রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

চন্দন কথা

চন্দনের গন্ধ নিতে যেয়ে বুকের গন্ধ নিয়েছি
দখিনা বাতাস বইছে তাই ঝন্ঝার বেগে
এই রকম আরো কতো কিছু যে ভুল হয়
চন্দনের টিপকে চন্দ্রমল্লিকা বলে মনে হয় --
চন্দন দেবনা তোকে আবির নে
ভালোবাসা জমেছে যতো সবই তা লুটিয়ে দে।


শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সম্পূর্ণ করো

আমি চেয়েছি জল। চাইনি আধার তরঙ্গ।
আমি নির্বোধের  মতোই তাকে ভালোবাসি
নির্লিপ্ত ভাবলেশহীন --
এতো মেঘ আমি চাইনি,
চতুর্পাশে এমন থমথমে অন্ধকার
আমাকে ভাসাতে চাও তুমি -- ভাসাও,
সম্পূর্ণ করো--
অসম্পূর্ণ সঙ্গমের বাকি শেষ টুকু।

স্বপ্নময় এই রাত্রি

এক একদিন নেমে আসে সন্নাস আধাঁর এক
বেটোফোনের সুর বাজে রক্তের তরঙ্গে তরঙ্গে
গুমরে গুমরে কেঁদে ওঠে শোকাশ্রিত চোখ
অতল দীর্ঘশ্বাসের রাত্রি যেনো শেষ হতে চায়না।

আমি আলুথালু যুবকের মতো হাটি রাজপথে
রোদ্রে খরতাপে পুড়ে যায় বাদামি শরীর
স্বপ্নগুলো থেতলে যায় কালো আলকাতরায় মিশে
তারপরও উদ্গ্রীব হই রক্তজবার প্রস্ফুটনের জন্য।

আমি তখন আশা নিরাশায় জেগে উঠি
জীবনানন্দের মায়াময় নারীর শ্লেষে
সব বিদ্দ্বেশ ত্যাগ করে তোমাকেই খুঁজি
স্বপ্নময় এই রাত্রির আকাশে বাতাসে।

স্বপ্নের ঘরবাড়ি

 অভিমান ছিলো তার। তাই সে ঘর বাঁধেনি
ভালোবাসা কাঁদলো সেই প্রথম।
সে যে কেঁদে কেঁদে চলে গেলো অচিন দেশে।
ঠিকানাহীন সেই দেশে খুঁজে বেড়ায় স্বপ্নের ঘরবাড়ি।

সেখানে অশ্রু দ্বীপ। ঘুম আসেনা রাত্রি দুপুরে।
তাকে চেয়েছিলো সে আরো বেশী ।
জলে জলে ভেসে গেলো সব স্বপ্ন দেখা।
তারপরে আর কোথাও ঘর বাঁধা হলোনা তার।

নক্ষত্রেরা সব রাত্রি দুপুরে কেঁদে ওঠে
প্রজাপতিরও যাযাবর জীবন হয়
নীলিমার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে সব ধ্রুবতারা
যমুনার জলে সব ক্লেদ ধুয়ে মুছতে চায় সে
আবার ভালোবাসতে চায় বসন্তরাতে।

আকাশের সব নীল

আমি প্রতিদিন বিস্ময়ে দেখি-তুরাগ পারের কাশবন
বালি মাটিতে ফুটে থাকা তুচ্ছ ঘাস ফুল
দেখি দিয়াবাড়ির আকাশ,শুনি কানপেতে সন্ধ্যার শব্দ,
কপালের উপর তোমার উড়ে পড়া চুল
দেখি স্বপ্নের মধ্যে ভালোবাসার কাতরতা ।

ঘর থেকে বের হওয়ার বাঁশি শুনি
ধূসর বসন্ত সন্ধ্যায় যদি তুমি ডাক দাও
উড়ন্ত শশারের মতো স্বপ্ন নিয়ে উড়ে যাই
আকাশের সব নীল তখন লালচে হতে থাকে।

তোমাকে সাথে নিয়ে যে সন্ধ্র্যা আমি দেখি
যে রাত দেখি- বিমুগ্ধ প্রণয়ের যে কাতরতা
চোখের উপর চোখ রেখে বুঝতে পারি-
এই ক্লান্তির শহরে আমাদের সব প্রেমই অম্লান।

আমি যেথায় থাকি

তোমাকে দেখতে দেখতেই চোখ বন্ধ হয়ে যাবে
নিরাভরণ অন্ধকার নামবে যখন সেই বিকেলে
অথবা নিঃস্তব্ধ কোনো সন্ধ্যায়
তারপর থেকে প্রতি রাতে, প্রতি রাত জাগা সময়ে
আমার চোখ দেখে যাবে তোমাকেই আঁধার ছেনে --

সন্ধ্যার বাতাসে আমার নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাবে
তোমার চোখ তোমার চুলে
যদি সন্ধ্যার বাতাস কোনোদিন না থাকে
যদি কখনো সুগন্ধ না ঝরে শিউলির ঝাঁরে
স্বর্গলোক থেকে ধূপের গন্ধ আসবে তখন তোমার ঘরে
তুমি বুঝতে পারবে সে যে আমারই শরীরের
সেই পুরনো গন্ধ মিশে আছে সেখানে।

আমি যেথায় থাকি কিংবা না থাকি
আমার আত্মা সেথায়ই থাকবে, বাজবে অনন্তকালের বাঁশি, দূর বহু দূর থেকে --
এই ব্রহ্মাণ্ডেই তোমার অস্তিত্ব জুড়ে রবে
আমারই অসীমত্বের আত্মা, সেকি তোমার সেই আমি!

তুমি চলে যাচ্ছো

এই শহর ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছো
কারখানার চিমনির ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে আকাশ
তুমি চলে যাচ্ছো বিমান বন্দরের রানওয়ে
খালি পড়ে আছে
একটি এয়ারবাসও কোথাও নেই
কার্গোর শ্রমিকরা ফিরে গেছে আরো আগেই
তুমি চলে যাচ্ছো, লাইট পোস্টের বাতি সব নিভে গেছে
পার্কে নেই কোনো প্রেমিক প্রেমিকা, বাদামওয়ালা
মুসল্লীরাও নামাজ শেষে চলে গেছে ঘরে
এই শহরে নেই কোনো রঙ্গিন পানশালা
রাতের নর্তকীদের কোনো নৃত্য উৎসব নেই।

তুমি চলে যাবে বলে চাঁদও কি বিষন্ন ছিলো?
তারাগুলোও মিটমিট করছিলো আধারে
রাতের গভীরে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিলো সব গাড়ির হর্ণ
চালকরা ফিরে গেছে নিজ নিজ ঘরে --
তুমি চলে যাচ্ছো তোমার শহরে আজ
কনকর্স হলের নিঝুম ওয়েটিং রুমে বসে
মনে পড়বে কি কারো কথা? কোনো নদীর কথা,
কোনো অদেখা বন্ধুর বিষন্ন মুখের কথা,
কিংবা তার চোখের কথা,
যে চোখ রাতভোর ভিজাবে আঁধারের প্রহর!

২২/৯/২০১৭ ইং
উত্তরা, ঢাকা।
রাত ১০.৫০ মি :

লেকের পারে

আজ সকালে উত্তরা লেক পাড়ে হাটতে গিয়েছিলাম। ওয়াকওয়ের দুই পাশের সবুজের পাশ দিয়ে হাটতে ভালই লাগছিলো। লেকের জল ভেদ করে আসছিলো সকালের শীতল বাতাস। আর এক দেড় মাস পর উত্তরা ছেড়ে চলে যাবো অন্যত্র। আর এখানে হাটতে আসা হবেনা । এই লেকের পাড় দিয়ে, এই ওয়াকওয়ে ধরে কতো পথ আমি হেঁটেছি। আর কিছু দিন পর তা হয়ে যাবে নস্টালজিক।

ছবির এই মনোরম দৃশ্যটি তুলেছিলাম ৩ নং সেক্টরের লেকের ধার থেকে। এই সৌন্দর্য এখানেই থাকবে আরো  বহুকাল। শুধু আমি থাকবোনা। এই পথ ধরে আর কখনো হাটবোনা।

নাইবা রইলাম

আমি নেই তাই বলে শরৎ আসবেনা
আকাশে সাদা মেঘ ভাসবেনা
কাশবন ফুলে ফুলে ভরে উঠবেনা
তাই কি কখনো হয়?
আমি নেই তাই বলে  ভৈরবী সুর বাজবেনা
জ্যোৎস্নার প্লাবন হবেনা
শ্যামা দোয়েল গান করবেনা, তাই কি হয়?

আমি নাইবা হলাম তোমার আকাশ
আমি নাইবা হলাম দখিনার বাতাস
সন্ধ্যা মালবিকার সুবাস ঝরুক তোমার ঘরে
সন্ধ্যা তারা হয়ে নাইবা রইলাম তোমার তরে।

নীলাদ্রিতা

মাথার উপরে লক্ষ তারার আকাশ
তারই নীচে তুমি সম্পূর্ণ হয়ে আছো
সম্পূর্ণ হয়ে আছি আমিও --
আছে জোনাকিদের যতো আলো।

নীলাদ্রিতা, তুমি আজ মেঘ
বৃষ্টিও হয়ে যাও কখনও
রোদে ফেরা ফড়িংও হও --
প্রজাপতি উড়ে যায় তোমার কাছে।

রাত বলি আর আকাশ বলি
এই উপত্যকায় আমি আর তুমি
আমাদের জন্যেই এতো সব আয়োজন।

বসে আছি

আমি বসে আছি --
কালো পিরানের মতো নামে অন্ধকার
পাশে ফিরে দেখি সেও অপেক্ষায় অাছে
যাত্রী হারায়ে বুকে অসীম হাহাকার।

লিমেরিক

ঢেউয়ের জল আছড়ে পড়ে নিভে যায় আগুন
যতোটুকু নেভে তারচেয়ে জ্বলে ওঠে তিনগুন
রূপ যে তোমার ভাসে জলে
দেহ বল্লরীতে আগুন জ্বলে
পেয়েছি তার গভীর আঁচ বুঝেছি যে গুনাগুণ।

সমিকরণ

আমি তোমাকে ভালোবাসি
তুমি আমাকে ভালোবাসো
ভালোবাসা রয়েছে হৃদয়ে তে।

একদিন আমি চলে যাবো
একদিন তুমিও চলে যাবে
হৃদয় ক্ষরিত হবে শোনিতে।

একটি ঘাসফুল

মিলিসা, তুমি বিস্ময়কর! সূর্যমুখীর আনত ভঙ্গিতে
যখন বলতে -'আমি তোমাকে ভালোবাসি'
তখন পুলকে আমারও শরীর কেঁপে উঠতো,
লোমকূপের গোড়ায় জেগে উঠতো তোমার উর্বর দেহ
অনায়াসে উন্মোচন করতে পোশাকের যতো বাঁধা
মেরিলিন মনরে কখনোই বিস্ময়কর ছিলোনা
মখমলের রাত্রিবাস খুলতে জানতোনা সে কখনোই।

যুবতী বনিতা'রা জিভে রিং ফুটিয়ে
হূল্লোর করতো শপিং মলে, রাতের পানশালায়
তুমি কি তাদের মতোই,
নাকি স্বপ্ন দেখো অন্য পুরুষের?
তোমার সম্ভোগের শরীরে কি উত্তাল প্যাসিফিকের
ঢেউ জাগে? তুমি কি নীল জলে ভাসো ?
কিংবা জোড়া জোড়া যুবতীদের ঠোঁটের আশ্লেষে!

মিলিশা, তুমি হলুদ রুমাল দিয়ে মুছে ফেলতে
গোলাপি লিপস্টিক
শ্বেতশঙ্খের প্রদীপ শিখা জ্বলে উঠতো শয্যার চারপাশে
তুমিও কি মাকড়সা জালের মতো পড়তে রাত্রিবাস
ধুম্র বিষ, তরল বহ্নি, ভোদকার নেশায় চূর হতে--
সুইসাইড করতে চাইতে কেশে আর কোষে?

মিলিশা, তোমার কি ইচ্ছা হতো ঐসব আদরে
যোগ দিতে, সুরমা পড়ে চোখে
রাত্রির পুরুষের বুক আগুনে পোড়াতে
গাঢ় বাদামি রঙের রাত্রিবাসের নীচে ফুটতো যখন সুঘ্রাণের ঘাসফুল।

পিছনের সেই সব মুখ

পিছনে ফেলে আসা জীবনের বাঁকে বাঁকে কিছু মুখের কথা মনে পড়ে। এইসব মনে পড়া মানুষদের সাথে বাকি জীবনে দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরেও মনে পড়ে। ভাবতে অবাক লাগে-- যাদের কথা মনে হয় আমার, তারা জানতেও পারছেনা তাদেরকে আমি মনে রেখেছি।


সবার উপরে মানুষ সত্য

অং সান সুচি 'র সেনাবাহিনীর নির্যাতনে সেদেশের রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গা মুসলিম ও হিন্দুরা আমাদের দেশে এসে অাশ্রয় নিচ্ছে। কোনো দেশের শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক কোনো জাতি নির্যাতিত হলে তারা নিকটস্থ অন্য কোনো দেশে এসে অাশ্রয় নেবে, এইটাই স্বাভাবিক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেই মানবিক দিক বিবেচনা করেই তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি সাধুবাদ জানাই।

এইসব রোহিঙ্গাদের মধ্যে মুসলীম আছে
হিন্দু আছে, অগ্নি উপাসক আছে
শিশু আছে, নারী আছে, বৃদ্ধ আছে
যুবক আছে, যুবতী আছে
প্রেমিক আছে, প্রেমিকা আছে
ইমাম আছে, পুরোহিত আছে, শিক্ষক আছে
ফকির আছে, সন্ন্যাসী আছে, গায়েন আছে
চোর আছে, বদমাশ আছে, ছ্যাচ্চোর আছে
বেশ্যা আছে, বারবনিতা আছে
আস্তিক আছে, নাস্তিক আছে, জঙ্গি আছে।

তারা যে যাই হোক, তারা সবাই মানুষ। তাদের বিপদের দিনে আমরা এই মানুষগুলিকেই আমাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছি। সবার উপর মানুষ সত্য, শুধু এই বিশ্বাসে।

আমার প্রশ্ন : তসলিমা নাসরীন যতো খারাপ মেয়েই হোক, তার এ দেশে ফিরে আসতে বাঁধা কোথায়? সে যদি অন্যায় করে থাকে, তাকে ধরে প্রচলিত আইনে বিচার করেন। দোষী সাব্যস্ত হলে  মৃত্যুদণ্ড দেন।  মেয়েটাকে এইভাবে দেশছাড়া করে রেখেছেন কেন?

পূর্ণিমানিশীথিনী-সম

নির্ঘুম রাত্রি দুপুরে মিত্রার চোখে ঘুম আসেনা। বাইরে যতোবার সে তাকিয়েছে, দেখেছে সেখানে অন্ধকার । বেদনাহত ঝাউগাছ দাড়িয়ে আছে নিরব পথের পথিকের মতো।  হঠাৎ হুহু ঠান্ডা বাতাস এসে লাগে ওর গায়ে। শীতে আরো বেশী কাঁপন লাগে অস্থিতে। রক্তও হিমশীতল হয়ে যেতে থাকে , হিমোগ্লোবিনের ক্ষুধা আরো বেরে যায় ওর রক্তে। অস্থিও কেমন অসার হয়ে  আসে।

মেডিসিনের ক্লাশে প্রোফেসর আবেদীন স্যার মিত্রাদের বলেছিলেন -- মানবদেহে রক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান৷ এই রক্তের উপাদানগুলোর মধ্যে লোহিত রক্ত কনিকা বা RBC (Red blood cell) এর ভিতরে রয়েছে হিমোগ্লোবিন নামক এই প্রোটিন যার গুরুত্ব অপরিসীম ৷ এটি ফুসফুস হতে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বয়ে নিয়ে যায়৷ স্বাভাবিকভাবে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ পুরুষের জন্য ১৩.৫ থেকে ১৭.৫ এবং মহিলাদের জন্য ১২ থেকে ১৫ mg/dl৷ কিন্তু মেয়েদের যখনি তা ১০ এর নীচে নামতে থাকে তখনই তা ভাবনার কারণ হয়।

মিত্রা চোখ রাখে আকাশের দিকে। এই শহরে বাজছে --        ' দূরে কোথাও দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে। "  মিত্রা ঘুমোতে চায়। কিন্তু ওর চোখে ঘুম নেই, কুয়াশা নামে ছেঁড়া ছেঁড়া, আর ঘুম যদিও আসে, তা দেহে অসে, মনে নয়। মন তার জেগে থাকে সেই মহানন্দা নদীর তীরে। যেখানে ছোটবেলায় চেনা তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো। যে তারাগুলোর নীচে মিত্রা আর নীল জেগে রইতো। যার নীচে এখন শুধুই নীল থাকে, মিত্রা নেই।

ডাঃ আবেদীন স্যারের ক্লাশে মিত্রা জেনেছিল, লিউকেমিয়া কি? লিউকেমিয়া হচ্ছে, রক্ত বা অস্থিমজ্জার ক্যান্সার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর প্রধান লক্ষণ রক্তকণিকার, সাধারণত শ্বেত রক্তকণিকার অস্বাভাবিক সংখ্যাবৃদ্ধি। রোগটির নামই হয়েছে এর থেকে লিউক অর্থাৎ সাদা, হিমো অর্থাৎ রক্ত। রক্তে ভ্রাম্যমান এই শ্বেত রক্ত কণিকাগুলি অপরিণত ও অকর্মণ্য। রক্ত উৎপাদনকারী অস্থিমজ্জার মধ্যে এদের সংখ্যাধিক্যের ফলে স্থানাভাবে স্বাভাবিক রক্তকণিকা উৎপাদন ব্যাহত হয়।

একটু পিছনে ফিরে দেখা :
দিনটি কেনো এমন হলো সেদিন। কর্কট রোগের উপর রিসার্চ করবে কে কে? ক্লাশে জানতে চেয়েছিল আবেদীন স্যার। প্রথম হাতটি উঠলো তারই সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী মিত্রার। ক্লাস শেষে কলেজের লম্বা কোরিডোর দিয়ে হেটে ক্যান্টিনে চলে যায় মিত্রা। গরম চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে চা খেতে খেতে সহপাঠী পান্না আর জয়ন্তীকে বলছিল -- একদিন আমারও করবো জয়, আমরাও করবো জয় এই কর্কট ক্রান্তিকাল।

শহীদ মিনারের পাশ থেকেই রিকশা উঠছিল মিত্রা। একবার ফিরে তাকালো সে মিনারের সু উচ্চ প্রান্তের দিকে। মা তার স্তনের দুধ পান করাচ্ছে তার কোলের শিশুকে।  নভেরা আহমেদ তাই-ই বলেছিল। হ্যাঁ, তাই দেখতে পেলো মিত্রাও।  এই দৃশ্যটি দেখে ওর মন ভালো লাগার কথা। কিন্তু ভালো লাগেনি। মাথা ঝিমঝিম করছিল। কড়ই গাছের ছায়াতল দিয়ে রিকশাটি চলে যায় নিউ মার্কেট হয়ে জিগাতলার দিকে , যেখানে ওদের বাসা।

মিত্রা বাসায় এসে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ে। মা এসে জিজ্ঞাসা করে -- 'তোমার কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?
মিত্রা :  না মা। আজ আমার মন ভালো লাগছে। আজ আমাদের ক্যানসার রোগের উপর ক্লাস ছিলো। মা, আমি ক্যান্সারের উপর রিসার্চ করবো। তুমি আমাকে দোয়া করবেনা মা?
মা মিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল -- 'অবশ্যই করবো। তুমি একদিন ক্যান্সারের বড়ো ডাক্তার হবে। '

মিত্রা শুয়ে শুয়ে আবেদীন স্যারের ক্লাসের লেকচারের কথা মনে করছিল -- লিউকিয়ামের লখ্খণ হচ্ছে,  ঘন ঘন জ্বর হওয়া, প্রচন্ড দুর্বলতা ও অবসাদ,খিদে না থাকা ও ওজন হ্রাস, মাড়ি ফোলা বা খেতে থেলে রক্তক্ষরণ, ছোট কাটাছড়া থেকে অনেক রক্তক্ষরণ, স্ফীত যকৃত ও স্প্লীন, অস্থিতে যন্ত্রণা, স্ফীত টনসিল। '

কর্কটময় সেই একদিনের কথা :
আবেদীন স্যারই সমস্ত রিপোর্ট দেখে কষ্ট ভারাক্রান্ত চিত্তে বলে দেয়, তারই সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রীটির লিউকেমিয়া হয়েছে।  মিত্রা যেহেতু চিকিৎসা বিঞ্জানের ছাত্রী তাই ব্যাপারটি ওর কাছে আর গোপণ থাকেনা। আর এও জেনে যায়, কবে তার মৃত্যু হবে সে কথাও।

এই শহর জেগে আছে। জেগে আছে মিত্রার  উন্মোলিত চোখ অন্ধকার পথের দিকে। মিত্রার কান্না পায়। কিন্তু কান্না তার আসেনা, গলায় কেমন ঘড়ঘড় আওয়াজ হয়, যেন মৃত্যুর গাড়িতে চেপে স্বপ্ন-চাকায় শব্দ তুলে সে কোথায় চলেছে। সবই শান্ত- জমাট বাঁধা কালো রাত্রির নীরবতা এক পায়ে দাঁড়িয়ে ধুঁকতে থাকে।

মিত্রার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। নীলের কথা মনে পড়ে।  ঘাসের ঘ্রান আর দখিনা বাতাসের কথা মনে পড়ে।  আজ আর হয়তো সেই তারাগুলোর নীচে বাতাস নেই, ঘ্রান নেই, আছে শুধু জমাট বাঁধা অন্ধকার। মিত্রা  ঘুমোতে পারেনা। সে উঠে পড়ে। ধীরগতিতে চলা একজোড়া পায়ের আওয়াজ আসে কোরিডোর থেকে এবং সে অবাক হয়ে ভাবে এই যে তারই খেলার সাথী নীলের। যার চোখে কোন তারা নেই। সেই চোখে কোন কথা নেই, রাগ নেই, আদর নেই। সেই তারাহীন চোখের ছেলেটিকেই মিত্রা ডাকে। মিত্রা হাঁটতে থাকে করিডোর দিয়ে, নাকি ধূসর প্রান্তর দিয়ে , সে বুঝতে পারেনা। কোরিডরের শেষপ্রান্তে, হাসপাতালের  নীচে ক্লান্ত সিকিউরিটি গার্ড তখন সমুদ্রের স্বপ্ন দেখছিলো।

ডাঃ আবেদীন স্যার একদিন ক্লাসে বলেছিল -- ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকমিয়া নির্ণয় করতে রক্তের কোষ পরীক্ষা, বায়োপসি বা হাড়ের মজ্জা পরীক্ষা করাতে হয়। এর চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, ক্যান্সারের ধরন এবং ক্যান্সার শরীরে কতটুকু ছড়িয়েছে তার উপর। চিকিৎসা পদ্ধতির ভেতর আছে কিমোথেরাপি ( কিছু ওষুধের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধংস করা হয় ), রেডিও থেরাপি (যন্ত্রের মাধ্যমে রেডিও ওয়েভ ব্যাবহারের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধংস করা হয়), হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপন।  মিত্রার আজ মনে হচ্ছে, সেগুলো সব মিথ্যা লেকচার ছিলো।

কে বাজায় দূরে এই গান -- 'জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো। সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীতসুধারসে এসো।
কর্ম যখন প্রবল-আকার, গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার,
হৃদয়প্রান্তে হে জীবননাথ, শান্তচরণে এসো।'

বাবা এসেছিল হাসপাতালে। মিত্রা ওর বাবার দু 'হাত বুকে টেনে বলেছিল -- ' বাবা তুমি আমাকে আমার সেই ছেলেবেলার গোদাগাড়ীর মহানন্দা নদীর তীরে নিয়ে যাও। '
বাবা :  এমন করোনা মামনি আমার! তোমাকে কালই নিয়ে যাবো গোদাগাড়ীর সেই মহানন্দার তীরে। '

আজ এই গোদাগাড়ীতে উঠবে পূর্ণিমার চাঁদ। আজ এইখানে মিত্রা এসেছে। মিত্রাকে দেখতে ওর খেলার সাথীরাও এসেছে। এসেছে ওর কাজিন
 নীল, যে ওর বাল্যসাথী ছিলো। নীল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে  অনার্স করছে। ওরা সবাই মিত্রাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় গ্রাম, প্রাইমারি স্কুল, ছোট্ট খেলার মাঠ আর ঠাকুরবাড়ির ঝিলপুকুর। এই সব জায়গাতেই মিত্রার ছেলেবেলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

সন্ধ্যা রাতের আকাশে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। মহানন্দা নদীতে তখন কুলকুল স্রোত বইছিলো। মিত্রা নীলাকে বলে -- 'তুমি আমার হাত ধরে ঐ মহানন্দা নদীর তীরে নিয়ে যাবে?  আমি তীরে বসে শুনবো জলের শব্দ, আর দেখবো রাতের যতো তারা। '
মিত্রার মন আজ স্তব্ধ। সেই স্তব্ধতার আর্তনাদ শুনতে পায় সে। অাঁধার সুড়ঙ্গ বেয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে আসা আর্তনাদ। তারাহীন চোখের তারায় ছেলেটা তাকে ডাকে। সে নদীর কুলের দিকে পা বাড়ায়।

মিত্রার সে রাতে চোখে আর ঘুম আসেনাই। রাতের শিউলি গন্ধ বিলিয়েছিলো বাতাসে।  তারাগুলো মমতাভরে কাছে টেনে নেয় ওকে- দেয় শীতল জল, ঘাসের ঘ্রান আর দখিনা বাতাস।  আর নীল মিত্রাকে গেয়ে শোনায়েছিলো --

'তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম।
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম...। '

কুড়িয়ে পাওয়া একটি রত্ন

এক গলি রাস্তার মোড় দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে তাকিয়ে দেখি ইলেকট্রিক পোষ্টের সাথে একটি কাগজ ঝুলছে। উৎসাহ নিয়ে সামনে এগিয়ে দেখি কাগজের গায়ে লেখা, ''আমার ৫০ টাকার একটা নোট এখানে হারিয়ে গেছে। আপনারা যদি কেউ খুঁজে পান তবে আমাকে সেটি পৌছে দিলে বাধিত হব, আমি বয়স্ক মহিলা চোখে খুব কম দেখি।"  তারপরে নিচে একটি ঠিকানা।

আমি এরপর খুঁজে খুঁজে ঐ ঠিকানায় গেলাম। হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক।  গিয়ে দেখি একটি জরাজীর্ণ  বাড়ির উঠোনে এক বয়স্ক বিধবা মহিলা বসে আছেন। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন "কে এসেছো ?"

আমি বললাম, "মা, আমি রাস্তায় আপনার ৫০ টাকা খুঁজে পেয়েছি আর তাই সেটা ফেরত দিতে এসেছি।"
এটা শুনে মহিলা ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বললেন, ' বাবা, এই পর্যন্ত অন্তত ৩০-৪০ জন আমার কাছে এসেছে এবং ৫০ টাকা করে দিয়ে বলেছে যে তারা এটি রাস্তায় খুঁজে পেয়েছে।  বাবা, আমি কোন টাকা হারাই নাই, ঐ লেখাগুলোও লিখিনি। আমি খুব একটা পড়ালেখা জানিও না।

আমি বললাম, সে যাইহোক সন্তান মনে করে আপনি টাকাটা রেখে দিন। আমার কথা শোনার পর টাকাটা নিয়ে বললেন 'বাবা আমি খুব গরীব কি যে তোমায় খেতে দিবো!  একটু বসো। একটু পানি অন্তত খাও।' বলে ঘরে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন।

ফেরার সময় তিনি বললেন, "'বাবা, একটা অনুরোধ তুমি যাওয়ার সময় ঐ কাগজটা ছিঁড়ে  ফেলো, ওটি সত্যি আমি লিখিনি । "

আমি ওনার  বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মনে মনে  ভাবছিলাম, সবাইকে উনি বলার পরেও কেউ ঐ কাগজটি ছেড়েনি!!

আর ভাবছিলাম ঐ মানুষটির কথা যিনি ঐ লেখাটি লিখেছেন। ঐ সহায়সম্বলহীন বয়স্কা মানুষটাকে সাহায্য করার জন্য এতো সুন্দর উপায় বের করার জন্য তাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়লো একজনের কথায়। তিনি এসে বললেন, 'ভাই, এই ঠিকানাটা কোথায় বলতে পারেন, আমি একটি ৫০ টাকার নোট পেয়েছি , এটা ওনাকে  ফেরত দিতে চাই।'

ঠিকানাটা দেখিয়ে দিলাম তাকে। হঠাৎ করে চোখে জল চলে এলো আমার।  আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, দুনিয়া থেকে মানবতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি!

এই ভাবেই বেচে থাকুক আমাদের মধ্যে মানবতা ।
-----------------------------------------------------------------------

( একটি বিদেশী ই-ম্যাগাজিন থেকে পাওয়া থীম অবলম্বনে। )

আত্মার স্পন্দন ধ্বনি

মানুষ মরে গেলে তার আত্মার কি হয়? কোথায় চলে যায় সে আত্মা? সেকি এই ইথারেই থাকে? কেউ তার অভিজ্ঞতা থেকে আজো বলতে পারেনি মৃত্যুর পরে আত্মা আসলে কোথায় যায়। কিংবা মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্ব থাকে কতোটুকু ? সেই আত্মার কি কোনো রকম অনুভূতি আছে? যেহেতু এটি মৃত্যুর পরের অৰস্থা, তাই এর কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা কেউ লিখে যায় নাই।

ক্লাশে কিংবা টিউটোরিয়াল ক্লাশে আহমদ শরীফ স্যার কিংবা সেই সময়ের তরুণ শিক্ষক হূমায়ূন আজাদ স্যার  সিলেবাসের বাইরে অনেক কথাই বলতেন। তাদের অনেক বক্তব্যেই চিত্তকে আলোড়িত করতো, মনের সিংহ দুয়ার খুলে যেতো বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী বক্তৃতা শুনে। তাদের অনেক কথাই কোনো গ্রন্থে হয়তো লিপিবদ্ধ হয়নি। কিন্তু তাদের সেইসব মত ও পথ অনুসরণ করতে ব্যাকুল হয়ে উঠতো আমার তরুণ মন।

আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিলো দর্শন শাস্ত্র। এই সাবসিডিয়ারি ক্লাশেই একদিন পরিচয় হয় সংস্কৃত ও পালি বিভাগের ছাত্রী কীর্তিকা পোখরেলের সাথে। কীর্তিকা এসেছিল নেপাল থেকে স্কলারশিপ নিয়ে। হালকা বাদামি বর্ণের চেহারার এই মেয়েটির লাবন্য ছিলো গৌরীয়, চোখ ছিলো কালো, আর চুল ছিলো কৃষ্ণ বর্ণের। অসম্ভব মার্জিত মনের মেয়ে ছিলো কীর্তিকা। তার মননে ছিলো কার্ল মার্ক্স, লেলিন, আর মাও সেতুং এর দর্শন। ওর সাথে যখন কথা বলতাম, তখন কোথায় যেনো একটা অদ্ভূত মনের মিল খুঁজে পেতাম। 'আমরা করবো জয় একদিন ' এর মতো সত্যিই আমরা দু'জন একদিন ভালো বন্ধু হয়ে যাই।

ভিসি স্যারের বাড়ির পাশ দিয়ে, রেইনট্রির ছায়াতল দিয়ে, নির্জনতায় হাটতে হাটতে দু'জন প্রায়ই চলে যেতাম ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরীতে। ওখানে যেয়ে পড়তাম ঐ সময়ের সারা জাগানো যতো বিখ্যাত বই। কীর্তিকাকে পড়তে দেখতাম বোভোয়ার, জন এ্যান্ডারসনের মতো দার্শনিকদের বই। আবার বায়রন, শেলী, সেক্সপীয়ার এবং বোদলেয়ারের বইও পড়তো সে। আমরা দুইজনই নেশার মতো সেইসব বই পড়তাম আর আলোচনা করতাম। পড়তে পড়তে ক্লান্তি চলে আসলে কখনো উঠে এসে বসতাম বারান্দায়। আমাদের সামনে থাকতো সবুজ ঘাস। আমি কীর্তিকাকে মাঝে মাঝে ফান করে আবৃত্তি করে শোনাতাম --

" দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস –
আকাশের ওপারে আকাশ।"

একদিন টিএসসি র ক্যাফেটেরিয়ায় বসে দুইজন লান্চ করছিলাম। খেতে খেতে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিল আমাদের। তারপর দুজন চলে যাই পুলপারে। অনেকেই বসা ছিলো সেখানে। আমরাও বসে থাকি বিকেল পর্যন্ত। কীর্তিকা বলছিল, মানুষের আত্মার কথা। বলছিল স্বর্গ আর নরকের কথা। কি এক মায়াবী চোখে বলছিল -- ' এই যে তুমি আমি বসে আছি, কথা বলছি, এইসবই আমাদের আত্মার কথা। আমি যদি তোমার বুকে কান পেতে রাখি, আমি তার শুনবো মর্মরধ্বনি। সে ধ্বনি কান্নারও হতে পারে, আনন্দেরও হতে পারে। আবার তুমি আমার বুকে কান পেতে ধরো, তুমিও শুনতে পাবে এইরূপই কোনো শব্দ । '

কীর্তিকা আরো বলছিল -- 'জানো স্বর্গ নরক বলতে কিছু নেই। মানুষকে ভালোবাসো, আত্ম পরিজনদের প্রতি খেয়াল রাখো, অন্নহীনকে অন্ন দাও, চিকিৎসাহীনতায় যে মানুষগুলো ব্যথা বেদনায় আর্তনাদ করছে, তাদেরকে একটু চিকিৎসা দাও। দেখবে এখানেই স্বর্গ সুখ পাবে। আর যদি তুমি এসব না করো, দেখবে তোমার চারপাশটা নরকের মতো মনে হবে। '

কীর্তিকা বলছিল -'তোমার একটি হাত আমার হাতের উপর রাখো। আমাকে ধরে উঠাও। চলো দুইজন হাত ধরে এই পুলপারে হাটি। এখন পরিক্রমণের সময়। ক্লান্ত হবেনা কখনো। আমাদের অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হবে।'

কীর্তিকা একবার গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে কাঠমান্ডু থেকে ঘুরে ঢাকা চলে আসে। আমি ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হোস্টেলে ওর রুমে যেয়ে দেখা করি। ছোট্ট কেটলীতে ও নিজেই চা তৈরী করে। সাথে টোস্ট বিস্কুট। চা খেতে খেতে শুনছিলাম স্টেরিওতে বাজানো টেরি জ্যাকের গান। 'স্কিন্ভ আওয়ার হার্টস এ্যান্ড স্কিন্ড আওয়ার নিস' এবং 'সিজন ইন দ্য সান' এ্যালবামের গানগুলো শোনার ভিতরে ডিলান আর বিটলসের মাঝে গুনগুন করছিল কীর্তিকা। আমি বলছিলাম, 'তুমি ভারতীয় গণ সংগীত পছন্দ করোনা?'
কীর্তিকা :  করি। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকার গান আমার ভালো লাগে। হেমাঙ্গের আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগীত 'ইন্টারন্যাশনাল' ও রাশিয়ান সুরে তার গাওয়া 'ভেদী অনশন মৃত্যু তুষার তুফান (গান) টি 'In the call of comrade Lenin' এর ভাবানুবাদ। এটি কমিউনিস্ট কর্মীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।'

কথায় কথায় কীর্তিকা বলছিল চারু মজুমদারের কথা।এই বিপ্লবী কম্যিউনিস্টের আদর্শ সে ধারণ করতো। ওর বড়ো ভাই নেপালের পূর্বাঞ্চলে চারু মজুমদারের সশস্ত্র আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়েছিলো। দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি এলাকায় সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্ব নেপালে ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করে । কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, নাগি রেড্ডি প্রমুখের সহযোগিতায় অত্র অন্চলে একটি কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন গঠিত হয়। কীর্তিকার ভাই এই কনসোলিডেশনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন কিসের যেনো ছুটি ছিলো। কীর্তিকা আমাকে আগের দিনই বলে রেখেছিল, আমি যেন ওর সাথে দেখা করি। আমি কলাভবনের সামনের সিঁড়িতে বসে ছিলাম। কীর্তিকা আসে অনেকটা ক্যাজুয়াল ড্রেস পড়েই। ও আমাকে বলছিল, আমি একটু গুরুদ্বুয়ারা নানক সাই এর মন্দিরের ভিতরে যাবো। তুমিও চলো আমার সাথে। আমি বললাম - 'আমাকে তো ঢুকতে দেবেনা। ' ও বললো - 'আমার সাথে চলো, ঢুকতে দেবে।'
কীর্তিকা কোনো ধর্মই অনুসরণ করতোনা। কিন্তু ও আজ এই শিখ মন্দিরে প্রার্থনা করলো। আমিও ওর সাথে প্রার্থনায় মগ্ন ছিলাম।

মন্দির থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরী বারান্দায় যেয়ে বসি দু'জন।  কড়ই গাছ থেকে অহেতুক মরা পাতা ঝরে পড়ছিল। আমি কীর্তিকাকে বলছিলাম - 'তোমার কি আজ মন খারাপ? '
কীর্তিকা :  না। তুমি কি এরিক সিগালের 'লাভ স্টোরি' বইটি পড়েছো? '
আমি :  না, পড়িনি।
কীর্তিকা ওর ব্যাগ থেকে লাভ স্টোরি বইটি আমাকে দিয়ে বলে, 'তোমার জন্য এনেছি। পড়ে নিও।'
আমি : আমি গতরাতে পড়ছিলাম কার্ল সাগান। আজ তুমি দিলে 'লাভ স্টোরি'।
কীর্তিকা : আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম কাল রাতে। স্বপ্ন কেন আসে? যে স্বপ্ন কোনোদিন সত্য হবেনা, সেই স্বপ্ন আমাকে দেখতে হয়। কান্চনজঙ্ঘা দেখবো বলে  হিমালয়ের পাদদেশে টিলার উপর দাড়িয়ে আছি তুমি আর আমি। কিন্তু কান্চনজঙ্ঘা আর দেখা হয় নাই। দূরে অন্ধকারে দেখতে পেয়েছিলাম একাকী দুটি নক্ষত্র। '
আমি :  স্বপ্ন তো স্বপ্নই। এর জন্য মন খারাপ করতে হয়না।
কীর্তিকা :  আমাকে সিগারেট খেতে হবে।
আমি : খাও। তেমন কেউ আজ এখানে নেই।

বেশ কিছু দিন আমি  কীর্তিকার সাথে দেখা করতে পারি নাই। আমারও ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল, ওরও চলছিল। পরীক্ষা শেষ হলে আমি হোস্টেলে ওর সাথে দেখা করতে যাই। দেখলাম, কীর্তিকা কেমন যেনো শুকিয়ে গেছে। খুব মায়া হলো ওকে দেখে। ওর মনটা ভালো করার জন্য বললাম -- 'চলো সিনেমা দেখে আসি।  মধুমিতায় চলছে ডি সিকার 'টু ওমেন'। ছবিটি দেখলে তোমার ভালো লাগবে। ওয়ার ফিল্ম। যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইতালিতে ঘটে যাওয়া এক মর্মস্পর্শী ঘটনা যা মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাই নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্বসেরা এ চলচ্চিত্র।'

ছবিতে গীর্জার ভিতরে মা এবং তার এগারো বছরের মেয়ে দুইজনই নাৎসী সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। কীর্তিকা ছবিটি দেখছিল আর আমার কাধেঁ মাথা হেলান দিয়ে কাঁদছিল। ওর মন ভালো করে দেওয়ার পরিবর্তে মনটি আরো বেশি খারাপ করে দিয়েছিলাম। হল থেকে বেরিয়ে রিকশায় আসতে আসতে কীর্তিকা বলছিল,পরশু কাঠমান্ডু চলে যাবো। আবার কবে আসবো, জানিনা। নাও আর আসতে পারি। সার্টিফিকেট এ্যামবাসি থ্রো নিয়ে নিতে পারি। তুমি কাল একবার আমার হোস্টেলে চলে এসো।

রাতে আর ঘুম আসছিল না। শুয়ে শুয়ে কীর্তিকার শুকিয়ে যাওয়া মুখটির কথা মনে হচ্ছিল। বারবার শুধু এপাশ ওপাশ করছিলাম। রাতের শেষ প্রহরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি দুপুরের একটু আগেই কীর্তিকার রুমে চলে যাই। ওর রুমে বসতেই গুনি - স্টেরিওতে বাজছে, লুডভিগ ফান বেটোফেনের পিয়ানোর সুর।
কীর্তিকা বলছিল, এবার যেয়ে আমি কমুনিস্ট পার্টিতে পুরো দমে কাজ শুরু করে দিব। আমি সিন্দুলি, দুলাখা আর গুর্খা এরিয়াতে মেয়েদের সশস্ত্রভাবে সংগঠিত করবো। পার্টির পরবর্তী স্টেপ একটি জনযুদ্ধ। যা নেপালের রাজ শাসনকে কবর দেবে।
কীর্তিকা বলছিল -- 'আমার শরীরটা হঠাৎই কেমন যেনো রোগাগ্রস্ত হয়ে গেলো। দুর্গম পাহাড়ে পাহাড়ে কিভাবে কাজ করবো? '
আমি : তুমি ওখানে যেয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবে। আর একটি কথা।
কীর্তিকা :  কি কথা।
আমি :  তোমার সাথে আমার আর কি দেখা হবেনা?
কীর্তিকা : থাকবো নিষিদ্ধ জীবনে। কি হয় বলতে পারিনা। যদি জয়ী হই, যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে। আর যদি মরে যাই, তবে আর দেখা হবেনা।

আমি কীর্তিকার হাতটি ধরি, বলি -- 'এই হাতে কি একটি চুম্বন দিতে পারি? '
কীর্তিকা : দাও। তুমি এতো মন খারাপ করছো কেন, পাগল ছেলে!  আরে, আমি তো আমার আত্মা তোমার বুকের মাঝেই রেখে যাচ্ছি। বেঁচে থাকলেও তোমার কাছে থাকবে, মরে গেলেও তোমার কাছে থাকবে। '

শুনেছি জনযুদ্ধে কীর্তিকা মারা গেছে। মানুষের আত্মা আসলে কি হয়? কীর্তিকা বলেছিল, ও মরে গেলেও নাকি ওর আত্মা আমার বুকের মাঝে থাকবে। হ্যাঁ, আমি আজো নিঃস্তব্ধ রাত্রি দুপুরে আমার বুকের মাঝে বেটো়ফোনের সুরের মতো কীর্তিকার আত্মার স্পন্দন ধ্বনি শুনতে পাই।

সাত পাকে বাঁধা

হিন্দু মতে বিয়েতে আমরা দেখতে পাই, আগুনের কুন্ডলীর চারপাশে বর-বউকে ঘুরতে। একে সাত পাকে বাঁধা পড়া বলা হয়। বলা হয়, এর মাধ্যমে অগ্নিদেবতাকে বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়। শুধু আগুনের চারপাশে ঘোরাই নয়, এই সময়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিও দিতে হয় একে অপরকে।

প্রথম প্রতিশ্রুতি- প্রথমে বর তাঁর বউ এবং তাঁর ভাবী সন্তানদের যত্ন নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
বিনিময়ে কনেও প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর স্বামী এবং তাঁর পরিবারের যত্ন নেবেন।

দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি- এবার বর প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর স্ত্রীকে সবরকম পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করবেন। বিনিময়ে কনেও প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি স্বামীর সবরকম যন্ত্রণায় পাশে থাকবেন।

তৃতীয় প্রতিশ্রতি- এবার বর প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর পরিবারের জন্য রোজগার করবেন এবং তাঁদের দেখভাল করবেন। একই প্রতিশ্রুতি এবার কনেও করেন।

চতুর্থ প্রতিশ্রুতি- স্ত্রীর কাছে তাঁর পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেওয়া এবং একইসঙ্গে স্ত্রীর সমস্ত মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন বর। স্ত্রী তাঁর সমস্ত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করার প্রতিশ্রুতি দেন।

পঞ্চম প্রতিশ্রুতি- যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেন বর। স্বামীকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দেন স্ত্রী।

ষষ্ঠ প্রতিশ্রুতি- স্ত্রীর প্রতি সত্য থাকার প্রতিশ্রুতি দেন স্বামী। স্ত্রীও স্বামীর প্রতি সত্য থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।

সপ্তম প্রতিশ্রুতি- শুধু স্বামী হিসেবেই নয়, বন্ধু হিসেবেও সারাজীবন স্ত্রীর সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন বর। বিনিময়ে স্ত্রীও স্বামীর সঙ্গে জাবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।

তথ্য সূত্র : 24 ghanta .com.

যখন তুমি থাকবেনা

এই প্রেম তোমার, এই নির্জনতাও তোমার
সমস্ত স্মৃতিতে বিস্মৃতির ধূলো জমবে একদিন
যখন তুমি থাকবেনা।

শোক বিহবল কক্ষের অসীম নিরবতায়
মন ছুটে চলবে দিগন্তে, যেখানে ওড়ে একাকী চিল
তার ডানা মেলার কোনো শব্দ নেই
মেঘ আকাশ জলরাশি নক্ষত্র মন্ডলী
প্রত্যেকেই আর্তনাদ করবে তোমার অনুপস্থিতিতে।

পার্কের পাশে পাইন গাছ ছিলো
ছাতিম গাছের তলায় নির্জনতাও ছিলো
লেকের জল স্থির হয়ে ছিলো
দুইজনের নিঃশ্বাস মাতাল করতে পারতো হাওয়া।

অবসর আর কর্মহীন প্রহরে তোমার ছায়া পড়বেনা
পাখি কলরব করবে মোয়াজ্জিনের আযান হবে
মন্দিরে শঙ্খধবনি বাজবে, গীর্জায় নিনাদ হবে
এই আকাশ এই নক্ষত্র সবই থাকবে যেখানে আছে
শুধু তুমি থাকবেনা।

তখন মাতাল হবেনা কোনো বাতাস
তখন মেঘে মেঘে ছেয়ে থাকবেনা কোনো আকাশ।

K.T
18/9/2017

আমার রোদ্রের দিন

এতো ভালোবাসা এতো ভালোলাগা এতো মায়া
ভেবেছিলাম তুমিই আমার সম্পূর্ণ কবিতা হবে,
না হলেনা, তুমি অসম্পূর্ণ হয়েই থাকলে।

এতো পরিচর্যা এতো যত্ন এতো জল ঢালা
তবুও একটি সম্পূর্ণ ফুল হয়ে ফুটতে পারোনি
তুমি অপ্রস্ফূটিত করে রাখলে তোমার পাঁপড়ি।

শ্রাবণের মেঘ সব সরিয়ে দিলাম
শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘ উড়ছে
মেঘে মেঘে ভেসে এসে না হতে পারলে জল
না হতে পারলে আমার রোদ্রের দিন।

এতো ভালোবাসা বিশ্বাস হলোনা
বিশ্বাস হলোনা তোমার জন্যই জ্বলে ধূপ আর মোম
মরে গেলে কবরের মাটি ছেনে জানতে পারবে
এই আমি তোমাকে কতো ভালোবেসেছিলাম।

দূরের সুবর্ণরেখা

কপালে পড়েছিলে টিপ যেনো লেগে রয়েছিল চাঁদ
পূর্ণিমার আকাশ থেকে
মুখ তোমার আলোয় হেসেছিল
মায়াবী ছোঁয়ায় চুল ছড়িয়ে পড়েছিল পিঠের উপরে
যেনো আদিগন্ত ছায়া পড়েছিল সেখানে
স্থির হয়েছিল তোমার গ্রীবার ভঙ্গি
ভ্রু বেঁকেছিল তৃতীয়া চাঁদের মতো ধনুকের।

চোখ ছিলো চোরাবালি, পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার
এসে ডুব দিয়েছিল সেখানে --
তারপরও ভালোবাসার চিহ্নগুলি খুঁজেছিলাম
দূরের সুবর্ণরেখায়।

এই প্রেম সেই প্রেম ছিলোনা

আজ এই সন্ধ্যার বাতাস থেকে জেনে নিয়েছি
যে হাওয়া বইছে আজ এখানে
যে গানের সুর ভেসে আসছে পূরবী ঝংকারে
সেই সুর ঝংকার আমার জন্য বাজেনি --
তোমার ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত কাপড় বলে দিচ্ছে
গর্ভধারিণীর আড়ালে যে তুমি
সে তুমি কখনোই আমার ছিলেনা।

এই প্রেম, সেই প্রেম ছিলোনা কস্মিনকালেও
এ ছিলো প্রেমহীনতার উৎসব উৎসব খেলা
প্রেমের আড়ালে ছিলো শূন্য করে দেবার দহন
জ্যোৎস্নার আড়ালে যে উদ্বাস্তু প্রান্তর ছিলো
সেখানে হতো কেবল বেদনাহতদের কান্নার উৎসব।

এই রকম শোকাচ্ছন্ন উৎসবের রাতে --
এই রকম অন্ধকার পথের প্রান্তের উপর
অনিশ্চিত গোপণ রক্ত ক্ষরণের ভিতর
পূর্ব পুরুষদের বিদ্ধ করতে চাইনা কোনো পাপ স্খলনে
আজ এই সন্ধ্যার বাতাস সেই বার্তাই দিয়ে গেলো।

কেবা আপন কেবা পর

মেয়েটি বিদেশ থেকে এসেছে আজ কয়েকদিন ধরে। স্বামীর সাথে থাকে পশ্চিমের একটি দেশে। অনেকটা মাটির টানে আর প্রিয়জনের টানেই দেশে আসা তার। চলে যাবে কয়েক দিন পরই। ওর মা নেই। বাড়ি এসে মার কবরটাও যিয়ারত করে নিয়েছে। বাড়িতে সৎমা। তবে তার সাথে সম্পর্কের কোনো অবনতি নেই। ভালোই বলা যায়।

গতকাল সন্ধ্যায় মেয়েটি বেড়াতে গিয়েছিল ওর এক বান্ধবীর বাসায়। যাবার সময় মাকে বলে গিয়েছিলো - 'মা, আমি আমার বান্ধবীর বাসায় একটু বেড়াতে যাচ্ছি। ফিরতে দেরী হতে পারে। ওর ওখান থেকে আমি খেয়েও আসতে পারি, আবার না খেয়েও আসতে পারি।'

বান্ধবীর বাসায় গল্প করতে করতে এবং পথে আরো
দু'একটি কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে রাত বারোটা বেজে যায়। তাছাড়া রাস্তার দূরত্ব ও জ্যামের কারণেও এই দেরি হওয়া। বান্ধবীর ওখানে সে শুধু চা নাস্তাই খেয়েছিল, ভাত খায় নাই । বাসায় এসে দেখে ওর জন্য কোনো ভাত রাখা হয় নাই। পেটে প্রচন্ড ক্ষিদে ছিলো। সেই ক্ষিদে অভূক্ত রেখেই তাকে রাতে ঘুমিয়ে যেতে হয়েছিল।

( মেয়েটি আমার বান্ধবী। ইনবক্সে পাঠানো ওর খুদে বার্তা থেকে। )

সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সিম্ফোণী নেই

বিচ্ছেদ চাইনি কখনো --
আঙ্গুলগুলো জড়িয়ে রয়েছে তার হাতেই
আকাশে চেয়ে দেখি একাকী নক্ষত্র
বাতাসেও কোনো সিম্ফোণী নেই।

অনু গল্প : সেই আমি

আমার একটি কর্মক্ষেত্রে একজন মেয়ে অধঃস্থন ছিলো। সে দেখতে ছিলো বেশ সুন্দরী। সে আমার নিকটতম দূরত্বে বসলেও তার সাথে আমি অফিসিয়াল দূরত্ব মেয়েইনটেইন করে কথা ও আচরণ করতাম। একদিন আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি আজ দুপুরে আমার অফিসে চলে এসো। কস্তুরিতে বসে দু 'জন লান্চ করবো। সে অফিসে এসে দেখতে পায়, আমার খুব কাছে একজন সুন্দরী মেয়ে বসে আছে। সেদিন লান্চে সে আর কোনো কিছুই ঠিকমতো খেলোনা। সারাক্ষণই মনটা বিষন্ন করে রাখলো।

রাতে শুয়ে আছি পাশাপাশি। সে আমার হাতটি তার বুকের উপর রেখে বলছিল - 'কেন জানি আমার ভয় হয়, কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে।'  আমি তাকে সেই রাতে বলেছিলাম - ' এ তোমার মিছেই আশংকা। তোমার এসব দূর্ভাবনা করার কোনো কারণ নেই। তুমি নিশ্চিত থাকো, আমি তোমার আছি, তোমারই থাকবো চিরকাল। '

নাহ্!  তারপরও সে নিশ্চিত হতে পারেনি। দেখলাম সে প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকে। খাওয়া দাওয়া কর্ম কোনো কিছুতেই মন বাসেনা তার। এবং সে যে গোপনে অশ্রুপাতও করে তা আমি তার চোখের পাতা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম।

সুখ আর শান্তির জন্যই মানুষ জীবিকা করে। যে জীবিকা করার কারণে কেউ একজন এতো কষ্ট পাচ্ছে, এতো কান্না কাটি করছে। ঘরে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। সে জীবিকা আমি নাইবা করলাম। হয়তো সাময়িক অসুবিধা হবে। তা হোক। আমি তাই একদিন চাকুরীটিকে ইস্তফা দিলাম।

নাহ্, কোনো অসুবিধা হয়নাই। জীবন ভালোই চলছে।  সুখেই আছি। আমিও তার চিরদিনের সেই আমি হয়েই আছি।

তাতে দোষ কি?

কেউ কেউ টিপ্পনি কেটে আমাকে বলে আমি নাকি বউয়ের জন্য একটু বেশী পাগল। আরে, পাগল হবোনা কেন, এইতো সেদিন আমার ভীষণ জ্বর হয়েছিল, সেইতো সারারাত আমার শিয়রে বসে থেকে মাথায় জল পট্টি দিয়েছে। একবার হাসপাতালে আইসিইউতে যখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলাম, সেইতো একটানা তিনদিন সারাদিন সারারাত বাইরে দাড়ানো ছিলো। এখনো কোথাও থেকে বাসায় ফিরতে দেরী হলে, সেই তো উদ্বিগ্ন থাকে। আগে মা এমন করতো, এখন বউ করে। আপনারাই বলুন এই পৃথিবীতে বউয়ের চেয়ে বড়ো বন্ধু কেউ আছে? আর এই পরম বন্ধুটির জন্য পাগল না হয় একটু বেশীই হলাম। তাতে দোষের কিছু আছে কি?

পাখি উড়ে গেছে

যে পাখি উড়ে গেছে, তার পিছু আর যেওনা। নতুন আকাশে মেঘের আড়ালে সে বাসা বেঁধেছে । স্মৃতি ও বিস্মৃতির মধ্যবর্তী ধূসরে এখন তুমি একা।

যে পাখি উড়ে গেছে, তাকে আর পিছু ডাক দিওনা। এখন সে উৎসবে ব্যস্ত । আলো ঝলমলে স্বপজাল তার চোখে মুখে। তাকে অনুসরণ কোরো না।

যে পাখি উড়ে গেছে, যতটা সম্ভব ছিন্ন পর্ব থেকে ভুলে যাও তাকে । বারবার তাকে ডেকো না। পুরাতন ডাক শুনলে সে চমকে উঠবে। বিরক্ত হবে।

পথে যেতে যেতে

পথে যেতে যেতে সন্ধ্যা হলো,
চারদিকে এতো নীলাভ ছায়া কেন?
তুমি তো আলোই ছিলে --
তবে কেন এই অন্ধকার হয়ে আসা!

দুপুরের গল্প

যখন কোনো কিছু লেখার থাকেনা
তখন লিখি ছোট্ট একটি পাখির নাম
কিংবা তার শিস্
ডানা মেলা পালক হারিয়ে গেছে কবে।

অন্ধকার মেঘ করে এলে
লিখি হারানো দুপুরের গল্প
সাদা পাতায় শূন্যতার স্মৃতি তখন লেখা হয়
আমাদের তখন বড়ো একা লাগে।

যা হারিয়ে যায়

কোনো একসময় প্রতিদিনই চিঠি আসতো কনিকার। কোনো কোনো দিন তিন চারটি করে। এতো ভালোবাসা আর এতো ভালোলাগা থাকতো সেইসব চিঠিতে। জীবন ভরে উঠতো, হৃদয় দুলে উঠতো। কতো ঝিম দুপুর পার করেছি এইসব চিঠি পড়ে। চিঠি হয়ে উঠতো এক একটি কবিতার প্রহর । কনিকা কাকে ভালোবেসেছিল? আমাকে না আমার কবিতাকে? সে যখন লেখে --

প্রিয় সখা, তোমার 'চোখ' কবিতাটি পড়েছি। তুমি যে চোখ নিয়ে কবিতাটি লিখেছো সেটি কার চোখ ছিলো? তুমিতো আমার চোখ দেখোনি, কিভাবে মেলালে আমার ভ্রু। আমার চোখের তারা। লিখেছো, চোখের জলপতনের কথা। লিখেছো করোতোয়ার স্বচ্ছ জলের কথা। আমার চোখে নাকি স্বপ্ন আঁকা আছে। তুমি কোথায় পেলে সে স্বপ্নের রং। আবার লিখেছো, আমার চোখে নাকি কান্না মানায় না। ভূবন জোড়া হাসি দেখতে চাও। আমি স্বপ্ন দেখি দুই চোখ ভরে। স্বপ্ন দেখি তোমাকে নিয়ে। তুমি যে চোখে স্বপ্ন খোঁজো, আমি সেখানে খুঁজি মুক্তির স্বাদ। দিন আসে দিন যায়। রাত্রি আর ফুড়ায়না। আমি কি কোনো অনন্ত দূঃখের ছায়া দেখতে পাই। নাহ্ এসবই আমার দুর্ভাবনা। আমি তোমার স্বপ্ন হতে চাই। আমি  তোমার দূরের মাধবী হয়ে থাকতে চাইনা।

আমি লিখেছিলাম --
কনিকা, পড়তে পড়তে আমার ঘুম এসে যায়। লিখতে লিখতে ঘুম এসে যায়। তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে যায়। কালকে হেনা স্যারের পদাবলীর ক্লাসে রাধার বিরহবিধুর কথা শুনতে শুনতে ঘুম এসে গিয়েছিল। ঘুম আসুক, কিন্তু সে ঘুমে কোনো স্বপ্ন না আসুক। বন্ধন আমার ভালো লাগেনা। জীবন যেভাবে চলছে, সেই ভাবেই চলুক। আমার সবকিছুই এলোমেলো, কোনোকিছুই সাজাতে চাইনা। আমি যে পথে চলছি, সেই পথ চলা অন্তহীন। তুমি আমার যাত্রী হইওনা।

কনিকা কি মনে করে লিখেছিলো -- ' আমি তোমার জন্য পথে নেমেছি। এই পথ মিলবে একদিন তোমারই পথে। পথের মাঝের এই ক্লান্তিকে তুমি থামিয়ে দিওনা। আমার  পথের মাঝে ফুল বিছিয়ে নাইবা রাখলে, কাঁটা বিছিয়ে রেখোনা। আর যদি রাখো, সেই কাঁটা বিঁধেই আমি হাঁটবো। রক্ত ঝরবে পথে, ঝরুক না। আমি একদিন ঠিকই পৌঁছে যাবো তোমার বাড়ি। যদি তুমি তুলে নাও তোমার ঘরে।'

একটি চিঠিতে লিখেছিলাম --
তুমি করোতোয়া পারের মেয়ে। যে স্বচ্ছ জল তুমি হাত দিয়ে ধরো, সে সৌন্দর্য তোমার। শিমুল পিয়াল থেকে যে ফুল ঝরে পড়ে, সে রক্তিম পাঁপড়ি তোমার। ফাগুনে যে জীর্ণ পাতা ঝরছে, সে মর্মরধ্বনি তোমার। বসন্ত রাতে জ্যোৎস্নার যে মাধুর্য, সে সিম্ফোণীও তোমার। এই শহরের রুক্ষ ইট পাথরের কথা তুমি শুনতে চাইবেনা। অট্টালিকার ফাঁকে যে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, তা দেখে তুমি কখনোই তোমার দয়িতের জন্য আকুল হবেনা। এখানে কখন শুক্লপক্ষ আর কখন কৃষ্ণপক্ষ হয়, তুমি জানতে পারবেনা।

কি এক আবেগ ছিলো তার, কি এক ভালোবাসার টান ছিলো কনিকার। একটি চিঠিতে সে লিখেছিলো -- 'আমার আর সালোয়ার কামিজ পড়তে ইচ্ছা করেনা। আমার মাথায় ঘোমটা দিয়ে শ্বশুরবাড়ির উঠোনে হাটতে ইচ্ছা করে। কুয়া পার থেকে কলসীতে জল তুলতে ইচ্ছা করে। তুমি সোহাগপুরের হাট থেকে একটি সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি কিনে এনে দেবে। আমি সাধারনের মতো করে পড়বো সে শাড়ি। করোতোয়ার স্বচ্ছ জল কলসী ভরে আমি নিয়ে যাবো তোমাদের বাড়ি। যমুনায় মিশাবো সে জল। তুমি কি আমাকে পাগলি ভাবছো। আসলেই হয়তো তাই। এসবই আমার ভাবনার কথা। তুমি হাসবেনা। এ যে আমার ভালোলাগার কথাও।'

কনিকা, এইভাবে স্বপ্ন দেখোনা। যদি সব স্বপ্ন একদিন ভেঙে যায়, সেদিন কার কাছে এসব স্বপ্নের কথা বলবে। তুমি কবিতাকে ভালোবাসো, কবিতাকেই বাসো। আমাকে না। আমি বিহঙ্গের মতো ঘুরে ফিরি নীল আকাশের মেঘের নীচে। কখনো হয়ে যাই ডানামেলা গাংচিল সমুদ্রের। রাতের নিবিড়ে সাগরের শব্দ শুনি। তোমার ওখানে আছে হেমন্তের চাঁদের রাত্রি। আমার আছে ঝলমলে নিয়ন বাতি। তুমি করোতোয়ার পারে ভাটিয়ালী গান শোনো মাঝিদের। আমি বুড়িগঙ্গার পারে যেয়ে শুনি অসংখ্য লন্চের কর্কশ ভেঁপুর শব্দ। আমার সাথে তোমার জীবন মিলবেনা।

প্রিয় কবি, তোমাকে কেবল চিঠিই লিখে গেলাম। তোমার কন্ঠ কখনো শোনা হয়নাই। তুমি কেমন করে বলো - 'ভালোবাসি', বড়োই শুনতে ইচ্ছা করে এ জীবনে। তুমি যে গান লিখো সে গান আর কে শোনাবে। তুমি দেখতে কেমন, তোমার সে রূপ আমার অন্তরে গেঁথে আছে। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাকে যে দীপ জ্বালাতে হবে, তা তোমার সেই মূর্তিকে সামনে রেখেই জ্বালাতে হবে। এ এক অসীম বেদনার দীর্ঘশ্বাস। তোমার গায়ে সে তপ্ত বাতাস কোনোদিনই লাগবেনা।

কনিকা, রাত জেগে জেগে তোমাকে নিয়ে অনেক কবিতা আমি লিখেছি। তোমার শরীরবৃত্ত সাজিয়েছি আমি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। তোমাকে আমি কোনো দিন দেখিনি কিন্তুু তোমাকে দেখেছি আমার কবিতায়। তোমার কাজল কালো চোখ এঁকেছি প্রিয়তম শব্দগুলি দিয়ে। তোমার চুলের সুবাস নিয়েছিলাম কতো দখিনা বাতাস থেকে। তোমার মায়াময় ঐ মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি কতো রাত। সবই যেনো এক রূপকথা। মাঝে মাঝে মনে হয়, তোমাকে পেলে ভালোই হতো।সোহাগপুরের হাট থেকে শাড়ি কিনে এনে দিতাম তোমাকে । তুমি ঘোমটা দিয়ে হাটতে আমাদের বাড়ির উঠোনে। কিন্তু তা আর এ জীবনে হবেনা।

প্রিয়তম, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করতে না করতে সে স্বপ্ন দেখা তুমি ভেঙে দিওনা। আমি প্রায়ই করোতোয়ার নদীর পারে বসে নিস্তব্ধ জল দেখি। কি নির্জনতা চারদিকে। আমি কান পেতে থাকি তোমার পদধ্বনি শোনার জন্য। জীবনের আর কোনো মধুর রাগিণী শোনা হলোনা। প্রায়ই ভ্রান্তি হয়, তোমার গভীর আলিঙ্গনে উদ্বেলিত হই। তোমার বুকের গন্ধ লাগে আমার গায়ে। আচ্ছা বলোতো, জীবন এমন কেন? আমি কি বেশি কিছু চেয়েছিলাম? যাক, নাইবা হলে তুমি আমার। তোমার লেখা কবিতা আর গানগুলোই আমার জীবনের করে নিব।

তারপর কোনো এক সময়ে কনিকাকে আর খুব বেশি চিঠি লিখি নাই। কনিকা মাঝে মাঝে লিখেছে, কিন্তু তার আর উত্তর দেওয়া হয়নাই। শেষ যে চিঠিটি লিখেছিলো সেখানে সে বলেছিলো -- 'তুমি কি সত্যিই আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলে? তুমি আর আমায় লিখবেনা? ' আমি সেই চিঠিরও উত্তর দিয়েছিলাম না।  জীবনে এরকম কতো মায়া এসেছে, এরকম কতো কনিকা'ই তো চিঠি লিখেছে। একটা হেয়ালি অহংকার ছিলো আমার। যে অহংকার করতে ভালোই  লাগেতো। এর জন্য কতোজন যে চোখের জল ফেলেছে। আবার এজন্যে আমাকে অনুতপ্তও হতে হয়েছে। সব কিছুরই একটি প্রায়শ্চিত্ত্ব আছে।

এমনি এক প্রায়শ্চিত্ত্বের কথা বলছি। কনিকাকে আমি একদম ভুলেই গেছি। আমার কোনো কবিতায়, কোনো গানে সে আর ছিলোনা। একদিন দুপুরে পোষ্টম্যান একটি চিঠি দিয়ে যায়। অনেক দিন পর কনিকার চিঠি। হঠাৎ পুরনো আবেগ প্রাণে দোলা দিয়ে উঠলো। আমি খুলে চিঠিটি পড়ছিলাম --

'প্রিয়তম, জীবনকে হার মানাতে পারলাম না। আমার এই জীবন আমার একার নয়। এ জীবন আমার বাবা মা ভাই বোনদেরও। তাদের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে। তাদেরকে আমার সুখী করার দায় আছে। আগামী অগ্রহায়ণের সাত তারিখে আমার বিয়ে। তুমি তো আর বিয়েতে আসবেনা।  তুমি আমার সুখের জন্য শুধু প্রার্থনা করিও।'

সেদিন রুমেই সারা বিকেল শুয়ে রইলাম। চোখে আর ঘুম এলোনা। সন্ধ্যায় হাটতে হাটতে চলে যাই লাইব্রেরী এলাকায় হাকিম চত্বরে। পর পর তিন কাপ চা খেলাম। তিনটি সিগারেটও খেলাম। আজ কোনো পরিচিত বন্ধুর দেখা পেলাম না। সন্ধ্যার পর রাতে  হলে চলে আসি। মন ভালো লাগছিলোনা।  হলের বন্ধু মমিনের রুমে যাই। দেখি ওরা তিন বন্ধু নীলক্ষেত থেকে মৃত সন্জিবিনী সুরা কিনে এনে খাচ্ছে। ওদের সাথে আমিও বসে কয়েক পেগ খেলাম। তারপর রুমে এসে ঘুম দেই।

ছুটিতে বাড়িতে চলে আসি।  বাড়িতে এসে শুনি, আমার এক কাজিনের বিয়ে। বগুড়ার মহাস্থানগড়ের এক গ্রামে। কনের নাম পারভীন আকতার কনিকা। আমাকে সে বিয়েতে বরযাত্রী হিসাবে যেতে হবে। গেলামও আমি। করোতোয়া নদীর পারে ছায়া সুনিবিড় একটি গ্রাম। সেই গ্রামেরই মেয়ে কনিকা। ওকে দেখে চমকে উঠি, এ যে সত্যিই আমার সেই কনিকা। যাকে আমি কল্পনায় অনেক ছবি এঁকেছিলাম। কনিকা লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। সে আমাকে চিনতে পারেনি। কি অপরূপ কবিতার মতো সুন্দরী মেয়ে। কি মায়াময় তার চোখ! আমি বিমুগ্ধ নয়নে ওকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, কনিকা তো আমারও বউ হতে পারতো। জীবনে কতো না পাওয়ার বেদনা আসে। সে যে আজ অন্য একজনের বউ।

কি এক দহনে আস্তে আস্তে হেটে বাড়িটির সামনে করোতোয়া নদীর তীরে চলে যাই। দেখি শান্ত আর স্নিগ্ধ  নদীর জল। আমি একটি ঢিল ছুঁড়ি, জল আলোড়িত হলো। কিছুক্ষণ পরে আবার স্তব্ধও হলো। জীবনটা কি এই রকমই? এই আলোড়িত হয়, এই স্তব্ধ হয়।

ফিরে যেতে চাই

আমি যে চলে যেতে চাই সেই বেলায়
যে বেলায় ঘুরে বেড়েয়েছি ইছামতীর তীরে
যে বেলায় শ্রাবনের মেঘের বৃষ্টিতে ভিজতাম
যে বেলায় গোল্লাছুট খেলতাম স্কুল মাঠে
যে বেলায় বিকালের হাওয়া লাগাতাম গায়ে
যে বেলায় কোনো শ্যামল কালো মেয়ে
হাত ধরে নিয়ে যেতো সোনাল বনে
যে বেলায় আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতাম
যে বেলায় কবিতা লিখতাম ছন্দ খুঁজে খুঁজে
যে মেয়ের মুখ দেখে খাঁ খাঁ রোদ্দুরে বের হতাম
ফিরে যেতে চাই সেইখানে তাহাদের কাছে।

তোমার চুল

তোমার চুল আমাকে টানে
তোমার কন্ঠস্বর রাগ কলাবতী হয়
মুখের মদিরতা আমাকে টানে --
নির্বাক, বুভুক্ষু আমি পায়চারি করি
চন্দ্রালোকের খাঁ খাঁ রাস্তায়।

বৃষ্টি ভেজা গল্প

ছেলেটির বৃষ্টিতে ভেজার খুব সখ ছিলো। কিন্তু ঠান্ডা লাগবে দেখে ওর মা ওকে কোনোদিন বৃষ্টিতে ভিজতে  দেয়নি। এ জন্যে ওর অভিমানও ছিলো। এক শ্রাবন বৃষ্টির দিনে ছেলেটির মা মারা যায়। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেদিন শব যাত্রায় কবরস্থানে গেলো ছেলেটি। মাকে কবর দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেই সে বাড়ি ফিরলো। আজ আর বৃষ্টিতে ভিজতে ওকে কেউ বাঁধা দিলোনা।

জলের শব্দ

ঘুম ভেঙে গেলো জলের শব্দে
সেও ছিলো আজ হৃদয় উড়ায়ে,
যদি গ্লাসটা খোলা থাকতো
জল এসে ভেজাতো আমাদের গায়ে।


অর্ঘ্য দিতে চাও

আজ মনে হয় কপালে ভালোবাসা নেই
নেই একটি চুমোও
আজ যদি থাকে কাল আবার নেই
পরশুর কথা ভাবছিনে কোনো।

অর্ঘ্য দিতে চাও বাসর রাতে নিভৃতে শয়নে,
তুমিই জ্বালাও তুমিই পোড়াও
তপ্ত প্রেমের দহনে।

K.T
3/9/2017

ঈদ শুভেচ্ছা

ছোটবেলা যখন ঈদ করতাম, তখন অনেকেই ছিলো। মা বাবা ছিলো। ভাইবোনেরা ছিলো। সবাইকে সাথে করে নিয়ে কি আনন্দেই না সেই সব ঈদগুলো করতাম। আজ মা বাবা নেই। ভাইবোনেরা অনেকেই নেই। কেউ এতো দূরে চলে গেছে যে, কোনো ঈদেই তাদের সাথে আর কোনদিন দেখা হবেনা। আবার কেউ কেউ আছে আমার থেকে দূরে অথবা দূরদেশে। এই সব প্রিয় মানুষের শূন্যতা নিয়েই ঈদ করতে হয়।

আবার এইসব শুন্যতা ভরে দিয়েছে স্ত্রী সন্তানেরা। তাই ঈদ আনন্দেরই বলা যায়। সবাইকে ঈদ শুভেচ্ছা।

মায়া দ্বীপ

বালক বয়সে এই কাহিনীটি আমার পিতামহের জেঠাতো ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তিনিও আমার দাদাজান হন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতবর্ষজুড়ে তখন স্বদেশি আন্দোলন চলছিলো। বাংলায়ও তখন এ আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছিলো। অরবিন্দ ঘোষ, গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে আন্দোলন  উচ্চ মাত্রা পায়। উল্লেখ্য এই স্বদেশি আন্দোলনে একটি গ্রুপ ছিল সশস্ত্র। তাদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কারণে এই আন্দোলন একসময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আমার এই দাদাজান সশস্ত্র গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ওনার নাম ছিলো শ্রীমান মফিজ উদদীন মন্ডল।

স্বদেশি আন্দোলন করতে যেয়ে সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কারণে প্রায় তেরো জনের একটি গ্রুপকে তৎকালীন বৃটিশ সরকার শাস্তি স্বরূপ কালাপানি অর্থাৎ আন্দামান দ্বীপে দীপান্তরিত করে। তার ভিতর আমার দাদাজান শ্রীমান মফিজ উদ্দিনও ছিলেন। আমার দাদাজান ছিলেন তৎকালীন এন্ট্রান্স পাশ শিক্ষিত সুদর্শন এক যুবক। আসুন তৎসময়ের সেই যুবক মফিজ উদদীনের মুখেই তার সেই দীপান্তর জীবনের কাহিনীটি শোনা যাক --

৭ই ডিসেম্বর, ১৯১১ সাল। এম.ভি মহারাজ যখন কোলকাতা বন্দর থেকে ভোরে ভেঁপু বাজিয়ে ছাড়ে তখনও ভোরের  সূর্য ওঠে নাই। জাহাজটি বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে  দক্ষিণ পূর্ব অক্ষরেখার দিকে চলতে থাকে। আমার হাতে হাতকড়া, জাহাজের দোতলায় ক্যাবিনের মতো একটি কামড়ায় আরো পাঁচজন আসামির সাথে আমিও বসে আছি। আমাদের রুমের দরজার সামনে দুইজন নিরাপত্তা রক্ষী দাড়ানো। বাইরে তখন রোদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছিলো। আমার খুব ইচ্ছা করেছিলো বাইরের সূর্যোদয় দেখার । গভীর সমুদ্র থেকে সূর্যোদয় দেখা কয়জনেরই ভাগ্যে জোটে। আমি রক্ষী দুইজনকে বললাম -- 'আমাকে একটু রেলিংয়ের এই পাশে যেতে দাও। আমি জলে ঝাঁপ দিয়ে মরবোনা। এই সাগর, এই সূর্যোদয়, চারদিকে এতো আলো, সাগরের এই নিনাদ, ডানা মেলা গাংচিল পৃথিবীর এতো সুন্দরকে রেখে কেউ কোনো দিন মরতে চাইবেনা। আত্মহত্যা তো নয় -ই। '

মহারাজ চলতে চলতে দুপুরের মধ্যেই ভারত মহাসাগর টেরিটোরীতে ঢুকে যায়। আমি এর আগে দেখেছিলাম বালুকাবেলায় দাড়িয়ে সাগর কিন্তু কখনো দেখিনি গভীর সমুদ্রের মাঝে সমুদ্র। আমার হাতে শিকল পরানো, কিন্তু আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো দুই হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে। এ আমার শাস্তি নহে গো, এ আমার পরম পাওয়া। আমি দেখতে পাচ্ছি সৃষ্টির অসীমত্ব। হে প্রভু তুমি আমাকে অমরত্ব দাও এই জলধিতে। আমাকে তুমি মহান করো। '

এই মহারাজ জাহাজে রাজপুত্তুরের মতো বেশ আছি। দুপুরে কোরাল মাছের তরকারি, ভুবনেশ্বরের মিহি আতব চালের ভাত। চারিদিকে জলরাশি! এতো সুখ এখানে, মনে মনে লুই মাউন্টব্যাটেনকে স্মরণ করছিলাম, বলছিলাম তোদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। শাস্তি স্বরূপ পাঠিয়ে দিচ্ছিস কালাপানিতে। কিন্তু আমিতো উপভোগ করছি জীবন। পৃথিবীর এই অপরূপ রূপ না দেখলে জীবন অপূর্ণ থেকে যেতো।

তারপর সমুদ্রে নেমে এলো সেই সন্ধ্যা। রক্ষীদের বলি --'তোরা আমায় এই রুমের ভিতর শিকল পড়িয়ে রাখিসনে। আমাকে একবার শুধু যেতে দে ঐ রেলিংয়ের পাশে। যেতেও দেয় ওখানে। পানিতে চেয়ে দেখি হাজার হাজার রূপালী মাছ লাফাচ্ছে। আহা! আমি যদি একটিবার এই জল ছুঁইতে পারতাম। যদি ধরতে পারতাম একটি রূপালী মাছের পালক। চিলগুলোর দিকে চেয়ে ভাবছিলাম - এখানে এই অতলান্তিকে এতো চিল আসলো কই থেকে? রাত হলে উড়ে ওরা কোথায়-ই বা চলে যাবে? কোথায় নেবে ঠাঁই? ওরা কি ক্লান্ত হয়না?

আস্তে আস্তে সমুদ্রে রাত নেমে আসে। সাগরের শোঁ শোঁ গর্জনে মন কেমন যেনো উচাটন হয়ে ওঠে। কেবিনের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। গভীর সমুদ্রে এমন চন্দ্র দর্শনে আত্মা আমার হিম হয়ে আসে। এমন মায়া মুগ্ধ রাতে আমার দুই চোখে সেদিন আর ঘুম আসেনি।

তিন দিন ধরে সাগরে ভাসতে ভাসতে চতুর্থ দিনের সকাল বেলায় মহারাজ জাহাজটি যেয়ে পৌঁছে কালাপানিতে তথা আন্দামান দ্বীপে। মহারাজ যখন কূলে নোঙ্গর করে, তখন দ্বীপে তাকিয়ে দেখি আন্দামানের পারিপার্শ্বিক দৃশ্য। কি সুন্দর সমুদ্রসৈকত ও ম্যানগ্রোভ অরণ্য। মুহূর্তেই এক উত্তেজক আনন্দের উপলব্ধির ঢেউ খেলে গেলো অন্তরে। বিস্ময়কর ও চিত্তাকর্ষক অরণ্য, শ্বেত বালুকাময় সমুদ্র সৈকত ও সমুদ্রের কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ জলধারা এই দ্বীপকে মহিমান্বিত করেছে।

আমাদের প্রথম দিন নিয়ে যাওয়া হয় সেলুলার জেলে। গরাদের পিছনে কয়েকমাস বন্দী করে রাখা হয়। এই সেলুলার জেল একটি মহান অতীতকে জড়িয়ে ধরে আছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা যে কি অসহ্য দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে তাঁদের জীবন কাটিয়েছিলেন তার সাক্ষী আমিও হতে পেরেছিলাম।

আমার মাত্র পাঁচ বছরের দীপান্তরের শাস্তি হয়। আমি কোনো চোর বদমাশ ছিলাম না। আমি ছিলাম নিছক ভারতবর্ষের  স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন তরুণ যোদ্ধা। আসামিদের আচরণ ভেধে সাগর দ্বীপেই শর্ত সাপেক্ষে মুক্ত জীবনে ছেড়ে দেওয়া হতো। সৌভাগ্যক্রমে আমি ছিলাম তাদেরই একজন।

মুক্ত জীবন পেয়ে সেলুলার জেল থেকে প্রায় পনেরো মাইল উত্তরে মায়া দ্বীপ নামে একটি ছোট্ট দ্বীপে চলে যাই। দ্বীপটি ভারত মহাসাগরের কোলে অবস্থিত। এই উর্বর সমভূমীয় দ্বীপটি নারিকেল গাছ দ্বারা আবৃত। সমুদ্রের অনবরত হুঙ্কারের নিনাদ মনকে পুলকিত করে তুলে।  দ্বীপের প্রকৃতির হেঁয়ালিপূ্র্ণ সৌন্দর্য আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। ছোট্ট এই দ্বীপে দশ বারোটি নিকোবরী কুঁড়ে ঘর ছিলো। যেখানে কয়েকঘর শোমপেন আদিবাসি পরিবার বাস করতো। এরা দেখতে অনেকটা মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্ঠীর মতো। নাক চ্যাপ্টা। গায়ের রং বাদামি। প্রায় নগ্ন হয়ে এরা বসবাস করতো। মেয়েরা শরীরে স্বল্প লতাপাতা জড়িয়ে রাখতো আর  পুরুষগুলো জালের নেংটি পড়ে থাকতো।

দামোদর নামে এক জেলের সাথে আমি ভাব করি। এবং তার পরিবারের সাথে মিশে যাই। দামোদরের বউ ছিলো, একটি যুবক ছেলে ছিলো, ছেলে বউ এবং একটি চোদ্দ পনেরো বছরের মেয়ে ছিলো। এরা কোনো ধর্মব্রত পালন করতোনা। শুধু সন্ধ্যার সময় অগ্নি উপাসনা করতো এবং কি সব জপ করতো। আমি এদের ভাষা বুঝতাম না। প্রথম প্রথম ইশারায় কথা বলতাম। পরে ভাষা রপ্ত করতে পেরেছিলাম। ঠিক ধর্ম গ্রহণ নয়, আমি ওদের সাথে বসে অগ্নি উপাসনাও করতাম এবং জপ করতাম।

আমার সেই একাকী দীপান্তর জীবনে দামোদরের পরিবারটির সাথে আমি মিশে যাই। আমি দামোদরদের সাথে সাগরে মাছ ধরতে যেতাম। মনে হতো আমি দামোদরেরই একটি ছেলে। দামোদর, দামোদরের বউ, সবাই আমাকে আপন করে নেয়। আপন করে নিয়েছিল, দামোদরের মেয়ে চিনুপুদিও।

আমার যখন মন খারাপ লাগতো, তখন দূরে বহুদূরে হাটতে হাটতে চলে যেতাম। ভারত মহাসাগরের তীরে বসে বঙ্গোপসাগরের জলের নিনাদ শুনতাম। মন আর ভালো হতোনা। চলে আসতাম কুটিরে। এই কুঁড়ে ঘরে কখনোই সন্ধ্যা বাতি জ্বলতোনা। সন্ধ্যা হলেই সবাই শুয়ে পড়তো। কিন্তু আমি শুতামনা । বাইরে তালপাতা বিছিয়ে শুয়ে থাকতাম, না হয় বসে থাকতাম। একাকী আকাশ ভরা তারা দেখতাম। জ্যোৎস্না ঝরে পড়তো। তারপর একসময় ঘুমিয়ে যেতাম।

সেদিন ছিলো পূর্ণিমা সন্ধ্যা। পুন্জে ছিলো অগ্নি উপাসনার উৎসব। নাচ হবে। গান হবে। তাড়ি খাবে। নেশা করবে। স্ফূর্তি করবে। উৎসবের এই দিনে আমি উপস্থিত থাকিনা। মনটা খুব খারাপ লাগছিলো। একাকী চলে যাই সমুদ্র তীরে। বালুকাবেলায় বসে থাকি। শুনি সাগরের শব্দ।  জলের কুলকুল ধ্বনি কান্নার শব্দের মতো মনে হচ্ছিলো। চাঁদের আলো এসে ভেসে গিয়েছিলো নীল জলে। হঠাৎ পিছনে ফিরে দেখি চিনুপুদি দাড়িয়ে আছে। আমি ছোট ডিঙ্গিটার কাছে চলে যাই। যেয়ে ডিঙ্গিতে বসি। চিনুপুদিও আমার পিছে পিছে এসে নৌকায় বসে।

আমি :  তুমি চলে আসলে যে। ওখানে উৎসব হচ্ছে।
চিনুপুদি :  আমার ভালো লাগছিলোনা, তাই চলে এলাম।
আমি : তোমাকে খুঁজবেনা?
চিনুপুদি :  না। সবাই নেশায় চূর হয়ে আছে।
আমি :  তুমি ওসব খাও নাই?
চিনুপুদি : না।

হঠাৎ সাগরে পূর্ণিমার জোয়ার শুরু হয়ে যায়। আমরা তখনও বিহবল হয়ে নৌকায় বসে আছি । ডিঙ্গিটি ভাসতে ভাসতে আরো কূলের দিকে চলে আসে। সাগরের ঢেউ আমাদের শরীরের উপরে আছড়ে পড়ছিল। চিনুপুদি ভয় পেয়েছিল কিনা জানিনা। সে আমাকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছিল। সমুদ্রের ঢেউ আর জ্যোৎস্নার প্লাবনে আমরা সেই সন্ধ্যা রাতে আরো বেশি ভিজে স্নাত হয়েছিলাম।

এই মায়া দ্বীপে আরো চার পাঁচ মাস চলে যায়। এর মাঝে আমি চিনুপুদির আরো কাছে চলে আসি। ওকে একটু  ভালোও বেসে ফেলি। এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় পুন্জের পুরোহিত কি এক মন্ত্র পড়িয়ে চিনুপুদিকে আমার হাতে সপে দেয়। এটি ওদের বিয়ের নিয়ম ছিলো কিনা জানিনা।

বন্দীদের শর্ত অনুযায়ী প্রতি মাসে মুক্ত বন্দীদের সেলুলার জেলে যেয়ে রিপোর্ট করতে হতো। এবার রিপোর্ট করতে যেয়ে জানতে পারি, গভর্নর লুই মাউন্টবাটেন  যীশু খ্রিস্টের বড়ো দিন উপলক্ষে আন্দামানের কিছু বন্দীকে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দেবে। সেই তালিকায় আমার নামও আছে। আমি খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। আগামীকাল সন্ধ্যায়ই মহারাজ ছেড়ে যাবে বন্দর থেকে। ঐ জাহাজে করেই চলে যেতে হবে কোলকাতা।

আমি ঐদিনই চলে আসি মায়া দ্বীপে। আজ রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ নেই। ভারত মহাসাগরের তীরে এই দ্বীপে আজ নেমেছে আঁধার। চিনুপুদি আমাকে জড়িয়ে থেকে সারারাতই কেঁদেছে। খুব ভোরে মায়া দ্বীপ  থেকে ছোট নৌকায় করে পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেলে চলে আসি। বিদায় বেলায় চিনুপুদি ওর পেটের কাছে কান পেতে আমাকে ওর বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে বলেছিল। আমি শুনেওছিলাম। আর ওর এক হাত থেকে পিতলের একটি রুলি বালা খুলে দিয়ে বলেছিল -- 'এটি আমার স্মৃতিচিহ্ন, ভুলে যাবেনা। এসো আবার। '

বিকেলে যখন সেলুলার জেলের অফিসে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সেরে বিদায় নিচ্ছিলাম, জেলার সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো -- 'এই দ্বীপের আমার সবচেয়ে বেশী কি ভালো লেগেছিলো? ' আমি উত্তরে বলেছিলাম, তিনটি জিনিস আমার ভালো লেগেছিলো -- এক.  মায়া দ্বীপ,  দ্বিতীয়ত:  সাগরের শব্দ,  আর তৃতীয় হচ্ছে, চিনুপুদি।

K.T
31/8/2017

রাতের পদাবলী

কবিতা লিখবো বলে রাত জেগে আছি
নিশাচর পাখিরা এলো
তারারা ছুটে এলো
বাতাস এলো
নৈঃশব্দ্যে গান শোনা গেলো
জ্যোৎস্নায় আকাশ ভাসলো
তোমার পদধ্বনি বাজলো
সকাল বেলা খাতা খুলে দেখি --

সেখানে কোনো পদ নেই
কোনো পদাবলী নেই
কোনো কবিতা নেই
সারা পাতা জুড়ে তোমারই নাম লেখা।

সাব্বাস বাংলাদেশ!

অজিদের সব দর্প ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে খানখান হলো সব অহংকার। বাঘের থাবায় রক্তাক্ত হয়ে গেছে ক্যাঙ্গারুদের হাড়গোড়, মজ্জা, পাজর সব। মিরপুর স্টেডিয়ামে ওদের রক্তের নহর বইছে। সাব্বাস বাঘের জাতি! সাব্বাস বাংলাদেশ! পৃথিবী তুমি আমাদের তাকিয়ে দেখো।

জীবনের পরাজয়

পরাজয়ের গান তিনি গেয়েছিলেন পন্চাশ বছর আগে। আজ এতো বছর পর তিনি সেই জীবনের কাছেই পরাজিত হলেন। চিরতরে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমরা বিস্ময়ে শুনতাম মুক্তি যুদ্ধের সময় সেই সব প্রেরণা জাগানিয়া গান তার কন্ঠে। যা আমাদের শক্তি যোগাতো মুক্তি যুদ্ধে। তিনি অমর রহে এই লাল সবুজের দেশে, পদ্মা মেঘনা বহতা ধারার মতো চিরকাল।

Rest in Peace Abdul Jabbar.

সুস্মেলী

সুস্মেলী, সেই যে তুই চলে গেলি
একবার আর ফিরে না তাকালি

তুই কি আমার মতো একলা থাকিস
নাকি কাউকে আবার ভালোবাসিস

নাকি চেয়ে দেখিস একলা সন্ধ্যাতারা
নীল জোনাকি খোঁজে তোকে পথহারা

নির্জনতায় কি ঘুরে বেড়াস চিত্রাপারে
ইচ্ছে হলেই আমায় ডাকিস চুপিসারে

সুস্মেলী, আমি যে তোকে ভালোবাসি
রাত গভীরে তোর জন্যই বাজাই বাঁশি।

ফুলের বনে

সেদিন ফুলের বনে বাতাস এসে
দোল দিয়েছিল
তোমার মন দুলে উঠেছিল .....

অসম্পূর্ণ আকাশ

কিছুটা সম্পূর্ণ  কিছুটা অসম্পূর্ণ একটি আকাশ
কয়েক'শ কোটি তারার আয়োজনে
আসে একটি মাত্র রাত।

তোমাকে ভালোবাসি এই আকাশ তলে
আমরা মেঘ হবো, নীল মেঘ,খয়েরী মেঘ,
রঙবেরঙের মেঘ।

ক্লেদজ কুসুম

আমার এই জীবনে তুমি একমাত্র রমণী
তুমিই একমাত্র সহচরী কিংবা রাজ রাজেশ্বরী
যে তুমি ঠাঁয় দাড়িয়ে আছো আমার পাশে,
ময়ুরের পেখম মেলে কথা বলি তোমার সাথে প্রাগৈতিহাসিক ভাষায় --
যেনো রাত্রিও সচকিত হয়ে ওঠে।

তুমি কখনো হতে পারোনি সম্পূর্ণ রমণী
কোনো বসন্ত শেষ করতে পারোনি
হয়ে থাকলে ক্লেদজ কুসুম --
কতো রাত শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে রুমাল বানিয়েছি
কতো রাত দাবা খেলায় রানী হেরে গেছে
ধাবমান অশ্ব ক্ষুরে, সৈনিকের তলোয়ারের খোঁচায়।

জীবন ফতুর হয়ে গেলো
সব আয়ুস্কাল ভাঙ্গা প্রদীপের নীচে নিভে গেলো
এ এক দুঃসহ ক্লেদ আমার --
একটি রাজ্যও এখনো জয় করতে পারিনি।

K.T
29/8/2017

যামিনী না যেতে

একদিন রাতে অনলাইনে বসে 'সে যে আমার নানা রঙ্গের দিনগুলি' নামে আমার ব্লগে এক বর্ষা দিনের কথা লিখছিলাম। আর্ট কলেজের বকুল তলায় বসে, পাপিয়া সেদিন আমাকে বলেছিলো - 'ভালোবাসি।' ঠিক সেই সময়ে কোথা থেকে উদ্ভ্রান্ত বাতাস এলো। বকুলের পাতা সব দুলে উঠলো। পাপিয়া'র মাথার চুল উড়ছিলো। ঝরা ফুল এসে ঝরে পড়েছিলো ওর চুলে। আমি চুল থেকে কুঁড়াই ফুল। সেই ফুল পাপিয়া 'র হাতে দিয়ে বলেছিলাম- 'আমিও তোমাকে ভালোবাসি। '

ভালো বাসতে বাসতেই আমাদের দু'জনের জীবনে বসন্ত আসে। এমনি এক বসন্ত দুপুরে আমরা বসেছিলাম সেই বকুল তলাতেই। তপ্ত দুুপরে সেদিন কোনো উদ্ভ্রান্ত বাতাস আসেনি। বকুলের পাতার ফাঁক দিয়ে কেবল রোদ্দুর ঝরে পড়ছিলো। এতো মায়ময় আলোর ঔজ্জ্বল্যে পাপিয়ার মুখ সেদিন বিষন্ন লাগছিলো। আমার ব্লগে লিখছিলাম তাই --

' সেদিন আমার অপেক্ষা ছিলো আনন্দের
সেদিন তোমার আগমন ধ্বনি ছিলো
পাতা ঝরার মতো বসন্ত গানের --
আম্র মুকুলের আড়ালে কোকিল ডেকে উঠেছিলো
সমস্ত সৌরভ হঠাৎ কোথায় মিলিয়ে গেলো
কি দ্বিধায় গোপণ রেখেছিলো সে সত্য
ভালোবাসার কাছে সত্যও গোপন হয়
তার আকন্ঠে কখনো চুম্বনের দাগ দেখিনি
বুঝতে পারিনি অন্য কারোর ঘর থেকে
সে প্রতিদিন বেরিয়ে আসতো রাধিকার মতো। '

আমার ব্লগে যখন পাপিয়া'র কথা, তার অভিসারিকা হওয়ার কথা লিখতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই ল্যাপটপে খুলে থাকা ফেসবুকের উইন্ডোতে  একটি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট নোটিফিকেশন আসে। রিকুয়েস্টটি ছিলো একটি মেয়ের। নাম যামিনী। আমি যামিনীর ওয়ালে চলে যাই। একটি মাত্র ছবি সেখানে দেওয়া আছে। পিছন দিক হওয়া, মুখ দেখা যায়না। লাল পেঁড়ে সাদা শাড়ি পড়ে কাশবনের ভিতর দিয়ে হেটে যাচ্ছে।

এ্যাবাউটে লেখা আছে --''আমি যামিনী, একসময় কাশবনের সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে হাটতে খুব পছন্দ করতাম। এখন যেখানে আছি, সেখানে কাশবন নেই। আছে রডোডেনডন গুচ্ছ। অবশ্যই তা শিলংয়ের পাহাড়ের ঢালে নয়। সুদূর অষ্ট্রিয়ায় দানিয়্যুব নদীর তীরের এক উপত্যকায়।"

আমি রিকুয়েস্টটি এ্যাকসেপ্টটেন্স দেই। কোনো মিউচুয়াল ফ্রেন্ড নেই। এমনকি তার বন্ধু লিস্টে অন্য কোনো বন্ধুও নেই। আমিই তার প্রথম বন্ধু হলাম।
ইনবক্সে প্রথম সে লিখলো - 'আমাকে তুমি বন্ধু করলে! কিযে ভালো লাগছে আমার।'
আমি বিব্রত হই প্রথমেই 'তুমি' সম্বোধনে। তারপরও সহজ করে নেই ব্যাপারটা। বলি :  আমিও খুশি, আপনার বন্ধু হতে পেরে। '
যামিনী :  বন্ধুকে 'আপনি' বলছো কেন? বন্ধুকে কেউ. 'আপনি ' বলে?
আমি :  আমি খুশি তোমাকে বন্ধু পেয়ে।
যামিনী :  কি করছিলে?
আমি :  ব্লগে লিখছিলাম। বায়োগ্রাফিমুলক লেখা।
যামিনী :  কার কথা লিখছিলে?
আমি  :  সে তুমি চিনবেনা! একটি মেয়ের কথা।
যামিনী :  কি নাম তার?
আমি :  পাপিয়া।
যামিনী :  ভালোবাসতে তাকে ?
আমি :  জ্বী।

যামিনী  :  তোমার সাথে কাল আবার কথা বলবো। ঠিক এই সময়ে। তুমি অনলাইনে থেকো। নীচে আমার হাজব্যান্ড এসে গাড়ির হর্ণ বাজাচ্ছে। যাই।

যামিনী অফ্ লাইনে চলে যাবার পর ভাবছিলাম, একজন মেয়ে অনেক কিছুই পারে, তার অত্যাশ্চর্য সম্মোহন শক্তি দিয়ে মুহূর্তেই একজন ছেলের মন জয় করতে পারে । সেই সুদূর অস্ট্রিয়ার দানিয়্যুব নদীর তীর থেকে এক অজানা অচেনা রমণী এ কোন্ হৃদয় দোলায় দোল দিয়ে রেখে গেলো।

পরের দিন রাতে ব্লগে পাপিয়া'র অসমাপ্ত কথা লিখতে যেয়ে আর লেখা হলোনা। ইউটিউবে রবি ঠাকুরের এই গানটি শুনছিলাম --

"কেন যামিনী না যেতে জাগালে না,
বেলা হল মরি লাজে।
শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথেরি মাঝে।
আলোকপরশে মরমে মরিয়া
হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া,
কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া
কামিনী শিথিল সাজে। "

গান শেষ হতে না হতেই ইনবক্সে যামিনীর নোটিফিকেশন চলে আসে। যামিনী লিখে :  কি করছো এই রাতে? সবুজ আলো জ্বেলে একাকী।
আমি :   শুনছিলাম 'কেন যামিনী না যেতে' গানটি।
যামিনী :    তাই? ভালো লাগলো। গতকাল থেকে তোমার কথা মনে পড়ছে খালি। তারপর বলো -- 'তোমার সেই পাপিয়া 'র কথা।
আমি :   পাপিয়া আমার জীবনে নেই। আসেও নাই। তাকে ভালোবাসবার আগেই সে আরেকজনের বউ ছিলো। আমি তা জানতাম না। দুইজনের কতো ভালবাসা ছিলো, কতো স্বপ্ন ছিলো, কতো চাওয়া পাওয়া ছিলো। এই জীবনে কোনো কিছুই আর পাওয়া হয়নি। পাপিয়া যার স্বপ্ন ছিলো তারই স্বপ্ন হয়ে আছে।

যামিনী :  তুমি কখন জানলে, পাপিয়া আরেকজনের বউ।
আমি :  সেদিন আর্ট কলেজের বকুলের তলায় আমরা বসেছিলাম, শুধু ভালোবাসার সময়গুলো একসময় শেষ হয়ে আসে, পাপিয়াকে বলি -- 'চলো আমরা বিয়ে করি, ঘর বাঁধি। ' পাপিয়া সেদিন কাঁদতে কাঁদতে তার সেই না বলা কথাটি বলে দিয়েছিলো।
যামিনী :  তারপর কি হলো?
আমি :  পাপিয়ার সাথে সেইটাই ছিলো আমার শেষ দেখা। এরপর ওর সাথে আমি কখনো দেখা করি নাই। চিঠিও লিখি নাই। পাপিয়াও বুঝতে পেরেছিলো আমার অভিমানের কথা। আমি চিরতরে নিজেকে তার কাছ থেকে দূরে সরে রেখেছিলাম।

যামিনী :  তোমার কি এখনো পাপিয়ার কথা মনে হয়? তুমি কি তাকে এখনো ভুলে যেতে পেরেছো?
আমি :   মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। ও আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা ছিলো। এক বর্ষায় আমার দু'হাত নিয়ে করোতলের উপর সে চুম্বন একেঁ বলেছিলো, 'এমনি করেই সারা জীবন তোমাকে ভালোবাসবো।' বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিলো। এখনো কোনো বর্ষার দিনে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হলে পাপিয়া 'র কথা মনে পড়ে। মনে হয়, সে যেনো আছে আমারই পাশে। তার নিঃশ্বাস এসে আমার বুকে পড়ে। আমার দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে তার কপোলে।
যামিনী :  পাপিয়া এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? জানো কি?
আমি  :   আজ বহু বছর হয়ে গেছে। কিছু জানিনা তার কথা । বেঁচে আছে কিনা তাও জানিনা।
যামিনী :  তুমি আমাকে মনটা খারাপ করে দিলে। আজ এই পর্যন্তই। কাল আবার কথা হবে। ভালো থেকো।শুভরাত্রি।

সন্ধ্যা থেকেই মনটা কেমন উতলা হয়ে উঠছিলো। কখন রাত্রি গভীর হবে। কখন আসবে যামিনী অনলাইনে। এই দুই দিনেই যামিনীর প্রতি কেমন যেনো টান চলে আসে।
ইনবক্সে যামিনীর ইমো দেখতে পাই --
যামিনী :  কেমন আছো।
আমি  : ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
যামিনী :  ভালো নেই। কাল রাত থেকেই তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। জানো, আমিও খুব দুঃখী। সেই কতোকাল ধরে, কতো রাত্রিতে গোপণে কতো যে আমাকে কাঁদতে হয়েছে। সে কথা শুধু ঈশ্বরই জানে। তোমার প্রোফাইলে তোমার বউয়ের ছবি দেখলাম। খুবই সহজ সরল মায়াময়ী এক দেবী যেনো। ওকে খুব ভালো লাগলো।
আমি :  জ্বী, ও খুব ভালো মেয়ে। ওকে নিয়ে সুখেই আছি। ও সত্যিই একজন মায়াবতী।

যামিনী :   আমি ভালো নেই। আসোনা তুমি একবার এখানে বেড়াতে। এক সন্ধ্যায় দানিয়্যুবে বজরা ভাসিয়ে দূরে অনেক দূরে চলে যাবো। এখানেও ওঠে আমাদের দেশের মতো পূর্ণিমার চাঁদ। সারা রাত চন্দ্রালোকে ভাসবো দুইজন। তুমি যদি আসো দানিয়্যুবের তীরে ওপারে রয়েছে আকাশ জুড়ে পাহাড় আর উপত্যকা। সারা বিকেলে হাঁটবো গিরি পথে পথে। দেখতে পাবে রডোডেনডন গুচ্ছ। এখানেও আছে মাধবীলতা। আসবে তুমি!

আমি :  দেখি, তোমাকে আমি দেখতে যাবো একদিন ভিয়েনায়। তোমার প্রোফাইলে তোমার একটি মাত্র ছবি। তাও পিছন দিক হয়ে। যামিনী, তোমার মুখ আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। তোমার মুখের একটি ছবি পোস্ট দাওনা? তোমায় একটু দেখি।

যামিনী :  আমি দেখতে খুবই কুৎসিত। তুমি আমাকে দেখে পছন্দ করবেনা। অামাকে ঘৃণা করবে।
আমি :  কে বলেছে, তোমায় ঘৃণা করবো? সত্যি বলছি, ঘৃণা করবোনা। তুমি একটি ছবি পোষ্ট দিও।
যামিনী :  ঠিক আছে। পোষ্ট দিবো। কাল সকালে তুমি দেখতে পাবে। এখন যাই। ভালো থেকো। কোনো দিন তুমি আমাকে ভুলে যেওনা।

সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে, তখন ফেসবুকে যেয়ে যামিনীর প্রোফাইল ছবি খূঁজি। পেলামও। অনেক আগের একটি সাদা কালো ছবি। এ যে দেখছি সেই পাপিয়া! নামটাও চেন্জ করা। যামিনী নয় -- পাপিয়া আলী, ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।

K.T
28/8/2017

ভালোবাসা কারে কয়

তুমি বঙ্গোপসাগরের লোনাজল,
নাকি পলিমাটি মিশানো যমুনার স্রোতধারা?
তোমার প্রেম শীত না বসন্ত, নাকি নাতিশীতোষ্ণ!
সবকিছুই দ্বিধায় ঢেকে রেখেছো।

নাকি ভালোবাসা এই রকমই --
যেমন তুমি আবক্ষ জলে নামলে শীৎকার করো
আবার ডাঙ্গায় তপ্ত রোদ্রে ছটফট করো
তোমাকে কাছে টানলেই সমস্ত মেঘ
জল হয়ে ভূবন ভাসে।

আবার তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখলে
সমস্ত দীর্ঘশ্বাস ঝড় হয়ে যায় ঈ্ষাণ কোণে
তুমি আগুন হয়ে জ্বলে পোড়া মাটি করো
আবার জল হয়ে নদীও হয়ে যেতে পারো।

তোমাকে ভালোবাসতে কোনো দ্বিধা নেই
তুমিই শিখিয়েছো কিভাবে ভালোবাসতে হয়
তুমি শিখিয়েছো, ভালোবাসা কারে কয়!

K.T
27/8/2017

ভালোবাসা কারে কয়

তুমি বঙ্গোপসাগরের লোনাজল,
নাকি পলিমাটি মিশানো যমুনার স্রোতধারা?
তোমার প্রেম শীত না বসন্ত, নাকি নাতিশীতোষ্ণ!
সবকিছুই দ্বিধায় ঢেকে রেখেছো।

নাকি ভালোবাসা এই রকমই --
যেমন তুমি আবক্ষ জলে নামলে শীৎকার করো
আবার ডাঙ্গায় তপ্ত রোদ্রে ছটফট করো
তোমাকে কাছে টানলেই সমস্ত মেঘ
জল হয়ে ভূবন ভাসে।

আবার তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখলে
সমস্ত দীর্ঘশ্বাস ঝড় হয়ে যায় ঈ্ষাণ কোণে
তুমি আগুন হয়ে জ্বলে পোড়া মাটি করো
আবার জল হয়ে নদীও হয়ে যেতে পারো।

তোমাকে ভালোবাসতে কোনো দ্বিধা নেই
তুমিই শিখিয়েছো কিভাবে ভালোবাসতে হয়
তুমি শিখিয়েছো, ভালোবাসা কারে কয়!

K.T
27/8/2017

রূপকথার রাজপুত্র

সোনা মেয়ে, কেনো তুমি রাগ করো অসময়ে
কেনো তুমি সঁপে দিতে চাও পাংশু দেহ
চোখে কাজল নেই,
মুছে ফেলেছো তা বহু রাত জেগে --
কোন্ দুঃখে তুমি বিপথে যেতে চাও?
মনি রত্নম আর রাজকন্যার রূপের হাসি
কবে ডুবে গেছে মেঘলোকের অন্ধকারে
এখন আলোহীন নিভু নিভু নক্ষত্র তুমি।

তোমার কালো চোখ তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণলোকে
খোঁজো সেখানে জ্যোতির্ময় কাউকে
আমি নেই সেখানে, আমি কারোরই নই, তোমারও --
আমি রূপকথার এক রাজপুত্র দূরালোকের।

K.T
26/8/2017

সুইসাইডাল গেম : ব্লু হোয়েল

ইন্টারনেটে কিছু দিন ধরে দেখছি ব্লু হোয়েলের খবর। ব্লু হোয়েল সেই ভয়ঙ্কর অ্যাপ তথা গেম  যা একেক পর এক মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মহননের দিকে। কী করে কোনও সুস্থ, বুদ্ধিমান ছেলে বা মেয়ে এধরণের ফাঁদে পা দেয়!

ব্লু হোয়েল কিভাবে ছড়াচ্ছে? পড়ছিলাম -- এর স্রষ্টা এক রাশিয়ান যুবক। যার স্কুল-কলেজে বন্ধু ছিলোনা। বাড়িতে মায়ের কাছ থেকে কোনও অন্তরঙ্গ স্নেহ আদর জোটেনি। কিভাবে সে টেনে আনতো আত্মহননের পথে, অন্যদের?  ব্লু হোয়েল কিন্তু আর পাঁচটা গেমের মত অটোমেটেড নয়। এখানে প্রতি পদেই অ্যাডমিনিস্টেটররা কথা বলেন পার্টিসিপেন্টদের সঙ্গে, অ্যাসাইন করে দেন পরবর্তী টাস্ক। যার মধ্যে পড়ে নিজেকে আঘাত করা, দুর্ঘটনায় নিষ্ঠুর মৃত্যু ইত্যাদির ভিডিও দেখা, আরও অনেক কিছু। শেষ টাস্ক, নিজেকে খতম করে দেওয়া। অন্তিম আত্মহত্যাটির মুখ থেকে ফিরে এসেছে এমন এক টিনেজার মেয়ে পুলিশকে জানিয়েছিল, তাকে ওই রাশিয়ান যুবক চ্যাটে বোঝাতো-- " তোমার কোনও বন্ধু নেই, কেউ তোমায় ভালোবাসে না, তোমার মা বাবা তোমায় পছন্দ করেন না। এই অবস্থায় জীবনটা নিয়ে একটাই সুন্দর কাজ তুমি করতে পারো, ওটাকে শেষ করে ফেলা।"  মেয়েটিও আস্তে আস্তে পা বাড়াচ্ছিল সেদিকে...।

তাহলে কি একটা কমন প্যাটার্ণ রয়েছে এই সব মগজ-ধোলাই পদ্ধতির? মানুষের একাকীত্বকেই টার্গেট করছে এরা? চারপাশ থেকে ঘিরে রাখা ভালোবাসার সুরক্ষাবলয় নেই যাদের, তারাই শিকার হচ্ছে, তারাই পা বাড়াচ্ছে এই মরণখেলায়?

'পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে
পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে-বা জানে
আমরা ফিরেছি দোরে দোরে ।
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয় আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।'

------------------------------------------------------------------
তথ্য সূত্র :  ইন্টারনেট।

কাঁদালে তুমি মোরে

তখন বেলা দ্বিপ্রহর। ঈশ্বরদী জংশনের একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর বিশ্রামাগারে প্রফেসর সাহেব একাকী বসে আছেন। মুখে তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি এবং বিষন্নতার ছাপ। যেনো কতোকালের দুঃখ সেখানে লেগে আছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে, এই চোখ একাকী অনেক রাত কেঁদেছে। বিশ্রামাগারের এককোণে বসে নিরিবিলি পত্রিকা পড়ছিলো সে। তিনি এসেছেন নওগাঁ থেকে, যাবেন খুলনায়। সুন্দরবন এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করছে।

বিশ্রামাগারে আরো দুই তিনজন যাত্রী বসে আছে। তারাও চুপচাপ। কেউ কাউকে চেনেনা। কেউ কারোর সাথে কথা বলেনা। এমনি এক নিরব সুনসান মুহূর্তে রুমে প্রবেশ করে একটি ছোট্ট পরিবার। স্বামী স্ত্রী এবং তাদের পনেরো ষোলো বয়সের একটি মেয়ে। তারা এসে বসে প্রফেসরের ঠিক পাশেই। প্রফেসর সাহেবের বয়স চল্লিশের কাছে। মেয়েটি উৎসুক হয়েই প্রফেসর সাহেবকে দেখছিলো। সে খুব আকুবাকু করছিলো, তার সাথে একটু কথা বলবার।  মেয়েটি নিজ থেকেই কথা বলে - ' আঙ্কেল, আপনি কোথায় যাবেন?
প্রফেসর :  খুলনা। সেখান থেকে আরো ভিতরে, এক পাড়াগাঁয়ে।
মেয়েটি : ওখানে কি আপনার বাড়ি?
প্রফেসর :  না। ওখানে আমি এক কলেজের প্রফেসর।
মেয়েটি :  কোন্ সাবজেক্ট আপনি পড়ান?
প্রোফেসর :  বাংলা।
মেয়েটি :  খুব ভালো সাবজেক্ট। আমারও বাংলা পড়ার খুব ইচ্ছা।
মেয়েটির বাবা মেয়েটিকে বলে :  ' সেঁজুতি মা, তুমি ওনাকে বিরক্ত করছো কেন? '

সেঁজুতি মেয়েটি এই রকমই। ৰাড়িতে, স্কুলে, পথে ঘাটে মানুষকে আপন করে নেওয়া তার স্বভাব। মুহূর্তে মানুযকে সে ভালোও বাসে। এমন সহজ সরল মেয়ে সাধারনতঃ খুঁজে পাওয়া ষায়না। সেঁজুতি প্রোফেসর সাহেবের সাথে কথা বলছেন, এজন্য ওর বাবা কিছু মনে করছেনা। তিনি বুঝতে পারছে যে, প্রোফেসর সাহেবের বিষন্ন মুখই সেঁজুতির মনের মধ্যে এক ধরনের মমত্ব তৈরি করেছে। যার কারণে তার সাথে কথা বলতে তার এতো আকুতি।

প্রোফেসর সাহেব সিটের উপর পত্রিকাটি রেখে ওয়েটিং রুমের বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়। সে দেখছিলো অনেকগুলি রেললাইন চলে গেছে সামনের দিকে। অনেক পথই খালি পড়ে আছে, ট্রেন নেই। আবার কোনো কোনো প্লাটফর্মে ট্রেন আসছে, কোনো কোনো প্লাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ট্রেনদের এই আসা যাওয়ার মাঝেই তিনি ভাবছিলেন অতীতের একটি স্মৃতির কখা।

আজ থেকে তেরো বছর আগে কার্তিকের এক শেষ রোদের বিকেলে চাটমোহরের বড়াল নদীর পাড়ের একটি গ্রাম থেকে সাহানাকে সে বিয়ে করে এনেছিলো। নওগাঁয় ফিরে যাবার সময় এমনি করেই সেদিন অপেক্ষা করছিলো এই ঈশ্বরদী জংশনে। প্লাটফরমের উপর দিয়ে পাশাপাশি হেটে এসে বসেছিলো এই ওয়েটিং রুমেই। আজ এখানে দাড়িয়েই দেখছিলো সেই তেরো বছর আগের দৃশ্যটি। লাল রঙের জর্জেট শাড়ির ঘোমটা ছিলো সাহানার মাথায়। সাদা পান্জাবী পড়েছিলো সে নিজে। তার হাতটি ধরা ছিলো তার হাতে।

প্রোফেসর সাহেব বাইরে দাঁড়িয়েই আছে। সেঁজুতি ওর বাবাকে বলছিলো - 'বাবা, আমি কি প্রোফেসর আঙ্কেলের কাছে যেয়ে একটু কথা বলতে পারবো?'
বাবা :  'যাও, বলোগে। '

সেঁজুতি চলে আসে বারান্দায়। প্রোফেসর তখনো তাকিয়েই ছিলো জনারণ্যময় প্লাটফর্মের দিকে। সেঁজুতি যেয়ে বলে -- 'আঙ্কেল, আপনি মনখারাপ করে দাড়িয়ে রয়েছেন কেন? আপনার কি হয়েছে?'
প্রোফেসর :  শুনবে তুমি? তুমি তো অনেক ছোট মানুষ।
সেঁজুতি :  আপনি বলেন, আমি শুনবো।

প্রোফেসর :  আমার কলেজের কাছেই টিনের একটি ছোট্ট বাড়িতে আমি থাকি। ঘরে শুধু আমার স্ত্রী ছিলো। আমাদের কোনো সন্তান নেই। সেদিন ক্লাশ নিচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর এলো, সে খুব অসুস্থ। আমি বাসায় চলে  যাই। যেয়ে দেখি, সে মৃত। ব্রেন স্টোক করেছিলো। মুখ তার পরনের শাড়ির আঁচলে ঢাকা। হাসপাতালে নেওয়ার সময়ও পাই নাই। আট দিন আগের ঘটনা। পরে লাশ নওগাঁয় নিয়ে আসি। আত্রাই নদীর তীরে আমদের গ্রাম। সেখানেই তাকে কবর দিয়ে এলাম। এখন চলে যাচ্ছি খুলনায়।

সেঁজুতি :  আপনার একা একা ওখানে খারাপ লাগবেনা? বাড়ি থেকে কাউকে সাথে করে আনতেন?
প্রোফেসর :  "আমার তেমন কেউ নেই। বাবা, মা,ভাইবোন কেউ না। ছিলো শুধু আমার স্ত্রীই। তেরো বছর ধরে আমরা একদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন ছিলামনা । দুই তিনবার সে শুধু তাদের বাড়ি গিয়েছিলো, তাও আমি সাথে ছিলাম। ''

বিয়ের পর তিন বছর গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। কয়েকটি টিউশনি করতাম। ভালোই চলছিলো জীবন। ছোট্ট একটি কুটিরে থাকতাম। কতো হেমন্ত জ্যোৎস্নায় আমাদের কেটেছে সময়, আত্রাইয়ের কূলে কূলে। তারপর সেই জীবন ফেলে চলে আসি খুলনায়। কলেজে চাকুরী হলো। ভালোই চলছিলো জীবন।

সেঁজুতি : তারপর?

প্রোফেসর :   তুমি ছোট মানুষ। তোমায় আর কি বলবো? আমি ওখানে যাচ্ছি, সপ্তাহখানেক থাকবো। কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে আমার পদত্যাগপত্র জমা দিবো। ওখানে আমার একাকী থাকা সম্ভব নয়। ঐ কলেজ, ঐ কলেজের প্রাঙ্গন, কলেজের কাছে আমার ঐ বাড়ি, সবখানে ওকে নিয়ে আমার হাজার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ওখানে আমার একাকী দম বন্ধ হয়ে আসবে।

সেঁজুতি : আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

প্রোফেসর :   ওর বেশ কিছু ব্যাবহার করা কাপড় চোপর আছে। ভাবছি সেগুলো গরীবদের দিয়ে দিবো। তাছাড়া বিয়ের দিনের লাল শাড়ি, নাকফুল, চারটে চুরি আর একটি মালাও আছে। এ ক'টি জিনিস কাকে যে দিব, ভেবে পাচ্ছিনা। আমারতো ঐরকম আপন কেউ নেই।
সেঁজুতি :  কেন, আপনার কাছেই রেখে দিবেন। আপনি আর বিয়ে করবেন না?
প্রোফেসর :  না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনেক দূরে চলে যাবো। বাকি জীবন মাজারে মাজারে, আশ্রমে আশ্রমে ঘুরে বেড়াবো। মঠ,গীর্জা, মন্দিরে মন্দিরে থাকবো। যেথায় শান্তি পাবো, সেখানেই ঘুমিয়ে যাবো। কেউ দেখবেও না, কেউ জানবেও না।

সেঁজুতির চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে।

প্রোফেসর :  সেঁজুতি, তুমি খুব ভালো মেয়ে। খুব ছোট্ট বেলায় আমি মাকে হারিয়েছিলাম। তার কথা আমার মনে নেই। তারপর এই পৃথিবীতে আমার স্ত্রীকে পেলাম। সেও ছেড়ে চলে গেলো। আর আজ তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। তুমি কি সেই লাল শাড়ি, নাকফুল, হাতের চুড়ি আর গলার মালাটি নেবে? যদি না নাও, তাহলে এক হেমন্তের পূর্ণিমার রাতে সেগুলো আত্রাইয়ের জলে ফেলে দিয়ে আসবো। তারপর চিরতরে অনেক দূরে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো।

সেঁজুতির কন্ঠ রোধ হয়ে আসে। কোনো কথা বলতে পারছিলোনা।

সেঁজুতির কোনো কথার উত্তর প্রোফেসর আর শুনতে পেলোনা। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্লাটফর্মে এসে ততোক্ষণে ভিঁরে গেছে। সে ওয়েটিং রুম থেকে তার ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে প্লাটফর্মের হাজারো মানুষের মধ্যে মিশে যায় এবং ট্রেনে যেয়ে উঠে পড়ে। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটি পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রীজের দিকে ছেড়ে চলে যেতে থাকে। সেঁজুতি ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ রেখে অঝোর ধারায় কাঁদছিলো তখন।

K.T
24/8/2017

ওপারে কতো সুখ

 ছোট্ট একটি গ্রাম। নাম নীলকন্ঠহার পাড়া। গ্রামটির ধার দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটি নদী, নাম শঙ্খনদী। তবে আমি বলছি নীলকন্ঠহার পাড়ার কথা। এই গ্রামে অনেক দিন আগে এক দম্পতি বাস করতেন নদীর ধারে ঘর বানিয়ে। স্বামী কাজে যেতেন কিন্তু স্ত্রী সারাক্ষণ ঘরে মন মরা হয়ে বসে থাকতেন। ঘরে স্বামী ফিরলে বলতেন, “নদীর ওপার টা কত সুন্দর তুমি ওপারে কেন ঘর বানালে না। ওপারের রং কি সুন্দর সোনার মতন বালি , নীল রঙ্গের পাহাড় , আর সবুজ রঙ্গের গাছ পালা। মেঘ ঢাকা পাহাড় আর তাতে বিদ্যুতের ঝলকানি সব মিলিয়ে ছবির মতন লাগে। এপারটা দেখো কিছুই আকর্ষণ নেই যেন খাঁ খাঁ লাগে। আমার ভালো লাগে না। তুমি ওপারে ঘর করো। আমি ওপারে থাকবো। ”

স্বামী আশ্চর্য হয়ে বলতেন ঠিক আছে একদিন ওপারে নিয়ে যাবো তোমাকে। তারপর বলবে কোথায় ঘর করলে ভালো হবে। এক ছুটির দিনে স্বামী স্ত্রী তে ওপারে গেলেন। স্ত্রী ওখানে পৌঁছে বললেন এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি ? এতো আমার সেই নদীর ওপার নয়। এখানে পাহাড় গর্তে ভরা। মরা গাছের ডালে ন্যাড়া পাহাড় অতি কদাকার লাগছে। এটা সে জায়গা নয় ।
স্বামী বোঝান স্ত্রীকে, তুমি ভুল করছো। এটাই সেই জায়গা, যা তুমি ওপার হতে দেখতে। এখন দেখো আমাদের ওপার কেমন দেখাচ্ছে ? কি সুন্দর দেখেছো ! সবুজ গাছ পালা, ধানের ক্ষেত, সরু বাঁকা নদী বয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে চিত্রকরের হাতে তূলির টানে আঁকা চিত্রপট। দেখো আমি কতো সুন্দর জায়গায় তোমাকে রেখেছি অথচ তুমি আমার তৈরি ঘরকে হতাদর করেছো। এখন বলো কোথায় তুমি থাকবে? এখানে না ওখানে ? তুমিতো সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট দুটো চিত্রপটই দেখলে !

ঈশ্বর আমাদের দুটি জিনিষ দিয়েছেন, তৃষ্ণা ও তৃপ্তি।  তুমি তৃষ্ণার বশবর্তী হয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে তুলনা করে মনে তৃপ্তি পাচ্ছিলেনা। তাই অতৃপ্ত তোমার আকাঙ্ক্ষা। যা আছে তাতে তুমি তৃপ্ত হলে তোমার আকাঙ্ক্ষা হতোনা, কিন্তু অতৃপ্ত হলে আকাঙ্ক্ষা হবে। তাই আকাঙ্ক্ষাকে সীমিত রাখো। স্বামীর কথায় স্ত্রী হতবাক। স্ত্রী তার ভুল বুঝতে পারেন।

-------------------------------------------------------------------
ঋণ :  একটি বিদেশী  ই -ম্যাগাজিন থেকে নেয়া থিম্ অবলম্বনে।

K.T
24/8/2017

একটি অপ্রেমের কবিতা

বসন্ত আসার আগেই ঝরা পাতা উড়িয়ে দিলাম --
মল্লিকার বনও পুড়ে বিরান হলো
এ কোন্ আগুনে?
এই শ্রাবণে বৃষ্টির জন্য তাই এতো হাহুতাস।

তোমাকে ভালোবাসি অসম্ভবের মতো অসংলগ্ন
ঈশ্বরের নাম আসেনা মুখে জপি তোমার নাম
সারারাত ধরে কবিতার শিরোনাম হও তুমিই --
এইসবই কি ভ্রান্ত তবে?

মাটির বিহনে ঘুম পারাতে চাই এ প্রেম, এ মাধুরী--
বুভুক্ষ পিঁপড়ার দল এসে পুরোয় তার উদোর
সব প্রেম অপ্রেম এসে জড়ো হয় তোমারই কাছে।
বাগানের ফুল ছিঁড়তে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলি তোমার ফুল
সময়ে অসময়ে কিংবা মধ্যরাতে।

K.T
23/8/2017

যতো আনন্দ সঙ্গীত

উত্তরার একটি বহুতল বানিজ্যক ভবনের পনেরো তলায় ছিলো আমার অফিস। অফিস বলতে আমিই একাই সব। ছিলো শুধু অল্প বয়সের একজন এ্যাটেন্ডেন্ট। বসে বসে সেখানে ইন্ডেন্টিং এর কাজ করতাম। তবে বেশীর ভাগ সময় কোনো কাজ থাকতো না। তখন ফেসবুক এতো জনপ্রিয় ছিলোনা। ইয়াহু ম্যাসেঞ্জারে মাঝে মাঝে চ্যাটিং করে সময় কাটাতাম। ফিলিপিনো মেয়েরা তখন  চ্যাটরুমে লাইন দিয়ে বসে থাকতো।

একদিন সকালবেলা পার্কে ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটার সময় অনিক নামে এক তরুনের সাথে আমার পরিচয় হয়। সে উত্তরার একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটির ফ্যাশন ডিজাইনের শেষ সেমিস্টারের ছাত্র ছিলো। ছেলেটি দেখতে খুব সুদর্শন ও ভদ্র ছিলো। সৌখিন ভাবে সে নাটকে অভিনয়ও করতো। ভদ্র ও সাংস্কৃতিমনা ছেলে দেখে ওকে আমার খুব ভালো লাগে। আমার একটি ভিজিটিং কার্ড ওকে দিয়ে বলেছিলাম -- তুমি আমার অফিসে এসো।

এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই পরিপূর্ণ সুখের মানুষ নয়। ক্রান্তিকাল সবার জীবনেই আসে। কিছু ভুলের জন্য কিছু  দুঃখ কষ্ট আমিও বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। রিভোলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রায়ই বসে থাকতাম। জানালা খুলে দেখতাম উত্তরার নীল আকাশ। দূর দিয়াবাড়ীর খোলা বালুর প্রান্তরও দেখতাম। কাশবনের সাদা ফুলগুলো গালিচার মতো লাগতো। দেখা যেতো বিমানবন্দরের রানওয়ে, সেখানে বিকট শব্দ করা প্লেনগুলোর ওঠা নামা দেখতাম। এমনি বসে থাকা এক ক্লান্ত দুপুরে অনিক প্রথম আমার অফিসে এসেছিলো।

আমি অনিককে অন্য কথা না বলে সরাসরি বলি - 'তুমি কি লান্চ করে এসেছো ? ' অনিক প্রথম দিনের আমার এমন স্ট্রেইট কথা শুনে ও তার সত্য কথাটিই বলে ফেলে -- ' না, সকালের নাস্তাও করিনি। ঘুম থেকে উঠেছি একটু আগে। হোস্টেলের ক্যান্টিনে তখন খাবার শেষ। আমার পকেট দিয়াবাড়ির ধূধূ বালুর মাঠ। ঘুম ভেঙ্গেই আপনার কথা মনে হলো। তাই চলে এলাম।'

আমরা চলে আসি উত্তরার আকাশ ছোঁয়া রেস্টুরেন্ট 'শিকারা'তে। জানালার কাছে বসে এখানেও দেখা যায় নীল আকাশ, দিয়াবাড়ির কাশবন, আশুলিয়ার গ্রাম আর তুরাগ নদীর জল। আমরা দুইজন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম এমনি জানালার পাশে বসে। খেতে খেতে অনেক কথাই বলা হলো দু 'জনের। দূরের নিসর্গগুলি দেখতে দেখতে একে অপরের অনেক কিছুই জানা হলো।

অনিক নিতান্তই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। ওর গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ভাটি অন্চল দিরাই তে। ঢাকায় উল্লেখ করার মতো কোনো আত্মজন নেই। থাকে প্রাইভেট হোস্টেলে। গ্রাজুয়েশন শেষ হবার পথে। শেষ সেমিস্টার শেষ হয়ে যাবে। অনিক আমার অফিসে প্রায় প্রতিদিনই আসতে থাকে। আমার একাকীত্বের সময়গুলোর ও সাথী হয়।  জীবনের অনেক হতাশা,বন্চনা আর গ্লানির কথাগুলো ওর কাছেই ভাগাভাগি করে নেই। আমিও ওকে অনেক কিছুইতে সাহায্য সহযোগিতা করি। ওর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান পনেরো ষোল বছর। তারপরেও সম্পর্কটা হয়ে ওঠে বন্ধুর মতো, আমি হয়ে যাই ওর আপন আত্মজন।

একদিন অফিসে মৌরি নামে একটি মেয়েকে অনিক নিয়ে আসে। মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দরী। অনিক আমাকে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওরা একে অপরে ভালোবাসে। মৌরি বিত্তবান ঘরের মেয়ে হলেও ছিলো নিরাহংকারী ও সহজ সরল। এক ধরনের নিষ্পাপ সারল্য ওর চোখে মুখে দেখতে পাই। আমি প্রথম দিন অফিসেই ওদেরকে আপ্যায়ন করাই। এরপর থেকে মেয়েটাকে প্রায়ই অনিক আমার অফিসে নিয়ে আসতো। ওদের দুজনেরই সাথে আমারও একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ৰাড়ী থেকে অনিক যে টাকা পয়সা পেতো তা দিয়ে অনিকের সারামাস যেতো না। মৌরিকে ভালোবাসার কারণে ওর অতিরিক্ত খরচ হয়ে যেতো। মাসের শেষের দিনগুলো আমিই ওকে চালাতাম। বলতাম, 'তোমাকে করুণা করছিনা। হিসাব রেখো। যখন সামর্থ্য হয়, দিয়ে দিও। আর না দিলেও তুমি ঋৃণী হবেনা কখনো। মনে করবে একজন ভাইয়ের স্নেহের এ দান।'

অনেক সময় আমি অফিসে থাকতাম না, সে সময়ে অনিক আর মৌরি গল্প করতো প্রহরের পর প্রহর। ওদের প্রেমময় মধুর ক্ষণগুলো আমার অফিস চেম্বারে কাটিয়েছে। হাজার স্বপ্ন দেখেছে ওরা এখানে বসেই।  বিয়ে, ঘর বাঁধা, সন্তান, সংসার সব। অনেক সময় ওদের ভিতর ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে, সেগুলো আমিই মিটিয়ে দিয়েছি।

একদিন আমরা তিনজনই বসে আছি। ওদের দুইজনকেই দেখতে খুব ভালো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো কোন্ স্বপ্নের দেশ থেকে ময়ুরপঙ্খী নাও ভাসিয়ে আমার এখানে ওরা চলে এসেছে। মনে হচ্ছিলো ওরা দু'জন শতো জনমের এক রাজপুত্র আর রাজকুমারী। ওদের মায়াময় চোখে মুখে তাকিয়ে আমার মন স্নিগ্ধতায় ভরে উঠেছিলো। এতো আপন লাগছিলো যে,সেদিন তা ওদেরকেও বুঝতে দেইনি। শুধু বলেছিলাম -- 'তোমাদের বিয়ের দিনে আমি পিয়ানো বাজাবো। গাইবো আমি জগতের যতো আনন্দ সঙ্গীত। '

ইতোমধ্যে অনিকের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যায়। দুই তিন মাস বেকার ছিলো। এই বেকার সময়গুলোতে আমি ওকে আর্থিক সহায়তা করি। প্রতি দিনই আমার এখানে এসে লান্চ করতো। মৌরিও আসতো প্রায় প্রতিদিনই। এরই মাঝে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে অনিকের ভালো চাকুরী হয়ে যায়। এরপর অনিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে চাকুরীতে।  আগের মতো আর আমার এখানে আসেনা। অনিক আসেনা দেখে মৌরিও আসতো না। একসময় ওরা আসা টোটালেই বন্ধ করে দেয়। প্রথম দিকে ফোন করলে পাওয়া যেতো। পরে আর পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সিম কার্ড চেন্জ করে ফেলেছিলো।

অফিসে সময়গুলো এখন আর কাটতে চায়না কিছুতেই। মানুষের জীবনটা মনে হয় এই রকমই। জীবনের বাঁকে বাঁকে কতো মানুষ আসে। কতো মানুষের সাথে পরিচয় হয়, কতো মানুষ আবার চলে যায়। একাকীত্ব কিছুতেই ঘুচেনা। এই অফিসে বসে ক্লান্তিতে কেমন যেনো অবশ হয়ে যায় দেহ। রিভোলভিং চেয়ারে বসে জানালার পাশে প্রায়ই বসে থাকি। নীল আকাশ আর হৃদয়ে দোলা দেয়না। মনে হয় ধূসর মেঘে ছেয়ে আছে সমস্ত আকাশ।

এরপর কখন তিনটি বছর চলে গেছে বুঝতে পারি নাই। এরই মধ্যে আমার ব্যাবসার অনেক উত্থান পতন হয়েছে। শরীরটাও হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। ব্যবসাও ভালো করতে পারছিলাম না। অফিসটা তাই ছেড়ে দেই। শেষ দিনে অফিস ঘরের সমস্ত বকেয়া ভাড়াদি পরিশোধ করে মালিককে চাবি বুঝে দেই। শুধু একটি অফিস ব্যাগ হাতে করে হেটে হেটে বাসার দিকে চলে আসছিলাম। ফুটপাতের উপর দিয়ে হাঁটছিলাম, কিন্তু পা কিছুতেই সামনের দিকে চলতে চাইছিলোনা।

তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি। উত্তরা ৭ নং সেক্টরের পার্কের কাছে চলে আসি। মনটা ভালো লাগছিলোনা। ভাবলাম পার্কের ভিতরে যেয়ে পাকা বেন্চের উপর একাকী বসে থাকি কতোক্ষণ। পার্কের মূল গেট দিয়ে ঢুকে ওয়াকওয়ে দিয়ে হেটে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম। দেখি একটা ছেলে আর একটি মেয়ে তাদের দুই বছরের বাচ্চা মেয়ের দুইহাত দু'জন দুই দিক থেকে ধরে আস্তে আস্তে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটি ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে হাঁটছিলো। আমি এ দৃশ্য ওদের পিছন দিক থেকে দেখছিলাম। ওদের দেখে চিনতে পারলাম, ওরা অনিক আর মৌরি।

ওদের এই আনন্দমুখর মুহূর্তটি নিরবে দাড়িয়ে চুপিচুপি অবলোকন করছিলাম, আমার আজকের সকল মনখারাপ মুহূর্তে যেনো ভালো হয়ে গেলো। এমন হাসিখুশির দৃশ্য কিছুক্ষণ দেখে - পিছন ঘুরে হেটে হেটে পার্কের বাইরে চলে আসি।

সন্ধ্যার অাঁধার ঘনিয়ে আসছিলো তখন। ধূসর সেই সন্ধ্যার ক্ষণে ফুটপাতের উপর দিয়ে হাটছিলাম, আর ভাবছিলাম একটি দুঃখবোধের কথা  -- 'আমি তো ওদের বিয়ের দিনে বাজাতে চেয়েছিলাম পিয়ানো, আর গাইতে চেয়েছিলাম জগতের যতো আনন্দ সঙ্গীত।'

K.T
21/8/2017

লখিন্দরের মহাপ্রয়াণ

আমার জীবনের প্রথম সিনেমা দেখা ছিলো 'বেহুলা '। তখন এতো ছোট ছিলাম যে, লখিন্দরকে চিনতে পেরেছিলাম, কিন্ত রাজ্জাক নামের কাউকে চিনেছিলাম না। পরে এতোটুকু আশা, নীল আকাশের নীচে, ময়নামতি, মধুমিলন, জীবন থেকে নেয়া ছবিগুলো দেখতে দেখতে রাজ্জাককে চিনে ফেললাম। এরই মাঝে সে হয়ে গেছে নায়করাজ। হয়ে গেছে আমাদের স্বপ্ন সময়ের স্বপ্নের নায়ক। আমাদের সিনেমার রূপকথার রাজপুত্র। সে ছিলো এক বিস্ময়কর ব্যাপার! সে ছিলো আমাদের জীবন্ত কিংবদন্তী।

এই জীবন্তু কিংবদন্তীটি আজ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমি কাঁদছি। Rest in Peace Mohanayok , Nayok Raaj Razzaque.

কতো স্বপ্ন

কতো স্বপ্ন পড়ে আছে, জীবনের কতো জীর্ণ স্মৃতির স্তুপ। কতো স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে প্রথম প্রহরেই। স্বপ্নের সব সিঁড়ি পথ কি অন্ধকার গলিমুখে হারিয়ে গেলো? সকল পাওয়ার সাধ অর্ধেক পৃথিবী দেখার মতো কি অপূর্ণ হয়ে থাকবে? আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় পুরোনো বাতাস থেকে। বহু কালের একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর এখনো শুনতে পাই। ফিরে যেতে চাই সেই অতীত বিন্দুতে, যেথায় অসংখ্য স্বপ্ন নিয়ে কেউ একজন বসে ছিলো দু’হাত বাড়িয়ে। আমি আমার জীবনের সব হিবিজিবি লেখার পাতাগুলো সরিয়ে খুঁজি সেই প্রথম সাদা পাতা, যা রাখা আছে সযত্ন করে চন্দন কাঠের কোনো সিন্ধুকে। কতো স্বপ্ন লেগে আছে সেখানে, কতো স্বপ্ন ভেঙ্গে পড়ে আছে তারই কোঠরে। আমি নির্লিপ্ত দু'চোখ মেলে দেখছি তা।

সুগন্ধি লোবান

ক্রমেই দিনগুলি বিষন্ন হয়ে আসছে
যেমন বিষন্ন হলো আজকের বিকেলও
একগুচ্ছ রক্তিম ক্যামেলিয়াও
বিষন্ন হয়ে রইলো হাতের করতলে,
স্বপ্নগুলো তোমাকে খুঁজতে খুঁজতেই ভেঙ্গে গেলো
কষ্টগুলো তোমার বুকেই ঘুমিয়ে গেলো
নিভৃত ক্রন্দন ধ্বনিতে।

এ কোন্ মায়া পুড়ে ছারখার হয় নিষ্ঠুর ছায়াধূপে
সকল কর্মের পরিসমাপ্তি কি আসন্ন তবে --
যেথায় যে বাগান আছে তা আর থাকবে কি?
যেথায় যে ফুল ফুটবার কথা তা আর ফুটবে কি?

সাদা পান্জাবী টুপি পড়ে মৌলানা সাহেব আসবেন
আসবেন তার নবাগত শিষ্যরাও
সুর করে সুরা ফাতিহা পাঠ করবেন
কফিনের পাশে সুগন্ধি লোবান জ্বলবে,
তোমাকে দেখতে পারবে কি আর আমার চোখ?
শেষবারের মতো আর একবার।

চন্দ্রাহত মেয়েটির কথা

মালা নামের মেয়েটি নিতান্তই গ্রামের একটি বালিকা ছিলো । ছোটবেলা় থেকেই ও ছিলো কিছুটা পাগলি স্বভাবের। সে পছন্দ করতো চাঁদ। দশমী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত সে বেশি অস্বাভাবিক থাকতো। নির্জন সন্ধ্যা রাতে পুকুরের পারে বসে দেখতো জলে ভাসা চাঁদ। ঝিরিঝিরি ঢেউয়ের দোলায় চাঁদ ভাসতো, সাথে এই বালিকা মেয়েটির অন্তরও দুলে উঠতো। রাতে কুয়ার জলেও দেখতো চাঁদ। কলসি নামিয়ে দিতো জলে। জলে শুয়ে থাকা সেই চাঁদ কলসির ঢেউয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেতো।

আমি তখন কৃষি বিভাগে চাকুরী করতাম। একটি এ্যাসাইনমেন্টে তিন মাসের জন্য আমাকে সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে যেতে হয়েছিলো। এই থানাটি চারদিকে নদী বেস্টিত। একদিকে ধলেশ্বরী অন্য দিকে প্রমত্তা যমুনা। এক আষাঢ়ে মেঘের দিনে টাংগাইলের নাগরপুর থেকে নৌকায় করে চৌহালীতে চলে যাই। আমি ওখানে যেয়ে অবাক! নদী ভাঙ্গনের জন্য থানা সদর স্থানান্তর হয়েছে চরের মধ্যে। তখনও কোনো ভবন তৈরি হয়নি ঠিকমতো। অস্থায়ী টিনের ঘরে চলতো যাবতীয় অফিসিয়াল কার্যাদি।

আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো অফিস থেকে অদুরে ধূধূ চরের মধ্য এক গৃহস্থ বাড়ির কাচারি ঘরে। এর জন্য ঐ বাড়ির মালিককে কিছু পে করতে হয়েছিলো। বাড়িটি থেকে পশ্চিম পার্শ্বে যমুনা নদী বেশি দূরে নয়। ভালো লাগছিলো নদী মুখোমুখি এই রকম একটি বাড়ি। আমার অফিসের পিয়ন ছমির আলী ঐ গাঁয়েরই  চাঁদ পাগলী মালা নামের এতিম এক বালিকাকে আমার টুকটাক ফয় ফরমাস পালনের জন্য ঠিক করে দেয়।

মেয়েটির বয়স কতোই হবে। এগারো বারো বছর হবে। গরীবের ঘরে মেয়ে হলেও সে ছিলো খুব পরিচ্ছন্ন। চেহারায় ছিলো এক ধরনের সরলতা। খুব মায়া করে কথা বলতো। ওর সাথে আমার কথা বলতে এতো ভালো লাগতো যে, ওকে আমি কখনোই তুই সম্বোধন করিনি। যখন আমি জানলাম মেয়েটি চাঁদ পাগল, তখন আরো বেশি ওর প্রতি আমার আলাদা কেয়ার চলে আসে।

আমার একাকী অবসর সময়গুলোতে এই মালার সাথে কথা বলে কাটাতাম। ছোট ছোট করে ও অনেক কথাই বলতো, অনেক কিছুই জানতে চাইতো। ঢাকায় আমার চার বছরের মেয়েকে রেখে এসেছি, তার কথা মালা শুনতে চাইতো। জিজ্ঞাসা করতো, ও কেমন দেখতে! প্রায়ই বলতো বাবুকে তার কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করে। এমনি করেই ওর সাথে কথা বলতে বলতে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে মালা আমার ভালো ক্ষুদে বন্ধু হয়ে উঠলো।

একদিন বিকাল থেকেই মালা আসছিলোনা। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরে বসে আছি। তারপরও ও আসেনি। আমি ঘর থেকে বের হই। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে। পূর্ব আকাশে দেখলাম দশমীর চাঁদ উঠেছে। চরের চরাচর জুড়ে জ্যোৎস্না নেমে পড়েছে। আমি হেটে হেটে মালাদের বাড়ির দিকে যাই। ওখানে যেয়ে শুনি, সন্ধ্যা থেকেই সে ছোট্ট পুকুর পারে বসে ছিলো। ঐসময়ে সে নাকি কারো সাথে কথা বলেনা। দেখলাম বাড়ির বারান্দায় মাদুর পেতে মালা শুয়ে আছে। আমি ওকে ডাকলাম, কিন্তু শুনলোনা। কথা বলতে চাইলাম, কথাও বললোনা।

পরের তিন দিনও মালা আসেনি। আমার খুব ইচ্ছা হলো, একদিন সন্ধ্যা রাতে ওর সাথেই আমি পুকুর পারে বসে থাকবো। দেখবো চাঁদের সাথে ও কিভাবে সময় কাটায়। সেদিন ছিলো পূর্ণিমার রাত। বাড়ির কাচারি ঘর হতে বের হয়ে কাশবনের পাশ দিয়ে হেটে হেটে মালাদের বাড়ি যাই। যেয়ে দেখি মালা নেই। সন্ধ্যাই সে নদীর তীরে চলে গেছে। মালার মা মেয়ের সাথেই রয়েছে। আমি আর নদীর তীরে যাইনি।

চার পাঁচটি দিন মালার অভাব আমি খুব অনুভব করছিলাম। আমার ঘরে ঠিকমতো রান্না হয় নাই। প্রতিদিনের একাকী বিকেলগুলো ঘরের মধ্যেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দেই। যে মেয়েটি আমার সাথে ছোট ছোট করে কথা বলে আমার সময় পার করে দিতো, সে আজ চারদিন ধরে নেই। কি এক চন্দ্রালোক তাকে এই জগৎ থেকে আলাদা করে রেখেছে, সে এক বিস্ময়ই শুধু।

এক মাস পার হতেই হেড অফিস থেকে হঠাৎ টেলিগ্রাম পেলাম, আমাকে আবার ঢাকাতে থাকতে হবে এক মাস। আমি পরের দিন সকালে ঢাকায় চলে আসার প্রস্তুতি নেই। মালাই আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছিলো। মালা বলছিলো -- 'দাদাভাই, আপনি আর আসবেন না?
আমি :   এক মাস পরে আসবো।
মালা :    আপনি আমাকে সাথে করে নিয়ে যান। আমি বাবুকে দেখে রাখবো। ঘরের কাজ সব করে দিবো।'
আমি :   ঠিক আছে, তোমাকে আমি নিয়ে যাবো। তবে এবার না। আমি তোমার আপার সাথে আলাপ করে আসবো। এর পরেরবার আমি যখন একেবারে এখান থেকে চলে যাবো, তখন তোমাকে নিয়ে যাবো। '
মালা :    আচ্ছা।

একমাস ঢাকায় থেকে আমি আবার চৌহালী চলে আসি। পিয়ন ছমির আলী কে বললাম, মালাকে খবর দিতে যে, আমি এসেছি। ও যেনো আমাকে একটু দেখভাল করে। ছমির বললো - 'স্যার, মালা খুব অসুস্থ। ও এখন চলাফেরা করতে পারেনা। '
আমি :   কি হয়েছে ওর?
ছমির আলী :  আপনি চলে যাবার পরপরই ওকে ময়মনসিংহে এক সাহেবের বাসায় কাজ করতে পাঠিয়েছিলো। পাঁচ দিন ওখানে ছিলো। তারপর অসুস্থ হয়ে সে ফিরে আসে। '
আমি  :  ওহ!  তাই।

হেড অফিসের সিদ্ধান্তে চৌহালীর এই এ্যাসাইন্টমেন্ট তাড়াতাড়ি ক্লোজ করতে হ্চ্ছে। এবং তা আগামী আট দশ দিনের ভিতরেই। আমি ছমির আলীকে বললাম, মালার এ্যাবসেন্টে সেই যেনো আমার একটু দেখভাল করে। কাজের ব্যস্ততার কারণে আমি আর তিন চার দিন মালার কোনো খোঁজখবর নিতে পারি নাই। মালা'ই একদিন বিকেলে ওর মার সাথে আমার এখানে চলে আসে। ওকে দেখার পর আমার মনটা হাহাকার করে ওঠে। একি অবস্থা মালার! একদম শুকিয়ে গেছে। মায়াবী সেই চোখ দু'টো কোঠরে চলে গেছে। চোখের নীচের পাতা কালচে হয়ে গেছে।

মালা'র মা বলছিলো, আপনি এসেছেন একথা শোনার পর মালা আপনাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলো। ও বলছিলো -- 'আমাকে দাদা ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও। '  মালা ছলোছলো চোখে আমাকে দেখছিলো । ও বসে থাকতে পারছিলোনা, ওর মা মালা'কে বুকের পাজরে ধরে বাড়ি নিয়ে যায়। মালা যখন চলে যায় তখন সন্ধ্যা। আমি ওর চলে  যাবার সময়ে অতোটুকু খেয়াল করিনি। চলে যাবার পরপরেই দেখি - যে পথ দিয়ে মালা হেটে হেটে চলে গেছে, সেই পথে টপ টপ করে তাজা রক্ত মাটিতে পড়ে আছে। ছমির আলীর মুখে পরে জানতে পারি-- মালা ময়মনসিংহে একাধিক বার ধর্ষিত হয়েছিলো।

ছমির আলী আরো বললো, মালা আগের মতো চাঁদ দেখে আর ঘরের বাইরে যায়না। বিনম্র হয়ে শুয়ে থাকে বিছানায়। মেয়েটির জন্য কেন জানি খুব মায়া হলো। অন্তর টা হুহু করে কাঁদতে লাগলো। আমারও তো ছোট্ট একটি মেয়ে আছে। মালার মুখচ্ছবিতে আমার মেয়ের মুখ দেখতে পেলাম। বেতনের টাকা উঠিয়েছিলাম, সেখান থেকে ঢাকা যাবার সামান্য টাকা রেখে বাকিটা ছমির আলীর মারফতে মালা'র মা'র কাছে পাঠিয়ে দিলাম।

অফিসের ব্যস্ততার জন্য আমি আর মালাদের বাড়ি যাই নাই। সেদিন বিকাল থেকেই একটু অবসরে ছিলাম। অফিসের কাজও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। একাকী বসে আছি। ভালো লাগছিলোনা কিছুই। যে মেয়েটি থাকলে ওর সাথে ছোট্ট ছোট্ট করে কথা বলে সময় কাটাতাম, সেই মেয়েটি আজ নেই। ঘরের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতে পারি নাই। হারিকেনটাও জ্বালানো হয় নাই। মালা থাকতে সন্ধ্যা আলোটা ঐ জ্বালিয়ে রাখতো। মালা নেই তাই ঠিকমতো সন্ধ্যা বাতিটাও জ্বলে ওঠেনা। হারিকেনের কাঁচের চিমনি  ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে।

সন্ধ্যার পর ঘর হতে নেমে আসি। সারা চর জুড়ে সন্ধ্যা রাতের নির্জন পূর্ণিমার চাঁদের অন্ধকার। সমস্ত কাশবন জ্যোৎস্নায় ছেয়ে গেছে। একবার মনে হলো হাটতে হাটতে যমুনা তীরে চলে যাই। যেয়ে যমুনার জলে চাঁদের মুখ দেখি, কিন্তু ওদিকে আর গেলামনা। মালার করুণ মুখখানি মনে পড়তে লাগলো। আমি চলে যাই মালাদের বাড়ি। মালা  মাদুর পেতে বারান্দায় শুয়ে আছে। আমি কাঠের একটি টুলে ওর পাশে বসি। ওকে বলি - 'মালা,আজতো আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। পুকুরের জলে চাঁদ দেখবেনা? '
মালা :  'দাদা ভাই, আপনি আমাকে একটু ধরে পুকুরের পারে নিয়ে যান। আমি চাঁদ দেখবো আজ। '
আমি সেই সন্ধ্যা রাতে মালাকে ধরে পুকুর পারে নিয়ে গিয়েছিলাম।  পাড়ের দূর্বা ঘাসের উপর বসে ও কিছুক্ষণ জলের উপর চাঁদ দেখেছিলো।

পরের দিন সকালবেলা ছমির আলী এসে আমাকে খবর দেয় - 'মালা রাতেই মারা গেছে।'  এরপর আরো দুইদিন আমি চৌহালীতে ছিলাম। তৃতীয় দিন ঢাকায় চলে আসার প্রস্তুতি নেই। আজ আর আমার ব্যাগটি কেউ গুছিয়ে দিলোনা। আমিই গোছালাম। ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে যখন ঘর হতে বের হচ্ছিলাম, তখন পাশ থেকে মালার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম -- 'দাদাভাই, আপনি আমাকে সাথে করে নিয়ে যান। বাবুকে দেখে রাখবো। ঘরের কাজ সব করে দিবো। '

খেয়াঘাটে এসে নৌকায় উঠে বসি। ধলেশ্বরীর প্রবল ভাটির স্রোতে নৌকাটি ভেসে যাচ্ছিলো নাগরপুরের দিকে। পাড়ের গ্রাম, আর বৃক্ষ শৈলীর দিকে তাকিয়ে চন্দ্রাহত সেই মেয়েটির কথা খুই মনে হচ্ছিলো। দূরে কোন্ নৌকার মাঝি গাইছিলো তখন --

'' তুই ফেলে এসেছিস কারে,  মন, মন রে আমার।
তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে মন, মন রে আমার।
যে পথ দিয়ে চলে এলি, সে পথ এখন ভুলে গেলি--
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে, মন, মন রে আমার।''

এতো জল

আহা! এতো জল এখন আমাদের!
মমতাদি, তোমার কাছে এখন আর জল মাঙ্গতে হয়না
কি সুন্দর তোমার সেই শুকিয়ে যাওয়া মন
জলে ভরেছে তোমারও হৃদয়, কি উদার তুমি!

এখন জল আসছে গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে
এখন জল আসছে দেবী পার্বতীর আবক্ষ বক্ষ থেকে
গঙ্গা ভাগিরথী উপচে পড়ে এই মরু পদ্মায়।
এখন জল আসছে কৈলাস শৃঙ্গ থেকে
মানস সরোবর হয়ে আমাদের ব্রহ্মপুত্রে আর যমুনায়।
এখন জল আসছে শেভক গোলা গিরি থেকে
আসছে জল দেহাং কালিজানি ভরিয়ে এই তিস্তায়।

এখন জল ছুঁয়ে যায় বঙ্গোপসাগরের উপদ্রুত উপকুল
সুন্দরবনের মোহনায় কুমিররা খায় ডিগবাজী
রূপালী ইলিশরা লাফাচ্ছে মেঘনার কোল জুড়ে
রেল ব্রীজ ভাঙ্গছে, ভাসছে দুইকূল, ডুবছে জনপদ
গরু ছাগল পশুরাও ভেসে যায় বানের তোড়ে।

আহা! এতো জল এখন আমাদের!
মমতা, লক্ষ্মী দিদি আমার!  তুমি কততো মমতাময়ী
তোমাকে নমস্কার।

ছবি : ইন্টারনেট।

রোড টু গৌরীপুর

অনেক ছোট বেলায় বাবার কাছ থেকেই শুনেছিলাম আমার এক ফুফুর কথা। সে ছিলো বাবার সবচেয়ে ছোট বোন। তখন অবিভক্ত ভারতবর্ষ। বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম জেলাগুলোর সাথে আসামের সঙ্গে ছিলো একটি নিবিড় সম্পর্ক। ব্যবসা বানিজ্য, বিয়ে সাদি এবং অন্যান্য যোগাযোগ ছিলো প্রাত্যাহিক মেলবন্ধনের মতো। আমাদের বাড়ি উত্তরের জেলা বৃহত্তর পাবনাতে। আমার বাবা ব্যাবসায়িক কাজে আসামের ধুবড়ি এবং গোয়ালপাড়াতে যেতেন। ঐখানে কিছু আত্মীয় ছাড়াও বাবার পরিচিত জনেরাও ছিলো।

আমার সেই ফুপুটির নাম ছিলো নুরজাহান। সে নাকি বেশ সুন্দরী ছিলো। বাবার ইচ্ছাতেই আমার এই ফুফুর ৰিয়ে হয় আসামের ধুবড়িতে। নিতান্ত বালিকা বয়স ছিলো তার। অসম্ভব সুন্দরী হওয়ার কারণে মাত্র তেরো চৌদ্দ বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। ছেলে ছিলো নাকি ওখানকার খান্দানী পরিবারের। প্রচুর জমি জিরাতের মালিক ছিলো তারা।

এক শ্রাবণ বর্ষায় তিনটি বড়ো পানসী নৌকা করে ফুপুকে বিয়ে করার জন্য ধুবড়ি থেকে বরযাত্রীরা আসে। ঢাকঢোল, বাদ্য যন্ত্র আর কলের গান বাজিয়ে এসেছিলো তারা। ব্রহ্মপুত্র আর যমুনা নদীর ভাটি বেয়ে ভরা বর্ষায় পানসীগুলো এসেছিলো। আর বিয়ে করে উজান বেয়ে সে নৌকাগুলো চলে গিয়েছিলো আবার ধুবড়িতে। এই বিয়ে ছিলো নাকি বিশাল আয়োজনের আর মহা ধুমধামের। এতো সমারোহ, এতো উৎসব আর এতো আনন্দের মাঝে আমার সেই নুরজাহান ফুফু লাল শাড়ি পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেদিন শ্বশুর বাড়ি চলে গিয়েছিলো।

নূরজাহান ফুফুর সেই যে লাল শাড়ি পড়ে চলে গিয়েছিলো তারপর আর ফিরে আসে নাই। ফুফুর শ্বশুর, শ্বাশুড়ী, স্বামী ও বাড়ির লোকজন সবাই নাকি ফুফুকে খুব ভালোবাসতো ও আদর করতো।  বিয়ের পরপরই ফুফু সন্তানসম্ভবা হয়ে যায়। এবং সন্তান প্রসবকালীন সময়ে তিনি ওখানে মারা যান। একটি মেয়ে নাকি হয়েছিলো। সে মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা বাবা আর তা বলতে পারে নাই। ঠিক সেই বছরেই অর্থাৎ সাতচল্লিশে ভারত বিভক্ত হয়ে যায়। তারপর আসামের ধুবড়ি আর ঐ পরিবারের সাথে বাবাদের সকল যোগাযোগ ও সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে।

বাবার মুখে এই ফুপুর কথা শুনে সেই কিশোর বয়সে আমার মনে রেখাপাত করেছিলো। তাকে আমি কোনোদিন দেখি নাই, তার কোনো ছবি নাই, সে ছিলো আমার জন্মেরও আগে। অথচ তার জন্য আমার প্রাণ কাঁদতো। কেন কাঁদতো, তাও জানি নাই। আমি মনে মনে তার একটি মুখচ্ছবি অন্তরে গেঁথে রেখেছিলাম। বাবার মুখে ফুপুর কথা শোনার পর, আরো অনেক বছর চলে গেছে। ইতোমধ্যে বাবাও মারা যান।

বাবার মুখ থেকে শোনা ফুপু বাড়ির দুই তিনটি তথ্য আমার মনে ছিলো। আমার ফুপার নাম : আব্দুল রশিদ মন্ভল। গ্রামের নাম গৌরীপুর, ধুবড়ি, আসাম। প্রাণের এক অসম্ভব তাড়নায় আমার এই ফুপুর সমাধি খূঁজতে আমি এক ফাল্গুন মাসে চলে গিয়েছিলাম ধুবড়ির সেই গৌরীপুরে।

ট্রেন নং ১৫৭৬৬, ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস, শিলিগুড়ি টু ধুবড়ি। প্রত্যুষ ৬.৩০ মিনিটে শিলিগুড়ির নিউ জলপাইগুড়ি জংশন থেকে ট্রেনটি ধুবড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে । আমি সামনে মুখি জানালার পাশে বসে আছি। আমি তাকিয়ে দেখছিলাম জলপাইগুড়ির নয়নাভিরাম চা বাগান। ট্রেনটি যখন হাশিমারা স্টেশনে দাড়ায় তখন মনে পড়ছিলো সমরেশ মজুমদারের কালবেলা কালপুরুষ উপন্যাস দুইটির কথা। পথে পথে আসছিলাম আর মিলাচ্ছিলাম উপন্যাসের সব চিত্রকল্পগুলি।

আলিপুর দুয়ার জংশনে ট্রেনটি অনেকক্ষণ দাড়িয়েছিলো। আমি নেমে একটি রেস্টুরেন্টে ঘীএ ভাজা লুচি আর মহিষের দুধের ছানা দিয়ে নাস্তা করে নেই। ট্রেনটি কয়েকটি ছোট বড়ো নদী অতিক্রম করে, রাইডাক, কালিজানি তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে রাইডাক নদীটি আমাকে ভীষণরকম মুগ্ধ করেছিলো।

কোচবিহার স্টেশন থেকে একজন ছাত্র উঠেছিলো, ওর নাম শ্যামল রায়। ও পুন্ডিবারী আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ কলেজের  দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলো। ওর কাছ থেকে আমি ধুবড়ি ও গৌরীপুর সম্পর্কে জেনে নেই। গৌরীপুরও একটি স্টেশন, ধুবড়ির ঠিক আগের স্টেশনটাই হচ্ছে গৌরীপুর। ও আমাকে ধুবড়িতেই নামবার ও থাকবার পরামর্শ দেয়। শ্যামলের সাথে আরো অনেক কথা হয়েছিলো। ও তুফানগন্জ স্টেশনে নেমে যায়। অল্প কিছুক্ষণ সময়েই খুব ভালো লেগেছিলো ছেলেটিকে।

ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ট্রেন টি ধুবড়ির খুব কাছাকাছি এসে যায়। শ্যামল বলেছিলো, ঠিক ধুবড়ির আগের স্টেশনটি গৌরীপুর। আমি স্টেশনটি দেখার জন্য জানালার কাছে বসে আছি। একসময় দেখলামও। আমার আত্মা কেমন যেন হিম হয়ে গেলো। মুহূর্তেই চোখ মুখ বিষাদে ছেয়ে যায়। দ্রুতগামী ট্রেনটি এখানে থামলোনা। ঝিকঝিক শব্দ করে ট্রেন ধুবড়ির দিকে চলে গেলো।

ধুবড়ি স্টেশনে নেমে ছোট এই শহরটির দিকে একবার তাকালাম। শহরটিকে কেমন যেনো চেনা শহর মনে হলো। আজ থেকে অর্ধ শত বছর আগে এখানে আমার বাবার হাজারো পদচিহ্ন পড়েছিলো। আমার নুরজাহান ফুপুরও অনেক পদচিহ্ন আছে এই শহরেই। ব্রহ্মপুত্র তীরে যোগমায়া ঘাটেই হয়তো বরযাত্রীর সেই পানসী নৌকাগুলো এসে ভীঁড়েছিলো। এই ঘাট থেকেই হয়তো লাল শাড়ি পড়ে ঘোমটা দিয়ে হেটে হেটে স্টেশনে এসেছিলো ফুপু ।

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিক্সা ডাকলাম। বললাম - আমাকে এনএস রোডে মহামায়া হোটেলে নিয়ে যাও। তখন বিকাল হয়ে গেছে। আমি হোটেলে একটু রেস্ট নিয়ে আবারও শহরের ভিতর বের হই। একটি রিক্সা রিজার্ভ করে ঘুরতে থাকি শহরময়। চলে যাই ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে। এই শহরের তিন দিকেই নদী। আমি একটি তীর থেকে ফিরে তাকালাম পশ্চিম পাড়ে। কে একজন বললো ঐপাড়েই বাংলদেশের রৌমারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যমুনা - ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে নৌকায় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আর স্মরণার্থীরা এসেছিলো এই ধুবড়িতে।

পরের দিন সকাল বেলায় হোটেল থেকে চেক আউট নেই। ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে চলে আসি স্টেশনে। একটি লোকাল ডেমো ট্রেনে উঠে বসি। নামবো সামনের স্টেশন গৌরীপুর।

ট্রেনটি আস্তে আস্তে চলে আসে গৌরীপুরে। আমি কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে নেমে পড়ি প্লাটফর্মে। মৃদু পায়ে হাটতে থাকি প্লাটফর্মের উপর দিয়ে। আমি কোথায় যাবো, কাকে বলবো আমার ফুফুর কথা। কেউ চেনা নেই, কোনো আপন মানুষ নেই। স্টেশনেই একটি ছোট চা'র দোকানে যেয়ে বসি। দেখি একজন পৌঢ় লোক ওখানে বসে আছে। বয়স সত্তরউর্দ্ধো হবে। অমি ওনাকে নমস্কার দিয়ে বলি - 'কাকা আপনি কি এই গাঁওয়ের আব্দুল রশিদ মন্ডল নামে কাউকে চেনেন?' পৌঢ় লোকটি কিছুক্ষণ ঝিম ধরে রইলেন। একটু পর জিজ্ঞাসা করলেন - 'ওনার বাবার নাম কি?
আমি :  বাবার নাম জানিনা।
পৌঢ় :   ওনার কোনো ছেলে মেয়ের নাম জানো কি?
আমি :   একটি মেয়ে থাকতে পারে, তার নামও জানিনা।
পৌঢ় :    তুমি কোথায় থেকে এসেছো?
আমি  :   বাংলাদেশ থেকে।
পৌঢ় :   উনি তোমার কি হয়?
আমি  : আমার ফুপা হয়। উনি বিয়ে করেছিলেন অনেক আগে, অবিভক্ত ভারত বর্ষের পূর্ব বাংলায়।

পৌঢ় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন -- ' চিনতে পারছি। উনিতো মারা গেছেন সে অনেক বছর আগে। '
আমি খুশিতে স্তব্ধ হয়ে যাই। পৌঢ়ের দুই হাত ধরে বলি -- 'কাকা, আপনি কি ওনার বাড়িটি কি আমাকে চিনিয়ে দিবেন? '
কাকা :  আসো তুমি আমার সাথে।

গ্রামের মেঠো পথ ধরে আমি কাকার পিছনে পিছনে চলতে থাকি। প্রায় হা়ফ কিলো যাওয়ার পর দূরে নদী দেখা গেলো। কাকাবাবু বলছিলেন, ঐটা ব্রহ্মপুত্র নদী। এক সময় অনেক দূরে ছিলো, এখন কাছে চলে এসেছে।তবে এখন আর আগের মতো ভাঙ্গেনা। আমরা হাটতে হাটতে অনেকটা নদীর কাছেই চলে আসি। একটি টিনের বাড়ির কাছে এসে কাকাবাবু থামে। ফলের গাছ বেষ্টিত ছায়া ঢাকা খুবই ছিমছাম একটি বাড়ি। আমাকে বাড়ির বাইরে দাড় করিয়ে রেখে উনি ভিতরে চলে যান।

কিছুক্ষণ পর চল্লিশোর্ধ্ব একজন মহিলা কাকাবাবুর সাথে বাইরে চলে আসে। ওনাকে দেখার পরেই আমার ধমনির সকল রক্ত প্রবাহ থেমে গেলো। জগতের সকল হাহাকার যেনো সুখের আতিশয্যে ভরে উঠলো। বহু বছরের পূর্ব পুরুষদের রক্তের ঋণ পরিশোধ হওয়ার জন্য সমস্ত শরীর অসীম এক আবেগে চন্চল হয়ে উঠলো। কাকাবাবু বললেন - 'ইনি তোমার বোন, তোমার ফুপির মেয়ে।' আমি তাকে 'বুবু' বলে ডাক দেই। বুবু আমাকে তার বাহুডোরে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন।

সেদিন আমার বোনটির বাড়িতেই ছিলাম। তার কাছেই জানতে পারি, ফুপুর মৃত্যুর পর ফুপা আর বিয়ে করে নাই। কিন্তু সেও বেশী দিন বাঁচে নাই। অকালেই সে মারা যায়। আমার এই বোনটির নাম, আলো জান। আমি আলো বুবু কে জিজ্ঞাসা করি, 'ফুপুর কবরটি কোথায়?'
আলো বুবু আমাকে বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বে ভিটায় নিয়ে যায়। ওখানে বেশ কয়েকটি কবর দেখতে পাই। তার ভিতর দুইটি কবর আলাদা করে বাঁধানো। একটি ফুপু'র, আরেকটি ফুপার। ফুফু 'র কবরে শ্বেতপাথরের উপর লেখা আছে :  মোছাম্মাৎ নুরজাহান খাতুন। মৃত্যু তারিখঃ ৮ই আগস্ট, ১৯৪৭ ইং। আমরা দুই ভাই বোন দাড়িয়ে কবর জিয়ারত করি। মোনাজাতে অঝোর ধারায় দুইজনই কেঁদেছিলাম।

পরের দিন অপরাহ্নে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ট্রেন ধুবড়ি থেকে ছেড়ে চলে আসে। ট্রেনটি আজকেও গৌরীপুর অতিক্রম করলো। আমি ফিরে তাকালাম আলো বুবুদের গ্রামের দিকে। পাশেই ব্রহ্মপুত্র চিরন্তন ধারায় বয়ে চলেছে। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ হঠাৎই যেনো বেগ পেলো এখানে। কিন্তু মনে হলো চাকা থেমে যাচ্ছে। এই মাটি এই দেশ অনেক দূরের দীর্ঘশ্বাস হয়ে পড়ে রইলো। এই মাটির নীচে মিশে রয়েছে আমারই রক্ত ধারার অযুত বিন্দু,অশ্রু বিন্দু হয়ে।

সমান্তরাল পথে ট্রেনটি তখন দ্রুত গতিতে চলে  আসছিলো আরো দূরের দিকে। পিছনে ফিরে তাকিয়ে থাকলাম, মনে হলো আলো বুবু এখনো কাঁদছে।

সুখ নেই

সুখ নেই তারপরেও শুকপাখি এসে বসলো
ঘরের অলিন্দে ..
ওকেই বলি- যতো সুখ আছে তোর
সব আজ ভাসিয়ে দে...

জাতীয় পতাকা

জাতীয় পতাকা আজ অর্ধনমিত --
পিতার রক্ত সিঁড়ি বেয়ে গড়ে গেছে
রবীন্দ্র সরোবরে,
কে গায় আজ গান পথে পথে মর্মর সুরে
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।

আমার স্বপ্নেরা

একসময় তুমি মেঘনাপাড়ের মেয়ে আমি মেঘনাপাড়ের নেয়ে পড়তে যেয়ে মন চন্চল হতো , রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা পড়তে পড়তে চেঙ্গী ভ্যালীর পথে পথে খুঁজে মরতাম এক লাবন্যকে, কিন্তু অমিত আধারকার হয়েই রয়ে গেছে।

আমি এখনো রয়ে গেছি জীবনানন্দের একাকী এক শঙ্খচিল, ভোরের শিশিরে ভেজা ঘাস, ধূসর পান্ডুলিপির অস্পষ্ট অক্ষর হয়ে , নির্ঘুম চোখে এখন আর কোনো স্বপ্ন নেই , বুদ্ধদেব বিষ্ণু সমর সেনদের মতো কবিতা লিখতে যেয়ে হারিয়েছি অনেককেই।

সেদিন সবই ছিলো, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ছিলো, ভালোলাগার ঘোর ছিলো,ভালোবাসার আকুলতা ছিলো, মৌনতার দুঃখ ছিলো, এখন আর কোনো কিছুই নেই। আমার স্বপ্নেরা মৃত হয়ে চলে গেছে অনেক আগেই।রা

একসময় তুমি মেঘনাপাড়ের মেয়ে আমি মেঘনাপাড়ের নেয়ে পড়তে যেয়ে মন চন্চল হতো , রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা পড়তে পড়তে চেঙ্গী ভ্যালীর পথে পথে খুঁজে মরতাম এক লাবন্যকে, কিন্তু অমিত আধারকার হয়েই রয়ে গেছে।

আমি এখনো রয়ে গেছি জীবনানন্দের একাকী এক শঙ্খচিল, ভোরের শিশিরে ভেজা ঘাস, ধূসর পান্ডুলিপির অস্পষ্ট অক্ষর হয়ে , নির্ঘুম চোখে এখন আর কোনো স্বপ্ন নেই , বুদ্ধদেব বিষ্ণু সমর সেনদের মতো কবিতা লিখতে যেয়ে হারিয়েছি অনেককেই।

সেদিন সবই ছিলো, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ছিলো, ভালোলাগার ঘোর ছিলো,ভালোবাসার আকুলতা ছিলো, মৌনতার দুঃখ ছিলো, এখন আর কোনো কিছুই নেই। আমার স্বপ্নেরা মৃত হয়ে চলে গেছে অনেক আগেই।

কঙ্কনা দাসী

হাজার বছর আগের কথা। কেমন ছিলো তখন নবদ্বীপ? ভাগিরথী ও জলাঙ্গী নদীর সঙ্গমস্থল তখনো কি প্লাবনে ভরে থাকতো? এখনকার এই নীল আকাশ, এখনকার বাতাসের এই ঝিরি ঝিরি দোলা তখনও কি বইতো সেখানে ? খুব মন চায়, ভাগিরথী তীরে যেতে। দেখতে ইচ্ছা হয়, কোথায় আমার সেই পূর্ব পুরুষদের রাজধানী নবদ্বীপ।

কৃষ্ণনগর। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কৃষ্ণনগর।গোপাল ভাঁড়ের কৃষ্ণনগর। মাটির পুতুলের কৃষ্ণনগর।সরপুরিয়া-সরভাজার কৃষ্ণনগর । বাংলার ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা কৃষ্ণনগর । হ্যাঁ, আমি নদিয়ার কথা বলছি। নবদ্বীপের কথা বলছি। হাজার বছর আগে আমার পূর্ব পুরুষদের রাজধানীর কথা বলছি।

এক রবিবারের সকালে 'কৃষ্ণনগর সিটি জংশন' লোকাল ট্রেন ধরে গিয়েছিলাম কৃষ্ণনগরে। সারাদিনে শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার অনেকগুলো ট্রেন চলে । সপ্তাহের অন্যদিনে এই ট্রেনগুলো গ্যালপিং হলেও রবিবার সব স্টেশনে থামে। প্রায় তিন ঘন্টা লেগে যায় কৃষ্ণনগর পৌঁছতে। ওখানে পৌঁছে শহরের জগজিৎ হোটেলে আমি উঠি।

বিকেলে রিক্সা করে প্রথমে যাই রাজবাড়ি। নদীয়া অধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বিখ্যাত রাজপ্রাসাদ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিরাট বড় রাজবাড়ি, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দেয় না । বাইরে থেকে ভেতরটা যতদূর দেখা যায় দেখলাম। কিন্তু আমার কৃষ্ণনগরে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য বাংলার সেন বংশের রাজাদের লুপ্ত প্রায় রাজ প্রাসাদের ধংসাবশেষ দেখা।

নদিয়া জেলায় বর্তমান নবদ্বীপের প্রায় তিনক্রোশ উত্তর পূৰ্বদিকে বল্লালদীঘি নামক গ্রাম আছে । সেখানে অতি উচ্চ এক ভূমিখণ্ড আছে । তাঙ্গকে লোকে “বল্লাল টিবি" বলে থাকে । শোনা যায় সেখানে বল্লাল সেনের রাজ প্রাসাদ ছিল । আমি একটি টাঙার মতো ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করি। ইতিহাসের এক পোড়া মাটির ধূলো পথ ধরে  আমার টাঙা গাড়িটি চলতে থাকে ভাগিরথীর তীর ধরে বল্লাল সেনের সেই ধ্বংস প্রায় রাজ প্রাসাদের দিকে।

আমার টাঙা গাড়ির কোচোয়ান ছিলো পৌঢ় বয়সের একটি লোক, নাম বিষ্ণুপদ ঘোষ। সে বহু বছর ধরে এই পরগনায় টাঙা গাড়ি চালায়। তার যাত্রী বেশির ভাগ বাইরে থেকে আসা পর্যটক। সে অনেকটা গাইডের মতোও কাজ করে । পথ চলতে চলতে আমি ওনার কাছ থেকে অনেক কিছুই জেনে নেই। সবকিছু শুনে একটু ভয়ও পাচ্ছিলাম। একা একা যাচ্ছি অপরিচিত নির্জন এক ভগ্ন প্রাসাদের দিকে।

সেই নির্জন দুপুরে আমি এখন আমাদের পূর্ব পুরুষদের রাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদের সামনে। এক সময়ের সেই জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদটি ভাঙ্গা পোড়া ইট আর মাটির স্তুপ হয়ে আছে। ইটের ভিতর থেকে গাছ গাছালী বেড়ে উঠেছে, কতো গাছে পরগাছা হয়ে আছে। আমার চোখের সামনে দেখলাম একটি বিষধর গোক্ষুর সাপ গর্তে যেয়ে লুকালো। প্রাসাদের কাছেই দেখি একটি শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটের পাশেই আর একটি জরাজীর্ণ প্রাসাদ। বিষ্ণুপদ বলছিলো ওটা ছিলো একটি প্রমোদশালা। আমি ঘাট আর ঐ জীর্ণ প্রমোদ ঘরের দিকে এগুতে থাকি। তখন ছিলো তপ্ত দুপুর সময়। অদূরে ভাগিরথী নদী। ওখানকার শীতল হাওয়া এসে তপ্ত দুপুরের উষ্ণতাকে শীতল করে তুলেছিলো।

কি এক অদ্ভুত টানে আমি এগুতে থাকি সেই ঘাটের দিকে, সেই ভগ্ন প্রমোদশালার দিকে। বিষ্ণুপদ ঘোষ আমাকে বাঁধা দিচ্ছিলো, কিন্তু আমার চোখে তখন একাদশ শতকের এক স্বপ্নের ঘোর। মনে হলো যেনো হাজার বছর আগে আমার পূর্ব পুরুষদেরই কেউ আমি। ঠিক আবার তাও নয় - আমি যেনো এই রাজ্যের এক রাজকুমার।

ফ্লাসব্যাক ---

আমি নাকি আমার পিতামহ বিজয় সেনের মতো দেখতে। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো কালো চুল। বাউলের মতো লম্বা হয়ে তা পিছনে ঘাড় পর্যন্ত নেমে গেছে। চোখ নীল পাথরের মতো জ্বলজ্বল করে। প্রশস্ত বুকের খাঁজে নাগ কেশরের গন্ধ ছড়ায়। ধবল সাদা বাহুদ্বয় বাজ পাখির পালকে উড়ে। লম্বা লম্বা পা ফেলে আমি যখন পাসাদ প্রাঙ্গণে হাটতে থাকি, তখন সব রমণীকুল, দাসী, নর্তকীরা  আমাকে কুর্নিশ করে। তাদের হৃদয় আত্মা কেঁপে উঠতো আমাকে পাওয়ার আকুলতায়। শুধু একজনের হৃদয় আত্মা কেঁপে উঠতো না, নাম তার কঙ্কনা দাসী।

রাজ প্রাসাদের খাস দাসী রত্নাবতীকে নিয়ে এসেছিলো আমার মাতা রামদেবী। আমার মা পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের রাজকুমারী ছিলেন। এই রত্নাবতী ছিলো আমার মাতার পরিচারিকা । বিবাহের পরেও আমার মা রত্নাবতীকে নবদ্বীপের এই প্রাসাদে নিয়ে আসে। কারণ সে ছিলো আমার মায়ের বিশ্বস্ত দাসী। আর এই রত্নাবতীর গর্ভের মেয়েই হচ্ছে কঙ্কনা দাসী।

কঙ্কনা ছিলো আমার খেলার সাথী। দিনের পর দিন সে বেড়ে ওঠে আমার চোখের সামনে। কঙ্কনা যেনো বাগানের অপ্রয়োজনীয় ফুল নয়। সে প্রস্ফুটিত হতে থাকে গোলাপের সৌরভ নিয়ে। তার উন্মেলিত চোখে আমার স্বপ্ন দেখতাম। চুল থেকে গুন্জ ফুলের সুবাস পেতাম। কাঁচা হলুদের গায়ের রঙে আবিরের দরকার হতোনা। বুকে তার কালান্তরের কুন্দন, বক্র শরীরে হাটতো প্রাসাদময় সর্পিনী্র মতো। নিকষিত হেমের ছোবলটি এসে পড়তো যেনো আমার বুকে। কণ্ঠতল থেকে বুক হয়ে নাভিমূলে তার উত্তাল ভাগিরথীর বাঁক। তার সেই প্রমত্ত শরীরের বাঁকে বাঁকে আমি আমার দৃষ্টি হারাতাম।

সেদিন ছিলো হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। বিকাল থেকেই মনটা উদাসী হয়ে উঠেছিল। প্রগাঢ় এক আকাঙ্ক্ষা মন প্রাণ জুড়ে, আজকের এই চাঁদের সন্ধ্যায় কঙ্কনাকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ভাগিরথীর তীর ধরে বেড়াতে নিয়ে যেতে মন চায়।  বনারন্যের সবুজে সবুজে, পাতায় পাতায় ঢলে পড়ছিলো জ্যোৎস্নার প্লাবন। কঙ্কনা একজন দাসী হলেও তার অহংকার ছিলো রাজকুমারীর মতো। তন্বী এই তরুণী আমার সকল সকল শৌর্য বীর্য কেড়ে নিয়েছিলো। গোপনে গোপনে ইচ্ছা পোষন করে রেখেছিলাম, ওকেই আমি বিয়ে করবো, হোক না সে দাসী।

পাইককে বললাম আস্তাবল থেকে ঘোড়া বের করতে। দাসী মহলে খবর পাঠিয়েছি কঙ্কনাকে অপরূপ সাজে সাজাতে। এই যে এতো আয়োজন, এতো সাজ সাজ রব, সবকিছুই আমার মা রামদেবী আর পিতা বল্লাল সেনের অগোচরে। সেদিনের সেই মনোরম সন্ধ্যা রাতে  দেবদারু গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা দিলো। প্রাসাদের দাসীদের দরজা দিয়ে চন্দ্রালোকে হাটতে হাটতে কঙ্কনা দাসী বের হয়ে আসে। পরনে ছিলো কারুকার্যখচিত চোলি ও ঘাঘরা। চাঁদের আলো পড়ে ওর পোশাকে লাগানো পাথর আর চুমকিগুলি ঝিকমিক করছিলো।

অশ্বের খুরের খটখট শব্দ তুলে ভাগিরথীর তীর ধরে ঘোড়া ছুটতে থাকে বনের দিকে। আমার হাতে সোয়ার। পিছনে কঙ্কনা দাসী। চাঁদের আলো বাঁধ ভেঙে পড়েছে আরো আগেই। উতলা কুন্তলা হয়ে কেঁপে ওঠে ভরা পুর্ণিমার চাঁদ। একি পাগল কাড়া এই ক্ষণ! বুঁনো জ্যোৎস্নায় বনের মরা পাতার সব মর্মরধবনি একসময় থেমে যেতে থাকে । যেনো সব গান আর সব সুর বনের গভীরে হারিয়ে যায়। এতো আলো আর এতো জ্যোৎস্না সব আধারে ভেসে যায়।

আমরা যখন রাজ প্রাসাদে ফিরে আসি তখন চাঁদ মধ্য গগনে মেঘের নীচে নিস্তব্ধ হয়ে ডুবে গেছে। কঙ্কনা দাসী চলে যায় দাসী মহলে তার মায়ের কাছে। সেদিন সকাল বেলা পুকুরের জলে কঙ্কনা দাসীর মা রত্নাবতীর মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায়।

তারপর --

বিষ্ণুপদ ঘোষের টাঙা গাড়িতে আমি বসে আছি। লাল পোড়া মাটির ধুলো উড়তে উড়তে ঘোড়ার গাড়িটি ছুটে চলতে থাকে কৃষ্ণনগরের দিকে। তখন বিকাল হয়ে গেছে। আমি বিষ্ণুপদ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম - কঙ্কনা দাসীর পরে কি হয়েছিলো? পথে আসতে আসতে বিষ্ণুপদ বলছিলো, ঠিক পরের রাত্রিতেই কঙ্কনা দাসীও একই পুকুরের জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলো। সত্য মিথ্যা জানিনা -- জনশ্রুতি আছে যে, রাজকুমারের পিতার ঔরসে রত্নাবতীর গর্ভে কঙ্কনার জন্ম হয়। এই কথাটি রত্নাবতী যে রাতে আত্মহত্যা করেছিলো, সেই রাতেই কঙ্কনাকে সে বলে গিয়েছিলো।
এখনো নাকি হেমন্তের পুর্ণিমা রাতে ভাগিরথী তীরের জীর্ণ এই প্রাসাদ থেকে মা মেয়ের দু 'জনেরই কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে।

-------------------------------------------------------------------
ডিসক্লেইমার : এই কাহিনীর তথ্যগুলো বিষ্ণুপদ ঘোষের দেওয়া। আমার কাছে মনে হয়েছে এইসবই ছিলো তার কল্প কাহিনী। সেন রাজাদের কারও সাথে এর কোনো মিল নেই।