শুক্রবার, ১৯ জুন, ২০২০

উপন্যাস ( প্রথম পরিচ্ছেদ)

১.

এই আখ্যানের ঘটনাকাল  ইং ১৯৬৭ সাল থেকে ইং ২০০২ সাল পর্যন্ত।
    
আখ্যানের মূল চরিত্র শ্রী রোহিত কুমাার সেন প্রায় তেত্রিশ বছর পর নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশে আসছেন। উনি এদেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন অনেক বছর আগে কার্তিকের এক অমানিশা রাত্রির অন্ধকারে । সময়টা ছিল ১৯৬৭ ইং সাল।  

সেদিন সন্ধ্যা রাত্রিতে একটি ছোট্ট বালক একটি চিরকুট এনে রোহিতকে দিয়েছিল। কাঁপা কাঁপা মেয়েলি হাতে সেই চিরকূটে লেখা ছিল -- 
' আমি নজরবন্দী হয়ে আছি। বের হতে পারছি না। তুমি আর একটা মূহুর্ত দেরি না করে এই গ্রাম ছেড়ে আজই  চলে যাও। তোমাকে আজ রাতেই মেরে ফেলবে। ওরা সব পরিকল্পনা সম্পন্ন করে রেখেছে। আমি সব শুনেছি। 
জানিনা এ জীবনে আর কোনোদিন তোমার সাথে আমার দেখা হবে কিনা। যেখানেই যাও যতদূরে যাও,  ভুলবে না আমাকে। এই অভাগীকে তুমি  মনে রেখ।'         

রোহিত হয়ত সাহস করে, জেদ করে গ্রামে থেকে যেতে পারত। কিন্তু থাকেনি। জলের ভিতর কুমিরের সাথে বসবাস বেশি দিন করা যায় না। বিপদ এক সময় না একসময় চলে আসবেই। সেদিন সেই সন্ধ্যা রাত্রিতে কাউকে কিছু না বলে, এমনকি বৃদ্ধ বাবা মা, বড়ো দা এবং ছোট বোন রোহিনীকে কিছু না জানিয়ে  সে গৃহ ত্যাগ করে। এক অনিশ্চিত অজানার উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়ে সে বেরিয়ে পড়ে।  

কার্তিক মাসের অমাবস্যার সেই রাতে রোহিত যখন হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে শ্লথ পায়ে হেঁটে হেঁটে চলে আসছিল, তখন আঁধার ভেদ করে সে পিছনে চেয়ে দেখছিল  তার শৈশবের পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা গ্রামকে। সে দেখতে পায় দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাকুড় , জারুল, দেবদারু ও আমগাছ গুলো। আকাশের দিকে চেয়ে দেখে  
দূরে  বিষণ্ণ হয়ে অনুজ্জ্বল সব তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে।             
                 
রোহিত মেঠো পথ ধরে হেঁটে হেঁটে প্রায় সাত মাইল দূরে বয়রা ঘাটে চলে আসে।  তার পকেটে ছিল তাদের মনোহারি দোকানের সওদা বিক্রি করা একশত আশি টাকা। আর ছোট্ট টিনের স্যুটকেসের ভিতর  ছিল একটি  সার্ট, একটি পায়জামা, দুটি লুঙ্গি, একটি গামছা, একটি চিরুনি, ছোট্ট একটি গোল আয়না ও খুটিনাটি কিছু দ্রব্য।  আর ছিল জরুরি কিছু  কাগজপত্র, খাতা ও একটি কলম।                                                

বয়রা ঘাটে যখন সে পৌঁছে তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে যায়।  পথে হেঁটে আসতে আসতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। খুব খিদাও লেগেছিল তার।  ঘাটে একটি ভাঙা টিনের চালার হোটেলে ঢুকে সে আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে নেয়। 

ওপারে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যাওয়ার জন্য রাতে কোনো  স্টীমার নেই । পরের দিন সকাল সাতটায় স্টীমার আসবে। সে ঘাটে নোঙর করা  ভাসমান প্লাটফর্মের একটি খালি বেঞ্চের উপর যেয়ে বসে পড়ে।  উত্তাল নদীর জল বয়ে চলেছে ছলাৎছলাৎ শব্দ করে। নদীর আকাশ জুড়ে অন্ধকার রাত্রি।  রোহিত তাকিয়ে ছিল জলের দিকে। তার মনে পড়ছিল কত কথা। মনে পড়ছিল বৃদ্ধ বাবার কথা, অসুস্থ মায়ের কথা, দাদা ভাইয়ের কথা, স্নেহময়ী ছোট বোনটার কথা। আর মনে পড়ছিল আর একজনের কথা, যার কারণে তার এই গৃহ ত্যাগ, যার জন্য তার এই দূর্দশা। 

আর কী কখনও দেখা হবে প্রিয় এই মানুষগুলোর সাথে। জানে না সে কোথায় যাচ্ছে, বিদেশ বিভূঁইয়ে কোথায় কোন ছন্নছাড়া ছিন্ন জীবনে এ জীবন কাটবে, তা সে কিছুই জানে না। যে জীবনই পাওয়া হোক, তাও একদিন শেষ হয়ে যাবে। কেউ জানবে না সে কেমন আছে, কোথায় আছে।     

' অনন্ত অজানা দেশ , নিতান্ত যে একা তুমি , পথ কোথা পাবে ! হায় , কোথা যাবে ! কঠিন বিপুল এ জগৎ , খুঁজে নেয় যে যাহার পথ। স্নেহের পুতলি তুমি সহসা অসীমে গিয়ে কার মুখে চাবে । হায় , কোথা যাবে !....
যাবে যদি , যাও যাও , অশ্রু তব মুছে যাও , এইখানে দুঃখ রেখে যাও।'
 
                                                     
রোহিত বাগবাটি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞানে ম্যাট্রিক পাশ করে টাংগাইলের করটিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে গ্রামে ফিরে এসেছিল । সে কোনো একটি স্কুলে অংকের শিক্ষকের চাকুরি করবে এই তার ইচ্ছা ছিল।     

একদিন গুরিগুরি বৃষ্টির দিনে তাদেরই গ্রামের    হাসান আলী মাস্টার ছাতা মাথায় দিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। পথে দেখা হয় রোহিতের সাথে। রোহিত আসছিল কুড়াগাছা হাটখোলা থেকে। রোহিত হাসান আলী মাস্টারের ছাত্র ছিল।  হাসান আলী জানত রোহিত খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। এবং সে ছিল সরল, অমায়িক ও ভদ্র একটি ছেলে । 
  
পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে  হাসান আলী মাস্টার রোহিতকে বলে -- ' তুমি কী মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে আমাদের রেবেকাকে একটু অংক দেখিয়ে দিয়ে যেতে পারবে?  এজন্য তুমি অবশ্য  মাহিনা পাবে। তুমি হয়ত জানো -- রেবেকা এখন  নবম ক্লাসে পড়ে।                                           
রোহিত হাসান আলী মাস্টারের প্রস্তাব ফেলতে পারেনি। সে বলেছিল -- আচ্ছা, আসব ওকে পড়াতে।       

রোহিত বেশির ভাগ সময় বিকালবেলা রেবেকাকে পড়াতে আসত।  বাড়ির খোলা বারান্দায় এক কোণে চেয়ার টেবিল পাতা থাকত।  সেই টেবিলে বসে মোটামুটি সবার নজরের সামনে রোহিত প্রতিদিনের অংকগুলো রেবেকাকে করিয়ে এবং বুঝিয়ে দিয়ে যেত।             
          
রোহিতের কাছে রেবেকা প্রাইভেট পড়ে ভালোই রেজাল্ট করছিল। আগে ক্লাসে অংক ও এ্যালজাবরা সলভ্ করতে পারত না। এখন পারে।  এখন সবার আগে অংক করে ক্লাসে স্যারের কাছে জমা দিতে পারে। হাসান মাস্টারও খুব খুশি। রেবেকাকে পড়ানোর জন্য রোহিত মাসে দশ  টাকা করে পায়।
                                     
রেবেকা চৌদ্দ পনরো বছরের উদ্ভাসিত তন্বী  তরুণী। গায়ের রঙ গৌরীয়, এবং কালো কেশী। টানা ডাগর চোখের মণিদুটো ছিল সন্ধ্যাতারার মতো সমুজ্জ্বল। অপরূপা সে। বিশ্ব বিধাতা শিল্পীর মতো করে কত সৌন্দর্য, কত সুধা, কত মমতা দিয়েই না এই নারীদেহ তৈরি করেন! রেবেকা এমনই একটি নারী শিল্প কর্ম।    

মানুষের রূপ, প্রেম, জৈবিক চাহিদা, শরীর সৌন্দর্যের মুগ্ধতা কোনো স্থান কাল মানে না। রেবেকা নেহায়াতই একজন পল্লীবালা, কিন্তু তার চাওয়া পাওয়া ছিল পার্থিব জগতের অন্যান্য রমণীদের মতোই।  সেও কিছু চাইতে পারে তার মতো করে। যা অন্যরা চায়।  আবার অন্য কারোর চাওয়ার সাথে তার চাওয়ার মিল নাও হতে পারে। একজনের চোখে যা আঁধার। অন্য আর একজনের চোখে তা দ্যুতিময় আলো।  কাউকে দেখতে দেখতে ভালোলাগে, কাউকে ভালোলাগতে লাগতে ভালোবাসে।  জগতের অনেক ভালোবাসার কাহিনি  এমনই স্বাক্ষ্য দেয়।             

সেদিনও বিকালবেলা রোহিত বাড়ির বারান্দায় বসে রেবেকাকে পড়াচ্ছিল। নিম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বিকালের সোনালী আলো এসে পড়ছিল রেবেকার মুখের উপর। কী অপরূপ লাগছিল ঐ সময়ের তার মুখের দীপ্তি। আঙিনায় দুচোখ মেলে রেবেকা দেখে -- কোথাও কেউ নেই।
এখন যে শুধু কথা বলার সময়।    

যে কথাটি রেবেকা  আজ কয়েকদিন ধরে রোহিতকে বলতে চায় , সেই কথাটি আজ বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে সে। কম্পিত ঠোঁট যেন কেঁপে কেঁপে কিছু বলতে চায় বারবার । মনে হচ্ছে যেন  বহুদূরের কোন পাহাড়ি ঝর্নার মতো অমিয় ফল্গুধারা তার হৃদয় থেকে ঝরে পড়ছে। অদ্ভুত বিস্মরণের সময়!  রেবেকা রোহিতের হাতের উপর তার একটি হাত রেখে দ্বিধাহীন চিত্তে বলে  -- 'আমি তোমাকে ভালোবাসি রোহিত'।  

হঠাৎ বিকালের দীপ্ত আলো যেন ধপ্ করে  নিভে গেল। সেদিনের সন্ধ্যা দ্রুত আঁধার হয়ে গেল। আম গাছের ডালে থেকে একটি কাক কা-কা করে  উড়ে চলে গেল। রোহিতের মুখখানা চকিত বিমর্ষ হয়ে উঠল। এক অমাঙ্গলিক ছায়া পড়ল যেন তার চোখে মুখের উপর ।                

সেদিন আর রোহিত রেবেকাকে পড়াল না।  সে ওর সাথে কোনো কথা না বলে সোজা বাড়ি চলে আসে। বাড়ির সামনে পুকুরের চালায়  একাকী বসে ভাবছিল -- 'এ প্রেম কখনোই পূর্ণ করে পাওয়ার নয়।  এ চাওয়া অসঙ্গত ও অমাঙ্গলিক।  এ ঘটনা গ্রামে  জানাজানি হলে তাদের পরিবারের উপর মহাবিপদ নেমে আসবে।' হাসান মাস্টারের পরিবার গ্রামে দূর্দান্ত প্রতাপশালী। এরা যে কোনো রূপ ক্ষতি করতে পারে। আসন্ন সব বিপদের দৃশ্যগুলো রোহিতের চোখের সামনে ভয়ঙ্কর ছবির মতো ভেসে উঠতে থাকে। এবং সে ভিষণ বিচলিত হয়ে ওঠে।            

সে পরের দিন আবারও রেবেকাকে পড়াতে যায়। 
রেবেকার পড়ায় কোনো মন বসে না।  রোহিত যা পড়ায় তা কোনো কিছুই বুঝে নেয়না।  সে ছিল নির্বিকার। মন ছিল উড়ো উড়ো। রেবেকা আজও আস্তে আস্তে মৃদুস্বরে রোহিতকে বলেছিল -- 'আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।'                                                                              
রোহিতের সাথে রেবেকার এই গোপন সম্পর্ক চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস।  ওরা পড়তে বসে প্রায়ই  চুপিচুপি কথা বলত। কখনও একে অপরের হাত ধরে থাকত। অস্ফুট করে অনেক কথাই বলত দুজনে। এমনই করে দিনে দিনে তারা গভীর মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলে দুজনকে। দুজনেই এক অনিশ্চিত আনন্দে আপ্লূত হয়ে ওঠে। সেদিন বাড়ি আসতে আসতে রোহিত অখ্যাত এক কবির কবিতার এই পংক্তিগুলো আওরাচ্ছিল --

'একদিন তপ্ত দুপুরবেলায় তুমি আগুন পলাশ বনে এসে দাঁড়াবে। রাঙা পলাশের আবীর মাখবে তোমার গালে।  তোমার বুক দুরুদুরু। আমার নামে কাজল দেবে চোখে, আদর মেখে নেবে তোমার ঠোঁটে। জুঁই ফুল দিয়ে তুমি চুলের বিনুনি গাঁথবে, খোঁপায় গুজবে হলুদ গোলাপ।'

প্রতিদিন ওরা দুজন যে হাত ধরাধরি করে, এবং ফিসফিস করে নানান কথা বলে -- ওদের এই ব্যাপারটা রেবেকার মায়ের নজরে পড়ে। সে শুনবার চেষ্টা করে তাদের ভিতর কী কথা হয়। কিন্তু ওরা এত আস্তে কথা বলত যে, কোনো কথাই সে শুনতে পেত না। কিন্তু  সন্দেহ রয়েই যায়। ওদের গতিবিধির উপর আড়াল থেকে সে নজরদারি করতে থাকে। 
                   
একদিন রেবেকাকে পড়াতে এসেছিল রোহিত। রেবেকার মা ঘরের ভিতর থেকে জানালার ফাঁক দিয়ে ওদের  উপর নজর রাখছিল, সে দেখতে পায়, রেবেকা রোহিতের দুই হাতের ভিতর  মুখ লুকিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছে।  কেঁদে কেঁদে বলছে- 'তুমি আমাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাও।  আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাও। আমাক বিয়ে করো, তোমার সাথে ঘর সংসার বাঁধব।' রোহিত নিরব ছিল। এই কথার কোনো জবাব তখন সে দেয়নি। 

রোহিত আজও বাড়িতে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবছিল অনেক কথা। রেবেকাকে সে কী ভাবে বলবে যে -- 'আমার উপর থেকে তোমার এই ভালোলাগা উঠিয়ে নাও। যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো, সে ভালোবাসাও ফিরিয়ে নাও। ধর্ম বিরুদ্ধ এই ভালোবাসা তোমার ধর্মের মানুষেরা কখনোই মেনে নেবে না।'    

রোহিত ও রেবেকার আরও কিছু ঘনিষ্ঠ হওয়ার  দৃশ্য রেবেকার মা কয়েকদিন দেখেছে। প্রায় সময়ই দুজন দুজনকে কাছে টানে। জড়িয়ে ধরে।  হাত ধরে থেকেই পড়াশোনা করে এবং আলাপ চারিতা করে। আর একদিন তো চুম্বনের দৃশ্যও দেখে ফেলে।  ব্যাপারটি তার কাছে ভালো লাগ নাই। সে এই ঘটনাগুলো নিজের ভিতর গোপন রাখতে আর সাহস পায়নি। 

একদিন রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে সব কথা বলে দেয় তার স্বামী হাসান আলী মাস্টারের কাছে। পরের দিন যখন রোহিত রেবেকাকে পড়াতে আসে তখন রোহিতকে হাসান আলী মাস্টার ডেকে বলে দেয় -- ' তোমাকে আর আজ থেকে পড়াতে আসতে হবে না। তুমি আর কোনাদিন আমার বাড়িতে ঢুকবে না। এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। এই গ্রামের ত্রিসীমানায় থাকবে না।'   

হাসান মাস্টার আরও শাসায় -- 'যদি কখনও আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়াও, তাহলে তোমার পরিণতি হবে ভয়াবহ। বুঝতে পেরেছ? কী করব তোমাকে? এবার তুমি চলে যেতে পারো। 

রোহিত নিরবে চলে আসছিল -- পিছনে থেকে হাসান মাস্টার আবারও ডাক দিয়ে রোহিতকে,  এবং বলে-- 'এই ঘটনা তোমার বাবা মা ভাই বোন বা অন্য কেউ কী জানে? 
--- জ্বী, না,  কেউ জানে না। 
--- জানলে আমার মেয়ের বদনামি হবে। তুমি তোমার গীতার কসম খেয়ে বলো -- কাউকে বলবে না এই কথা। কোনো কাক পক্ষীও যেন না জানে। বুঝলে? যদি জানে, তবে এর পরিণতিও হবে ভয়াবহ। 
--- জ্বী,  আমি গীতার কসম খেয়ে বলছি -- 
কেউ জানবে না এ কথা। আমার আপনজন, বন্ধু বান্ধব কেউ না। আমি অঙ্গীকার করে গেলাম। আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে না।           

হাসান আলী মাস্টার তার মেয়ে রেবেকাকে ডেকে বলে -- আজ থেকে তোমার লেখাপড়া বন্ধ।  তুমি আর স্কুলে যেতে পারবে না।  ঘরে থাকবে।  বুঝতে পেরেছ? 
--- জ্বী। 
--- ঐ ছেলের সাথে ভবিষ্যতে কোনোরূপ যদি যোগাযোগ করো তাহলে ওকে আমরা জবাই করে হাড়গোর টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে যমুনায় ভাসিয়ে দিব।  বুঝলে? 
--- জ্বী।                                                                                                             
কয়েকদিন পর একদিন রেবেকা ওর ছোট ভাই রাসেলের মারফতে রোহিতের কাছে একটি পত্র লিখে পাঠায়। পত্রে লেখা ছিল --

কল্যাণীয়েষু, 

বাবা মা আমাকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। লেখাপড়া সব বন্ধ। রোহিত, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি সারাক্ষণ তোমার জন্য অশ্রুপাত করি।  
তুমি কখনই আমার ভালোবাসাকে অমর্যদা করো না।  যে কোনো ভাবে হোক, তুমি আমার জন্য ত্যাগ স্বীকার করিও। তোমাকে যেন এ জীবনে কখনোই না হারাই, সেই ব্যবস্থা করবে।
 
যাই করো, খুব তাড়াতাড়ি করিও।  বাবা মা আমাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোর করছে। পারলে আগামীকাল মধ্যরাতে তুমি আমার সাথে দেখা করবে।  আমি সবার অলক্ষ্যে চুপিচুপি ঘর থেকে বের হবো।  তুমি আমাদের পুকুরপাড়ে লিচু গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আর যদি না যেতে পারি, তবে মনে করবে ঘর থেকে বের হওয়া আমার সম্ভব হয় নাই।        
                  
ইতি --- রেবেকা।     

চিঠিটি পড়ে কী মনে করে ঐদিনই রোহিত  সিরাজগঞ্জ শহরে যেয়ে গোপনে ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। দেখা হলে রেবেকাকে যেন বলতে পারে -- '' আমি এখন মুসলমান। তুমি তোমার বাবাকে বলো, রোহিত মুসলমান হয়েছে। ওর সাথে তোমরা আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও।"    

রোহিতের কাছে মনে হয়েছে এ জগতে ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়।  আর প্রেম হচ্ছে ধর্মের চেয়েও মহোত্তম।  সে বার বার ভাবছিল -- এই বালিকাটি অবুঝ!  তাকে কাঁদানো ঠিক হবে না। তার সরল প্রাণের চাওয়াকে মর্যাদা দেওয়া দরকার। ধর্মে কী এসে যায়। কেউ জানুক না জানুক, আমি জানি -- রেবেকার প্রেমকে মর্যাদা দিতে গিয়ে একটি ননজুডিশিয়াল স্টাম্পের মধ্যে ধর্মকে সীমাবদ্ধ রেখে না হয় স্বাক্ষ্য দিলাম -- আমি মুসলমান। তবুও আমি রেবেকাকে পেতে চাই। তবু্ও এই মেয়েটির চাওয়া পূর্ণ হোক।        

রোহিত তার ধর্মান্তরিত হয়ে যাবার ঘটনাটি আগেই কাউকে বলল না।   
 
একদিন রেবেকা ওর বাবা মাকে এমনই  বলেছিল-''রোহিত যদি মুসলিম হয়ে যায়, তাহলে কী ওর সাথে আমাকে তোমরা বিয়ে দিতে রাজি হবে?' এ কথা শুনে হাসান মাস্টার আরও রেগে গিয়ে বলেছিল -- কোনোক্রমেই না। ঐ মালাউনের সাথে বিয়ে আমি কখনোই  হতে দেব না।' 


সেদিন ছিল কার্তিকের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। ক্রমেই  রাত গভীর হতে থাকে। বাইরে নির্জনতা খাঁ-খা করছে। ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন ধ্বনি স্পষ্টতর হচ্ছে। রেবেকা জেগেই ছিল। চিঠিতে লেখা পূর্ব কথা মতো তাকে বের হতে হবে। সে বিছানা থেকে  উঠে বসে। পাশের রুমে ওর বাবা নাকে শব্দ করে ঘুমাচ্ছে। আর কেউ যে জেগে নেই, এটাও বোঝা গেল। ওর পরনে ছিল সালোয়ার কামিজ। হাতে চুড়ি ছিল না। গলায় নেই মালা। দুই কানে ছোট্ট দুটো কান ফুল পরা ছিল শুধু। সে খালি পায়ে আস্তে আস্তে হেঁটে  গিয়ে দরজার খিল খোলে। বাইরে থেকে পাল্লা  ভেজায়ে  দিয়ে সে উঠোনে চলে আসে।  বাইরে তাকিয়ে দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কোনো মনুষ্যজনের সাড়াশব্দ নেই। হেঁটে হেঁটে সে পুকুর পাড়ের দিকে চলে যায়।  সেখানে দেখতে পায়,  লিচুগাছ তলায় রোহিত দাঁড়িয়ে আছে। 

রেবেকা রোহিতের বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলে-- 'তুমি আমাকে নিয়ে যাও। বাবা মা তোমার সাথে  বিয়েতে রাজি নয়।  তুমি যদি মুসলমানও হয়ে যাও, তারপরেও বিয়ে দেবে না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। তুমি আমাকে বের করে আজ রাতেই নিয়ে যাও। '

রোহিত বলে -- তুমি ছোট মানুষ। বুঝবার চেষ্টা করো। এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব?  আর গেলে আমাদের পরিবারের উপর বিপদ নেমে আসবে।  তুমি একটু ধৈর্য ধরো।  অপেক্ষা করো। 

--- আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। আমাকে খুব শীঘ্রই বিয়ে দিয়ে দেবে। 

-- তুমি আমাকে কটা দিন সময় দাও।  দেখা যাক, কী করা যায়।    
 
-- দেখ কী হয়। আমার খুব ভয় হয়। 

রোহিত ওর মুসলমান হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা রেবেকাকে সেক্ষণে আর বলার প্রয়োজন মনে করল না। 
          
এরপর দুজন হাত ধরে হেঁটে হেঁটে পুকুর পাড়ের দিকে চলে যায়। ওখানে হাস্না হেনা ঝোপের আড়ালে ঘাসের উপর যেয়ে বসে। রেবেকা ওখানেও রোহিতকে বুকে জড়িয়ে অশ্রুপাত করতে থাকে। এবং রুদ্ধবাকে বলতে থাকে -- আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।'      

সেদিন সেই কৃষ্ণপক্ষের রাতে ঘাসের উপরে  
দুটো প্রাণ কতক্ষণ একে অপরকে  জড়িয়ে থেকেছিল, এবং প্রকাশিত করেছিল ভালোবাসা -- তা শুধু জানে শিশির সিক্ত ঘাস আর রাতের আঁধার !  কারণ, আঁধারই যে সেই রাতে নিবিড় করে ওদেরকে ঢেকে রেখেছিল।                                                                 
রেবেকা রোহিতের সাথে  দেখা করে বাড়ি  ফিরে এসে দেখে --  ওর বাবা ও মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।  হাসান মাস্টার রুদ্র মূর্তিতে   রেবেকাকে চরম রাগান্বিত স্বরে  বলে --- কোথায় গিয়েছিলেে? 

-- রোহিতের সাথে দেখা করতে। 

-- এর পরিণতি কী ভয়াবহ হবে, তা তুমি  জানো? 

রেবেকা ত্রস্ত হয়ে  মাথা নিচু করে থাকে।                   

 
এক দিন পরেই রেবেকাদের বাড়িতে ব্রম্মগাছা থেকে ওর এক মামা আসে। তাকে জরুরি ভাবে  খবর দিয়ে আনা হয়। রেবেকার মামাটি ষন্ডা প্রকৃতির। গোপনে সে সর্বহারা পার্টি টার্টি করে। মানুষ গুম ও হত্যা করাই তার কাজ। রেবেকার বাবা বিকালবেলা সেই ষন্ডার কাছে রেবেকার ঘটনাটি খুলে বলে। ষন্ডা বলে -- আজ রাতেই ঐ মালুর বাচ্চাকে খতম করে দেই, ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেই দুলাভাই। 

হাসান মাস্টার বলে -- আমি তো এই জন্যই তোমাকে খবর দিয়ে এনেছি। তুমি একা এই কাজ করতে পারবে? 

ষন্ডা বলছিল -- পাশের গ্রামেই আমার দুজন অনুসারী আছে।  প্রয়োজনে ওদের খবর দিব। ওরা চলে আসবে।

--- ঠিক আছে তাই করো। ঐ মালুর বাচ্চারে আজ রাতেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দাও। ওকে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে যমুনার জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসবে।         

--- আচ্ছা। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে দুলাভাই।  কোনো চিন্তা করবেন না।    

রেবেকা পাশের রুম থেকে তাদের সব শলাপরামর্শ শুনে ফেলে।  আর সেই ক্ষণেই সে একটি চিরকুট  লিখে ওর ছোট ভাইয়ের মারফতে রোহিতের কাছে পাঠয়ে দেয়।
  
প্রিয় পাঠকগণ আপনারা ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছেন -- রোহিত এই হরিনা গোপাল গ্রাম ছেড়ে ততক্ষণে অজানা গন্তব্যের পথে ঘর হতে বেরিয়ে পড়েছে।                                                                                 


                                 
                                                                                                              

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন