সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বনলতা সেন

তখন সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে জগন্নাথগন্জ ঘাট পর্যন্ত ট্রেনের যাত্রিরা স্টীমারে পারাপার হতো। আমি ঢাকায় আসছিলাম রাতের ট্রেনে। যমুনা পার হচ্ছিলাম শের আফগান নামে বড়ো একটি স্টীমারে। তখন ছিলো ভরা বর্ষা কাল। সারা যমুনার বুক জুড়ে অথৈ পানি। সেদিন আকাশ ভরা তারা ছিলো, পূর্ণিমার চাঁদ ছিলো। এমনি শ্রাবন বর্ষারাতে সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে শের আফগান স্টীমারটি ছেড়ে চলে আসে।

আমি ডেকের যাত্রি ছিলাম। তৃতীয় ক্লাশের টিকেট আমার। সিটের উপর ব্যাগটি রেখে পাশের যাত্রিকে বলে আমি বাইরে রেলিং এর কাছে চলে আসি। তারুণ্যের বাঁধ ভাঙা বয়স তখন। রাতের যমুনা দেখবার জন্য অনেকটা দৌড়ে চলে যাই রেলিংয়ের পাশে। ভরা যমুনায় পানি ছলাৎছলাৎ করছে। পশ্চিম কুল ঘেষে স্টীমারটি চলছিল। রাতের নিস্তব্ধতা আর জলের শব্দের মাঝে পাড় ভাঙ্গনের শব্দ শুনছিলাম। আমি আবার চলে আসি পূর্ব রেলিংয়ে পাশে। পূর্ব আকাশে তখন উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। জলের অনেক উপর দিয়ে চাঁদটি যেনো ভাসছে। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম চাঁদ, দেখছিলাম থৈথৈ জল, দেখছিলাম শ্রাবনের তারা ভরা আকাশ।

রেলিংয়ের পাশে দাড়িয়ে রয়েছিলাম অনেকটা সময়। তারপর আবার চলে আসি ডেকে, বসে পড়ি আমার সিটের উপরে। দেখি ঠিক আমার সামনে একজন বৃদ্ধ লোক এবং তার পাশে একটি মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি হয়তো বৃদ্ধের কন্যা হবে। তাকে একজন ছাত্রীর মতো মনে হলো। বৃদ্ধ লোকটি ক্লান্তিতে ঘুমাচ্ছে আর মেয়েটি জেগে আছে। মেয়েটি এতো কাছে মুখোমুখি বসে আছে অথচ কোনো কথা নেই। 'যেনো সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুড়ায় জীবনের সব লেনদেন। থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখী বসিবার বনলতা সেন। '

আমার ব্যাগের মধ্যে জীবনানন্দ দাশের 'বনলতাসেন'। আছে শামসুর রাহমানের 'প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে'। আছে সুনীলের 'দাড়াও সুন্দর' আর আল মাহমুদের 'সোনালি কাবিন'। সুনীল থেকে ঐ মেয়েকে বলতে ইচ্ছা করছিলো --
'স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ
ছেঁড়া পৃষ্ঠা উড়ে যায়, না-লেখা পৃষ্ঠাও কিছু ওড়ে
হিমাদ্রি-শিখর থেকে ঝুঁকে-জড়া জলাপ্রপাতের সবই আছে
শুধু যেন শব্দরাশি নেই
স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ। '

আমি ঐ মেয়েকে মনে মনে বলছিলাম চুপ করে থেকোনা মেয়ে। তোমার চোখ বনলতা সেনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সুনীলের নীরার চোখে জল থাকলেও তোমার চোখে নেই। চলো বাইরে যেয়ে দেখি শ্রাবণের আকাশ। দেখো যেয়ে যমুনার জলে কি সুন্দর ভাসছে পূর্ণিমার চাঁদ। চলো রেলিংয়ের পাশে দাড়িয়ে দুইজন চাঁদ দেখি। আকাশ ভরা তারাদের গুনগুন গান শুনি।

উপরে গুডস্ রাকে রাখা ব্যাগ থেকে 'বনলতা সেন' বইটি বের করার সময় হঠাৎ নিচে ঐ মেয়ের পায়ের কাছে বইটি পড়ে যায়। এবং বইটি উঠিয়ে সে আমার হাতে তুলে দেয়। এই প্রথম মেয়েটি আমার দিকে সরাসরি তাকালো। হঠাৎ আমার চোখের তারা যেনো থেমে গেলো তার চোখের তারায়। আমি বনলতা সেনের পাতা উল্টাতে থাকি --
'তোমার মুখের্ রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না,
খুঁজি না।
ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পান্ডুলিপি। '

স্টীমারের ইম্পেইলার যমুনার জলে গর্জন করছিলো। ইন্জিন রুম থেকে ভেসে আসছিলো যন্ত্রের বিকট শব্দ। ডেকে বসে থাকা মধ্যরাতের যাত্রিদের চোখে ঘুম তখন। সব শব্দ ভেঙ্গে ঐ মেয়েটি মৃদুস্বরে বলছিলো -- ' বনলতা সেন'কে আপনার খুব পছন্দ বুঝি? '
আমি : জ্বী।
মেয়ে :  কোথায় যাচ্ছেন?
আমি : ঢাকা। আপনারা কোথায় যাবেন?
মেয়ে :  সামনে সরিষাবাড়ী নেমে যাবো।

ইন্জিন ঘর থেকে ভেসে আসা শব্দে কথা শুনতে অসুবিধা হচ্ছিলো। আমাদের কথা বলা তাই থেমে গেলো। বনলতা সেন আর পড়তে ইচ্ছা হলোনা। রেখে দিলাম পাশের সিটের উপরে। স্টীমার গর্জন করে সামনের দিকে  চলছে। মনটা কেমন উড়ো উড়ো লাগছিলো। আবার দেখতে ইচ্ছে করছিলো রাতের আকাশ, শুনতে ইচ্ছে করছিলো যমুনার কুলকুল জলের ধ্বনি ।

দেখলাম ঐ মেয়েটি ঘুমে চোখ মুদে ফেলেছে। জানিনা সে হয়তো জাগারণে আছে, না হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সে কি ভাবছে আমার কথা? হয়তো না। আমি চলে আসি রেলিংয়ের ধারে।  চাঁদ তখন  পূর্ব আকাশ থেকে মধ্য গগনে চলে এসেছে। যে চাঁদ আমি হাসি খুশি রেখে গিয়েছিলাম, তাকে এখন বিষন্ন মনে হচ্ছে। জলের শব্দগুলিকে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা অস্ফুট কান্নার ধ্বনির মতো মনে হচ্ছিলো।

হঠাৎ আবার সেই মায়াবী কন্ঠস্বর! বলছে সে আমাকেই -- 'ঘাট আর কতোদূর?' মেয়েটি আমার পাশে এসে রেলিং ধরে দাড়ায়। আমরা দুই জনই দূরে জগন্নাথগন্জ ঘাটের বাতি খুঁজছিলাম। অন্ধকার ভেধ করে দেখা যাচ্ছিলো অনেক দূরের বাতি। আমি বলছিলাম, হয়তো আর আধা ঘন্টার মধ্যে আমরা ঘাটে পৌঁছে যাবো।

আলো আঁধারের মাঝেই আমরা দুই জন জাহাজের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছি। একটু আগে যে চাঁদকে দেখে মন খারাপ লাগছিলো, সেই চাঁদকে এখন দেখতে ভালো লাগছে। যমুনার জলের শব্দকে আনন্দ ধ্বনির মতো মনে হচ্ছে। জগতের সকল সুখ যেনো জ্যোৎস্না ধারা হয়ে ঝরে পড়ছে যমুনার জলে। ভাবছিলাম - এই মেয়েটি এই চাঁদের রাতে আমার পাশে দাড়িয়ে আছে, তাই নিজকে এতো ভালো লাগছে। আর যদি এই মেয়ে আমার সারা জীবনের জন্য হয়, না জানি কতো সুখের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে ভাসবো আমি!

আবারও মায়া জড়ানো কণ্ঠ তারই -- 'কোথায় পড়েন।?'
আমি :  ঢ়াকা সিটি কলেজে। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। বললাম -- আপনি?
মেয়েটি :  কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। এখন বন্ধ রেখেছি। কলেজে আর যাইনা।
আমি :  বন্ধ রেখেছেন কেন?
মেয়ে:  সে অনেক কথা। বলা যাবেনা।
আমি :  আচ্ছা থাক্, না বললেন। আপনার নামটি কি?
মেয়েটি:  কাকতালীয় ভাবে বলতে হয় 'বনলতা সেন।'

শের আফগান স্টীমারটির ঘাটে পৌঁছবার প্রথম দূর সাইরেন বেজে ওঠে।

আমি :  এতো সুন্দর নাম আপনার! একদম জীবনানন্দের নাটোরের বনলতা সেন যেনো!
বনলতা :  কাকতালীয় ভাবে আবারও বলতে হয় -- আমার বাড়িও নাটোরে।
আমি :   বিশ্বাস করবেন, আপনাকে দেখার পর ঠিক কল্পনার সেই 'বনলতা সেন' এর মতো আপনাকে মনে হয়েছে । আমি বিস্ময়ে আপনাকে দেখছিলাম কেবল।
বনলতা :  সত্যি তাই?
আমি :  জ্বী।

স্টীমারটির ঘাটে পৌঁছবার দ্বিতীয় সাইরেন বেজে ওঠে।

আমি বনলতা সেনকে বলছিলাম -- 'আপনার সাথে আর কি কখনো দেখা হবেনা? '
বনলতা সেন :  অবশ্যই দেখা হবে। তুমি তোমার ঠিকানাটি আমায় লিখে দাও। আমি তোমাকে চিঠি লিখবো।
আমি :  তুমি সিটে চলো। এখানে কাগজ নেই। 'বনলতা সেন' বইটির পাতায় আমার ঠিকানা লিখে তোমাকে দিয়ে দিব।

শের আফগান স্টীমারের ঘাটে পৌঁছার শেষ সাইরেনটি বেজে ওঠে।

এতোক্ষণে সেই বৃদ্ধ লোকটি বনলতা সেনের কাছে চলে আসে, এবং ধমকের সুরে বলে -- 'বৌমা, তুমি এখানে কি করছো? চলে এসো'।

স্টীমারটি তখন নোঙ্গর ফেলেছে। যাত্রিরা নামবার জন্য সবাই ছুটাছুটি করছে। একে একে সবাই নেমে যায়। আমার আর নামতে ইচ্ছা করছিলো না। ঠাঁয় রেলিং ধরে দাড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি -- পূর্ণিমার চাঁদ আর সেখানে নেই। ডুবে গেছে, না হয় মেঘে ঢেকে গেছে। রাতের গায়ে কেমন যেনো আধার নেমে আসছিলো। শেষ যাত্রিটি হয়ে আমি স্টীমারের সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নামতে থাকি।

'হঠাৎ ভোরের আলোর মুর্খ উচ্ছাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব'লে বুঝতে পেরেছি আবার,
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুনির্বার বেদনা
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে।''

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন