শনিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৭

নর্তকী জরিনা

সম্রাট আকবর তখন ফতেপুর সিক্রিতে থাকতেন। একদিন তিনি তার কাছে আসা অতিথীদের জন্যে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তিনি গায়ক তানসেনকে ডাকেন সেই অনুষ্ঠানে গান গাইতে। সম্রাট তানসেনকে বললেন, আপনার গানের সাথে সেখানে কাউকে নাচতেও হবে। তানসেন বললেন, আচ্ছা। আমি চেষ্টা করবো নর্তকী রাখতে কিন্তু আমি এখানে কোনো নর্তকীকে চিনি না। দাসীদের মধ্য থেকে কেউ একজন সম্রাট আর তানসেনের এই আলাপ শুনেছিলেন। সম্রাট চলে গেলে সেই দাসী তানসেনকে গিয়ে জরিনার কথা বললেন, এবং পরামর্শ দিলেন তানসেন যাতে জরিনাকে নাচার জন্য প্রস্তাব দেয়। যখন তানসেনের মতো বিখ্যাত গায়ক জরিনাকে সম্রাট আকবরের প্রাসাদে নাচার জন্য প্রস্তাব দিলেন তখন জরিনার বাবা আর না করতে পারলেন না।

জরিনা ফতেপুর সিক্রিতে চলে আাসার সময় বাবার কাছে বিদায় নিতে যান।বাবা জরিনাকে পরামর্শ দিলেন- একটা ব্যাপার মাথায় রাখবে, যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে বিপদও আছে। সাবধানে থাকবে, আর মনে রাখবে তোমার জন্য আমি সবসময়ই আছি। জরিনা প্রাসাদে গিয়ে আকবর এবং তার সভাসদদের সামনে সারারাত নাচলেন। জরিনার কাছে এটা ছিল স্বপ্ন সত্যি হওয়ার ব্যাপার। সম্রাট জরিনাকে এতো পছন্দ করলেন যে তিনি জরিনাকে প্রাসাদে রেখে দিলেন যাতে প্রয়োজন হলে তাকে ডাকতে পারেন। 

প্রাসাদের সবাই জরিনাকে পছন্দ করলেও রানী যোধা বাঈয়ের একজন দাসী জরিনাকে পছন্দ করলো না। সম্রাটের কাছ থেকে জরিনা বেশী মনোযোগ পাওয়ার কারণে মাধবী জরিনার প্রতি ঈর্ষাকাতর ছিলো। জরিনা যেন সম্রাটের চোখে অপরাধী হয় সেজন্য একটা বুদ্ধি বের করে মাধবী। রানী যোধা বাঈ যখন স্নান করছিলেন তখন মাধবী তার গয়নার বাক্স থেকে একটি সোনার বালা চুরি করে জরিনার জিনিসপত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। যোধা বাঈ যখন দেখে যে তার একটি বালা নেই তখন তিনি মারাত্মক ক্রোধান্বিত হয়ে সারা প্রাসাদ তল্লাশি করার নির্দেশ দিলেন। মাধবী তখন রানী যোধা বাঈকে বলে, আমি জরিনার ঘরে সেই বালাটি দেখেছি। বালাটি যখন জরিনার ঘরে পাওয়া গেলো যোধা বাঈ তখন রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি সম্রাট আকবরের কাছে গিয়ে নালিশ দিলেন,বললেন নর্তকী জরিনা একটা চোর। এই ব্যাপারে আপনি কী করবেন এখন? 

জরিনা তখন আকবরের সামনে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হুজুর, আমি বালা চুরি করিনি। সম্রাট আকবর তখন বললেন, তোমার ঘরে বালা কিভাবে পাওয়া গেলো সেই ব্যাখ্যা কি তুমি দিতে পারবে? স্বাভাবিকভাবেই জরিনার তখন বলার কিছু ছিলোনা। সে জানতোনা বালা কিভাবে তার ঘরে গেলো। সম্রাট মাথা নেড়ে বললেন, প্রমাণ যেহেতু দেখাই যাচ্ছে, জরিনা চোর এবং মিথ্যুক। চুরি করার শাস্তি হিসেবে হাত কেটে দেওয়া হবে। জরিনা তখন বলেন- হুজুর, আমি একজন নর্তকী। আমার হাত কেটে ফেললে আমি নাচবো কীভাবে?  তাছাড়া আমি চুরি করিনি। সম্রাট আকবর চিৎকার করে উঠলেন, চুপ ! আগামীকাল সকালে তোমাকে শাস্তি দেওয়াই হবে প্রথম কাজ। সম্রাট আকবর এরপর দরবার ত্যাগ করলেন।

জরিনা সারাদিন কাঁদলেন। রাতে জরিনা অন্যান্য দিনের মতই সম্রাটের সামনে নাচলেন। কিন্তু এটা আনন্দের নাচ ছিলোনা, এটা ছিলো খুবই ধীরগতির দুঃখের একটি নাচ। আকবরের সভাসদদের কেউই এতো সুন্দর নাচ জীবনে দেখেনি। তার নাচ আর দেখতে পারবেন না ভেবে আকবরও খুব দুঃখ পেলেন। 

পরের দিন সকালে আকবর তার সকল সভাসদদের ডাকলেন। তিনি একজন রক্ষীকে পাঠালেন জরিনাকে নিয়ে আসার জন্য। সারা প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও জরিনাকে পাওয়া গেলোনা। সে এসে সম্রাটকে এ কথা জানালো। সম্রাট আকবর জিজ্ঞাসা করলেন, কেউ কি জরিনাকে দেখেছে? সভায় উপস্থিত সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।

 তখন সভায় এক বৃদ্ধ লোক প্রবেশ করেন। সিংহাসনে বসা সম্রাট আকবরের সামনে গিয়ে তিনি বললেন, হুজুর, কোনো প্রমাণ ছাড়াই জরিনাকে অভিযুক্ত করে আপনি ভুল করেছেন। আকবর জরিনার বাবাকে চিনতে পারলেন। তিনি বললেন, জরিনা কোথায় আমাকে বলুন, আমি দেখবো তার সাথে যাতে ন্যায়বিচার ঘটে। জরিনার বাবা মাথা নেড়ে বললেন, অনেক দেরী করে ফেলেছেন আপনি। আর কিছুই করা যাবে না। আপনি আমার মেয়ের জীবনে অনেক দুঃখ এনে দিয়েছেন, আর ফতেহপুর সিক্রি অবশ্যই এই বেঈমানির শাস্তি পাবে। বৃদ্ধ লোকটির এই কথার অর্থ কী আকবর তা জিজ্ঞাসা করার আগেই সেই লোকটি ভিড়ের মধ্যে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

দুই সপ্তাহ পরে ফতেহপুর সিক্রির কুয়াগুলি শুকিয়ে গেলো। সম্রাটের উট ও ঘোড়ার জন্য এবং মানুষের জন্য কোনো পানি আর কুয়াগুলিতে অবশিষ্ট ছিলো না। সম্রাট আকবর তার স্ত্রীদের ও সন্তানদের নিয়ে আগ্রার দুর্গে গিয়ে উঠলেন। তারা আর কখনোই ফতেহপুরে ফিরে আসেননি। 

সিক্রি গ্রামে এই গল্প এখনো প্রচলিত আছে। গ্রামের কেউ কেউ বলে যে পূর্নিমা রাতে ফতেহপুর সিক্রির প্রধান ফটক, বুলন্দ দরজাতে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা বলে যে এটা আসলে মাধবী, সে জরিনার জন্য অপেক্ষা করে যাতে তার কাছে ক্ষমা চাইতে পারে।

তথ্যসূত্র : 1,The Hindu: Akbar's folly  2. quora.com 3. Natunsomoy.                                                                                               . 
                                                                                               

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন