বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭

শিউলী কথা

বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পরীক্ষার পরপরেই তূলানামুলক ভাষাতত্বের উপর উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য ক্যালেফোর্নিয়ার লস এ্যাঞ্জেলেসের একটি ইউনিভার্সিটি থেকে দুই বৎসরের স্কলারশীপ পাই । সব ফর্মালিটিস্ কমপ্লিট করতে সপ্তাহ খানেক সময় লেগে যায়। হাতে বেশী সময় ছিলোনা। তিন দিন পরেই ফ্লাইট। আমার এই সুখবরটি শুনে যিনি সবচেয়ে বেশী খুশী হবেন তিনি আমার এক স্কুলের শিক্ষক জনাব মোঃ ইদ্রিস আলী। যার বাড়ীতে নন্ পেয়িং হিসাবে আমি  পাঁচ বছর ছিলাম।

আমার এই শিক্ষক মহোদয়কে এই সুসংবাদ ও তার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য সকালের ট্রেনেই চলে আসি জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে। সেখান থেকে যমুনার কূল ধরে হেটে হেটে আড়াই মাইল দূরে উল্লা নামে একটি গ্রামে চলে যাই। নদীর পাড় ঘেসেই মাস্টার মশাইয়ের বাড়ী। পথে আসছিলাম আর ভাবছিলাম, এই মাষ্টার মশাই ছাড়া এ জগতে আমার আর কেউ নেই। আমি যখন এখানে পৌঁছি, তখন বিকাল হয়ে যায়। বাড়ী পৌঁছে মাষ্টার মশাইকে সব কথা বললাম। এও বললাম কাল প্রত্যুষেই আমি চলে যাবো।

এখানে নদী কূলে একাকী কতো মময় কাটিয়েছি। ভাটির স্রোতের টানে মাঝি মাল্লারদের কতো গান শুনেছি। যমুনার জলে কতো যে গা ভিজিয়েছি। এই বাড়ীর পূর্ব পাশে দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে যমুনা নদী। খুব ইচ্ছা হলো, আরেকবার সব ঘুরে ঘুরে  দেখতে। সারা বিকেল একাকী নদীর কুল ধরে হাটলাম। নির্জন নদীর পাড়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম অনেক কথা, মাস্টার মশাইয়ের কথা, ওনার স্ত্রীর কথা, তাদের কিশোরী মেয়ে শিউলীর কথা। আমি যখন প্রথম এই বাড়ীতে আসি। তখন শিউলীর বয়স ছিলো নয় দশ বছর। এখন চৌদ্দ পনরো হবে। অস্টম ক্লাশ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। আমাকে এই বালিকা আনেক সেবা করেছে। অনেক যত্ন সহকারে খাবার খেতে দিয়েছে। আমার কাপড়চোপড় পরিস্কার করে দিয়েছে। অসুখের সময়ও সেবা করেছে। জ্বর আসলে মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছে।

নদীর কূল থেকে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে মাস্টার মশাইয়ের কাছে বসে কথা বলছিলাম- উনি বলছিলো-  ''আমার শরীরটা ভালো যাইতেছেনা। কোনো ঔষুধ পত্র কাজে আসিতেছেনা। যে কোনো সময় ইহলোক ত্যাগ করিতে পারি। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো শিউলীর সহিত তোমাকে বিবাহ দিতে। তুমি কাল প্রত্যুষে চলিয়া যাইবে। তুমি যদি রাজি হও, তাহা হইলে আজ রাতেই তোমাদের বিবাহের ব্যবস্থা করিতাম।'

এই পরিবারের কাছে,এই মাস্টার মশাইয়ের কাছে আমার অনেক ঋন আছে। এরা আমার মতো একজন অনাথকে অনেক স্নেহ করেছে। আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। নিজেরা কষ্ট করে আমার লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছে। আমি বেশী কিছু ভাবলাম না। বললাম- বিবাহের ব্যবস্থা করেন।


মেয়েটির গায়ে কোনো হলুদ দেওয়া হলোনা। দূর্বা চন্দন ভিজিয়ে গোসল করানো হলোনা। নতুন কোনো শাড়ি পরানো হলোনা। হাতে মেহেদী দিলোনা। মুখে কেউ আলপনা আঁকলোনা, পায়ে আলতা মেখে দিলোনা। বুকে লাগানো হলোনা কোনো সুগন্ধী। আমারও তাই। কোনো শেরোয়ানী পড়লামনা। পাঞ্জাবীও পড়লামনা। সানাই বাজলোনা। মসজিদের মৌলভী সাহেবকে ডেকে এনে ইসলামী নিয়মে আমাদের বিবাহ পড়ানো হলো।

সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিলোনা। তারাগুলি জ্বলছিলো নিষ্প্রভ হয়ে। রাতের যমুনায় কুলুকুলু শব্দ হচ্ছিলো।  বাইরে ছিলো ঝিঁঝিঁ পোকাদের গান। নিরব নিস্তব্ধ রাত্রি যেনো চাপা কান্নায় গুমরিয়ে কাঁদছিলো। দেখলাম শিউলী ওর মায়ের পুরানো একটি শাড়ী পড়ে চৌকির এক কোনে ঘোমটা টেনে বসে আছে। ভাবলাম, কাল প্রত্যুষেই চলে যাবো। এই সরলা বালিকাকে আজ রাতের বঞ্চনায় রেখে লাভ কি ? কাছে যেয়ে বললাম-

আমি:  তুমি কি খুশী ?
শিউলী:  হে।
আমি : কাল সকালে চলে যাবো।কষ্ট পাবেনা ?
শিউলী : হে।
আমি:  আমাকে মনে রাখবে না ?

দেখি শিউলী অঝোর ধারায় কাঁদছে। ঘোমটা খুলে ওর মুখখানি দেখলাম। কেরোসিনের শিখার আলো এসে পড়েছে। এর আগেও এই বালিকাকে অনেক দেখেছি। আজ মনে হচ্ছে চন্দ্রালোকের যতো মোহনীয় মাধূর্য এই মেয়ের মুখে লেগে আছে। ওর চোখে জল, তারপরেও আলপনাহীন মুখখানি হিরন্ময় লাগছিলো। ওকে বুকে টেনে নেই। সকালবেলা যখন বিদায় নিচ্ছিলাম তখন শিউলী বলেছিলো - 'আপনি আমাকে ভুলে যাবেন না।'



থাই এয়ারওয়েজের বিমানটি লস এ্যাঞ্জেলেসের লাক্স এয়ারপোর্টে অবতরণ করে। আমার থাকার ব্যবস্থা ছিলো গ্রামের্সি প্লেসের একটি হোস্টেলে।এয়ারপোর্ট থেকে একটি ট্যাক্সী নিয়ে চলে যাই সেখানে। অচেনা শহর,কোনো সজ্জন নেই। পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে রিপোর্ট করি। ঠিক তৃতীয় দিনে ওয়েস্টার্ন বেলভিউতে রোড ক্রসিংএর সময় একটি লরি আমাকে প্রচন্ডভাবে  ধাক্কা দেয়। যখন আমার  জ্ঞান ফেরে দেখি একটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। শুনেছি আমি নাকি একমাস অজ্ঞান ছিলাম। বেশ স্মৃতিভ্রম হয়ে গিয়েছিলো। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়। বাম পায়ের হাড় ভেঙ্গে যায়।

হাসপাতালে আমাকে একটানা এক বৎসর  চিকিৎসা নিতে হয়েছে। আমার স্কলারশীপ প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে যায়। হাসপাতালে মেক্সিক্যান বংশোদ্ভূত এক নার্স আমাকে নিবিড়ভাবে সেবা করে। সে ছিলো পঞ্চাশোর্ধ এক বিধবা মহিলা, নাম রেবেকা উইন্টার। যেদিন আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়, এই রেবেকা উইন্টারই তার বাসায় নিয়ে যায়। সে আমাকে তার বাসায় রেখে সেবা করে। আমাকে ক্রাচে ভর করে হাটতে হতো। রেবেকা তার সারা জীবনের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ আমার চিকিৎসার পিছনে খরচ করে।


আমার পুরোপুরি স্মূতি ফিরে পেতে তিন বছর লেগে যায়। আসার পর থেকে বাংলাদেশের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারি নাই। আমি ভুলেই গেছি মাস্টারমশাইয়ের কথা, শিউলীর কথা। এরই মধ্য একদিন গীর্জায় গিয়ে খ্রীষ্ট ধর্ম মোতাবেক রেবেকাকে বিয়ে করি। এই ভাবেই পনেরো বছর চলে যায়। রেবেকা একসময় ইহলোক ত্যাগ করেন। নিজেকে নিঃস্ব ও একাকী লাগছিলো। ভাবলাম, আর কার জন্য  এদেশে থাকবো ?  আমি দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই।

ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমে কেমন যেনো উদাস লাগছিলো। এই শহরে একজন আপন মানুষ নেই যে সেখানে গিয়ে উঠবো। পল্টনে একটি  হোটেলে যেয়ে উঠি। ভাবলাম কাল সকালবেলাতেই মাস্টার মশাইয়ের ওখানে চলে যাবো। ট্রেন চলছে জগন্নাথগঞ্জের ঘাটের দিকে। কামড়ার মধ্যে বসে ভাবছিলাম- শিউলী কি আমার কথা মনে রেখেছে ? শিউলী কি আমার জন্য অপেক্ষা করছে ? শিউলী কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে ?'  ট্রেন  জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যেয়ে থামে। যমুনার কূল ধরে হাটতে হাটতে উল্লা গ্রামের দিকে চলতে থাকি। তখন বিকাল হয়ে গিয়েছে। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ীর আঙ্গিনায় পৌছতেই দেখি কাঁঠাল গাছের তলায় একটি বালিকা দু'টি ছাগল ছানাকে কাঠালপাতা খাওয়াচ্ছে। পরনে তার সালোয়ার কামিজ। দেখতে একদম শিউলীর মতো। আমাকে দেখে বালিকা থমকে দাড়িয়ে যায়। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম- সেই শিউলীর চোখ, শিউলীর চুল, শিউলীর নাক, সেই চাহুনী, সেই রকমই মুখের মায়া ! ভাবছিলাম, শিউলীকে যে রুপ রেখে গিয়েছিলাম,সেই রুপেই আছে।


তারপরেও মনে হলো- এ মেয়ে শিউলী নয়। আমি কাছে যেয়ে বলি-' তোমার নাম কি ? মেয়েটি বলে- 'রূপালী'। বলি -'তোমার মায়ের নাম কি ?' ও বলে- 'শিউলী বেগম।' আমার চোখ ছলো ছলো হয়ে ওঠে। ওকে বলি- 'তোমার বাবার নাম কি ?' রূপালী তখন আমার নাম বলে। রূপালীকে বলি-'তোমার মা কোথায় ?' বাড়ীর ভিটার পিয়ারা গাছের তলা দেখিয়ে বলে- 'ঐখানে মাটির নীচে শুয়ে আছে।'

আমাদের কথাগুলো শুনছিলো বারান্দায় বসে থাকা এক অন্ধ বৃদ্ধা। উনি মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী। সে আমার কন্ঠ শুনে চিনতে পারে। রূপালীকে ডেকে বলে - 'রূপা, তুই চিনতে পারছিস না ? উনি তোর বাবা।'

আমি রূপালীকে বলি- 'মামনি আমার হাত ধরো, চলো ঐ পিয়ারা গাছের তলায়। আমরা তোমার মায়ের জন্য প্রার্থনা করি।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন