রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৭

জিপসি ছেলে

তখন ইউনিভার্টিতে পড়ি। থাকতাম কবি জসিম উদ্দীন হলে। আমার বড়ো বোনের চিকিৎসা চলছিলো পিজি হাসপাতালে।  যে কয়দিন আপা হাসপাতালে ছিলো প্রতিদিন সন্ধ্যায়  চলে যেতাম তাকে দেখতে। আমার মাথায় নজরুলের ইসলামের মতো ঝাঁকরা চুল। হাতে পড়তাম পিতলের ব্রেসলেট। গায়ে থাকতো বুক খোলা টি-সার্ট, আর পরনে থাকতো কাউবয় মার্কা জিন্স প্যান্ট। আপার পাশের কেবিনে এক ভদ্রমহিলার চিকিৎসা চলছিলো। ওনার একটি টিনেজ মেয়ে ছিলো  ,সে  প্রায়ই আসতো হাসপাতালে। ঐ মেয়েকে আমি চেয়ে দেখতাম, কিন্তু কথা বলতাম না। আবার ওর সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা করতো। একদিন হাসপাতালের কোরিডরে একাকী দাড়িয়ে আছি। মেয়েটি হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করে- আপনারা কি খ্রীষ্টান ?
আমি :  না
মেয়ে :  তাহলে কি ?
আমি:  সুন্নী মুসলমান। আমার বাবার নাম মৌলভী..............।
মেয়ে:   আপনাকে দেখে খ্রীষ্টান মনে হয়।
আমি:   তাই নাকি ?
মেয়ে :  হু।

সন্ধ্যার পর হলে চলে আসি। সখ করে তখন একটু আধটু কবিতা লিখতাম। আর আমার যে বয়স সে বয়সে মানুষ প্রেমের কবিতা লিখে থাকে। সে প্রেমে পড়লেও লেখে, প্রেমে না পড়লেও লেখে। জুনিয়র রুমমেট সাহিদ বলছিলো- আপনাকে আজ বেশ খুশী খুশী লাগছে ।কবিতার খাতায় লিখলাম-

আমিতো তোমাকে আজ দেখলাম মেয়ে,
পরীবাগের খোলা আকাশের দিক থেকে এসেছিলো বাতাস,
হাওয়ায় দুলছিলো তোমার চুল,
কাজল ছিলোনা চোখে, বাঁকা হয়ে যাওয়া ভ্রু ছিলো তোমার সুচিত্রা সেনের মতো,
ইশারা কি ছিলো সেই ভ্রুতে- আমি বুঝি নাই তা-
কামিজের ভাজে ঢাকা ছিলো সব নদীর বাঁক
মেয়ে তোমার চোখে মুগ্ধতা ছিলো, পরানের নীচে ছিলো কেবলই ঘাস ।


পরের দিনও দেখা হয় ঐ মেয়ের সাথে। পাখীর পাখার মতো উড়ছে তার ওড়না। মাথার চুল পিছনে ব্যানড দিয়ে বাঁধা। পায়ে সেমি হিল জুতো। খট্ খট্ করে হাটছে হাসপাতালের করিডোরে।  আমি তার চরণ ধ্বনি শুনি।  সে শোনে এলিফ্যান্ট রোডের গাড়ীর হর্ণ। আমি অপেক্ষা করছি তার জন্য, দাড়িয়ে আছি কোরিডোরে একাকী।  চোখ একবার তাকালো দূরে বেতার ভবনের দিকে। তরঙ্গে ভেসে এলো রুনা লায়লার সেই গান- 'অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে,যেনো এক মুঠো রোদ্দুর,আমার দু'চোখ ভরে তুমি এলে।' হঠাৎ পাশে থেকে সে মেয়ের কন্ঠস্বর শোনা গেলো-

মেয়ে :  কেমন আছেন ?
আমি : ভালো আছি। 
মেয়ে:  আপনি কোথায় পড়েন ? কি পড়েন ?
আমি:  ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, বাংলা সাহিত্যে।
মেয়ে:  আপনাকে দেখে মনে হয় ইংরেজীতে পড়েন।
আমি:  কেনো মনে হলো ?
মেয়ে:  হিপ্পি হিপ্পি চুল, ছেঁড়া জিন্স, ম্যাগি হাতা গেঞ্জি পড়েন, তাই মনে হলো।
আমি:  আপনি কোথায় পড়েন ,কি পড়েন ?
মেয়ে: ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার, ইডেন কলেজে।
আমি: নাম কি আপনার ?
মেয়ে:  জিনিয়া
জিনিয়া আমার নামটিও জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়।


রূমে এসে রাত জেগে খাতার পাতায় লিখলাম হিবিজিবি কথা-

তোমার চোখে দেখলাম অসীম দৃস্টি এক, চেয়ে দেখো অন্তর গভীরে
উড়ে চিল ডানা মেলে, নিঃসীম নীল মেঘের উপর দিয়ে
তোমার চঞ্চল ডানা মেলতে চায় তারও উপর দিয়ে
আফ্রোদিতির মতো প্রেম বুকে নিয়ে ডাক দাও আমাকে-
আমি সানাইওয়ালাদের খবর দিবো,
পাল্কি নিয়ে চলে যাবো তোমার রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাড়ী।

আজ আগে ভাগেই দেখা পাই জিনিয়ার। একাকী দাড়িয়ে আছে কোরিডোরে, মনে হলো আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। দু'জন দাড়িয়ে কথা বলছিলাম। আমি যখন কথা বলি,তখন দেখি- আমাকে দেখতে দেখতে জিনিয়ার চোখ উদাসীন হয়।  ও কি ভাবছিলো আমি তা জানিনা।  আবার জিনিয়া যখন কথা বলে আমি তখন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি,  দেখতে পাই- নীল সমুদ্রপাড়ে, সাগরের ঢেউ আছড়িয়ে পড়ছে বালুকাবেলায়।  সাদা শাড়ী পড়ে ধবল আঁচল উড়িয়ে জিনিয়া আসছে আমারই দিকে।  দূর থেকে আস্তে আস্তে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরছে বুকে।

আমরা দু'জন 'মৌলি'র দোতালায় গিয়ে বসি। ওখানে কিছু স্নাকস্ জাতীয় খাবার খাই। কথা বলতে বলতে ভালোবাসার কোনো কথাই বলা হলোনা। বলা হলোনা- 'তোমাকে আমার ভালোলাগে', বলতে পারলামনা- 'জিনিয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি।'  জিনিয়াও কিছু বললোনা।  মৌলি থেকে যখন উঠবো- তখন ও বলছিলো-  'তুমি কবি জসীম উদ্দীন হলের কতো নাম্বার রুমে থাকো ?'  আমি বললাম- '৪২৬ নং রুমে।'  জিনিয়া যেনো ভুলে না যায়- ,তাই ওর হাতের তালুতে নম্বরটি লিখে দেই।

রাতে বিছানায় শুয়ে আছি।  কেমন যেনো এক মুগ্ধতায় দু'চোখে ঘূম আসছিলোনা।  মানুষের যেমন দুঃখের কারনে চোখে ঘুম আসেনা। আবার অনেক সময় অনাবিল সুখের ভাবনাতেও ঘুম আসেনা।  মনে হচ্ছিলো অচেনা অজানা এক মেয়ের দেখা পেলাম,  তাকে ভালোও লাগলো,  হয়তো এই মেয়ে আমার বউ হয়ে ঘরে আসবে একদিন।  বিছানা থেকে উঠে কবিতার খাতায় লিখছিলাম-

তোমার ঐ মায়াবী চোখ আমাকে টানে
তোমার লাবন্যের মুখ আমাকে বের করে নিয়ে যায়
মখমলের চাদর বিছানো মসৃন পথে-
তুমি কোনো স্বপ্ন নও, আমি জানালা খুলে দেখি শাহবাগের আকাশ,
এতো তারা কখনো এক সাথে দেখিনি
এতো গানের সুর কখনো একসাথে বাতাসে ভাসেনি।

পরের দিন হলুদ রঙ্গের একটি টি-সার্ট গায়ো দিলাম। গাঢ় নীল রঙ্গের একটি জিন্স প্যান্ট পড়লাম। খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো রয়েই গেলো। আয়নায় ঘুরে ফিরে দেখলাম নিজের মুখ খানি। আজ জিনিয়াকে মৌলিতে ডেকে নিয়ে যে করেই বলবো- 'তোমাকে ভালোবাসি।'

সন্ধ্যায় হাসপাতালে যাই। আজ কোরিডোরে কাউকে দাড়ানো দেখলাম না। আপার কেবিনে যেয়ে শুনি- পাশের কেবিনের ঐ মহিলা রোগীটি আজ সকালে রিলিজ নিয়ে চলে গেছে। বুকের ভিতর কেমন যেনো হাহাকার করে উঠলো।  আমি আজ আর বেশীক্ষণ দেরী করলামনা।  হাসপাতালের শূন্য কোরিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে হলে ফিরে চলে আসি।

তারপর কতো দুপুর কতো বিকেল অপেক্ষা করেছি জিনিয়ার একটি চিঠির জন্য।  তারো অনেক পরে একটি বিদেশী নীল খামের চিঠি পাই।  প্রেরক- জিনিয়া নাওসীন, নিউ ইয়র্ক, ইউ এস এ ।  চিঠিটির কিছু অংশ এই রকম ছিলো- ''তোমাকে অনেক দিন ধরে লিখবো লিখবো করে লেখা হয়না।  তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছিলো,  কিন্তু আমি একজনের বাগদত্তা ছিলাম।  তাই তোমাকে বলতে পারিনি- 'ভালোবাসি'।....এখানে প্রায়ই আমার স্বামীর হাত ধরে হাডসন নদীর তীরে বেড়াতে যাই,  সেখানে দেখতে পাই বড়ো বড়ো চুলের জিপসি ছেলে হলুদ রঙ্গের টি-সার্ট গায়ে দিয়ে,  ছেঁড়া জীন্স পড়ে হাডসন নদীর তীরে ঘুরে বেড়াতে।  তখনই মনে হয় এমনই একজন জিপসি ছেলেকে আমি দেখে এসেছিলাম পিজি হাসপাতালের বারান্দায়।''

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন