সেই কবে একদিন বন্দরে জাহাজ এসে ভিড়েছিলো। দেখেছিলাম, কিভাবে বন্দর জেগে উঠে কূলে। অসংখ্য মানুষ নামছে প্লাট ফরম ধরে । সবাই ডিনদেশী নারী পুরুষ যুবক যুবতী। সব অচেনা মুখ। যাত্রী নামতে নামতে জাহাজটি একসময় খালি হয়ে যায়। জাহাজটিতে এবার যাত্রী ওঠার পালা। কিন্তু হায়! আমি ছাড়া অন্য কোনো যাত্রী নেই । আমি যেয়ে বসি উপরে উন্মুক্ত কেবিনে। চারদিকে স্বচ্ছ কাঁচের বেষ্টনী। দূরে সফেদ জলরাশি, সারা আকাশ জুড়ে সীগাল চ্রিঁহি চ্রিঁহি করে ডাকছে।
নাবিক যখন জাহাজ ছাড়ার শেষ হূইসেলটি বাজিয়ে ফেলে, ঠিক তখনই দেখি -- সাদা শাড়ি পড়ে একজন রমণী আমার মুখোমুখি এসে বসলেন। যেনো --
"চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে। " অনেকটা এই চিত্রকল্গের মতো তাকে আমিও দেখি।
জাহাজ কোন দিকে চলছে, কোথায় যাচ্ছে জানিনা। শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম -- দৃস্টি সীমানা জুড়ে অসীম সমুদ্র। অতল শুভ্র জল ফেনায়িত হচ্ছে, সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে রূপালী সী গালের সাদা পালকের মতো জল। ঠিক তখনই সেই রমণী 'পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে' আমাকে বলেছিলো, ' আপনি কোথায় যাবেন? ' আমি বলেছিলাম --
' সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে' কিংবা যেতে পারি --
'বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে'
কিংবা ' আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে। '
আমি তাকে বললাম,' আপনি কোথায় যাবেন?' সে তখন বললো 'তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানেই যাবো। ' জানো, বাতাস আজ কানে কানে এসে বলেছিল , তুমি নাকি আজ একাকী সাগরে ভাসবে। তুমি একা থাকবে, তাই কি হয়? তাই চলে এলাম তোমার কাছে। '
আমি : কে তুমি? আমি তোমাকে চিনতে পারছিনা ! কিন্তু চেনা চেনা লাগছে। তুমি কি বনলতা সেন?
মেয়েটি : না, আমি বনলতা সেন হবো কেন? আমি তোমার সেই সাগরিকা। যাকে তুমি ভালোবেসেছিলে তোমার পূর্ব জনমে।'
আমি ৰিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম সাগরিকার চোখের দিকে। এই চোখ আমি কবে দেখেছিলাম মনে করতে পারছিনা। সমুদ্রের হিম শীতল বাতাসে ওর যে চুলের গন্ধ পাচ্ছি, তা বহু যুগ আগের পরিচিত কোনো পুরনো গন্ধ। আমি তাকে প্রথম দেখেছিলাম, গোমতী নদীর পারে। এলোমেলো চুল ছিলো তার পিঠের উপরে। তখনো সেখানে দখিনের বাতাস ছিলো। আমি মাতাল হয়েছিলাম তার চুলের গন্ধ নিয়ে। '
সাগরিকা হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। বলে - তুমি এসো, চলো ঐ রেলিং এর ধারে। দেখি ভূবন জুড়ে জলরাশি। ' রেলিং ধরে দেখছিলাম দুজন জলের উপর নীল আকাশ, আর আকাশের নীচে থৈথৈ করা পানি । রূপালী ডলফিন সব নৃত্য করছে। সাগরিকা একবার সমুদ্রের দিকে মুখ রেখে, আর একবার আমার দিকে চেয়ে গুনগুন করে গাইছিলো --
'তুমি সাত সাগরের ওপার হতে আমায় দেখেছো
আর মন ভ্রমরের কাজল পাখায় ছবি এঁকেছো
আমি বলি :
আমি ময়ুর পংখি নাও ভিড়িয়ে তোমায় দেখেছি
আর প্রবাল দ্বীপের পান্না ভেবে চেয়ে থেকেছি
সাগরিকা :
আগুন ঝরা ফাগুন যখন ছিল পলাশ বনে
তোমার কথাই ভেবেছিলেম আমি মনে মনে।
আমি :
তোমার চোখে তাই তো খুশির পরাগ মেখেছি।'
আমি সাগরিকাকে বলি এখন তো গানের সময় নয়। এখনতো কোনো কথা বলবারও সময় নয়। এখন সাগরের ভাষা শুনবো দুজন ! সাগরিকা তুমি কান পাতো ঐ জলের কাছে। ঐখানে জীবনের যতো সুর বাঁধা পড়ে আছে। ঐ অতল জলধিতে কি হারাবে তোমার প্রাণ? এবং আমারও।
সাগরিকা বলছিল, তোমার কি মনে আছে? অনেক আগের এক বসন্ত দিনের কথা? ময়নামতি থেকে আমরা দুইজন হাটতে হাটতে অনেক দূর পর্যন্ত পূর্ব দিকে চলে গিয়েছিলাম। দুইপাশে ধানক্ষেত ছিলো, পথের উপর দূর্বা ঘাস ছিলো। হাটতে হাটতে আমরা গোমতীর তীরে পৌঁছে যাই। গোমতীর স্বচ্ছ নির্মল জল আজলা ভরে তুলে এনে তুমি আমার তৃষ্ণা মিটিয়েছিলে। ক্লান্ত দুপুরে আমি আমার মুখ রেখেছিলাম তোমার বুকে। তারপর নদী থেকে শীতল বাতাস এলো। ছাতিম গাছে ঘুঘু গান গেয়ে উঠলো। মেঘ ঢেকে দিলো সেদিনের সব রোদ্র। তুমি আমায় তোমার বুকের ছায়ায় আগলে রাখলে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, তারপরও তুমি তোমার সকল ক্ষণ শেষ করতে চাওনি।
আমি সাগরিকার মুখের পানে চেয়ে আছি। মনে করি কতো বছর আগের সেই সব কথা? সেই মধু ক্ষণ আমার মনে পড়েনা। আমার ভাবনায় কেবল শুধু এই আজকের বিকেল। সাগরের জলে ভাসে রক্তিম আভা ঐ সূর্যের। যে হাওয়া আসছে সমুদ্র থেকে, তার দোলায় উড়ছে সাগরিকার অবিনস্ত চুল, উড়ছে তার শাড়ির আঁচল। আজ এই স্বর্নাভ বিকেল শুধু আমার আর সাগরিকার করে পেতে চাই --
'হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় —
চিতা শুধু পড়ে থাকে তার,
আমরা জানি না তাহা; — মনে হয় জীবনে যা আছে। '
তারপর সেই সাগরের মাঝে সন্ধ্যা নেমে এলো। সূর্য ভেসে ডুবে গেলো লোনা জলে । সীগাল চ্রিঁহি চ্রিঁহি করে গান গেয়ে উড়ে চলে যায়। কতো অরণ্যের আঁধার আমরা দেখেছিলাম, কতো অন্ধকার নেমে এসেছিলো গোমতীর তীরে, ময়নামতির শালবনে ডুবেছিলো শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। আজ যেনো সে সবই নস্টালজিক। সাগরে নেমে আসা এই মনোরম সন্ধ্যায় সাগরিকার মুখখানি স্নিগ্ধ রূপ পেলো। মনে হলো -- ফিরে গিয়েছিলাম অনেক বছর আগের সেই গোমতীর তীরে। সাগরে নেমে আসা সেই সন্ধ্যায় আমার কাঁধে মাথা রেখে সাগরিকা গেয়েছিলো এই গান --
'বাতাসের কথা সে তো কথা নয়
রূপ কথা ঝরে তার বাঁশিতে
আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই
যেন দুটি আঁখি ভরে
রাখে হাসিতে।
কিছু পরে দূরে তারা জ্বলবে
হয়তো তখন তুমি বলবে।'
তারপর একে একে আকাশের সব তারা জ্বলে উঠলো। আশ্বিনের পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে পূর্ব আকাশে। সাগরের জলে ভাসে যতো ধ্রুবতারা। এই রাত কি আজ আমাদের হবে? ঐ চাঁদ কি দুজনের হবে? ঐ ধ্রুবতারা কি সাগরিকার কপালে জ্বলবে? জাহাজের রেলিংয়ের পাশে দাড়িয়ে আছি আমরা দুজন। সাগরিকা খুব নিবিড় ভাবে আমার কাছে চলে আসে। দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে -- ' ওগো, তুমি সেই আগের জনমের মতো আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা। সেবার গিয়েছিলে, সে জন্য আমি আত্মাহূতি দিয়েছিলাম গোমতীর জলে। এবার তোমাকে অনেক সাধনা করে পেয়েছি। এবার আর তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবেনা। '
পূর্ণিমার চাঁদ হঠাৎ করেই যেনো মেঘে ঢেকে গেলো। কেমন অদ্ভুত এক আঁধার নেমে এলো সারা সাগর জুড়ে। অনেকটা অন্ধকারে আমি সাগরিকার আনত মুখখানির দিকে তাকিয়ে বলি -- 'কিভাবে আমি তোমার হবো? আমার ঘরে লক্ষ্মী একজন মায়াবতী স্ত্রী আছে। '
সেই রাতে পূর্ণিমার আলো এসে সাগরিকার মুখে পড়েনি। তাই দেখা হলোনা ওর মায়াবী মুখ খানি। যে বাহুডোরে সাগরিকা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলো, তা শিথিল হলো। কোনো কথা না বলে সাগরিকা আমায় ছেড়ে সরে দাড়ালো। হঠাৎ যেনো জগৎ জুড়ে নিকষ অন্ধকার নেমে আসে। রেলিংয়ের ওপাশে সাগরের জলে ঝাঁপ দেওয়ার একটি শব্দ শোনা গেলো।
মানুষের জীবনে কখনো ভ্রান্তি চলে আসে । অতীতের অনেক কিছুই বর্তমানের জন্য সত্যি হয়। আবার কখনো সে সব স্বপ্ন হয়ে আসে। সাগরিকা কি শুধু স্বপ্নই ছিলো আমার? বিশ্বাস করতে হয় তাই। যখন স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, জেগে দেখি -- আমার স্ত্রীর একটি হাত জড়িয়ে আছে আমারই বুকের উপর।
নাবিক যখন জাহাজ ছাড়ার শেষ হূইসেলটি বাজিয়ে ফেলে, ঠিক তখনই দেখি -- সাদা শাড়ি পড়ে একজন রমণী আমার মুখোমুখি এসে বসলেন। যেনো --
"চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে। " অনেকটা এই চিত্রকল্গের মতো তাকে আমিও দেখি।
জাহাজ কোন দিকে চলছে, কোথায় যাচ্ছে জানিনা। শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম -- দৃস্টি সীমানা জুড়ে অসীম সমুদ্র। অতল শুভ্র জল ফেনায়িত হচ্ছে, সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে রূপালী সী গালের সাদা পালকের মতো জল। ঠিক তখনই সেই রমণী 'পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে' আমাকে বলেছিলো, ' আপনি কোথায় যাবেন? ' আমি বলেছিলাম --
' সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে' কিংবা যেতে পারি --
'বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে'
কিংবা ' আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে। '
আমি তাকে বললাম,' আপনি কোথায় যাবেন?' সে তখন বললো 'তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানেই যাবো। ' জানো, বাতাস আজ কানে কানে এসে বলেছিল , তুমি নাকি আজ একাকী সাগরে ভাসবে। তুমি একা থাকবে, তাই কি হয়? তাই চলে এলাম তোমার কাছে। '
আমি : কে তুমি? আমি তোমাকে চিনতে পারছিনা ! কিন্তু চেনা চেনা লাগছে। তুমি কি বনলতা সেন?
মেয়েটি : না, আমি বনলতা সেন হবো কেন? আমি তোমার সেই সাগরিকা। যাকে তুমি ভালোবেসেছিলে তোমার পূর্ব জনমে।'
আমি ৰিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম সাগরিকার চোখের দিকে। এই চোখ আমি কবে দেখেছিলাম মনে করতে পারছিনা। সমুদ্রের হিম শীতল বাতাসে ওর যে চুলের গন্ধ পাচ্ছি, তা বহু যুগ আগের পরিচিত কোনো পুরনো গন্ধ। আমি তাকে প্রথম দেখেছিলাম, গোমতী নদীর পারে। এলোমেলো চুল ছিলো তার পিঠের উপরে। তখনো সেখানে দখিনের বাতাস ছিলো। আমি মাতাল হয়েছিলাম তার চুলের গন্ধ নিয়ে। '
সাগরিকা হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। বলে - তুমি এসো, চলো ঐ রেলিং এর ধারে। দেখি ভূবন জুড়ে জলরাশি। ' রেলিং ধরে দেখছিলাম দুজন জলের উপর নীল আকাশ, আর আকাশের নীচে থৈথৈ করা পানি । রূপালী ডলফিন সব নৃত্য করছে। সাগরিকা একবার সমুদ্রের দিকে মুখ রেখে, আর একবার আমার দিকে চেয়ে গুনগুন করে গাইছিলো --
'তুমি সাত সাগরের ওপার হতে আমায় দেখেছো
আর মন ভ্রমরের কাজল পাখায় ছবি এঁকেছো
আমি বলি :
আমি ময়ুর পংখি নাও ভিড়িয়ে তোমায় দেখেছি
আর প্রবাল দ্বীপের পান্না ভেবে চেয়ে থেকেছি
সাগরিকা :
আগুন ঝরা ফাগুন যখন ছিল পলাশ বনে
তোমার কথাই ভেবেছিলেম আমি মনে মনে।
আমি :
তোমার চোখে তাই তো খুশির পরাগ মেখেছি।'
আমি সাগরিকাকে বলি এখন তো গানের সময় নয়। এখনতো কোনো কথা বলবারও সময় নয়। এখন সাগরের ভাষা শুনবো দুজন ! সাগরিকা তুমি কান পাতো ঐ জলের কাছে। ঐখানে জীবনের যতো সুর বাঁধা পড়ে আছে। ঐ অতল জলধিতে কি হারাবে তোমার প্রাণ? এবং আমারও।
সাগরিকা বলছিল, তোমার কি মনে আছে? অনেক আগের এক বসন্ত দিনের কথা? ময়নামতি থেকে আমরা দুইজন হাটতে হাটতে অনেক দূর পর্যন্ত পূর্ব দিকে চলে গিয়েছিলাম। দুইপাশে ধানক্ষেত ছিলো, পথের উপর দূর্বা ঘাস ছিলো। হাটতে হাটতে আমরা গোমতীর তীরে পৌঁছে যাই। গোমতীর স্বচ্ছ নির্মল জল আজলা ভরে তুলে এনে তুমি আমার তৃষ্ণা মিটিয়েছিলে। ক্লান্ত দুপুরে আমি আমার মুখ রেখেছিলাম তোমার বুকে। তারপর নদী থেকে শীতল বাতাস এলো। ছাতিম গাছে ঘুঘু গান গেয়ে উঠলো। মেঘ ঢেকে দিলো সেদিনের সব রোদ্র। তুমি আমায় তোমার বুকের ছায়ায় আগলে রাখলে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, তারপরও তুমি তোমার সকল ক্ষণ শেষ করতে চাওনি।
আমি সাগরিকার মুখের পানে চেয়ে আছি। মনে করি কতো বছর আগের সেই সব কথা? সেই মধু ক্ষণ আমার মনে পড়েনা। আমার ভাবনায় কেবল শুধু এই আজকের বিকেল। সাগরের জলে ভাসে রক্তিম আভা ঐ সূর্যের। যে হাওয়া আসছে সমুদ্র থেকে, তার দোলায় উড়ছে সাগরিকার অবিনস্ত চুল, উড়ছে তার শাড়ির আঁচল। আজ এই স্বর্নাভ বিকেল শুধু আমার আর সাগরিকার করে পেতে চাই --
'হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় —
