বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আমার অনন্ত ক্রন্দনধ্বনি ( কাব্য)

আমারই অনন্ত ক্রন্দনধ্বনি (কাব্যগ্রন্থ)


উৎসর্গ -

ইউনিভার্সিটির হল জীবনের
'আমরা ত্রিরত্নে'র
ইকবাল মাহমুদ বাদল
সহিদউল্যাহ্ শহীদ,

আমার উন্মূল ও বাঁধনহারা সময়ের
দুই অনুজ বন্ধুকে।



১. আমারই অনন্ত ক্রন্দনধ্বনি


কোনও একদিন সব কোলাহল থেমে যাবে
স্তব্ধ হয়ে যাবে বাতাসের বেগ দিগন্তে
মুখর পাখিরা এসে গাইবে না গান অলিন্দে বসে
মৃতেরা যেয়ে ঠাঁই নেবে মাটির গহ্বরে
সেদিন পাশে থাকবে না কেউ আর

আমার সমস্ত জীবন ভার
বেদনার সব ভার
পৃথিবীর ধূলো পথে বয়ে বেড়াবে না আর
হারাবে সমস্ত পথ তার অন্ধকারে
আমার প্রাণের প্রান্তে নৈঃশব্দরা উন্মাতাল হবে।

কার হাতে দেবো তখন জীবনের ক্লান্তির ভার
সাদা কফিনের পাশে তোমরা কেউ উৎসব করো না
লোবানের গন্ধ উড়িও না বাতাসে
পৃথিবীর সমস্ত রোদ্র যখন ছায়ায় ভাসতে থাকবে
প্রিয়জনেরাও শান্ত হবে তখন।

সব পাপ প্রায়শ্চিত্ত হবে একদিন
স্তব্ধ হয়ে যাবে সব জনকলরোল
আত্মারা তখন উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকবে পুনর্জন্মের জন্য পৃথিবীর ধুলির পথে পথে
আমারই অনন্ত ক্রন্দনধবনির মতো।


২. চাই অমৃত, শরাবে ও সাকীতে

রাতের নির্জনতায় অন্তরমহলের দরজাটা খুলে দাও,
এই তো তুমি আছ তোমার মতো করে --
হৃদয় ভরে নিয়ে শিউলি আর চন্দনের গন্ধে !

সব দুঃখকে ভুলে দিতে পারো তুমি।

আমি চাই বাগদাদের একটি রাত আর রাজস্থানের একটি সকাল,
যেখানে রাতের ভালবাসা শরাব আর
সাকীতে বিভোর থাকে।

সকালবেলা ধ্বনিত হয় মীরা বাঈয়ের কণ্ঠে
প্রভুর জন্যে গাওয়া গীত ও সংগীত ।


৩. যুগল প্রেমের কবিতা


পূর্ব মেঘ :
মাটির গন্ধ পাই তোর শরীর থেকে
করমচা রঙ্গের ঠোঁট নুয়ে পড়েছে লজ্জাবতীর মতো,
দ্রোপদীর মুখ যখন রঙ্গীন হয়
পৃথিবী শোভিত হয় তখন হীরণ্য দ্যূতিতে।

তুই বল, আমি কি তোর পৃথিবী?

উত্তর মেঘ :
মাঝে মাঝে দূরত্ব তৈরি করো আকাশ সমান।
কিন্তু আকাশের কাছে যেয়ে কখনও বলোনি-
এই মেঘ তোমার, এই জল তোমার জন্য।

আমি করতল ধরে বসে আছি
এই রকম জলের জন্য --
কিন্তুু কেউই এসে জলে ভরায়নি,
আমি কি আসলে জলের কাঙ্গাল, না তোমার?


৪.    অমান্য


রোদ্রতাপে উষ্ণ হয়ে তুমি হেঁটে আসো
আমার দিকে
ঘোমটা নেই মাথায়, বুকের আ্ঁচল এলমেল
তুমি তখন দুপুর মানো না,
তুমি নির্জনতা মানো না ।

তোমার শরীর ভেজে শ্রাবণ সন্ধ্যার
বৃষ্টির জলে
রাতের অন্ধকার ঢাকে তারার আকাশ
তুমি তখন জ্যোৎস্না মানো না,
শুকতারা মানো না।

ভালোবাসা রোদ্রে জ্বলে,
শরীর ভেজে বৃষ্টিতে
শিহরিত হয় তোমার গ্রীবা, শিরা উপশিরা
তুমি তখন রাত্রি মানো না,
দিনও মানো না ।


৫.     নিমগ্নিকা


কতটুকু তোমাকে ভালোবাসলে আকাশে মেঘ হবে,
মেঘগুলো জল হবে, পূর্ণতা পাবে নদী ---
কতটুকু ভালোবাসলে বসন্তে ফুটবে ফুল
মৌবন হবে শোভিত, মৌমাছিরা গুনগুন করবে চারদিক ,
কতটুকু ভালোবাসলে তোমার কস্তরী ঠোঁট
সপ্রতিভ হবে, কাজল চোখে তারা জ্বলবে,
কুচবরণ কেশে গন্ধ ছুটবে !
কতটুকু ভালোবাসলে তুমি নির্জনে হয়ে উঠবে একজন নিমগ্নিকা।


৬.    জ্বলুক দীপ্তি ঢালা সুধা


তুমি আমার জীবন চরিতার্থ করে দিয়েছিলে,
সব ফুলের আগুন নীল দিগন্তে মিলিয়ে গিয়েছিল।
সেই তীব্র ভালোবাসার মুহূর্তগুলো নত হয়েছিল জমিনের উপর।
সেইখানেই একই বিন্দুতে তুমি আমি একীভূত হয়েছিলাম।
ঠিক সেইখানে শূন্যতা কি রাখা যায়? এতটুকুও কি ম্লান হয়েছে সেই স্বেদবিন্দু? সেই অনাবৃত শিহরণ? অনিঃশেষ প্রেম চিহ্নগুলি কি কখনও মুছে যায়?

জ্বলুক তোমার দীপ্তিঢালা সুধা, ঐ সুধায় ধন্য হোক এই নশ্বরতার সমস্ত আর্তি বেদনা দু:খ ও সুখ। এস, সর্বাঙ্গ লেহন করো, চির চরিতার্থ হোক এই দুই হৃদয়খানি।


৭.    দুপুরের পংক্তিমালা


তুমি যদি দাঁড়িয়ে থাকতে বারান্দায়, বসন্তের এই আগমনী বাতাসে উড়ত তোমার মাথার চুল,
লুকোচুরি আলো ছায়ায় নেমে আসত সন্ধ্যা,
ধূসর রঙের একটি টি-সার্ট গায়ে দিয়ে হেঁটে যেতাম তোমার আঙিনা দিয়ে।
দেখতাম পথে থেকেই তোমার চোখ, চোখের কাজল,
বুঝতে পারতাম মনিরত্নমের নীচে কোনও অশ্রুত জলধারা, 
কোনও বিনম্র হাসি, কিংবা মনখারাপের আরক্ত সেই মুখ।

এই শহরে দ্রুতই দীর্ঘশ্বাসের মতো ধেয়ে আসে হাওয়া -
ধুলিতে আঁধার হয় এর পথ,
কত প্রবল ইচ্ছার মৃত্যু হয়, কত আকুতি অন্ধকারে মিশে।

কী ভাবে হেঁটে যাব তোমার বাড়ির আঙিনা দিয়ে,
কী ভাবে দেখব পরনে তোমার পরিপাটি নীল শাড়ি।
আমার যে ঠিকানা জানা নেই।



৮.    কে সে জন


মর্ত্যে অমর্ত্যের কোন্ অন্তঃপুর বাসিনী সে?
কী সব স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ক্ষরণে অন্তঃসলিল প্রবাহমান হয়। রাতের বিছানা সব এলমেল থাকে। শুকিয়ে যাওয়া রজনীগন্ধার মতো চোখ মুদে আসে। এত সংবেদনা, 
তবুও এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে না। 
কবে কে বলেছিল -- অশ্রুহীন রেখ চোখ।

মায়াবতী বা কোথায়?
কত গল্পের কত রমণীকূল, বালিকা, নর্তকী, রাজকুমারী, ঘুঁটেকুড়ানী, যোগিনী, সন্ন্যাসিনী, প্রেতেনী, কঙ্কাবতী, বনলতা .....

তারা কেউ নেই।

মিত্রা, কমলিকা, সাহানা, মেহেরজান, ঊষা, হৈমন্তী, দীপান্বিতা, মালিনী, মাধবী, যামিনী, টিনটিন, মহুয়া, পিয়ালি.....

সবাই ছিল লাবণ্যময়। ঘোরে অঘোরে কত নাম লিখি। কত নাম যপি। শব্দ সাজাই। কবিতার চরণ লিখি। কত সব নামের উপরে সমুজ্জল মুক্তো জ্বলে, একটি দুটি নাম উপনাম হয়ে যায় ....

অমরাবতী আর মায়াবতী।


৯.      শূন্যতা 


তোমাকে যেখানে নিয়ে যাবে 
সেখানে কেবলই শূন্যতা, কেউ নেই। 

যেখানে থাকবে তুুমি
সেখানে কেবলই নিস্তব্ধতা, কান্নাও নেই। 

যেখানে রবে তুমি, সেখানে আলো নেই
কেবলই অন্ধকার... 

এত শূন্যতার ভিতর , এত শব্দহীন কান্নার ভিতর 
চারপাশে অনিঃশেষ এত অন্ধকারের ভিতর --
আমাকে তুমি খুঁজে পাবে কী করে!



১০.      পথ সঙ্গীত


আমরা আজ এখানে এই পথের উপর  এসেছি 
আমরা তোমাদের ভালোবাসা দিতে এসেছি 
আকাশের গায়ে থেকে মুঠো ভরে নীল এনেছি 
তোমাদের আজ  নীলাদ্রী করে রাঙাতে এসেছি।

আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি। 

দুরের ঐ পাহাড় থেকে লতাগুল্ম বনফুল এনেছি 
মহুয়া বন থেকে ঝাঁপি ভরে ফুল তুলে এনেছি 
তোমাদের আজ মালা পরিয়ে দিতে এসেছি 
ফুলের সুবাসে আকুল করে দিতে এখানে এসেছি। 

আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি। 

সাগর বালুকাবেলা থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে এনেছি 
তোমাদের ঘরে মণিমুক্তা ভরিয়ে দিতে এসেছি 
রূপালি ঢেউয়ের সমুদ্র পাড়ে নিয়ে যেতে এসেছি
সূর্যস্নানে পুণ্য হবে এই আনন্দ বার্তা দিতে এসেছি।

আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি। 

পথের উপরে তোমাদের গান শোনাতে এসেছি
তোমাদের জন্য আজ এই আনন্দ গান বেঁধেছি 
পথের দিশা দিতে তোমাদের কাছে এসেছি 
পথের মাঝে যেন হারিয়ে না যাও সেকথা ভেবেছি। 

আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি। 

আমরা অনেক দুঃখ যাতনার কথা ভুলেছি 
ভালোবাসা হৃদয় কোণে কানায় কানায় ভরেছি
আমরা তোমাদের সেই ভালোবাসা দিতে এসেছি
ভালোবেসে শুন্য করে দিতে এখানে এসেছি।

আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি। 



১১.        তার হৃদয়খানি


তার কটিতে এতটা আবেদন ছিল না, যেখানে জ্যোৎস্না এসে বাঁক খেতে পারে। 
তার  মুখে এমন কোনো মায়া ছিল না, যেখানে 
মধুরিমার আবেশ না দিতে হয়
তার চিবুকে একটি তিলও নেই, যেথায় কাজলের আঁচড় না লাগাতে হয়।

চুলকে কখনোই অবন্তীর আঁধার মনে হয়নি
না ছিল তার পায়ে ঘুঙুরের আওয়াজ 
না ছিল ওষ্ঠের আশ্লেশ --
না ছিল ভ্রু-তে কোনো আমন্ত্রণের ঝিলিক, যা দেখে কোনো স্বর্গলোকের পথে হাঁটা যায়  ! 
না ছিল তার স্পর্শে এমন চুম্বকীয় টান, যা কোনো নদী নিমিষেই সাগরে বিলীন হতে পারে ---

তবুও ভালবেসেছি তাকে, শুধু তাকেই। দুর্বার গতিতে...
জানি, তার হৃদয়খানি পৃথিবীর মতো অসীম !


১২.      একটি  সুইসাইডাল স্টাটাস


স্পর্শ দিয়ে তোমার সাথে আমার সম্পর্কের শুরু
সিনে কমপ্লেক্সের সবগুলো আলো তখন নীভে গিয়েছিল
একটি কোমল কঠিন হাত আমার স্নিগ্ধ নরম হাত স্পর্শ করেছিল।
প্রথম কম্পন সেখান থেকেই , প্রথম ভালোলাগাও সেখান থেকে শুরু --
'চিত্রা নদীর পারে'র শেষ দৃশ্য সেদিন আর দেখা হলো না।
তারপর, রিক্সার হুড ফেলে সাহসী যাত্রীর মতো চষে বেড়িয়েছি ঢাকার অনেক রাজপথ অলিগলি 
কত রোদ্দূর, কত বৃ্ষ্টির মেঘ, কত ছায়াতল দিয়ে আমরা হেঁটে গিয়েছি।

আমাদের স্পর্শগুলো সভ্যের সিমানা ছাড়িয়ে যেতে থাকে
দিয়াবাড়ির কাশবন, বেড়ীবা্ঁধের পাশে নির্জন একাকী রেস্তোরায় হয়েছে যত স্পর্শের মহোৎসব।

যে তুমি একদিন ভালোবাসার জন্য মাহিনের ঘোড়ায় চড়ে আমাকে নিয়ে  সোয়ার হতে চেয়েছিলে
সেই তুমি আমাকে গণিকার মতো করে রেখে দিলে। 

আমাকে ভালোবাসবার তোমার সময় হয় না
নীল আলোর নীচে নগ্নিকা করে সৌন্দর্য ভোগ  করতে তোমার সময় হয়
বিয়ের কথা  শোনার জন্য তোমার সময় হয় না
আমার উত্তপ্ত শরীর খুবলে খামছে খেতে তোমার সময় হয়।

বার্থ কন্ট্রোল পিল কিনিনি , আজ ফার্মেসীগুলো ঘূরে ঘুরে স্লিপিং পিল কিনেছি
আজ রাত্রে একজন বেশ্যা  ঘুমিয়ে যাবে চিরঘুমে--
I love you more than life itself, but you didn't see it.
You didn't realize what you had. Maybe once I'm gone.

( একটি জাতীয় দৈনিকে একটি মেয়ের আত্মহত্যার খবর পড়ে এই কবিতা।) 


১৩.       না আমি না তুমি

'
যদি কখনও প্রেমময়ী হও, 
যদি তুমি জেগে উঠতে চাও তোমার প্রাসাদে,
শোকাচ্ছন্ন একাকীত্বে
যদি প্রশ্ন করো বাতাসে 'আমি কেমন আছি '?
ইথারের সমস্ত তরঙ্গ, নক্ষত্র, পাখি, পুঞ্জীভূত মেঘ
সবাই সমস্বরে উত্তর দেবে 'ভালো নেই। '
কোথাও প্রেম নেই, আছে শুধু আন্দোলিত প্রাণ
আছে ভালোবাসার কুঞ্জবনে বিস্মৃতির নির্ঝর।

যদি কখনও তুমি মায়াবি কেউ হও
যদি মাতাল হয় মধ্যরাতের গান
যদি লুপ্ত হয়ে যায় এ্য়োদশীর কোনও চাঁদ 
যদি নিভে যায় এক এক করে সকল তারা 
তখন ভালো থাকবো না আমরা কেউই -
না আমি না তুমি, না আমাদের মধুময় প্রেম।


১৪.      গোলাপ ফোটান দিন 


আজ তোমার গোলাপ ফোটানোর দিন
জুঁই চামেলীর তোড়া নিয়ে আজ তোমার
অপেক্ষা করার দিন --
আমি জানি তুমি এখন আছো বিবর্তনে
জানি আজ তুমি অসময়ে রক্ত জবা ফুটিয়ে রেখেছ। 

ভ্রু কুঁচকে যখন তুমি পাশে এসে দাঁড়াও
আমি তখন ভালোবাসার কোনও ব্যাকরণ মানি না
সনদ মানি না ধর্মের কিংবা জাতিসংঘের,
তাই তো আমি রাতভর সুবাস ছড়িয়ে বসে থাকি
এই ক্যামেলিয়ার বাগানে।

তখন অপার্থিব এক ভালোবাসায় ভরে ওঠে দেহ মন জানালা --
শুনি তার কাছে আসার গান পথে পথে 
সারা রাত্রিতে কামিনী কুন্তলের ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য
আমি মাতোয়ারা হয়ে থাকি।

চাই ঘৃণা , চাই অমরতা -- 
হেমলক পান করতে হলে তাই করব পান, 
তা গন্দম হোক, তবুও চাই, অমৃত সুরলহরীতে বাজুক
গোলাপ ফোটানো দিনে আমাদের আনন্দ সঙ্গীত।


১৫.     ভালোবাসা নেই ঘৃণা নেই


আমি তাকে বললাম, ভালোবাসা দেবো, তুমি কি দেবে আমাকে ?
উদাসীন সে, কোনও জবাব নেই
যেন বহুকাল ধরে বহুজনের কাছ থেকে সে বহু ভালোবাসা পেয়েছে
এসবের তার দরকার নেই।
তাকে আবার বললাম- তোমাকে আমি ঘৃণা করি
আচমকা মুখ তার বিবর্ণ হয়ে গেল
যেন সে এই প্রথম কারো কাছ থেকে ঘৃণা পেল।

মনে মনে বলি, এখন তুমি কি দেবে আমাকে ?
তোমার কিছুই নেই- ভালোবাসা নেই, ঘৃণাও নেই।


১৬.     একটি শায়েরী


আমার ভাঙ্গা ঘরে তুমি ঘোমটা মাথায় এসে দাঁড়াইও। আমার শূন্য ঘর ধন ধান‍্যে ভরিয়া উঠিবে।
আমার মৃত্যুর পর দূর্বা ঘাসের কবরের পাশে
এলো চুলে তুমি কাঁদিও। মরণকে আমার সুন্দর মনে হবে।

ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের লেখা একটি গজলের কয়েকটি পংক্তি --

'কভি তো সুবহ্ তেরে কুঞ্জ‌-লব সে হো আগাজ 
কভি তো শব সর-এ-কাকুল-সে মুশ্কবার চলে৷'

কখনও তো ঠোঁটের কোণ্ থেকে তোমার ফুটে উঠুক ভোর, কখনও তো বিণুনী থেকে ঝরে পড়ুক মৃগনাভি সুরভিত রাত।


১৭.       প্রেরণাদাত্রী


নিভু নিভু করে নিভে যাচ্ছে দিন। সন্ধ্যার অস্তরাগ নিঃশেষিত করে নক্ষত্রের আকাশকে ঢেকে দিচ্ছে রাত। নিস্তব্ধতার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কেউ একজন কানের কাছে বলছে ----

ক্লান্ত হইও না তুমি। অমরতার লগ্ন এখনও আসেনি তোমার। সময়কে বরণ কর সৃষ্টিতে।
তোমার অনেক কিছুই আছে। ফেলে আসা কুসুমপুরের মাটি। কুর্চি ফুলের গন্ধ। জোনাকির ঝিল্লি গান। শরতের জ‍্যোৎস্না, জলাভূমি, নদী, রুপালি বালুচর, বাঁশের বন, স্বপ্ন আর রূপকথা।

তুমি অতিক্রম কর তোমার কাল।
মানুষের কাছে, ইতিহাসে, সভ‍্যতায় তোমার সৃষ্টির চিহ্ন রেখে যাও।


১৮.      হারিয়ে গেছে 


এখানে অট্টালিকার আড়ালে চাঁদ লুকিয়ে থাকে 
ছাই ভস্ম হয়ে উড়ে যায় যতো মেঘ
সহাস্য মুখখানি তার ভেসে যায় অন্তরালে।    

এইসব মেঘের নীচে ছেলেবেলা হারিয়ে গেছে 
কবেকার সন্ধ্যার পাখি সব ডানা মেলে চলে গেছে
সেই কবে লুকোচুরিতে কেটে গিয়েছিল বেলা।

ক্লাশে রাফ খাতায় টুকেছিলাম কিছু শব্দাবলী
পংক্তিও কিছু লিখেছিলাম ছন্দহীন
খাতার পাতায় ঝাউ পাতাও রেখে দিতাম 
এসবই জীর্ণ হলো, ছিঁড়ে গেল --
কোনও পংক্তিমালাই সম্পূর্ণ কবিতা হলো না আর। 

যাকে ভালোবেসেছিলাম অবগুন্ঠন খোলার 
সময় হলো না তার --
কোনও ঘাসফুল ফুটে পদ্ম হলো না
কোনও ছবি জলছবি হয়নি জীবনের।

কোথায় আমার হারিয়ে গেছে ছেলেবেলা --
কোথায় যেয়ে লুকাবো আমার মলিন মুখখানি।


১৯.      তুমি মণিভূষণ বেষ্টিত


তুমি নিজেই সন্ধ্যাতারা হয়ে জ্বলছ
তোমার আকাশে, 
আমার আঁধারে তাই তোমাকে খুঁজে না পাবার ভয় নেই।
তুমি শান্ত স্নিগ্ধ দীঘির জল -- 
সাঁতার কাটি সেই জলে প্রতিদিন প্রাণ ভরে।

তুমি ' মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে ' 
তুমি 'ধরণী’পরে ঝরে নির্ঝর, মোহন মধু শোভা
ফুলপল্লব-গীতবন্ধ-সুন্দর-বরনে।'


২০.        বুভুক্ষু এক হরিণী


তোমার ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়ে আশ্লেষ
বুক থেকে ঝরে পড়ে ক্লেদজ ঘাম
আলিঙ্গনে আলিঙ্গনে আমরা তবু ক্লান্ত হই না।

তৃষ্ণার্ত হরিণীরা নদীর শীতল  জল পান করে 
তুমিও বুভুক্ষু এক হরিণী যেন আমার কাছে।

যে মায়ানাভী তলে শূল বিদ্ধ হয় অস্থির সৈনিকের
তুমি তোমার রক্তাক্ত ভ্রুণের ভিতর আনন্দ খু্ঁজো।

পৃথিবী ঘুরছে তার কক্ষপথে, আমার ছায়াপথে 
তুমি মেতে থাকো প্রজন্ম জন্ম দেবার উৎসবে।


২১.      সম্পর্ক


কেমন নির্মোহ হয়ে যাচ্ছ তুমি দিনদিন 
কেমন বন্ধাত্ব্য সময় করছ পার
আনন্দ নেই, জোয়ার নেই, ঢেউ নেই
কেমন ছিন্ন কাগজের জোড়াতালি সম্পর্ক! 
আমার একার সম্পর্ক তো না, তোমারও- 
তুমি চাইলেই ছেড়ে যেতে পারো 
তুমি চাইলেই থেকে যেতে পারো 
তুমি চাইলেই আমাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারো
কি অদ্ভুত তাই না?

সম্পর্ক গড়তে দুটো মানুষের দরকার হয় 
আর ভাঙ্গতে একজন লাগে।



২২.      ইচ্ছেডানা


ইচ্ছে করে ডানা মেলে কোথাও আমি যাই উড়ে           
বিরহেরা থাক না পড়ে 
তোকেই রাখব প্রাণ জুড়ে 

মেঘে মেঘে ভেসে যেতে বড়ই আমার  সাধ জাগে 
তোর বিরহে দুচোখ আমার জলে ভিজে রাত জাগে

তোর কপালে লেখা ছিল অন্য কারোর নাম যে
মিছেই আমি প্রেমিক হলাম 
হয়ে গেলাম নিষ্কাম যে।


২৩.     অভিসারিকা


তুমি ধ্রুপদী এক হাওয়ার মতোন,
মনের তন্ত্রীতে কাঁপন ধরাও আজও। 
আজও তুমি উষ্ণতা দাও হিম দেহে। 
তুমি শেষ রাতের শ্বাস, নাকি চাঁদ!
প্রান্তরে কাশবন আলোয় ভরে ওঠে জ্যোৎস্নার প্লাবনে। 

ঘোড়ার পায়ের খটখট আওয়াজ তুলে মধ্যরাতে জেগে থাকি এখনও। এখনও লোভ হয় রাইফেলের গুলি চালাতে। রক্তাত্ত করতে ইচ্ছে করে ডাহুকীর নরম বুক। 

আমাকে কার্তুজ দাও। 
ট্রিগার চালাতে কাঁপে তর্জনী। বারুদের গন্ধে ভাসুক রাতের আকাশ বাতাস।


২৪.       যত দূরেই যাই


তোমার জন্য বিকেল গুলো বিষাদ হয়ে 
থাক্ 
আমি থাকব-- সন্ধ্যা তারায়  আকাশের 
গায়,
তোমার জন্য আঁধারগুলো নিবিড় করে  থাক্
আমি নেব আঁধারেতে জোনাক জ্বালার দায়।

তুমি হবে  চিত্রিত  ভোর  সোনালি 
আলোর
রোদ্দুর হয়ে আঁকব আমি রূপালি 
ঝালর

আমার হোক বেদনভরা অথৈ জলে 
ঠাঁই!
তুমি থাকবে হৃদ কোঠরে যতদূরেই 
যাই।



২৫.     দুপুরের শব্দ 


ইচ্ছা করে কোনও বাউল দুপুরে একটি ছন্দহীন কবিতা লিখি। একাকী কোনও পাখি ক্লান্ত চোখে যেমন চেয়ে 
থাকে, তেমন করে পৃথিবীর দিকে চেয়ে থেকে ভালোবাসার কোনও গান শুনি।
কেউ কী নেই? নিস্তব্ধ দুপুরের এই নিস্তরঙ্গ শব্দগুলোকে
বিসমিল্লা খাঁর সানাইয়ের সুরের মতো মায়াবী করে কণ্ঠে তুলে দিতে?


২৫.      দাঁড়িয়ে আছো 


হঠাৎ করে শরীর খারাপ লাগলে মনটাও খারাপ হয়ে যায়। তখন মনে হয় কেউ আমার শিয়রে এসে বসে থাকুক। হাতটি আমার ধরে রাখুক তার হাতে। 

কেমন যেন ক্লান্তি লাগে। দূরে কোথাও নিভে যায় দীপ অন্ধকারে। তখন অবসাদ নেমে আসে। ঘুম এসে যায় চোখে। 

বিকেল বেলা ঘুমিয়েছিলাম অসময়েই। ঘুম ভাঙার পর দেখি, আমার শিয়রেই সে দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলের রৌদ্রে মলিন লাগছিল তার মুখখানি।  

কবিগুরুর গানের কথা একটু ঘুরিয়ে বলতে ইচ্ছা হলো --
'দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার জীবনেরই পাড়ে'।


২৭.     তোমার হলো


তোমাকে ভালোবাসার আগেই আমার মায়াগুলো তোমার হলো
তোমাকে ভালোবাসার আগেই আমার স্বপ্নগুলো তোমার হলো
তোমার জন্য আমার সারা বিকেলের অপেক্ষাগুলো তোমার হলো
তোমাকে পাওয়ার জন্যে আমার আকুলতাগুলো তোমার হলো
তোমাকে না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাসগুলো 
তোমার হলো
যে চুম্বনগুলো দেওয়া হয় নাই সেই অতৃপ্তিগুলো তোমার হলো
তোমাকে না পাওয়ার সকল গ্লানি ক্লেদ 
তোমার হলো
তোমার জন্যে অন্ধকারে এই যে বসে থাকা তাও তোমার হলো
আমার সকল কান্নার অশ্রুজলগুলো 
তোমার হলো
আমার এই সমস্ত সকল দুঃখের ভার আজ থেকে তোমার হলো।


২৮.       পরকীয়া


যে রমণীটি আমার নয়
সে যদি আমার কাছে আসে সে কেমন হয়
যে শরীর আমি ছুঁইতে চাই না
তা যদি আমাকে ছুঁইতে হয় তাই কি হয়!

ছুঁইতে চাই না তবু ছুঁইতে দিতে হয়
মন যেন কেমন আমার উদাস উদাস হয়
না ছুঁইলেও আবার কষ্ট হয়!

একি মুহূর্তের কোনও মহত্তম প্রেম তবে
অচ্ছূত রমণীটি যে আমার কাছে বারে বারে দেবী হয়ে ফিরে আসে।

( উৎসর্গ :   মন্দাক্রান্তা সেন।) 


২৮.       আর কত মৃত্যু 


মানুষ মরে পড়ে থাকে রাস্তার উপর
পাশ দিয়ে দ্রুত বেগে গাড়ীগুলো চলে যায় ধেয়ে
কর্কশ হর্ণ বাজে ক্রন্দনের শব্দে
শেষ চাহনীতে তার দেখা হলো না প্রিয়জনের অশ্রুবিন্দু
তার চোখ চেয়ে দেখেছে কেবল মৌন নীল আকাশ।

মানুষ মরে পড়ে থাকে রেস্তোরায় নীল নীল আলোর দীপাবলীতে
রক্তে ভেসে যায় সুগন্ধি মাখা জামা,
টি-সার্ট, ট্রাউজার্স
এমন মৃত্যু দেখেনি হিরোসিমার মানুষ
মিলানের মানুষদের কর্মচাঞ্চলতা সেদিন কি থেমে গিয়েছিল আপিসে ?
তর তর করে রক্ত গড়ে গেছে আর্টিজানের মেজে ভেসে  লেকের জলে
প্রাণহীন চোখের অশ্রুজল দেখতে পায়নি কোনও কন্যাী জায়া জননী।

মানুষ মরে পড়ে থাকে মশুলে
মানুষ মরে পড়ে থাকে আলেপ্পোতে
মানুষ মরে পড়ে থাকে আরব সাগরে
মানুষ মরে ভাসছে আটলান্টিকে
আর কত মৃত্যু দেখবে মানুষ
আর কত রক্ত ঝরলে শুদ্ধ হবে ধর্ম
আর কত লাশের স্তুপ দেখলে আধিপত্য শান্ত হবে।

কোন্ সভ্যতায় বসবাস করছে মানুষ
কোন্ পাপ পুণ্যের জন্য এত গোলা,এত রাইফেল, গ্রেনেড আর শাণিত তরবারি
আমরা মৃত্যু চাই না,আমরা শান্তি চাই.
করজোড় তোমাদের কাছে, বন্ধ করো সব হত্যা,গণহত্যা, সব রক্তপাত !


৩০.      সেলিয়া - ফিডেলের প্রেম


তারা দু'জনই দ্রোহ করেছিল বাতিস্তার বিরুদ্ধে একসাথে
তারা দু'জনই বিপ্লবী, যুদ্ধ করেছিল  রনাঙ্গনে একসাথে
তারা কি প্রেম করেছিল দু'জনই হৃদয়িক বিপ্লবে একসাথে?

সেলিয়া ফিডেলকে বলেছিল তুমি আমার প্রেম
ফিডেল বলেছিল আমি তোমার দেশপ্রেম
যুদ্ধমাঠে সেলিয়া  বিপ্লবী যোদ্ধাদের সেবা করেছে
সেলিয়া যুদ্ধমাঠে ফিডেলকে শুধুই কি সেবা করেছে ?

সেলিয়া তোমার রূপ কি বারুদের গন্ধে মেশেনি কিউবার আকাশে ?
তোমার অপরূপ রূপ কি একবারও বিমোহিত করেনি ফিডেলকে ?
তা্ঁবুতে তা্ঁবুতে সেদিন কি কেবলই অস্তের ঝনঝনানি বে্ঁজেছে ?
তোমার অন্তরদোলায় একবারও কি দুলে ওঠেনি ফিডেলের অন্তর আকাশ ?


৩১.         এখন ভালোবাসার      সময়

মন শোনে না মনেরই কথা, তোমার কথা কি শুনব আমি? 
আমি যে অবাধ্য এখন তোমার প্রেমে।

তুমি যখন তখন আস নেমে, ধরো হাত --
শরীরের উপর তখন সূর্যের উত্তপ্ত রোদ্দুর পড়ে
অগ্নুোৎসব শুরু হয় দুজনের মর্মরে মর্মরে।

অবাধ্য হই সকল নিয়ম বিধি নিষেধে
পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থ দূরে সরিয়ে রাখি 
আমার যে তখন ভালোবাসবার সময়।

ডাক্তার চলে যাক হাসপাতালে
উকিল চলে যাক কোর্টে
বিচারপতি বসুক তার এজলাসে 
সাংসদেরা চলে যাক সংসদে
আইন তৈরি করুক আমার বিরুদ্ধে, আমার প্রেমে।

আমি এসব আইন মানি না --
আমার যে এখন ভালোবাসার সময়।


৩২.     দেবযানী 


তোমাকে নিয়ে এই শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে ইচ্ছা করে। তুমি সাদা রঙের মিরপুরের জামদানী শাড়ি পরবে। শাড়ি থেকে  কড়কড়ে মাড়ের গন্ধ ভাসবে বাতাসে। 

তুমি বলবে -- 'আমি নীরা নই, মাধবীলতাও না, সুনন্দা, কিংবা রূপাও নই।' আমি বলব -- 'তুমি দেবযানী হয়ে ওঠো আজ।

রাত দুপুরে তোমাকে নিয়ে এই শহরের পথে পথে হাঁটতে বের হবো। ট্রেনে চেপে দূরের কোনও স্টেশনে চলে যাব। যেখানে ধুপছায়ার আমলকী বনে শ্রাবণ মেঘের বৃষ্টিতে ভিজব রাতভর  দুজন।


৩৩.     স্বপ্নঘুড়ি


আমার হাতটি ধরে বহু পথ হেঁটে চলেছে।
পথ চলতে চলতে পথের ক্লান্তি কখনও গ্রাস করে নাই। 
তার ছোট ছোট ভালোবাসার কথা 
আমার ভালো লাগত। 
আমারই মনের আকাশে উড়াত স্বপ্নঘুড়ি। 

বুকে তার সারা জীবনের স্বপ্ন গাঁথা। 
সেই স্বপ্নই কি আমার ঘুমের মাঝে স্বপ্ন হয়ে আসে? 


৩৪.     হেমন্তের জনারণ্যে


অনেকটা হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল আজ দু'জনের
শহরের পিচ পথে লাইট পোস্টের নীচে যেখানে অন্য কেউ ছিল না
আলো আঁধারের নিমগ্নতায় তোমাকে দেখলাম
শুষ্ক খুসকো খুসকো ঠো্ঁট যেখানে চুম্বনের দাগ পড়েনি অনেককাল-
দেখলাম বুকের আঁচল ম্রিয়মান, যেখানে কোনও সুগন্ধি ছিল না
মনে হলো কতোকাল এই বুকে কারোর একটি আলিঙ্গন পড়েনি।

আজ আর তোমার হাতখানি ধরা হলো না
মেহেদিহীন কোমল নোখগুলো হয়ে গেছে পর
হাঁটছিলাম এলমেল দু'জন 
এভাবে হাঁটে না কোনও প্রেমিক প্রেমিকা
তোমার সেই কাজল আ্ঁকা চোখ দু'টো দেখছিলাম বার বার
কাজল নেই সেখানে কালচে হয়েছে জল পড়া  নুড়ীর মতো
যেখানে কোনও দুঃখ ছু্ঁইতে দেইনি কোনও সময়ে কোনও অনাদরে
সেই তোমাকে দেখছি আজ হয়ে গেছ দীনহীনা অভাগীর মতো।

পথচারীরা আজ কোনও দুঃখ দেখল না তোমার
এরাই সাক্ষী ছিল একসময় কত ভালোবাসার স্পর্শের
কত চুম্বন দেখেছে পার্কের পাখি, কত আলিঙ্গন দেখেছে বনের কাকাতূয়া
আজ এই হেমন্ত সন্ধ্যায় সে সবই দুঃখ জাগানিয়া নস্টালজিক,
কোনও কথা না বলে কোনও চুম্বন আর আলিঙ্গন না রেখেই
বিষাদময় এই সন্ধ্যায় জনারণ্যে তুমি হারিয়ে গেলে।


৩৫.     চন্দনে চন্দনে 


শাড়ির আঁচল মুখে পড়ে আছে তার 
রাত ভোর ছিল বুনো চন্দনের গন্ধ,
তার আগের রাতে ভেসেছিল কোজাগরী চাঁদের জ্যোৎস্নায়।

এমনই তুমি
এমনি মায়াবতীর জন্য কতকাল বসেছিলাম 
চন্দনের গন্ধ মেখে বুকে
কত জ্যোৎস্না ভেসে গেছে নিশীথ অন্ধকারে।

সেই তুমি এখন এত কাছে যে, 
চন্দনে চন্দনে জ্যোৎস্নায় জ্যোৎস্নায় একাকার হয়ে আছ আমারই কাছে।


৩৬.       জলকাব্য


আমি বুঝতে পারি না, কোন্ মেঘ থেকে কখন বৃষ্টি ঝরে। আমি দেখতে পারি না, মেঘ সরিয়ে রবি কিরণের আলোক সম্পাত। সূর্যের বেপথু কিরণে রাতের আকাশের তারাদের ঔজ্জ্বল্য।

হঠাৎই কখনও কখনও মন আমার বৈরাগ‍ী হয়ে ওঠে। আমি বুঝাতে পারি না, আমার প্রণয় বিহ্বলতার
কথা। আমার অপ্রকাশিত শিহরণ সুখ কোন্ মেঘময় আকাশ থেকে জল হয়ে নদীতে ঝরে পড়ে।

কখন যে নদী বিহ্বল হয়। আকুল হয়ে মিশতে থাকে সাগরে। মেঘও পরাজিত হয়। রবিকিরণ উত্তাল তরঙ্গে একাকার হয়ে যায়। আর জলবিন্দু সমুহ নদীর আবক্ষ গহ্বরে হয়ে যায় বিলীন।


৩৭.        রোদ্র ক্লান্ত দুপুর


একি কোনও মায়াজাল তবে? 
আমার সকল ভাবনায়
সকল পাওয়ার আকুলতায়
এই রোদ্র ক্লান্ত দুপুরে তোমাকে কাছে টানতে মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে 
আমার অন্তর্মহলের সমস্ত দুয়ার খুলে যায় 
আমি নির্মোহে শূন্য করে দিতে চাই সব।    

তখন তুমি ছিলে রবীন্দ্র সঙ্গীতে 
থামিয়ে দিয়ে সব গান দিলে বাহু পেতে 
বললে, 'এসো এসো আমার ঘরে এসো।'


৩৮.        বিদায়ী পংক্তিমালা


যে ছেলেটি একদিন ট্রেনে করে এসেছিল এই ঢাকা শহরে
সে আজ শববাহী যাত্রী হয়ে চলে যাচ্ছে তারই শহরে,
তার জ্বলজ্বলে চোখ ভালোবেসেছিল বাংলাদেশের মানচিত্র
উদ্দাম তারুণ্যে বার বার হেঁটে গেছে রবীন্দ্র সরোবরের কাছে
যেখানে নিহত হয়েছিলেন স্থপতি, জাতির পিতা ইতিহাসের সেই আদর্শিক পিতার ছবিকে করেছে কুর্নিশ।

বহিমিয়ান ছিল না সে, সে  লিখত কবিতা
জীবন থেকে শব্দ তুলে এনে লিখত গল্প 
কোনই অভিমান ছিল না তার ! ধূসর এই হেমন্ত সন্ধ্যায়
চলে গেল সে শীর্ণ এক নদীর  তীরে, শেষ খেয়াটির অপেক্ষা না করে।


৩৯.     হাওয়ার রাতে 


জীবনের দৃষ্টিপাত একজায়গায় কেন?  কত গান আছে জীবনের।  আরো কত স্পন্দন আছে হৃদয়ে এবং আত্মায়। সেসবও কিছু শুনতে হয়।

খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। মনে হয় সারাজীবন ছুঁয়ে থাকি। জীবনের পরেও।

এই পৃথিবীতে অনেক ভালো মানুষ আছে। তাদের চিনে নিতে হয়। তাদের ধরে রাখতে জানতে হয় যত্ন করে।

এই হাওয়ার রাতে কত হাসনাহেনার গন্ধ ভাসে। কত মনখারাপের কথা লুকিয়ে থাকে অন্ধকারে! কেউ কেউ গল্পের বই নিয়ে বিছানায় শোয়, আর কেউ কেউ জীবনের শেষ পাতা লিখতে বসে যত্ন করে....


৪০.          না কবিতা না তুমি


কবিতার মধ্যে তুমি লুকিয়ে থাকো, সামনে আসতে পারো না দুরন্ত সাহস নিয়ে। ভাঙ্গতে পারো না অচলায়তন, অবাধ্য হতে পারো না নিষিদ্ধ নিষেধাজ্ঞার। 
তোমার এলমেল চুল বাতাসে উড়ে, চোখ দুটো মেলে থাকে, 
তপ্ত দুপুরে পথিকহীন উড়োখুরো পথের ধুলোয়। যেখানে কোনও বসন্ত সন্ধ্যা বেলায় ভুল করে আমি কখনই হাঁটিনি।

আমাকে টানে মধ‍্যরাত্রির উতলা হাওয়া, নক্ষত্রহীন নিঃসঙ্গ আকাশ। 
আমি গাঢ় অন্ধকারের ভিতর তোমাকে খুঁজি। স্বপ্নহীন ঘুমে তখন তুমি ঘুমিয়ে থাকো। আমার কবিতার শব্দে তোমার ঘুম ভাঙ্গে না। 
কী উষ্ণতা চাও, আমার কবিতার কাছে। আমি সমর্পণের জন্য সারারত্রি জেগে থাকি।

তোমার জন্য আমি কবিতার কাছে দেউলিয়া হয়েছি। 
ভুল করে কবিতা নির্মাণ করেছি এক রাখাল বাঁশির উদাসীন দুপুরে। 
কবিতার সারা অঙ্গে পরিয়েছি অর্থহীন উপমা উৎপ্রেক্ষা। 
ক্ষরণ করেছি রক্ত কবিতার দেহে, তোমার আত্মায়। 
আমি যশ চাইনি। আমি কবি হতে চাইনি। আমি কবিতায় তোমাকে চেয়েছি। 

এই গাঙে, এই জল ভূমিতে কত বান এল, বিবর্ণ এই গিরি উদ‍্যানে কত অগ্নুৎপাত হলো। শুধু তোমার জন্য আমি অথৈ জলে ভাসতে চেয়েছি, 
দহন দাহে আমাকে পুড়ে ছারখার করতে চেয়েছি। 
তবুও কিছু পাওয়া হলো না, 
না কবিতাকে, না তোমাকে।


৪১.    কোনও যতিচিহ্ন নেই


কিছু সময় আসে ভালোবাসা উন্মাতাল হয় 
নম্র বুকের উপত্যাকায় মেলে রাখি চোখ 
মদিরার মতো তার শরীর থেকে অচেনা গন্ধ ভেসে আসে 
স্বপ্ন ভেঙ্গে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়,
শরীর থেকে শরীরে হয় লেনদেন 
বেহিসাবী চাওয়া পাওয়া পূর্ণতা পায়-
দেহ নিবিড়ে তৈরি হয় এক প্রগাঢ় আলোড়ন....


৪২.      অজ্ঞাত যাত্রা 

   
আমি আগে কখনও প্রেম বুঝিনি 
তাই তো ঠোঁটকে মনে করতাম রক্তকরবী 
চোখকে মনে করতাম ময়ুরের পালকের ফোঁটা 
শরীরকে শরীর মনে হতো না
মনে হতো মণিরত্নম খচিত এক সর্পিণী, এঁকে বেঁকে চলেছে নদীর মতো।

সবকিছু রহস্যময় মনে হতো, বুঝতাম না গন্তব্য কোথায় ! সালভাদর দালির তুলির মতো হাতের আঙ্গুল 
উপত্যকা ছুঁয়ে চলে যেত অরণ্য পথে,
সেই পথ চেনা ছিল না কখনও আগে
গ্রীক দেবী আ়ফ্রোদিতিও এসে শেখায়নি  প্রেম শাস্ত্র 
ও কোনও কলাকৌশল।

আমার ছিল না কোনো বোধ কিভাবে সন্ততি হয়
জানতাম না কিভাবে সভ্যতার বিস্তার হয় 
কিভাবে জল ভেঙে জলধি তল থেকে মুক্তা তুলে আনতে হয়।
তারপরেও সাগরতলে অজ্ঞাত যাত্রার অভিযাত্রী আমাকে হতে হয়েছিল।


৪৩.        ফিরিয়ে নেব প্রেম


হঠাৎ একদিন দেখি তুমি বদলে গেছ
বদলে গেছে তোমার চুলের সিঁথি,
বদলে গেছে তোমার টিপের রং
শুনেছি অন্য কারোর সাথে বেঁধেছ ঘর।

আমি তো বহুগামী প্রজাপতি ছিলাম না
নস্ট নর্দমার জলও ছিলাম না
আমি নিজকে কখনো রাজহংসও ভাবিনি
তবে তুমি বদলে গেলে কিসের জন্যে।

আমি চলে যেতে চাই অজ্ঞাতে কোনও নিরুদ্দেশে
তার আগে তুমি ফিরিয়ে দাও আমার যত চুম্বন
ফিরিয়ে দাও বসন্ত দুপুরে দেওয়া যত আলিঙ্গন
ফিরিয়ে দাও আমার প্রজন্মের জল
যে জলে ভিজিয়েছিলে তোমার উর্বর ভূমি।

আমি কোনও অভিজ্ঞান চিহ্ন রেখে যেতে চাই না
ফিরিয়ে নেব প্রেম, যত দুঃখ, যত গ্লানি ।


৪৪.       তোমার গ্লানি


আমি তোমার চোখ দেখেই বুঝতে পারি, তুমি কী চাও --
রৌদ্র ক্লান্ত দুপুরে তোমার ঘুম এসে যায়
অযাচিত কোনও স্বপ্নের ঘোরে তুমি যা চাও
আমি তা বুঝতে পারি।

আমি বুঝতে পারি, তোমার বুকের নিচে অনন্ত উত্তাপ
তোমার কপাল ঘেমে যায়, ঘর্মাক্ত পিঠের উষ্ণতা বলে দেয়,
তুমি যা চাও সে আমার ছায়া। 

তুমি কখনও হেঁটে হেঁটে তোমার ঘরের সিঁড়ি পর্যন্ত নেমে আসো, দাঁড়িয়ে থাকো নির্লিপ্ত
আমি বিদ্ধ হই তোমার বুকের খাঁজে,
আমি বুঝতে পারি তোমার এই থেমে যাওয়া পথ চলায়
ধরতে চাও কার হাত।

ঐ হাত তোমার বিশ্বস্ত নয়, চোখের পাতার নিচে যে চরাচর 
সেখানে আমার বসবাস নেই।

এই আমি দিতে পারতাম, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম প্রেম
অজস্র ফলন যোগ‍্য ফসলের বীজ --
কিন্তু তুমি ভূমি নারী হয়ে উঠতে পারলে না।

৪৫.       সর্বভুক মাংস ও করোটি


অপেক্ষায় থাকি শাড়ির আ্ঁচল তুলে দেখব তোমার  পিঠের আঁচিল, দেখব সব কালো তিলক যেখানে আছে।

রমণীর কাছে কবিরা পরপুরুষ, প্রেমভোগী প্রজাপতি
ভালোবাসে ছিন্নভিন্ন ফুলের পাপড়ি
নরম মাংসের শরীর শুয়ে থাকে গ্রীবা বাঁকিয়ে নদীর মতো
ঝরে জ্যোৎস্না কা্ঁপে বসন্তের বাতাস দিগ্বিদিগ ঊর্ধশ্বাসে।

ভালোবাসি কলাবতী নারীর শরীর 
করি কুর্নিশ তার দেহপল্লবে
দেখি তার ভোগচিহ্ন, যখন রক্তাক্ত হয় সর্বভুক মাংস ও করোটি ।


৪৬.        অহংকার ছিল যৌবনের


তোকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, অহংকার ছিল যৌবনের
অহংকারে হেঁটেছিস তোর বাড়ির উঠোনে
কাঁদা লাগাসনি পায়ে, জলে ভিজাসনি শাড়ি
বলেছিলাম তোকে-- বু্নো জ্যোৎস্নায় স্নান করতে এক সাথে
তুই খুলেসনি শাড়ি, খুলেসনি অন্তর্বাস,
কিসের এত অহংকার ছিল তোর ?

যৌবন তো শুকিয়ে ফেলেছিস, অহংকার চূর্ণ করেছিস বলিরেখায়
নদীর জল শুকিয়ে ফেলেছিস
কোথায় সেই ফেনায়িত ঝর্নাধারা ?
অনুর্বর ভুমি, শুকিয়ে চৌচির হয়েছে মৃৃত্তিকা
এমন অনুর্বর ভুমি এমন জলহীন নদী 
কীসের এত আহলাদ তোর! 

যদি পারিস আবার নদী হ, আবার জলে ভর্ নদী
আবার উর্বর কর্ ভূমি
তবেই আমি লাঙ্গলের ফলা চালাব,
সাঁতরাব নদী।


৪৭.       একটি ভুল


ভুলটি কখন করেছিলাম? ঠিক
কখন? ক্লান্ত পাখির তৃষিত 
মর্মর দুপুরে?

প্রজাপতি লুকিয়ে পড়েছিল 
মহুয়া বনে
জলজ মেঘ শুকিয়ে গিয়েছিল।
তপ্ত রৌদ্রে
ভ্রমর উড়ছিল
তুমি কানের কাছে হাত উঠিয়ে 
ডাক দিয়েছিলে ইশারায়
কী দ্বিধা হলো
কী শিহরণে দুলে উঠল
মহুয়া বন
গাঁদা ফুলের ঝাড়!

ঘুম ঘুম শরীর
চোখের কথা
মনের কথা
নিস্তব্ধ দুপুর যেন
সব আলো নিভে দিল
কেমন অন্ধকার!

তুমি শুয়ে আছ ঘাসে
মৌ মৌ মৌনতা মহুয়া বনে
কেঁপে উঠল ধরিত্রী
ভরে উঠল নদী
মহুয়া ফুলের ঘ্রাণ তিন দিগন্ত
জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল
পাখি ডাকল
কবিতার মতো গাঁদা ফুলে
রোদ্দুর মাখা মেঘে
আকাশের ছায়ায়! 

কী ভুল আমরা করেছিলাম?
সব কী দুপুরের স্বপ্নের 
মতোন ছিল?
তোমার কী মনে আছে সেই
ভুলটির কথা!


৪৭.      মনে নেই

সারারাত যে ছিল পাশে সকালবেলা দেখি সে নেই। 
কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে ভেসে আসছে ধবল 
তুষার কুচি 
আমাদের যৌথ শরীর কখন বিচ্ছি্ন্ন হয়েছিল
কখন ছেদ পড়েছিল,
কখন তরঙ্গায়িত নদীর বা্ঁধ ভেঙ্গেছিল
কখন স্রোতধারা গড়িয়ে এসে ভিজে দিয়েছিল সারা বিছানায় --

বিমুগ্ধ সকালবেলায় কোনো কিছুই আর মনে পড়ছে না।


৪৯.         পৃথিবী


শুধু ভালোবাসতে চাই 
শুধু তুমি আমার সাথে থাকবে
আমি শুধু জানতে চাই 
তুমি আমার পাশে আছো কি?

একসঙ্গে আমরা একটি জীবনকাল অতিবাহিত করব
এটা আমাদের জন্য কঠিন হবে না
আমি তোমার সাথে আছি! 
আমার আত্মা তোমার আত্মায় একাকার, 
যাকে দুজনেই ভালোবাসি।

আমি তোমাকে ভালোবাসি
আমি চিৎকার করে বলছি, তোমাকে ভালবাসি।
আমার শ্বাস তোমাকে দিচ্ছি, তুমি তার প্রশ্বাস নিচ্ছ,
আমার স্পন্দন তোমার আত্মায় ধ্বনিত হচ্ছে ।

তুমি আমার আত্মা, সূর্য এবং সমুদ্র --- 
আমাদের পুরো জীবন এর চেয়ে সুন্দর আর কি! 
তোমার আমার জন্যই এই পৃথিবী তৈরি!


৫০.       চাই দেখার মতো সুন্দর চোখ


কোঁকড়া চুলের কোনো মেয়েকে চুল খুলে 
রাখতে দেখলে মনে হয়, ও কেন চুল বেঁধে রাখে না,
কেমন কাকের বাসার মতো ওর মাথার চুল!

ঐ কালো মেয়েটি 
কেমন গাঢ় রঙের শাড়ি পরে থাকে 
ও কেন হালকা নীল রঙের শাড়ি পরে থাকে না,
কেমন কিম্ভূত ওর কালো শরীর!

আর ঐ মেয়েটি অরক্ষণীয়া,
যত ছেলে দেখতে আসে পছন্দ করে না কেউ 
মেয়েটির পায়ে আলতা পরা হয় না
হাতে মেহেদি দেয়া হয় না, কপালে দেয় না টিপ!

আচ্ছা যদি এমন হয়, 
ঐ কোঁকড়া চুলের মেয়েটিকে বনলতা সেনের মতো দেখতে অসাধারণ লাগছে!
ওই শ্যামলা মেয়েটাকে গাঢ় শাড়িতে মোহনময়ী লাগছে!
আর ঐ অরক্ষণীয়া মেয়েটিকে কোনো এক 'রাজপুত্র' এসে 'রাজরানী' করে ঘরে তুলে নিয়ে গেছে।

চাই শুধু দেখার জন্য  সুন্দর চোখ!


৫১.      মনে রেখ না


জীবনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে দুঃখ খেদ 
হে আমার অনন্ত শৈশব 
আমার হেমন্ত বিকেল
ধানক্ষেতের মৃন্ময়ী গন্ধ 
তোমরা আমাকে মনে রেখ না।

প্রেম লুকিয়ে থাকে প্রেমিকার হৃদয় গহ্বরে
হে আমার জগৎ বিধ্বংসী বিষাদ রমণী 
আমার আকাংখার মৃত্যু
অস্বাদিত কামনার ছন্দ
তোমরা আমাকে মনে রেখ না।

যাতনা লুকিয়ে থাকে চোখের অশ্রু তলে
হে আমার দুঃস্বপ্নের রাত্রি
আমার নির্ঘুম চোখের তারা
অনাদরের সকল চুম্বন স্শর্শ 
তোমরা আমাকে মনে রেখ না।

মৃত্যু লুকিয়ে থাকে স্পন্দনহীন আত্মার ভিতরে
হে আমার স্বপ্ন সৌধে গড়া তাজমহল 
আমার স্বপ্ন ভঙ্গের দীর্ঘশ্বাস 
অপ্রেমের যত গ্লানি, নিঃসৃত বেদনা
তোমরা আমাকে মনে রেখ না।


৫২.         তুমি স্বৈরিণী নও 

পুরুষকে তুমি কী মনে করো ? পুরুষ মানেই কি মধুকর ?
তুমি স্বৈরিণী নও, ময়ুরাক্ষীও নও, তুমি প্রেমিকা
আমি চাইলেই স্ত্রৈণ হতে পারি না, 
তুমি পারো না স্বৈরিণী হতে,
আমরা যা-ই হই, স্ত্রৈণ কিংবা স্বৈরিণী
আমরা প্রেমবুভূক্ষু এক যুগল, ভালোবাসি প্রেম
যে প্রেম উৎসব করে দেহে, স্বর্গে কিংবা নরকে।


৫৩.       এসো জল দেই


বাড়িয়ে দাও হাত এসো স্পর্শ করি
যে হাতে আমার ছোঁয়া পড়েনি
সে হাতে কোনই অলংকার কী মানায়? 

এসো বুক বাড়িয়ে দাও, আলিঙ্গন করি
যে বুকে জড়াওনি আমার বুক
সে বুক কী কখনও বনমল্লিকা ফুটবে? 

ঠোঁটও তো শুকনো হয়ে আছে, এসো চুম্বন আঁকি
যে ঠোঁটে আমার স্বপ্ন ছোঁয়া নেই
সে ঠোঁটে কি কৃষ্ণচূড়ার আগুন জ্বলবে? 

উপত্যাকায় লতাগুল্মে ছেয়ে ফেলো না
নদীতে জল ভরো ,খরস্রোত রাখো মোহনা
এসো জল দেই, সাঁতার কাটো সহস্র বছর।

মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

অনুগল্প ( পাণ্ডুলিপি )

১.       নীল অপরাজিতা


ইতিহাস তার গৌরব-গর্ব ও কলঙ্ক দায়কে একসূত্রে গেঁথে  রাখে। এই গেঁথে রাখা পথ বেয়েই মানুষের প্রবাহমান জীবনস্রোত বয়ে চলে কাল থেকে কালান্তরে। ইতিহাসের এমনি এক ধূসর পথে সীমান্ত-শহর মেহেরপুরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আমঝুপি। এই পথে একদিন মোঘল-সেনাপতি মানসিংহের বিজয়-রথ ছুটেছে, এই পথে ভাস্কর পণ্ডিতের বর্গীদল ধূলি উড়িয়ে গেছে লুণ্ঠনের কালো হাত বাড়িয়ে, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতি নবাব আলীবর্দ্দী খাঁ-র মৃগয়ায় স্মৃতিও রয়েছে এইখানে। পলাশীর পরাজয়ের নীল-নকশাও রচিত হয়েছিল এইখানে-এই আমঝুপিতে।
 
অনেকদিন আগে কোনও এক হেমন্তের সকালে কাজলা নদীর তীরে আমঝুপিতে নীলকুঠি দেখতে গিয়েছিলাম। আমার সাথে ছিল জেসমিন নামে একটি মেয়ে। মেহেরপুর থেকে আধাপাকা পথে রিকসায় যাচ্ছিলাম আমরা। পথে যেতে যেতে রাস্তার দু'পাশে দেখেছিলাম নীল অপরাজিতার ঝাড়। একটি কাকতালীয় ঘটনা সেদিন ঘটিছিল --- জেসমিনের পরনে ছিল নীল রঙের সালোয়ার কামিজ, আমার পরনে ছিল নীল টি-সার্ট, মাথার উপর নীল আকাশ, রাস্তার দু/পাশে নীল অপরাজীতা - দেখতে যাচ্ছি আমজুপির নীলকুঠি। কি মুগ্ধ  চোখে দেখেছিলাম সেদিনের সেই অপরাজিতা, যার রং ছড়িয়ে গিয়েছিল জেসমিনের চোখে মুখে। 

ও বলছিল -- কেমন যেন এই নীল, কেমন বিষাদময় -- এত নির্জন এখানে ! মনে হচ্ছে, কেউ আছে কেউ নেই! 

সব কথার অর্থ তাৎক্ষণিক বোঝা যায় না। আর বোঝা গেলেও মুহূর্তে তার  উত্তর দেওয়া যায় না৷ আমার হয়েছিল তাই। দেরি করে ফেলেছিলাম বুঝতে । 

সে আফসোসের কথা থাক। 

আমরা চলে যাই কাজলা নদীর পাড়ে। দেখছিলাম স্থির স্বচ্ছ জল! নদীর তীর ধরে  ধূলি পথে আমরা হেঁটেছি দুজন। দেখেছিলাম নীলকুঠি। ভগ্ন কুঠিরের পলেস্তারা ভেদ করে উঠেছে কত পরগাছা। লতাগুল্ম তার বিষণ্ণ সবুজ।  কেন যেন মন ভালো লাগছিল না! শত বছর আগে কৃষকের বঞ্চনার করুণ  হাহাকারও কানে বাজছিল তখন !

তারপর চলে গেছে অনেক বছর। চলে গেছে অনেক হেমন্তের কমলা রঙের মধুময় দিন। অনেক আনন্দ বেদনা পার হয়েছে জীবনের। 

এখন কেবল মনে পড়ে -- এখনও হয়তো কাজলা নদীর দুপাড়ের পথে পথে ধুলি উড়ে, এখনও হয়তো পথের দু'ধারে নীল অপরাজিতা ফুটে থাকে। হেমন্তের রোদ্দুর তেমনই হয়তো আলো ছড়ায়। 

কত সুন্দর মুহূর্ত-- মুহূর্তেই লুপ্ত হয়ে যায়! এই জীবনে কতকিছুই  নিছকই সব ক্ষণকালের হয়। জেসমিন নামের সেই মেয়েটিকে আর কোনদিন পাশে পাওয়া যায়নি।  কোথাও আর দেখতেও পাইনি। এরা যে ক্ষণিকা। এরা ঐ নীল অপরাজিতার মতো ফুটেই ঝরে যায়। 




২.        সানফ্লাওয়ার


সে ছিল মধ্যবয়সী এক রমণী। শরীরের বাঁকে বাঁকে জমে গেছে রেখা। মেকআপের নীচে পরিচিত তিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই দোতালায়। সুপারহিট ম্যাটেনী শো। সোফিয়া লরেনের সানফ্লাওয়ার। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ। সুনসান নীরবতা। ভয়ে ত্রস্ত হলাম, সোফিয়ার চুুলের কাঁটা গিলে ফেললো মার্শেলো।
ঝুঁকে পড়ে রমণী। আমার হাত থেকে ক্লাশ পালানো বই খাতা নীচে পড়ে যায়। কলমটাও হারিয়ে ফেলি অন্ধকারে। কাটতে থাকে রোমাঞ্চ সময়। ম্যাটেনী শো শেষ হয়। সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নেমে আসি। রাস্তায় ব্যস্ত গাড়ীর হর্ণ বাজছে। বসন্তের ধূলো উড়ছে। বিকালের রোদটাও ঝাঁ-ঝাঁঁ করছে। বিদগ্ধ মাঝ বয়সী রমণী রিক্সার হূড তুলে রামকৃষ্ণ মিশনের দিকে চলে যায়।

ইউনিভার্সিটির হলে শুয়ে আছি। মাথা ঝিম ঝিম করছে। সন্ধ্যাকে মনে করছি মধ্যরাত। ঘুমের ঘোর নাকি, স্বপ্নে আছি ! কে যেন বলছে- থেমে যাও তরুণ ! নিঃসঙ্গ নারী নাভীতলে মগ্ন হয়ো না। নিঝুম পুষ্প বৃষ্টিতে ভিজিও না। এ সব মায়ার সময় এখন তোমার নয়-
আমি দু'হাতে ছুঁতে চেয়েছি সবুজ অরণ্য ,
বুকের তলায় বেঁধেছি অনেক স্বপ্ন-
বাড়িতে যাই না --- ছোট বোন অভিমানে তাই বেণী গাঁথে না
মা পথের দিকে তাকিয়ে থাকে বিমর্ষ চোখে--
নষ্ট ঠোঁটের গন্ধ নিতে চাই না
আলোগুলো ফেলতে চাই না কোনো ভ্রষ্ট রক্তের বিন্দুতে।


৩.      ময়মনসিংহ জংশন



অনেক দিন আগের কথা। নতুন বিয়ের পরে বউকে নিয়ে ময়মনসিংহে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। যেদিন ঢাকায় ফিরব সেদিন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম ময়মনসিংহ জংশনে। ট্রেন আসতে অনেক লেট। স্টেশনের একটু পূর্বদিকে পুরানো একটা বেঞ্চে বসে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। একজন পঞ্চাশোর্ধ লোক তখন আমাদের কাছে ঘুর ঘুর করছিল, বার বার তাকিয়ে দেখছিল আমার বালিকা বধূকে। কিন্তু তার সেই চাহনিতে কোনো লাম্পট্য ছিল না। খুব মায়া করে দেখছিল ওকে। এক পর্যায়ে লোকটি আমাদের পাশে এসে বসে। এবং আগ বাড়িয়ে সে-ই কথা বলছিল বেশি। সে নেত্রকোনা যাবে। লোকটি আমাদের এটা ওটা কিনে খাওয়াতে চায়। আমরা বিরক্ত হই। সে আমার বউয়ের সাথে টুকটুক করে কথাও বলছিল । হঠাৎ লোকটি উঠে চলে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, যাক, বাঁচলাম। 

ঢাকার ট্রেন আসতে তখনো আরো দেরি। আমরা বসেই আছি। প্রায় আধা ঘন্টা পরে লোকটা আবার ফিরে আসে। দেখি তার হাতে একটি প্যাকেট। আমার স্ত্রীকে প্যাকেটটি দিয়ে বলে -- মা, এই তাঁতের শাড়িটি তোমার জন্য্ কিনে এনেছি।' আমার দিকে তাকিয়ে বলে -- 'বাবাজি ঠিক ওর মতো দেখতে আমার একটি মেয়ে ছিল। মাত্র একমাস আগে আমার সেই মেয়েটি মারা গেছে।' 

ওনার চোখে মুখে আমি একটি মায়াময় পিতৃমুখ দেখতে পেলাম।  ওনার হাত থেকে শাড়ির প্যাকেটি আমার স্ত্রীকে নিতে বলি। শাড়িটি নেয়ও সে। ইতোমধ‍্যে আমাদের ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছে । খুব তাড়াহড়ো করে লোকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ট্রেনে উঠে পড়ি। 

ট্রেনের সিটে বসে আছি। আমার স্ত্রী খুব মন খারাপ করে বলছিল --- 'তুমি ওনাকে আমাদের বাসার ঠিকানাটা দিয়ে আসো।' ভাবলাম নেমে গিয়ে ঠিকানাটা ওনাকে দিয়ে আসি। কিন্তু নামা হলো না। ট্রেনটির ছাড়বার হূইসেল তখন বেজে উঠেছে। এবং ঝিকঝিক করে ট্রেনটি ছেড়ে চলে আসতে থাকে ঢাকার দিকে।



৪.       ঊষা চক্রবর্তী


আমার বিয়ের মেয়ে দেখবে। তাই ছুটি নিয়ে ঢাকা থেকে বাড়িতে এসেছি। বাড়িতে মা আর এক দু'জন কাজের মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। শরীর ক্লান্ত ছিল, তাই  খাওয়াদাওয়া করে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ি। আমি একাকী এক ঘরে শুয়েছিলাম। হারিকেন এক কোণে টিমটিম করে জ্বলছিল। 

গ্রামের রাত। ক্রমেই  নিঝুম হয়ে আসছিল কিন্তু ঘুম আসছিল না । ঝিঁঝি পোকা আর পিছনের বাঁশঝাড় থেকে থেমে থেমে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছিল। রাত ক্রমে গভীর হতে থাকে। 

হঠাৎ, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যায়। আমি কান পেতে আছি দরজা খুলছি না। একটুু পর  মেয়ে কণ্ঠের গুমরে গুমরে কান্নার ধ্বনি শোনা গেল। ভাবলাম কে কাঁদছে ? আমি হারিকেনের আলোটা বড় করে দরজা খুলে দেই। দেখি --- সাদা ধবধবে একটি শাড়ি পরে আমাদের গ্রামের ঠাকুরবাড়ির ঊষা চক্রবর্তী দাঁড়িয়ে আছে।কতদিন পর ঊষাকে দেখলাম। কী প্রসন্ন বিমল মুখকান্তি মুখ ওর! ভুবন আলো করা সেই মুখ অবগুণ্ঠনমুক্ত। মাথা জুড়ে
আবেণীবদ্ধ কেশদাম এই রাত্রিতেও শোভাবর্দ্ধন করছে। ঊষা আমার সাথে একই স্কুলে পঞ্চম ক্লাশ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে, সুচিত্রা সেনের মতো চোখ, রাধিকার মতো নাক, চাঁপাফুলের মতো চিবুক। 

ঊষা সোজা ঘরে ঢুকে আমার বিছানায় এসে বসে পড়ে। তখনও সে কাঁদছিল। আমি ওকে বললাম, তুমি এত রাতে একাকী আমার ঘরে আসলে কেন ? উষা বলল - 'তুমি আমাকে ঢাকা নিয়ে যাও। যদি না নিয়ে যাও, তাহলে কালকেই আমি আত্মহত্যা করব।' মনে মনে ভাবলাম- 'বিয়ের পাত্রি দেখতে এসেছি, এ কোন্ বিপদ !'  আমি বললাম --- 'আমি তো তোমাকে কখনও ভালোবাসি নাই। তুমি এসব কথা বলছ কেন ? 'উষা বলল- 'তুমি ভয় পাইও না, আমি তোমার ঘর করতে আসি নাই। তুমি কেবল আমাকে কাশীতে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে।' এই কথা বলে ঊষা চক্রবর্তী ঘর হতে বের হয়ে চলে যায়।

পরের দিন ভাবলাম -- আপদটি আবারও যদি আজ রাতে আসে, তাই ভয়ে মাকে সরল মনে ঘটনাটি বলে দিই।  মা বিস্ময়ে বলল - ঊষা চক্রবর্তী আসবে কোত্থেকে ? ও তো দুই দিন আগে ওদের বাড়ির বকুল গাছের ডালে ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।'


৫.       প্রথম পুরুষ


নাগাল্যান্ডের পাহাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গ্রামের ঘটনা। ওখানকার গোত্রের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের আগে বর ও কনেকে একদিন একই ঘরে এক সাথে রাখা হয়। যেন তারা একে অপরে ভাব বিনিময় করে বিয়ে করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারে। এই অনুষ্ঠানটি খুব উৎসবের সহিত করা হয়। 

এই রকমই এক অসম্ভব সুন্দর হবু বর ও কনেকে একই ঘরে রাখা হয়। বাইরে তখন উৎসব চলছে। ঢাক ঢোল গান বাজনা নৃত্য হচ্ছে। দিন শেষে সন্ধ্যায় বর বিষণ্ন বদনে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বরের কাছে যেয়ে বরের দিদিমা জিজ্ঞাসা করে ---  'কিরে মন খারাপ কেন, পছন্দ হয় নাই ?'

বর :  না।
দিদিমা:  বলিস কি ! এত সুন্দরী ছুকড়ি, তাও ভালো লাগল না !
বর:  ও একটা অকর্মা মেয়ে, ওকে দিয়ে কিছু হবেনা। ওকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
দিদিমা:  কেন, কি করেছে ?
বর:  ও এখনও ভার্জিন। আমি ওর প্রথম পুরুষ।

এই কথোপকথন পাশ থেকে শুনে ফেলে বরের ছোট ভাই। সে ওর দিদিমা কে বলে -- 'আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করব দিদিমা। ও বেশ কর্মা হবে, আমি ওর প্রথম পুরুষ নই।'


৬.        টক অফ দ্যা টাউন


অনেকদিন আগের বাবলির সাথে এক বিকেলের কথা।পাবলিক লাইব্রেরীতে বসে বাবলির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পাতা উলটাচ্ছিলাম সৈয়দ হকের 'খেলারাম খেলে যা'-র। জাহেদা আমার মনকে স্থির করতে পারেনি। ওকে পাশে রেখে 'বেগম শেফালী মির্জা'। ভালোই লাগছিল মির্জা বউকে। 

বাবলি আসলো এক ঘন্টা লেটে। সে এসেই বলে --- বাসায় দশটা মিথ্যা কথা বলতেও তো দশ দু'গনা বিশ মিনিট লেগে যায়।

বললাম, কোথায় যাবে ? বাবলি বলে --- কোথায় আবার যাব? বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।
বললাম --- ঠোঁটের লিপস্টিক এবড়োথেবড়ো কেন ? টান টান জবাব বাবলির ---- সৌমেন ঠিকমতো চুমু খেতে পারেনি।
বললাম --- সৌমেন টা আবার কে ? বাবলির জবাব --- কাল রাতের স্বপ্নের। আমি ওকে চিনিনা।

বাইরে তখনও বৃষ্টি। পুরো শাহবাগ বৃষ্টিতে ভিজছে। জলে ভিজছে রিকশাওয়ালা। জলে ভিজছে কাক। জলের ছিটা লাগছে সি্ঁড়িতে বসা একজোড়া তরুণ তরুণীর। ওরা যুগল কী না জানি না।

বাবলিকে বললাম -- চলো রিকসায় যেয়ে বসি। হূড তোলা থাকলে তোমাকে নিবিড় ভাবে কাছে পাওয়া যাবে। এবারও বাবলির উত্তর --- না।

বললাম --- আসলে তো দেরিতে, এত চটাংচটাং করছ কেন ? বাবলি একটু রেগে বলে --- এ জন্যে উসুল করতে চাও ? কোথায় যাবে ? চলো। বললাম --- 'টক অফ দ্যা টাউন'।

'টক অফ দ্যা টাউন' মিরপুর রোডে ধানমন্ডি পা্ঁচ নম্বর সড়কের দোতালাতে অবস্থিত একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্ট।আমি আর বাবলি সেই রেস্টুরেন্টে চলে যাই। 

বসে আছি দু'জন পাশাপাশি। শহরের কোনও কথা নেই। বাইরে তখন বৃষ্টি নেই। চীনা মাটির প্লেটে চামচের টুংটাং শব্দ। বাবলির কাঁচের চুড়ির রিনঝিন শব্দ। বাইরে গাড়ীর হর্ণ। ভালোবাসায় কী কখনও শব্দ হয় ? কখন প্রাণের বীণা বাজে ? আমরা কান পেতেছিলাম বুকের শব্দ শোনার। শুনেছিলামও সেদিন 'টক অফ দ্যা টাউন'এ সারা বিকেল।


৭.         রক্তপদ্ম


একটা মানুষের অনেকগুলো মনের দরজা থাকে।  মনের সেই দরজা দিয়ে কতজন যে প্রবেশ করে, আর কতজন যে বেড়িয়ে যায়। সে কথা কে বা মনে রাখে?

মনে পড়ে কী পড়ে না।
কবে এক অবিন্যস্ত ধূলোমলিন দুপুরে এক কুমারী মেয়ের বাড়িতে একটি সাদা পদ্মের ভ্রমর উড়ে গিয়েছিল। তাকে সে বসতেও দিয়েছিল তার অলিন্দে । তারপর কী হয়েছিল ওখানে , তা কেউ জানে না।

পরে জানা গিয়েছিল। একটি সাদাগোলাপ বাগানে একটি মাত্র লাল গোলাপ ফুটে আছে। সেটি আসলে লাল গোলাপ ছিল না। সে ছিল কাটার ঘায়ে জর্জরিত রক্তমাখা সেই সাদা পদ্মের ভ্রমর। 

সেই ভ্রমরটিকে কি মেয়েটি মনে রেখেছে?


৮.       বসন্ত দিনের কথা


অনেক বৎসর আগে কোনো এক ভুলে যাওয়া বসন্ত দিনের কথা। এক বিকালে আমি আর মণিকা নামে একটি মেয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতরে পাকা পথ ধরে হাঁটছিলাম। দু'পাশের গাছ তখন আজকের মতো এত বড়ো ছিল না। পিছনে বেড়ি বাধও তখন হয়নি।আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই ঝিলের পাড়ে।সাইবেরিয়া থেকে আসা শীতের পাখিরা ঝিলের জলে উড়াউড়ি করছিল। 

মণিকা আমার বন্ধু। আমরা বাফা'র নাচের ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। ঝিলের পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কথা বলতে থাকি। 

দু'দিন পর মণিকার এ্যানগেজমে্ন্ট, পানচিনি অনুষ্ঠান, এই সব কথা বলেছিল মণিকা। সাথে আরো অনেক কথা। কিন্তু -- "বাতাসের কথা সে তো কথা নয়
রূপ কথা ঝরে তার বাঁশিতে
আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই
যেন দুটি আঁখি ভরে
রাখে হাসিতে।''

আমরা ফিরে আসি গার্ডেনের বাইরে মেইন রোডে। একটি বেবী ট্যাক্সিতে উঠে মণিকা চলে যায় শ্যামলীতে। আমি চলে আসব মিরপুর ৬ নং সেকশনে বোনের বাসায় ।

মনটা খুব উদাস লাগছিল। কি মনে করে আমি আবার ঢুকে যাই গার্ডেনের ভিতর। একাকী হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই ঝিলের পাড়ে। বসি একটি ছাতিম গাছ তলায়।পশ্চিমের সূর্য তখন অস্তাচলের দিকে যাচ্ছিল। এক অদ্ভুত বিষাদ টলমল করছিল ঝিলের জলে।  ভাবছিলাম --- মণিকা আমার জীবনে কি না হতে পারত ! আজ থেকে সে আর আমার কেউ না। কি এক বিষণ্ন মায়ায় মনটা গুমরিয়ে কেঁদে ওঠে । 

ঝিলের পাড়ে নির্ঝরে ঝরে পড়ছিল শুন্যতা । কেমন যেন  নিঃসীম সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল । ধূসর সেই সন্ধ্যায় দূর আকাশে লাল আভার দিকে চেয়ে থাকি।  সেখানে মণিকার মায়াবী মুখচ্ছবিখানি শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম। আর কাউকে না।


৯.        রোড টু বড়াল ব্রীজ


সিরাজগঞ্জ থেকে রাতের ট্রেনে ঈশ্বরদী যাচ্ছিলাম।ডাউন ট্রেন, অত ভীড় ছিল না। পথে উল্লাপাড়া থেকে স্কুল শিক্ষকের মতো চেহারার এক লোক ওঠে এবং এসে বসে আমারই সামনে। প্রথমে পাত্তা দিতে চাইনি, কিন্তু একাকী থাকলে যা হয়। ওনার সাথে অনেক কথা হয়।

উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা,পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের সদস্য ছিলেন। লতিফ মির্জা ছিল তার কমান্ডার। পরে গণবাহিনী করেছেন। তারপরে যেটি করেন তা তিনি আকারে ইঙ্গিতে বললেন --- নিষিদ্ধঘোষিত পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি। আমি আর রাজনীতির দিকে কথা এগুলাম না। 

কথা বলতে বলতে ওনাকে একসময় জিজ্ঞাসা করলাম, 'ভাই আপনার নামটি জানা হলো না। উনি বললেন --  সামাদ আসমী। ( 'সামাদ' পরিবর্তিত নাম) 

বললাম:  ছেলেমেয়ে কয়জন ? উনি বললেন --- বিয়ে করা হয় নাই। আমি বললাম -- নামের শেষে আসমী কেন?  একটু চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ---  'আসমী নামে একটি মেয়েকে আমি ভালোবাসতাম,....'৷ (ট্রেনের ঘষঘষ শব্দ হচ্ছিল তখন, শোনা যাচ্ছিল না কিছুই।)  

কথাটি বলতে যেয়ে  সে থেমে যায়।

ট্রেনটি তখন খটখট আওয়াজ করে বড়াল ব্রীজ অতিক্রম করছিল। ওপারেই বড়াল ব্রীজ স্টেশন, ট্রেনটি থেমে যায় স্টেশনে।

আসমী ভাইকে বললাম:  তারপর?  

দেখি -- ওনার  চোখ জলে ছলছল করছে। 

সে বলল -- আমি এই স্টেশনেই নেমে যাচ্ছি। যদি আবার কখনও দেখা হয়, তখন বলব হতভাগী আমার  সেই আসমীর কথা।


১০.      সেভক পাহাড়ে


গ্রামে আমি যখন ফ্রী প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের স্কুলে তিন জন অধীর ছিল। একজন অধীর হালদার, আরেকজন অধীর কুন্ডু অন্যজন অধীর ঘোষ। তিন জনের সাথেই কমবেশি আমার সখ্যতা ছিল। দারিদ্র আর অভাবের কারনে ওরা লেখাা পড়ায় বেশি দূর এগুতে পারে নাই। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েই ঝরে যায়। 

একটা সময় পর্যন্ত ওদের সাথে যোগাযোগ ছিল, দেখা হতো, কথাও হতো। তারপর কালের পরিক্রমায় আমিই দূরে চলে আসি। আমার দীর্ঘ নানা জীবনে ওদেরকে আমি একেবারে ভুলে গেছি তা নয়। কর্মহীন কোনো অবসরে ওদেরকে মনে করেছি।

তারপর চলে গেছে আরো অনেক বছর। সময়ের ব্যবধানে তিন অধীরই চলে গেছে ভারতে। অধীর হালদার বালুঘাটে, অধীর ঘোষ রায়গঞ্জ আর অধীর কুন্ডু চলে যায় শিলিগুড়ি।

২০০৯ সালে আমি আর আমার স্ত্রী জলপাইগুরির ডুয়ার্স ও ভুটানের ফুয়েন্টসলিং বেড়াতে যাই। বাড়ি থেকে শুধু এইটুকু জেনেছিলাম, অধীর কুন্ডু শিলিগুড়িতে কোথাও ফল বিক্রি করে। আমি আর আমার স্ত্রী শিলিগুড়িতে তিনদিন ছিলাম। থাকতাম সেন্ট্রাল প্লাজা হোটেলে। আমরা রিক্সা করে ছোটো শহর শিলিগুড়ি ঘুরেছি। বাস টার্মিনাল, বাজার, রেল স্টেশন সব ফলের দোকানে অধীরকে খু্ঁজেছি, কিন্তু পাই নাই।

শেষ দিনের বিকালে আমরা বেড়াতে যাই সেভক পাহাড়ে।  সেভক ব্রীজে দাঁড়িয়ে আমরা তিস্তার কালো জল দেখেছি। দূরের পাহাড় দেখেছি। নিসর্গের অপরূপ রূপের মাঝে অবগাহন করেছি। 

সন্ধ্যা তখনো হয় নাই। ব্রিজের কাছেই পাহাড়ের একটু উপরে কালি মন্দির। আমরা মন্দির দেখে পাশেই সেভক বাজারে আসি। একটি রেস্টুরেন্টে বসে দুজন কিছু খেয়ে নেই। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে রাস্তার উপর চলে আসি। হঠাৎ পাশেই একটি ফলের দোকানে অধীরকে দেখতে পাই। চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল। মাথার চুল অর্ধেক পেকে গেছে। পরনের কাপড় চোপড় খুব মলিন। আমি অধীরের পিঠে হাত রাখি। ও চমকে ওঠে। মুখ ফিরে আমাকে দেখে। এবং চিনতে পারে। অধীর আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয়। 

রাস্তার উপর দাঁড়িয়েই অধীরের সাথে কথা হয়। সুখের কথা , দুঃখের কথা, ছেলেবেলার কথা আরও অনেক কথা। ও বলে --- ভাবীকে সঙ্গে এনেছিস, আমার বাড়িতে একটু যাবি না?' আমি বললাম:  'এবার নারে অধীর, কাল সকালেই চলে যাব। আবার যখন আসব, তখন যাব।' এই কথা বলে ওর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠি। 

ট্যাক্সিতে উঠে কাঁচের জানালা দিয়ে  চেয়ে দেখি-- অধীর কাঁদছে। ওর চোখে জল।

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পাশের মন্দিরে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠেছে। উঁচু নীচু পাহাড় আর টিলা পেরিয়ে আমাদের ট্যাক্সি শিলিগুড়ির দিকে দ্রুতবেগে ছুটে চলে আসতে থাকে।



১১.       ৩৬  চৌরঙ্গী লেন


প্রতিদিন প্রাতঃ ভ্রমণে বের হই। কোনো কোনো দিন আমার স্ত্রী সাথে থাকে, কোনো কোনো দিন থাকে না। কোনো দিন ৭ নং সেক্টর পার্কে যাই আবার কোনো দিন ১৩ নং সেক্টরের লেকের ধারে। ১৩ নং সেক্টরের লেকের ধারে ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটার সময় প্রায় দিনই সত্তোরোর্ধ একজন পৌঢ়া মহিলাকে হাঁটতে দেখতাম।প্রতিদিন একাই সে হাঁটত। কোনোদিন তার সাথে অন্য কাউকে হাঁটতে দেখিনি। না তার স্বামী,, না তাঁর কোনো ছেলেমেয়ে, না তার কোনো নাতি পুতি। আমরা বলাবলি করতাম, হয়ত এই বৃদ্ধার বাসায় কেউ নেই। স্বামী নেই, ছেলেমেয়েরা সবাই হয়ত দূর প্রবাসে থাকে।

একদিন আমার স্ত্রীকে কৌতুক করে বলেছিলাম- তুমি যদি আমার বউ না হয়ে বান্ধবী কিংবা প্রেমিকা হতে তাহলে ঐ বৃদ্ধার সাথে খাতির করা যেত।

বউ:  কেন ?
আমি:  ৩৬ চৌরঙ্গী লেন।
বউ:  সেটি আবার কি?

বুঝতে পারলাম, বউ অপর্ণা সেনের এই সিনেমাটি দেখেনি। তাকে শুধু এইটুকু বললাম-- পৌঢ়ার বাসায় কেউ থাকে না। ডেটিংএর সুবিধা হতো।

গত প্রায় তিন মাস এই বৃদ্ধাকে হাঁটতে দেখিনি। কাল বিকালে অলসভাবে লেকের ধারে একাকী হাঁটছিলাম। দেখি দুজন মাঝবয়সী মহিলা, (ভৃত্যা হবে হয়ত) হুইল চেয়ারে করে এক পৌঢ়া মহিলাকে লেকের  ওয়াকওয়ে দিয়ে ঘুড়ে ঘুড়ে সব দেখাচ্ছে। পৌঢ়াকে চিনতে অসুবিধা হলো না। এ যে সেই বৃদ্ধা, একদম শীর্ণকায় ও চোখ দুটো কোঠরে চলে গেছে। 

জেনেছিলাম কর্কট রোগে সে আক্রান্ত। বৃদ্ধা মায়া করে দেখছে লেকের গাছগাছালি, পাখি, জল ও জলের উপর নীল আকাশের ছায়া। আমাকেও দেখল একবার। সেই আগের মতোই আজকেও কোনো কথা হলো না তাঁর সাথে। ভাবলাম, অন্য আর একদিন কথা বলব ওনার সাথে। 

তারপর আরও অনেকদিন গিয়েছি লেকের ধারে। কিন্তু ঐ বৃদ্ধাকে আর দেখতে পাইনি। 


১২.         না


গতকাল একজন নতুন বন্ধু হল। বন্ধু হয়েই লিখল -- 'আপনার আজকের লেখায় লিখেছেন, হাতের চিঠির লেখা শেষ হয়ে গিয়েছে। হাতে লেখা অক্ষর ও একদিন থাকবে না।'
.....  ........
সে আরও লিখেছে -- ' আমি আপনাকে চিঠি লিখব, একদম হাতের লেখা চিঠি। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে একদিন। আমরা শেয়ার করব আমাদের জীবন লিপি। আমাদের সুখ দুঃখ, মনখারাপ। কী লিখবেন তো!'

আমি তাকে উত্তরে লিখলাম -- 'এখন শুধুই নির্জন অবসাদ সময়। এই সময়ে আর একটি  নির্জনতার পাশে গিয়ে নিভৃতে বসবার অবসর আমার নেই। এখন জীবনের অন্য আয়োজন। ছোটোছোটো দুঃখের আর কোনও প্রয়োজন নেই। অক্ষরকে ধমনিতে পৌঁছে দেওয়ারও কোনও দায় নেই।'
. ‌.....  .......  ........ ......

সে একজন রমণী ছিল। দূর বরফের কোনও শহরে সে থাকে। তাকে আমি খুব জোর ধূলি শহর ঢাকার রোদ্দুর পাঠাতে পারতাম। সে পাঠাত তার শহরের বরফকুচি। তার মনখারাপ আর আমার মনভালো পথে পরস্পরকে ক্রস করতে করতে কাটাকাটি খেলত। আর তো কিছু না।

কী হবে এই সব করে? আর কত কাগজের নৌকা ভাসানোর খেলা খেলব। রাত জেগে নৌকা বানাব, সেই নৌকা ভাসিয়ে দিব পরের দিন বুড়িগঙ্গার জলে। ঐ নৌকা কোনো দিন যেয়ে ভিড়বে না হাডসন নদীর তীরে। না, এই সব আর 'না'।


১৩.       কমলদীঘি


একদিন এক অস্তগামী সূর্যের বিকালে স্নান করিবে ভাবিয়া রমণী বসিয়াছিল কমলদীঘির শান বাঁধানো ঘাটের সোপানে। বিনম্র কুচভারে সে জলের দিকে তাকাইয়া ভাবিতেছিল,  'তোমাকে আমি প্রাণ দেবো তবুও আমার প্রেম থাকিবে আমার অন্তরে।' 

দক্ষিণের দিকে হইতে ঝিরিঝিরি বাতাস বহিতেছিল। মাথার কালো কেশ এলমেল উড়িতেছিল। কী কথা ভাবিয়া সে নিচের সোপানে পা রাখিল। জলে নামিয়া কমল ছিড়িল। সে নিজেই মৃণাল পরিধান করিল খোঁপায়। বিমুগ্ধ ছিল রমণী। জলের পরিধি কত, সে বুঝিতে পারিল না।
 
সে ছিল কমলিনী। রাজ্যের সব মানুষ তাহাকে কমল বলিয়া ডাকিত। তারপর  তাহাকে কেউ খুঁজিয়া পায় নাই। কিন্তু সে যে অজস্র কমলের মাঝে কাল কালান্তর ধরিয়া ফুটিয়া আছে। সে যে ভাসিয়া বেড়ায় দীঘিতে। তাহার ভেজা পাপড়িতে অশ্রু-সম জল লাগিয়া থাকে। রোদ্রে তাহা শুকিয়া যায়। সবাই ঐ দীঘিকে কমলদীঘি বলিয়া ডাকে।

আজও কোনো উন্মূল প্রেমিক ঐ দীঘির পাড়ে বসিয়া ভাবে -- 'তার রূপ-রত্নাকরে;
মগ্ন হয়ে, তারে আমি সঁপিলাম মন!'



১৪.       চিরদিনের সেই আমি



আমার একটি কর্মক্ষেত্রে একজন মেয়ে অধঃস্থন ছিল। সে দেখতে ছিল বেশ সুন্দরী। সে আমার নিকটতম দূরত্বে বসলেও তার সাথে আমি অফিসিয়াল দূরত্ব মেয়েইনটেইন করে কথা ও আচরণ করতাম। একদিন আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি আজ দুপুরে আমার অফিসে চলে এসো। কস্তুরিতে বসে দু 'জন লাঞ্চ করব। সে অফিসে এসে দেখতে পায়, আমার খুব কাছে একজন সুন্দরী মেয়ে বসে আছে। সেদিন লাঞ্চে সে আর কোনো কিছুই ঠিকমতো খেল না। সারাক্ষণই মনটা বিষন্ন করে রাখল।

রাতে শুয়ে আছি পাশাপাশি। সে আমার হাতটি তার বুকের উপর রেখে বলছিল - 'কেন জানি আমার ভয় হয়, কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে।'  আমি তাকে সেই রাতে বলেছিলাম - ' এ তোমার মিছেই আশঙ্কা। তোমার এসব দূর্ভাবনা করার কোনো কারণ নেই। তুমি নিশ্চিত থাকো, আমি তোমার আছি, তোমারই থাকব চিরকাল। '

নাহ্!  তারপরও সে নিশ্চিত হতে পারেনি। দেখলাম সে প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকে। খাওয়া দাওয়া কর্ম কোনো কিছুতেই মন বাসে না তার। এবং সে যে গোপনে অশ্রুপাতও করে তা আমি তার চোখের পাতা দেখে বুঝতে পারছিলাম।

সুখ আর শান্তির জন্যই মানুষ জীবিকা করে। যে জীবিকা করার কারণে কেউ একজন এত কষ্ট পাচ্ছে, এত কান্না কাটি করছে। সে জীবিকা আমি নাই বা করলাম। হয়ত সাময়িক অসুবিধা হবে। তা হোক। আমি তাই একদিন চাকুরীটিকে ইস্তফা দিলাম।

নাহ্, কোনো অসুবিধা হয়নাই। পরে আরও একটা চাকুরী পেয়েছি।  জীবন ভালোই চলছে।  সুখেই আছি। আমিও চিরদিনের তারই হয়ে আছি।


১৫.        গোলাপ বউ


নিঝুম ছিমছাম বাড়িতে সেই প্রথম একবার পরী তার  পালক খুলেছিল। আবার কি তবে মনে মনে চাইব তোমাকে? পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছ সুখের সেই তুমি। বাতাসের গান জলে ডুবছে ভাসছে। আবার তুমি যদি রাতে নেমে আসো এই বাড়িতে? প্রদীপের পাশে এসে ফিসফিস করে বলো, 'জানিনা আমি জানিনা। তুমি জানো?'
ছাতিম ফুল নাকি মনের কথা শোনে। নীলকণ্ঠ পাখির দেশে কানে কানে বলবে,  চলো ওই একলা যুবকের বুকে। যে একা একা এই শহরে ঘোরে, তার হাত ধরে একবার হেসে ওঠো। শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ছাতিম ফুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা সুখের শিশিরে তুমি ঠোঁটের দাগ রেখে চলে যাও। যে যায় সে আর আসে না। যে আসে সে এখন যুবকের সন্ধ্যার বুকে একাকী টবে রাখা গোলাপ বউ।


১৬.       পায়ের শব্দ


আজ এক পুরনো বন্ধুর সাথে কিছুক্ষণ চা আড্ডায় বসেছিলাম। অনেক কথা হলো তার সাথে। অনেক পুরনো কথা, কালের অতল তলে লুপ্ত হয়ে যাওয়া কিছু নস্টালজিক কথা।  সে আমাকে একপর্যায়ে বলছিল -- 'তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়কাল কখন এবং কোনটি ছিল?'

বলেছিলাম -- ' ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সময়কাল।'

--- কেন?

--- 'বন্ধনহীন গ্রন্থি' র মতো অদ্ভুত সুন্দর বোহেমিয়ান জীবন ছিল। বৃষ্টির রাতে একাকী ঘরে থাকলে মনে হতো আমার জন্য কেউ কোথাও বৃষ্টির গান শুনছে না,  কেউ বৃষ্টিতে ভিজছে না।

বন্ধুটি বলল -- আমিও দেখেছি তোমাকে অন্ধকারে হ্যারিকেন ধরাতে বহুবার। আদ্র দিয়েশলাই জ্বলতে জ্বলতে নিভে গেছে। এটি কোনো অদ্ভুত সুন্দর জীবন হলো!

--- রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলে, দেখতাম কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে আমার পালঙ্ক ঘেঁষে। জোনাকি পোকার মতো ছোট্ট ছোট্ট আলো বিচ্ছুরিত হতো তার শরীর থেকে। আমি চুপ করে চোখ খুলে দেখতাম তাকে। তারপর চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যেতাম। অপলক চেয়ে থাকলে সে চলে যেত। তখন ভয় পেতাম। বাকী রাত আর ঘুম আসত না।

--- তুমি কী তাকে চিনতে সে কে ছিল?

--- একজনই সে বিভিন্ন রূপে। অস্পষ্ট ছায়া মূর্তি। এ জীবনে তাকে দেখিতে পাইনি আর! চিনতেও পারি নাই। 

--- থাক্। কল্পকাহিনি আর বলতে হবে না। আমি তোমাকে চিনি। আরো একজন তোমাকে হাড়ে হাড়ে চিনে। তাঁকেও আমি চিনি। যার সাথে তোমার জন্মজন্মান্তরের সহবাস।

বন্ধুটির সাথে কথোপকথন এই টুকুই ছিল। 

কী এক কাকতালীয়! আজ সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। মনে হল -- সেই আমার ঘর। সেই রকমই কোনো এক সন্ধ্যার অন্ধকার। দেখতে পাচ্ছিলাম একটি মলিন প্রদীপ মিটমিট করে জ্বলছে। বাইরে ছিল ঝিল্লি রব, বাঁশ পাতার ঘর্ষণের শব্দ! যেন  ঠিক বহু বছর আগের এক উদাসী তরুণ সান্ধ্য অন্ধকারে চোখ মেলে চেয়ে আছে।

শুনতে চাইছে দূরাগত কারোর পায়ের শব্দ!


১৭.      সায়াহ্নবেলায়


অনেক বছর পর একজন সিনিয়র বন্ধুর সাথে আমার দেখা হয়। বন্ধুটি এখনও চিরকুমার। সে কেন যে চিরকুমার জীবন বেছে নিয়েছিল, তা সবার কাছে রহস্যই রয়ে গেছে। তাঁর কাছের কোনো বন্ধুই জানে না, কেন এই নিঃসঙ্গ থাকা তার। তারা কেউই উন্মোচন করতে পারেনি তার এই বিয়ে না করার রহস্য।

কথা প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম--
' ভাই, এত বছর পর আপনার কেমন মনে হয়? আপনি কী সঠিক কাজটি করেছিলেন এই একাকী জীবন বেছে নিয়ে?'

সে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন, তারপর বলেন-
"পঞ্চান্ন বছর পর্যন্ত খারাপ লাগেনি। এত বছরে আমার জীবন পাত্রখানিতে যেমন খুশি তেমন করে জল ঢেলে খেয়েছি। বেশ আনন্দেই আমার জীবন পার করেছি। কোনো বন্ধন ছিল না। আমার জন্য কেউ কোথাও উদ্বিগ্নে থাকেনি‌।"
 
সে আরও বলছিল -
"বয়স যখন আজ ষাট পেরিয়ে সত্তরের দিকে ধাবমান, এখন কেন জানি মনে হয় --- বড়ই ভুল করেছিলাম। সায়াহ্নবেলা যত ঘনিয়ে আসছে, তত কেন জানি ভয় হয় আমার। খুব একা লাগে। মানুষের যৌনজীবনই মূখ্য নয়। আরো এক রকম জীবন আছে যা এখন পার করছি।" 

চারুদত্ত আধারকারের কথা মনে হয় -"...আমার মৃত্যু শয্যায় আমার তপ্ত কপালের উপর পড়বে না কোনো কোমল হাতের স্পর্শ! অনিমেষ নয়নে চেয়ে থাকবে না  কেউ বিদায় কালীন আমার চোখের দিকে? দেখবে না বিন্দু বিন্দু চোখের কোণে জল!  আমার আত্মার প্রস্থান সময়েও আমি কী একা থাকব?"

উনি একটি সিগারেট ধরালেন। আমি বললাম -- 'এই বয়সে সিগারেট খাওয়া ঠিক না।' অনেক ক্ষণ তিনি আর আমার সাথে কথা বললেন না। সিগারেটটি খাওয়া শেষ হলে তিনি পুনরায় আরও একটি সিগারেট ধরালেন।


১৮.       কাগজের ঝুনঝুনি


উত্তরার ৭নং সেক্টরের পার্কের গেটের সামনে আজ একজন বৃদ্ধলোক কাগজের তৈরি পাখির ঝুনঝুনি বিক্রি করছিল। বৃদ্ধকে দেখে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। এক চৈত্রে আমাদের গ্রামের মেলা থেকে বাবা আমাকে এমনি একটি কাগজের তৈরি ঝুনঝুনি কিনে দিয়েছিল, সেই ঝুনঝুনি পেয়ে আমি কি যে খুশী হয়েছিলাম ! আজ এই ঝুনঝুনিওয়ালা বৃদ্ধকে দেখে হঠাৎ নস্টালজিয়ায় ফিরে যাই, হঠাৎ কেন জানি তার প্রতি খুব মায়া হলো। তার অসহায় মুখ দেখে মনে হচ্ছিল - সে এবং তার পরিজন প্রায়ই হয়তো অভূক্ত থাকে। আমি তাকে বললাম- আপনার ঝুনঝুনির দাম কতো। বৃদ্ধ বলল, একটির দাম ৫ টাকা। আমি বললাম--কয়টি আছে ? বৃদ্ধ গুণে বলল, ১৬ টি। আমি ১০০ টাকা দিয়ে সবগুলো ঝুনঝুনি কিনে নেই। বৃদ্ধ খুশিতে আমার হাত টেনে নেয় তার বুকে। 

বাসায় এসে ঝুনঝুনিগুলো আমার দুই মেয়েকে দিয়ে দেই। ওরা এতগুলো কাগজের তৈরি পাখির ঝুনঝুনি পেয়ে খুব খুশি হয়। যেমন খুশি হয়েছিলাম আমি আমার ছেলেবেলায়। ভাবছিলাম -- সব খুশিই দেখতে কি একই রকম হয়? নিশ্চয়ই না। কোনও খুশির আড়ালে থাকে আনন্দ, আবার কোনও খুশিতে থাকে বেদনা। যে বেদনাটি দেখেছিলাম আজকে ঐ ঝুনঝুনিওয়ালার চোখে  মুখে।


১৯.      দীপাবলি 


ছেলেটির আজ খুব মনখারাপ ছিল। তাই সে সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কান্না করে সময় কাটিয়েছে। ওর নিবেদনের প্রেক্ষিতে কেউ একজন একদিন ওকে বলেছিল -- 'এখন নয়, আগে তুমি যোগ্য হয়ে ওঠো, তারপর তোমার ভালোবাসা গ্রহণ করব।'

ছেলেটি সেই থেকে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে থাকে এবং যোগ্য হয়ে ওঠে। তাই সে মেয়েটির কাছে গিয়ে কাল বলেছিল- 'এবার তবে গ্রহণ করো। আমি তোমার যোগ্য হয়ে উঠেছি।' কিন্তু মেয়েটি ওকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কারণ সে এতদিনে অন্য কারোর হয়ে গিয়েছে।

ছেলেটি সন্ধ্যা অবধি অন্ধকারে ঘরের মধ্যেই ছিল। আলো জ্বালায়নি সে। হঠাৎ ওর মনে হলো আজ দীপাবলি। সে তখন নিজেই চোদ্দটি প্রদীপশিখা জ্বালায় তার ঘরে। আলোয় আলোয় ভরে ওঠে ঘর। আলোকিত হয়ে ওঠে ছেলেটির মন! কী যে ভালো লাগছিল ওর! কোনোই মন খারাপ নেই। প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ শিখার মধ্যে নিকষিত হেমের মতো একটি রমণীমুখ সে দেখতে পায়।  

অচেনা অজানা সেই হেমকান্তমণির মেয়েটিকেই সে বলে -- শুভ দীপাবলি। 


২০.      কে এই অভাগী?


আশির দশকের কথা। সেই সময়ে কামারখালী মধুমতি নদীর উপরে ব্রীজ হয়নি। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা বাসটি যখন ফেরিঘাটে এসে থামে, দেখি লম্বা লাইন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ফেরির সিরিয়াল পেতে কমপক্ষে দেড় দুঘন্টা সময় লাগবে। আমি ঘাটের একটি টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাই। এবং একটি সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকি। দেখি --- ঘাট থেকে বেশ দূরে মধুমতি নদীর কূল ঘেঁষে একটি ধানক্ষেতের ভিতর অনেক মানুষের ভিড়। শুনতে পেলাম একটি মেয়ে মানুষের লাশ নাকি ওখানে পড়ে আছে। আমি কৌতুহল বশত কাছে যাই। এবং দেখতে পাই, সত‍্যি সেখানে ত্রিশ বত্রিশ বছরের একটি মেয়ের নিথর দেহ পড়ে আছে। তার শরীর ভর্তি সোনার গহনা। পরনে কাতান শাড়ি। গায়ের রং কাঁচা হলুদের মতো ফর্সা। দেখে মনে হলো,অভিজাত ঘরের কোনো মেয়ে হবে। মুখটি ঠিক মতো দেখতে পাচ্ছিলাম না, ডান পাশে মাটির দিকে একটু কাত হয়ে আছে। আমি মেয়েটির মুখ ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করি। এবং দেখতেও পাই। একি ! এ যে দেখছি, সেই পরিচিত মুখ। পায়ে সেই নুপুর। হাতে রূপার বাজু। গলায় সেই মতির হার।

কাল রাতেই খুলনাতে এই মেয়েটিকে আমি দেখেছিলাম। খুব ক্ষণিক সময়ের জন্য মেয়েটিকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। ঐরকম পূর্ব পরিচিত ছিলনা। সে ভালো গানও গাইতে পারত। শোনায়েও ছিল সে একটি গান ---

তারে ভোলানো গেল না কিছুতেই
ভুল দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে
বিষের পরশ দিয়ে
ভুলানো গেলোনা কিছুতেই....।

ঢাকায় এসে পরেরদিন ইত্তেফাকে একটি ছোট্ট নিউজ দেখতে পেলাম। খবরের শিরোনাম ছিল --- 'কে এই অভাগী মেয়ে?'


২১.         শিপ্রা নদীর পারে


তারুণ্যের সময়ে একবার শিপ্রা নদীর পাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। নদীর পাশেই ছিল ঘন বনজঙ্গল। একটু  ভিতরেই ছিল একটি কাঠের দোতালা বাড়ি। নির্জন নিরিবিলি চারদিক। দেখি -- বাড়িটি থেকে সতেরো আঠারো বছরের একটি  মেয়ে বের হয়ে আসছে। অপরূপ সুন্দরী, পরনে জয়পুরী ঘাঘরা, বুকে কাঁচুলি বাঁধা, পায়ে রূপর মল, মুখে লোধ্ররেণু মাখা, গভীর নাভিকূপ, ক্ষীণ কটিদেশ, কপালে চন্দনের টিপ,  যেন প্রথম যুবতী  বিশ্বস্রষ্টার। আমি বিস্ময়ে তার দিকে তাকাতেই সে এসে আমার একটি হাত ধরে বলে --- আমি শকুন্তলা। আমি জানতাম, তুমি আসবে। কত জনম জনম তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি।

আমাকে সে নিয়ে যায় শিপ্রা নদীর পারে। একটি হরিদ্রাভ অশোক তলায় যেয়ে দু'জন বসি। সামনে স্রোতহীন স্বচ্ছ জলের শিপ্রা নদী। আমি দূর্বা ঘাসের উপর শুয়ে পড়ি। 

শকুন্তলা শিপ্রা নদীর জলে যেয়ে নামে। যাওয়ার সময় আমাকে বলে যায়, আমি নগ্ন হয়ে স্নান করব, তুমি চোখ বন্ধ করে থাকবে। 

আমি চোখ বন্ধ করে থাকি। দক্ষিণের ঝড়ো বাতাসে অশোকের গাছ থেকে শত শত ঝরা পাতা আমার মুখের উপরে ঝরে পড়তে থাকে। আবেশ জড়ানো  চোখ যখন খুলি --- তখম দেখি, শকু্ন্তলা কোথাও  নেই। আমি শুয়ে আছি আমার বিছানায়।  

কালিদাসের শকুন্তলা বইটি আমার বুকের উপর পড়ে আছে।


২২.      ঝরা পাতার গান


আজ খুব ভোরবেলায় ঘুম ভেঙ্গে যায়। সূর্য তখনো ওঠে নাই। কম্পিউটারে বসে ফেসবুকে নিউজ ফিডগুলো দেখছিলাম। হঠাৎ বন্ধু নেয়ামুলের টাইমলাইনে রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটি অডিও ক্লিপের উপর চোখ স্থির হয়ে যায়। অনেক বৎসর আগে এক চৈত্রের পাতা ঝরা দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুকুরপাড়ে বসে এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল একটি মেয়ে। জীবনের পাদপ্রদীপহীন অন্ধকারে সে মেয়ে হারিয়ে গেছে। সে আজ আর নেই। সেই গান সেই ভালোলাগার মুহূর্তগুলোও বিস্মৃত হয়ে গেছে। আমি অডিও ক্লিপটা অন্ করলাম, শুনলাম সেই গানটি --

"তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম. নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম॥ 
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন. তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম॥ 
জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি। 
মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন. তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥"

গানটি শুনতে শুনতে চোখ চলে যায়- সেদিনের সেই  উদ্যানের পুকুরপাড়ে। চৌচির করছে গাছগাছালি, খা্ঁখা্ঁ করছে রোদ্দুর। তপ্ত হাওয়ায় কড়ই গাছটি থেকে জীর্ণ পাতাগুলি এখনো ঝরে পড়ছে।


২৩.       আমি তো তোমারে চাহিনি


সিডি রাখার র‌্যাকটিতে ধুলো জমে গেছে। আগের মতো আর সিডিতে গান শোনা হয়না। আজ র‌্যাকটির ধূলো পরিস্কার করতে যেয়ে রজনীকান্তের লেখা এবং হেমন্তের গাওয়া একটি পুরানো সিডি পেয়ে যাই। এই সিডিটি আমার স্ত্রীকে দিয়েছিল আমাদের কোলকাতার বন্ধু হিমাদ্রি চক্রবর্তী ২০০৮ সালে। হিমাদ্রির পূর্বপুরুষেরা ঢাকার সাভারের ছিল। ওর স্ত্রীর নাম পৃথা চক্রবর্তী। শান্তি নিকেতনের মেয়ে। ওদের আতিথীয়তায় সেবার সেখানে তিনদিন ছিলাম। শান্তি নিকেতনের আমতলায় সবুজ ঘাসে বসে হিমাদ্রি খালি কণ্ঠে গেয়ে শোনায়েছিল রজনীকান্তের লেখা এই গানটি। 

হিমাদ্রি আর নেই। পৃথা গত বছর আমাদের দু'জনকে উদ্দেশ্য করে একটা মেইল পঠিয়েছিল, সেই মেইলের কিছু অংশ এই রকম ছিল- 'কর্কটের কাছে হিমাদ্রির দেহ হার মেনেছে কিন্তু ওর চিত্ত পরাভূত হয়নাই।বেলেভিউ হাসপাতালের কেবিনের অ্ন্তিম শয্যায় শুয়ে শুয়ে হিমাদ্রি তোমাদের কথা অনেক বলেছে। তোমরা তো ভুলেই গেছ । সেই যে চলে গেলে আর এলে না।হিমাদ্রির ছাই ভস্ম রেখে দিয়েছি। যদি আসো আর একবার তাহলে তোমাদেরকে দিয়ে দেবোএই ছাই ভস্ম।এগুলো ফেলে দেবে হিমাদ্রির পূর্বপুরুষদের বংশী নদীর জলে।' 

এবার শুনি রজনীকান্তের সেই গানটা-
আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে তুমি অভাগারে চেয়েছ;
আমি না ডাকিতে, হৃদয় মাঝারে নিজে এসে দেখা দিয়েছ।।
চির-আদরের বিনিময়ে সখা! চির অবহেলা পেয়েছ......."

পৃথা, কে বলেছে হিমাদ্রি আর নেই। আমরা আবার আসব শান্তি নিকেতনে, বসব আমতলার সবুজ ঘাসে। সেদিনও হিমাদ্রি গেয়ে শোনাবে এই গান।


২৪.      বালুরঘাট থেকে শিলিগুড়ি


নব্বই দশকের কথা। পশ্চিম বঙ্গের বালুরঘাট থেকে বাসে উঠেছি শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্য। বাসে উঠেই দেখি আমার পাশের সিটে একটি বাইশ তেইশ বছরের তরুণী বসে আছে। আমি অনেকটা দ্বিধা নিয়েই ওর পাশে বসে পড়ি। মেয়েটির সিঁথিতে সিঁদুর নেই, হাতে শঙ্খ চূড়ি নেই, শাঁখা পলা নেই। মনে হলো মেয়েটি কুমারী হবে। বাস চলছে। আমাদের মাঝে কোনো কথা নেই। 

ঢাকা থেকে রাতের বাসে হিলি এসেছিলাম। চোখে তাই ঘুম ঘুম ভাব ছিল। অনেকটা পথ ঘুমে অনেকটা পথ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। মেয়েটিকে খেয়াল করা কিংবা আগ বাড়িয়ে কথা বলা হয়ে ওঠে নাই। এই ভাবেই কখন তিন / চার ঘন্টা কেটে গেছে বুঝতে পারিনি। 

বাসটি তখন বিহার টেরিটরী অতিক্রম করছিল।এ্যাটেনডেন্ট বলছিল, সামনে ইসলামপুর স্টপেজ।মেয়েটিকে দেখলাম, রেডী হচ্ছে নামার জন্য। মন চাইল ওর সাথে একটু কথা বলি ---

আমি:  Can you speak in Bangla ?

মেয়েটি:  আমি বাঙ্গালি, বাংলাদেশের মেয়ে।

আমি:  আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। যাচ্ছি শিলিগুড়ি। ওখান থেকে দার্জিলিং। তা বাংলাদেশে কোথায় তোমার বাড়ি ?

মেয়েটি:  সিরাজগজ্ঞের ধলডোব গ্রামে।

আমি চমকে উঠি। বললাম, আমার বাড়িও সিরাজগঞ্জে। আমি বাগবাটি স্কুলের ছাত্র ছিলাম।ধলডোব গ্রামে আমার একজন সহপাঠি ছিল, নাম মিহির কুমার বৈদ্য। মেয়েটি বলে -- 'মিহির আমার বড়দা, আমি ওনার ছোট বোন নির্মলা। ১৯৭১ সনে শরণার্থী হয়ে আমরা এদেশে এসেছিলাম। তারপর আর যাওয়া হয় নাই। এই ইসলামপুরেই আমরা থেকে যাই।' নির্মলার দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। 

ওকে দেখেছিলাম ওর দুই বছর বয়সে। কোলেও নিয়েছিলাম। কত আদর করেছি ওর চোখে মুখে কপালে !

বাসটি এসে ইসলামপুর থামে। নির্মলা এখানেই নেমে যায়। নামার সময় বলেছিল --- দাদা নেমে যান এখানে। বাড়িতে বড়দা আছে। দেখা করে যান।' আমার আর নামা হয় নাই। কর্কশ স্বরে হর্ণ বেজে ওঠে। বাসটি তখন চলতে থাকে শিলিগুড়ির দিকে।


২৫.       রক্তজবার গন্ধ


অনাচ্ছাদিত এক রৌদ্রের বিকাল। আকাশ জড়িয়ে আছে পাহাড়কে। মেঘ লুকিয়ে আছে নীলে। উপত্যকার পথে হাঁটছি। নির্জন। মনুষ্য নেই কোথাও। বুক থেকে ঝরছে কোমল নিঃশ্বাস। পাখি নেই। কলরব নেই। জন কোলাহল নেই। 

শব্দহীন অরণ্য পথ। হঠাৎ কোথা থেকে নেমে এল এক মেয়ে। মেয়েও নয়, দেবী। ঠিক দেবীও নয়, বেহেস্তের হুরীর মতো একজন। ললিত গ্রীবা, মেঘবরণ কুন্তল, মৃগ নাভি, সুউচ্চ বুক, চোখ মায়াবদ্ধ, কুঞ্চিত ভ্রু যুগল, ব‍্যঙ্গময় ঠোঁট। কী আশ্চর্য, হেঁটে আমার দিকেই আসছে রমণী। আমি তার নাম জিজ্ঞাসা করতেই মেয়েটি বলেছিল-- জেবা সাহানী।

যখন এই নির্জনে এসেছিলাম, তখন দেখেছিলাম মেহগুনি, জারুল আর পাইন গাছের সারি। এখন দেখি, সব গাছগুলো রক্ত জবার সারি হয়ে গেছে। চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে লাল নীল হলুদ প্রজাপতি। গুনগুন গানের শব্দ শোনা যাচ্ছিল দখিনা বাতাসে। পার্বত্য ঢাল থেকে ঝরে পড়ছিল ঝর্নার জল। অপরূপ নীল আকাশ চেয়ে ছিল ঐ রমণীর দিকে। শব্দহীন সেই অরণ্য হঠাৎ পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠে।

আমি নিতান্তই এক তরুণ। এবং লজ্জাশীল। রূপবতি মেয়ে দেখলে কুঁচকে যাই মোমের মতো। চোখ মেলে তাকাতে পারি না কারোর দিকে। আমি তাকাতে পারছিলাম না জেবা সাহানীর দিকেও। রমণী একএক করে তার সমস্ত বসন খুলে ফেলেছিল। কিন্তু, আমি গুচ্ছগুচ্ছ রক্তজবায় ঢেকে দিয়েছিলাম তার নিরাভরণ দেহ।

রমণীর কী অভিমান হয়েছিল? হঠাৎ দেখি, সে নেই। ছেঁড়া রক্তজবাগুলো পড়ে আছে উপত্যকার ঘাসের উপরে। কেমন যেন মাংসের গন্ধে লেগে আছে ফুলে। বাতাসে তার শরীরের সুবাস পাচ্ছিলাম। আমি বনপথে দৌড়াতে থাকি।  দৌড়াচ্ছি... দৌড়াচ্ছি...দৌড়াচ্ছি...  খুঁজছি জেবা সাহানীকে... 

ততক্ষণে জেগে উঠি। ততক্ষণে স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। ঘুম জড়ানো চোখ মুদে তাকাচ্ছিলাম এপাশ ওপাশ সম্মুখ। চক্ষু সম্মুখে কেউ নেই। রক্ত জবার কোনো সুগন্ধও নেই। 


২৬.       পৃথিবীর ক্লান্তি 


মধ্যরাতে একটি অচেনা নম্বর থেকে হোয়াটসআপে ম্যাসেজ এল। কোনো কোনো সময় সামান্য টুংটাং শব্দেও ঘুম ভেঙে যায়। তেমনই ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা।  বার্তায় কী এক মায়া নিবেদন! কেমন এক নৈবদ্যে ভরা দু'হাত বাড়ানো তার ! লিখেছে সে -

'মসৃণ গাত্রবর্ণ। জলভরা ঘন মেঘের ন্যায় কুঞ্চিত কেশদাম । আরক্ত সুন্দর মুখ আমার। বড়ই  শিহরণ লাগছে এই রাতে। শক্ত দু'হাতে কেউ এসে ধরুক আমাকে। শাড়ির অঞ্চল না। বুকও না, চিবুকও না। লুকানো অস্থি ধরুক। অদ্ভুত তরঙ্গ তুলুক রক্তে। গুহার আঁধার সরিয়ে আলোক প্রজ্জ্বলিত করুক। কতকাল ধরে তমস্রী সেখানে। প্রণয় আঁচড় নেই। উদ্ধত প্রলয় উঠুক দু'পাড়ে। একটি দূরন্ত হাঙর এসে উপড়ে  গিলে ফেলুক নরম করোটি । কত উচ্ছ্বাস, কত উচ্ছ্বল স্পর্শ। কিছু মুহুর্ত হোক হেমবর্ণের। কিছুটা সময় মধুময়।  পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্তি নেমে আসুক...না...!' 



২৭.      ফেরা


হোয়াটস্ আপে এই ম্যাসেজটি পাঠায় কেউ একজন। "তোমার ফেসবুকে স্টাটাসে দেখলাম, আমার চিঠিগুলো দিয়ে কাগজের নৌকা বানিয়ে বালু নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছ। আর আমিও সেই থেকে জলে ভাসছি। 

আমাকে ভাসিয়ে এরপরে তূমি কাকে কয়টা চিঠি লিখেছ ? তারাও তো তোমার চিঠিগুলো টুকরো টুকরো করে একদিন জলে ভাসিয়ে দেবে, তখন তো তুমি ভাসতে ভাসতে আমার কাছেই চলে আসবে।''


২৮.       লক্ষ্মীজান


নতুন বিয়ে করে প্রথম গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। তখন আষাঢ়ের প্রথম সময়কাল। তখনও বর্ষার জল খাল বিলে আসেনি। কিন্তু প্রমত্ত যমুনা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। নতুন বউয়ের ইচ্ছা হলো যমুনা নদী দেখবার।

ভাটপিয়ারী আমার মামাদের গ্রাম। মামার বাড়ির পাশ দিয়ে যমুনা বয়ে চলেছে। হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গে  তখন ধবল মেঘ পুঞ্জের ঘনঘটা, জিমা ইয়ংজং হিমবাহে তখন হিমেল হাওয়া। মানস সরোবরের উত্তাল তরঙ্গমালা ব্রহ্মপুত্র হয়ে যমুনাকেও উত্তাল করে তুলেছে। 

আমরা দু'জন মামা বাড়িতে। সেদিন ছিল পূর্ণিমার সন্ধ্যা রাত। বাড়ির সামনে বাঁশ ঝাড়ের অর্ধেক ভেঙ্গে গেছে নদীতে। পূর্ণিমার চাঁদ জ্বলছে যমুনার জলে। আমরা নদীর খুব কাছে চলে যাই। কুলে উচুঁ মাটির ঢিপির ঘাসের উপর দুজন যেয়ে বসি। থর থর করে নদীর জলের শব্দ হচ্ছে। আশে পাশে থেকে পাড় ভেঙ্গে পডছে জলে। এক মোহনীয় স্রোতের শব্দে ভাসছে যমুনা। সন্ধ্যার জ্যোৎস্নায় কেঁপে ওঠে আমাদের হৃদয়। মনে হচ্ছে হিমালয়ের গিরি শৃঙ্গ থেকে জল ঝরছে মানস সরোবরে।

পাগলকাড়া চাঁদের আলোয় দেখলাম ওর মুখ। স্নিগ্ধ মায়াবী এক হাসি দেখতে পেলাম সে মুখে। আমার হাত কখন সে ছেড়ে দিয়েছিল, জানি নাই। মুহূর্তেই পাড় ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাই। মাটি ধ্বসে পড়া শব্দের সাথে যমুনার জল ঝলসিয়ে ওঠে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয়।পাশে ফিরে দেখি সে নেই। প্রমত্তা যমুনার জল তাকে ভেসে নিয়ে গেছে।

আজ থেকে অনেক বছর আগে আমার ছোটো ফুপু লক্ষ্মীজান'কে ঠিক এমনি এক পূর্ণিমা রাতে প্রমত্তা যমুনা কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর স্বামীর কাছে থেকে। এটি তারই একটি অনুগল্পের রূপ।


২৯.        ডং ডং ডং


কফি খাওয়ার জন্য বইমেলার গেটের দক্ষিণ পাশের খাবারের দোকানের দিকে যাচ্ছিলাম। ওখান দিয়ে বেশ গাছগাছালি। তখন সন্ধ্যার আলো আঁধার। মাওলা ব্রাদার্সের প্যাভিলিয়নের অদূরে একটি গাছতলায় একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। একাকী সে। কেউ নেই সাথে।

আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। এই মুখ যে বহু বছর আগের চেনা মুখের মতো লাগছে। কাছে এগিয়ে যেয়ে বলি, 'আপনার নাম কি কালাম?'
সে হকচকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক পলক। এবং পর মূহুর্তেই আমাকে জড়িয়ে ধরে! 
আলিঙ্গন যেন ছাড়তে চাচ্ছিল না!

এত বছর পর দেখা আমার এই কলেজ জীবনের বন্ধুটির সাথে। এত বছরের মাঝখানের এই বিচ্ছেদ সময়েও ধুলো পড়ে বন্ধুত্বের সেই  সম্পর্ককে একটুও  ম্লান করতে পারেনি।

হাতে একদম স্বল্প সময়। স্টলের সামনে পাঠকরা এসে অপেক্ষা করবে, তাই আমার চলে যাবার তাড়া ছিল।  আমি কালামকে নিয়ে কফি খাই। কফি খেতে খেতে ওর সাথে কিছু কথা হয়। আমি বলি আমার কথা, ও বলে ওর কথা। এত বছর পর দেখা!  কত কথা আমাদের!  এই ক্ষণিক সময়ে কী সব কথা বলে শেষ হয়! 

কালামকে বলছিলাম,  তোর ছেলে মেয়ে কজন?  ও বলে এক মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে।
-- ভাবী কে মেলায় আনলি না যে!
-- তোর ভাবী নেই। 
-- নেই মানে? 
-- চলে গেছে সে বহু বছর আগে! যেখানে গেছে সেখান   থেকে কেউ কোনো দিন ফিরে আসেনা।

মনটা খুব বিষণ্ণ হলো। আমি ওর কাধের উপর হাত রাখি। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে ওর শরীরের উপরে। ওকে বলি, 'চল তোর ভাবী স্টলের সামনে আছে। দেখা কর্।' কালাম ওর মলিন পোশাকের দিকে একবার তাকায়। এবং বলে -- 'আজ না দোস্ত। '

আমাদের কফি খাওয়া শেষ হয়।

কালাম বলে -- 'তুই কি বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস?'
-- হ্যাঁ, ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর খাই না। 
-- আমাকে বিড়ি খেতে হবে।
-- আচ্ছা, তোর সাথে আজ না হয় একটু খেলাম। চল গেটের বাইরে। 

দুজনেই সিগারেটে টান দেই। কালামের সাথে আরও কিছু কথা হয়। তারপর ও চলে যায়। আবারও সে জনারণ্যে মিশে যায় আর এক জনমের জন্য। আমি কেবল ওর অপসৃয়মান ছায়ামূর্তিটির দিকে নির্বিকার  তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ।

ওই দূরপ্রহরে কী এক শেষের ঘন্টাধ্বনি যেন  শুনতে পেলাম -
ডং ডং ডং!


৩০.      অটোগ্রাফ


একবার বইমেলায় আমার একজন পাঠিকা এসেছিল "পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম" গল্পের বইটি নিতে। মেয়েটির বয়স কুড়ি একুশ হবে। কেমন যেন দুঃখী দুঃখী বিনম্র চেহারা ছিল তার। মুখে ম্লান হাসিটুকুও ছিল না। 
সে বিক্রয়কর্মীর কাছে থেকে আমার 'পূর্ণিমা নিশীথিনী" বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকে, এবং  ঠিক 'পূর্ণিমা নিশীথিনী' গল্পটির উপর স্থীর দৃষ্টি রাখে কিছুক্ষণ। একটু পড়লও মনে হয়। মেয়েটি বিক্রয়কর্মীকে বইটির মূল্য পরিশোধ করে। 
আমি সাধারণত আগ বাড়িয়ে কাউকে বলিনা, 'আসুন, অটোগ্রাফ লিখে দিই'। কারণ নিজেকে অতবড়ো সেলিব্রিটি লেখক মনে হয় না। 
মেয়েটি নিজেই বলল 'অটোগ্রাফ লিখে দিন। '

তখন ছিল সন্ধ্যাপূর্ব মুহূর্ত। আমি বইটির প্রথম সাদা পাতায় লিখলাম- "আজকের এই অপূর্ব সুন্দর ফাগুন সন্ধ্যার চেয়ে তোমার মুখখানি আরও বেশি সুন্দর ও আশ্চর্য লাগছে। " মেয়েটি পড়ে একটু ম্লান হাসলো। এবং সালাম দিয়ে চলে গেল।

মেয়েটি আমার ফেসবুকে বন্ধু তালিকায় ছিল। কিন্তু চিনতাম না, জানতামও না তেমন। পরে জেনেছি সে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল। এবং সে মারা যায়।
উল্লেখ্য, আমার "পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম " গল্পটি একটি মেডিকেল পড়ুয়া ক্যান্সার আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে লেখা । 


৩১.     যে কথা বলা হয়নি


এক জ‍্যোৎস্না প্লাবিত পূর্ণিমা রাতে পুকুরপাড়ে দূর্বা ঘাসের উপর বসেছিলাম অনেক রাত্রি পর্যন্ত। দক্ষিণ দিক হতে বয়ে এসেছিল উতরোল হাওয়া। কারো একজনের মলমল পায়ের ধ্বনি বাজছিল। মনে হয়েছিল --- ধানক্ষেতের আলপথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে কেউ আসছে। যখন সে কাছে এল, শরীর থেকে তার পাকা ধানের গন্ধ পাচ্ছিলাম।

রাতের কোনও কথা নেই। আকাশ থেকে নক্ষত্রেরা আলোর তীরের মত ছুটে আসছিল। অতিপ্রাকৃতার মাথায় দোপাট্টা দিয়ে ঢাকা ছিল। প্রথম কথা ছিল তারই --- 'তুমি আমার প্রাণ।' সেই রাতের সেই উতরোল হাওয়া হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি দোপাট্টা সরিয়ে মুখখানি খুলে দেখতেই চিনে ফেলি তাকে। সে যে আমার বহু স্বপ্নে দেখা সেই স্বপ্নময়ী।

তারপর কী হয়েছিল জানো? 
 
আমার অনেক কিছুই মনে নেই। সেই মুখখানি একটি পুঞ্জিভুত শোকের ছবির মতন। কে যেন আমার মোহঘোর ভেঙে দিল। অতি প্রাচীন একটি পোড়া মাটির ঘর। একটি অন্ধকার গুহামুখ সেখানে। ধূসর আলোয় প্রদীপ শিখা জ্বেলে বসে আছে সেই স্বপ্নময়ী। হঠাৎ প্রদীপ খানি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল সে নিজেই। যে তারাভরা আকাশ দেখে এসেছিলাম দূর্বা ঘাসের উপর বসে পুকুরপাড়ে। যে প্রান্তর জুড়ে পূর্ণিমা চাঁদের জোছনা ভেসেছিল বন‍্যার মতো। যে উতরোল হাওয়া বয়ে এসেছিল দক্ষিণে থেকে, সেসব কিছু নেই। দেখি, কেবলই অন্ধকার। এত অন্ধকার যে আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠি। 

আসলে স্বপ্ন নয় সত্যি।

সেই আঁধারে তুমিই যত্ন করে জ্বালালে পাথরের চুলার আগুন। আমাকে সাহস দিলে। মাথার ঘোমটার আঁচল ঠিক করতে করতে দেখে নিলে কোথাও কোনো অঙ্গারের টুকরো পড়ে রয়েছে কীনা। আমি ভাবি, এই ভাবেই তুমি অন্ধকার থেকে চিরকাল আলো জ্বালিয়ে ধরবে আমায়।

তুমিই এই মোহঘোর ভেঙে দাও। 
শ্লথ পায়ে এগিয়ে নিয়ে যাও রাস্তা পেরিয়ে, তুমি একা নও, আমাকে সাথে নিয়ে ।


৩২.      করবী


আজ এই রাতে ঢাকার আকাশে মেঘ নেই। পশ্চিম দিকে রাস্তার উপর গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কুসুমপুরের মতো কোনও নিশাচর পাখিকে উড়ে যেতে দেখলাম না আলো অন্ধকারে। এই নিয়নের আলোর দেশে কোনও পাখির দেখা কী মেলে? তা না মিলুক। সামান‍্য পাখির জন্য মন খারাপ হয় নাকি কারোর?

ইউটিউবে শচীন দেব বর্মনের গান শুনছিলাম। 
'বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছো দোলা,/ রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে 
একি তব হরি খেলা,/ তুমি যে ফাগুন রঙেরও আগুন তুমি যে রসেরও ধারা, /তোমার মাধুরী তোমার মদিরা করে মোরে দিশাহারা।'

আমি কী করতে পারি? উদাস মন হলে হাত পা অবশ হয়ে আসে। যা করতে চাই, তা করতে পারি না। কিছু না করি সেও কম ভালো, বেশি যেন না ভাবি। ভালোলাগা বেঁচে থাক আমার রাতের সঙ্গে। এও এক অবুঝ অবোধ সঙ্গ।

গান শোনা বন্ধ হয়ে গেছে। যদি মেঘ হতো তাহলে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসত। এই ফাগুন ঋতু জানান দেয়, বৃষ্টি হতেও পারে। বারান্দায় হেঁটে হেঁটে ওপাশে চলে যাই। আকাশ দেখে ফিরে আসি আবার। আমি কী পেয়ে গেছিলাম নিরক্ষর চিরচেনা কোনো ফুলের গন্ধ?

তুমি কী উদ্বেলিত! আমি চন্দন যোগার করেছি ভালোবাসার জন্য। আমি গন্ধ বিলাব রাত্রি সহচরী রমণীর বুকে। পাখি হয়ে রোজ আকাশে উড়তে চাই। যেমন করে কোনো একলা যুবক অন্ধকারে ভালবেসে ভেসে যায়।

আমি নিমগ্নতা চাই। একজন রমণী এ ঘর ও ঘর হাঁটবে আমার সুখে সুখে। সে আনন্দ করুক রাতে ফুটে থাকা কোনো রক্ত করবীর মতো। সে যে নন্দিনী হবে আজ রাত্রিতে এই রঞ্জনের।


৩৩.        একা একা কথা বলি 


--- এই, আজ বিকালে আমরা বুড়িগঙ্গার পাড়ে যাব।

--- যাবে যে, কোথায় বসবে ওখানে? ওখানে কী সবুজ ঘাস আছে? আছে কী কোনো অশ্বত্থ বৃক্ষ নদীর কূলে? যার ছায়ায় দুজন বসে থাকব। 

--- সবুজ ঘাস না থাক, সদরঘাটের প্লাটফর্মের লোহার রেলিং তো আছে। দুজন দাঁড়িয়ে থাকব সেই রেলিং ধরে। আর কিছু না থাক, খোলা বাতাস তো পাব সেখানে। কূলে যদি থাকে ডিঙি নৌকা। তবে নৌকায় চড়ে ভাসতে তো পারব নদীতে।

---- নৌকার কথা বলো না। তুমি থাকলে আমার যে কেবল হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসতে ইচ্ছা করে।

----  ভাসতে চাও ভাসবে। কী সুন্দর হিম বাতাস বয়ে যায় সেখানে। নদীতেই কেবল এই ধরনের বাতাস  পাওয়া যায়। সেই শীতল হাওয়া লাগবে আমাদের শরীরে। জানো? এমন কোনো নদীর পাড় দেখিনি আমি, যেখানে হাওয়া বয় না। হাওয়াটা বেশ ভাল লাগবে। বাতাস এসে খেলা করবে তোমার চুলে। উড়বে তোমার শাড়ির আঁচল। আমরা ভেসে বেড়াব। বা ধরো, নদীতে ছোট ছোট ঢেউ বয়ে যাবে তখন। তুমি দুহাত দিয়ে সেই ঢেউ ধরতে চাইবে।  

--- এই ধরো , তুমি আর আমি , বিকেল - সন্ধ্যা - রাত - ভোর অব্দি নদীতেই থাকব। এই, আমি যাব তোমার সাথে। 

--- এই,  শোনো....।

হঠাৎ পাশে থেকে সে বলে ওঠে --- এই! তুমি একা একা কার সাথে কথা বলছ? 

--- কই , না তো । ও কিছু না...। 

একটু লজ্জাই পাই আমি। অপ্রস্তুতও হয়ে যাই। মাঝে মাঝে আমার কী যে হয়! দিন নেই, ক্ষণ নেই। সময় অসময় নেই। এমনিতেই একা একা কথা বলি।


৩৪.         পদ্মফুলের রূপকথা


আমার দাদাজানকে আমি কখনই দেখি নাই। তাহার কোনো ফটোগ্রাফ কিংবা কোনো  তৈলচিত্রও কোথাও আঁকা নাই। বাবার কাছে শুনিয়াছি,  তিনি  ঊনিশ শত ছত্রিশ সালে মৃত্যুবরণ করিয়াছিলেন। তিনি দেখিতে নাকি অনেকটা ঋৃষিদের মতো ছিলেন। ভাল পুঁথি পাঠ করিতে পারিতেন। গত রাতে আমার দাদাজানকে স্বপ্নে দেখিলাম।

উনিশ'শ তিরিশ দশকের এক নিঝুম সন্ধ্যারাত্রি। বাড়ির উঠানে বসিয়া দাদাজান পুঁথি পাঠ করিতেছে।  মাটির প্রদীপদানীতে সলতে মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে। তাহার পাশে অনেকেই বসিয়া তাহার পুঁথি পাঠ শুনিতেছে। দাদীমাও বসিয়া আছেন সেখানে । আমি ঠিক দাদীমার বাহুতে হেলান দিয়া সেই পূথি পাঠ মন্ত্রের মতো হা করিয়া শুনিতেছি। পরম উদ্গ্রীব হইয়া শুনিতেছিলাম আর ভাবিতেছিলাম --- আহা! এমন করিয়া তিনি যদি সারা রাত্রি পুঁথি পাঠ করিয়া যাইতেন! কী সুন্দর  সুরেলা প্রেমময় কণ্ঠ তাহার। অনেকটা ব্রজবুলি ভাষায় তিনি দৌলত কাজীর পুঁথি পাঠ করিয়া যাইতেছেন।

'‘‘কি কহিব কুমারীর রূপের প্রসংগ।
অংগের লীলায় যেন বান্ধিছে অনংগ
কাঞ্চন কমল মুখ পূর্ণ শশী নিন্দে।
অপমানে জ্বলেতে প্রবেশে অরবিন্দে "

একটা সময়ে তিনি পুঁথি পাঠ বন্ধ করিলেন। আমার দিকে তাকিয়া কহিলেন --

বৎস, এই যে তুমি তোমার দাদীজানকে দেখিতেছ এর কথা তোমাকে কী বলিব? একবার আমি আরাকান পাহাড়ে গিয়াছিলাম। সে তখন হাঁস হইয়া ওখানের একটি নদীতে ভাসিতেছিল। সে কখনও মাছ হইয়া সাঁতার কাটিত নাফ, কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীতে । আবার কখনও  হাজার পাপড়ির পদ্মফুল হইয়া ফুটিয়া থাকিত সরোবরে – দূর দূর দেশ হইতে অনেকেই আসিত তোমার দাদীমার সৌন্দর্য দেখিতে। কিন্তু কেহই তাহার সৌন্দর্য সুধা উপভোগ করিতে পারে নাই। আমিই পারিয়াছিলাম। তাহার পাঁপড়ির ঘ্রাণে আমিই প্রথম  মুগ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলাম।

আমি আমার দাদাজানকে বলিলাম, আমি কী এমন একটি পদ্মফুলের ঘ্রাণ কোনোদিন লইতে পারিব না? তিনি কহিলেন --- তুমি তোমার মাথাটি আমার দিকে আগাইয়া ধরো। এসো বর  দেই -- তোমার এই রূপবতী দাদিমার মতো তুমিও যেন জীবনে এমন একটি পদ্মফুলের পাঁপড়ির ঘ্রাণ লইতে পারো।

আমি ঠিক বুঝিতে পারিলাম না ঠিক কোন্ পদ্মফুলের পাঁপড়ির ঘ্রাণে আমার ঘুম হঠাৎ ভাঙ্গিয়া গেল! 


৩৫.         হলুদকণ্ঠ পাখির খোঁজে


কিশোর সময়ের কথা। একদিন বৈশাখের এক বিকেলে বাড়ির পুকুর পাড়ে আমগাছ তলায় বসে আছি। হঠাৎ দেখি দুটো হলদে পাখি ছাতিম গাছের ডালে এসে বসল। ওরা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে কোনো সবুজ বৃক্ষ ছিল না। ছিল দিগন্ত জোড়া খোলা মাঠ। আর উপরে আকাশ ছিল নীলিমার নীল। ভাবলাম, এত নীলে থেকে ওরা এল, অথচ ওরা নীলকণ্ঠী না হয়ে এমন হলুদকণ্ঠী হলো কেন?

তিন দিন পরে গিয়ে দেখি, হলদে পাখি দুটো ছাতিম গাছের পাতার ফাঁকে নতুন বাসা বেঁধেছে। আমার কী যে ভালো লাগল ওদের বাসা বাঁধা দেখে। এত ভাল লাগছিল যে, সেদিন রাতে আনন্দ আতিশয্যে আমার আর ঘুম এল না। 

পরের দিন সন্ধ্যা রাতে হঠাৎ প্রচুর শীলা বৃষ্টি হয়। সাথে প্রচন্ড ঝড়। ঝর বৃষ্টি থেমে গেলে আমি হ্যারিকেন নিয়ে পাখির বাসাটি দেখতে যাই। দেখি, পাখির বাসাটি সেখানে নেই। ঝড়ে বাসাটা ভেঙে গেছে। পাখি দুটোকে তখন দেখতে পেলাম না।

সকালবেলা গিয়ে দেখি -- শীলার আঘাতে স্ত্রী পাখিটি মরে মাটিতে পড়ে আছে। সারা শরীরে তার রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সে যে মরে পরে আছে, ছেলে পাখিটা তা জানতো না। পাখিটার মৃত শরীর ঝরা পাতায় ঢাকা ছিল। 

ছেলে পাখিটা মন খারাপ করে সারাদিন ছাতিম গাছের ডালে বসে থাকত। সে ভাবত, তার স্ত্রী ঝড়ে উড়ে কোথাও চলে গেছে। একদিন  হয়ত সে চলে আসবে। তাই সে অপেক্ষা করে। কিন্তু সে আর আসেনা।  

আর একদিন গিয়ে দেখি, ছেলে পাখিটির চোখে মুখে বেশ খুশি খুশি ভাব। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি  ' তুমি আজ এত খুশি কেন? ' সে তখন বলে --- ' আজ আমি মধুপুর বনে চলে যাচ্ছি। ওখানে সব হলুদ পাখিদের মিলন মেলা বসবে। আমার প্রেয়সীও ওখানে আসবে। তার সাথে আমার দেখা হবে। ' এই বলে পাখিটি উড়ে চলে গেল।

আমি সেই পাখিটিকে শুভাশীষ জানিয়ে বললাম -- 'তুমি যেন তোমার প্রেয়সীর দেখা পাও।'


৩৬.       কালা চোর


ঘটনাটি ঘটেছিল এক অস্থির সময়ে। ১৯৭৬ সালের মার্চ এপ্রিলের দিকে হবে । গ্রামে গঞ্জে তখনো পুরোপুরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। জাসদের গণ বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির খুন খারাবী, নক্সালদের হাতে গুম খুন লুট - গ্রাম এলাকায় তখন চরম ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এইসব নৈরা্জ্য দমন শুরু করেছিলেন বটে কিন্তু পঁচাত্তরের আগস্টে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান অবশ্য এইসব অরাজকতা কঠোর হস্তে দমনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

ছেলেটির নাম কালা। গায়ের রং ছিল কুঁচকুঁচে কালো। ২১/২২ বছরের সুঠাম যুবক। ওর বাবার নাম ছিলো দানেশ। পেশায় চোর। সিধেল চোর যাকে বলে। দানেশ তার ছেলে কালা'কেও চৌর্য পেশায় নামায়। ওদের একটা নীতি ছিল-, ওরা কখনো নিজ গ্রামে কিংবা আশে পাশের গ্রামে চুরি চামারী করতো না। দূর গাঁয়ে সিঁদ কেটে  চুরি করতো। তবে কখনো কাউকে খুন জখম করেনি। চোর হিসাবে ওরা খুবই নিরীহ ও ভদ্র ছিল।

একদিন আশে পাশের ৩/৪ গ্রামের কিছু মানুষ কালাকে ধরে এনে শালিসে বসায়। শালিসটি বসেছিল আমাদের পাশের গ্রামের এক স্কুল ঘরে। আর কালাকে শালিস চলাকালীন সময়েই বেদম মারপিট করে আড়মরা করে বেঁধে রেখেছিল স্কুল মাঠের গাছের সাথে। ওর শরীরের বিভিন্ন জখম থেকে তখন রক্ত ঝরছিল। ঐ শালিসের অন্যতম বিচারক ছিল-পাশের গ্রামের এক যুবক। বিচারে রায় হয় কালার মৃত্যদন্ড।

তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। সকাল থেকে কালা অভুক্তই ছিল। তখনো তাকে গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা ছিল। ওর অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী ওকে দেখতে আসে। কালা তখনো জানে না তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়েছে। ওর স্ত্রী ওর পাশে বসে কাঁদতে থাকে। স্ত্রীর এই রকম অঝোর ধারায় কান্না দেখে কালা মনে হয় লজ্জা পাচ্ছিল। কালা ওর স্ত্রীকে বলে- 'কান্দিতোছো ক্যান, বাইত চইলা যাও।' ওর স্ত্রীর হাত ধরে  ছল ছল চোখে তাকিয়ে থেকে আবার বলে- 'কাইন্দোনা,বাইত যাও।'

স্কুল ঘর থেকে পাশের গ্রামের যুবকটি বের হয়ে আসে। গরুকে যেভাবে মাঠে নিয়ে যায়, ঠিক তেমনি ভাবে ঐ যুবক কালাকে  টেনে বেঁধে দূরে বিরাণ মাঠের দিকে নিয়ে যায় । প্রায় পাঁচশত গজ ফাঁকে শত শত মানুষ তখন দর্শক হিসাবে দাঁড়িয়ে দেখছিল সব । দূর হতে দেখা গেল- সেই যুবক কালাকে বেওনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলছে। কালার রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকে নির্জন প্রান্তরে ধানক্ষেতের ভিতর।

ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্তমিত হয়েছে। মসজিদে আযান  হচ্ছে। মন্দিরে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠেছে। শত শত মানুষ ঘরে ফিরছে। কেউ উল্লাস করছে। কারো চোখে মুখে বিষাদ। হতভাগ্য কালা চোরের লাশটি ধানক্ষেতেই পড়ে থেকেছিল সারারাত। লাশটি দাফন হয়েছিল, না শিয়াল কুকুরে খেয়েছিল,আজ আর তা মনে নেই।



৩৭.        ডায়েরির পাতা



পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলাম পিছনের দিকে।
১৬ জুলাই, ১৯৮২ ইং

কিছু গান আছে আমার হয়ে কানে বাজে। 'এই মণিহার আমায় নাহি সাজে।' কেন জানি না, এই গানটি আমার নিজের গান হয়ে গেছে। নিজে খেয়াল না করে যে সুর গুনগুন করি। 

দুপুর ছিল সেই সময়। শ্রাবণ দিনে বৃষ্টি না হলে মানায় না। কিন্তু, সেদিন ছিল কাঠ পোড়া রোদ। চানখাঁর পুল বাস স্ট্যান্ড থেকে জয়দেবপুরের কাঠবডি বাসে করে সোজা লতিফ গেট যেয়ে নামি -- আমি এবং ফারিয়া মির্জা।

বর্ষার ফুল লাগিয়েছিলাম ঘরের চারপাশে। কয়েকটি ফুলেই যেন মালঞ্চ ঘেরা ঘর যেন আমার।  নতুন ফুল এসেছিল। এত সুন্দর সাজের ফুল ফুটে থাকে, একলা দেখি, একলা অনুভব করি। এই ফুল দেখবার সাধ হয়েছিল ফারিয়া মির্জার।

ফারিয়া আমার বন্ধু। ওর স্বামী কৃষি বৈজ্ঞানিক। দেরাদুনে একটি কৃষি কর্মশালায় যোগ দিতে চলে গিয়েছিল। ফারিয়া বলেছিল, 'কেমন যেন একলা লাগে আমার। তোমার ফুল দেখতে যাব। এবং দেখব তোমার মালঞ্চ ঘেরা বাড়ি।'

লতিফ গেট থেকে কাঁচা রাস্তার পথ। তবুও রিক্সায় উঠি। রিক্সা এ দোল ও দোল করে চলে আসে। পথ ছিল সামান্য। মাথার উপর বর্ষার রোদ। ফারিয়া বলছিল--
'ভাল লাগছে এই পথ।' 
রাতে বৃষ্টি হয়ে যাওয়া মাটিতে রোদ্দুর পড়ে গন্ধ ভেসে আসছিল।

মালঞ্চ ঘেরা বাড়িতে সেদিন অনেক ফুল ফুটেছিল। গন্ধরাজ পাপড়ি মেলেছিল ভুজঙ্গের মত। বেলী আর রক্ত জবা রঞ্জিত করেছিল তার চারপাশ। 
এই সৌন্দর্য ছিল স্বর্গীয়, যে দেখে সেই জানে, যে গন্ধ নেয় সেই বোঝে এর তীব্র সুবাস। যে কন্ঠে পরে সেই জানে, এই মণিহার কেমন?

ফারিয়া সেদিন একটি গান গেয়ে শোনায়েছিল আমাকে। ঠিক ঐ গানটি, এই মণিহার আমায় নাহি সাজে। যখন ও গাইছিল গান, তখন অলিন্দে বসে দেখেছিলাম --  প্রখর রোদ্দুরে মালঞ্চের সব ফুলের পাপড়ি  নির্যাসিত হয়ে ঝরে পড়ছে।

পৃষ্ঠাগূলো আর উল্টালাম না। বন্ধ করে রাখি। জীবনের অনেক সৌন্দর্যে অমঙ্গল লুকিয়ে থাকে।


৩৮.      কদম্বকেশরের স্পর্শ


বর্ষা এসেছে কবে। এখনো কোথাও কদম ফুলের দেখা মেলে নাই। এই শহরে আজো কেমন যেন এর ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হই। তাইত বর্ষা এলে কদম গাছ খুঁজে মরি পথে পথে।

কুসুমপুরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুকুরপাড়ে একটি কদম গাছ ছিল। থোকা থোকা ফুল ফুটে থাকত এর ডালে ডালে। গাছটির ছায়া পড়ত দীঘির স্বচ্ছ জলে। আমি একবার জলের দিকে তাকাতাম, আরেকবার গাছের দিকে। কোথায় কোন্ বাতাস থেকে বিমুগ্ধ ঘ্রাণ চলে আসত। আর সে ঘ্রাণে মর্মরিত হয়ে উঠত আমার হৃদয়।

বহু শতাব্দী আগে কোনো এক জনমে পুন্ড্রনগরীর একটি পুষ্করিণী পাড়ের কদমতলে দাঁড়িয়ে কদম ফুলের ঘ্রাণ দিয়েছিল একটি মেয়ে। কদম্বকেশরের হলুদ কমলার স্পর্শ লেগেছিল আমার ঠোঁটে আর গ্রীবায়। প্রথম কোনো শিহরণও ছিল ঐটি।

কতো শত বছর আগের সেই মধুরম ছায়া-ছায়া স্মৃতি আজও আমার মনকে বিহ্বলিত করে।


৩৯.       বৃষ্টি ভেজা গল্প


ছেলেটির বৃষ্টিতে ভেজার খুব সখ ছিল। কিন্তু ঠাণ্ডা লাগবে দেখে ওর মা ওকে কোনোদিন বৃষ্টিতে ভিজতে  দেয়নি। এ জন্যে ওর অভিমানও ছিল মায়ের উপর । 
এক শ্রাবণ বৃষ্টির দিনে ছেলেটির মা মারা যায়। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই শব যাত্রায় কবরস্থানে গেল ছেলেটি। মাকে কবর দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই সে বাড়ি ফিরল। আজ আর বৃষ্টিতে ভিজতে ওকে কেউ বাঁধা দিল না।


৪০.        কেউ নেই


একা মানুষ তখন। উদ্দাম স্রোতের মত জীবন। একদিন রাত্রিতে ঘরে ফিরছিলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও আলো নেই। চারদিক ঝিল্লি মুখরিত। বাঁশ ঝাড়ের দিক থেকে গায়ে এসে লাগছিল মিহি বাতাস। এত স্তব্ধ, এত নির্জন এই আঙিনায়, এই আলয়ে, এই ঘরে -- কেমন যেন কেউ নেই, কে্উ নেই।

সকালবেলা তালা মেরে ঘর বন্ধ করে যাই। রাতে এসে তালা খুলি। আজও তালা খুলতে গিয়ে দেখি --- দরজার রিঙে তালা নেই। ভিতরে থেকে বন্ধ। নক করব। ঠিক সেই মুহূর্তে আচম্বিতে দরজার পাল্লা ঝপাং করে কে যেন খুলে দেয়। ভিতরে অন্ধকার ছিল। খুঁজি, কে খুলে দিল দরজা! কিন্তু ঘরের ভিতর কেউ নেই। দিয়াশলাই জ্বেলে মোমবাতি ধরাই। ভালো করে সারা ঘরময় খুঁজে দেখি, কোথাও কেউ নেই।

কেমন যেন গা শিউরে উঠছিল, আমি দ্রুত দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। মোমবাতি আর নেভালাম না। কখন মোমবাতি পুড়ে গলে  শেষ হয়ে নিভে গেছে জানি না। যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল। জানালার ফাঁক দিয়ে কমলালেবুর মতো রঙিন রোদ্দুর আমার মুখের উপর এসে পড়েছে। আহা, আমার এই রোদ্দুর মাখা মুখখানি কেউ দেখল না। এই ঘরে, এই বিছানায় কেউ যে নেই।

ঘুম ভেঙ্গে দেখি, আমার এলমেল কাপড়গুলো কে যেন পরিপাটি করে ভাঁজ করে আলনায় সাজিয়ে রেখেছে। ফুলদানিতে শুকিয়ে যাওয়া ফুল সরিয়ে কে যেন তাজা গোলাপ রেখে দিয়েছে। টেবিলের উপর এলমেল বইপত্তর সব গুছিয়ে রেখেছে। মশারি টাঙিয়ে শুয়ে ছিলাম না, কিন্তু কে যেন মশারি টানিয়ে দিয়েছে। স্নান ঘরে গিয়ে দেখি, বালতি ভর্তি গোসলের জল। আমি বিস্মিত হই। দিনের আলোয় আবার খুঁজি। কিন্তু এই ঘরে কেউ নেই।

কেমন যেন কারোর স্পর্শের অনুভূতি পাচ্ছিলাম। কার যেন শরীরের ঘ্রাণ ! কোথা হতে যেন এসে লেখা হতে লাগল কবিতা --
'এইখানে নিঝুম এসে নামে অতর্কিতে গূঢ় রাতদুপুর।
অনেক এলমেল, কী তাতে এসে গেল, বুকের দরজায় তবুও এই —
জোনাকি বুনে চলে নিপুন নকশায় মধ্যরাত্রির স্বপ্নকেই।
শুষেছে সংকেতে শিরা ও ধমনীতে তীব্র চুম্বনে মুখ্য প্রাণ, তারে খুঁজেছি যে এতই, আহা! কোথাও যে কেউ নেই।'


৪১.        বিষাদ চিহ্ন


হঠাৎ আকাশ মেঘে কালো হয়ে গেল। বৃষ্টিও হলো। রোদও উঠল। আবার মেঘ হলো। আবার বৃষ্টি। তারপর রোদ আর উঠলো না। আকাশ থমথমে হয়ে থাকলো। ঘুম এলো চোখে। অসময়ের সেই ঘুম। 

তখন সন্ধ্যার আঁধার নেমেছে। জঙ্গলের ওপাশ দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল একটি মেয়ে। ঘোমটা দেওয়া ছিল মাথায়। কাপড়ের রং দেখে মনে হয়েছিল তাকে আমি চিনি। সে গন্ধরাজের ঝাড় থেকে একটি ফুল ছিঁড়ছিল। হঠাৎ একটি বিষধর সাপ তাকে ধ্বংসন করে। মেয়েটি আর্ত চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার কান্নার শব্দ শুনেই  তাকে চিনতে পারি। আমি কাছে এগিয়ে যাই। দেখি, হাত তার বিষে নীল হয়ে আছে। নাহ্ এটি কোনো সত‍্যি ঘটনা নয়। এটি একটি দুঃস্বপ্ন ছিল।

ঘুম থেকে জেগে তার হাতখানি আমি কাছে টেনে নেই। অনেক দিনের পুরনো একটি ক্ষত সেখানে আজও দেখতে পেলাম। যা আমারই সৃষ্ট করা একটি বিষাদ চিহ্ন। এখনও নীল হয়ে আছে।

আমি মুখ লাগিয়ে আজকেও ব‍্যথা শুষে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিছু ক্ষত কখনো উপশম হয়না।
     

৪২.         অন্তর মম অন্তর তব


সেই কুমার জীবনের কথা। সীতাকুণ্ড, রাউজান ও হাটহাজারীতে অফিস ট‍্যুর শেষ করে রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। ট্রেনের কামরায় আমার সফরসঙ্গী ছিল আরও চারজন। দুজন ছেলে এবং দুজন মেয়ে। ওরা কেউ কেউ বসে বসে ঘুমাচ্ছিল কেউ কেউ ঝিমুচ্ছিল। টুকটাক কথা ও গল্পও হয়েছিল আমাদের ভিতরে। তারপর সবাই চুপ হয়ে যায়। তারপর নীরবতা আসে রাতের। 

জানুয়ারির শীতের রাত্রি। সবাইয়ের গায়ে শীতের কাপড়, সবাই শীতের চাদরে গা ঢেকে বসে আছে। ট্রেন চলছে। হঠাৎ অনুভব হলো--- একটি কোমল হাত গোপনে ধরে আছে একটি কঠোর কঠিন হাতকে। অনুনয় ও সমর্পণ করার আকুলতা ছিল সেই হাতে। হয়ত বলতে চেয়েছিল --- 'এই অন্তর মম, এই অন্তর তব। আমাকে তুমি বিকশিত করো।' কিন্তু আমি ছিলাম নির্বিকার। সফর সঙ্গীরা কেউ তা দেখল না। সবাই জানল, আমরা যার যার মতো করে ঘুমিয়েছি।

আগের দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের গ্রামে গিয়েছিলাম আমি আর আমার সফরসঙ্গী এই মেয়েটি।  এ‍্যাসাইন্টমেন্টটা যদিও ছিল গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের প্রান্তিক আয় এবং তাদের আর্থ সামাজিক ও প্রাত‍্যহিক জীবন যাপন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা।

কাজ শেষে সেই গ্রাম থেকে ডাকবাংলোয় ফেরার পথে আমরা দুজন পাহাড়ের পাশে অবস্থিত চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি ক‍্যাম্পাসে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। মনোরম ছায়া পথে হাঁটতে হাঁটতে, চলতে চলতে এই মেয়েটি আমাকে তার অনেক স্বপ্নের কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার তা শোনা হয়নি। আমি শুনেছিলাম, বনের পাখিদের সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার গান। বিচিত্র সব পাখপাখালিদের কিচিরমিচির।

ভোরে ট্রেনটি ঢাকা ক‍্যান্টনমেন্ট স্টেশনে থামলে আমি ট্রেন থেকে নেমে পড়ি। বাকি সফর সঙ্গীরা নেমে যায় কমলাপুরে।

যে চোখে সারারাত ট্রেনে ঘুম আসলো না, সেই চোখ বাসায় এসে ঘুমে নুয়ে পড়ল।  আমি একা থাকতাম আমার ঘরে। আর কেউ না। সারাদিন ঘুমালাম। কখন দুপুর চলে গেছে, কখন বিকাল, কখন সন্ধ্যা, কিচ্ছু জানিনা। 

যখন ঘুম ভাঙ্গে, দেখি --- ঘর ভর্তি অন্ধকার। কিছুই চোখে দেখছিলাম না। মনে করতে পারছিলাম না কোনও কথা, কোনও স্বপ্নের কথা। মনে হয়েছিল --- এই অন্ধকার জগতে আমি কেবলই একা। আমার পাশে আর কেউ নেই।


৪৩.      মায়ের সই


সেই কত বছর আগে এক স্কুলফেরা এক দুপুরে পথের পাশে একটি বাড়ির আমগাছের ছায়াতলে বসে জিরাচ্ছিলাম। কচি ধানপাতা ছুঁয়ে বাতাস আসছিল দূর থেকে। ছায়ারোদ্দুর খেলা করছিল আমপাতার ফাঁকে ফাঁকে। শরীরের ঘাম যখন শুকিয়ে আসছিল, ঠিক তখনই সেই বাড়ির অন্দরমহল থেকে এক মধ্যবয়সী রমণী এগিয়ে আসে আমার দিকে। কাছে এসে বলেছিল সে, 'কে গো তুমি বাছা! তোমার বাড়ি কোন্ গাঁয়ে? তোমার নাম কী, তোমার বাবার নাম কী? আহারে! রোদে পুড়ে মুখখানি দেখছি কেমন মলিন হয়ে গেছে!'

নাম পরিচয় বলতেই সেই মধ্যবয়সী রমণী বলে ওঠে- 'তুমি দেখছি রাবেয়ার ছেলে ! তোমার মা আমার সই ছিল। আমরা একসাথে পুতুল খেলেছি। সে ছিল আমার খেলার সাথি। গোপিনাথপুর স্কুলে আমরা একসাথে লেখাপড়া করেছি'।

সে আমার হাত ধরে। কাছে টেনে নিয়ে তাঁর আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে বলে -- 'চলো ভিতরে চলো। কিছু খেয়ে যাবে'। 

আমি যাব না, তবুও আমাকে জোর করে টেনে বাড়ির ভিতরে সে নিয়ে যায়।  আমাকে চৌকিতে বসিয়ে বেতের টালাতে করে নারিকেল আর আখের গুর দিয়ে মুড়ি খেতে দিয়েছিল।

সেই কবেকার কথা। মা বেঁচে নেই।  আমার মায়ের 
সেই সইটিও আর বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর শাড়ির আঁচলের ছোঁয়া এখনও আমার কপালে পাই। মায়ের শরীরের গন্ধের মতোই সেই গন্ধ। তিনি আমার পার্থিব দেহে ছুঁয়ে নেই। কিন্তু তিনি আজো ছুঁয়ে আছেন আমার অনুভবে  .....


৪৪.        ঝরা পাতার গান


আজ খুব ভোরবেলায় ঘুম ভেঙ্গে যায়। সূর্য তখনো ওঠে নাই। কম্পিউটারে বসে ফেসবুকে নিউজ ফিডগুলো দেখছিলাম। হঠাৎ বন্ধু নেয়ামুলের টাইমলাইনে রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটি অডিও ক্লিপের উপর চোখ স্থির হয়ে যায়। অনেক বৎসর আগে এক চৈত্রের পাতা ঝরা দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুকুরপাড়ে বসে এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল একটি মেয়ে। জীবনের পাদপ্রদীপহীন অন্ধকারে সে মেয়ে হারিয়ে গেছে। সে আজ আর নেই। সেই গান সেই ভালোলাগার মুহূর্তগুলোও বিস্মৃত হয়ে গেছে । আমি অডিও ক্লিপটা অন্ করলাম, শুনলাম সেই গানটি --

"তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম. নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম॥ 
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন. তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম॥ 
জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি। 
মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন. তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥"

গানটি শুনতে শুনতে চোখ চলে যায়- সেদিনের সেই  উদ্যানের পুকুরপাড়ে। চৌচির করছে গাছগাছালি, খা্ঁখা্ঁ করছে রোদ্দুর। তপ্ত হাওয়ায় কড়ই গাছটি থেকে জীর্ণ পাতাগুলি এখনো ঝরে পড়ছে।


 ৪৫.      উপেক্ষিতা


একদিন ভোরবেলা ইনবক্সে একটি ম্যাসেজ আসে।

--- সুপ্রভাত  আপনাকে। ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছি। এ্যাড করে নেবেন। 

--- নতুন করে বন্ধু লিস্টে কাউকে যুক্ত করে নিতে খুব একটা আগ্রহ হয় না।

--- অনেক দিন ধরে রিকুয়েস্ট ঝুলিয়ে রেখেছেন। এ্যাকসেপটেন্স দিচ্ছেন না কেন? একজন না হয় আপনার বন্ধু বেশি হলো।

এ্যাড করে নিলাম তাকে। তারপর থেকে সে প্রতিদিন ভোরে সুপ্রভাত পাঠায়। প্রতিদিন শুভ রাত্রি জানায়। কখনও কখনও শুভ দুপুর, শুভ সন্ধা ....

ফরোয়ার্ড করা শুভেচ্ছা টুভেচ্ছা খুব একটা পছন্দ হয় না। প্রায়ই আনসিন করে রেখে দেই। পড়িও না এই সব। দেখার সময় নেই...

এরপর 'সুপ্রভাত' 'শুভ রাত্রি' জানানোর পাশাপাশি গানের লিঙ্ক পাঠাতে শুরু করে -- ' তুমি চেয়েছিলে ওগো জানতে..'  জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো....'   ' 'আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব....' এই রকম অসংখ্য সুন্দর সুন্দর বাংলা গান পাঠাতে থাকে ....

আমার এই সব শুনবার সময় কই? জীবন থেকে সব গান হারিয়ে গেছে কবে... কারোর কাছ থেকে আর কোনো শুভ কামনাও নিতে ইচ্ছা করে না। কোনো গান শুনতে ইচ্ছে করে না। জীবনের কোনো নতুন রঙের জলছবি আঁকতে ইচ্ছা করে না .….......

হঠাৎ দেখলাম, তার থেকে আর কোনো শুভেচ্ছা আসছে না। সকালে সুপ্রভাত নেই। রাতে শুভ রাত্রি নেই। কোনো গান নেই। সব গান সব সুর থেমে গেছে তার ....

ইচ্ছাও হলো না জানতে। কেন তার শুভাশিস নেই... কেন আর গানের কোনো লিঙ্ক নেই... 

কিন্তু মানুষের মনে হঠাৎই কৌতুহল হয়, হঠাৎ পদ্ম ফুলের মতো মন কোমল হয়। ইচ্ছে হলো -- মেয়েটার প্রোফাইলে যেয়ে একবার ঘুরে আসি।

দেখলাম, ওর কত বন্ধু ওকে ফুলে ফুলে শুভেচ্ছা দিয়ে রেখেছে। কতো অশ্রুাঞ্জলি ...

খুব খারাপ লাগল। কান্নাও পেল...। জগতে এমন নীরব প্রস্থান হয় কারও! কী উপেক্ষাই না করেছিলাম মেয়েটিকে। 

জানি, কমেন্ট দেখতে পাবে না আর, তবুও 
ছোট্ট করে  লিখলাম --- ' ওপারে তুমি ভালো থেকো। রেস্ট ইন পিচ।' 


৪৬.      মেঘের আড়ালে বৃষ্টি 


অনেকদিন আগে এক কর্মহীন আলস্য দিনে সারাদিনই ঘুমিয়ে ছিলাম। মা বোন'রা কেউই তখন থাকত না কাছে। অনেকটা আহ্লাদি বোহেমিয়ান জীবন ছিল আমার। ঘুম ভাঙ্গা অবসাদ নিয়ে বিকালে ঘরের জানালা খুলে দেখি-- আকাশ ভরা মেঘ। এমন মেঘ দেখে খূঁজছিলাম তাই বৃষ্টি।

আর ওদিকে মেঘের আড়াল থেকে বৃষ্টি মনে মনে ভাবছিল--- 'ছেলেটি ঘর হতে বের হোক আগে। তারপর  দেখাব মজা। ঝমঝম করে নেমে  ওকে আজ আমি ইচ্ছে মতো ভিজিয়ে দেবো।'


৪৭.        করবী


'যখন বিদায়-বাঁশির সুরে সুরে
শুকনো পাতা যাবে উড়ে সঙ্গে কে র'বি ।'
'আমি রব, উদাস হব ওগো উদাসী, 
আমি তরুণ করবী ।' 
 করবী ফুল সম্পূর্ণ বিষাক্ত। সুন্দর ফুলের জন্য বাগানে লাগানো হয়। লাল (রক্তকরবী), সাদা(শ্বেতকরবী) আর গোলাপি রঙের ফুল গাছ পাওয়া যায়। গোলাপি রঙের করবী ফুলের ডাবল ফুলের জাত আছে, একে বলে পদ্মকরবী। পদ্মকরবীর পাপড়ি অনেকগুলো, দেখতেও সুন্দর। প্রায় সারা বছরই করবী ফুল ফোটে। গাছের মূল, কান্ড, পাতা, ফুল, ফল- সবই বিষাক্ত।

এই করবী ফুলের কথা লিখতে গিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৮৫ সালে একটি অফিসিয়াল এ্যাসাইনমে্ন্টে তামাবিল/জাফলং গিয়েছিলাম।উঠেছিলাম তামাবিল রেস্টহাউজে।  টিলার উপর নির্জন পরিবেশে বাংলোটির অবস্থান। এই বাংলোর কেয়ার টেকার ছিল আমির আলী। বয়স ৩৫ হবে। সুঠাম দেহ ও সুদর্শন। বিয়ে করে নাই, বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বাংলোর পিছনে একটি ছোটো কাঠের বাড়িতে থাকে। একদিন বিকালে ওর বাড়িটির দিকে যাই। দেখি বাড়ির চারদিকে করবী ফুলের বাগান। ফুল দিয়ে ঢেকে গেছে ছোট্ট কাঠের বাড়িটি। আমি আমির আলীকে জিজ্ঞাসা করি--- তুমি মনে হয় করবী খুব পছন্দ করো। দেখলাম ওর মুখটা বিষাদে ভরে উঠল। একদিন বাংলোয় আমির আলীকে ডেকে জানতে চাই, এই করবী ফুলের রহস্য। ও বলতে চায়নি, তারপরও শুনি আমির আলীর কথা---

মেয়েটির নাম বৈজয়ন্তীমালা। খাসিয়া মেয়ে। পিয়াইন নদীর ওপারে ভারতের অংশে পাহাড়ের ঢালে ওদের বাড়ি। পিয়াইন নদীতে পাথর কুড়াতে গিয়ে ওর সাথে পরিচয় হয়। মেয়েটি আমাকে ভালোবাসতো, আমি ঠিক ততটা নই। পাহাড়ের ঢালে একটা জায়গা ছিল, করবী ফুলের ঝাড়ে ঢাকা। আমরা সেখানে প্রায়ই মিলিত হতাম। একদিন ঐ করবী ফুলের ঝাড়ে বসে বৈজয়ন্তীমালার সাথে কথা হচ্ছিল---

বৈজয়ন্তী:   তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাও। বিয়ে করো।
আমি:  এখন না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু বিয়ে এখন করব না। পরে করব।

বৈজয়ন্তীমালা আমার ছলনাটুকু বুঝতে পেরেছিল। বৈজয়ন্তী বলল--- তাহলে আমি যাই।
যাবার সময় ওর খো্ঁপায় একটি করবী ফুল পরিয়ে দিয়েছিলাম।

সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমা। শুনেছি--- সেই রাতেই ঐ করবীর ঝাড়ে করবী ফুল খেয়ে বৈজয়ন্তীমালা আত্মহত্যা করেছে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট ছিল---
ও নাকি দুই মাসের অন্তঃস্বত্তা ছিল। কিন্তু কেউ জানত না, ঐটি ছিল আমারই দেওয়া একটি পাপের ফসল।

বিশ্বাস করুন,  ওকে আমি সত্যি  ভালোবেসেছিলাম। তাই তো এখনও কাউকে বিয়ে করে ঘরে আনিনি। এই করবী ফুলের মাঝেই ওকে অনুভব করি। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় ওকে পরিচর্যা করি। রোদ্রকরোজ্জ্বল তপ্ত দুপুরে ওকে ছুঁয়ে দেখি।  একাকীর স্তব্ধ রাত্রিপ্রহরে ওর শরীর  থেকে সুবাস নিই।


৪৮.      ফুলের জাদু 


তখন ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ি। আমার বড় দুলাভাই আমাকে একটি পিআইএ-র চমৎকার স্কুল ব্যাগ  গিফট করেছিল। 

ব্যাগটিতে বইখাতা ভরে নিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করতাম । একদিন ক্লাস শেষে আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়িতে আসছিলাম। তখন হেমন্ত সময় ছিল। পথের দুপাশে সরিষা ক্ষেতের বিস্তৃর্ণ প্রান্তর। চারদিকে হলুদ আর হলুদ। আমি হাঁটছিলাম, আর মুঠো মুঠো সরিষার ফুল তুলে ব্যাগের ভিতরে ভরে ফেলছিলাম। এক পর্যায়ে ব্যাগের ভিতরের বইগুলো ফেলে দিয়ে পুরো ব্যাগ ফুল দিয়ে ভরিয়ে ফেলি।

বাড়িতে আসার পর মা আমার বইখাতা বের করে টেবিলে গুছিয়ে রাখবে বলে ব্যাগটি খোলে। ব্যাগ খুলে দেখতে পায়, ব্যাগ ভর্তি শুধু সরিষার ফুল। বইখাতা একটিও নেই। 

মা আমাকে বলেন -- বইখাতা কোথায়? 

কি বলব ?  ভয়ে ভয়ে মাকে বলি --

' জাদু করে বইখাতা গুলো আমি সরিষার ফুল করে ফেলেছি মা, একটু পর ফুলগুলো আবার বইখাতা হয়ে যাবে ।'

আমি তখন বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ি। ক্ষেতের ভিতর ফেলে দিয়ে আসা বইখাতা গুলো কুড়িয়ে আনার জন্য  হলুদ প্রান্তরের দিকে দৌড়াতে থাকি, দৌড়াতে থাকি....দৌড়াতে থাকি...


৪৯.        যমুনা পাড়ের মাঝি


জীবনে যশ খ্যাতি কোনোটাই হলো না। তারচেয়ে যদি যমুনা পাড়ের খেয়া নৌকার মাঝি হতাম, অথবা কোনো জেলে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস পাড়ের বাসন্তির মতো কোনো মালো মেয়েকে বিয়ে করতাম অথবা পদ্মাপাড়ের কোন এক মালাকে। সেখানেও কপিলার মতো যৌবনবতী কারো সাথে পরকীয়া করতাম। নিঝুম চরে শেয়াল ডাকা ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে রাত নামত। বয়ে চলা নদীর শোঁ-শোঁ শব্দে হৃদয় কাঁপত। রাতের আকাশে দেখা দিত পূর্ণিমার চাঁদ। নিঝুম রাতে কপিলাকে নিয়ে নদীর তীর ঘেষে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম অনেক দূরে । উদ্দাম জনশূন্য নদীর জলে ডিঙি নৌকায় ভাসতাম দু'জন। রাতভোর জ্যোৎস্নাা ঝরত সেই কালো নৌকাটির উপর। টুপটাপ ঝিরিঝিরি....


৫০.        কাগজের নৌকা


অনেক দিন আগের কথা। একদিন দোকান থেকে সাতরঙ্গের সাতটি রঙ্গিন কাগজ কিনে নিয়ে আসি।ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে কাগজগুলো দিয়ে সাতটি নৌকা তৈরি করি। তারুন্যের  এক উদ্দাম সময়ে একটি মেয়েকে আমি সাত নামে ডাকতাম, কিন্তু একসময়ে সে নামগুলোতে ডাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় । একটি রঙ্গিন কলম দিয়ে নৌকাগুলোতে সেই মেয়ের সাতটি নাম লিখি।

সেদিন ছিল বর্ষার এক বিকেল। আকাশে মেঘ ছিল। কোথাও রোদ নেই। আবার বৃষ্টিও নেই। একটি ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগে করে নৌকাগুলো নিয়ে চলে যাই বালুর নদীর তীরে।  একটি নি্র্জন নদীর কূল বেছে নেই। সেখানে বসে এক সলা স্টার সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকি।  তখন মনে পড়ছিল কি আমার কারও কোনো মুখের কথা ?

নদীতে সেদিন স্রোত ছিল। দমকা বাতাসও বইছিল। আমি একে একে নাম লেখা কাগজের সেই নৌকাগুলো বালুর নদীর জলে ভাসিয়ে দেই। দেখলাম --- প্রবল স্রোতের টানে আর দমকা হাওয়ায় নৌকাগুলো ভেসে ভেসে অনেক দূর চলে যাচ্ছে।


৫১.       রঙ্গনার কথা


আমি কী আমার সারা জীবনে রঙ্গনাকে ত্যাগ করতে পারব? তুমি যদি একা মনে কর নিজকে, কিছুদূর তোমার সঙ্গী হতে পারি। পথ চলতে চলতে পথ ঠিকই ফুরাবে একদিন। তোমার পথ চলা শেষ হলে এবং তোমার সুদিনের শুরুতে আমি তোমাকে ত্যাগ করব। আমাকে জড়িয়ে ফেলো না। আমি তোমার কেউ নই। যেমন তুমি আমার কেউ নও। আমি কেবল অলক্ষ্যে রঙ্গনাকে ভালোবেসে প়ৃথিবীর পথে পথে হাঁটছি। 

এ জীবনে তোমার সঙ্গে প্রেম হল না বলে রাগ কোরো না। তুমি একবার শুধু চোখ মেলে দেখ, পৃথিবীও তোমার মতো একা নয়, সেও পথ পরিক্রমণ করছে চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা নিয়ে। তুমিও ওদের মতো সত্য হয়ে গথ চলো।


৫২.       এক সন্ধ্যার কথা


কিছু কেনাকাটার জন্য গিয়েছিলাম উত্তরার রাজলক্ষী কমপ্লেক্সে। মার্কেটের বারান্দায় হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যায় আমার স্কুল জীবনের সহপাঠি মোজাম্মেল হকের সাথে। প্রায় আঠারো বছর পরে ওর সাথে আমার দেখা। মোজাম্মেলই আমাকে প্রথম চিনে ফেলে এবং আচমকা আমার দুহাত চেপে ধরে বলে : আরে, হাবিব!  তুই কেমন আছিস?

আমি প্রথমে একটু থমকে গিয়েছিলাম, তার পরক্ষণেই ওকে চিনে ফেলে বলি :  তুই মোজাম্মেল না? কেমন আছিস তুই?

ও কেমন আছে, আমার এই কথার জবাব না দিয়ে মোজাম্মেল বলছিল :  কত বছর পর তোর সাথে আমার দেখা হলো।  তোকে দেখে আমার কী যে ভাল লাগছে! 
আমি বলি :  'তুই না অনেক ফর্সা ছিলি, তা এমন কালচে হয়ে গেছিস কেন? কী, কোনও দুঃখে টুঃখে নেই তো? '

মোজাম্মেলের মুখটি মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়। কেমন যেন  কাঁপা গলায় বলে : আমার কিডনি ফেউলিওর। একটি পুরোপুরি । আরেকটি অাংশিক। দোয়া করিস আমার জন্য। '

আমি কিছু মুহূর্ত নির্বাক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার পরমুহূর্তেই অসীম এক মায়ায় ওর ঘারের উপর দুটো হাত রেখে বলি :  'এত বছর পর তোর সাথে আমার দেখা হলো। আর তুই কিনা আমাকে এত বড় দুঃখের কথা শোনালি।'

আমি আরও বললাম --- তা কী চিকিৎসা করছিস?

-- দেশের বাড়িতে থাকি। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসি ডায়ালাইসিস নিতে। পথে খুব কষ্ট হয়। সামনে হয়ত আর আসা সম্ভব হবে না। ভাবছি, ওখানে সদর হাসপাতালে যে চিকিৎসা আছে, সেইটাই নেব। '
-- এখানে কোথায় উঠেছিস?
-- আজমপুর কাঁচা বাজারে আমার এক ভায়রার বাসায়। কাল প্রত্যুষেই আমি সিরাজগঞ্জ চলে যাব। '

আমি ওকে বললাম -- 'এর পরে যখন ঢাকায় আসবি, তুই আমার বাসায় উঠবি।'
মোজাম্মেল মাথা নেড়ে সম্মতি দিল -- ' যদি আসি, উঠব তোর ওখানে। '
আমি ওকে বলি -- চল, হিমালয় রেস্টুরেন্টে বসে দুজন কিছু খেয়ে নেই ।
--  না। তারচেয়ে চল্,  পিছনে টং দোকানে বসে দুজন চা খাই আর গল্প করি।

চা খেতে খেতে বলি : তোর ছেলে মেয়ে কী?
--- একটি মাত্র মেয়ে। বয়স : ছয় বছর।

-- তোর কী মনে আছে, একবার তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তোর ছয় বছরের একটি ছোট বোন ছিল মর্জিনা। হঠাৎ ও এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে কোলে বসে পড়েছিল! ও নিশ্চয়ই এখন বড়  হয়ে গেছে?
-- হ্যাঁ, সব মনে আছে। ওর বিয়ে হয়ে গেছে।
-- তোর মেয়ের নাম কী?
-- মরিয়ম।

চা খাওয়ার পর আমার খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছিল। মোজাম্মেলকে বলি:  তুই তো এখন আর সিগারেট খাসনে। ডাক্তারের নিশ্চয়ই মানা আছে। ' 
-- না খাইনা। তোর কী মনে আছে? স্কুলে টিফিনের সময় পুরনো রথ ঘরে বসে এক সলা তিস্তা সিগারেট আমরা চারজন খেতাম। তুই আমি সাইফুল আর আমিনুল।
-- মনে আছে। তার আগে আমরা চার আনা দিয়ে বাদাম কিনে খেতাম। 
-- ডাক্তারের নিষেধ আছে সিগারেট না খাওয়ার। তবে আজ একটি সিগারেট খাব তোর সাথে। আমার খুব ইচ্ছা করছে তোর সাথে সিগারেট খেতে। তুই আমাকে মানা করিসনে। '

আমি এক স্টিক বেনসন এ্যান্ড হেজেস সিগারেট ধরিয়ে ওকে দেই। আরেকটি স্টিক আমি ধরিয়ে টানতে থাকি।

তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। উত্তরার রাস্তায় লাইট পোস্টের বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। মোজাম্মেল যখন সিগারেট টানছিল , আলো অাঁধারিতে তাকিয়ে দেখছিলাম ওর মুখখানি। ওর মুখে তখন কোনো বিষাদের ছায়া ছিল না। মনে হয়েছিল -- সেই ভাঙা রথ ঘরে বসে থাকা ওর হাস্যজ্জ্বল আনন্দময় মুখখানি আমি দেখছি।


৫৩.

সে এক অন্য গল্প

এখন এমন হয়েছে একলা আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। অথচ এই আমি কুসুমপুরে আমার  বিছানার পাশে জানালা খুলে বাইরের কতো চন্দ্রালোকিত রাত্রি দেখেছি একাকী । ভয়হীন চিত্তে নিশাচরি পাখিদের উড়ে যেতে দেখেছি। নিঝুম রাত্রিরকূলে বসে জোনাকিদের গান শুনেছি। তিমির নিশীথের আঁধার দেখতে দেখতে কতো রাত্রি শেষ করেছি। কী যে এক পাগল ইচ্ছা পূরণ করেছি তখন, মনে হতো পৃথিবীর সবাই ঘুমাক। আমি একলা জেগে থাকি।

এই আমি আছি, দেখছি পৃথিবীকে। লিখছি কবিতা, লিখছি জীবনের কথা। গ্লানির কথা। হৃদয় গহীনের ব‍্যর্থ আকুতির কথা। আমি না থাকলে আমার লেখা কে পড়বে? কার এমন দায় হবে এইসব ব‍্যর্থ খন্ডিত জীবন কাহিনী পড়বার? কে  দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করবে আমার কবিতা শুনবার?

একা নয়, তোমাকে নিয়ে কুসুমপুরে চন্দ্রালোকিত রাত্রি দেখতে যাব। তোমার ঘন কালো কেশ মেলে, তার ফাঁক  দিয়ে দেখব ফাগুন রাতের চাঁদ। যদি সালভাদোর দালি হতাম -- তাহলে অন্ধকারের রঙে তোমার অবয়ব এঁকে নিয়ে আসতাম। কী ভীষণ ইচ্ছা হয়, যমুনার কূলে কূলে হাঁটতে দুজনে। দূরের চরাচর থেকে রাতের বাতাসে ভেসে আসবে শুকিয়ে যাওয়া কাশফুলের গন্ধ। 

আমরা যেন --

'অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে,
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।'

জীবনের সবকিছু কী আক্ষেপ? সবকিছু কী বিস্মৃতির ধুলিতে ঢেকে থাকবে? এই আমি কবে কখন তোমাকে যুক্ত করেছিলাম। তুমিও জানো, আমিও জানি আমাদের দুজনের একজন হয়ে ওঠার কথা। এই মহাবিশ্বের সকল সঙ্গ-অনুসঙ্গের সঙ্গী হয়েছিলান কখন? তাও আমরা জানি।

যা কিছু জানি, শুধু জানি -- কুসুমপুরের সেই সব রাত্রির কথা। একা আমি নয়, তুমিও আমার সাথে যাবে। কতো রাত জেগে কতো অলক্ত ঝালর শব্দে লিখেছি কতো কবিতা। তিমির ঘন রাত্রি বেলায় তুমি শুনবে কবিতা। আর আমিও শুনব পূর্ণিমা জোৎস্নামিশ্রিত তোমার হৃদয়ের কথা।

'আমি কান পেতে রই  ও আমার   আপন হৃদয়গহন-দ্বারে   বারে বারে
কোন্‌   গোপনবাসীর কান্নাহাসির   গোপন কথা শুনিবারে--   বারে বারে।'