সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২০

এক চন্দ্ররাত্রির কথা

এক চন্দ্ররাত্রির কথা 

চরের নাম খানুরবাড়ি। এটি যমুনা নদীর একটি দূর্গম চর। সেই কত বছর আগে যমুনা বক্ষে এই চর জেগে উঠেছিল, কেউ বলতে পারে না। একসময় এই চর ধু-ধু বালুতে খা-খা করত। তারপর এখানে কাশবনে ছেয়ে  যায়। প্রতি হেমন্তে সাদা ফুলের সৌরভে ভরে উঠত চরের প্রাঙ্গণ। কিছু সৌরভ তার অবলোকন করত দূরগামী লঞ্চের যাত্রীরা। আর কিছু এর শোভা  উপভোগ করত গয়না নৌকায় পারাপার হওয়া মানুষেরা।

কালক্রমে এই চরটিতে  নদী ভাঙনের ঘরহারা কিছু জেলে এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। এর সংখ্যা বিশ পঁচিশ ঘর জেলে পরিবারে দাঁড়ায়। ওরা বন্যা, জল জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করে এখানে  বসবাস করে আসছে সে অনেক বছর যাবৎ। 

এই চরে যে জেলেরা বসবাস করে তারা সবাই নিম্ন বর্ণের হিন্দু শ্রেণির। এরা যমুনা থেকে মাছ ধরে নদীর ওপারে বিভিন্ন হাট বাজারে গিয়ে বিক্রি করে। এদের চলাচলের একমাত্র বাহন হচ্ছে ছোট ডিঙি নৌকা। এরা খুবই গরীব। খুবই দুঃখ দূর্দশার জীবন এদের। এবং সবাই অশিক্ষিত। 

সব অশিক্ষিতের ভিতর এই চরের জগাই মাঝির ছেলে কার্তিক একমাত্র শিক্ষিত ছেলে। কার্তিক ভূয়াপুর ইব্রাহিম খাঁ কলেজে বিএ পড়ে।  জগাই  মাঝি খুব কষ্ট করে ছেলেটাকে লেখা পড়া করায়। খানুরবাড়ি  চরে কোনো স্কুল নেই।  জগাই মাঝি  নিজে ডিঙি নৌকা বেয়ে  চর গাবসারা স্কুলে আনা নেওয়া করে ছেলেকে পড়িয়েছে। কার্তিক এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়। ভূয়াপুরে একটি দোকানে গোমস্তার কাজ করে, এবং সেখানে থেকে কলেজে ক্লাস করে।  ছুটিতে বাড়ি এলে সে বাবাকে সাহায্য করে।  নদীতে যেয়ে মাছ ধরে এবং  ডিঙি বেয়ে হাট বাজারে যেয়ে মাছ বিক্রি করে। যখন কার্তিক এসব করে তখন আর তাকে ছাত্রের মতো মনে হয় না।  মনে হয় কার্তিকও একজন জেলে। 

ছেলেটি খুবই লক্ষী। দেখতেও খুবই সুন্দর। চরের সবাই  ওকে পছন্দ করে এবং ভালোবাসে। জেলে পুঞ্জির নিতাই হালদারের মেয়ে কমলা কার্তিককে খুব পছন্দ  করে। কমলার নাম কমলা হলেও ওর গায়ের রং ছিল কালো। সে ছিল উঠতি যৌবনের।  ভরা বর্ষা মাসের উদ্দাম  যৃুমুনার মতো ডবকা শরীর গঠন তার। 

কমলা কার্তিককে দাদা ডাকত। একদিন চরের বালুকাবেলায় কার্তিক ছেঁড়া জাল সেলাই  করছিল। কাছাকাছি কেউ নেই। আষাঢ়ের রোদ্দুর এসে পড়ছিল কার্তিকের উদোম গায়ে। ওর শরীরের ধবল চামড়া চিকচিক করছিল। কমলা কার্তিকের কাছে চলে এসে পিছনে দাঁড়িয়ে ডাক দেয় -- কার্তিক দাদা। 
-- কী। 
-- তুমি আমাকে পছন্দ করো না? 
-- করি। 
-- আমাকে ভালো বাসো না? 
-- বাসি। 
-- আমাকে বিয়া করবা না? 
-- না। 
-- আমি দেখতে কালো এই জন্য? 
-- না। 
-- তো কী জন্য ? 
-- তোকে বিয়া করব এই কথা ভাবি নাই কখনও।
-- তোমার ছেলেবেলার কথা মনে নাই?
-- কী কথা? 
-- আমাদের খেলার সাথীরা খেলার ছলে তোমার সাথে আমার বিয়া দিয়েছিল। মাটির সিঁদুর তুমি আমাকে সিঁথিতে পরিয়ে দিয়েছিলে? মনে  নাই? 
-- ওটা ছিল খেলার ছল। 
-- কাশবনের আড়ালে আমাদের বাসর ঘর হয়েছিল,  মনে আছে তোমার ? 
-- খেলাঘরের বাসর। ভেঙে গেছে তা। 
-- তুমি আমার মন ভাঙতে পারো নাই। আমি সে কথা মনে রেখেছি। তুমি আমার মন ভেঙে দিওনা। 
-- আমার কিছু মনে নাই।  তুই এখান থেকে চলে যা। আমাকে  কাজ করতে দে। 

কমলা চলে যায়। 

আর একদিন  সন্ধ্যায় কার্তিক চরে নদীর কুলে কাঁকড়া ধরতে যায়। কমলা তা দেখতে পায়।  অনেক সময় গড়িয়ে যায়, কার্তিক আর ফেরে না। আস্তে আস্তে রাত হতে থাকে।  আকাশে ত্রয়োদশী চাঁদ ওঠে।  কমলা চুপিচুপি ঘর থেকে বের  হয়। সে কার্তিকের খোঁজ করে । রাতের নির্জনে চলে যায় যমুনা কুলে। পথে বন্যার মতো ফিরকি দিয়ে  পড়ছিল চাঁদের আলো। কমলা সে আলোয় পথ চিনে চলে যেতে থাকে নদীর কুলে। সে দেখতে পায় কার্তিক বাড়ির দিকে ফিরে আসছে। কমলা কার্তিকের পথ রোধ করে দাঁড়ায়।  কার্তিক কমলাকে বলে -- তুই এখানে? 
-- আমার ভালো লাগছিল না। তাই তোমাকে খুঁজতে  চলে এসেছি।
-- চল্ বাড়ি চল্। 
-- না, যাব না। 
-- পাগলামি করিস না। 
-- আমাকে মেরে দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে আসো। 
-- চল্ কমলা! 
-- এই রাত, এই জোছনা, আমার এই দেহ তোমার। তুমি নাও। 
-- না। 
 -- না, তোমার সব নিতে হবে। 

কার্তিক সেদিনের সেই সন্ধ্যা রাত্রিতে শিউলি ফুলের মতো স্নিগ্ধতাময় চাদের আলো আর কমলার উদ্দাম দেহ কোনোটাই উপেক্ষা করতে পারেনি। 

সে রাতে কার্তিক ঘরে ফিরতে ফিরতে কমলাকে বোঝায়েছিল -- এসব কিছুই মনে রাখিস না কমলা। সবই ক্ষণিক আনন্দ।  তুই আমাকে ভুলে যাস্। 

কয়েকদিন পর কার্তিক ভুঁয়াপুর চলে যায়। ওখানে ওর কলেজ খুলে যায়। কার্তিক পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। তারপরও প্রায়ই মনে পড়ে কমলার কথা। মনে পড়ে তার এক উদ্ভাসিত চন্দ্র রাত্রির কথা।  দুরে থিরথির করে কাঁপছে  যমুনার জল। গন্ধ আসছিল জীর্ণ পঁচে যাওয়া কাশবনের পাতার ঘ্রাণ। সে ভাবছিল --- কমলা সত্যি কী কালো?  শরীর বৃত্তের কোনো কিছু আমি কালো দেখিনি তার । ভিতরের আনন্দ ধাম সব একই রকম। কালো গোলাপ আর শুভ্র-প্রস্ফুটিত গোলাপ দুটোর সুবাস একই। দুটোই সেদিনের সেই ত্রয়োদশী বিচ্ছুরিত জোছনার মতো পুণ্যময়। 

প্রায় মাস দুয়েক পর কার্তিক খানুরবাড়ি চরে ফিরে আসে। ফিরে এসে প্রথম ওর মায়ের কাছে থেকেই জানতে পারে কমলার বিয়ে হয়ে গেছে।  খানুরবাড়ির চর থেকে একমাইল দুরে চর তেতুলিয়ার সুখেন মাঝি কমলাকে বিয়ে করে নিয়ে গেছে। সুখেন মাঝির আরও দুই বউ আছে।  বয়স তার পঞ্চাশোর্ধ্ব। 

কার্তিকের মা কার্তিককে বলে -- তুমি  স্নান করে আসো, খেয়ে নাও। 

কার্তিক স্নান করে এসে খেতে বসে। কিন্তু  পুরো ভাত খেতে পারল না। সে হাত ধুয়ে ঘরের ভিতর চোকিতে যেয়ে  শুয়ে পড়ে। সে ভাবছিল -- আমার কেন কমলার জন্য মন খারাপ লাগছে। আমি তো ওকে কখনোই ভালোবাসি নাই। কবে কোন্ এক সন্ধ্যা রাত্রিতে অসংখ্য তারার আকাশের নীচে, উচ্ছ্বসিত জোছনায় ভিজে একজন সামান্য কালো মেয়ে আমাকে না হয় একটু জৈবিক আনন্দ দিয়েছিল, আনন্দ তো আনন্দই -- ফুরিয়ে গেছে তা।  এই নিয়ে মনখারাপের কিছু নেই। এ তো আর প্রেম নয়। ওকে কী আমি হারিয়েছি? আফসোস করব না নির্বোধের মতো। 

বিকালে একাকী চরের মধ্যে কার্তিক হাটঁতে বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে যায় নদীর কুলে। নদীর তীরে বসে কিছুক্ষণ জলের ধ্বনি শোনে। কিন্তু  ভালো লাগছিল না জলের শব্দ।  উঠে চলে যায় বালুচরের তীর ধরে আরও  দুরে। চরের শেষ মাথায় একটি ছোনের কুঁড়ে ঘর দেখতে পায়। সেখানে ঘরের দুয়ার ধরে একটি যুবতী  জেলে বউ একাকী দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ব্লাউজ নেই। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে বুক।  কার্তিক তাকে চিনতে পারে না। যুবতী বউটি  কার্তিককে বলে -- তুমি আমাকে চিনতে পারছ না ঠাকুর পো?  আমি তোমাদের জুরান মাঝির বউ। 

-- ও আচ্ছা। চিনতে পারছি। তা জুরান দাদা কোথায়? 
-- সে মাছ বিক্রি করতে গঞ্জে গেছে । 
-- আচ্ছা, যাই। 
-- আসো না ঠাকুরপো ঘরে, এসে বসো। পান খেয়ে যাও। 
-- পান খাই না আমি । 
-- কাচা ডাঁসা পিয়ারা আছে। দুটো পিয়ারা খেয়ে যাও। 
-- পিয়ারাও খাই না। যাই। 

কার্তিক বাড়ির দিকে ফিরে আসে। পথে  ফিরতে ফিরতে সেদিনের মতো আজও রাত হলো। কিন্তু আজ আকাশে কোনো চাঁদ নেই।  কিছু তারা জ্বলছে একাকী বিচ্ছিন্ন ভাবে। আজ আর কেউ এসে পথের মাঝে পথ রোধ করে দাঁড়াল না।  বলল না -- 'ঘরে ফিরে যাব না।'  সেই একই পথ, একই বালিয়াড়ি। ঝিঁঝি ডাকছে সেদিনের মতোই। কী এক শুন্যতা চারদিকে।  মানুষের জীবনের ফেলে আসা দুএকটি আনন্দময় ক্ষণ এত বেদনার হয়ে ফিরে আসে?  

ঘন হয়ে রাত নামে আরও গভীর হয়ে।  সারা চরাচর আঁধার করে আকাশ যেন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। একি ! হৃদয় তন্ত্রীতে এ কেমন ব্যথার প্রদাহ হচ্ছে , দুচোখ বেয়ে কেন এমন জল বয়ে পড়ছে আমার। ভাগ্যিস এই রাত গভীর অন্ধকারে ঢাকা।  তাই এই জল কেউ দেখতে পেল না !

তারপর চলে গেছে পাঁচটি বছর। কার্তিক ইতোমধ্যে  বিএ পাশ করে  একটি সরকারি চাকুরিতে ঢোকে। ওর বাবা স্বর্গীয়  হয়ে যান। সে জেলে পেশা ছেড়ে দিয়ে মাকে নিয়ে চিরদিনের জন্য ঢাকায় চলে যায় । বিয়েও করে সে। ঘরে তার রূপময়ী স্ত্রী আছে।

এই শহরে বসে এখনও সে শুনতে পায় দুরের যমুনার কলকল জলের ধ্বনি। ছোট ডিঙি নৌকা বেয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছে মাঝ নদীতে। হয়ত এখনও খানুরবাড়ি চরে  প্রতি হেমন্তে কাশফুল ফুটে থাকে। হঠাৎ কখনও সব জলের শব্দ স্তব্ধ হয়ে যায় -- একটি কালো মেয়ে মলিন কাপড় পরে কাশফুল সরিয়ে সরিয়ে ঘাটের দিকে চলে আসছে -- সে হয়ত অপেক্ষায় থাকে কোনো এক জেলের ছেলে ডিঙি নৌকা ভাসিয়ে চলে আসছে এই চরে, এই ঘাটে ! 

ওই পুণ্যসলিলা যমুনার নদী, ওই শুভ্রনীল  দিগন্তরেখা,  ঐ কাশবনে এখনও হয়ত সেদিনের সেই ত্রয়োদশী চন্দ্রের স্নিগ্ধতার মতো রাত্রি নামে। কার্তিকের  জীবনে কমলা একটা মধুর স্বপ্নের মতো। বেদনায়, স্মৃতিতে, অনুভূতিতে নীরব দীর্ঘশ্বাসের মতো। নাহ্ -- এই সবই তার কোনো ভ্রম না।




~  কোয়েল তালুকদার
২০ অক্টোবর, ২০২০ ইং
ঢাকা।