বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৭

ধূসর চিতোরের পদ্মিনী

( ঘটনাকাল ১৩০৩ সাল। দিল্লীর মসনদে আসীন তূর্কি বংশোদ্ভূত খিলজী বংশের দ্বিতীয় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী। এই কাহিনীর কতোটা মিথ এবং কতোটা সত্য তা আজ আর নির্নয় করা সম্ভব নয়। ইতিহাস বলে আলাউদ্দিনের চিতোরগড় দূর্গ দখলকালীন সময়ে ঘটনাটি ঘটেছিল, তা তাঁর দরবারের ইতিহাসবিদ এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমির খসরুর লেখনিতে আছে।এই কাহিনী যারা কল্প কাব্যের চেয়ে বেশী কিছু বলে মনে করেন না, তারা দাবী করেন যে রানী পদ্মিনীর অস্তিত্বের কথা ইতিহাস স্বীকৃত নয়। আবার এই তত্ত্বও পুরো তথ্যভিত্তিক নয়।রাজপূত ইতিহাসে পদ্মিনীর নাম  আছে এটাই ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। )

”হিন্দুস্তানে এক ফুল ফুটেছিল- তার দোসর নেই, জুড়ি নেই!”
কী কুক্ষণে পিয়ারী বেগমের বাঁদীর এই গান কানে গিয়েছিলো বাদশা আলাউদ্দিন খিলজির, কে জানে! গানটা তাঁর ভাল লেগে গিয়েছিলো। সঙ্গে গেঁথে গিয়েছিলো মাথায় গানের কথাগুলো- ”কার সাধ্য সে রাজার বাগিচায় সে ফুল তোলে!”
না কি কথাগুলো ঘা দিয়েছিল তাঁর অহং-এ?
বোধ হয় দ্বিতীয়টাই হবে! শুধুমাত্র রূপে পাগল হয়ে পদ্মিনীকে পেতে চাওয়া এবং ব্যর্থ হলে চিতোরগড় ছারখার করে দেওয়া- প্রেম এতটাও বিধ্বংসী হতে পারে না। বিধ্বংসী হয় কেবল মোহ, অচরিতার্থ কামনা।
আলাউদ্দিন খিলজির সেই অচরিতার্থ কামনার আগুনে যেমন পুড়েছিলো চিতোরগড়, তেমনই গড়ের নারীরাও! কাহিনী বলে, রানী পদ্মিনীর সঙ্গে বারো হাজার নারী বরণ করে নিয়েছিলেন আগুনের দুঃসহ তাপ। জহরব্রত করে আত্মসম্মান রক্ষা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু, তাঁদের আত্মা গড় ছেড়ে কোথাও যায়নি! কোথাও যাননি রানী পদ্মিনীও!

শুনতে অবাক লাগলেও চিতোরগড় বরাবরই রহস্যে মোড়া! মানুষে যেখানে যেতে পারে না, সেখান থেকে বার বার অনেকেই ঘোরাফেরা করেছেন চিতোরগড়ে। তাঁদের কেউ বা দেবী, কেউ বা অভিশপ্ত প্রেতিনী!
সেই আবির্ভাব প্রথম ঘটেছিল যুদ্ধের সময়ে। আলাউদ্দিন খিলজি পণ করেই এসেছেন, চিতোরকে জনশূন্য করে পদ্মিনীকে তিনি বন্দিনী করে রাখবেন হারেমে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তখন বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে গড়। এমন সময়েই ঘটে সেই অলৌকিক কাণ্ড!
'হঠাৎ পায়ের তলায় মেঝের পাথরগুলো যেন কেঁপে উঠলো; তারপর মহারানী অনেকখানি ফুলের গন্ধ আর অনেক নূপূরের ঝিন-ঝিন শব্দ পেলেন। কারা যেন অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে! মহারানী বলে উঠলেন, কে তোমরা? কি চাও? চারিদিকে-দেওয়ালের ভিতর থেকে ছাদের উপর থেকে, পায়ের নিচে থেকে শব্দ উঠল- ম্যায় ভুখা হুঁ!'


রাণা লক্ষ্মণসিংহকে যিনি দেখা দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন চিতোরের কুলদেবী উবরদেবী! তবে, পদ্মিনীর স্বামী খোদ রাণা ভীমসিংহর মন থেকে সন্দেহ যায়নি। রাজপুত বীরেরা যখন যুদ্ধে যাচ্ছেন, তখন আবার দেখা দিয়েছিল সেই মূর্তি। ভীমসিংহের মনে হয়েছিল, তিনি দেবী না পদ্মিনী?
রাণার যা-ই মনে হোক, যুদ্ধের খবর কিন্তু খারাপই আসতে থাকে গড়ে। নিজের জলমহলে বসে শোনেন পদ্মিনী কেবল তাঁকে রক্ষার জন্য হাসিমুখে প্রাণ দিচ্ছে রাজপুতানা! অবশেষে যখন তিনি বুঝতে পারেন, আর আশা নেই, তখন তৈরি হন।
”চিতোরের মহাশ্মশানের মধ্যস্থলে চিতোরেশ্বরীর মন্দিরে বারো-হাজার রাজপুত সুন্দরীর জহর-ব্রত আরম্ভ হলো। বারো হাজার রাজপুতের মেয়ে সেই অগ্নিকুণ্ডের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগলো- লাজ হরণ! তাপবারণ! হঠাৎ একসময় মহা কল্লোলে চারিদিকে পরিপূর্ণ করে হাজার-হাজার আগুনের শিখা মহা আনন্দে সেই সুড়ঙ্গের মুখে ছুটে এলো। প্রচণ্ড আলোয় রাত্রির অন্ধকার টলমল করে উঠলো। বারো হাজার রাজপুতানীর সঙ্গে রানী পদ্মিনী অগ্নি-কুণ্ডে ঝাঁপ দিলেন- চিতোরের সমস্ত ঘরের সোনামুখ, মিষ্টি কথা আর মধুর হাসি নিয়ে এক-নিমেষে চিতার আগুনে ছাই হয়ে গেলো।”


কিন্তু, কোথাও গেলো না! তারা অশরীরে, সবার অলক্ষ্যে থেকে গেলো চিতোরেই!
আজও রাত নামলে চিতোরগড়ে সেই বারো হাজার রমণীর বিলাপের শব্দ শোনা যায়। তাঁরা কেঁদে কেঁদে অপমানের প্রতিকার চান !


বিশ্বাস না হলেও অনেকে চিতোরগড়ে দেখা পেয়েছেন রানী পদ্মিনীরও! রাজকীয় পোশাকে, অপূর্ব অলঙ্কারে শোভিতা এক নারী মাঝে মাঝেই দেখা দেন। ঠিক যেমনটা দেখেছিলেন রাণা ভীমসিংহ আর লক্ষ্মণসিংহ।কিন্তু,বর্তমান সময়ে যাঁরা দেখেছেন,চোখে পড়েছে সেই রমণীর মুখ আগুনে ঝলসানো! সেই রূপ সহ্য করা যায় না! পদ্মিনীর এই মর্মান্তিক দগ্ধ রূপ দেখেই অনেকে ভয়ে প্রাণত্যাগ করেছেন।
তাই রাত নামলে কেউ চিতোরগড়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখান না। যে রূপ একসময়ে বিনাশ ডেকে এনেছিল চিতোরের, সেই রূপের দগ্ধাবশেষেই চিতোরকে রক্ষা করতে চান পদ্মিনী! কাহিনী এমনটাই বলে! তাই তাঁর প্রতি সম্মান করেই  রাত নামলে এখনো কেউ ঐ চিতোর গড়ের দিকে যায় না।

তথ্যসূত্রঃ
২। Legend-Of-Alauddin-Khilji-And-Rani-Padmavati
৩। ancientales.wordpress.com
৪। chittorgarh.com/rani-padmini.
৫। Songbadprotidin
উদ্ধৃতি : অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রাজকাহিনী' থেকে।


                                                                                                                 



                                                                                                                                         

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন