মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০২০

পরিচ্ছেদ ৪

রিকশায় উঠে রোহিত আবেগ আপ্লূত হয়ে  ভাবছিল -- সে আবার তার শৈশবের স্বপ্নলোক হরিনা গোপাল গ্রামে ফিরে যেতে পারছে। তার এই গ্রামকে সে মুছে ফেলতে পারেনি জীবন স্মৃতি থেকে।  সেখানকার পথের উপর ফেলে রাখা তার পায়ের চিহ্নগুলো এত বছরে হয়ত মিলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছায়াময় মায়াময় তার সেই গ্রামটি এখনও স্পষ্ট সুখ স্মৃতি হয়ে তার জীবন জুড়ে আছে। 

কার্তিক মাসের শেষ।  পথের দু ধারে মাঠের ভিতর  হলুদ সরিষা ফুলের অপার সৌন্দর্য থই থই করছে। কাসুন্দা, ধুতুরা, কুচকাঁটা, বিকাশ লতা, ঝুমকো লতার দল  জঙ্গলের মতো হয়ে একে অপরের সাথে নিবিড় হয়ে জড়িয়ে আছে। বিকালের হেমন্ত রৌদ্রের সাথে আকন্দ ফুলের গন্ধ যেন মিশে আছে চরাচরে— সেই সব কমনীয় রূপ আগেও ছিল, এখনও আছে। সে এই অপরূপ রূপের  মধ্যে দিয়ে চলেছে বাড়ির দিকে। 

যে রাস্তা  দিয়ে সে রিকশা করে আসছিল সেই রাস্তাটি ছিল একসময় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে।  আঁকাবাঁকা ধূলির পথ ছিল। মানুষ হেঁটে চলত আর চলত গরুর গাড়িতে। এখন এই রাস্তাটি পিচঢালা হয়েছে। চলতে চলতে পথে সে খুঁজছিল ইছামতী নদী। খুঁজছিল শৈলাভিটা খেয়াঘাট। যে ঘাটে প্রতিদিন শত শত মানুষ খেয়া নৌকায়  পারাপার হতো।   

খেয়াঘাটের এই নদীতে একসময় অনেক জল থাকত। প্রায়ই ঘ গানের আসর বসত নদীর কুলে। গান শুনতে শুনতে কত খেয়া যে মিস করত পারাপার হওয়া মানুষ। এখন এখানে খেয়া ঘাট নেই।  এখানে এখন কংক্রীটের বিশাল ব্রীজ। 
নীচে ধূঁ-ধূ বালুচর। নদীতে এই সময় জল থাকে না। বোষ্টমীদের গানও আর শোনা যায় না।

ছেলেবেলায় একবার বাবার সাথে শহরে আসছিলাম। খেয়া ঘাটে নৌকা আসতে তখনো দেরি। এপাড়ে নদীর কূলে তখন বৌষ্টমীদের গান হচ্ছিল। বৌষ্টমের হাতে ছিল খঞ্জরী, আর বৌষ্টমী গেয়ে যাচ্ছিল গান। দু'জনেরই পরনে ছিল গেরুয়া রঙ্গের ধূতি। বাবার হাত ধরে আমি নিমগ্ন হয়ে গান  শুনছিলাম। ভীড়ের ওপাশে চেয়ে দেখি -- আমাদের গাঁয়ের  লীলাবতী গান শুনছে ওর বাবার হাত ধরে। ওর পরনে ছিল ঝালরওয়ালা লাল নীল ফ্রক।

বৌস্টুমী যে গানটা গাচ্ছিল ---
'ও তোরা মন দিয়ে শোন্-
সে যে ছিল আমার মনেরই মতোন........।'

গান শুনতে না শুনতেই খেয়া নৌকা এসে যায় ঘাটে। আমি বাবার হাত ধরে যেয়ে নৌকায় উঠি। বৌষ্টমী তখনো গেয়ে যাচ্ছিল গান। লীলাবতী ওর বাবার হাত ধরে শুনছিল সেই গান। নৌকায় বসে ওকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাাম। কিন্তু লীলাবতী আমার দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি।    

ক্রমেই বেলা পড়ে আসছিল। রিকশাটা এক সময় ঘোড়াচরা গ্রাম পার হয়ে হরিপুর গ্রামের ভিতর  দিয়ে চলতে থাকে। এখানেও রাস্তার দুপাশে ফসলের মাঠ। দূরে ধনিদহ বিল। ঐ বিলের আরেক নাম পদ্মবিল। শত শত লাল আর গোলাপি রঙের পদ্মফুল ফুটে থাকত জলের উপর। এই রকম অপূর্ব শোভামন্ডিত জলাভূমি, স্বপ্নমাখা ফসলের মাঠ -- পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই সে দেখতে পায়নি। অতসীর ঝাড়, আমলকীর বন, আম গাছের কচি পাতার মিহি গন্ধ, অপূর্ব সুন্দর ঘোর লাগা সন্ধ্যা-পূর্ব বিকাল রোহিতের মনকে উদ্ভাসিত করে তুলছিল।   

এরপরই আর একটি মাঠ পেরিয়ে রিকশাটি ধলডোব গ্রামের ঠাকুর পুকুর পাড়ের কাছে যেয়ে থামে। এটি ছিল ধলডোব গ্রামের শেষ সীমানা। তারপর কিছুদুর আলপথ দিয়ে হেঁটে গেলেই হরিনা গোপাল গ্রাম।  রোহিত এই ঠাকুর পুকুর পাড়েই রিকশা থেকে নেমে পড়ে।  সন্ধ্যার ছায়াতল দিয়ে, মাঠের ভিতর দিয়ে, মেঠো পথের বাঁক পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে সে হরিনা গোপাল গ্রামে ওদের বাড়ির দিকে যেতে থাকে। 

সে সময় সাঁজের পাখিরা পুকুরের ওপারের ঝোপের মাথায় কিচ কিচ করে ডাকছিল, পথের দুপাশে গুচ্ছ গুচ্ছ দূর্বাদল সারাদিনের রোদ্র তাপে মুড়ে পড়েছে। ডোবার ধারে ঘেঁটু ফুলের সাদা পাঁপড়ি থেকে বুঁনো গন্ধ আসছিল। সন্ধ্যার আলোছায়ায় কেউ কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছিল। ওরা হয়ত ভাবছিল -- এ কোন্ অপরিচিত আগন্তুক কোথা থেকে এই গ্রামে এল। কিন্তু কেউই এগিয়ে এসে অচেনা এই মানুষটির সাথে কোনো কথাই বলল না। 

মানুষ যখন সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায় নিজ ঘরে। ঠিক সেই সময় রোহিত ওদের বাড়ির আঙিনায় এসে পা ফেলে। বাড়িটি দেখে বুকের ভিতর তার হুহু করে উঠে। মনের ভিতর এই রকম প্রতীতী জাগল --'যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়, কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, আহা, ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের, শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়-- '

এই বাড়ির কেউ কী মনে রেখেছে তাকে? চিনতে পারবে কী এক সময়ের একুশ বাইশ বছরের উচ্ছল সেই তরুণকে। যে এখন পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন  বছরের এই প্রবীন। ন্যুব্জ হয়ে গেছে যৌবন। যে ছেলেটা অপরিপক্ক ও অবাঞ্চিত এক অভিমান নিয়ে কোনো এক আঁধার রাত্রিতে গৃহ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল।    

বিদেশে থাকাকালীন সময়েই জেনেছিল সে তার সব হারানোর কথা। ১৯৭১ সালে বাগবাটী-ধলডোব-হরিনা গোপাল  গ্রামে ম্যাসাখার করেছিল পাক সেনারা। ২৭ শে মে ভোরে, একটি যৌথ অভিযানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর রাজাকাররা উল্লেখিত  গ্রামগুলি  ঘিরে ফেলে। তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত লোককে হত্যা করে, এর ভিতর বেশিরভাগ ছিল হিন্দু। তারা অসংখ্য আবাসস্থল লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়।পাক আর্মিরা মেয়েদের ধর্ষণ করে। গণহত্যার পরের দিন, বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা বাগবাটি ও ধলডোবের পূর্ববর্তী জমিদারদের নির্জন বাড়ির কূপে মৃতদেহ গুলি ফেলে দিয়ে মাটি চাপা  দিয়েছিল।

এই নির্মম গণহত্যায় প্রাণ গিয়েছিল রোহিতদের পরিবারের সব সদস্যদের।  সেদিন সে হারিয়েছিল তার বৃদ্ধ বাবাকে, অসুস্থ মাকে, বড় ভাইকে। ধর্ষিত হয়েছিল বৌদিদি ও ছোট বোন রোহিনী।  ধর্ষণের পর পাকসেনারা তাদের দুজনকেও হত্যা করে ফেলে রেখে গিয়েছিল ।                     

সেই নির্জন ঘোর সন্ধ্যাবেলায় রোহিত মৃদু পায়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। দেখে -- ভিতরের আঙিনায় কেউ নাই।  ইঁদারা পাড় ঘন ঘাসে জঙ্গল হয়ে আছে। মনে হলো কতকাল ধরে এই ইঁদারা থেকে কেউ জল তোলে না। রান্না ঘরের কোণায় একটি বড়ো পিয়ারা গাছ ছিল, সেই গাছটিও নেই। রান্না ঘরের চালের মাটির টালিগুলো ভেঙেচুরে গেছে। বোঝা গেল, এই রান্না ঘরে দীর্ঘদিন ধরে কেউ রান্না করে না।           

রোহিত তাদের পশ্চিম দুয়ারি বড়ো ঘরটির দিকে এগিয়ে যায়। দেখে ঘরের দরজা খোলা। ভিতরে একটি অল্প পাওয়ারের  বাল্ব  জ্বলছে। মনে হলো  সন্ধ্যা আলোটা কেউ এখনই জ্বালিয়ে রেখেছে ৷ প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সী একজন  মহিলা ধীর পায়ে  দরজার কাছে চলে আসে। একজন অপরিচিত লোককে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে চমকে ওঠে।  আগন্তুক লোকটিকে সে জিজ্ঞাসা করে -- 'আপনি কে গো, কাকে চাচ্ছেন?'  


রোহিত বলে -- আমি রোহিত কুমার সেন। বাবা স্বর্গীয় অসিত কুমার সেন। আমি এই বাড়িরই লোক।  

মহিলা বিস্ময়ে রোহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর স্মিত হাস্যে বলে -- 'ও মা! তুমি রোহিত দা!  এত বছর পর তুমি এলে! আমাকে তুমি চিনতে পারছ না?  আমি ছায়া রাণী। তোমার খুরততো বোন'। 

-- হ্যাঁ, তোকে আমি চিনতে পারছি। তুই তো একেবারে বুড়ী হয়ে গেছিস।  তোকে চিনব কী করে? আয় তো এই দিকে-- তোর কপালখানি দেখি। মনে আছে তোর?  আমগাছে ইটের টুকরো দিয়ে আম পাড়ার জন্য ঢিল দিয়েছিলাম,  সেই ঢিলটি এসে পড়েছিল তোর কপালে। তোর কপাল জখম হয়ে রক্ত ঝরে পড়েছিল।                                                                               

ছায়া রাণীর কপালে সেই দাগটি রোহিত আজও দেখতে পেল। কী এক অপার বিস্ময়েে তাকিয়ে দেখছিল দুজন দুজনকে। সেই কতকাল পরে রক্তের সম্পর্কের একজন মানুষকে তৃষা মিটিয়ে পরম স্নেহ দৃষ্টি দিয়ে রোহিত দেখতে থাকে।  রোহিতের হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে ছায়া রাণী বলে, দাদা, তুমি ঘরে চলো, বসো,  বিশ্রাম নাও ।      

রোহিত ছায়া রাণীকে বলে -- জামাই বাবু কই?

--- বাজারে গেছে , দোকানে । একটু পরই চলে আসবে।    

---  তোর  ছেলে মেয়ে কী? 

--- একটা মেয়ে ও একটি ছেলে। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি দাদা। গারোদহ গ্রামে শশুর বাড়িতে থাকে। আর ছেলেটা কলেজে পড়ে, আই এ সেকেন্ড ইয়ারে।         

রোহিত যে খাটের উপর বসে কথা বলছিল, সেই খাটটিতে ওর বাবা মা শুইত। সিয়রের কাঠের উপর ময়ুরপঙ্খী ডিজাইন করা। ওয়াল ঘেষে একটি পুরানো কাঠের আলমারি। সেটিও ওর বাবা সখ করে মিস্ত্রি বাড়িতে এনে বানিয়েছিল। এখনও আলমারিটা সেই রূপই আছে। ঘরের এক কোণে ঠাকুরের ছোট্ট মূর্তি রাখার জায়গাটা শুচি পবিত্র করে রেখেছে ছায়া রাণী। ধূপধূনো ও প্রদীপ  জ্বালিয়ে রেখেছিল সন্ধ্যায়। সে ধূপ দীপ এখনও জ্বলছে।                                

ঘরের দেয়ালের পলেস্তারা গুলো খসে  পড়ে গেছে। ছাদের পলেস্তারাও খুলে পড়েছে। ইটগুলো পোড়া মাটির মতো লাল হয়ে গেছে। বাইরের দিকে পরগাছা উঠেছে জায়গায় জায়গায়। রোহিত তাদের এই থাকার মেইন ঘরটি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। 

কী উৎসবমুখর ছিল এই বাড়িটা। মা বাবা বড়ো দা ও রোহিনীর কথা খুব মনে পড়ছিল রোহিতের। আজ কেউ নেই তারা। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।  রোহিত ছায়া রাণীকে বলে -- যেদিন মিলিটারীরা এল, তোরা কোথায় ছিলি? 

--- আমি বাড়ির পিছনে জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে ছিলাম। ওরা মাকে কিছু বলে নাই।  কিন্তু বাবাকে গুলি করে মেরে রেখে গেছে। দাদাকেও।  আমাদের বাড়ি ও তোমাদের বাড়ি পাকসেনা ও রাজাকারেরা প্রথম আক্রমণ করে। কেউ পলানোর সুযোগ পায় নাই। তাই ম্যাসাখারটা তোমাদের বাড়ি ও আমাদের বাড়িতে বেশি হয়েছে।                                                

---  বাবা মা বড়োদা ভাই, বৌদিদি ও রোহিনীর লাশ কী দাহ করা হয়েছিল? 

-- না। দাহ করা হয় নাই। বেশির ভাগ লাশ জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত কূপের ভিতর ফেলে দিয়েছিল। জেঠামশায়, জেঠিমা সহ সবার লাশও কূপের ভিতর ফেলে দিয়েছে। ওখানেই অন্ধকার মৃত্তিকা তলে সবাই  মিশে গেছে।  

ইতোমধ্যে বাজার থেকে জামাইবাবু চলে আসে। ছায়া রাণী রোহিতকে ওনার সাথে  পরিচয় করিয়ে দেয়। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে  ছায়ারাণী রোহিতকে বলে -- 'দাদা, তুমি এই ঘরে এই খাটের উপর ঘুমাও। আমরা পাশের ঘরে ঘুমাব।'  এই বলে ওরা দুজন চলে যায় পাশের ঘরে।           

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন