সোমবার, ২২ জুন, ২০২০

পরিচ্ছেদ ৩

প্রায় পয়ত্রিশ বছর পর রোহিত তার গ্রামের বাড়ি হরিনা গোপালে আজ ফিরে যাচ্ছে। যেদিন  সে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা এসেছিল -- সেদিন রাতে বয়রা ঘাটে ভাসমান প্লাটফর্মের রেলিংয়ের কাছে  দাঁড়িয়ে জলের ধ্বনি শুনেছিল। ভেবেছিল সে -- 'জীবনের কী এক অমূল্য সম্পদই না পিছনে রেখে এলাম। যে সম্পদ কোনো দামেই কোথাও থেকে কিনতে পারব না।'  জীবনের প্রতি  সে ঘৃণাও করছিল-- এ কেমন কাপুরুষের মতো সব ফেলে চলে যাচ্ছে সে কোন্ অচেনা ভূবনে।

সেদিন তার একবার মনে হয়েছিল সে আবার ফিরে যাবে হরিনা গোপাল গ্রামে , কিন্তু পরক্ষণেই ছেলেমানুষের মতো কী এক চির অভিমান হয় তার নিজের প্রতি। চরম ঘৃণাও  হয় ধর্মের প্রতি, এবং সমাজের নিয়মনীতির প্রতি। চিত্ত তার অস্থির হয়ে উঠছিল। 

যমুনা বক্ষে সেদিনের সেই হেমন্তের রাত্রিটি ছিল কোনো এক ব্যর্থ প্রেয়সীর চোখের নীচে মলিন দাগের মতো বিষণ্নতার। দূরে কোনো বন নিবিড়ে ত্রস্ত কোনো হরিণ চোখ তুলে যেন ঘাতক শিকারীকে বলছে -- এই জীবন তুমি কেড়ে  নিও না। আমি বাঁচতে চাই। আমি রয়ে যেতে চাই অপূর্ব সুন্দর এই সবুজ অরণ্যে।    

ভোরে শের আফগান  জাহাজটি বয়রা ঘাট থেকে ছেড়ে এসেছিল। যমুনার জল ভেঙে ভেঙে  জাহাজটি ভেঁপু বাজিয়ে একসময় জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে গিয়ে ভেড়ে। রোহিত আস্তে আস্তে জাহাজের সোপান বেয়ে নীচে নেমে আসে। সে দেখতে পেয়েছিল ঢাকা যাওয়ার একটি ট্রেন স্টেশনে  অপেক্ষা করছে। 

রোহিত বাসের ভিতর বহু বছর আগের তার গৃহ ত্যাগের কথা ভাবছিল।  হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসে তার। সে দেখতে পায় -- সে এখন সিরাজগঞ্জগামী একটি এক্সপ্রেস বাসের ভিতরে বসে আছে।  বাসটি  মির্জাপুর অতিক্রম করছিল।  

পাশে এমন কেউ নেই যে তার সাথে দুদন্ড কথা বলে সময় পার করবে। কেমন যেন ঘুম ঘুম লাগছিল চোখে।  সে সামনের সিটে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করে।  কিন্তু ঘুমও আসছিল না।  তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে কী সব ভাবছিল। সেই সূদুর অতীতের সব কথা -- 'কোথায় সেই ভাঁটফুল, ভেরেন্ডার পাপড়ি, আকন্দের ঝোপঝাড়। কোথায় হিজলের বন, মহুয়া মাতাল নদীর কূল। যে নারীকে নদী মনে করত, সেই একদিন ধর্ম অন্ধতার কবলে পড়ে হারিয়ে গেল। 

সে যেন দিনের অস্তবেলায় আবার ফিরে যাচ্ছে নক্সী কাঁথার পথ ধরে সেইখানে,  যেখানে অসংখ্য দূর্বাঘাসের উপর অপরাহ্ণের রোদ্দুর পড়ে আছে। সব ঘাস পায়ে মারিয়ে হেঁটে হেঁটে সে চলে যাবে নদীর কাছে। সেখানে যেয়ে বলবে -- ' আজ তোমার কাছে থেকে কিছুই নেব না, আজ সব ফিরিয়ে দিতে এসেছি।' 

যখন চাঁদ উঠবে, যখন রাতের আঁধার ফুঁড়ে জ্বলে  উঠবে থোকা থোকা তারা, তখন ফিরে আসবে সে জীবনের উপত্যকায়। জ্যোৎস্নায় নেশাচ্ছন্ন নগ্ন পায়ে নেমে পড়বে মৃত্যু নদীর জলে। আর উঠবে না। তখন কেউই একাকী কূলে দাঁড়িয়ে খুঁজবে না তাকে শীর্ণা নদীর জলে।'

বাসের জানালার গ্লাস উঠিয়ে রোহিত দেখেছিল গ্রাম। কত সুন্দর সুন্দর সুন্দর মানুষ, কত রূপ অপরূপ মুখ। এখনও মনে রেখেছে সে এখন হেমন্ত কাল। মাঠে মাঠে  পাকা ধান।  বাতাসে কাঁচা পাকা ধানের গন্ধ ভাসছে। রোহিত সেই গন্ধ নিচ্ছিল প্রাণ ভরে।  
                                            
বাসটি একসময় যমুনার খুব কাছাকাছি চলে আসে। ধূঁধূ বালির প্রান্তর আর কাশবন দেখলেই মনে হয় কাছেই নদী আছে।  কত বছর ধরে যমুনার জল দেখা হয় না।  তার শুধু মনে 
পড়ছিল -- ঢাকায় যাবার বেলায় সেই রাতের কথা। স্টিমারের ডেকের বেঞ্চের উপর সে যখন বসেছিল, কী এক অন্তর বেদনায় হিম হয়ে আসছিল সারা শরীর। অনেক দূর থেকে গুমরে গুমরে কার যেন কান্নার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল। চোখের  ভিতর জল ছপ ছপ করছিল। সে জল সেদিন যেন করুণ ধারায় বৃষ্টি  হয়ে ঝরে  পড়েছিল।

বাসটি একসময় যমুনা সেতু অতিক্রম করছিল।  সে জানালা দিয়ে দেখছিল দুইপাশের নদীর রূপ। হায়!  এই সেই উত্তাল ভরা যমুনা?  বিশাল বিশাল চর জেগে উঠেছে নদীর মধ্যখানে। কাশবন দেখতে ভালো লাগলেও ভরা যমুনা দেখার জন্য এতদিন সে অপেক্ষা করেছিল। তা আর দেখা হলো না। এই নদী দেখে তার প্রাণ কাঁদতে থাকে।   

তারপর,  একসময় বাসটি তার শৈশবের নিজ 
শহর সিরাজগঞ্জ প্রবেশ করে। বুকের ভিতর কেমন শিহরণ জেগে উঠল।  বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকতে কত মনে পড়েছে  এই শহরকে। কত উন্মন মন আকুল হয়েছে এই শহরটিকে দেখবার জন্য। লক্ষী সিনেমা হলে সে প্রথম সিনেমা দেখেছিল ফতেহ লোহানীর 'আসিয়া' ছবিটি। কী অমিত বিস্ময়ে দেখেছিল ছবিটি। শহরের ইলিয়ট ব্রীজের কাছে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখত সে থাম্বা বিহীন ব্রিজ। সবই এখন স্মৃতি, সবই নস্টালজিক।   

রেল স্টেশনের কাছেই বাস স্ট্যান্ড। ওখানেই সে বাস থেকে  নেমে পড়ে। ছোট বেলার চেনা শহর তার কাছে আজ অচেনা লাগছে। কত মানুষ হাঁটছে পথের উপর দিয়ে, একজনও চেনা মানুষ কোথাও দেখতে পেল না । স্টেশনের কাছে একটি হোটেলে সে ভাত খেয়ে নেয়। তারপর পায়ে প্যাডেল টানা একটি রিকশায় করে  হরিনা গোপাল গ্রামের দিকে রওনা হয়।                                                
 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন