সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

যামিনী না যেতে

একদিন রাতে অনলাইনে বসে 'সে যে আমার নানা রঙ্গের দিনগুলি' নামে আমার ব্লগে এক বর্ষা দিনের কথা লিখছিলাম। আর্ট কলেজের বকুল তলায় বসে, পাপিয়া সেদিন আমাকে বলেছিলো - 'ভালোবাসি।' ঠিক সেই সময়ে কোথা থেকে উদ্ভ্রান্ত বাতাস এলো। বকুলের পাতা সব দুলে উঠলো। পাপিয়া'র মাথার চুল উড়ছিলো। ঝরা ফুল এসে ঝরে পড়েছিলো ওর চুলে। আমি চুল থেকে কুঁড়াই ফুল। সেই ফুল পাপিয়া 'র হাতে দিয়ে বলেছিলাম- 'আমিও তোমাকে ভালোবাসি। '

ভালো বাসতে বাসতেই আমাদের দু'জনের জীবনে বসন্ত আসে। এমনি এক বসন্ত দুপুরে আমরা বসেছিলাম সেই বকুল তলাতেই। তপ্ত দুুপরে সেদিন কোনো উদ্ভ্রান্ত বাতাস আসেনি। বকুলের পাতার ফাঁক দিয়ে কেবল রোদ্দুর ঝরে পড়ছিলো। এতো মায়ময় আলোর ঔজ্জ্বল্যে পাপিয়ার মুখ সেদিন বিষন্ন লাগছিলো। আমার ব্লগে লিখছিলাম তাই --

' সেদিন আমার অপেক্ষা ছিলো আনন্দের
সেদিন তোমার আগমন ধ্বনি ছিলো
পাতা ঝরার মতো বসন্ত গানের --
আম্র মুকুলের আড়ালে কোকিল ডেকে উঠেছিলো
সমস্ত সৌরভ হঠাৎ কোথায় মিলিয়ে গেলো
কি দ্বিধায় গোপণ রেখেছিলো সে সত্য
ভালোবাসার কাছে সত্যও গোপন হয়
তার আকন্ঠে কখনো চুম্বনের দাগ দেখিনি
বুঝতে পারিনি অন্য কারোর ঘর থেকে
সে প্রতিদিন বেরিয়ে আসতো রাধিকার মতো। '

আমার ব্লগে যখন পাপিয়া'র কথা, তার অভিসারিকা হওয়ার কথা লিখতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই ল্যাপটপে খুলে থাকা ফেসবুকের উইন্ডোতে  একটি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট নোটিফিকেশন আসে। রিকুয়েস্টটি ছিলো একটি মেয়ের। নাম যামিনী। আমি যামিনীর ওয়ালে চলে যাই। একটি মাত্র ছবি সেখানে দেওয়া আছে। পিছন দিক হওয়া, মুখ দেখা যায়না। লাল পেঁড়ে সাদা শাড়ি পড়ে কাশবনের ভিতর দিয়ে হেটে যাচ্ছে।

এ্যাবাউটে লেখা আছে --''আমি যামিনী, একসময় কাশবনের সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে হাটতে খুব পছন্দ করতাম। এখন যেখানে আছি, সেখানে কাশবন নেই। আছে রডোডেনডন গুচ্ছ। অবশ্যই তা শিলংয়ের পাহাড়ের ঢালে নয়। সুদূর অষ্ট্রিয়ায় দানিয়্যুব নদীর তীরের এক উপত্যকায়।"

আমি রিকুয়েস্টটি এ্যাকসেপ্টটেন্স দেই। কোনো মিউচুয়াল ফ্রেন্ড নেই। এমনকি তার বন্ধু লিস্টে অন্য কোনো বন্ধুও নেই। আমিই তার প্রথম বন্ধু হলাম।
ইনবক্সে প্রথম সে লিখলো - 'আমাকে তুমি বন্ধু করলে! কিযে ভালো লাগছে আমার।'
আমি বিব্রত হই প্রথমেই 'তুমি' সম্বোধনে। তারপরও সহজ করে নেই ব্যাপারটা। বলি :  আমিও খুশি, আপনার বন্ধু হতে পেরে। '
যামিনী :  বন্ধুকে 'আপনি' বলছো কেন? বন্ধুকে কেউ. 'আপনি ' বলে?
আমি :  আমি খুশি তোমাকে বন্ধু পেয়ে।
যামিনী :  কি করছিলে?
আমি :  ব্লগে লিখছিলাম। বায়োগ্রাফিমুলক লেখা।
যামিনী :  কার কথা লিখছিলে?
আমি  :  সে তুমি চিনবেনা! একটি মেয়ের কথা।
যামিনী :  কি নাম তার?
আমি :  পাপিয়া।
যামিনী :  ভালোবাসতে তাকে ?
আমি :  জ্বী।

যামিনী  :  তোমার সাথে কাল আবার কথা বলবো। ঠিক এই সময়ে। তুমি অনলাইনে থেকো। নীচে আমার হাজব্যান্ড এসে গাড়ির হর্ণ বাজাচ্ছে। যাই।

যামিনী অফ্ লাইনে চলে যাবার পর ভাবছিলাম, একজন মেয়ে অনেক কিছুই পারে, তার অত্যাশ্চর্য সম্মোহন শক্তি দিয়ে মুহূর্তেই একজন ছেলের মন জয় করতে পারে । সেই সুদূর অস্ট্রিয়ার দানিয়্যুব নদীর তীর থেকে এক অজানা অচেনা রমণী এ কোন্ হৃদয় দোলায় দোল দিয়ে রেখে গেলো।

পরের দিন রাতে ব্লগে পাপিয়া'র অসমাপ্ত কথা লিখতে যেয়ে আর লেখা হলোনা। ইউটিউবে রবি ঠাকুরের এই গানটি শুনছিলাম --

"কেন যামিনী না যেতে জাগালে না,
বেলা হল মরি লাজে।
শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথেরি মাঝে।
আলোকপরশে মরমে মরিয়া
হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া,
কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া
কামিনী শিথিল সাজে। "

গান শেষ হতে না হতেই ইনবক্সে যামিনীর নোটিফিকেশন চলে আসে। যামিনী লিখে :  কি করছো এই রাতে? সবুজ আলো জ্বেলে একাকী।
আমি :   শুনছিলাম 'কেন যামিনী না যেতে' গানটি।
যামিনী :    তাই? ভালো লাগলো। গতকাল থেকে তোমার কথা মনে পড়ছে খালি। তারপর বলো -- 'তোমার সেই পাপিয়া 'র কথা।
আমি :   পাপিয়া আমার জীবনে নেই। আসেও নাই। তাকে ভালোবাসবার আগেই সে আরেকজনের বউ ছিলো। আমি তা জানতাম না। দুইজনের কতো ভালবাসা ছিলো, কতো স্বপ্ন ছিলো, কতো চাওয়া পাওয়া ছিলো। এই জীবনে কোনো কিছুই আর পাওয়া হয়নি। পাপিয়া যার স্বপ্ন ছিলো তারই স্বপ্ন হয়ে আছে।

যামিনী :  তুমি কখন জানলে, পাপিয়া আরেকজনের বউ।
আমি :  সেদিন আর্ট কলেজের বকুলের তলায় আমরা বসেছিলাম, শুধু ভালোবাসার সময়গুলো একসময় শেষ হয়ে আসে, পাপিয়াকে বলি -- 'চলো আমরা বিয়ে করি, ঘর বাঁধি। ' পাপিয়া সেদিন কাঁদতে কাঁদতে তার সেই না বলা কথাটি বলে দিয়েছিলো।
যামিনী :  তারপর কি হলো?
আমি :  পাপিয়ার সাথে সেইটাই ছিলো আমার শেষ দেখা। এরপর ওর সাথে আমি কখনো দেখা করি নাই। চিঠিও লিখি নাই। পাপিয়াও বুঝতে পেরেছিলো আমার অভিমানের কথা। আমি চিরতরে নিজেকে তার কাছ থেকে দূরে সরে রেখেছিলাম।

যামিনী :  তোমার কি এখনো পাপিয়ার কথা মনে হয়? তুমি কি তাকে এখনো ভুলে যেতে পেরেছো?
আমি :   মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। ও আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা ছিলো। এক বর্ষায় আমার দু'হাত নিয়ে করোতলের উপর সে চুম্বন একেঁ বলেছিলো, 'এমনি করেই সারা জীবন তোমাকে ভালোবাসবো।' বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিলো। এখনো কোনো বর্ষার দিনে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হলে পাপিয়া 'র কথা মনে পড়ে। মনে হয়, সে যেনো আছে আমারই পাশে। তার নিঃশ্বাস এসে আমার বুকে পড়ে। আমার দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে তার কপোলে।
যামিনী :  পাপিয়া এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? জানো কি?
আমি  :   আজ বহু বছর হয়ে গেছে। কিছু জানিনা তার কথা । বেঁচে আছে কিনা তাও জানিনা।
যামিনী :  তুমি আমাকে মনটা খারাপ করে দিলে। আজ এই পর্যন্তই। কাল আবার কথা হবে। ভালো থেকো।শুভরাত্রি।

সন্ধ্যা থেকেই মনটা কেমন উতলা হয়ে উঠছিলো। কখন রাত্রি গভীর হবে। কখন আসবে যামিনী অনলাইনে। এই দুই দিনেই যামিনীর প্রতি কেমন যেনো টান চলে আসে।
ইনবক্সে যামিনীর ইমো দেখতে পাই --
যামিনী :  কেমন আছো।
আমি  : ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
যামিনী :  ভালো নেই। কাল রাত থেকেই তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। জানো, আমিও খুব দুঃখী। সেই কতোকাল ধরে, কতো রাত্রিতে গোপণে কতো যে আমাকে কাঁদতে হয়েছে। সে কথা শুধু ঈশ্বরই জানে। তোমার প্রোফাইলে তোমার বউয়ের ছবি দেখলাম। খুবই সহজ সরল মায়াময়ী এক দেবী যেনো। ওকে খুব ভালো লাগলো।
আমি :  জ্বী, ও খুব ভালো মেয়ে। ওকে নিয়ে সুখেই আছি। ও সত্যিই একজন মায়াবতী।

যামিনী :   আমি ভালো নেই। আসোনা তুমি একবার এখানে বেড়াতে। এক সন্ধ্যায় দানিয়্যুবে বজরা ভাসিয়ে দূরে অনেক দূরে চলে যাবো। এখানেও ওঠে আমাদের দেশের মতো পূর্ণিমার চাঁদ। সারা রাত চন্দ্রালোকে ভাসবো দুইজন। তুমি যদি আসো দানিয়্যুবের তীরে ওপারে রয়েছে আকাশ জুড়ে পাহাড় আর উপত্যকা। সারা বিকেলে হাঁটবো গিরি পথে পথে। দেখতে পাবে রডোডেনডন গুচ্ছ। এখানেও আছে মাধবীলতা। আসবে তুমি!

আমি :  দেখি, তোমাকে আমি দেখতে যাবো একদিন ভিয়েনায়। তোমার প্রোফাইলে তোমার একটি মাত্র ছবি। তাও পিছন দিক হয়ে। যামিনী, তোমার মুখ আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। তোমার মুখের একটি ছবি পোস্ট দাওনা? তোমায় একটু দেখি।

যামিনী :  আমি দেখতে খুবই কুৎসিত। তুমি আমাকে দেখে পছন্দ করবেনা। অামাকে ঘৃণা করবে।
আমি :  কে বলেছে, তোমায় ঘৃণা করবো? সত্যি বলছি, ঘৃণা করবোনা। তুমি একটি ছবি পোষ্ট দিও।
যামিনী :  ঠিক আছে। পোষ্ট দিবো। কাল সকালে তুমি দেখতে পাবে। এখন যাই। ভালো থেকো। কোনো দিন তুমি আমাকে ভুলে যেওনা।

সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে, তখন ফেসবুকে যেয়ে যামিনীর প্রোফাইল ছবি খূঁজি। পেলামও। অনেক আগের একটি সাদা কালো ছবি। এ যে দেখছি সেই পাপিয়া! নামটাও চেন্জ করা। যামিনী নয় -- পাপিয়া আলী, ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।

K.T
28/8/2017

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন