সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

কঙ্কনা দাসী

হাজার বছর আগের কথা। কেমন ছিলো তখন নবদ্বীপ? ভাগিরথী ও জলাঙ্গী নদীর সঙ্গমস্থল তখনো কি প্লাবনে ভরে থাকতো? এখনকার এই নীল আকাশ, এখনকার বাতাসের এই ঝিরি ঝিরি দোলা তখনও কি বইতো সেখানে ? খুব মন চায়, ভাগিরথী তীরে যেতে। দেখতে ইচ্ছা হয়, কোথায় আমার সেই পূর্ব পুরুষদের রাজধানী নবদ্বীপ।

কৃষ্ণনগর। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কৃষ্ণনগর।গোপাল ভাঁড়ের কৃষ্ণনগর। মাটির পুতুলের কৃষ্ণনগর।সরপুরিয়া-সরভাজার কৃষ্ণনগর । বাংলার ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা কৃষ্ণনগর । হ্যাঁ, আমি নদিয়ার কথা বলছি। নবদ্বীপের কথা বলছি। হাজার বছর আগে আমার পূর্ব পুরুষদের রাজধানীর কথা বলছি।

এক রবিবারের সকালে 'কৃষ্ণনগর সিটি জংশন' লোকাল ট্রেন ধরে গিয়েছিলাম কৃষ্ণনগরে। সারাদিনে শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার অনেকগুলো ট্রেন চলে । সপ্তাহের অন্যদিনে এই ট্রেনগুলো গ্যালপিং হলেও রবিবার সব স্টেশনে থামে। প্রায় তিন ঘন্টা লেগে যায় কৃষ্ণনগর পৌঁছতে। ওখানে পৌঁছে শহরের জগজিৎ হোটেলে আমি উঠি।

বিকেলে রিক্সা করে প্রথমে যাই রাজবাড়ি। নদীয়া অধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বিখ্যাত রাজপ্রাসাদ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিরাট বড় রাজবাড়ি, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দেয় না । বাইরে থেকে ভেতরটা যতদূর দেখা যায় দেখলাম। কিন্তু আমার কৃষ্ণনগরে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য বাংলার সেন বংশের রাজাদের লুপ্ত প্রায় রাজ প্রাসাদের ধংসাবশেষ দেখা।

নদিয়া জেলায় বর্তমান নবদ্বীপের প্রায় তিনক্রোশ উত্তর পূৰ্বদিকে বল্লালদীঘি নামক গ্রাম আছে । সেখানে অতি উচ্চ এক ভূমিখণ্ড আছে । তাঙ্গকে লোকে “বল্লাল টিবি" বলে থাকে । শোনা যায় সেখানে বল্লাল সেনের রাজ প্রাসাদ ছিল । আমি একটি টাঙার মতো ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করি। ইতিহাসের এক পোড়া মাটির ধূলো পথ ধরে  আমার টাঙা গাড়িটি চলতে থাকে ভাগিরথীর তীর ধরে বল্লাল সেনের সেই ধ্বংস প্রায় রাজ প্রাসাদের দিকে।

আমার টাঙা গাড়ির কোচোয়ান ছিলো পৌঢ় বয়সের একটি লোক, নাম বিষ্ণুপদ ঘোষ। সে বহু বছর ধরে এই পরগনায় টাঙা গাড়ি চালায়। তার যাত্রী বেশির ভাগ বাইরে থেকে আসা পর্যটক। সে অনেকটা গাইডের মতোও কাজ করে । পথ চলতে চলতে আমি ওনার কাছ থেকে অনেক কিছুই জেনে নেই। সবকিছু শুনে একটু ভয়ও পাচ্ছিলাম। একা একা যাচ্ছি অপরিচিত নির্জন এক ভগ্ন প্রাসাদের দিকে।

সেই নির্জন দুপুরে আমি এখন আমাদের পূর্ব পুরুষদের রাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদের সামনে। এক সময়ের সেই জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদটি ভাঙ্গা পোড়া ইট আর মাটির স্তুপ হয়ে আছে। ইটের ভিতর থেকে গাছ গাছালী বেড়ে উঠেছে, কতো গাছে পরগাছা হয়ে আছে। আমার চোখের সামনে দেখলাম একটি বিষধর গোক্ষুর সাপ গর্তে যেয়ে লুকালো। প্রাসাদের কাছেই দেখি একটি শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটের পাশেই আর একটি জরাজীর্ণ প্রাসাদ। বিষ্ণুপদ বলছিলো ওটা ছিলো একটি প্রমোদশালা। আমি ঘাট আর ঐ জীর্ণ প্রমোদ ঘরের দিকে এগুতে থাকি। তখন ছিলো তপ্ত দুপুর সময়। অদূরে ভাগিরথী নদী। ওখানকার শীতল হাওয়া এসে তপ্ত দুপুরের উষ্ণতাকে শীতল করে তুলেছিলো।

কি এক অদ্ভুত টানে আমি এগুতে থাকি সেই ঘাটের দিকে, সেই ভগ্ন প্রমোদশালার দিকে। বিষ্ণুপদ ঘোষ আমাকে বাঁধা দিচ্ছিলো, কিন্তু আমার চোখে তখন একাদশ শতকের এক স্বপ্নের ঘোর। মনে হলো যেনো হাজার বছর আগে আমার পূর্ব পুরুষদেরই কেউ আমি। ঠিক আবার তাও নয় - আমি যেনো এই রাজ্যের এক রাজকুমার।

ফ্লাসব্যাক ---

আমি নাকি আমার পিতামহ বিজয় সেনের মতো দেখতে। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো কালো চুল। বাউলের মতো লম্বা হয়ে তা পিছনে ঘাড় পর্যন্ত নেমে গেছে। চোখ নীল পাথরের মতো জ্বলজ্বল করে। প্রশস্ত বুকের খাঁজে নাগ কেশরের গন্ধ ছড়ায়। ধবল সাদা বাহুদ্বয় বাজ পাখির পালকে উড়ে। লম্বা লম্বা পা ফেলে আমি যখন পাসাদ প্রাঙ্গণে হাটতে থাকি, তখন সব রমণীকুল, দাসী, নর্তকীরা  আমাকে কুর্নিশ করে। তাদের হৃদয় আত্মা কেঁপে উঠতো আমাকে পাওয়ার আকুলতায়। শুধু একজনের হৃদয় আত্মা কেঁপে উঠতো না, নাম তার কঙ্কনা দাসী।

রাজ প্রাসাদের খাস দাসী রত্নাবতীকে নিয়ে এসেছিলো আমার মাতা রামদেবী। আমার মা পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের রাজকুমারী ছিলেন। এই রত্নাবতী ছিলো আমার মাতার পরিচারিকা । বিবাহের পরেও আমার মা রত্নাবতীকে নবদ্বীপের এই প্রাসাদে নিয়ে আসে। কারণ সে ছিলো আমার মায়ের বিশ্বস্ত দাসী। আর এই রত্নাবতীর গর্ভের মেয়েই হচ্ছে কঙ্কনা দাসী।

কঙ্কনা ছিলো আমার খেলার সাথী। দিনের পর দিন সে বেড়ে ওঠে আমার চোখের সামনে। কঙ্কনা যেনো বাগানের অপ্রয়োজনীয় ফুল নয়। সে প্রস্ফুটিত হতে থাকে গোলাপের সৌরভ নিয়ে। তার উন্মেলিত চোখে আমার স্বপ্ন দেখতাম। চুল থেকে গুন্জ ফুলের সুবাস পেতাম। কাঁচা হলুদের গায়ের রঙে আবিরের দরকার হতোনা। বুকে তার কালান্তরের কুন্দন, বক্র শরীরে হাটতো প্রাসাদময় সর্পিনী্র মতো। নিকষিত হেমের ছোবলটি এসে পড়তো যেনো আমার বুকে। কণ্ঠতল থেকে বুক হয়ে নাভিমূলে তার উত্তাল ভাগিরথীর বাঁক। তার সেই প্রমত্ত শরীরের বাঁকে বাঁকে আমি আমার দৃষ্টি হারাতাম।

সেদিন ছিলো হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। বিকাল থেকেই মনটা উদাসী হয়ে উঠেছিল। প্রগাঢ় এক আকাঙ্ক্ষা মন প্রাণ জুড়ে, আজকের এই চাঁদের সন্ধ্যায় কঙ্কনাকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ভাগিরথীর তীর ধরে বেড়াতে নিয়ে যেতে মন চায়।  বনারন্যের সবুজে সবুজে, পাতায় পাতায় ঢলে পড়ছিলো জ্যোৎস্নার প্লাবন। কঙ্কনা একজন দাসী হলেও তার অহংকার ছিলো রাজকুমারীর মতো। তন্বী এই তরুণী আমার সকল সকল শৌর্য বীর্য কেড়ে নিয়েছিলো। গোপনে গোপনে ইচ্ছা পোষন করে রেখেছিলাম, ওকেই আমি বিয়ে করবো, হোক না সে দাসী।

পাইককে বললাম আস্তাবল থেকে ঘোড়া বের করতে। দাসী মহলে খবর পাঠিয়েছি কঙ্কনাকে অপরূপ সাজে সাজাতে। এই যে এতো আয়োজন, এতো সাজ সাজ রব, সবকিছুই আমার মা রামদেবী আর পিতা বল্লাল সেনের অগোচরে। সেদিনের সেই মনোরম সন্ধ্যা রাতে  দেবদারু গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা দিলো। প্রাসাদের দাসীদের দরজা দিয়ে চন্দ্রালোকে হাটতে হাটতে কঙ্কনা দাসী বের হয়ে আসে। পরনে ছিলো কারুকার্যখচিত চোলি ও ঘাঘরা। চাঁদের আলো পড়ে ওর পোশাকে লাগানো পাথর আর চুমকিগুলি ঝিকমিক করছিলো।

অশ্বের খুরের খটখট শব্দ তুলে ভাগিরথীর তীর ধরে ঘোড়া ছুটতে থাকে বনের দিকে। আমার হাতে সোয়ার। পিছনে কঙ্কনা দাসী। চাঁদের আলো বাঁধ ভেঙে পড়েছে আরো আগেই। উতলা কুন্তলা হয়ে কেঁপে ওঠে ভরা পুর্ণিমার চাঁদ। একি পাগল কাড়া এই ক্ষণ! বুঁনো জ্যোৎস্নায় বনের মরা পাতার সব মর্মরধবনি একসময় থেমে যেতে থাকে । যেনো সব গান আর সব সুর বনের গভীরে হারিয়ে যায়। এতো আলো আর এতো জ্যোৎস্না সব আধারে ভেসে যায়।

আমরা যখন রাজ প্রাসাদে ফিরে আসি তখন চাঁদ মধ্য গগনে মেঘের নীচে নিস্তব্ধ হয়ে ডুবে গেছে। কঙ্কনা দাসী চলে যায় দাসী মহলে তার মায়ের কাছে। সেদিন সকাল বেলা পুকুরের জলে কঙ্কনা দাসীর মা রত্নাবতীর মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায়।

তারপর --

বিষ্ণুপদ ঘোষের টাঙা গাড়িতে আমি বসে আছি। লাল পোড়া মাটির ধুলো উড়তে উড়তে ঘোড়ার গাড়িটি ছুটে চলতে থাকে কৃষ্ণনগরের দিকে। তখন বিকাল হয়ে গেছে। আমি বিষ্ণুপদ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম - কঙ্কনা দাসীর পরে কি হয়েছিলো? পথে আসতে আসতে বিষ্ণুপদ বলছিলো, ঠিক পরের রাত্রিতেই কঙ্কনা দাসীও একই পুকুরের জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলো। সত্য মিথ্যা জানিনা -- জনশ্রুতি আছে যে, রাজকুমারের পিতার ঔরসে রত্নাবতীর গর্ভে কঙ্কনার জন্ম হয়। এই কথাটি রত্নাবতী যে রাতে আত্মহত্যা করেছিলো, সেই রাতেই কঙ্কনাকে সে বলে গিয়েছিলো।
এখনো নাকি হেমন্তের পুর্ণিমা রাতে ভাগিরথী তীরের জীর্ণ এই প্রাসাদ থেকে মা মেয়ের দু 'জনেরই কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে।

-------------------------------------------------------------------
ডিসক্লেইমার : এই কাহিনীর তথ্যগুলো বিষ্ণুপদ ঘোষের দেওয়া। আমার কাছে মনে হয়েছে এইসবই ছিলো তার কল্প কাহিনী। সেন রাজাদের কারও সাথে এর কোনো মিল নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন