শনিবার, ৬ জুন, ২০২০

তোমার দেওয়া অঙ্গুরীয়

তোমার দেওয়া অঙ্গুরীয়

বর্ষা মাসের  এক মধ্যাহ্ণে আমাদের বাড়ির ঘাটে একটি ছোট ছইওয়ালা নৌকা এসে থামে। নৌকার ভিতর থেকে একজন মধ্যবয়সী লোক ও আর একজন মধ্যবয়সী মহিলা নামে।  তারা দুজনেই বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করে।      

মহিলাটি আমার মায়ের দূর সম্পর্কের বোন। নাম মোছাঃ শিরিনা খাতুন। আমরা তাকে শিরিন খালা বলে ডাকতাম। এই শিরিন  খালা খুব কম আসত আমাদের বাড়িতে।  সে কম আসলেও আমাদের ভাই বোনদের খুব স্নেহ করতেন তিনি ।                                  
শিরিন খালার সাথে যে লোকটি এসেছেন, তিনি আমাদের খালু।  মা, শিরিন খালা ও খালুকে দেখে খুব খুশি হন। এবং তাদেরকে দুপুরেই উপস্থিত মতো ভালো খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করলেন।                
শিরিন খালা মার তিন চার বছরের ছোট ছিল।  শিরিন খালা মার আপন ছোট বোন না হলেও, মা তাকে ছোট বোনের অধিক স্নেহ করতেন।  

দুপুরের খাওয়ার পরে শিরিন খালা মার কাছে একটি কথা পারলেন।  সে মাকে বলল -- 'বুবু আমরা একটা শুভ প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।'
--- কী প্রস্তাব এনেছ।      
--- 'মঞ্জুর একটি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। মেয়ে আমাদের গায়েরই। বাবা মার একটাই মেয়ে আর কেউ নেই। মেয়ে খুব রূপবতী। ক্লাস সেভেনে পড়ে। বয়স তেরো চোদ্দ হবে। 
আমি খুব আশা নিয়ে এসেছি।  তোমরা মেয়েটিকে একবার দেখো।  পছন্দ হবে তোমাদের। খুব সুন্দরী এবং অমায়িক।  তাছাড়া, মেয়ের বাবা অনেক ধন সম্পদের মালিক। এই ধন সম্পত্তি সব একদিন মেয়ের হবে।    
আমি মেয়ের বাবা মায়ের সাথে আলাপ করেছি।  তারা বলেছে -- আপনি ছেলের মায়ের সাথে আলাপ করে দেখেন। আমাদের এই সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি নেই। '
  
মা বলছিল - ' তোমরা তো জানো,  মঞ্জু মাস্টার্স করে কেবল সরকারি চাকুরিতে ঢুকেছে। ও এখানে থাকে না।  ঢাকায় থাকে।  ওর সাথে আলাপ না করে তোমাকে কোনো কিছু বলতে পারছি না।'

-- 'ঠিক আছে, মঞ্জুর সাথে তো আলাপ করবেই।  কিন্তু তার আগে তোমরা মেয়েটিকে একবার দেখে রাখো, তোমাদের পছন্দ হলেই পরে না হয় মঞ্জুরকে মেয়ে দেখালে।'             
                              
-- 'কথাটি খারাপ বলো নাই।  আমরা না হয় আগেই দেখে নিলাম। আমাদের পছন্দ হলেই মঞ্জুরকে দেখাব। মঞ্জুর পছন্দ হলেই আমরা বিয়ের কথা পাকাপাকি করব।'

-- তাহলে কবে যাবে মেয়ে দেখতে? 
-- সামনের শুক্রবারই যাব।  আমরা চার পাঁচজন যাব।  তুমি মেয়ের বাবা মাকে বলে রেখো।

-- আচ্ছা।    

ঘটনাক্রমে আমার সবচেয়ে বড়ো বোন তখন বাড়িতেই ছিল।  সে তখন  বেড়াতে এসেছিল। আমার এই বোন আমাদের পরিবারের ভালো মন্দের সবকিছুতে মাকে পরামর্শ দিত।  মাও তার পরামর্শ গ্রহণ করত। 

একটি বড়ো ছইওয়ালা নৌকায় করে আমার মা, বড়ো বোন, এক জেঠাত ভাবি,  ছোট বোন ও ছোট ভাই সামনের ঐ শুক্রবারেই মেয়ে দেখতে চলে  য়ায়।  তারা প্রথমে শিরিন খালার বাড়িতে যায়। তারপর ওখান থেকে কণে বাড়িতে যায়।                                                                                    
একদম ঘরোয়া ভাবে এবং কোনো প্রকার  ফর্মালিটিস না করে আমাদের বাড়ির লোকজন মেয়েটিকে দেখে। মেয়ে অপ্রস্ফুটিত চন্দ্রমল্লিকার মতো দিগবালিকা। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রঙ। গোলাপি জবার মতো গাল, অবাক করা চোখে তার মায়া মায়া মাধুর্য লুকিয়ে আছে । আশ্বিনের বৃষ্টির রাতের মতো কালো মাথার চুল। এই তেরো চোদ্দ বছরের মেয়েটির উপরে হেমন্ত সকালের কমলা রঙের রোদের আলো এসে পড়েছে যেন। সবার দৃষ্টি ওর উপর স্থির হয়ে ছিল।    
   
আমি এই মেয়ের কিছুই জানিনা, কিছুই দেখিনি আমি। নিষ্পাপ নিষ্কলুষ ছিল কী সে ! স্বচ্ছ জলের মতো  নিবিড় ও পবিত্র?  হয়ত তার অপ্র্স্ফুটিত পাপড়িগুলো আমার আঙুলের ছোঁয়ায় এক এক করে মেলিতে পারিত। হয়ত তার শরীর মন আমার অলৌকিক যাদুরকাঠীর স্পর্শে উদ্বেলিত হয়ে উঠত।          

আমার মা মেয়েটিকে কাছে বসিয়ে বলেছিল --
'তোমার নাম কী মা?' মার মুখের দিকে চেয়ে মেয়েটি স্মিত বলেছিল -- রেশমা আলী। আমার বাবা আমাকে ডাকে -- রেশমী বলে।    

রেশমীকে সবাই আমার বউ করার জন্য পছন্দ করে।  এবং এই পছন্দ হওয়ার ব্যাপারটা তাৎক্ষণিক প্রকাশও হয়ে যায়।  মেয়ের বাবা মা
খুব খুশি হন। মেয়ের মা একপর্যায়ে তার মেয়েকে আমার মায়ের হাতের ভিতর সমর্পণ করে দিয়ে মাকে বলে -- 'বুবু, আজ থেকে আমার মেয়ে তোমার। তুমি ওকে তোমার বউমা করে ঘরে নিয়ে যেও।' আমার মা ও বলেছিল -- রেশমীকে আমরা যত দ্রুত আমাদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যাব। ওযে সাক্ষাৎ লক্ষী মেয়ে!'              
রেশমীকে সবাই বলছিল -- 'তোমার শ্বাশুড়ি মাকে কদমবুসি করো।' বালিকা সেদিন স্বলজ্জিত
হয়ে আমাদের বাড়ির গুরুজনদের কদমবুসি 
করেছিল। মা, তার হাতের আঙুল থেকে একটি অঙ্গুরীয় খুলে পরিয়ে দিয়েছিল রেশনীর অনামিকায়।                

একদিন অফিসের ঠিকানায় মার একটি চিঠি পাই।মা লিখেছিল ---
'স্নেহের মঞ্জুর,
আশা করি তুমি ভালো আছো।  তোমার চাকুরি ভালোভাবেই হয়ত চলছে।  পর সমাচার এই যে, আমরা তোমার বিবাহের পাত্রী দেখেছি।  মেয়ে খুবই সুন্দরী। ক্লাস সেভেনে পড়ে।  বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরে রাণীগ্রামে।  তোমার শিরিন খালার পরিচিত।  আমরা মেয়েটিকে দেখেছি।  তোমার বড়ো বুবুসহ আমাদের সবার পছন্দ হয়েছে। 

তুমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একবার বাড়িতে আসবে।  তুমিও মেয়েটিকে দেখবে।  তোমার পছন্দ হলে আমরা বিয়ের পাকাপাকি কথা বলব ওনাদের সাথে।  তুমি অবশ্যই বাড়ি চলে আসবে।  কোনোরূপ গাফিলতি করবে না।  

ভালো থাকবে। তোমার জন্য আমার দোয়া ও আশীর্বাদ রইল। 

ইতি --- তোমার মা।                                                     
মার পত্রখানি পড়ে একটাই খটকা মস্তিস্কে ঘুরপাক খাচ্ছিল -- ' মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে। তার মানে মেয়ের বয়স খুব জোর তেরো চোদ্দ বছর হবে। লেখাপড়ার কথা বাদই দিলাম,  শেষ পর্যন্ত কী না একটি বালিকা কে বিয়ে করব? '                      

আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম,  আমি কিছুতেই এই বালিকাকে বিয়ে করব না। অফিসের ব্যস্ততার কথা বলে ও নানা অযুহাত দেখিয়ে  মেয়েটিকে আমি কখনোই দেখতে যাব না।  আমি না দেখতে গেলে বিয়ে তো হবে না।  একসময় এমনি এমনি বিয়ের প্রস্তাবটা ভেঙে যাবে।  মেয়ে পক্ষ অন্তত এইভেবে শান্তি পাবে যে, তাদের  মেয়েটিকে দেখে অপছন্দ করে ছেলেটা বিয়ে করেনি।  ভাববে তারা তখন অন্য কথা।    

আমি আর বাড়িতে যাই না। মা পর পর আরও কয়েকটি পত্র লেখে। প্রতি চিঠিতেই বাড়িতে যাবার কথা লেখা থাকে। আমি প্রতিবার উত্তর লিখে পাঠাই --- 'মা, অফিসের কাজে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে গেছি।  বাড়িতে যাওয়ার কোনোরূপ সুযোগ পাচ্ছি না।  সুযোগ পাইলেই চলে আসব।'                                                         
এইভাবে ছয়-সাত মাস চলে যায়।  আমি আর বাড়িতে যাই না। 

আমরা অফিসিয়াল ট্যুরে কয়েকজন কর্মকর্তা একবার নেত্রকোনার বারহাট্টা গিয়েছিলাম।  কয়েকদিন ছিলাম ওখানে।  আমাদের সাথে দুটো মেয়েও গিয়েছিল। সেদিন ছিল ছুটির দিন। আমরা একটি নৌকা করে কংশ নদীতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। কী মায়াময় অপরাহ্ণ। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছিল। বিমুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম কংশের দুকূলে ঘরবাড়ি, বৃক্ষ, শস্যের ক্ষেত।  বিকালের সোনা রোদ্দুর বৃক্ষের পাতায় পড়ে ঝিকমিক করছিল।  ঝলমল করছিল কংসের শান্ত জলও।  কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলাম --
                                     
'একবার এসেই দেখুন কংশ নদের সাথে সমুদ্রের বেশ মিল আছে।
হাসবেন না, দোহাই, আমাদের গাঁয়ের লোকেরা খুব কষ্ট পাবে।....
আরে, এ তো শুধু নদী নয়, এ যে সমুদ্রের ছদ্মবেশী রূপ।.....
কোনো দিন কাউকে বলিনি, শুধু সুদূর শৈশব থেকে মনে-মনে..... 
মিলিয়েছি বারহাট্টার সাথে কক্সবাজার, কংশের সাথে বঙ্গোপসাগর।’

নৌকার পাটাতনের উপর চাদর বিছিয়ে আমরা বসেছিলাম, খালি কন্ঠে গান গেয়ে শোনায়েছিল নাসরিন। -- এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়,  একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু। 

ফেরার পথে গৌরীপুর জংশনে অপেক্ষা করছিলাম ঢাকাগামী ট্রেনের জন্য।  ট্রেন আসতে তখনও অনেক দেরি ছিল।  নাসরিন কী যেন বলতে চাইছিল আমাকে। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিল না।  তারপর এক পর্যায়ে  বলছিল -- 'আমার খুব প্লাটফর্ম ধরে  হেঁটে হেঁটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে ঐ দূরে ব্রিজটার কাছে। দুপাশে কী সুন্দর  মহুয়া গাছ। বাবলাও আছে। ফুলও ফুটে আছে। তুমি  যাবে আমার সাথে ঐ ব্রিজটার কাছে ?'

আমি বলেছিলাম -- না, যাব না। সহকর্মীরা মন্দ বলবে।'

সেই গৌরীপুর জংশন, সেই মনুষ্য কোলাহলের প্লাটফর্ম, সেই মহুয়া গাছের সারি, সেই  বাবলা ফুলের সুবাস নিতে আর যাওয়া হয়নি। কোনোদিন আর হেঁটে হেঁটে যেয়ে দেখা হয়নি দূরের সেই নির্জন ব্রীজটা।                    
   
                                
একদিন আমার ঢাকার বাসায় শিরিন খালার ছেলে এসে হাজির হয়। সে আমার হাতে মার একটি চিঠি তুলে দিয়ে বলে -- খালা তোমাকে আমার সাথে জরুরি ভাবে বাড়িতে যেতে বলেছে।  আমি চিঠিখানা পড়ে একটি উত্তর লিখি --- 

শ্রদ্ধেয়া মা, 
আমার কদমবুসি নিও।  পর সমাচার এই যে ---আমি তোমাদের পছন্দ করা এই বালিকাকে বিবাহ করতে পারব না।  এত অল্প বয়সের একটি মেয়েকে বিবাহ করা আমার পক্ষে কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।
আমি এখানে একটি মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছি। তোমরা এসে এই মেয়েটিকে দেখে যেও ।  পছন্দ হলে এই মেয়ের সাথেই আমার বিবাহের ব্যবস্থা করবে। 

ইতি --- মঞ্জুর।                                                          
নাহ্ কাউকেই পাওয়া হয়নি এই জীবনে। না রেশমীকে,  না নাসরিনকে। যাকে এই জীবনে জীবন সঙ্গিনী করে পেলাম সে অন্য আর একজন মায়াবতী। যাকে চাইনি, যে আমাকেও চায়নি কোনোদিন -- সেই হলো আমার ভূবনের ভূবন বাসিনী।          

কারোর জন্যই কোনো আফসোস নেই।  কোনো আক্ষেপও কখনো ঠাঁই দেইনি অন্তরে।  কে কোথায় ভালো আছে, কে কোথায় দুঃখে আছে -- তারও কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি। কতজন তো কতভাবে কতজনকে চায়, সব চাওয়া কী পাওয়া হয়? হয় না। কী যে লীলা ঈশ্বরের !   

২০১২ সালের কথা।  বাইশ বছর চলে গেছে।  মার মৃত্যুর পর বাড়িতে চল্লিশার একটি অনুষ্ঠান হয়।  অনুষ্ঠান শেষে যখন ঢাকায় চলে আসব,  কী মনে করে মার কাঠের সিন্দুকটা আমরা ভাই বোনরা খুলি।  সিন্ধুকে মার অনেক কিছু ছিল। তার ব্যবহৃত কাপড়চোপড়, সামান্য কিছু টাকা ও কিছু গহনা।  একটি ছোট্ট কাপড়ের টোপলা ছিল আলাদা করে।  টোপলার ভিতরে একটি বহু পুরনো জীর্ণ চিঠি দেখতে পাই।  হলুদ রঙ হয়ে গেছে কাগজের।  ধরলেই ছিঁড়ে যাচ্ছিল।  চিঠিটার সাথে একটি সোনার অঙ্গুরীয়। 
চিঠিটা রেশমীর মায়ের হাতে লেখা ---     

প্রিয় বুবু, 
সালাম নিও। কত আশা বুকে বেঁধেছিলাম। কত স্বপ্ন দেখেছিলাম --  আমার মেয়েটি তোমাদের ঘরে যাবে।  জানো বুবু,  এত ছোট্ট একটা মেয়ে !  তারপরও তোমাদের জন্য ও খুব কান্না করে। কী যে এক অসীম ক্ষত ওর ছোট্ট প্রাণে দিয়ে দিলাম।  তোমার দেওয়া অঙ্গুরীটা ফেরত দিলাম।  এই বেদনার ভারটি আমার মেয়েকে দিয়ে বইতে দিতে চাচ্ছি না।  তোমার দেওয়া এই অভিজ্ঞান তোমার কাছেই থাক্।  

ইতি --- রেশমীর মা। 
২৩ - ১-- ১৯৮৯ ইং
রাণীগ্রাম, সিরাজগঞ্জ।  
                                                                                           

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন