রবিবার, ২৮ জুন, ২০২০

টেন্ডু পাতার বিড়ি

টেন্ডু পাতার বিড়ি

  
আমার প্রথম ধূমপানখড়ি হয়  পাতায় বানানো বিড়ি দিয়ে। স্কুলে টিফিনের সময় চার আনার বাতাম কিনে চারজন খেতাম। আমি সাইফুল, আমিনুল ও ফটিক।  বাদাম খাওয়ার পর স্কুলের পাশে ভাঙা রথ ঘরের ভিতর আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে  চারজন চারটা টেন্ডু পাতার বিড়ি ধরিয়ে টানতাম। 

তারপর অনেক বছর চলে গেছে। কালের বিবর্তনে ধূমপানের ব্রান্ডটিও আমার পরিবর্তন হয়েছে। তিস্তা, মিতালি, কিং স্ট্রং থেকে স্টার, ক্যাপস্টেন। গোল্ডলিফও খেতাম।  বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ষেদিন বাবার পাঠানো মানি অর্ডার পেতাম, সেদিন মনের আনন্দে লন্ডন ব্রান্ড  555 কিনে খেতাম দুই এক শলা।     

সহপাঠি বন্ধু ইকবাল হোসেন বাদল মাঝে মাঝে যখন হলে আমার রুমে এসে থাকত, তখন ঐ কদিন রেগুলার লন্ডন 555  খেতাম। বাদল ছিল ঢাকার স্থানীয় বড়োলোকের পোলা। গোড়ানের চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে। ও খেত  555, বাদল যে কয়দিন থাকত, সে কয়দিন আমার আর সিগারেট কিনতে হতো না। ঐ-ই কিনত। আমি খেতাম মাংনা।    

আমেরিকাতে ছিলাম মাস তিনেক। ওখানে খেতাম মার্লবরো হার্ড। লাসভেগাস থেকে এসেছিল কোভা নামে একটি মেয়ে।  কোভা আমার খুব ভালো বন্ধু হয়েছিল, ও খেত মার্লবরো লাইট। ওর কারণে ব্রান্ড বদল করে মার্লবরো লাইট ধরেছিলাম। হলিউডে সিনে মেকআপ আর্টিস্ট্রির উপর একটি  ওয়ার্কশোপে আমরা যোগ দিয়েছিলাম। ওয়ার্কশপ শেষে উইলটার্ন বিল্ডিংয়ের সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসে স্মোকিং জোনে আমি আর কোভা সিগারেট ধরিয়ে টানতাম। 

একদিন বিকালে কোভা বলছিল -- হাবিব,  চলো সান্তা মনিকা বীচে যাই।  বললাম -- কেন? 

আজ আমার মন ভালো লাগছেনা।  

আচ্ছা,  চলো যাই। 

বীচে দুজন বালু আর ছোটো ছোটো ঝিনুকের উপর পা মাড়িয়ে হাঁটছিলাম। কোভা খুব বেশি কথা বলছিল না। প্যাসিফিকের জল ছিল সেদিন শান্ত। ওর চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, চোখ দুটো সমুদ্রের নীল জলের মতো স্থির ও শান্ত হয়ে আছে। আমি ওকে বলি -- 'কী হয়েছে তোমার?  মন খারাপ করে আছ কেন?'

ও ওর ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করে একটি  সিগারেট ধরায়। আমাকেও বলে -- 'খাবে নাকি একটা?' দেখলাম -- আজকের সিগারেট মার্লবরো লাইট নয়। অন্য আর একটি ব্রান্ডের সিগারেট।  আমি একটি স্টিক নিয়ে ধরালাম এবং টানতে থাকি। সিগারেটটি টান দেওয়ার পর  আমার শরীর আস্তে আস্তে কেমন যেন হিম শীতল হয়ে আসছিল। আমার ইন্দ্রিয়ে অদ্ভুত এক সুখানুভূতি অনুভূত হচ্ছিল।
 
মানুষ কত ভাবে দুঃখ সরিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সুখ খোঁজে কত কিছুর ভিতর। সেদিন সেই অস্ত-সন্ধ্যা বেলায় কোভা কী ওর দুঃখ সরিয়ে দিতে পেরেছিল সিগারেটে ! সে কথা আর ওর কাছে থেকে জানা হয়নি। শুধু মনে হয়েছিল -- ' আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন-- আমার  ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন।'

তো, যে কথা বলছিলাম --  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার প্রায় পনেরো বছর পরের কথা।  কয়দিন ধরেই সেই স্কুলবেলার টেন্ডু পাতার বিড়ি খাওয়ার কথা খুব  মনে পড়ছিল। খেতেও ইচ্ছে করছিল ভীষণ।  ঢাকায় এই বিড়িটি কোথাও পাওয়া যায় না।  কী করা যায় !  একদিন আমার সেই বাল্য সহপাঠি বন্ধু  সাইফুলকে পত্র লিখলাম--'সাইফুল, আমার খুব টেন্ডু পাতার বিড়ি খেতে ইচ্ছে করছে।  এখানে পাচ্ছি না। তুই টেন্ডু পাতার বিড়ি যোগার করে রাখবি। আমি খুব শীঘ্রই আসছি।  একসাথে দুজনে বিড়ি টানব। '
     

কয়েক দিন পর আমি বাড়িতে যাই।  সাইফুলের সাথে আমার দেখা হয় না সে অনেক বছর।  আমি একদিন দ্বিপ্রহরেের আগেই দুই মাইল দূরে আমিনপুর গ্রামে সাইফুলদের বাড়িতে সাইকেল চালিয়ে  চলে যাই।  সাইফুল আমাকে দেখে তো বেজায় খুশি।  সেই কত বছর পরে দেখা। ও ম্যাট্রিক পাস করার পর অভাব অনটনের কারণে  আর পড়ে নাই। জমি জমা যা আছে, তাই দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে।      
                   
ওর থাকার ঘরে বিছানার উপর  আমাকে বসতে দেয়। একটু পর ওর স্ত্রীকে অনেকটা জোর করে টেনে আমার সামনে নিয়ে আসে।  ওর স্ত্রীকে বলে-- 'এতদিন তো হাজারো বার আমার এই  বন্ধুটির কথা তোমাকে বলেছি । আজ ওকে দেখো চক্ষু মেলিয়া।' 

একটুপর সাইফুল এগারো বারো বছরের একটি বালিকাকে পরিচয় করিয়ে দেয়।  বলে -- 'এই হচ্ছে আমার মেয়ে মরিয়ম। ক্লাস সিক্সে পড়ে।  খুব ভালো ছাত্রী।  রোল নং ২, সাইফুল ওর মেয়েকে বলে -- ইনি আমার বাল্য বন্ধু।  তোমার চাচা হয়।  পায়ে হাত দিয়ে সালাম করো।'

মরিয়ম আদুরী আদুরী খুব লক্ষ্মী মেয়ে। দেখতেও খুব মায়াবী এবং রূপন্বিতা। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি-- তুমি বেঁচে থাকো মা,  ভালো ভাবে লেখা পড়া করবে। ' সাইফুলের স্ত্রী ও মেয়ে অন্য ঘরে চলে গেলে আমি সাইফুলকে বললাম -- 'বিড়ি কই,  বিড়ি দে।'  সাইফুল এক বান্ডিল টেন্ডু পাতার বিড়ি কই থেকে যেন যোগার করে এনেছে।  আমাকে বিড়ির বান্ডিল  দিয়ে বলে -- 'নে, বসে বসে খা।'  এখানে এই বিড়ি পাওয়া যায় না।  হিলি বর্ডার থেকে আনিয়েছি। যে কয়টা পারিস খা। বাকীগুলো নিয়ে যাবি।'          

সেই কতকাল পরে দুই বন্ধু বসে বসে মনের সুখে বিড়ি টানলাম। কী যে ভালো লাগছিল, কী যে ঘ্রাণ ছিল বিড়ির। সেই কত বছর আগের রথ ঘরে বসে বিড়ি খাওয়ার কথা মনে পড়ছিল। সেই অনাবিল  ঘ্রাণ,  সেই স্বর্গীয় আনন্দ।       

দুপুরে সাইফুল না খেয়ে আসতে দেয়নি।  ওর বউ ধনিদহ বিলের বোয়াল মাছ, আর ওদের নিজেদের  পালন করা হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ায়ে দিয়েছিল। দারুণ সুস্বাদু ছিল ওর বউয়ের রান্না। 

ভাত খেয়ে বিছানার উপর বসে আবারও দুজন বিড়ি ধরাই। দুইজনই বিড়ি টানতে থাকি।  সাইফুল বিষাদ জড়িত কণ্ঠে বলছিল -- 'তোকে একটা কথা বলা হয় নাই। ' 

আমি বললাম -- কী কথা, বল্ ? 

-- মরিয়মের খুব অসুখ। 

--- কী অসুখ! 

--- আজ দশ পনেরো দিন ধরে ভিতরে ভিতরে খুব জ্বর।  ভালো হচ্ছে  না। 

--- শহরে নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবি।  

--- আচ্ছা। 

আমি ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম,  কোনো করুণা কিংবা দয়া না।  তোর মেয়ে আমারও মেয়ে। টাকাগুলো রাখ্।  মরিয়মের চিকিৎসা করাবি। ' আমি ওকে আরও বললাম -- আল্লাহ খারাপ কিছু না করুক --যদি মনে করিস ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে।  তাহলে চলে আসিস আমার বাসায়। 

আমি যখন চলে আসি, মরিয়ম কাছে এসে বলেছিল --
চাচু, তুমি আবার এস।       

আমি ঢাকায় চলে আসি। এরপর আরও কয়েকমাস চলে যায়।  বিভিন্ন কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে যাই। সাইফুলের মেয়েটার আর খোঁজ নেওয়া হয় নাই। অনেকটা  'পৃথিবীতে কে কাহার?' এর মতো উপেক্ষা , এবং ভুলে থাকা । 

তারও অনেক পরে -- একদিন জানতে পারি যে, সাইফুলের মেয়েটার নাকি লিউকেমিয়া হয়েছিল এবং সে মারা গেছে। 
     

২৯ জুন, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।  
                                                                                                     

                
                               
                               
                                                     
                                                                   

শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০

পরিচ্ছেদ ৭

শহীদুলের ওখান থেকে বাড়িতে এসে রোহিত বিছানায়  শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ভেবেছিল একটু ঘুমাবে। কিন্তু ঘুৃম আসে নাই চোখে। ছায়া রাণী  চা বানিয়ে এনে বলে -- 'দাদা, ওঠো  খেয়ে নাও।'  রোহিত চা খেতে খেতে ছায়াকে বলে -- 'পুরনো জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত কূপ দেখতে যাব, যেখানে মা, বাবা, বড়ো দা, বৌদিদি  ও রোহিনীর লাশ ফেলে দিয়েছিল। তুইও চল্ আমার সাথে।'

--- আচ্ছা, যাব তোমার সাথে।            

রোহিত ও ছায়া রাণী  বিকালের গোধূলি লাল আভার ছায়া পড়া  সবুজ মাঠের পাশে দিয়ে হেঁটে হেঁটে জমিদার বাড়ির কূপটির কাছে চলে যায়। রোহিত দেখতে পায় স্থানীয় মুুুুক্তিযোদ্ধা সংসদ কূপটিির পাশে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছে। বেদিতে সব শহীদদের নাম লেখা আছে।  সেখানে ওর বাবা মা ভাই বোনদের নামও লেখা আছে। রোহিত ও ছায়া রাণী সৌধের পাদমূলে দাঁড়িয়ে নিরবে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং তাদের  আত্মার শান্তি কামনা করে ।  

তারপর দুজন হেঁটে যেয়ে কূপের পাশে দাঁড়ায়। মাথা নত করে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে কূপের নীচ তলায়। কেমন আঁধার সেখানে। কবরের মতো অনন্ত অম্বর যেন। কূপের ভিতর থেকে রোহিত শুনতে পাচ্ছিল মায়ের কান্নার শব্দ আর রোহিনীর করুণ আর্তনাদ। রোহিত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করতে থাকে। কূপের তলা থেকে সে শুনতে পাচ্ছিল, কে যেন ওকে বলছে, অনেকটা ওর বাবার কণ্ঠস্বরের মতো করে -- ' ওরে ভয় নাই, নাই স্নেহমোহবন্ধন, ওরে আশা নাই, আশা শুধু মিছে ছলনা। ওরে ভাষা নাই, নাই বৃথা বসে ক্রন্দন, ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজরচনা।'

রোহিত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু চোখে ছিল তার জলের ধারা।    
 
ছায়া ওর দাদাকে বলছিল -- চলো দাদা, ঘরে ফিরে যাই ।  

সন্ধ্যা পূর্বেই  রোহিত ও ছায়া বাড়ি চল আসে। রোহিত ঘরের ভিতর না ঢুকে ছায়াকে বলে -- আমকে উঠোনে জাম্বুরা গাছ তলায় একটি চেয়ার বের করে দে। ওখানেই কতক্ষণ একা একা বসে থাকব।   

ছায়া ঘর থেকে পুরানো হাতলওয়ালা একটি চেয়ার বের করে দেয়। রোহিত চেয়ারটা দেখে চিনতে পারে। এ রকম চেয়ার আরও একটি ছিল। প্রায়ই চাঁদনী রাতে ওর বাবা মা উঠোনে চেয়ারে বসে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করত । কত কথা বলত ফিসফিস করে। চাঁদ ডুবে গেলে তারপর ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়ত।'  আজ মনে হচ্ছে -- সবই ছিল তাদের মহব্বত, সবই ছিল প্রেম। 
                          
রোহিত অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে উঠানে। আজ আকাশে কোনো চাঁদ উঠল না। তারা' রা বিচ্ছিন্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে জ্বলে আছে আকাশে। আজ --- যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে, / সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া, / যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে, / যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া, / মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে।'
              
পরের দিন সকালে রোহিত নাস্তা করতে বসে  ছায়াকে বলে -- আমাদের জমিজমা, বাড়ি, পুকুর, বাজারের দোকান, দুটো আমবাগান এগুলো কী ভাবে রেকর্ড হয়েছে? তুই জানিস? 

--- পিপুল বাড়িয়ার ইয়াকুব চেয়ারম্যান নিজে তদারকি করে তোমাদের সব জায়গা জমি তোমার নামে রেকর্ড করে দিয়েছেন। জমির সব পর্চা ও কাগজপত্র আমার কাছে আছে। তুমি সেগুলো দেখতে পারো। জানো দাদা, ইয়াকুব চেয়ারম্যান মুক্তি যোদ্ধা ছিলেন। উনি খুব ভালো মানুষ ছিল।  এই ভালো মানুষটিকে সর্বহারা পার্টির লোকেরা দিনের বেলায় ইউনিয়ন বোর্ডের অফিসের ভিতর কুপিয়ে হত্যা করে।   

-- কাগজপত্র যা আছে তোর কাছে আপাতত থাক। আমি পরে দেখব সব।  আমার কিছু কাজ আছে। পরে তোর কাছ থেকে নিয়ে নেব। আর মরহুম ইয়াকুব আলী চেয়ারম্যানের আত্মার শান্তি কামনা করছি। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ওপারে যেন ভালো থাকেন।                                                              

নাস্তা খাওয়া যখন শেষের দিকে তখনই শহীদুল চলে আসে। ছায়া শহীদুলকে বলছিল -- দাদা আপনাকেও নাস্তা দেই। 

-- আমি নাস্তা করে এসেছি।

-- তাহলে আপনাদের চা করে দেই। 

-- না। চা দিতে হবে না।  আমি আর রোহিত পিপুল বাড়িয়া বাজারে যেয়ে চা খেয়ে নেব।    


যেতে যেতে পথে  শহীদুল রোহিতকে বলছিল -- 'আবার কোন্ জনমে তুই আসবি, চল্ --  আমাদের স্কুলটা একটু দেখে যা।'     

ওরা দুজন হেঁটে হেঁটে স্কুল আঙিনায় চলে আসে।  রোহিত স্কুল আঙিনা দেখে হতবাক!  কোথাও নেই আগের সেই শান্ত সৌম্য নিরিবিলি পরিবেশ। কোথায় হারিয়ে গেছে আঙিনা বেষ্টিত সবুজ বৃক্ষরাজি।  তখনকার সেই আমগাছ, ঝাউ গাছ, দেবদারুর ঝাড়, সুপারি গাছের সারি, ছাতিম গাছ, এসবের  চিহ্ন কোথাও নেই।  আগে স্কুল ঘরটা ছিল বিশাল লম্বালম্বি, এবং সামান্য এল্ প্যাটার্নের। এখন তার পাশে অপরিকল্পিত ভাবে বিল্ডিং উঠানো হয়েছে।  স্কুল আঙিনার অন্য এক পাশে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। উঠানো হয়েছে  এলমেল ভাবে  স্টাফ কোয়ার্টার আর হোস্টেল। এই গিঞ্জি পরিবেশ দেখে রোহিতের মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়।                                                                     
ছুটির দিন ছিল ঐদিন। ছাত্র ছাত্রীদের মুখর করা কোলাহল ছিল না। রোহিত শহীদুলকে বলছিল -- দেখ্ -- মাঠের ঐ কোণে একটি আম গাছ দেখতে পাচ্ছি। ওখানে আগেও একটি এমন আম গাছ ছিল। কিন্তু এই গাছটি দেখে  নতুন মনে হচ্ছে। 

-- আগের সেই গাছটি মরে গেছে।  এই গাছটি নতুন করে ঠিক একই জায়গায়  পরে লাগানো হয়েছে। 

--- চল্,  ঐ গাছটার নীচে ঘাসের উপর দুজন কিছুক্ষণ বসে থাকি। 

--- আচ্ছা,  চল।                                    
         
ওরা দুজন আমগাছের নীচে যেয়ে বসে। রোহিত বলছিল -- ' তেমন কাউকে তো কোথাও দেখছি না। একটা  সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। খাওয়া যাবে? 

শহীদুল এদিক ওদিক তাকিয়ে বলছিল -- কেউ তো নেই। কেই দেখতে পাবে না। সিগারেট ধরাতে পারিস।                       

সিগারেট টানতে টানতে রোহিত শহীদুলকে বলছিল -- তোর মনে আছে? টিফিনের সময় স্কুল ঘরের পিছনে লুকিয়ে লুকিয়ে আমি তুই ও দত্তবাড়ি গ্রামের রতন -- আমরা তিনজন টেন্ডু পাতার বিড়ি খেতাম।  রতন হরিপুর গ্রাম থেকে আসা সেতারা নামে একটি মেয়েকে খুব পছন্দ করত, ভালোও বাসত একতরফা। ও শুধু দূর থেকেই মেয়েটিকে ভালো বেসে গিয়েছিল। কোনো দিন তা মেয়েটিকে বলে  নাই। যেন শুধুই  --

'মনে রয়ে গেল মনের কথা-- শুধু চোখের জল, প্রাণের ব্যথা। মনে করি দুটি কথা বলে যাই, কেন মুখের পানে চেয়ে চলে যাই।'

সেই রতন এখন কোথায় আছে, কেমন আছে? দূর দেশে কত মনখারাপিয়া মুহূর্তে  ওর কথা খুব মনে পড়ত। ওর সেই সারল্য মুখ, নিষ্কলুষ চাহনি, সব সময় চোখের সামনে দেখতে পেতাম। কী ভালো ছেলে ছিল।  খেপালে একটুও রাগ হতো না কখনও। মুখে একটি স্মিত হাসি লেগেই থাকত সবসময় ।  
                             
-- রতন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য ভারতের বালুঘাট গিয়েছিল।  আরও কয়েকজন যুবকের সাথে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ও সেখানে যায় । তখন ছিল শ্রাবণ মাস। ওরা প্রথম উঠেছিল পুণর্ভবা নদীর তীরে  স্থাপিত একটি স্মরণার্থী শিবিরে। ক্যাম্পের  অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ওর ডায়রিয়া হয়েছিল। অনেকটা বিনা চিকিৎসায় রতন সেখানে   মৃত্যু বরণ করে।                                   
           
-- এই দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হওয়া  হতভাগ্য রতনের নাম নিশ্চয়ই তালিকায় নেই। এই রকম কত শহীদের নাম অলিখিত রয়ে গেছে। কত তরুণ অকাতরে বিলিয়ে গিয়েছে তাদের প্রাণ! তারা বাংলাদেশের আকাশে  তারা হয়ে মিটিমিটি করে জ্বলে থাকবে।

কেউ চলে গেছে, কেউ ফিরে এসেছে, কেউ হয়ে গেছে নিখোঁজ,  কেউ আছে মিনারে অভিজ্ঞান হয়ে চিরন্তন, তারা রবে --  

'অনন্ত আকাশে অনন্তকাল,    
কখনো নদীর স্রোতে মৃত গাধা
ভেসে যেতে দেখেছি সন্ধ্যায়,
দেখেছি একদা যারা হৈচৈ করে যুদ্ধে
গেছে তাদের ক’জন
মহৎ স্বপ্নের শব কাঁধে নিয়ে হেঁটে-হেঁটে
ক্লান্ত হয়ে ফের
স্বগৃহে এসেছে ফিরে।'

শামসুর রাহমানের কবিতা।    
               

--- চল্,  পিপুলবাড়িয়া বাজারে যাই।  ওখানে চা'র দোকানে বসে বসে চা আর সিগারেট খাই গে।  তোর মন ভালো লাগবে।           

--- সিগারেট একটু বেশি খাওয়া হচ্ছে না?  

--- এই তো এই কটা দিনই একটু বেশি খাব। যে কয়দিন তোর সাথে আছি।           

বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন, ২০২০

পরিচ্ছেদ -- ৬

বহু বছর পর রোহিত যাচ্ছে শহীদুলদের বাড়িতে। কৈশোরে আর তারুণ্যে  কত সময় ওরা দুজন একসাথে কাটিয়েছে।  প্রায়ই শহীদুল চলে যেত রোহিতদের বাড়িতে,  না হয় রোহিত আসত শহীদুলদের বাড়িতে। চিরকালের সেই চেনা পথ দিয়েই রোহিত আজ চলে আসে শহীদুলদের বাড়িতে।  বাড়ির বড়ো উঠোনেই ওর সাথে দেখা হয়ে  যায়। পয়ত্রিশ বছর পর দেখা। কিন্তু চিনতে একটুও অসুবিধা হয়নি।  কোনো দ্বিধা না করেই  শহীদুলকে রোহিত বলে -- 'তুই কেমন আছিস শহীদুল?' শহীদুলও রোহিতকে চিনে ফেলে এবং জড়িয়ে ধরে বলে -- 'রোহিত, তুই? এত বছর পর তোর দেখা পেলাম।'  
দুই বন্ধু আপ্লূত হয়ে কিছু সময়  একে অপরকে  জড়িয়ে ধরে থাকে। খুশির আনন্দ অশ্রুতে ভিজে যায় দুজনেরই নয়ন।
                               
শহীদুল রোহিতকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় বাড়ির ভিতরে। বিছানায় বসিয়ে ওর স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে আসে। রোহিতকে দেখিয়ে পরিচয় করে দিয়ে  বলে, এই হচ্ছে রোহিত।  আমার প্রাণের বন্ধু। যার কথা তোমাকে কত লক্ষ বার যে বলেছি।    

অনেক বছর পর দুই বন্ধু দুজনকে কাছে পেয়ে নানা অতীত স্মৃতিচারণ করতে থাকে।  রোহিত শহীদুলকে বলে -- তোর কথা কিছু বল, কত ঘটনা ঘটে গেছে এই পয়ত্রিশ বছরে ! বল, শুনি।  
  
শহীদুল বলছিল -- 'জীবনে কত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি অপূর্ণতা রয়ে গেল। কতকিছু পেয়েছি যেমন, আবার হারিয়েছিও অনেক।  আল্লাহর কী অসীম মহিমা এখনও বেঁচে আছি।  তার করুণার দানেই  এই জীবন পার করে দিলাম। কত ঘাত, কত আনন্দ বেদনা, কত সুখ, কত অপূর্ব জ্যোৎস্না-রাত্রি এসেছে জীবনে। এই গ্রামে ঝোপে ঝাড়ে কত নতুন নতুন  ফুল ফুটেছে।  কত সন্ধ্যা তারা নিভে গেছে, কত কোমল হৃদয় ভেঙে গেছে। কান্না জড়ান কত মধুর স্মৃতি, কত দিন রাত্রির কাব্য গাঁথা রচিত হয়েছে ।'    

'মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে চুপিচুপি গান শুনি। এরকম করে গান শোনাও খারাপ। তবুও শুনি। কিছু গান থাকে সৃষ্টির অমৃত সুধাকে পান করায় এমনই রাত্রির মধ্য প্রহরে। কিছু সুর থাকে স্নায়ু বিকল হয়ে যায় , হাড় হীম হয়ে আসে। শুনি সেই গান রাতের নিবিড়ে গোপনে। 

শীত চলে গেছে কত বসন্তের হুহু বাতাসকে ডাক দিয়ে। এ হাওয়ায় যখন তখন মন কেমন কেমন করে।  চোখ মেলে থাকি অন্ধকারের দিকে। আঁধার ভালো লাগে। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করে না। ভয়ও লাগে, যদি নিভে যায়।

কত কথা মনে হয় পিছনের জীবনের। কত পদচিহ্ন পড়ে আছে এই পৃথিবীর মাটিতে। গায়ে মাখতে ইচ্ছে করে শৈশবের ধূলো। গান শুনতে শুনতে ঘুম আসে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন আসে।  আবার কখনো আর ঘুম আসে না। ঘুমের মতো ঘোরের মধ্যে থাকি। দিন রাত্রি বুঝি না, সুখ দুঃখ বুঝতে পারি না।

একটি চাওয়া সবসময় চিত্তকে আকুল করে। হাসিমুখ রাখতে চাই। হাসির ওপিঠে দুঃখ কেউ যেন না দেখতে পায়। হাসিটুকু রেখে যেতে চাই। 

তারপর ক্রমশ গানের কথার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। সুরের সঙ্গে ভেসে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না আমার।

"যেটুকু প্রহর বাকী সুপটু হাতের ফাঁকি
কিছুটা সময় আঁকি
জামার গায়।
সে জামা হলুদ ভোরে তোমারি কপোল জুড়ে
ঠোঁটের অনতিদূরে 
রোদ পোহায়।"

-- তোর অনিতা দেব বর্মনের খবর কী? ভাবীকে দেখলাম, সে তো অনিতা নয়।   

-- আমি মুক্তি যুদ্ধে চলে গিয়েছিলাম। ভারতের আসামের ধুবড়িতে ট্রেনিং নিয়ে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের আন্ডারে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেই। খালেদ মোশাররফ, যিনি পরবর্তীকালে কে ফোর্সেরও অধিনায়ক ছিলেন। আমরা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ  জায়গায় ঢুকে পড়ে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলাম। যুদ্ধ শেষে যখন গ্রামে ফিরে আসি,  দেখি -- আমাদের এই জনপদ পাকিস্তানি আর্মিরা এ দেশের বাজাকার আলবদরদের সাথে নিয়ে এখানে হত্যা যজ্ঞ চালিয়েছে।  আমাদের এই হরিনাগোপাল গ্রামেই দুইশত মানুষকে তারা হত্যা করে। আমার বাবাকেও মেরে ফেলে। আমাদের বাড়ি ঘর আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।                          

--- তারপর? 

অনিতাকে পাক সেনারা ধর্ষণ করে  গুলি করে মেরে ফেলে রেখে যায়।  অনিতার দুই ভাই এবং ওর বাবাকেও পাক সেনারা গুলি করে মেরে ফেলে। জানিস রোহিত -- যেদিন যুদ্ধে যাই তার আগের দিন সন্ধ্যা রাতে অনিতা আর আমি মন্দিরে গিয়েছিলাম। ও পূজো দেয়ার জন্য মন্দিরে ঢোকে। আমি বাইরে বেল গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকি।  পুজা শেষে অনিতা মন্দির থেকে বের হয়ে এসে  সন্ধ্যা রাত্রির অন্ধকারে  আমাকে প্রণাম করে বলেছিল -- দেশ যখন স্বাধীন হবে, তুমি তখন লাল সবুজের ঝান্ডা উড়িয়ে গান গাইতে গাইতে চলে আসবে এই গ্রামে । আমিও হারমনিকা বাজাব বাড়ির উঠোনে নেচে নেচে। তারপর একদিন তুমি ----
'স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে 
মুগ্ধ এ চোখে।
ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে   এসে আমার ঘরে।'

-- সরি, শহীদুল,  তোকে আমি অনিতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে দুঃখ  দিলাম।                   

-- অনিতাকে একটুও ভুলতে পারিনা রে!  আমার শত কর্মের মাঝে ও চুপিচুপি চলে আসে।  কানের কাছে ফিসফিস করে বলে -- 'তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি, আসব যাব চিরদিনের সেই আমি, তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।'                    
শত বছর পরে কোনো এক শ্রাবণে বৃষ্টি সন্ধ্যা রাত্রিতে হয়ত মাটির ফোড়া কাটা ঝোপে ঝাড়ে লুকিয়ে ঝিঁঝি পোকা ডাকবে।  বাঁশঝাড়ের আড়ালে আঁধার করা বনমৌরির গন্ধে যখন রাতের জোনাকিরা আকুল হবে -- সেই রাতের  গোপনে হয়ত সে আবার  ফিরে আসবে এই হরিনা গোপাল গ্রামে। আমিও মরে যাব একদিন। আমিও হয়ত ফিরে আসব।  চেনার মতো আজিকার কোনো মানুষ হয়ত তখন থাকবে না।  এই পৃথিবী নামে গ্রহে তখন অন্য রূপে আসব। তুচ্ছ কোনো কিছু হয়ে। হয়ত ঝিঁঝি পোকা কিংবা সন্ধ্যা নিশীথের নীল নীল জোনাকি হয়ে।    

শহীদুলের চোখের কোণ্ জলে ভিজে চিকচিক করছিল। রোহিত ওকে বলে -- তোকে আমি অহেতুক কাঁদালাম।         

-- ধলডোবের দোলা মিত্রের কথা শুনেছিস না ! তুই যখন গ্রাম ছেড়ে চলে গেলি, তখন ও বালিকা ছিল। মুক্তি যুদ্ধের সময় ও ক্লাস নাইনে পড়ত।  আমি তখন স্কুলে নবীন শিক্ষক।  দোলা  আমার সরাসরি ছাত্রী ছিল। মেয়েটি ভালো গান গাইত।  পাক সৈন্যদের কালো হাতের থাবা থেকে সেদিন দোলাও রক্ষা পায়নি। সেও ধর্ষিত হয়েছিল।          লজ্জ্বায় আর গ্লানিতে দোলাদের পরিবার স্মরণার্থী হয়ে সেই যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারপর আর ওরা ফিরে আসে নাই এই দেশে। শুনেছি ওরা নাকি ভারতের শিলিগুড়িতে থাকে।      

শহীদুল রোহিতকে বলে -- মুক্তিযুদ্ধের সময় তুই কোথায় ছিলি?       

--- মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসে থেকেও আমি কিছু ভূমিকা রেখেছিলাম । আমি তখন লন্ডনে পিএইচডি করছিলাম। এপ্রিল মাসের কোনো একসময় ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনেক প্রবাসী বাঙালি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গমহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে        সমাবেশ করেছিল। সমাবেশ শেষে প্রবাসী বাঙালিরা  ডাউনিং স্ট্রীটস্থ প্রধানমন্ত্রীর অফিসের দিকে মিছিল নিয়ে যায়। সেখানে তারা     পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক  বাংলাদেশে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের  বিরুদ্ধে স্মারকলিপি প্রদান করে। সেদিনকার  সেই মিছিলে খন্দকার ফরিদ আহমেদ, লুলু বিলকিস বানু , ফেরদৌস রহমান, সুলতা শরীফ, বদরুল হোসেন তালুকদার  প্রমুখদের সাথে আমিও উপস্থিত  ছিলাম। আমরা সেদিন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি প্রদান ও পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছিলাম।  
তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে লন্ডনে অনুষ্ঠিত  বিভিন্ন সভা, সমিতি ও  সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়েছিলাম।                         

--- আয়, আমরা দুজন এই গানটি কবিতার মতো করে একসাথে আবৃত্তি করি । খুব শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছে করছে শহীদদের প্রতি ও বীরাঙ্গনাদের প্রতি।

'মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে/ কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা, তাঁরা কি ফিরিবে আজ সু-প্রভাতে,
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে।'
     
শহীদুল রোহিতকে বলে,  তুই কি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস? 
--- না।  তবে বেশি খাই না।  মন খারাপ হলে খাই।  মাঝে মাঝে মনে হয়, এই সিগারেটই প্রকৃত বন্ধু। ঐই দুদণ্ড শান্তি দেয় আমাকে। ও কোনো ফাঁকি দেয় না।  এই মনে কর্,  এখন খুব খেতে ইচ্ছে করছে। 

--- তোর কি মন খারাপ লাগছে?  

--- হুম। 

--- চল বাইরে পুকুর পাড়ে ছাতিম তলায় যাই। ওখানে যেয়ে খাই।   

--- চল্।  

রোহিতই  শহীদুলকে সিগারেট ওফার করে।  দুই বন্ধু ছাতিম তলায় চেয়ার পেতে বসে সিগারেট খেতে থাকে।      

শহীদুল রোহিতকে বলে -- তুই একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি আমাকে? 

-- বল।  সম্ভব হলে উত্তর দিব। 

--- তুই গৃহ ত্যাগ করেছিলিি কেন?  কী হয়েছিল তোর? 

--- না, এই প্রশ্নের উত্তর তোকে আমি দিব না। আমার জীবনের এই গোপন কথাটি আজ পয়ত্রিশ বছর ধরে গোপন রেখেছি।  কাউকে বলিনি।  বলবও না কখনও। কারণ, আমি যে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলাম ও আছি। বললে গীতাকে অপবিত্র করা হবে।       

--- তোর এই গোপন কথাটি আর কেউ কি জানে? 

---  যারা জানত তারা কেউ আজ আর বেঁচে নেই। সবাই পরপারে চলে গেছে।       

--- তোর কী মনে হয় না,  তুই ভুল করেছিলি চিরদিনের জন্য গৃহ ত্যাগ করে। 

--- চিরদিনের জন্য আর হলো কই?  এই তো কয়দিনের জন্য এলাম তো ফিরে। তবে হ্যাঁ, আমি ভুল করেছিলাম।      

--- তা, বিয়ে করিস নাই কেন? 

---  পৃথিবীর পথে পথে কত খুঁজেছি একজন মনের মানুষকে, কিন্তু মনের মতো মনের মানুষ কোথাও খুঁজে পাইনি। একবার অস্ট্রিয়ার একটি অজো গ্রামে গিয়েছিলাম। ওখানে ঐ জনপদে  ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন জাতি সত্বার মানুষ বসবাস করে। তাদের নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের  উপর  কিছু উপাত্ত সংগ্রহ করাই আমার কাজ ছিল।    

নদীর নাম মোরাভা।   
ঠিক আমাদের ইছামতী নদীর মতো ছোট্ট একটি নদী বয়ে এসেছে কোথা থেকে, জানতাম না । পরে জেনেছি --  নদীটির উৎপত্তি স্থল ছিল দানিয়ুব নদী। স্লোভাকিয়ার বুক চিরে ভেসে ভেসে এসেছে সে অস্ট্রিয়ার এই নির্জন সমতটে।  স্লোভাক আর রোমার এই দুটি জাতি স্বত্বার সংমিশ্রণে বিবর্তিত নৃগোষ্ঠির মানুষেরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিল।  

একটি গ্রাম্য বধু স্নান করে উঠে আসছিল ঘাট থেকে। দেখতে একদম বাঙালি রমণীর মতো লাগছিল । মেয়েটিকে দেখে মনে হয়েছিল -- তাকে  আমি এর আগে কোথায় যেন অনেক দেখেছি। আমি ওর কাছে যেয়ে কথা বলবার চেষ্টা করি।  বলেছিলামও কথা ওর সাথে  - 'মেয়ে, তোমাকে আমি জন্মজন্মান্তর ধরে চিনি।'  কিন্তু ও আমার কথা কিছুই বোঝেনি। 

ডরমেটরীতে ফিরে আসার পর  মন কিছুতেই ভালো লাগছিল না। বারবার মনে পড়ছিল ঐ মেয়েটির কথা।  পরের দিন আবার গেলাম ওকে খুঁজতে।  কিন্তু ওর কোনো দেখা পেলাম না।  তারপরের দিন আবার যাই।  সেদিনও  দেখা পেলাম না। যেদিন ভিয়েনা ছেড়ে চলে আসব, তার আগের দিন আবার যাই ঐ জনপদে ছোট্ট ঐ স্বচ্ছতোয়া নদীটির তীরে। কত খুঁজেছি তাকে। একে ওকে কতজনকে জিজ্ঞাসা করেছি কেউ ওর খোঁজ দিতে পারেনি।                                 
                                           
প্রায়ই ঐ মেয়েটির কথা মনে পড়ে। ওগো লক্ষ্মী মেয়ে!  তুমি কী এখনও আছ সেখানে ? সুদীর্ঘ কত বছর চলে গেছে। আজও তুমি কি সেই নির্জন নদীর কূলে ভাঙা ঘাটে স্নান করতে আসো? তোমাকে খুব  মনে পড়ে…তোমাকে আবার দেখতে বড়োই ইচ্ছে করে..... অনেক দূরের  কোনো বনপাতার ঘরে তুমি কী প্রদীপ জ্বালাও মৌন সন্ধ্যায়? আবার যদি যাই,  দেখা কী পাব 
তোমার?

-- খুব তো সুন্দর গল্প কথা শোনালি।  তা এটি কী সত্য কথা !  নাকি  আসল কথাটা আড়াল করে গেলি।  

---  সত্যটাও সত্য,  মিথ্যাটাও সত্য।     

--- তোর কী এই দেশের জন্য প্রাণ কাঁদত না?   

--- এই দেশের মাটি, জলবায়ু, আকাশ, বৃক্ষরাজি ও নদীর জন্য প্রায়ই  মন তৃষিত হয়ে ঘাকত। যখনই কোনও অস্তমিত  সন্ধ্যাবেলায় টেমস কিংবা স্যাভরন নদীর পাড়ে গিয়েছি, তখনই মনে হতো ইছামতী ও যমুনা নদীর কথা। বিস্মৃতপ্রায় ঝাপসা ছবির মতো মনে ভেসে উঠত -- নিভৃত পল্লিগ্রামের জীর্ণ শানবাঁধানো পুকুর ঘাটের কথা। পুকুরের জলে ভেজা লক্ষ্মীর চরণচিহ্নের মতো মায়ের  জলসিক্ত পা দু খানির রেখা আঁকা পদচিহ্নর কথা…আঁধার সন্ধ্যায় আম কাঁঠালের বনের  মাথার ওপরের আকাশে দু-একটা নক্ষত্র জ্বলে ওঠার কথা । শান্ত  আঙিনায় তুলসী মঞ্চমূলে মঙ্গল প্রার্থিনী সে কোন্ পূজারত মাতৃমূর্তি, করুণামাখা অশ্রু ছল ছল তার চোখের কথা  ... । 

শহীদুলের স্ত্রী শেফালী দুই বন্ধুর জন্য প্লেটে করে  পিয়ারা কেটে  দিয়ে যায়। এবং রোহিতকে বলে যায় -- দাদা, আজ দুপুরে আমাদের এখানেই ডাল ভাত খাবেন।       
   
শহীদুল বলছিল -- একটা সুখের কোনো ঘটনা বল্,  যা শুনে মনটা যেন একটু ভালো হয়।  আর একটা সিগারেট দে খাই।         

-- লন্ডনে যে ইউনিভার্সিটি থেকে এমফিল করছিলাম -- ওখান থেকেই একবার ব্রাজিল গিয়েছিলাম। রিও ডি জেনেরিওর একটি ইউনিভার্সিটির সাথে আমাদের ইউনিভার্সিটর এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ছিল।  উদ্দেশ্য ছিল আমাজনের আদিবাসীদের জীবন যাত্রার উপর এ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করা ।      

আমার সাথে আরও তিনজন তরুণ গবেষক ছিল। এর ভিতর দুজন ছিল মেয়ে । রিও ডি জেনেরিও থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে  আমাজন অরণ্য অবস্থিত । সেই অরণ্যে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির আদিবাসীদের বাস। তার একটি হলো --    ‘আয়োরো’।  এই আয়ারো আদি গোষ্ঠীকে নিয়েই আমাদের এ্যাসাইমেন্ট ছিল। 

আয়োরো আদিবাসীদের বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী। 
এরা মূলত পশুপালন করে । এক একটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকে কমপক্ষে শতাধিক শূকর। এই গোষ্ঠীর সমাজে যখন কেউ 
প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন তাকে নিজ চেষ্টায় ঘর তৈরি করতে হয়। ঘর তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করলেই বর্ষায় তাকে বিয়ে দেয়া হয়। আর বর্ষার শুরুর আগে প্রথম যেদিন পাখি ডাকে সেদিন শুরু হয় আয়োরো আদিবাসী গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় উৎসব ‘আছোঞ্জা’। পুরো একমাস ব্যাপী এই উৎসব চলে।

রিও থেকে আমরা প্রথম চলে গিয়েছিলাম  আমাজন নিকটবর্তী একটি ছোট্ট শহরে। তারপর  আমাজনের সেফ জোনে যেয়ে আমরা তাবু পেতেছিলাম। একমাস সেই তাবুতে ছিলাম। কী আনন্দময় জীবন ছিল , যাকে বলে 'দ্যাট ওয়াজ রিয়াল ন্যাচারাল লাইফ টুগেদার। যে একমাস ছিলাম জীবনের সব দুঃখ বেদনা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম আমাজনের গভীর জঙ্গলেে। আমাদের মূল শ্লোগান ছিল -- Life is ours, we live it our way.   

আমাদের সাথে যে দুজন মেয়ে ছিল তার একজনের নাম ছিল সান্ডি আরিস্তা। ও এসেছিল স্পেনের  বার্সিলোনা থেকে।  তেইশ চব্বিশ বছরের স্প্যানিশ উচ্ছ্বল তরুণী।  ও আমার রিসার্চ 
মেট ছিল। আমরা দুজন প্রায়ই  হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম গভীর অরণ্যে। ও ছিল সাংঘাতিক  ভিতু প্রকৃতির। এক জায়গায় এক নীল জলের শীর্ণা নদীর কূলে বসে দুজন গল্প করছিলাম।  জলের ছোট ছোট ঢেউ  দেখছিলাম চেয়ে  চেয়ে। কারোরই কোনো চাওয়া নেই। সান্ডি আরিস্তা শুধু আমাকে বাহু বন্ধনে বেঁধে রেখেছিল।  নির্জন সেই বন-ক্রোরে নীল আকাশের নীচে কী আর কথা থাকে? 
অরণ্য ঘেরা নদীর কূলে আরক্ত  চাঁপাফুলের কি যে মৌ মৌ গন্ধ,  সিক্ত হলো ঘাস -- স্বর্গীয় আশীর্বাদে ঋদ্ধ হলো দুজন।  এক গভীর নিবিড় আলিঙ্গনে একাত্ম হয়ে গেলাম।  শুধু  'তোমারি আনন্দ আমার দুঃখে সুখে ভরে / আমার করে নিয়ে তবে নাও যে তোমার করে। / আমার বলে যা পেয়েছি শুভক্ষণে যবে,/ তোমার করে দেব তখন তারা আমার হবে-- সব দিতে হবে।'
                                     
শুনলি তো, আমার আনন্দময় একটি ঘটনার কথা। একটা কথা তোকে বলি -- জীবনের আনন্দময় ক্ষণ খুবই ক্ষণকালের হয়। সান্ডি আরিস্তার চোখের জল মিশেছিল আমাজনের  শীর্ণা নদীটির নীল জলে, আর আমার দীর্ঘশ্বাস মিশেছিল সেখানকার হিমেল বাতাসে।                  




বুধবার, ২৪ জুন, ২০২০

পরিচ্ছেদ -- ৫

রাতে খাটের উপর রোহিত শুয়ে আছে। ঘুম আসছিল না চোখে। মনে পড়ছিল  তার  পূর্ব পুরুষদের কথা। ঘুমহীন চোখের সামনে তারা বিচরণ করছিল। পিতামহীর মুখে সে শুনেছিল -- 'নববধূরূপে প্রথম যেদিন সে এই বাড়িতে এসেছিল-- দুধে-আলতায় পা রেখে দাঁড়িয়েছিল এ বাড়ির প্রাঙ্গণে।' 'আজ এই প্রাঙ্গনে তারা কেউ নেই। স্বর্গের বাড়িতে তারা চলে গেছে। হয়ত সেখানে তারা  এখন ভালো আছে। 

ঠিক পিতামহীর মতো মাও একদিন এই বাড়িতে এসে প্রাঙ্গনে দূধে আলতায় পা রেখে দাঁড়িয়েছিল। মা আজ নেই। সেও বাবাকে সাথে করে স্বর্গলোকে চলে গেছে। আমার জন্য কেউ আজ এই বাড়ির প্রাঙ্গনে এসে দাঁড়াল না। কেউ বলল না, খোকা তুই ফিরে এসেছিস!  তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে আমার দুই চোখে ঘা হয়ে গেছে।'

গভীর রাত্রে স্বপ্নের ঘোরে পূর্বপুরুষদের  অনুযোগ করে রোহিত বলছিল — ' কেন তোমরা আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? কী করেছিলাম আমি? আমিও ঠিক একদিন চলে আসব তোমাদের কাছে।' 

পাশের ঘরে জামাইবাবু ছায়াকে বলছিল -- দাদা এতদিন পর কী উদ্দেশ্যে যে বাড়িতে আসল? নিশ্চয়ই কোনো মতলব নিয়ে এসেছে। বাড়ি ঘর, জমি জিরাত, বাজারের দোকানপাট সব মনে হয় বিক্রি করে দিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে একেবারে পাততারি গুটিয়ে  চলে যাবে। '

ছায়া রাণী বলছিল --   তুমি এইসব আজেবাজে কথা বলো না।  দাদা কত বছর পরে এল।  নিশ্চয়ই তিনি মাটির টানে, পূর্ব পুরুষদের পুন্য আত্মার আহবানে  নিজের জন্মস্থান দেখার জন্য এসেছে। দাদাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। আর তিনি যদি সব বিক্রি করে  দিয়ে চলেও যায়,  যাবে। তার জিনিস তিনি যা করবেন, করবে।  তুমি এসবের উপর দৃষ্টি দিও না।        

ভোরবেলা রোহিতের আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। তার কাছে মনে হয়েছিল -- ঠিক যেন মায়ের মতো বিছানার পাশে এসে কেউ একজন বলছে -- 
' বাবা, তুমি ওঠো। তুমি সেই এলে ! তোমার জন্য আমি কত অপেক্ষা করেছি পথের দিকে চেয়ে।  মনে হতো -- এই বুঝি তুমি চলে এলে।  কিন্তু আসোনি।  আমি তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে চোখ অন্ধ করে ফেলেছি। সেই তুমি এলে বাবা।  আমি জীবন নদীর এপারে যখন চলে এলাম তখন।'

শুয়ে থেকেই বালিশে মুখ গুজে রোহিত বিড়বিড় করে বলছিল -- 'মা, তুমি যখন ছিলে এই বাড়ি  মুখর হয়ে থাকত , তুমি আজ নেই।  কেমন  নিরব চারদিকে।  তুমি থাকলে মুখর সব , না থাকলে মন খারাপ লাগে। তুমি আসবে না মা?  তোমার পায়ের শব্দে আনন্দ ভৈরবী বেজে ওঠে  পথে পথে। মনে হয় তুমি আসছ।

'মা, তুমি আর কখনোই আসবে না জেনেও, দৌড়ে চলে যাব ঘরের বাইরে । যেয়ে দেখব -- পথের উপর নির্জনতা'রা ক্রন্দন করছে।'

রোহিত বিছানা হতে উঠে মেঝেতে পা রেখে খাটের উপর বসে। কোথা থেকে আসা বেলী ফুলের গন্ধ পাচ্ছিল সে। হঠাৎ তার মনে হলো -- বহু বছর আগে পুকুরের চালায় মা বেলী ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন। যে বছর সে বাড়ি ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল সেই বছর। 

রোহিত দরজা খুলে বাহির আঙিনা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের পাড়ে চলে যায়। এক জায়গায় দেখতে পায়, অনেকগুলো বেলী ফুলের গাছে জঙ্গল হয়ে আছে।  মা ঠিক এই জায়গাতেই কয়েকটি বেলীফুলের চারা লাগিয়েছিল। সেই চারা কটি-ই জঙ্গল হয়ে গেছে অনাদরে আর অপরিচর্যায়।  আর এই জঙ্গল থেকেই বেলী ফুলের বুঁনো গন্ধ ভেসে গিয়েছিল ঘরে। এই বন বেলী ফুল সেই কতকাল পূর্বের কোনো এক বিস্মৃত অতীতের কথা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল।  মায়ের শরীরের গন্ধের  ন্যায়  আজিকার এই ফুলের গন্ধ  সৌরভ ছড়াচ্ছে এই বাড়ির সারা আঙিনাতে। 
       
কেমন যেন উদাস উদাস লাগছিল তার।  সে পুকুরের ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। ঘাটের পাকা সোপানগুলো জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে। আগাছা উঠেছে ফাঁক গুলো থেকে। পুকুর শ্যাওলা আর কচুরিপানায় ভরে গেছে।  বহুবছর ধরে কচুরিপানা যে পরিস্কার করা হয় না।  এটা বোঝা গেল।                           
                       
পুকুরের একপাশে ছিল একটি বকুল গাছ। হঠাৎ মনে পড়ল তার সেই বকুল ফুলের গাছটির কথা।  একবার রোহিনী বকুল ফুলের মালা গেথে এক রাখী বন্ধনের দিনে তার হাতে পরিয়ে দিয়ে বলেছিল -- দাদা, তোমার জন্য এটা আমার রাখী। তুমি এরকম করে আমায় বেঁধে রেখ তোমার স্নেহে আর মায়ায় ।'  রোহিত সেই গাছটি খুঁজে পেল না। শুধু মরা শুকনো গুড়িটি মাটির উপর এখনো  লেগে আছে।                                                                                          
রোহিত  মন খারাপ করে বসেছিল ঘাটের ভাঙা সোপানের উপর। দুঃংখ জাগানিয়া কত স্মৃতিকথা মনে হচ্ছিল তার। যখন সে ভাবছিল সেইসব স্মৃতি কথা, তখনই  ছায়া রাণী এসে তাকে ডাক  দেয়-- 'দাদা, বাড়ির ভিতর চলো। নাস্তা খাবে। তোমার জামাই বাবু অপেক্ষা করছে।'    


নাস্তা খেতে বসে রোহিত ছায়া রাণীকে বলছিল -- আমি কয়েকদিনের জন্য এখানে এসেছি। তারপর, চলে যাব। 
--- দাদা, রাতে তোমাকে বলা হয়নি। আমাদের বৌদিদিকে তুমি যে আনলে না। এবং ভাইজি ভাইপুতদেরও। 
--- হা হা হা, আমি তো এখনও বিয়েই করিনি রে! আনব আর কাকে? 

--- কেন তুমি এখনও বিয়ে থা করোনি?

--- ' সে অনেক আফসোসের কথা। পৃথিবীর কত দেশ ঘুরলাম, কতজন কে দেখলাম -- কাউকেই মনের মত করে পছন্দ করতে পারলাম না।  একটা না একটা খুত থেকেই যায়। এইভাবে খুঁজতে খুঁড়তে কখন যে এতগুলো বছর চলে গেছে, বুঝতেই পারিনি।  আর এখন তো বুড়োই হয়ে গেছি।  এখন বিয়ে করলে মানুষ হাসবে।  তাই বাদ দিয়েছি এই সাবজেক্ট।  পরজনম বিশ্বাস করি না। তারপরও যদি থাকে -- সেই জনমে না হয় কাউকে খুঁজে নিব।'   

রোহিত জামাই বাবুকে বলছিল -- তুমি কেমন আছো?  তোমার ব্যাবসা কেমন চলছে? 

-- ঠাকুরের দোয়ায় ভালোই আছি। পুঁজিপাটা তেমন নেই। আপনার দোকান ঘরটাতেই কোনোভাবে দোকানদারী করে যাচ্ছি। 

-- ওহ! আচ্ছা।     

রোহিত ছায়াকে বলছিল--  আমাদের গ্রামে যে হাসান আলী মাস্টার ছিলেন, ওনার খবর কী?  উনি কী বেচে আছেন?  

-- না দাদা উনি মারা গেছেন অনেক আগেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর।  ওনার স্ত্রী তারও আগে মারা যান।  ওনাদের যে মেয়েটা ছিল নাম রেবেকা। সেও মারা গেছে তুমি চলে যাওয়ার বছর খানেকের মধ্যে । 

তুমি চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরই ওর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরপরই অন্তঃসত্ত্বা  হয়। দূর্ভাগ্য,  প্রসবকালীন  সময় সে মারা যায়। বাচ্চাটা এখনও আছে। মেয়ে হয়েছিল । নাম -- মণিকা। অনেক বড়ো হয়ে গেছে। বিয়েও হয়েছে। ওর ঘরে একটা মেয়েও হয়েছে। বয়স পাঁচ ছয় বছর হবে ।  স্বামী একজন উকিল। নাম নাসির উদ্দীন।  সিরাজগঞ্জ শহরে আমলা পাড়াতে  থাকে। 

রোহিত ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত বাতাস কারোরই গায়ে লাগল না।  তার অন্তরমহল কেঁপে উঠল,  সে কাঁপনও কেউ অনুভব করতে পারল না । চোখের ভিতর জল ছপছপ করছিল,  সে জলও গড়িয়ে পড়েনি ললাটে বেয়ে।     

রোহিত ছায়াকে বলে -- হাসান মাস্টারের যে একটি ছেলে ছিল নাম রাসেল, ওর খবর কী? 

---ওতো বেঁচে নেই। মুক্তিযুূদ্ধের সময় ওর টায়ৈয়েড হয়েছিল। বিনা চিকিৎসায় সে মারা গেছে। পাক সেনাদের ভয়ে ওকে শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করতে পারে নাই।        
  

--- আর  রেবেকার স্বামী?  সে কোথায়?  

--- সেও নেই। পাঁচ  বছর আগে  সে পরপারে চলে গেছে। উনি আর বিয়ে করে নাই। মেয়েকে উনিই লালন পালন করেছে। বড়ো করেছে। লেখাপড়া করিয়েছে। এবং বিয়েও দিয়ে গেছে। মনে হয়েছে মেয়ের জন্যই সে বেঁচে থেকেছিল।                 

রোহিত ছায়াকে বলে -- আমার বাল্যবন্ধু শহীদুল এখন কোথায় আছে?  জানিস?  বাগবাটী স্কুলে আমরা দুজন একই সাথে  পড়েছি।

-- শহীদুল ভাই গ্রামের বাড়িতেই থাকে দাদা। সে বাগবাটী স্কুলেই শিক্ষকতা করে। 

--- আচ্ছা। 

সবার নাস্তা খাওয়া শেষ হয়।  রোহিত উঠে দাঁড়ায়। এবং ছায়াকে বলে -- 'আমি একটু ঘুরে আসি।

-- কোথায় যাবে দাদা?  

-- শহীদুলদের বাড়ি।   
                                                                                                                                                      
                           


মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০২০

পরিচ্ছেদ ৪

রিকশায় উঠে রোহিত আবেগ আপ্লূত হয়ে  ভাবছিল -- সে আবার তার শৈশবের স্বপ্নলোক হরিনা গোপাল গ্রামে ফিরে যেতে পারছে। তার এই গ্রামকে সে মুছে ফেলতে পারেনি জীবন স্মৃতি থেকে।  সেখানকার পথের উপর ফেলে রাখা তার পায়ের চিহ্নগুলো এত বছরে হয়ত মিলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছায়াময় মায়াময় তার সেই গ্রামটি এখনও স্পষ্ট সুখ স্মৃতি হয়ে তার জীবন জুড়ে আছে। 

কার্তিক মাসের শেষ।  পথের দু ধারে মাঠের ভিতর  হলুদ সরিষা ফুলের অপার সৌন্দর্য থই থই করছে। কাসুন্দা, ধুতুরা, কুচকাঁটা, বিকাশ লতা, ঝুমকো লতার দল  জঙ্গলের মতো হয়ে একে অপরের সাথে নিবিড় হয়ে জড়িয়ে আছে। বিকালের হেমন্ত রৌদ্রের সাথে আকন্দ ফুলের গন্ধ যেন মিশে আছে চরাচরে— সেই সব কমনীয় রূপ আগেও ছিল, এখনও আছে। সে এই অপরূপ রূপের  মধ্যে দিয়ে চলেছে বাড়ির দিকে। 

যে রাস্তা  দিয়ে সে রিকশা করে আসছিল সেই রাস্তাটি ছিল একসময় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে।  আঁকাবাঁকা ধূলির পথ ছিল। মানুষ হেঁটে চলত আর চলত গরুর গাড়িতে। এখন এই রাস্তাটি পিচঢালা হয়েছে। চলতে চলতে পথে সে খুঁজছিল ইছামতী নদী। খুঁজছিল শৈলাভিটা খেয়াঘাট। যে ঘাটে প্রতিদিন শত শত মানুষ খেয়া নৌকায়  পারাপার হতো।   

খেয়াঘাটের এই নদীতে একসময় অনেক জল থাকত। প্রায়ই ঘ গানের আসর বসত নদীর কুলে। গান শুনতে শুনতে কত খেয়া যে মিস করত পারাপার হওয়া মানুষ। এখন এখানে খেয়া ঘাট নেই।  এখানে এখন কংক্রীটের বিশাল ব্রীজ। 
নীচে ধূঁ-ধূ বালুচর। নদীতে এই সময় জল থাকে না। বোষ্টমীদের গানও আর শোনা যায় না।

ছেলেবেলায় একবার বাবার সাথে শহরে আসছিলাম। খেয়া ঘাটে নৌকা আসতে তখনো দেরি। এপাড়ে নদীর কূলে তখন বৌষ্টমীদের গান হচ্ছিল। বৌষ্টমের হাতে ছিল খঞ্জরী, আর বৌষ্টমী গেয়ে যাচ্ছিল গান। দু'জনেরই পরনে ছিল গেরুয়া রঙ্গের ধূতি। বাবার হাত ধরে আমি নিমগ্ন হয়ে গান  শুনছিলাম। ভীড়ের ওপাশে চেয়ে দেখি -- আমাদের গাঁয়ের  লীলাবতী গান শুনছে ওর বাবার হাত ধরে। ওর পরনে ছিল ঝালরওয়ালা লাল নীল ফ্রক।

বৌস্টুমী যে গানটা গাচ্ছিল ---
'ও তোরা মন দিয়ে শোন্-
সে যে ছিল আমার মনেরই মতোন........।'

গান শুনতে না শুনতেই খেয়া নৌকা এসে যায় ঘাটে। আমি বাবার হাত ধরে যেয়ে নৌকায় উঠি। বৌষ্টমী তখনো গেয়ে যাচ্ছিল গান। লীলাবতী ওর বাবার হাত ধরে শুনছিল সেই গান। নৌকায় বসে ওকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাাম। কিন্তু লীলাবতী আমার দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি।    

ক্রমেই বেলা পড়ে আসছিল। রিকশাটা এক সময় ঘোড়াচরা গ্রাম পার হয়ে হরিপুর গ্রামের ভিতর  দিয়ে চলতে থাকে। এখানেও রাস্তার দুপাশে ফসলের মাঠ। দূরে ধনিদহ বিল। ঐ বিলের আরেক নাম পদ্মবিল। শত শত লাল আর গোলাপি রঙের পদ্মফুল ফুটে থাকত জলের উপর। এই রকম অপূর্ব শোভামন্ডিত জলাভূমি, স্বপ্নমাখা ফসলের মাঠ -- পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই সে দেখতে পায়নি। অতসীর ঝাড়, আমলকীর বন, আম গাছের কচি পাতার মিহি গন্ধ, অপূর্ব সুন্দর ঘোর লাগা সন্ধ্যা-পূর্ব বিকাল রোহিতের মনকে উদ্ভাসিত করে তুলছিল।   

এরপরই আর একটি মাঠ পেরিয়ে রিকশাটি ধলডোব গ্রামের ঠাকুর পুকুর পাড়ের কাছে যেয়ে থামে। এটি ছিল ধলডোব গ্রামের শেষ সীমানা। তারপর কিছুদুর আলপথ দিয়ে হেঁটে গেলেই হরিনা গোপাল গ্রাম।  রোহিত এই ঠাকুর পুকুর পাড়েই রিকশা থেকে নেমে পড়ে।  সন্ধ্যার ছায়াতল দিয়ে, মাঠের ভিতর দিয়ে, মেঠো পথের বাঁক পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে সে হরিনা গোপাল গ্রামে ওদের বাড়ির দিকে যেতে থাকে। 

সে সময় সাঁজের পাখিরা পুকুরের ওপারের ঝোপের মাথায় কিচ কিচ করে ডাকছিল, পথের দুপাশে গুচ্ছ গুচ্ছ দূর্বাদল সারাদিনের রোদ্র তাপে মুড়ে পড়েছে। ডোবার ধারে ঘেঁটু ফুলের সাদা পাঁপড়ি থেকে বুঁনো গন্ধ আসছিল। সন্ধ্যার আলোছায়ায় কেউ কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছিল। ওরা হয়ত ভাবছিল -- এ কোন্ অপরিচিত আগন্তুক কোথা থেকে এই গ্রামে এল। কিন্তু কেউই এগিয়ে এসে অচেনা এই মানুষটির সাথে কোনো কথাই বলল না। 

মানুষ যখন সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায় নিজ ঘরে। ঠিক সেই সময় রোহিত ওদের বাড়ির আঙিনায় এসে পা ফেলে। বাড়িটি দেখে বুকের ভিতর তার হুহু করে উঠে। মনের ভিতর এই রকম প্রতীতী জাগল --'যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়, কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, আহা, ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের, শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়-- '

এই বাড়ির কেউ কী মনে রেখেছে তাকে? চিনতে পারবে কী এক সময়ের একুশ বাইশ বছরের উচ্ছল সেই তরুণকে। যে এখন পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন  বছরের এই প্রবীন। ন্যুব্জ হয়ে গেছে যৌবন। যে ছেলেটা অপরিপক্ক ও অবাঞ্চিত এক অভিমান নিয়ে কোনো এক আঁধার রাত্রিতে গৃহ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল।    

বিদেশে থাকাকালীন সময়েই জেনেছিল সে তার সব হারানোর কথা। ১৯৭১ সালে বাগবাটী-ধলডোব-হরিনা গোপাল  গ্রামে ম্যাসাখার করেছিল পাক সেনারা। ২৭ শে মে ভোরে, একটি যৌথ অভিযানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর রাজাকাররা উল্লেখিত  গ্রামগুলি  ঘিরে ফেলে। তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত লোককে হত্যা করে, এর ভিতর বেশিরভাগ ছিল হিন্দু। তারা অসংখ্য আবাসস্থল লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়।পাক আর্মিরা মেয়েদের ধর্ষণ করে। গণহত্যার পরের দিন, বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা বাগবাটি ও ধলডোবের পূর্ববর্তী জমিদারদের নির্জন বাড়ির কূপে মৃতদেহ গুলি ফেলে দিয়ে মাটি চাপা  দিয়েছিল।

এই নির্মম গণহত্যায় প্রাণ গিয়েছিল রোহিতদের পরিবারের সব সদস্যদের।  সেদিন সে হারিয়েছিল তার বৃদ্ধ বাবাকে, অসুস্থ মাকে, বড় ভাইকে। ধর্ষিত হয়েছিল বৌদিদি ও ছোট বোন রোহিনী।  ধর্ষণের পর পাকসেনারা তাদের দুজনকেও হত্যা করে ফেলে রেখে গিয়েছিল ।                     

সেই নির্জন ঘোর সন্ধ্যাবেলায় রোহিত মৃদু পায়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। দেখে -- ভিতরের আঙিনায় কেউ নাই।  ইঁদারা পাড় ঘন ঘাসে জঙ্গল হয়ে আছে। মনে হলো কতকাল ধরে এই ইঁদারা থেকে কেউ জল তোলে না। রান্না ঘরের কোণায় একটি বড়ো পিয়ারা গাছ ছিল, সেই গাছটিও নেই। রান্না ঘরের চালের মাটির টালিগুলো ভেঙেচুরে গেছে। বোঝা গেল, এই রান্না ঘরে দীর্ঘদিন ধরে কেউ রান্না করে না।           

রোহিত তাদের পশ্চিম দুয়ারি বড়ো ঘরটির দিকে এগিয়ে যায়। দেখে ঘরের দরজা খোলা। ভিতরে একটি অল্প পাওয়ারের  বাল্ব  জ্বলছে। মনে হলো  সন্ধ্যা আলোটা কেউ এখনই জ্বালিয়ে রেখেছে ৷ প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সী একজন  মহিলা ধীর পায়ে  দরজার কাছে চলে আসে। একজন অপরিচিত লোককে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে চমকে ওঠে।  আগন্তুক লোকটিকে সে জিজ্ঞাসা করে -- 'আপনি কে গো, কাকে চাচ্ছেন?'  


রোহিত বলে -- আমি রোহিত কুমার সেন। বাবা স্বর্গীয় অসিত কুমার সেন। আমি এই বাড়িরই লোক।  

মহিলা বিস্ময়ে রোহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর স্মিত হাস্যে বলে -- 'ও মা! তুমি রোহিত দা!  এত বছর পর তুমি এলে! আমাকে তুমি চিনতে পারছ না?  আমি ছায়া রাণী। তোমার খুরততো বোন'। 

-- হ্যাঁ, তোকে আমি চিনতে পারছি। তুই তো একেবারে বুড়ী হয়ে গেছিস।  তোকে চিনব কী করে? আয় তো এই দিকে-- তোর কপালখানি দেখি। মনে আছে তোর?  আমগাছে ইটের টুকরো দিয়ে আম পাড়ার জন্য ঢিল দিয়েছিলাম,  সেই ঢিলটি এসে পড়েছিল তোর কপালে। তোর কপাল জখম হয়ে রক্ত ঝরে পড়েছিল।                                                                               

ছায়া রাণীর কপালে সেই দাগটি রোহিত আজও দেখতে পেল। কী এক অপার বিস্ময়েে তাকিয়ে দেখছিল দুজন দুজনকে। সেই কতকাল পরে রক্তের সম্পর্কের একজন মানুষকে তৃষা মিটিয়ে পরম স্নেহ দৃষ্টি দিয়ে রোহিত দেখতে থাকে।  রোহিতের হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে ছায়া রাণী বলে, দাদা, তুমি ঘরে চলো, বসো,  বিশ্রাম নাও ।      

রোহিত ছায়া রাণীকে বলে -- জামাই বাবু কই?

--- বাজারে গেছে , দোকানে । একটু পরই চলে আসবে।    

---  তোর  ছেলে মেয়ে কী? 

--- একটা মেয়ে ও একটি ছেলে। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি দাদা। গারোদহ গ্রামে শশুর বাড়িতে থাকে। আর ছেলেটা কলেজে পড়ে, আই এ সেকেন্ড ইয়ারে।         

রোহিত যে খাটের উপর বসে কথা বলছিল, সেই খাটটিতে ওর বাবা মা শুইত। সিয়রের কাঠের উপর ময়ুরপঙ্খী ডিজাইন করা। ওয়াল ঘেষে একটি পুরানো কাঠের আলমারি। সেটিও ওর বাবা সখ করে মিস্ত্রি বাড়িতে এনে বানিয়েছিল। এখনও আলমারিটা সেই রূপই আছে। ঘরের এক কোণে ঠাকুরের ছোট্ট মূর্তি রাখার জায়গাটা শুচি পবিত্র করে রেখেছে ছায়া রাণী। ধূপধূনো ও প্রদীপ  জ্বালিয়ে রেখেছিল সন্ধ্যায়। সে ধূপ দীপ এখনও জ্বলছে।                                

ঘরের দেয়ালের পলেস্তারা গুলো খসে  পড়ে গেছে। ছাদের পলেস্তারাও খুলে পড়েছে। ইটগুলো পোড়া মাটির মতো লাল হয়ে গেছে। বাইরের দিকে পরগাছা উঠেছে জায়গায় জায়গায়। রোহিত তাদের এই থাকার মেইন ঘরটি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। 

কী উৎসবমুখর ছিল এই বাড়িটা। মা বাবা বড়ো দা ও রোহিনীর কথা খুব মনে পড়ছিল রোহিতের। আজ কেউ নেই তারা। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।  রোহিত ছায়া রাণীকে বলে -- যেদিন মিলিটারীরা এল, তোরা কোথায় ছিলি? 

--- আমি বাড়ির পিছনে জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে ছিলাম। ওরা মাকে কিছু বলে নাই।  কিন্তু বাবাকে গুলি করে মেরে রেখে গেছে। দাদাকেও।  আমাদের বাড়ি ও তোমাদের বাড়ি পাকসেনা ও রাজাকারেরা প্রথম আক্রমণ করে। কেউ পলানোর সুযোগ পায় নাই। তাই ম্যাসাখারটা তোমাদের বাড়ি ও আমাদের বাড়িতে বেশি হয়েছে।                                                

---  বাবা মা বড়োদা ভাই, বৌদিদি ও রোহিনীর লাশ কী দাহ করা হয়েছিল? 

-- না। দাহ করা হয় নাই। বেশির ভাগ লাশ জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত কূপের ভিতর ফেলে দিয়েছিল। জেঠামশায়, জেঠিমা সহ সবার লাশও কূপের ভিতর ফেলে দিয়েছে। ওখানেই অন্ধকার মৃত্তিকা তলে সবাই  মিশে গেছে।  

ইতোমধ্যে বাজার থেকে জামাইবাবু চলে আসে। ছায়া রাণী রোহিতকে ওনার সাথে  পরিচয় করিয়ে দেয়। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে  ছায়ারাণী রোহিতকে বলে -- 'দাদা, তুমি এই ঘরে এই খাটের উপর ঘুমাও। আমরা পাশের ঘরে ঘুমাব।'  এই বলে ওরা দুজন চলে যায় পাশের ঘরে।           

সোমবার, ২২ জুন, ২০২০

পরিচ্ছেদ ৩

প্রায় পয়ত্রিশ বছর পর রোহিত তার গ্রামের বাড়ি হরিনা গোপালে আজ ফিরে যাচ্ছে। যেদিন  সে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা এসেছিল -- সেদিন রাতে বয়রা ঘাটে ভাসমান প্লাটফর্মের রেলিংয়ের কাছে  দাঁড়িয়ে জলের ধ্বনি শুনেছিল। ভেবেছিল সে -- 'জীবনের কী এক অমূল্য সম্পদই না পিছনে রেখে এলাম। যে সম্পদ কোনো দামেই কোথাও থেকে কিনতে পারব না।'  জীবনের প্রতি  সে ঘৃণাও করছিল-- এ কেমন কাপুরুষের মতো সব ফেলে চলে যাচ্ছে সে কোন্ অচেনা ভূবনে।

সেদিন তার একবার মনে হয়েছিল সে আবার ফিরে যাবে হরিনা গোপাল গ্রামে , কিন্তু পরক্ষণেই ছেলেমানুষের মতো কী এক চির অভিমান হয় তার নিজের প্রতি। চরম ঘৃণাও  হয় ধর্মের প্রতি, এবং সমাজের নিয়মনীতির প্রতি। চিত্ত তার অস্থির হয়ে উঠছিল। 

যমুনা বক্ষে সেদিনের সেই হেমন্তের রাত্রিটি ছিল কোনো এক ব্যর্থ প্রেয়সীর চোখের নীচে মলিন দাগের মতো বিষণ্নতার। দূরে কোনো বন নিবিড়ে ত্রস্ত কোনো হরিণ চোখ তুলে যেন ঘাতক শিকারীকে বলছে -- এই জীবন তুমি কেড়ে  নিও না। আমি বাঁচতে চাই। আমি রয়ে যেতে চাই অপূর্ব সুন্দর এই সবুজ অরণ্যে।    

ভোরে শের আফগান  জাহাজটি বয়রা ঘাট থেকে ছেড়ে এসেছিল। যমুনার জল ভেঙে ভেঙে  জাহাজটি ভেঁপু বাজিয়ে একসময় জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে গিয়ে ভেড়ে। রোহিত আস্তে আস্তে জাহাজের সোপান বেয়ে নীচে নেমে আসে। সে দেখতে পেয়েছিল ঢাকা যাওয়ার একটি ট্রেন স্টেশনে  অপেক্ষা করছে। 

রোহিত বাসের ভিতর বহু বছর আগের তার গৃহ ত্যাগের কথা ভাবছিল।  হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসে তার। সে দেখতে পায় -- সে এখন সিরাজগঞ্জগামী একটি এক্সপ্রেস বাসের ভিতরে বসে আছে।  বাসটি  মির্জাপুর অতিক্রম করছিল।  

পাশে এমন কেউ নেই যে তার সাথে দুদন্ড কথা বলে সময় পার করবে। কেমন যেন ঘুম ঘুম লাগছিল চোখে।  সে সামনের সিটে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করে।  কিন্তু ঘুমও আসছিল না।  তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে কী সব ভাবছিল। সেই সূদুর অতীতের সব কথা -- 'কোথায় সেই ভাঁটফুল, ভেরেন্ডার পাপড়ি, আকন্দের ঝোপঝাড়। কোথায় হিজলের বন, মহুয়া মাতাল নদীর কূল। যে নারীকে নদী মনে করত, সেই একদিন ধর্ম অন্ধতার কবলে পড়ে হারিয়ে গেল। 

সে যেন দিনের অস্তবেলায় আবার ফিরে যাচ্ছে নক্সী কাঁথার পথ ধরে সেইখানে,  যেখানে অসংখ্য দূর্বাঘাসের উপর অপরাহ্ণের রোদ্দুর পড়ে আছে। সব ঘাস পায়ে মারিয়ে হেঁটে হেঁটে সে চলে যাবে নদীর কাছে। সেখানে যেয়ে বলবে -- ' আজ তোমার কাছে থেকে কিছুই নেব না, আজ সব ফিরিয়ে দিতে এসেছি।' 

যখন চাঁদ উঠবে, যখন রাতের আঁধার ফুঁড়ে জ্বলে  উঠবে থোকা থোকা তারা, তখন ফিরে আসবে সে জীবনের উপত্যকায়। জ্যোৎস্নায় নেশাচ্ছন্ন নগ্ন পায়ে নেমে পড়বে মৃত্যু নদীর জলে। আর উঠবে না। তখন কেউই একাকী কূলে দাঁড়িয়ে খুঁজবে না তাকে শীর্ণা নদীর জলে।'

বাসের জানালার গ্লাস উঠিয়ে রোহিত দেখেছিল গ্রাম। কত সুন্দর সুন্দর সুন্দর মানুষ, কত রূপ অপরূপ মুখ। এখনও মনে রেখেছে সে এখন হেমন্ত কাল। মাঠে মাঠে  পাকা ধান।  বাতাসে কাঁচা পাকা ধানের গন্ধ ভাসছে। রোহিত সেই গন্ধ নিচ্ছিল প্রাণ ভরে।  
                                            
বাসটি একসময় যমুনার খুব কাছাকাছি চলে আসে। ধূঁধূ বালির প্রান্তর আর কাশবন দেখলেই মনে হয় কাছেই নদী আছে।  কত বছর ধরে যমুনার জল দেখা হয় না।  তার শুধু মনে 
পড়ছিল -- ঢাকায় যাবার বেলায় সেই রাতের কথা। স্টিমারের ডেকের বেঞ্চের উপর সে যখন বসেছিল, কী এক অন্তর বেদনায় হিম হয়ে আসছিল সারা শরীর। অনেক দূর থেকে গুমরে গুমরে কার যেন কান্নার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল। চোখের  ভিতর জল ছপ ছপ করছিল। সে জল সেদিন যেন করুণ ধারায় বৃষ্টি  হয়ে ঝরে  পড়েছিল।

বাসটি একসময় যমুনা সেতু অতিক্রম করছিল।  সে জানালা দিয়ে দেখছিল দুইপাশের নদীর রূপ। হায়!  এই সেই উত্তাল ভরা যমুনা?  বিশাল বিশাল চর জেগে উঠেছে নদীর মধ্যখানে। কাশবন দেখতে ভালো লাগলেও ভরা যমুনা দেখার জন্য এতদিন সে অপেক্ষা করেছিল। তা আর দেখা হলো না। এই নদী দেখে তার প্রাণ কাঁদতে থাকে।   

তারপর,  একসময় বাসটি তার শৈশবের নিজ 
শহর সিরাজগঞ্জ প্রবেশ করে। বুকের ভিতর কেমন শিহরণ জেগে উঠল।  বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকতে কত মনে পড়েছে  এই শহরকে। কত উন্মন মন আকুল হয়েছে এই শহরটিকে দেখবার জন্য। লক্ষী সিনেমা হলে সে প্রথম সিনেমা দেখেছিল ফতেহ লোহানীর 'আসিয়া' ছবিটি। কী অমিত বিস্ময়ে দেখেছিল ছবিটি। শহরের ইলিয়ট ব্রীজের কাছে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখত সে থাম্বা বিহীন ব্রিজ। সবই এখন স্মৃতি, সবই নস্টালজিক।   

রেল স্টেশনের কাছেই বাস স্ট্যান্ড। ওখানেই সে বাস থেকে  নেমে পড়ে। ছোট বেলার চেনা শহর তার কাছে আজ অচেনা লাগছে। কত মানুষ হাঁটছে পথের উপর দিয়ে, একজনও চেনা মানুষ কোথাও দেখতে পেল না । স্টেশনের কাছে একটি হোটেলে সে ভাত খেয়ে নেয়। তারপর পায়ে প্যাডেল টানা একটি রিকশায় করে  হরিনা গোপাল গ্রামের দিকে রওনা হয়।                                                
 


শনিবার, ২০ জুন, ২০২০

পরিচ্ছেদ ২

তেতত্রিশ  বছর পর রোহিত সেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে লন্ডন থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে এসে নামেন । সে দেশ ত্যাগ করেছিল ১৯৭০ ইং সালে।  আর ফিরছে ২০০২ ইং সালে।  রোহিত সেই যে  গ্রাম ছেড়েছিল পয়ত্রিশ বছর আগে, এর মাঝে সে কারোর কোনো খোঁজ খবর রাখেনি। রোহিত কোথায় থাকত, কোথায় ছিল , সে বেঁচে আছ না মরে গেছে তা কেউই জানত না।  

রোহিত তার জীবনের এতগুলো বছর পৃথিবীর পথে পথে ঘুরেছে।  একদেশ থেকে অন্য আর এক দেশে গিয়েছে।  কোথাও সে স্থায়ী  ভাবে থিতু  হতে পারেনি।  তার জীবন ছিল যাযাবরের মতো। ভলগা থেকে দানিয়ুব, আটলান্টিকের বালুকাবেলা থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের নির্জন পাড়ে, মস্কো থেকে মাদ্রিদ, সান্টিয়াগো থেকে টরেন্টো, আল্পস পর্বতমালা থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাত -- কত শহর, কত বন্দর সে গিয়েছ।  কখনও মেট্রোতে, কখনও ট্রেনে,  জাহাজের ডেকে, স্টেশনে স্টেশনে, মসজিদ-মন্দির- গীর্জায় ও বিভিন্ন ধর্মশালায় সে রাত কাটিয়েছে। কত যে স্থানে সে ঘুরেছে ফিরেছে থেকেছে। তার ইয়াত্তা নেই।  সারা পৃথিবীই যেন ছিল তার নিজের ঘর। যেন 'মোরা একই যাত্রী এক তরণীর'।   

আজ এত বছর পর এদেশের মাটিতে পা দিয়ে মনে হলো রোহিতের -- এই দেশ এই মাটি যে তারই। কত যে আপন  লাগছে।  এই যে মাথার উপর নীল আকাশ, এই রোদ্দুর, মেঘের শীতল ছায়া, বাতাসের গন্ধ, সবই আগের মতোই তার চিত্তকে দোলা দিচ্ছে। রোহিত প্রাণ ভরে উপভোগ করছে -- 'আমারও দেশেরও মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন।'    

এয়ারপোর্টের কনকোর্স হল দিয়ে হেঁটে  রাজপথের উপর এসে দাঁড়ায় সে। হঠাৎ ধূসর লাগছিল এই শহর। তার মনে পড়ছিল --  আজ থেকে তেতত্রিশ বছর আগের তেজগাঁও বিমানবন্দরের কথা। সেদিন একটি পিআইএর বিমানে করে লন্ডন যাত্রা করেছিল সে। কেউ আসেনি সেদিন এয়ারপোর্টে।  কোনো আপন মানুষ বিমান বন্দরে তাকে বিদায়ী অভিবাদন জানায়নি। কাঁদতে কাঁদতে সেদিন এই দেশ ছেড়ে সে চলে গিয়েছিল।  

কোথায় যাবে সে প্রথম?  কোথাও কেউ তো তার জন্য অপেক্ষায় নেই। আবার ভাবছিল -- হয়ত কেউ তার জন্য অপেক্ষায় থাকতে পারে। জীবনের পয়ত্রিশটা বছর খুব কী বেশি সময়? যাদের জীবন আনন্দের, তাদের জন্য এটি খুব বেশি সময় নয়। আবার নিঃসঙ্গ একাকী মানুষের জন্য এটি দীর্ঘ সময়। 

রোহিত একটি রেন্ট- এ ট্যাক্সি ডাকে। ট্যাক্সির চালককে বলে -- ভাই,  সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে আমাকে নিয়ে চলো। চালক বলে -- ওঠেন।  

ট্যাক্সি আশুলিয়ার পথ ধরে চলতে থাকে। সে ভাবছিল -- আমি অধম। আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি। একাত্তরে  আমি  টগবগে যুবক ছিলাম। ইচ্ছা করলেই এই  মাটিতে ফিরে আসতে পারতাম। কিন্তু আসিনি।  কী এক অভিমান ছিল অন্তর জুড়ে। কারোর টানেই এ দেশে ফিরে আসা হয়নি।  না মা, না দেশ, না আদরের ছোট বোন , না অন্য কারোর টানে।    
                                                         
মানুষের হৃদয় পাথরের মতো এত কঠিন হয় ! কী যে অনাহুতের মতো সজ্জনহীন ভাবে পরবাসে পড়ে রইলাম এতকাল? কত পথ চলেছি, কত রমণীর সাথে দেখা হয়েছে, কত রূপময়ী মেয়ের সাথে  পরিচয় হয়েছে। কত বর্ণের, কত ধর্মের -- কিন্তু কাউকেই ভালো লাগল না। কাউকেই  পথে থেকে তুলে নিয়ে পথের সাথী করা হয়নি।  সারাটা জীবন ঘরহীন ঘরে পড়ে রইলাম। এই সবই এক অন্তহীন গ্লানি।     

একবার লাসভেগাসে ভ্রমণ করতে যেয়ে পকেটে কোনো ডলার ছিল না। কপর্দকহীন যাকে বলে।  কী করব?  একটি মেট্রোরেল স্টেশনের প্লাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে  আমার প্রকাশিত নৃবিজ্ঞানের উপর সারা জাগানো বই 'পিউরিটি এ্যান্ড ড্যান্জার' কয়েকটি কপি বিক্রি করছিলাম। এক পঞ্চাশোর্ধ্ব মার্কিন মহিলা আমার ব্যাগে থাকা বইটির সবগুলো কপি সে কিনে নেয়।  মহিলা তার বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ করেছিল।  আমি গিয়েছিলাম তার বাসায়।  বাসায় ঢুকে আমি অবাক হয়েছিলাম। দেখি -- তার ড্রয়িং রুমের দেয়াল জুড়ে জয়নুল আবেদীনের বিখ্যাত  দূর্ভিক্ষের ছবিটির কপিফটো টানানো। মহিলার নাম ছিল -- ডোর্বা আলিসন।  সে ভালো পিয়ানো বাজাতে পারত। আপ্যায়নের পর  সেই রাতে ডোর্বা আমাকে পিয়ানো বাজিয়ে শোনায়েছিল।  আমি শুধু তার বাজানো মেলোডি সুরটিই শুনেছিলাম। গানের কথা কী ছিল তা বুঝতে পারিনি। তবে এটা যে একটা দুঃখের গানের সুর ছিল, তা বুঝতে পেরেছিলাম।  আরও সিয়র হয়েছিলাম, - যখন দেখি পিয়ানো বাজানো শেষে ডোর্বার চোখে জল।   
এই ধনাঢ্য বিনয়ী মহিলাটিও আমার জীবনের অনেক কিছুই হতে পারত।                                                             
ট্যাক্সিটি একসময় নবীনগর স্মৃতিসৌধের সামনে গিয়ে থামে। রোহিত গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে সৌধের কাছে চলে যায়।  এতদিন ধরে এই সৌধটি ছবিতে আর ভিডিওতে দেখেছে সে।  আজ চাক্ষুষ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষ শহীদের রক্তে গড়া এই সৌধ।  রোহিত তার নিজের গ্লানি যেন মোচন করছিল বিনম্র ভঙ্গিতে মাথা নত করে।  দূরে প্রবাসে বসে কত শুনেছে সে এই গানটি -- ' সব কটা জানালা খুলে দাওনা,  ওরা আসবে চুপিচুপি / যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ...। '                                     

রোহিত ট্যাক্সীর কাছে চলে আসে।  চালক ছেলেটি বলছিল -- স্যার এখন কোথায় যাবেন? 
-- হোটেল অবকাশ, মহাখালী।          

হোটেলে চেক ইন করে নেয় রোহিত। তারপর রুমে যেয়ে গোসল করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।  
    
কখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি।  
রোহিত উঠে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকে।  এই শহরে কেউ নেই তার। সেই কবে প্রথম এসেছিল সে এই শহরে । সব মনে পড়ছে তার। মনে পড়ছে শরীফুল ইসলামের কথা। শরীফ নামের সেই ছেলেটা তাকে এই ঢাকা শহর চিনিয়েছিল, আশ্রয় দিয়েছিল তাকে এই আত্মজনহীন শহরে  । 

শরীফের সাথে রোহিতের পরিচয় হয়েছিল ট্রেনে। সে যেদিন গ্রাম থেকে চলে আসছিল সেদিন।  স্টিমার থেকে নেমে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে সে ঢাকাগামী একটি ট্রেনে উঠে। তৃতীয় শ্রেণির কামড়ায় সে বসেছিল । তার পাশেই বসেছিল ওর সমবয়সী একটি ছেলে। চলতে চলতে ট্রেনে ছেলেটির  সাথে কথা হয় ও পরিচয় হয়।  প্রথম কথা বলেছিল শরীফ আগে। বলেছিল -- কোথায় যাবে তুমি ? রোহিত বলেছিল -- উদ্দেশ্যহীন গন্তব্য। তবে ঢাকা পর্যন্ত আপাতত যাব। 
--- ঢাকায় কোথায় যাবে? 
--- জানি না। 
--- এর আগে কখনও ঢাকা যাওনি? 
--- না। 

এরপর সারা রাস্তা দুজনের সাথে আরও অনেক কথা হয়। এবং ট্রেনের ভিতর ক্ষণকালের ভ্রমণের সময়টুকুতে একে অপরের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কমলাপুর স্টেশনে যখন দুজন নামে তখন শরীফ বলছিল -- বন্ধু, তুমি আমার মেসে কিছুদিনের জন্য উঠতে পারো। আমি যেমন থাকি তুমিও তেমন থাকবে, আমি যা খাই, তুমিও তাই খাবে।  একই চোকিতে দুজন একসাথে না হয় কিছুদিন কষ্ট করে ঘুমাব।  

আর শোনো,  আমি কিন্তু তোমাকে কোনো করুণা বা দানের কথা বলছি না।  ঢাকা শহরে এসেছ যখন, তখন কিছু একটা করে তো খাবেই। এই যেমন আমি একটি এ্যালুমিনিয়াম কারখানায় কাজ করে খাই। তুমিও এমন কিছু করে খেতে পারবে। তখন না হয় শোধ করে দিও। 

রোহিত শরীফের দুহাত চেপে ধরে বলে -- তুমি সত্যি মহৎ ওগো বন্ধু আমার। চলো,  তোমার কাছেই আমি থাকব।                                                                            
বকশি বাজারে একটি সরু গলির ভিতর একটি মেসে শরীফ  থাকে। ঐ মেসেই রোহিত বর্ডার হয়ে যায়।  অল্প কিছুদিনের মধ্যে সে দু-তিনটে টিউশনি পেয়ে যায়।  মেসের জীবন ভালোই চলতে থাকে তার । 

জীবনের সুখ দুঃখের ক্রান্তিকালের দুই আড়াই বছর এই শরীফ রোহিতের জীবনে জড়িয়ে ছিল। খুব হাসি খুশিপূর্ণ ছেলে ছিল। হাজারও দুঃখের মাঝে নিজেকে হাসি খুশি রাখত।  একদিন ওর কারখানা বন্ধ ছিল। বিকালে সে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে ছিল ।  রোহিত জিজ্ঞাসা করে -- 'বন্ধু, তোমার কী হয়েছে?  কোনো অতীত সুখ স্মৃতি মনে পড়ছে তোমার?  কিংবা কোনো দুঃখের কথা?'

শরীফ বলে, না আমার তেমন কিছু নেই। আমি কী অতই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছি যে -- একটি গোলাপ ফুল হাতে দিয়ে কোনো মায়াময়ী মেয়ে এসে বলবে ---আমি তোমাকে ভালোবাসি। তবে আমার কৈশোরের বেদনা জাগানিয়া একটি  স্মৃতি আছে, যা এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে। 

---   ঐটিই শোনাও, বলো শুনি। 

--- ' মনটা কখনো কখনো ভবঘুরে মন হয়ে ওঠে। কোনো কিছু ভালো লাগে না। কারোর মায়াও কাছে টানে না। কিন্ত পথ আমাকে টেনে নিয়ে যায়। উদাস হয়ে ঘুরতে মন চায় পথে পথে, খেয়া ঘাটে। নদীতে নদীতে, নৌকায় নৌকায় । মন চায় কোনো সার্কাস দলের কিংবা কোনো যাত্রা দলের গায়েন হই। বর্ষার রাত্রি নিশীথে মঞ্চের পালায় গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেড়াই ! 

অনেক বছর আগে এক শ্রাবণ বর্ষা মৌসুমে আমাদের গ্রামে হাটের পাশে সার্কাস পার্টি এসেছিল। নাম ' নিউ স্টার সার্কাস অপেরা '। প্রায় একমাস ছিল তারা আমাদের গ্রামে। তখন ছিল আমার তারুণ্যের প্রথম প্রহরের সময়। প্রায় প্রতিদিন যেতাম, ঐ সার্কাস দেখতে। কি প্রবল আকর্ষণে টেনে নিয়ে যেত আমাকে। সার্কাস দেখানোর পাশাপাশি সেখানে গান হতো, নাচ হতো, কৌতুক হতো, হাতির খেলা হতো । 

ঐ সার্কাস দলে তেরো চৌদ্দ বছরের একটি বালিকা এসেছিল। নাম স্বপ্না। পিঙ্গল মণিকান্ত চোখ। শরীর নদীর বাঁকে বাঁকে তখনও ঢেই তরঙ্গায়িত হয়নি । সে ঘাগরা পড়ে নাচত। গানও গাইত। আবার সার্কাসের বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ দেখাত সে। ওর এই চৌকস ব্যাপারগুলো  আমাকে ভীষণরকম মুগ্ধ করেছিল। ঐ মেয়ের অদ্ভুত সব গুণ দেখে সেদিনের এক গ্রাম্য সরল বালক ঐ বালিকার ভক্ত হয়ে উঠেছিল।

তখন বর্ষার দিনে নৌকায় করে স্কুলে যেতাম। ছলাৎছলাৎ বৈঠার শব্দ হতো জলে। কাঠের পাটাতনের উপর চুপচাপ বসে থাকতাম। জলের নুপুরে ঐ সার্কাস বালিকার ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পেতাম। মরা গাঙে তখন বর্ষার জলে ভরে যেত। সন্তোষ  মাঝি জাল পেতে রাখত মাছ ধরার জন্য। পাটের জাঁকের উপর বসে থাকত ধবল বক। মাথার উপরে উড়ত গাংচিল। ওদের চ্রিহি চ্রিহি ডাকের মধ্যে আমি শুনতে পেতাম সার্কাসের ঐ বালিকার গানের সুর  আর যন্ত্রী দলের খুঞ্জরীর শব্দ।

মন প্রফুল্ল হতো কিনা বুঝতে পারতাম না। পুকুর পাড়ের কদম গাছ থেকে কদম ফুল ছিঁড়ে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিতাম। উজান থেকে আসা নৌকাগুলো বাদাম তুলে চলে যেত দক্ষিণের গঞ্জে। মাঝি মল্লারও গান গাইত ভাটিয়ালি সুরে । কিন্তু সব গান আর সব সুর থেমে যেত সার্কাস দলের ঐ বালিকার ঘুঙুরের তালে। জলে কদম ফুল ভাসানোর সময় মনে হতো, এর একটি ফুল যদি  আমার থেকে  নিত ঐ দিগবালিকা।

কাউকে কিছুই বলা হয়নি আর। ভাবতাম, লেখাপড়া করে কি লাভ হবে? তারচেয়ে আমি যদি গায়েন হতে পারতাম। যদি যোগ দিতে পারতাম ঐ সার্কাস দলে। জীবনটা কত সুন্দরই না হতো। বালিকা শুনত আমার গান ! দ্বৈত কণ্ঠে গাইতাম যাত্রার পালায়। জীবনের স্বপ্নগুলো পূর্ণ হতো আনন্দময় সঙ্গীতে।

সেইদিন শ্রাবণ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল। আমাদের বাড়ির রাখাল সমির আলি ছোট নৌকায় করে আমাকে নিয়ে যায় সার্কাস প্যান্ডেলে। হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে প্যান্ডেলের ভিতরে । যন্ত্রী দলের কেউ একজন ৰাঁশিতে সুর তুলে, তবলায় তাল দিচ্ছিল তবলচি। হারমোনিয়াম বেজে উঠে। সেদিনও বালিকা গান গেয়েছিল। নুপুরের ঝুমঝুম শব্দ তুলে নেচেছিল । আমার প্রাণের তন্ত্রী কেঁপে উঠেছিল।   

প্যান্ডেলের বাইরে ছিল পূর্ণিমার চাঁদ। নৌকায় আসার সময় বাইরে দেখে এসেছিলাম জ্যোৎস্নায় ভাসছে জলে ভাসা মাঠ ঘাট। আমি জানতাম না, সেই রাত ছিল বালিকার শেষ গানের রাত। জানতাম না সেইটি হবে আমার বালিকার কাছ থেকে শেষ গান শোনা।

পরের দিন দুপুরের পর সার্কাস দলটি বড়ো একটি  পানসি নৌকা করে চলে যায় দূরে অন্য আরেক ঘাটে। বিকেলে যখন প্যান্ডেলটি দেখতে যাই, 
দেখি -- সেখানে কোনো সামিয়ানা টানানো নেই। দুই একটি বাঁশের খুঁটি এলমেল পড়ে আছে। স্তব্ধ  বাতাসে কান পেতে থেকেছিলাম অনেকক্ষণ।সেদিন আর বালিকার কোনো ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পেলাম না।



টিউশনী করার পাশাপাশি রোহিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে মাস্টার্স প্রিলিমিনারীতে  ভর্তি হয়। ক্লাসে পড়া শোনায় সে খুব ভালো করে এবং শিক্ষকদের নজরে আসে। দুবছর পর সে মাস্টার্স ফাইনাল  পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়। রেজাল্টের পরপর বৃটিশ সরকারের স্কলার্শিপ নিয়ে নৃবিজ্ঞানের উপর উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য সে লন্ডনেে চলে যায়।  

সেদিন সেই ট্টেনে যদি শরীফের সাথে রোহিতের পরিচয় না হতো,  যদি ঢাকা শহরে তাকে আশ্রয় না দিত,  তাহলে সে আজকের এই রোহিত সেন হতে পারত না। 

এত বছর পর ঢাকায় এসে তার সেই অকৃত্রিম নিঃস্বার্থ  বন্ধুটির কথা খুব মনে পড়ছে ।  পুরোনো ঢাকার একটি এ্যালুমিয়াম ফ্যাক্টরীর শরীফ একজন কেরানী ছিল।        

রোহিত সন্ধ্যায় একটি বেবীট্যাক্সি নিয়ে জেলখানার নিকট  বেগম বাজার মোড়ে চলে যায়। ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে বেচারাম দেউরীর  একটি গলির মধ্যে ঢোকে। রোহিতের এ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরীটি খুঁজতে থাকে। সে দেখতে পায় -- যে বাড়িতে ফ্যাক্টরিটি ছিল সেখানে সেটি নেই।  লোকজনদের জিজ্ঞাসা করে শরীফুল ইসলামের কথা। কিন্তু  তারা কেউই তাকে চিনতে পারে না।  সে কোথায় চলে গেছে তাও জানে না। 

রোহিত একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেগম বাজারের জনারণ্যময় গলির উপর  দিয়ে হাঁটতে থাকে।  বিমর্ষ হয়ে  ভাবছিল -- যাকে একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম একটি যাত্রী  ট্রেনে,  সে আজ হারিয়ে গেল কোন্ অজ্ঞাতে, কোন্  জনারণ্যে। এ জীবনে তাকে কী আর খুঁজে পাব? যেখানেই থাকো শরীফ, তুমি ভালো থেক বন্ধু।    

সে ভগ্ন মন নিয়ে ফিরে আসে হোটেলে। ট্যাক্সিতে আসতে আসতে মনে পড়ছিল শরীফের সাথে মেস জীবনের সুখ দুঃখের স্মৃতির কথা।

একদিনের কথা।  ক্লাস শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেসে ফিরছিলাম। পথে জয়কালী মন্দিরের কাছে আমাদের গাঁয়ের মজিদ মন্ডলের সাথে দেখা হয়। ও এসেছিল  ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওর এক আত্মীয়ের চিকিৎসা করাতে। রাস্তার পাশে ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে মজিদের সাথে কথা বলছিলাম । কথায় কথায় জানতে পারলাম রেবেকার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। মনটা মুহূর্তে বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মজিদের সাথে কথা বলতে পারছিলাম না। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। নিশ্চুপ হয়ে ভাবছিলাম --   যাও-বা গ্রামে ফিরে যাওয়ার ক্ষীণ ইচ্ছা ছিল, তাও রুদ্ধ হয়ে গেল।  

মজিদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর মেসে গেলাম না।  কোথায় গেলে মন ভালো লাগবে সেই পথ খুঁজছিলাম। ভাবলাম, বুড়িগঙ্গার তীরে যেয়ে বসে থাকি গিয়ে। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে    চানখার পুল পার হয়ে জেলখামার পাশে দিয়ে ইসলামপুর রোডের উপর যেয়ে উঠি।                                                 
আমি যখন নবাব বাড়ির গেটের পাশে দিয়ে  বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের দিকে  যাচ্ছিলাম,  তখন মনে হলো -- নবাববাড়ির  ভিতরে অন্দরমহল থেকে ঘুঙুরের আওয়াজ কানে আসছে।  কে যেন পায়েল পরে নাচছে। উঁকি দিয়ে একবার দেখতে মন চাইল -- কোন্  সে নর্তকী? 

পিয়ারি বেগম।

জিন্দাবাহার লেনের একটি বাড়িতে হরিমতি বাঈজীর কাছে রক্ষিতা হয়ে থাকত পিয়ারি। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সকালে ভৈরবি রাগে গান গাইত ‘রসিয়া তোরি আখিয়ারে, জিয়া লাল চায়’ ঠুংরী ঠাটের গানের এ কলিতে জিন্দা বাহার গলি কানায় কানায় ভরে উঠত। আরও একটি গান পায়েলের ঝুমুর শব্দের সাথে শোনা যেত --
 
'প্রভু মোর অবগুন চিতনা ধর
সমদরশি হ্যায় নাম তোমার
এক লহো পুজামে রহত হ্যায়
এক রহো ঘর ব্যাধক পরো
পরলোক মন দ্বিধা নাহি হ্যায়
দুই কাঞ্চন করো।'

খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, যদি কোনো  অস্তরাগের  বিকালে কাউকে নিয়ে বসতে পারতাম ওয়াইজঘাটের অদুরে সেই শান বাঁধানো ঘাটে। যে ঘাটে অনেক বছর আগে কত হেমন্ত বিকালে কমলা রঙের রোদ মেখে নবাব বাড়ি থেকে এসে বসত পিয়ারি বেগম। পিয়ারির মুখটি ছিল অবিকল ছবির মতো, থুতুনিটি ঈষৎ তীক্ষ, ঠোঁট দুটি যেন কোয়ারিতে রাখা করবী। তার নাকের প্রতিটি নিঃশ্বাস বুড়িগঙ্গার মলয় বাতাসে মিলিয়ে যেত। ওর শরীরটি যেন মুর্শিদাবাদী রেশম দিয়ে মোড়ান। এমনই মসৃন তার ত্বক। পাকা পাতি লেবুর গায়ে হাল্কা গোলাপী রঙের পোচে যে রঙের মিশ্রন হয় ঠিক তেমনই ছিল তার গায়ের রঙ। তার নীল কালো চোখ দুটি যেন স্তম্ভিত মেঘ মুখের অর্ধেকটাই জুড়ে থাকত।

তুমি কী আমার সেই রূপ ঝলসিত একজন পিয়ারি বেগম? 

না, তুমি  পিয়ারি বেগম নও।  তুমি রেবেকা বেগম। 
যাকে আমি পেয়েছিলাম পূর্ব জীবন থেকে এই পর জীবনে। স্বপ্নের কোন্ ইন্দ্রলোক থেকে তুমি এসেছিলে। তোমার চোখের আলোয় যে দ্যুতি ছড়িয়েছিল, তা আমাকে পথ দেখিয়েছিল নতুন জীবনের। 

এই সবই আমার পরাবাস্তব ভাবনা ছিল, যা একেবারেই  মূল্যহীন। 

বুড়িগঙ্গার  ঘাট থেকে ফেরার সময় ইসলামপুরের মোড়ে গঙ্গাজলির মক্ষিকালয়ের প্রবেশ মুখে দেখতে পাই -- রঙবেরঙের চোলি পরিহিতা রূপবাহারি অনেকগুলো মেয়ে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে, গান গাইছে, বিচিত্র অঙ্গ ভঙ্গি করছে। ইশারায় শীশ দিচ্ছে ভিতরে যাওয়ার জন্য। 

ওখানে কী আনন্দ হয় অনেক? ওটা নাকি বিরহীদের আনন্দলোক। ওখানে রূপের হাটে  শরীরের ভালোবাসা বেচাকেনা হয়।

"অ্যায় হুসন, জী খোলকর আজ সাতাঁলে মুঝকো। কাল, মেরা ইস্ককা আন্দাজ বদল যায়ে গা। ”

মানে, “ওহে সুন্দরী! আজ প্রাণ খুলে আমাকে দুঃখ দিয়ে নাও, আমায় নিয়ে খেলা করো, আমার সঙ্গে আজ তোমার প্রাণের খেলার সময়। আহা! তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা। কারণ কাল, আগামিকাল, আমার প্রেমের পাত্রী অন্য কেউও হয়ে যেতে পারে।”


সেদিন রাতে পথে ঘুরে ঘুরে মেসে ফিরে এসে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শরীফ কতবার বলেছিল, কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু ওর সকল অনুরোধ  উপেক্ষা করেছিলাম। ও বলেছিল, কেন তোমার মন খারাপ? আমাকে বলো না !' কী বলব ওকে? মনে রয়ে গেল মনেরই কথা, শুধু চোখে জল।'   


                                                                                                                                                                                                                                   

শুক্রবার, ১৯ জুন, ২০২০

উপন্যাস ( প্রথম পরিচ্ছেদ)

১.

এই আখ্যানের ঘটনাকাল  ইং ১৯৬৭ সাল থেকে ইং ২০০২ সাল পর্যন্ত।
    
আখ্যানের মূল চরিত্র শ্রী রোহিত কুমাার সেন প্রায় তেত্রিশ বছর পর নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশে আসছেন। উনি এদেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন অনেক বছর আগে কার্তিকের এক অমানিশা রাত্রির অন্ধকারে । সময়টা ছিল ১৯৬৭ ইং সাল।  

সেদিন সন্ধ্যা রাত্রিতে একটি ছোট্ট বালক একটি চিরকুট এনে রোহিতকে দিয়েছিল। কাঁপা কাঁপা মেয়েলি হাতে সেই চিরকূটে লেখা ছিল -- 
' আমি নজরবন্দী হয়ে আছি। বের হতে পারছি না। তুমি আর একটা মূহুর্ত দেরি না করে এই গ্রাম ছেড়ে আজই  চলে যাও। তোমাকে আজ রাতেই মেরে ফেলবে। ওরা সব পরিকল্পনা সম্পন্ন করে রেখেছে। আমি সব শুনেছি। 
জানিনা এ জীবনে আর কোনোদিন তোমার সাথে আমার দেখা হবে কিনা। যেখানেই যাও যতদূরে যাও,  ভুলবে না আমাকে। এই অভাগীকে তুমি  মনে রেখ।'         

রোহিত হয়ত সাহস করে, জেদ করে গ্রামে থেকে যেতে পারত। কিন্তু থাকেনি। জলের ভিতর কুমিরের সাথে বসবাস বেশি দিন করা যায় না। বিপদ এক সময় না একসময় চলে আসবেই। সেদিন সেই সন্ধ্যা রাত্রিতে কাউকে কিছু না বলে, এমনকি বৃদ্ধ বাবা মা, বড়ো দা এবং ছোট বোন রোহিনীকে কিছু না জানিয়ে  সে গৃহ ত্যাগ করে। এক অনিশ্চিত অজানার উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়ে সে বেরিয়ে পড়ে।  

কার্তিক মাসের অমাবস্যার সেই রাতে রোহিত যখন হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে শ্লথ পায়ে হেঁটে হেঁটে চলে আসছিল, তখন আঁধার ভেদ করে সে পিছনে চেয়ে দেখছিল  তার শৈশবের পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা গ্রামকে। সে দেখতে পায় দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাকুড় , জারুল, দেবদারু ও আমগাছ গুলো। আকাশের দিকে চেয়ে দেখে  
দূরে  বিষণ্ণ হয়ে অনুজ্জ্বল সব তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে।             
                 
রোহিত মেঠো পথ ধরে হেঁটে হেঁটে প্রায় সাত মাইল দূরে বয়রা ঘাটে চলে আসে।  তার পকেটে ছিল তাদের মনোহারি দোকানের সওদা বিক্রি করা একশত আশি টাকা। আর ছোট্ট টিনের স্যুটকেসের ভিতর  ছিল একটি  সার্ট, একটি পায়জামা, দুটি লুঙ্গি, একটি গামছা, একটি চিরুনি, ছোট্ট একটি গোল আয়না ও খুটিনাটি কিছু দ্রব্য।  আর ছিল জরুরি কিছু  কাগজপত্র, খাতা ও একটি কলম।                                                

বয়রা ঘাটে যখন সে পৌঁছে তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে যায়।  পথে হেঁটে আসতে আসতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। খুব খিদাও লেগেছিল তার।  ঘাটে একটি ভাঙা টিনের চালার হোটেলে ঢুকে সে আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে নেয়। 

ওপারে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যাওয়ার জন্য রাতে কোনো  স্টীমার নেই । পরের দিন সকাল সাতটায় স্টীমার আসবে। সে ঘাটে নোঙর করা  ভাসমান প্লাটফর্মের একটি খালি বেঞ্চের উপর যেয়ে বসে পড়ে।  উত্তাল নদীর জল বয়ে চলেছে ছলাৎছলাৎ শব্দ করে। নদীর আকাশ জুড়ে অন্ধকার রাত্রি।  রোহিত তাকিয়ে ছিল জলের দিকে। তার মনে পড়ছিল কত কথা। মনে পড়ছিল বৃদ্ধ বাবার কথা, অসুস্থ মায়ের কথা, দাদা ভাইয়ের কথা, স্নেহময়ী ছোট বোনটার কথা। আর মনে পড়ছিল আর একজনের কথা, যার কারণে তার এই গৃহ ত্যাগ, যার জন্য তার এই দূর্দশা। 

আর কী কখনও দেখা হবে প্রিয় এই মানুষগুলোর সাথে। জানে না সে কোথায় যাচ্ছে, বিদেশ বিভূঁইয়ে কোথায় কোন ছন্নছাড়া ছিন্ন জীবনে এ জীবন কাটবে, তা সে কিছুই জানে না। যে জীবনই পাওয়া হোক, তাও একদিন শেষ হয়ে যাবে। কেউ জানবে না সে কেমন আছে, কোথায় আছে।     

' অনন্ত অজানা দেশ , নিতান্ত যে একা তুমি , পথ কোথা পাবে ! হায় , কোথা যাবে ! কঠিন বিপুল এ জগৎ , খুঁজে নেয় যে যাহার পথ। স্নেহের পুতলি তুমি সহসা অসীমে গিয়ে কার মুখে চাবে । হায় , কোথা যাবে !....
যাবে যদি , যাও যাও , অশ্রু তব মুছে যাও , এইখানে দুঃখ রেখে যাও।'
 
                                                     
রোহিত বাগবাটি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞানে ম্যাট্রিক পাশ করে টাংগাইলের করটিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে গ্রামে ফিরে এসেছিল । সে কোনো একটি স্কুলে অংকের শিক্ষকের চাকুরি করবে এই তার ইচ্ছা ছিল।     

একদিন গুরিগুরি বৃষ্টির দিনে তাদেরই গ্রামের    হাসান আলী মাস্টার ছাতা মাথায় দিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। পথে দেখা হয় রোহিতের সাথে। রোহিত আসছিল কুড়াগাছা হাটখোলা থেকে। রোহিত হাসান আলী মাস্টারের ছাত্র ছিল।  হাসান আলী জানত রোহিত খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। এবং সে ছিল সরল, অমায়িক ও ভদ্র একটি ছেলে । 
  
পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে  হাসান আলী মাস্টার রোহিতকে বলে -- ' তুমি কী মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে আমাদের রেবেকাকে একটু অংক দেখিয়ে দিয়ে যেতে পারবে?  এজন্য তুমি অবশ্য  মাহিনা পাবে। তুমি হয়ত জানো -- রেবেকা এখন  নবম ক্লাসে পড়ে।                                           
রোহিত হাসান আলী মাস্টারের প্রস্তাব ফেলতে পারেনি। সে বলেছিল -- আচ্ছা, আসব ওকে পড়াতে।       

রোহিত বেশির ভাগ সময় বিকালবেলা রেবেকাকে পড়াতে আসত।  বাড়ির খোলা বারান্দায় এক কোণে চেয়ার টেবিল পাতা থাকত।  সেই টেবিলে বসে মোটামুটি সবার নজরের সামনে রোহিত প্রতিদিনের অংকগুলো রেবেকাকে করিয়ে এবং বুঝিয়ে দিয়ে যেত।             
          
রোহিতের কাছে রেবেকা প্রাইভেট পড়ে ভালোই রেজাল্ট করছিল। আগে ক্লাসে অংক ও এ্যালজাবরা সলভ্ করতে পারত না। এখন পারে।  এখন সবার আগে অংক করে ক্লাসে স্যারের কাছে জমা দিতে পারে। হাসান মাস্টারও খুব খুশি। রেবেকাকে পড়ানোর জন্য রোহিত মাসে দশ  টাকা করে পায়।
                                     
রেবেকা চৌদ্দ পনরো বছরের উদ্ভাসিত তন্বী  তরুণী। গায়ের রঙ গৌরীয়, এবং কালো কেশী। টানা ডাগর চোখের মণিদুটো ছিল সন্ধ্যাতারার মতো সমুজ্জ্বল। অপরূপা সে। বিশ্ব বিধাতা শিল্পীর মতো করে কত সৌন্দর্য, কত সুধা, কত মমতা দিয়েই না এই নারীদেহ তৈরি করেন! রেবেকা এমনই একটি নারী শিল্প কর্ম।    

মানুষের রূপ, প্রেম, জৈবিক চাহিদা, শরীর সৌন্দর্যের মুগ্ধতা কোনো স্থান কাল মানে না। রেবেকা নেহায়াতই একজন পল্লীবালা, কিন্তু তার চাওয়া পাওয়া ছিল পার্থিব জগতের অন্যান্য রমণীদের মতোই।  সেও কিছু চাইতে পারে তার মতো করে। যা অন্যরা চায়।  আবার অন্য কারোর চাওয়ার সাথে তার চাওয়ার মিল নাও হতে পারে। একজনের চোখে যা আঁধার। অন্য আর একজনের চোখে তা দ্যুতিময় আলো।  কাউকে দেখতে দেখতে ভালোলাগে, কাউকে ভালোলাগতে লাগতে ভালোবাসে।  জগতের অনেক ভালোবাসার কাহিনি  এমনই স্বাক্ষ্য দেয়।             

সেদিনও বিকালবেলা রোহিত বাড়ির বারান্দায় বসে রেবেকাকে পড়াচ্ছিল। নিম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বিকালের সোনালী আলো এসে পড়ছিল রেবেকার মুখের উপর। কী অপরূপ লাগছিল ঐ সময়ের তার মুখের দীপ্তি। আঙিনায় দুচোখ মেলে রেবেকা দেখে -- কোথাও কেউ নেই।
এখন যে শুধু কথা বলার সময়।    

যে কথাটি রেবেকা  আজ কয়েকদিন ধরে রোহিতকে বলতে চায় , সেই কথাটি আজ বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে সে। কম্পিত ঠোঁট যেন কেঁপে কেঁপে কিছু বলতে চায় বারবার । মনে হচ্ছে যেন  বহুদূরের কোন পাহাড়ি ঝর্নার মতো অমিয় ফল্গুধারা তার হৃদয় থেকে ঝরে পড়ছে। অদ্ভুত বিস্মরণের সময়!  রেবেকা রোহিতের হাতের উপর তার একটি হাত রেখে দ্বিধাহীন চিত্তে বলে  -- 'আমি তোমাকে ভালোবাসি রোহিত'।  

হঠাৎ বিকালের দীপ্ত আলো যেন ধপ্ করে  নিভে গেল। সেদিনের সন্ধ্যা দ্রুত আঁধার হয়ে গেল। আম গাছের ডালে থেকে একটি কাক কা-কা করে  উড়ে চলে গেল। রোহিতের মুখখানা চকিত বিমর্ষ হয়ে উঠল। এক অমাঙ্গলিক ছায়া পড়ল যেন তার চোখে মুখের উপর ।                

সেদিন আর রোহিত রেবেকাকে পড়াল না।  সে ওর সাথে কোনো কথা না বলে সোজা বাড়ি চলে আসে। বাড়ির সামনে পুকুরের চালায়  একাকী বসে ভাবছিল -- 'এ প্রেম কখনোই পূর্ণ করে পাওয়ার নয়।  এ চাওয়া অসঙ্গত ও অমাঙ্গলিক।  এ ঘটনা গ্রামে  জানাজানি হলে তাদের পরিবারের উপর মহাবিপদ নেমে আসবে।' হাসান মাস্টারের পরিবার গ্রামে দূর্দান্ত প্রতাপশালী। এরা যে কোনো রূপ ক্ষতি করতে পারে। আসন্ন সব বিপদের দৃশ্যগুলো রোহিতের চোখের সামনে ভয়ঙ্কর ছবির মতো ভেসে উঠতে থাকে। এবং সে ভিষণ বিচলিত হয়ে ওঠে।            

সে পরের দিন আবারও রেবেকাকে পড়াতে যায়। 
রেবেকার পড়ায় কোনো মন বসে না।  রোহিত যা পড়ায় তা কোনো কিছুই বুঝে নেয়না।  সে ছিল নির্বিকার। মন ছিল উড়ো উড়ো। রেবেকা আজও আস্তে আস্তে মৃদুস্বরে রোহিতকে বলেছিল -- 'আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।'                                                                              
রোহিতের সাথে রেবেকার এই গোপন সম্পর্ক চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস।  ওরা পড়তে বসে প্রায়ই  চুপিচুপি কথা বলত। কখনও একে অপরের হাত ধরে থাকত। অস্ফুট করে অনেক কথাই বলত দুজনে। এমনই করে দিনে দিনে তারা গভীর মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলে দুজনকে। দুজনেই এক অনিশ্চিত আনন্দে আপ্লূত হয়ে ওঠে। সেদিন বাড়ি আসতে আসতে রোহিত অখ্যাত এক কবির কবিতার এই পংক্তিগুলো আওরাচ্ছিল --

'একদিন তপ্ত দুপুরবেলায় তুমি আগুন পলাশ বনে এসে দাঁড়াবে। রাঙা পলাশের আবীর মাখবে তোমার গালে।  তোমার বুক দুরুদুরু। আমার নামে কাজল দেবে চোখে, আদর মেখে নেবে তোমার ঠোঁটে। জুঁই ফুল দিয়ে তুমি চুলের বিনুনি গাঁথবে, খোঁপায় গুজবে হলুদ গোলাপ।'

প্রতিদিন ওরা দুজন যে হাত ধরাধরি করে, এবং ফিসফিস করে নানান কথা বলে -- ওদের এই ব্যাপারটা রেবেকার মায়ের নজরে পড়ে। সে শুনবার চেষ্টা করে তাদের ভিতর কী কথা হয়। কিন্তু ওরা এত আস্তে কথা বলত যে, কোনো কথাই সে শুনতে পেত না। কিন্তু  সন্দেহ রয়েই যায়। ওদের গতিবিধির উপর আড়াল থেকে সে নজরদারি করতে থাকে। 
                   
একদিন রেবেকাকে পড়াতে এসেছিল রোহিত। রেবেকার মা ঘরের ভিতর থেকে জানালার ফাঁক দিয়ে ওদের  উপর নজর রাখছিল, সে দেখতে পায়, রেবেকা রোহিতের দুই হাতের ভিতর  মুখ লুকিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছে।  কেঁদে কেঁদে বলছে- 'তুমি আমাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাও।  আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাও। আমাক বিয়ে করো, তোমার সাথে ঘর সংসার বাঁধব।' রোহিত নিরব ছিল। এই কথার কোনো জবাব তখন সে দেয়নি। 

রোহিত আজও বাড়িতে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবছিল অনেক কথা। রেবেকাকে সে কী ভাবে বলবে যে -- 'আমার উপর থেকে তোমার এই ভালোলাগা উঠিয়ে নাও। যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো, সে ভালোবাসাও ফিরিয়ে নাও। ধর্ম বিরুদ্ধ এই ভালোবাসা তোমার ধর্মের মানুষেরা কখনোই মেনে নেবে না।'    

রোহিত ও রেবেকার আরও কিছু ঘনিষ্ঠ হওয়ার  দৃশ্য রেবেকার মা কয়েকদিন দেখেছে। প্রায় সময়ই দুজন দুজনকে কাছে টানে। জড়িয়ে ধরে।  হাত ধরে থেকেই পড়াশোনা করে এবং আলাপ চারিতা করে। আর একদিন তো চুম্বনের দৃশ্যও দেখে ফেলে।  ব্যাপারটি তার কাছে ভালো লাগ নাই। সে এই ঘটনাগুলো নিজের ভিতর গোপন রাখতে আর সাহস পায়নি। 

একদিন রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে সব কথা বলে দেয় তার স্বামী হাসান আলী মাস্টারের কাছে। পরের দিন যখন রোহিত রেবেকাকে পড়াতে আসে তখন রোহিতকে হাসান আলী মাস্টার ডেকে বলে দেয় -- ' তোমাকে আর আজ থেকে পড়াতে আসতে হবে না। তুমি আর কোনাদিন আমার বাড়িতে ঢুকবে না। এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। এই গ্রামের ত্রিসীমানায় থাকবে না।'   

হাসান মাস্টার আরও শাসায় -- 'যদি কখনও আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়াও, তাহলে তোমার পরিণতি হবে ভয়াবহ। বুঝতে পেরেছ? কী করব তোমাকে? এবার তুমি চলে যেতে পারো। 

রোহিত নিরবে চলে আসছিল -- পিছনে থেকে হাসান মাস্টার আবারও ডাক দিয়ে রোহিতকে,  এবং বলে-- 'এই ঘটনা তোমার বাবা মা ভাই বোন বা অন্য কেউ কী জানে? 
--- জ্বী, না,  কেউ জানে না। 
--- জানলে আমার মেয়ের বদনামি হবে। তুমি তোমার গীতার কসম খেয়ে বলো -- কাউকে বলবে না এই কথা। কোনো কাক পক্ষীও যেন না জানে। বুঝলে? যদি জানে, তবে এর পরিণতিও হবে ভয়াবহ। 
--- জ্বী,  আমি গীতার কসম খেয়ে বলছি -- 
কেউ জানবে না এ কথা। আমার আপনজন, বন্ধু বান্ধব কেউ না। আমি অঙ্গীকার করে গেলাম। আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে না।           

হাসান আলী মাস্টার তার মেয়ে রেবেকাকে ডেকে বলে -- আজ থেকে তোমার লেখাপড়া বন্ধ।  তুমি আর স্কুলে যেতে পারবে না।  ঘরে থাকবে।  বুঝতে পেরেছ? 
--- জ্বী। 
--- ঐ ছেলের সাথে ভবিষ্যতে কোনোরূপ যদি যোগাযোগ করো তাহলে ওকে আমরা জবাই করে হাড়গোর টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে যমুনায় ভাসিয়ে দিব।  বুঝলে? 
--- জ্বী।                                                                                                             
কয়েকদিন পর একদিন রেবেকা ওর ছোট ভাই রাসেলের মারফতে রোহিতের কাছে একটি পত্র লিখে পাঠায়। পত্রে লেখা ছিল --

কল্যাণীয়েষু, 

বাবা মা আমাকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। লেখাপড়া সব বন্ধ। রোহিত, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি সারাক্ষণ তোমার জন্য অশ্রুপাত করি।  
তুমি কখনই আমার ভালোবাসাকে অমর্যদা করো না।  যে কোনো ভাবে হোক, তুমি আমার জন্য ত্যাগ স্বীকার করিও। তোমাকে যেন এ জীবনে কখনোই না হারাই, সেই ব্যবস্থা করবে।
 
যাই করো, খুব তাড়াতাড়ি করিও।  বাবা মা আমাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোর করছে। পারলে আগামীকাল মধ্যরাতে তুমি আমার সাথে দেখা করবে।  আমি সবার অলক্ষ্যে চুপিচুপি ঘর থেকে বের হবো।  তুমি আমাদের পুকুরপাড়ে লিচু গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আর যদি না যেতে পারি, তবে মনে করবে ঘর থেকে বের হওয়া আমার সম্ভব হয় নাই।        
                  
ইতি --- রেবেকা।     

চিঠিটি পড়ে কী মনে করে ঐদিনই রোহিত  সিরাজগঞ্জ শহরে যেয়ে গোপনে ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। দেখা হলে রেবেকাকে যেন বলতে পারে -- '' আমি এখন মুসলমান। তুমি তোমার বাবাকে বলো, রোহিত মুসলমান হয়েছে। ওর সাথে তোমরা আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও।"    

রোহিতের কাছে মনে হয়েছে এ জগতে ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়।  আর প্রেম হচ্ছে ধর্মের চেয়েও মহোত্তম।  সে বার বার ভাবছিল -- এই বালিকাটি অবুঝ!  তাকে কাঁদানো ঠিক হবে না। তার সরল প্রাণের চাওয়াকে মর্যাদা দেওয়া দরকার। ধর্মে কী এসে যায়। কেউ জানুক না জানুক, আমি জানি -- রেবেকার প্রেমকে মর্যাদা দিতে গিয়ে একটি ননজুডিশিয়াল স্টাম্পের মধ্যে ধর্মকে সীমাবদ্ধ রেখে না হয় স্বাক্ষ্য দিলাম -- আমি মুসলমান। তবুও আমি রেবেকাকে পেতে চাই। তবু্ও এই মেয়েটির চাওয়া পূর্ণ হোক।        

রোহিত তার ধর্মান্তরিত হয়ে যাবার ঘটনাটি আগেই কাউকে বলল না।   
 
একদিন রেবেকা ওর বাবা মাকে এমনই  বলেছিল-''রোহিত যদি মুসলিম হয়ে যায়, তাহলে কী ওর সাথে আমাকে তোমরা বিয়ে দিতে রাজি হবে?' এ কথা শুনে হাসান মাস্টার আরও রেগে গিয়ে বলেছিল -- কোনোক্রমেই না। ঐ মালাউনের সাথে বিয়ে আমি কখনোই  হতে দেব না।' 


সেদিন ছিল কার্তিকের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। ক্রমেই  রাত গভীর হতে থাকে। বাইরে নির্জনতা খাঁ-খা করছে। ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন ধ্বনি স্পষ্টতর হচ্ছে। রেবেকা জেগেই ছিল। চিঠিতে লেখা পূর্ব কথা মতো তাকে বের হতে হবে। সে বিছানা থেকে  উঠে বসে। পাশের রুমে ওর বাবা নাকে শব্দ করে ঘুমাচ্ছে। আর কেউ যে জেগে নেই, এটাও বোঝা গেল। ওর পরনে ছিল সালোয়ার কামিজ। হাতে চুড়ি ছিল না। গলায় নেই মালা। দুই কানে ছোট্ট দুটো কান ফুল পরা ছিল শুধু। সে খালি পায়ে আস্তে আস্তে হেঁটে  গিয়ে দরজার খিল খোলে। বাইরে থেকে পাল্লা  ভেজায়ে  দিয়ে সে উঠোনে চলে আসে।  বাইরে তাকিয়ে দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কোনো মনুষ্যজনের সাড়াশব্দ নেই। হেঁটে হেঁটে সে পুকুর পাড়ের দিকে চলে যায়।  সেখানে দেখতে পায়,  লিচুগাছ তলায় রোহিত দাঁড়িয়ে আছে। 

রেবেকা রোহিতের বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলে-- 'তুমি আমাকে নিয়ে যাও। বাবা মা তোমার সাথে  বিয়েতে রাজি নয়।  তুমি যদি মুসলমানও হয়ে যাও, তারপরেও বিয়ে দেবে না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। তুমি আমাকে বের করে আজ রাতেই নিয়ে যাও। '

রোহিত বলে -- তুমি ছোট মানুষ। বুঝবার চেষ্টা করো। এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব?  আর গেলে আমাদের পরিবারের উপর বিপদ নেমে আসবে।  তুমি একটু ধৈর্য ধরো।  অপেক্ষা করো। 

--- আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। আমাকে খুব শীঘ্রই বিয়ে দিয়ে দেবে। 

-- তুমি আমাকে কটা দিন সময় দাও।  দেখা যাক, কী করা যায়।    
 
-- দেখ কী হয়। আমার খুব ভয় হয়। 

রোহিত ওর মুসলমান হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা রেবেকাকে সেক্ষণে আর বলার প্রয়োজন মনে করল না। 
          
এরপর দুজন হাত ধরে হেঁটে হেঁটে পুকুর পাড়ের দিকে চলে যায়। ওখানে হাস্না হেনা ঝোপের আড়ালে ঘাসের উপর যেয়ে বসে। রেবেকা ওখানেও রোহিতকে বুকে জড়িয়ে অশ্রুপাত করতে থাকে। এবং রুদ্ধবাকে বলতে থাকে -- আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।'      

সেদিন সেই কৃষ্ণপক্ষের রাতে ঘাসের উপরে  
দুটো প্রাণ কতক্ষণ একে অপরকে  জড়িয়ে থেকেছিল, এবং প্রকাশিত করেছিল ভালোবাসা -- তা শুধু জানে শিশির সিক্ত ঘাস আর রাতের আঁধার !  কারণ, আঁধারই যে সেই রাতে নিবিড় করে ওদেরকে ঢেকে রেখেছিল।                                                                 
রেবেকা রোহিতের সাথে  দেখা করে বাড়ি  ফিরে এসে দেখে --  ওর বাবা ও মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।  হাসান মাস্টার রুদ্র মূর্তিতে   রেবেকাকে চরম রাগান্বিত স্বরে  বলে --- কোথায় গিয়েছিলেে? 

-- রোহিতের সাথে দেখা করতে। 

-- এর পরিণতি কী ভয়াবহ হবে, তা তুমি  জানো? 

রেবেকা ত্রস্ত হয়ে  মাথা নিচু করে থাকে।                   

 
এক দিন পরেই রেবেকাদের বাড়িতে ব্রম্মগাছা থেকে ওর এক মামা আসে। তাকে জরুরি ভাবে  খবর দিয়ে আনা হয়। রেবেকার মামাটি ষন্ডা প্রকৃতির। গোপনে সে সর্বহারা পার্টি টার্টি করে। মানুষ গুম ও হত্যা করাই তার কাজ। রেবেকার বাবা বিকালবেলা সেই ষন্ডার কাছে রেবেকার ঘটনাটি খুলে বলে। ষন্ডা বলে -- আজ রাতেই ঐ মালুর বাচ্চাকে খতম করে দেই, ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেই দুলাভাই। 

হাসান মাস্টার বলে -- আমি তো এই জন্যই তোমাকে খবর দিয়ে এনেছি। তুমি একা এই কাজ করতে পারবে? 

ষন্ডা বলছিল -- পাশের গ্রামেই আমার দুজন অনুসারী আছে।  প্রয়োজনে ওদের খবর দিব। ওরা চলে আসবে।

--- ঠিক আছে তাই করো। ঐ মালুর বাচ্চারে আজ রাতেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দাও। ওকে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে যমুনার জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসবে।         

--- আচ্ছা। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে দুলাভাই।  কোনো চিন্তা করবেন না।    

রেবেকা পাশের রুম থেকে তাদের সব শলাপরামর্শ শুনে ফেলে।  আর সেই ক্ষণেই সে একটি চিরকুট  লিখে ওর ছোট ভাইয়ের মারফতে রোহিতের কাছে পাঠয়ে দেয়।
  
প্রিয় পাঠকগণ আপনারা ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছেন -- রোহিত এই হরিনা গোপাল গ্রাম ছেড়ে ততক্ষণে অজানা গন্তব্যের পথে ঘর হতে বেরিয়ে পড়েছে।                                                                                 


                                 
                                                                                                              

বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০২০

বিদিশার অন্ধকার

বিদিশার অন্ধকার 

                                                                  
কোনো এক শণিবারের বিকেলে চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকের ধারে বসে বিদিশা আমার হাত ধরে বলেছিল --- 'আমি তোমাকে ভালোবাসি।' সেদিন সেই মনোরম বিকেলে বিদিশার কানের কাছে মুখ রেখে কানে কানে আমিও বলেছিলাম ---
' তোমাকেও আমি ভালোবাসি।' 

আমাদের ভালোবাসার কথা শুনে উদ্যানের সকল ঘাস সেদিন সবুজ হয়ে উঠেছিল। লেকের জল হয়ে উঠেছিল চঞ্চল। শিরিষ আর ছাতিম গাছ থেকে ঝরা পাতাগুলো ঝরে পড়ছিল আমাদের উপর।'

তারপর কত বিকেল, কত সন্ধ্যায় আমি আর বিদিশা কত যে ভালোবাসা রচনা করেছি, সেকথা জানে চন্দ্রিমা উদ্যানের ঘাস আর লেকের জল। দিনগুলি আমার কাটছিল ভালোই বিদিশার ভালোবাসা নিয়ে। হঠাৎ একদিন সব এলোমেলো হয়ে গেল । এক ধূসর সন্ধ্যায় চন্দ্রিমার ঘাসে বসে বিদিশা আমাাকে বলেছিল --- ' তোমার সাথে আমার ঘর বাঁধা হবে না।' সেদিন সেই সন্ধ্যায় আমি বিদিশার কাছে এর কোনো কারণ জানতে চাইনি। সোজা ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে রাজপথে এসে জনারণ্যে মিশে গিয়েছিলাম। পিছনে আর ফিরেও তাকাইনি ।

তারপর অনেক বছর চলে গেছে। একদিন বিকাল বেলা খুব মন খারাপ লাগছিল। ভাবলাম --- চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে একটু বেড়িয়ে আসি। আমি বসেছিলাম যেয়ে সেইখানে, যেখানে বসে বিদিশার হাতে হাত রেখে বলেছিলাম --- 'ভালোবাসি'। এত বছর পরে আজ নিজেকে খুবই অপরাধি মনে হচ্ছিল, আফসোস করছিলাম --- কেন সেদিন বিদিশাকে বলিনি --- 'কি তোমার অসুবিধা ছিল, কেন তোমার বিয়ে করা সম্ভব নয়,?'

লেকের ধারে বসে থাকতে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছিলাম। উদ্যানের ঘাসগুলো সেদিনের মতো সবুজ লাগছিল না । লেকের জল কেমন অস্বচ্ছ, ঘোলাটে হয়ে আছে। শিরিষ ও ছাতিম গাছ থেকে মরা পাতাগুলো ঝরে পড়ছিল আজও। সারা উ্দ্যান জুড়ে কেমন আঁধার নেমে আসতে থাকে, কেমন যেন বিদিশার মতো অন্ধকার !

সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

মান ভঙ্গ

মান ভঙ্গ

বেশ কিছুদিন ধরে মেহনাজের সাথে আমার ঘন ঘন ঝগড়াঝাটি ও খুনসুটি হচ্ছে। নানান কারণে নানারূপ ঝগড়া । মাঝে মাঝে ঝগড়া তুমুল আকার ধারণ করে। প্রায়ই মেহনাজ আমাকে বলে -- 'তুমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।  তোমার মতো স্বামীর আমার দরকার নাই।'   
   
একদিন খুব তুমুল ঝগড়া হয় মেহনাজের সাথে আমার। সেদিনও মেহনাজ রাগে গর্জনে আমাকে বাড়ি হতে বের হয়ে যেতে বলে। আরও বলে --  'তোমার মুখ আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। আই হেট্ ইউ।'     

সেদিন সত্যি সত্যি বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। পকেটে তেমন কোনো টাকা ছিল না ।  বিভিন্ন সোর্স থেকে যে টাকা আয় হয়, তা মেহনাজই খরচ করে। আমার কোনো অধিকার নেই তাতে। আসলে আমার কাছে কোনো অধিকার রাখিনি।  আমি চাইতাম -- এই টানাটানির সংসারে মেহনাজই সব সামলাক। এ আমার কান্ডজ্ঞানহীন দায়িত্বহীনতাও বলা যেতে পারে। 
   
বাজার করে এনে দেওয়ার পর কিছু খুচরো টাকা বাচতো,  সেগুলো রেখে দিতাম বিছানার নিচে।  গুণে দেখি -- সেখানে ৪৫৩ টাকা আছে । তখন সকাল এগারোটা বাজে।  এই কটা টাকা নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। মোবাইল ফোনটা সাথে নেই না। রেখে যাই বাড়িতে।      
                                       
আমার একটি প্রিয় জায়গা বিমানবন্দর রেল স্টেশন। হাঁটতে হাঁটতে সেখানেই চলে যাই। প্লাটফর্মেের  উত্তর মাথায় নিরিবিলি একটি পাকা কংক্রিটের বেঞ্চের উপর  যেয়ে বসে থাকি। 
     
আমার কাছে পান বিড়িওয়ালা একটা ছেরা আসে। ওকে বললাম, সিগারেট দে। 
-- কোন্ সিগারেট দিব স্যার?   
  
আজ থেকে তিন বছর আগে চিরজনমের জন্য সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলাম।  ছাড়ার আগে তখন খেতাম বেনসন।  আজ আবার শুরু করছি নতুন করে।  বিড়িওয়ালা ছেরাকে বললাম -- বেনসন এ্যান্ড হেজেস দে। ঐ ছেরা আমাকে তাই দিল।  

কংক্রিটের বেঞ্চের উপর বসে পরপর দুই শলা সিগারেট মনের সুখে খেলাম।    

প্লাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে আরও একটু উত্তর দিকে যাই।  ওখানে দেখি -- একলোক পথের উপর কাপড় পেতে অনেকগুলো ইনভিলপ সারি করে বিছিয়ে রেখেছে। তার হাতের উপর একটি পোষা টিয়া পাখি বসে আছে। কাগজের সাইনবোর্ডে লেখা--  "এখানে ভাগ্যলেখা দেখা হয়।" আমি লোকটিকে বললাম -- 'ভাগ্য লেখা দেখতে কত টাকা লাগবে?'       
--- দশ টাকা স্যার। 

আমি লোকটিকে দশ টাকা দিয়ে বললাম -- ভাগ্য লেখা দেখান।  
লোকটি টিয়া পাখিকে বলল -- 'এই সাহেবের ভাগ্যে কী লেখা আছে?  উঠাও।'     
  
টিয়া পাখি ঘুরে ঘুরে একটি ইনভিলপ ঠোঁট দিয়ে উঠিয়ে লোকটির হাতে দিল। সে দিল আমার হাতে।  আমি ইনভিলপটি হাতে নিয়ে ভিতর থেকে কাগজটি বের করে পড়লাম।  কাগজটিতে  লেখা আছে -- 'স্বামী--স্ত্রী / প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে আজ মহব্বত বাড়বে।'            

হেঁটে হেঁটে আবার কংক্রিটের বেঞ্চের উপর এসে  বসি। প্লাটফর্মের ওপাশে ডোবার মতো পুকুর। পুকুর পাড়ে দুটো শালিক আজাইরা ঠোকরাঠুকরি করছে। প্রেমে গদগদ হলে এমন নাকি  লাফালাফি করে। খুব বিরক্ত লাগছিল, এর নাম নাকি 'টু ফর জয়।' মনে মনে বললাম -- 'ঘোড়ার ডিম। এই বুঝি আমার আনন্দ !'  

কমলাপুরের দিক থেকে একটি লোকাল ট্টেন প্লাটফর্মে এসে থামে। যাবে ময়মনসিংহ।  আমি ঐ ট্রেনটিতে উঠে পড়লাম। তৃতীয় ক্লাসে টিকিট বিহীন যাত্রী আমি।  ট্রেনটা ষখন জয়দেবপুর ছেড়েছে, তখন এক ছোকরা বয়সের চেকার এসে বলে -- 'টি-কে-ট।'
বললাম -- নেই। 
-- কোথায় যাবেন? 
--  যেতে চেয়েছিলাম মশাখালি, গফরগাঁও।  তা আর যাব না। সামনে রাজেন্দ্রপুর নেমে যাব।  
-- জরিমানা সহ একশত টাকা দিন। 
আমি ছোকরাকে একশত টাকা গুণে দিয়ে পাকা রশিদ নিয়ে নিলাম।     

রাজেন্দ্রপুর স্টেশনে নেমে পড়ি।  পেটে তখন সাঙ্গাতিক খিদা।  একটা টিনের চালার হোটেলে ঢুকে পড়ি।  মালিককে বললাম -- তরকারি কী? 
মালিক বলল -- ফার্মের মুরগী, পাকিস্তানি কক, দেশি মোরগ, আর কালিয়াকৈরের বিলের বাইলা মাছ। 
আমি বললাম -- দেশী মোরগ আর বাইলা মাছ দিবেন। 
মালিক তার মেছিয়ারকে বলল -- ঐ বেটা, প্লেট ভালো করে ধুইয়ে এই স্যারের জন্য বাইলা মাছ আর দেশি মুরগী লাগা।       

হোটেলে খেয়ে বাইরে এসে একটি টং দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে আবারও বেনসন সিগারেট খেলাম পরপর দুই শলা। দ্বিতীয় শলা যখন টানছিলাম তখন হঠাৎ মনে পড়ল --                                                                                   
আজ থেকে সাতাশ বছর আগে মেহনাজকে নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে এই শালবনে বেড়াতে এসেছিলাম।  তখন সবেমাত্র বিয়ে করেছি। বউকে নিয়ে শালবন দেখার খুব সাধ হয়েছিল। একদিন ছুটির দিনে লোকাল ট্রেনে করে টংগী স্টেশন থেকে এই রাজেন্দ্রপুর চলে আসি। এখানে স্টেশনে নেমে একটি চা'র দোকানে বসে দু'জন চা খাই। সাথে দুটো করে ডালপুরি ও গরম সিঙারাও খেয়েছিলাম।

স্টেশনটা আস্তে আস্তে এক সময় ফাঁকা হয়ে যায়। আমরা বসেই থাকি। দেখি -- একটা লোক একটা বানর নিয়ে এগিয়ে আসছে। সে বানরের নাচের খেলা  দেখায়। লোকটাকে দশ টাকা দিয়ে বানরের নাচ দেখি। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা শালবনের দিকে চলে যাই। 

মেহনাজের  পরনে ছিল হলুদ রঙের জর্জেট শাড়ি। পায়ে ছিল লাল রঙ্গের বাটার জুতা আর চুল ছিল সবুজ ভেলভেটের ফিতা দিয়ে খোপা বা্ঁধা। দেখতে একদম রূপবানের মতো রূপবতি লাগছিল। আমরা শালবনের অনেক ভিতরে চলে যাই। কা্ঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। ভাবছিলাম, ওর একটা হাত ধরি। কিন্তু লজ্জা লাগছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে। আরো কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি, একটি জলার মতো পুকুর। পুকুরের চারপাশে শালবনে ঘেরা। পাড়ে দূর্বা ঘাসের উপর দু'জন বসে পড়ি।

একটু পর দেখি, একটি বালিকা বকুল ফুলের মালা নিয়ে এগিয়ে আসছে। মেহনাজকে বলে -- 'আফা, একটা মালা নিবেন।' আমি বালিকার কাছ থেকে চারটি মালা কিনে ওর খোঁপায় পরিয়ে দিয়েছিলাম। 

তারও কিছু সময় পর একটি বৃদ্ধ লোক ময়ুরের পেখম এনে ওকে বলে -- মা, ময়ুরের ফইরা নিবেন।' আমি বৃদ্ধের কাছ থেকে সবগুলো পেখম কিনে নতুন বউকে দিয়ে বলেছিলাম, বাড়িতে যেয়ে আমার জন্য একটা ময়ুরপঙ্খী পাখা বানাইয়া দিও।

বালিকা ও লোকটি চলে যায়। পুকুরের পাড় তখন নির্জন। বক, ডা্হুক, হা্ঁস,পানকৌড়িরা তখন কিচিরমিচির করছিল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, জনমানব শূণ্য। আমি ওর মুখের দিকে একবার তাকাই। নির্জন দুপুরের রোদ্দুর ওর মুখে এসে পড়েছিল। খুব মোহনীয় লাগছিল ওকে। ভাবলাম- একটু কাছে টানি। আদর দেই ঐ মুখে। ওর মুখের দিকে ঝুঁকতেই কোত্থেকে একটি তীর এসে ওর শরীরে বিদ্ধ হয়। রক্তাক্ত হয় ওর শরীর, রক্তে ভিজে যায় ওর শাড়ি।

আর আহত হয় পানকৌড়ি। পানকৌড়ির রক্তাক্ত পালক পড়ে থাকে পুকুরের পাড়ে।
                                       
মনটা ভালো লাগছিল না। ভাবছিলাম কী করব,  কোথায় যাব?  একবার মনে হলো -- হেঁটে হেঁটে পুকুর পাড়ে চলে যাই, যেয়ে বসি পাড়ের ঘাসের উপর।  যেখানে আজ থেকে সাতাশ বছর আগে আমরা দুজন বসেছিলাম। সেই ঘাস হয়ত নেই,  নেই আমাদের স্পর্শ কোথাও । তবু যেতে ইচ্ছে করছে। কেউ না থাকুক, শালবনের নিবিড় ছায়া তো সেখানে আছে।  সেই ছায়ায় মিশে আছে কারোর ছায়াহীন মায়া।         

একা একা যেতে আর ইচ্ছা করল না।  বসে থাকি বেঞ্চের উপরই। বসে বসে আরও এক কাপ চা ও দুটো সিগারেট খাই। হঠাৎ অদূরে তাকিয়ে দেখি --  স্টেশনের সবুজ সিগনাল বাতিটা জ্বলে উঠেছে।  ঢাকামুখি একটি ট্রেন এসে স্টেশনে থামে।  আমি টিকেট কেটে ট্রেনটাতে উঠে পড়ি, এবং ঢাকায় চলে আসি।    

বিমানবন্দর স্টেশনে যখন আসি তখন বিকাল হয়ে যায়। প্লাটফর্মের উপর নেমে পায়চারি করতে থাকি। ভাবছিলাম এখন কোথায় যাব?  আমার তো ঘর নেই। আমার কেউ নেই। যে একজন আছে, সে আমাকে ঘৃণা করে। আমাকে দেখতে পারে না।  
       
স্টেশনের নির্জন পুকুর পাড়ের কাছে যেয়ে একটু দাঁড়াই। ছোট ছোট কচুরীপানার ফাঁকে মৃদুমন্দ ঢেউ ভাঙছিল।  বিকালের বিষণ্ণ রোদ জলের উপর পড়ে ঝলমল করছিল।
 
সামনের দিকে  চোখ ফিরিয়ে দেখি, সমান্তরাল রেল পথ। জীবনের অনেক কিছুই জলের ঐ রৌদ্র দীপ্ত ঢেউয়ের মতো ঝিলমিল করে, আবার ঐ পথের মতো সমান্তরাল। একটি অপরিচিত ট্রেনে উঠে দূরে কোনো অচিনপুরে চলে যেতে ইচ্ছে করে। 

স্টেশনের বাইরে এসে একটি অটো রিকশা নিয়ে চলে যাই শিয়ালডাঙ্গা। দুধারে কাশবনের ফাঁকে নির্জন পথের উপর নেমে রিকশা ছেড়ে দেই। জলাশয়ের কাছে বাবলা গাছটার তলে যেয়ে বসি। মন খারাপ হলে কত বিকাল, কত সন্ধ্যায় আমি আর মেহনাজ এসে বসে থাকতাম এই বাবলা গাছের নীচে । পশ্চিম আকাশে সূর্য  অস্তমিত হতে দেখেছি কত দুজন, কত লাল আভার আবেশে ভরে  উঠেছে আমাদের মন।

মেহনাজ আমার বুকের ছায়ায় মাথা লুকিয়ে বলত,  'এই জীবনে তোমাকে আমি পেয়েছি, তাই কোনো দৌলত খুঁজি না কোথাও। আমি অন্য কিছু চাই না আর।'   

দুই হাঁটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে একটা অনুযোগই শুধু  করছিলাম -- ' সেই তুমি কত বদলে গেছ !'

হাঠাৎ পিঠের উপর কার যেন কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করি। মুখ তুলে দেখি -- মেহনাজ।  ও বলছিল -- ' আমি জানতাম, তোমার মন খারাপের দিনে তুমি এখানেই থাকবে। তাই এখানেই চলে এলাম তোমাকে খুঁজতে।'   
    
সায়াহ্নের সেই সন্ধ্যায় অস্ত সূর্যের উদ্ভাসিত আলোয় চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম তার আনত মায়াবী মুখখানি।