বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২০

রোড টু কুসুমপুর

রোড টু কুসুমপুর 

এই ঘটনাটি গত শতাব্দীর আশির দশকের কথা।সালটি ছিল ১৯৮৯ ইং।  

সেদিন ছিল ছুটির দিন। আমি বাসায়ই ছিলাম। মনটা কেমন যেন এলমেল লাগছিল।  ঠিক সেই সময় আমাদের গাঁয়ের কালাম এসে খবর দিল-- মা নাকি খুব অসুস্থ। কালাম টঙ্গীতে একটি কারখানার ফোরম্যান এর চাকুরি করে । ছুটি কাটিয়ে ও বাড়ি থেকে আজই এসেছে। পরের দিন আমার অফিস। ছুটি নেবার সময় নেই। মায়ের অসুস্থতার কথা  শুনলে পৃথিবীর বাকি সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়।  তখন বেলা  দুইটা বাজে।  আমি আর দেরি না করে সোজা আব্দুল্লাহপুর বাস স্ট্যান্ডে চলে যাই। 

রোড টু কুসুমপুর,  সিরাজগঞ্জ।  

বাস ছাড়তে ছাড়তে তিনটা বেজে যায়। সময় হিসাব করে দেখলাম -- টাংগাইলের ভূয়াপুরের চর গাবসারা লঞ্চ ঘাটে পৌঁছতে সন্ধে সাতটা বেজে যাবে।  হলোও তাই। বাস যখন চর গাবসারা যমুনা নদীর তীরে এসে পৌঁছে তখন সাতটা পঁচিশ বেজে যায়।  দিনের  শেষ লঞ্চ ঘাটে নোঙর করা আছে। আমি দোতালায় ছোট্ট কেবিনে যেয়ে বসি। 

রাত্রি আটটার দিকে লঞ্চ সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে চলে আসে। আশ্বিনের রাত্রি।  অন্য কোনো সময়ে হলে লঞ্চের ছোট্ট কাঠের কেবিন থেকে বেরিয়ে রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশে চাঁদ উঠেছে কী না দেখতাম, কিংবা অজস্র নক্ষত্রের আলোয় খুঁজতাম, চরে ফুটে থাকা কাশফুল। নদীর জল ছুঁয়ে দূর থেকে বয়ে আসা লি-লি হাওয়া লাগাতাম গায়ে।  আজ আর কোনোকিছু ইচ্ছে করল না। 

আজ এই রাত্রিতে নদীর জলের উপরে লঞ্চের কেবিনে চুপচাপ বসে আছি।  চোখ বন্ধ করে থাকি, দেখি মায়ের মুখ।  চোখ খুলে চেয়ে থাকি, দেখি মায়ের মুখ। জলের শব্দ শুনি -- মায়ের অসুখের ব্যথা বেদনার আর্তি শুনতে পাই। কেবিনের ভিতর আরও ক'জন যাত্রী আছে। কিন্তু তাদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। 

লঞ্চ চলছে ভটভট আওয়াজ করে। কেমন যেন কর্কশ মনে হচ্ছে শব্দ। কেবিনে বসে থাকা একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব লোক আমাকে বলে -- তুমি কোথায় যাবে?

-- কুসুমপুর।  সিরাজগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে? 
-- এলাকাটা চিনি। তুমি কী এই রাতেই ওখানে যাবে?  নাকি শহরে থেকে যাবে? 
-- না, শহরে থাকব না। রাতেই চলে যাব। আমার মায়ের অসুখ। যেতেই হবে। 
-- অনেক  রাত হয়ে যাবে। আধাপাকা খানিক পথ। তারপর বেশির ভাগ কাঁচা রাস্তা। মাঝে নদী। খেয়া পারাপার হতে হবে।  পথে বিপদ হতে পারে তো!  

-- বিপদ হোক।  আমি যাবই। 

লঞ্চ সিরাজগঞ্জ ঘাটে এসে যখন ভেড়ে তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে। বয়স্ক লোকটা আমার সাথে সাথেই লঞ্চ থেকে নামে। সে আবারও আমাকে বলছিল -- শহরের কালীবাড়িতে আমার বাসা।  তুমি ইচ্ছে করলে আমার বাসায় আজ রাতে থাকতে পারো। 

-- না। আমি আজ এই রাতেই চলে যাব। 
-- ঠিক আছে। তা না থাকলে, দুটো ডালভাত খেয়ে যাও। অনেকখানি পথ যেতে হবে।  তোমার খিদে লেগে যাবে। কষ্ট পাবে। 

-- না, আমার খিদে লাগে নাই। খেতে হবে না। 

দেখলাম লোকটি একটু হতাশ হলো। দুঃখও পেল মনে হয়। আমি ওনার কাছে থেকে বিদায় নেই। তারপর একটা রিকশা নিয়ে প্রথমে রহমতগঞ্জ কাঠের পুল চলে আসি। এখানে এসে দেখি -- কুসুমপুর যাওয়ার একটা রিকশাও নেই।  যে রিকশাওয়ালা আমাকে ঘাট থেকে নিয়ে এসেছে তাকে বলি -- ' তুমি কী আমাকে শালুয়াভিটা খেয়াঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাবে? ' রিকশাওয়ালা বলে -- 'না যাব না। আমার ভয় লাগে। ফকিরতলা পার হলেই  যে নিরিবিলি নির্জন জায়গা আছে, ঐ জায়গাটা ভালো না। আমি আমার রিকশাটা হারাতে পারব না।  '

কী করব। রিকশাওয়ালা যাবে না।  অগত্যা আমি একাই হেঁটে রওনা হই। কাটাখালি নদী পার হয়ে আকাশের দিকে তাকাই। দেখি আধাভাঙ্গা চাঁদ। নবমীর চাঁদ হবে হয়ত। আবছা আলোয় পথ দেখা যাচ্ছে।  হেঁটে হেঁটে যখন রহমতগঞ্জ গোরস্তানের কাছে আসি দেখতে পাই , একটি বৃদ্ধা সাদা ধবধবে কাপড় পড়ে গোরস্তানের ভিতর থেকে হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসছে। সে ক্রমশঃ যত আমার দিকে আসছে তত তাঁর মুখখানি চিনবার চেষ্টা করি। নবমীর চাঁদের আলোয় বৃদ্ধার যে মুখচ্ছবি দেখলাম, তা অস্পষ্ট। কেমন স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতের এই আঁধার, চাঁদের যে স্ফুরিত রশনি, আকাশ ভরা নক্ষত্রের যে ঝিলিমিলি আলো-- সেই আলোয় বৃদ্ধাকে যতটুকু দেখলাম,  মনে পড়ে গেল অনেক আগে দেখা একটি মুখ ---

আমার বয়স তখন পাঁচ কী ছয় হবে। সেই শিশু বয়সে  একজনের মুখ আমার আজো মনে আছে।  সে আমার মাতামহীর মুখ। আবছা আবছা সেই মুখখানি আমি এখনও মনে রেখেছি। সে বেঁচে নেই। তার কবর হয়েছিল -- এই গোরস্তানেই। 

বৃদ্ধাকে দেখে কেন যেন মনে হলো সেই তারই মুখ, মাতামহীর সেই অস্পষ্ট আবছায়া মুখচ্ছবির মতোন। বৃদ্ধা যেন বলছে -- ' তুমি ভয় পেওনা। পথে তোমার কিছু হবে না। আমার রাবেয়াকে তুমি দেখতে যাচ্ছ, যাও। আমার আশীর্বাদ রইল।'

বৃদ্ধা আর কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে গোরস্তানের দিকে চলে গেল। তাকে চেয়ে দেখতে দেখতেই  সে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।  আমি শুধু অস্ফুট করে একবার ডাকলাম তাকে -- নানী মা। 

কেমন যেন একটা উদ্যোম পেলাম। সারা শরীর মনে এক স্বর্গীয় অনুভব অনুভূত হতে লাগল। আমি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি।  আমার কাছে মনে হলো -- এই নিশীথ রাতে এই পথে আমি একাকী হলেও কে যেন আমার সাথে আছে। আকাশ ভরা তারার ছায়া, ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ, ঝিঁঝি পোকা, নিশি পাখি সব আছে। ঘেঁটুফুল ফুটেছে রাস্তার ধারে, আকুল করা গন্ধ পাচ্ছি তার। কী একটা পাখি ডাকছে নাম জানিনা,  আখ ক্ষেতের ভিতর শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছিল।  

জন কোলাহলহীন পথে নিঃশব্দচারীর মতো  আমি পথ চলতে থাকি।  ফকির তলা পার হয়ে আরও নির্জন পথ ধরে সামনে এগিয়ে যাই।  হঠাৎ পাশের শন ক্ষেতের ভিতর থেকে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের দুটো ছেলে  রাস্তার উপর উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। অনেকটা গম্ভীর ও ধমকের স্বরে আমাকে বলে  -- দাঁড়াও। 

একজনকে নেতা মনে হচ্ছিল। আর একজন তার চেলা মনে হলো। নেতা ছেলেটি বলছিল -- বাড়ি কই তোমার? 
-- কুসুমপুর। তা তোমার নাম কী?
-- বক্কার।  এই নাম শুনেছ আগে? 
-- না। 
-- তেলকুপীর বক্কারকে সবাই চেনে। তুমি চেনো না? 
-- চিনি না। 
-- চিনবা একটু পরই !  

বক্কার ওর চেলাকে ডাক দিয়ে বলে -- 'এই সিদ্দিক মাল বের কর্।' সিদ্দিক ওর কোমর থেকে একটা চকচকা ডেগার বের করে। বক্কার ডেগারটি সিদ্দিকের হাত থেকে নিয়ে আমার চোখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে -- 'কাছে কত টাকা আছে? 

-- হাজার বারো শ হবে। 
-- বের করো। 
আমি পকেট থেকে টাকাগুলো বের করে বক্কারকে দিয়ে দেই। বক্কার সিদ্দিককে বলে -- ঐ সিদ্দিক, ওর সবগুলো পকেট ভালো করে চেক কর্।  সিদ্দিক আমার সবগুলো পকেট চেক করে বলে -- 'আর নেই ওস্তাদ।'

বক্কার আমাকে বলে --  ' এবার চলে যাও।' 

আমি রাস্তার উপর মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। সামনে আর এগুই না। বক্কার বলে -- তুমি যাচ্ছ না কেন? 
-- এমনই যাচ্ছি না। 

কেন জানি  আমার চোখ দিয়ে জল চলে এল। মার জন্য কিছু পথ্য কিনতে চেয়েছিলাম, যদি ঔষধ কিনতে হয়? ঔষধ কিনব। ছোনগাছা হাট থেকে মার জন্য পান শুপারী কিনতে চেয়েছিলাম। আমার আর মার জন্য কিছু কেনা হবে না। এই ভেবে কাঁদছিলাম। 

বক্কার বুঝতে পারে আমি কাঁদছি।  সে বলে -- এই তুমি কাঁদছ কেন? 

-- আমার মা খুব অসুস্থ।  মার অসুস্থতার খবর শুনে কত পেরেশান  হয়ে ঢাকা থেকে আসতেছি।  তোমরা আমার টাকাগুলো  নিয়ে  নিলে।  আমি মার জন্য ঔষধ পথ্য কিছুই কিনতে পারব না।  এইজন্য কাঁদছি। 

আমার কথাগুলো শুনে বক্কারের  মুখ কেমন যেন দুঃখী দুঃখী হয়ে গেল। একধরনের কোমল এবং মায়াময়। আমি সেই অন্ধকারে তা দেখতে পাচ্ছিলাম।

বক্কার আমার টাকাগুলো আমাকে ফেরৎ দেয়।  এবং বলে -- সামনে তো আরও বেশ কিছু পথ বাকী  আছে।  তুমি একা যাবে কী করে? এত রাতে? তোমার বিপদ হতে পারে।  আমরা তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব। 

বক্কার এবং সিদ্দিক আমাকে অনেকটা পাহারা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসে। পথে ওদের সাথে আমার অনেক কথাই হয়, শুনি ওদের জীবন কাহিনি। আমিও বলি - আমার অনেক কথা।  

এইটুকু পথে আসতে আসতে একজন মানুষের সব কথা  কী শোনা হয়?  কিংবা বলা হয়? 'আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বক্কার  বলে -- তুমি ঘরে যাও। মাকে গিয়ে দেখো,  আমরা যাই। 

-- তোমরাও ঘরে চলো। আমার মাকে দেখে যাও। 

বক্কার বলে --  আর একদিন দিনের বেলায় এসে  তোমার মাকে দেখে যাব।  আজ আর এত রাতে  না।  আর একটি কথা,  আমার মার জন্য তুমি একটু দোয়া করবে।  আমার মাও তোমার মার মতো খুব অসুস্থ।  
তোনাকে একটা সত্যি কথা বলি -- তোমার কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছিলাম সেই টাকা দিয়ে মার চিকিৎসা করতে চেয়েছিলাম। 

বক্কারের কথা শুনে আমার খুব কান্না পেল। আমার অসুস্থ মায়ের মুখের সাথে বক্কারের মায়ের মুখটি মিলে গেল। মনে হলো -- জগতের সব মা-ই এক। একই রকম স্নেহ একই রকম মায়া একই রকম মমতাময়ী। 

আমি আমার বারোশত টাকা থেকে  বক্কারের হাতে  ছয়শত টাকা দিয়ে বললাম -- এটি নাও --মায়ের চিকিৎসা করবে। 

~ কোয়েল তালুকদার