চিতা শুধু পড়ে থাকে তার,
আমরা জানি না তাহা; — মনে হয় জীবনে যা আছে। '
তারপর সেই সাগরের মাঝে সন্ধ্যা নেমে এলো। সূর্য ভেসে ডুবে গেলো লোনা জলে । সীগাল চ্রিঁহি চ্রিঁহি করে গান গেয়ে উড়ে চলে যায়। কতো অরণ্যের আঁধার আমরা দেখেছিলাম, কতো অন্ধকার নেমে এসেছিলো গোমতীর তীরে, ময়নামতির শালবনে ডুবেছিলো শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। আজ যেনো সে সবই নস্টালজিক। সাগরে নেমে আসা এই মনোরম সন্ধ্যায় সাগরিকার মুখখানি স্নিগ্ধ রূপ পেলো। মনে হলো -- ফিরে গিয়েছিলাম অনেক বছর আগের সেই গোমতীর তীরে। সাগরে নেমে আসা সেই সন্ধ্যায় আমার কাঁধে মাথা রেখে সাগরিকা গেয়েছিলো এই গান --
'বাতাসের কথা সে তো কথা নয়
রূপ কথা ঝরে তার বাঁশিতে
আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই
যেন দুটি আঁখি ভরে
রাখে হাসিতে।
কিছু পরে দূরে তারা জ্বলবে
হয়তো তখন তুমি বলবে।'
তারপর একে একে আকাশের সব তারা জ্বলে উঠলো। আশ্বিনের পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে পূর্ব আকাশে। সাগরের জলে ভাসে যতো ধ্রুবতারা। এই রাত কি আজ আমাদের হবে? ঐ চাঁদ কি দুজনের হবে? ঐ ধ্রুবতারা কি সাগরিকার কপালে জ্বলবে? জাহাজের রেলিংয়ের পাশে দাড়িয়ে আছি আমরা দুজন। সাগরিকা খুব নিবিড় ভাবে আমার কাছে চলে আসে। দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে -- ' ওগো, তুমি সেই আগের জনমের মতো আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা। সেবার গিয়েছিলে, সে জন্য আমি আত্মাহূতি দিয়েছিলাম গোমতীর জলে। এবার তোমাকে অনেক সাধনা করে পেয়েছি। এবার আর তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবেনা। '
পূর্ণিমার চাঁদ হঠাৎ করেই যেনো মেঘে ঢেকে গেলো। কেমন অদ্ভুত এক আঁধার নেমে এলো সারা সাগর জুড়ে। অনেকটা অন্ধকারে আমি সাগরিকার আনত মুখখানির দিকে তাকিয়ে বলি -- 'কিভাবে আমি তোমার হবো? আমার ঘরে লক্ষ্মী একজন মায়াবতী স্ত্রী আছে। '
সেই রাতে পূর্ণিমার আলো এসে সাগরিকার মুখে পড়েনি। তাই দেখা হলোনা ওর মায়াবী মুখ খানি। যে বাহুডোরে সাগরিকা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলো, তা শিথিল হলো। কোনো কথা না বলে সাগরিকা আমায় ছেড়ে সরে দাড়ালো। হঠাৎ যেনো জগৎ জুড়ে নিকষ অন্ধকার নেমে আসে। রেলিংয়ের ওপাশে সাগরের জলে ঝাঁপ দেওয়ার একটি শব্দ শোনা গেলো।
মানুষের জীবনে কখনো ভ্রান্তি চলে আসে । অতীতের অনেক কিছুই বর্তমানের জন্য সত্যি হয়। আবার কখনো সে সব স্বপ্ন হয়ে আসে। সাগরিকা কি শুধু স্বপ্নই ছিলো আমার? বিশ্বাস করতে হয় তাই। যখন স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, জেগে দেখি -- আমার স্ত্রীর একটি হাত জড়িয়ে আছে আমারই বুকের উপর।