শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

পূর্ণিমানিশীথিনী-সম

নির্ঘুম রাত্রি দুপুরে মিত্রার চোখে ঘুম আসেনা। বাইরে যতোবার সে তাকিয়েছে, দেখেছে সেখানে অন্ধকার । বেদনাহত ঝাউগাছ দাড়িয়ে আছে নিরব পথের পথিকের মতো।  হঠাৎ হুহু ঠান্ডা বাতাস এসে লাগে ওর গায়ে। শীতে আরো বেশী কাঁপন লাগে অস্থিতে। রক্তও হিমশীতল হয়ে যেতে থাকে , হিমোগ্লোবিনের ক্ষুধা আরো বেরে যায় ওর রক্তে। অস্থিও কেমন অসার হয়ে  আসে।

মেডিসিনের ক্লাশে প্রোফেসর আবেদীন স্যার মিত্রাদের বলেছিলেন -- মানবদেহে রক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান৷ এই রক্তের উপাদানগুলোর মধ্যে লোহিত রক্ত কনিকা বা RBC (Red blood cell) এর ভিতরে রয়েছে হিমোগ্লোবিন নামক এই প্রোটিন যার গুরুত্ব অপরিসীম ৷ এটি ফুসফুস হতে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বয়ে নিয়ে যায়৷ স্বাভাবিকভাবে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ পুরুষের জন্য ১৩.৫ থেকে ১৭.৫ এবং মহিলাদের জন্য ১২ থেকে ১৫ mg/dl৷ কিন্তু মেয়েদের যখনি তা ১০ এর নীচে নামতে থাকে তখনই তা ভাবনার কারণ হয়।

মিত্রা চোখ রাখে আকাশের দিকে। এই শহরে বাজছে --        ' দূরে কোথাও দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে। "  মিত্রা ঘুমোতে চায়। কিন্তু ওর চোখে ঘুম নেই, কুয়াশা নামে ছেঁড়া ছেঁড়া, আর ঘুম যদিও আসে, তা দেহে অসে, মনে নয়। মন তার জেগে থাকে সেই মহানন্দা নদীর তীরে। যেখানে ছোটবেলায় চেনা তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো। যে তারাগুলোর নীচে মিত্রা আর নীল জেগে রইতো। যার নীচে এখন শুধুই নীল থাকে, মিত্রা নেই।

ডাঃ আবেদীন স্যারের ক্লাশে মিত্রা জেনেছিল, লিউকেমিয়া কি? লিউকেমিয়া হচ্ছে, রক্ত বা অস্থিমজ্জার ক্যান্সার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর প্রধান লক্ষণ রক্তকণিকার, সাধারণত শ্বেত রক্তকণিকার অস্বাভাবিক সংখ্যাবৃদ্ধি। রোগটির নামই হয়েছে এর থেকে লিউক অর্থাৎ সাদা, হিমো অর্থাৎ রক্ত। রক্তে ভ্রাম্যমান এই শ্বেত রক্ত কণিকাগুলি অপরিণত ও অকর্মণ্য। রক্ত উৎপাদনকারী অস্থিমজ্জার মধ্যে এদের সংখ্যাধিক্যের ফলে স্থানাভাবে স্বাভাবিক রক্তকণিকা উৎপাদন ব্যাহত হয়।

একটু পিছনে ফিরে দেখা :
দিনটি কেনো এমন হলো সেদিন। কর্কট রোগের উপর রিসার্চ করবে কে কে? ক্লাশে জানতে চেয়েছিল আবেদীন স্যার। প্রথম হাতটি উঠলো তারই সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী মিত্রার। ক্লাস শেষে কলেজের লম্বা কোরিডোর দিয়ে হেটে ক্যান্টিনে চলে যায় মিত্রা। গরম চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে চা খেতে খেতে সহপাঠী পান্না আর জয়ন্তীকে বলছিল -- একদিন আমারও করবো জয়, আমরাও করবো জয় এই কর্কট ক্রান্তিকাল।

শহীদ মিনারের পাশ থেকেই রিকশা উঠছিল মিত্রা। একবার ফিরে তাকালো সে মিনারের সু উচ্চ প্রান্তের দিকে। মা তার স্তনের দুধ পান করাচ্ছে তার কোলের শিশুকে।  নভেরা আহমেদ তাই-ই বলেছিল। হ্যাঁ, তাই দেখতে পেলো মিত্রাও।  এই দৃশ্যটি দেখে ওর মন ভালো লাগার কথা। কিন্তু ভালো লাগেনি। মাথা ঝিমঝিম করছিল। কড়ই গাছের ছায়াতল দিয়ে রিকশাটি চলে যায় নিউ মার্কেট হয়ে জিগাতলার দিকে , যেখানে ওদের বাসা।

মিত্রা বাসায় এসে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ে। মা এসে জিজ্ঞাসা করে -- 'তোমার কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?
মিত্রা :  না মা। আজ আমার মন ভালো লাগছে। আজ আমাদের ক্যানসার রোগের উপর ক্লাস ছিলো। মা, আমি ক্যান্সারের উপর রিসার্চ করবো। তুমি আমাকে দোয়া করবেনা মা?
মা মিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল -- 'অবশ্যই করবো। তুমি একদিন ক্যান্সারের বড়ো ডাক্তার হবে। '

মিত্রা শুয়ে শুয়ে আবেদীন স্যারের ক্লাসের লেকচারের কথা মনে করছিল -- লিউকিয়ামের লখ্খণ হচ্ছে,  ঘন ঘন জ্বর হওয়া, প্রচন্ড দুর্বলতা ও অবসাদ,খিদে না থাকা ও ওজন হ্রাস, মাড়ি ফোলা বা খেতে থেলে রক্তক্ষরণ, ছোট কাটাছড়া থেকে অনেক রক্তক্ষরণ, স্ফীত যকৃত ও স্প্লীন, অস্থিতে যন্ত্রণা, স্ফীত টনসিল। '

কর্কটময় সেই একদিনের কথা :
আবেদীন স্যারই সমস্ত রিপোর্ট দেখে কষ্ট ভারাক্রান্ত চিত্তে বলে দেয়, তারই সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রীটির লিউকেমিয়া হয়েছে।  মিত্রা যেহেতু চিকিৎসা বিঞ্জানের ছাত্রী তাই ব্যাপারটি ওর কাছে আর গোপণ থাকেনা। আর এও জেনে যায়, কবে তার মৃত্যু হবে সে কথাও।

এই শহর জেগে আছে। জেগে আছে মিত্রার  উন্মোলিত চোখ অন্ধকার পথের দিকে। মিত্রার কান্না পায়। কিন্তু কান্না তার আসেনা, গলায় কেমন ঘড়ঘড় আওয়াজ হয়, যেন মৃত্যুর গাড়িতে চেপে স্বপ্ন-চাকায় শব্দ তুলে সে কোথায় চলেছে। সবই শান্ত- জমাট বাঁধা কালো রাত্রির নীরবতা এক পায়ে দাঁড়িয়ে ধুঁকতে থাকে।

মিত্রার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। নীলের কথা মনে পড়ে।  ঘাসের ঘ্রান আর দখিনা বাতাসের কথা মনে পড়ে।  আজ আর হয়তো সেই তারাগুলোর নীচে বাতাস নেই, ঘ্রান নেই, আছে শুধু জমাট বাঁধা অন্ধকার। মিত্রা  ঘুমোতে পারেনা। সে উঠে পড়ে। ধীরগতিতে চলা একজোড়া পায়ের আওয়াজ আসে কোরিডোর থেকে এবং সে অবাক হয়ে ভাবে এই যে তারই খেলার সাথী নীলের। যার চোখে কোন তারা নেই। সেই চোখে কোন কথা নেই, রাগ নেই, আদর নেই। সেই তারাহীন চোখের ছেলেটিকেই মিত্রা ডাকে। মিত্রা হাঁটতে থাকে করিডোর দিয়ে, নাকি ধূসর প্রান্তর দিয়ে , সে বুঝতে পারেনা। কোরিডরের শেষপ্রান্তে, হাসপাতালের  নীচে ক্লান্ত সিকিউরিটি গার্ড তখন সমুদ্রের স্বপ্ন দেখছিলো।

ডাঃ আবেদীন স্যার একদিন ক্লাসে বলেছিল -- ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকমিয়া নির্ণয় করতে রক্তের কোষ পরীক্ষা, বায়োপসি বা হাড়ের মজ্জা পরীক্ষা করাতে হয়। এর চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, ক্যান্সারের ধরন এবং ক্যান্সার শরীরে কতটুকু ছড়িয়েছে তার উপর। চিকিৎসা পদ্ধতির ভেতর আছে কিমোথেরাপি ( কিছু ওষুধের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধংস করা হয় ), রেডিও থেরাপি (যন্ত্রের মাধ্যমে রেডিও ওয়েভ ব্যাবহারের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধংস করা হয়), হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপন।  মিত্রার আজ মনে হচ্ছে, সেগুলো সব মিথ্যা লেকচার ছিলো।

কে বাজায় দূরে এই গান -- 'জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো। সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীতসুধারসে এসো।
কর্ম যখন প্রবল-আকার, গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার,
হৃদয়প্রান্তে হে জীবননাথ, শান্তচরণে এসো।'

বাবা এসেছিল হাসপাতালে। মিত্রা ওর বাবার দু 'হাত বুকে টেনে বলেছিল -- ' বাবা তুমি আমাকে আমার সেই ছেলেবেলার গোদাগাড়ীর মহানন্দা নদীর তীরে নিয়ে যাও। '
বাবা :  এমন করোনা মামনি আমার! তোমাকে কালই নিয়ে যাবো গোদাগাড়ীর সেই মহানন্দার তীরে। '

আজ এই গোদাগাড়ীতে উঠবে পূর্ণিমার চাঁদ। আজ এইখানে মিত্রা এসেছে। মিত্রাকে দেখতে ওর খেলার সাথীরাও এসেছে। এসেছে ওর কাজিন
 নীল, যে ওর বাল্যসাথী ছিলো। নীল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে  অনার্স করছে। ওরা সবাই মিত্রাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় গ্রাম, প্রাইমারি স্কুল, ছোট্ট খেলার মাঠ আর ঠাকুরবাড়ির ঝিলপুকুর। এই সব জায়গাতেই মিত্রার ছেলেবেলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

সন্ধ্যা রাতের আকাশে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। মহানন্দা নদীতে তখন কুলকুল স্রোত বইছিলো। মিত্রা নীলাকে বলে -- 'তুমি আমার হাত ধরে ঐ মহানন্দা নদীর তীরে নিয়ে যাবে?  আমি তীরে বসে শুনবো জলের শব্দ, আর দেখবো রাতের যতো তারা। '
মিত্রার মন আজ স্তব্ধ। সেই স্তব্ধতার আর্তনাদ শুনতে পায় সে। অাঁধার সুড়ঙ্গ বেয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে আসা আর্তনাদ। তারাহীন চোখের তারায় ছেলেটা তাকে ডাকে। সে নদীর কুলের দিকে পা বাড়ায়।

মিত্রার সে রাতে চোখে আর ঘুম আসেনাই। রাতের শিউলি গন্ধ বিলিয়েছিলো বাতাসে।  তারাগুলো মমতাভরে কাছে টেনে নেয় ওকে- দেয় শীতল জল, ঘাসের ঘ্রান আর দখিনা বাতাস।  আর নীল মিত্রাকে গেয়ে শোনায়েছিলো --

'তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম।
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম...। '

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন