১. গীতসুধারসে এসো
একদিন আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটি ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজটি ছিল একটি মেয়ের। মেয়েটি লিখেছে -- "আমার নাম কঙ্কণা। কেউ কেউ আমাকে কঙ্কণ ও কঙ্কা বলে ডাকে। একজনই শুধু আমাকে কঙ্কাবতী বলে ডাকতো সে কোন্ জন তা পরে একদিন আপনাকে বলব।
তার আগে বলে নেই, আপনি আমাকে চেনেন না। কোনোদিন দেখেননিও। আমিও আপনাকে দেখেনি। ফেসবুকে আপনার লেখা আমি পড়ি। আপনি অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প লিখেন, আমি আপনার একজন মুগ্ধ পাঠিকা। আপনার অনেক গল্প আমি বহুবার পড়েছি। কত গল্পে আপনি যে আমাকে কাঁদিয়েছেন। সে কান্নার কথা কেউ জানেনা। আপনিও না।
আপনার গল্প পড়ে পড়ে মনে হয়েছে আমার কিছু কথা আপনাকে বলব। আমার জীবনের কিছু কথা আপনার গল্প হয়ে থাক্। আমি গল্পকার নই, নই কথাকারও। আপনার মতো করে গুছিয়ে আমি লিখতে পারব না আমার কথা। তাই আপনার কাছে এই লেখা, আমার এই নিবেদন।... "
আমি কঙ্কণাকে উত্তরে লিখলাম -- আমার কাজই তো মানুষের জীবন কাহিনি নিয়ে গল্প কিংবা উপন্যাস লেখা। আপনি বলতে পারেন দ্বিধাহীন ভাবে সব কথা। আমি আপনার জীবন কথা নিয়ে লিখব গল্পকথা।
কঙ্কণা লিখল -- " আমি হয়ত সব কথা একদিনে একই সময়ে লিখতে পারব না। দু একদিন পরপর বলব। আর আপনি যেন বিরক্ত না হন।... "
আমি বললাম -- আপনি যে রূপ মনে করেন, যেভাবে বলতে চান, সেইভাবেই লিখবেন। আর আমি লিখব আপনার কথা গল্পের মতো করে। সত্য বললে সত্য কথাই লিখব, মিথ্যা বললে মিথ্যা কথাই লিখব।
আমি কঙ্কণাকে আরও বললাম -- সবচেয়ে ভালো হয়, আপনি আপনার কথাগুলো এখানে লিখে রাখবেন আপনার সুবিধা মতো সময়ে। আর আমি আমার সুবিধা মতো সময়ে আপনার কথাগুলো পড়ে গল্পের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করব।
কঙ্কণা লিখল -- আচ্ছা, তাই হবে। তবে একটা ব্যাপারে আমাকে মার্জনা করবেন তাহলো -- আমার প্রকৃত পরিচয়টি আমি ইচ্ছা করে গোপন রাখছি আপনার কাছে। যদি কখনও মনে হয় আমার প্রকৃত পরিচয় আপনাকে বলা দরকার, -- তখন বলব আমার পরিচয়। আপনি যেন তার আগে জানতে না চান আমার পরিচয় । তাহলে আমি খুব বিব্রত হবো।
আমি কঙ্কণাকে বললাম -- তাই হবে। আপনি আমার কাছে শুধু কঙ্কণা। কঙ্কণ, কঙ্কা কিংবা কঙ্কাবতীও নন্। আমি আপনাকে আমার গল্প লেখা পর্যন্ত কঙ্কণা বলেই ডাকব, কঙ্কণা বলেই জানব। আপনার কথা বলা যেদিন শেষ হবে, আর আপনার কথাগুলো নিয়ে আমার গল্প লেখাও যেদিন সমাপ্ত হবে , সেদিন থেকে এই নাম, এই কঙ্কণা উপাখ্যানও আমার কাছে শেষ হয়ে যাবে। আপনি হারিয়ে যাবেন আপনার পৃথিবীর কোনো জনারণ্যে। আর আমি হারিয়ে থাকব, অন্য কোনো এক কঙ্কণার জীবন কাহিনি নিয়ে গল্প লেখার জগতে। আপনার সাথে এই কথকতা, রাত জেগে আপনার এই কথা শোনা, আর আপনাকে নিয়ে এই গল্প লেখারও পরিসমাপ্তি ঘটবে।
কঙ্কণা লেখে -- এমন করে বলবেন না। খুব কোমল প্রাণের মেয়ে আমি। কোনো কিছুতে একটুতেই আমার কান্না পায়।
আমি বললাম -- ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব আমার কোনো আচরণে আপনাকে যেন কাঁদতে না হয়। তো, শুরু করুন আপনার জীবন কাহিনি বলা...।
কঙ্কণা লিখল -- ঠিক আছে, আমি লিখে রাখব আমার কথা এখানে। তবে জীবনের সব কথা তো লেখা সম্ভব না। আমি লিখে রাখব জীবনের কিছু খণ্ডিত অধ্যায়ের কথা। কিছু সুখ দুঃখের কথা, কিছু বঞ্চনা ও আক্ষেপের কথা।...
কঙ্কণার সাথে সেদিনের মতো ম্যাসেজিং শেষ হয়।
একদিন দেখি -- কঙ্কণা ওর কিছু কথা লিখে রেখেছে। অনেকটা পয়েন্ট আউট করে লিখেছে। কথাগুলো এলোমেলো ও অগোছালোও। অনেক কথার ইঙ্গিত আছে, কিন্তু বর্ণনা নেই। সংলাপগুলোও কেমন ভাঙা ভাঙা।
আমি কঙ্কণার সেদিনের কথাগুলো গুছিয়ে গল্পের মতো করে এখানে লিখলাম। কঙ্কণা যা লিখেছে সব ঠিক আছে। শুধু প্রকৃতি, নিসর্গ, মানুষ, স্থান, কাল, পাত্র একটু হেরফের করা হয়েছে। কঙ্কণা যা লিখেছে ঠিক তেমনটি নয়। আমার ধারণা কঙ্কণাও ইচ্চাকৃতভাবে অনেক কথা আড়াল বা গোপন করার চেষ্টা করেছে। আমি কেবল কঙ্কণার কথাগুলো, উত্তম পুরুষে কঙ্কণার হয়ে এখনে লিখলাম।
২.
মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ের কোল থেকে ধিতাং ধিতাং বালিকার মতো এঁকেবেঁকে একটি নদী চলে এসেছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের দিকে। ওপারে ওর যেই নামই থাক, এপারে এই নদীটির নাম কর্ণঝরা। কর্ণঝরার আরও কতগুলো বোন আছে, যারা একই মায়ের গর্ভে জন্ম। ওদের মা'ও খাসিয়া পাহাড়। এই খাসিয়ার অন্য মেয়েরা হচ্ছে ভোগাই, কংস ও সোমেশ্বরী।
খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া থেকে মেঘ বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ে কত ঝর্ণা যে নদী হয়েছে। পাথর, বালু,মাটি, বৃক্ষ, লতাগুল্ম চিরে চিরে বয়ে এসেছে তারা সমতলের দিকে। কত হাজার বছর ধরে চলে এসেছে এই স্রোতধারা, কে তার কতটুকু জানে। এরই একটি ধারা কর্ণঝরা। এই কর্ণঝরা নদীর তীরে ছবির মতো একটি গ্রাম নাম তার হাঁসুলিগাঁও।
আমি সেই হাঁসলিগাঁওয়ের মেয়ে কঙ্কণা।
আমাদের বাবা চাচা'রা ছিলেন বিত্তবান কৃষক পরিবারের মানুষ। গোলাভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ ছিল আামাদের। আমাদের বাড়ি ছিল ফুলে ফলে বৃক্ষ শোভিত। ছিল নানা জাতের ঔষধি গাছও। বাড়ির সামনে পুকুর। পুকুরের পর শস্য ক্ষেত। তারপর কর্ণঝরা নদী।
এই নদীর পারে আমি বেড়ে উঠতে লাগলাম। বালিকা এখানে গোল্লাছুট খেলতো। মাথার দু'বেণী দুলিয়ে এক্কা দোক্কা খেলতো। আমগাছের পাতা আর বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে আসা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সন্ধ্যা রাত্রিতে 'পলাতকা' খেলা খেলতো খেলার সাথীদের সাথে। খেলতে খেলতে একদিন বালিকা তরুণী হয়ে উঠল।
আমাদের বাড়ির উঠোনের একপাশে ছিল ফুলের বাগান। ওখানে ছিল বিভিন্ন রকমের ফুল। জুঁই, কনকচাঁপা, রক্তজবা, কামিনী, গাঁদা, বেলী, গন্ধরাজ, সন্ধ্যা মালতী ও রংবেরঙের পাতাবাহার। লোকে বলত কঙ্কণা নাকি ঐ বাগানের একটি ফুল। কেউ বলত আমি নাকি কনকচাঁপার মতো দিনে দিনে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছি। কেউ বলত কঙ্কণা একদম রক্তজবার মতো রক্তিম। কেউ বলত সন্ধ্যামণির মতো সুবাসিত।
পড়তাম গ্রামের স্কুলে। কোনো বালিকা বিদ্যালয় তখন ছিল না ওখানে। আমাদের স্কুলে ছেলেমেয়ে একসাথে পড়াশোনা করত। তবে নিয়ম ছিল কঠিন। মেয়েরা কথা বলতে পারত না ছেলেদের সাথে। কমনরুম থেকে স্যারদের পিছে পিছে ক্লাসে যেতাম। ক্লাস শেষে আবার কমনরুমে ফিরে আসতাম। কোনো ছেলের সাথে কথা বললে অভিভাবকদের জানিয়ে দেওয়া হতো। স্কুল থেকে বের করে দেওয়ারও নিয়ম ছিল। তাই কারোর সাথে কথা বলার সাহস করতাম না আমি।
আমি যখন ক্লাস নাইনে উঠি তখন আমাদের ক্লাসে একজন নতুন ছাত্র এসে ভর্তি হয়। নাম মাইনুল ইসলাম। ছেলেটি দূর গ্রামের। ওর বাবা একজন গরীব দিনমজুর। প্রায় তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে এসে সে ক্লাস করত। ছেলেটি ছিল মেধাবী। ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছে। ছেলেটির গায়ের রং শ্যাম বর্ণ। চুল কোঁকড়ানো। লিকলিকে লম্বা ধরনের। চোখ দুটো মায়াময়। কেন জানি দূর থেকে দেখে ছেলেটিকে আমার খুব ভালো লাগল।
আমি ক্লাসে বসে ছেলেটিকে চুপিচুপি খুঁজতাম কোথায় কোন্ বেঞ্চে বসে আছে। হয়ত দেখতে পেতাম কোনো কোনো দিন। আবার দেখা পেতাম না কোনো দিন। যেদিন দেখতে পেতাম না সেদিন খুব মন খারাপ করে বাড়ি চলে আসতাম। পথে আসতে আসতে পা চলত না, পা অবশ হয়ে থেমে যেত পথের উপরে। মনে হতো, আহা! ঐ ছেলেটি এসে যদি আমার সাথে পায়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটত, তবে পথের উপর এমন করে পা আমার থেমে যেত না।
বাড়িতে খুব মনমরা হয়ে থাকতাম। কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করত না। মা জিজ্ঞাসা করত -- কঙ্কণ, তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগে? '
আমি বলতাম -- না মা, কিছু হয়নি আমার।
আমি যে ঘরে শুতাম, ঠিক আমার বিছানার পূর্ব দিকে একটি জানালা আছে। জানালার একপাশে লাগোয়া পড়ার টেবিল। আমি একদিন সন্ধ্যা রাতে হেরিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসেছি। পড়ার মন বসছিল না! জানালাটা খুলে দেই। দেখি - বাইরে আলো আর অন্ধকার একসাথে মিশে আছে। আঁধারের মাঝে যে আলো তা ছিল চাঁদের আলো। রাতের আকাশ যেন ছুঁয়ে আছে নিঃশব্দে আকন্দ গাছের ঝাড় পাতায়। জ্যোৎস্নার এই চন্দনমাখা স্বর্গীয় ক্ষণে চোখ মেলে অনেক দূরে আবছা আবছা দেখতে পেলাম ঐ ছেলের মুখ, রাতের তারার মতো চেয়ে আছে যেন আমারই দিকে। এই বিরাট আলো আঁধারের বিশ্বজগতে কতকিছুই অদৃশ্যমান, কত প্রাপ্তিতা অপ্রাপ্তি হয়ে হারিয়ে যায়। একজন অবুঝ তরুণী কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে কী চেয়ে বসল বিধাতার কাছে, তা কী বিধাতা আমার করে দেবে?
দূরে কর্ণঝরা নদী থেকে বয়ে আসছিল শীতল বাতাস, জানালা দিয়ে প্রবেশ করছিল কাঁচা দুধের মতো ফিনকি দিয়ে জোছনা। কাউকে দু'কলম লিখতে ইচ্ছে করছিল খুব। কোনো কবিতা বা গানের পংক্তি নয়, ছোট্ট একটি চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছে। ভাবছিলাম, একটি চিঠি লিখে রাখি কাছে। বইয়ের পাতায় সেই চিঠি গোপনে রেখে দেব। যদি কখনও সুযোগ আসে চিঠিখানি দিয়ে দেব ঐ ছেলেকে।
কল্যাণীয়ষু
খুব ভালো লাগে তোমাকে। এত ভালো লাগে যে, জনম জনম তোমাকে কাছে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছা করে। তুমি এসো গো আমার জীবনে। 'প্রাণের হিল্লোলে এসো'। জনম জনমকাল ধরে অপেক্ষা করব।
-- কঙ্কণা।
হেরিকেনের পুষ্পিত আলোয় কী লিখলাম! অক্ষরগুলোর গায়ে লেগে আছে যেন কনকচাঁপার পুষ্পবর্ণাভা। বাইরে তখন চাঁদ ডুবছে নিভছে। চরাচর জুড়ে বিষণ্ণ আঁধার আর ম্লান আলো। আকাশের তারা'রা জ্বলছে নিভছে। কর্ণঝরা নদী থেকে বয়ে আসা শীতল বাতাস হঠাৎ থমকে গেল যেন । কুমারী মেয়ের কুন্তলের মতো নৈঃশব্দ্য এসে ঘরটি ভরে গেল। বুকের তলায় দীর্ঘশ্বাস জট পেকে ধরল। আকাশে কোথাও আর দেখতে পেলাম না মণিনীল নক্ষত্র।
৩.
ছেলেটি অপার্থিব মাধুর্যের রূপ ধারণ করে ক্ষণে ক্ষণে ছায়ামূর্তি হয়ে আমার চোখের সামনে এসে ভাসতে থাকে। কখনও সন্ধ্যার আকাশের অপরূপ শোভায়, কিংবা কখনও দূরের খাসিয়া পাহাড়ের ধূসর মেঘের ছায়ায়, কর্ণঝরা নদীর কুলকুল কলতানের মধ্যে -- ওর অস্তিত্ব অনুভব করতে থাকি। মনে হয়, অনেক দূর থেকে সুর ভৈরবীর তানে হেঁটে হেঁটে সে আমার দিকে আসছে। আমি কান পেতে ওর আগমনের পদধ্বনি শুনছি। আমার অবুঝ অবলা মন কেন যে ওর মাঝে থিতু হলো, কী এমন ঐশ্বর্য দেখতে পেয়েছিলাম, যা আমি চাইলাম এমন আকুল করে।
মাইনুল ছিল পল্লী গ্রাম-নিবিড়ের প্রস্ফুট বন-কুসুম-গন্ধ ছড়ানো একটি সহজ সরল তরুণ। তাই তো ওকে আমি এমন পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম
আমার লেখা চিঠিখানি ভূগোল বইয়ের পাতায় পুরনো হয়ে পড়ে থাকে প্রায় দেড় দু'বছর। এতদিনেও মাইনুলকে চিঠিটি দেওয়া সম্ভব হয়নি। মাঝের সময়ে টুকটাক ওর সাথে যদিও কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে স্কুলের বারান্দায় কিংবা পথের উপরে। কিন্তু চিঠিটি ওকে দিতে পারিনি। আমার ভালোলাগার কথাও বলার সুযোগ হয়নি কখনও। সবসময় কেউ না কেউ আমাদের কাছাকাছি থেকেছে।
কেমন করে কখন স্কুল জীবনের এতগুলো দিন চলে গেল! কত বিরহে কত অপেক্ষায় সময় করেছি পার। মাঝে মাঝে অজানা আশঙ্কায় মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। ভাবতাম -- যা চাইছি তা পাব তো?
একসময় আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে। ক্লাসও বন্ধ হয়ে যায়। স্কুল থেকে আমাদের ফেয়ারওয়েল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেই বিদায় অনুষ্ঠানে ছাত্র- ছাত্রীদের পক্ষ থেকে মায়নুল খুব সুন্দর বক্তৃতা দিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে বিদায়ী সহপাঠীদের সাথে আমাদের একে অপরের কথা বলার সুযোগ হয়। কথা বলি আমি মাইনুলের সাথেও --
-- পাস করার পর তুমি কোথায় ভর্তি হবে?
-- জানি না কোথায় ভর্তি হবো। পড়ার আর ভাগ্য হবে কী না তাও জানি না।
-- পড়া থামিয়ে রেখ না।
-- তুমি কোথায় ভর্তি হবে?
-- ময়মনসিংহ।
-- আচ্ছা। ভালো ভাবে লেখা পড়া করবে। ভালো থেকো। তো যাই এখন।
মাইনুল খুব তাড়াহুরো করছিল, অস্বস্তি ও বিব্রতও হচ্ছিল লজ্জায়। আমি আস্তে করে ওকে বলি -- 'যেওনা তুমি। একটু দাঁড়াও।' আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যাগ থেকে দু'বছর আগের লেখা সেই পুরনো চিঠিটি বের করে ওর হাতে দেই এবং বলি -- বাড়িতে যেয়ে এটি পড়বে।
বাড়িতে যেয়ে মায়নুল চিরকুটটি পড়েছিল হয়ত কোনো প্রদীপ জ্বালা সন্ধ্যার আলোয়। হয়ত পুলকিত হয়ে উঠেছিল আমার মতো একজন প্রস্ফুটিত রক্ত জবার উন্মত্ত ভালোবাসার এমন নিবেদন দেখে! একটি মেয়ের এমন প্রাণ হিল্লোল দেখে, এমন দ্যুতি ছড়ানো অরুণ আলো!
তারপর কর্ণঝরা নদীর জল গড়েছে ব্রহ্মপুত্র নদীর দিকে। কত বাঁকে স্রোত হয়েছে ধীর, খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় থেকে বয়ে এসেছে কত হিমেল বাতাস, আমি ওকে পেয়েছিলাম আমার জীবনের সকল গ্লানি ও যাতনাকে হারিয়ে দিয়ে। সে যে সত্যি এসেছিল প্রাণের হিল্লোলে। সেই তরুণী বয়সের সপ্তরঙের রঙধনুর মতো অতীত দিনের কত কথা মনে পড়ে আমার। কত কম্পিত প্রেম দান। কেন যে মাইনুলের উপর মাঝে মাঝে এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করতাম। সেসবের জন্য অনুশোচনাও করি। কত কথা মনে পড়ে, কত বেদনায়, কত দীর্ঘশ্বাসে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু জল ঝরে পড়ে।
মাইনুলের সাথে আমার জীবনের প্রকৃত ঘটনাটা আমি ব্লাক আউট করলাম। মানুষের জীবনের কিছু অন্ধকার পর্যায় থাকে, সেই অন্ধকারের কথা একান্তই তার একার। সেই অন্ধকারের কথা কাউকে বলা যায় না। তারপরও যদি সম্ভব হয় আমি বলব সেই আঁধারের কথা।
শুধু এইটুকু বলছি -- আমার সেই অল্প বয়সের কুমারী জীবনের পূর্ণচ্ছেদ পড়েছে অনেকদিন আগেই। তবু সে-সব দিনের কিছু আনন্দ বেদনার মুহূর্তগুলোর জন্যে এখনও মাঝে মাঝে মন কেমন করে ওঠে। সেই সারল্যমুখর স্মিত মুখ, সেই পূর্ণিমা ঝালরের আলো মাখা স্বর্গীয় রাতের বিমুগ্ধ ক্ষণ, হারানো সেই সুখস্মৃতির জন্যে আক্ষেপ করি। শুধু ভাবি, যা পেয়েছিলাম তা সত্যি করেই পেয়েছিলাম। মানুষ অনেক কিছুই পায়, তা আবার ফুরিয়েও যায়। শূন্য হয়ে গেলে আবার পাওয়ার আশায় পথে নামে। কোনো অচেনা পথিক অকাতরে কিছু দেওয়ার জন্য হয়ত দাঁড়িয়ে পথের উপর আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এখন শুরু করব আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের কথা। 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি' র মতো কেউ কী আমার সেই জীবনে প্রাণের হিল্লোল তুলে এসেছিল? আবার কী ভেঙেচুরে রক্তক্ষরণ হয়েছিল আমার হৃদয় মন?
৪.
কর্ণঝরা নদীর স্বচ্ছ জলের উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে আমি এসে পড়েছিলাম আরেক রূপবতী নদী ব্রহ্মপুত্রের উদ্দাম বুকে। নাহ্, ঠিক জলে নয়। এর কূলে একটি শহরে। জীবনের যত ঝড় ঝাপটা এর কূল দিয়েই বয়ে গেল আমার। গ্রামের একটি লাস্যময়ী তরুণীর জীবন হঠাৎ কঠিন দুর্মর ব্যাথা বেদনার ভরে উঠল। এক করুণ কাব্য গাঁথা রচিত হলো এই শহরে।
ময়মনসিংহের সরকারী মমিনুন্নিসা মহিলা কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। থাকতাম ছাত্রী হোস্টেলে। সারা শরীরে তখনও গ্রামের রোদ্র তাপের তামাটে দাগ। ভেজা চুল থেকে গন্ধ বের হতো কর্ণঝরার জলের। বেণীর ভিতর থেকে খুঁজে পাওয়া যেত হাঁসুলীগাঁওয়ের বন মল্লিকার শুকনো পাপড়ি।
এখানে এসে পড়াশোনা করছিলাম ভালোই। ইন্টারমিডিয়েট পাস করি ভালো রেজাল্ট নিয়ে। আর এখানেই কী না ঘটে গেল আমার জীবনের এক কলুষিত ঘটনা। কলুষিত হলো ব্রহ্মপুত্রের জল। আমার এই জীবন ব্যথার মর্মর কথা জেনেছিল ব্রহ্মপুত্র নদীর জল, নদীর উপরের রাতের আকাশ, আকাশের যত তারা। আর সেখানকার আঁধার।
কলেজের পাঠ শেষ করে এই শহর থেকে একদিন ট্রেনে করে ঢাকা চলে আসি। ভর্তি হই সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তখন আশির দশক। কী চমৎকার গ্রামীণ পরিবেশ, ছায়া ঢাকা, পাখিদের কলকাকলি মুখর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন। দূরে দিগন্তের নীচ দিয়ে দেখা যেত কলধ্বনিতে বয়ে যাওয়া বংশী নদীর জল।
ভূগোল বিভাগের প্রথম দিনের ক্লাস। ক্লাসে যেতে আমার সেদিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। স্যারের অনুমতি নিয়ে শ্রেণি কক্ষে ঢুকি। বুক হাত পা থরথর করে কাঁপছিল। ক্লাস রুমের মাঝখানের স্পেস দিয়ে হেঁটে যেতেই একটি ছেলের পায়ের গোড়ালিতে হোঁচট খেয়ে মেঝেতে ধাম্ করে পড়ে যাই। মুহূর্তে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউই এগিয়ে এসে উঠাল না আমাকে। আমি একাই বই খাতা কুড়িয়ে নিয়ে পিছনের একটি খালি সিটে গিয়ে বসি।
ক্লাস শেষে করিডরে একাকী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। যার পায়ে লেগে হোঁচট খেয়েছিলাম, সেই ছেলেটি আমার কাছে এসে বিনম্র ভঙ্গিতে বলে -- "আমি একান্তভাবে দুঃখিত ও ক্ষমা প্রার্থী।"
আমি বলি -- আমারও তো পা লেগেছিল আপনার পায়ে। আমিও দুঃখিত।
এইভাবেই ঐ ছেলেটির সাথে আমার প্রথম কথা হয় এবং সখ্যতা ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ওর নাম-- আনিস রহমান।
আমার ভাগ্য কী এই রকমই হয়, জগতের যত সহজ সরল ছেলের সাথে পরিচয় হয়। তাদের জন্য মায়া লাগে। আর এই মায়ায় পড়ে তাদের সাথে এক অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে যাই।
আনিস এসেছিল ফরিদপুরের রাজবাড়ি থেকে। গোয়ালন্দের কাছে পদ্মাপাড়ে ওদের বাড়ি। আনিসকে আস্তে আস্তে চিনতে লাগলাম। ভালো লাগলো বন্ধুর মতো করে। একটু সতর্ক থাকলাম -- কোনো ভাবেই যেন দূর্বল হয়ে না যাই।
ছেলেটি ভালো কবিতা লিখত। নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, হেলাল হাফিজদের মতো সুন্দর সুন্দর কবিতা। ও প্রায়ই কবিতা লিখে এনে আমাকে দেখাত এবং পড়ে শোনাত। খুব ভালো লাগত ওর কবিতা। আনিসের একটাই দোষ ছিল, ও কবিতা কোথাও ছাপানোর জন্য পাঠাত না। বলত -- আমি কবি হতে চাইনা। আমি কবিতা লিখি আমার জন্য। ছাপিয়ে কী হবে।
-- শুধু তোমার জন্য?
-- আমার জন্য এতদিন লিখেছি, এখন লিখি তোমার জন্য।
আমি বলতাম, আমার জন্য কেন লেখ? আমি আবার কবিতা লেখার তোমার কেউ হয়েছি নাকি?
আনিস বলত -- তুমি আমার অনেক কিছু। তুমি পছন্দ করো, তাই লিখি।
একটা কবিতার কথা মনে আছে। একদিন ক্লাস শেষে করিডরে দাঁড়িয়ে আছি। আনিস আমার কাছে এসে বলে -- কঙ্কাবতী।
-- বলো।
-- চলো আজ বংশী নদীর পারে। ওখানে কূলে বসে নদীর জল, আর নীল আকাশ দেখে আসি।
আমি বললাম - চলো।
আমরা চলে যাই বংশী নদীর তীরে। তখন ছিল আষাঢ় মাস। নদী সবে মাত্র জলে ভরে উঠেছে। তখনও জল উপচে ক্ষেতে খামারে ঢুকে পড়েনি। চারদিকে আউশ ধানের প্রান্তর। ধানক্ষেত পার হলেই নদী। ঠিক নদীর কূল ঘেষে একটি কদম গাছ আছে। গাছ ভর্তি ডালে ডালে কদমফুল ফুটে আছে। অপরাহ্ণের রোদ লেগে ফুলগুলো থেকে তীব্র গন্ধ বের হচ্ছিল। আমরা যেয়ে কদমতলায় ঘাসের উপর বসি। নদীর জল বয়ে যাচ্ছিল ছলাৎছল করে। কিছু সময়ে নদীও কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়। আমরা দেখলাম- আষাঢ় মাসের এই ভরা নদী আমাদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। নদীর কথা সবাই সবসময় শুনতে পায় না। কেউ কেউ কখনও পায়। আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম সেই কথা নির্জন সেই অপরাহ্ণ বেলায়।
আনিস ওর বুক পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে। সেই কাগজে লেখা আছে একটি কবিতা। পড়ে শোনায় সেই কবিতাটি। যেন নদী এসে কথা বলছিল নিভৃতে আমার কানে কানে।
আনিস কবিতাটি পড়ার পর আমাকে দিয়ে দিয়েছিল কাগজটি। আমি রেখে দিয়েছিলাম তা আমার বইয়ের পাতায়। পয়ত্রিশ বছর চলে গেছে। বইটি এবং কবিতাটি রেখে দিয়েছিলাম যত্ন করে একটি পুরনো কাঠের তোরঙ্গে। আনিসের লেখা সেই কবিতাটি ছিল ---
" একদিন এক নিরাভরণ আয়োজনহীন বিকালে আমরা হাঁটছিলাম, কাঁচা ধান শীষের নির্জন সেই পথ, পাশে দূর্বা ঘাসের উপর দুপুরের এক পশলা বৃষ্টির মুক্তো লেগেছিল। তখন আকাশ ছিল ধূসর নীল।
আষাঢ়ে কাশফুল ফোঁটার কথা না। দয়িত হারানো বিরহী রমণীর মত শেফালিকাও কোথাও নেই। ধুলোর পথ ছেড়ে দূর্বা ঘাসের উপর আমাদের চরণ পড়ে দূর্বাও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল।
যে পাশে ছিল সে ছিল আমার আনন্দময়ী, আমার প্রাণাধিকা। বিকালের রোদ্র মেখে স্বর্ণপ্রভা হয়ে উঠেছিল সে। যেন কতকালের পরিচিত আরক্ত মুখশ্রী। দেখেছি কত সন্ধ্যার ছায়ায়, কত চন্দ্রালোকিত নিশীথে। সে প্রকৃতিভৈরবী হয়ে আমাকে ঘর থেকে কত যে বের করে নিয়ে আসে ।
কতদিন পর আজকে এই বিকালে এখানে এসেছি। পশ্চিম দিগন্তে আলো নেভে নাই, তখনও দিগন্তে কমলা রঙে ছেয়েছিল..
আমরা হেঁটে চলেছি ........
এমন কত পথ পাশাপাশি হেঁটেছি
হাঁটতে হাঁটতে কত দূর চলে গেছি
কত কথা বলেছি, কত কথা বলতে ইচ্ছা করত !
পথের পাশে অচ্যূত ঘাসফুলের দিকে চেয়ে
কত প্রাণের ছোঁয়া যে তাকে দিতে চেয়েছি।
আমি দেখেছি তার মাথার চুল উড়ছে আসন্ন সন্ধ্যার ধূপগন্ধ বাতাসে,
তাকে একাকার করে নিতে ইচ্ছা করত আমার সকল একাকীত্বে...
অন্তরের ভিতর তখন অন্য তরঙ্গ --
'জানি না কোথা অনেক দূরে বাজিল গান গভীর সুরে,
সকল প্রাণ টানিছে পথপানে
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।'"
সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসি তখন আনিস ধরেছিল আমার একটি হাত। আমি কিছুই বলিনি ওকে। জগতে কিছু হাতের স্পর্শে অনুভব করা যায়, এই হাত বিশ্বাসের। আনিসের হাতটা ছিল তেমনই জাদু স্পর্শের মতো। গত একবছর ধরে ওকে আমি দেখে আসছি। এত ভালো ছেলে। ওর হাতে পাপ নেই।
কিন্তু আমার? এমন একটি ছেলেকে আমি কী নোংরা করে দিতে পারি? কিংবা নস্ট করতে পারি ওর আসন্ন নবীন জীবন? আমি আনিসকে সেদিন থেকে এমন আচরণ করতে থাকি, যেন ওকে বোঝাবার চেষ্টা করি, 'আমি কেবলই বন্ধু তোমার একজন। আর কিছু না। কিছুই হবো না তোমার কোনোদিন।'
৫.
আমার জীবন দুইদিক থেকে বয়ে আসা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হাওয়ায় এলমেল হতে লাগল। যেন হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল তছনছ হয়ে গেল! আনিসের দিক থেকে বয়ে আসা ঝড়টি কেন জানি বেশি অমঙ্গলের মনে হলো। তাই এই ঝড়টিকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য প্রাণমনে চেষ্টা করতে থাকি।
এরপর থেকে আনিসকে বুঝতে দিতে চাইনি যে -- আমি ওকে ভালোবাসি। দূর থেকে দিনের পর দিন ভালোবেসেছি, কিন্তু কখনও বুঝতে দেইনি ওকে। নিজে নিজেই একটি সিদ্ধান্ত নেই -- মাইনুলই আমার জীবনের প্রথম পুরুষ। কত কিছু দিয়ে, কত অর্ঘ্য আর চোখের জলে ওকে জীবনে পেয়েছিলাম -- ও-ই আমার জীবনে চির জীবনের বাঁধন হয়ে থাক্।
সেমিনার কক্ষে বসে পড়াশোনা, লাইব্রেরি যেয়ে বসে বসে নোট করা, ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা খাওয়ার মধ্যেই আনিসের সাথে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের চলাফেরা সীমাবদ্ধ করে রাখলাম। এরপর মাঝে মাঝে আনিস অনেক কবিতা লিখে আমার কাছে নিয়ে এসেছে, কিছু তার শুনেছি, কিছু তার শোনা হয়নি।
মাইনুলের সাথে আমার গোপন অবৈধ সম্পর্ক, আমার গর্ভধারণ, গর্ভপাত এসব কিছুই আনিসকে কোনোদিন বলিনি। আমার এই গোপন অন্ধকার জীবনের গ্লানির কথা আনিসের কাছে অজানাই রয়ে গেছে।
অনার্স শেষ বর্ষের এক গ্রীষ্মের ছুটির দিনে বাড়ি গেলে অনেকটা অনাড়ম্বর করে মাইনুলের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। এই বিয়ের কথাও আনিসকে আর বলিনি। ইতোমধ্যে আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়।
পারিবারিক ভাবে সিদ্ধান্ত ছিল -- আমার আর মাস্টার্স পড়া এখানে হবে না। আর আমারও ইচ্ছে করছি না পড়তে।
এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাব। এই স্মৃতিময় নবাব ফয়জুন্নেসা হল। এই সবুজ ক্যাম্পাস! দূরে বয়ে যাওয়া বংশী নদীর কলধ্বনিও আর শুনব না। এখানে আর সন্ধ্যা নামা দেখব না পাখিদের মুখর করা সন্ধ্যার গানে।
খুব ইচ্ছে হলো -- আনিসের সাথে একটি বিকাল কাটাতে বংশী নদীর তীরে। চলেই তো যাচ্ছি আনিসকে ছেড়ে চিরদিনের করে, আর কোনোদিন হয়ত দেখা হবে না। স্বামী - সংসার, সন্তান নিয়ে গদবাঁধা জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকতে হবে।
যেদিন চলে আসব - ঠিক তার আগের দিন আমি আর আনিস চলে যাই -- বংশী নদীর তীরে। কাকতালীয় ভাবে সেদিনও ছিল আষাঢ় মাস। কিন্তু এর আগে যে এখানে এসেছিলাম ঠিক সেই সবুজের ধানক্ষেত আজ দেখতে পেলাম না। নেই সেই কদমগাছটিও। কোনো বৃক্ষরাক্ষস সম্ভবত কদম গাছটি কেটে ফেলেছে। তবে নদীর দিকে চেয়ে দেখলাম, নদী কুলকুল করে বয়ে চলেছে ঠিক আগের মতোই।
আমরা নির্জন মেঠোপথে নদীর কূল ধরে হাঁটতে থাকি। একজায়গায় দেখতে পাই একটি বাবলা গাছ। সারা বাবলাগাছ ধরে হলুদ ফুল ফুটে আছে। আমরা দাঁড়াই এই বাবলা তলে। আনিস বলছিল -- তুমি কী এখানে বসতে চাও?
আমি বললাম, বসব, তোমাকে নিয়ে দেখব নদীর জল। হয়ত এমন করে আর তোমাকে নিয়ে নদী দেখা হবে না।
তখন সন্ধ্যা পূর্ব বিকাল। আমরা দুজন বসে আছি। টুকটাক করে অনেক কথা বলছি, আবার নীরবতায়ও কেটে যাচ্ছিল সময়। আজ আনিসের একটি হাত খুব ধরতে ইচ্ছা করল -- আমি ওর একটি হাত ধরি। হাত ধরে বলি -- এই হাতে একটি চুমু কী আমি দিতে পারি? আনিস বলল, দাও।
আনিস আমাকে ওর বাহুডোরে বেঁধে নিয়ে বলে, 'আমরা কী চিরদিনের জন্য দুজন দুজনের হতে পারি না?'
আমি আনিসের মুগ্ধ দুচোখের দিকে চেয়ে বলি -- না। আমি যে অনেক আগেই আর একজনের জন্য চিরদিনের হয়ে গেছি। আমার জীবন তোমার জীবনে নেই।
দেখলাম -- আনিসের বাহু মুহূর্তেই শিথিল ও নির্জীব হয়ে গেল। হাঁটুতে মাথা গুজিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সেদিনের অস্তবেলার শেষ সন্ধ্যা নেমেছিল নদীর বুকে। দুজন চেয়ে থেকে দেখছি -- কী ভাবে সোনালি আবীর মাখা রং আকাশ থেকে মুছে গেল।
ফিরবার পথে সন্ধ্যার সেই বিলুপ্ত মেঘের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম -- যাকে বেশি করে ভালোবাসা যায়, নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ বুঝি তার সাথেই করা যায়, আবার এই ভেবে মনে শান্তিও পেলাম -- আনিসের জীবনে আমি যে জড়াইনি এইটাই ওর জন্য চির কল্যাণ হয়ে থাক্। ওর সামনে যে অনেক কর্ম।
পথে আসতে আসতে আবারও মনে হলো ওর একটি হাত আমার হাত ধরে আছে -- কিন্তু কেমন যেন অসার সেই হাত। আমাকে কেমন মায়া করে ডাক দিল আনিস -- কঙ্কাবতী!
-- জ্বী।
-- তোমার সাথে আর কী কখনো দেখা হবে না আর?
-- না। লুকিয়ে রাখব তোমার থেকে নিজেকে বাকি জীবনকাল।
পথের উপর সেই সন্ধ্যার আঁধারে থেমে যাই। পা চলছিল না। কেমন যেন ব্যথা করছিল পায়ে। আমি আনিসকে বলি - তোমার বুকে একটু মুখ লুকোতে দেবে?
-- দাও।
-- একটু কাঁদতে দেবে?
-- কাঁদো।
তারপর আমার জীবনের কত পিঙ্গল পথ, কত পটে কত বর্ণের হয়ে জীবনের এই অস্ত পর্বে এসে দাঁড়ালাম। কত শুকতারার আলোকোজ্জ্বল রাত আঁধারে উড়িয়ে অদৃশ্য হয়েছে – প্রতিদিনই কোনো কোনো সন্ধ্যায়
সেই হারিয়ে ফেলা বংশী নদীর কূলের মতো হাসি আনন্দের সন্ধ্যা নেমেছে, আপন ভালবাসার রঙে আমার প্রাণ রাঙিয়ে তুলেছি কত। আমি শুধু অনুভব করেছি -- একজনকে ভালোবেসে পেয়েছি, আর একজনকে ভালোবেসে হারিয়েছি। একজনকে দেহ মন দিয়ে কেবল আনন্দ দিয়ে গিয়েছি, আর একজনকে জীবনভর মনে রেখে দুঃখ কুড়িয়েছি।
*** *** *** ****
তারপর চলে গেছে জীবনের পয়ত্রিশ বছর। আমি এখন বিগত যৌবনা এক রমণী। জানো! এই শহরেই আমি থাকি।
তোমাকে আমি অনেক কথাই বললাম, আবার অনেক কথা বলিনি। জীবনের এমন অনেক কথা আছে, লেখা যায় না, বলাও যায় না, চোখে এসে দেখতে হয়। তোমাকে কফি খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলাম -- যদি আসো তাহলে তুমি দেখতে পাবে আমার জীবন ছবি।
আমার ঠিকানা ঃ রোড নং ২৩,
বাসা নং ... , বনশ্রী, রামপুরা -- ঢাকা।
আমি একদিন সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম কঙ্কণার বাড়িতে। বাসায় নক করতেই একটি লোক এসে দরজা খুলে দেয়। লোকটি আমাকে দেখে বুঝতে পারে - আমি কে? মনে হলো কঙ্কণা আমার কথা আগেই বলে রেখেছিল ওনাকে। পরে জেনেছি - লোকটি হচ্ছে কঙ্কণার স্বামী মাইনুল।
ভিতরে শোবার ঘরে যেয়ে দেখি একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা অন্যদিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। মাইনুল ওনাকে ডাকে -- দেখ কে এসেছে!
কঙ্কণা আস্তে করে ঘুরে আমার দিকে তাকায়, কী করুণ শীর্ণা রোগক্লিষ্ট মুখ। চোখের নীচে কালো দাগ। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল। আমি ওকে দেখে আৎকে উঠি। আমি যে একে চিনি। বহু জন্মজন্মান্তরের সে যে আমার একজন ছিল। শুধু নামটি ভিন্ন, কঙ্কণা নয় -- ও যে দিলারা জাহান।
এইরকম কতকিছু পরিবর্তন করে আমাকে লিখেছিল দিলারা -- বংশী নদী নয়, নদী ছিল বুড়িগঙ্গা, জাহাঙ্গীরননগর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর, আনিস রহমান সে নয়, সে ছিল রঞ্জন রহমান।
দিলারা কর্কট রোগে আক্রান্ত ছিল। পৃথিবীর সমস্ত ঔষধ ও চিকিৎসা অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল ওর শরীরে। ডাক্তার হাসপাতাল থেকে ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
সেদিন একটি সন্ধ্যাই কেবল দিলারার শিয়রে বসেছিলাম -- খুব আবছা করে দেখতে পাচ্ছিলাম অনেক দূরের একটি নদী। শ্রাবণের বুড়িগঙ্গা বয়ে চলছিল যেন কুলুকুলু করে...
দিলারা আমাকে একদিন বুকে মাথা রেখে বলেছিল, "
"জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো, সকল মাধুরি লুকায়ে যায় গীতসুধারসে এসো। "
গলা রোধ হয়ে আসছিল -- অস্ফুট কণ্ঠে দিলারাকে মনে মনে বললাম -- সেই আমি এলাম, যখন কিনা তুমি চলে যাচ্ছ।
~ কোয়েল তালুকদার
২. লক্ষ্মীমতি
নাজিম উদ্দীন ছিল আমার স্বল্প সময়ের জন্য একজন সহকর্মী। বছর তিনেক একটি সরকারি প্রকল্পে আমরা একসাথে কাজ করেছিলাম। আমি তখন ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য পাশ করে বের হয়েছি। দক্ষিণখানে একটি বাংলো বাড়িতে একা থাকি।
নাজিম উদ্দীন আমার চেয়ে সাত আট বছরের বড়ো ছিল। বয়সে সে বড়ো হলেও খুব অল্প দিনের মধ্যে আমরা একে অপরে ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। নাজিম উদ্দীন থাকত ইন্দিরা রোডের একটি মেসে। ওর বাড়ি ছিল শ্রীপুরের কাওরাইদে। গ্রামের বাড়িতে বউ বাচ্চা থাকত। সাপ্তাহিক ছুটিতে সে ট্রেনে করে কাওরাইদে আসা যাওয়া করত।
একদিন নাজিম উদ্দীন আমাকে বলছিল -- 'তোমার ভাবীকে ঢাকায় আনতে হবে চিকিৎসার জন্য। সাত আট দিন থাকতে হবে। আমি মেসে থাকি। ঢাকায় দুএকজন আত্মীয় স্বজন আছে কিন্তু সেখানে উঠতে চাচ্ছি না। তুমি তো একা এক বাড়িতে থাকো। তোমার ওখানে তোমার ভাবীকে নিয়ে উঠতে চাই।'
আমি বললাম -- তুমি উঠতে পারো, আমার সামান্যতম অসুবিধা নেই। কিন্তু, আমার চাল চুলো কিছু নাই। খাওয়াব কী ! আমি যেখানে থাকি, সেটি এখনও গ্রাম। কাছে একটা ইতালিয়ান হোটেল অবশ্য আছে। কিন্তু ঐ হোটেলে ভাবীকে নিয়ে বসে খাওয়া যাবে না। প্রেস্টিজ চলে যাবে। যদিও আমি বিপদে পড়ে মাঝে মাঝে সেখানে খাই। আর বেশির ভাগ সময় বাইরে এদিক সেদিক কোনো হোটেল থেকে খেয়ে তারপর বাড়িতে যাই । আবার এমনও ইতিহাস আছে, না খেয়েও রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। অনেক সময় রুটি-পাউরুটি খেয়েও রাতের খাবার সারি।
নাজিম বলছিল -- তা অসুবিধা হবে না। এটা নিয়ে তুমি ভেবো না। আমরা ম্যানেজ করে নিব।
-- আচ্ছা, তাহলে ভাবীকে নিয়ে চলে এসো।
-- আমি এবার বাড়িতে যেয়ে আসার সময় তোমার ভাবীকে নিয়ে সোজা তোমার ওখানেই এসে
উঠব।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। সকাল এগারোটা বাজে আমি তখনও ঘুম থেকে উঠিনি। হঠাৎ শুনতে পাই --- বাইরের গেটে কে যেন নক করছে। দরজা খুলে দেখি, নাজিম উদ্দীন তার স্ত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হেমন্তের রোদ্দুর তখন সারা আঙিনাতে মুখর। নাজিম উদ্দীনের স্ত্রীর পরনে একটি সবুজ রঙের তাতের শাড়ি, হাতে চারটি চিকন সোনার চুড়ি, মুখে কোনো আবীর মাখা নেই। অনেকটাই নিরাভরণ। বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। মাথায় ছোট্ট ঘোমটা দেওয়া। আমায় দেখে ঘোমটাটা আরও একটু সামনের দিকে টেনে আনেন । হেমন্তের রোদ্দুর সেই ঘোমটার ভিতর দিয়ে আবছায়া রূপে প্রবেশ করে তার মুখখানিকে বেশ উজ্জ্বল করে তুলেছিল। নাজিম উদ্দীন আমাকে পরিচয় করে দেয় -- এই হচ্ছে তোমার ভাবী। তোমার শারমিন ভাবী। আমি তাকে সালাম দিলাম।
নাজিম উদ্দীন ও শারমিন ভাবী ঘরে এসে বসলেন। আমার কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছিল। তখন আমি ইউনিভার্সিটির সদ্য মাস্টার্স পাশ করা তরুণ এক , বয়স চব্বিশ পঁচিশ। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। তখনও বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, মেঘদূতম, শকুন্তলা দুস্মমন্ত'রা মগজে ঘোরাফেরা করে। সুযোগ পেলেই কল্পনায় চলে যাই, দূর শিপ্রানদীর তীরে। সেই আমি দেখলাম আজ হেমন্তের রোদ্দুর ছোঁয়া একজন কুসুমিত রমণীর অনাবৃত দুটো হাত। আমার মনের ভিতর এক প্রকারের নূতন অনুভূতি, আমার বুকের রক্তের তালে তালে সেদিন এক প্রকার নূতন স্পন্দন স্পন্দিত হয়েছিল।
রুমের ভিতর মৌনব্রত বসে আছি। ভাবছি, আগত এই অতিথিদের কী খাওয়াব? নাজিম উদ্দীন আমার বিব্রত মুখ দেখে বুঝতে পারে -- আমি কিছু দুশ্চিন্তা করছি। সে বলে -- তোমার ভাবী মশাখালীর দেশী মুরগী, সুতিয়াখালীর নদীর বাইটকা মাছ আর ছোট ছোট আইর মাছ রান্না করে নিয়ে এসেছে। আমরা সবাই এগুলো দুইদিন খেতে পারব।
তরকারি না হয় হলো। কিন্তু ঘরে ভাত নেই। চাল নেই। চুলো নেই। কী করব? আজিজ মিয়ার টিনের চালার হোটেল থেকে ভাত কিনে এনে দুপুরে তিনজন খেয়ে নিলাম।
আমার বাড়িতে থাকার কোনো অসুবিধা ছিল না। পরিপাটি রুম। আলনা, টেবিল, নিওন বাতি, ইলেকট্রিক ফ্যান সবই আছে৷ আমি নাজিম উদ্দীনকে বললাম -- 'যাও তোমরা এখন বিশ্রাম করো গে।' এই কথা বলে আমি আমার রুমে চলে আসি।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিভূতিভূষণের 'উপেক্ষিতা' পড়তে থাকি। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বুঝতে পারিনি। যখন ঘুম ভাঙে, দেখি -- জানালার ওপাশে বাঁশ ঝাড়ের পাতাগুলো মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে। অপরাহ্ণের মিহি আলোয় চিকচিক করছে মাধবীলতার গুচ্ছগুচ্ছ ফুল। একটুপর ছায়া ছায়া অন্ধকার নামবে। এই সময়ে খুব একা একা লাগে। কিন্তু আজ লাগছে না। আজ আমার ঘরে দুজন অতিথি আছে। যাদের পদচারণায় নৈশব্দ ভেঙে গেছে।
আমি উঠে মাঝখানে ড্রইং রুমে চলে আসি। সোফায় বসে নাজিম উদ্দীনকে ডাক দেই। -- 'নাজিম ভাই....। ' আমার ডাক শুনে পাশের রুম থেকে নাজিম ভাই চলে আসে, সাথে শারমিন ভাবীও।
নাজিম ভাই বলছিল -- তোমার রান্নাঘর শারমিন ভিজিট করেছে। কিছু নাই। সব নাকি খালি। ঠনঠন করছে। তোমার ভাবী একটা লিস্ট করেছে। কী কী লাগবে। তুমি আমার সাথে চলো টংগী বাজারে। সব কিনে আনব।
আমার কোনো 'না' তারা শোনেনি। বাধ্য হয়েছিলাম চলে যেতে। ভাতের পাতিল, তরকারির পাতিল, কড়াই, খাবার প্লেট, গ্লাস, চামচ, খুন্তি, বটি, বালতি, গামলা থেকে শুরু করে যা যা লাগে সব কিনল নাজিম ভাই। আরও কিনল চাল, ডাল, লবন, পিয়াজ, কাঁচামরিচ, মসলাপাতিসহ কতকিছু। শারমিন ভাবী করে দিয়েছিল লম্বা ফর্দ। ফর্দের সবই কিনলেন তিনি। আমাকে একটা টাকাও দিতে দিল না। আমি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নাজিম ভাই বলেছিল -- ' তুমি যদি টাকা দাও তাহলে শারমিন আমাকে মারবে।' এই কথা শুনে আমি থেমে গেলাম।
রাতে যখন খেতে বসি -- দেখি -- আজ অন্যরকম সব আয়োজন। এ যেন আমাদের দেশের বাড়িতে খাবার টেবিলে মার মতো করে সাজানো সব খাবারের আয়োজন।
শারমিন ভাবী পাশে দাঁড়িয়ে থেকে খাবার পরিবেশন করছিল আর বলছিল -- 'রঞ্জন ভাই, আমি যে কয়দিন এখানে আছি, আপনার সংসার টা সব সাজিয়ে দিয়ে যাব। এরপর যদি কখনও আসি, এসে যেন দেখি -- একজন লক্ষ্মীমতি বউ ঘরে এনেছেন।'
শারমিন ভাবীরা সাতদিন ছিলেন আমার বাড়িতে। ঐ কয়দিনে সত্যি সত্যি আমার বাড়িটা তিনি সাজালেন। ঘরের কোণে কোণে ধূলোময়লা জমেছিল সেগুলো তিনি নিজ হাতে পরিস্কার করলেন। বারান্দার চালে মাকড়সা বাসা বেঁধে অসংখ্য ঝুলে ভরে রেখেছিল, সেগুলোও ঝারলেন। পড়ার টেবিল গোছালেন। বিছানাপত্র সব পরিপাটি করে রাখলেন। বাড়ির সামনের বাগানে আগাছাগুলো লোক ডেকে কাটিয়ে ফেললেন। মালিনীর মতো প্রতিদিন গোলাপ, বেলী, পাতাবাহারের গাছগুলোতে পানি ঢাললেন।
হঠাৎ করেই জমিদার পুত্রের মতো জীবন হলো আমার। বাড়িতে খাবার রেডি থাকত। হাতখান ধূয়ে শুধু খেতে বসতাম। শারমিন ভাবী খালি মুখে তুলে খাওয়ানোটাই বাকি রাখতেন। বাকি সবই তিনি করতেন, তৈরি রাখতেন।
শারমিন ভাবীকে ডাক্তার দেখানো, তাকে চেক-আপ করানো, রিপোর্ট নেওয়া এবং ডাক্তারের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ঔষধ কেনা, সবই শেষ হয়ে যায়। একদিন বিকালে ডাক্তারের কাছে থেকে ফিরে এসে নাজিম ভাই বলছিল -- তোমার ভাবীকে ডাক্তার দেখানো শেষ। আগামীকাল সাড়ে বারোটার ট্রেনে আমরা চলে যাব।
তখন ছিল বিকেল। নাজিম ভাইয়ের কাছে থেকে তাদের চলে যাবার কথা শুনে মনটা খুব খারাপ লাগছিল। ঘরের পিছনে বৃক্ষরাজিতে তখন বসে থাকা পাখিদের কলকাকলি ক্রমান্বয়ে বিষাদের সুরের মতো হৃদয়ের তন্ত্রীতে অনুরণিত হতে লাগল। যে সুরের উদাস মাধুর্য প্রাণের মধ্যে কোনো সাড়া দেয় না।
বিকালগুলো কী এমনই বিষণ্ণতার হয়? মনে হতে লাগল -- জীবনটা এমন হয় কেন, এই এলমেল, এই সাজানো গোঋানো, আবার হয়ে যায় এলমেল। সেদিনের সেই অপরাহ্ণের রোদ্দুর বাশের পাতার উপর পড়ে আর চিকচিক করল না৷ মাধবীলতা গুলোও ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। জানি আঁধার নামবে, জানি -- ' সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুড়ায় জীবনের সব লেনদেন, তারপর থাকে শুধু অন্ধকার !'
পরের দিন সকালে আমি অফিসে চলে যাই। যাওয়ার সময় নাজিম ভাইকে বলি -- তোমাদের ট্রেন তো ছাড়বার দেরি আছে। তোমরা পরে বের হইও। ঘরের তালা টিপ দিয়ে লক করে বেরিয়ে যেও। আমি চাবি নিয়ে যাচ্ছি। পরে এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকব।
আমি যখন বেরিয়ে যাব -- তখন দেখি, শারমিন ভাবী সেদিনের মতো ঘোমটা অর্ধেকটা খুলে স্থির শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো তার কালো চোখদুটির নীচে জগতের সকল অশ্রু ভার যেন গোপনে লুকিয়ে রেখেছে। ঈষৎ ভারী সেই চোখ দুটো তুলে বলেছিল -- 'আমি কিন্তু সব সাজিয়ে গুজিয়ে রেখে যাচ্ছি। কোনো এলমেল যেন না হয়। যদি কখনও আবার আসি -- ঘরে যেন একজন লক্ষ্মীমতিকে দেখতে পাই।'
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে দেখি ঘরের দরজায় তালা দেওয়া। আপন পরিজনের মতো আজ আর কেউ অপেক্ষায় নেই। সারা ঘর অসীম শূন্যতায় খাঁ-খাঁ করছে। কয়টা দিনের সেই মুখর করা মানুষ দুজন নেই। বিছানার উপর জুতা না খুলে সটান হয়ে শুয়ে পড়ি। জানালা খুলতে ইচ্ছে হলো না। সন্ধ্যার আলো জ্বালাতেও মন চাইল না। ক্রমশ আঁধারের ভিতর নারীকণ্ঠের একটি কথার প্রতিধ্বনি বাজছিল কেবল -- " যদি কখনও আবার আসি, ঘরে যেন একজন লক্ষ্মীমতিকে দেখতে পাই।''
৩০ আগস্ট, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।
৩. নীল আকাশের খোঁজেে
এই করোনা কালে মাধবীর সাথে আমার একবারই যোগাযোগ হয়েছিল। ও আমাকে লিখেছিল, আমিও ওকে লিখেছিলাম, লকডাউনের সময় কে কেমন আছি -- তা জানতে চেয়েছিলাম দুজন দুজনের কাছ থেকে। তারপর আর কোনো খোঁজ খবর নেই। কারোর সাথে কোনো কথাও নেই। আসলে মাধবী আর আমার সম্পর্কটা এই রকমই। দীর্ঘদিন চলে যায় দীর্ঘ রাত্রি। দুজনেই কোথায় ডুব দিয়ে থাকি। কেউ কারোর খবর নেই না। কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝে এই নিয়ে কোনো মান অভিমান নেই। কোনো ভুল বোঝাবুঝিও নেই। আমরা জানি -- একে অপরকে ভুল বোঝার দুঃসাহস আমাদের কারোর নেই।
দীর্ঘ প্রায় চার মাস পর মাধবী আমাকে লিখেছে ওর কথা ---
২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ ইং
ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।
রঞ্জন,
তুমি তো জানোই তোমার মন খারাপ থাকলে আমার মনখারাপ লাগে। কোনো কিছুতে তুমি কষ্টে থাকলে আমার অন্তর বীণার তার ছিঁড়ে য়ায়। 'পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা-- দুখের মাধুরীতে করিল দিশেহারা, সকলই নিবে-কেড়ে, দিবে না তবু ছেড়ে-- মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে।'
কয়দিন ধরেই মনটা তোমার জন্য আকুল হচ্ছিল খুব। কেমন যেন ভেতরটা ভারী হয়ে আসছিল। মন বলছিল -- তুমি ভালো নেই। তুমি কষ্টে আছ। তোমার মন যে কতখানি কোমল, তা এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে কে বেশি জানে ! আর সেই মনটি যদি যাতনায় থাকে, তাহলে আমি কী ভাল থাকি, বলো ? কী যে এক অনিঃশেষিত মায়ায় তুমি আমাকে জড়িয়ে রেখেছ চিরকালের জন্য, তা জানে বিধাতা, আর জানি আমি।
এই শহরে করোনার বন্দীকাল জীবন আর নেই। তবুও মন কেন যে উচাটন হয়! তুমি তো জানো -- সুখে হোক আর দুঃখে হোক, তোমার কথা মনে হলে আমি নিভৃতে চলে যাই। ঘর হতে বেরিয়ে পড়ি। একাকী ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকি। আজ হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর। টিলার মতো একটা উঁচু জায়গায় একটি নিরিবিলি ইতালিয়ান কফিসপে বসেছিলাম কফি খেতে। ওয়েটারকে অর্ডারও করেছিলাম এক গ্লাস গরম কফি দিতে । কিন্তু এক চুমুক খাওয়ার পর আর খেতে ইচ্ছে করল না। হঠাৎ মনে পড়ল-- সেই কতবছর আগের একদিন শাহবাগের মৌলিতে বসে কফি খাওয়ার কথা। গরম কফি চুমুক দিতে যেয়ে তুমি তোমার টি সার্টের উপর সব কফি ঢেলে ফেলেছিলে।
কফিসপ থেকে বেরিয়ে একটি ট্যাক্সি কল করে চলে যাই আল্পস পাহাড়ের দিকে। ভেবেছিলাম রডোডেনডন গুচ্ছ দেখে মন ভরাব। গাড়ির উইন্ড গ্লাস খুলে দেখি -- কোথাও কোনো পাহাড়ের ঢালে রডোডেনডন ফুটে নেই। এখানেও এসে স্মৃতি খুঁড়ে রক্ত ঝরালাম। একবার তুমি কী যে এক পাগলামি করলে ! একদিন একটি লোকাল বাসে করে আমাকে জোর করে নিয়ে গেলে রাজেন্দ্রপুর শালবনে। ওখানে নাকি রডোডেনডন থোকায় থোকায় ফুটে থাকে। কিন্তু সেদিন সারা শালবন তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও একটি রডোডেনডন গুচ্ছের ঝাড়ও খুঁজে পাইনি।
ট্যাক্সি চালককে বললাম -- তুমি আমাকে দানিয়ুব নদীর তীরে নিয়ে যাও। গেলাম সেখানে, কিন্তু ওখানেও ভালো লাগল না। এত নির্জন, এত নির্মল জল, এত নৈঃশব্দ -- ভালো লাগছিল না। দানিয়ুবের তীর ধরে যখন হাঁটছিলাম-- তখন মনে পড়ে গেল, একবার এক চৈত্রের ভর দুপুরে তুমি বললে -- 'চলো বুড়িগঙ্গার পারে শ্মশান ঘাটে যেয়ে বসে থাকি। ঐ জায়গা নাকি খুব নির্জন হয়, ভয়ে কেউ ওখানে যায় না'।
কোথাও মন ভালো হলো না। সন্ধ্যার পর ভিয়েনা শহর আলোয় আলোয় ভরে উঠল। ঘরে ফিরে এসে আমার স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে কতক্ষণ কেঁদে নিলাম। বুকের ভার অনেকটাই কমে গেল। আমার আফসোস শুধু একটাই -- আমারও রক্তের গ্রুপ AB Positive.. তোমার মায়াবতীর এই সংকটকালে আমিও তো ওকে রক্ত দিতে পারতাম। কিন্তু এত দূরে পড়ে রয়েছি যে -- আমার শরীরের প্রবাহমান সব রক্ত বেদনায় হিম হয়ে গেল।
কেমন আছ তুমি? কেমন আছে তোমার মায়াবতী জানাইও।
--- মাধবী।
আমি মাধবীর লেখার শেষ লাইনটাই শুধু প্রলম্বিত করলাম। লিখে জানালাম ওকে --
চির কল্যাণীয়াসু,
দার্জিলিং থেকে আনা ধবধবে সাদা শাড়িটা মায়াবতীর খুুব পছন্দ। সেই কতবছর ধরে একটি কাঠের তোরঙ্গের ভিতর যত্ন করে শাড়িটি রেখে দিয়েছে সুগন্ধী আতর মেখে । আজ বিকালে পরেছিল সেই শাড়িটি।
কতদিন ধরে বন্দী ঘরে রোগ শয্যায় শুয়েছিল কত কাতরতায়। এখন অনেক ভালো সে। ও নীল আকাশ দেখতে বের হবে। মায়াবতী তাই বলছিল-'তুমি আমাকে হাত ধরে একটি খোলা অটো রিকশায় নিয়ে বসাও। দেখে নিয়ে আসো উদাস কোনো প্রান্তরের উপরের নীল আকাশ।
আমরা চলে যাই শিয়ালডাঙ্গার মাঠে নীল আকাশের খোঁজে। খুঁজে পেলামও মাথার উপর অসীম নীল আকাশ। সারা আকাশ জুড়ে শরতের সাদা মেঘরাশি তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। রাস্তার দুপাশে বিস্তির্ণ কাশবন। অজস্র শুভ্র কাশফুল ফুটে আছে থরে থরে। ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলছে পাপড়িগুলো। পথের উপর নেমে খুঁজলাম আমাদের প্রিয় সেই বাবলা গাছটিও। যার তলে বসলে মনখারাপ ভালো হয়ে যায়।
কত কথা আমাদের গল্পে ছিল। কী অদ্ভুত সন্ধ্যা এসেছিল ভৈরবীর অস্ত রাগে। আজ এখানেও তেমনই নেমে এসেছিল সন্ধ্যা -- গল্পের মতো, রাগ ভৈরবীর মতো । চুপচাপ আঁধার হয়ে আসছিল। পথে কাশবনের ঝাড়ে জোনাকিদের আলো জ্বলে উঠেছিল আর নিভছিল। এমন ক্ষণে মন আবার বিষণ্ণও হয়--- ' যে -জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা।'
তবুও মনে কত আশা জাগে , কত স্বপ্ন গাঁথা হয়ে থাকে চিত্রের মতো ....
---- রঞ্জন।
৩ আগস্ট, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।
আরও চিঠি --
( বারান্দায় বেতের ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে ছিলাম -- দেখি, তুমি দূর রোদ্র মলিন পথ ধরে হেঁটে হেঁটে আসছ আমার দিকে। তোমার আগমনী ছায়া ক্রমশ এগুতে থাকে। তুমি কাছে এসে জড়িয়ে ধরলে আমাকে! তুমি জানো, আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমার সমস্ত মনখারাপ ভালো হয়ে যায়।
আসলে এটি ছিল ভ্রম!)
ম্যাসেঞ্জারে টুং করে আওয়াজ হল। ওপেন করে দেখি লাস্ট মেসেজে লেখা আছে --
রঞ্জন,
আজ কয়েক দিন ধরে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তোমার খুব মনখারাপ। তোমার মন খারাপ থাকলে আমি আজো এত দূর থেকে তা বুঝতে পারি। এ আমার টেলিপ্যাথিও বলতে পারো। আমি জানতাম, কী করলে তোমার মন ভালো হত। যা করতাম, তা খুব সামান্যই। একদম মূল্যহীন। কোনো দাম দিয়ে কিনতে হত না। আজ আমি এত দূরে যে, তা কোনো দাম দিয়েও করতে পারিনা।
সেদিন জোলারগেসীতে কফিমিকে বসে আমি আর আমার স্বামী কফি খাচ্ছিলাম। সুউচ্চ আকাশ ছোঁয়া ভবন। ঊনপঞ্চাশ তলায় কফি শপটি। কাচের জানালার কাছে বসেছিলাম। বাইরে তখন প্রচুর তুষারপাত হচ্ছিল। গরম কফি খাচ্ছিলাম আর জানালার ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম, দূরের আল্পস পাহাড়। সাদা বরফে ঢেকে আছে শৃঙ্গ। আমার স্বামী তার একটি হাত ধরে রেখেছিল আমার পাঁজরে।
ঐ দূরে ধবল মেঘ ভেসে যায়, তুলোর মতো উড়ে যায়।মন চলে যায় সুদূরে, সাকুরায়। জানালা দিয়ে সেদিন তাকিয়ে দেখেছিলাম ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। সেদিন আমি রাখতে চেয়েছিলাম একটি হাত তোমার পাঁজরে। তুমি একটু দূরে সরে গিয়ে দূরত্ব তৈরি করলে!
আসলে আমি তোমাকে কখনোই বুঝতে পারিনি। মন আর রসায়ন দুটো আলাদা জিনিস। একটি অতৃপ্ত আর একটি তৃপ্ত। একটিকে ছোঁয়া যায়, আর একটিকে ছোঁয়া যায় না।
তুমি বিচ্ছেদ পছন্দ করতে। বলতে- দূরে থাকলেই সারাজীবন তুমি আমার হয়ে থাকবে। কাছে এলে আর মুঠো মুঠো নকলা তুলে ভোগ করলে তা সব শেষ হয়ে যাবে। আর কথায় কথায় তোমার কী এক প্রিয় কবি আছে , নাম ভানু চক্রবর্তী! তার কবিতা পড়ে আমাকে শোনাতে।
কোথায় থেকে কোথায় গেলাম! ঐ যে মনখারাপের কথা বলছিলাম! তোমার মায়াবতীর সাথে আমার একবার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ওর সাথে কথা হলে ওকে বলে দিতাম- তোমার মন ভালো করে দেয়ার সিক্রেটটা।
ব্যস্ততম এই শহরে আমার সকল কর্ম অবসরে হঠাৎ কোনো ফুরসতে তোমার কথা খুব মনে পড়ে। রঞ্জন, তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিয়ে আমার কাছে তুমি চিরকাছের হয়ে আছ এখনও। যেন 'যেথা আমি যাই নাকো, তুমি প্রকাশিত থাকো।'
কী যে ধরতে ইচ্ছা করছে, কী যে ছুঁইতে করছে তোমার দেবযানীকে। এখানকার 'আমাজন ডট কম' কে বলেছি আমাকে এক কপি দেবযানী সংগ্রহ করে দেয়ার জন্য। ওরা বলেছে -- করে দেবে।
------ মাধবীলতা।
৭ মার্চ, ২০২০ ইং
ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।
( ভিয়েনা শহরে এক ধরনের ঘোড়ার গাড়ি তাদের অনেক পুরোনো ঐতিহ্যকে এখনো ধরে রেখেছে। ব্যাস্ততম এই শহর এখন অন্য সব যানশুন্য। নির্জন, জনমানবহীন রাজপথে কোথাও কিছু নেই- য়ের মধ্যে করোনা সময়ে যাত্রীহীন এই ঘোড়ার গাড়িই শুধু দেখা যায়।)
মাধবী লিখেছে --
রঞ্জন,
পৃথিবীর এই অসুখের দিনে তুমি কেমন আছো?
ভালো যে তুমি নেই সে আমি বুঝতে পারি এত দূর থেকেও। তুমি যতই তোমার মনখারাপের কথা গোপন করে রাখো না কেন, আমি বুঝতে পারি -- আমার এই চিরকালের বন্ধুটি ভালো নেই। ঈশ্বর আমাকে এই বোঝার ক্ষমতাটুকু দিয়েছেন।
ঘরবন্দী জীবন আর কত ভালো লাগে, বলো? এই শহর এখন দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকে। হঠাৎ মাঝে মধ্যে দুএকটি ঘোড়ার গাড়ির খট খট শব্দ কানে বাজে। আর কোনো শব্দ নেই। এই শব্দহীনতার মধ্যে হঠাৎ করুণ স্বরে এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বেজে ওঠে। তখনই মনে হয়, ঐ যানটি কোনো করোনা আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে, না হয় নিয়ে যাচ্ছে কোনো মৃত ব্যক্তির লাশ গ্রেভইয়ার্ডে।
করুণ এই করোনার মধ্যে তোমার কথা খুব মনে পড়ে। এই মনে পড়াটা কোনো সুখেও যায়না, দুঃখেও যায়না। কী এক অনির্বচনীয় বেদনা তুমি আমাকে দান করেছিলে জীবনের প্রথম প্রহরে, তা কোনো কিছু দিয়ে তোমাকে ফেরত দেওয়া হলো না। জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, তারপরও না। এই বেদনার ভার আমাকেই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
কোনো কর্ম নেই। যতটুকু কাজ তা শেষ হয়ে যায় ফুড়ুৎ করে। আমার স্বামী আমাকে অনন্ত সময় দেয় অসীম ভালোবাসায়। এই করোনায় একটা জিনিস পাচ্ছি উজার করে তাহলো-- প্রিয়তম স্বামীর আদর সোহাগ। হৃদয় ভরে সব জমা করে নিচ্ছি, খরচ করব তা বাকি জীবন ভরে। এত প্রেম! তারপরও কোথায় যেন হাহাকার রয়ে গেল।
এখানে এখন সামারকাল। মনখারাপ হলে চুপিচুপি জানালা খুলে দেখি ভিয়েনার নীল আকাশ। এত নীল য়ে, কোথাও একটুও মেঘ নেই। যদি মেঘ থাকত, বুঝতাম সে মেঘের নীচে তোমার মুখখানি লুকিয়ে আছে। কিন্তু এত স্বচ্ছ নীল যে, কোথাও তোমাকে দেখতে পাই না।
ভাবছি, এই করোনার দহনকাল শেষ হলে প্রথম যাব দানিউব নদীর তীরে। মনটা এত বিবাগী হয়ে উঠেছে যে, ঘরের বাহির হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছি। আমার স্বামীকে নিয়েই যাব। ও ধরে থাকবে আমার হাত, হাঁটব দুজনে সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে নদীর কূল ধরে। শীতল বাতাস মেখে নিব শরীর জুড়ে। দৃষ্টি মেলব অনেক দূর আল্পস্ পর্বতের শৃঙ্গের দিকে। ঐ ধূসর অচলায়তন পাহাড় যে তোমাকে আমার থেকে চিরকালের জন্য আড়াল করে রেখেছে।
তোমাকে দেখার কী যে তৃষ্ণা আমার!
পৃথিবীর এই অসুখ ভালো হোক। যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে একদিন, যদি বেঁচে না থাকি, হবে না। ভালো থেকো তুমি বন্ধু। ঘরে থেকো। একটুও ঘরের বের হবে না।
----- মাধবী লতা।
৯ এপ্রিল, ২০২০ ইং
ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।
মাধবী
একজনই তুমি আছ আমার পৃথিবীতে, যে আমাকে বুঝতে পারে একান্ত নিজের করে। যে আমাকে দেখে দূর থেকে অনেক কাছের করে।
আজ কয়েকদিন ধরেই তোমাকে খুব লিখতে ইচ্ছে করছে। যা-ই লিখি, তোমাকে পাঠাই না পাঠাই -- কিন্তু লিখতে ইচ্ছে করছে। আজ সকালে দরজা খুলে প্রথম যে রোদ দেখেছিলাম, সেখানে কোনো মেঘের ছায়া ছিল না, স্বচ্ছ ও ঝিলমিল রোদ্দুর ছিল। ধুলিমাখা দুর্বা ঘাসের মাঠের উপরে একটি শালিক লাফিয়ে চলছিল এদিক ওদিক। কোনো শীষ নেই। সেও কী বেদনাময় একা। সেও কী অভিমানী হয়ে একা একা ঘুরছে ফিরছে?
তোমাকে লিখতে যেয়ে কিছুক্ষণ লেখা থামিয়ে দেই। বহু বছরের পুরনো একটি কাঠের তোরঙ্গ বের করি। অনেক জীর্ণ অভিজ্ঞান ভরা সে তোরঙ্গ । কয়েকটি বইও আছে। তার একটি "কুর্চি বনের গান"। প্রথম পাতা উল্টাতেই দুলাইনের তোমার লেখা --
"যতবার তোমার কাছে আসতে চাই,
ততবারই আমি দূরে চলে যাই, এত দূরে যাই যে সে এক অসীম অনন্তপুর।
তুমি কখনোই অত দূরে আসবে না জানি।"
এই বৈশাখের সকালে এত সুন্দর রোদের ভিতর তোমার ছায়া খুঁজতে থাকি। পাতা ঝরে পড়ছিল বৃক্ষরাজি থেকে। হঠাৎ কেমন বিবাগী মন হয়ে উঠেছে আমার। বইয়ের পাতাগুলো জীর্ণ পাতার মতো মর্মর করছে। সেই কবেকার এক দুপুরের কথা মনে পড়ছিল --
সেদিন ছিল আমার জন্মদিন। কিন্তু আমার মনে ছিল না। তখন কেউ এইদিন আজকের দিনের মতো করে মনে রাখত না। কিন্তু তুমি মনে রেখেছিলে। তুমি তোমাদের বাসা থেকে পায়েস ও পরোটা করে এনেছিলে। আমার পকেটে একটি টাকাও ছিল না। হলের ক্যানটিনে না ঢুকে সোজা ক্লাসে চলে এসেছিলাম। হেনা স্যারের ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরি বারান্দায় দুজন যেয়ে বসি, তুমি পরোটা ছিড়ে ছিড়ে পায়েস পুরে আমাকে দিচ্ছিলে। তারপর খাওয়া শেষে তুমি আমাকে দিলে -- "কুর্চিবনের গান"।
লেখার নীচে তোমার নাম নেই। তুমি আমার কেউ ছিলে না, তারপরও গোপন করে রেখেছিলে তোমার কথা। আমি ছিলাম একটা ইডিয়ট, অনেক গোপনের অর্থ বুঝতাম না। মানুষের অনেক নীরব অভিব্যক্তিও। তারপরও তুমি বলেছিলে সেদিন, কিছু একটা বলো। কিছুই বলিনি সেদিন। আমি যেটি পারতাম তাহলো কবিতা -- লিখে এনেছিলাম না খাতায়। এমনি মুখে মুখে বলেছিলাম। সব কথা, সব শব্দ আজ আর মনে নেই। অনেকটা এমন ছিল মনে হয় -- নীচের এমনটাই হয়ত বলতে চেয়েছিলাম সেদিন, তা না বলে বলেছিলাম অন্য কথা, অন্য কবিতা ---
" চপল ঢেউয়ের মতো এঁকেবেঁকে
পুষ্প কানন থেকে মাধবীলতা আসলেন
হঠাৎ সজল বাতাসে উন্মুখ হয়ে উঠল এক ভ্রমর।
মাধবী তার পদ্মযৌবন পাপড়ি মেলে ধরলেন
কোনো বিষাদ নেই, সে যেন উতলা হয়ে আছে
বিস্মরণের এক রমণীর মতো।
বহুকাল পরে ভ্রমর যেন প্রাণ পেলেন মাধবীর পুষ্পিত দেহ বল্লরীর সৌরভে, এবং স্নাত হলেন
তার অন্তঃপুরের সকল ধারায়।"
আজ নিজেকে বলছি স্বগোতক্তি করে -- হে আহম্মক, এই কথা তুই বলিসনি সেদিন। এই কথা বললে কী তোর মাধবী এত দূরে চলে যায়!
কাউকে ভালোবাসতে চাইলে পরিকল্পনা করে ভালোবাসতে নেই। ভালোবাসা হতে হয় নদীর জলের মতো স্বচ্ছ ও গতিময়। চলবে স্রোতের টানে, ভেসে নিয়ে যাবে, যতদূরেই থাক মোহনা। তবে ভালোই করেছ, আমাকে ভাল না বেসে। জীবনের কোনো সফল প্রাপ্তি পেতে না তুমি। এ যে অপ্রাপ্তিতেই গড়িয়ে যেত। তার সব কিছুই আজ মূল্যহীন হয়ে যেত। ভালোই করেছ মূর্খ্যামী না করে।
মাধুকরীতে বুদ্ধদেব গুহ লিখেছিল -- হুসের মানুষদের কপালে ভালোবাসা জোটে না। যারা হারাবার ভয় করে না কিছুতেই, একমাত্র তাঁরাই ভালোবেসে সব হারাতে পারে। অথবা অন্যদিক দিয়ে দেখলে মনে হয়, যাকিছুই সে পেয়েছিলো বা তাঁর ছিলো, সেই সমস্ত কিছুকেই অর্থবাহী করে তোলে ভালোবাসা। যে ভালোবাসেনি তাঁর জীবন বৃথা। তবুও বড় কষ্ট ভালোবাসায়। এমন মহা বোধ আর কি আছে?"
আজ আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। মন কেমন উড়ো উড়ো লাগছে। জানি না তুমি এখন কী করছ? আবারও স্বপ্নের কথা চলে আসছে। জীবন মানুষের দুবার আসে না। একবারই আসে ক্ষণকালের জন্য এই মহাকালের পৃথিবীতে। তুমি একবার তোমার একটি চিঠিতে লিখেছিলে, ".... যদি তুমি আসো একবার এখানে -- তোমাকে নিয়ে দানিয়ুব নদীর পাড়ে বেড়াতে নিয়ে যাব। একপাশে আছে পাহাড়, সেই পাহাড়ের ঢালে ফুটে থাকে অজস্র রডোডেনডন গুচ্ছ। আমরা দুজন বিমুগ্ধ হয়ে দেখব নদীর জল, পাহাড় আর রডোডেনডন। "
না গো মাধবী, এই জীবনে আমার আর রডোডেনডন দেখতে ইচ্ছে করছে না। আজ এই অস্তবেলায় তোমাকে নিয়ে কুর্চিবনে যেতে ইচ্ছে করছে। তুমি জানাইও তোমাদের দানিয়ুব নদীর কূলে কোনো কুর্চিবন আছে কী না?
ভোরের আলোয় পথ চিনে বেরিয়ে পড়েছি পথে। কোথা' থেকে ভেসে আসছে অচেনা সুবাস, কেমন এক অস্পর্শ ফুল ফুটে আছে কোন্ সুদূরের কুসুম কাননে।
আমি তার আরক্ত পরাগ রেণূতে ছুঁয়েছি ঠোঁট, যেন প্রজাপতি প্রথম পালক রেখে গেল পত্রপল্লবে। এমন লাজুক প্রস্ফুটিত পাঁপড়িতে বসেনি এর আগে কোনও উড়ন্ত মৌমাছি থামিয়ে দিয়ে ডানা, শুষে নিতে পারেনি এর মধুরিমা।
আজ আর কোনো পত্র লেখা হলো না তোমাকে। ভালো থেকো তুমি মাধবী।
-- রঞ্জন।
৪ মে, ২০২১ ইং, ঢাকা।
৪. প্রথম নিমন্ত্রণ
আফছার ডাকাত প্রায় ছয় মাস পর আজ তার গ্রামের বাড়িতে আসলো। বাড়িতে সবাই জানত -- আফছার একটি কোস্টাল জাহাজে লোডারের চাকুরি করে। কিন্তু আসলে তা নয়। সে একজন সক্রিয় ডাকাত দলের সদস্য।
বাড়িতে তার স্ত্রী কন্যা ও মা থাকে। মা বৃদ্ধা। চোখে ভালো মতো দেখতে পায় না। আবছা আবছা দেখে। সে সারাক্ষণ বারান্দায় ধারীর উপর শুয়ে বসে থাকে। ওখানেই খায়, ওখানেই ঘুমায়।
আফছারের একটি গুণ -- সে নিজ জেলায় চুরি ডাকাতি করে না। সে করে ময়মনসিংহ ও সুনামগঞ্জের গ্রাম অঞ্চলে। বিশেষ করে হাওর এলাকায়।
নৌকা করে তারা ডাকাতি করে বেড়ায়। আফছারের যিনি ওস্তাদ, তার বাড়ি হচ্ছে ময়মনসিংহের গফরগাঁও - এ।
আফছারের স্ত্রীর নাম মায়মুনা। সে গরীবের ঘরের মেয়ে। বাবা দিনমজুর। মায়মুনা দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল। খুব তাড়াতাড়ি কদম্ব ফুলের সুবাস ঝরে পড়তে থাকে তার শরীর থেকে। উষ্ণ নজর পড়ে তার দিকে। ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা স্বর্ণলতিকার মতো মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই মায়মুনার বিয়ে হয়ে যায় এই আফছার ডাকাতের সাথে।
আফছার অষ্টম শ্রেনী পাশ। সে জাহাজের একজন লোডার। মায়মুনা, তার আত্মীয় স্বজন এবং গ্রামবাসী এমনটাই জানে। আফছার জাহাজে কাম করে। এমন একটি স্বামী পেয়ে মায়মুনাও দারুণ খুশি হয়।
আফছারের মেয়েটির বয়স তিন বছর। নাম পরী। দেখতে পরীর মতো। পরীর দাদী সোহাগ করে নাতনীর নামটি রেখেছিল তাই -- পরী।
আফছার বাড়িতে আসার সময় ডাকাতি করা টাকা পয়সার ভালোই ভাগ পেয়েছিল। সব মিলে হাজার সাতেক টাকা সে আনতে পেরেছিল। ট্রেন থেকে সিরাজগঞ্জ বাহিরগোলা স্টেশনে নেমে শহর থেকে সে অনেক কিছুই কেনাকাটা করে। মায়মুনার জন্য ভালো দেখে একটি কমলা রঙের তাঁতের শাড়ি কেনে, পরীর জন্য জামা কাপড়, জুতা, খেলনা, এবং মায়ের জন্যেও ভালো একটা পরনের কাপড় কেনে। তেল সাবান, পাউডার, স্নো, আতরও কেনে মায়মুনার জন্য।
আফছার আসার পথে যখন শৈলাভিটার খেয়াঘাট পার হচ্ছিল, সে তখন দেখতে পায় এক লোক একটি বড়ো তাজা কাতল মাছ বিক্রি করার জন্য ঘাটে বসে আছে। আফছার বাড়ির জন্য সেই মাছটিও কিনে নিয়ে আসে।
মায়মুনা অনেক খুশি। নিজের জন্য, মেয়ের জন্য, শ্বাশুড়ির জন্য নতুন কাপড় পেয়েছে। সে মহাধুম করে কাতল মাছ রান্না করে বেগুন আর নতুন আলু দিয়ে। রাতে আফছার যখন কাতল মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছিল তখন সে মায়মুনাকে বলছিল, তরকারি খুব স্বাদ হইয়াছে। ফাস্ট ক্লাস রাঁধিয়াছো তুমি মায়মুনা। '
স্বামীর এমন প্রসংসা শুনে মায়মুনা মিটিমিটি করে হাসতে থাকে। কেরোসিনের কুপীর আলোয় তার সেই মুখের হাসিটি কেউ দেখতে পায় নাই। এমনকি আফছারও না।
মায়মুনা আজ তার শ্বাশুড়িকেও খুব যত্ন করে কাতল মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ায়। খাওয়ানোর সময় মায়মুনা শ্বাশুড়িকে বলেছিল --
'আম্মা, আপনার ছোয়াল আপনার জন্য একখান শাড়ি কাপড় কিনে এনেছে'।
রাতে বিছানায় শোবার আগে আফছার পান মুখে দিয়ে একটি গোল্ডলীফ সিগারেট ধরায়। সিগারেট টানতে টানতে মায়মুনাকে সে বলছিল -- আমি বাড়িতে থাকি না, তোমার মনে হয় খুব দুঃখ কষ্ট হয়, তাই না?
-- জ্বী।
-- আমার কথা মনে পড়ে?
-- জ্বী, খুব পরান পোড়ে।
-- আমি এবার যেয়ে কিছুদিন পরেই একেবারে বাড়িতে চলে আসব। ওখানে ঐ কাম কাজ আর ভালো লাগে না। খুব বিপদের কাজ। দরিয়া খুব উত্তাল হয়ে ওঠে। বড়ো বড়ো ঢেউ হয়। আমার শরীর কাঁপতে থাকে। তখন তোমার মুখখানির কথা খুব মনে পড়ে।
-- তুমি অমন বিপদের চাকুরি আর কইরো না। বাড়িতেই চইলা আইসো।
-- হু। এবার চলে এসে এই গায়ে প্রয়োজনে কামালা বেইচা খাব। তাও ভালো।
-- খুব খুশি হইলাম। আমার খুব ভয় করে তোমাকে ছাড়া একা একা থাকতে । তুমি কাছে থাকলে আমার কোনো ভয় লাগব না।
আফছার মায়মুনাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভিতর নিয়ে বলতে থাকে -- তোমার আর কখনও ভয় পেতে হবে না। আমি এমন করেই এরপর থেকে আমার বুকের মাঝে তোমাকে সারা জীবন জড়িয়ে রাখব।
আফছার সপ্তাহ খানেক বাড়িতে থাকে। সে যখন বাড়িতে আসে তখন তার ওস্তাদ মোবারক মোল্লা তাকে বলে দিয়েছিল -- 'আফছার, তুই তাড়াতাড়ি চলে আসবি। একটা ভালো দাইন আছে সামনে। তরে থাকতে হইব। ভালো ভাগ পাবি। তুই এবার বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। তরে আমি সাত দিনের ছুটি মঞ্জুর কইরা দিলাম।'
আফছার যেদিন বাড়ি থেকে চলে যাবে, তার আগেরদিন ছিল হাটবার। সে হাটে যায়। হাট থেকে খেজুর গুরের জিলাপি ও বাতাসা কেনে। হাটে ওর খাতিরা এক লোকের সাথে দেখা হয়। তার সাথে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত্রি হয়ে
যায়।
আফছার যখন বাড়িতে ঢুকছিল সেই মুহূর্তে সে দেখতে পায় --- এক যুবক মায়মুনার ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল বাড়ির অন্য দিক দিয়ে। আবছা অন্ধকারে ঐ যুবককে চিনতে পারল না -- যুবকটি কে? কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন ভাবছিল সে।
হাটে যাওয়ার আগে আফছার মায়মুনাকে বলে গিয়েছিল -- তুমি আজ নতুন শাড়িটি পরবে। মুখে পাউডার স্নো মাখবে। চুলে দেবে সুগন্ধি নারিকেল তেল। আর গায়ে মাখবে আতর। আফছার ঘরে যেয়ে দেখতে পেল -- মায়মুনা সেজেগুজে বসে আছে। ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ।
মায়মুনা আফছারকে রাতের খাবার খেতে দেয়। কিন্তু সে তেমন কিছু খেতে পারল না। মায়মুনা বলে -- তুমি খাচ্ছ না যে৷!
---- কাল সকালে তোমাদের ছেড়ে চলে যাব। খুব মন খারাপ লাগছে, এইজন্য খেতে ইচ্ছে করছে না।
রাত অনেক হয়ে গিয়েছে তখন। আফছার বলছিল, তোমাকে নতুন কাপড়ে খুব ভালো লাগছে। এসো বুকের মাঝে।'
আফছার মায়মুনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে --তোমার শরীর থেকে কেমন যেন উৎকট, কেমন যেন দুর্গন্ধময় গন্ধ পাচ্ছি।
-- কেন, আমি তো তোমার দেওয়া আতর মেখেছি গায়ে। সেই আতরের গন্ধ তুমি পাচ্ছ হয়ত।
-- হয়ত তাই হবে। আতরের গন্ধটাই খারাপ।তোমার শরীর থেকে পাগলকরা সেই চেনা গন্ধটা পাচ্ছি না। যে গন্ধটা আমাকে মাতাল করে তোলে। আজ তোমার শরীর থেকে কেমন যেন একটা অপরিচিত গন্ধ
আসছে ।
-- এমন করে বলছ যে !
--- এমনি বলেছি। তোমার শরীর থেকে তোমারই সুগন্ধ পাচ্ছি। চলো না, একটু পুকুর পারে যাই। বাইরে রূপালি চাঁদের রাত। সারা বিশ্ব জমিন আজ জোছনার চাদরে ঢেকে আছে । চলো -- সেই চাদরের উপর আমরা যেয়ে শুয়ে থাকি।
পরী ঘুমাচ্ছে। আফছারের মা'ও খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সন্ধ্যা রাতেই । দরজা খুলে দুজন বেরিয়ে পড়ে। চলে যায় তারা পুকুর পারে।
সমস্ত পৃথিবী জোছনায় ডুবে আছে। কোথা থেকে যেন কাঁঠালীী চাঁপার মাতাল গন্ধ ভেসে আসছে। আফছার তার দুই হাত দিয়ে মায়মুনার দুই বাহু চেপে ধরে। এ যেন কাছে পাওয়ার প্রথম নিমন্ত্রণ। মায়মুনা আবেশে বলছিল --
'ওগো তুমি আমাকে বুকে টেনে নাও , আমার বুক থরথর করে কাঁপছে। আফছার বলে -- ''আরও কাছে আসো।'
মায়মুনা আরও নিবিড় হয়, এবং বলছিল -- এই ঘাসের উপরে তুমি আমাকে শুয়ে দাও। তোমার সমস্ত ভালোবাসা এই অলৌকিক জোছনায় মেখে আমাকে আদর করো, ঢেলে দাও তোমার যত অনন্ত সুখ ।
আফছারের দুটো হাত তখন মায়মুনার গলা পর্যন্ত চলে গেছে। সে শক্ত কঠিন করে মায়মুনার গলা টিপে ধরে। তার প্রাণ নিঃস্পন্দন না হওয়া পর্যন্ত সে হাত চেপে ধরেই থাকে ।
ভোর বেলা সবাই দেখতে পায় -- মায়মুনার নিথর দেহ পুকুরপারে ঘাসের উপর পড়ে আছে। শিশিরে সিক্ত হয়ে আছে তার পরনের কাপড় ও অমল দেহখানি৷ কোনো কোনো ভোর কোমল সুন্দর বিষণ্ণতারও হয়। সূর্যের কাঁচা হলুদ আলোয় মায়মুনার মুখটি রাঙাময় হয়ে উঠেছিল।
আফছার নেই। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল
না।
কয়েকদিন পর একটি জাতীয় দৈনিকে ছোট্ট একটি নিউজ হয় তৃতীয় পাতায় -- কলমাকান্দার একটি গ্রামে ডাকাতি করতে যেয়ে গ্রামবাসীর টেঁটার আঘাতে আন্তঃ জেলা ডাকাত সর্দার মোবারক মোল্লা ও তার একান্ত সহযোগী আফছার ডাকাত সহ মোট পাঁচ ডাকাত নিহত হয়েছে। এই ঘটনায় স্থানীয় থানায় একটি মামলা রজ্জু করা হয়েছে।
৭ আগস্ট, ২০২০ ইং
মানসী কুঞ্জ, দক্ষিণখান, ঢাকা।
৫. আঁধারের গান
সেদিন দুপুরের পর থেকেই মনটা ভালো লাগছিল না। কেন যে ভালো লাগছিল না, তারও কোনো কারণ নেই। অকারণে মন খারাপ করে থাকাটা নাকি ফ্যাসানের পর্যায়ে পড়ে। কৈশরে একবার এমন ফ্যাসান করে আমি ও আমার বাল্যবন্ধু মুকুল পাকা ধানক্ষেতের পাশে মেঠোপথের ঘাসের উপরে চৈত্রের তপ্ত রোদের নীচে তিন ঘন্টা শুয়ে থেকেছিলাম। উদ্দেশ্য কিছুই না। পাগলামি। ফ্যাসান। অনেক বছর পরে একবার বাড়িতে গেলে মুকুলের সাথে আমার দেখা হলে ওকে বলি, তোর কী সেই রোদ্রে পোড়ার কথা মনে আছে?
-- আছে।
-- আবার ইচ্ছা হয়?
-- হয়।
মুকুল এখন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের অনেক বড়ো কর্মকর্তা।
বারান্দায় যেয়ে বেতের ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে থাকি। কত আবোল তাবোল কথা ভাবনায় চলে আসে। আহা,, সৃষ্টিকর্তা যদি আর একবার পুণর্জন্ম হওয়ার চাঞ্চ দিত। জন্মটা তাহলে কোথায় নিতাম! পৃথিবীতে কত সুন্দর সুন্দর জায়গা নাকি আছে। বইয়ে পড়েছি। কত ভূসর্গ,, কত নয়নাভিরাম পাহাড়ের পাদদেশ, কত সুন্দর নদীর কুলে গ্রাম, কত শিল্পিত কারুকার্যময় শহর। সৃষ্টিকর্তাকে বলে কয়ে সেখানে জন্ম নিতাম না হয়। কিন্তু নাহ্, ঐসব স্থানে নয়। জন্ম নিতাম আবার পল্লীর নিবিড় সবুজ সেই কুসুমপুর গ্রামে। আমাদের সেই টিনের চালা ঘরে, হেমন্তের আবছায়া সন্ধ্যা রাত্রিতে। একে একে জ্বলে উঠবে আকাশে সব তারা। ঝিঁঝি পোকার নিভু নিভু আলো জ্বলবে। অদূরে সেদিনও কুলকুল করে বয়ে যাবে যমুনার স্বচ্ছ জল।
কিছু সময় আসে খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছা করে। যারা সিগারেট খায় তারাই বোঝে ব্যাপারটা। ডাক্তারের মানা আছে সিগারেট খেতে। আর আমার সিগারেট না খেতে দেওয়ার যম হচ্ছে আমার স্ত্রী। থাক্ সেই সব দুঃখের কথা। কখন অপরাহ্ণ হয়ে এল, কখন বাঁশঝাড়ের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর এসে মুখের উপর পড়েছে বুঝতে পারিনি। ট্রাউজার পরে, টি সার্ট গায়ে দিয়ে, পায়ে চপ্পল পরে ঘর থেকে বের হই। স্ত্রী বলছিল -- কোথায় যাও?
-- স্টেশনের দিক থেকে একটু হেঁটে আসি।
-- এই অসময়ে?
-- যার কোনো কাজ নেই তার আবার কিসের সময় অসময়?
আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ। দেখলাম, কথা বেশি বাড়াল না।
পথের উপরে বিপ্লবের চা'র দোকান। উল্টা পাল্টা গান বাজছে। বিপ্লব জানে, আমি এইসব গান পছন্দ করি না। আমাকে দেখে ও গান বাজানো বন্ধ করে দেয়। আমি বসি চা'র দোকানে। বিপ্লব বলছিল -- মামা, 'ওয়ান টাইম' কাপে চা দেই?
-- দাও।
-- মামা, গান বাজাবো?
-- বাজাও।
-- লালন, না আয়নাল বয়াতি?
-- কোনোটাই না।
-- তাইলে কী বাজাবো?
-- লতা।
‘বরষে ঘন সারি রাত সঙ্গ শো যাও’
চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই বিমান বন্দর স্টেশনে। লম্বা প্লাটফরমের উত্তর দিকের শেষ মাথায় বসার বেঞ্চ গুলো সাধারণত খালি থাকে। আমি ওখানে গেলে যে বেঞ্চে বসে থাকি -- আজ দেখি ' বাউডান্ডা' টাইপের এক লোক ব্যাগ মাথার নীচে দিয়ে সেখানে শুয়ে আছে। দেখে মনে হলো, লোকটা এতক্ষণ ঘুমিয়েছিল, মাত্রই সে জেগে উঠল। আমি বেঞ্চের কাছে যেতেই সে শোয়া থেকে উঠে বসল।
আমি ওনাকে বলি -- ভাইজান আমি একটু বসি?
-- বসেন।
-- ভাইজান, আপনি কোথায় যাবেন?
-- সিলেট।
-- সিলেট আপনার বাড়ি বুঝি?
-- না। শাহজালালের দরগায় যাচ্ছি।
-- বেশ।
হঠাৎ আমার চোখে পড়ল লোকটার ব্যাগের পাশে হুমায়ুন আহমেদ-এর 'আধারের গান' বইটি পড়ে আছে। মনে হলো বইটি পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। লোকটার প্রতি আমার ধারণাটা একটু পাল্টে গেল। আমি ওনাকে বলি -- 'ভাইজান আমি আপনার পরিচয়টা কী একটু জানতে পারি? মানে আপনার বাড়ি কোথায়, আপনার নাম কী, আপনি কী করেন? '
-- আমার বাড়ি টাংগাইলের মির্জাপুর। নাম মোঃ আবদুল কাদের, আমি কিছু করি না। ঘুরে বেড়াই, খাই, ঘুমাই। তা আপনি কোথায় যাবেন?
-- আমি কোথাও যাব না। এই স্টেশনেই এসেছি ঘুরতে।
-- আপনার সাকিন কোথায়?
-- দক্ষিণখান। এখান থেকে সামান্য দূর। মন খারাপ থাকলে এখানে চলে আসি। এসে এই বেঞ্চের উপর বসে থাকি।
-- আপনার কী আজ মন খারাপ?
-- জ্বী।
-- কী জন্য মন খারাপ?
-- তা বলতে পারব না।
-- আপনি কী ধূমপান করেন?
-- আগে করতাম। এখন করি না। ডাক্তার ও স্ত্রীর মানা আছে।
-- একটাও খান না?
-- বেশি মন খারাপ থাকলে চুরি করে এক দুইটা খাই।
-- এখন একটা খান আমার সাথে।
-- আছে?
-- আছে।
কাদের আমাকে একটি সিগারেট ওফার করল। আমি সিগারেটটি ঠোঁটে নিলাম। সে গ্যাস লাইটার জ্বালিয়ে ধরিয়ে দিল। এবং নিজেও একটা ধরালো।
কাদের সিগারেট টানতে টানতে বলছিল -- ভাইসাব, আপনি কী করেন?
-- আমি কিছু করি না।
-- কিছুই করেন না?
-- একটু আধটু লিখি টিখি। আর আমার ছোট মেয়েকে বাংলা পড়াই।
-- খুব ভালো।
-- আপনি হুমায়ুন আহমেদ- এর বই মনে হয় খুব পছন্দ করেন?
-- জ্বী। আপনি তো লেখক মানুষ। তা আমার কিছু জীবনের কথা নিয়ে কিছু লিখেন না?
-- আমার কাজই তো মানুযের জীবন কাহিনি নিয়ে লেখা। তা বলেন, আমি শুনি।
-- দাঁড়ান। আমি আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে নেই। আপনি কী আরও একটা খাবেন?
-- না। আর খাব না। একটা খেয়েছি। তাই প্রতিশ্রুতি অনেকখানি ভঙ্গ হয়েছে। আর বেশি ভঙ্গ করতে চাই না।
আবদুল কাদের তার জীবন কাহিনি বলতে শুরু করল। আমি ওর জবানেই এখানে লিখলাম। (অবশ্য কিছু পরিমার্জন করেছি। অপ্রয়োজনীয় কিছু অংশ বাদও দিয়েছি। এবং কিছু সংক্ষিপ্ত করেছি।)
আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যায়। আমার বাবা একজন স্কুল মাস্টার ছিলেন। আমার দুই ভাই ছিলাম। আমি ছিলাম ছোট। আমার বড়ো ভাই আমার দশ বছরের বড়ো ছিলেন। মাঝে একটা বোন হয়েছিল সে জন্মের সময় মারা যান।
বড়ো ভাই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কালিয়াকৈরে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কেরাণীর চাকুরি নেয়। আমার পড়াশুনা ও আমাদের সংসার চালানোর দায়িত্ব আমার ভাইটির উপরেই পড়ে। ভাগ্যের এমনই পরিহাস, বাবা মরে যাওয়ার দুই বছর পরে আমার মা'ও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
সংসারে যেহেতু কোনো মেয়ে মানুষ রইল না, তখন আমার ভাইটি বিয়ে করেন। সংসারে ভাবী এসে সংসারের হাল ধরেন। আমার ভাবী আমার থেকে তিন চার বছরের বড়ো ছিলেন। সে আমাকে তার ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন। আদর যত্ন করতেন। সে কখনোই আমার মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেয় নাই।
আমি যখন বিএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, তখন আমার ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সে ছিল নিঃসন্তান। তাদের কোনো ছেলে মেয়ে হয় নাই। তবে জানা গিয়েছিল আমার ভাইয়ের সমস্যার কারণে তাদের কোনো সন্তান হয় নাই।
সবাই ভেবেছিল -- আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর ভাবী আমাদের সংসার ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু যায় নাই। আত্মীয় স্বজন সবাই বলেছিল -- আমাকে বিয়ে করতে। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয় নাই। সে বলত, আমি কাদেরকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখি। ওকে আমার বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমি এই সংসারে ওর বড়ো বোন হয়ে থাকব। কোথাও যাব না।
তাছাড়া, আমারও মত ছিল না। যাকে নিজের বোনের মতো সেই কিশোর বয়স থেকে দেখে এসেছি, যাকে মায়ের আসলে স্হান দিয়েছি। তাকে কী করে বিয়ে করব? ভাবীর সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাবটা চাপা পড়ে যায়।
এই পর্যন্ত বলে আব্দুল কাদের থেমে গেল। আমি বললাম, তারপর কী হলো বলেন। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে -- একটু চা খেতে ইচ্ছা করছে, এবং সিগারেট।
আমি একজন ফ্লাস্কে চা সিগারেট বিক্রেতাকে ডাকলাম। কাদেরকে চা খাওয়ালাম। এবং এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিলাম। সে সিগারেট ধরিয়ে বলে -- আপনিও একটা ধরান। বললাম, দেন।
আবদুল কাদের আবার বলতে শুরু করল --
আমিও একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানেে ছোট্ট চাকুরি নেই।
কয়েকমাস কাটছিল ভালোই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আশেপাশের লোকজন নানা গুঞ্জন করতে শুরু করতে লাগল। একই বাড়িতে দুজন যুবক যুবতী থাকি। নানান জন নানা রসালো কথাবার্তা বলতে থাকে। কিন্তু আমার ভাবী ছিল নির্বিকার। সে এইসব কানে তুলত না। আমিও খুব একটা তেয়াক্কা করতাম না। ভাবতাম -- নিজে ভালো তো জগৎ ভালো।
কিন্তু প্রকৃতি প্রভাবিত করেছে তার নিজস্ব চিরন্তন নিয়মে। জীবনের অনেক কিছুই এলোমেলো করে দেয় অসম্ভব সুন্দর কিছু প্রকৃতি। প্রকৃতি জীবনকে যেমন সুন্দর করে, মন ভালো করে, তেমনই আবার জীবনকে তছনছ করে দেয়। কালিমাও মেখে দেয় ।
সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি। চোখে ঘুম আসছি না। এমন উদাস করা জোছনা রাতে দুচোখ মুূদে ঘুম আসার কথা। কিন্তু ঘুম আসছিল না। আমি জানালা খুলে দেখি -- অলৌকিক এক আলোর ভুবন। চারিদিকে মুখর করা জোছনার বন্যায় ভেসে গেছে। আমি দরজা খুলে উঠোনে চলে আসি। কলপারের পাশে হাস্নাহেনার ঝাড় থেকে আকুল করা গন্ধ ভেসে আসছিল। ঘরের দরজা খোলার শব্দ শুনে ভাবী বের হয়ে আসে উঠানে। সে দেখতে পায় -- আমি উঠানে ফেলে রাখা একটি পুরানো বেঞ্চের উপর বসে আছি। সে বলে -- তুমি এখানে কী করছ?
-- ঘুম আসছিল না। তাই এখানে এসে বসে আছি।
ভাবী আমার কাছে এসে বলে -- যাও ঘরে যাও।
-- তুমি ঘুমাওনি যে!
-- ঘুম আসছিল না। জেগে ছিলাম। তোমার বের হয়ে আসার শব্দ শুনে আমিও চলে এলাম।
-- ঘুম আসছিল না কেন?
-- জানি না।
ভাবী আমার হাত ধরে বলে -- কাল সকালে তোমাকে উঠতে হবে। অফিসে যেতে হবে। যাও, ঘরে যাও। ঘুমিয়ে পড়ো।
একবার ভাবীর খুব জ্বর হয়েছিল। এত জ্বর যে, ১০৩/৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর। তাকে ঔষধপত্র, পথ্য খাওয়ানো হয়। তবুও জ্বর কমছিল না। আমি সারারাত ভাবীর পাশে বসে থাকি। কপালে জলপট্টি দেই। মাথায় পানি দেই। জ্বরের দ্বিতীয় রাতেও ভাবীর পাশে বসে থেকে তাকে সেবা শুশ্রূষা করছিলাম, জলপট্টি দিতে দিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি নাই। হঠাৎ ভাবীর গোঙানির শব্দ শুনতে পাই। কপালে হাত দিয়ে দেখি -- জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সে অজ্ঞান হয়ে আছে। আমি কপালে জলপট্টি ও মাথায় পানি দিতে থাকি। তারপরও জ্বর নামছিল না। সে অজ্ঞান হয়েই আছে। কাপড়ে জল ভিজিয়ে সারা শরীরে স্পঞ্জ করে দেই। এবং আস্তে আস্তে একসময় তার জ্ঞান ফিরে আসে। ভাবী দেখতে পায় তার শরীর শীতল এবং জলে ভিজে আছে। পরনে ব্লাউজ অন্তর্বাস কিছু নেই। সে সলজ্জিত হয়। শরীরে জ্বরের উত্তাপ নেই। তার চোখে মুখে স্নিগ্ধ হাসি তখন।
আর একদিনের কথা। তখন বসন্ত সময়। সেদিন হঠাৎ সন্ধ্যারাত থেকেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। বসন্তের অসময়ের এমন উতল বৃষ্টির সাথে মাতাল হাওয়ায় প্রকৃতিও উতলা হয়ে উঠে। আমি আর ভাবী একই ঘরে খাটের উপর বসে আছি। টিনের চালের উপর ময়ূরাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটা ঝমঝম করে ঝরে পড়ছে। এমন বৃষ্টির শব্দে হৃদয় বীণায় তখন অন্য গানের সুর। বিদ্যুৎ চলে যায়। সারা ঘর অদ্ভুত আঁধারে ছেয়ে গেছে। শুধুই আঁধার নয় তখন। তখন আঁধারের গান বাজছিল বৃষ্টি নিশীথে। আমরা পাপ পুণ্য ভুলে যাই। ভাবী কখনো কী বোন হয়? দেবর কখনো কী ভাই হয়? আমরা ভুলে যাই এই সম্পর্ক, এইসব অলিক অনুশাসন। বৃষ্টির সুরে জলের নুপুরে আর আঁধারের গানে আমাদের দুটো প্রাণ একাকার হয়ে যায়।
আবদুল কাদের এই পর্যন্ত বলে আবার থেমে যায়। আমি ওনাকে বলি -- থামলেন কেন? বলেন। সে আরও একটি সিগারেট ধরায়। এবং জোরে শ্বাস নিয়ে সিগারেট টানতে থাকে। একটু দম নিয়ে সে বলতে থাকে আবার ---
একসময় বৃষ্টি থেমে যায়। আমি চলে যাই আমার ঘরে। সকালে ঘুম ভাঙ্গে একটু দেরিতে। ঘুম থেকে উঠে দেখি -- ভাবীর ঘরের দরজা খোলা। ভিতরে সে নেই। এবং কোথাও সে নেই। লজ্জায় আর গ্লানিতে সে সেই রাত্রিতেই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
আমি আবদুল কাদেরকে বলি -- তারপর ওনার আর কোনো খোঁজ পাননি?
--- পেয়েছিলাম দশ বছর পর।
--- বলুন কী ভাবে?
--- একদিন একটা চিঠি পাই। অজ্ঞাত কেউ একজন লিখেছিল। চিঠিটা এইরূপ ছিল --
জনাব,
আমি চট্টগ্রাম থেকে লিখছি। সাহানা নামে কোনো একজন মহিলা সম্ভবত সে আপনার আত্মীয় হয়।সে এতদিন তার পরিচয় গোপন রেখেছিল। এই মেয়েটি আমাদের বাসায় ঝিয়ের কাজ করত। গত একবছর ধরে তার লিভার সিরোসিস রোগ হয়েছে। আগামী ২৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার একটি জটিল অপারেশন হবে। সাহানা কেঁদে কেঁদে বলছিল আপনার কথা। সে আপনাকে দেখতে চায়। পারলে আপনি চলে আসবেন।
ইতি -- ইকবাল হাসান চৌধুরী।
হাতে সময় ছিল না। তারিখ মিলিয়ে দেখলাম ---আগামীকাল সকাল দশটায় অপারেশন। রাতের ট্রেনেই চলে যাই চট্টগ্রামে। হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল এগারোটা বেজে যায়।
হাসপাতালের বারান্দায় দেখি কয়েকজন নারী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে ইকবাল সাহেবও ছিলেন। আমি তাকে আমার পরিচয় দেই। ইকবাল সাহেব আমাকে বলেন -- সাহানা আপনার কী হয়? আমি বলি -- আমার ভাবী হয়।
অপারেশন থিয়েটারে তখন অপারেশন চলছিল। আরও ঘন্টা দেড়েক পরে একজন সহকারী সার্জন বের হয়ে এসে বলেন -- আমরা দুঃখিত, রোগিণীকে বাঁচানো গেল না।
আমি ডাক্তার সাহেবকে বলি -- ওনার কী জ্ঞান ফিরেছিল না ?
-- ফিরেছিল তিরিশ সেকেন্ডের মতো।
-- কোনো কথা বলেনি?
-- বলেছিল, অস্ফুট স্বরে একটি শব্দ !
-- কী সেই শব্দ?
-- ' কাদের। '
কাদের তার জীবনের কাহিনি বলা থামিয়ে দেয়। চেয়েে দেখি -- তার চোখে জল।
সিলেট গামী ট্রেনটি ততক্ষণে প্লাটফরমে ঢুকে পড়েছে। সে দ্রুত আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে যেয়ে ওঠে। বেঞ্চের উপর সে ফেলে রেখে যায় ' আধারের গান '।
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।
৬. হৈমন্তীবালা
দুই হাজার নয় সালে একবার আমরা শিলিগুড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাাম । বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ করেছিল শিলিগুড়ির আমাদের বন্ধু শিশির রায়। শিশির এবং ওর স্ত্রী পৃথার প্রবল ইচ্ছা ছিল আমরা শিলিগুড়িতে যেয়ে ওদের বাড়িতেই উঠি। কিন্তু তা না উঠে আমরা হোটেল সেন্ট্রাল প্লাজাতে উঠেছিলাম।
এই ভ্রমণের উপর বেশ কিছু লেখা এর আগে আমি লিখেছিলাম। সেইসব লেখা ফেসবুকে ও ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল। আজ সেই সব কথা আর বলব না। আজ বলব অন্য কথা।
ছোট্ট এই শহরে এলাম। শহর থেকে একটু দূরে গেলেই পাহাড় দেখা যায়। আবার যদি মন চায় সমতলে পাকা রাস্তার উপর দিয়ে ট্যাক্সি চালিয়ে চলে যাওয়া যায় তিস্তার পাড়ে, জলপাইগুড়ির চা বাগানে, ডুয়ার্সের বন জঙ্গলে। তিস্তার পাড়ে গেলে মনে হবে, এই নদী ওপারে বাংলাদেশেও আছে। শুধু বিভাজন করা হয়েছে সীমানারেখায় আর কাঁটা তারের বেড়ায়।
শিশির একদিন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল --আমি জানি, তুমি ভালো কবিতা লিখ। কাল আমাদের এখানে ঘরোয়া ভাবে একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছে। আমি চাই -- তুমি সেখানে তোমার একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করো।'
আমি শিশিরকে 'না' বললাম না।
এই শহরে এসে আমি কবিতা পড়ছি! এই শহরে আমি কবিতা পড়ব -- এই কথা শুনলে সবচেয়ে যে বেশি খুশি হতো, যে এসে আমার কবিতা শুনত, সে আজ এই শহরে নেই।
বহু পুরনো বহু বিস্মৃত স্মৃতিকথা মনে পড়ে মুহূর্তেই চোখ দুটো মৌনতায় স্থীর হয়ে গেল। জীবন পাতার পিছনের পৃষ্ঠাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছু
সময়।
ঝাপসা ও ম্লান হয়ে যাওয়া জীবনের সেই প্রথম দিককার পৃষ্ঠাগুলো এক এক করে উল্টাতে
থাকি ---
ফুলকোচা ফ্রী প্রাইমারি স্কুলে তখন টু ক্লাসের ছাত্র আমি। প্রথম দিনের কথা। মা আমার মাথায় সরিষার তেল মেখে পরিপাটি করে চুল আঁচড়িয়ে দিয়েছিল। জহুরা বুবু দিয়েছিল চোখে পুরু করে কাজল এঁকে । পরনে ছিল রাবার লাগানো চেক হাফ প্যান্ট। গায়ে ছিল পপলিনের সাদা হাফ সার্ট। পায়ে ছিল স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে এক কোণে চুপচাপ বসেছিলাম। ওপাশ থেকে দেখি --- হৈমন্তীবালা আমার হ্যাবলাকান্ত চেহারা দেখে মিট মিট করে হাসছে।
একদিন হৈমন্তীবালা চুপিচুপি ওদের গাছের একটি কাঁচা ঢাসা পেয়ারা এনে আমাকে খেতে দিয়ছিল। আর একদিন দিয়েছিল পূজোর প্রসাদ--- খেঁজুরের গুরের খাজা, নারিকেলের নারু আর তখতি। মাঝে মাঝে আমি কুণ্ডুদের দোকান থেকে মা'র দেওয়া এক আনা পয়সা থেকে কাঠি লজেন্স কিনে এনে হৈমন্তীকে খেতে দিতাম এবং আমিও খেতাম। ফাইভ ক্লাস পর্যন্ত হৈমন্তী আমার সহপাঠি ছিল।
একদিন দেখি হৈমন্তীবালা ক্লাসে আসেনি। কেন সে আসেনি সে কথা জানতেই -- সবাই বলাবলি করছে হৈমন্তীদের পরিবার গত রাতে দেশ ত্যাগ করে ওপারে চলে গেছে। সেই শিশু বেলায় বুঝিনি, হৈমন্তীরা কেন দেশ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল।
হৈমন্তী আর ক্লাসে আসে না। ওকে আর দেখতে পাই না। শুধু এই কথা ভেবেই মন খারাপ লাগত। ওর জন্য তখন কেঁদেছিলাম কিনা, সে কথা আজ আর মনে নেই।
তারপর চলে গেছে আরও কয়েকটি বছর।
তারপর প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হলাম। সেখানে কত নতুন নতুন সহপাঠী বন্ধু পেলাম। ঝর্ণা, দোলা, জাহানারা, সাইফুল, আমিনুল -- আরও কত বন্ধু। কিন্তু শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাওয়া আমার সেই সহপাঠিনী বন্ধু হৈমন্তীবালা আমার মনের কোণে রয়েই গেল।
তারপর চলে গেছে আরও কয়েক বছর। হৈমন্তী'রা কোথায় আছে? কেমন আছে? জানতে ইচ্ছা করত। পরস্পরে শুধু এইটুকু জেনেছি যে, ওরা নাকি জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির কাছাকাছি তিস্তা নদীর পারের কোনো একটি গ্রামে থাকে। কিন্তু কে যায় তিস্তা পারে ! কার এত দায় একজন হৈমন্তীবালাকে দেখতে যেতে ? মনেও পড়ে না ওকে তেমন আর ! আর হৈমন্তীও কী মনে রেখেছে আমাকে ?
জীবন পাতা ইতোমধ্যে লিখে লিখে ভরে ফেলেছি অনেক। বিস্মৃতির অতল আঁধারে হারিয়ে গেছে শিশুকালের সেই ফ্রক পরা লাস্যময়ী সহপাঠিনী হৈমন্তীবালা।
কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎই মনটা বিহবল হয়ে উঠত। উদাস হয়ে চেয়ে দেখতাম -- চার চালের সেই টিনের স্কুল ঘর। ছোট্ট মাঠের উপরে নিম গাছ। স্কুলে ছুুুটির ঘন্টা পড়ছে। দৌড়ে দৌড়ে বালক বালিকারা বাড়ি চলে যাচ্ছে। হাতে বই খাতা নিয়ে হৈমন্তীবালাও বাড়ি যাচ্ছে। আমিও যাচ্ছি। যাবার বেলায় ফিরে ফিরে দেখছি হৈমন্তীকে। আর হৈমন্তী দেখছে আমাকে।
তখন আমি কলেজে পড়ি। গ্রীষ্মের ছুটিতে সেবার বাড়িতে এসেছি। একদিন পিওন একটি চিঠি নিয়ে আসে। চিঠিটি ভারতীয় একটি ডাক খামের। খুলে পড়তে থাকি --
রঞ্জন,
কেমন আছো তুমি। আমি তোমার কৈশোরের সহপাঠিনী হৈমন্তী। আমাকে কি তোমার মনে আছে? চিনতে পারছ কী আমাকে? বাংলাদেশ থেকে আমাদের এক আত্মীয় এসেছিল এখানে । তার কাছে থেকে জানতে পারলাম তোমার কথা। তারপর থেকে তোমাকে আমার খুব লিখতে ইচ্ছে করছিল। তাই লিখছি এই চিঠি।
যদি আমার কথা তোমার মনে থাকে, যদি আমাকে লিখতে মন চায়, তাহলে লিখ। আজ আর বেশি কিছু লিখছি না। তোমার কাছে থেকে উত্তর পেলে তখন লিখব আরও অনেক কথা। নীচে আমার ঠিকানা দিলাম। আমি তোমার চিঠির জন্য অপেক্ষা করব।
ভালো থেকো।
ইতি -- হৈমন্তী।
হৈমন্তীর চিঠির উত্তর আমি লিখেছিলাম। ও তখন শিলিগুড়ি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ত। থাকত কলেজের কাছেই হাকিম পাড়াতে একটি ছাত্রী হোস্টেলে। হৈমন্তী খুবই সাহিত্য সংস্কৃতিমনা ছিল। ও কবিতা লিখত, আবৃত্তি করত। গানও গাইত। ওর সাথে বছরখানেক আমার পত্র যোগাযোগ ছিল। প্রায় চিঠিতে ও কবিতা লিখে পাঠাত। আমিও লিখে পাঠাতাম কবিতা। ওর লেখা একটি কবিতার কয়েকটা লাইন এখনও মনে আছে --
'আমার ছোট কিছু আশা ছিল, ছোট ছোট ভালোবাসা ছিল, ছোট কিছু স্বপ্ন ছিল, আমার কিছু পাওয়ার ছিল।
আমার কিছু আক্ষেপ আছে, বুকের নীচে কান্না আছে, চোখ ভরা জল আছে -- পুতুল খেলার ঘরটি আমার ভেঙে গেছে। ,
একখানা ঘর পাব কী আর আগের মতো, স্বপ্বগুলো কী আর ফিরে পাব পুুুুতুলখেলার সেই খেলাঘরটির মতো.... '
হ্যাঁ, আমিও স্বপ্ন দেখতাম হৈমন্তীবালার মতো। কত স্বপ্নের কথা চিঠিতে লিখে পাঠাতাম ওকে। তপ্ত রোদ্রের নীচে হাঁটতে হাঁটতে উদাস হয়ে চলে যেতাম অনেক দূরে । ইছামতীর নদীর কূলে বসে স্বচ্ছতোয়া জল দেখতাম। ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়িতে গেলে প্রায়ই চলে যেতাম স্কুল প্রাঙ্গনে। নিম গাছটা বুড়ো হয়ে সেখানেই আছে। কখনও কখনও মরা পাতা ঝিরঝির করে ঝরে পড়তে দেখতাম মাটির উপরে।
বাস্তবে কোনো কিছু পাওয়ার ভিতর যেমন আনন্দ থাকে , আবার স্বপ্নে পাওয়া বস্তু পেয়েও মানুষ আনন্দ পায়। বাস্তবে পাওয়া বস্তু হারিয়ে মানুষ আক্ষেপ করে, কান্নাকাটি করে। কিন্তু স্বপ্নে পাওয়া কোনো দূর্লভ বস্তু হারিয়ে মানুষ কাঁদে না।
কেমন করে যেন সব স্বপ্নগুলো ভেঙে গেল। একটা সময়ে হৈমন্তীবালার আর কোনো পত্র আসত না। আমি তারপরও দুতিনটি চিঠি লিখেছিলাম কিন্তু সবগুলোর নো রিপ্লাই ছিল।
কেমন যেন অন্তর হাহাকার করে উঠত। মনে পড়ত পিছনের সব মানুষ, নদী, ধানক্ষেত। শুনতে পেতাম বাউল আর ভোরের পাখিদের গান। মনে পড়ত হৈমন্তীবালার কথা। খুব ইচ্ছা হতো তিস্তা নদীতে নৌকা ভাসিয়ে চলে যাই ময়নাগুরিতে। ওখানে তো এই নদী আছে। যেয়ে খুঁজে বের করি ওর গ্রাম। ওর শহর। দেখে আসি একটিবার আমার ছেলেবেলার সেই হৈমন্তীকে।
হৈমন্তীবালার খবরটি জেনেছিলাম আরও পরে।
সেদিন সন্ধ্যায় শহর থেকে বাড়িতে ফিরছিলাম। শালুয়াভিটা নদীর খেয়াঘাট পারাপারের সময় দেখা হয় হৈমন্তীদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সাথে। ওর নাম দীলিপ। স্কুলে আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিল। সেই বলল হৈমন্তীর কথা।
হাতে শাঁখা পলা পরা হয়নি ওর। সিঁথিতেও দিতে পারেনি কেউ সিঁদুর। তার আগেই পোড়ামুখী চিতায় পুড়ে নাকি ভস্ম হয়ে গেছে। আহা! কেউ যদি ওর দেহের ছাইভস্ম ওপারের তিস্তা নদীতে ভাসিয়ে দিত, তাহলে চলে আসত সেই ছাইভষ্ম ভেসে ভেসে এপারের তিস্তায়। একই নদী, একই স্রোত, উপরে একই নীল আকাশ।
"এই স্নেহহীন, মায়াহীন, জলবায়ু শুন্য জতুগৃহে
কতোদিন শুনি না ঘুঘুর ডাক, রাখালের বাঁশি,
টানা বাতাসের শব্দ
দেখিনা সবুজ মাঠ, উধাও দিগন্ত
ঘরের পিছনের ছোট্ট জংলায় দোয়েলের উড়াউড়ি,
কোথাও দেখিনা একটি ধানের শীষে গঙ্গাফড়িং,
লাউ জাংলার পাশে স্থলপদ্ম..... "
--- মহাদেব সাহার কবিতা।
সব চাওয়া এক জীবনে পাওয়া হয় না, হয়ত বহু জন্মেও না– প্রাপ্তির আনন্দ এইটুকু পাই যেন আমি, মনের কোণে কারোর মায়া যেটুকু পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তা যেন কখনও নিঃশেষ না হয়ে যায়। শাশ্বত যুগসমূহের মধ্যে, সুদীর্ঘ অনাগত কাল ব্যেপে তা যেন ভরে থাকে। ঐ নীল আকাশ, ওই কলতরঙ্গিনী তিস্তা নদী , দূরের নীহারিকাপুঞ্জ, হলদে-ডানার প্রজাপতি, এই শোভা, এই আনন্দের মধ্যে দিয়ে যেন বেঁচে
থাকি ।
সেদিনের সেই গভীর রাতে সেন্ট্রাল প্লাজা হোটেলের কাঁচের জানালা খুলে দেখেছিলাম -- দূরের আঁধার হওয়া আকাশ। তারা জ্বলছিল তখনও। শহরের রাজপথ সব জনশূন্য। জাতীয় সড়ক থেকে দু'একটা গাড়ির কর্কশ হর্ণ শোনা যাচ্ছিল কেবল। একটা সিগারেট ধরাই। জানালার পাশ থেকে ফিরে এসে টেবিলে বসি। এই শহরে হৈমন্তীবালা থাক বা না থাক। আমার আবৃত্তি করা কবিতা সে শুনুক আর না শুনুক -- একটা কবিতা তো লিখতে হবে।
~ কোয়েল তালুকদার
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ইং
ঢাকা।
৭. নীলাঞ্জনা
ফরিদুল ইসলাম অফিস থেকে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন রাত্রি এগারোটা বেজে গেছে। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে সিড়ি বেয়ে তিনি দোতালায় উঠলেন। তালা খুলে ঘরে ঢুকেই তিনি দেখলেন, ঘর ভর্তি অন্ধকার।
সকালবেলা ঘর থেকে বের হবার সময় মনের ভুলে জানালাটা সে খুলে রেখে গিয়েছিল। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের ল্যাম্প পোস্টের নিওন আলো এসে পড়েছে ঘরে। সেই আলো দেখে তিনি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ঘুমাবার জন্য তিনি শুয়ে থাকলেন না। এমনিতেই শুয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
একটুপর বিছানা থেকে উঠে কাপড় চেঞ্জ করে সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেল -- আকাশ ভরা আজ তারা নেই। চাঁদ নেই। সজল বাতাস নেই। শ্রাবণের মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ । ল্যাম্বপোস্টে জ্বলে থাকা বাল্বের চারপাশে উইপোকা ভিনভিন করছে।
বাইরে থেকে আসার সময় তিনরাস্তার মোড়ে হেমায়েতের হোটেল থেকে দুটো তন্দুরি রুটি খেয়ে এসেছে। ইজি চেয়ারটা জানালার কাছে টেনে নিয়ে বসে তিনি একটি সিগারেট ধরালেন। সিগারেট টানতে টানতে ফরিদুল ইসলাম ভাবছিলেন জীবনের অনেক কথা।
বাবা মরে গিয়েছিল একদম শিশু বয়সে। মা আর বিয়ে করেনি। ফরিদ' রা স্বচ্ছল ছিল না মোটেই। গ্রামের বাড়িতে কিছু জমিজমা ছিল। ফরিদের মা তাই থেকে কষ্ট করে ওকে লেখাপড়া করিয়ে বিএ পাশ করান।
ফরিদ একটি চাকুরি পায় রাবার মিলে। চাকুরি পাওয়ার পরপরই ফরিদের মা ফরিদকে বিয়ে করায়। মেয়ে তখন নবম শ্রেণিতে পড়ছিল। গ্রামের মেয়ে। দেখতে সুন্দরী। মাথা ভর্তি কালো চুল। গায়ের রং গৌরীয়। টানা টানা চোখ। মেয়েটি ফরিদের মায়ের ফুপাত ভাইয়ের মেয়ে। মায়ের পছন্দেই ঐ মেয়েটাকেই ফরিদ বউ করে ঘরে নিয়ে আসে।
মেয়েটির নাম মোছাঃ নীলা বেগম।
বিয়ে করার পর নীলা বেগমকে ফরিদ গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছেই রেখেছিল কিন্তু ছয়মাস না যেতেই ফরিদের মা অকস্মাৎ তিনদিনের জ্বরে ইন্তেকাল করেন। ফরিদ নিরুপায় হয়ে তার বালিকা বউকে টংগীতে তার কাছে নিয়ে আসে। টংগীর মধুমিতা রোডে দেড় রুমের একটি আধাপাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে বসবাস করতে থাকে।
ছোট সংসার। ফরিদ আর নীলা টংগী বাজারে যেয়ে ঘরের সব জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসে। একটি কাঠের খাট, একটা আলনা, চেয়ার টেবিল, লেপ তোশক, বালিশ, হাঁড়ি পাতিল সব। ঘর সাজাতে সাজাতে নীলা ফরিদকে বলেছিল -- 'ওগো তুমি একটা ছোট্ট বাড়ি করে দেবে না আমাকে? আমি মনের মতো করে আমার সেই বাড়িটি সাজাব।' ফরিদ বলেছিল -- তোমার বাড়ি হবে একদিন। তুমি তোমার মতো করে সে ঘর সাজিয়ে নিও।
আর একদিন নীলা ফরিদকে বলে -- তুমি আমাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে? আমি সিনেমা দেখব।
--- আচ্ছা, দেখাতে নিয়ে যাব।
ফরিদ আনারকলি সিনেমা হলে নীলাকে নিয়ে গিয়ে একদিন ' মনের মাঝে তুমি ' সিনেমাটি দেখিয়ে নিয়ে আসে।
ছোট বাচ্চাদের মতো নীলা ফরিদের কাছে প্রায়ই বিভিন্ন আবদার করতেই থাকে।
আর একদিন নীলা বলছিল -- 'আমি চিড়িয়াখানা দেখব। তুমি আমাকে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে নিয়ে আসো।' ফরিদ নীলাকে মিরপুরে নিয়ে গিয়ে চিড়িয়াখানাও দেখিয়ে নিয়ে আসে।
আর একদিন ফরিদ অফিস থেকে এসে দেখে -- নীলা কোনো রান্না করে নাই। ফরিদ নীলাকে বলে, রান্না করোনি যে।
-- আমি আজ হোটেলে বসে খাব। আমাকে তুমি হোটেলে নিয়ে যাও।
কী করবে ফরিদ ! অগত্যা নীলাকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ায়ে নিয়ে আসে।
আর একদিন অফিস থেকে ফরিদ এসে দেখে -- নীলা সেজেগুজে শাড়ি পড়ে বসে আছে। ফরিদ বলে, তুমি সেজেছ যে !
-- আমার ইচ্ছা করছিল খুব সাজতে। তাই সেজে বসে আছি। কেমন লাগছে আমাকে?
-- খুব ভালো লাগছে তোমাকে । একদম চাঁপা ফুলের মতো।
আর একদিন অফিস থেকে ফরিদ এসে দেখে নীলা বাসায় নেই। নেই তো নেই কোথাও নেই। আশেপাশে বাসার সবাইকে জিজ্ঞাসা করে। তারাও কেউ কিছু বলতে পার না। গ্রামের বাড়িতে এবং আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোঁজ খবর নেয় -- কোথাও নীলা যায় নাই।
ফরিদ টংগী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে। তারা বিভিন্ন সূত্রে নীলাকে খোঁজাখুঁজি করে। পুলিশও কোনো হদিস করতে পারেনি নীলা কোথায় আছে। সে জীবিত আছে, না সে মরে গেছে।
এরপর পাঁচ বছর চলে গেছে। নীলাকে কোথাওে খুঁজে পাওয়া যায়নি। নীলাকে হারিয়ে ফরিদ আর বিয়ে করেনি। চাকুরিতে সে মোটামুটি সুনাম করেছে। টংগীর মধুমিতা এলাকাতেই সে দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে একাই থাকে। ভাড়া বাড়িটি তিনি সামনের মাসের এক তারিখে ছেড়ে দিবে। গাজীপুরের শিমুলতলীতে জায়গা কিনে সে ছোট্ট একটি বাড়ি করেছে। বাড়ির নির্মাণ কাজ সবে শেষ হয়েছে। ফরিদ তার নতুন বাড়িতেই উঠবে।
ফরিদের খুব ইচ্ছা করছে তার এই ছোট বাড়িটার একটি নাম দিতে। এই জগতে তার আর আপন কেউ নেই যে, তাদের কারোর নামে বাড়িটার নাম দেবে। সে রুমের ভিতর পায়চারি করছিল, আর ভাবছিল অনেক কথা।
সে আবার জানালার কাছে যায়। আকাশ পানে চেয়ে দেখে, মেঘগুলো সরে গিয়েছে। একফালি চাঁদ দেখা দিয়েছে। মনে পড়ে নীলার কথা। নীলা বলেছিল -- 'ওগো তুমি একটা ছোট্ট বাড়ি করে দেবে না আমাকে? আমি মনের মতো করে আমার সেই বাড়িটি সাজাব।'
মাসের পহেলা তারিখেই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে শিমুলতলীর নতুন বাড়িতে গিয়ে ফরিদ ওঠে। কাকতালীয় ভাবে এইদিনই তাদের বিয়ে বার্ষিকী ছিল। খুব বেশি জিনিসপত্র নাই। নীলা থাকতে যা কিছু কেনা হয়েছিল তাই-ই শুধু আছে -- একটি কাঠের খাট, একটা আলনা, চেয়ার টেবিল, লেপ তোশক, বালিশ, হাঁড়ি পাতিল।আর আছে একটি ট্রাঙ্ক, যার ভিতর নীলার এবং তার নিজের কাপড় চোপড় রয়েছে। নীলার হালকা কয়েকটি গহনা ও বিয়ের শাড়িটাও ট্রাঙ্কে আছে। নীলা যেখানেই যাক, যেভাবেই যাক, যাবার সময় সে এক কাপড় পরে চলে গিয়েছিল। কিছুই নেয় নাই।
ফরিদ নতুন বাড়িতে যাওয়ার সময় টংগী থেকে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড লিখে নিয়ে যায়। সেই সাইনবোর্ডটি বাড়ির গেটের সামনে সে লাগিয়ে দেয়। সাইনবোর্ডে বাড়িটির নাম লেখা আছে -- 'নীলাঞ্জনাা '।
'নীলাঞ্জনা' বাড়িটা খুব নিরিবিলি। আশেপাশে তেমন বাড়িঘর নেই, চারদিকে ছায়াবীথিতে ঘেরা। ফরিদ দুপুরে টংগীর এক হোটেল থেকে খেয়ে গিয়েছিল -- তারপর আর খায়নি। এখানে আশেপাশে কোনো খাবার হোটেলও নেই। নতুন বাড়িতে সে কোনো কিছু রান্নাও করে নাই। আসবাবপত্র এলোমেলো ভাবে মেঝেতে পড়ে আছে। সেগুলোও সে সাজায় নাই।
একসময় সন্ধ্যা নামে নীলাঞ্জনাায়। রাত হলো। খাটটা জানালার পাশে পাতা ছিল। তোশকটা কোনো মতো বিছিয়ে ক্লান্ত ও অভুক্ত দেহ নিয়ে সে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘরে আলো জ্বালায়নি। জানালা দিয়ে নবমীর চাঁদের আলো বৃক্ষপল্লব ভেদ করে তার মুখের উপর এসে পড়ে। ঐ মধুবন্তী চাঁদ, এই জোছনা, ঝিরিঝিরি কোমল স্পর্শের এই হাওয়ায় ফরিদের চোখে ঘুম এসে যায়। এবং সে ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত তখন মধ্য প্রহর। কে যেন তাকে ডাকছে -- 'ওগো তুমি ওঠো, চোখ মেলো। দেখো চেয়ে তুমি! দেখো আমি এসেছি।' ফরিদের ঘুম ভেঙে যায়। সে দেখতে পায় -- নীলা তার শরীর ছুঁয়ে বসে আছে তারই পাশে । কাঁদছে অঝোর ধারায়। তার পরনে বিয়ের দিনের শাড়ি, গলায় তার মায়ের দেওয়া মালাখানি, হাতে চুড়ি, কানে ঝুমকা দুল। পা দুটো আলতা মাখা। কপালে টিপ। নীলাকে আজ সেই বাসর রাতের মতো দেখতে লাগছে।
নীলা বলছিল -- এমন করে কেউ নিজেকে কষ্টে রাখে। সময়মতো না খেয়ে শরীরটা কী করেছ ! আমি নেই দেখে তুমি এমন পাগলামি করবে? কেউ কী চিরদিন থাকে নাকি? কেউ না কেউ আগে চলে যায়। ওঠো লক্ষীসোনা, আমি খাবার রান্না করেছি খেয়ে নাও।
নীলা আরও বলে -- কী সুন্দর বাড়ি করেছ আমার জন্য। নাম দিয়েছ নীলাঞ্জনাা। আমি কী যে খুশি হয়েছি। তুমি তোমার কথা রেখেছ। ওঠো জান আমার। খেয়ে নাও। তুমি খেয়ে নিলেই ঐ বারান্দায় যেয়ে দুজন দাঁড়াব। আকাশে এখনও নবমীর চাঁদ জ্বলছে। আমরা দেখব নক্ষত্রের রাত আধো
অন্ধকারে।
ফরিদ নীলাকে বুকে জড়িয়ে বলে -- ' বলো, তুমি -- কখনও আমায় ছেড়ে তুমি আর চলে যাবে না।'
--- আমাকে তুমি নেবে আবার ! তোমার নির্মল
দেহ, কী করে তোমাকে ছুঁই ! আমি যে নরকে থাকি। নরকের শকুনরা আমার দেহের রক্ত মাংস চেটেপুটে খায়। আমাকে যদি চাও -- তবে এই অভাগীকে....
'খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে;
যেখানে রব না আমি, রবে না মাধুরী এই,
রবে না হতাশা,
কুয়াশা রবে না আর- জনিত বাসনা নিজে---বাসনার মতো ভালোবাসা.....
খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’
ফরিদের স্বপ্নটা ভেঙে যায়। নয়নের কোণে বিন্দু বিন্দু জলগুলো তখন অঝোর ধারায় ললাট পথগামি।
৮. এক চন্দ্ররাত্রির কথা
চরের নাম খানুরবাড়ি। এটি যমুনা নদীর একটি দূর্গম চর। সেই কত বছর আগে যমুনা বক্ষে এই চর জেগে উঠেছিল, কেউ বলতে পারে না। একসময় এই চর ধু-ধু বালুতে খা-খা করত। তারপর এখানে কাশবনে ছেয়ে যায়। প্রতি হেমন্তে সাদা ফুলের সৌন্দর্যে ভরে উঠত চরের প্রাঙ্গণ। কিছু সৌন্দর্য তার অবলোকন করত দূরগামী লঞ্চের যাত্রীরা। আর কিছু এর শোভা উপভোগ করত গয়না নৌকায় পারাপার হওয়া মানুষেরা।
কালক্রমে এই চরটিতে নদী ভাঙনের ঘরহারা কিছু জেলে এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। এর সংখ্যা বিশ পঁচিশ ঘর জেলে পরিবারে দাঁড়ায়। ওরা বন্যা, জল জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করে এখানে বসবাস করে আসছে সে অনেক বছর যাবৎ।
এই চরে যে জেলেরা বসবাস করে তারা সবাই নিম্ন বর্ণের হিন্দু শ্রেণির। এরা যমুনা থেকে মাছ ধরে নদীর ওপারে বিভিন্ন হাট বাজারে গিয়ে বিক্রি করে। এদের চলাচলের একমাত্র বাহন হচ্ছে ছোট ডিঙি নৌকা। এরা খুবই গরীব। খুবই দুঃখ দূর্দশার জীবন এদের। এবং সবাই অশিক্ষিত।
সব অশিক্ষিতের ভিতর এই চরের জগাই মাঝির ছেলে কার্তিক একমাত্র শিক্ষিত ছেলে। কার্তিক ভূয়াপুর ইব্রাহিম খাঁ কলেজে বিএ পড়ে। জগাই মাঝি খুব কষ্ট করে ছেলেটাকে লেখা পড়া করায়। খানুরবাড়ি চরে কোনো স্কুল নেই। জগাই মাঝি নিজে ডিঙি নৌকা বেয়ে চর গাবসারা স্কুলে আনা নেওয়া করে ছেলেকে পড়িয়েছে। কার্তিক এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়। ভূয়াপুরে একটি দোকানে গোমস্তার কাজ করে, এবং সেখানে থেকে কলেজে ক্লাস করে। ছুটিতে বাড়ি এলে সে বাবাকে সাহায্য করে। নদীতে যেয়ে মাছ ধরে এবং ডিঙি বেয়ে হাট বাজারে যেয়ে মাছ বিক্রি করে। যখন কার্তিক এসব করে তখন আর তাকে ছাত্রের মতো মনে হয় না। মনে হয় কার্তিকও একজন জেলে।
ছেলেটি খুবই লক্ষী। দেখতেও খুবই সুন্দর। চরের সবাই ওকে পছন্দ করে এবং ভালোবাসে। জেলে পুঞ্জির নিতাই হালদারের মেয়ে কমলা কার্তিককে খুব পছন্দ করে। কমলার নাম কমলা হলেও ওর গায়ের রং ছিল কালো। সে ছিল উঠতি যৌবনের। ভরা বর্ষা মাসের উদ্দাম যৃুমুনার মতো ডবকা শরীর গঠন তার।
কমলা কার্তিককে দাদা ডাকত। একদিন চরের বালুকাবেলায় কার্তিক ছেঁড়া জাল সেলাই করছিল। কাছাকাছি কেউ নেই। আষাঢ়ের রোদ্দুর এসে পড়ছিল কার্তিকের উদোম গায়ে। ওর শরীরের ধবল চামড়া চিকচিক করছিল। কমলা কার্তিকের কাছে চলে এসে পিছনে দাঁড়িয়ে ডাক দেয় -- কার্তিক দাদা।
-- কী।
-- তুমি আমাকে পছন্দ করো না?
-- করি।
-- আমাকে ভালো বাসো না?
-- বাসি।
-- আমাকে বিয়া করবা না?
-- না।
-- আমি দেখতে কালো এই জন্য?
-- না।
-- তো কী জন্য ?
-- তোকে বিয়া করব এই কথা ভাবি নাই কখনও।
-- তোমার ছেলেবেলার কথা মনে নাই?
-- কী কথা?
-- আমাদের খেলার সাথীরা খেলার ছলে তোমার সাথে আমার বিয়া দিয়েছিল। মাটির সিঁদুর তুমি আমাকে সিঁথিতে পরিয়ে দিয়েছিলে? মনে নাই?
-- ওটা ছিল খেলার ছল।
-- কাশবনের আড়ালে আমাদের বাসর ঘর হয়েছিল, মনে আছে তোমার ?
-- খেলাঘরের বাসর। ভেঙে গেছে তা।
-- তুমি আমার মন ভাঙতে পারো নাই। আমি সে কথা মনে রেখেছি। তুমি আমার মন ভেঙে দিওনা।
-- আমার কিছু মনে নাই। তুই এখান থেকে চলে যা। আমাকে কাজ করতে দে।
কমলা চলে যায়।
আর একদিন সন্ধ্যায় কার্তিক চরে নদীর কুলে কাঁকড়া ধরতে যায়। কমলা তা দেখতে পায়। অনেক সময় গড়িয়ে যায়, কার্তিক আর ফেরে না। আস্তে আস্তে রাত হতে থাকে। আকাশে ত্রয়োদশী চাঁদ ওঠে। কমলা চুপিচুপি ঘর থেকে বের হয়। সে কার্তিকের খোঁজ করে। রাতের নির্জনে চলে যায় যমুনা কুলে। পথে বন্যার মতো ফিরকি দিয়ে পড়ছিল চাঁদের আলো। কমলা সে আলোয় পথ চিনে চলে যেতে থাকে নদীর কুলে। সে দেখতে পায় কার্তিক বাড়ির দিকে ফিরে আসছে। কমলা কার্তিকের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। কার্তিক কমলাকে বলে -- তুই এখানে?
-- আমার ভালো লাগছিল না। তাই তোমাকে খুঁজতে চলে এসেছি।
-- চল্ বাড়ি চল্।
-- না, যাব না।
-- পাগলামি করিস না।
-- আমাকে মেরে দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে আসো।
-- চল্ কমলা!
-- এই রাত, এই জোছনা, আমার এই দেহ তোমার। তুমি নাও।
-- না।
-- না, তোমার সব নিতে হবে।
কার্তিক সেদিনের সেই সন্ধ্যা রাত্রিতে শিউলি ফুলের মতো স্নিগ্ধতাময় চাদের আলো আর কমলার উদ্দাম দেহ কোনোটাই উপেক্ষা করতে পারেনি।
সে রাতে কার্তিক ঘরে ফিরতে ফিরতে কমলাকে বোঝায়েছিল -- এসব কিছুই মনে রাখিস না কমলা। সবই ক্ষণিক আনন্দ। তুই আমাকে ভুলে যাস্।
কয়েকদিন পর কার্তিক ভুঁয়াপুর চলে যায়। ওখানে ওর কলেজ খুলে যায়। কার্তিক পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। তারপরও প্রায়ই মনে পড়ে কমলার কথা। মনে পড়ে তার এক উদ্ভাসিত চন্দ্র রাত্রির কথা। দুরে থিরথির করে কাঁপছে যমুনার জল। গন্ধ আসছিল জীর্ণ পঁচে যাওয়া কাশবনের পাতার ঘ্রাণ। সে ভাবছিল --- কমলা সত্যি কী কালো? শরীর বৃত্তের কোনো কিছু আমি কালো দেখিনি তার । ভিতরের আনন্দ ধাম সব একই রকম। কালো গোলাপ আর শুভ্র-প্রস্ফুটিত গোলাপ দুটোর সুবাস একই। দুটোই সেদিনের সেই ত্রয়োদশী বিচ্ছুরিত জোছনার মতো পুন্যময়।
প্রায় মাস দুয়েক পর কার্তিক খানুরবাড়ি চরে ফিরে আসে। ফিরে এসে প্রথম ওর মায়ের কাছে থেকেই জানতে পারে কমলার বিয়ে হয়ে গেছে। খানুরবাড়ির চর থেকে একমাইল দুরে চর তেতুলিয়ার সুখেন মাঝি কমলাকে বিয়ে করে নিয়ে গেছে। সুখেন মাঝির আরও দুই বউ আছে। বয়স তার পঞ্চাশোর্ধ্ব।
কার্তিকের মা কার্তিককে বলে -- তুমি স্নান করে আসো, খেয়ে নাও।
কার্তিক স্নান করে এসে খেতে বসে। কিন্তু পুরো ভাত খেতে পারল না। সে হাত ধুয়ে ঘরের ভিতর চোকিতে যেয়ে শুয়ে পড়ে। সে ভাবছিল -- আমার কেন কমলার জন্য মন খারাপ লাগছে। আমি তো ওকে কখনোই ভালোবাসি নাই। কবে কোন্ এক সন্ধ্যা রাত্রিতে অসংখ্য তারার আকাশের নীচে, উচ্ছ্বসিত জোছনায় ভিজে একজন সামান্য কালো মেয়ে আমাকে না হয় একটু জৈবিক আনন্দ দিয়েছিল, আনন্দ তো আনন্দই -- ফুরিয়ে গেছে তা। এই নিয়ে মনখারাপের কিছু নেই। এ তো আর প্রেম নয়। ওকে কী আমি হারিয়েছি? আফসোস করব না নির্বোধের মতো।
বিকালে একাকী চরের মধ্যে কার্তিক হাটঁতে বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে যায় নদীর কুলে। নদীর তীরে বসে কিছুক্ষণ জলের ধ্বনি শোনে। কিন্তু ভালো লাগছিল না জলের শব্দ। উঠে চলে যায় বালুচরের তীর ধরে আরও দুরে। চরের শেষ মাথায় একটি ছোনের কুঁড়ে ঘর দেখতে পায়। সেখানে ঘরের দুয়ার ধরে একটি যুবতী জেলে বউ একাকী দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ব্লাউজ নেই। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে বুক। কার্তিক তাকে চিনতে পারে না। যুবতী জেলে বউটি কার্তিককে বলে -- তুমি আমাকে চিনতে পারছ না ঠাকুর পো? আমি তোমাদের জুরান মাঝির
বউ।
-- ও আচ্ছা। চিনতে পারছি। তা জুরান দাদা কোথায়?
-- সে মাছ বিক্রি করতে গঞ্জে গেছে ।
-- আচ্ছা, যাই।
-- আসো না ঠাকুরপো ঘরে, এসে বসো। পান খেয়ে যাও।
-- পান খাই না আমি ।
-- কাচা ডাঁসা পিয়ারা আছে। দুটো পিয়ারা খেয়ে যাও।
-- পিয়ারাও খাই না। যাই।
কার্তিক বাড়ির দিকে ফিরে আসে। পথে ফিরতে ফিরতে সেদিনের মতো আজও রাত হলো। কিন্তু আজ আকাশে কোনো চাঁদ নেই। কিছু তারা জ্বলছে একাকী বিচ্ছিন্ন ভাবে। আজ আর কেউ এসে পথের মাঝে পথ রোধ করে দাঁড়াল না। বলল না -- 'ঘরে ফিরে যাব না।' সেই একই পথ, একই বালিয়াড়ি। ঝিঁঝি ডাকছে সেদিনের মতোই। কী এক শুন্যতা চারদিকে। মানুষের জীবনের ফেলে আসা দুএকটি আনন্দময় ক্ষণ এত বেদনার হয়ে ফিরে আসে?
ঘন হয়ে রাত নামে আরও গভীর হয়ে। সারা চরাচর আঁধার করে আকাশ যেন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। একি ! হৃদয় তন্ত্রীতে এ কেমন ব্যথার প্রদাহ হচ্ছে , দুচোখ বেয়ে কেন এমন জল বয়ে পড়ছে আমার। ভাগ্যিস এই রাত গভীর অন্ধকারে ঢাকা। তাই এই জল কেউ দেখতে পেল না !
তারপর চলে গেছে পাঁচটি বছর। কার্তিক ইতোমধ্যে বিএ পাশ করে একটি সরকারি চাকুরিতে ঢোকে। ওর বাবা স্বর্গীয় হয়ে যান। সে জেলে পেশা ছেড়ে দিয়ে মাকে নিয়ে চিরদিনের জন্য ঢাকায় চলে যায় । বিয়েও করে সে। ঘরে তার রূপময়ী স্ত্রী আছে।
এই শহরে বসে এখনও সে শুনতে পায় দুরের যমুনার কলকল জলের ধ্বনি। ছোট ডিঙি নৌকা বেয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছে মাঝ নদীতে। হয়ত এখনও খানুরবাড়ি চরে প্রতি হেমন্তে কাশফুল ফুটে থাকে। হঠাৎ কখনও সব জলের শব্দ স্তব্ধ হয়ে যায় -- একটি কালো মেয়ে মলিন কাপড় পরে কাশফুল সরিয়ে সরিয়ে ঘাটের দিকে চলে আসছে -- সে হয়ত অপেক্ষায় থাকে কোনো এক জেলের ছেলে ডিঙি নৌকা ভাসিয়ে চলে আসছে এই চরে, এই ঘাটে !
ওই পুণ্যসলিলা যমুনা নদী, ওই শুভ্রনীল দিগন্তরেখা, ঐ কাশবনে এখনও হয়ত সেদিনের সেই ত্রয়োদশী চন্দ্রের স্নিগ্ধতার মতো রাত্রি নামে। কার্তিকের জীবনে কমলা একটা মধুর স্বপ্নের মতো। বেদনায়, স্মৃতিতে, অনুভূতিতে নীরব দীর্ঘশ্বাসের মতো। নাহ্ -- এই সবই তার কোনো ভ্রম না।
~ কোয়েল তালুকদার
২০ অক্টোবর, ২০২০ ইং
ঢাকা।
৯. কংসবতীর তীরে
তেমন কোনো বিত্ত ছিল না আমাদের। ছিল না দৌলতও। টিউশনি করে লেখাপড়া করেছি। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয় নাই। পরিবারের প্রয়োজনে একটি এনজিও তে চাকুরি নেই। আমার পোস্টিং হয় শেরপুরের নালিতাবাড়ীর ভারতের মেঘালয় সীমান্তবর্তী এক অজো পাড়া গাঁয়ে। আমার পদবী ছিল মাঠকর্মী। যারা এনজিও থেকে ঋণ নেয়, তাদের কাছ থেকে ঋণের কিস্তির টাকা আদায় করাই আমার কাজ ছিল।
আমি এর আগে কখনও এই নালিতাবাড়ী আসিনি। বাড়ি থেকে আসার পথে খুব দুর্ভাবনা করেছি, ঐ অপরিচিত জায়গায় যেয়ে কোথায় উঠব, কোথায় থাকব। কিন্তু এখানে আসার পর সেই ভাবনা অনেকটা দূর হয়েছে। আমাদের কেন্দ্রের ম্যানেজার সাহেব অফিস সংলগ্ন একটি ছোট্ট রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
এখানে নিজেই রান্না করে খাই। বেশিরভাগ সময় সকালবেলা রান্না করে তিন বেলা খেয়ে নিতাম। ভাত রান্না করার সময় ভাতের মধ্যে ডিম সিদ্ধ দিতাম। সেই ডিম কাঁচা মরিচ ও পিয়াজ দিয়ে ভর্তা করতাম। আবার ডিম মামলেটও করতাম মাঝে মাঝে। কোনো কোনো সময় মসুর ডাল ভর্তা দিয়েও ভাত খেয়েছি। মাছ মাংস তেমন কেনা হতো না। ওগুলো কাটাকুটি করে রান্না করে খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এলাকাটি দারুণ প্রকৃতি শোভাময়। অদুরেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সীমান্ত শুরু হয়েছে সুউচ্চ গারো পাহাড় দিয়ে। সেই পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে এসেছে কংসা নদী। জেনেছি ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগে তুরার কাছে এ নদীর উৎপত্তি। কী অদ্ভুত ! যে নদীর জন্ম দিল শৃঙ্গে জমে থাকা মেঘ আর চেরাপুঞ্জির অজস্র বৃষ্টির জলধারা। আর সেই ধারা কী-না বয়ে এল আমাদের দেশে নদী হয়ে। কী স্বচ্ছ এর জল। পাথর, পাথরকুচি আর সিলিকন বালু এই নদীর অতল দিয়ে ভেসে আসে এ দেশে ।
এই নদীর এখানে অন্য নাম -- ভোগাই। নাহ্ আমি তাকে সে নামে ডাকতাম না। ভালো লাগত না এই নামটি। আমি ওকে কংসাবতী বলে ডাকতাম। আমিই ওকে ডাকি, আমি তা শুনি। আমিই তার অরূপ রূপ দেখি ।
আমার তেমন কোনো বন্ধু ছিল না এখানে। তাই এই নদীটাকে আমি আমার বন্ধু করে নিয়েছিলাম। এর কূল ধরে হাঁটতাম, কত সন্ধ্যা নেমেছে কংসাবতীর তীরে, কত সূর্য ডুবে গেছে গারো পাহাড়ের শৃঙ্গের আড়ালে। অস্তাচলের কত সোনালি আভার দিগন্ত আঁধারে কালো হয়ে গেছে। মনে হতো জীবনের সব গান হারিয়ে ফেলেছি ঐ দূর আকাশে, ঐ পাহাড় শৃঙ্গের ঘন লতাগুল্মের নিভৃতে ।
এই কংসাবতীর তীরের একটি গ্রাম নয়াগাঁও। আমাদের এনজিওর একটি কেন্দ্র ছিল এখানে। কেন্দ্রটির অফিসিয়াল নাম দেওয়া হয়েছিল 'সন্ধ্যাতারা'। এই কেন্দ্র থেকে গরীব, দুস্থ ভূমিহীন মেয়েরা ঋণ গ্রহণ করত। আছিয়া, নুরজাহান, নুরী, বুলবুলি, নসিরণ, জরিনা সহ আরও এমন অনেক মেয়ে এই সন্ধ্যাতারা কেন্দ্র থেকে ঋণ নিয়ে তারা নিজেদের স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে । শাখার ম্যানেজার সাহেব প্রথম দিনই ঋণ গ্রহিতাদের তালিকা আমাকে দিয়ে বললেন -- এই সন্ধাতারা কেন্দ্রে আপনাকে কাজ করতে হবে। তিনি এই ব্যাপারে আমাকে আরও কিছু প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দিলেন।
পথম দিনের কথা।
শাখা অফিস থেকে কংসাবতীর তীর ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম নয়াগাঁও সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে। তখন ছিল আশ্বিন মাস। কংসাবতীর বুক ভরা অথৈই জল। কংসার স্বচ্ছ পানির উপরে পড়েছে শরতের সাদা মেঘের ছায়া। জলের উপর রোদ্দুর ঝিলমিল করছে। নদীর কূল ধরে যখন হাঁটছিলাম তখন দেখছিলাম জল আর মেঘ-রোদ্দুরের খেলা। আরেক দিকে দেখছিলাম হলুদ ফুলের সরিষার ক্ষেত। ফড়িং আর প্রজাপতি এসে পড়ছিল গাদা গাদা ফুলের উপর। অদূরে দেখতে পাই একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ। কোথাও একটি মানুষও নাই। একদম বিজন। বটবৃক্ষটি পার হয়ে সামনের দিকে হাটঁতে থাকি।
তখন বেলা বারোটা হবে। নয়াগাঁও গ্রামের নিকটবর্তী হতেই দেখতে পাই -- একটি স্ত্রীলোক নির্জন কংসাবতীর জলে নেমে সে স্নান করছে। বক্ষের বসন ঈষৎ উন্মোচন করা, সাদা ঝকঝকে গায়ের রং, হাতে বালা , পরনে লালপাড় শাড়ি, বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে। স্ত্রীলোকটি প্রথমে আমাকে দেখতে পায় নাই, যখন আমাকে দেখতে পায়, সে লজ্জাশীলা হয়ে উঠে। বুকের বসন ঠিক করে নদীর কূলে অবস্থিত তার বাড়ির দিকে হেঁটে চলে যায় ।
তখন আমার বয়সই কত ! বিশ হবে। একজন উচ্ছল তরুণ, বিয়ে করি নাই। আমি অত বড়ো বিদ্বান ব্যক্তিও ছিলাম না। তেমন কিছু পড়া হয় নাই উপন্যাস, গল্প, নাটিকা। পড়লে বুঝতে পারতাম -- মঞ্জুলিকা, বাসন্তী, শকুন্তলা, বিনোদিনী, অভিসারিকা এইসব কী ! কিন্তু সেদিন সেই আশ্বিনের মিষ্টি রোদের নীচে কংসাবতীর জলে যে রমণীকে স্নানরত দেখলাম -- তা আমার তরুণ হৃদয় মনে একধরনের মদিরার মতো চির আসক্তির অনুভব হয়ে থাকল।
নয়াগাঁও গ্রামে ঢুকে কেন্দ্র প্রধান নুরজাহান খাতুনের বাড়িটি খুঁজে বের করি। আমি নুরজাহানের বাড়িতে ঢুকে আমার পরিচয় দেই। নুরজাহান আমাকে ছালাম দিয়ে বলে --
'স্যার আপনি বসেন। আমি সব সদস্যদের ডেকে নিয়ে আসি।'
আমি উঠোনে একটি কাঠের চেয়ারে বসে থাকি। আমার ভালোই লাগছিল এই জন্য যে, সামান্য একটা চাকুরী করি। আর এই মেয়েটি কিনা আমাকে স্যার ডাকল। আমাকে তাহলে এখানকার সবাই স্যার ডাকবে।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্রায় বিশ বাইশ জনের মতো মেয়ে জড়ো হলো। তাদের সবার বয়স কুড়ি থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। আমি ওদের নিকট আমার পরিচয় দিলাম -- বললাম, 'আমার নাম আনিসুর রহমান। এই কেন্দ্রে নতুন জয়েন করেছি। আমার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি থানায়। শাখা অফিসেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আমি নবীন, অল্প বয়স। আপনেরা আমাকে স্যারও ডাকতে পারেন, আবার আনিস ভাইও ডাকতে পারেন।' নুরজাহান বলে উঠল -- স্যার, আমরা সবাই আপনাকে স্যারই ডাকব। '
সবাই তাদের ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তিগুলোা আমাকে প্রদান করে তাদের জমা বইয়ে এন্ট্রি করে নিচ্ছিল। একটি মেয়ে ঘোমটা টেনে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। সে আসছিল না আমার কাছে। নুরজাহান ঐ মেয়েটিকে ডেকে বলে -- ও জরী, তুই দাঁড়িয়ে রইছোস ক্যান, কিস্তি জমা দে। '
মেয়েটি ঘোমটা টেনে মৃদু পায়ে আমার কাছে এসে টাকা ও জমা বইটি আমার হাতে দেয়। আমি ঘোমটাটার ফাঁক দিয়ে দেখলাম তার মুখ। এ যে সেই মেয়ে যাকে আমি কংসাবতীর জলে স্নানরত দেখেছিলাম। জমা বইতে নাম দেখলাম -- মোছাঃ জরিনা খাতুন, স্বামী -- সোলাইমান মিয়া, সাকিন -- নয়াগাঁও। মেয়েটি আমার দিকে একবারও তাকাল না। খুব সলজ্জ ভঙ্গিতে টাকা জমা দিয়ে সে চলে গেল।
সেদিনের মতো কাজ শেষ করে চলে আসি। ফিরে আসছিলাম কংসাবতীর তীর ধরে। নদীর জলগুলো কেমন স্থির হয়ে আছে। বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতের প্রান্তরের দিকে তাকালাম -- ফুলগুলো দুপুরের রোদে ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। বটবৃক্ষের তলে যেয়ে দেখি -- একটি মধ্যবয়সী গারো গায়েন বসে গান গাইছে বাঁশের দোতারা বাজিয়ে। আমি তার গান শুনি। কী অপূর্ব গাইছিল। ওর গানের ভাষা আমি বুঝিনি। কিন্তু গানের সুরটি ছিল দুঃখের।
রুমে এসে খেয়ে একটু বিশ্রাম নেই। বিকালবেলা কংসাবতীর তীরে গিয়ে চুপ করে বসে থাকি। নদীর নীরব তরঙ্গধ্বনি শুনি। গারো পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে সূর্য অস্তমিত হতে থাকে। সোনালী আভা সরিয়ে ক্রমে আকাশ ধূসর হয়ে উঠে। তারপর অন্ধকার নামে আদিম গুহার আঁধারের মতো। সেই আঁধার জগতে একটি সিক্ত বসনার রমণী মূর্তি ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল। যাকে আমি দেখে এসেছিলাম আজ কংসাবতীর
তীরে।
রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম অনেক কথা। ঘুম আসছিল না চোখে। মধ্য প্রহরে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়কে দৈত্যের মতো লাগছিল। একবার মনে হলো -- কংসাবতীর তীরে যেয়ে ঘুরি। কিন্তু এত অন্ধকার যে, ঐ জনমানবহীন নদীর তীরে যেতে শঙ্কা লাগছিল। বারান্দা থেকে রুমে এসে আবার শুয়ে পড়ি। তারপর কখন ঘুমিয়ে যাই জানতে পারি নাই।
সপ্তাহে একদিন আমাকে নয়াগাঁও এ সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে যেতে হতো। বাকী কর্ম দিনগুলোতে অফিসে কাজ করতাম। নয়াগাঁও কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সারা সপ্তাহ উন্মুখ হয়ে থাকতাম।
একদিন নয়াগাঁও যাওয়ার জন্য বের হয়েছি। যখন বের হয়েছি তখন ঝকঝকে রোদ ছিল। সেই একই রাস্তা, একই নদীর কূল ধরে চলেছি সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রের দিকে। অর্ধ রাস্তা যাওয়ার পর হঠাৎ আকাশে মেঘ হয়। প্রাচীন বটবৃক্ষের নিকট যাওয়া মাত্র ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতে থাকে। আমি বটগাছের নীচে দাঁড়াই। কিছুটা বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেলেও ভিজে যায় জামা ও মাথার চুল । বৃষ্টি ছাড়লে আমি আবার রওনা হই। ভেজা শরীর নিয়েই নয়াগাঁও পৌঁছি।
জরিনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে আমি যাচ্ছিলাম। বাড়ির আঙিনা থেকে জরিনা আমাকে ভেজা অবস্থায় দেখে ফেলে। একটি ছয় সাত বছরের বালক কাছে এসে বলে -- 'আপনাকে মায়ে ডাকছে।' আমি দেখলাম -- জরিনা ঘোমটা মাথায় দিয়ে বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে যেতেই সে মুখ আড়াল করে বলে -- 'আপনি ভিজে গেছেন। বারান্দায় টুলের উপর বসেন।'
আমি টুলের উপর বসি। জরিনা একটি গামছা এনে দিয়ে সেই একই রকম মাথায় ঘোমটা টেনে বলে -- 'এইটা দিয়ে মাথা মুছে নিন। আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।'
মাথা মুছে এবং জামা একটু শুকিয়ে নিয়ে নুরজাহানের বাড়ি যাই। সেদিনও জরিনা মাথায় ঘোমটা দিয়ে কিস্তির টাকা আমার কাছে এসে জমা দিয়ে যায়। জরিনার এমন ঘোমটা দেওয়া দেখে নুরজাহান ওকে বলে -- 'কী লো জরী, তুই মাথায় এমন ঘোমটা দ্যাস ক্যান? স্যারেরে দেইখা তুই কি লজ্জা পাস? '
কাজ শেষে কাঠের চেয়ারের উপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। দেখলাম, জরী মুখ ঘুরিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সলজ্জিত মুখখানি দেখতে বড়ই সাধ হয়। জরী মনে হয় -- ওর সেদিনের সেই নির্জন নদীর কূলে ঈষৎ উদোম হওয়া দেহখানি দেখেছি যে, সেই লজ্জা ঘোমটা দিয়ে আড়াল করে ফেলতে চাইছে। কিন্তু জরী জানে না -- তার সেই অপরূপ রূপ আমার অন্তরের কোণে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে রেখেছে।
সেদিনও পথে আসতে আসতে চেয়ে দেখছিলাম কংসাবতীর জল। কেমন অতৃপ্ত বিষাদ বাতাস ঝাপটার বেগে আমার দেহ মনে এসে লাগল। কেমন শীতল অনুভব হলো -- জরি আমার সব না। কেউ না। কিন্তু আমি এই কদিনে অনেক কিছু ভেবে বসলাম। জরির মতো এমন একটি মেয়েকে নিয়ে এমন ভাবনা করা ঠিক নয়। জীবনের মধুকাল তো ধরতে গেলে শুরুই হয়নি। সামনে আরও কত সময় আসবে। দেখা পাব কত কুমারী মেয়ের। কত উদ্যোত প্রস্ফুটিত সন্ধ্যামালতী ফুল ফুটে থাকবে পুষ্প কাননে। যা কিছু পাব তার গন্ধ বিলাস উপভোগ করব। তখন মনে হবে আমিই জগতের সুখী মানুষ।
বিকাল বেলা রুম থেকে বাইরে আর বের হলাম না। শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। ঘরে আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করল না। অন্ধকারেই শুয়ে থাকলাম আরও কিছু সময়। তারপর উঠে আলো জ্বালাই। সকালের রান্না করা ভাত খেয়ে নেই। খেয়ে বিছানায় এসে আবার শুয়ে পড়ি। আজও চোখে কোনো ঘুম নেই। আজও দরজা খুলে বাইরে আসি।
নিস্তব্ধ তারাভরা রাত্রি। কংসাবতীর পাড় থেকে হু-হু হাওয়া বইয়ে আসছিল। এই রকম তারাভরা অন্ধকার আকাশের তলে দাঁড়ালে কত কথা মনে আসে। জীবনের গ্লানিগুলো মনে জাগে। আবার কত পাওয়া আঁধারে হারিয়ে যেতে থাকে। আসলে জীবন বড়োই পলাতকা। পাওয়া হয় না কোনো কিছু, যা আমি চাই।
আর একদিন যখন নয়াগাঁও যাই, পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, আহা! আজ যদি জরী ওর ঘোমটাখানি সরিয়ে ফেলত। তাহলে প্রাণ ভরে দেখে নিতাম ওর মুখ , স্থির শান্তদৃষ্টিতে আমার দিকে যদি একবার চাইত। ঐ সুশ্রী মুখ যে আমি এখনো মন ভরে দেখিনি। ঐ চোখ নিশ্চয়ই ডাগর কালো হবে। ঠোঁটের নীচে আলগা ভাঁজ আছে, হাসলে নিশ্চয়ই গালে টোল পড়ে। এর আগে ওকে যতটুকু দেখেছিলাম তা দূর থেকে। দেখতে না দেখতে সেই শুভ দৃষ্টি মিলিয়ে গিয়েছিল বিন্দুর মতো। জরীর বাড়ির কাছে যেয়ে ওকে খুজলাম, কিন্তু আজ সে বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে নেই।
সন্ধ্যাতারায় যেয়ে দেখলাম -- জরী দূরে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। কারোর সাথে কথা বলছে না। আজও নীরবে এসে সবার আগে কিস্তির টাকা দিয়ে চলে গেল। জরীর সাথে কথা বলার তেমন সুযোগ নেই। আর বললেও মাথা থেকে ঘোমটা তো সে সরাবে না।
জরী তাড়াতাড়ি করে চলে যাওয়াতে মন ভালো লাগছিল না। সকালে আমি কোনো রান্না করে খেয়ে আসিনি। অভুক্ত ছিলাম। পেটে খুব খিদা ছিল। দ্রুত কাজ সেরে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে পড়ি। জরীর বাড়ির পাশ দিয়ে যখন আসছিলাম, তখন দেখি -- জরী পথের উপরে একটি ছোট্ট টোপলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টোপলাটি আমার হাতে দিয়ে বলে -- আপনার মুখটি খুব শুকনো দেখেছিলাম। এর ভিতর কিছু খাবার আছে। ঘরে গিয়ে খেয়ে নেবেন।'
আমি বললাম -- তুমি একটু ঘোমটা সরাও না জরী। তোমাকে একটু দেখি।
-- না।
-- কেন না।
-- এই মুখ আপনাকে দেখাতে লজ্জা করে।
জরি আরও বলছিল -- আমি যাই। আপনার সাথে একাকী দাঁড়িয়ে কথা বলছি, কেউ দেখে ফেললে আমার বদনামি হবে। আমার স্বামী আমাকে মারধর করবে। আপনি জানেন না, সে একটা কসাই।
ঘরে এসে টোপলাটা খুললাম। টোপলার ভিতর তেলের পিঠা, নারিকেলের কুশলি পিঠা, আর মুড়ির কয়েকটি মোয়া দেখলাম। আমার পেটে প্রচণ্ড খিদা ছিল। আমি বেশ পরিমাণ খেয়ে নিলাম।
এরই মধ্যে সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে আমার কাজ করা দুই মাস পূর্ণ হয়। প্রতি সপ্তাহেই জরীর সাথে কেন্দ্রে আমার দেখা হতো। ঘোমটা টেনে কোনো কথা না বলে কিস্তি দিয়ে নিঃশব্দে সে চলে যেত। আমার দিকে একটুও তাকাত না। ওর বাড়ির কাছে দিয়ে আসা যাওয়ার পথে ওকে খুঁজতাম ওর আঙিনায়। ঘোমটা টেনে মাঝে মাঝে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত অদূরে। দেখতাম ওকে দূর থেকেই।
দুই মাস পূর্ণ হওয়ার প্রেক্ষিতে আমাকে অন্য একটি কেন্দ্রে বদলি করে। এরপর থেকে নয়াগাঁও সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে আমার আর যাওয়া হতো না। মনটা প্রায়ই বিষণ্ণ হয়ে থাকত। যেখানেই যাই, কেমন যেন অবসন্ন লাগত। সন্ধ্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম কংসাবতীর তীরে। নদীর জলের দিকে তাকিয়ে বলতাম -- 'আমার সাথে তুমি একটু কথা বলো। তোমার জলে আমাকে টেনে নাও।' সেই ধূসর সন্ধ্যায় বক ও বালিহাঁসগুলো নদীর চরাচর ছেড়ে উড়ে চলে যেত গারো পাহাড়ের দিকে। হয়ত ওখানেই ওদের বাসা।ওখানেই ওদের কুলো।
কূলেই রাত্রি নেমে আসত। নদীর কোনো কথাই শোনা হতো না। আকাশ ভরা নক্ষত্রবীথি তখন জ্বলে উঠত। ফিরে আসি ঘরে। আমি কী বুঝি অত কোনো গান, কোনো সুর। জীবন মর্মরে তখন অন্য কথা বাজে --
'যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার। জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পারো তুমি...'।
আরও চার মাস পর ---
আমার বদলি অর্ডার আসে জেলা সদর অফিস থেকে। ইতোমধ্যে বাড়িতে আমার দাদাজানের পীড়াপীড়ি তে আমার বিবাহ ঠিক হয়ে যায়। আমার দাদা খুব অসুস্থ। মৃত্যুর আগে সে তার নাত্ বউকে দেখে যেতে চায়।
আমি শাখা অফিসে সমস্ত খাতাপত্র ও হিসাব নিকাশ বুঝিয়ে দেই। ব্যাবস্থাপক সাহেবকে বলি, আমার চাকুরি জীবনে প্রথম যাদেরকে নিয়ে কাজ করেছিলাম, নয়াগাঁও এর সন্ধ্যাতারার সেই মেয়েগুলোর কাছ থেকে একটু বিদায় নিয়ে আসতে চাই। উনি আমাকে অনুমতি দিলেন এবং বললেন -- 'যান, দেখা করে আসেন নুরজাহান, নুরী, নসিরন ও জরিনাদের সাথে।'
আমি আজও গেলাম নয়াগাঁও-এ সেই প্রথম দিনের মতো কংসাবতীর তীর ধরে একাকী হেঁটে হেঁটে। যেদিন প্রথম যাই -- সেদিন ছিল শরতের রোদ্দুর। আজ চৈত্রের দুপুর। সেদিন মাঠ ভরা ছিল সরিষা ফুলের হলুুদ প্রান্তর। আজ ধুঁ-ধূঁ বিস্তীর্ণ খালি মাঠ। সেদিন ছিল কংসাবতীতে ভরা জল, আজ সেখানে স্বল্প পাথুরে পানি , বালি আর নুড়ি ।
পথের পাশে বৃক্ষগুলির পাতা চৌচির হয়ে ঝরে পড়ছে। ধুলো উড়ছে। পাখিদের সুমধুর গান নেই। কংসাবতীর জলে ঠোঁট চুবিয়ে জল খাচ্ছে তৃষিত কয়েকটি বক ও পানকৌড়ি। রুক্ষ বাতাস এসে লাগছিল আমার গায়ে। একসময় প্রাচীন সেই বটবৃক্ষ তলে এসে দাঁড়াই। আজ আর কোনো গায়েন নেই এখানে। একটু জিরিয়ে আবার নয়াগাঁও এর দিকে হাঁটতে থাকি।
একসময় নয়াগাঁও-এ জরীদের বাড়ির কাছে চলে আসি। কংসাবতীর তীরে যে ঘাটে জরী সেদিন স্নান করেছিল, সেখানে এসে দাঁড়াই। আজ আর সেখানে জরী স্নানরত নেই। কিন্তু আমার মানসপটে দেখতে পাচ্ছিলাম, সেদিনকার সেই স্বর্গীয় দৃশ্য ! একটি পল্লীবালা, যার দেহবল্লরী ছিল এই কংসাবতী নদীর মতো উচ্ছলা, স্বচ্ছ জলের ঢেউ আছরে পড়ছিল যেন শরীরের বাঁকে। আজও কম্পিত হলাম কিছু মুহূর্তের জন্য । চোখ ফিরিয়ে আনলাম কংসাবতীর জল থেকে।
আমি জরীর বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। ওর বাড়ির আঙিনায় যেয়ে দেখতে পাই ওর ছেলেটাকে। ওকে বলি -- 'তোমার মাকে একটু ডেকে নিয়ে আসো। যেয়ে বলো -- তোমার স্যার এসেছে।'
জরী ঘর থেকে বের হয়ে আসে। আজকেও সে ঘোমটা টেনে আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। আমি জরীকে ডাকি -- জরী।
-- জ্বী।
-- কেমন আছো তুমি?
-- ভালো।
-- জরী...
-- বলেন।
-- আমার বদলি হয়েছে, আগামীকালই চলে যাচ্ছি এখান থেকে।
-- আর আসবেন না?
-- না।
জরী কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। কেমন যেন স্থির, এবং নির্বাক। কথা বের হচ্ছিল না মুখ থেকে। আমি আবার ওকে ডাকি -- জরী...
জরী কথা বলছে না।
আমি জরীকে বললাম -- 'আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তোমাদের সবাইকে আমি নিমন্ত্রণ করব। তুমি যাবে না আমার বিয়েতে? '
জরী এবার মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি খুব কাছে থেকে দেখলাম তার বিষাদস্নাত ম্লান মুখ ও চোখ। দেখলাম, ওর চোখ দুটো জলে ভরে আছে ! কংসাবতীর জলের মতো সেই জল স্বচ্ছ ও নির্মল।
পরিশিষ্ট --
আমার সেই অল্প বয়সের জীবন অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সেই জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির কথা ভেবে এখনকার জীবনেও অবসাদ নামে। হঠাৎই মন কেমন করে ওঠে। হারানো মধুময় কোনো দৃশ্য কখনোই আর দেখতে পাব না। সেই সবের জন্যে আক্ষেপও নেই। মহাকালের বীথিপথের দিকে চোখ মেলে দেখব -- কংসাবতীর তীরে এক পল্লী রমণী হাঁটছে ফিরছে, জলের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছে। দক্ষিণা শীতল হাওয়া এসে তার শরীরে লাগছে, তার মাথার চুল উড়ছে।
আমি যা পেয়েছিলাম, তা সত্য। আবার হয়ত কখনও পাব তা, এটি আশা। পেলেও তা আবার ফুরিয়ে যাবে, এটা অমোঘ ।
~ কোয়েল তালুকদার
১০. রুপালী আলো
রফিক লোকটা আদতে একটা খচ্চর। বয়স পয়ত্রিশ হবে। এই পর্যন্ত বিয়ে করেছে পাঁচটা। প্রথম চার বউ ছেড়ে চলে গেছে। বর্তমানে যে বউ আছে -- ওর নাম রুপালী। বছর খানেক আগে রুপালীর বিয়ে হয়েছে এই খচ্চর রফিকের সাথে। এখনও এই বিয়েটা টিকে আছে।
রফিক অটো চালাত রাজেন্দ্রপুর মাস্টার বাড়ি এলাকায়। রুপালীর সাথে ওর প্রথম দেখা এই অটো চালাতে গিয়ে। রুপালী কাজ করত চৌরাস্তায় একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে। মাস্টার বাড়ি এক বাড়িতে ওরা কয়েকজন মেয়ে মিলে ভাড়া থাকত । রফিক প্রতিদিন ফ্রী তে আনা নেওয়া করত রুপালীকে। আর এই ভাবেই রফিকের সাথে ওর প্রণয় হয়। এবং পরবর্তীতে বিয়ে হয়।
রফিক ছিল সুঠাম দেহের অধিকারী। সুদর্শনও বলা যায়। ওর এই সৌন্দর্যের কারণে মেয়েদেরকে সে প্রলুব্ধ করতে পারত। ওর প্রধান অভ্যাস ছিল তারি খাওয়া। তারি খেয়ে মাতাল হয়ে ওর বউদের সাথে সে মাতলামি করত। অকারণে তাদের মারপিট করত। ওর এই আচরণের কারণে ওর আগের বউরা ওকে ছেড়ে চলে যায়।
রুপালীকে বিয়ে করার দুইদিনের মাথায় একদিন সন্ধ্যায় তারি খেয়ে মাতলামি করতে করতে রুপালীকে বলে -- 'তুই কাল থাইকা আর গারমেনে যাইতে পারবি না।'
রুপালী বলে -- ' ক্যান যাইতে পারুম না? '
-- আমি তরে কইলাম, যাবি না। ব্যাস, আর যাবি না। '
-- কারনডা আমারে কও।
-- তুই তো রূপের ছেরি, ডবকা যৌবন, আরেক ব্যাডার লগে তুই পিরিত করবি। এবং আমারে ছাইড়া চলে যাবি। এই জন্য।
-- আমি গারমেন্টে কামে যামুই।
রফিক রুপালীর এই কথা শোনা মাত্র ওকে ধরে পেটাতে থাকে। সেকি তুমুল মাইর। চুল ধরে কিলাইতে কিলাইতে রুপালীকে বলে -- কী যাবি মাগী? ক।
রুপালী ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে কাতর হয়ে বলে -- 'না, যাব না।'
শালবনের পাশে নান্দুয়াইন গ্রামে একটি ছোট্ট মাটির বাড়িতে রফিক ওর বউ রুপালীকে নিয়ে থাকে। বনপাশে এমন নিরিবিলি বাড়িতে একা একা থাকতে রুপালীর ভালো লাগে না। রুপালীর মনে পড়ে ওর সহকর্মীদের কথা। মনে পড়ে ফিরোজা, রুবী, খাদিজাদের কথা। মনে পড়ে আরও একজনের কথা, নাম -- শাহীন। শাহীনও ওর সহকর্মী ছিল। শাহীন একদিন ওকে বলেছিল, ' তোমাকে আমার ভালো লাগে রুপালী।' ঐ পর্যন্তই। শাহীনকে আর কিছু বলা হয়নি রুপালীর। এর মধ্যেই ওর বিয়ে হয়ে যায় খচ্চর রফিকের সাথে।
রফিক একটা গোয়ার। তরকারিতে লবন কম হলে রুপালীকে ধরে পিটায়। ঘরের বাইরে কোনো লোকের সাথে রুপালী একটু কথা বললেই -- ওকে ধরে পিটায়। রফিক রুপালীকে বাপের বাড়ি মির্জাপুর যেতে দিত না। যেতে চাইলে ধরে পিটাত। রফিক ভাবত -- রুপালী বাপের বাড়ি চলে গেলে আর ফিরে আসবে না। রফিক অনেক সময় রুপালীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনও করত। বাধা দিলে মারপিট করত।
রুপালী হাঁপিয়ে ওঠে রফিকের সাথে ঘর করতে। এক একসময় রুপালীর মনে হতো -- এই ঘর, এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে সে। মনে হতো -- শাহীন যদি আবার এসে বলত, 'তোমাকে আমি ভালোবাসি রুপালী, তুমি আমার ঘরে চলো।' রুপালী ঠিকই শাহীনের হাত ধরে পালিয়ে যেত। এই পাষাণ স্বামীর ঘর করতে তার কিছুতেই আর ভালো লাগছে না।
একদিন সন্ধ্যা রাত্রিতে রুপালী ঘরে বাতি জ্বালিয়ে বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়াতেই ছায়ার মতো কাকে যেন দেখতে পায়। কে যেন বরোই গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা এগিয়ে আসে রুপালীর কাছে। এসে বলে -- আমি শাহীন রুপালী। তুমি আমাকে চিনতে পারছ না ?' তোমার খোঁজ জেনে তোমাকে দেখতে আসলাম। তুমি কেমন আছো ? '
-- 'আমি ভালো নেই। কিন্তু তুমি এ কী করলে ! প্রতিবেশী কেউ দেখে ফেললে তারা আমার স্বামীকে বলে দেবে। ঐ গোয়ার লোকটা আমাকে মেরেই ফেলবে। তুমি এক্ষুনি চলে যাও।'
সেদিনের মতো শাহীন চলে আসলেও এর পরে
প্রায়ই গোপনে রুপালীর সাথে সে দেখা করত। দেখা করে কথা বলত। ওদের এই দেখা করাটা খুব সাবধানে হতো। অল্প সময় কথা বলে চলে আসত শাহীন। ঘরে বসত না। দেরিও করত না।
এরই মধ্যে ওদের সাথে প্রণয় গভীর হয়ে ওঠে।
একদিন রুপালীর সাথে শাহীনের শলাপরামর্শ হয় -- ওরা দুজন রাতে দেখা করবে শালবনের ভিতর। ঘন বনের ভেতর চলে আসবে রুপালী একটি নির্দিষ্ট জায়গায়। শাহীন অপেক্ষা করবে ওর জন্য সেখানে। যেখানে ওরা মিলিত হবে।
কথামতো সেই রাতে শাহীন চলে যায় শালবনে। রাত ক্রমে গভীর হতে থাকে। শাহীন অপেক্ষা করতে থাকে রুপালীর জন্য। বনের ভিতর ঝিঁঝি পোকারা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে থেমে যেতে থাকে। জোনাকিদের আলো জ্বলা নিভে যেতে থাকে। পঞ্চমীর চাঁদও ডুবে গেছে সেই সন্ধ্যা রাতেই। তারারা জ্বলছে, নিভছে। কেমন নীরব হয়ে আছে বন নিভৃতে। বন জুড়ে তখনও স্তব্ধ অন্ধকার ।
হঠাৎ শুকনো পাতার মর্মর ধ্বণি শোনা গেল। পথের উপর পড়ে থাকা বনের শুকনো পাতা মাড়িয়ে নগ্ন পায়ে হেঁটে চলে আসে রুপালী। রুপালী শাহীনকে দেখে বলে -- আমি দেরি করতে পারব না, এখনই যেতে হবে। গোয়ার কসাইটা জেগে উঠতে পারে । '
সেই স্বল্প সময়ের ভিতরই সেই বন নিবিড়ে দুটি মানব মানবী এক আশ্চর্য রাতের গভীরে মিলে গেল। বনতলে সেই আঁধারে দুজন হারিয়ে যেতে লাগল, হারিয়ে দিতে লাগল, ধরা দিল নিজেদেরকে, খুঁজে পেল একে অপরকে। মনে হয়েছিল ওদের -- রাতকে কখনও ভোর হতে দেবে না। শালবনের সব পাখি তখন ঘুমে বেঘোর। সব বৃক্ষ অন্ধকারের সাক্ষী হয়ে রইল অনেক কিছুর। সাক্ষী হলো আকাশ, আকাশের তারা, ঘুমন্ত জোনাকি আর বনশয্যার বিছানো শুকনো মর্মর পাতা।
তারপর রুপালী উঠে দাঁড়িয়ে শাহীন কে জড়িয়ে ধরে বলে -- তুমি আমাকে কবে নিয়া যাইবা।
-- খুব শীঘ্রই। তুমি যখন যাবে, তখনই।
রুপালী বাড়ির দিকে আসার জন্য পা বাড়ায়। পা ফেলতেই তার খালি পায়ে কাঁটার মতো কী যেন বিঁধে যায়। অন্ধকারে দেখতে পায় একটি মরা গাছের শুকনো চোখা গুরি বিঁধেছে। বেশ রক্ত ঝরছে। রুপালী খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসে। বাড়িতে এসে দেখে ওর স্বামী তখনও ঘুমিয়ে আছে।
খুব ভোরে রফিকের ঘুম ভাঙে। সে বিছানা থেকে উঠে বাইরে আসে। তখনও সূর্য দেখা যাচ্ছিল না বন প্রান্তরে। কিন্তু ভোরের আলোয় সে দেখতে পেল উঠানে পায়ের ছাপে রক্তের দাগ। সেই ছাপ ঘরের মেঝে পর্যন্ত চলে গেছে। সে ঘরের ভিতর যেয়ে রুপালীকে ডেকে তোলে। সে দেখতে পায় -- রুপালীর পায়ে থেকে তখনও একটু একটু করে রক্ত ঝরছে।
রফিক রুপালীকে বলে -- 'ওঠ্। আমার সাথে বাইরে আয়।' রুপালী উঠে রফিকের সাথে উঠানে আসে। রফিক পায়ের রক্তের ছাপ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রুপালীকে নিয়ে পিছনে শালবনে চলে যায়। য়েখানে রুপালী শাহীনের সাথে দেখা করেছিল সেখান পর্যন্ত। রফিক রুপালীকে বলে -' 'ক মাগী, রাইতে তুই কার সাথে দেখা করেছিলি এইখানে ? কী করেছিলি, ক।'
রুপালী কোনো কথা বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। রফিক ওর গলা চেপে ধরে বলে -- 'ক মাগী, তুই কার সাথে দেখা করেছিলি?' রুপালী নিশ্চুপ। রফিক শক্ত করে আরও জোরে গলা চেপে ধরে বলে -- 'ক মাগী।' রুপালী ততক্ষণে নির্জীব হয়ে গেছে।
একসময় ভোরের আলো শালবৃক্ষের পাতার ফাঁক দিয়ে নীচে মরে পড়ে থাকা রুপালীর মুখের উপর এসে পড়ছিল। কী সুন্দর সেই রুপালী আলো, কী শুচি শুভ্র দেখতে লাগছিল রুপালীর মুখখানি।
১১. হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো
একদিন কর্মহীন এক অলস অপরাহ্নে আত্ম পরিজনহীন আমার গৃহকোণে শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম শামসুর রাহমানের 'হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো' থেকে এই পংক্তিগুলো --
'... তোমার মদির চোখ, গোধূলি-রঙিন গ্রীবা,/জীবন স্পন্দিত টসটসে ঠোঁট/ অর্থাৎ তোমার সৌন্দর্যে সচকিত হয়েও/ শুধু সেজন্যেই আমার অনুরাগের আংটি/ পরিয়ে দিই নি তোমার আঙুলে।
তোমার হাসি, যা হতাশাকে করে তোলে দীপান্বিতা,
আমাকে নিয়ে গ্যাছে সেই ঘাটে, / যেখানে ফোটে মনোজ কহলার। / না, কেবলমাত্র সেজন্যেও
ভালোবাসি না তোমাকে।'
ঘরের পশ্চিম পাশে জানালাটা খোলা। বাঁশঝাড় থেকে দু'একটা করে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। এত নির্জন যে, আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। ঘুম আসতে চায় চোখে, মুদে আসছিল দুচোখ। তন্দ্রা, ঘুম ও স্বপ্ন নাকি পরপর আসে -- তন্দ্রায় বোঝা যায় আমি কী করছি, কী ভাবছি। কিন্তু ঘুম ও স্বপ্নে কিছুই বোঝা যায় না।
মনে হলো কার যেন পদধ্বনি বাজছে বাইরে। শুধুই পায়ের শব্দ। নুপুর কিংবা চুড়ির শব্দ নয়। পদ শব্দ আস্তে আস্তে নিস্তব্ধ হলো। কে যেন দরজায় কড়া নারল একবার। আমি যেয়ে দরজা খুলে দেই। দেখি --সম্মুখে দাঁড়িয়ে জেবা সাহানি। পরনে তার টাংগাইলের হালকা নীল রঙের তাঁতের শাড়ি। ম্যাচিং করে ব্লাউজ, টিপ, কানে ইমিটেশনের দুল ও গলায় নীল পাথর বসানো লকেটের সোনার চেন পরেছে। মুখে স্মিত হাসি। হাসিটা শুধু মুখে নয়, হাসিটা চোখে এবং চোখের তারায়। মেয়েদের এমন হাসি দেখতে খুবই ভালো লাগে। জেবা সাহানিকেও খুব ভালো লাগছিল।
জেবা আমার পড়ার টেবিলটার সামনে চেয়ারটাতে এসে বসে। জেবা বলছিল -- আমি হঠাৎ করে আপনার এখানে চলে এলাম আপনাকে কিছু না জানিয়ে। খুব অবাক হচ্ছেন বুঝি?
-- জ্বী, একটু চমকিয়ে উঠেছি। তুমি আসবে জানলে ঘরটা ভালো করে গুছিয়ে রাখতাম। আলনার কাপড়গুলো ভাজ করে সাজিয়ে রাখতাম। পড়ার টেবিলের বইখাতাগুলো এত এলমেল থাকত না। ফুলদানিতে কোনো ফুল নেই। অন্তত কয়েকটি গাঁদাফুল এনে ফুলদানিটা সাজিয়ে রাখতে পারতাম।
-- এই যে এলমেল সবকিছু এইটাই ভালো লাগছে। ছেলেদের ঘর সাজানো গোছানো মানায় না। সবকিছু পরিপাটি করে রাখে মেয়েরা। ছেলেরা নয়। খুব বেশি মনে হয় সিগারেট খান। এ্যাসট্রেটা একদম ভরে ফেলেছেন।
-- নাহ্ খুব বেশি খাই না। বেশ কয়েকদিনের এই ছাইগুলো। ফেলে দেয়া হয়নি।
-- বিছানার উপরে 'হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো'। তা কোন্ কবিতাটা পড়ছিলেন?
-- ' কেন তোমাকে ভালোবাসি? ' কবিতাটি পড়ছিলাম --
".... দৈবাৎ এক রাতে ভুলক্রমে তোমার সঙ্গে আমার/ অদৃশ্য যোগাযোগ। এমনই আকস্মিক
সেই ঘটনা, আজো কেমন ধন্দ লাগে। / বস্তুত
মধুর এক ধাক্কা খেয়ে পথচলা
মেঘের আলপথে। / একটি ভুলের কুঁড়ি বিকাশের বাঁশির তানে/ চমৎকার এক ফুল হয়ে
দুলে উঠবে সত্যের মুখোমুখি, কে জানতো?...''
***** ***** *****
( এখানে একটু বলি -- জেবার সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। আমার এক বন্ধুর কাজিন সে। আমি বিয়ে করব, মেয়ে খুঁজছি। এই কথা জেনে আমার সেই বন্ধু বলেছিল-- আমার একটি কাজিন আছে, ইডেনে পড়ে। ট্রেডিশনাল সিস্টেমে বাংলা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। তুমি ওকে দেখতে পারো। '
বললাম, ঠিক আছে দেখব।
ধানমন্ডির একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে আমরা তিনজন একদিন লাঞ্চ করি। ঐদিনই জেবাকে আমি প্রথম দেখি। দেখে ওকে ভালো লাগল।
আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স এবং মাস্টার্স করেছি। জেবা তাই আমাকে অনুরোধ করে বলেছিল -- 'আমি মাঝে মাঝে আপনার কাছে থেকে একটু হেল্প নেব।' আমি বলেছিলাম, অবশ্যই তোমাকে প্রয়োজনীয় হেল্প করব।'
শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি বারান্দায়, ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের লনে বসে আমি এবং জেবা সাহানি একাডেমিক বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছি, এবং জেবাকে যতটুকু পারি, টিপস্ দিয়েছি। ব্যাস, এই পর্যন্তই। কিন্তু কোনো ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে পড়িনি কেউই।
একদিন আমার সেই বন্ধুটির সাথে আমার দেখা হয়। এবং সে বলে -- 'জেবাকে কি তোমার পছন্দ হয় ?' আমি ওকে বলি -- 'জেবা খুব ভালো মেয়ে। ওকে নিয়ে ঘর করা যায়।'
আমার সেই বন্ধুটি বলে -- 'তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি।' আমি বললাম -- কী কথা?
-- জেবার একটি বিয়ে হয়েছিল। ওদের বাসর রাতও হয়েছিল। কিন্তু সেই একটি রাতই কেবল, কিংবা একটি দিনই বিয়ে টিকেছিল। তারপরের দিনই সে বিয়ে ভেঙে যায়। দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কী জন্য বিয়েটা ভেঙে যায়, তা জানি না। জেবা সে কথা কাউকে বলেনি কখনও।
আমি শুধু কথাগুলো শুনলাম। এবং বললাম -- আমি আমার বাড়িতে আলাপ আলোচনা করে, তোমাকে মতামত জানাব।
আমি বাড়িতে আলাপ আলোচনা করে -- আমার সেই বন্ধুকে নেগেটিভ মতামত জানিয়ে দিলাম। বললাম -- আমাদের বাড়িতে কেউই এই বিয়েতে রাজি নয়। )
***** ***** *****
জেবা বলছিল -- আপনার কবিতার খাতাটি কই? একটু দেখব। দেখি -- সর্বশেষ কোন্ কবিতাটি আপনি লিখেছেন, একটু পড়ব।
টেবিলের উপরেই আমার কবিতার খাতাটি ছিল। আমি খাতাটি জেবার হাতে দিলাম। জেবা খাতাটি হাতে নিয়ে আমার লেখা শেষ কবিতাটা পড়তে লাগল --
" আমি একটি ছেলেকে চিনি
সেই ছেলে
সন্ধ্যা আকাশের তারার আলো হতে চেয়েছিল
কিন্তু মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেছে সেই তারা
নিভে গেছে সেই আলো।
ছেলেটি একটি অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন ছুঁতে চেয়েছিল
কিন্তু অলৌকিক ঝরনাধারায় ভেসে গেছে সেই স্বপ্ন, জীবনের ক্যানভাসে সেই স্বপ্ন সে আঁকতে পারেনি।
ছেলেটি চেয়েছিল একটি ঘর
আনন্দলোক থেকে সুখ কুড়িয়ে আনতে চেয়েছিল
ফুলের রেণু থেকে অমৃত
মাধুকর হতে চেয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার মাধবীকে।
সে চেয়েছিল কেউ একজন চিরকালের হোক,
নিপবনের পাখির বাসার মতো ঘর হবে তার
পূর্ণিমা রাতের উদ্দাম জোছনার প্লাবন বইবে ভাঙা অলিন্দ দিয়ে।
ছেলেটি একটা অমল সুন্দর প্রিয়তমা চেয়েছিল
যার কাছে মন খুলে বলা যায় সব কথা
ইচ্ছে করলেই যাকে বুকে জড়িয়ে
চুমু খেয়ে নেওয়া যায় একটার পর একটা
চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখা যায়
হাতে হাত রেখে সব ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়া যায়
কিন্তু সে পারেনি।
হাতের মুঠোয় সে ভরতে পারেনি প্রেম
চিরকাল যৌবনের মোহ ভেঙে খুঁজেছে তার শৈশব
ময়ুরাক্ষী দিনগুলো কখন যে চলে গেছে সে বুঝতেই পারেনি।
এক একজন এভাবেই ভাবে
আর এভাবেই ভুল অঙ্কের খাতায় হারাতে থাকে
একের পর এক তার প্রিয়মুখ
দিনশেষে পড়ে থাকে শুধু অতৃপ্ত কিছু অভিমান।"
কবিতাটা পড়া শেষ হলে জেবা অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকে। কোনো কথা বলছিল না সে। মনে হলো ওর বুকের গভীর থেকে একটি লুপ্ত হয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল।
জেবা বলছিল -- 'আমার কাজিন, অর্থাৎ আপনার বন্ধু আমাকে সব কথা বলে দিয়েছে। তবুও আজ আসলাম আপনার এখানে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল আপনার ঘর, আপনার ঘরের এলমেল সব জিনিসপত্র। আপনার লেখার টেবিল যেখানে বসে আপনি কবিতা লেখেন।
আজ এই বিষণ্ণ বিকালে খুব ইচ্ছে করছিল -- আপনাকে নিয়ে দূরে কোথাও নদীর কূলে একটু বেড়াতে যেতে। নদীর জলের ধ্বনি শুনতে আপনাকে নিয়ে। একটি সূর্যাস্ত দেখতাম হৃদয়ের পৃথিবীর সব আলো নিভিয়ে দিয়ে।'
নাহ্ , সেইদিন সেই বিষণ্ণ বিকালে আমাদের নদীর তীরে যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি তীরে দাঁড়িয়ে শেষ সূর্যাস্ত। মনের ভিতর জীবনানন্দ দুঃখ তখন --
'সব পাখি ঘরে আসে -- সব নদী ফুরায় জীবনের সব লেনদেন, থাকে শুধু অন্ধকার।'
জেবা সাহানি সন্ধ্যার আগেই ফিরে চলে যায়। যাবার সময় একটুও সে পিছনে ফিরে তাকাল না। জানিনা, ওর চোখে হয়ত জল ছিল, তাই ফিরে তাকায় নি।
জেবা আমার কেউ নয়, সামান্য কিছুদিনের পরিচয় ছিল মাত্র। তবুও সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যায় খুব শূন্যতা বোধ করেছিলাম।
১২. রোড টু কুসুমপুর
এই ঘটনাটির সময়কাল গত শতাব্দীর আশির দশক। সালটি ছিল ১৯৮৯ ইং।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। আমি বাসায়ই ছিলাম। মনটা কেমন যেন এলমেল লাগছিল। ঠিক সেই সময় আমাদের গাঁয়ের কালাম এসে খবর দিল-- মা নাকি খুব অসুস্থ। কালাম টঙ্গীতে একটি কারখানার ফোরম্যান এর চাকুরি করে । ছুটি কাটিয়ে ও বাড়ি থেকে আজই এসেছে। পরের দিন আমার অফিস। ছুটি নেবার সময় নেই। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনলে পৃথিবীর বাকি সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়। তখন বেলা দুইটা বাজে। আমি আর দেরি না করে সোজা আব্দুল্লাহপুর বাস স্ট্যান্ডে চলে যাই।
রোড টু কুসুমপুর, সিরাজগঞ্জ।
বাস ছাড়তে ছাড়তে তিনটা বেজে যায়। সময় হিসাব করে দেখলাম -- টাংগাইলের ভূয়াপুরের চর গাবসারা লঞ্চ ঘাটে পৌঁছতে সন্ধে সাতটা বেজে যাবে। হলোও তাই। বাস যখন চর গাবসারা যমুনা নদীর তীরে এসে পৌঁছে তখন সাতটা পঁচিশ বাজে। দিনের শেষ লঞ্চ ঘাটে নোঙর করা আছে। আমি দোতালায় ছোট্ট কেবিনে যেয়ে বসি।
রাত্রি আটটার দিকে লঞ্চ সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে চলে আসে। আশ্বিনের রাত্রি। অন্য কোনো সময়ে হলে লঞ্চের ছোট্ট কাঠের কেবিন থেকে বেরিয়ে রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশে চাঁদ উঠেছে কী না দেখতাম, কিংবা অজস্র নক্ষত্রের আলোয় খুঁজতাম, চরে ফুটে থাকা কাশফুল। নদীর জল ছুঁয়ে দূর থেকে বয়ে আসা লি-লি হাওয়া লাগাতাম গায়ে। আজ আর কোনোকিছু ইচ্ছে করল না।
আজ এই রাত্রিতে নদীর জলের উপরে লঞ্চের কেবিনে চুপচাপ বসে আছি। চোখ বন্ধ করে থাকি, দেখি মায়ের মুখ। চোখ খুলে চেয়ে থাকি, দেখি মায়ের মুখ। জলের শব্দ শুনি -- মায়ের অসুখের ব্যথা বেদনার আর্তি শুনতে পাই। কেবিনের ভিতর আরও ক'জন যাত্রী আছে। কিন্তু তাদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
লঞ্চ চলছে ভটভট আওয়াজ করে। কেমন যেন কর্কশ মনে হচ্ছে শব্দ। কেবিনে বসে থাকা একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব লোক আমাকে বলে -- তুমি কোথায় যাবে?
-- কুসুমপুর। সিরাজগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে?
-- এলাকাটা চিনি। তুমি কী এই রাতেই ওখানে যাবে? নাকি শহরে থেকে যাবে?
-- না, শহরে থাকব না। রাতেই চলে যাব। আমার মায়ের অসুখ। যেতেই হবে।
-- অনেক রাত হয়ে যাবে। আধাপাকা খানিক পথ। তারপর বেশির ভাগ কাঁচা রাস্তা। মাঝে নদী। খেয়া পারাপার হতে হবে। পথে বিপদ হতে পারে তো!
-- বিপদ হোক। আমি যাবই।
লঞ্চ সিরাজগঞ্জ ঘাটে এসে যখন ভেড়ে তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে। বয়স্ক লোকটা আমার সাথে সাথেই লঞ্চ থেকে নামে। সে আবারও আমাকে বলছিল -- শহরের কালীবাড়িতে আমার বাসা। তুমি ইচ্ছে করলে আমার বাসায় আজ রাতে থাকতে পারো।
-- না। আমি আজ এই রাতেই চলে যাব।
-- ঠিক আছে। তা না থাকলে, দুটো ডালভাত খেয়ে যাও। অনেকখানি পথ যেতে হবে। তোমার খিদে লেগে যাবে। কষ্ট পাবে।
-- না, আমার খিদে লাগে নাই। খেতে হবে না।
দেখলাম লোকটি একটু হতাশ হলো। দুঃখও পেল মনে হয়। আমি ওনার কাছে থেকে বিদায় নেই। তারপর একটা রিকশা নিয়ে প্রথমে রহমতগঞ্জ কাঠের পুল চলে আসি। এখানে এসে দেখি -- কুসুমপুর যাওয়ার একটা রিকশাও নেই। যে রিকশাওয়ালা আমাকে ঘাট থেকে নিয়ে এসেছে তাকে বলি -- ' তুমি কী আমাকে শালুয়াভিটা খেয়াঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাবে? ' রিকশাওয়ালা বলে -- 'না যাব না। আমার ভয় লাগে। ফকিরতলা পার হলেই যে নিরিবিলি নির্জন জায়গা আছে, ঐ জায়গাটা ভালো না। আমি আমার রিকশাটা হারাতে পারব না।'
কী করব। রিকশাওয়ালা যাবে না। অগত্যা আমি একাই হেঁটে রওনা হই। কাটাখালি নদী পার হয়ে আকাশের দিকে তাকাই। দেখি আধাভাঙ্গা চাঁদ। নবমীর চাঁদ হবে হয়ত। আবছা আলোয় পথ দেখা যাচ্ছে। হেঁটে হেঁটে যখন রহমতগঞ্জ গোরস্তানের কাছে আসি দেখতে পাই , একটি বৃদ্ধা সাদা ধবধবে কাপড় পড়ে গোরস্তানের ভিতর থেকে হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসছে। সে ক্রমশঃ যত আমার দিকে আসছে তত তাঁর মুখখানি চিনবার চেষ্টা করি। নবমীর চাঁদের আলোয় বৃদ্ধার যে মুখচ্ছবি দেখলাম, তা অস্পষ্ট। কেমন স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতের এই আঁধার, চাঁদের যে স্ফুরিত রশনি, আকাশ ভরা নক্ষত্রের যে ঝিলিমিলি আলো-- সেই আলোয় বৃদ্ধাকে যতটুকু দেখলাম, মনে পড়ে গেল অনেক বছর আগে দেখা একটি মুখ ---
আমার বয়স তখন পাঁচ কী ছয় হবে। সেই শিশু বয়সে একজনের মুখ আমার আজো মনে আছে। সে আমার মাতামহীর মুখ। আবছা আবছা সেই মুখখানি আমি এখনও মনে রেখেছি। সে বেঁচে নেই। তার কবর হয়েছিল -- এই গোরস্তানেই।
বৃদ্ধাকে দেখে কেন যেন মনে হলো সেই তারই মুখ, মাতামহীর সেই অস্পষ্ট আবছায়া মুখচ্ছবির মতোন। বৃদ্ধা যেন বলছে -- ' তুমি ভয় পেওনা। পথে তোমার কিছু হবে না। আমার রাবেয়াকে তুমি দেখতে যাচ্ছ, যাও। আমার আশীর্বাদ রইল।'
বৃদ্ধা আর কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে গোরস্তানের দিকে চলে গেল। তাকে চেয়ে দেখতে দেখতেই সে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। আমি শুধু অস্ফুট করে একবার ডাকলাম তাকে -- নানী মা।
কেমন যেন একটা উদ্যোম পেলাম। সারা শরীর মনে এক স্বর্গীয় অনুভব অনুভূত হতে লাগল। আমি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। আমার কাছে মনে হলো -- এই নিশীথ রাতে এই পথে আমি একাকী হলেও কে যেন আমার সাথে আছে। আকাশ ভরা তারার ছায়া, ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ, ঝিঁঝি পোকা, নিশি পাখি সব আছে। ঘেঁটুফুল ফুটেছে রাস্তার ধারে, আকুল করা গন্ধ পাচ্ছি তার। কী একটা পাখি ডাকছে নাম জানিনা, আখ ক্ষেতের ভিতর শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছিল।
জন কোলাহলহীন পথে নিঃশব্দচারীর মতো আমি পথ চলতে থাকি। ফকির তলা পার হয়ে আরও নির্জন পথ ধরে সামনে এগিয়ে যাই। হঠাৎ পাশের শন ক্ষেতের ভিতর থেকে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের দুটো ছেলে রাস্তার উপর উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। অনেকটা গম্ভীর ও ধমকের স্বরে আমাকে বলে -- 'দাঁড়াও'।
একজনকে নেতা মনে হচ্ছিল। আর একজন তার চেলা মনে হলো। নেতা ছেলেটি বলছিল -- বাড়ি কই তোমার?
-- কুসুমপুর। তা তোমার নাম কী?
-- বক্কার। এই নাম শুনেছ আগে?
-- না।
-- তেলকুপীর বক্কারকে সবাই চেনে। তুমি চেনো না?
-- চিনি না।
-- চিনবা একটু পরই !
বক্কার ওর চেলাকে ডাক দিয়ে বলে -- 'এই সিদ্দিক মাল বের কর্।' সিদ্দিক ওর কোমর থেকে একটা চকচকা ডেগার বের করে। বক্কার ডেগারটি সিদ্দিকের হাত থেকে নিয়ে আমার চোখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে -- 'কাছে কত টাকা আছে?
-- হাজার বারো শ হবে।
-- বের করো।
আমি পকেট থেকে টাকাগুলো বের করে বক্কারকে দিয়ে দেই। বক্কার সিদ্দিককে বলে -- ঐ সিদ্দিক, ওর সবগুলো পকেট ভালো করে চেক কর্। সিদ্দিক আমার সবগুলো পকেট চেক করে বলে -- 'আর নেই ওস্তাদ।'
বক্কার আমাকে বলে -- ' এবার চলে যাও।'
আমি রাস্তার উপর মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। সামনে আর এগুই না। বক্কার বলে -- তুমি যাচ্ছ না কেন?
-- এমনই যাচ্ছি না।
কেন জানি আমার চোখ দিয়ে জল চলে এল। মার জন্য কিছু পথ্য কিনতে চেয়েছিলাম, যদি ঔষধ কিনতে হয়? ঔষধ কিনতাম। ছোনগাছা হাট থেকে মার জন্য পান শুপারী কিনতে চেয়েছিলাম। আমার আর মার জন্য কিছু কেনা হবে না। এই ভেবে কাঁদছিলাম।
বক্কার বুঝতে পারে আমি কাঁদছি। সে বলে -- এই তুমি কাঁদছ কেন?
-- আমার মা খুব অসুস্থ। মার অসুস্থতার খবর শুনে কত পেরেশান হয়ে ঢাকা থেকে আসতেছি। তোমরা আমার টাকাগুলো নিয়ে নিলে। আমি মার জন্য ঔষধ পথ্য কিছুই কিনতে পারব না। এইজন্য কাঁদছি।
আমার কথাগুলো শুনে বক্কারের মুখ কেমন যেন দুঃখী দুঃখী হয়ে গেল, একধরনের কোমল এবং মায়াময়। আমি সেই অন্ধকারে তা দেখতে পাচ্ছিলাম।
বক্কার আমার টাকাগুলো আমাকে ফেরৎ দেয়। এবং বলে -- সামনে তো আরও বেশ কিছু পথ বাকী আছে। তুমি একা যাবে কী করে? এত রাতে? তোমার বিপদ হতে পারে। আমরা তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব।
বক্কার এবং সিদ্দিক আমাকে অনেকটা পাহারা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসে। পথে ওদের সাথে আমার অনেক কথাই হয়, শুনি ওদের জীবন কাহিনি। আমিও বলি - আমার অনেক কথা।
এইটুকু পথে আসতে আসতে একজন মানুষের সব কথা কী শোনা হয়? কিংবা বলা হয়? 'আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বক্কার বলে -- তুমি ঘরে যাও। মাকে গিয়ে দেখো, আমরা যাই।
-- তোমরাও ঘরে চলো। আমার মাকে দেখে যাও।
বক্কার বলে -- আর একদিন দিনের বেলায় এসে তোমার মাকে দেখে যাব। আজ আর এত রাতে না। আর একটি কথা, আমার মার জন্য তুমি একটু দোয়া করবে। আমার মাও তোমার মার মতো খুব অসুস্থ।
তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি -- তোমার কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছিলাম সেই টাকা দিয়ে মার চিকিৎসা করতে চেয়েছিলাম।
বক্কারের কথা শুনে আমার খুব কান্না পেল। আমার অসুস্থ মায়ের মুখের সাথে বক্কারের মায়ের মুখটি মিলে গেল। মনে হলো -- জগতের সব মা-ই এক। একই রকম স্নেহ একই রকম মায়া একই রকম মমতাময়ী।
আমি আমার বারোশত টাকা থেকে বক্কারের হাতে ছয়শত টাকা দিয়ে বললাম -- এটি নাও --মায়ের চিকিৎসা করবে।
১৩. এক রাজকন্যার গল্প
আমার মেয়ে আমার হাত পায়ের নোখগুলো নেইল কাটার দিয়ে কেটে দিতে দিতে বলেছিল-
'কাল আমার বিয়ে। কাল আমাকে শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হবে। আমার যাবার সময় তুমি একটুও কাঁদবে না। তুমি কাঁদলে আমি কিন্তু হাউমাউ করে কেঁদে ফেলব। আমি তখন আর শ্বশুর বাড়িতেই যাব না।'
আমি মাথা নেড়ে বলছিলাম -- না মা, আমি কাঁদব না একটুও। তুমি দেখে নিও।
বিয়ের দিন সানাই বাজল। বর আসল। বর যাত্রীরা এল। কত হৈহুল্লর হলো। কত আনন্দ, কত রকম খাওয়া দাওয়া হলো। কোথাও কোনো দুঃখের লেশ নেই। চারিদিকে কেবল হাসি রাশি। কোথাও কোনো ক্রন্দন ধ্বনি নেই।
যথারীতি মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় হলো। বিদায়কালীন আমার মুখে কোনো বেদনার ছায়াপাত পড়ল না। চোখে মুখে আনন্দময় হাসি। আমার হাসি মুখ দেখে মেয়েও তার মুখখানিতে হাসি মেখে রেখেছে। কোনো কান্না নেই। চোখ থেকে একবিন্দু অশ্রুও ঝরে পড়ল না। আগত অতিথিদের কেউ কেউ সমালোচনা করল - কেমন বাবা মেয়ে! কারোর চোখে জল নেই।
মেয়েকে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে ঘরে চলে আসি।
বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছি। কেমন নিঝুম সারা ঘরময়। মুহূর্ত পরেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে মেয়ের কিছু কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। যে কথাগুলো গত চার পাঁচ দিন ধরে আমাকে বলে এসেছে। আমি খুব কানের কাছে থেকে ওর এই কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম --
' বাবা, তুমি ঔষধগুলো সময়মতো খাবে। ভুলে যাবে না। কখন কোন্ ঔষধ খাবে আমি কাগজে সব লিখে রেখেছি। সাজিয়ে রেখেছিও ঐ ভাবেই৷'
' মশারী টানাতে ভুলবে না। আমি সুন্দর করে মশারী টানানোর ব্যবস্থা করে রেখেছি। '
' সুমীর মাকে বলে গেছি, উনি তোমাকে গোসলের পানি গরম করে দেবে। কখনও ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করবে না।'
' বেশি রাত জাগবে না কখনও, সময় মতো ঘুমিয়ে পড়বে।'
' ট্রাঙ্ক খুলে পুরনো এ্যালবাম বের করে মা'র ছবি একাকী বসে দেখে দেখে কাঁদবে না।'
' ময়লা কাপড়গুলো বালতিতে রেখে দিও। সুমীর মাকে বলে গেছি -- দুতিন দিন পর পর সে পরিষ্কার করে রেখে যাবে। '
' খাওয়া নিয়ে অনিহা করবে না। সময়মতো খেয়ে নেবে।'
' এক দুটো সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দিলাম। এর বেশি একটিও খাবে না। '
'আমি মাঝে মাঝে এসে তোমাকে দেখে যাব। তুমি কোনো অনিয়ম করেছ কী না, অনিয়ম করলে আমি কিন্তু তোমাকে দেখলেই ধরতে পারব।'
' হাত পায়ের নখ বড়ো হয়ে গেলে আমিই এসে কেটে দিয়ে যাব। তুমি কাটতে যেও না।'
' আর... পানি খেতে ভুলো না। শিয়রে জগের ভিতর পানি ভরে রাখবে সবসময়। '
' আমি যা বলে যাচ্ছি, সেই সব কথা মনে রাখবে এবং পালন করবে। আমার মাথা ছুঁয়ে তুমি দিব্বি দাও, বলো -- শুনবে সব কথা।'
এই রকম ওর আরও অনেক কথা শূন্য এই কক্ষের ভিতর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। দেখলাম -- আমার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বালিশ ভিজে যাচ্ছে।
মেয়েটা আমার হারানো মা এবং স্ত্রীর শূন্যতা কখনো বুঝতে দেয়নি একটুও। আজ যেন মনে হচ্ছে -- ঐ দুজনসহ তিনজনকে আমি হারিয়ে ফেললাম।
এই পৃথিবীতে মেয়েরা বাবার কাছে রাজকন্যার মতো, আর বাবাও যেন মেয়ের কাছে রাজার মতো বেশ থাকে। পৃথিবীর কোনো রাজাই রাজ্য হারিয়ে মনে হয় কাঁদে না, কিন্তু রাজকন্যা হারিয়ে কাঁদে।
এই যেমন আমি কাঁদছি।
১৪. ঘাস ফড়িং-এর রং
অনেক বছর আগের কথা। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি এসে দেখি -- আমার দূর সম্পর্কিত একজন মামু তার দশ এগারো বছরের একটি মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে। এই মামুকে এর আগে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই একা আসতে দেখেছি। উনি সকালে আসত, এবং বিকালেই চলে যেত। এই প্রথম দেখলাম -- এবার উনি ওনার মেয়েকে সাথে করে আমাদের বাড়িতে এসেছে।
মার কাছে শুনেছিলাম, তার এই ভাইটি দূর সম্পর্কের খালাত ভাই হয়। বয়সে মার থেকে অনেক ছোট। মেয়েটির জন্মের পরেই ওনার স্ত্রী মারা যায়। এর পরে আর বিয়ে করেনি। এই মেয়েকে নিয়েই থাকে। উনি খুব গরীব। অনেক অভাব অনটনের ভিতর জীবন নির্বাহ করে।
মেয়েটির নাম ফিরোজা। ক্লাস ফাইভ পাস করেছে। ওকে আরও পড়ানোর ইচ্ছে আমার সেই মামুর। তাদের গ্রামে আশেপাশে কোনো হাই স্কুল নেই। আবার অভাব অনটনও আছে। তাই এই মেয়েটিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। ওনার ইচ্ছে, এখানে থেকে তার মেয়ে লেখাপড়া করুক।
মার সাথে এই ব্যাপারে সে কী আলাপ আলোচনা করেছিল -- সে কথা আমি জানিনা। শুধু দেখলাম, ফিরোজাকে আমাদের বাড়িতে রেখে আমার সেই মামু বিকেলেই চলে গেল। যাবার সময় তার মেয়েকে
ডেকে কাছে জড়িয়ে নিয়ে বলল - মা, তুমি ভালোভাবে এখানে থাকবে। সবার কথা শুনবে। সবাইকে মান্য করে চলবে।
ফিরোজা মাথা নেড়ে বলেছিল --' আচ্ছা। তুমি আবার আইসো, আমাকে দেখে যাইও।' দেখলাম, বাবা মেয়ে দুজনেই অশ্রু মোচন করছে।
মেয়েটি এখন থেকে এখানেই থাকবে, আমার খুব ভালোই লাগছে, মনে হলো-- একজন সাথী পেলাম। যে আমার ছোট বোনের মতো, খেলার সাথীর মতো। ঐ বয়সে ফিরোজা আমার প্রেমিকার মতো কেউ একজন হবে, এই কথা ভাবিনি।
প্রথম দিন সন্ধ্যা রাতে হেরিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসেছি, ফিরোজা আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। টেবিলের উপর রাখা আমার বইগুলো নেড়েচেড়ে বলে -- রতন ভাই, তুমি মনে হয় অনেক ভালো ছাত্র, ক্লাসে তোমার রোল নং কত?
আমি বললাম, 'আমার রোল নং চব্বিশ।' ফিরোজা শুনে খুব মন খারাপ করল। ও ভেবেছিল - আমার রোল নং এক হবে। আমি খুব ভালো ছাত্র।
টুকটাক করে কথা বলতে বলতে আমি ওকে বললাম, এখন থেকে তুমি তো আমাদের বাড়িতেই থাকবে, তাই না? ফিরোজা বলল, 'হে। তুমি খুশি হও নাই ?' বললাম, 'খুশি হয়েছি।'
পরের দিন আমি স্কুলে গেলে স্কুলের ক্লাসগুলো কেমন যেন শেষ হচ্ছিল না। মন খুব আকুবাকু করছিল -- কখন ছুটি হবে, কখন বাড়ি যাব, কখন ফিরোজার সাথে গল্প করব?
স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে আসতে আসতে পথে মনে হলো, ফিরোজাও নিশ্চয়ই আমার জন্য এমন ছটফট করছে, ভাবছে-- কখন আমি বাড়ি আসব, কখন আমাকে ও দেখতে পাবে, আমার সাথে গল্প করবে।
দ্বিতীয় দিন বিকালবেলা, ফিরোজাকে নিয়ে পাড়ার অন্যান্য খেলার সাথীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। ওদের বলি - ওর নাম, ফিরোজা, ও আমার বোন হয়। এখন থেকে ও আমাদের বাড়িতেই থাকবে। আমি ফিরোজাকে নিয়ে সারা আঙ্গিনা ঘুরে ঘুরে দেখাই। পুকুর পাড় ধরে হাঁটতে থাকি। কদমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যায় জল থেকে উঠে আসা হাঁসগুলোর ঘরে ফেরা দেখি।
মাত্র দুতিনদিনেই ফিরোজা আমার সারাক্ষণের সাথী হয়ে ওঠে। আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে অন্য খেলার সাথীদের সাথে খুব বেশি মিশতাম না। ফিরোজাকে নিয়েই এ বাড়ি ও বাড়ি যেতাম। কোনো কোনো দিন পুকুর পাড় পেড়িয়ে আলপথ দিয়ে হাঁটতাম। তখন ছিল হেমন্তের দিন। সারা প্রান্তর জুড়ে ছিল সরিষার ক্ষেত। চারদিকে শুধু হলুদের সমারোহ। আমরা বিমুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখতাম হলুদ গালিচার মতো সরিষা ফুলের মাঠ। মৌ মৌ গন্ধ নিতাম নাক ভরে।
আমি চার পাঁচ দিনেই ফিরোজাকে খুব আপন করে নিলাম। ফিরোজাও আমাকে আপন করে নেয়। ভাবছিলাম, কবে ওকে ভর্তি করে দেবে স্কুলে। দুজন প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যাব। প্রতিদিন স্কুলে যেতে যেতে সারা পথে কথা বলব, গল্প বলব। গল্প করতে করতে, কথা বলতে বলতে -- কথা ফুরাবে না, গল্পও ফুরাবে না, কিন্তু পথ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে।
সেদিন ছিল বুধবার, গুনে দেখলাম ছয়দিন ধরে ফিরোজা আমাদের বাড়িতে এসেছে। আমি স্কুলে চলে যাই। সেদিনও ক্লাসে মন বসছিল না পড়ায়। খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘ হচ্ছিল ক্লাস। মনে হচ্ছিল, কখন ছুটি হবে, কখন বাড়ি যাব, কখন দেখব যেয়ে ফিরোজাকে।
ক্লাস শেষে ছুটির পর আমি খুব জোরে জোরে পা ফেলে বাড়ির দিকে আসতে থাকি। পায়ে পায়ে পথের ধুলি উড়িয়ে আসছিলাম, আর ভাবছিলাম কখন এই পথ চলা শেষ হবে।
যখন বাড়িতে আসি, এসে দেখি-- আজ ফিরোজা বাড়ির গলি মুখে দাঁড়িয়ে নেই। ওকে না দেখে মন খারাপ করে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করি। উঠোনেও কোথাও ওকে দেখতে পেলাম না। ঘরের ভিতর যেয়ে দেখি, ঘরেও নেই। ভাবলাম, হয়তো পাশের বাড়ি বেড়াতে গেছে।
মা আমাকে খেতে দিল। আমি ভাত খেতে খেতে মাকে বললাম -- ফিরোজা কোথায় গেছে? মা জবাব দেয় , ওর বাবা এসে ওকে আজ নিয়ে গেছে। আমি বললাম, কবে আবার আসবে? মা, বলল, এমনিতেই আর কখনও আসবে না, তবে বেড়াতে আসলে আসতে পারে।
ফিরোজার চলে যাবার কথা শুনে, আমি আর এক নকলা ভাতও মুখে দিতে পারিনি। আমার চোখে জল চলে আসে। আমি হাতে পানি ঢেলে হাতও ধুইনি। এঁটো হাতেই মাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে
থাকি। আমার সেই কান্নার অর্থ সেদিন মা কী বুঝেছিল, আমি জানিনা।
পরে শুনেছি -- ফিরোজার বাবাই ফিরোজাকে আমাদের বাড়ি থেকে ফিরিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল। মেয়েকে ছাড়া সে নাকি একদণ্ড একাকী থাকতে পারেনা।
সেই কত বছর চলে গেছে কত দিনকাল ক্ষণ। এত বছর পরেও সেই বালিকাকে আমি ভুলতে পারিনি। কী মায়া করেই না আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কথা বলত, স্মিত হাসি লেগে থাকত চোখে মুখে, সন্ধ্যার দীপশিখায় দেখতাম সেই মুখ, হাঁটত ছোট ছোট পা ফেলে আমাদের বাড়ির উঠোনে। ওর কিছু কথা এখনও ক্ষীণ করে আমার কানে বাজে। বিশেষ করে আদুরে কণ্ঠের সেই ডাক -- রতন ভাই।
খুব করে মন চায় রাঙা পথের ধুলো উড়িয়ে চলে যাই পল্লীর নিভৃত ওর সেই গাঁয়ে। যেয়ে যদি দেখা পাই ঐ বালিকার, কিংবা খুঁজতে খুঁজতে যদি দেখা মেলে ফিরোজা রঙের কোনো ঘাস ফড়িং কিংবা অপরাজিতার। দেখতে তো পাব তবু তার রূপ রং ঠিক অনেক বছর আগে দেখা ঐ বালিকার মতো। আম-কাঁঠালের ঝাড়ের উপর দেখতে পাব নীল আকাশ, দেখব রাতের নক্ষত্র বীথি, আলো আঁধারে চেয়ে দেখতে পাব হয়তো কারোর চোখের অশ্রু ছল ছল।…
১৫. চিত্রিতা
এই গল্পের কাহিনিকাল গত শতাব্দীর ষাটের দশকের। গল্পের নায়ক একজন ডাক্তার। আমি তার হয়ে উত্তম পুরুষে কাহিনিটি বর্ণনা করেছি মাত্র।
এলএমএফ পাস করার পর চাকুরি নিয়ে নবাবগঞ্জের একটি পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার হিসাবে যোগদান করি। স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি ছিল ইছামতী নদীর তীরে। বান্দুরা-কলাকোপা থেকে কেন্দ্রটি বেশি দূরে না হলেও আসা যাওয়ার পথ ছিল খুবই খারাপ। সেই সময়ে গ্রামের কাঁচা পথে বৃষ্টিতে কাদা হতো, শুকনো দিনে ধুলো উড়ত আর বর্ষায় অথৈ পানিতে থৈথৈ করত।
আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয় কেন্দ্রের পিছনে একটি পুরানো আধা পাকা ঘরে। যেটিতে গত এক দেড়বছর ধরে কেউ থাকত না। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। আমার কেন্দ্রের কম্পাউন্ডার শ্যামল গোমেজকে দিয়ে ঘরটি সাজ সজ্জা করিয়ে নেই। সেখানে তখন বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। আমাকে রাতে হারিকেন কিংবা লণ্ঠন জ্বালিয়ে থাকতে হতো।
শ্যামল ওখানকার স্থানীয় ছেলে। আমার চেয়ে তিন চার বছরের বড়ো হবে। বিয়ে করেছে। একটি বাচ্চাও আছে। বউ সন্তান নিয়ে থাকে। বাড়ি থেকেই ডিসপেনসারিতে আসা যাওয়া করে। শ্যামল আমার জন্য একটি কাজ করেছিল, তাহলো পাশের একটি বাড়ি থেকে আমাকে পেয়িং খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
এলাকাটির নাম সোনাবাজু। নিভৃত গ্রাম। অদূরে বয়ে চলেছে ইছামতী নদী। আমি বিকাল হলেই হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম নদীর তীরে। জেলে পাড়া দিয়ে হাঁটতাম। ওরা আমাকে খুব মান্য করত। বলত - ডাক্তার বাবু এসেছে। কোথায় বসতে দেই! কী খেতে দেব! তারপরও কাঠের টুলে বসতে দিত। বেতের টুরিতে মুড়ি খেতে দিত নারিকেল দিয়ে, না হয় আখের গুড়। গাছের পিয়ারাও খেতে দিত।
আবার কোনো কোনো দিন একাকী হেঁটে নদীর কূল ধরে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতাম। সন্ধ্যা নামত নদীর কূলেই। বক, পানকৌড়ি, বালিহাঁসের দল উড়ে চলে যেত মাথার উপর দিয়ে ওদের কুলায়। সন্ধ্যা ঘোর হয়ে রাত্রি নেমে এলে আমি ঘরে চলে আসতাম। ঘরে এসে নিজ হাতে সন্ধ্যা বাতি জ্বালাতাম।
সন্ধ্যার পরে কেউ থাকত না। মাঝে মাঝে শ্যামলকে বলতাম, তুমি কিছু সময় আমার এখানে থাকো, কথা বলো, গল্প করো আমার সাথে। শ্যামল আমার অনুরোধে প্রায়ই সন্ধ্যা রাত্রি পর্যন্ত থাকত, এবং গল্প গুজব করে চলে যেত।
আমি শুনতাম ওর অনেক গল্প কথা। বলত এখানকার অনেক পুরাণ কাহিনিও। দুইশত বছর আগের কলাকোপার কোকিলপেয়ারী জমিদার বাড়ির কেচ্ছা কাহিনিও শোনাত। বলত ব্রজেন নিকেতনের নানা রঙ্গ-লীলার কথা। ভালোই লাগত সেই সব কল্পকথা শুনতে। আমি শ্যামলকে বলতাম -- তুমি এসব কার কাছে থেকে শুনেছ? শ্যামল বলত, আমার পিতামহের কাছে থেকে। পিতামহ আবার শুনেছে নাকি তার পিতামহের কাছে। এইভাবেই শোনা কাহিনি। সবই কিংবদন্তি।
সারাদিন ডিসপেনসারিতে রোগীরা আসত, ভালোই লাগত। বিকালবেলা এদিক সেদিক ঘুরতে বের হতাম, সময় কেটে যেত। কিন্তু সমস্যা হতো সন্ধ্যা হতে রাত্রিতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। ঐ সময়টুকু কেমন যেন ভয় ভয় লাগত। যেদিন শ্যামল থাকত সেদিন ভালোই লাগত, যেদিন থাকত না, সেদিন খারাপ লাগত।
একদিন সন্ধ্যায় শ্যামল বহু বছর আগের কোকিলপিয়ারির জমিদার বাড়ির এক কাহিনি আমাকে শোনায়। পুরোটা বলেনি, আংশিক বলছিল। ওর গল্প শোনার পর আমি কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। একবার মনে হলো দরজা খুলে বাইরে যাই। এই নিশীথে সন্তর্পণে হেঁটে চলে যাই ব্রজেন নিকেতনে। কিন্তু পা থেমে গেল!
খুব অস্থির লাগছিল। পায়চারি করছিলাম কক্ষের ভিতর। কী মনে করে দরজা খুললাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি -- প্রাচীন বিধ্বস্ত নগরীর মতো নিকষ অন্ধকার, কেমন ভূতুড়ে লাগছিল চারদিকে। কেমন যেন হুহু করছে আঁধার। আমার হাত পা ভয়ে হিম হয়ে আসছিল। আমি আর বাইরে এগুলাম না। ঘরের ভিতর এসে দরজা বন্ধ করে দেই। বিছানায় শুয়ে থাকি চুপচাপ।
হারিকেন জ্বলছে টেবিলের উপর। নিভালাম না। কালিগঙ্গার কূলবর্তী সোনাবাজুর চরাচরে ক্রমে গভীরভাবে রাত নেমে আসছে। নিস্তব্ধতার ভিতর শুধু নিশি পোকাদের গুনগুনানি শুনছিলাম। ভয়ে ঘুম নেমে আসছিল চোখে। অবশে বুক থরথর করছিল। কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। হয়ত ঘুমিয়েও পড়েছিলাম।
হঠাৎ বাইরে কার যেন পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। হারিকেন তখনও জ্বলছে। আমি চুপচাপ কান পেতে শুনছিলাম পায়ের শব্দ। একটুপর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। খুব ভয় লাগছিল। ঘড়িতে চেয়ে দেখি রাত ১.৪০ মিঃ। আমি দরজা খুলছিলাম না। কাঁপা কাঁপা পায়ে দরজার এপাশ থেকে বলছিলাম -- আপনি কে? কিছুক্ষণ নীরব। কোনো কথা নেই। আবার বলি-- কে আপনি? ওপাশ থেকে রমণীকণ্ঠে জবাব এল, 'আমাকে তুমি চিনবে না, দরজা খোলো, দেখলে আমাকে চিনবে, আবার নাও চিনতে পারো।'
আমি দুরুদুরু বুকে দরজা খুলে দেই। চেয়ে দেখি - বাইরে এক অপরূপ রমণী মূর্তি দাঁড়িয়ে। আমার কোনো অনুমতি না নিয়েই সে গৃহের ভিতর প্রবেশ করে। সোজা যেয়ে খাটের উপর বসে। হারিকেনের আলোয় দেখলাম - পরনে তার ধূসর রঙের ফিনফিনে ঢাকাই জামদানী শাড়ি। কানে সোনার ঝুমকা, গলায় সীতাহার। দুহাত ভরে সোনার চুড়ি। মৃদু রিনঝিন করছে। রমণীর মুখ অপার মাধুর্যে পরিপূর্ণা। গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরীয়। চোখ দুটো টানাটানা। কালো ভ্রুকুটি। নিরাভরণ মুখশ্রী, কিন্তু লাবণ্যময়। আমি ভয়মিশ্রিত বিস্ময়ে দেখছিলাম তাকে। রমণী আমাকে বলছিল - তুমি চেয়ে দেখছ আমাকে কিন্তু চিনতে পারছ না।
আর চিনবে কী করে? এর আগে আমাকে কখনও দেখনি! আমার নাম চিত্রিতা। সবাই আমাকে চিত্রা বলে ডাকে।
আমি চিত্রাকে বললাম - এই নিঝুম রাত্রি নিশীথে আপনি আমার এখানে কেন এসেছেন? কেউ জানলে কেউ দেখলে আপনার বদনামি হবে, আমারও বিপদ হবে। আপনি চলে যান।
চিত্রা পরিহাস করে বলছিল - আমার একদণ্ড সান্নিধ্য পাবার জন্য কত পুরুষ হাহুতাস করে, আর তুমি কী না তোমার ঘরের মধ্যে এই নির্জন গভীর রাত্রিতে আমাকে একা পেয়েও তাড়িয়ে দিতে চাইছ। সত্যি তুমি এক আহম্মক তরুণ!
আমি বললাম - ঠিক আছে, আপনি আপনার পরিচয় দিন। কী জন্য এসেছেন, বলুন। দেখি, আপনার জন্য কী করতে পারি।
চিত্রা বলছিল -- আমি জমিদার বাড়ির বধু। জমিদারের বড়ো ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল চার বছর আগে। আমাদের কোনো সন্তান হচ্ছিল না। ডাক্তার কবিরাজ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে -- আমার স্বামীই সন্তান প্রদানে অক্ষম।
-- এই রকম তো হতেই পারে। তো এই সমস্যার জন্য আপনি এত রাতে আমার এখানে কেন এলেন?
-- রাতে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। দিনের বেলায়, দিনের আলোয় জনসম্নূখ দিয়ে এসে আমার সমস্যা তোমাকে বলা সম্ভব হতো না। তাই এত রাতে নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে আসতে হলো।
-- তো কী সমস্যা আপনার?
-- আমি দেড়মাসের সন্তান সম্ভবা। আমার গর্ভে অন্য পুরুষের সন্তান এসেছে। যার সন্তান এসেছে তাকে আমি ভালোবাসি না। এটি ক্ষণিক আনন্দের একটি দূর্ঘটনা। আমি গর্ভপাত করার জন্য তোমার এখানে এসেছি। আমার এই অবৈধ গর্ভধারণের খবর জানাজানি হলে জমিদার বাড়ির মান সম্মান হানি হবে। তুমি আামাকে রক্ষা করো - আমাকে বাঁচাও।
-- কীভাবে সম্ভব হবে? আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি এখানে নতুন এসেছি। নতুন চাকরি। আমার খুব ভয় লাগছে। আমি এটা করতে পারব না।
চিত্রা আমার অপারগতার কথা শুনে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে - তুমি যত টাকা চাও, তাই দেব। তবুও করে দাও।
আমি বললাম -- টাকার লোভ আমাকে দেখাবেন না। আমার কোনো টাকা পয়সার দরকার নেই।
চিত্রা বলছিল -- তবে গর্ভপাত করাতে চাচ্ছ না কেন?
-- এটি একটি অবৈধ কাজ। গর্ভপাত করানো হবে আমার জন্য বেআইনি। তাই।
-- দেখো, তুমি বয়সে তরুণ। আমি তোমার চেয়ে বয়সে পাঁচ ছয় বছরের বড়ো হবো। তোমাকে আমি মিনতি করছি। তুমি আমার এই উপকারটা করে দাও। কী করবে না?
-- না, করব না। আমার খুব ভয় লাগছে। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়, যদি বিপদ হয়। আমার চাকরি চলে যাবে।
চিত্রা এবার বলছিল -- আমি যৌবনবতী রূপসী রমণী। আমাকে তোমার ভোগ করতে ইচ্ছে করে না? আমার সৌকর্য, আমার গোপন রূপ তোমার দেখতে মন চায় না? আমি কালরাতে আসব। তুমি সব সার্জিক্যাল জিনিসপত্র নিয়ে রেডি থাকবে। ঘরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করবে। আমি আসব মধ্য নিশীথে একাকী। কাল পরব কালো রঙের তাঁতের শাড়ি। শরীরে গহনা পরা থাকবে আজকের গহনাগুলোই। তোমাকে আমি আজই প্রথম দেখলাম -- খুব সুদর্শন তুমি। তোমাকে খুব ভালো লেগেছে। কেন জানি জীবনে আর একটি ভুল করতে খুব ইচ্ছে করছে। তোমাকে এই রাত্রি নিশীথে হেরিকেনের ম্লান আলোয় যতটুকু দেখলাম- খুব ভালো লাগছে। অদ্ভুত সরল তুমি। এই কলঙ্কিত জীবন, এই দেহ এই মন তোমাকে দিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আবার! কী আমাকে নেবে তুমি!
আমি কোনো কথা বলছিলাম না। শুধু নিষ্পলক চেয়ে দেখছিলাম চিত্রাকে। কী মোহিনী রূপ! কী আবেদনময়ী! কী চুম্বক আমন্ত্রণ! এই চিত্রিত রাত থমকে যাচ্ছিল অসীমে!
চিত্রা এসে আমার একটি হাত ধরে বলে -- চলো, একটু বাইরে যাই। এই আঁধার রাতে আজ আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু কোটি কোটি তারা জ্বলছে। সেই কোটি তারার আলোয় তুমি আমাকে একবার দেখ প্রাণ ছুঁয়ে। দেখবে, আমাকে তোমার ভালো লাগবে। আমার শরীরের এক অলৌকিক গন্ধে পাগল হবে তুমি!
চিত্রা আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে। আকাশে জ্বলে থাকা কোটি কোটি তারার আলোয় দেখলাম চিত্রাকে! কী মাধুর্যময় ওর মুখ। কী নিষ্কলুষ মায়াভরা চোখ! কী যে স্বর্গীয় ক্ষণ ছিল তখন! অন্তরে আমার তখন অন্য অনুভব, যেন --
"আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,/ তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।"
বিমুগ্ধ হয়ে দুজনেই আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে থেকেছিলাম কতক্ষণ জানিনা। একসময় চিত্রা বুক ছেড়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল -- কাল আসব।
সকালে আমার ঘুম ভাঙে নাই স্বাভাবিক নিয়মে। শ্যামল এসে ঘরের কড়া নাড়ছিল খুব জোরে জোরে এবং ডাকছিল 'স্যার, স্যার' ওঠেন। আমি যেয়ে দরজা খুলে দেই। শ্যামলের চোখ মুখ কেমন যেন ভয়ার্ত ও বিষাদময়!
শ্যামল বলছিল - স্যার আপনাকে এখনই জমিদার বাড়িতে যেতে হবে। গতরাতে জমিদার বাড়ির বউ চিত্রিতা খুন হয়েছে। আপনাকে তার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে হবে।
১৬. সেই মুখচ্ছবি
আমার প্রতিদিনের কর্ম ব্যস্ততার ফাঁকে কিংবা রাত্রিতে ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে যখন শুয়ে পড়ি, সেই আঁধার হয়ে আসা ক্ষণে শৈশবের যে সব মুখগুলোর কথা মনে পড়ে, তার মধ্যে একটি মুখচ্ছবি প্রায়ই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কখনও সেই মুখটি আবছা আবছা দেখি, কখনও আবার উজ্জ্বল রৌপ্যকান্তের মতো ঝলমলে দেখি।
গ্রামে ফ্রী প্রাইমারি স্কুলে 'ক,খ' ক্লাস রুমে সেই মুখখানি আমি প্রথম দেখেছিলাম। পরনে ছিল হাফ প্যান্ট, গায়ে পুরনো জামা। খালি পা, কোনো স্যান্ডেল পরত না। পায়ে প্রায়ই ধুলোবালি লেগে থাকত।
ওর নাম আব্দুর রহমান। গরীব ঘর থেকে পড়তে আসা একটি ছেলে। ক্লাস রুমের এক কোণে নিরীহের মতো চুপচাপ বসে থাকত। ক্লাসেও সম্ভবত ও নিজেকে গরীব মনে করত। এই ছেলেটাই আমার অন্যান্য বাল্য সহপাঠী বন্ধুদের মতো একজন বন্ধু হয়ে উঠল।
আব্দুর রহমানের বাড়ি আমাদের পাশের পাড়ায়। স্কুলে যেতে প্রায়ই ওর সাথে পথে দেখা হতো। আবার স্কুল ছুটি হলে ওর সাথে বাড়ি চলে আসতাম। সেই কৈশোর বেলায় কতো কথা হয়েছে ওর সাথে, কতো খেলা করেছি উন্মুক্ত মাঠে, তার কোনো কথাই আজ আর মনে নেই। আজ এত বছর পর শুধু ওর মুখখানির কথাই আমার মনে পড়ে।
প্রাইমারি স্কুল পাস করার পর আমরা একই হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। আব্দুর রহমান নিয়মিত ক্লাস করতে পারত না। সপ্তাহে একদুই দিন কামলা বেচত। ওদের সংসারের ভরণপোষণেরও সহায়তা করতে হতো ওকে। খুব একটা ভালো ছাত্র আব্দুর রহমান তাই হতে পারেনি। তারপরও লেখাপড়া চালিয়ে নিয়েছিল। ও আমাকে প্রায়ই ওর আশার কথা বলত, স্বপ্নের কথা বলত। ওর ইচ্ছে ছিল -- ও একদিন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হবে।
নাহ্, আব্দুর রহমান প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হতে পারেনি। কোনো মতো তৃতীয় শ্রেণিতে এসএসসি পাস করতে পেরেছিল। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য কলেজে ভর্তি হয়নি।
আমি ঢাকা চলে আসি। এবং কলেজে ভর্তি হই। ঢাকা থেকে যখন বাড়িতে যেতাম, তখন ওর সাথে আমার খুব একটা দেখা হতো না। শুনতাম আব্দুর রহমান পুরোপুরি কামলা হয়ে গেছে। সে কামলা বেচে তাদের সংসারের ভরণপোষণ নির্বাহ করে।
আমি কলেজের পড়া শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। প্রতি ছুটিতে যখন বাড়িতে যেতাম তখনই অন্যান্য বাল্যবন্ধুদের মতো ওকেও খুঁজতাম বাজারে চা স্টলে আড্ডার স্থানে। কিন্তু ওর দেখা পেতাম না।
তারও দুতিন বছর পর একবার আব্দুর রহমানের দেখা পেয়েছিলাম গ্রামের পথের উপর। আমি ওকে দেখে চিনতেই পারছিলাম না। মলিন একটি লুঙ্গি পরে আছে। উদোম শরীর। ক্ষেতের ধুলোবালি সর্ব অঙ্গ মাখা। আমি ওকে বলি -- কেমন আছিস রহমান? ও বলল -- ভালো।
আমি আরও কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও কোনো কথাই শুনল না। হেঁটে অন্য দিকে চলে গেল।
তারপর চলে গেছে আরও কয়েক বছর। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে চাকুরিতে ঢু্কে যাই। বাড়িতে তাই একটু কম যাওয়া হতো। অনেকদিন পরপর দুএক দিনের জন্য বাড়িতে গেলেও আব্দর রহমানের কথা খুব একটা মনে করতাম না। দেখাও হতো না। ভুলে যাওয়া যাকে বলে।
তারও দু' বছর পর একবার বাড়িতে গেছি। কেন জানি আব্দুর রহমানকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হলো। আমার আরেক বাল্য সহপাঠী সামাদকে বলি --' চল্ আব্দুর রহমানদের বাড়ি থেকে আজ একটু ঘুরে আসি।'
সামাদ বলে -- কেন যাবি?
আমি বললাম -- ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
সামাদ বিস্ময়ে বলে -- তুই শুনিসনি কিছু?
আমি বললাম -- কী? না তো!
সামাদ বলে -- 'আবদুর রহমান তো মারা গেছে। গত বছর যমুনার চরে নৌকা নিয়ে কাশ কাটতে গিয়েছিল। কী এক বাকবিতণ্ডায় প্রতিপক্ষরা ওকে লগি বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে যমুনার জলে ভাসিয়ে দেয়। ওর লাশটাও পাওয়া যায়নি।'
তারপর আরও কতো বছর চলে গেছে। জীবনের কতো কর্ম ফাঁকে, কতো আঁধার হয়ে আসা রাত্রিতে বিছানায় শুয়ে আব্দুর রহমানের মুখখানি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখেছি ... এমনই কতো রাত্রি পেরিয়ে যাবে। এমন করেই আরও কতকাল দেখতে পাব ওর মুখচ্ছবি।
১৭. বাসনা কুসুম
আশির দশকের মাঝামাঝির বৃষ্টিমুখর এক বিকেল। তখন একলা জীবন আমার। সুখের মুহূর্তগুলো একলা উপভোগ করি। দুঃখের ক্ষণগুলো একাকী পাড় করি। আবার ভালো না লাগার সময়গুলো মন কেমন করে যেন কেটে যেত।
ঘরের চালে রুপোলী বৃষ্টির ফোঁটা ঝমঝম করে পড়ছে। একবার বিছানায় শুয়ে থাকি। আর একবার বারান্দায় যেয়ে বৃষ্টি দেখি। দাঁড়িয়ে থেকে জলের শব্দ শুনি। আবার ফিরে এসে বিছানার উপর বসে থাকি। ভাবলাম, বই পড়ব। বুকশেলফের কাছে যেয়ে বই খুঁজি। কোন্ বইটি পড়ব? চোখে পড়ল বুদ্ধদেব গুহের 'বাসনা কুসুম'। বইটি পড়া ছিল আজ থেকে বছর চারেক আগে। কেন জানি আবার পড়তে ইচ্ছে হলো। শেলফ থেকে বইটি বের করে পাতা উল্টাতে থাকি। পাতা উল্টাতে যেয়ে একটি চিঠি দেখতে পাই। চিঠির কাগজের রং হলদেটে হয়ে গেছে। চার ভাজ করা চিঠিটি খুলে পড়তে থাকি --
দাদা ভাই,
আপনি আমার বয়সে ছোট ছিলেন। তারপরও দাদা ভাই ডেকেছিলাম। আত্মপরিজনহীন এই শহরে আপনার এখানে যে ক'টি দিন ছিলাম খুব আপন করে নিয়েছিলেন। আমাদের জন্য অনেক করেছেন। চির ঋণী হয়ে থাকলাম।
আজ চলে যাচ্ছি। আপনার সাথে আর কী কখনও দেখা হবে ? যাবার বেলায় কেন জানি, এই চিঠিতে আপনাকে "তুমি" বলতে ইচ্ছে করছে। একবার হলেও আমাদের বাড়িতে তুমি এসো। আমি জানি, সময়ে অসময়ে তোমার কথা আমার খুব মনে পড়বে। তোমাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করবে।
ইতি --
শারমিন ভাবী।
এই শারমিন ভাবী ছিলেন আমার ক্ষণকালীন এক সহকর্মী নাজিমউদ্দীনের স্ত্রী। নাজিম উদ্দীন ছিল আমার থেকে প্রায় সাত আট বছরের বড়ো । উনি ওনার স্ত্রীকে ঢাকায় চিকিৎসা করতে এনে আমার বাড়িতে সপ্তাহখানেক থেকেছিলেন।
ওনারা এসেছিলেন তিন বছর আগে। আমার মনে পড়ছে ওনারা যখন এসেছিলেন তখন এই "বাসনা কুসুম" বইটি সদ্য পড়া শেষ করে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছিলাম। শারমিন ভাবী যেদিন চলে যায় সেদিনই হয়ত চিঠিখানি লিখে বইয়ের ভাজে রেখে গিয়েছিলেন। আমি তা না দেখেই বইটি বুকশেলফের ভিতর রেখে দিয়েছিলাম।
এই ক'বছরে আমার কাছে শারমিন ভাবী অনেকটাই বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। আজ এই চিঠিটি পড়ার পর সেই শারমিন ভাবীকে আবার নতুন করে মনে পড়ছে। কয়েকটি দিন উনি ছিলেন, কী আদর যত্নই না করে গিয়েছিলেন আমাকে। ঐ ক'টা দিন স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে উনি কানায় কানায় ভরে তুলেছিলেন।
মনে পড়ছে তাকে প্রথম দেখার সেই দিন।
হেমন্তের রোদ্দুর তখন সারা আঙিনাতে মুখর। নাজিম উদ্দীনের স্ত্রীর পরনে একটি সবুজ রঙের তাতের শাড়ি, হাতে চারটি চিকন সোনার চুড়ি, মুখে কোনো আবীর মাখা নেই। অনেকটাই নিরাভরণ। বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। মাথায় ছোট্ট ঘোমটা দেওয়া। আমায় দেখে ঘোমটাটা আরও একটু সামনের দিকে টেনে আনেন । হেমন্তের রোদ্দুর সেই ঘোমটার ভিতর দিয়ে আবছায়া রূপে প্রবেশ করে তার মুখখানিকে বেশ উজ্জ্বল করে তুলেছিল। নাজিম উদ্দীন আমাকে পরিচয় করে দেয় -- 'এই হচ্ছে তোমার ভাবী। তোমার শারমিন ভাবী।'
আমি তখন ইউনিভার্সিটির সদ্য মাস্টার্স পাশ করা তরুণ এক , বয়স চব্বিশ পঁচিশ। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। তখনও বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, মেঘদূতম, শকুন্তলা দুস্মমন্ত'রা মগজে ঘোরাফেরা করে। সুযোগ পেলেই কল্পনায় চলে যাই, দূর শিপ্রানদীর তীরে। সেই আমি দেখলাম আজ হেমন্তের রোদ্দুর ছোঁয়া একজন কুসুমিত রমণীর অনাবৃত দুটো হাত। আমার মনের ভিতর এক প্রকারের নূতন অনুভূতি, আমার বুকের রক্তের তালে তালে সেদিন এক প্রকার নূতন স্পন্দন স্পন্দিত হয়েছিল।
শারমিন ভাবীরা সাতদিন ছিলেন আমার বাড়িতে। ঐ কয়দিনে সত্যি সত্যি আমার বাড়িটা তিনি সাজালেন। ঘরের কোণে কোণে ধূলো ময়লা জমেছিল সেগুলো তিনি নিজ হাতে পরিস্কার করলেন। বারান্দার চালে মাকড়সা বাসা বেঁধে অসংখ্য ঝুলে ভরে রেখেছিল, সেগুলোও ঝাড়লেন। পড়ার টেবিল গোছালেন। বিছানাপত্র সব পরিপাটি করে রাখলেন। বাড়ির সামনের বাগানে আগাছাগুলো লোক ডেকে কেটে ফেললেন। মালিনীর মতো প্রতিদিন গোলাপ, বেলী, গাঁদা ও পাতাবাহারের গাছগুলোতে পানি ঢাললেন এবং পরিচর্যা করলেন।
হঠাৎ করেই জমিদার পুত্রের মতো জীবন হলো আমার। বাড়িতে খাবার রেডি থাকত। হাতখান ধূয়ে শুধু খেতে বসতাম। শারমিন ভাবী মুখে তুলে খাওয়ানোটাই শুধু বাকি রাখতেন। বাকি সবই তিনি করতেন, সব তৈরি করে রাখতেন। কটা দিন ছিল শুধুই আনন্দময় দিবারাত্রি।
শারমিন ভাবীরা যেদিন চলে যাবে তার আগের দিনের কথা। বিকালে অফিস থেকে এসে দেখি -- শারমিন ভাবী নতুন একটি শাড়ি পরে সেজেগুজে বসে আছে। অপূর্ব সুন্দর লাগছিল ওনাকে। কপালে টিপ পরেছিল। চোখে মেখেছিল কাজল। খোপায় বেঁধেছিল গাঁদা ফুলের মালা। শারমিন ভাবী আমাকে চুপিচুপি বলেছিল-- 'আামাকে দেখতে কেমন লাগছে?'
-- অপূর্ব সুন্দর লাগছে, একদম দেবীর মতোন।
-- কেন সেজেছি জানেন?
-- কী জন্য?
-- আপনাকে প্রেরণা দিচ্ছি। যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে করে একটি লক্ষ্মীমন্ত সুন্দরী বউ ঘরে আনেন।
-- তাই?
-- জ্বী।
চিকিৎসা শেষে শারমিন ভাবী যেদিন চলে যায়, সেদিন তাকে দেখি -- মাথার ঘোমটা অর্ধেকটা খুলে স্থির শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হলো কালো চোখদুটির নীচে জগতের সকল অশ্রুভার গোপনে লুকিয়ে রেখেছে। ঈষৎ ভারী সেই চোখ দুটো তুলে বলেছিল -- 'আমি কিন্তু ঘরের সবকিছু সাজিয়ে গুজিয়ে রেখে গেলাম । কোনো এলমেল যেন না হয়। যদি কখনও আবার আসি -- ঘরে যেন একজন লক্ষ্মীমন্ত বউ দেখতে পাই।'
চিঠিখানা পড়ে ভাজ করে 'বাসনা কুসুমে'র পাতায় রেখে দেই। সেদিন আর বইটি পড়া হলো না। ধীর সন্তর্পণে হেঁটে বারান্দায় চলে যাই। বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘরের চাল থেকে গড়ে পড়া স্বচ্ছ বৃষ্টির জল আঁজলায় ভরে চোখমুখ ধূয়ে ফেলি। চোখ দুটো ধুতে যেয়ে মনে হলো -- কেনই ধুয়ে ফেললাম এই চোখ! আমার চোখ থেকে তো কোনও গোপন অশ্রু ঝরে পড়েনি।
তিনটি বছর চলে গেছে। এই তিন বছরে চিঠিটি আমার চোখে পড়েনি, এজন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল । কী এক কোমল অনুভব নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন। ভাবলাম, শারমিন ভাবীকে দেখতে যাওয়া উচিৎ।
আমার বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হয়ে আছে। আমার এই বিশেষ দিনে শারমিন ভাবী'রা আসুক। তাদেরকে নিমন্ত্রণ করার জন্য তাই একদিন সকালবেলা একটি লোকাল ট্রেনে করে ঢাকার অদূরে শ্রীপুরের কাওরাইদ স্টেশনে গিয়ে নামি।
নির্জন ছোট্ট একটি স্টেশন। কোনো জনকোলাহল নেই। একটি চা'র দোকানে চা খেতে খেতে দোকানীকে জিজ্ঞাসা করি -- ভাই, বেলদিয়া গ্রাম কতদূর?
দোকানী বলল -- এখান থেকে মাইল দুই আড়াই হবে।
-- কীভাবে যাব?
-- হেঁটে যেতে হবে। আপনি প্রথমে কাওরদীর ব্রাহ্ম মন্দির পর্যন্ত রিক্সায় যাবেন। তারপর সুতিয়া নদীর কূল ধরে মেঠো পথে হেঁটে হেঁটে চলে যাবেন।
আমি তাই করলাম। একটি রিক্সা নিয়ে মন্দির পর্যন্ত চলে যাই। ওখানে নেমে প্রথমে মন্দির দর্শন করি। খুব ভালো লাগছিল ব্রাহ্ম্য ধর্মালোম্বীদের এই মন্দির। জনশ্রুতি আছে রবীন্দ্রনাথ নাকি এই মন্দির দেখতে এসেছিলেন। পাশেই অতুল চন্দ্র সেনের সমাধি। সমাধি গাত্রে লেখা আছে -- 'মোদের গরব মোদের আশা, আ-মারি বাঙলা ভাষা।'
মন্দির আর সমাধি দেখে পথে নেমে পড়ি। নদীর তীর ঘেষে মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকি সামনের দিকে। কার্তিকের রোদ্রছায়ায় হাঁটতে কী যে ভালো লাগছিল! পথের একপাশে স্বচ্ছতোয়া সুতিয়া নদী। নদীটির জল স্থির। স্রোত নেই। বক ও পানকৌড়ি উড়ছে। অদূরে সারি সারি গ্রাম। গ্রামগুলো সবুজ শ্যামলিমায় ঢাকা। হাতের বামদিকে বিস্তৃর্ণ ধানক্ষেত। পাকা ধানের গন্ধ মিশ্রিত বাতাস মৌ মৌ করে ভেসে আসছিল।
মাইল দুই যাওয়ার পর দেখলাম, একটা হালট। হালটটি নদী থেকে চলে এসেছে। ছোট্ট বাঁশের পুল। সাঁকোটি পেরিয়ে আবার মেঠো পথে উঠি। ধানক্ষেতের আইল ধরে কিছু দূর যেতেই বনানী ঘেরা যে গ্রামটা দেখতে পেলাম, ঐটাই বেলদিয়া গ্রাম। ঠিক পূর্বপাশ দিয়েই সুতিয়া নদী বয়ে গেছে।
বেলদিয়া গ্রামে ঢুকতেই একজনকে জিজ্ঞাসা করে নাজিম উদ্দিনের বাড়িটি চিনে নেই ৷
নাজিমউদ্দীনের বাড়ির আঙিনায় যখন পৌঁছি -- তখন দুপুর গড়িয়ে যায়। বাড়িটি ছায়াঘেরা। চারপাশে আম কাঠালের গাছ। ছোট্ট একটি পুকুরও আছে। ঠিক অদূরে মাঠের পরে সুতিয়া নদী। আমাকে দেখে একটি আট নয় বছরের মেয়ে বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে আসে।
আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করি -- তোমার নাম কী?
মেয়েটি বলে -- নাজমা।
-- তোমার বাবার নাম কী?
-- নাজিম উদ্দীন দেওয়ান
-- উনি বাড়িতে নেই?
-- বাবা তো বেঁচে নেই।
আমি স্তব্ধবাক হয়ে যাই। ওকে বলি -- কী বলো তুমি! মেয়েটি বলছিল -- আপনি জানেন না?
-- জানিনা মা।
নাজমা বিনম্র কণ্ঠে বলে -- আপনি কোথা থেকে এসেছেন? বললাম -- ঢাকা থেকে এসেছি। তোমার বাবা আমার বন্ধু। একসাথে আমরা চাকুরি করেছি দু'বছর ।
বললাম -- তোমার মা বাড়িতে নেই?
-- আছে।
-- তুমি যেয়ে ওনাকে বলো -- ঢাকা থেকে রঞ্জন চাচু এসেছে।
-- আচ্ছা।
মেয়েটি বাড়ির ভিতর চলে যায়। ভাবছিলাম -- এই জগতে আনন্দহাসিরাশি কত ক্ষণকালের। কোথায় কোন্ গ্রামের নিভৃতে এসে দেখতে পেলাম, কত ফুল অনাদরে ফুটে নির্জনে তা ঝরে যায়। কতজন কত
অশ্রু ঝরায়…কত স্বপ্ন ভেঙে যায়..কত আশার হাসি মিলিয়ে যায়!
একটুপর বাড়ির ভিতর থেকে শারমিন ভাবী চলে আসে। আজও দেখলাম তাকে সেই প্রথম দিনের দেখার মতো করে। আজও মাথায় ঘোমটা দেওয়া ছিল। কিন্তু কত পার্থক্য। হেমন্ত রোদ আমপাতার ফাঁক দিয়ে আজকেও পড়েছিল তার মুখের উপর। কিন্তু প্রথম দেখার মতো সেই স্নিগ্ধ রূপ আজ নেই। বিষাদমাখা মুখ তার.. ... কেমন শীর্ণকায় ও মলিন হয়ে আছে। তাকে দেখে আমার বুকের ভিতর অস্ফুট কান্না গুমরে ওঠে।
শারমিন ভাবী কিছুটা বিস্ময় কণ্ঠে বলে -- 'দাদাভাই তুমি! আমাদের কথা তোমার মনে আছে?' পরক্ষণে আবার বলে -- 'সেই তুমি এলে! যখন তোমার নাজিম ভাই আর নেই।'
আমাকে বাড়ির ভিতর নিয়ে যায়। ভাবী বলছিল -- আমার এই জীর্ণ পর্ণকুটিরে তোমাকে যে কোথায় কীভাবে বসতে দেই।
তিনি আমাকে একটি দুই হাতলের কাঠের চেয়ারে বসতে দেন। শারমিন ভাবীর কাছে থেকে জানতে পারি নাজিম ভাই পাঁচ মাস আগে হার্ট অ্যাটাক করে বাড়িতেই মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার সময় পায়নি।
শারমিন ভাবীর সাথে অনেক কথা হয়। নাজিম ভাইকে নিয়ে অনেক স্মৃতিকথা বলি। ভাবী বলছিল -- 'তুমি কী তোমার ঘরে লক্ষ্মীমন্ত বউ এনেছ? ' বললাম -- না। এখনও আনিনি। তবে আনব খুব শীঘ্রই। দিন তারিখ ঠিক হয়ে আছে।
-- খুব খুশি হলাম। দেখতে অনেক সুন্দরী নিশ্চয়ই।
-- জ্বী, আপনার মতো মায়াময়ী!
-- আমাকে দেখাবে না?
-- দেখাব বলেই এখানে এসেছি। আমার বিয়েতে আপনি যাবেন।
-- তোমার নাজিম ভাই নেই যে! বরঞ্চ তুমি তোমার বউকে এখানে নিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে নিয়ে
যেও।
তখন বিকেল ঘনিয়ে এসেছে। আমি শারমিন ভাবীকে বললাম -- সন্ধ্যায় একটি ট্রেন আছে। ঐ ট্রেনে আজই ঢাকা চলে যাব।
তিনি কিছুতেই আসতে দিলেন না। বললেন-- কাল সকালে একটি ট্রেন আছে, সেই ট্রেনে তুমি চলে যেও। আমি তার কথা ফেরাতে পারিনি। শারমিন ভাবীর ওখানেই সেদিন থেকে যাই।
তখন সন্ধ্যা আসন্ন। শারমিন ভাবীকে বললাম -- আমি একটু নদীর কূলে বেড়াতে যাব। ভাবী বললেন -- যাও। ঘুরে এস। ভালো লাগবে।
আমি জানি, এই পল্লীগ্রামে শারমিন ভাবীকে সাথে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তাকে বললাম না সাথে যেতে। আমি একাই নদী দেখতে যাই। নদীর কূলে একজায়গায় দেখি, একটি জারুল গাছ। পাতায় পাতায় অসংখ্য নীল রঙের ফুল ফুটে আছে। আমি জারুল তলায় বসে নদীর শান্ত রূপ দেখতে থাকি। সন্ধ্যার হিমেল বাতাস বয়ে আসছিল নদী থেকে। একাকী নীরবে বসে থাকি কিছুক্ষণ। শারমিন ভাবীর কথা মনে পড়ছিল খুব । কেমন জনম দুঃখী সে। এমন মায়াময়ী একটি মেয়ের এত কষ্ট! এত যাতনা। আচ্ছা, কোনো প্রদীপ জ্বলা সন্ধ্যায়–আমার কথা সে কি মনে করবে, আমার তো মনে পড়বে।
নদীর কূল থেকে ফিরে আসি। পথে আসতে আসতে রাত হয়। বাড়িতে এসে দেখি -- শারমিন ভাবী হারিকেন জ্বালিয়ে বাড়ির ফটকে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
ভাবী খুব যত্ন করে রাতের খাবার খাওয়ালেন। পাশের রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। আমি শুয়ে আছি। চোখে ঘুম আসছিল না। নির্ঘুমে কেটে যায় অনেকটা সময়। তারপর ঘুমিয়ে যাই...। তারপর অদ্ভুত একটি বিস্মরণেরও স্বপ্ন দেখি --
শারমিন ভাবী কেমন যেন মাধুর্যের রূপ ধরে কাছে আসে। রাতের আকাশের তারার মতো কারুকার্যময় সেই রূপ! সুতিয়া নদীর মতো স্নিগ্ধ সৌম্য দেহ। অনেক দূর থেকে সে প্রাণের হিল্লোলে কাছে চলে আসছে।
তার পায়ের শব্দ জল কলতানের মতো বাজছে... হঠাৎ সমস্ত পৃথিবী নতুন রঙে রঙীন হয়ে ওঠে। নিভৃত পল্লী কোণে এক জীর্ণ পর্ণকুটিরে একজন মায়াবতীকে দেখছি বিমুগ্ধ হয়ে! কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে! চরাচর জুড়ে অদ্ভুত আলো আঁধার। সেই আলো আঁধারের মাঝে শারমিন ভাবী আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে ...।
আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি কান পেতে থাকি। এ কী সত্যি! আমি শুনতে পাচ্ছিলাম -- পাশের ঘরে শারমিন ভাবী গুমরে গুমরে কাঁদছে।
বাকি সারারাত দুঃস্বপ্নের অনুভব নিয়ে কাটিয়ে দেই। তারপর ভোর হয়।
পরিশিষ্ট --
শারমিন ভাবী আমার কেউ হয়নি। সে ছিল একটা মধুর স্বপ্নের মতো, বেদনার মতো। হঠাৎ কোনো গানের সুরের মতো কানে কানে গান শোনার মতো.. আমার জীবন ছন্নছাড়া হয়নি। একটি লক্ষ্মীমন্ত বউ এনেছি ঘরে। সেই আমার ঘর দুয়ার সাজিয়ে রাখে। সন্ধায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে ধরে ....।
তারপরও মাঝে মাঝে মন কেমন করে ওঠে। এইসব দুঃখ নিয়ে আফসোস করি না। যা পেয়েছি অনেক পেয়েছি। তাই সত্য। তাই পরম পাওয়া। এ যে অসীম। ফুরায় না কখনও। আর, ফুরিয়ে গেলেও তার কাছে থেকেই আবার মুঠো মুঠো করে ভরিয়ে নেই আমার জীবন পাত্র।
১৮. কাশফুল
বইমেলায় প্রথম দিকে ভীড় একটু কম থাকে। ধুলো উড়ে কম। যেখানে ধুলো নেই সেখানে থাকে ঘাস। ঘাসগুলোও সতেজ থাকে। পায়ে পায়ে নুয়ে মিশে যায় না মাটিতে। আমার প্রকাশক অনুরোধ করে বলেছিল, আপনি মাঝে মাঝে মেলায় আসবেন। স্টলের সামনে দাঁড়াবেন। অনেক পাঠক আপনাকে খোঁজে, আপনার অটোগ্রাফ চায়।
সেদিন কোনো ছুটির দিন ছিল না। মেলায় লোক সমাগম খুব কম ছিল । আমি স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তেমন কোনো দর্শনার্থী নেই। দু'একজন করে স্টলের সামনে এসে বইপত্র দেখছিল, নাড়াচাড়া করে দুচার লাইন পড়ছিল। পরিচিত তেমন কেউ আসছে না। একটু বোরিং লাগছিল নিজেকে। ভাবলাম, কফি খেয়ে আসি।
হঠাৎ দেখি -- একটি একুশ বাইশ বছরের তরুণী স্টলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি দূর থেকে দেখছিলাম মেয়েটি আমার বইগুলো পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখছে।
তরুণী সেলসম্যানকে বলছিল -- লেখক সাহেব নেই?
সেলসম্যান ছেলেটি বলে -- আছে।
ছেলেটি আমাকে ডাক দেয়। আমি কাছে চলে যাই। আমাকে দেখিয়ে ছেলেটি তরুণীকে বলে, ইনি হচ্ছেন লেখক।
মেয়েটি আমাকে সালাম দিয়ে বলে -- আমি কী যে খুশি হয়েছি। জানেন, আমি কত যে আপনাকে খুঁজেছি। আজ আপনার দেখা পেলাম।
আমি মেয়েটিকে বলি -- তোমাকে এর আগে কোথাও কী দেখেছিলাম? মেয়েটি বলে -- না মনে হয়। আবার দেখতেও পারেন।
আমি আমাকেই মনে মনে বলছিলাম -- ঠিক এই রকমই দেখতে একটি মেয়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল। সে অনেক বছর আগের কথা। অনেক বছর আগেই সে আমার জীবন থেকে অনেক দূরের হয়ে গিয়েছিল। কী আশ্চর্য ! ঠিক সেই মেয়ের মতো এই মেয়েটির চোখ, ভ্রূ, থুতনি, কপাল, মাথার চুল, কণ্ঠস্বর, হাসি। এত অবিকল চেহারা হয়! আমি বিস্ময়ে এই মেয়েকে দেখেছিলাম আর ফিরে যাচ্ছিলাম, বহু বছর আগের দিনগুলোতে। মনে হচ্ছিল -- সেই মেয়েটি যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়েটি বলছিল, আপনার আগের দুটো বই আমি সংগ্রহ করেছিলাম। আপনার নতুন প্রকাশিত এই গল্পের বইটি আমি আজ সংগ্রহ করলাম। আগের বই দুটোতে আপনার অটোগ্রাফ নিতে পারিনি। কী যে আফসোস করেছি। আজ আর কোনো আফসোস নেই। আপনার অটোগ্রাফ নেব। খুব খুশি লাগছে -- আপনাকে দেখলাম। কী যে ইচ্ছে ছিল, আপনাকে দেখবার! আজ আপনাকে দেখলাম, আমার আর কোনো খেদ নেই।
মেয়েটি বইটি এগিয়ে দিয়ে বলে -- অটোগ্রাফ লিখে দিন। আমি বইটি হাতে নিয়ে মেয়েটিকে বললাম -- তোমার নাম কী ইশিকা? মেয়েটি অবাক হলো ভীষণ! বিস্মিত হয়ে বলছিল -- আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?
আমি বললাম -- মনে হলো তোমার নাম ইশিকা। তাই বললাম।
-- জানেন, এই নামটি রেখেছিল আমার মা। মাকে বলেছিলাম, এই নামের অর্থ কী? মা বলত, জানি না। যিনি আমাকে এই নামটি আমার মেয়ে হলে রাখতে বলেছিল -- সে অনেক দূরে চলে গেছে। তার আর দেখা পাইনা।
ইশিকা আমাকে বলে -- আপনি কী এই নামের অর্থ জানেন?
-- জানি, ইসিকা নামের অর্থ হচ্ছে, শরতের শুভ্র তুলতুলে কাশফুল।
-- জানেন আমার জন্ম হয়েছিল শরৎকালে। আশ্বিনের এক সন্ধ্যায় আমি নাকি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম।
আমি বইটির সাদা পাতায় অটোগ্রাফ লিখি -- "তোমার মেয়ের নাম রেখে দিলাম -- ইশানা। মেয়ে হলে এই নামটি রেখো। "
ইশিকা খুব খুশি হয় -- বলে, এই নামের অর্থ কী ? বললাম -- ইশানা অর্থ -- ঐশ্বর্যময়ী।
আমি ইশিকার লাস্যময়ী মুখখানির ভিতর দেখছিলাম ঠিক বহু বছর আগের এমনই এক বিকালের অন্য একটি মুখকে। বংশী নদীর কূলে আমরা বসেছিলাম -- ওপারে ছিল সারি সারি কাশবন। শুভ্র কাশফুল গুলোকে লাগছিল সাদা গালিচার মতো। নীচে সাদা ফুল ঢেউয়ে দোল খেলছিল, আর পশ্চিম আকাশকে লাল আভার মেঘ ছেয়ে রেখেছিল।
আমি ইশিকাকে বললাম -- তোমার মা কেমন আছেন?
ইশিকা কতক্ষণ চুপ থাকে। তারপর মৃদু কম্পমান স্বরে বলছিল -- মা তো নেই। দু'বছর আগে চলে গেছেন পরপারে।
ইশিকা আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আমি ধীরে ধীরে হেঁটে চলে আসি উদ্যানের বিজয় স্তম্ভের দীঘির পাড়ে। সোপানে একাকী বসে থাকি সারা সন্ধ্যা। রাত্রিও নামছিল ধীরে -- আঁধারে জলের ভিতর দেখছিলাম -- বহুবছর আগের সেই বিস্মৃত মেয়েটির হাতে প্রদীপশিখা জ্বলছে, কী অপার্থিব স্নিগ্ধ নির্মল সেই দীপালোক, এই দীঘির জল কী অপরূপ ধারায় আলোকিত হয়ে উঠেছে।
১৯. তারা বানু
অনেক বছর আগে একবার বিকাল করে ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম। অফিস কর্মদিবসের সেদিন ছিল সপ্তাহের শেষ দিন। অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে মনে হলো আজ বাড়ি যাব। উদ্দেশ্য কিছুই না। মার কথা মনে হয়েছিল। ভাবলাম মাঝখানে একদিন ছুটি আছে, যাই বাড়িতে। মাকে দেখে আসি।
তখন টাংগাইলের ভূয়াপুর থেকে লঞ্চে যমুনা পার হয়ে সিরাজগঞ্জ যেতে হতো। আমি বাসে মহাখালী থেকে প্রথম ভুয়াপুর যাই, তারপর লঞ্চে সিরাজগঞ্জ। শহরে যখন পৌঁছি তখন রাত প্রায় আটটা বেজে যায়। আমাদের বাড়ি শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে। কোনো বাস চলত না তখন। আমি শহরের বাহিরগোলা থেকে একটি রিকশা নেই শালুয়াভিটা খেয়াঘাট পর্যন্ত। এরপর আর রিকশা যায় না।
খেয়াঘাট পর্যন্ত যেতেই বেশ রাত হয়ে যায়। খেয়াপার হয়ে আমি হেঁটে রওনা হই। যেতে হবে আরও তিন মাইল। গ্রামের রাস্তা সন্ধ্যার পর থেকেই জনমানবহীন হয়ে যায়। অনেকটা একাকী হাঁটতে থাকি বাড়ির দিকে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ধূলি সড়ক পথ ধরে।
সাহানগাছা পর্যন্ত যেতেই রাত প্রায় দশটা বেজে যায়। এখান থেকে আরও এক মাইল যেতে হবে মেঠোপথে ফসলের ক্ষেতের ভিতর দিয়ে। নির্জন পাথার পুরো প্রান্তর। কোথাও একটি বাড়িঘর নেই। রাত বিরাতে এই পথ দিয়ে যেতে মানুষ ভয় পায়। মাঝে একটা শ্মশান ঘাটও আছে।
অন্ধকার রাত্রি। ঢাকা থেকে আসার সময় খেয়াল ছিল না এখন কৃষ্ণপক্ষ। আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু আকাশ ছিল তারায় তারায় ভরা। আখ ক্ষেতের ভিতর শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। নিশাচর পাখি ডানা ঝাপটে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে ঝোপে ঝাড়ে। কোথাও একজন মানুষও নেই। শরীরটা ভয়ে কেমন যেন ছমছম করছে। মনে পড়ে গেল -- একবার এমনই এক রাত্রিতে একাকী এই পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম, শ্মশান ঘাট পাড় হওয়ার পরই ঠাকুর বাড়ির উষা চক্রবর্তী আমার পিছু নিয়েছিল। ছোট পাকুড় গাছের তলে আমাকে নিয়ে গিয়ে গলা টিপে মারতে চেয়েছিল। সে যাত্রা দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম। জানি না আজ কী হবে ! কী কপালে আছে। হয়ত সেই পেত্নীটা আজও পাকড়াও করতে পারে।
কিন্তু যেতে তো হবেই। এই রাত্রি নিশীথে পথের উপর বসে থাকতে পারব না। ভয়ে ভয়ে আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে দোয়া দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা থেকে নেমে মরা নদীটা পাড় হলাম। নদীতে তখন হাঁটু পানি। জুতা খুলে হাতে নেই। পানি পেরিয়ে ওপারে উঠি। ব্যাঙ ডাকছে। একটা কাছিম ঝপাং করে ডাঙা থেকে জলে ঝাপ দিল। আৎকে উঠলাম। হাঁটতে থাকি মরা নদীর কূল ধরে মেঠো পথ দিয়ে। জোনাকির আলো জ্বলছে। অদূরে আখ ক্ষেতের পাশে একটি খেক শিয়াল আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। কাছে যেতেই টুপ করে আখ ক্ষেতের ভিতর লুকিয়ে যায় ।
আমি একটু জোরে জোরেই হাঁটছি। সামনেই শ্মশান ঘাট। খুব ভয়ে আছি আজও না জানি ফাঁসিতে মরা সেই উষা চক্রবর্তী আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। হাত পা কেমন যেন হিম হয়ে আসছিল। ডানে বায়ে তাকাচ্ছিলাম না। আবারও দোয়া দরুদ পড়ে সামনের দিকে এগুতে থাকি। এবং ভালো ভাবেই শ্মশান ঘাট পাড় হই।
আরও কিছুদূর যাওয়ার পর নির্জন পাথারের মাঝখানে পিটেসরা গাছটির কাছাকাছি চলে যাই। শুনেছি এই জায়গাটাও খারাপ। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল। বুকের উপর হাত রেখে দেখি ভিতরের আত্মাটা ধকধক করছে। চারদিকে রাতের নিঝুম আঁধার শনশন করছে। অন্ধকারে সামনের দিকে তাকিয়ে পথ চলতে থাকি।
হঠাৎ দেখতে পাই একটি স্ত্রীলোক পিটেসরা গাছটির তলায় মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ মেয়েলোকটিকে দেখে আমার হাত পা অবশ হয়ে যায়। আবার হয়ত উষা চক্রবর্তীর বাগে পড়লাম। আজ আর আমার রক্ষা নেই। মেয়েটি সন্তর্পণে আমার আরও কাছে চলে আসে। আমি পথের উপর দাঁড়িয়ে যাই। আমার পা থরথর করে কাঁপছে। মেয়েটি মাথা থেকে ঘোমটা সরায়। আমি মাটির দিকে মাথা নীচু করে থাকি।
মেয়েটি বলে -- 'তুমি আমার দিকে তাকাও।' কণ্ঠ শুনে মনে হলো এই মেয়ে উষা চক্রবর্তী নয়, অন্য কেউ। আমি মাথা তুলে তাকাচ্ছিলাম না। মেয়েটি আবার বলে-- তুমি ভয় পেওনা। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। তুমি আমারই গায়ের ছেলে। আমি জানি, তুমি অনেক ভালো ছেলে।
আমি ওনার অভয় পেয়ে আস্তে করে চোখ তুলে আঁধারের মাঝে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাই। কিন্তু মুখ দেখে চিনতে পারলাম না উনি কে? তবে মুখটি দেখে খুব অস্পষ্ট করে অনেক আগের একটি মুখের কথা মনে পড়ল। মনে হলো হয়ত সেই মেয়েটাই হবে। তারপরও বললাম -- আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।
মেয়েটি বলল -- সে তুমি এত বছর পর আমাকে চিনতে পারবে না। তুমি যখন আমাকে শেষ দেখেছিলে তখন তুমি নিতান্তই একটি কিশোর বালক ছিলে। আমি খুব বেশি তোমাদের বাড়িতে যেতাম না। আমি আমার নামটি বলি, দেখ তো মনে পড়ে কী না?
মেয়েটি কম্পিত কণ্ঠে বলে -- আমি তারা বানু।
আমি একটু ভয় পেলাম। হঠাৎ আৎকেও উঠলাম। আমি বললাম -- মনে পড়ছে আপনার কথা। সে তো অনেক বছর আগে তুমি মরে গেছ।
তারাবানু আমার কথা শুনে একটি বিদ্রুপের অট্টহাসি দিল। সেই হাসির শব্দ সেদিনের সেই নির্জন প্রান্তর ও আঁধারের আকাশ একধরনের ঘৃণার প্রকম্পে অনুরণন হতে লাগল। সে বলে -- আমি মরে গেছি? হা-হা, সত্যি কী আমি মরে গেছি! তুমি মনে করে দেখ তো, আমি কী অভাবে কিংবা রোগে, শোকে, দুঃখে মরে গিয়েছিলাম ?
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম --
সে এক অস্থির সময়ের কথা। আমার তখন কিশোর বয়স। আমাদের গ্রামের একটি গরীব মেয়ে অভাবের তাড়নায় পয়সার বিনিময়ে নাকি নিজের দেহ দান করত। একদিন সন্ধ্যারাতে জানতে পারলাম, ঐ মেয়েটিকে আজ রাতেই মেরে ফেলবে, গ্রামেরই কিছু যুবক শ্রেণীর মানুষ। মেয়েটির অপরাধ, সে ছেলেদের চরিত্র নষ্ট করে ফেলছে।
খবরটি শোনার পর মনটা ভালো লাগছিল না। কেমন যেন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমি নিতান্তই একজন কিশোর বালক ছিলাম, কী-ই-বা আমি করতে পারি? মেয়েটি যেহেতু আমার গ্রামেরই, তাই ওকে দেখেছিও অনেক। মেয়েটার মুখচ্ছবি কেবল চোখে ভেসে উঠছিল। অনেক অজানা আশংকা ও ভয় নিয়ে সে রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
সকালবেলা লোকমুখে জানতে পারি -- মেয়েটিকে রাতের প্রথম প্রহরে ওদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে নেয়।পরে দূরে নির্জন নদীর কূলে একটি পিটেসরা গাছের তলায় নিয়ে যায়। সেখানে প্রথমে সবগুলো যুবক পালাক্রমে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে এবং পরে চোখ বেঁধে বেওনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে এবং ঐ পিটেসরা গাছটির তলায় গর্ত খুরে মাটির নীচে ওকে পুতে রাখে।
ধর্ষণ শেষে ওরা যখন মেয়েটির চোখ বাঁধবে, তখন নাকি মেয়েটি অনুনয় করে বলেছিল- 'তোমরা শেষবারের মতো একটিবার আমাকে এই পৃথিবীকে দেখতে দাও।'
মেয়েটি অন্ধকারের মাঝেই চোখ মেলে দেখেছিল চারদিকের রাতের পৃথিবীকে, দেখেছিল তারাভরা আকাশকে। দেখেছিল অদূরে আঁধারের ছায়ায় তার কুসুমপুর গ্রামকে। আমার মনে পড়ছে, ঐ মেয়েটির নাম ছিল তারা বানু।
**** **** ****
তারাবানু বলছিল -- জানো রঞ্জন, আমি রাত হলেই ঘুরে বেড়াই আমাদের সারা গ্রাম। দেখতে যাই আমাদের ছনের পাতার জীর্ণ বাড়িটা। আমার গরীব মা বাবা রোগে শোকে দুঃখে অনাহারে মারা গেছে। আমার ছোট ভাইটা অনেক কেঁদে কেঁদে না খেয়ে শীর্ণকায় হয়ে বড়ো হয়েছে। দেখেছি ভাইটা ভালো নেই। ছায়া ঢাকা আমার এই গ্রামে বেঁচে থাকার কত সাধ ছিল। গায়ের কিছু ছেলে যাদের আমি স্নেহ করতাম, তারাই আমাকে বাঁচতে দিল না।
তারাবানু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। এবং আমাকে বলে -- তুমি চলে যাও।
আমি তারা বানুকে পিছনে রেখে সামনের দিকে হেঁটে চলে আসতে থাকি। পথ চলতেই শুনতে পেলাম তারা বানু গুমরে গুমরে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ শুনে মনটা মুহূর্তে খুব খারাপ হয়ে গেল। হাঁটা বন্ধ করে পথের উপর থেমে যাই। খুব দেখতে ইচ্ছে হলো তারা বানুকে। আমি পিছনে ঘুরে দাঁড়াই। দেখি -- তারা বানু নেই। শুধু তার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
২০. একটি রুমালের আত্মকথা
শেষ পর্যন্ত চাকুরি একটি পেলাম। পোস্টিং - চট্টগ্রামের এক পার্বত্য থানা শহরে। কালই এই শহর ছেড়ে চলে যাব। পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি গলিতে মেসের জীবনের অবসান হবে কাল থেকে।
চাকুরি পেয়ে মনটা খুশি লাগছে না। একটা আফসোস বোধ, আর একটি হারানোর বেদনা মনটাকে বড়ই বিষাদাচ্ছন্ন করে রেখেছে। কেমন যেন হাহাকার লাগছে। ভাবছিলাম - এই শহরের এই শেষ বিকালটা কোথাও যেয়ে একাকী বসে থাকি।
আমি তো একাকী মানুষ। যেখানেই যাই না কেন সেখানেই চির একা। তাই একাকীই বের হলাম।
চানখার পুলের মোড় থেকে একটি রিকশা নিয়ে চলে যাই পার্কে। লেকের পাড়ে একটি কংক্রিটের বেঞ্চ আছে। ওয়াক ওয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাই বেঞ্চটির কাছে। বেঞ্চটি খালি। চৈত্রের দুপুরের রোদে তপ্ত হয়েছিল আগেই। দেখলাম -- তখনও বেঞ্চটি তপ্তই আছে। কড়োই গাছের ঝরা পাতা বেঞ্চের উপর পড়ে আছে। আমি ঝরা পাতার উপর বসে পড়ি। লেকের জলের দিকে তাকাই। পানিপোকা জলের উপর দৌড়াদৌড়ি করছিল।
অদূরে চেয়ে দেখি -- এক জোড়া নবীন প্রেমিক প্রেমিকা ঘাসের উপর বসে আছে। দুইজন দুইদিকে মুখ ফিরে আছে। কোনো কথা নেই তাদের। হয়ত সব কথা বলা শেষ হয়ে গেছে। হয়ত বা কোনও অভিমানে তারা মুখ ফিরিয়ে বসে আছে।
আজ থেকে ছয়মাস আগে এক আশ্বিনের বিকালে
ঠিক এখানে এই বেঞ্চের উপর বসে শর্মিলী আমার সাথে অভিমান করেছিল। নাহ্, ঘাসের উপর বসে থাকা ঐ দুটি ছেলেমেয়ের মতো আমরা মুখ ফিরিয়ে বসে ছিলাম না। শর্মিলী চির অভিমানে সেদিন চলে গিয়েছিল। যাবার বেলায় আমার দিকে একটিবারও ফিরে তাকায়নি।
শর্মিলীকে আমি ডাকতাম মিলি বলে। সে আমার সহপাঠী বন্ধু ছিল। বড়ো লোকের মেয়ে। আমরা বন্ধু থেকে কখন প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে উঠেছিলাম, সেই দিনক্ষণ কেউই নির্দিষ্ট করে মনে রাখতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাস, এই শহরের কত অলিগলি রাজপথ, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, নদীর কূলে আমরা চুটিয়ে প্রেম করে বেড়িয়েছি। সে এক বাঁধ ভাঙা জলের মতো কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রেম। বর্ষার সারারাত্রির বৃষ্টির মতো, তপ্ত রোদ্দুরেরর মতো, পাগল কাড়া জোছনার মতো আমরা ভিজেছি, পুড়েছি, জ্বলেছি।
এই পার্কেও আমরা অনেকবার এসেছি। এই বেঞ্চে উপর বসে থেকে কত স্বপ্নের কথা বলেছি। অভিমান করে ঐ নতুন তরুণ তরুণীর মতো আমরাও মুখ ঘুরে বসে থেকেছি কত। কথা বলতে বলতে কথা শেষ হয়ে গেলে চুপচাপ কেটে গেছে কত সময়।
কিন্তু সেদিনের সেই আশ্বিনের বিকালটা চির বিচ্ছেদের ক্ষণ হয়ে থাকল। অভিমানটা চিরকালের হয়ে গেল। মিলি বলেছিল -- "বাবা মা তোমার সাথে আমার বিয়ে দেবে না। তোমার চাকুরি নেই। বেকার। টিউশনি করো। এমন ছেলের সাথে আমাকে তারা বিয়ে দিতে রাজি নয়। তারচেয়ে চলো আমরা একাকী কোর্টে যেয়ে বিয়ে করে ফেলি।"
আমি না বলেছিলাম। আরও অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। মিলিকে বলেছিলাম -- 'একটি চাকরি পেয়ে নেই। তারপর বিয়ে করব।'
মিলির বাবা মা পাত্র ঠিক করে রেখেছিল। মিলির পক্ষে সম্ভব ছিল না বাবা মাকে ফেরানো।
সেদিন আমি বুঝতে পারিনি কী বড়ো একটি বস্তু আমি হারাতে বসেছি। কী অসীম মূল্য ছিল তার। যা পেতাম সাগরের জলের মতো সুলোভে। সেই কী না হয়ে গেল দূর্লভ। পরে তা আমি কোনও দাম দিয়ে আর কিনে নিতে পারিনি।
আমি দেখছিলাম মিলি অঝোর ধারায় কাঁদছে। এত চোখের জল এর আগে কারোর চোখ থেকে ঝরতে দেখিনি। আমি আমার পকেট থেকে শুভ্র একটি রুমাল বের করে মুছে দিচ্ছিলাম ওর চোখের জল। একবার মুছে ফেলি। দেখি আবার ঝরছে। আবার মুছে ফেলি। আবার ঝরে পড়ছে। অশ্রুধারা এমন অনবরত প্রবাহমান হয়! সত্যি বিস্ময়কর! আমি স্তব্ধ চোখে তা চেয়ে দেখছিলাম শুধু ।
মিলি আর কোনও কথা বলল না। চোখের জল ঝরাতে ঝরাতে চলে গেল। একবারও ফিরে তাকল না। পরে শুনেছি, মিলি আর একজনের বউ হয়েছে। এই শহরেই সে থাকে। ওর সাথে আর দেখা হয়নি কোনদিন কোথাও।
উত্তর চট্টগ্রামের থানা শহর ফটিকছড়িতে একটি এনজিও অফিসে আমার পোস্টিং হয়। প্রিয় ঢাকা শহর ছেড়ে চলে এসেছি এখানে। সেও কয়েকদিন হয়ে গেল।
আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয় ছোট্ট একটি নদীর তীরে একটি কাঠের বাড়িতে। অফিস থেকে বেশি দূরে নয় বাড়িটি। দুটো রুম ওখানে। একটি রুম বড়ো। আর একটি রুম ছোট। ছোট রুমটিতে আগে থেকেই পিওন মোমিন আলী থাকে। বড়ো রুমটিতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
পুরনো ঢাকায় একটি ঘিঞ্জি গলিতে থাকতাম। কী কোলাহল ছিল সেখানে। কত মানুষ দেখতাম! কত হৈহল্লা হতো! কত চিৎকার চেচামেচি। ফেরিওয়ালার হাঁকঢাক। রিকশার বেলের শব্দ। কুকুরের ঘেউঘেউ। এখানে এইসবের কিছু নেই। কেন যেন মনে হতে লাগল শহরের ঐ কোলাহলই ভালো ছিল। প্রচণ্ড শব্দ তরঙ্গ আমার মনকে ভুলিয়ে দিতে পারত অনেক দুঃখ বেদনা আর গ্লানিকে।
অফিসে যতক্ষণ থাকতাম ততক্ষণ মোটামুটি ভালোই লাগত। সময় বয়ে যেত কর্ম ব্যস্ততায়। বিকালে যখন ঘরে ফিরতাম তখন থেকেই নিঃসঙ্গতা ধেয়ে আসত আমার দিকে। যখন সন্ধ্যা নামত তখন থেকেই মনে হতো এই ঘর, এই নদীর তীর, এই বনবিহার সব যেন প্রাগৈতিহাসিক এক ভূতুরে রাজ্য ।
প্রায়ই সন্ধ্যায় মোমিন আলীকে ডেকে কাছে বসিয়ে রাখতাম, অকারণে ওর সাথে গল্প গুজব করতাম অনেক রাত পর্যন্ত। তারপর শোবার আগে দেখতাম তারার আকাশ। আঁধার অরণ্যানী। রাতের শব্দে কুলু কুলু করে বয়ে যেত নদীর জলধারা।
আমার কাছে শর্মিলীর কোনও অভিজ্ঞান বা কোনও স্মৃতি চিহ্ন বা বস্তু নেই যে, তাই নিয়ে সময় কাটাব। ওর সাথে আমার কোনও চিঠিপত্র আদান প্রদান হতো না। তাই পুরনো কোনও চিঠি পড়ে সময় কাটাব। এই নির্জন জনমানবহীন কোলাহলহীন নদীর কূলে এই বাড়িতে মিলির সমস্ত মধুময় স্মৃতিগুলো আমার মন মাঝে আক্রমণ করতে থাকে।
রাত হলেই ওর চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ শুনতে পাই। ওর পায়ের শব্দ কানে বাজে। ওর নিঃশ্বাস আমার ললাটে এসে পড়ে। যেদিন পার্কে লেকের ধারে ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয়, নীরব শব্দহীন করে ও যে কেঁদেছিল, সেই কান্না আমি গুমরি গুমরি শব্দের মতো শুনতে পাই। অনেক রাত পর্যন্ত আমার ঘুুম আসে না। কী যে অন্তর দাহ হয়!
একদিন কেন জানি বিকাল থেকেই শরীরটা অবশ লাগছিল। পা চলতে চাইছিল না পথ চলতে। সন্ধার পরই মোমিন আলীকে বলি -- আমাকে খেতে দাও। আমার কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে। মোমিন আলী আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করে। আমি খেয়ে শুয়ে পড়ি। এবং ঘুমিয়ে যাই।
মাঝরাতে কীসের একটি শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখি -- জানালার পাল্লাগুলো নড়ছে। অথচ বাইরে কোনও ঝড়ও নেই, বাতাসও নেই। আমি কক্ষে আলো জ্বালাই। তখনও জানালার পাল্লা দুলছে। আমি মোমিন আলীকে ডাকি। ও শুনল না। আমি জানি মোমিন ঘুমকাতুরে ছেলে। ও হয়ত নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে৷
আমি আস্তে আস্তে জানালার কাছে যাই। জানালার কাছে যেতেই শব্দটা আর শোনা গেল না। জানালা খুলে চেয়ে দেখি -- বাইরে অপূর্ব জোছনার রাত। হারুয়ালছড়ির নদীর জল সোনালি রঙে রঙিন হয়ে আছে। নিভৃত নদীর কূল তাকিয়ে দেখছিলাম, আর দেখছিলাম আরেকপাশের অরণ্য পথ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখি -- একটি মেয়ে সাদা শাড়ি পরে হেঁটে হেঁটে বনের দিকে চলে যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় দেখছিলাম সেই মেয়ের পিছন রূপ। এই যেন সেই শর্মিলী আমার। তেমনই উচ্চতা, তেমনই দেহ, তেমনই হাঁটার ধরণ তার।
সকালবেলা মোমিন আলীকে বলি -- রাতে কে যেন এসেছিল জানালার ওপাশে। সে এক রমণী। আমার এক পরিচিতার মতো দেখতে । একাকী বনের গভীরে সে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। জোছনার বন্যায় মিলিয়ে গেল বন অভ্যন্তরে। মোমিন আলী আমার এই কথা শুনে বলছিল - এইসব কিছু না স্যার। এ আপনার মনের ভ্রম! এখানে কোনও ভূত প্রেত নেই।
আর একদিনের কথা, সেদিন ছিল ছুটির দিন। বিকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সন্ধার পর থেকে তা মুষলধারে নামতে থাকে। মোমিন আলী নেই। ও চলে গেছে রাঙ্গুনিয়ায় ওদের গ্রামের বাড়িতে। আমি খেয়েদেয়ে আগে আগেই শুয়ে পড়ি। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিল।
শুয়ে আছি। মনে হলো আমার সারা শরীর হিম হয়ে আসছে। বুক ধড়পড় করছে। হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। দুচোখ ঘুমে মুদে আসছিল। একটুপর গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আজও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। কান পেতে শুনি -- বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে দমকা বাতাস। ঘরের জানালার কপাট নড়ছে। কিন্তু জানালা বন্ধ। আমি উঠে বসি। শোয়ার সময় ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছিলাম না। ইচ্ছে করেই জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। জানালার পাল্লা নড়ার শব্দটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা!
আমি জড়সড় হয়ে বসে আছি। হঠাৎ বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাই। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দও কানে আসছিল। ঠিক সেদিনের সেই মেয়ের মতো কারোর পায়ের শব্দ। এর পরপরই দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাই। আমি দরজার কাছে এগিয়ে যেয়ে বলি -- কে তুমি? দরজার ওপাশ থেকে উত্তর আসে -- আমি শর্মিলী।
আমি ভয় পেলাম না। চিত্ত আমার উৎফুল্ল হয়ে উঠল। মনে মনে ভাবলাম -- আমার হারিয়ে যাওয়া মহামূল্যের সেই নীলকান্তমণি আমারই দরজায় এসে কড়া নাড়ছে।
আমি দরজা খুলে দেই। দেখি -- বাইরে সত্যি সত্যি শর্মিলী দাঁড়িয়ে আছে।
শর্মিলীর পরনের শাড়ি ভিজে চুপসে গেছে। আমি মিলিকে বলি -- 'এত রাতে তুমি এখানে! ' আমার কোনও কিছু বলার আগেই মিলি আমার বিছানার উপর এসে বসে।
আমি ওকে বলি -- তুমি কাপড় চেঞ্জ করে নাও। মিলি বলে -- না।
আমি বললাম -- ঠাণ্ডা লাগবে তো।
-- লাগুক। আমি দেরি করব না। আমি এখনই চলে যাব।
-- তুমি থাকবে না?
-- না। আমি তো একসময় তোমার ঘরেই আসতে চেয়েছিলাম। তুমি আনো নি।
-- আমি এজন্য খুব অনুতপ্ত। তোমাকে হারানোর ব্যথা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি।
-- হ্যাঁ, তুমি বয়ে বেড়াচ্ছ আমি জানি। আর আমি তোমার সেই ব্যথা সারিয়ে দেয়ার জন্যই এই বৃষ্টির রাতে ভিজতে ভিজতে তোমার কাছে চলে এসেছি।
আমি মিলিকে বললাম -- তুমি আমার কাছে আমার ঘরে থেকে গেলেই আমার ব্যথা সারবে।
-- না। আমি থাকতে আসিনি। তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াও।
আমি ওর সামনে মুখোমুখি দাঁড়াই। মিলি আমার টি-সার্টের পকেট থেকে একটি সাদা রুমাল বের করে বলে -- এই রুমালে আমার চোখের জলে ভিজে আছে। আমার চোখ, মুখ, গাল ও পুরো মুখ মণ্ডলের স্পর্শ এই রুমালে লেগে আছে। তুমি জ্ঞানে অজ্ঞানে এই রুমাল থেকে আমার শরীরের স্পর্শ অনুভব করো। গোপনে কেঁদে কেঁদে তুমিও তোমার চোখের জল মুছে ফেল এই রুমাল দিয়ে। জানো -- আমার খুব কষ্ট হয় এই জন্য। অনেক দূর থেকে আমি তা অনুভব করি। এই অভিশপ্ত রুমালটি তুমি আর তোমার বুক পকেটে রেখ না। তুমিও এজন্য কষ্ট পাও। আমিও পাই। এ যে অভিশপ্ত এক অভিজ্ঞান। এটা রাখতে নেই। তুমি তোমার কেচিখানি দাও। আসো-- আমরা দুজনে মিলে এই রুমালটি কুচিকুচি করে কেটে ফেলি।
আমি আর মিলি সেইরাতে রুমালটি কুচিকুচি করে কেটে ফেলি। বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। যেন অনেকদিন আগের এক আশ্বিনের বিকালে রমনা পার্কের মিলির সেই গুমরে গুমরে কান্নার শব্দের মতো সেই বৃষ্টি।
সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি -- শর্মিলী নেই। টি-শার্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখি --যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা রুমালটিও নেই । দরজার দিকে চেয়ে দেখি -- দরজা খোলা। আমি বাইরে চলে আসি। তখন উজ্জ্বল ভোর। সূর্য উঠি উঠি। বৃষ্টি থেমে গেছে। মনটা উদাস লাগছিল। মনটা ভগ্নও হলো -- মূল্যবান কিছু পেয়ে আবার হারিয়ে ফেললাম। আমি হেঁটে হেঁটে নদীর কূলে চলে যাই -- জলের দিকে চেয়ে দেখি, রুমালের টুকরোগুলো নদীর জলে ভাসছে ।
২১. বিগলিত জোছনা
একটি ব্যবসায়িক কাজ সেরে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে ঢাকা ফিরছিলাম । আখাউড়া জংশনে এসে ট্রেনটি যে থেমে রইল, ঢাকার দিকে আর আসছিল না। জানা গেল ভৈরব ব্রিজের কাছে লাইনের রিপিয়ারিং-এর কাজ চলছে। ট্রেন ছাড়তে এক-দুই ঘণ্টা দেরি হবে।
আমি কামরা থেকে নেমে প্লাটফর্মের উপর হাঁটতে থাকি এলমেল। একসময় হেঁটে পূর্ব দিকে শেষ মাথা পর্যন্ত চলে যাই। সেখানে একটি টং চার দোকান দেখতে পাই। কাঠের বেঞ্চটা খালি। কেউ নেই। আমি ওখানে বসে চা খেতে থাকি। চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরাই। ঠিক তখনই একটি লোক এসে বেঞ্চে বসে। সেও চার অর্ডার দেয়। লোকটি আমাকেও চা অফার করে। আমি বলি, খেয়েছি। ধন্যবাদ।
লোকটিও সিগারেট খায়। আমাকেও সিগারেট অফার করে। আমি এবার সিগারেট নেই। যদিও একটু আগে একটি খেয়ে শেষ করেছি। সিগারেট পরপর তিন-চারটা স্টিক পর্যন্ত খাওয়া যায়। এইরকম এর আগে বহু খেয়েছি।
লোকটা আগ বাড়িয়ে একটু বেশি কথাই বলছিল। সে বলছিল -- আপনার বাড়ি কোথায়? কী করেন? বললাম -- ময়মনসিংহের গৌরিপুর। ব্যবসা করি। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করেনি ওনার বাড়ি কোথায়? তবুও জেনেছিলাম -- ওনার বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন।
আমাকে বলছিল -- আপনি বিয়ে করেছেন কোথায়? বললাম -- ময়মনসিংহ শহরে। বলছিল -- আপনার স্ত্রীর নাম কী? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম -- আফসানা মরিয়ম।
লোকটার সাথে প্রায় আধাঘন্টা এলমেল বিভিন্ন কথা হয়। ইতোমধ্যে ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। হয়তো লাইনের রিপিয়ারিং কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি লোকটিকে বললাম -- আপনি কোথায় নামবেন?
উনি বললেন -- ভৈরব জংশন ।
প্লাটফর্মের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উনি যে কথাটি বললেন -- আপনার সাথে হয়তো আর দেখা হবে না। আমি থাকি-- অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সিটিতে। এদেশে আর কখনও আসব না। বাবা-মার কবর জিয়ারত করতে এসেছিলাম। বাকী জীবনকাল ওখানেই ঐ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ইয়ারা নদীর পাড়ে নির্জন কুটিরে কাটিয়ে দেব।
আমি বললাম -- আপনি তো বিয়ে করেননি এখনও। কোনও বন্ধন নেই আপনার। যখন তখন এ দেশে আসতে পারেন তো ।
-- নাহ্, আসব না আর।
যাবার বেলায় উনি আমাকে একটি অনুরোধ করলেন। বললেন -- আপনি একবার হলেও আপনার স্ত্রীকে নিয়ে কোন শীত মৌসুমে সিলেটের জাফলং এ বেড়াতে যাবেন। ওখানে পিয়াইন নদীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথর, বালি আর নুড়ির উপর দিয়ে হাঁটবেন। দেখবেন পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলধারা। কী অদ্ভুত রূপালী রং তার ! যদি আপনার স্ত্রী পা ফসকে পড়ে যায়, আপনি ওনার হাতটি ধরবেন। আর সময়টা যেন হয় পূর্ণিমা তিথি। রাতের নিরিবিলিতে দেখতে পাবেন সেখানে -- দূরে পাহাড়ের গায়ে অপরূপ চাঁদের আলোর বন্যা বইছে। শুনবেন কান পেতে -- পাহাড় আর রাত্রি কীভাবে কথা বলে। রাতের নির্জনতায় আরও শুনবেন ঝর্নার জলপতনের শব্দ! আপনি একা শুনবেন না, আপনার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে শুনবেন। বুঝতে পারবেন -- এমন একটি রাত পেলে সারা জীবনকালে আর কোনকিছু পেতে ইচ্ছে করবে না। মানুষের জীবনে কিছু আনন্দময় ক্ষণ আসে, তা ক্ষুদ্র সময়ের জন্য হলেও সারাজীবনকাল চিত্তকে সেই মধুক্ষণ রোমন্থন করে সুখ-আনন্দে ভরে রাখা যায়।
এবার কেন জানি ভদ্রলোকটি সম্বন্ধে আরও বেশি
কিছু জানতে ইচ্ছে করলো, কিন্তু হাতে সময় ছিল না। উনি দ্রুত হেঁটে গিয়ে ওনার কামরায় গিয়ে উঠে পড়লেন। শেষ মুহূর্তে শুধু ওনার নামটি জেনেছিলাম -- মনজুর হোসেন খোকন।
বছরখানেক পর ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে আমাকে সিলেট যেতে হয়। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম- আমার সাথে সিলেট যেতে। ও প্রথমে রাজি হলো না। পরে আমার অনুরোধে রাজি হয়। তখন ছিল পৌষের শীতের সময়। পঞ্জিকা খুলে দেখলাম চাঁদের শুক্ল পক্ষ। ত্রয়োদশী হবে। আমরা রাতের ট্রেনে সিলেট চলে যাই। ঢাকা থেকেই হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। সিলেট শহরে একরাত থাকি। ব্যাবসায়িক কাজ সেরে পরের দিন জাফলং চলে যাই। সিলেটে আমার ব্যবসায়িক বন্ধু আগে থেকেই গোয়াইনঘাটের তামাবিলে যাবার জন্য একটি গাড়ি ও ডাকবাংলোতে থাকার জন্য রুম ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
ভোরেই আমাদের গাড়িটি সিলেট শহর থেকে জাফলং-এর উদ্দেশ্যে বের হয়। পথের ধারে বন-বনানী ও অজস্র বৃক্ষের সমারোহ। রাস্তাটি উঁচুনিচু টিলা ও ছোট ছোট পাহাড়ি ঢালু ধরনের। খুব ভালো লাগছিল জার্নিটা। অনেক দিন পর মনে হলো আমরা দুজন নতুন করে মধুচন্দ্রিমায় ছুটেছি। গাড়ির চালক একটি গান ছেড়েছে --
গীতিময় সেইদিন চিরদিন বুঝি আর হলো না
মরমে রাঙ্গা পাখি উড়ে সে গেলো নাকি
সে কথা জানা হলো না।
আমরা দুপুরের অনেক আগেই ডাকবাংলোতে যেয়ে পৌঁছি। বাংলাটি উঁচু একটি টিলার উপর অবস্থিত। বাংলো থেকে ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তা পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়ের গায়ে থেকে ঝর্নার জল গড়িয়ে পড়ছে। নীচে নদীটা অবশ্য দেখা যাচ্ছিল না। আমার সকল আকুতি এই নদীটি ঘিরে। কখন দেখব ওকে! কখন দেখব ওর রুপোলী জল!
ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে। আমি ওনাকে বললাম, আমরা একরাতই এখানে থাকব। এখানেই খাব। আপনি সেইভাবেই সব ব্যবস্থা করবেন।
পড়ন্ত বিকালে আমরা পিয়াইন নদীর তীরে চলে যাই। আফসানা একটি নীল রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি পরে। ম্যাচিং করে কপালের টিপ, পাথর বসানো দুল, হাতের চুড়ি, গলার মালা, চুলের ক্লীপ, নীল জুতো, লিপস্টিক ও নোখে নেইলপালিশ পরে। কী যে অপরূপ লাগছিল ওকে। হেনকালে যদি চণ্ডীদাসের দেখা মিলতো, তবে নতুন করে তিনি পদ লিখতেন -- চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরান সহিতে মোর।
এর আগে কত মধুময় ক্ষণে কত দেখেছি ওকে, কিন্তু আজকের এই পিয়াইন নদীর তীরে ওকে এমন রূপে দেখব, তা ভাবিনি কখনও। ও যেন হেম-কান্তি ও নীলকান্তিতে আচ্ছাদিত এক মনময়ূরী! খোঁপায় নীল অপরাজিতার গুচ্ছ, আধ-কপালের চন্দনবিন্দুতে আফসান মিশানো! গলায় খাসিয়া এক মেয়ের কাছে থেকে নিয়ে পরেছে বনফুলের মালা। এ যেন চিরপিপাসিত কোনও প্রকৃতি-পুরুষের সাথে তার আনন্দময় মিলন হবে আজ।
আমরা ধীরে ধীরে হেঁটে নদীর পাথুরে চরের দিকে চলে যাই। সিলিকন বালির সাথে হাজার হাজার ছোট বড় বিভিন্ন রঙিন পাথরে ভরে আছে। পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জল! আফসানা জুতো খুলে ব্যাগে রাখে। আমার জুতোও খুলে ফেলি। পাথর, বালি ও নুড়ির উপর দিয়ে, জলে পা ভিজিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। হাঁটার সময় হঠাৎ পা ফসকে আফসানা পাথরের উপর পড়ে যায়। আমি খেয়াল করিনি। আমাকে অবশ্য খোকন সাহেব সতর্ক করে দিয়েছিল ওর হাতটি ধরে রাখতে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম হাতটি ধরতে ।
আফসানা পায়ে বেশ ব্যথা পায়। আমি ওর হাতটি ধরি। ও খুব মনখারাপ করে বলছিল -- ভেবেছিলাম, তুমি আমার হাত ধরে থাকবে ! তা ধরে রাখনি। তুমি এমনই উদাসীন আমার উপর! অন্য কেউ হলে ঠিকই আমার হাত ধরে রাখতো।
আমি আফসানার হাত ধরে আস্তে আস্তে নদীর পাড়ে উঠে আসি। পিয়াইন নদীতে আর বেড়ানো হলো না। আমরা ডাকবাংলোয় ফিরে আসি।
আফসানা পায়ে বেশ ভালোই ব্যথা পেয়েছিল। বাংলোর কেয়ারটেকার আমির আলীকে দিয়ে ফার্মেসী থেকে অয়েন্টমেন্ট ও ব্যথার ঔষধ আনিয়ে নেই। সারা বিকাল ও সন্ধ্যায় কোথাও আর যাওয়া হলো না। বাংলোতেই সন্ধ্যা নামে। এবং রাত হয়। পিছনে সুপারি ও নারিকেল গাছে অজস্র বাদুড়ের কিচির মিচির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অদূরে খাসিয়া পুঞ্জিতে মিটমিট করে জ্বলে থাকা আলোগুলো একে একে একসময় নিভে যায়।
আমির আলী আমাদের রাতের খাবার খাওয়ায়ে চলে যায় বাংলোর পিছনে ওর থাকার ঘরটিতে। যাবার সময় বারান্দায় দুটো চেয়ার পেতে রেখে যায় এবং বলে যায় -- আপনারা যদি রাতে এখানে বসতে চান তবে বসতে পারবেন।
সন্ধ্যার পর থেকে দুজন খাটের উপরই শুয়ে বসে ছিলাম। একসময় রাত অনেক হয়ে যায়। চোখে কারোরই ঘুম আসছিল না। আফসানা কেমন চুপচাপ ছিল । তেমন কোনও কথা বলছিল না। আমি ওকে বলি-- চলো একটু বাইরে যাই। বাইরের রাত দেখি। আফসানা বললো - চলো।
আমি আফসানাকে পাজরে জড়িয়ে নিয়ে বারান্দায় চলে যাই। দরজা খুলেই দূরে দেখতে পাই পাহাড়ের উপর প্রকাণ্ড একটি চাঁদ উঠেছে। এমন রাক্ষুসে চাঁদ এর আগে কখনও দেখিনি। কমলা রঙের জোছনায় ভেসে গেছে পাহাড়ের শরীর, গাছগাছালি ও বনবৃক্ষ। বিগলিত জোছনার রোশনি আমাদের চোখে মুখে এসে লাগে। হঠাৎ কেমন এক অদ্ভুত জগৎ তৈরি হলো। নিস্তব্ধতার ভিতর ঝর্নার জলপতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। জলের শব্দ, রাতের শব্দ, আঁধারের শব্দ, জোছনার ধারা -- সব মিলে এক মায়াবী আবেশে ভরে উঠলো মন। তখন পাহাড় আর আকাশ পেরিয়ে ম্লান লালিমা মুছে গেছে আধো অন্ধকারে। সব লালিমা বিস্তৃত কালো রঙা গালিচা হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
আফসানা বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। ও কেমন যেন আরও চুপ হয়ে গেল। আমার মতো বিস্ময় ওর ভিতর নেই। মনে হলো এইরকম বিস্ময়কর দৃশ্য এর আগে ও দেখেছে। আমি আফসানাকে ডাকি- এই। ও বলে-- জী, বলো।
-- এই চাঁদ এই জোছনা, দূরের ঐ পাহাড় ও নক্ষত্ররাজি তোমার ভালো লাগছে না?
-- ভালো লাগছে।
-- তবে এমন মনখারাপ করে আছো কেন?
-- কই না তো!
আফসানা আমাকে বলে -- আমি কী তোমার কাঁধের উপর একটু মাথা রাখতে পারি?
বললাম -- রাখো।
আফসানা আমার কাঁধের উপর ওর মাথা রাখে। এবং বলে -- আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
বললাম -- কেন?
আফসানা ওর একটি হাত আমার হাতটিকে শক্ত করে ধরে বলে -- এমন রাত, এমন জোছনা, এমন আলো আঁধার যদি চিরকালের জন্য চির আঁধার হয়ে যায়! যদি তোমাকেও আমি হারিয়ে ফেলি?
দেখি-- আফসানা কাঁদছে। বললাম -- কেন এমন ভয় তোমার? কেন তুমি কাঁদছ?
আফসানা বলে -- আজ এই রাতের নির্জনতার সামনে বসে -- তোমাকে কোনও মিথ্যা বলতে পারব না৷ আজ থেকে নয় বছর আগে একটি উন্মূল তরুণ এই জায়গায় এমনই পাহাড়ের পাদদেশে, এমনই চাঁদের রাতে আমাকে বলেছিল -- আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তাকে আমি প্রত্যাখান করেছিলাম। ছেলেটি আমার সহপাঠী ছিল। ভালো গান গাইতো। গানও লিখতো। সুরও দিতো। ছেলেটির নাম ছিল মনজুর হোসেন খোকন। সেইবার ময়মনসিংহ আমাদের কলেজ থেকে একদল ছাত্র ছাত্রী শিক্ষাসফরে এই জাফলং-এ এসেছিলাম।
আমি বললাম -- তো কী হয়েছে? এমন ঘটনা অনেক মানুষের জীবনেই আছে। তোমারও যেমন আছে, আমারও আছে। এই সমস্ত ঘটনাগুলো আমাদের সংসার জীবনে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। আমরা আমাদের প্রতিদিনের ঘর সংসার করে য়াই সুন্দর মতো। তবে মাঝে মাঝে তাদের কথা মনে পড়ে হৃদয় যে উদ্বেলিত হয়না, তা নয়। কখনও কখনও অশ্রুও ঝরে পড়ে। কিন্তু তাতে সংসারে অমঙ্গলের ছায়া পড়ে না একটুও।
আমি আফসানাকে বলি -- তারপর কী হয়েছিল?
-- ছেলেটি তারপর আর কখনও কলেজে আসে নাই। সেই যে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল -- ওর আর খবর পাইনি। আমিও কোনো খবর নিইনি। ওকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ এই রাত, এই চাঁদ, দূরের ঐ পাহাড়, পাথুরের পিয়াইন নদী, ঐ ঝর্নার জল, তারার এই আকাশ দেখে ওকে খুব মনে পড়ছিল । তুমি বিশ্বাস করো-- মনে হয়েছিল ঠিকই। তা চোখের জল ঝরিয়ে শেষ করে দিয়েছি। আর কান্না হবে না।
আমরা পিয়াইন নদীর তীরে সেই দিনের সেই রাত, সেই চাঁদ, পাহাড়ের গায়ে সেই জোছনার সৌন্দর্যকে ব্যর্থ হতে দিইনি। আমরা ভেসেছিলাম বিগলিত জোছনায়। আমরা মিশেছিলাম শুভ্র স্বেদে ভালোবেসে অপার মাধুরিতে।
২২. এক আশ্চর্য সন্ধ্যা
একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। পরিচিত অপরিচিত অনেক মানুষই সেই অনুষ্ঠানে এসেছিল। আগত অতিথিদের মধ্যে কেউ খাচ্ছিল। কেউ গল্পগুজব করছিল। একজন রমণীকে দেখলাম সে একাকী এককোণে চুপচাপ সোফায় বসে আছে। কারোর সাথে কথা বলছিল না। মহিলাটির বয়স পঁয়তাল্লিশের মতো হবে।
ওনাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল। দূর থেকে দেখলাম তার চোখ। মনে হলো এই চোখ আমি এর আগে অনেক দেখেছি। মুখ দেখে মনে হলো -- এই মুখের দিকে আমি বহুবার চেয়ে থেকেছি। তার কপাল, ভ্রূ, মাথার চুল, নাক, ঠোঁট, আনত চাহনি আমার বহুদিনের চেনা।
সে একটি হালকা নীল রঙের জামদানি শাড়ি পরেছিল। গায়ে ফিকে নীল-রঙা ব্লাউজ। চুল খোঁপা করা, টিপ পরেছে বড়ো করে। ঠিক এমন সাজে একটি মেয়েকে দেখেছিলাম অনেক বছর আগে এক আশ্চর্য সন্ধ্যায় কলাকোপার কোকিল পিয়ারীর জমিদার বাড়ির দিঘির পাড়ে। সেও কপালে পরেছিল বড় করে টিপ। খোপায় ছিল চন্দ্রমল্লিকা ফুল। অনেক আগের সেই সন্ধ্যার কথা, সেই মেয়েটির কথা, সেই দিঘির পাড়ের নির্জনতার কথা, ঘাটের কথা, টলটলে জলের কথা -- আমার মনমুকুরে আজও মণিদীপার মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
আমি ঐ রমণীর একটু কাছে যাই। তার মুখের দিকে চেয়ে বলি -- তুমি পল্লবী না? রমণীটি আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছু মুহূর্ত স্থির চোখে, তারপর বিস্মিত হলো! তারপর বললো -- তুমি রঞ্জন না?
বললাম, হ্যাঁ আমি রঞ্জন।
পল্লবী বলছিল -- সেই কত বছর পর তোমাকে দেখলাম। জানো কত বছর?
-- তেইশ বছর পর।
পল্লবীর সাথে কথা বলছিলাম যখন, তখন খুব ইচ্ছে করছিল -- ওর হাতটি একটু ধরি। পরক্ষণেই মনে হলো, কী ভাবছি? পল্লবী কী আর সেই পল্লবী আছে? সে এখন আর একজনের বউ। ঘরসংসার করে। ছেলে মেয়ে আছে। ওর কী আর মনে আছে? সেই কবে শীতের এক অস্ত বিকালে কোকিল পিয়ারীর জমিদার বাড়ির দিঘির ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম টলটলে জল। জলে পড়েছিল আকাশের লাল আবীর মাখা ছায়া। দূর অস্তাচলে ডুবতে দেখেছিলাম সূর্য। কী মায়াময় সন্ধ্যা নেমেছিল দিঘির পাড়ে ! তারপর রাত হয়েছিল। আমার খুব শীত লাগছিল। কেন জানি কাঁপছিলাম খুব। পল্লবী ওর শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে সেদিন।
আজ এত বছর পর ওর সাথে আমার দেখা। ওকে বললাম -- তুমি কেমন আছ? কী করো, কোথায় থাকো এখন?
-- কেমন আছি সে কথা পরে বলি। থাকি অনেক দূর। অন্য আরেক গোলার্ধে। আমেরিকার আরিজোনার এক ছোট মরু শহরে আমার বাস। সেও দেড় যুগ হয়ে গেল। দু সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলাম। কালই চলে যাচ্ছি। এই জীবনকাল তোমাকে কত যে খুঁজেছি আমি। দেখা পাইনি তোমার। সেই যে কবে কেমন করে তুমি হারিয়ে থাকলে!
পল্লবী একটি শ্বাস ফেলে বলছিল -- সেই তোমার দেখা পেলাম। একেবারে জীবনের ক্রান্তিকাল সময়ে। কেমন করে যেন শেষ হয়ে গেল বেলা। জীবন যখন শুকায়ে গেল, তখন তোমার দেখা পেলাম।
পল্লবী বলছিল -- তোমার বউকে এখানে নিয়ে আসো নাই?
-- না।
-- কেন?
-- নেই।
-- নেই মানে!
-- ও দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে সেই যৌথ জীবনের শুরুর ঊষা লগ্নেই।
-- শুনে ব্যথিত হলাম। কী হয়েছিল ওর?
-- সে অনেক কথা।
-- তারপর আর কাউকে জীবনে আনো নাই?
-- না। ইচ্ছে করে না আর!
আমি পল্লবীকে বললাম -- তুমি কেমন আছো?
-- ভালো নেই।
-- কেন, কী হয়েছে?
-- ঐ যে বললাম, জীবন শুকিয়ে গেছে। ডাক্তার একটি নির্দিষ্ট সময় পর্বের কথা বলে দিয়েছে -- ঐ ক'দিনই নাকি বাঁচব। শেষ বারের মতো এই দেশ, এই মাটি ও প্রিয় মানুষদের দেখতে এসেছিলাম। তোমাকেও খুঁজেছি। মরে গেলে টুসন শহর থেকে দূরে কান্ট্রি সাইডে নির্জন কোনও মরু প্রান্তরে গ্রেভইয়ার্ডের বালুর নিচে শুয়ে থাকব। ওখানে দূর্বা ঘাস নেই। ব্লু বনেটও ফোটে না। কলাকোপার জমিদার বাড়ির বাগানে ফুটে থাকা চন্দ্রমল্লিকার মতো সুবাসে ভরে থাকবে না মৌন সন্ধ্যায়। মরু বাতাসে হুহু করে শুনতেও পাব না জীবনের কোনও মর্মর ধ্বনি।
আমি পল্লবীর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল ওর চোখ জলে ভরে উঠেছে। শুধু ঝরে পড়ছে না কেবল। চারদিকে কত মানুষ কত অতিথিজন। সুরের কত মূর্ছনা। কেঁদে ফেললে লোকে কী ভাববে? আমারও খুব কান্না পাচ্ছিল। অনেকটা জোর করে জল আটকিয়ে রাখলাম।
পল্লবীর সাথে কথা বলছিলাম যখন, তখন একজন বয়স্ক রাশভারি লোক ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। এবং গম্ভীর কণ্ঠে বলে - পল্লবী, তুমি কী করছো এখানে , কার সাথে কথা বলছো? তুমি চলো। গাড়ি চলে এসেছে।
লোকটি খুব তাড়া করছিল চলে যাবার। এরই ফাঁকে পল্লবী আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় লোকটির সাথে। বলে -- ইনি আমার স্বামী। আমাকেও পরিচয় করে দেয় ওনার সাথে। বলে-- ওর নাম রঞ্জন। আমরা একসময় সাংস্কৃতিক সহকর্মী ছিলাম। পল্লবী আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
তারও কিছুকাল পরে জেনেছিলাম-- পল্লবীও চলে গেছে জীবন সীমানার ওপারে। কী যে দুঃখ আমার, কেন যে ঈশ্বর দুটো বেদনার ভার বয়ে বেড়াবার দায় আমাকেই দিলো।
মাঝে মাঝেই দিনের শেষ আলোর স্বপ্নলোকে কোনও দূরাগত ঘন্টারধবনি কানে বাজে, তখন নিরুদ্দেশ হয়ে দূর কোনও গন্তব্যে যেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কখনও আবার অতীতের মধুময় সুন্দর কোনও সন্ধ্যার সমস্ত আলো, শব্দ, গন্ধ এসে প্রবেশ করে সানন্ধকারে আমার ঘরে। তখন নিঃশ্চুপ চেয়ে থাকি অনিমিখ।
আমার সমস্ত প্রাপ্তির মধ্যে আমি কত অসহায়, কত নিঃস্ব।
২৩. নীলকমলের তীরে
আজ থেকে শতবছর আগে কেমন ছিল বৈকুণ্ঠপুর গ্রাম? এর পথ, ঘাট, নদী? কেমন করে কুলকুল শব্দে বয়ে যেত ইছামতী নদীর জলের ধারা? নদীর পাড়ের জারুল আর তাল তমালের বনে কেমন লাগত পূর্ণিমা রাতের নিশিছবি! আর কেমন ছিল এই গ্রামের এক বালিকা বউ? কেমন ছিল মণিবালা।
শতবছর আগে এক কালি সন্ধ্যায় ইছামতীর নদীর তীরে হরেন মাঝির বাড়িতে চল্লিশোর্ধ্ব এক সন্ন্যাসীর মতো লোক এল। মুখে আাধাপাকা শশ্রূমণ্ডিত দাড়ি । পরনে গেরুয়া রঙের মলিন ধুতি। লোকটি সোজা গৃহে প্রবেশ করে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দায় হোগলা পাতার পাটিতে বসে সেই সময় হুক্কা টানছিল সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ । সে ভালো করে চোখে দেখতে পায় না। সন্ন্যাসীর পায়ের শব্দ শুনে বলে -- ওখানে কে?
সন্ন্যাসী বৃদ্ধকে চিনতে পারে। সে বলে -- বাবা, আমি হরিপদ।
বৃদ্ধ হরেন মাঝি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে --
বাবা, তুই এত বছর পর আসলি। কোথায় ছিলি এতদিন? সেই তুই এলি, যখন তোর মা নেই। তোর মণিবালা নেই। আমি আধা অন্ধ হয়ে এই নদীর কূলে মরণের তীরে একা রয়ে গেছি।
হরিপদ এই বৈকুন্ঠপুর গ্রামে ফিরে এল কুড়ি বছর পর। সে অল্প বয়স থেকেই ছিল ভবঘুরে। ঘর সংসারে তার মন ছিল না। প্রায়ই সে উধাও হয়ে কোথাও চলে যেত। কখনও গানের দলের সাথে, কখনও যাত্রা দলের সাথে, কখনও সন্নাসীদের দলে। বিভিন্ন আখড়ায় সে রাত কাটাত। তিনমাস, ছয়মাস, কখনও বছর পর ফিরে আসত সে। একবার হরিপদ এক ঝুমুর দলের সাথে বাঁকুড়া চলে গিয়েছিল । ওখানে নাকি -- গঙ্গা, ভাগীরথী, দারেকেশ্বর আর ময়ূরাক্ষী নদীর উপর নৌকায় নৌকায় ভেসেছে দুবছর ।
হরেন মাঝি বুদ্ধি করে হরিপদকে ঘরবন্দী করার জন্য বৈকুন্ঠপুর গ্রামেরই জুরান মাঝির দ্বাদশী রূপসী কন্যা মণিবালাকে ছেলে বউ করে ঘরে নিয়ে আসে। নদীর কূলে হরেন মাঝির ছোনপাতার ছিন্নঘর সেদিন থেকে দ্বাদশী চান্দের আলোর মতো আলোকিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই বালিকা হরিপদকে ঘরবন্দী করতে পারেনি। বিয়ের কয়েকমাস পর এক শ্রাবণ রাতে কাউকে না বলে হরিপদ ঘর ছেড়ে নৌকায় উঠে ভেসে চলে যায়। সেই যে হরিপদ ঘর হতে বেরিয়ে গিয়েছিল, কুড়ি বছর পর এই বৈকুন্ঠপুর গ্রামে আজ সে ফিরে এল।
যে ছোনপাতার ঘর থেকে হরিপদ বের হয়ে গিয়েছিল সেই ঘরটি বুড়ো হরেন মাঝি এত বছর ঠিকঠাক করে রেখেছিল, কিন্তু বছর দুয়েক আগে মণিবালার অন্তর্ধানের পর সে আর ঘরটি ঠিক করে রাখেনি। ঘরটি জীর্ণ পর্ণকুটিরে রূপ নিয়েছে। বৃষ্টি হলে জল পড়ে। ঘরের চারপাশে আগাছায় ভরে গেছে। কখনও কখনও সর্পও দেখা যায়।
হরিপদ আস্তে আস্তে পায়ে হেঁটে ঐ ঘরে গিয়েই ওঠে। কেমন গুমোট আঁধার হয়ে আছে ঘরটির ভিতর। অসীম শূন্যতা! কেমন মাটির সোদা গন্ধ! বাইরে থেকে অচেনা বৃক্ষ আর গাছগাছালির গন্ধও আসছিল। কোনও দীপশিখা কেউ জ্বালায়নি। কাঠের চৌকিটা পড়ে আছে এক কোণে। বিছানাপত্তর নেই। হরিপদ অন্ধকারে চৌকির উপর বসে পড়ে। ঘরের চালের ফুটো দিয়ে আকাশ দেখতে পায়। গুচ্ছ গুচ্ছ তারা ঠিকরে পড়ছিল ঘরে।
বুড়ো হরেন মাঝি ডাকছিল -- হরি, তুই কোথায় গেলি?
হরিপদ বাপের কাছে চলে আসে। বলে -- কেন ডাকছ বাবা?
-- পাতিলে কটা ভাত আছে। খেয়ে নে। তোর অনেক খিদে লেগেছে মনে হয়। হরিপদর পেটে খিদে ছিল। সে দুটো খেয়ে নেয়।
হরেন মাঝি ছেলেকে বলে -- তুই মণিবালাকে এত দুঃখকষ্ট ক্যান দিলি? একটি সরলমতি বালিকাকে ঘরে এনে দিয়েছিলাম তোকে। এতগুলো বছর মেয়েটি তোর জন্য অপেক্ষা করেছিল। কত গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। কত লম্পটের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে মেয়েটির উপর। শেষ পর্যন্ত আর রক্ষা করতে পারেনি ও । মেয়েটি কলংকিত হয়েছে।
বুড়ো আরও বলছিল -- লজ্জা আর গ্লানি নিয়ে যেদিন মেয়েটি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, সেদিন বলেছিল -- ''বাপ, আমি যদি কখনও হারিয়ে যাই, কখনও যদি অনেক দূরে চলে যাই, আর আপনার ছেলে যদি ফিরে আসে-- ওকে বলবেন, আমাকে যদি তার দেখতে সাধ হয় -- তবে সে দেখতে পাবে আমাকে দূর বহুদূরে কোনও এক নীলকমল নদীর তীরে।"
হরিপদ বাপের কাছে থেকে উঠে আবারও পাতার ঘরে চলে যায়। অন্ধকারে খালি চৌকির উপর গিয়ে শুয়ে পড়ে। বালিশ নেই। একটি হাত মাথার নিচে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। ঘুম আসছিল না চোখে। হরিপদর মনে পড়ে -- একদিন রাতে এই চৌকির উপর শুয়ে মণিবালা জড়িয়ে ধরে বলেছিল -- আমাকে ছেড়ে তুমি আর কোথাও উধাও হয়ে যাবে না, আমাকে ছুঁয়ে কসম করে বলো, -- বলো, যাইবা না।" হরিপদর চোখ জল ভরে উঠে।
সে পুনরায় চৌকির উপর বসে। কিছু ভালো লাগছিল না ওর। বাইরে নিঝুম আঁধার। হরিপদ বের হয়ে উঠানে আসে। আরেক জীর্ণ ঘরে হরেন মাঝি ঘুমাচ্ছিল তখন। রাতের বৈকুন্ঠপুর গ্রাম ওর কাছে বড়ই অচেনা মনে হচ্ছিল। আকাশে কোনো চাঁদ নেই। ঝিঁঝি পোকারা ডাকছে। নিশাচর পাখিরা পাখা ঝাপটে পতপত করে উড়ে যাচ্ছে। নদীর কূলের বন থেকে শিয়াল কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিল। হরিপদ উঠোন ছেড়ে নদীর দিকে হাঁটতে থাকে। নদীর কূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে জারুল আর তাল তমালের বনের দিকে চলে যায়৷
বনের ওধারেও নদী আছে। নদীর কূল আছে। হয়তো সেখানে কোনও ডিঙি নৌকা বাঁধা আছে। হরিপদ ভাবছিল, গত কুড়ি বছর কত নদীর উপর সে ভেসেছে, কত জনপদে ঘুরেছে কিন্তু কোথাও নীলকমল নদীর নাম শোনেনি। এই নামে নদীর উপর সে ভাসেনি কখনও। হরিপদ শূন্যে দৃষ্টি মেলে ভাবছিল, কোথায় এই নীলকমল নদী? আমাকে যে সেথায় পৌঁছতে হবে। মণিবালার দেখা পেতেই হবে।
শতবছর আগের কোনও এক গরীব পল্লী জেলে বালিকা কেমন করে ভালোবেসেছিল ভবঘুরে এক তরুণকে? কেমন ছিল তার স্নেহ মায়া মমতা প্রেম? সেই আঁধার রাতে নৌকায় উঠে হরিপদ মণিবালাকে দেখতে নীলকমল নদীর খোঁজে রওনা হয়েছিল এক অপার্থিব মায়ার টানে।
বুড়ো হরেন মাঝি সকালবেলা হরিপদকে ডাকতে থাকে-- 'হরি, ও হরি ওঠ্ বাবা!' কোনও সাড়া শব্দ পাচ্ছিল না। হরেন মাঝি ঘরের ভিতর যেয়ে দেখে ঘর শূন্য। হরিপদ নেই।
এই জনমে নীলকমল নদীর তীরে মণিবালার দেখা পেয়েছিল কী হরিপদ? সেকি ধরতে পেরেছিল মণিবালার কোমল দুটো হাত? আবারও কী কাশফুলের মৌতাতের মতো তার আকুল করা বুকের গন্ধ নিতে পেরেছিল সে? এই কথা লেখক আজও জানিতে পারে নাই।
২৪. পদ্মা পাড়ের উপাখ্যান
স্কুল ছুটির সময়ে মেয়েকে আনতে সেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম। আমার অফিস ও নানা ব্যস্ততার কারণে সাধারণত মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়া করা সম্ভব হয় না। এই কাজটি তাই মেয়ের মা-ই করে।
তখনও ছুটির ঘন্টা বাজেনি। দেখি -- মাদার্স কর্ণারে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। ওনাকে দেখে চিনতে পারলাম । ওনার সাথে কথা বলব কী বলব না, ভাবতেই তার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। সে মাদার্স কর্ণার থেকে লবিতে চলে আসে। কাছে এসে প্রথম কথা সেই বলে--
-- কেমন আছ তুমি? চিনতে পারছ আমাকে?
-- খুব ভালো চিনতে পারছি। তুমি রুনু। দশ বছর পর তোমাকে দেখলাম। কী জন্য এখানে?
-- আমার মেয়ে এখানে পড়ে । ওকে নিতে এসেছি।
- আমারও মেয়ে পড়ে। আমিও ওকে নিতে এসেছি। তা তোমার মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে?
-- ক্লাস থ্রি।
- আমার মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে।
রুনু বলে -- তোমাকে তো এর আগে কখনও দেখিনি স্কুলে।
-- ওর মা-ই মেয়েকে আনা নেওয়া করে। তবে হঠাৎ হঠাৎ আমারও আসা হয়, কিন্তু তোমার সাথে দেখা হয়নি।
রুনুকে দেখে একটু মনখারাপ হলো। ওর চেহেরা কেমন যেন নিরাভরণ লাগল। কোনও সাজসজ্জা নেই। সিম্পল একটি শাড়ি পরেছে। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই। হাতের নোখে নেইলপালিশ মাখা নেই। চোখে কাজল নেই। চুল পরিপাটি করে বাঁধা নেই। খুব সাধারণ করে চুল খোঁপা করে রেখেছে।
আমি রুনুকে বললাম -- এই শহরেই তুমি থাকো, অথচ জানতাম না তা। দেখাও পাইনি কোথাও। তা তুমি কেমন আছ? কোথায় থাকো?
স্কুলের ছুটির বেল বাজতে থাকে। বেলের শব্দটা খুব জোরে কর্কশ করে বাজছিল। কিছুক্ষণ চুপ থাকে রুনু।
তারপর বলছিল -- আমি কেমন আছি সে কথা পরে বলব একদিন। কয়েকদিন পর এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি ভেড়ামারাতে। বাকি জীবন ওখানেই থাকব। যদি ইচ্ছে হয়, একবার বাসায় এসো। বাসার ঠিকানা-- ৩৬ দলিপাড়া, উত্তরা। বাসায় এলে সব বলব।
একটি সাত আট বছরের ফুটফুটে মেয়ে দৌড়ে এসে রুনুকে জড়িয়ে ধরে। ওর কাঁধে বইয়ের ব্যাগ। রুনু মেয়েটির কাছে থেকে ব্যাগটি নিয়ে রিকশায় উঠে। যাবার বেলায় বিষাদমাখা হাসি দিয়ে বলে -- বাসায় এসো তুমি।
দশ বছর আগে -
রুনু পদ্মা পাড়ের মেয়ে। পদ্মার তীর ঘেঁষে একটি গ্রাম, নাম তার চাঁদগ্রাম। সেখানেই কেটেছে ওর শৈশব। কৈশোরেই বাবা মাকে হারিয়ে ফেলে। গ্রাম ছেড়ে চলে আসে মামার কাছে থানা শহর ভেড়ামারায়। ওখানেই পড়াশোনা করে। রুনু যখন কলেজে পড়ে, ঠিক সেইসময় এক ছুটির দিনে আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম ভেড়ামারা। ওখানে গঙ্গা-কপোতক্ষ প্রজেক্টে আমার ভগ্নিপতি চাকুরি করত। কয়েকদিন আমার বোনের বাসায় ছিলাম। রুনু আমার ছোট্ট একটি ভাগ্নীকে পড়াতে আসতো প্রতিদিন। সেই ছলেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়।
আমি তখন ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র। উচ্ছল প্রাণের এক তরুণ বয়স আমার। সুন্দর লাগে পৃথিবীর সব রূপ। নদী ভালো লাগে। বৃক্ষ ভালো লাগে। পাতা ঝরা দেখতে ভালো লাগে। রোদ্দুরে হাঁটতে ভালো লাগে। বৃষ্টির মেঘ দেখতে ভালো লাগে। গীতবিতান খুলে গান পড়তে ভালে লাগে। ভালো লাগলো এই রুনু নামের মেয়েটাকেও।
মেয়েটা সালোয়ার কামিজ পরে, চপ্পল পায়ে হেঁটে হেঁটে আসতো। চোখ দুটোতে মায়া জড়িয়ে থাকত। কেমন স্বপ্নময়ী দৃষ্টি তার! আমার সাথে কথা বলত না। আমিও কোনও কথা বলতাম না। যেন সব কথা লুকিয়ে থাকে কণ্ঠের নীচে। কিন্তু খুব ইচ্ছে হতো ওর সাথে কথা বলতে।
কয়েকদিন এইভাবে কথা না বলেই কেটে গেল। বলি বলি করে কোনো কথাই বলা হলো না। আমারও ওখানে থাকবার দিনগুলো শেষ হয়ে যেতে লাগলো। কী করব? ভাবলাম, থাক। ওকে কিছুই বলব না। আমার ভালোলাগা আমার মাঝেই গোপন থাক। এখান থেকে যখন চলে যাব। তখন সব ভুলে যাব। এই জীবনকালে এইরকম কত মেয়ের দেখা পাবো, দেখতে পাবো মায়াবী চোখের কত মায়াবতীকে! এদের ভিতর থেকেই ভালোলাগার কোনও মেয়েকে ভালোবেসে ফেলব। কেউ না কেউ আমার জীবনে এসে যুক্ত হবে। এত দূরের পদ্মাপাড়ের এই মেয়ে আমার জীবনে কিছু না-ই বা হলো।
ভেড়ামারা থেকে চলে আসবাব দুইদিন আগে কেন জানি কী মনে করে মেয়েটিকে ছোট্ট একটি চিরকুট দিয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল --
'' হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে তোমাকে নিয়ে খুব পদ্মার জল দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি কাল বিকালে ব্রিজের কাছে পদ্মা পাড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। এসো। "
রুনু সেদিন এসেছিল পদ্মাপাড়ে। আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম পদ্মার জল। খোলা হাওয়ায় উড়ছিল রুনুর চুল। আমরা দেখেছিলাম ছোট ছোট ঢেউ। স্রোতে ভেসে যেতে দেখলাম কত খড়কুটো। কী স্নিগ্ধ শীতল বাতাস নদীর জল ছুঁয়ে এসে লাগছিল গায়ে। কী কথা বলব আমি রুনুর সাথে? কত কথা অন্তরে বাজে। রূপকথার মতো যত কথা। ভেবে পাচ্ছিলাম না কিছুই। তবুও বলেছিলাম কম্পিত স্বরে -- 'তোমাকে আমার ভালো লাগে রুনু।'
রুনু বলেছিল -- 'তোমার এই ভালোলাগাটুকু আমার জন্য চিরকালের করে রেখে দিও। ভালোবেসো না। আমি যে বাগদত্তা। মামা আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন।' দেখলাম, রুনু আমার চোখের দিকে স্থির শান্ত তাকিয়ে আছে। তখন পদ্মার জল ছলাৎ ছলাৎ করছিল। রুনুর চোখ জলে ছলছল করছে। নদীর উপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাস কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। ব্রিজের উপর থেকে জলের দিকে চেয়ে দেখি -- ঢেউগুলো জলের নিবিড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
পদ্মা পাড়ের রুনু উপাখ্যান সেদিনের সেই অলৌকিক সূর্য অস্তকালেই শেষ হয়ে গিয়েছে।
তারপর, এই পৃথিবীর পথে প্রান্তরে কত বনঝাড়ে কত ফুল ফুটে থাকতে দেখেছি। কত নাম না জানা ফুল। সব ফুলের সৌরভ কী আর নেওয়া হয়? স্পর্শহীন, মায়াহীন হয়ে কত ফুল নীরবে ঝরে গেছে। আবার পথ চলতে চলতেই সেখান থেকেই রাজকুমারীর মতো সৌন্দর্যের একটি ফুল ছিড়ে এনে ফুলদানিতে রেখেছি। শোভিত হয়েছে ঘর। সুবাস ঝরিয়েছে সারা ঘরময় । প্রতিদিন সেই ফুলে জল দেই। পরিচর্যা করি। ভালই লাগে। ভালোবাসি।
দশ বছর পর সেই রুনুকে আজ দেখলাম। মেয়েটিকে দেখে কেমন নির্জীব স্পন্দনহীন ঝরা ফুলের মতো মনে হলো। ও কী খুব দুঃখে আছে? ওর কোনও পরিস্ফুটন নেই। জীবন থেকে একদম বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এই মেয়েটির জন্য কেমন যেন মায়া লাগছিল।
রুনুর ওখানে যাব কী যাব না একটু দ্বিধা করছিলাম।
ভাবছিলাম পুরনো কোনও মায়াকে মায়া করতে নেই। তারপরও নিজের কাছে হেরে গেলাম। ক'দিন পর এক সন্ধ্যায় চলে যাই দলিপাড়া রুনুর বাড়িতে। বাড়ির গেটে নক্ করি। একজন মধ্যেবয়সী রমণী বের হন। আমি ওনাকে বলি -- এখানে রেহেনা জোয়ার্দার রুনু নামে কোনও মেয়ে থাকে? মহিলা বললেন -- বাসা ছেড়ে দিয়ে উনি আজ সকালেই চলে গেছেন। তা, আপনার নাম কী? বললাম -- রঞ্জন।
মহিলা বললেন, আপনার একটি চিঠি আছে। এই কথা বলে ঘরের ভিতর থেকে একটি ইনভিলাপ এনে আমার হাতে দিলেন।
পথের উপর দাঁড়িয়ে চিঠিটি পড়ছিলাম --
রঞ্জন,
দীর্ঘ রোগভোগের পর দেড়মাস আগে আমার স্বামী চলে গেছেন। ওকে ধরে রাখার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই শহরে নিজেকে কেমন নিরাপত্তাহীন ও একা মনে হচ্ছিল। তাই চলে গেলাম আমার ছোট্ট শহর ভেড়ামারাতে। জানি, ওখানেও ভালো লাগবে না। মন ছুটে চলে যেতে চাইবে অপার্থিব কোনও ছায়াপথ ধরে দূরে কোথাও। একটি স্কুলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াব। ওদের মাঝেই ভুলে থাকব আমার স্বামীর কথা। প্রতিদিন ঘরে সন্ধ্যায় আলো জ্বালাতে গিয়ে ওর কথা মনে করে দম বন্ধ হয়ে আসবে।
মনটাকে ভালো করার জন্য কোনও কোনদিন হয়তো একাকী হেঁটে চলে যাব পদ্মা পাড়ে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখব পদ্মার জল। পদ্মায় এত জল! কী যে ভালো লাগবে আমার! সেই জলে ছায়ার মতো দেখতে পাবো তোমার মুখ।
-- রুনু।
২৬. বেস্ট ফ্রেন্ড
আমার ছোট মেয়ে ঐশ্বর্যময়ী তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ত। স্কুলে যেতে ওর খুব অনাগ্রহ ছিল। নানা ছলাকলা করে সে স্কুলে না যাওয়ার ছুতো খুঁজত। এই যেমন, ওর মাকে সকালবেলা বলত -- মা, আমার পেটে ব্যথা করছে। কিংবা বলত -- 'আমার বমি বমি লাগছে, ক্লাসের ভিতর বমি করে ফেলব।' এই রকম নানান বাহানা সে করত।
আসলে পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য সে এসব
করত না। আমরা যেটা বুঝতে পেরেছি, তাহলো ক্লাসে সে কোনো ভালো বন্ধু খুঁজে পায়নি। এমন কাউকে বন্ধু করতে পারেনি, যার সাথে সময় কাটাবে, তার সাথে গল্প করবে। এটা ওরও সীমাবদ্ধতা হতে পারে। ও হয়ত কাউকে বেস্ট ফ্রেন্ড করে নিতে পারেনি।
একদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে ঐশ্বর্যময়ী খুব খুশি। ওর সারা মুখে চোখে এক অপূর্ব হাসির ঝিলিক। সে নিজে থেকেই বলছিল -- বাবা, আমাদের ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে ভর্তি হয়েছে। ওর নাম রুম্পা। ও খুব ভালো। রুম্পা আমাকে বলেছে -- 'তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হবে?' আমি ওকে বলেছি -- 'হবো।' তারপর, ওর থাম্ব আমার থাম্বে মিলিয়ে বলেছে -- 'আজ থেকে আমরা দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড।'
এরপর থেকে দেখলাম ঐশ্বর্যময়ী স্কুলে যেতে আর কোনো টালবাহানা করছে না। ও খুব উৎসাহ নিয়ে স্কুলে যায়। কোনো ক্লাস মিস করে না। পড়াশোনাও খুব আগ্রহ সহকারে করে। বাসায় আমার কাছে, ওর মায়ের কাছে, ওর বড়ো বোনের কাছে সারাক্ষণ রুম্পার প্রসংশা করে।
স্কুলে ওরা দুজন টিফিন শেয়ার করে খেত। এইজন্য ওর মাকে স্পেশাল নাস্তা করে দিতে হতো। কেক, ন্যুডুল, পুডিং, ফলমূল, এটা ওটা একটু বেশি করেই দিয়ে দিত। আবার রুম্পাও ওর জন্য অনেক রকম খাবার নিয়ে আসত।
ঐশ্বর্যময়ীর স্কুলে যাওয়া নিয়ে আমাদের আর কোনো টেনশন করতে হতো না। ও নিজে নিজেই ওর ব্যাগ গুছিয়ে রাখে। হোমটাস্ক গুলো ঠিকমতো করে নিয়ে যায়।
একদিন ঐশ্বর্যময়ী স্কুল থেকে খুব মন খারাপ করে বাসায় আসে। আমি ওকে বলি -- 'মামণি, তুমি মন খারাপ করে আছ কেন? কী হয়েছে?' ঐশ্বর্যয়ী বলে -- 'বাবা, আজ রুম্পা ক্লাসে আসেনি।' আমি ওকে বললাম -- 'রুম্পার কোনো অসুবিধা ছিল হয়ত, তাই আজ আসেনি। দেখবে কাল আসবে।'
পরের দিন মেয়ে আবারও মন খারাপ করে স্কুল থেকে এসে বলে -- 'বাবা, আজও রুম্পা ক্লাসে আসেনি। আমি বললাম --' হয়ত ওর জ্বর হয়েছে তাই ক্লাসে আসছে না। তুমি মন খারাপ করো না। রুম্পার অসুখ ভালো হলে ঠিকই স্কুলে চলে আসবে।
এক সপ্তাহ মতো রুম্পা যখন স্কুলে আসছে না, তখন ঐশ্বর্যময়ীর পীড়াপীড়িতে স্কুলে অফিস থেকে খবর নিয়ে জানতে পারলাম -- 'রুম্পার আসলেই জ্বর। তাই স্কুলে আসছে না।' এদিকে, ঐশ্বর্যময়ী প্রতিদিনই মনখারাপ করে বাসায় ফেরে এবং আগের মতো স্কুলে যেতে অনিহা প্রকাশ করতে থাকে । কোনো উৎসাহ নেই।
আরও বেশ কিছুদিন পরে একদিন ঐশ্বর্যময়ী স্কুল থেকে বাসায় এসে ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে -- 'জানো বাবা, আজ রুম্পাকে ওর বাবা মা স্কুলে নিয়ে এসেছিল। ওর নাকি অনেক অসুখ। ও আমাদের দেখতে চেয়েছিল। তাই ওকে স্কুলে নিয়ে এসেছিল।'
পরে খবর নিয়ে জানতে পারলাম রুম্পার লিউকেমিয়া হয়েছে। রক্তে ক্যান্সার। ডাক্তার বলে দিয়েছে -- ও বেশি দিন বাঁচবে না। রুম্পা আর বাঁচবে না জেনেই ওর বাবা মা রুম্পাকে স্কুলে এনে ওর সহপাঠী বন্ধুদের দেখিয়ে নিয়ে গেছে।
আরও কয়েকদিন পর ঐশ্বর্যময়ী আমার কাছে খুব কান্নাকাটি করে বলতে থাকে -- বাবা, আমাকে রুম্পার কাছে নিয়ে যাও, আমি ওকে দেখব।'
ওকে কিছুতেই বুঝিয়ে রাখতে পারা যাচ্ছিল না।
ঐশ্বর্যকে নিয়ে আমি এবং ওর মা রুম্পাকে দেখতে একদিন ওদের বাসায় যাই। বাসায় যেয়ে শুনি -- রুম্পা হাসপাতালে। আমরা ওখান থেকেই হাসপাতালে চলে যাই
হাসপাতালে রুম্পা ওর বেডে শুয়ে আছে। মেয়েটা শুকিয়ে একদম কালচে হয়ে গেছে। শুধু প্রাণটাই যেন আছে। দেখলাম -- স্যালাইন চলছে। নাকে পাইপ লাগানো। ঐশ্বর্যময়ীকে খুব মায়া করে ও দেখছিল। রুম্পা ওর একটি হাত এগিয়ে দেয় ঐশ্বর্যময়ীর দিকে। ঐশ্বর্য ওর হাত ধরে -- এবং বলে -- 'তুমি আবার কবে স্কুলে যাবে? আমি ক্লাসে তোমাকে খুব মিস করি।'
রুম্পা বলছিল -- যাব। আমিও তোমাকে খুব মিস করি মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।
২৭. সুপ্রভাত
এই গল্পের কাহিনিকাল ও চরিত্রসমূহ গত শতাব্দীর আশির দশকের।
ট্রেনটি যখন লাহিড়ী মোহনপুর এসে পৌঁছে তখন শেষ বিকাল। একটুপর সূর্য ডুবে যাবে। আশ্বিন মাস। তখনও বন্যার পানি মাঠে খালে বিলে নদীতে থৈথৈ করছে। বাড়িতে যাওয়ার অন্য কোন পথ নেই। মতিন স্টেশনের অদূরে ঘাট থেকে একটি ছোট নৌকায় করে তার গ্রামের বাড়ি কৈবর্তগাঁতী রওনা হলেন।
আবদুল মতিন চাকরি করে ঢাকার লালবাগে একটি এ্যালুমেনিয়াম কারখানায়। সে ঐ কারখানার একজন ফোরম্যান । ছুটিছাটা খুব কম পায়। বছরে এক দুইবার বাড়ি আসে। এবার সে বাড়ি আসছে তার স্ত্রীর অসুখের খবর পেয়ে।
শেষ বিকালের আবছা আলোয় নৌকাটি চলতে থাকে ছলাৎছলাৎ করে। ভরা জলের মাঠ পেরিয়ে নৌকাটি চলছে ধীরে। মতিন মিয়া পাটাতনের উপর চুপচাপ বসে আছে। বালিহাঁস মাথার উপর দিয়ে শোঁ-শোঁ করে উড়ে চলে যাচ্ছে তাদের কুলায়। জলের উপর আমন ধানের ডোগাগুলো ভাসছে। জল কমবে, ডোগাগুলোও আস্তে আস্তে নুয়ে পড়বে। জায়গায় জায়গায় সাদা রঙের শাপলা ফুল ফুটে আছে। ঢেউ লেগে জলে ভিজছে পাপড়িগুলো।
এখানে জলের প্রান্তর দেখতে সাগরের মতো লাগে। বিশাল পাথার পেরুলেই তারপর নদী, তারপর গ্রাম। মতিন সামনে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা খুবই বিষণ্ণ। সে এখনও জানে না, তার স্ত্রী এখন কেমন আছে?
নৌকার ভিতর আরও কয়েকজন মানুষ আছে। কারোর সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাদের কাউকেই সে চেনেও না। ভিন গাঁয়ের মানুষ। তারা বিভিন্ন ঘাটে নেমে যাবে।
সন্ধ্যা নামছে জলের উপর। ক্রমে আঁধার হয়ে আসছে। দূরের কোন গ্রাম দেখা যাচ্ছিল না। একসময় নৌকাটা কোমলা নদীতে এসে পড়ে। প্রচণ্ড ভাটি স্রোত। নৌকাটি বেগ পেল। মতিন মিয়া খোলা আকাশের দিকে চেয়ে দেখে -- তারায় তারায় আকাশ জ্বলজ্বল করছে। চাঁদও উঠেছে। এমন তারাভরা আকাশ আর চাঁদ দেখলে যে কারোর মন ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু মতিন মিয়ার মন ভালো হলো না। তার মন নিমগ্ন হয়ে পড়ে আছে তার ঘরে।
একটু পর নৌকার মাঝি মতিন মিয়াকে বলল -- কৈবর্তগাঁতী এসে গেছি। কোন্ ঘাটে নৌকা ভিড়াব?
মতিন মিয়া বলল -- হরি মন্দির ঘাটে।
আব্দুল মতিন নৌকা থেকে ঘাটে নামে। চাঁদের আলোয় হেঁটে হেঁটে সে বাড়ির দিকে যেতে থাকে। বাড়িতে এসে দেখে - ঘরের দরজা বন্ধ। ভিতরে হারিকেন জ্বলছে। সে দরজায় কড়া নাড়ে। ভিতর থেকে এক বৃদ্ধা দরজা খুলে দেয়। সে ছিল মতিনের মা।
চৌকির উপর তার স্ত্রী ফাতেমা শুয়ে আছে। প্রায় সাত মাস পর মতিন তার স্ত্রীকে দেখল। ফাতেমা তার স্বামীকে দেখে চোখের জল আটকাতে পারল না। সে ঝরঝর করে কাঁদছে। মতিন তার স্ত্রীর হাতখানি ধরে, এবং বলে -- তোমার কী হয়েছে? শরীর এত শুকিয়ে গেছে যে!
ফাতেমা বলে -- বঙ্কিরাটের সাইফুল ডাক্তারকে দেখিয়েছি। সে বলেছে -- আমার নাকি কলিজায় কঠিন অসুখ হয়েছে। ঔষধও খেতে দিয়েছে। উনি বলেছেন, সদর হাসপাতালে যেয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে হবে ।
-- তুমি যাও নাই?
-- না। ভেবেছিলাম তুমি এলে তোমার সাথে যাব।
-- কতদিন ধরে এই সমস্যা?
-- তিনমাস হবে।
-- আমি কালই তোমাকে সদর হাসপাতালে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
মতিনকে দেখার পর থেকেই ফাতেমা যে কাঁদছে, তা থামছিল না। সে বলছিল -- কতদিন তোমার আসার পথের দিকে চেয়ে থেকেছি। প্রায়দিনই হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম নদীর ঘাটে। চেয়ে দেখতাম স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা নৌকাগুলির দিকে। কিন্তু কোনও নৌকায়ই তোমাকে দেখতে পেতাম না।
মতিন ফাতেমাকে বলে -- তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন? খেতে পারো না?
-- না। খেলেই বমি করে ফেলি। বমির সাথে রক্তও আসে। পেট খুব ব্যথা করে। চিৎকার করি। আল্লাহকে ডাকি। তোমাকে ডাকি।
-- টুটুল কই?
-- ওর ফুপু এসে নিয়ে গেছে আমার এই অবস্থা দেখে। ফাতেমা কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠছিল । খুব কষ্ট হচ্ছিল। কথাও ঠিক মতো বলতে পারছিল না।
মতিনের মা ভাত খেতে বলে ছেলেকে। মতিন খেতে চায় না। তবুও জোর করে সামান্য কটা ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করে । মতিন খেতে পারে না। ওর চোখে জল চলে আসে। ফাতেমাকে বলে -- তুমি খাবে না?
ফাতেমা মাথা নেড়ে বলে -- না৷ খেলেই রক্ত বমি করে ফেলব।
মতিন ফাতেমাকে বলে -- তুমি ঘুমাও। আমি তোমার শিয়রে সারারাত বসে থাকব। ভোর হলেই আমরা নৌকা করে চলে যাব সদরে। ফাতেমা তার স্বামীর হাত ধরে বলে, আমাকে ধরে একটু বাইরে নিয়ে যাও। উঠোনে তোমার হাত ধরে হাঁটব।
মতিন ফাতেমাকে ধরে উঠোনে নিয়ে আসে। সারা গ্রাম তখন নিঝুম হয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় ভেসে আছে আঙিনা। ফাতেমা ওর স্বামীকে বলে -- আমাকে ধরে একটু পুকুর পাড়ে বকুলতলায় নিয়ে যাবে? মতিন তার স্ত্রীকে পাঁজরে জড়িয়ে বকুলতলায় বাঁশের মাঁচার উপর নিয়ে বসিয়ে দেয়।
ফাতেমা বলে -- আমি একটু তোমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকি?
-- থাকো।
-- তোমার মনে আছে? আমাকে যেদিন তুমি তোমাদের বাড়িতে প্রথম নিয়ে এসেছিলে, প্রথম সেই রাতে তুমি আমাকে এই বকুলতলায় এনে বসিয়েছিলে। সেদিনও ছিল আজকের মতো এমনই চাঁদের রাত। বকুলের গন্ধে আমরা দুজন কী যে আকুল হয়ে উঠেছিলাম! ওগো, তুমি আমাকে তোমার বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো না! আমাকে ছেড়ো না। আমি মনে হয় দূরে কোথাও চলে যাব। আমাকে তুমি যেতে দিও না। তোমার বুকের মাঝে আমার বহুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে ।
মতিনেরও মনে পড়ছিল কত কথা। ফাতেমা সব দুঃখ, গ্লানি ভুলিয়ে দিয়েছিল– ও যখন এল তখন জীবনে আর কিছু চাইবার থাকল না, তার সব চাওয়া পূর্ণ করে দিলো। মনে করত -- তার মতো সুখী মানুষ জগতে আর কেউ নেই।
ফাতেমার শরীর কাঁপছিল খুব। সারা শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। মতিন ফাতেমাকে পাঁজরে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসে। এবং বিছানায় শোয়ায়ে দেয়।
ফাতেমা আরও কিছুক্ষণ জেগে ছিল। সে অস্ফুট করে মতিনকে বলছিল -- তুনি নৌকায় করে আমাকে লাহিড়ী মোহনপুর স্টেশনে নিয়ে যাও। তারপর ট্টেনে করে তোমার ওখানে নিয়ে যাবে। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছাড়বে। ঝিকঝিক করে চলতে থাকবে ট্রেন! জানো, তোমার কাছে আমার জনম-জনম-কাল থাকতে ইচ্ছে করে।
ফাতেমা একটু ঘুমের মতো হয়ে যায়। মতিন হারিকেন জ্বালিয়ে স্ত্রীর শিয়রে বসে থাকে। সারারাত চোখের পাতা ক্ষণতরেও বন্ধ করল না।
শেষ রাতের দিকে হঠাৎ ফাতেনার হেচকি ওঠে। কথা বন্ধ হয়ে যায়। মতিন ওর মাকে ডাকে। ওর মা উঠে এসে ফাতেমার শিয়রে বসে। ফাতেমা মতিনের দিকে এক দৃষ্টিতে নীরবে তাকিয়ে থাকে। কি অপূর্ব স্নেহ-মমতামাখা দৃষ্টি ওর চোখে! মতিন দেখতে পায় ফাতেমার চোখের কোনায় বিন্দু বিন্দু অশ্রুজল জমে আছে।
তখন সুপ্রভাত সময়। ভোরবেলার পাখিরা কিচির মিচির করছে। দূরে মসজিদে আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ঠিক অকস্মাৎ, ফাতেমা তার স্বামীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। মতিন কেমন একটি আর্ত শব্দ করে ফাতেমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরে।
মতিন দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ায়। দূর থেকে ভোরের হাওয়া এল কোমলা নদীর শীতল জল ছুঁয়ে। ধীরে ধীরে রোদ্দুর উঠছে ঝলমল করে। ছায়া পড়েছে উঠোনর উপর বৃক্ষ- পল্লবের। এই পৃথিবীতে কে যে কখন চলে যায়, কে যে খালি করে সব নিয়ে যায়, কে তার খোঁজ রাখে।
সময় বহিয়া যায়। নদীর স্বচ্ছ জলের স্রোতধারায়, আঁধার রাতের অনন্ত নক্ষত্রবীথির ঋজু আলোয়… সুদীর্ঘ যুগসমূহের মধ্যে… যা-কিছু মনের শক্তি, স্মৃতি বিস্মৃতির যতটুকু আনন্দ-বেদনা আছে তাই নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে।
মতিনও এমনি কোন শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকবে তার বাকী জীবনকাল।
২৮. মহাপ্রস্থানের পথে
একদিন সকালবেলা বাড়ির সদর দরজায় কেউ একজন নক করছিল। আমি নিজেই যেয়ে দরজা খুলে দেই। লোকটাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে চিনেছি। তিনি ছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একজন সিনিয়র হলমেট।
ওনার নাম আবদুল গাফফার। বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলায়। উনি আমার তিন বছরের সিনিয়র ছিলেন।পড়তেন রাষ্ট্র বিজ্ঞানে। আমার রুম থেকে চার রুম পরেই ছিল ওনার রুম। কোরিডোর দিয়ে হাঁটার সময় তাকে প্রথম দেখি। দেখার মাঝেই কথা হয় ও পরে ঘনিষ্ঠতা হয়।
উনি আমার সিনিয়র হলেও ওনার সাথে আমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তবে ওনাকে বেশিদিন হলে পাইনি। মাস ছয়েক পরে উনি মাস্টার্স সমাপ্ত করে হল ছেড়ে চলে যান।
প্রায় ত্রিশ বছর পর ওনাকে আজ দেখলাম। মুখ ভর্তি দাড়ি। চুলগুলো উসকোখুসকো, মোটেই পরিপাটি নয়। অর্ধেক চুল পেকে গেছে। কেমন যেন পাগল দার্শনিক টাইপের লাগছে। অনেক বছর পর হঠাৎ আজ ওনাকে এইরূপ দেখে একটু বিস্মিতই হলাম। বললাম - গাফফার ভাই আপনি কেমন আছেন? আমার বাসা চিনলেন কীভাবে?
-- অনেক আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে , অনেক পথ ঘুরে, চেনা অচেনা কত মানুষকে জিজ্ঞাসা করে তোমার খোঁজ আমি পেয়েছি। যখন জানতে পারলাম তুমি এখানে এই শহরে থাকো, তখনই চলে এলাম তোমার কাছে।
-- খুব খুশি হলাম গাফফার ভাই। তা ভাবী কেমন আছেন?
-- 'সে হয়তো খুব ভালো আছে। যেখানে সে চলে গেছে সেখানে তার ভালো থাকারই কথা।' উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন -- 'তোমার ভাবি পরপারে চলে গেছে। এই তো মাসতিনেক হয়ে গেল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই গাফফার ভাই তারই এ্ক সহপাঠিনীকে ভালোবাসতো। দেখেও ছিলাম তাকে সেই সময়ে। মেয়েটি একজন ভালো এ্যাথলেট ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হার্ডেল রেসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। একধরনের অদ্ভুত সৌন্দর্য ছিল তার ধ্রুপদী দেহ জুড়ে। একবার হলে এসেছিল সে। গাফফার ভাইয়ের রুমে আমাকে কয়েকটি তাসের জাদু শিখেয়েছিলেন তিনি । কী অমায়িক স্নেহশীলা মেয়ে ছিল সে। এখনও আমার ভিতর তার সেই ব্যবহার ও তার রূপ সৌন্দর্য ধারণ করে রেখেছি। তার মৃত্যুর কথা শুনে আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেল।
আমি গাফফার ভাইকে বললাম, এ কী দুঃখের কথা শোনালেন গাফফার ভাই। আপনি এমন হয়ে গেছেন কেন? এত ভেঙে পড়েছেন যে!
দেখলাম, গাফফার ভাইয়ের চোখ ছলছল করছে। আমি বললাম, কী হয়েছিল ভাবীর? সে বললো -- হার্টে সমস্যা ছিল। বাইপাস অপারেশনও করা হয়েছিল। অপারেশনের পর আট বছর তেমন সমস্যা হয়নি। সর্বশেষ আবার এ্যাটাক করে। হাসপাতালে ভর্তিও করেছিলাম। পঁচিশ দিন আইসিইউ তে ছিল। এক পর্যায়ে কোমায় চলে যায়।
বললাম, তারপর?
-- সেদিন আমি হাসপাতালে ছিলাম না। কোমা থাকাকালীন অবস্থায় হঠাৎ সে নাকি চোখ মেলে তাকিয়েছিল। কর্তব্যরত ডাক্তারকে ইশারায় বলে মুখের মাস্ক সরিয়ে ফেলতে বলেছিল। ডাক্তার প্রথমে রাজি হয়নি। ও নাকি করুণভাবে অনুনয় করছিল বারবার। ডাক্তার মাস্ক খুলে ফেলে। সে কথা বলছিল বিড়বিড় করে -- সব কথা ছিল অস্পষ্ট। পাশে থেকে এক নার্স তার ঐ কথাগুলি রেকর্ড করেছিল। এক মিনিট তেত্রিশ সেকেণ্ডের একটি ভয়েস রেকর্ড আমার কাছে আছে। কিন্তু তার বলে যাওয়া কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
বললাম, তারপর ?
-- ঐ কথাগুলো বলেই সে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল চিরতরে। তার আত্মা চলে যায় এক অপার্থিব জগতে। আইসিইউতে কোনও আপন কেউ ছিল না। আমিও ছিলাম না। ওর প্রাণ স্পন্দন থাকা তপ্ত কপালে আমি আমার হাতের স্পর্শ রাখতে পারিনি। দেখতে পারিনি বিদায়কালীন সময়ে ওর ঐ চেয়ে থাকা চোখ, চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু। কী বলতে চেয়েছিল সে, কী কথা? কিছুই শোনা হয়নি।
গাফফার ভাই একটি সিগারেট ধরালেন। আমি স্তব্ধবাক হয়ে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর উনি বললেন -- জানো রঞ্জন, আমার রাত কাটতে চায় না, আমার দিন ফুরায় না। কোথাও একদণ্ড ভালো লাগে না। উদাস হয়ে এমনই ঘুরি পথে পথে। নদীর কূলে যেয়ে বসে থাকি। কখন বিকাল হয়, কখন সন্ধ্যা নামে, কোথায় কখন পাতা ঝরে পড়ে যায়। কোথায় কে গায় আনন্দ সঙ্গীত। কিছুই শোনা হয় না। সিগারেট খেতে ভালো লাগে। সিগারেট পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে যায়।
তুমি হয়তো ভাবছ, আমি পাগল হয়ে গেছি। আসলে আমি পাগল হই নাই। তোমার ভাবী ত্রিশটি বছর আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে ছিল। আমার আত্মার সাথে, আমার দেহের রক্তকণিকার সাথে, আমার সুখ দুঃখ বেদনার সাথে মিশেছিল। আমরা কখনোই বিচ্ছিন্ন হই নাই একদিনের জন্য।
আমি গাফফার ভাইকে বলি -- আপনার বাড়িতে আর কেউ নেই? আপনার ছেলেমেয়ে কিংবা আপন কোনও জন?
-- আমরা নিঃসন্তান ছিলাম। আমার মা অনেক বছর আমাদের সাথেই ছিলেন। সেও নেই। কয়েক বছর আগে তিনি গত হয়েছেন।
-- আপনি এখন কোথায় থাকেন?
-- পলাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকুরি পেয়েছিলাম। প্রতিষ্ঠানটি পলাশে অবস্থিত। ওখানে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে সামান্য জায়গা কিনে বাড়িও করেছি। ওখানেই থাকি। শীতলক্ষ্যার পাড়ে কত স্মৃতি আছে তোমার ভাবীকে নিয়ে। কত চাঁদের রাত্রিতে আমরা নদীর তীর ধরে হেঁটে বেড়িয়েছি। কত আকুল করা সন্ধ্যা নেমেছে নদীর জলের কলধ্বনিতে।
গাফফার ভাই আরও একটা সিগারেট ধরালেন। কিছু সময় চুপ থেকে আমাকে ডাকলেন - রঞ্জন।
-- জ্বী।
-- তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে তোমার কাছে যে জন্য এসেছি তাহলো -- তুমি তো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলে। ভাষাতত্ব, ধ্বনিতত্ব পড়েছ। আমি তোমাকে তোমার ভাবীর মৃত্যুকালীন সময়ের কথাগুলোর 'ভয়েস রেকর্ড'' দেবো। তুমি সেই রেকর্ড শুনে তার কথাগুলো উদ্ধার করে আমাকে লিখে দেখাবে। তুমি রেকর্ডটা শুনলে বুঝতে পারবে, কিছু কিছু শব্দ অস্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু অর্থবহ কোনও বাক্য বোঝা যায় না। তুমি বার বার বাজিয়ে সেই কথাগুলো উদ্ধার করবে। কী পারবে না?
আমি গাফফার ভাইকে বললাম -- আপনি রেকর্ডটি আমাকে ফরোয়ার্ড করে দিয়ে যান। আমার অভিজ্ঞ একজন বন্ধু আছে। সে একজন ভাষা ও ধ্বনিতত্ববিদ। সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক। আমি ওকে নিয়ে চেষ্টা করব ভাবীর কথাগুলো উদ্ধার করতে।
আমি আমার সর্বমেধা দিয়ে চেষ্টা করব।
গাফফার ভাই আশ্বস্ত হলেন। এবং বললেন, তবে রেখে দাও। তুমি আমাকে অগ্রগতি জানাবে। আমি চলে আসব তোমার কাছে।
গাফফার ভাই সেদিনের মতো চলে গেলেন।
আমার সেই ভাষাতত্ত্ববিদ বন্ধুটিকে একদিন বাড়িতে ডেকে নিয়ে আসি। আমরা দুজন মিলে বারবার ভয়েস রেকর্ডটি বাজিয়ে শুনি। প্রথম দিকে কিছু কথা রেকর্ডকৃত ছিল না। হয়তো নার্স পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলেন না কথাগুলো রেকর্ড করতে। রেকর্ড করা অনেক শব্দ বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছিল। কিছু শব্দ অস্পষ্ট। অনেক শব্দ কিছুই বোঝা যায় না। আমরা শব্দ জোড়া দিয়ে দিয়ে এবং কাছাকাছি কিছু শব্দ প্রয়োগ করে অনেক ভেবেচিন্তে একটা অর্থবোধক পর্যায় দাঁড় করাই। এবং মোটামুটি শিয়র হই -- উনি হয়তো মৃত্যুর সময়ে এই কথাগুলেোই বলেছিলেন।
ভয়েস রেকর্ডের সবগুলো কথা ভাবী তার স্বামী গাফফার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। গাফফার ভাইকে খবর দেই চলে আসতে। উনি একদিন চলে আসেন। কাগজে লেখা ভাবীর কথাগুলো তাকে পড়তে দেই --
' আমি চোখ মেলেছি তোমাকে দেখতে। কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না যে! মহাপ্রস্থানের পথে আমি পা বাড়িয়ে। কত পথ পেরিয়ে কত দূরে চলে যাব একা। তোমাকেও একা রেখে যাচ্ছি... আমার খুব দুশ্চিন্তা হবে -- আমাকে ছাড়া তুমি তো ভালো থাকো না। দিব্বি রইল, পাগলামি করবে না। ঠিক মতো খাবে ও ঘুমাবে....।'
'আমি যে পথ দিয়ে চলে যাচ্ছি, ঐ পথে আমার পায়ের চিহ্ন চিনে তুমি আমার কাছে চলে এসো। আমি যেখানে যাচ্ছি -- সেই দেশ আমি চিনি না। ওখানে কী শীতলক্ষ্যা নদী আছে? পলাশের আমাদের বাড়ির উঠোনের মতো ঐখানে কী উঠোন আছে? বাড়ির আঙিনার মতো আছে কী অলকানন্দার ঝাড়....?'
ঐখানে ঐ নদীর তীরে অলকানন্দার ছায়াতলে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব। আমার ইহকাল কালের স্রোতে ভেসে গেল। পরকাল থাকল। তুুমি এসো পরকালেই। আমি জানি -- তুমি ঠিকই পথ চিনে আমার কাছে চলে আসতে পারবে। লক্ষ লক্ষ তারা আর জোনাকগুচ্ছ আলো দেখিয়ে দেবে তোমাকে। আর সেখানকার গন্ধবাতাস পথ চিনিয়ে তোমাকে আমার কাছে ঠিকই নিয়ে আসবে...।"
২৯. তেত্রিশ নম্বর
আমার এক জুনিয়র হলমেট ছিল, নাম খোকন। ও একদিন আমাকে বলছিল -- রঞ্জন দা, একটা অনুরোধ করব আপনাকে, রাখবেন? বললাম -- কী অনুরোধ? রাখার মতো হলে রাখব। তুমি বলতে পারো।
-- নাহ্! আমার একটু বলতে ভয়ই লাগছে। আপনি তো এই কাজটি করেন না! তাই বলতে দ্বিধা করছি।
-- আরে, তুমি বলে ফেলো তো।
ছেলেটি খুব বিনয় করে বলছিল -- আমার এক খালাম্মা আমাকে খুব করে ধরেছে, তার মেয়ের জন্য একজন বাংলার টিচার ঠিক করে দেওয়ার জন্য। মেয়েটা ভারতের মানালীতে এক নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। পরে আর ওখানে কন্টিনিউ করেনি। ঢাকায় এনে ক্লাস নাইনে ওকে ভর্তি করা হয়। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ও বাংলায় ভীষণ কাঁচা। খালাম্মার আশা, একজন টিচার রেখে দিলে বাংলায় পাস করতে ওর কোন অসুবিধা হবে না।
আমি খোকনকে বললাম -- আমি তো টিচার নই। কোনদিন কখনও কাউকে পাঠদান করিনি। তাছাড়া, আমাকে টিউশনি করতে হবে, এইকথা ভাবিনিও
আমি।
-- আমি জানি, তাইতো আপনাকে বলতে খুব ভয় লাগছিল। এই ছোট ভাইটার অনুরোধ একটু রাখেন রঞ্জন দা। মাত্র ছয়মাস আপনাকে পড়াতে হবে৷ আমি আপনার কথা অলরেডি খালাম্মাকে বলে ফেলেছি। ওনারা খুব আশায় আছেন। আপনি রাজি হোন। আপনাকে ওনারা খুব সম্মান করবেন।
কী আর করব! শেষপর্যন্ত আমার সেই জুনিয়র হলমেটের অনুরোধ আমাকে রক্ষা করতে হলো। আমি ওর কাজিনকে কয়েক মাস বাংলা পড়ানোর জন্য রাজি হয়ে যাই।
আমার এই ছাত্রীটির নাম নায়না। একদিন সন্ধ্যায়
হল থেকে হেঁটে হেঁটে চলে যাই এলিফ্যান্ট রোডের অ্যারোপ্লেন মার্কা মসজিদের পাশে ওদের বাসায়। মেয়েটি একদম বালিকা বয়স। চৌদ্দ পনের বছর হবে। ছিপছিপে গরণ। গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরীয়। চোখ দুটো টানা টানা। মায়াভরা চাহনি। আমি গিয়েছি ছাত্রী পড়াতে। ছাত্রীর রূপ দেখা আমার কাজ নয়। তবুও ওর মায়াবী রূপের কথা বলতে হলো।
আমি নায়নাকে বললাম -- তুমি কী বাংলায় ৩৩ নম্বর পেয়ে পাশ করতে চাও, নাকি ৪৫, অথবা ৬০ । কারণ, তুমি এই তিনটি থেকে যেটি চাও, সেই অনুযায়ী তোমার উপর শর্ত ও বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।
নায়না বললো-- ৩৩ নম্বর
আমি বললাম -- ঠিক আছে তাই হবে।
-- শর্ত ও বিধিনিষেধগুলো কী?
-- পরে আস্তে আস্তে জানতে পারবে। যেহেতু তুমি ৩৩ নম্বর চুজ করেছ৷, সেইক্ষেত্রে বিধিনিষেধ একটু কমই আরোপ হবে।
নায়না বলছিল -- আপনাকে কী বলে সম্বোধন করব? রঞ্জন দা, নাকি স্যার বলে।
-- স্যার বলে সম্বোধন করবে।
আমি নায়নাকে বললাম, কাল থেকে তোমাদের বাসায় ইংরেজি পত্রিকার পাশাপাশি বাংলা পত্রিকাও রাখবে। সাথে সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও চিত্রালীও রাখবে। এবং এগুলো পড়বে তুমি নিয়মিত।
-- জ্বি স্যার, পড়ব।
-- আর একটি কথা। যেহেতু তুমি ৩৩ নম্বর বেছে নিয়েছ, তাই তোমাকে সিলেবাস থেকেও পড়াব এবং সিলেবাসের বাইরে থেকেও পড়াব।
জ্বি, আচ্ছা।
আমি নায়নার বাংলা বইটি ওর হাতে দিয়ে বললাম -- মাইকেল মধুসূদন দত্তের " কপোতক্ষ নদ " কবিতাটি পড়ো। নায়না পড়ল ঠিকই কিন্তু অনেক ভুল উচ্চারণে। আমি ওকে আবৃত্তির মতো করে কবিতাটি পড়ে শোনালাম। এবং বললাম -- এরপর এই কবিতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও কবির জীবনী পড়াব।
তুমি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী পড়বে। এইটাই তোমার হোমটাস্ক।
আমি সপ্তাহে তিনদিন করে যেয়ে নায়নাকে পাঠদান করতে থাকি। মোটামুটি ভালোই অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু ওর মধ্যে কিছু মানসিক সমস্যা দেখছিলাম। নায়নার এই মানসিক সমস্যাটি আমার জুনিয়র বন্ধু খোকন আমাকে বলেছিল না।
মেয়েটি মানালীতে পড়তে যেয়ে একটি দূর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। রাজকুমার নামে এক রাজস্থানী তরুণের সাথে ওর গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। এক তুষার পড়া দিনে ওরা দুজনেই তুষারের উপর স্কিইং করেছিল। ছেলেটা হঠাৎ পা ফসকে আচমকা দ্রুতবেগে গিরিখাতে পড়ে যায়। ওকে আর খাত থেকে উদ্ধার করতে পারে নাই কর্তৃপক্ষ। অতল গিরিখাতেই ছেলেটির সমাধি হয়। সেই থেকে নায়না মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তারপর ওকে আর মানালীতে রাখা সম্ভব হয় নাই। ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়।
মেয়েটির মা একদিন অবশ্য আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলছিল -- তুমি ওকে পড়াবার পর থেকে ওর পাগলামি অনেক কমে গেছে। পড়াশোনায়ও বেশ মনোযোগী হয়েছে। আমাকে তুমি কী যে উপকার করেছ বাবা!
একদিন নায়নাকে বললাম -- তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'হৈমন্তী' গল্পটি পড়বে কমপক্ষে তিনবার। যদিও তোমার সিলেবাসে এটি নেই। সিলেবাসে আছে 'দেনাপাওনা'। এই হৈমন্তী গল্পটি পড়ে তোমার যে অংশটি বেশি ভালো লাগবে, তা আমাকে জানাবে। ওর হাতে একটি পিনআপ করা কাগজ দিয়ে বললাম -- এখানে গল্পটির আমারও ভালোলাগার কথাগুলো লেখা আছে। এখন খুলে দেখবে না। পরে দেখবে। দেখি তোমার সাথে আমার ভালোলাগা মিলে যায় কী না?
দুইদিন পর যেয়ে দেখলাম -- হৈমন্তী গল্পের ওর ভালোলাগার কথাগুলো একটি কাগজে লিখে রেখেছে। আমার পিনআপ করা কাগজটাও খুললাম-- দুজনেরই একই কথা লেখা। "... যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়াই দিলাম । এখন ফিরিয়া তাকাইতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে । অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই...।"
তখন একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে। আমি একদিন নায়নাকে পড়াতে যেয়ে বললাম -- ২০ ও ২১ তারিখ আসব না। আর্ট কলেজের ছাত্র- ছাত্রীদের সাথে ২০ তারিখে আমি রাজপথে আলপনা আঁকবো। আর একুশ তারিখ সকালবেলা যাব -- প্রভাতফেরিতে। গাইব নগ্নপায়ে গান -- "আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি?''
নায়না বায়না ধরেছিল সেও আমার সাথে রাজপথে আলপনা আঁকবে। ওর মাকে বলে গিয়েওছিল আলপনা আঁকতে। সারারাত রাজপথে আলপনা এঁকে সকালবেলা প্রভাতফেরি করে সেদিন নায়না বাড়ি ফিরে গিয়েছিল।
একসময় নায়নার পরীক্ষার তারিখ খুব কাছাকাছি চলে আসে। এই কয়মাসে নায়নাকে বাংলা বিষয়ে বেশ প্রস্তুতি করে তুলি। ওর ভিতর আমি একটি আস্থাও দেখলাম। আর এক-দুই দিন পড়িয়েই শেষ করে দেবো ভাবছি।
সেদিন ছিল ওকে পড়ানোর শেষ দিন। নায়নাকে বললাম -- কাল থেকে আর আসব না। তুমি ভালোভাবে পরীক্ষা দিও। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে তোমাকে অভিনন্দন জানাতে আর একদিন আসব।
নায়না মুখ নীচু করে আছে -- আমার কাছে মনে হলো, ওর চোখ ছলছল করছে। হ্যাঁ, মানুষের জন্য মানুষের মায়া হয়, আমার প্রতি ওরও হয়ত মায়া হয়েছিল। যেমন ওর জন্য আমারও খারাপ লাগছে। কটা মাস কী এক দায়িত্ববোধ যেন ছিল আমার । সেই দায়িত্ব পালন শেষ হয়ে গেল।
নায়না বলছিল -- 'স্যার, একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?' বললাম, বলো রাখবো।'
আপনি কোনদিন কোনও পর্বতমালায় যাবেন না। ওখানে কোনও তুষারপড়া দিনে তুষারের উপর দিয়ে হাঁটবেন না। বলেন -- রাজি আপনি!
বললাম -- আচ্ছা যাব না। রাজি।
-- 'স্যার, আমার এমন লাগছে কেন? কেমন যেন কান্না পাচ্ছে। ' দেখলাম -- নায়না কাঁদছে।
আমি নায়নাকে বললাম-- সামনে আমাদের ইউনিভার্সিটি সামারের বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি চলে যাব। তিন মাস ওখানে থাকব। ভালোই লাগবে ওখানে। নিঝুম সন্ধ্যায় যমুনার কূল ধরে হাঁটব। আকাশ জুড়ে দেখব ঘন নীল! অপূর্ব শীতল বাতাস জল ছুয়ে এসে লাগবে আমার গায়ে।
আমি নায়নার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। তখন সন্ধ্যা রাত্রি। এলিফ্যান্ট রোডের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি নীলক্ষেত মোড়ে। একটি টং চার দোকানে বসে চা খাই। একটা সিগারেট ধরাই। সিগারেট টানতে টানতে চলে আসি ভিসি স্যারের বাসার সামনে।
সেখানে রাস্তার উপর একধরনের অদ্ভুত আলো আঁধার বিরাজ করছিল। রেইনট্রির বড়ো বড়ো ডাল আর পাতার ফাঁক দিয়ে অসম্ভব সুন্দর চাঁদের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছিল রাস্তার উপর। তার কিছু আলো এসে লাগছিল আমার শরীরে। কী যে ভালো লাগছিল তখন! মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার এই কয়টি পংক্তি --
"...সবাই মানুষ থাকবে না।
কেউ কেউ ধুলো হবে, কেউ কেউ কাঁকর ও বালি
খোলামকুচির জোড়াতালি।
কেউ ঘাস, অযত্নের অপ্রীতির অমনোযোগের
বংশানুক্রমিক দুর্বাদল।
আঁধারে প্রদীপ কেউ নিরিবিলি একাকী উজ্জল।
সন্ধ্যায় কুসুমগন্ধ,
কেউ বা সন্ধ্যার শঙ্খনাদ।
অনেকেই বর্ণমালা
অল্প কেউ প্রবল সংবাদ... ।"
বাড়ি থেকে তিনমাস পর ফিরে আসি। ততদিনে নায়নার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। আমি খোকনকে জিজ্ঞাসা করি -- নায়নার রেজাল্ট কী? খোকন বললো -- প্রথম বিভাগ পেয়েছে। বাংলায় ওর নম্বর ৬০+। একবার ভাবলাম, একটি ফুলের তোড়া নিয়ে নায়নাকে একদিন অভিনন্দন জানিয়ে আসব। কিন্তু যাওয়া আর হয়নাই।মানুষের কিছু আবেগ ও মায়া নিষ্ঠুরতায় আটকে রাখতে হয়। প্রকাশিত করতে হয়না।
মেয়েটা হয়তো অপেক্ষা করেছে অনেক বিকেল।গণ্ডগামী হয়েছে অশ্রুবিন্দু। মানুষের এমন কত চোখের জল অগোচরে কালের কপোল তলে ঝরে পড়ে যায়, কে তা দেখে।
৩০. রিনি আন্টি
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। রেজাল্টও বের হয়নি। অনেকটা না চাইতে বৃষ্টির মতো একটি সরকারি প্রকল্পে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকুরি পেয়ে যাই। চাকুরিটা ভালো লেগেছিল এইজন্য যে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পকাজের মূল্যায়নের জন্য সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াতে হবে। আমরা কুড়িজন গ্রাজুয়েট ছেলেমেয়ে একসাথে যোগদান করেছিলামঐ প্রকল্পে কাজে। একটি আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, যোগদানকৃতদের মধ্যে আমরা ছিলাম দশজন ছেলে এবং দশজন মেয়ে।
সম্ভবত অফিসের তৃতীয় দিন হবে। অফিসে যেয়ে দেখি- একজন স্মার্ট ও সফিসটিকেটেড মেয়ে হালকা ঘিয়ে রঙের একটি টাংগাইলের শাড়ি পরে চুপচাপ বসে আছে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মাথার চুল বয়কাট করা। সিঁথি করা নেই। কিন্তু সিঁথির চুলের কাছে সিঁদুর লাগানো। হাতে শাখাপলা পরা। বয়স আমার চেয়ে দুতিন বছরের বড়ো হবে। লাবণ্যভরা মুখশ্রী তার। এক ধরণের কোমল সৌন্দর্য সারা মুখোয়বে ছড়িয়ে আছে।কেমন দেবী দেবী লাগছিল মেয়েটিকে।
সবার সাথে ওর পরিচয় হলো। ঐ মেয়েটি যখন ওর নাম পরিচয় বলছিল -- তখন জানলাম, মেয়েটির নাম আয়েশা নূর।
একটু বিস্মিতই হলাম। মেয়েটির মুসলিম নাম। অথচ হাতে তার শাখা পলা পরা, সিঁথিতে সিঁদুর। আমার মতো সবাই অবাক হলো ব্যাপারটি দেখে। কিন্তু তৎক্ষনাৎ কেউ কিছু বললো না। ভাবলাম, সবকিছুই পরে জানা যাবে।
আমাদের নতুন সহকর্মীদের ভিতর প্রথম থেকেই একটি 'তুমি' সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । যেহেতু আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে সদ্য পাশ করা তরুণ তরুণী, তাই হয়তো এমনটি হয়ে উঠেছিল। সহকর্মী নয়, আমরা সবাই যেন বন্ধু বান্ধবীর মতো। শিক্ষা সফরের ন্যায় ছোট ছোট গ্রুপে অফিসিয়াল ট্যুরে সারা বাংলাদেশে শহর গঞ্জ ঘুরে বেড়াতাম। বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরেই থাকতে হতো।
আয়েশা নূরের সাথে আমার বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেয়েটি ছিল একদম নিরহংকারী, অমায়িক ও স্বল্পভাষী । ওর বাবা ছিল অনেক বড়ো ব্যবসায়ী। ধানমণ্ডিতে ওদের বাড়ি। এত ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে কেন যে একটি অস্থায়ী চাকরি করতে এল! এই কথাটাই ভাবতাম।
আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম মেয়েটিকে। কেমন যেন সরল পাগলামি ছিল ওর ভিতর। সম্পূর্ণ একটা আলাদা ধরণ। পরিবারের সাথে একটু মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। আমরা পরে জেনেছিলাম -- আয়েশা নূর একটি হিন্দু ছেলেকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়নি। কী কারণে এই বিচ্ছেদ -- তাও জানা যায়নি।
ওকে একদিন কী মনে করে বললাম -- তুমি তো আমার বয়সে বড়ো। আমার এক ছোট খালার নাম আয়েশা। তোমাকে আমি খালা বলে ডাকব। মেয়েটি আমার প্রস্তাব লুফে নিল -- বললো, আজ থেকে তুমি আমাকে রিনি আন্টি বলে ডাকবে। উল্লেখ্য -- মেয়েটির ডাক নাম ছিল রিনি। ঐদিন থেকে আয়েশা নূর আমার রিনি আন্টি হয়ে গেল।
অফিসে এবং অফিসের বাইরে আমি ওর সহকর্মীর চেয়ে একজন ভাগ্নে হিসাবে মর্যাদা পেতে থাকলাম। প্রায় প্রতিদিন আমাকে অফিসে লাঞ্চ করাতো। সে বাসা থেকে বেশি করে খাবার নিয়ে আসতো। আমাকে বাইরে খেতে দিত না।
অফিসে হঠাৎ কখনও কখনও রিনি আন্টিকে খুব মন খারাপ দেখতাম -- বলতাম, 'তোমার কী হয়েছে আজ? মনখারাপ করে আছ যে!' সে বলতো, না, কিছুই হয়নি আমার।' মাঝে মাঝে আন্টিকে বলতে ইচ্ছে করতো -- তুমি সিঁথিতে সিঁদুর পরে থাকো কেন? কিন্তু বলতে সাহস হতো না। কারণ, সে ছিল দারুণ জেদি ও অভিমানী মেয়ে। ওর সাথে মিশে এই ব্যাপারটি আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
একবার অফিস থেকে আমরা কয়েকজন অফিসমেট ট্যুরে পটুয়াখালী যাচ্ছিলাম। সেই টিমে রিনি আন্টিও ছিল। একটি বড়ো লঞ্চ সদরঘাট থেকে সন্ধ্যার পর ছেড়েছিল। আমরা সেই লঞ্চের যাত্রী ছিলাম। কেবিনে কেউ কেউ সময় কাটানোর জন্য তাস খেলছিল, কেউ কেউ গল্প করছিল। লঞ্চটি তখন চাঁদপুর পার হয়ে মেঘনা নদী অতিক্রম করছিল। রিনি আন্টি কারোর সাথে কথা বলছিল না। আমমনা হয়ে চুপচাপ বসে আছে। রিনি আন্টির মন খারাপ দেখে আমারও মনটা ভালো লাগছিল না।
রিনি আন্টি আমাকে ডাকে -- রঞ্জন।
-- জ্বি।
-- চলো, বাইরে যেয়ে রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে মেঘনার জল দেখি।
-- চলো।
বাইরে রেলিঙের কাছে এসে দেখি -- আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। সারা আকাশ ছেয়ে আছে তারায় তারায়। আমি আর রিনি আন্টি রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে শুনছি মেঘনার ছলাৎছলাৎ জলের শব্দ। জলের উপর পড়া চাঁদের প্রতিবিম্ব ঢেউ লেগে ভেঙে যাচ্ছে। তারাদের কোনও ছায়া নেই। ওদের কোনো প্রতিবিম্বও নেই। দূরে চাঁদপুর শহরের জ্বলে থাকা নিওন বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে। আমি রিনি আন্টিকে ডাকি --
-- রিনি আন্টি।
-- বলো রঞ্জন।
-- তুমি এত মনখারাপ করে আছ কেন?
-- এখন রাত্রি কয়টা বাজে?
আমি আমার ঘড়ি দেখে বললাম -- রাত দেড়টা।
রিনি আন্টি কিছুক্ষণ জলের দিকে নীরব হয়ে চেয়ে রইল। আকাশের দিকে চেয়ে দেখে নেয় কমলা রঙের বিশালাক্ষি চাঁদ। আমি চেয়ে দেখলাম রিনি আন্টির চোখ ছলছল করছে। চোখে জল ভরে আছে কীনা আঁধারে বুঝতে পারলাম না। খুব ভেজা কণ্ঠে রিনি আন্টি বলছিল --
' জানো রঞ্জন, আজ এই চন্দ্রতারার পবিত্র রাতে, মেঘনার ঐ জলের দিকে চেয়ে জল ছুঁয়ে বলছি -- প্রতিদিন এইরকম মধ্যরাত পর্যন্ত আমি জেগে থাকি, ঘুম আসে না চোখে। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে একটি প্রদীপ জ্বালাই। তারপর অন্য আলোগুলো নিভে দেই। প্রদীপের আলোর দিকে চেয়ে থাকি। চেয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে যাই।
অন্ধকারে প্রদীপের আলো ক্রমে নিস্তরঙ্গ হয়ে ওঠে। আলোর মধ্যে কেমন যেন শূন্যতা দেখতে পাই। সেই শূন্যতার ভিতর একটা মুখ ছবির মতো ফুটে উঠে। একদম জীবন্ত মুখ, চোখের দৃষ্টিতে তার প্রাণপূর্ণ সজীবতা। সেই মুখখানার দিকে আমি মগ্ন হয়ে চেয়ে থাকি। নির্মল সেই মুখখানি দেখতে দেখতে আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।
একসময় প্রদীপের সলতে পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। প্রদীপ নিভে যায়। পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে ওঠে। সেই নিস্তব্ধ আঁধারের ভিতর সেই মুখটি আর দেখতে পাই না। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। এবং কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে যাই।
জানো রঞ্জন, প্রদীপের আলোয় যে মুখখানি আমি দেখি- সেই মুখটি আমার প্রদীপের। সেই অবয়বটি প্রদীপ দেব বর্মনের।
-- সে এখন কোথায় আছে? আমাকে বলবে?
-- সে নেই। কোথায় আছে, তাও জানিনে।
-- আমি বেশি কিছু জানতে চাইলাম না। শুধু বললাম, তুমি সিঁথিতে সিঁদুর আর হাতে শাখাপলা পরে থাকো কেন?
-- এমনি, তাকে স্মরণ করে পরে থাকি।
আমরা পটুয়াখালীর ট্যুর শেষ করে ঢাকায় চলে আসি। লঞ্চে ফিরতে ফিরতে রিনি আন্টি বলেছিল -- 'আমার জীবনের কিছু গোপন ব্যাথার কথা এই তরঙ্গ নিনাদের জলপথে চলতে চলতে কেবল তোমাকেই বললাম। এই কথা আর কাউকে বলো না।'
-- না, বলব না।
দিনের পর দিন আমি রিনি আন্টির অবিসংবাদিত একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। আমিও তাকে সময় দেই। আমি চাইতাম, আমার এই রিনি আন্টি মনের দিক থেকে ভালো থাক। সে ভুলে যাক, একজন প্রদীপ দেব বর্মনকে। সে ভুলে যাক তার বিষণ্ণ অতীত। নতুন কোনও জীবনের গান সে শুনুক।
কতো বিকেলে রিনি আন্টি আমাকে নিয়ে গেছে এই শহরের কত জায়গায়, কত রেস্টুরেন্টে। নিয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। কত সন্ধ্যা অবধি বসে থেকেছি রবীন্দ্র সরোবরে। কড়োই গাছের কত শুকনো পাতা ঝরে পড়েছে, শুনেছি কত পাখিদের কিচিরমিচির। কত বিমল সন্ধ্যা নেমেছে ছায়ার মতো অন্ধকারে। তখন জীবনানন্দ দাশের কবিতার এই পংক্তিগুলো ধ্বনিশ্রুত হতো কানে --
'...মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব
বেদনার গন্ধ ভাসে....
কতদিন মলিন আলোয় বসে দেখেছি
বুঝেছি এই সব;
সময়ের হাত থেকে ছুটি পেয়ে স্বপনের গোধূলিতে নামি
ধূসর আলোয় বসে কতদিন দেখেছি বুঝেছি
এইসব...।'
একবার কী এক অসুখ হলো আমার। ঠাণ্ডা জ্বর ও কাশি। কয়েকদিন অফিসে যেতে পারিনি। আবার অফিসে খবরও দিতে পারিনি। থাকতাম আমি আমার নির্জন বাড়িতে একা। তখন বিকাল হয়ে এসেছিল। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে রয়েছিলাম। হঠাৎ ঘরের মধ্যে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আধো অন্ধকারে চোখ মেলে দেখি -- একটি মেয়ে আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। খেয়াল করে দেখলাম, রিনি আন্টি। বললাম -- ' রিনি আন্টি! তুমি হঠাৎ এখানে ? চিনলে কীভাবে বাড়ি?'
-- হ্যাঁ আমি। পথ চিনে চিনেই এলাম তোমার ঘরে।
তা তোমার কী হয়েছে রঞ্জন? কোনও অসুখ হয়েছে? অফিসে যাও না কেন?
বললাম -- সামান্য অসুখ হয়েছে। ভালো হয়ে যাব।দুএক দিনের মধ্যে অফিসে যাব।
-- ঘর অন্ধকার, আলো জ্বালওনি যে।
-- এখানে নিওন বাতি এখনও আসেনি। হারিকেন জ্বালাতে হয়।
সেদিনের সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে রিনি আন্টি আমার ঘরে আলো জ্বালালেন। তার আঙ্গুলের করস্পর্শ পড়লো আমার কপালে। ক্ষিণ মায়াকণ্ঠে বললো-- 'এইভাবে কোনকিছু না জানিয়ে কেউ কখনও থাকে? কারোর বুঝি দুশ্চিন্তা হয় না?' রিনি আন্টি আমাকে খাবার খাওয়ালেন। ঔষধপথ্য কী খেয়েছি, না খেয়েছি সবকিছুর খোঁজ নিলেন।
আর একবার আমরা বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে ট্যুরে গিয়েছিলাম যশোরের ঝিকরগাছায়। আমরা ছিলাম ওখানকার একটি ডাকবাংলোয়। অফিসিয়াল এ্যাসাইনমেন্টে আমাকে আর রিনি আন্টিকে যেতে হবে গদখালি ইউনিয়নের একটি গ্রামে।
তখন ছিল জৈষ্ঠ্যের তপ্ত দুপুর। বাংলো থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকি। ভালোই লাগছিল পাকা রাস্তার উপর বড় বড় রেইনট্রির ছায়া। কী সুন্দর রোদ্দুর এসে পড়ছিল আমাদের গায়ে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একসময় মেঠো আলপথে নেমে পড়ি।
হেঁটে যেতে যেতে পথের দুপাশে দেখেছিলাম গ্লাডিওলাস ফুলের প্রান্তর। রঙ বেরঙের ফুলের ফাঁকে ফাঁকে গ্রীষ্মের ফালি ফালি রোদ খেলা করছে ঝাড়ে । কখনও গ্লাডিওলাসের সৌরভের সাথে কেমন যেন মৌ মৌ সুর ধ্বনিত হচ্ছিল বাতাসে। কেমন যেন মর্মর মায়া হিল্লোলিত হচ্ছিল মেঠো পথের ধূলির উপরে। বাঁশি বেহালা আর পিয়ানো যেমন করে অ্যাকর্ডিয়নে একের পর এক মায়া জড়িয়ে যায়, তেমন করে নির্জন ফুলের প্রান্তরে ভালবাসার পাখিরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিল।
এখানে কেউ কোথাও নেই। চারিদিকে এত ফুল, এত সৌরভ, উপর থেকে ঝুলে পড়া এমন নির্জন নীল আকাশ, ফুলের বনে ফড়িং আর হলুদ প্রজাপতিদের এত গান। মনটা কেমন যেন উদাস উদাস লাাগছিল। আমি রিনি আন্টিকে বললাম -- দেখো, চারিদিকে চেয়ে। আমরা এসেছি ফুলের দেশে। দেখো চেয়ে পথের দুপাাশের আচ্ছাদিত ফুলের প্রাান্তর। চলো আমরা এই ফুলের পাশ দিয়ে ওদের সুগন্ধি নিয়ে হাঁটতে থাকি। আমরা যাব এখন কৃষ্ণপুর গ্রামে। যদি ক্লান্তি লাগে ফুলের বনে ঝাড়ের পাশে জিরিয়ে নিও।
আমরা হাঁটছি। দেখলাম-- গ্লাডিওলাসের পর শুরু হলো হলুদ গাঁদা ফুলের প্রান্তর। অফুরন্ত সেই ফুলের পথ! হাঁটতে হাঁটতে রিনি আন্টি যেন আর পথ চলতে পারছিল না। সে বসে পড়লো। সেইদিন সেই দুপুরে ফুলের ক্ষেতের পাশে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল রিনি আন্টি। যেন সে নীল রঙের একটি গোলাপ ফুল হয়ে লক্ষ লক্ষ গাঁদা ফুলের মাঝে হারিয়ে গেছে। দেখলাম -- তার শরীরময় গাঁদা ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু লেগে আছে।
রিনি আন্টি একসময় জেগে ওঠে। চারদিকে ছিল তখন অসীম মৌনাতা। হঠাৎ সেই মৌনতা ভঙ্গ করে রিনি আন্টি আমাকে বললো -- 'এবার ঢাকা যেয়ে চাকরিটা ছেড়ে দেবো।'
আমার অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল। আমি বললাম -- কী হয়েছে তোমার রিনি আন্টি?
-- কিছু না।
-- তা চাকরি ছেড়ে দেবে কেন?
-- এমনই। চাকুরি করতে আর ভালো লাগছে না।
আমি সেইদিন সেই ক্লান্ত দুপুরে রিনি আন্টিকে কিছুই বললাম না। আমি জানি, রিনি আন্টি খুব জেদি মেয়ে। সে যা বলে তাই করে।
যশোর ট্যুর শেষ করে আমরা ঢাকায় চলে আসি। দুইদিন বাড়িতে রেস্ট নিয়ে তৃতীয় দিনের দিন অফিসে যাই। অফিসে যেয়ে দেখি -- রিনি আন্টি আসেনি। পরের দিনও এল না। তারপরের দিনও এল না। রিনি আন্টি আর কোনদিন অফিসে আসেনি। এ্যাকনোলজমেন্ট করা একটি রেজিস্ট্রি ডাকে সে তার পদত্যাগ পত্র অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
অফিসটা কেন জানি আর ভালো লাগছিল না। কোথাও কী এক গভীর শূন্যতা আঁকড়ে ধরতো আমাকে। রিনি আন্টির সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম দেখা করতে , কিন্তু তার দেখা পাইনি। ওনাদের বাড়িতে আগে থেকেই কাউকে নিত না সে। আমাকেও না। হয়তো পারিবারিক কোনো অসুবিধা ছিল।
আমি এই অফিসটা ছেড়ে দিয়ে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে চলে যাই। ইতোমধ্যে জীবনে আরও কতগুলো ওলট-পালট হয়ে গেল। বছর তিনেক পর বিয়ে করলাম। রিনি আন্টির শূন্যতায় এই পৃথিবী কেমন যেন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। জীবনটা বিস্বাদ হয়ে থাকতো, আশা-আনন্দের কোনও অনুভবই অনুভূত হতো না।
তারপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেল। নতুন জীবনে আনন্দের স্বাদ পেলাম। জীবনটাকে আর আনন্দহীন করে রাখলাম না। কত বড় বড় সুখের আতিশয্যে জীবনকে ব্যাপৃত করে রাখলাম। কবেকার সেই একজন রিনি আন্টির স্নেহ ভালোবাসা অন্তর থেকে মুছে যেতে লাগলো। একদিন যে স্নেহ মমতা পরম বলে মনে হতো, তাই একদিন তুচ্ছ হয়ে গেল।
অনেক বছর পর একটি ব্যাবসায়িক কাজ সেড়ে ফরিদপুর থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। ফেরীতে পার হচ্ছিলাম পদ্মা নদী। ফেরীটি যখন আরিচা ঘাটে ভীড়ছিল, তখন দেখি -- একটি মধ্যবয়সী রমণী ঘাটে পদ্মা তীরে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় আধো ঘোমটা দেওয়া। চিনলাম তাকে। এ যে আমার সেই রিনি আন্টি। আমি ফেরী থেকে নেমে তার কাছে যাই। ডাক দেই -- রিনি আন্টি।
রিনি আন্টি স্থিরদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে দেখলো কতক্ষণ । তারপর বললো -- তুমি কেমন আছো রঞ্জন?
বললাম -- ভালো আছি। তবে তুমি এখানে কেন? কোথায় যাচ্ছ তুমি ?
-- আমার জীবনের কত কথাই তোমাকে বলা হয়নি। তুমি হয়তো আমাকে ভুল বুঝেছিলে -- কেন সেদিন অফিস ছেড়ে, তোমাকে ছেড়ে অমন আচম্বিতে চলে এসেছিলাম। তুমি চেয়ে দেখো - আমার সিঁথিতে এখনও সিঁদুর লাগানো আছে, হাতে এখনও শাখাপলা পরে থাকি। আজ এই পদ্মাতীরে দাঁড়িয়ে তোমাকে একটি কঠিন সত্য বলছি -- কেন জানি আমার মনে হয়েছিল -- আমার সিঁথির সিঁদুর তুমি মুছে ফেলবে একদিন, হাতের এই শাখাপলা তুমি খুলে ছুড়ে ফেলে দেবে কোনও অতল দিঘিতে। তাই সেদিন তোমাকে ত্যাগ করে চলে এসেছিলাম। আর...
-- বললাম, আর কী?
রিনি আন্টিকে বহন করা গাড়িটা তখন ফেরীতে উঠার জন্য বারবার হুইসেল দিচ্ছিল। রিনি আন্টি যেয়ে গাড়িতে বসেন। গাড়িতে উঠতে উঠতে তিনি বলেছিল -- 'আমি একটি স্মরণ কাজে বের হয়েছি। মনে আছে কী তোমার.....।'
তার কথাটি ছিল অসমাপ্ত। শেষ শুনতে পারিনি।
ফেরীটি ততক্ষণে কর্কশ হুইসেল বাজিয়ে কালো ধূয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ছেড়ে চলে যায়। আমি চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ পদ্মার আলোড়িত জলের দিকে।
পুনশ্চঃ--
যদি কোনদিন এই পৃথিবীর কোথাও রিনি আন্টির সাথে আবার দেখা হয়, তবে তার সেই অসমাপ্ত কথা ও তার জীবনের আরও কিছু কথা জেনে এই আখ্যানের বাকিটুকু পূর্ণ করে দেবো।
৩১. পথের বাঁধন
অনেক বছর আগে রাউজানের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম কলমপতি থেকে রিকশায় করে ফিরছিলাম থানা সদরে। তখন ছিল সন্ধ্যা পূর্ব বিকেল। শুকনো কাঁচা রাস্তা ছিল। পথের দুপাশে উঁচুনিচু টিলা। টিলার গায়ে লতাগুল্ম, কোথাও আবার বাঁশঝাড়। শাল, মেহগনি, জারুল ও বনফুলসহ মহুয়া গাছের বিস্তীর্ণ সারি।
ঐসব বৃক্ষ আর লতাপাতার উপর বিকেলের সোনা রোদ ঝলমল করছিল।
ঠিক পিছনেই অস্তমিত সূর্য। রোদের রঙ দেখে মনে হচ্ছিল এখন সময় শুধু লাল আভা বিচ্ছূরণের! এই রকম স্বর্ণালি রোদ্দুর গায়ে মেখে রিকশার হুডি ফেলে আসছিলাম আমি আর সীমা ভাবি। সামনে পথের উপরে আমাদের দুজনের ছায়া পড়েছিল। রিকশাটি চলছিল সদর থানার দিকে।
সীমা ভাবি আমার ক্ষণকালীন সহকর্মী ছিল। বিয়ে হয়েছে মাত্র বছর দুয়েক আগে। শরীর ও মননে তখনও তারুণ্যের ছোঁয়া বিরাজমান ছিল। কখনও সে চঞ্চলা উচ্ছ্বলা হরিণীর মতো একটি মেয়ে । আবার মুহূর্তেই সে গম্ভীর, দায়িত্ববান রমণী। কখনও সে বন্ধুর মতো একজন। আবার কখনও সে কারোর প্রেমময়ী স্ত্রী। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় ছিল সে। বন্ধু হলেও তাকে সীমা ভাবি বলে ডাকতাম।
আমরা কয়েকজন ছেলেমেয়ে সেইবার রাউজানে গিয়েছিলাম একটি অফিসিয়াল ডাটা উপাত্ত সংগ্রহের কাজে। আর এই কাজ করতে যেয়েই আমাকে আর সীমা ভাবিকে ঐদিন যেতে হয়েছিল সেখানকার একটি পাহাড়ি গ্রাম কলমপতিতে।
আমরা দুজন পথ দিয়ে আসতে আসতে দেখছিলাম পথের ধারে সাদা ও লাল রঙের মর্নিং গ্লোরীর মতো ছোট ছোট ফুল। সারি সারি টিলার ফাঁক দিয়ে হুহু করে বয়ে আসছিল বাতাস। আর সেই বাতাসে ভেসে আসছিল যত নাম না জানা বনফুলের গন্ধ! আমি সীমা ভাবিকে বলছিলাম -- 'এখন তো গানের সময়, একটা গান গাও তুমি ।'
সীমা ভাবী বলছিল --
'এখন কোনও গান নয়, কোনও কথাও নয়। এখন শুধু চুপচাপ করে সব দেখবার সময়। তুমি আমলকী পিয়ালি আর মহুয়া বন দেখতে থাকো।'
আমি বললাম --
'কী উজ্জ্বল বিকেল আজ! কমলা রঙের রোদ্দুর এসে পড়েছে বৃক্ষরাজির সবুজ পাতার উপর! অপূর্ব লাল আভায় ভরে উঠেছে চারদিকে। এই রোদ্দুর, এই বিকেল ভালো লাগছে না তোমার ? কেন গাইবে না তুমি গান ,
বলো? '
-- তোমার নাম রঞ্জন না হয়ে যদি অমিত হতো, তাহলে বলতাম -- গান নয় আজ, একটি কবিতা আবৃত্তি করো তুমি অমিত রায়ের মতো। '
-- তুমি গান গাইবে না বলে আমি কবিতা আবৃত্তি করতে পারব না! এত সুন্দর মহুয়ার গন্ধের বিকাল আজ! আর তোমাকে একটি কবিতা শোনাব না, তাই কী হয় কখনও? ভানু চক্রবর্তী শুধু অমিতের জন্যই কবিতা লেখেননি, সে আমাদের জন্যও লিখেছিল --
পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য,
হঠাৎ-আলোর ঝল্কানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।
আমার মুখ থেকে কবিতা কেড়ে নিয়ে সীমা ভাবি নিজেই বাকি অংশ আবৃত্তি করতে থাকে --
নাই আমাদের কনকচাঁপার কুঞ্জ,
বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।
হঠাৎ কখন্ সন্ধ্যাবেলায়
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
অরুণকিরণে তুচ্ছ
উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেন্ড্রন্ গুচ্ছ।
কখনও চুপচাপ, কখনও কথা বলতে বলতে আমরা অনেকটা পথ চলে আসি। জনশূন্য বনভূমির সেই পথ। সীমা ভাবি বলছিল -- 'রঞ্জন, রিকশাটা ছেড়ে দাও। বাকি পথটুুকু আমরা হেঁটে হেঁটে চলে যাই!'
রিকশা থেকে নেমে আমরা সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। চারদিকে সারি সারি টিলা। সন্ধ্যা হয়নি তখনও। কেমন যেন চাপা বাতাস বইছিল। এক জায়গায় দেখলাম - ছোট বড় নুড়ি বিছানো পথ। পা ফসকে পড়ে যাবার আশঙ্কা আছে। সীমা ভাবি বলছিল -- 'রঞ্জন তুমি আমার হাত ধরো।'
আমি সীমা ভাবির হাত ধরি।
বাকি পথটুকু আমার হাত সে আর ছাড়ল না। পথ চলতে যেয়ে কিসের যেন এক ভয় পাচ্ছিল ভাবি! নির্জন বন লোকালয়ে কণ্ঠরোধ হয়ে আসার মতো সন্ধ্যা নামছিল তখন। এক লাবণ্যময় আঁধার হয়ে আসছিল ঐ পথের উপরে।
আরও কিছু পথ আসার পর দেখি, পাশে একটি ছোট্ট পাহাড়। একটি মৃত ঝর্ণাও দেখতে পেলাম। বৃষ্টির স্বরূপে ঝিরঝির করে জল ঝরে পড়ছে। সঙ্গীতের মতো পানিরও এমন কলকল শব্দ হয়! জলের এমন সিম্ফনি কানে আসতেই ক্ষণিক বিমোহিত হয়ে পড়ি আমরা। টপটপ জলপতন শুনে বিষণ্ণ হলো মন। আবার প্রশান্তি জাগানিয়াও মনে হলো। অনেকটা পথ ঝর্ণার ঐ কলকল শব্দ শুনতে শুনতে চলে আসি।
আমরা চলতে থাকি সামনের দিকে। তখন সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার হয়েছে! বন মোরগ আর টুনটুনির ডাক শোনা যাচ্ছিল। নাম না জানা আরো পাখির ডাকও শুনতে পাচ্ছিলাম। মাঝে এক ফাঁকে পিছনে ফিরে দেখেছিলাম সূর্যাস্ত। সে এক অপূর্ব দৃশ্য । নির্জন বন ক্রোড়ে কিছু অপার্থিব সৌন্দর্য আস্বাদন করে নিতে হয়। আমরা নিয়েছিলাম তাই। নিজেদের বঞ্চিত হতে দিইনি।
পথ যখন ফুরিয়ে আসছিল, তখন সীমা ভাবি আরও নিবিড় করে আমাকে জড়িয়ে নিচ্ছিল। নিঝুম স্তব্ধতার মাঝে আমি বলেছিলাম -- 'আজিকার মতো এমন সন্ধ্যা, এমন মায়াময় আঁধার আর কোনদিন পাবো না। পৃথিবীতে কিছু স্বর্গীয় ক্ষণ মানুষের জীবনে আসে, যা থেকে মণিরত্ন কুড়িয়ে নিতে হয়।'
এই পথ চলতে তেমনই কিছু উজ্জ্বল মুহূর্ত পেলাম। এবং তা একান্ত করে নিলাম। হয়তো এটা কোনও পরম পাওয়া নয়। কিন্তু যা পেলাম তা সারা জীবনকালের জন্য পরম হয়ে থাকল।
সব পরম পাওয়া কাউকেই দেবার হয় না , সেই সত্য কথা বুঝতে পেরে মানুষ নাকি কাঁদে। সীমা ভাবি সেই সত্য কথাটি বুঝতে পেরেছিল। তাই সেদিন সেই সন্ধ্যায় পথের উপর দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল সে। 'চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে/ পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা--দুখের মাধুরীতে করিল দিশাহারা....।'
আমাদের সেই কর্মকাল একদম ক্ষণকালের ছিল।
সীমা ভাবি চলে গিয়েছিল অন্য কর্মে, আর আমি থেকে গিয়েছিলাম আমার কর্মলোকে।
তারপর কত বছর চলে গেছে! আমার সমগ্র জীবন কালের উপর কত রাত্রির ছায়া এল, কত সন্ধ্যা!
কত কর্মে , কত ভাবনায়, কত বিভ্রমে ভেসে উঠত সীমা ভাবির মুখ! কত পথ পেরিয়ে এলাম এই জীবনে! কোথাও কোনও অপার্থিবে সীমা ভাবির সেদিনের সেই কান্নার শব্দটি নিঃশব্দ হলো না !
৩২. নদীর নাম সুবর্ণরেখা
সিফাত ওর বাবার পুরোনা বুকশেলফ থেকে একদিন একটি ডায়েরি খুঁজে পায়। ঠিক ডায়েরিও নয়, একটি বাঁধানো খাতার মতো অনেকটা। খাতার পাতাগুলো এত পুরোনো ও জীর্ণ হয়ে গেছে যে ধরলেই মরমর করে ছিঁড়ে যায়।
সিফাত খুব আস্তে করে খাতার পাতা গুলো উল্টায়ে পড়তে থাকে। সে ডায়েরিটা পড়ে বুঝতে পারে এটি তার প্রপিতামহ মৃত ফয়জুর রহমানের । ঝরনা কলমে লেখা ডায়েরির অনেক শব্দ, অনেক অক্ষর ঝলসে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
ডায়েরিতে সিফাতের প্রপিতামহ ঐ সময়ে ঘটিত গ্রামের বিভিন্ন ঘটনা, তার নিজের স্মৃতিকথা, আত্মীয় স্বজন ও গ্রামের বিভিন্ন মানুষের জন্ম ও মৃত্যু তারিখ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। ব্যক্তিগত অনেক কথাও লেখা আছে। আছে অনেক ঐতিহাসিক তথ্যও । কোথাও কোথাও কাব্যিক ভাষায় অনেক গদ্য পদ্যও তিনি লিখে রেখেছেন।
একজায়গায় লেখা আছে --
'২৫ শে চৈত্র, ১৩২৮ বাং
আজ দুপুরের পর হইতেই মনটা কেমন উতলা হইয়া উঠিল। আমগাছের শাখা হইতে এক সুমধুর কোকিলের কুহু ধ্বনি ভাসিয়া আসিতেছিল। সে এক সঙ্গীত মুখরিত কলকাকলি পুষ্প সুবাসা মোদিত সুর যেন । প্রেমোচ্ছল আজকের এই বসন্তদিনে—কোথায় যেন শূন্যতা অনুভব করিতে লাগিলাম। মনে হইল অদূরে ঐ সুবর্ণরেখা নদীর কূলে চলিয়া যাই। ওখানে কদম্বতলে এই অস্ত দুপুরে বসিয়া বাঁশি বাজাই।'
এইটুকু পড়ে সিফাত অবাক হয়ে যায়। সেই কত বছর আগের কথা। আজ থেকে শত বছর আগেও পৃথিবী এমনি সুন্দর ছিল, এমনি বসন্ত নামত পাড়াগাঁয়ের ঐ বন-বুকে কুঞ্জে, এমনি কোকিল ডাকত রাত্রিদিনে। সুবর্ণরেখা নদীটি না জানি কত সুন্দর ছিল ! কেমন ছিল তার জল, নদীর পাড়? তখনও কী বালুচরে কাশফুল ফুটে থাকত? নানা কৌতূহল সিফাতের মনে উঁকি দিতে থাকে।
সিফাতের দাদা গত শতকের মাঝামাঝিতে চাকুরি উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়ে ঢাকাতে এসে থিতু হয়েছিল। সিফাতের বাবার জন্ম এই ঢাকাতেই। সিফাতের জন্মও ঢাকায়। মোটামুটি দুই পুরুষ ধরে তারা গ্রাম ছাড়া। পৈত্রিক ভিটা এখনো আছে কী নেই, সে কথা সিফাত জানে না। ওর বাবা এক বছর আগে মারা গিয়েছে। মা জীবিত আছেন।
সিফাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় অনার্স শেষ করেছে। এখন মাস্টার্স করছে। ও বরাবর অনুসন্ধিৎসু একটি ছেলে। প্রপিতামহের লেখা পুরনো এই ডায়েরিটি পড়ে তার ভিতর একটি কৌতূহল জেগেছে -- সে তাদের পৈত্রিক ভিটা দেখবে। এবং দেখবে সুবর্ণরেখা নদী।
সে তার মাকে বলে -- মা, আমি আমাদের পৈত্রিক ভিটা দেখতে যাব।
-- তোদের পৈত্রিক ভিটা এখন আছে কী না আমার জানা নেই। আমিও কখনো যাইনি। আমি আমার জীবনকাল এই ঢাকা শহরের ওয়ারীর এই বাড়িটিই শ্বশুরবাড়ি হিসাবে জেনে এসেছি। তোর বাবাও কখনো সেখানে যায়নি। আমি শুনেছি -- জায়গা জমি যতটুকু ছিল তা আমার শ্বশুরমশাই বিক্রি করে দিয়ে এই ঢাকা শহরে এসে স্থায়ী হয়েছিলেন।
-- তুমি কী জানো আমাদের সেই গ্রামের নাম কী ছিল?
-- আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, কুসুমপুর। বৃহত্তর পাবনা জেলায় সিরাজগঞ্জ মহুকুমায় এই গ্রামটি অবস্থিত। ট্রেনে গেলে সলোপ স্টেশনে নামতে হয়, এইটুকু জেনেছিলাম। আর তোর বাবার মুখে শুনেছিলাম তাদের বংশীয় একজন চাচীর কথা। সে সম্ভবত এখনো জীবিত আছেন, নাম হালিমা বিবি।
এক ফাগুন মাসের শুক্লপক্ষের দিনে সিফাত একটি ট্রাভেল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে সাথে একটি ক্যামেরা নিয়ে তাদের পৈত্রিক ভিটা দেখবার উদ্দেশ্য ঘর হতে বেরিয়ে পড়ে।
২.
ট্রেন থেকে সিফাত যখন সলোপ স্টেশনে এসে নামে তখন বিকাল হয়ে যায়। ছোট্ট একটি স্টেশন। ট্রেন যখন এসে থামে তখন একটু জন সমাগম হয়। ট্রেন ছেড়ে চলে গেলে সারা স্টেশন নির্জন হয়ে যায়। একটি মধ্যবয়সী লোক স্টেশনে বসে ঘোল বিক্রি করছিল। সিফাত তার কাছে থেকে দুই গ্লাস ঘোল খেয়ে নেয়। তারপর ঐ লোকটিকে বলে -- 'চাচা, এখান থেকে কুসুমপুর কতদূর?'
-- তা ছয় মাইল হবে।
-- কীভাবে যাব?
-- বাইস্যা মাসে তুমি আসলে নৌকায় যেতে পারতে। এখন হেঁটে যেতে হবে। তা ওখানে কার বাড়িতে যাইবা?
-- ( আমি আমার দাদার নাম বললাম।) আনিসুর রহমানের বাড়ি যাব।
-- ওনারা কেউ তো এখানে থাকে না। এই দেশ গ্রাম ছেড়ে বহু বছর আগে চলে গেছে।
-- জানি।
-- ঐ বাড়িতে একজন বুড়ী থাকে তার এক নাতনিকে নিয়ে। তুমি কী হও তার?
-- আমিও তার নাতি হই।
সিফাত ঐ লোকের কাছে থেকে কুসুমপুর যাওয়ার পথ নির্দেশনা জেনে নেয়। তারপর সে হাঁটতে শুরু করে।
সিফাত থানা পরিষদের কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। সে এর আগে এমন নিবিড় গ্রামে কখনো আসে নাই। পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি এই দেশ। কী সুন্দর নীল আকাশ এখানে। কেন যে এতকাল সে এখানে আসে নাই ! সে হাঁটছিল আর মনে মনে আফসোস করছিল। সে কী জানত এত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এই গ্রাম বাংলার সবুজ শ্যামল মাঠে প্রান্তরে। এত সুন্দর করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে এখানে। গাছে বাঁশ ঝাড়ে পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। কৃষক হাল গরু লাঙল নিয়ে ফিরে যাচ্ছে ঘরে। একটু পর রাত্রি নামতে থাকে। ঘরে ঘরে টিম টিম করে কুপী- হ্যারিকেন জ্বলে ওঠে। কী সুন্দর রাত্রির গন্ধ ।
সিফাত যখন কুসুমপুর পৌঁছে তখন সন্ধ্যা রাত্রি হয়ে যায়। ওখানকার এক লোককে জিজ্ঞাসা করে হালিমা বিবির বাড়িটি চিনে নেয় সে।
বাড়িতে পৌঁছে সিফাত দেখতে পায় একটি চারচালার টিনের ঘরে একটি হ্যারিকেন বাতি জ্বলছে। সিফাত আওয়াজ করে ডাক দেয় -- 'বাড়িতে কে আছেন?' একটি চৌদ্দ পনেরো বছরের বালিকা হ্যারিকেন নিয়ে উঠোনে এগিয়ে আসে। মেয়েটি সিফাতের মুখের উপর আলো ফেলে জিজ্ঞাসা করে -- 'আপনি কে?'
-- আমি সিফাত, হালিমা দাদিমার কাছে এসেছি। ওনার সাথে আমি দেখা করব। ওনার কাছেই আমি আমার পরিচয় দেব। উনি আমাকে চিনতে পারবেন।
-- আসুন ঘরের ভিতর।
ঘরে ঢুকে হালিমা বিবিকে পায়ে সালাম করে বলে-- দাদিমা, আমার নাম সিফাত রহমান , বাবার নাম -- আশিকুর রহমান, দাদার নাম -- আনিসুর রহমান, তৎ-পিতার নাম ফয়জুর রহমান।
বৃদ্ধা হালিমা বিবি হ্যারিকেনের আলোয় সিফাতকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলে --- ওরে আমার সোনা, আমাদের কথা, এই দেশের কথা তোমার তবে মনে পড়েছে !
এতক্ষণ বালিকাটি বিস্ময়ে শহর থেকে আগত সিফাতকে দেখছিল। হালিমা বিবি মেয়েটির সাথে সিফাতকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে -- এই মেয়েটি আমার ছেলের ঘরের নাতনি। পিতৃ-মাতৃহীন, আমি ছাড়া এই জগতে ওর আর কেউ নেই । সম্পর্কে তোমার চাচাতো বোন হয়। ওর নাম লিলি।
সেই সন্ধ্যা রাতেই লিলিকে নিয়ে হালিমা বিবি ঢাকা থেকে আগত তার নতুন নাতির জন্য রান্না করলেন। মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে খেতে দিলেন। হলদে রঙের পেইজরা চালের ভাত, পেঁপে ভর্তা, মুগের ডাল, কোরলা ভাজা, নন্দই মাছের তরকারি। সরপড়া গরুর দুধ, দুটো সর্বি কলা ও আখের গুড়ের পাটালি। অদ্ভুত রান্না হালিমা বিবির হাতের।
সিফাত তৃপ্তি সহকারে খেয়ে বলে -- দারুণ রান্না করেছেন দাদিমা।
সিফাত ওর দাদিমাকে বলে -- 'আমি এখানে দুই দিন থাকব। ঘুরব ফিরব আর খাব। ' লিলিকে বলে, ' তুমি আমার সাথে সাথে থাকবে। তোমাকে নিয়েই ঘুরব।
লিলি মাথা নেড়ে বলে -- আচ্ছা।
-- তুমি কোন্ ক্লাসে পড়ো?
-- ক্লাস নাইনে। কিন্তু এখন আর স্কুলে যাই না।
-- কেন যাও না?
-- আমাদের স্কুল দেড় মাইল দূরে। পথে বোখাটে ছেলেরা আমাকে খুব জ্বালাতন করে। হুমকিও দেয়। ওদের ভয়ে যাই না।
-- ওহ্ আচ্ছা।
৩.
কী সুন্দর এই বাড়িটিও। পশ্চিম পার্শ্বে বাঁশবন, আমবন। ফলের বাগান যেন প্রাচীন অরণ্যে পরিণত হয়েছে। এই বাড়িতে নির্জন দুটো মানুষ শুধু থাকে। আর যারা আছে, দুজন কামলা ও একটি কাজের মহিলা। তারা কাজ কর্ম করে সন্ধ্যা রাতেই চলে যায়।
সকালবেলা দরজা খুলেই একঝলক সকালের রোদ্দুর এসে সিফাতের গায়ে লাগে। এত পরিচ্ছন্ন নীল আকাশ, আম কাঁঠালের পাতার ফাঁক দিয়ে ভোরের রোদের এমন ঝলমলে বিচ্ছুরণ এর আগে সিফাত দেখেনি কখনও।
সিফাত দাদিমার ঘরে যেয়ে দাদিকে বলে -- আমি একটু পুকুরপাড়ের ওদিকে যাব। লিলিকে সাথে নেব।
-- আচ্ছা, নিয়ে যাও।
সিফাত লিলিকে নিয়ে পুকুরপাড়ে চলে যায়। কী সুন্দর পুকুরের জল ! দিঘির জলের মতো স্বচ্ছ। পুকুরের চারপাশে নানা জাতের ঘাসের আচ্ছাদন। বিচিত্র সব ঘাসফুল ফুটে আছে। পাড়ের ফাঁকে ফাঁকে নারিকেল গাছ। ফুলের গাছও আছে। রক্তজবা, বেলী গাঁদা আর পাতাবাহার। সিফাত অনেক ঘাসফুল চিনতে পারে না। পুকুর পাড় ধরে দুজন হাঁটছিল আর লিলির কাছ থেকে জেনে নেয় কোন্ ফুলটির কী নাম।
সিফাত লিলিকে বলছিল -- এত ফুলের সাথে তুমি আমাকে পরিচয় করে দিলে। কোথাও তো লিলি ফুল দেখলাম না।
-- আমার নাম লিলি। কিন্তু আমি কখনও লিলি ফুল দেখিনি।
-- আচ্ছা, এরপর আমি যদি কখনও আসি তখন ঢাকা থেকে লিলি ফুলের চারা নিয়ে এসে এখানে লাগিয়ে দিয়ে যাব।
-- আচ্ছা, ভাইয়া।
-- লিলি....
-- জ্বী, ভাইয়া।
-- চলো, ঐ আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে প্রান্তরের ঐ দিকে যাই।
-- চলো।
দুজন মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকে। লিলি আগে, সিফাত পিছে। যেন লিলিই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফাগুনের নতুন কচি আউশ আর পাটক্ষেতের পাশে দিয়ে। মাঠে রাখালেরা কাজ করছে। তারা ধান ক্ষেতে জঙ্গল হয়ে থাকা ঘাস নিরাচ্ছে, আর জারীগান
গাইছে।
লিলিদের পাড়ার এক বৃদ্ধ লোক যাচ্ছিল ওদের পাশ দিয়ে। সিফাতকে লিলির সাথে দেখে লিলিকে বলে --
এত সুন্দর ছোয়ালডা কে রে লিলি?
-- আমার ভাইয়া হয়। ঢাকা থেকে এসেছে।
সিফাত আর লিলি পুনরায় ফিরে আসতে থাকে বাড়ির দিকে। পথিমধ্যে দেখা হয় দুটো ছেলের সাথে। এরা বখাটে। লিলিকে পথে ঘাটে উত্যক্ত করে। একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করে এই ছোকরা কে রে লিলি? কই থেকে আমদানি হলো? তোরে দেখে মনে হচ্ছে বেশ স্ফূর্তিতে আছিস।
লিলি কোনো কথা বলে না। সিফাত ওদেরকে বলে, এমন করে কথা বলছ কেন?
-- কেমন করে কথা বলব? তুই শিখাবি?
-- আয়, শিখিয়ে দেই।
ওদের একটারে দেয় কষে একটা থাপ্পড়। লিলি যেয়ে সিফাতের হাত ধরে, এবং বলে -- চলো ভাইয়া। লিলি সিফাতের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে বাড়িতে। বখাটে ছেলে দুটো শাসাচ্ছিল, 'তুই কার নাতি? তোকে আমরা দেখে ছাড়ব'।
পথে আসতে আসতে লিলি বলছিল -- তুমি ওদের সাথে আর এমন করবে না।
-- আচ্ছা।
-- আমার মাথা ছুঁয়ে বলো আর এমন করবে না।
-- এই তোমার মাথা ছুঁইয়ে বলছি -- আর এমন করব না। দেখা হলে -- ওদেরকে সরি বলে দিব। আসলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তো। মাথা একটু বেশি গরম হয়ে গিয়েছিল ।
৪.
দুপুরে সিফাত খেতে বসে তো অবাক! নানা রকম ব্যঞ্জন। চলনবিলের বোয়াল মাছের তরকারি, ভেটকি মাছের দোপিয়াজা, টাকি মাছের ভর্তা, মুরগির ঝাল তরকারি, চালতার আচার, ডিম মামলেট, তেলে ডুবে কাঁকরোল ভাজি। সাথে ঘোষদের গাওয়া ঘী। সিফাত ওর দাদিমাকে বলে --তুমি একদিনেই আমাকে এত ভালোবেসে ফেললে দাদিমা। আমি সত্যি মুগ্ধ।
বিকালে সিফাত লিলিকে বলছিল -- এখান থেকে সুবর্ণরেখা নদীটি কতদূর? আমি ঐ নদীটা দেখতে যাব। মনে করো -- ঐ নদীটা দেখতেই আমি এখানে এসেছি।
-- কাছেই। বেশি দূরে নয়। আধা মাইল দূরে হবে। একটা মাঠের প্রান্তর পেরুলেই সুবর্ণরেখা নদী ।
-- আমি আজই যাব নদী দেখতে। তুমিও যাবে আমার সাথে।
-- আচ্ছা।
-- ওখানে নদীর কূলে কদম গাছ আছে কোনো?
-- আছে। ওখানে তো বহু বছরের প্রাচীন একটা কদমবন আছে। কিন্তু ফুল পাবে না। এখন ফাল্গুণ মাস। ফাগুনে কদম ফুল ফোটে না। পাশে শিমুল গাছ আছে। এখন শিমুল ফুটে ।
-- আচ্ছা, আমি আর তুমি শিমুল তলা আর কদম তলায় বসে সুবর্ণরেখার জল দেখব।
-- আচ্ছা।
৫.
তখন সন্ধ্যা পূর্ব বিকাল। ফসলের প্রান্তরের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে দুজন চলে যায় সুবর্ণরেখা নদীর তীরে। সিফাত বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে নদীটাকে। পৃথিবীতে এত সুন্দর নদী থাকে? নদীটি খুব বেশি চওড়া নয়। ওপার দেখা যায় এপার থেকে। ওপারে ফসলের ক্ষেত। আছে কদম গাছ। বাবলা গাছও আছে। নদীর পাড় ধরে রাখাল গরু নিয়ে যাচ্ছে বাথানে। পশ্চিম আকাশে সূর্যের রং ক্রমাগত গাঢ় কমলা রূপ ধারণ করছে।
সিফাত সুবর্ণরেখার পারে তার প্রপিতামহ ফয়জুর রহমানের পায়ের ছাপ খুঁজতে থাকে। পায়ের ছাপ খুঁজতে খুঁজতে সিফাত লিলিকে নিয়ে কদমতলায় যেয়ে বসে। দুজনই বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সুবর্ণরেখার জলের দিকে। স্থির পানি। স্রোত নেই। স্বচ্ছ জলের উপর পড়েছে কমলা রঙের সূর্যের ছায়া, সূর্যটি একদম ভরা পূর্ণিমার চাঁদের মতো লাগছে।
সিফাত লিলিকে বলছিল তুমি গান গাইতে পারো?
-- না। তুমি পারো?
-- পারি।
-- তবে একটা গান গেয়ে শোনাও।
সিফাত লিলিকে গান গেয়ে শোনায় --
'যমুনা পুলিনে কদম্ব কাননে
কি হেরিনু সখী আজ!
শ্যাম বংশীধারী মণিমঞ্চোপরি
লীলা করে রসরাজ।......
আমি ঘরে না যাইব বনে
প্রবেশিব ও লীলা রসের তরে,
ত্যাজি কুললাজ ভজ ব্রজরাজ
বিনোদ মিনতি করে।'
সিফাত লিলিকে ডাকে -- লিলি....
-- জ্বী।
-- আমি ঢাকা যেয়ে মা বাবাকে বলে তোমাকে ঢাকা নিয়ে যাব। তুমি ওখানে যেয়ে স্কুলে ভর্তি হবে। পড়াশোনা করবে।
-- সত্যি তুমি নিয়ে যাবে আমাকে?
-- সত্যি বলছি।
সন্ধ্যা নামে সুবর্ণরেখার তীরে। আঁধার নামতে থাকে ধীরে। একসময় সত্যি বেশ রাত্রি হয়ে যায়। ওরা দুজন হেঁটে হেঁটে চলে আসে প্রান্তরের দিকে।
কী সুন্দর রাত্রির অন্ধকার। আকাশ ভরা নক্ষত্ররাজি। ওরা হাঁটছে আকাশের নীচে দিয়ে নক্ষত্রের আলো দেখে পথ চিনে চিনে। লিলি আগে, সিফাত পিছে। চলতে চলতে লিলি হঠাৎ আর্তনাদ শুনতে পায়। পিছনে ফিরে সে দেখে -- দুটো ছেলে মুখোশ পরে বেয়নেট দিয়ে সিফাতের বুকে পেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে।
সেই রাত্রির চরাচরে ফসলের ক্ষেতের ভিতর নিস্তেজ দেহে শুয়ে থেকেছিল সিফাত। তার দুচোখ তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে থেকেছিল নিষ্পলক। আত্মার শেষ অনুভবে হয়ত সে ভেবেছিল -- লিলি নিতান্তই একটি অনাথ বালিকা, ওর ওপর আমার এইজন্য কি অনুকম্পা জেগেছিল? ওর জন্য মায়া হয় আমার। ওর সকল দুঃখ, বিপদ থেকে আড়াল করে রাখতে ইচ্ছা হয়।
সুবর্ণরেখা নদী বয়ে চলবে আরও বহুকাল।
১৫ আগস্ট, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।