেন ?

নামাজ পড়তে দেখা যায় ? ঠিক আছে বছরের ঐ দুই দিন না হয় কাপড়ের পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখেন। আমরা আমাদের বাসা বাড়ীতে নামাজ বা মিলাদের সময় ওয়ালে টানানো ছবি থাকলে তা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখি। বছরে ঐ দুই দিন ভাস্কর্যটি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে অসুবিধা কি ?

আর যদি সরানোর ইচ্ছাই থাকে, আমি বলবো-সরাবেন না। তার বদলে ভাস্কর্যটির চারপাশে কালো পাথর দিয়ে দেয়াল তুলে ঢেকে দিন। যেদিন এ দেশের সব মানুষ বুঝতে পারবে- মূর্তি পূজা করা আর ভাস্কর্যের শৈল্পিক সৌন্দর্য এক জিনিস নয়, সেদিন ভেঙ্গে ফেলা হবে এই ভাস্কর্যের চারপাশের পাথরের কালো দেয়াল। আর না বুঝতে পারলে ঐ কালো দেয়ালেই 'মূর্তি' টি ঢেকে থাকবে অনন্তকাল ।




রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৭

ভালোবাসি

গ্রীস্মের উষ্ণতার রাত্রি তুমি নাও,
দাও উর্বর ভুমি, ফসল ফলাবো শস্যক্ষেতে
নদীর কাছে উন্মোচিত হও,নেমে পড়ো জলে,
ভিজাও পদকরতল-
তুমি শীতল হইওনা, গ্রীস্মের তপ্ত দাহ তুমি নাও
জ্বলো তুমি,জ্বালাও দেহ,শুদ্ধ করো তোমার প্রেম-
আকণ্ঠ চিৎকার করে তুমি বলো- ভালোবাসি।

নদী

যদি কোনো অত্যাশ্চর্য  কিছু থাকে তাহলো নদী।এর জল ছোঁয়ার আগে দেখে নাও,তোমার আঙ্গুল পবিত্র আছে কিনা ? আর নদীর দু'পারে যদি কোনো বাঁধ দেওয়া থাকে, তবে আমি সেই বাঁধ ভেঙ্গে দিতে এসেছি।

শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৭

সেই সর্বনাশী

অনেক বছর আগের কথা। তখন কিশোর বয়স। সকালবেলা খবর রটেছে, নদীর পারে আঁখক্ষেতে এক নবজাতকের লাশ পড়ে আছে। মানুষ দল বেঁধে দেখতে যাচ্ছে সেই শিশুর লাশ দেখতে। লাশটি ছিলো এক কন্যা শিশুর। সবাই বলাবলি করছে- আহা ! এতো সুন্দর মেয়েটিকে কোন্ সর্বনাশী গলাটিপে মেরে ফেলে রেখে গেছে।পরেরদিন সকালবেলা গ্রামবাসী ঐ নদীর তীরে পিটেসরা গাছের ডালে একটি মেয়ের ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায়। সবাই বলাবলি করছে এই সে সর্বনাশী যে গত পরশু রাতে ঐ শিশুটিকে গলা টিপে মেরে ফেলে গিয়েছিলো।

নদীর কূলের ঐ পথ দিয়ে সন্ধ্যার পরে মানুষ একাকী চলতে এখনো ভয় পায়। প্রতিদিন নিশুথি রাতে ঐখানে থেকে ডুকরিয়ে ডুকরিয়ে কান্নার ধবনি ভেসে আসে। সবাই বলে- এটি নাকি সর্বনাশি ঐ মেয়েটির কান্না। যে তার সন্তানের জন্য এমন করে ডুকরে কাঁদে। 

বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৭

ফুলমতি

মেয়েটির নাম ফুলমতি,বয়স দশ বছর হবে। কিশোরগঞ্জের হাওড় পাড়ে ওর বাড়ী। ওখানেই সে বড়ো হয়েছে। ওখানেই সে ধুলো বালিতে খেলতো আর ঘুরে বেড়াতো। এক হেমন্তের সকালবেলায় ফুলমতি বাবার সাথে নৌকায় করে ভৈরব চলে আসে। ভৈরব রেল জংশনে ঢাকাগামী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে বাবা ও মেয়ে। দুপুর গড়িয়ে যায়। অনেকটা সময় ধরে অভুক্তই থাকে ফুলমতি। বাবা একটি পাউরুটী আর দু'টো কলা কিনে খেতে দেয় । ফুলমতি সেখান থেকে অর্ধেক দেয় বাবাকে। এর মধ্যে চট্রগ্রাম থেকে এক্সপ্রেস ট্রেন প্লাটফরমে এসে থামে। বাবা আর মেয়ে উঠে পড়ে সেই ট্রেনে। ট্রেন যখন কমলাপুর এসে পৌঁছে তখন সন্ধ্যা হয়ে যায়। ওরা যাবে মগবাজার তাদেরই গাঁয়ের এক পরিচিতের বাসায়। বাবা ফুলমতিকে বাইরে অপেক্ষায় রেখে বাথরুমে যায়। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখে ফুলমতি সেখানে নেই। অচেনা ঢাকা শহরে বাবা ফুলমতিকে অনেক খুঁজেছে কিন্ত পায়নি।

এই শহরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ফুলমতির কান্নার ধ্বনি শোনা যায়। কালো হাতের থাবার নীচ থেকে সে ডাকে- 'বাবা তুমি কোথায় ? আমাকে নিয়ে যাও।'

নববর্ষের শুভেচ্ছা

অনেকদিন পথে হাটিনি। অনেকদিন প্রতিবাদ করিনি।
অনেকদিন প্রতিরোধ করিনি। এই অনেকদিনে হারিয়েছি অনেক কিছু।

আজকে পথে হাটবো তোমাদের সাথে।
সামনে যতোই অন্ধকার থাক্। আলো দেখতে চাই
ঢোলের তালে,ঢাক আর খুঞ্জরের আওয়াজে-
এক্কেবারে বাঙ্গালিয়ানায়।

সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।

পদ্মাবতী

আমি আর আমার স্ত্রী  ২০০৯ সালে ডুয়ার্সের অরণ্য দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের শিলিগুরির বন্ধু শিশির রায় বলেছিলো, এসেছোই যখন, এক ফাঁকে তোমরা কোচবিহারের রাজবাড়ীটাও দেখে নিও, ভালো লাগবে। শিলিগুরির এনজে জংশন থেকে একদিন আমরা কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেসে কোচবিহার চলে যাই। ছিমছাম সুন্দর শহরটির ইলোরা হোটেলে আমরা উঠি। ভখন বিকাল হয়ে গিয়েছে। সেদিন আর রাজবাড়ী দেখতে যাইনা। সন্ধ্যায় রি্ক্সায় মদনমোহন মন্দির দেখতে যাই। সেখানে কৃষ্ণ মূর্তির পাশে বসে অনেকক্ষণ আমরা কীর্তন শুনেছিলাম।

রাতে ক্যাফেতেই খেয়ে নেই। খেয়ে হোটেল রুমে বসে আমরা গল্প করছিলাম।সে সময়ে হোটেল এ্যাটেন্ডেন্ট  রুমে প্রবেশ করে। ও বলছিলো আমাদের সুবিধা অসুবিধার কথা। ওর নাম কৃষ্ণ কুমার। মধ্য বয়সী অসমীয়া লোক।শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে। বাড়ী আসামের ডিব্রুগড়ে। কথায় বুঝতে পারলাম.লোকটা খুবই পরোপকারী এবং ভদ্র। আমরা ওর কাছ থেকেই জানার চেষ্টা করি রাজবাড়ীর কথা। এই রাজবাড়ী সম্পর্কে বলতে গিয়েই কৃষ্ণ কুমার আমাদের একটি কাহিনী শোনায়েছিলো। ও শুনেছিলো নাকি ওর পিতামহের কাছ থেকে, আর পিতামহ শুনেছিলো তারও পিতামহের কাছে। অনেকটা কিংবদন্তীই বলা যায়। শুনুন এবার সেই কাহিনী।


১৬২১ সালে রাজা দীননারায়ণ কোচবিহারের সিংহাসনে বসেন। রাজা ছিলেন প্রবৃত্তির বশবর্তী। তাঁর চরিত্রে ছিল লাম্পট্যের আধিপত্য। যদিও তিনি সংগীতপ্রেমিক  ও সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন, কিন্তু নিজের রাজত্বের বহু উচ্চবংশীয় নারীকে তিনি হরণ করে নিয়ে যেতেন, এবং তাঁদের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হতেন।


চিকনা পাহাড়ের পাদদেশের নিরিবিলি টিলা বেষ্টিত একটি লোকালয়। পাশেই খরস্রোতা কালজানি নদী।এই নৈসর্গিক উপত্যাকার একটি গ্রামে থাকতেন এক পন্ডিত মশায়। আশে পাশের ছেলেরা এসে এই পন্ডিতের কাছে লেখাপড়া করতো। পন্ডিত মশাইয়ের একটি ষোড়সী মেয়ে ছিলো নাম পদ্মাবতী। উদ্ভাসিত নব যৌবনা, টানা টানা পিঙ্গল চোখ, মাথা ভর্তি কালো চুল, মৃগনাভি,চিকন কোমড়, প্রসারিত বক্ষরাজি, তোর্সা নদীর বাঁকের মতো তার উরু। একদিন রাজা দীন নারায়ন তার সঙ্গী নিয়ে ঘোড়ায় চরে উপত্যাকার ঐ পথে যাচ্ছিলো।পদ্মাবতী তখন কালজানি নদীতে স্নানরত। রাজা দীন নারায়ন সেই দৃশ্য দেখে ফেলে। সে তখন সঙ্গীদের প্রাসাদে পাঠিয়ে দেয়। লম্পট দীন নারায়ন তার পৈশাচিক নিবৃতি প্রথম চরিতার্থ করে এই কালজানি নদীর উপকূলে।


এরপর কালজানির নদীর কালো জল অনেক গড়িয়েছে। রাজা দীন নারায়ন এই উপত্যাকায় এসেছে বার বার। একসময় পদ্মাবতী গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এ কথা লোক সমাজের কেঊ জানতোনা। সন্তান জন্ম দেয়ার দুইতিন মাস আগে পদ্মাবতী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পাশের পরগনা দেওহাটায় ওর এক মাসি থাকতো। সেখানেই পদ্মাবতী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। নাম রাখে ইলা। এই ইলাকে নিঃসন্তান মাসীর কাছে রেখে তার গ্রামে আবার ফিরে আসে। ইলা থেকে যায় মানুষের লোক চক্ষুর আড়ালে।


 কিছু দিন পর রাজা দীন নারায়ন পদ্মাবতীকে বিয়ে করে। তাকে রানীর মর্যাদা দিলেও রাজার লাম্পট্য থেমে থাকেনি। এভাবেই কেটে যায় 
পদ্মাবতীর ষোলোটি বছর। এদিকে ইলা পদ্মাবতীর মাসীর ঘরেই বড়ো হতে থাকে। ইতোমধ্যে সেই মাসীর মৃত্যু হয়। পদ্মাবতী ইলার পরিচয় গোপন রেখে রাজাকে বলে ইলাকে রাজ প্রাসাদে নিয়ে আসে।কিন্তু রাজা জানেনা ইলা তারই ঔরসজাত কন্যা।

ইলা অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে ছিলো। রাজকুমারী হয়েও সে রাজকুমারী নয়। প্রাসাদে তার মর্যাদা অনেকটা বাঈজীদের মতো। ইলা সুন্দর গান গাইতে পারতো, সুন্দর নাচতে পারতো। ওর রূপ পদ্মাবতীর রূপকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। রাজা দীন নারায়নের কুনজরে পড়ে ইলা। রানী পদ্মাবতী এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে আশংকা বোধ করতে থাকে।


শরতের এক বিকেলে রাজা দীন নারায়ন কালজানি নদীতে অনেকটা জোড় করেই ইলাকে নিয়ে বজরায় নৌ বিহারে যায়।পদ্মাবতী রাজার কুউদ্দেশ্য বুঝতে পারে। বজরাটি অপরূপ সাজে সাজানো হয়েছিলো। গানের বাদ্যয্ন্ত্র ও নাচের নুপুর, ঘুঙ্গুরও নেয়া হয়েছিলো। ইলার পরনে ছিলো মুক্তাখচিত জয়পুরী চোলী। ইলা সেদিনের সেই বিকেলে রাজা দীন নারায়নকে সব দুঃখের গানগুলি শোনায়েছিলো। নেচেছেও রাজার সামনে একাকী। তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বজরার অন্দরমহলে একসময় ইলার সব গান থেমে যায়। নুপুরের শব্দ আর শোনা যায়না। তখন সূর্য অস্তমিত হয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বক আর গাংচিলরা পাখা ঝাপটে দুর অরণ্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে। জলের উপরে ছোটো ছোট পাখীদের কিচির মিচির গানগুলো কান্নার শব্দের মতো মনে হচ্ছেছিলো। 
খরস্রোতা কালজানির জল যেনো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।

তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে। বজরা এসে ঘাটে ভেড়ে। মাঝি মাল্লারা পাটাতন ফেলে দেয় কূলে। রাজা দীন নারায়ন নেমে আসে। ইচ্ছাকৃতই হবে হয়তো, নামতে যেয়ে ইলা পা ফসকে অন্ধকারে নদীর গভীরে পড়ে যায়। শুধু টুপ করে একটা শব্দই শোনা গেলো। মুহূর্তেই ইলা জলের তলে হারিয়ে গেলো।


পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার নীচ দিয়ে হেটে হেটে রাজা দীন নারায়ন একাকী প্রাসাদে ফিরে আসে। মুখে তার মগ্ন বিষাদ। নিঃশব্দে শোবার ঘরে ঢুকতেই সে দেখতে পায় রানী পদ্মাবতী ফাঁসিতে আত্মহত্যা করেছে।

_____________________________________________________ 


ডিসক্লেমেয়ার:   এই কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা যাছাই করা হয় নাই। এটি কৃষ্ণ কুমারের বলা একটি কল্প কাহিনীও হতে পারে।



মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭

কাজল রেখা

আজ আমার এই চিলকোঠার ছোট্ট ঘরে কাজলের বউ হয়ে আসার কথা ছিলো। সজ্জায় বিছিয়ে রাখার কথা ছিলো ফুলের পাঁপড়ি। জ্বালাতে চেয়েছিলো ঘরে আলো। এসব আজ কোনো কিছুই হলোনা। আমি ঘরকে আঁধার করে একাকী বসে আছি। কোনো আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করছেনা। সিগারেটের ধূয়ায় রুমটা অন্ধকারে ভরে গেছে।

 কাজল রেখা। আমি ডাকতাম ওকে কাজল বলে। ওর বাবা মা ডাকতো রেখা। ঢাকা শহরের এই জনারণ্যে পথ চলতে চলতেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। পথের মানুষ পথেই যেন প্রিয় মানুষের দেখা পেয়ে গেলাম। এক বৃষ্টি  ঝুমঝুম সন্ধ্যায় দাড়িয়েছিলাম গুলিস্তান বাস স্টান্ডে রাস্তার উপরে। বৃষ্টিতে ভিজতেছিলো আমার মাথার চুল। পাশে দাড়ানো মেয়েটা ওর ছাতাটা এগিয়ে দিয়েছিলো আমার মাথায় উপর। রাস্তার উপরে এই প্রথম কোনো মেয়ের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়া, প্রথম কোনো মায়া দিয়েছিলো একজন অপরিচীতা। সে এই কাজল।

মতিঝিল এরিয়ায় কাজল একটি চাকুরী করতো। আমারও চাকুরীস্হল ছিলো মতিঝিলেই।আমি অস্থায়ী ছোটো একটি চাকুরী করি,বেতন ভাতা নগন্য। কাজলের সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো। কোনো কোনো দিন রাস্তার উপর হোটেলে বসে আমরা লাঞ্চ করতাম। কোনো কোনো দিন পাউরুটী কলা, কোনো কোনো দিন নোনতা বিস্কুট আর চা খেতাম।

এই ভাবেই চলতে চলতে দু'জন দু'জনার প্রতি মায়ায় বেঁধে যাই। দু'জন দু'জনকে ভালোবেসে যাই। জগৎ সংসারে কোনো পাওয়াই মনে হয় মসৃন হয়না। কাজল যখন আমার কথা বলেছিলো ওর মা বাবার কাছে, তখন তারা বলেছিলো 'না'। এ ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হবেনা। আমার মতো চালচুলোহীন ছেলের কাছে কোনো বাবা মা তার আদরের মেয়েকে তুলে দিতে চায় ?  কেমন যেনো মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো এ জীবনে কাজলকে আমি আর পাবোনা। যাকে এতো আপন করে কাছে টানতে চাইলাম ,সে তাহলে দূরেই থাকবে।

গতকাল আমরা দুজনই লাঞ্চের পর আর অফিসে যাইনা। একটি রিক্সা নিয়ে বলদা গার্ডেনে চলে যাই। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল হয়েছে। আমরা দু'জন ঝাউবনের পাশে সবুজ ঘাসের উপর যেয়ে বসি। জারুল আর মহুয়াবনে পাখীরা তখন কিচির মিচির করছিলো। কথা বলছি দু'জনে, ভালোবাসছি দু'জনে। যেনো ' বাতাসের কথা সে তো কথা নয় রূপ কথা ঝরে তার বাঁশিতে আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই যেন দুটি আঁখি ভরে রাখে হাসিতে।'  কেনো জানি ভানু চক্রবর্তীর কবিতার এই চরণটি আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো- 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি।' গার্ডেনের সবুজ ঘাসে বসেই দু'জন সিদ্ধান্ত নেই. আগামীকালই আমরা কোর্ট ম্যারেজ করবো।

সন্ধ্যার পাখীরা সব কলোরব করে উঠলো। বাগানের সব ফুল যেনো ফুটে উঠতে লাগলো। সুবাস ছড়িয়ে পড়তে থাকলো চারদিকে। মৃদুমন্দ বাতাস বইতে লাগলো। কাজল কখন আমার হাত ধরেছিলো,খেয়াল নেই। সন্ধ্যার আলো আধারীতে ওর আনত মুখখানি একবার দেখলাম। জগতের সমস্ত সুখের আভা যেনো ছড়িয়ে আছে ওর চোখে মুখে। '
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হারিয়ে. মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। তব ভুবনে তব ভবনে. মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।' গার্ডেন থেকে আমরা বেরিয়ে আসি । কাজল রিক্সায় উঠে বক্সীবাজারে ওদের বাসার দিকে চলে যায়। যাবার বেলায় বলে যায়- কাল তোমার চিলেকোঠায় বউ হয়ে আসছি।
 
চিলেকোঠায় ফিরে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে ভাবছিলাম- এই ছোট্র ঘরে কাল কাজল আসবে। আমার চুলো জ্বালাবে। সন্ধ্যাবাতি জ্বালাবে ঘরে। ছোট সংসার হবে। ঘরবাড়ী গোছাবে লক্ষ্মী ঐ মেয়ে। যে স্বপ্ন দেখেছিলাম,তারুণ্যের প্রথম প্রহরে, তা যেনো কালকেই পূরণ হতে যাচ্ছে। আমার মন প্রাণ উল্লসিত হয়ে উঠলো।


হঠাৎ দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ শুনতে পাই। দরজা খুলে দেখি- একটি অপরিচিত লোক দাড়িয়ে। উনি বলছিলো- আমি হাসপাতাল থেকে এসেছি।কাজল নামে একটি মেয়ে আমাকে পাঠিয়েছে। উনি রোড এক্সিডেন্টে আহত হয়ে জরুরী বিভাগে আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রক্ত দরকার।'


আমি ্দ্রুত হাসপাতালে চলে যাই। হাসপাতালের জরুরী বিভাগের কোরিডোরের সামনে আমি দাড়ানো। ডাক্তারকে বলি- কাজল এখন কেমন আছে ?  
ডাক্তার : আপনি ওনার কি হন ?
আমি :   আমি ওর কিছু হইনা।
ডাক্তার :  ও আচ্ছা।
আমি:  ওর সাথে আমি কি একটু কথা বলতে পারবো ?
ডাক্তার :  উনি এখন জীবনেও নেই, মরনেও নেই। আপনি ভিতরে যান। দেখেন আপনার সাথে উনি কথা বলে কি না ?

কাজল আমার সাথে কথা বলেনি। রুম হতে বের হতেই দেখি- এক পৌঢ় ও একজন বয়স্কা মহিলা বাইরে দাড়ানো। কাজলের বাবা মা হবে হয়তো। তারা কাঁদছে। হাসপাতালের কোরিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে আমি রাস্তায় চলে আসি। যে জনারণ্যে একদিন কাজলকে খুঁজে পেয়েছিলাম, সেই জনারণ্যেই আমি হারিয়ে গেলাম।

             

Pl. Stop It.

একটা ফালতু জিনিস নিয়ে 'টক অফ দ্যা টাউন' হয়, একট নোংড়া ব্যাপার নিয়ে 'টক অফ দ্যা দেশ' হয়, আমার জানা ছিলোনা।হায়, মানুষের রুচিবোধ ! কতো অন্ধকার,কতো গোপন অভিসার হয় যেখানে, যে ভুবনে হয় নষ্ট গদ্য লেখা। হয়তো কোনো একটি পাপ, হয়তো অসচ্ছ কোনো আনন্দের ফসল এই শিশু, কিংবা না।
এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন. এ নিয়ে এতো নাচানাচি, আমাদের মিডিয়াগুলোও আছে। ছি !
বন্ধ করুন এ সব মাতামাতি। Please Stop It.

সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৭

ঘুমিয়ে যাবার আগের গান

মনে করুন, মৃত্যু শয্যায় শুয়ে আছি। জ্ঞান আছে কথ আছে,চেয়ে আছি।দেখছি সবাইকে।তখন যদি শিয়রে বসে এই গানটি কেউ গায়,আর গানটি শুনতে শুনতে যদি ঘুমিয়ে যাই। কেমন হতো ?

মঙ্গল করো হে

কতোটা ভালোবাসা দিলে অন্দরমহলে পৌঁছতে
পারবো
নাকি অন্ধকার গোপন গহবরে হারিয়ে যাবো
আচমকা নিভে যাবে হাতের প্রদীপখানি।
সব ভালোবাসা দেবার আগে,সব গান শোনাবার আগে
সুরের মসৃন তান জেনে নিতে হয় ঊষালগ্নে-
তারপর শান্তি, তারপর মঙ্গল দীপ তুলে ধরো-
 হে প্রাণেশ !

রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৭

সমীরের বউ

আমাদের গ্রামে একটি ছেলে ছিলো,নাম সমীর আলী। বিয়ে করে বউ নিয়ে সুখেই সংসার চলছিলো তার।কয়েক বৎসার পর হঠাৎ শুনতে পাই, সমীর আলী তার এক যুবতী খালাশ্বাশুরীকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে চলে গেছে। আর সমীরের বউ অন্য পাড়ার এক যুবক লালু মিয়ার কাছে যেয়ে নিকা বসেছে।

তারও কয়েক বৎসর পরে বাড়ীতে গেলে, একদিন লালু মিয়ার বাড়ীর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম- দেখি লালু মিয়ার বউ তাকিয়ে দেখছে আমাকে। কিন্তু আমি চিনতে পারছিলামনা । সে তখন বলে- 'ভাই, আমাকে চিনতে পারছেন না,আমি আপনেগো পাড়ার সমীর আলীর বউ।'

বিষন্নতা নেই

এই শহরকে দেখে বোঝা যাচ্ছেনা কেউ একজন
 আজ চলে গেছে
বোঝা যাচ্ছেনা কেউ চলে গেছে অনন্তের পথে আজ সকালে-
মসজিদে আযান হয়েছে, মুসুল্লীরা চলে গেছে সব নামাজে।

সংবাদপত্রের গাড়ী ছুটে যাচ্ছে মফস্বলের দিকে
কারখানার শ্রমিকেরা চলে যাচ্ছে কাজে
ক্লাশ শুরু হবার ঘন্টাধ্বনি বাজছে স্কুলে স্কুলে
ছাত্র ছাত্রীরা চলে যাচ্ছে ক্লাশে,কেউ হেটে,
কেউ রিক্সায়,কেউ বা গাড়ীতে করে।

সকালের রোদ্দুরকে আজ বিষন্ন দেখায়নি
পাখীরা গান গেয়েছে, সে গানে বিষন্নতা নেই
পাশের বাসায় বালিকা গান শিখছে
হারমনিয়াম বাজছে,তবলার তাল থেমে নেই।

বিষন্নতা নেই অফিসগামী যাত্রীদের
বিষন্নতা নেই রিক্সাওয়ালার, ভ্যানওয়ালার,
বিষন্নতা নেই গার্মেন্ট শ্রমিকের,ঠেলা চালকের
বিষন্নতা নেই হকারের, কোনো কামারের।


খেলার মাঠে,পার্কে,লেকের ধারে,মানুষ হাটছে
প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছে হৃদরোগীরা
দোকানীরা দোকান খুলেছে,বিক্রি করছে পশরা
বাস স্টপেজ,স্টেশন,লঞ্চঘাটে যাত্রিরা ছুটে যাচ্ছে
কারোরই চোখে মুখে কোনো বিষন্নতা নেই।

সকল বিষন্নতা আজ আমার, এই শহর থেকে শববাহী এ্যাম্বুলেন্স
সাইরেন বাজিয়ে চলে গেলো আমারই গ্রামের দিকে।






তুমি জলপ্রপাত হও

ভুলতে চাইলেই কি ভুলতে পারি বাহু ডোরের উষ্ণতা ?
ভুলতে কি পারি মুখ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির গন্ধের মতো আশ্লেশ ?
পর্বতারোহী হয়ে ভ্রমন করেছি পথের বাঁকে বাঁকে
ভুলতে কি পারি শরীরের খাঁজে খাঁজে সেইসব ভ্রমন ?
লতা গুল্ম বৃক্ষ ঝোঁপ ঝাঁর মাড়িয়ে পৌঁছে গেছি যে বন্দরে
ভুলতে কি পারি সেই সব রোমাঞ্চকর পরিভ্রমণের পথ ?

তুমি চাইলেই আবার সেই পথের পরিব্রাজক হতে পারি
দিতে পারি আবারও শ্লেশ,দিতে পারি ঈষাণের পুঞ্জিভূত মেঘ
তুমি বঙ্গোপসাগর থেকে জল নিয়ে এসো
মেঘে মেঘে ভেসে এসে তুমি জলপ্রপাত হও- আমারই বাহু ডোরে।


শনিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৭

তিস্তার আথালি পাথালি পানি

'নাও ছাড়িয়া দে পাল উড়াইয়া দে
ছল ছলাইয়া চলুক রে নাও মাঝ দইরা দিয়া চলুক মাঝ দইরা দিয়া
উড়ালি বিড়ালি বাওয়ে নাওয়ের বাদাম নড়ে 
আথালি পাথালি পানি ছলাৎ ছলাৎকরে রে।'

গানটি কে লিখেছিলো জানা নেই।যিনিই লিখেছিলেন তিনি হয়তো তিস্তা পাড়ের কেউ ছিলেন।তখন তিস্তায় এতো জল ছিলো যে- 'আথালি পাথালি পানি ছলাৎ ছলাৎকরে।' গিরীশ চক্রবর্তীর সুরে গানটি গেয়েছিলেন মরমী কন্ঠ শিল্পী মরহুম আব্বাস উদ্দীন আহমেদ।
আহা ! সেই গানের 'আথালি পাথালি পানি' আজ কোথায় হারালো ? তিস্তার এই চর আমরা চাইনি। এই চরাচরও নয়।বালুচরে এই শুভ্র কাশবনও দেখতে চাইনা। দেখতে চাই সেই-'আথালি পাথালি পানি।' যেখানে কোনো এক বর্ষার ভর দুপুরে নতুন কোনো আব্বাস উদ্দীন আবার গাইবে-

'ঢেউয়ের তালে পাওয়ের ফালে নাওয়ের গলই কাঁপে
তির তিরাইয়া নাওয়ের খৈয়াই রোইদ তুফান মাপে,
আরে খল খলাইয়া হাইসা উঠে, 
বৈঠার হাতল চাইয়া হাসে, বৌঠার হাতল চাইয়া।'

চিত্রা নদীর পাড়ে

এই অনন্তলোকে একটি ছায়ামূর্তি আমি দেখতে পাই। সদাই মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে তার।যাকে দেখা যায় তাকে চেনা যায়না। হাজার বছর আগে একবার দেখেছিলাম চিত্রা নদীর পাড়ে। সেই মুখ.সেই চোখ মনে ভেবে আমি এখনো গান ও কবিতা লিখে যাই।

নর্তকী জরিনা

সম্রাট আকবর তখন ফতেপুর সিক্রিতে থাকতেন। একদিন তিনি তার কাছে আসা অতিথীদের জন্যে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তিনি গায়ক তানসেনকে ডাকেন সেই অনুষ্ঠানে গান গাইতে। সম্রাট তানসেনকে বললেন, আপনার গানের সাথে সেখানে কাউকে নাচতেও হবে। তানসেন বললেন, আচ্ছা। আমি চেষ্টা করবো নর্তকী রাখতে কিন্তু আমি এখানে কোনো নর্তকীকে চিনি না। দাসীদের মধ্য থেকে কেউ একজন সম্রাট আর তানসেনের এই আলাপ শুনেছিলেন। সম্রাট চলে গেলে সেই দাসী তানসেনকে গিয়ে জরিনার কথা বললেন, এবং পরামর্শ দিলেন তানসেন যাতে জরিনাকে নাচার জন্য প্রস্তাব দেয়। যখন তানসেনের মতো বিখ্যাত গায়ক জরিনাকে সম্রাট আকবরের প্রাসাদে নাচার জন্য প্রস্তাব দিলেন তখন জরিনার বাবা আর না করতে পারলেন না।

জরিনা ফতেপুর সিক্রিতে চলে আাসার সময় বাবার কাছে বিদায় নিতে যান।বাবা জরিনাকে পরামর্শ দিলেন- একটা ব্যাপার মাথায় রাখবে, যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে বিপদও আছে। সাবধানে থাকবে, আর মনে রাখবে তোমার জন্য আমি সবসময়ই আছি। জরিনা প্রাসাদে গিয়ে আকবর এবং তার সভাসদদের সামনে সারারাত নাচলেন। জরিনার কাছে এটা ছিল স্বপ্ন সত্যি হওয়ার ব্যাপার। সম্রাট জরিনাকে এতো পছন্দ করলেন যে তিনি জরিনাকে প্রাসাদে রেখে দিলেন যাতে প্রয়োজন হলে তাকে ডাকতে পারেন। 

প্রাসাদের সবাই জরিনাকে পছন্দ করলেও রানী যোধা বাঈয়ের একজন দাসী জরিনাকে পছন্দ করলো না। সম্রাটের কাছ থেকে জরিনা বেশী মনোযোগ পাওয়ার কারণে মাধবী জরিনার প্রতি ঈর্ষাকাতর ছিলো। জরিনা যেন সম্রাটের চোখে অপরাধী হয় সেজন্য একটা বুদ্ধি বের করে মাধবী। রানী যোধা বাঈ যখন স্নান করছিলেন তখন মাধবী তার গয়নার বাক্স থেকে একটি সোনার বালা চুরি করে জরিনার জিনিসপত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। যোধা বাঈ যখন দেখে যে তার একটি বালা নেই তখন তিনি মারাত্মক ক্রোধান্বিত হয়ে সারা প্রাসাদ তল্লাশি করার নির্দেশ দিলেন। মাধবী তখন রানী যোধা বাঈকে বলে, আমি জরিনার ঘরে সেই বালাটি দেখেছি। বালাটি যখন জরিনার ঘরে পাওয়া গেলো যোধা বাঈ তখন রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি সম্রাট আকবরের কাছে গিয়ে নালিশ দিলেন,বললেন নর্তকী জরিনা একটা চোর। এই ব্যাপারে আপনি কী করবেন এখন? 

জরিনা তখন আকবরের সামনে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হুজুর, আমি বালা চুরি করিনি। সম্রাট আকবর তখন বললেন, তোমার ঘরে বালা কিভাবে পাওয়া গেলো সেই ব্যাখ্যা কি তুমি দিতে পারবে? স্বাভাবিকভাবেই জরিনার তখন বলার কিছু ছিলোনা। সে জানতোনা বালা কিভাবে তার ঘরে গেলো। সম্রাট মাথা নেড়ে বললেন, প্রমাণ যেহেতু দেখাই যাচ্ছে, জরিনা চোর এবং মিথ্যুক। চুরি করার শাস্তি হিসেবে হাত কেটে দেওয়া হবে। জরিনা তখন বলেন- হুজুর, আমি একজন নর্তকী। আমার হাত কেটে ফেললে আমি নাচবো কীভাবে?  তাছাড়া আমি চুরি করিনি। সম্রাট আকবর চিৎকার করে উঠলেন, চুপ ! আগামীকাল সকালে তোমাকে শাস্তি দেওয়াই হবে প্রথম কাজ। সম্রাট আকবর এরপর দরবার ত্যাগ করলেন।

জরিনা সারাদিন কাঁদলেন। রাতে জরিনা অন্যান্য দিনের মতই সম্রাটের সামনে নাচলেন। কিন্তু এটা আনন্দের নাচ ছিলোনা, এটা ছিলো খুবই ধীরগতির দুঃখের একটি নাচ। আকবরের সভাসদদের কেউই এতো সুন্দর নাচ জীবনে দেখেনি। তার নাচ আর দেখতে পারবেন না ভেবে আকবরও খুব দুঃখ পেলেন। 

পরের দিন সকালে আকবর তার সকল সভাসদদের ডাকলেন। তিনি একজন রক্ষীকে পাঠালেন জরিনাকে নিয়ে আসার জন্য। সারা প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও জরিনাকে পাওয়া গেলোনা। সে এসে সম্রাটকে এ কথা জানালো। সম্রাট আকবর জিজ্ঞাসা করলেন, কেউ কি জরিনাকে দেখেছে? সভায় উপস্থিত সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।

 তখন সভায় এক বৃদ্ধ লোক প্রবেশ করেন। সিংহাসনে বসা সম্রাট আকবরের সামনে গিয়ে তিনি বললেন, হুজুর, কোনো প্রমাণ ছাড়াই জরিনাকে অভিযুক্ত করে আপনি ভুল করেছেন। আকবর জরিনার বাবাকে চিনতে পারলেন। তিনি বললেন, জরিনা কোথায় আমাকে বলুন, আমি দেখবো তার সাথে যাতে ন্যায়বিচার ঘটে। জরিনার বাবা মাথা নেড়ে বললেন, অনেক দেরী করে ফেলেছেন আপনি। আর কিছুই করা যাবে না। আপনি আমার মেয়ের জীবনে অনেক দুঃখ এনে দিয়েছেন, আর ফতেহপুর সিক্রি অবশ্যই এই বেঈমানির শাস্তি পাবে। বৃদ্ধ লোকটির এই কথার অর্থ কী আকবর তা জিজ্ঞাসা করার আগেই সেই লোকটি ভিড়ের মধ্যে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

দুই সপ্তাহ পরে ফতেহপুর সিক্রির কুয়াগুলি শুকিয়ে গেলো। সম্রাটের উট ও ঘোড়ার জন্য এবং মানুষের জন্য কোনো পানি আর কুয়াগুলিতে অবশিষ্ট ছিলো না। সম্রাট আকবর তার স্ত্রীদের ও সন্তানদের নিয়ে আগ্রার দুর্গে গিয়ে উঠলেন। তারা আর কখনোই ফতেহপুরে ফিরে আসেননি। 

সিক্রি গ্রামে এই গল্প এখনো প্রচলিত আছে। গ্রামের কেউ কেউ বলে যে পূর্নিমা রাতে ফতেহপুর সিক্রির প্রধান ফটক, বুলন্দ দরজাতে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা বলে যে এটা আসলে মাধবী, সে জরিনার জন্য অপেক্ষা করে যাতে তার কাছে ক্ষমা চাইতে পারে।

তথ্যসূত্র : 1,The Hindu: Akbar's folly  2. quora.com 3. Natunsomoy.                                                                                               . 
                                                                                               

শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৭

তুমি গীতি কবিতা

তোমাকে নিয়ে গীতি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম হলোনা
তোমাকে নিয়ে গানে সুর সাজাতে চেয়েছিলাম তা হলোনা
কবিতার কোনো ছন্দে তুমি নেই
গানের  কোনো কথায় তুমি নেই
তোমাকে নিয়ে বাঁধতে চেয়েছিলাম ঘর তা আর হলোনা
তোমাকে নিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম স্বপ্ন তা আর হলোনা
যদি মনে পড়ে আমায় কবিতায় এসো
যদি সুরে ভাসে প্রাণ তবে গানে এসো
তোমাকে নিয়ে তাজমহল গড়তে চেয়েছিলাম তা হলোনা
তোমাকে নিয়ে গীতি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম হলোনা



তুমি আসো

দমকা বাতাস জানালা দিয়ে প্রবেশ করতে যেমন অনুমতি নেয়না-
তেমনি কোনো অনুমতি ছাড়াই তুমি চলে আসো আমার ঘরে-
'তোমার ঐ দেহখানি তুলে ধরো,আমার এই দেবালয়ের প্রদীপ করো।'।'

আলোর প্রতিধ্বনি

দুইটি জীবন চলছিলো আলাদা আলাদা করে। দুইটি নদী যেমন ভিন্ন ভাবে প্রবাহিত হয় তেমনি। দুই নদী কি কখনো এক হতে পারে ? কিন্তু আমরা হয়েছিলাম, আমরা একই মোহনায় মিশেছিলাম, যেনো এক জীবন ছুঁয়ে ফেললো আরেক জীবনকে। এ যেনো এক বিস্ময়কর নিয়তির খেলা।

তারপর নদীর জল তরঙ্গায়িত হলো। ছোটো ছোটো ঢেউ তৈরী হলো।নতুন আরো জীবন এলো। সব যেনো এক অদ্ভূত প্রেমে বাঁধা। মনে হয় এই প্রেম আছে, আবার মনে হয় প্রেম নেই। জীবনের এই সব রহস্য বুঝতেই এক জীবন চলে গেলো।

জীবনের যতোটুকু সুখ তা হঠাৎ আলোর প্রতিধ্বনি মতো ক্ষণকালের। জীবন চলছে জীবনের দিকে- কখন এই চলা শেষ হয়, জানেনা কেউ। আমরাও চলছি অচেনা একটি প্রান্তের দিকে যাকে বলে মানুষের Death end.
                                                                                                                                           

বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৭

চন্দনে মৃগপদচিহ্ন

কবি সাংবাদিক সাজ্জাদ কাদির আর নেই।
আপনি কাউকে না বলে, হঠাৎ করে এই ভাবে চলে গেলেন।

ফেইসবুকে নিউজ ফিডে আপনি প্রতিদিন থাকতেন।আমি অনেক লেখায় লাইক দিতাম। আর আজকে আপনাকে নিয়ে আমাকে স্টাটাস লিখতে হচ্ছে। যা নিউজ ফিডে থাকবে। সবাই দেখবে, শুধু আপনি দেখতে পাবেননা। মাত্র দুই দিনের জ্বর সইতে পারলেননা কবি।আপনি সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন,। আপনার কালজয়ী সৃষ্টি ' চন্দনে মৃগপদচিহ্ন' ও 'দূরতমার কাছে' র বই দু'টি হাতে নিয়ে উদাস নয়নে পৃষ্ঠার পর উল্টিয়ে যাচ্ছি আর পড়ছি এবং  চোখের কোনে জলে ভরে উঠছে। Rest in Peace,-  Sazzad Quadir' আমিন।


কালা চোর

ঘটনাটি ঘটেছিলো এক অস্থির সময়ে। ১৯৭৬ সালের মার্চ এপ্রিলের দিকে হবে । গ্রামে গঞ্জে তখনো পুরোপুরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। জাসদের গণ বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির খুন খারাবী, নক্সালদের হাতে গুম খুন লুট - গ্রাম এলাকায় তখন চরম ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু এইসব নৈরা্জ্য দমন শুরু করেছিলেন বটে কিন্তু পঁচাত্তরের আগস্টে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান অবশ্য এইসব অরাজকতা কঠোর হস্তে দমনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

ছেলেটির নাম কালা। গায়ের রং ছিলো কুঁচকুঁচে কালো। ২১/২২ বছরের সুঠাম যুবক। ওর বাবার নাম ছিলো দানেশ। পেশায় চোর। সিধেল চোর যাকে বলে। দানেশ তার ছেলে কালা'কেও চৌর্য পেশায় নামায়। ওদের একটা নীতি ছিলো-, ওরা কখনো নিজ গ্রামে কিংবা আশে পাশের গ্রামে চুরি চামারী করতোনা। দূর গাঁয়ে সিঁদ কেটে  চুরি করতো। তবে কখনো কাউকে খুন জখম করেনি। চোর হিসাবে ওরা খুবই নিরীহ ও ভদ্র ছিলো।

একদিন আশে পাশের ৩/৪ গ্রামের কিছু মানুষ কালাকে ধরে এনে শালিসে বসায়। শালিসটি বসেছিলো আমাদের পাশের গ্রামের এক স্কুল ঘরে। আর কালাকে শালিস চলাকালীন সময়েই বেদম মারপিট করে আড়মরা করে বেঁধে রেখেছিলো স্কুল মাঠের গাছের সাথে। ওর শরীরের বিভিন্ন জখম থেকে তখন রক্ত ঝরছিলো। ঐ শালিসের অন্যতম বিচারক ছিলো-পাশের গ্রামের এক যুবক। বিচারে রায় হয় কালার মৃত্যদন্ড।

তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। সকাল থেকে কালা অভুক্তই ছিলো। তখনো তাকে গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা ছিলো। ওর অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী ওকে দেখতে আসে। কালা তখনো জানেনা তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়েছে। ওর স্ত্রী ওর পাশে বসে কাঁদতে থাকে। স্ত্রীর এই রকম অঝোর ধারায় কান্না দেখে কালা মনে হয় লজ্জা পাচ্ছিলো। কালা ওর স্ত্রীকে বলে- 'কান্দিতোছো ক্যান,বাইত চইলা যাও।' ওর স্ত্রীর হাত ধরে  ছল ছল চোখে তাকিয়ে থেকে আবার বলে- 'কাইন্দোনা,বাইত যাও।'

স্কুল ঘর থেকে পাশের গ্রামের যুবকটি বের হয়ে আসে। গরুকে যেভাবে মাঠে নিয়ে যায়, ঠিক তেমনি ভাবে ঐ যুবক কালাকে  টেনে বেঁধে দূরে বিরাণ মাঠের দিকে নিয়ে যায় । প্রায় পাঁচশত গজ ফাঁকে শতো শতো মানুষ তখন দর্শক হিসাবে দাড়িয়ে দেখছিলো সব । দূর হতে দেখা গেলো- সেই যুবক কালাকে বেওনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মেরে ফেলছে। কালার রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকে নির্জন প্রান্তরে ধানক্ষেতের ভিতর।

ততোক্ষণে পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্তমিত হয়েছে। মসজিদে আযান  হচ্ছে। মন্দিরে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠেছে। শতো শতো মানুষ ঘরে ফিরছে। কেউ উল্লাস করছে। কারো চোখে মুখে বিষাদ। হতভাগ্য কালা চোরের লাশটি ধানক্ষেতেই পড়ে থেকেছিলো সারারাত। লাশটি দাফন হয়েছিলো, না শিয়াল কুকুরে খেয়েছিলো,আজ আর তা মনে নেই।






বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৭

পৃথিবী ( The Earth )

সে এক অস্থির সময়ের কথা। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। পুরো দেশ একটি ধবংস স্তুপ। বঙ্গবন্ধুকে সবকিছু গড়ে নিতে হচ্ছিলো। গ্রামে গঞ্জে তখনো পুরোপুরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। আমার তখন কিশোর বয়স। আমাদের গ্রামের একটি গরীব মেয়ে অভাবের তাড়নায় পয়সার বিনিময়ে নিজের দেহ দান করতো কারো কারো কাছে। একদিন সন্ধ্যারাতে জানতে পারলাম, ঐ মেয়েটিকে আজ রাতেই মেরে ফেলবে,গ্রামেরই কিছু যুবক শ্রেণীর মানুষ। মেয়েটির অপরাধ,সে গ্রামের যুবকদের চরিত্র নস্ট করে ফেলছে।

খবরটি শোনার পর মনটা ভালো লাগছিলোনা। কেমন যেনো ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমি নিতান্তই একজন কিশোর বালক ছিলাম,কি-ই-বা আমি করতে পারি ? মেয়েটি যেহেতু আমার গ্রামেরই,তাই ওকে দেখেছিও অনেক।মেয়েটার মুখচ্ছবি কেবল চোখে ভেসে উঠছিলো। অনেক অজানা আশংকা ও ভয় নিয়ে সে রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সকালবেলা ঐ 'কিছু যুবক শ্রেণীর মানুষ'দেরই একজনের কাছ থেকে রাতের প্রত্যক্ষ ঘটনা জানতে পারি। প্রথমে তারা মেয়েটিকে ওদের বাড়ী থেকে উঠিয়ে নেয়।,পরে দূরে নির্জন নদীর কূলে একটি পিটেসরা গাছের নীচে ওকে নিয়ে যায়।সেখানে সবগুলো যুবক পালাক্রমে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে এবং পরে চোখ বেঁধে বেওনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে এবংং সেখানেই গর্ত খুরে মাটির নীচে ওকে পুতে রাখে।

ধর্ষণ শেষে ওরা যখন মেয়েটির চোখ বাঁধবে, তখন নাকি মেয়েটি অনুনয় করে বলেছিলো- 'তোমরা শেষবারের মতো একটিবার আমাকে এই পৃথিবীকে দেখতে দাও।' মেয়েটি অন্ধকারের মাঝেই চোখ মেলে দেখেছিলো চারদিকের রাতের পৃথিবীকে,দেখেছিলো তারাভরা রাতের আকাশকে।

যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন

আজকে আমার পুরানো বাড়ীটিতে গিয়েছিলাম।কেমন  জীর্ণ হয়ে গেছে বাড়ীটি। কোনো এক সময় গ্রামীন পরিবেশের এই বাড়ীতে আমার হাজার পদচিহ্ন পড়েছিলো। তখন সবকিছু ঝকমক করতো। বারান্দাটা খোলা ছিলো।সেখানে ইজি চেয়ার পাতা থাকতো। ঘরের সামনে ফুলের বাগান ছিলো। এখন এসব কিছুই নেই। ডানদিকে করমচা গাছটি এখনো আছে। বিশ্ববিদ্যাালয়ের হল ছেড়ে প্রথম এই বাড়ীতে এসে উঠেছিলাম। বিয়ে করে নতুন বউ এনেছিলাম এই বাড়ীতেই। এর আঙ্গিনায় আমার বাবা,মা.শ্বশুর,শ্বাশুরী,আমার বড়ো দুই বোনের পদচিহ্ন লেগে আছে। তারা আজ আর কেউ নেই। চলে গেছেন পরপারে। আমার ছেলেমেয়েদের শিশুকালও কেটেছে এই বাড়ীতে।কতো যে কলমুখর ছিলো এই বাড়ী।আজ সব নস্টালজিক।

কেমন যেনো বিষাদ আমাকে কাঁদায়। কতো যে মায়া তৈরী হয়েছিলো এই বাড়ীটি ঘিরে।সব মায়া ছিন্ন করে এক সময় এ বাড়ী ছেড়ে চলে আসি।আমার কোনো পায়ের চিহ্ন পড়েনা আর এই বাড়ীর আঙ্গিনায়। আত্মা এখানো আমাকে টানে।হয়তো ফিরে আসবো এখানে বারে বারে,যতোদিন বেঁচে থাকি।

রবি ঠাকুরের এই গানটি শুনতে ইচ্ছা করছে -
'যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।;

তারিখ: ৫/৪/২০১৭ ইং
উত্তরা, ঢাকা।


কিছু স্বপ্ন আছে

কিছু স্বপ্ন আছে কাছে রাখতে নেই। কিছু স্বপ্ন আছে যা দেখতেও নেই। ভাবছি, এগুলো সব যমুনার জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসবো। ওগুলো জলেই ভাসুক।

সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৭

সকালের আলিঙ্গনে

সারারাত মেঘের ঘনঘটা ছিলো,বৃষ্টি ছিলো
স্বপ্ন মাধবীরা এসে ভর করেছিলো ক্ষণে ক্ষণে,
সকালবেলা প্রতিক্ষা করছি দখিনের জানালা খুলে
মাতাল হাওয়ায় আসছো তুমি নগ্ন বাহুর আলিঙ্গনে।
নীলাম্বরীর নামটিই শুনেছি দেখিনি কখনো তারে
আজ ওকে খুঁজতে বের হবো-
,যেখানে পাই পার্কে,লেকের পাশে কিংবা ঝোঁপ ঝারে ।
ছবি :নীলকণ্ঠ ফুল।