সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

যতো আনন্দ সঙ্গীত

উত্তরার একটি বহুতল বানিজ্যক ভবনের পনেরো তলায় ছিলো আমার অফিস। অফিস বলতে আমিই একাই সব। ছিলো শুধু অল্প বয়সের একজন এ্যাটেন্ডেন্ট। বসে বসে সেখানে ইন্ডেন্টিং এর কাজ করতাম। তবে বেশীর ভাগ সময় কোনো কাজ থাকতো না। তখন ফেসবুক এতো জনপ্রিয় ছিলোনা। ইয়াহু ম্যাসেঞ্জারে মাঝে মাঝে চ্যাটিং করে সময় কাটাতাম। ফিলিপিনো মেয়েরা তখন  চ্যাটরুমে লাইন দিয়ে বসে থাকতো।

একদিন সকালবেলা পার্কে ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটার সময় অনিক নামে এক তরুনের সাথে আমার পরিচয় হয়। সে উত্তরার একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটির ফ্যাশন ডিজাইনের শেষ সেমিস্টারের ছাত্র ছিলো। ছেলেটি দেখতে খুব সুদর্শন ও ভদ্র ছিলো। সৌখিন ভাবে সে নাটকে অভিনয়ও করতো। ভদ্র ও সাংস্কৃতিমনা ছেলে দেখে ওকে আমার খুব ভালো লাগে। আমার একটি ভিজিটিং কার্ড ওকে দিয়ে বলেছিলাম -- তুমি আমার অফিসে এসো।

এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই পরিপূর্ণ সুখের মানুষ নয়। ক্রান্তিকাল সবার জীবনেই আসে। কিছু ভুলের জন্য কিছু  দুঃখ কষ্ট আমিও বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। রিভোলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রায়ই বসে থাকতাম। জানালা খুলে দেখতাম উত্তরার নীল আকাশ। দূর দিয়াবাড়ীর খোলা বালুর প্রান্তরও দেখতাম। কাশবনের সাদা ফুলগুলো গালিচার মতো লাগতো। দেখা যেতো বিমানবন্দরের রানওয়ে, সেখানে বিকট শব্দ করা প্লেনগুলোর ওঠা নামা দেখতাম। এমনি বসে থাকা এক ক্লান্ত দুপুরে অনিক প্রথম আমার অফিসে এসেছিলো।

আমি অনিককে অন্য কথা না বলে সরাসরি বলি - 'তুমি কি লান্চ করে এসেছো ? ' অনিক প্রথম দিনের আমার এমন স্ট্রেইট কথা শুনে ও তার সত্য কথাটিই বলে ফেলে -- ' না, সকালের নাস্তাও করিনি। ঘুম থেকে উঠেছি একটু আগে। হোস্টেলের ক্যান্টিনে তখন খাবার শেষ। আমার পকেট দিয়াবাড়ির ধূধূ বালুর মাঠ। ঘুম ভেঙ্গেই আপনার কথা মনে হলো। তাই চলে এলাম।'

আমরা চলে আসি উত্তরার আকাশ ছোঁয়া রেস্টুরেন্ট 'শিকারা'তে। জানালার কাছে বসে এখানেও দেখা যায় নীল আকাশ, দিয়াবাড়ির কাশবন, আশুলিয়ার গ্রাম আর তুরাগ নদীর জল। আমরা দুইজন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম এমনি জানালার পাশে বসে। খেতে খেতে অনেক কথাই বলা হলো দু 'জনের। দূরের নিসর্গগুলি দেখতে দেখতে একে অপরের অনেক কিছুই জানা হলো।

অনিক নিতান্তই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। ওর গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ভাটি অন্চল দিরাই তে। ঢাকায় উল্লেখ করার মতো কোনো আত্মজন নেই। থাকে প্রাইভেট হোস্টেলে। গ্রাজুয়েশন শেষ হবার পথে। শেষ সেমিস্টার শেষ হয়ে যাবে। অনিক আমার অফিসে প্রায় প্রতিদিনই আসতে থাকে। আমার একাকীত্বের সময়গুলোর ও সাথী হয়।  জীবনের অনেক হতাশা,বন্চনা আর গ্লানির কথাগুলো ওর কাছেই ভাগাভাগি করে নেই। আমিও ওকে অনেক কিছুইতে সাহায্য সহযোগিতা করি। ওর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান পনেরো ষোল বছর। তারপরেও সম্পর্কটা হয়ে ওঠে বন্ধুর মতো, আমি হয়ে যাই ওর আপন আত্মজন।

একদিন অফিসে মৌরি নামে একটি মেয়েকে অনিক নিয়ে আসে। মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দরী। অনিক আমাকে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওরা একে অপরে ভালোবাসে। মৌরি বিত্তবান ঘরের মেয়ে হলেও ছিলো নিরাহংকারী ও সহজ সরল। এক ধরনের নিষ্পাপ সারল্য ওর চোখে মুখে দেখতে পাই। আমি প্রথম দিন অফিসেই ওদেরকে আপ্যায়ন করাই। এরপর থেকে মেয়েটাকে প্রায়ই অনিক আমার অফিসে নিয়ে আসতো। ওদের দুজনেরই সাথে আমারও একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ৰাড়ী থেকে অনিক যে টাকা পয়সা পেতো তা দিয়ে অনিকের সারামাস যেতো না। মৌরিকে ভালোবাসার কারণে ওর অতিরিক্ত খরচ হয়ে যেতো। মাসের শেষের দিনগুলো আমিই ওকে চালাতাম। বলতাম, 'তোমাকে করুণা করছিনা। হিসাব রেখো। যখন সামর্থ্য হয়, দিয়ে দিও। আর না দিলেও তুমি ঋৃণী হবেনা কখনো। মনে করবে একজন ভাইয়ের স্নেহের এ দান।'

অনেক সময় আমি অফিসে থাকতাম না, সে সময়ে অনিক আর মৌরি গল্প করতো প্রহরের পর প্রহর। ওদের প্রেমময় মধুর ক্ষণগুলো আমার অফিস চেম্বারে কাটিয়েছে। হাজার স্বপ্ন দেখেছে ওরা এখানে বসেই।  বিয়ে, ঘর বাঁধা, সন্তান, সংসার সব। অনেক সময় ওদের ভিতর ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে, সেগুলো আমিই মিটিয়ে দিয়েছি।

একদিন আমরা তিনজনই বসে আছি। ওদের দুইজনকেই দেখতে খুব ভালো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো কোন্ স্বপ্নের দেশ থেকে ময়ুরপঙ্খী নাও ভাসিয়ে আমার এখানে ওরা চলে এসেছে। মনে হচ্ছিলো ওরা দু'জন শতো জনমের এক রাজপুত্র আর রাজকুমারী। ওদের মায়াময় চোখে মুখে তাকিয়ে আমার মন স্নিগ্ধতায় ভরে উঠেছিলো। এতো আপন লাগছিলো যে,সেদিন তা ওদেরকেও বুঝতে দেইনি। শুধু বলেছিলাম -- 'তোমাদের বিয়ের দিনে আমি পিয়ানো বাজাবো। গাইবো আমি জগতের যতো আনন্দ সঙ্গীত। '

ইতোমধ্যে অনিকের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যায়। দুই তিন মাস বেকার ছিলো। এই বেকার সময়গুলোতে আমি ওকে আর্থিক সহায়তা করি। প্রতি দিনই আমার এখানে এসে লান্চ করতো। মৌরিও আসতো প্রায় প্রতিদিনই। এরই মাঝে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে অনিকের ভালো চাকুরী হয়ে যায়। এরপর অনিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে চাকুরীতে।  আগের মতো আর আমার এখানে আসেনা। অনিক আসেনা দেখে মৌরিও আসতো না। একসময় ওরা আসা টোটালেই বন্ধ করে দেয়। প্রথম দিকে ফোন করলে পাওয়া যেতো। পরে আর পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সিম কার্ড চেন্জ করে ফেলেছিলো।

অফিসে সময়গুলো এখন আর কাটতে চায়না কিছুতেই। মানুষের জীবনটা মনে হয় এই রকমই। জীবনের বাঁকে বাঁকে কতো মানুষ আসে। কতো মানুষের সাথে পরিচয় হয়, কতো মানুষ আবার চলে যায়। একাকীত্ব কিছুতেই ঘুচেনা। এই অফিসে বসে ক্লান্তিতে কেমন যেনো অবশ হয়ে যায় দেহ। রিভোলভিং চেয়ারে বসে জানালার পাশে প্রায়ই বসে থাকি। নীল আকাশ আর হৃদয়ে দোলা দেয়না। মনে হয় ধূসর মেঘে ছেয়ে আছে সমস্ত আকাশ।

এরপর কখন তিনটি বছর চলে গেছে বুঝতে পারি নাই। এরই মধ্যে আমার ব্যাবসার অনেক উত্থান পতন হয়েছে। শরীরটাও হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। ব্যবসাও ভালো করতে পারছিলাম না। অফিসটা তাই ছেড়ে দেই। শেষ দিনে অফিস ঘরের সমস্ত বকেয়া ভাড়াদি পরিশোধ করে মালিককে চাবি বুঝে দেই। শুধু একটি অফিস ব্যাগ হাতে করে হেটে হেটে বাসার দিকে চলে আসছিলাম। ফুটপাতের উপর দিয়ে হাঁটছিলাম, কিন্তু পা কিছুতেই সামনের দিকে চলতে চাইছিলোনা।

তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি। উত্তরা ৭ নং সেক্টরের পার্কের কাছে চলে আসি। মনটা ভালো লাগছিলোনা। ভাবলাম পার্কের ভিতরে যেয়ে পাকা বেন্চের উপর একাকী বসে থাকি কতোক্ষণ। পার্কের মূল গেট দিয়ে ঢুকে ওয়াকওয়ে দিয়ে হেটে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম। দেখি একটা ছেলে আর একটি মেয়ে তাদের দুই বছরের বাচ্চা মেয়ের দুইহাত দু'জন দুই দিক থেকে ধরে আস্তে আস্তে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটি ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে হাঁটছিলো। আমি এ দৃশ্য ওদের পিছন দিক থেকে দেখছিলাম। ওদের দেখে চিনতে পারলাম, ওরা অনিক আর মৌরি।

ওদের এই আনন্দমুখর মুহূর্তটি নিরবে দাড়িয়ে চুপিচুপি অবলোকন করছিলাম, আমার আজকের সকল মনখারাপ মুহূর্তে যেনো ভালো হয়ে গেলো। এমন হাসিখুশির দৃশ্য কিছুক্ষণ দেখে - পিছন ঘুরে হেটে হেটে পার্কের বাইরে চলে আসি।

সন্ধ্যার অাঁধার ঘনিয়ে আসছিলো তখন। ধূসর সেই সন্ধ্যার ক্ষণে ফুটপাতের উপর দিয়ে হাটছিলাম, আর ভাবছিলাম একটি দুঃখবোধের কথা  -- 'আমি তো ওদের বিয়ের দিনে বাজাতে চেয়েছিলাম পিয়ানো, আর গাইতে চেয়েছিলাম জগতের যতো আনন্দ সঙ্গীত।'

K.T
21/8/2017

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন