মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭

অমৃতা

কোনো এক বসন্ত বিকেলে চন্দ্রিমা উদ্যানের সবুজ ঘাসে বসে আমি আর অমৃতা দু'জন হাতে হাত রেখে প্রতিশ্রুতি করেছিলাম, আমরা এ জীবনে অন্য কাউকে বিয়ে করবোনা। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে অমৃতা মৃত্যুর ওপারে চলে যেয়ে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। সে আর বিয়ে করেনি। অমৃতার মৃত্যুর পর তার কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে মায়ের অনেক পিড়াপিড়ীতে শেষ পর্যন্ত আমি বিয়ে করলাম।

আমি তখন বনবিভাগে চাকুরী করি। পোস্টিং ছিলো গাজীপুর রেঞ্জে।শ্রীপুর থানা সদরের অদূরে বাংলো টাইপের এক বাড়ীতে আমি থাকি এবং সেখানেই নতুন বউ জেসমিনকে নিয়ে ঘরে তুলি। জেসমিন জানতোনা অমৃতা নামে কাউকে আমি ভালোবাসতাম। বিয়ের আগে একটা জেদ করেছিলাম,বউকে বেশী ভালোবাসবোনা; তাকে খেয়াল করবোনা ,তাকে সময় দিবোনা কিন্তু সে জেদ আর করতে পারিনি। আস্তে আস্তে আমি জেসমিনকে ভালোবাসতে থাকি।

জেসমিন যখন স্নান সেরে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে থাকে , তখন আমি ওকে দেখি। ও যখন কালো এলো চুল সামনে এনে আছড়াতে থাকে, তখন ওকে আমি দেখি। রান্না করতে যেয়ে টুকটুকে গালে কালি লাগিয়ে যখন আমার সামনে এসে দাড়ায়, তখন আমি ওকে দেখি। ও যখন ঘুমিয়ে থাকে আমার পাশে, ওর স্বপ্ন মুখ আমি তখন দেখি।জেসমিনকে দেখতে দেখতে ওর প্রতি আমার অূসম্ভব মায়া জন্মাতে থাকে।

একদিন ছুটির দিনে জেসমিনকে নিয়ে পাশেই বালু নদীর তীরে বেড়াতে যাই। একটি রিক্সা নিয়ে আধা পাকা পথ পেড়িয়ে, কিছু মেঠো পথ পায়ে হেটে আমরা নদীর কূলে চলে যাই। ওখানে তীরে বসে দেখি বালুর নদীর শান্ত জল। দেখি পানকৌঁড়ি আর বকদের জলের উপর ঘোরাঘুরি। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পশ্চিম আকাশের লাল আভা জেসমিনের মুখের উপর এসে পড়ে। ঠিক এমনি এক মোহনীয় ক্ষণে অমৃতাকে একবার দেখেছিলাম বুড়িগঙ্গার পারে। সেই রক্তিম মুখ ,সেই স্বর্ণাভ ললাট, সেই সৌম্য মুখখানি দেখতে পেলাম আজ জেসমিনের মুখোয়বে।

সেদিন ছিলো বৃষ্টির দিন। বাংলোর বারান্দায় দুজন বসে আছি। শালবনের ঝোপে ঝারে অনবরত বৃষ্টি ঝরছে। টিনের চালে ঝুমঝুম করে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। বারান্দার চাল থেকে গড়িয়ে পড়া জল ধরছিলো জেসমিন। এ যেনো শ্রাবণ মেঘ মল্লার দিন। মন আঁধার করে নামছে সন্ধ্যা। নির্জন সেই মায়াবী ক্ষণে আমাদের ছিলো অনেক চাওয়ার আকুলতা। গুনগুন করে জেসমিন গাচ্ছিলো- আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে, জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগেনা।' এমনি এক বৃষ্টিমুখর দিনে অমৃতার কন্ঠে শুুনেছিলাম এই গান।

রাতে বিছানায় শুয়ে আছি। আমার দুহাত জেসমিনের বাহুতে বাঁধা। দেখলাম ওর খুব মন খাারাপ। কথা বলতে চাইছেনা। ডাকি আদর করে, চুপ হয়ে থাকে সে। টানতে চাই বুকের খাঁজে,আসতে চায়না। কানের কাছে যেয়ে কানে কানে ওকে বলি-' কি হয়েছে তোমার ?' অভিমান ভেঙ্গে জেসমিন বলে- সন্ধ্যায় বারান্দায় বৃষ্টির সময়ে তুমি আমাকে 'মিত্রা' বলে ডেকেছিলে কেন ?' আমি বললাম- 'তুমি একটা পাগলি মেয়ে। আমিতো আদর করে তোমাকে 'মিত্রা' ডেকেছিলাম।' অবাক হই, আমি যে কখন জেসমিনকে 'মিত্রা' বলে ডেকেছিলাম,এ কথা আমার মনেই পড়ছেনা।

দিনগুলি চলছে ভালো করেই,সময়গুলি কাটছে ভালোবেসে। সেদিন ছিলো হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। বাংলোর সামনে পুকুরপাড়ে ঘাসে দু'জন বসে আছি। জেসমিন পড়েছিলো সাদা শাড়ি। শুভ্র জ্যোৎস্নার বিমুগ্ধ স্রোতে জেসমিন মিশে গিয়েছিলো। ওর গোলাপি গাল হয়ে উঠেছিলো সাদা,খয়েরী ঠোঁট হয়ে উঠেছিলো নীল, কালো চুল হয়ে গেলো সোনালী। পুকুরপাড়ের হাস্নাহেনার সুবাস এসে ভরে উঠছিলো জেসমিনের বুকে। আমি তখন কাছে টানি অমৃতাকে। ওকে বলি- চলো মিত্রা, কেউ যাক বা না যাক, আজ এই জ্যোৎস্না রাতে তুমি আর আমি যাবো শালবনে।' এতো ভালোবাসা ওকে ঢেলে দিলাম সেইখানে, তারপরেও জেসমিন সে রাতে ঘরে এসে বিছানায় মুখ গুজে কেঁদেছিলো।

আমি জেসমিনের কাছে ক্রমেই আমার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলাম। ওকে যতো বেশী ভালোবেসে কাছে টানছিলাম, ঠিক ততো বেশী ওর ভিতর অমৃতা সিনড্রোমে আমাকে পেয়ে বসতে থাকে। যা কিছু পুরোনো প্রেম তা প্রকাশিত হচ্ছে অজ্ঞাতসারে,কখনো ঘুমের ঘোরে, কখনো স্বপ্নে,কখনো জাগরণে,কখনো বিহব্বলতায় জেসমিনকে 'অমৃতা' 'মিত্রা' বলতে থাকি। এতে করে জেসমিন কতো যে কষ্ট পেয়েছে, কতো যে গোপনে গোপনে কেঁদেছে.এ খবর আমি কখনো রাখি নাই।

অফিসে সেদিন ঢাকা থেকে অডিট টীম এসেছিলো। তাই বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। জেসমিনকে দেখলাম,তাঁতের সবুজ রঙ্গের শাড়ি পড়ে আছে। এই শাড়িটি পড়েছিলো বিয়ের দ্বিতীয় দিনের সকালবেলায়। মুখে ওর বিষাদের হাসি। শরীরটা খুব ক্লান্ত ছিলো আমার। আমি দু'মূঠো খেয়ে শুয়ে পড়ি। চোখে দুনিয়ার ঘুম জড়িয়ে আসছে।

মিত্রা বলছিলো- আমি তোমাকে মনে হয় ভালোবাসা দিতে পারি নাই।'
আমি বলি-  কি যে বলো তুমি মিত্রা ! সেই কতোকাল ধরে তুমি আমাকে ভালোবাসিতেছো ! বুড়িগঙ্গার পাড়ে কতো  সন্ধ্যা কেটেছে,কতো বিমুগ্ধ তারার রাত কেটেছে আমাদের মিত্রা, তুমি কি ভুলে গেছো সেই সব গভীর চুম্বনের কথা ? ভুলে কি গেছো সেই সব প্রগাঢ় আলিঙ্গনের কথা ? '  
          
তারপর ঘুমের ঘোরে বলেছিলাম হয়তো আরো অনেক কথা। কোনো কথা মনে করতে পারছিনা।জেসমিন বলেছিলো- 'তোমার পুরানো ট্রাংক খুলে অমৃতার লেখা সব চিঠি আমি আজ পড়েছি।' তারপর আরো কি বলেছিলো অমৃতা মনে নেই। আমি গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে যাই।

সকালবেলা বাইরে অনেক মানুষের কথার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায়। জেগে দেখি পাশে জেসমিন নেই। পুকুরপাড়ে অনেক মানুষের ভীড়। সবাই দেখছে- একটি মেয়ে উবু হয়ে পুকুরের জলে ভাসছে।

তারপর ঐ বাংলোতে একাকী বেশী দিন আমি থাকতে পারিনি। হেড অফিসে অনুরোধ করে বদলীর আদেশ নেই। যেদিন চলে আসবো, সেদিন সকালবেলা পুকুরপাড়ে জলের কাছে গিয়ে দাড়াই। জলে দেখতে পাই জেসমিনের মুখ। ওকে বলি- অমৃতা মৃত ছিলো,সে তুমি জানতেনা।তার জন্য এতো বড়ো অভিমান ! তোমরা দু'জনেই একই রকম।আমাকে একা করে রেখে দু'জনেই চলে গেলে।'

                  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন