সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

কাঁদালে তুমি মোরে

তখন বেলা দ্বিপ্রহর। ঈশ্বরদী জংশনের একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর বিশ্রামাগারে প্রফেসর সাহেব একাকী বসে আছেন। মুখে তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি এবং বিষন্নতার ছাপ। যেনো কতোকালের দুঃখ সেখানে লেগে আছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে, এই চোখ একাকী অনেক রাত কেঁদেছে। বিশ্রামাগারের এককোণে বসে নিরিবিলি পত্রিকা পড়ছিলো সে। তিনি এসেছেন নওগাঁ থেকে, যাবেন খুলনায়। সুন্দরবন এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করছে।

বিশ্রামাগারে আরো দুই তিনজন যাত্রী বসে আছে। তারাও চুপচাপ। কেউ কাউকে চেনেনা। কেউ কারোর সাথে কথা বলেনা। এমনি এক নিরব সুনসান মুহূর্তে রুমে প্রবেশ করে একটি ছোট্ট পরিবার। স্বামী স্ত্রী এবং তাদের পনেরো ষোলো বয়সের একটি মেয়ে। তারা এসে বসে প্রফেসরের ঠিক পাশেই। প্রফেসর সাহেবের বয়স চল্লিশের কাছে। মেয়েটি উৎসুক হয়েই প্রফেসর সাহেবকে দেখছিলো। সে খুব আকুবাকু করছিলো, তার সাথে একটু কথা বলবার।  মেয়েটি নিজ থেকেই কথা বলে - ' আঙ্কেল, আপনি কোথায় যাবেন?
প্রফেসর :  খুলনা। সেখান থেকে আরো ভিতরে, এক পাড়াগাঁয়ে।
মেয়েটি : ওখানে কি আপনার বাড়ি?
প্রফেসর :  না। ওখানে আমি এক কলেজের প্রফেসর।
মেয়েটি :  কোন্ সাবজেক্ট আপনি পড়ান?
প্রোফেসর :  বাংলা।
মেয়েটি :  খুব ভালো সাবজেক্ট। আমারও বাংলা পড়ার খুব ইচ্ছা।
মেয়েটির বাবা মেয়েটিকে বলে :  ' সেঁজুতি মা, তুমি ওনাকে বিরক্ত করছো কেন? '

সেঁজুতি মেয়েটি এই রকমই। ৰাড়িতে, স্কুলে, পথে ঘাটে মানুষকে আপন করে নেওয়া তার স্বভাব। মুহূর্তে মানুযকে সে ভালোও বাসে। এমন সহজ সরল মেয়ে সাধারনতঃ খুঁজে পাওয়া ষায়না। সেঁজুতি প্রোফেসর সাহেবের সাথে কথা বলছেন, এজন্য ওর বাবা কিছু মনে করছেনা। তিনি বুঝতে পারছে যে, প্রোফেসর সাহেবের বিষন্ন মুখই সেঁজুতির মনের মধ্যে এক ধরনের মমত্ব তৈরি করেছে। যার কারণে তার সাথে কথা বলতে তার এতো আকুতি।

প্রোফেসর সাহেব সিটের উপর পত্রিকাটি রেখে ওয়েটিং রুমের বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়। সে দেখছিলো অনেকগুলি রেললাইন চলে গেছে সামনের দিকে। অনেক পথই খালি পড়ে আছে, ট্রেন নেই। আবার কোনো কোনো প্লাটফর্মে ট্রেন আসছে, কোনো কোনো প্লাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ট্রেনদের এই আসা যাওয়ার মাঝেই তিনি ভাবছিলেন অতীতের একটি স্মৃতির কখা।

আজ থেকে তেরো বছর আগে কার্তিকের এক শেষ রোদের বিকেলে চাটমোহরের বড়াল নদীর পাড়ের একটি গ্রাম থেকে সাহানাকে সে বিয়ে করে এনেছিলো। নওগাঁয় ফিরে যাবার সময় এমনি করেই সেদিন অপেক্ষা করছিলো এই ঈশ্বরদী জংশনে। প্লাটফরমের উপর দিয়ে পাশাপাশি হেটে এসে বসেছিলো এই ওয়েটিং রুমেই। আজ এখানে দাড়িয়েই দেখছিলো সেই তেরো বছর আগের দৃশ্যটি। লাল রঙের জর্জেট শাড়ির ঘোমটা ছিলো সাহানার মাথায়। সাদা পান্জাবী পড়েছিলো সে নিজে। তার হাতটি ধরা ছিলো তার হাতে।

প্রোফেসর সাহেব বাইরে দাঁড়িয়েই আছে। সেঁজুতি ওর বাবাকে বলছিলো - 'বাবা, আমি কি প্রোফেসর আঙ্কেলের কাছে যেয়ে একটু কথা বলতে পারবো?'
বাবা :  'যাও, বলোগে। '

সেঁজুতি চলে আসে বারান্দায়। প্রোফেসর তখনো তাকিয়েই ছিলো জনারণ্যময় প্লাটফর্মের দিকে। সেঁজুতি যেয়ে বলে -- 'আঙ্কেল, আপনি মনখারাপ করে দাড়িয়ে রয়েছেন কেন? আপনার কি হয়েছে?'
প্রোফেসর :  শুনবে তুমি? তুমি তো অনেক ছোট মানুষ।
সেঁজুতি :  আপনি বলেন, আমি শুনবো।

প্রোফেসর :  আমার কলেজের কাছেই টিনের একটি ছোট্ট বাড়িতে আমি থাকি। ঘরে শুধু আমার স্ত্রী ছিলো। আমাদের কোনো সন্তান নেই। সেদিন ক্লাশ নিচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর এলো, সে খুব অসুস্থ। আমি বাসায় চলে  যাই। যেয়ে দেখি, সে মৃত। ব্রেন স্টোক করেছিলো। মুখ তার পরনের শাড়ির আঁচলে ঢাকা। হাসপাতালে নেওয়ার সময়ও পাই নাই। আট দিন আগের ঘটনা। পরে লাশ নওগাঁয় নিয়ে আসি। আত্রাই নদীর তীরে আমদের গ্রাম। সেখানেই তাকে কবর দিয়ে এলাম। এখন চলে যাচ্ছি খুলনায়।

সেঁজুতি :  আপনার একা একা ওখানে খারাপ লাগবেনা? বাড়ি থেকে কাউকে সাথে করে আনতেন?
প্রোফেসর :  "আমার তেমন কেউ নেই। বাবা, মা,ভাইবোন কেউ না। ছিলো শুধু আমার স্ত্রীই। তেরো বছর ধরে আমরা একদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন ছিলামনা । দুই তিনবার সে শুধু তাদের বাড়ি গিয়েছিলো, তাও আমি সাথে ছিলাম। ''

বিয়ের পর তিন বছর গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। কয়েকটি টিউশনি করতাম। ভালোই চলছিলো জীবন। ছোট্ট একটি কুটিরে থাকতাম। কতো হেমন্ত জ্যোৎস্নায় আমাদের কেটেছে সময়, আত্রাইয়ের কূলে কূলে। তারপর সেই জীবন ফেলে চলে আসি খুলনায়। কলেজে চাকুরী হলো। ভালোই চলছিলো জীবন।

সেঁজুতি : তারপর?

প্রোফেসর :   তুমি ছোট মানুষ। তোমায় আর কি বলবো? আমি ওখানে যাচ্ছি, সপ্তাহখানেক থাকবো। কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে আমার পদত্যাগপত্র জমা দিবো। ওখানে আমার একাকী থাকা সম্ভব নয়। ঐ কলেজ, ঐ কলেজের প্রাঙ্গন, কলেজের কাছে আমার ঐ বাড়ি, সবখানে ওকে নিয়ে আমার হাজার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ওখানে আমার একাকী দম বন্ধ হয়ে আসবে।

সেঁজুতি : আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

প্রোফেসর :   ওর বেশ কিছু ব্যাবহার করা কাপড় চোপর আছে। ভাবছি সেগুলো গরীবদের দিয়ে দিবো। তাছাড়া বিয়ের দিনের লাল শাড়ি, নাকফুল, চারটে চুরি আর একটি মালাও আছে। এ ক'টি জিনিস কাকে যে দিব, ভেবে পাচ্ছিনা। আমারতো ঐরকম আপন কেউ নেই।
সেঁজুতি :  কেন, আপনার কাছেই রেখে দিবেন। আপনি আর বিয়ে করবেন না?
প্রোফেসর :  না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনেক দূরে চলে যাবো। বাকি জীবন মাজারে মাজারে, আশ্রমে আশ্রমে ঘুরে বেড়াবো। মঠ,গীর্জা, মন্দিরে মন্দিরে থাকবো। যেথায় শান্তি পাবো, সেখানেই ঘুমিয়ে যাবো। কেউ দেখবেও না, কেউ জানবেও না।

সেঁজুতির চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে।

প্রোফেসর :  সেঁজুতি, তুমি খুব ভালো মেয়ে। খুব ছোট্ট বেলায় আমি মাকে হারিয়েছিলাম। তার কথা আমার মনে নেই। তারপর এই পৃথিবীতে আমার স্ত্রীকে পেলাম। সেও ছেড়ে চলে গেলো। আর আজ তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। তুমি কি সেই লাল শাড়ি, নাকফুল, হাতের চুড়ি আর গলার মালাটি নেবে? যদি না নাও, তাহলে এক হেমন্তের পূর্ণিমার রাতে সেগুলো আত্রাইয়ের জলে ফেলে দিয়ে আসবো। তারপর চিরতরে অনেক দূরে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো।

সেঁজুতির কন্ঠ রোধ হয়ে আসে। কোনো কথা বলতে পারছিলোনা।

সেঁজুতির কোনো কথার উত্তর প্রোফেসর আর শুনতে পেলোনা। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্লাটফর্মে এসে ততোক্ষণে ভিঁরে গেছে। সে ওয়েটিং রুম থেকে তার ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে প্লাটফর্মের হাজারো মানুষের মধ্যে মিশে যায় এবং ট্রেনে যেয়ে উঠে পড়ে। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটি পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রীজের দিকে ছেড়ে চলে যেতে থাকে। সেঁজুতি ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ রেখে অঝোর ধারায় কাঁদছিলো তখন।

K.T
24/8/2017

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন